× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বাংলাদেশ
The sword of rumors has been cut on the necks of small ethnic groups
google_news print-icon
রাউজানে শিবলি সাদিক হত্যা

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঘাড়ে ‘মানুষখেকো’ গুজবের খড়্‌গ

ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর-ঘাড়ে-মানুষখেকো-গুজবের-খড়্‌গ
শিবলি সাদিক। ফাইল ছবি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্টে দাবি করা হচ্ছে- কলেজছাত্র শিবলিকে হত্যার পর অভিযুক্তরা তার ‘মাংস রান্না করে খেয়েছে’। একইসঙ্গে ‘মানুষখেকো’ আখ্যা দিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। এতে করে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

চট্টগ্রামের রাউজানে এক কলেজছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানামুখী গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলোতে ভর করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে বানায়োট গল্প, ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্ট ফেসবুক-টিকটকের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্টে দাবি করা হচ্ছে- ওই কলেজছাত্রকে হত্যার পর অভিযুক্তরা তার ‘মাংস রান্না করে খেয়েছে’। একইসঙ্গে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে ‘মানুষখেকো’ আখ্যা দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষমূলক নানা বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া এসব গুজব ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা বিব্রতকর পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

শুধু তাই নয়, এ ধরনের গুজব ও পাহাড়ে বসবাসকারী গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর ফলে এই অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- এটা কি নিতান্তই গুজব? নাকি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে এটা সৃষ্টি করেছে এবং বিরামহীন ‘জ্বালানি’ সরবরাহ করে চলেছে?

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের হেনস্তার অভিযোগ

দৈবভাবে পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৭ জন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাদের মধ্যে ৫ জন অবাধ চলাচল করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিদ্বেষমূলক এই গুজবের ফলে কোনো না কোনো সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

তাদের একজন চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করা নীলা চাকমা। তিনি জানান, কাজের সুবাদে তাকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে থাকতে হয়। রাউজানের ওই কলেজছাত্র খুনের পর শহরে বসবাস করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে বলে দাবি তার।

নীলা চাকমা বলেন, ‘নিজ এলাকার বাইরে ভাষাসহ নানা কারণে আমরা বুলিংয়ের শিকার হই। এখন মানুষের মাংস খাওয়ার আরেকটা ট্যাগ যুক্ত হলো। এই যে রিকশাওয়ালা মামা, সবজিওয়ালা, দোকানদাররা বলতেছে, আমি খুবই অনিরাপত্তায় ভুগছি।

‘কয়েকদিন আগে আমি এক বান্ধবীর সঙ্গে নগরীর অক্সিজেন এলাকায় অনন্যা আবাসিকে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে একজন আমাকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেছে। প্রতিবাদ করায় ওই ব্যক্তি আমার সঙ্গে বাদানুবাদে মানুষের মাংস খাওয়ার বিষয় টেনে আনেন।’

তিনি আরও বলেন, “সামসাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো থাকতেই পারছি না। নিউজফিডে ২০টি নিউজ থাকলে তার মধ্যে ১০টিই আমাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক। মেসেঞ্জারে বন্ধুরা বলতেছে- ‘তোরা তো এই খাস; তোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না।’ এমনকি গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট মানুষও আছে এই তালিকায়।”

আরেক ভুক্তভোগী অভি চাকমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাউজানের ওই ঘটনার পর যখন ফেসবুকে আমরা মানুষের মাংস খাই বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, এর কয়েকদিন পর ক্লাস থেকে ফেরার পথে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দিকে দুই তরুণীর সঙ্গে দেখা। তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই মনে হয়েছে। ওরা আমাদের দেখে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে যেন আমরা বোধহয় জ্যান্ত মানুষ খেয়ে ফেলি।

‘আবার নিজেদের মধ্যেও বলাবলি করছিল- রাউজানের ওই ঘটনার পর পাহাড়ি দেখলেই ভয় লাগে। কথাটা আমি শুনে ফেলায় ওদেরকে বলেছি, কয়েকজন অপরাধ করলেই সেই দায় পুরো জনগোষ্ঠীর হতে পারে না। তাছাড়া মানুষের মাংস খাওয়ার বিষয়টিও গুজব।’

চট্টগ্রাম শহরে কর্মক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার স্বপন চাকমা নামের আরও একজনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। শহরের বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার কনডেন্সড মিল্ক উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি৷

নিউজবাংলাকে স্বপন বলেন, “ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার সময় রাস্তাঘাটে মানুষজন আমাদের দেখলে বলে, ‘তোমাদের চাকমারা নাকি মানুষের মাংস খায়?’ এমনকি ফ্যাক্টরির ভেতর আমাদের সুপারভাইজারও প্রশ্নের সুরে বলেন- তোমরা চাকমারা নাকি মানুষের মাংস খাও। তখন স্বাভাবিকভাবেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”

গুজবটা যেভাবে ছড়ালো

ঘটনার শুরু ১১ সেপ্টেম্বর। ওইদিন রাঙামাটি জেলার কাউখালী ইউনিয়নের দুর্গম বালু পাহাড় এলাকা থেকে এক কলেজ শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত শিবলি সাদিক রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়ার মুহাম্মদ শফির ছেলে। কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় একটি মুরগির খামারে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। মরদেহ উদ্ধারের ১৪ দিন আগে ওই খামার থেকে অপহরণ করা হয়েছিল তাকে।

পুলিশ জানায়, শিবলির সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে আরো ৬ জন কাজ করত। তারা সবাই পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য। ঘটনার মাসখানেক আগে তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় শিবলির। খামার মালিক সে সময় ঘটনাটি মিমাংসা করে দিলেও ক্ষুব্ধ ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শ্রমিকরা। সেই ক্ষোভ থেকে ২৭ আগস্ট রাতে শিবলিকে অপহরণ করে আট কিলোমিটার দূরের গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায় তারা।

পরবর্তীতে স্বজনদের ফোন করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। এক পর্যায়ে ১ সেপ্টেম্বর শিবলির বাবা শফি গিয়ে বান্দরবানে অপহরণকারীদের কথামতো দুই ব্যক্তিকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আসেন। এর আগে ৩১ আগস্ট সবশেষ তাদের সঙ্গে শিবলির কথা বলিয়ে দেয় অপহরণকারীরা।

‘ছেড়ে দেয়া হয়েছে, বাসায় চলে যাবে’- মুক্তিপণ পাওয়ার পর অপহরণকারীরা স্বজনদের আশ্বাস দিলেও বাসায় ফেরেননি শিবলি। এ ঘটনায় ৭ সেপ্টেম্বর রাউজান থানায় মামলা করেন স্বজনরা। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুইচিংমং মারমা ও অংথুইমং মারমা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে উমংচিং মারমা নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১১ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির কাউখালী ইউনিয়নের দুর্গম বালু পাহাড় এলাকা থেকে শিবলি সাদিকের দেহাবশেষ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহ নিয়ে ফেরার পথে উমংচিং মারমাকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে উত্তেজিত জনতা।

গুজবের শুরু

মরদেহ উদ্ধার ও একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার পরপরই নিহত শিবলির দেহাবশেষের ছবি এবং অভিযুক্তদের যৌথ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ছবির ক্যাপশনে দাবি করা হয়- ‘হত্যাকারীরা শিবলিকে হত্যার পর তার মাংস রান্না করে খেয়ে হাড়গোড় পাহাড়ে ফেলে দিয়েছে।’

কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অনেকেই এই গুজবের ওপর ভিত্তি করে ভিডিও তৈরি করে ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করতে থাকে। কেউ কেউ ফটোকার্ড তৈরি করেও তা শেয়ার করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে শুধু ফেসবুক ও ইউটিউবে অধিকতর অনুসন্ধান পদ্ধতিতে (অ্যাডভান্স সার্স সিস্টেম) যাচাই করে এই গুজব ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো সংক্রান্ত সহস্রাধিক পোস্টের সন্ধান পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। এসব পোস্টের মধ্যে অধিকাংশের বক্তব্য আপত্তিকর হওয়ায় এই প্রতিবেদনে যুক্ত করা যায়নি।

আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, ঘটনা সত্য

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবটি এত দ্রুত ছড়িয়েছে যে দায়িত্বশীল অনেকেই বিশ্বাস করে তা নিয়ে কথা বলেছেন।

বাস্তবেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলেছে দাবি করেছেন রাঙামাটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুসা মাতব্বর। তার বক্তব্যের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের ওই বক্তব্যের প্রথম অংশে তিনি রাউজানে খুনের শিকার এক কিশোরের মাংস রান্না করে খাওয়ার অভিযোগ করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে প্রথম ৪৩ সেকেণ্ডে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘গত দুই-তিনদিন আগে রাউজানের একটি ছেলেকে অপহরণ করে রাঙ্গামাটির কাউখালিতে এনে তার মাংস পর্যন্ত তারা কেটেকুটে রান্না করে খেয়েছে। এটা দুঃখজনক রাঙ্গামাটিবাসীর জন্য। এ ধরনের ঘটনা যেন পরবর্তীতে আর না ঘটে, আমরা আবেদন জানাব সরকারের কাছে। এগুলো, এই হত্যাকাণ্ডগুলো আসলে মানুষ কোনো অবস্থাতে, যে কোনো মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। সবাইকে বলব, এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ- মানুষের মাংস রান্না করে খাওয়া, এটা কত বড় অপরাধ! আমি বলার, মুখের ভাষাই পাচ্ছি না, কী বলব আমি!’

পরের ১ মিনিটে পাহাড়ে অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন তিনি।

অবশ্য বক্তব্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। ব্যস্ততার অজুহাত তুলে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতেও রাজি হননি তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি প্রথম প্রকাশ করে ‘সম্প্রীতির রাঙ্গামাটি’ নামের এক ফেসবুক পেজ। এই ফেসবুক পেজের মালিক ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি অবজারভারের রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি শেখ ইমতিয়াজ কামাল ইমন।

১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে ইমনের সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘৪ থেকে ৫ দিন আগে নির্বাচন নিয়ে আমরা চার থেকে পাঁচটা গণমাধ্যম ওনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমাদের মধ্যে একজন ওনাকে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করলে ওনি এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমার কাছে র-ভিডিও (মূল ভিডিও) আছে।’

মরদেহ উদ্ধারকারী পুলিশ যা বলছে

শিবলি সাদিক হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। তাদের মধ্যে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে তিন জন। তবে তাদের কেউই শিবলির মাংস রান্না করে খাওয়ার বিষয়ে কিছু বলেনি বলে দাবি পুলিশের।

মরদেহ উদ্ধার ও আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযানিক দলে ছিলেন রাউজান থানার উপ-পরিদর্শক আজিজুল হক। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও তিনি।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রান্না করে তার মাংস খাওয়ার খবরটি ভুয়া। এসবের ভিত্তি নেই। এ বিষয়ে আমরা নিজেরাই তো কিছু পাইনি। ব্লগাররা ভাইরাল হওয়ার জন্য এটা ছড়াচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের সাইবার টিম মাঠে নামছে।

আমাদের স্যারও (ওসি) এটা নিয়ে কথা বলেছেন। যারা এসব ভুয়া নিউজ ছড়িয়ে দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এই মামলায় সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরই এক মেয়ে। তিনি আমাদের একজন কনস্টেবল। যেহেতু ভাষার একটা সমস্যা আছে, আমরা ওর সহযোগিতায় কাজগুলো করছি।’

প্রায় একই কথা বলেন রাউজান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘হত্যায় জড়িতরা নিহতের মাংস রান্না করে খেয়েছে- এরকম কোনো তথ্য আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। যারা এগুলো ছড়াচ্ছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে যে তারা এসব তথ্য কোথায় পেলেন!’

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অপহরণের ১৪ দিন পর আমরা দেহাবশেষ পেয়েছি। যে এলাকা থেকে দেহাবশেষ উদ্ধার করেছি, এর আশপাশের ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়িঘর নেই।

‘জায়গাটি পাহাড়ি গভীর জঙ্গল এলাকা। জনবসতিশূন্য এই জঙ্গলে বিভিন্ন প্রাণী থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সেসব প্রাণী মরদেহের অংশবিশেষ খেয়ে থাকতে পারে।’

‘আমরা তো জানি যে, মানুষের মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে মরদেহের পচন শুরু হয়। মরদেহটি পাওয়া গেছে হত্যার ৮ থেকে ১০ তিন পর। তাই আমাদের ধারণা, শেয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী মরদেহ খেয়ে ফেলেছে, নয়তো পচে গেছে।’ যোগ করেন তিনি।

তবে জবানবন্দি দেয়া তিনজনের একজন ওই এলাকায় একদিন রাতে মুরগির মাংস ও ভাত রান্না করে খাওয়ার কথা জানিয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘যেহেতু তারা সেখানে ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই মুরগি-ভাত রান্না করে তারা এক রাতে খেয়েছে।’

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যা বললেন

পুলিশ ও নিহতের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সবশেষ ৩১ আগস্ট পরিবারের সঙ্গে শিবলি সাদিকের কথা বলিয়ে দিয়েছে অপহরণকারীরা। এর পরপরই তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এরপর মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর। মাঝে ১১ থেকে ১২ দিন মরদেহটি গভীর পাহাড়ি জঙ্গলেই ছিল।

সাধারণত মরদেহে পচন শুরু হয় পরিবেশ, তাপমাত্রা, ঋতু, মরদেহের ধরনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে।

রাঙ্গামাটির ওই পাহাড়ি গভীর জঙ্গলে ১০ থেকে ১২ দিনে একটা মরদেহের কী অবস্থা হতে পারে তা জানতে চাওয়া হয় ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. কাশেমের কাছে। তিনি বলেন, ‘মরদেহের মাংস পচে যাবে। কিছু মাংসসহ হাড় অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিছু মাংস শরীরে সংযুক্ত থাকতে পারে।’

তবে গভীর জঙ্গলে একটা মরদেহ পড়ে থাকলে বিভিন্ন প্রাণী তা খেয়ে ফেলতে পারে বলে ধারণা তার।

ডা. কাশেম আরও বলেন, ‘বিভিন্ন প্রাণী মরদেহের বিভিন্ন অংশ খেয়ে ফেলতে পারে। তবে তা কোনো প্রাণী খেয়েছে নাকি কোনো অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে তা জানতে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে মরদেহ পরীক্ষা করতে হবে। মোটামুটি পচে গেলেও তিনি এ বিষয়ে বলতে পারবেন।’

রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা

বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। তাদের অধিকাংশেরই বাস পার্বত্য চট্টগ্রামে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ‘মানুষের মাংস খাওয়া’ গুজবকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘এটা একটা সাম্প্রদায়িক উষ্কানি ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র। এটা যারা করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এই অপতৎপরতায় নিরীহ লোকজন হয়রানির শিকার হচ্ছে। একটা সম্প্রদায়কে টার্গেট করে এভাবে গুজব ছড়ানো একটা গভীর চক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে। যে যা-ই করুক, অতীতেও এই অঞ্চলে শান্তি নষ্টের চেষ্টা করেছে, পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না ইনশাআল্লাহ।’

মাঠে নামছে সাইবার পুলিশ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের গুজব যারা ছড়িয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার পুলিশ সেন্টার) খন্দকার তৌহিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা হলে আমরা সাধারণত বিটিআরসির মাধ্যমে এ ধরনের গুজবের লিংকগুলো বন্ধ করে দেই। তাছাড়া এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে যারা জড়িত তাদেরও শনাক্ত করা হবে। শনাক্তের পর সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ
The land officer does not pay for government expenses

সরকারি খরচে পোষায় না ভূমি কর্মকর্তার

সরকারি খরচে পোষায় না ভূমি কর্মকর্তার ভূমি কর্মকর্তার (বাঁয়ে) সহকারী আহম্মদের ঘুষ গ্রহণের একটি ভিডিও নিউজবাংলার হাতে এসেছে। কোলাজ: নিউজবাংলা
ভিডিওতে আহম্মদকে বলতে শোনা যায়, এর আগে অন্য আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে জমি খারিজ বাবাদ ৪০ হাজার টাকা নিয়েছেন।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের রাজিপুর ইউনিয়নের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্যে ঘুষ নেয়া-সংক্রান্ত একটি ভিডিও নিউজবাংলার হাতে এসেছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, ভূমি কর্মকর্তা সানোয়ারের নির্দেশে জমি খারিজ করে দেয়ার কথা বলে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নিচ্ছেন অফিস সহকারী আহম্মদ। এ সময় ২০ শতাংশ জমি খারিজ করে দিতে ১৮ হাজার টাকা চান আহম্মদ। পরে দর কষাকষি করে ১৫ হাজার টাকা নেন তিনি, বাকি তিন হাজার টাকা পরে দিতে বলা হয়। এই টাকার ভাগ ভূমি কর্মকর্তা সানোয়ারের হাতে যাবে বলে জানানো হয়।

ভিডিওতে আহম্মদকে বলতে শোনা যায়, এর আগে অন্য আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে জমি খারিজ বাবাদ ৪০ হাজার টাকা নিয়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, ভূমি কর্মকর্তা সানোয়ারের বাড়ি ভূমি অফিসের কাছাকাছি। তিনি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। ফলে নিজের ইউনিয়নের ভূমি অফিসে এসে ঘুষ বাণিজ্য পসরা সাজিয়ে বসেছেন তিনি। এলাকার সবার সঙ্গে তার পরিচয় থাকায় নিজ হাতে ঘুষ গ্রহণ না করে অফিস সহকারী আহম্মদ ও অস্থায়ী ভিত্তিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করা হিরনকে ঘুষের দরকষাকষি ও তা সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। সরকারি খরচের সঙ্গে অতিরিক্ত টাকা (ঘুষ) না দিলে পোষায় না এ কর্মকর্তার। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না তার মাধ্যমে।

মাহফুজ আহম্মেদ নামের এক ব্যক্তির অভিযোগ, নিজের জমি খারিজ করতে সানোয়ারকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

নিউজবাংলাকে মাহফুজ বলেন, ‘খারিজ (জমি) করতে গেলে ভূমি কর্মকর্তার সহকারী আহম্মদের মাধ্যমে ইচ্ছামতো টাকা দাবি করা হয়। শুধুমাত্র সরকারি খরচে কখনওই ভূমি অফিসে কাজ করা যায় না। তো আহম্মদ ১৮ হাজার টাকা দাবি করলে নগদ ১৫ হাজারে মিটিয়েছি।’

উজ্জ্বল নামের আরেকজন বলেন, ‘মাস তিনেক আগে আমার কাছ থেকেও ভূমি কর্মকর্তা সানোয়ারের নির্দেশে জমি খারিজ বাবদ ১২ হাজার টাকা নিয়েছে কম্পিউটার অপারেটর হিরন। এই ভূমি অফিস থেকে ঘুষখোর ভূমি কর্মকর্তাকে সরানো প্রয়োজন।’

মেহেদী হাসান মঞ্জু নামে আরও একজন বলেন, ‘আমার ৪০ শতাংশ জমি খারিজ করতে গেলে ৬০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। আমি টাকার পরিমাণ কমাতে বললেও কমায়নি। এত টাকা আমার পক্ষে দেয়া অসম্ভব, তাই এখনও খারিজ করাতে পারিনি।’

এ বিষয়ে জানতে ভূমি অফিসের সহকারী আহম্মদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। ভিডিও থাকলেও ঘুষ নেয়ার বিষয়টি তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করে বসেন। বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিইনি।’

‘আপনি খারিজ বাবদ ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন, ভিডিওতে এটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে’- জানালে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন কেটে নম্বরটি বন্ধ করে দেন।

পরে রাজিবপুর ইউনিয়নের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অনুমিতভাবেই নিজের সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, ‘আমার নির্দেশে আহম্মদ-হিরন টাকা নেয় না। আহম্মদ ওই টাকা কেন নিয়েছিল তা আমার জানা নেই।’

তার দাবি, ‘আমি ভেজাল কাজ করি না বলেই কিছু লোক ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ এনে আমার বিরুদ্ধে বদনাম ছড়াচ্ছে। ওই ভিডিওটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি তদন্ত করা হবে। ঘুষ গ্রহণের প্রমাণ মিললে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আরও পড়ুন:
সাংবাদিক প্রশ্ন করতেই দৌড় ‘বায়োমিল’ রিপ্রেজেনটেটিভের
মাদ্রাসায় ‘লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য’, প্রতিবাদ করায় বরখাস্তের অভিযোগ
অনুমতি না নিয়েই বিদেশে চলে গেলেন প্রাথমিকের এক শিক্ষিকা
‘দুর্নীতির টাকার ভাগ তো স্যারও পেয়েছেন’
বৈধ অস্ত্র ভাড়া নিয়ে চলছিল অপহরণ-দখল

মন্তব্য

বাংলাদেশ
OC eager to save the SI who trapped Laden

লাদেনকে ফাঁসানো এসআইকে বাঁচাতে তৎপর ওসি!

লাদেনকে ফাঁসানো এসআইকে বাঁচাতে তৎপর ওসি! পুলিশের এমন আচরণে হতাশ এবং একইসঙ্গে আতঙ্কিত ভুক্তভোগীর স্বজনরা। ইনসেটে অভিযুক্তি এসআই রিয়াদ। ছবি: নিউজবাংলা
লাদেন ও তার বাবা মোসলেম জোমাদ্দারকে অপহরণ করা হলেও ৪০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে মঙ্গলবার বিকেলে মোসলেমকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে টাকা না পেয়ে লাদেনকে তিন পিস ইয়াবা দিয়ে এসআই রিয়াদ কাউনিয়া থানায় চালান দেন বলে অভিযোগ স্বজনদের।

পিতা-পুত্রকে ডিবি পরিচয়ে ‘অপহরণ করে’ চাঁদা দাবি এবং পরে তা না পেয়ে ছেলেকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার ঘটনায় ফুঁসছে বরিশালবাসী। এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রেদোয়ান হোসেন রিয়াদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকার কাউনিয়া থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। একেক সময় তার একেক রকম বিবৃতিতে বিভ্রান্ত সংবাদকর্মীরাও।

মঙ্গলবার সকালে জমিজমা-সংক্রান্ত একটি মামলায় হাজিরা দিতে মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুর থেকে লঞ্চযোগে বরিশাল নদী বন্দরে আসেন মোসলেম জোমাদ্দার ও তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে আব্দুল্লাহ বিন লাদেন। উপবন নামের একটি লঞ্চ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই দুইজন ব্যক্তি নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে লাদেন ও তার বাবা মোসলেমকে তল্লাশি শুরু করেন। একপর্যায়ে নিচে পড়ে থাকা একটি নীল রঙের কাগজ দেখিয়ে তারা বলেন- ‘এই তো পেয়েছি’। তারা ঠিক কী পেয়েছেন, তা তারাই জানতেন। এরপর নদীবন্দর থেকে লাদেনকে মোটরসাইকেলে করে আর মোসলেমকে রিকশায় করে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। একপর্যায়ে লাদেনকে মারধর শুরু করেন ডিবি পরিচয় দেয়া ওই দুইজন। এক লাখ টাকা না দিলে তাদের ছাড়া হবে না বলে জানান তারা। সবশেষ ৪০ হাজার টাকায় সমঝোতা করতে রাজি হন তারা।

পরে বাবা মোসলেমকে ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে আটকে রাখা হয় এবং জানা যায় ডিবি পরিচয় দেয়া ওই দুই ব্যক্তির একজন কাউনিয়া থানার এসআই রেদোয়ান হোসেন রিয়াদ। তিনি প্রথমে তিন পিস ইয়াবা পাওয়ার দাবি করে লাদেনকে কাউনিয়া থানায় আটকে রাখেন। তবে তাকে ধরে আনা হয় কোতোয়ালী থানা এলাকা থেকে।

এ বিষয়ে শুরুতে কাউনিয়া থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রিয়াদ (এসআই) মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে ৩ পিস ইয়াবাসহ ওই যুবককে আটক করেছেন- এমন খবর আমার কাছে রয়েছে। তার কাছে নাকি আরও ইয়াবা পাওয়ার কথা ছিল। অভিযান শেষ করে বিকেলে তাকে (লাদেন) থানায় রেখে যান তিনি।’ এমনকি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

কিন্তু ওই রাতেই বদলে যায় ওসি আসাদুজ্জামানের সুর। এসআই রিয়াদের পক্ষে সাফাই গেয়ে তখন তার দাবি ছিল, এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছিলেন এসআই রিয়াদ। অভিযানে লাদেনকে তিন পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়েছে।

সে সময় এক থানা পুলিশ অন্য থানা এলাকায় অভিযান চালাতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন ওসি।

পরে বুধবার দুপুরে ওসি আসাদুজ্জামান জানান, ধাওয়া দিয়ে ধরতে গিয়ে ঘটনাস্থল কোতোয়ালি মডেল থানার মধ্যে গিয়ে পড়ে। তাই নিয়মানুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মামলাটি কোতোয়ালি মডেল থানায় করা হয়েছে এবং মামলার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কাউনিয়া থানা থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখানে নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। পাশাপাশি লাদেনের বিরুদ্ধে কাউনিয়া থানার এসআই রেদওয়ান হোসেন রিয়াদও কোতোয়ালি মডেল থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছেন।

ঘটনার সত্যতা অনুসন্ধানে মঙ্গলবার রাতেই সরেজমিনে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউনিয়া থানায় হাজির হয় নিউজবাংলা। এ সময় দেখা যায়, থানা গারদে আটকে রাখা হয়েছে কলেজ ছাত্র আব্দুল্লাহ বিন লাদেনকে। গারদ থেকেই লাদেনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার।

সে সময় লাদেন বলে, ‘আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে লঞ্চঘাট থেকে আমাদের ডিবি বলে তুলে নেন এসআই রিয়াদ স্যার ও আরেকজন। পরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে বিকেলে টাকা দাবি করে আব্বাকে ছেড়ে দেন তারা। কিন্তু আমাকে ইয়াবার মামলা দিয়ে থানায় নিয়ে আসেন। আমি বিড়ি-সিগারেটও খাই না। তাহলে আমার নামে এ মিথ্যা মামলা কেন?’

লাদেনের বাবা মোসলেম জোমাদ্দার জানান, টাকা না দিতে পারলে পরে তাকে চরকাউয়া খেয়াঘাট এলাকায় নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়, কিন্তু তার ছেলের কোনো হদিস ছিল না। পরে ৯৯৯-এ ফোন করা হলে সেখান থেকে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন, কাউনিয়া থানার এসআই রিয়াদ এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন।

এ বিষয়ে মোসলেমের দাবি, তাদেরকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছে। বলেন, ‘ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই পুলিশের কর্মকর্তা এসআই রিয়াদ ১ লাখ টাকা দাবি করেন, আর সেই টাকা চেয়ে বাড়িতে স্বজনদের কাছে ফোন দিতে বাধ্য করেন। একটি বিকাশ নম্বরও দেন তিনি। পরে ৪০ হাজার টাকা ম্যানেজ করে দেয়ার শর্তে আমার ছেলেকে কাউনিয়া থানায় আটকে রেখে ছেড়ে দেন।

‘টাকা ম্যানেজ করতে না পেরে রাতে থানায় গিয়ে পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি খুলে বলি, কিন্তু তারা তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ করেননি। পরে টাকা দেয়ার জন্য এসআই রিয়াদের দেয়া বিকাশ নম্বরে যোগাযোগ করে জানতে পারি সেটি বরিশালের আমতলার মোড় এলাকায় অবস্থিত। এ ধরনের প্রমাণ থাকার পরও পুলিশ লাদেনকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছে।’

জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের যোগসাজশেই এসআই রিয়াদ এমন করে থাকতে পারেন বলে দাবি করেন মোসলেম।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্র নিউজবাংলাকে জানিয়েছে, এসআই রিয়াদ চাকরির মাত্র কয়েক বছরে মেট্রোপলিটনের বেশ কয়েকটি থানা ও ডিবিতে দায়িত্ব পালন করেন। তবে অজানা কারণে কোনো জায়গাতেই দীর্ঘদিন থাকা হয়নি তার। তার বিরুদ্ধে এর আগে রোগীর দালালদের ধরে কৌশলে টাকা আদায়সহ কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে, যদিও সেগুলো পরবর্তীতে আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সূত্র আরও জানায়, ওসি আসাদুজ্জামানের সঙ্গে এসআই রিয়াদের পূর্ব পরিচিতি আছে। কারণ ওসি আসাদুজ্জামান যখন বন্দর থানায় কর্মরত, তখন রিয়াদও ওই থানায় ছিলেন।

এদিকে লাদেনকে ফাঁসানোর বিষয়টি পরিষ্কার হতে তার স্বজনরা সিসি ক্যামেরা পর্যালোচনা করার দাবি তোলেন।

এ বিষয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. ফজলুল করিম বলেন, ‘ঘটনাস্থল কোতোয়ালি থানা এলাকায় হওয়ায় মামলাটি এখানে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই হয়েছে। তদন্তও সঠিকভাবে করা হবে।’

না জানিয়ে অন্য থানা এলাকায় অভিযান চালানো, তুলে নেয়া ব্যক্তিদের নিয়ে সারা দিন বিভিন্ন স্থানে ঘোরা, রাতে দীর্ঘ সময় এক থানায় আটকে রেখে পরে অন্য থানায় হস্তান্তর এবং দাবিকৃত টাকা না দেয়ায় ফাঁসিয়ে দেয়াসহ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। সেখানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া কোনো পুলিশ সদস্য বা অন্য কারও ইন্ধনে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য এমনটা করছে কি না, সে বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।’

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, ‘এসআই রিয়াদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। যে অপরাধ করবে সেটার দায় ব্যক্তিরই নিতে হবে। রিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে পেরে ইতোমধ্যে উত্তর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনারকে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে সেই অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এক্ষেত্রে পুলিশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা আশা করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাবেক নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এ ধরনের প্রাকটিস কাম্য নয়। ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আর ক্ষমতার জবাবদিহিতা থাকাও দরকার। পুলিশের ক্ষমতার জবাবদিহিতা না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘যে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, তাকে কেন থানাতে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো ভালোভাবে তদন্ত করা হয়নি অথবা আইনের কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে ওই পুলিশ সদস্য আবারও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখানে সিস্টেমে সমস্যা রয়েছে। এইসব পুলিশ সদস্য পুলিশের ভাবমূর্তি যেভাবে নষ্ট করছে সেইভাবে সমাজেরও ক্ষতি করছে। চাকরির সামান্য কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকটি অপকর্ম ঘটানো এই পুলিশ সদস্যকে স্থায়ী ভাবে বহিষ্কার করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। এ ছাড়া এসব পুলিশ সদস্যকে যারা প্রশ্রয় দিয়ে পুষে রেখেছেন, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা উচিৎ।’

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Sir also got the share of corruption money
জাল স্বাক্ষরে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ

‘দুর্নীতির টাকার ভাগ তো স্যারও পেয়েছেন’

‘দুর্নীতির টাকার ভাগ তো স্যারও পেয়েছেন’ গাইবান্ধা বিআরডিবি অফিসের উপ-পরিচালক আব্দুস সবুরই আর্থিক অনিয়মের হোতা বলে দাবি করেছেন বরখাস্ত হওয়া হিসাবরক্ষক আনিছুর রহমান। ছবি: নিউজবাংলা
৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬০ টাকা ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্বেই হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক ফাঁসানোর চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ সাময়িক বরখাস্ত হওয়া হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমানের।

‘আমি উপ-পরিচালক স্যারের সঙ্গে থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছি, স্বীকার করছি। কিন্তু এইসব অনিয়ম তো আমার নির্দেশে হয়নি, হয়েছে উপ-পরিচালক সবুর স্যারের নির্দেশে। আমি শুধু তার নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছি।

‘প্রকল্প থেকে সরানো ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬০ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা তো আমি নিজের চেক দিয়ে উত্তোলন করে স্যারকেই দিয়েছি। এখন তিনি বাকি টাকাটাও চান। প্রকল্পের সব কাজ যখন আমার মাধ্যমে হয়েছে, তখন ওই টাকাটা তো আমি খরচ করতেই পারি।

‘টাকাটা না দেয়ায় ক্ষেপে গিয়ে স্যার আমার নামে অভিযোগ দিয়েছেন; আমার বেতন আটকে দিয়েছেন। এতে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমি যদি অন্যায় করে থাকি, তাহলে আমার চেয়েও বড় অন্যায় করেছেন সবুর স্যার।’

দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) গাইবান্ধার উপ-পরিচালক আব্দুস সবুরের নামে নিউজবাংলার কাছে এভাবেই ফিরিস্তি দেন ‘গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’-এর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান।

শুধু ওই প্রকল্পের ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬০ টাকা নয়, এমন আরও অনেক প্রকল্প থেকে উপ-পরিচালক আব্দুস সবুর অন্তত ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে দাবি বরখাস্ত হওয়া ওই হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার। তার দাবি, আব্দুস সবুরের হাত থেকে রেহাই পায়নি রাজস্ব খাতও।

গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়ার পর এভাবেই থলে থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে অপরাধ আর অভিযোগের বেড়াল।

প্রকল্প পরিচালকের করা অভিযোগে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান। তার বিরুদ্ধে দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ৭ নভেম্বর তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে ঢাকার সদর দপ্তর থেকে পাঠানো তদন্ত দল।

আনিছুর রহমানের অভিযোগ, কৌশলে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। প্রকল্প থেকে সরানো টাকা যৌথ স্বাক্ষরে খোলা ব্যাংক হিসাবে রাখলেও তা প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুর আনিছুর রহমানের চেক দিয়ে উত্তোলন করিয়েছেন। পরবর্তীতে টাকার বিষয়ে অনুসন্ধান হলে নিজে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে প্রকল্প পরিচালক এই কৌশল করেছেন।

এ বিষয়ে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন গাইবান্ধা বিআরডিবি অফিসের সাবেক হিসাবরক্ষক ও ‘গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’র হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুরের বিরুদ্ধে অপকর্মে সহযোগিতা না করায় হয়রানির অভিযোগ তোলেন।

১৬ অক্টোবর করা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালে যোগদানের পর প্রকল্প বাস্তবায়নে একক সিদ্ধান্তে অর্থ ব্যয় করতে থাকেন প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুর। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অনিয়মের প্রতিবাদ করলে তিনি আনিছুর রহমানের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং বরখাস্ত করার হুমকি দেন। আব্দুস সবুর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হওয়ায় নিরুপায় হয়ে তার কথামতো বিভিন্ন কাজ এবং প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের হিসাবের নথিপত্র প্রস্তুত করতে থাকেন। পরে আনিছুর রহমানকে ফাঁসাতে প্রকল্প পরিচালক তাদের যৌথ স্বাক্ষরে একটি হিসাব খোলেন এবং পরবর্তীতে সেটাকে কেন্দ্র করেই এক সময় প্রকল্প পরিচালক তাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান।

সংবাদ সম্মলনে আরও উল্লেখ করা হয়, এর মধ্যে আনিছুর রহমানের পদোন্নতি হলে তাকে সাঘাটা উপজেলায় সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়। বদলির পর তিনি জেলা অফিসের নতুন হিসাবরক্ষক রাসেল সরকারকে চলতি বছরের ২১ জুলাই সকল দাপ্তরিক দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। এরপরও উপ-পরিচালক আব্দুস সবুর তার (আনিছুর) বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। শুধু তাই নয়, কর্তৃপক্ষের কাছে চাকরিচ্যুতি ও সামাজিকভাবে ক্ষতিসাধনের জন্য আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন তথ্য উপাস্থাপন করেন। ফলে আনিছুর রহমান বরখাস্ত হন। বরখাস্তের পর তিন মাস বেতন বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে তিনি মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

একইসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের দাবিও জানান তিনি।

এসব ব্যাপারে জানতে আনিছুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। এ সময় ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি নিরুপায়!’

অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন প্রকল্পের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান। তবে তার দাবি, তিনি একা নন, প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুরের যোগসাজসেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

আনিছুর রহমান বলেন, “প্রকল্পের ৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকার মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে প্রকল্প পরিচালক নিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা। আমার কাছে রাখা অবশিষ্ট ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আমি খরচ করেছি।

“এই পাঁচ লাখ টাকা ছাড়াও সাত উপজেলা থেকে একইভাবে ‘কাঁচামাল’ নামে খোলা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন আব্দুস সবুর।”

তিনি বলেন, ‘এরপরও প্রকল্প পরিচালক আমার কাছে থাকা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ফেরত চান। তবে আমি টাকা দেইনি। ফলে আমার ওপর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। প্রকল্প পরিচালক তার কাছের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে আমার বিরুদ্ধে প্রায় দুই কোটি টাকা অনিয়মের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন। ফলে আমি বরখাস্ত হই।’

বরখাস্ত হওয়ার পর আনিছুর রহমানকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকল্প পরিচালক একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এর জবাব প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুরকে না পাঠিয়ে ঢাকায় বিআরডিবি মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

লিগ্যাল নোটিশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নোটিশের জবাব আমি প্রকল্প পরিচালককে নয়, মহাপরিচালকের কাছে পাঠিয়েছি। তাতে তার (প্রকল্প পরিচালক) সব অপকর্মের ঘটনা আমি ফাঁস করেছি।’

গত ৩০ অক্টোবর মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো আনিছুর রহমানের ওই লিখিত জবাবের একটি কপি এবং আরও বেশকিছু নথি নিউজবাংলার হাতে এসেছে।

লিখিত জবাবে আনিছুর রহমান উল্লেখ করেছেন, তিনি ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত বিআরডিবির গাইবান্ধা জেলা দপ্তরে হিসাবরক্ষক এবং গাইবান্ধা জেলায় বিআরডিবি কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’র হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (অ. দা.) হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। এর মাঝে ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ উপ-পরিচালক হিসেবে গাইবান্ধায় যোগদান করেন আব্দুস সবুর। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধার অগ্রণী ব্যাংকে ‘গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’ শিরোনামে প্রকল্পটির পরিচালকের কার্যালয়ের একটি মূল হিসাব খোলা হয়। হিসাবটি খোলা ও পরিচালিত হয় প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুর ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রকল্পের জন্য ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। ওই বছরের আয়-ব্যয় শেষে ২৮ জুন অব্যয়িত (খরচ না হওয়া) হিসেবে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৪৩৬ টাকা গাইবান্ধা সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় জমা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ওই অর্থবছরে অব্যয়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৭ হাজার ৭৭৬ টাকা। অবশিষ্ট ১০ লাখ ৮৮ হাজার ৩৪০ টাকা পরবর্তীতে প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুর প্রকল্পের মূল হিসাব থেকে ‘পল্লী বাজার’ নামে একটি নতুন হিসাব খুলে সেটিতে স্থানান্তর করেন। শেষ পর্যন্ত (২০২২ সালের ১০ আগস্ট) ওই হিসাবে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৩০৬ টাকা রক্ষিত থাকে।

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুন মাসে শেষ হয় ‘গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন অডিট অধিদপ্তর থেকে প্রকল্পের শুরু থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত অর্থাৎ, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পাদন হয়। নিরীক্ষাকালে অডিট কর্মকর্তা প্রকল্পের মূল হিসাব থেকে ১০ লাখ ৮৮ হাজার ৩৪০ টাকা অন্য একটি হিসাবে স্থানান্তরের তথ্য পান। তবে ‘আর্থিক সমঝোতার মাধ্যমে’ নিরীক্ষা দল ‘পল্লী বাজার’ হিসাব নম্বরে কোনো স্থিতি (অবশিষ্ট টাকা) নেই মর্মে স্বাক্ষর করেন। অথচ ওই বছরের ৩০ জুন পর্যন্তও ওই হিসাব নম্বরে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৩৮৬ টাকা স্থিতি ছিল।

এ ঘটনার বছরখানেক পর প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুর ২০২২ সালের ১০ আগস্ট আগ্রণী ব্যাংকে একটি চিঠি দিয়ে হিসাবের নাম ‘পল্লী বাজার’ ঠিক রেখে হিসাব নম্বরটি বন্ধ করে নতুন একটি স্থায়ী হিসাব খোলার অনুরোধ জানান। চিঠি পেয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সে বছরের ১৬ আগস্ট ছয় মাস মেয়াদী একটি স্থায়ী আমানত হিসাব খোলে। পরে ওই স্থায়ী হিসাবটির মেয়াদও পূর্ণ হলে আব্দুস সবুর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমানকে আমানতটি ভেঙে ক্যাশ করে আনতে বলেন। এ বিষয়ে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি ব্যাংকে একটি চিঠিও দেন। পরে আনিছুর রহমান তার ব্যক্তিগত চেকের মাধ্যমে ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬০ টাকা (স্থায়ী আমানতের মুনাফাসহ) উত্তোলন করে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ে গিয়ে তার হাতে দেন।

২০২৩ সালের ২৬ জুন প্রকল্প পরিচালক একটি অডিট টিম গঠন করলে আনিছুর রহমান সকল আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেন এবং ২৭ জুলাই জেলা কার্যালয়ের নতুন হিসাবরক্ষক রাসেল সরকারের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নতুন পদায়নকৃত কর্মস্থল বিআরডিবির সাঘাটা কার্যালয়ে সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে ‘ছাড়পত্র ছাড়াই’ যোগদান করতে যান। কিন্তু ছাড়পত্র ছাড়া সাঘাটার ইউআরডিও সামিউল ইসলাম তাকে যোগদান করা হবে না মর্মে জানান বলে নথি থেকে জানা যায়। তারপরও তিনি এলপিসি ও ছাড়পত্র ছাড়াই সেখানে অফিস করতে থাকেন।

পরে উপ-পরিচালকের কাছে আনিছুর রহমান এলপিসি ও ছাড়পত্র চাইলে তিনি এবার সুযোগ পেয়ে বেঁকে বসেন। ছাড়পত্র ও এলপিসি দিতে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন উপ-পরিচালক আব্দুস সবুর। শুধু তাই নয়, টাকা না দিলে তার (আনিছুর) চাকরির ক্ষতিসহ পরিবারের ক্ষতি করারও হুমকি দেন।

উপ-পরিচালকের ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করে পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক আব্দুস সবুরকে দেন এবং তিন দিন পর চেকটি ব্যাংকে উপস্থাপনের অনুরোধ জানান। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক পরের দিনই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে চেকটি উপস্থাপন করেন। ফলে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স না থাকায় চেকটি ডিজঅনার হয়। এতে তিনি আরও ক্ষেপে গিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর আনিছুর রহমানকে অফিশিয়ালি একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেন।

জবাব না দেয়ায় লোক মারফত দ্বিতীয় দফায় আবারও আনিছুর রহমানকে ডেকে লিগ্যাল নোটিশ মোতাবেক টাকা জমা দেয়ার হুমকি দেন আব্দুস সবুর। টাকা জমা না দেয়ায় চার মাস আগে আনিছুরের এলপিসি বন্ধ করে দেন উপ-পরিচালক আব্দুস সবুর। ফলে গত চারমাস ধরে পরিবার নিয়ে আর্থিক সংকটে রয়েছেন বলে জবাবে উল্লেখ করেন আনিছুর রহমান।

শুধু তাই নয়, প্রকল্প পরিচালক ২০১৮ সালে যোগদানের পর থেকে চলতি ৫ বছরে তার (আব্দুস সবুর) অনুগত লোকদের নিয়ে গাইবান্ধায় একটি চক্র গড়ে তুলেছেন। এছাড়া তিনি শুধু প্রকল্পের টাকাই নয়ছয় করেননি, তিনি রাজস্ব খাতের লক্ষাধিক টাকাও তিনি হজম করেছেন বলে জবাবে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া আব্দস সবুর ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর সদর দপ্তরের জিপ গাড়ি মেরামত বাবদ পাওয়া ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জনতা ব্যাংক গাইবান্ধা শাখার একটি গোপনীয় হিসাব নম্বরে জমা করেন। কিন্তু পরে গাড়ি মেরামত না করেই সমুদয় টাকা হস্তগত করেন তিনি। এ ঘটনা বিআরডাবির ২০২২ সালের জুনে হওয়া অডিট দলের কাছে গোপন করা হয়েছে বলেও জবাবে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে গাইবান্ধা পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক ও ‘গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’র পরিচালক মো. আব্দুস সবুরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উকিল নোটিশ আমরা করেছি, জবাব আমাদেরকেই দিতে হবে। ওখানে (মহাপরিচালকের দপ্তরে) দিয়ে তো লাভ নেই। ওখানে দিয়ে থাকলে সেটা তার ব্যাপার।’

সেখানে তো (জবাবে) আপনার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তুলেছেন- এমন প্রশ্নে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সেটাতো করবেই এখন। বিভিন্ন বিষয় ধরা পড়েছে। সব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

এ ব্যাপারে বিআরডিবির মহাপরিচালক (গ্রেড-১) আ. গাফফার খান মুঠোফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিআরডিবি অনেক বড় দপ্তর। গাইবান্ধার আনিছুর রহমানের একটি পত্র সম্ভবত এসেছে। আমরা তার অভিযোগের বিষয়গুলো অবশ্যই খতিয়ে দেখব। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। এটি শেষ হলে পরে আমরা তার ব্যাপারটিও দেখব।’

আরও পড়ুন:
জাল স্বাক্ষরে অর্থ আত্মসাৎ: হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু
জাল স্বাক্ষরে প্রকল্পের ১০ লাখ টাকা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার পেটে

মন্তব্য

বাংলাদেশ
10 lakh rupees in the stomach of the accounting officer of the project with fake signature

জাল স্বাক্ষরে প্রকল্পের ১০ লাখ টাকা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার পেটে

জাল স্বাক্ষরে প্রকল্পের ১০ লাখ টাকা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার পেটে একই দপ্তরে দীর্ঘকাল কাজ করার সুবাদে বিরাট অঙ্কের এই দুর্নীতি করা আনিসুর রহমানের জন্য সহজ হয়েছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা
ইতোমধ্যে আনিসুর রহমান নামের ওই কর্মকর্তা বরখাস্ত হলেও তদন্ত কমিটির নিরীক্ষায় বের হয়ে আসছে তার একের পর এক অর্থ আত্মসাতের ঘটনা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, প্রাথমিকভাবে দশ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য মিললেও তা শেষ পর্যন্ত কোটিতে গিয়ে ঠেকবে।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) ‘গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’ পরিচালকের স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ওই প্রতিষ্ঠানের সাঘাটা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে। গাইবান্ধা বিআরডিবির জেলা কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক এবং প্রকল্পটির হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (অ. দা.) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি এসব অর্থ আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ। প্রাথমিক তদন্তে চেক জালিয়াতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে বরখাস্তও হয়েছেন এ কর্মকর্তা।

অভিযুক্ত আনিছুর রহমান ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর হতে চলতি বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর ওই দুই পদে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে শেষ দুই বছরে এই অর্থ আত্মসাত করা হয়। একই দপ্তরের অর্থনৈতিক শাখার দুই পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করায় প্রকল্পের অন্তত দুই কোটি টাকা তছরুপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থ আত্মসাৎ ও স্বাক্ষর জালিয়াতির ঘটনায় আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে পৃথক দুটি অভিযোগ দায়ের করেছেন গাইবান্ধার প্রকল্প পরিচালক আব্দুস সবুর। ওইসব অভিযোগপত্রসহ এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি নথি এসেছে নিউজবাংলার হাতে।

চলতি বছরের ১০ অক্টোবর বিআরডিবির মহাপরিচালক (গ্রেড-১) বরাবর করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২৩ সালের ২০ জুন গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষর স্ক্যান করে অগ্রণী ব্যাংক, গাইবান্ধা শাখার প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব নম্বর থেকে একই ব্যাংকের একই শাখায় প্রকল্পটির তৎকালীন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (অ. দা.) আনিছুর রহমান তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট নম্বরে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৭ টাকা স্থানান্তর করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজার বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজারের সন্দেহ হলে তিনি তাৎক্ষণিক প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফলে স্বাক্ষর স্ক্যান করে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি ধরা পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে অর্থ স্থানান্তর বন্ধ করা হয়।

পরে ২৬ জুন এ ধরনের আরও কোনো জালিয়াতির ঘটনা এর আগেও ঘটেছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে বিআরডিবির ফুলছড়ি সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা দল গঠন করেন গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুস সবুর। নিরীক্ষা শেষে নিরীক্ষা দল গত ২ আগস্ট গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের মাত্র দুই বছরের (২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছর) নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করেন।

দাখিলকৃত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট প্রকল্প পরিচালক ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে পল্লী বাজার গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৩৮৬ টাকার একটি স্থায়ী আমানত খোলা হয়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ১ মার্চ স্থায়ী আমানতটি সুদসহ ভেঙ্গে ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬০ টাকা একই ব্যাংকের আনিছুর রহমানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়।

এর আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি এই অর্থ স্থানান্তরের জন্য অফিসের একটি স্বারক উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে একটি পত্রও প্রেরণ করা হয়। নিরীক্ষাকালে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখা যায়, অর্থ স্থানান্তরের পত্রে ব্যবহৃত স্বারক নম্বরটি অফিস রেজিস্ট্রারে উল্লেখ নেই। এছাড়া ওই পত্রে প্রকল্প পরিচালকের যে স্বাক্ষরটি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা ছিল স্ক্যান করা।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, একই ব্যাংকের গাইবান্ধা প্রকল্পের মূল হিসাব নম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন ৩৮ হাজার ৮৪৯ টাকা প্রকল্পের কর্মচারীদের গ্রাচুইটি হিসেবে একই ব্যাংকের অপর একটি হিসেব নম্বরে স্থানান্তর দেখানো হয়, গ্রাচুইটি তহবিলের জমা খরচ বই ও ব্যাংক স্টেটমেন্টে যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিরীক্ষাকালে দেখা যায়, এখানে প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে কর্মচারীদের গ্রাচুইটি তহবিলের পরিবর্তে আনিছুর রহমানের ব্যক্তিগত ওই হিসাব নম্বরে (ই ৩৫৮২) এ টাকাও স্থানান্তর করা হয়েছে।

পরে জ্ঞাত হয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে স্থায়ী আমানত ভেঙ্গে আত্মসাত করা টাকা ফেরত দেয়ার জন্য আনিছুর রহমানকে চলতি বছরের ৩ আগস্ট একটি পত্র পাঠায় প্রকল্প কর্মকর্তা। আনিছুর রহমান প্রকল্পের আত্মসাতকৃত অর্থের আংশিক হিসেবে দুই বার পাঁচ লাখ টাকার করে চেক প্রদান করেন। কিন্তু তার হিসাব নম্বরে কোনো অর্থ না থাকায় চেকগুলো নগদায়ন করা যায়নি। ব্যাংকে টাকা না থাকার পরও বারবার চেক দিয়ে প্রতারণা ও ছলচাতুরি করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

পরে নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই বছরেই (২০২২ ও ২০২৩) ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় আনিছুর রহমান তার কর্মকালে জেলার পলাশবাড়ি উপজেলা এবং জেলা দপ্তরে হিসাবরক্ষক ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে প্রায় এক যুগের কর্মকালে আরও অন্য কোনো আর্থিক অনিয়ম করেছেন কি না, তা উদঘাটনের জন্য দ্বিতীয় দফায় গত ২৩ আগস্ট তিন সদস্যের আরও একটি নিরীক্ষা দল গঠন করা হয়। একইসঙ্গে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে অভিযুক্ত আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়।

কর্তৃপক্ষ আনিছুরের রহমানের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি, কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য, প্রশাসনিক ও আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের গুরতর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে তদন্তে নামে। প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হওয়া এবং তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যান্য অভিযোগসমূহের তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে আনিছুর রহমানের অপরাধের ধরণ, প্রকৃতি ও গভীরতা বিবেচনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মহাপরিচালক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ৫ অক্টোবরের স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে তাকে বরখাস্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তার খোরাকি ভাতা প্রাপ্যের সুযোগ রাখা হয়। একইসঙ্গে তাকে সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা লাখাই (হবিগঞ্জ)-এর বিপরীতে হবিগঞ্জ জেলায় সংযুক্ত করা হয়।

এদিকে বিআরডিবির মহাপরিচালক বরাবর গাইবান্ধার প্রকল্প পরিচালকের ৯ অক্টোবর করা অপর একটি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, অর্থ আত্মসাতের দায়ে বরখাস্ত হওয়া আনিছুর রহমান সংযুক্ত জেলায় (হবিগঞ্জ) যোগদান না করে গাইবান্ধায় অবস্থান করে বিভিন্নভাবে অফিসের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। অভ্যন্তরীণ নিরিক্ষার মাধ্যমে যে সমস্ত কর্মকর্তা তার বিপুল পরিমাণ অর্থ তছরুপ শনাক্ত করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) পোস্ট করে মর্যাদাহানিকর কাজ অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া আনিছুর রহমান আত্মসাতকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ না করে পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণেরও অনুমতি চাওয়া হয়েছে ওই পত্রে।

অন্যদিকে, প্রকল্প পরিচালক আবদুস সবুরের গাইবান্ধা অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে ৩ অক্টোবর পাঠানো এক পত্রে দেখা যায়, তার ব্যাংকে করা পল্লী বাজার বিআরডিবির স্থায়ী আমানত সুদসহ ভেঙ্গে প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষর স্ক্যানের মাধ্যমে আনিছুর রহমান ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬০ টাকা স্থানান্তর করে নিজের হিসাব নম্বরে নিয়েছেন। সরকারি অর্থ আদায় এবং এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধও করা হয় ওই পত্রে।

পরে প্রকল্প পরিচালকের পত্রের জবাবে ৩০ অক্টোবর অগ্রণী ব্যাংক ম্যানেজারের একটি পত্রে জানানো হয়, স্থায়ী আমানতটি ভেঙ্গে স্থানান্তর চেয়ে প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষরটি অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে স্ক্যান করায় আপাতঃদৃষ্টিত বোধগম্য হয়নি। এছাড়া এই জালিয়াতির সঙ্গে ওই ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা নেই। অপরাধের দায়ে চিহ্নিত বিআরডিবির কার্যালয়ের আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান ম্যানেজার।

শুধু তাই নয়, প্রকল্প পরিচালকের বর্তমান সাঘাটা পল্লী উন্নয়ন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠানো ১৫ অক্টোবরের এক চিঠিতে বলা হয়, বরখাস্ত হওয়া আনিছুর রহমান বিআরডিবির বিভিন্ন সমিতির সদস্যদের ঋণ পাইয়ে দেয়া এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়ার নামে আর্থিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছেন। বিষয়টি বিআরডিবির সকল সমিতির সদস্যদের অবগতসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। সে অনুযায়ী নোটিশও করে ওই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে বিআরডিবির ‘গাইবান্ধা সমন্বিত দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’-এর পরিচালক আব্দুস সবুর বলেন, ‘আনিছুর রহমান সর্বশেষ গত ২০ জুন স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৭ টাকা নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে নেয়ার সময় ধরা পড়ে। এরপর তার আরও এমন জালিয়াতি আছে কি না দেখতে একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা দল গঠন করা হয়। দলটি সর্বশেষ দুই বছরের নথি পর্যালোচনা করে তার বিরুদ্ধে ১০ লাখের বেশি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে আনিছুর রহমান বরখাস্ত হন।’

তিনি বলেন, ‘এ ছাড়াও আনিছুর রহমানের কর্মকালের (প্রায় ১০ বছর) কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে গঠিত অপর একটি নিরীক্ষা কমিটি তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে। বিষয়টি প্রধান কার্যালয়কে অবগত করা হয়েছে।’

তবে বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় ঠিক কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে, তা বলতে রাজি হননি এ কর্মকর্তা।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাতের প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। আমরা প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা ইতোমধ্যে হস্তান্তর করেছি।’

এসময় এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘হেড অফিসের অর্থনৈতিক শাখার দুই পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করায় প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত করা তার জন্য (আনিছুর রহমান) সহজ হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত কর্মকর্তা আনিছুর রহমান মোবাইল ফোনে নিউজবাংলার কাছে বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন।

তার দাবি, ‘প্রকল্প পরিচালক আমার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন। তিনিই আবার তদন্ত কমিটি গঠন করে করেছেন। সেখানে কি নিরপেক্ষ তদন্ত হবে? তদন্ত কমিটির সদস্যরা তো তারই অধীনস্ত।’

এ সময় প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধেই ১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন আনিছুর।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক (গ্রেড-১) আব্দুল গাফফার খান মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

বিপুল পরিমাণ বলতে ঠিক কত টাকা, তা বলতে চাননি তিনিও।

আরও পড়ুন:
ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তায় জিম্মি সেবাগ্রহীতারা
নিয়োগ দুর্নীতির বলি সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী
অর্থ আত্মসাৎ করতে ভুয়া প্রকল্প সাজান ইউপি চেয়ারম্যান
সেই স্কুলটির দ্বায়িত্ব নিতে চান না কোনো শিক্ষক
‘ঘুষ খেয়ে’ প্রধান শিক্ষককে সরিয়েছেন দুই শিক্ষা কর্মকর্তা

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Two officers of land office are hostage service takers

ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তায় জিম্মি সেবাগ্রহীতারা

ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তায় জিম্মি সেবাগ্রহীতারা দুবলহাটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তা উপসহকারী কর্মকর্তা ফাতেমা খাতুন এবং রাসেল হোসেনের বিরুদ্ধে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। কোলাজ: নিউজবাংলা
সেবা দেয়ার নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে গলাকাটা ফি। তাতে যে কাজ হবে, সেই নিশ্চয়তাও নেই। ফলে চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন স্থানীয়রা।

নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম ভরাট্ট নওগাঁ। এই গ্রামের মোজাফফর হোসেন তার জমির খাজনা বাবদ সরকারি ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করেন ৯০০ টাকা। কিন্তু তাকে যে রসিদ দেয়া হয়েছে, তাতে উল্লেখ রয়েছে ২৭২ টাকা।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শন করা হয়। ওই সময় ভূমি অফিস থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন চকপ্রাসাদ গ্রামের খলিলুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। এগিয়ে গিয়ে তার সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে একরাশ ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি।

খলিলুর রহমান বলেন, ‘সামান্য এক টুকরো জমি কিনেছিলাম। সেটি খারিজ করার জন্য আসছিলাম এখানে। ম্যাডামের (ভূমি কর্মকর্তা) সঙ্গে কথা হলে তিনি সব কাগজপত্র দেখে বলেন, আট হাজার টাকা খরচ পড়বে। পরে সাত হাজার টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছি।’

এমন অভিযোগের তালিকাটা বেশ লম্বা। দুবলহাটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তা উপসহকারী কর্মকর্তা ফাতেমা খাতুন এবং রাসেল হোসেনের বিরুদ্ধে এমন শত শত অভিযোগ রয়েছে। সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, ওই দুই কর্মকর্তার যোগসাজশেই ভূমি অফিসে এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা।

সরেজমিনে পরিদর্শন করে ওই দুই কর্মকর্তার লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।

সেবা দেয়ার নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে গলাকাটা ফি। তাতে যে কাজ হবে, সেই নিশ্চয়তাও নেই। ফলে চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন স্থানীয়রা।

অভিযোগের শেষ নেই

গ্রামের বাড়ি সরিসপুরে রীতিমতো ব্যক্তিগত অফিস খুলে বসেছেন দুবলহাটি ইউনিয়নের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা রাসেল হোসেন। জমি-জমার সমস্যায় থাকা মক্কেল ধরা ও টাকা-পয়সার দর কষাকষি চলে সেখানে। পরে যাতে অফিস থেকে কাজ সেরে (অনেক ক্ষেত্রে তাও হয় না বলে অভিযোগ) আর্থিক লেনদেন করা যায় নির্দ্বিধায়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অতিরিক্ত অর্থ ছাড়া ভূমি অফিস থেকে একটি কাজও হয় না। সামান্য হোল্ডিং অনুমোদন দিতেই বিরাট অঙ্কের অর্থ দাবি করেন রাসেল। শুধু তিনি একা সেই টাকা খান না, ভূমি অফিসের প্রসেস সার্ভেয়ার ছালমা খাতুনের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নিতে হয় রাসেলের। তাই সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকার অঙ্কটাও বাড়িয়ে নেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভূমি অফিসের এক কর্মচারী বলেন, ‘আমি অন্য জায়গায়ও চাকরি করেছি। কিন্তু এ অফিসের মতো মানুষকে হয়রানি হতে কোথাও দেখিনি। টাকা ছাড়া একটা কাজও করেন না উপসহকারী কর্মকর্তা রাসেল হোসেন। তার এক সহযোগী আছেন প্রসেস সার্ভেয়ার ছালমা খাতুন। তাকে দিয়ে তিনি (রাসেল) সব লেনদেন করান।’

রাসেল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে শিকারপুর ইউনিয়নের গোয়ালী গ্রামের মো. সাবু বলেন, “আমি গত এক মাস ধরে ঘুরতেছি আমার একটা হোল্ডিং অনুমোদনের জন্য। রাসেলকে এক হাজার টাকাও দিছি, কিন্তু আমার কাজটা করে দিচ্ছে না এখনও। ‘আজ এখানে, কাল সেখানে সরকারি কাজে ব্যস্ত আছি’ বলে ঘুরাচ্ছে শুধু।”

একই ইউনিয়নের চকরামকালি গ্রামের বিজিবি সদস্য হাসান আলী বলেন, ‘চাকরির কারণে আমি বাইরে থাকি। রাসেল আমার গ্রামের ছোট ভাই। তাকে হোল্ডিং করার জন্য কাগজপত্র ও এক হাজার টাকাও দিয়েছি, কিন্তু এখনও কাজটা হয়নি। ফোন করলে বলছে, হবে বা হওয়ার মধ্যে আছে কাজটি। কিন্তু কবে হবে, ঠিক জানি না।’

ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তায় জিম্মি সেবাগ্রহীতারা

উপজেলার নার্সি গ্রামের আল আমিন বলেন, ‘রাসেল তো চিটার প্রকৃতির লোক। অনেক আগে আমার ৩ বিঘা জমি খারিজের জন্য ৪৩ হাজার টাকা নিয়েছে সে। তবে খারিজ করে দিতে পারেনি। অথচ টাকাও ফেরত দেয়নি। পাঁচ-দশ হাজার করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে টাকা ফেরত দিচ্ছে। এখনও ৯ হাজার টাকা পাবো তার কাছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে পুলিশের চাকরি দেবে বলে এর আগে ১৭ লাখ টাকা নেয় রাসেল। চাকরি আমার আজও হয়নি, সেই টাকা থেকেও ২০ হাজার টাকা পাবো।’

ভরাট্ট নওগাঁ গ্রামের মোজাফফর হোসেন বলেন, ‘আমার জমির খাজনার চেক কাটতে আসছিলাম ফাতেমা খাতুনের কাছে। তিনি বলেন- এক হাজার টাকা লাগবে। পরে ৯০০ টাকা দিয়েছি। কিন্তু আমাকে চেক দিছে ২৭২ টাকার। আমারা তো এত বুঝিনা। যা চায় দেয়া লাগে। না হলে কাজ করে দেয় না।’

মাতাসাগর গ্রামের মহির উদ্দীন নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সামন্য একটা খারিজ করতে আসলে যেখানে সরকারি ফি এক হাজার ১০০ টাকা, সেখানে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা ছাড়া কাজ করে না তারা। এত অনিয়ম ও দুর্নীতি, তবু দেখার কেউ নাই।

যা বলছেন অভিযুক্তরা

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইনা। আপনার যা করার করতে পারেন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। যারা বলছে, তাদের ডেকে নিয়ে আসেন। আমি সামনা সামনি শুনতে চাই কে কী বলছে।’

অভিযোগের বিষয়ে উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা রাসেল হোসেনকে ফোন করা হলে বলেন, ‘এ বিষয়ে ফোনে কোনো কথা বলতে পারব না। আপনি অফিসে আসেন।’ এরপর একাধিকবার কল করা হলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।

অন্য কর্মকর্তাদের বক্তব্য

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুবলহাটি ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকা নেয়ার ব্যাপারে আমি জানি না। তবে কেউ অভিযোগ করলে সেটা বিবেচনা করে দেখব।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ বেশি টাকা দেয় কেন? না দিলেই তো হয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম রবিন শীষ বলেন, ‘ভূমি অফিসে সরকারি ফির বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেয়ার সুযোগ নেই।

‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। অভিযোগের বিষয়টি জানি না। তবে আমার কাছে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসলে তদন্ত করে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আরও পড়ুন:
নিয়োগ দুর্নীতির বলি সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী
এমপিওভুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিয়ম-বহির্ভূত ব্যবসার অভিযোগ
মেহেরপুরে ভুয়া ছাড়পত্র নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ
অর্থ আত্মসাৎ করতে ভুয়া প্রকল্প সাজান ইউপি চেয়ারম্যান
সেই স্কুলটির দ্বায়িত্ব নিতে চান না কোনো শিক্ষক

মন্তব্য

বাংলাদেশ
UP Chairman arranged fake project to embezzle money

অর্থ আত্মসাৎ করতে ভুয়া প্রকল্প সাজান ইউপি চেয়ারম্যান

অর্থ আত্মসাৎ করতে ভুয়া প্রকল্প সাজান ইউপি চেয়ারম্যান মহাদেবপুর সদর ইউপি চত্বরে ছাউনি নির্মাণের প্রকল্পের জন্য এক কোঁদাল মাটি পর্যন্ত খোঁড়া হয়নি। ছবি: নিউজবাংলা
চেয়ারম্যান নিজেই বলছেন, প্রকল্পটি এখনও শুরু হয়নি। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেছে- মর্মে প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

প্রকল্পের কাজই হয়নি, অথচ ভুয়া মাস্টার রোল দাখিল করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে নওগাঁর মহাদেবপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যের বিরুদ্ধে। তারা দুজন যথাক্রমে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

চেয়ারম্যান নিজেই বলছেন, প্রকল্পটি এখনও শুরু হয়নি। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেছে- মর্মে প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। আবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা ওই ইউপি সদস্যের দাবি, প্রকল্পের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

আর সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, ইউপি চত্বরে সেবাপ্রার্থীদের জন্য ছাউনি নির্মাণের প্রকল্পের জন্য এক কোঁদাল মাটি পর্যন্ত খোঁড়া হয়নি। শুধু তাই নয়, বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে এ ধরনের কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন হতে দেখেননি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

তাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে দুর্নীতির মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাত করেছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

এটিকে সরকারি অর্থের অপচয় ও অনিয়ম-দুর্নীতির বহুল প্রচলিত কৌশল হিসেবে দেখছে স্থানীয় সচেতন মহল। এ ঘটনার তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।

মহাদেবপুর সদর ইউপি কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পের আওতায় মহাদেবপুর ‘ইউপি কার্যালয় চত্বরে সেবাপ্রার্থীদের জন্য বসার স্থান নির্মাণ’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এ বছরের জুন মাসে কাগজে-কলমে প্রকল্পটি ‘শতভাগ সম্পন্ন’ বলে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, মাস্টার রোলের মাধ্যমে বরাদ্দের অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে।

৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ওই ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ হাসান তরফদার শকিল এবং সাধারণ সম্পাদক ইউপি সদস্য দিলরুবা খানম মুক্তা।

জানা যায়, এর আগের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ধলু তার আমলে কার্যালয়ের সামনে সেবাপ্রার্থীদের বসার স্থান নির্মাণ করেন।

মাহবুবুর রহমানের দাবি, ২০২০-২০২১ অথবা ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারি প্রকল্পের অর্থ দিয়ে সেবাপ্রার্থীদের বসার স্থান নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন তিনি। সেই প্রকল্পের মূল নকশা বিকৃত করে কয়েক মাস আগে পূর্বে নির্মাণ করা টিনের ছাউনির সামনের অংশের ১-২ ফুট কেটে ফেলা হয়। এই টিন কেটেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান। ফলে বরাদ্দের পুরো টাকাটা আত্মসাত করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইউপি সদস্য ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক দিলরুবা খানম মুক্তার মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। কিন্তু প্রকল্পের বিষয়ে তেমন কিছুই জানাতে পারেননি তিনি।

‘মাস্টার রোলে স্বাক্ষর করেছেন কি না’- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সচিব আমার কাছ থেকে বেশকিছু কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন। কিন্তু এর বেশি আমি জানি না। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান ও সচিবের সঙ্গে আমার লেনদেনের হিসাব ক্লিয়ার।’

তবে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন ইউপি সচিব গোলাম রাব্বানী মল্লিক। বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যাপারে ‘কিছুই জানি না’ বলে দায় সারেন তিনি। প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটি শুধু উপজেলায় দাখিল করা হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও মহাদেবপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ হাসান তরফদার শাকিলের কাছে গেলে অনুমিতভাবে তিনিও তা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের পেছনে একটি শেড (ছাউনি) নির্মাণ করা হবে। কিন্তু এখনই তা নির্মাণ করতে গেলে কিছুটা ঝামেলা রয়েছে। সড়কের কাজ চলছে। ফলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এখানে কতটা জমি নেবে, সেটা জানার অপেক্ষায় কাজটি আটকে আছে।’

প্রকল্প যখন বাস্তবায়নই হয়নি, সেখানে মাস্টার রোল দাখিল করে বরাদ্দের অর্থ কীভাবে উত্তোলন করা হলো- এ প্রশ্নের মুখে ঘাবড়ে যান তিনি।

বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হাসান সোহাগের (ইউএনও) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি জানেন না বলে জানান। ইউএনও বলেন, ‘এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখব।’

মোবাইল ফোনে নওগাঁর স্থানীয় সরকার উপপরিচালক (উপসচিব) সালাহ্উদ্দিন আহমেদ বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, ‘অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আরও পড়ুন:
সেই স্কুলটির দ্বায়িত্ব নিতে চান না কোনো শিক্ষক
সাইনবোর্ডে লেখা ‘সরকারি সম্পত্তি’, ব্যবসায়ীদের দাবি জায়গা তাদের
‘ঘুষ খেয়ে’ প্রধান শিক্ষককে সরিয়েছেন দুই শিক্ষা কর্মকর্তা
সড়কটি ঠিক হবে কবে?
সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে দুই স্বাস্থ্যকর্মী বদলি!

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The administration is silent on the expulsion of 2 women by arbitration

সালিশ বসিয়ে ২ নারীকে সমাজচ্যুত, প্রশাসন নীরব

সালিশ বসিয়ে ২ নারীকে সমাজচ্যুত, প্রশাসন নীরব প্রতীকী ছবি।
সরেজমিনে জানা গেছে, গ্রাম্য মোড়লের ভাইয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনায় এবং এক ইউপি সদস্যের মূর্তির ব্যবসা করার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সালিশ বসিয়ে ওই দুই নারীকে পরিবারের সদস্যসহ একঘরে করে রাখা হয়েছে। হতদরিদ্র পরিবার দুটি দিনের পর দিন মানবেতর জীবনযাপন করলেও প্রশাসনের উদ্যোগ দায়সারা।

গৃহবধূ বেলী খাতুনের স্বামী অন্যের বাড়িতে দিনহাজিরা চুক্তিতে কৃষাণের কাজ করেন। কর্মস্থলের মালিক তার পরিবারের সঙ্গে কৃষাণের পরিবারকেও গত কুরবানির ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটায় বেড়াতে নিয়ে যান। আর গরিবের এই বেড়াতে যাওয়াটাই কাল হয়েছে।

চল্লিশোর্ধ্ব বেলী খাতুন কুয়াকাটায় গিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন- এমন অপবাদ দিয়ে গ্রামে রীতিমতো সালিশ বসিয়ে এই ‘অপরাধের’ জন্য জরিমানা করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা।

জরিমানার টাকা দিতে না পারায় দরিদ্র পরিবারটিকে এক সপ্তাহ ধরে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। গ্রামের পক্ষ থেকে পালা করে পাহারা বসিয়ে পরিবারটির ওপর নজরদারিও করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অসহায় দরিদ্র পরিবারটি মানবেতর জীবনযাপন করছে।

অপর গৃহবধূ বিউটি খাতুনের ক্ষেত্রেই প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। তাকেও ওই সালিশ ডেকে ‘চরিত্রহীন’ ও ‘মূর্তি ব্যবসায়ী’ আখ্যা দিয়ে করা হয়েছে একঘরে। তাকেও একই অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অবশ্য তিন দিন পর ১০ হাজার টাকা সমাজপতিদের হাতে তুলে দেয়ায় তার ‘শাস্তি’ শিথিল করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার তালম ইউনিয়নের গাবরগাড়ি গ্রামে ঘটেছে এমন বর্বর ঘটনা। তবে ঘটনার এক সপ্তাহ পার হলেও প্রশাসন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি।

সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে আমি ও পরিবারের সদস্যরা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো কাজে যেতে পারছি না। এমনকি স্বজনের বাড়িতেও যেতে দেয়া হচ্ছে না। মাতব্বরদের ভয়ে গ্রামবাসী কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। এমনকি আমার নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না। এই কষ্ট কইবার মতো কোনো মানুষও নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, চরিত্রের ত্রুটি আছে- এমন অভিযোগ এনে গাবরগাড়ি গ্রামে দুই নারীকে এক সপ্তাহ ধরে সমাজচ্যুত করে রেখেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে কতিপয় গ্রাম্য মাতব্বর। আর ওই নারীরা সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে গ্রামের কারও কথা বলতে পারছেন না। পারছেন না কএনা বাড়িতে বা বাজারে যেতে। লোকলজ্জায় ঘরের কোণে বসে চোখের জল ফেলছেন শুধু।

ভুক্তভোগী পরিবার ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানা যায়।

‘গাবরগাড়ি গ্রামে পরস্পর স্বজন দুই নারী রাত করে বাড়ি ফেরেন। আবার মাঝেমধ্যেই বেড়াতে যান এখানে-সেখানে। এটা চারিত্রিক ক্রটির অংশ।’- মাস দুয়েক আগে গাবরগাড়ি গ্রামের মোড়লদের কাছে এমন অভিযোগ করেন ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা।

তৎপর হয়ে ওঠেন গ্রাম্য মোড়লরাও। তারপর এ নিয়ে ওই গ্রামের মো. জয়নাল মণ্ডলের বাড়ির উঠোনে সালিশ বৈঠক বসে। সেখানে ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা, গ্রামপ্রধান আলতাব হোসেন, মোজাম্মেল হক মন্টু, জুয়েল রানা, শফিকুল, বুলু ও আজিজুল হকসহ শতাধিক গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন। সেই সালিশে নানামুখী আলোচনা শেষে দুই নারীর চরিত্রের ত্রুটি আছে এমন অভিযোগ এনে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পাশাপাশি তাদের দু’জনকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানার ঘোষণা দেয়া হয়।

গ্রাম্য মোড়লদের এমন সালিশি সিদ্ধান্তে দিশেহারা হয়ে পড়েন দরিদ্র ওই নারীরা। তারা এই জরিমানার টাকা দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন।

জরিমানা না দিয়ে গ্রামপ্রধানদের অপমান করা হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে ১৬ সেপ্টেম্বর পুনরায় একই স্থানে গ্রাম্য সালিশ বৈঠক বসে। সেখানে জরিমানার টাকা পরিশোধ না করায় অভিযুক্ত দুই নারীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়া হয়।

একইসঙ্গে গ্রামবাসী কারও সঙ্গে তাদের কথা বলা, মেলামেশা এবং কারও বাড়ি দিয়ে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি সমাজচ্যুত দুই নারীর একজন যাতে নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে না পারেন সে জন্য সালিশের দিন থেকেই পাহারাদার নিয়োগ করেছেন গ্রাম্যপ্রধানরা। এরপর থেকে ওই দুই নারী পরিবারসহ সমাজচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

অভিযুক্তদের একজন ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, গ্রামের কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেটা না মানায় তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তাদের একজন ক্ষমা চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশ শিথিল করা হয়েছে। অপর নারী গ্রামপ্রধানদের কাছে এসে ক্ষমা চাইলে তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশও শিথিল করা হবে।

এদিকে দ্বিতীয় দফা সালিশের পর অভিযুক্ত নারীদের একজন জরিমানার ২০ হাজার টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা গ্রামপ্রধানদের হাতে তুলে দিয়ে তাকে মাফ করে দিতে বলেন। এতে ‘সন্তুষ্ট’ হয়ে গ্রামপ্রধানরা ওই নারীর বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির ‘আদেশ’ কিছুটা শিথিল করেছেন।

আর অপর নারী জরিমানার টাকা দিতে না পারায় তার ওপর সমাজচ্যুতি নির্দেশ বহাল রাখা হয়েছে।

বেলী খাতুন বলেন, ‘সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে আমি ও পরিবারের সদস্যরা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো কাজে যেতে পারছি না। এমনকি স্বজনের বাড়িতেও যেতে দেয়া হচ্ছে না। মাতব্বরদের ভয়ে গ্রামবাসী কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। এমনকি আমার নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না। এই কষ্ট কইবার মতো কোনো মানুষও নেই।’

এ বিষয়ে গ্রামপ্রধান ও ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘গ্রামের কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেটা না মানায় তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তাদের একজন ক্ষমা চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশ শিথিল করা হয়েছে। অপর নারী গ্রামপ্রধানদের কাছে এসে ক্ষমা চাইলে তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশও শিথিল করা হবে।’

তাড়াশের ইউএনও মো. সোহেল রানা বলেন, ঘটনাটি জানার পর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যকে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতে বলে দিয়েছি।

তবে ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা ও গ্রামপ্রধান বুলুর সঙ্গে পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ‌ই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ওই দুই নারী। তাদের একজন দুই বছর আগে গ্রামপ্রধান বুলুর ভাইয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। আর অপরজন ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফার কথামতো মূর্তির ব্যবসায় রাজি না হওয়ায় ষড়যন্ত্র করে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে তালম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল খালেক বলেন, ‘ঘটনাটি নিন্দ্যনীয়। বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

তাড়াশ থানার ওসি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর ঘটনাস্থলে থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নূরে আলমকে পাঠানো হয়েছে। আর সমাজচ্যুতির বিষয়টি মিমাংসার জন্য গ্রামপ্রধানদের বলা হয়েছে। তারা সতর্ক না হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যকে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতে বলে দিয়েছি।’

আরও পড়ুন:
সালিশেই কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা
সালিশে মারধরের পর যুবকের মৃত্যুতে পরিবারের মামলা

মন্তব্য

p
উপরে