সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। এখানকার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। আর তাদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হচ্ছে পানিতে সাঁতার কাটতে নেমে।
সবশেষ সোমবার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ‘সাদাপাথর’ থেকে জয় নামে এক পর্যটকের মরদেগ উদ্ধার করা হয়। এর দুই আগে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পর্যটন কেন্দ্রে রমিজ উদ্দিন নামে আরেক পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সবশেষ দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার মগবাজার থেকে সোমবার দুপুরে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরে বেড়াতে আসেন চার বন্ধু। তাদের মধ্যে জয় গাইন (২৫) নামে একজন পানিতে ডুবে মারা যান।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি হিল্লোল রায় জানান, জয় সাদাপাথরে গোসল করতে নেমেছিলেন। এ সময় পানির তীব্র স্রোতে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। মুহূর্তেই পানিতে তলিয়ে যান। প্রায় ১৫ মিনিট পর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করেন। এরপর তাকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে জাফলংয়ের নদী থেকে রমিজ উদ্দিন নামে ওই পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন দুপুরে তিনি জাফলংয়ের ডাউকি নদীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় গোসল করতে নেমেছিলেন। কিন্তু স্রোতের টানে তলিয়ে যান। প্রায় ৪ ঘণ্টা সন্ধান চালিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।
সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বরাবরই পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ। সেগুলোর মধ্যে আগ্রহের শীর্ষে থাকে জাফলং, সাদাপাথর, বিছানাকান্দি ও লালাখাল। প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রই পানিকেন্দ্রিক। আর এসব স্পটে বেড়াতে এসে প্রায়শ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছেন পর্যটকরা। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি ও স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যায়। আর এ সময়টাতে ভিড় বাড়ে পর্যটকেরও। একইসঙ্গে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বাড়ছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি।
জাফলংয়ের পিয়াইন নদে ৬ জুলাই বাবার সঙ্গে গোসলে নেমে নিখোঁজ হয় ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আল ওয়াজ আরশ। ৮ জুলাই সকাল ৭টার দিকে ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী স্থানে তার মরদেহ ভেসে ওঠে।
এর আগে ১ জুলাই কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রে আবদুস সালাম নামে এক তরুণ গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন। তার মরদেহ ভেসে ওঠে নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর।
বার বার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্টরা পর্যটকদের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন। অপরদিকে পর্যটকদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায়ই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে।
পর্যটন পুলিশ, থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র জাফলং। মেঘালয় পাঁহাড়ঘেষা জাফলংয়ের নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের ফলে অনেক স্থান মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত দুই দশকে জাফলংয়ে বেড়াতে এসে মারা গেছেন ৬০ জন পর্যটক।
অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তঘেঁষা ধলাই নদের সাদা পাথর পর্যটকদের কাছে পরিচিতিই পেয়েছে ৫-৬ বছর আগে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখন প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন সাদা পাথরে। তবে এই ৫/৬ বছরেই এখানে মারা গেছেন ১২ পর্যটক।
এ ছাড়া গোয়াইঘাট এলাকার পাথুরে নদীর আরেক পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দিতে এই সময়ে মারা গেছেন চারজন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষায় নদীর তীব্র স্রোত, চোরাবালি, নৌকাডুবি ও সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছেন পর্যটকরা।
পর্যটকদের নিরাপত্তায় গাইডলাইন না থাকা এবং তাদের সচেতনতায় তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সিলেট চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, ‘কয়েকটি সাইনবোর্ড টানানো ছাড়া সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় আর কোনো উদ্যোগ নেই। পর্যটন কেন্দ্রে টুরিস্ট পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবক নেই। ফলে পর্যটকরা ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা করেন। কেউ তাদের বাধা দেন না। তারাও বিপদের আশঙ্কার বিষয়টি সম্পর্কে আগেভাগে জানতে পারেন না।’
জানা গেছে, সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণে একক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের উন্নয়নসহ নানা দিক দেখাশোনা করে। তাদের পক্ষে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছে পর্যটন উন্নয়ন কমিটি। এর সভাপতি জেলা প্রশাসক। এই কমিটিতে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
উপজেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ এবং লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটককের নিরপত্তার দিকটি মূলত পর্যটন পুলিশ দেখভাল করে। তবে তাদেরও রয়েছে লোকবল সংকট।
জাফলংয়ের ট্যুরিস্ট পুলিশের ওসি রতন শেখ বলেন, ‘ছুটির সময়ে এখানে পর্যটকের এতো ভিড় হয় যে ট্যুরিস্ট পুলিশের অল্প লোকবল দিয়ে তা সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তবু আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করি।
‘ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাইনবোর্ড টানানো আছে। মাইকিং করেও সতর্ক করা হয়। তবে অনেকে তা শুনতে চান না। পর্যটকদের অসচেতনতা ও নির্দেশনা না মানার কারণেই প্রাণহানির ঘটনাগুলো ঘটছে।’
জাফলং ও বিছানাকান্দি পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এই দুই স্থানে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার পর্যটন কেন্দ্রে সতর্কতামূলক বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। তবে বন্যার পানিতে সেগুলো ভেসে গেছে।’
তিনি বলেন, মৌখিকভাবেও পর্যটকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু ভ্রমণে আসা মানুষের মধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞা শোনার প্রবণতা কম থাকে।’
প্রবল স্রোতের পানিতে না নামা এবং পানিতে নামলে লাইফ জ্যাকেট পরার দিকে নজর রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সাদা পাথরে পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও লুসিকান্ত হাজং বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে হ্যান্ডমাইক নিয়ে দুজন স্বেচ্ছাসেবী সার্বক্ষণিক পর্যটন কেন্দ্রে থাকেন। তারা পর্যটকদের স্রোতের পানিতে না নামার আহ্বান জানান। নৌকার ঘাটে সাইনবোর্ড দিয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পানিতে না নামতে নির্দেশনা দেয়া আছে। এরপরও পর্যটকরা এগুলো শুনতে চান না।’
পর্যটকদের সতর্ক করার জন্য ঘাটে মাইক লাগানো এবং নৌকার টিকিটের পেছনে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়ে প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের আট সদস্য। রাজধানীর মতিঝিলে ড. কামাল হোসেনের কার্যালয়ে শনিবার তারা এই সাক্ষাৎ করেন।
কমিশন প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, ফিরোজ আহমেদ ও মো. মুসতাইন বিল্লাহ।
ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে এই সাক্ষাতের সময় সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয় বলে জানান সংবিধান সংস্কার কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত জনসংযোগ কর্মকর্তা ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপ-পরিচালক মো. সাব্বির মাহমুদ।
এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ড. কামাল হোসেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানসহ উপস্থিত সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়ায় আস্থা প্রকাশ করেন। তিনি সংবিধানকে সমসাময়িক করার কথা উল্লেখ করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন।
দেশ থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে ধারণা করা যায় যে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে।
রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে শনিবার ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উপায়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মোট কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়। তবে ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক মাধ্যম ব্যবহার করে ১৭ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচারের কথা জানা যায়।’
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বলয় প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসা- এই ত্রিমুখী আঁতাত মূল ভূমিকা পালন করেছে।
‘সব প্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘ সময় ধরে দলীয়করণের চর্চা হয়েছে। গত ১৫-১৬ বছরে আমরা এর চূড়ান্ত রূপ দেখেছি। এতে আমলাতন্ত্রকে কর্তৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক শক্তি আর তা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন এজেন্সিকে। ফলে এসব জায়গায় কতটুকু পরিবর্তন আনা যাবে, তা গুরুত্বপূর্ণ।’
‘যে পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশা করছি তা যেন টেকসই হয়’, যোগ করেন তিনি।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি দৃষ্টান্ত আছে। সেটি হলো, সিঙ্গাপুর থেকে। দেশটি থেকে ২০০৭ সালে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে ২০১৩ সালে ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৯৩০ কোটি ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়েছিল।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে তা অনেক কঠিন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে, ওইসব দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেশগুলোর এ বিষয়ে সহযোগিতার মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘অর্থ পাচার বন্ধে সাপ্লাই (যে দেশ থেকে পাচার হয়) ও ডিমান্ড (যে দেশে পাচার হয়) উভয়ের মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশ থাকতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে সহযোগিতা করতে বিভিন্ন দেশে বিশেষজ্ঞদের সিন্ডিকেট আছে। সে কারণে আমরা একজন সাবেক মন্ত্রীর কয়েকটি দেশে কয়েক শ’ অ্যাপার্টমেন্টের বিষয়ে জানতে পারছি। কিন্তু এই ঘটনা বরফখণ্ডের চূড়ামাত্র, এমন পাচারকারী আরও অনেকে আছেন।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, এনবিআর, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, বিএফআইইউ- অর্থ পাচার বিষয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার পথনকশা আছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে, শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না। অর্থ পাচার রোধে বেশ কিছু আইনেরও প্রয়োজন আছে।’
আরও পড়ুন:কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে একটি সাদেকপুর। এই ইউনিয়নের একটি দাঙ্গাবাজ গ্রাম মৌটুপী। সাত হাজার মানুষের ওই গ্রামে রয়েছে দুটি প্রভাবশালী পরিবার- কর্তা বংশ আর সরকার বংশ।
সাদেকপুর ইউনিয়নে দুই বংশের নেতারাই বার বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসছেন। বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগ সদস্য সরকার মো. সাফায়েত উল্লাহ সরকার বংশের লোক। এর আগে তার বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক তিনবার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন।
সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি তোফাজ্জল হক কর্তা বংশের লোক। দুই বংশের দুই চেয়ারম্যান এখন তাদের নিজ নিজ বংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে গ্রামে আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জেরে দুই বংশের ১৭ জন খুন হয়েছেন। এতে কমপক্ষে শতবার সংঘর্ষ, বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বার বার মারামারি-সংঘর্ষে আহত হয়েছেন কমপক্ষে এক হাজার মানুষ।
সবশেষ গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) দুপুরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে কাইয়ূম মিয়া নামে সরকার বাড়ির এক ব্যক্তি খুন হন। আহত হন অন্তত ৫০ জন। এর কয়েক দিন আগে ইকবাল মিয়া নামে একই বংশের এক যুবক খুন হন।
গত ঈদুল আজহার পরদিন নাদিম মিয়া নামে কর্তা বংশের এক ব্যক্তি খুন হন। এর আগে ২০০৫ সালে সরকার বাড়ির সরকার সাফায়েত উল্লাহ চেয়ারম্যানের আপন দুই ভাই ওবাইদুল্লাহ ও হেদায়েত উল্লাহ ও তার এক চাচা সায়দুল্লাহ মিয়া কর্তা বংশের লোকজনের হাতে খুন হয়।
আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জের ধরে এভাবে আরও বেশকিছু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষ-ভাংচুর লেগেই আছে। এসব খুন-সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও অর্ধশত মামলা আদালতে চলমান। আসামির সংখ্যা দুই বংশের কয়েক শ’ হবে।
তাৎপর্যের বিষয় হলো, দুই বংশের নেতৃত্ব দেয়া দু’জন বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যান কেউ এলাকায় থাকেন না। নিজেদের বাড়িঘর থাকলেও তারা ভৈরব শহরে বসবাস করেন। আর প্রভাব বিস্তারের জন্য নেপথ্যে থেকে এলাকায় ঝগড়া-বিবাদ লাগিয়ে রাখেন।
একাধিক খুনের মামলার আসামি সরকার বংশের ‘মাথা’ মো. সাফায়েত উল্লাহ সরকার ও কর্তা বংশের ‘কর্তা’ তোফাজ্জল হক। তারা কখনও আদালত থেকে জামিন নেন, আবার কখনও নেন না। পুলিশের ভাষায় তারা পলাতক।
মামলার আসামি গ্রেপ্তার করতে পুলিশ মৌটুপী গ্রামে যায় না। ঝগড়া-সংঘর্ষ হলেও পুলিশ তাৎক্ষনিখ ওই গ্রামে যেতে চায় না। কারণ দাঙ্গাবাজ গ্রামে যেতে পুলিশও ভয় পায়। কখনও গেলেও ব্যাপক আয়োজন করে অর্ধশত পুলিশ সদস্যকে দল বেঁধে যেতে হয়। নয়তো উল্টো পুলিশকেই হামলার শিকার হতে হয়।
স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বহুবার চেষ্টা করেও দুই বংশের বিরোধ মীমাংসা করতে পারেননি। বিশেষ করে দুই চেয়ারম্যান মীমাংসায় সম্মতি দেন না। তারা মামলা জিইয়ে রাখতেই যেন বেশি আগ্রহী। এলাকায় তারা মামলাবাজ হিসেবে চিহ্নিত। কারণ মামলা হলেই তাদের অর্থ-বাণিজ্য জমে ওঠে। কোনো পক্ষ কোনো ঘটনায় মামলা করলে আসামি করার ভয় দেখিয়ে তারা লোকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করেন। আবার চার্জশিট থেকে নাম প্রত্যাহারের নামেও চলে তাদের ‘বাণিজ্য’। তবে তারা দু’জনই এসব কথা অস্বীকার করেছেন।
মৌটুপী গ্রামের বাসিন্দা মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমরা অন্য বংশের লোক হয়েও এসবের বাইরে থেকে বাঁচতে পারি না। কোনো না কোনো বংশকে সমর্থন করতে হয়।
‘গত ৫৪ বছরে এই গ্রামে কমপক্ষে দেড় ডজন খুন হয়েছে, আহত হয়েছে হাজারের উপরে। মামলা হয়েছে শত শত। এসব বিরোধের হোতা দুই বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ ও তোফাজ্জল হক।’
একই গ্রামের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘মৌটুপী গ্রামে দুজন নেতার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুগের পর যুগ ধরে ঝগড়া-বিবাদ ও খুনোখুনি চলছে। এই দু’জনই ঝগড়ার হোতা। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে মৌটুপী গ্রাম নীরব হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে কর্তা বাড়ির নাদিম খুন হলে সরকার বাড়ির অন্তত দুশ’ বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পালিয়ে যায় সরকার বাড়ির শত শত পরিবারের লোকজন। পরে সরকার বংশের ইকবাল খুন হলে কর্তা বংশের শতাধিক বাড়িঘর লুটপাট হয়।
‘গত বৃহস্পতিবার তারা বাড়ি এলে আবারও সংঘর্ষ বাধে। খুন হন কাইয়ূম। মানুষ বলছে, দুই চেয়ারম্যানকে পরবাসে পাঠালে গ্রামের বিরোধ থামবে, নতুবা নয়।’
এ বিষয়ে সরকার বংশের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সরকার মো. সাফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘কর্তা বাড়ির বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হক এই বিরোধ লাগিয়ে রেখেছে। তারা আমার দুই ভাই ও চাচাকে হত্যা করেছে। গত শুক্রবারের সংঘর্ষের নায়ক সে, আমি নই। গ্রামের যেকোনো মীমাংসায় আমি রাজি। কিন্ত তোফাজ্জল হক মীমাংসায় রাজি নয়। গ্রামের দাঙ্গার জন্য সে-ই দায়ী।’
অপরদিকে কর্তা বংশের বিএনপি নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হক বলেন, ‘৫৪ বছর আগে সাফায়েতের বাবা আমার বংশের কফিল উদ্দিনকে গলা কেটে হত্যা করে। ক’দিন আগে খুন করল আমার ভাই নাদিমকে। আরও কয়েকজনকে খুন করেছে। আমি গ্রামে থাকি না, থাকি ভৈরব শহরে। অথচ একাধিক ঘটনায় সাফায়েত আমাকে মামলার আসামি করেছে। তাহলে কিভাবে মীমাংসা করব।’
এ বিষয়ে ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ হাসমত উল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে গ্রামের দুই চেয়ারম্যানের বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার চলছে জানলাম। স্থানীয় জনগণ মৌটুপীকে দাঙ্গাবাজ গ্রাম বলে ডাকে।
‘আমি দুই মাস হলো এই থানায় যোগদান করেছি। এরই মধ্যে একজন খুন হলো মৌটুপী গ্রামে। এ নিয়ে দুই বংশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা দমন ও নিয়ন্ত্রণে আমি চেষ্টা করছি।’
ঢাকার মিরপুর-১৪ ও কচুক্ষেত এলাকায় বৃহস্পতিবার সকালে সংঘর্ষের সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছেন সেনা সদস্যরা।
সেনাবাহিনীর একটি দল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শুক্রবার অভিযান চালায়।
সে অভিযানে ভাষানটেক থেকে তিনজনকে আটক করা হয় বলে জানায় আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
আটক তিনজন হলেন রিফাত, হৃদয় ও ইয়াছিন। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ ও আইনি পদক্ষেপের জন্য ভাষানটেক থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিবৃতিতে আইএসপিআর জানায়, ইচ্ছাকৃতভাবে সেনাবাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার ঢাকার মিরপুর-১৪ ও কচুক্ষেত এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পাথর নিক্ষেপ করেন এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এতে দুই পোশাকশ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন।
আরও পড়ুন:ব্যাংকিং খাতকে লক্ষ্যবস্তু করে সাইবার হামলা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ায় সব তফসিলি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পেমেন্ট সেবাদানকারীদের সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ সাইবার সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের (বিসিএসআই) নিয়মিত তথ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের পর শুক্রবার এই সতর্কতামূলক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কিছু ব্যাংক ডুয়াল-কারেন্সি কার্ডে ফেসবুক অ্যাড ম্যানেজার ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত অবৈধ লেনদেনের শিকার হয়েছে, যা দেশব্যাপী সাধারণ গ্রাহকদের প্রভাবিত করছে।
নির্দেশনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় সাইবার অপরাধীদের ক্রমবর্ধমান কার্যকলাপকে তুলে ধরেছে, যারা অনবরত জনসাধারণ এবং ব্যাংক গ্রাহকদের একইভাবে হয়রানি করছে।
সাইবার হামলার এই ঊর্ধ্বগতি শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী সাইবার হুমকি বৃদ্ধির প্রবণতাকে চিহ্নিত করে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে, যেখানে ম্যালওয়্যার আক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বার বার ঘটে থাকে।
এসব সাইবার হুমকি প্রতিরোধে তথ্য আদান-প্রদান, যাচাইকরণ বৃদ্ধি, ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) ব্যবহার, টু-ফ্যাক্টর/মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন, লগইন প্রচেষ্টার সংখ্যা সীমিত রাখাসহ বেশ কিছু জরুরি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকটি বর্ণিত ঝুঁকির বিষয়ে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের পরিচালক (আইসিটি) তদারকি করবেন বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:রাজধানীর কাকরাইল ও আশপাশের এলাকায় শনিবার সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
শুক্রবার ডিএমপি কমিশনার ময়নুল হাসানের সই করা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
ডিএমপি অধ্যাদেশের ২৯ ধারা অনুযায়ী এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকা থেকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা’ ব্যানারে মশাল মিছিল বের হয়। জাতীয় পার্টিকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে দলটির কার্যালয় ঘেরাও করতে বিজয়নগর এলাকায় মিছিল নিয়ে যায় ছাত্র-জনতা। এ সময় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে থাকা নেতাকর্মীরা মিছিলে হামলা করেন। কার্যালয় থেকে মিছিলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন মিছিলকারী আহত হন।
পরে মিছিলকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে এসে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ভাংচুর করে। এ সময় কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
জাপা চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আগামীকাল শনিবার কাকরাইলে জাতীয় পার্টি সমাবেশ করবে।’
বিএনপির কর্মী মকবুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকা থেকে সাবেক এই মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শুক্রবার উবায়দুল মোকতাদিরকে হাজির করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন মডেল থানার উপ-পরিদর্শক নাজমুল হাসান সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে দশ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন।
উবায়দুল মোকতাদিরের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেরা মাহবুব জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মন্তব্য