ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অন্যতম বিপ্লবী জ্ঞানচন্দ্র মজুমদারের আজ ৫৩তম প্রয়াণ দিবস।
জ্ঞানচন্দ্র মজুমদার ১৮৮৯ সালে তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমার বারহাট্টা উপজেলার রায়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অনুশীলন সমিতির নেতা ছিলেন তিনি। অনুশীলন সমিতিতে তিনিই বিধিবদ্ধ শপথ গ্রহণ করে সর্বপ্রথম সদস্য হন।
১৯০৬ সালে এন্ট্রাস পাস করার পর ঢাকা কলেজে পড়ার সময় অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা পি. মিত্রের সংশ্রবে আসেন জ্ঞানচন্দ্র। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত সমিতির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।
বিপ্লবের মধ্যে থেকেও তিনি ১৯১০ সালে বিএসসি পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে এমএসসি পড়ার সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের দৃষ্টিতে পড়েন জ্ঞানচন্দ্র। পরে পুলিশি তৎপরতায় তার পড়া শেষ হওয়ার আগেই ১৯১৬ সালে আটক হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯১৯ সালে ছাড়া পেয়ে কংগ্রেস আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। এ সময় ময়মনসিংহ জেলায় কংগ্রেস সংগঠন গড়ে তুলে বহু বছর তার সম্পাদক এবং পরে সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। ১৯২৫-৩০ সালে তিনি বাংলার প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
১৯৩৮ সনে জ্ঞানচন্দ্র তদানীন্তন কংগ্রেস হাই কমান্ডের বিপক্ষে গিয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। জীবনের ২৬ বছর তাকে ব্রিটিশ রাজের কারাগারে বন্দি থাকতে হয়।
দেশ বিভাগের পর ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানে বাস করেন। এ সময় তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।
মহান এই বিপ্লবী ১৯৭০ সালের ৩রা অক্টোবর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
নাচে গানে আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ১২৪তম বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জিতে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী এ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান খাসিয়া ভাষায় ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ (Khasi Seng Kutsnem) অনুষ্ঠিত হয়।
খাসিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবে সিলেট অঞ্চলের প্রায় অর্ধশত খাসিয়া পুঞ্জির প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে সকল পুঞ্জি প্রধানকে পাগরী পড়িয়ে সম্মাননা জানানো হয় এবং আমনত্রীত অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়।
জানা যায়, সেং কুটস্নেম বা বর্ষ বিদায় খাসিয়াদের একটি সার্বজনীন উৎসব। প্রাচীন খাসিয়া সমাজে দেবতার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশের মধ্য দিয়েই এ উৎসব পালিত হতো। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া পুঞ্জির খেলার মাঠে নানা সমাহারে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।
মাগুরছড়া ফুটবল মাঠের একপ্রান্তে বাঁশের খুঁটির ওপর প্রাকৃতিক পরিবেশে নারিকেল গাছের পাতার দিয়ে ছাউনী দিয়ে আলোচনা সভার মঞ্চ তৈরি করা হয়। এ মঞ্চে বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি প্রধান জিডিসন প্রধান সুচিয়াংয়ের সভাপতিত্বে ও লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জি প্রধান ফিলা পত্মীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন, কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ সঞ্জয় চক্রবর্তী, বাংলাদেশ মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ প্রমুখ।
বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে খাসিয়ারা তাদের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে আদি পাহাড়ি নৃত্য ও গান করেন। পাশাপাশি তাদের জীবিকার প্রধান উৎসব জুম চাষ এবং জীবন-জীবিকার বিভিন্ন পদ্ধতি নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন। উৎসব উপলক্ষে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন এ সময়।
সেং কুটস্নেম উৎসবের দিনব্যাপী সবাই মিলে মাছ শিকার, ঐতিহ্যগত খেলাধুলা, ঐতিহ্যগত পোষাক পরিধান, সাংস্কৃতিক পরিবেশনাসহ ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে আনন্দ করে নিজেদের সামাজিক সম্পর্কে সুদৃঢ় করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
কই বসে এ মেলা
সেং কুটস্নেম উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মাগুরছড়া পুঞ্জির মাঠে বসে ঐতিহ্যগত মেলা। মেলায় খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসেন বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে। বিভিন্ন স্টলে খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, পান, তীর, ধনুকসহ বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়। খাসিয়া তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি, বাংলাদেশে খাসিয়াদের প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা ও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বর্ষ বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
খাসিয়া সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালি ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকরা অংশগ্রহণ করেন। বর্ষপুঞ্জি অনুযায়ী ১২৪তম বর্ষকে বিদায় ও ১২৫তম বর্ষকে বরণ করে নিলেন খাসিয়া জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ২৩ নভেম্বর খাসি বর্ষ বিদায় ‘খাসি সেঙ কুটস্যাম’ পালন করা হয়। ২৪ নভেম্বর শুক্রবার থেকে শুরু হবে খাসি বর্ষ বরণ।
আলাপকালে লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জি প্রধান ফিলা পত্মী জানান, সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা এবং খাসিয়া জনগোষ্ঠীর বর্ণিল সংস্কৃতির সৌরভ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার আহ্বান নিয়ে ঐতিহ্যবাহী ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ উৎসব পালিত হয়।
আরও পড়ুন:বাগেরহাটে হযরত খান জাহান (র.) এর মাজারের দিঘিতে থাকা ‘মাদ্রাজি’ নামে পরিচিত ( খাদেমরা এ নামে ডাকে) পুরুষ কুমিরটি মারা গেছে।
মাজারের দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় বৃহস্পতিবার বিকালে কুমিরটির মরদেহ ভাসতে দেখেন স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, উপজেলা প্রশাসন, মাজার কর্তৃপক্ষ ও খাদেমসহ দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন দিঘীর ঘাটে।
সন্ধ্যায় দিঘির উত্তর পাড়ে মৃত কুমিরটিকে তোলা হয়। কুমিরটির মৃত্যুর কারণ জানতে ময়না তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন খুলনা বিভাগীয় প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. লুৎফর রহমান।
তিনি বলেন, ‘কুমিরটি প্রায় তিন বছর আগে দুইবার অসুস্থ হয়। তখন দিঘী থেকে উঠিয়ে কুমিরটিকে ১৫ দিন চিকিৎসা দেয়া হয়েছিলো। সে সময় নিউরোলজিকাল ও নার্ভে কিছু সমস্যা ধরা পরলেও চিকিৎসায় কুমিরটি প্রায় সুস্থ্ হয়ে গিয়েছিলো। আমরা প্রাথমিক ভাবে ধারণা করছি ওই অসুস্থতার কারণেই কুমিরটির মৃত্যু হয়েছে। তবে ময়নাতদন্ত করা হলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
কুমিরটিকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন মাজারের খাদেমরা। কোনো অসৎ উদ্দেশ্যেই কুমিরটিকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা তাদের।
খ্রিষ্টীয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে নিজের শাসনামলে হযরত খানজাহান (র.) মিঠা পানি সংরক্ষণের জন্য ‘খাঞ্জেলি’ দিঘিতে ‘কালাপাহাড়’ ও ‘ধলাপাহাড়’ নামে দুটি কুমির ছাড়েন। সেই থেকে কুমির এই মাজারের ঐতিহ্য।
এখানকার কুমির দেখতে দেশ-বিদেশের হাজারো দর্শণার্থী আসেন বাগেরহাটে। ২০১৫ সালে ৫ ফেব্রয়ারী ঐতিহ্যবাহী হয়রত খান জাহান (র.) এর মাজারের দিঘির শতবর্ষী কুমিরের শেষ বংশধর ‘ধলা পাহাড়’ মারা যায়। এরপর ভারতের চেন্নাই (সাবেক মাদ্রাজ) ক্রোকোডাইল ব্যাংক থেকে দুটি কুমির এনে ছাড়া হয় মাজারে।
নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার জবই বিল। বিলের দুই পাড়ে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজারও মানুষের ঢল। থেমে থেমে হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে নদীর চারপাশ।
বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর মাঝি-মাল্লাদের কণ্ঠের কোরাস ‘হেইও রে, হেইও’ শোনা যাচ্ছে একটু পর পর। একেকটি নৌকা ছুটে চললেই হর্ষধ্বনি দিয়ে দলগুলোকে উৎসাহিত করছেন দর্শকরা।
এভাবেই আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে উদযাপিত হলো ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতা।
স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের আয়জনে হয় এই নৌকাবাইচ। এতে অংশ নেয় নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আশেপাশের ছোট-বড় ৮টি নৌকা।
নৌকাবাইচের এমন আয়োজন দেখতে গিয়ে দেখা যায়, আয়োজন উপভোগ করতে তিব্র রোদ ও গরম উপেক্ষা করে দুপুরের পর থেকেই ভির জমতে শুরু করে জবই বিলের চারপাশে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জবই বিলের মাহিল প্রান্ত থেকে নৌকাবাইচ শুরু হয়ে মাছ চত্বর এলাকায় শেষ হয়।
নৌকাবাইচের দূরত্ব ছিল প্রায় ১ কিলোমিটার। এ সময় বিলের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার দুই পাশে মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল দেখার মতো। নৌকাবাইচ দেখতে আসা দর্শনার্থীদের আনন্দ-উল্লাসে মুখরিত হয়ে ছিল বিলের চারপাশ।
এ সময় প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন নৌকাবাইচ দেখতে আসা দর্শনার্থীর।
দর্শনার্থী মমিন হোসেন বলেন, ‘বাইচ দেখতে আমি দুপুর ২টার মধ্যে এখানে এসেছি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শুরু হয়েছে নৌকাবাইচ। বাইচ দেখে খুব আনন্দ পেয়েছি।’
প্রতি বছর এমন আয়োজন করার আহ্বান জানিয়ে দর্শনার্থী রিনা খাতুন বলেন, ‘আমার জীবনে প্রথম নৌকাবাইচ দেখতে এসেছি। নৌকাবাইচ দেখে দারুণ আনন্দ পেয়েছি।’
নওগাঁ শহর থেকে নৌকাবাইচ দেখতে আসা সুমন আলী বলেন, ‘ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে নৌকাবাইচ উৎসবের কথা জেনে এখানে এসেছি বন্ধুদের সঙ্গে। এসে খুব ভালো লাগছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নৌকাবাইচ এখন বিলুপ্তির পথে, আশা করছি এখানে অন্তত এ ঐতিহ্য ধরে রাখবেন স্থানীয়রা।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘জবই বিল কেন্দ্রীক পর্যটন বিকাশে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিনিয়ত বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এরই একটি অংশ জবই বিলে নৌকাবাইচ। এই প্রতিযোগীতা আয়োজন করায় আবহমান বাংলার চিরায়ত চিত্র ধরে রাখার পাশাপাশি পর্যটকদের কাছে জবই বিল আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে বলে আশা করছি। এতে স্থানীয়দের জীবন জীবিকায় পরিবর্তন আসবে যদি আমরা এর মান বজায় রেখে এ ধারা বজায় রাখতে পারি।’
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘আবহমান গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ধরে রাখতে ও জবই বিলের ইতিহাস-ঐতিহ্যর ধারা বজায় রাখার একটি অংশ এই নৌকাবাইচ। নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়দের মাঝে যেন প্রাণ ফিরে আসে।’
আগামীতে আরও বড় পরিসরে এই ধরনের আয়োজন করা হবে বলে জানান এ মন্ত্রী।
আরও পড়ুন:জাম্বিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন একটি কাঠের শিল্পকর্ম আবিষ্কার করেছেন যা প্রায় অর্ধ মিলিয়ন (পাঁচ লাখ) বছর পুরানো বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিএনএনের খবরে বলা হয়, জাম্বিয়ার একটি নদীর তীরে পাওয়া ওই শিল্পকর্মটি সাধারণ কাঠামোর কাঠের ওপর তৈরি। দুটি কাঠের লগ দিয়ে জোড়া লাগানো ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে শিল্পীর হাতের কাজ।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের অ্যাবেরিস্টউইথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পৃথিবী বিজ্ঞানের অধ্যাপক জিওফ ডুলার বলেন, ‘আধা মিলিয়ন বছর ধরে শিল্পকর্মটি যে স্থানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। সবচেয়ে অসাধারণ বিষয় এই যে, সেটি এখনও অক্ষত রয়েছে।’
২০১৯ সালে যে দলটি এ শিল্পকর্ম আবিষ্কার করে তার সদস্য ছিলেন অধ্যাপক জিওফ ডুলার।
প্রস্তর যুগের মানুষ যে যাযাবর ছিলেন, সে ধারণাটিকে নতুন আবিষ্কৃত এ শিল্পকর্মটি চ্যালেঞ্জ করছে বলে জানান ডুলার।
এর আগে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন কাঠের শিল্প নিদর্শনটি (চরা এবং শিকারের জন্য কাঠের সরঞ্জাম) প্রায় ৪,০০,০০০ বছর আগের বলে দাবি গবেষকদের। আর সবচেয়ে পুরানো কাঠের শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিত যে শিল্পকর্মটি (পালিশ করা তক্তার পুরানো টুকরো ), তা প্রায় ৭,৮০,০০০ বছর পুরনো বলে দাবি গবেষকদের।
আরও পড়ুন:চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ খোঁজার লক্ষ্যে খনন কাজ শুরু হচ্ছে। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে এ খনন কাজের শুরু হবে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ষোড়শ শতকের দিকে বিলুপ্ত হওয়া পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্প্রতি দেয়াঙ পাহাড় পরিদর্শন করেন একাধিক প্রতিনিধিদল। তারই ধারাবাহিকতায় খনন কাজ পরিচালনার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বৃহস্পতিবার কর্ণফুলীর ইউএনও মামুনুর রশীদের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে উপস্থিত ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পীযূশ কুমার চৌধুরী, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক ড. আতাউর রহমান, ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান শাহীন আলম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা সহকারী নিয়াজ মাগদুম ও সার্ভেয়ার চাই থোয়াই মারমা।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে’র নির্দেশনা অনুসারে ১৬ সেপ্টেম্বর পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষের খোঁজে খনন ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করা হবে।’
কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়ের বিশ্বমুড়া নামক স্থান থেকে খননকাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন:পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় যা বর্তমানে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। খিস্ট্রীয় অষ্টম শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গের তথা বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা।
এটি মূলত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তৎকালীন সময়ে যা পূর্ববঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতো।
পাল সম্রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পণ্ডিত বিহারে কিছুদিন অবস্থান ও অধ্যয়ন করেছিলেন বলে জানা যায়।
পণ্ডিতবিহারে অধ্যাপকেরা তাদের অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসরে যেসব গান-দোহা রচনা করেছিলেন তা-ই পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পণ্ডিত বিহারের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত থাকলেও গবেষণায় উঠে এসেছে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ঝিওরি, হাজীগাঁও, বটতলী, কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ও জুলধা এলাকাজুড়ে সপ্তম-অষ্টম শতকে পণ্ডিত বিহার নামে একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
আনোয়ারার হাজীগাঁও থেকে ৬৬টি পিতলের বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া গেলে ওই স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কে প্রমাণ নিশ্চিত করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন পটিয়ার চক্রশালার ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ। তার হিন্দু জীবনের যোগ সাধনসঙ্গিনী তিল পিষে জীবনধারণ করতেন বলে তিনি তিলপাদ নাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর প্রজ্ঞাভদ্র নাম গ্রহণ করেন ও পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন।
মগধের প্রধান আচার্য নরতোপা পণ্ডিত বিহারে প্রজ্ঞাভদ্রের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে লুই পা, শবর পা, লাড় পা, অবধূত পা, অমোঘনাথ, ধর্মশ্রী, মৈন, বুদ্ধজ্ঞান পা, অনঙ্গবজ্র প্রমুখ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এবং পণ্ডিতগণ পরিদর্শক হিসেবে কিংবা অধ্যাপক হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
গবেষকদের অনুমান, বিভিন্ন বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ এই বিহারে সমবেত হয়েছিলেন বলে পণ্ডিত বিহার নামকরণ হয়েছিল।
পণ্ডিত বিহারের বিলুপ্ত হওয়ার কারণ বা সময়কাল সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি।
১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সেনাপতি কদলখাঁ গাজী চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানীদের বিতাড়িত করেন ও চট্টগ্রামকে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনের আওতায় নিয়ে আসেন।
১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিল বাংলার স্বাধীন সুলতান ও আফগান শাসনভুক্ত। ধারণা করা হয়, ওই সময়ই পণ্ডিত বিহারের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
সর্বশেষ ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি মোঘল যোদ্ধারা চাটিগাঁ দুর্গ দখল করে মগদের বিতাড়িত করেন। যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দরশহর দেয়াঙ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কালের বিবর্তনে পণ্ডিত বিহারের বিলুপ্তি ঘটে বলেই বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়।
ঐতিহাসিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষক ড. জিনবোধি ভিক্ষুর নেতৃত্বে একদল শিক্ষা অন্বেষক।
২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড় অঞ্চলে পণ্ডিত বিহারের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলেই গড়ে উঠবে এ বিশ্ববিদ্যালয়।
চলতি বছরের ২ আগস্ট আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের পাশাপাশি জাদুঘর স্থাপনের নিমিত্তে জায়গা পরিদর্শন করে গিয়েছে দেশি-বিদেশি পরিদর্শক দল।
তারা কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়ের বিশ্বমুড়া নামক স্থান ঘুরে দেখেন। সেসময় বিশ্বমুড়া আরাকান রাজা রাজ বিক্রমের বাড়ি ছিল বলে জানান তারা।
পরিদর্শন দলে ছিলেন পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যেক্তা ড. জিনবোধি ভিক্ষু, বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন নাগরিক উদ্যেগের সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল যাত্রা, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান, জাপানি নৃতাত্তিক হেনরি হিরোশে ও হিরোকো হিরোশে।
এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুনুর রশীদ।
শনিবার আবারও পরিদর্শক দল আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়ে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়েরর জন্য নির্ধারিত ৫০ একর জমি পরিদর্শন করে এসেছেন।
এদিন দুপুরে তারা উপজেলার বটতলী মৌজার ওই স্থানটি পরিদর্শন করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন আনোয়ারার ইউএনও মো. ইশতিয়াক ইমন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বশির আহমেদ, বান্দরবান বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রভাষক সুমদত্ত বড়ুয়া, সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী আশিক আরেফিন ও মো. রাসেল প্রমুখ।
ঐতিহাসিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জিনবোধি ভিক্ষু বলেন, ‘বাংলা ভাষার হারিয়ে যাওয়া আদি চর্যাপদের স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন বাংলার বিদ্যাপীঠ পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃস্থাপিত করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আমাদের সঙ্গে কাজ করছে একটি গবেষক দল। এটি পুনঃস্থাপিত হলে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের শিক্ষার মানচিত্র বদলে যাবে।’
পণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন নাগরিক উদ্যেগের সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল যাত্রা বলেন, ‘অষ্টম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সক্রিয় ছিল। এটা কীভাবে ধ্বংস হলো, তা তুলে আনার চেষ্টা করছি।
‘২০১২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাশ হয়। চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুমোদন হয়েছে। এর পরও এটি কেন থেমে আছে, তা বোধগম্য নয়। আপনারা জানেন, ইতোমধ্যে জায়গা অধিগ্রহণ হয়ে গিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে গবেষক দলের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও তৎপরতা প্রয়োজন।’
সবার আশা, শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সিদ্ধান্ত পেয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে প্রতিষ্ঠিত হবে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়। আর এটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম পাবে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এতে ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস। সেইসঙ্গে বদলে যাবে এ জনপদের চালচিত্র।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য