চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক-স্টাফ বাসসহ বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুরের ঘটনায় দুটি মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
দুই মামলায় সাতজন করে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও এক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
উপাচার্যের বাসভবনে ভাঙচুরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা শেখ মো. আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
চবি শাখা ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, নাম উল্লেখ করা ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন শাখা ছাত্রলীগের শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক উপগ্রুপ ‘সিক্সটি নাইন’, ‘সিএফসি’ ও ‘বিজয়’-এর রাজনীতিতে যুক্ত। তাদের মধ্যে সিএফসি গ্রুপের পাঁচজন, সিক্সটি নাইন গ্রুপের ছয়জন ও বিজয় গ্রুপের একজন অনুসারী আছেন।
বাকি দুজন নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে দাবি করেছেন। তাদের দলীয় পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।
এ মামলার সাত আসামি হলেন পালি বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আমিনুল ইসলাম, সিক্সটি নাইন গ্রুপের অনুসারী শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. রিয়াদ হাসান রাব্বি, ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সৌরভ ভূঁইয়া ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৫-২০১৬ শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের উপপ্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, সিএফসির গ্রুপের অনুসারী ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শাকিল হোসেন আইমুন, সংস্কৃত বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র দীপন বণিক দীপ্ত ও ইংরেজি বিভাগের ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র নুর মোহাম্মদ মান্না। মামলাটিতে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫০০ থেকে ৬০০ চবি শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়।
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা গত ৪ সেপ্টেম্বর উপাচার্যের বাসভবনে যান। সেখানে উপাচার্যকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে বাসার কেয়ারটেকার মেহেদী হাসানকে জানান, চবিতে চলমান উন্নয়নমূলক প্রকল্প থেকে তাদের ১০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে। এ টাকা না পেয়ে আসামিরা চবির শাটল ট্রেনের দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে গত ৭ সেপ্টেম্বর চবিতে তাণ্ডব চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করেন। ওই সময় তারা উপাচার্যের বাসভবনের নিরাপত্তার প্রহরীদেরও মারধর করেন।
অন্যদিকে পরিবহন দপ্তরে ভাঙচুরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেন।
এ মামলায় সাত আসামি হলেন দর্শন বিভাগের ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন, সিক্সটি নাইন গ্রুপের অনুসারী ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আনিছুর রহমান, ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের ছাত্র নাসির উদ্দিন মো. সিফাত উল্লাহ ও বাংলা বিভাগ ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র অনিরুদ্ধ বিশ্বাস, বিজয় গ্রুপের অনুসারী সংস্কৃত বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র অনিক দাশ, সিএফসি গ্রুপের অনুসারী বাংলা বিভাগ ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. আজিমুজ্জামান ও পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. ইমরান নাজির ইমন।
এ মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪০০ থেকে ৫০০ চবি শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়।
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা ৫ সেপ্টেম্বর পরিবহন দপ্তরের প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিনের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে পাননি। তারা চবির শাটল ট্রেনের দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে গত ৭ সেপ্টেম্বর চবিতে তাণ্ডব চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করেন।
শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, ‘আমাকে অনেকে জানিয়েছে ছাত্রলীগের প্রায় ১২ জন আন্দোলনে ছিল, পরে আন্দোলন থামিয়েছে। তাদেরও আসামি করা হয়েছে। আবার অনেকে অপরাধ করছে, তাদেরকে আসামি করা হয় নাই।
‘এটা প্রশাসনের একটা গ্যাম্বলিংয়ের অংশ। অনেকে মাস্ক পরে হামলা করেছে। তাদের খুঁজে বের করা হয়নি। এটা অন্য মতাদর্শের কাউকে ছাড় দেয়ার জন্য করা হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটা নিয়ে একটা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনে সবসময় পাশে থাকে। এখানে যৌক্তিক আন্দোলনে থাকতে গিয়ে যদি ছাত্রলীগকে ভুক্তভোগী হতে হয়, তাহলে সেখানে অবশ্যই আমরা প্রতিবাদ করব।’
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সিএফসি গ্রুপের একাংশের নেতা রেজাউল হক রুবেল বলেন, ‘যারা ভাঙচুর করেছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিরাপরাধ কাউকে ভিকটিম করা হলে শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না।’
শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও সিএফসি গ্রুপের অন্য অংশের নেতা সাদাফ খান বলেন, ‘যারা জিরো পয়েন্টে আন্দোলনে গেছে, সেটা কোনো অন্যায় না। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ভাঙচুর করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, কিন্তু আমাদের দাবি সঠিক তদন্ত করা হোক, সিসিটিভি ফুটেজগুলো প্রকাশ করা হোক।’
শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিজয় গ্রুপের নেতা মো. ইলিয়াস বলেন, ‘আমার যে একজন অনুসারীর নাম মামলায় দেয়া হয়েছে, সে রোগী নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছিল। সেখানে সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে এটা প্রমাণ হবে। আমার মনে হয় ভুলে করে, না হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে ফাঁসানোর জন্য তার নাম দেয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন:মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জবানবন্দি শেখ হাসিনার দুঃশাসনের এক অকাট্য দলিল।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বুধাবার বাসস’কে বলেন, ‘চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা অবশ্যই শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অকাট্য দলিল।’
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মঙ্গলবার জবানবন্দি দেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
সেসময় তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাকে ফোন করে জানান যে আন্দোলন দমনে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তখন তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছিলেন এবং তার সামনে ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার। পরে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের এই নির্দেশনা তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ সারাদেশে পৌঁছে দেন প্রলয় কুমার। সেদিন থেকেই মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়।
চৌধুরী মামুন আরও জানান, এই মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর ও ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। এ ক্ষেত্রে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশ ছিল, যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে হবে।
সাবেক আইজিপি তার জবানবন্দিতে বলেন, শেখ হাসিনাকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করতেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমাতে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার বিষয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। যার পরামর্শ দিয়েছিলেন র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ। আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে ব্লক রেইড দিয়ে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করা হয়। আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেন আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও ব্যবসায়ীরা।
জবানবন্দিতে ‘কোর কমিটি’র মিটিং বিষয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাসায় ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হত। সব বৈঠকেই আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হত। একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়।
ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয় উল্লেখ করে মামুন বলেন, তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পরে রাজি হন। আর সমন্বয়কদের আটকের দায়িত্ব তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনকে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও ডিবি তাদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে। সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য চাপ দেওয়া হয় এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের ডিবিতে এনে চাপ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন সাবেক এই আইজিপি। তিনি জানান, ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুনকে ‘জিন’ বলে ডাকতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির বৈঠক সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি জানান, ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবির প্রধান, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এনএসআইয়ের প্রধানের সঙ্গে তিনিসহ মোট ২৭ জন উপস্থিত ছিলেন। জুলাই আন্দোলন দমন এবং নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। সেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরছিল। কিন্তু চারদিকে পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠকটি মুলতবি করা হয়।
তবে ওইদিন রাতে গণভবনে আবারও বৈঠক ডাকা হয় বলেও জবানবন্দিতে জানান সাবেক আইজিপি মামুন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের মহাপরিচালক ও সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মজিবুর রহমানসহ তিনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান ও এসবির প্রধান বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন।
ওই বৈঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে। ওই বৈঠক থেকে সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যান বলে জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সেখানে (কন্ট্রোল রুম) তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এসবির প্রধান ও মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় এবং ৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টায় সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে তারা সবাই চলে যান।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বিষয়ে জবানবন্দিতে তিনি জানান, সেদিন সকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দপ্তরে যাই। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে ছাত্র-জনতা স্রোতের মত প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা জানতাম না। এরপর বিকেলে আর্মির হেলিকপ্টার এসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবি প্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন।
পরে হেলিকপ্টারে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদেরও সেখানে নেওয়া হয়। পরদিন ৬ অগাস্ট আইজিপি হিসেবে তার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয় এবং ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালে ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলেও জানান মামুন।
আন্দোলনের দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি।
ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও দেখান ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন যে, ‘গুলি করি, একজন মরে। সেই যায়। বাকিরা যায় না।’ পরবর্তীতে এই ভিডিও সারাদেশে ভাইরাল হয়।
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্বে ছিলেন উল্লেখ করে জবানবন্দিতে আল-মামুন বলেন, তখন পুলিশের আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামশর্ও শেখ হাসিনাকে এই জাবেদ পাটোয়ারী দিয়েছিলেন বলেও দাবী করেন।
পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সেই নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং তারা সেটা বাস্তবায়ন করেন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করেছেন, তাদের পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, র্যাব সদর দপ্তর পরিচালিত উত্তরাসহ র্যাব-১ এর কার্যালয়ের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। র্যাবের অন্যান্য ইউনিটের অধীনেও অনেক বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটকে রাখা হত, যা একটা কালচারে (সংস্কৃতি) পরিণত হয়েছিল।
তার ভাষ্যমতে, অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মত কাজগুলো র্যাবের এডিজি (অপারেশন) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকেরা সমন্বয় করতেন। আর র্যাবের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত এবং এই নির্দেশনাগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মাধ্যমে আসত বলে জানতে পারেন বলেও জবানবন্দি দেন সাবেক আইজিপি।
সেসব নির্দেশনা চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপারেশন) ও র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো বলে উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
ব্যারিস্টার আরমান আটক থাকার বিষয়টি তিনি আইজিপি’র দায়িত্ব গ্রহণের সময় জানানো হয় বলেও উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। তাকে তুলে আনা এবং গোপনে আটক রাখার সিদ্ধান্ত সরকারের ছিল।
বিষয়টি জানার পর আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন, ‘ঠিক আছে, রাখেন। পরে বলব।’ কিন্তু পরে আর কিছু তিনি জানাননি। এরপর আমি কয়েকবার বিষয়টি তুলেছিলাম, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারের আদেশে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার জন্য আমি অপরাধবোধ ও বিবেকের তাড়নায় রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরবর্তী সময়ে আমি ট্রাইব্যুনালে স্বজন হারানোদের কান্না, আকুতি ও আহাজারি দেখেছি। ভিডিওতে নৃশংসতা দেখে অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত আমি যৌক্তিক মনে করছি।
তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের পর আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মত বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে। আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে আমার দায়িত্বশীল সময়ে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর দায় আমি স্বীকার করছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। আমি প্রত্যেক নিহতদের পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন। আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত (বাঁচিয়ে রাখেন) দান করেন, বাকি জীবনে কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।
এদিকে, সাবেক আইজিপি’র জবানবন্দি দেওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রাজসাক্ষী হওয়া চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ক্ষমা পাবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত ট্রাইব্যুনাল নেবেন। তিনি নিজের বিবেকের তাড়নায় অপরাধ স্বীকার করেছেন। নিজের পক্ষ থেকে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছিলেন।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, সাবেক আইজিপি ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, বিশ্বের কোন আদালতেই এ সাক্ষ্যকে দুর্বল প্রমাণ করার সুযোগ নেই। এটি একটি অকাট্য অপ্রতিরোধ্য সাক্ষ্য। এটি শুধু জুলাই-আগস্টের ঘটনা নয়, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে যত গুম-খুন হয়েছে তার বিরুদ্ধে অকাট্য দলিল হিসেবেও কাজ করবে।
ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন বিএম সুলতান মাহমুদ, প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্য প্রসিকিউটররা।
এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ ছাড়াও রায়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন বাতিল করে পূর্বের (১৯৭২ সালের) অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে এ সংক্রান্ত রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ আজ এই রায় দেন।
আদালতে এ সংক্রান্ত রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অ্যামিকাস কিউরি (আদালত বন্ধু) হিসেবে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। আর ইন্টারভেনর হিসেবে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ, ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবী রিটটি করেন। তারা হলেন মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো. জহিরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, আবদুল্লাহ সাদিক, মো. মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল ও যায়েদ বিন আমজাদ।
এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছর ২৭ অক্টোবর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এ সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় কেন প্রতিষ্ঠা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রগতি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
গত ২৫ মার্চ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠান। সে অনুযায়ী এই বেঞ্চে উভয় পক্ষে কয়েকদিন রুল শুনানির পর ২ সেপ্টেম্বর (আজ) রায়ের দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলো।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আজ এই মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এরপর আবু সাঈদকে গুলি করার দুটি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়। এ সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন মনিটরে ছেলেকে গুলির দৃশ্যের ভিডিও দেখে বার বার চোখ মুছছিলেন।
এরপর প্রসিকিউসনের আবেদনে আগামীকাল এই মামলায় প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ৩০ জুলাই প্রসিকিউসনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই মামলায় অভিযোগ গঠনের প্রার্থনা করেন।
অন্যদিকে, আসামী পক্ষে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাওয়া হয়।
এরপর গত ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ২৭ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
এই মামলার যে ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনা হয়, তাদের মধ্যে গ্রেফতার ৬ জন আজ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন।
এরা হলেন-বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী মো. আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।
আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৩০ জুন ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ।
২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে, সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।
ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে, একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে।
জাজ্জ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
ঢাকাসহ ১৯ জেলায় ৪১ জন জেলা জজসহ একযোগে জেলা আদালতের ২৩০ বিচারককে বদলি করা হয়েছে। বদলি করা এসব বিচারকের মধ্যে রয়েছেন ৫৩ জন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ৪০ জন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং ৯৬ জন সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
গতকাল সোমবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে পৃথক চারটি প্রজ্ঞাপনে তাদের বদলির আদেশ দেয়।
বদলি করা জেলা ও দায়রা জজদের আগামী ২৮ আগস্টের মধ্যে বর্তমান পদের দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়েছে।
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার দ্বিতীয়তলার নারী ব্যারাকে ঢুকে নারী পুলিশ সদস্যকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা একই থানায় কর্মরত সাফিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ২১ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি আমলে নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৫ দিন ধরে ঘুরে মামলা দায়ের করতে না পারা ভুক্তভোগীকে পুলিশ লাইন্স থেকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় নিয়ে তাকে বাদী করে ধর্ষণ মামলা রুজু করানো হয়েছে। আর ওই মামলাতেই সাফিউরকে আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে ভুক্তভোগীর শারীরিক পরীক্ষা করানোর জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মোহাম্মদ আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের অভিযোগের যাচাই-বাছাই শেষে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল সাফিউরের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। ভুক্তভোগী নারী পুলিশ সদস্য নিজে বাদী হয়ে শুক্রবার মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলাতেই গত শুক্রবার রাতে সাফিউরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার সকালে তাকে আদালতে চালান করা হয়। বিষয়টি আরও গভীরভাবে জানতে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল সাফিউরের বিরুদ্ধে আদালতের কাছে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। একইসঙ্গে ভুক্তভোগীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুরো বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এর আগে ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার দ্বিতীয়তলার নারী ব্যারাকে ঢুকে এক নারী পুলিশ সদস্যকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে একই থানায় কর্মরত সাফিউর রহমান নামে আরেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে গত ৬ মাস ধরে থানা ব্যারাকেই ওই নারী সদস্যকে ধর্ষণ করে ওই পুলিশ সদস্য। সবশেষ গত ১৫ আগস্ট রাত আড়াইটার দিকেও সাফিউর থানা ব্যারাকের ওই নারীর রুমে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করে। এর প্রতিকার চেয়ে গত ৫ দিন ধরে ঘুরেও থানায় মামলা করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান ভুক্তভোগী নারী পুলিশ সদস্য। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও বিচার ব্যবস্থার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি পৃথক বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
গতকাল রোববার সিলেটের দ্য গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে বাণিজ্যিক আদালত শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ প্রস্তাব দেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো পৃথক বিচারিক ফোরাম নেই। এখন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যিক বিরোধগুলো ছোটখাটো দেওয়ানি মামলার সঙ্গে একই সারিতে নিষ্পত্তি করতে হওয়ায় দ্রুত, কার্যকর বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এটি আমাদের বিচারকদের প্রতি কোনো সমালোচনা নয়। তাদের নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত। বরং এটি একটি কাঠামোগত অসংগতি। ফলে মামলার জট যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও বিনিয়োগ পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত শুধু অর্থঋণ আদালতে প্রায় ২৫ হাজারের বেশি মামলা অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
পৃথক বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি কারও একক কোনো দাবি নয় বরং বাণিজ্যিক মামলাগুলো বিশেষায়িত আদালতে নির্দিষ্ট সময়সীমা ও কার্যকর রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য বৃহৎ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী সবাই দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এই দাবি জানিয়ে আসছে।
প্রধান বিচারপতি বৈশ্বিক উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, রুয়ান্ডা, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো বাণিজ্যিক আদালত গড়ে তুলে একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এসব দেশের অভিজ্ঞতাগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা বহন করে।
প্রধান বিচারপতি প্রস্তাবিত বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থার সাতটি মূল স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো- স্পষ্ট ও একীভূত এখতিয়ার নির্ধারণ, আর্থিক সীমারেখা ও স্তরভিত্তিক কাঠামো, বাধ্যতামূলক কেস ম্যানেজমেন্ট ও কঠোর সময়সীমা, সমন্বিত মধ্যস্থতা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার (যেমন, ই-ফাইলিং, ডিজিটাল ট্র্যাকিং, হাইব্রিড শুনানি), সবার জন্য ন্যায়সংগত প্রবেশাধিকার এবং জবাবদিহি ও কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাণিজ্যিক আদালতের কার্যক্রম হবে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সেমিনারে সূচনা বক্তব্য দেন সিলেটের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমান। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাফর আহমেদের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফান লিলার।
বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল আবার পেছানো হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমানের আদালত গতকাল সোমবার আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন দিন ধার্য করেন।
এ পর্যন্ত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা মোট ১২০ বার পিছিয়ে এসেছে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নির্মমভাবে খুন হন। ঘটনার সময় বাসায় তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ উপস্থিত ছিলেন। সাগর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামিরা হলেন — রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল ইসলাম ওরফে অরুন, আবু সাঈদ, সাগর-রুনির বাড়ির দুই নিরাপত্তা রক্ষী পলাশ রুদ্র পাল ও এনায়েত আহমেদ এবং তাদের ‘বন্ধু’ তানভীর রহমান খান।
এদের মধ্যে তানভীর ও পলাশ জামিনে রয়েছেন, বাকিরা বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন বারবার পিছিয়ে আসায় এ মামলার দ্রুত বিচার ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশায় সংশ্লিষ্ট পক্ষের মাঝে উদ্বেগ বিরাজ করছে।
মন্তব্য