এক বছর ধরে ক্রমাগত কাশিতে ভুগছিলেন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার নুর আলম। তিনি আধুনিক চিকিৎসা পাওয়ার আশায় রামপাল থেকে খুলনা শহরের বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে এসেছিলেন। তবে ক্লিনিকে প্রবেশ করার আগে প্রধান ফটকে এসে থমকে যান তিনি।
নুর আলম বলেন, ‘আমি ভাবছিলাম, আমি কি ভুল করে এখানে চলে এসেছি। চুর্ণবিচুর্ণ দেয়াল ও টিনের ছাদের ভবন দেখেই আমি বুঝে গেছি, ভেতরে কোনো ভালো চিকিৎসা হয় না।’
‘যেহেতু অনেক দূর থেকে এসেছি, আবার রোগও সারছে না। তাই আশা নিয়ে ভেতরে গেলাম। তবে সেখানে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। একজন কর্মচারী পরীক্ষার জন্য আমার কফ সংগ্রহ করেন। পরে একজন নার্স রিপোর্ট দেখে আরেক কর্মচারীকে বলেন আমাকে কিছু ওষুধ দিতে।’
‘সেখান থেকে ওষুধ নিয়ে যখন বের হচ্ছিলাম, তখনো ক্ষোভে বুকের ব্যাথা আরও বেড়ে গেল। কারণ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে আমাকে ৬০০ টাকার বেশি খরচ করতে হয়েছে। আমি মনে করি আমার এই টাকাটা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে।’
খুলনার সরকারি বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন নুর আলম।
সেখানে ১৭ বছর ধরে কাজ করা একজন কর্মচারী জানান, তিনি যোগদান করে একটি এক্স-রে মেশিন দেখতে পেয়েছেন। তবে কখনো সেই মেশিনটি ব্যবহার করা হয়নি। তার মতে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মেশিনটি অকেজো হয়ে আছে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির দিনে, টিনের ফুটা দিয়ে পানি পড়ে। এতে মেঝে ও দেয়াল ভিজে যায়। এ ধরনের ভবনে কখনো ভালো চিকিৎসা হতে পারে না।
‘বক্ষব্যাধি ক্লিনিক হলেও, এখানে প্রায় সব যক্ষ্মা রোগীরা আসেন। শুধু থুথু পরীক্ষার মাধ্যমে যক্ষ্মা শনাক্ত করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। একটি ভালো এক্স-রে মেশিন এখানে পরীক্ষার জন্য খুবই প্রয়োজন।’
একজন মেডিক্যাল অফিসারই ক্লিনিকের একমাত্র চিকিৎসক। কিন্তু প্রায়ই তিনি অনুপস্থিত থাকেন। আর এখানে ১২ জন জনবলের মধ্যে ৫টি পদ ফাঁকা রয়েছে।
ক্লিনিকের একমাত্র পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিলীপ কুমার দাস বলেন, ‘আমাদের ভবনে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই প্রতিদিন পাশের পুকুর থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে আসতে হয়। কারণ কফ সংগ্রহ করার সময়ে রোগীরা পানি চাই।’
ক্লিনিকের আরও কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা ধানাধীন নিউ মার্কেট এলাকায় ১৯৬২ সালে ওই ভবনটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে যার দেয়ালের প্লাষ্টার খুলে পড়ছে, টিনের চালগুলি ফুটা হয়েছে গেছে।
শুধু এই ক্লিনিকটি নয়, খুলনা শহরের মীরেরডাঙ্গায় ৭ একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত ১০০ শয্যা বিশিষ্ট খুলনা বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অবস্থাও একই। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৫ সালে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হলেও গত ৫৮ বছর সেখান নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হয়নি।
বর্তমানে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিতে চলছে কোনো মতে চিকিৎসা। দ্বিতল ভবনের সবগুলো ওয়ার্ড ও রুমের ছাদের প্লাষ্টার খসে পড়ছে। ভবনের ছাদ স্যাঁতসেঁতে হয়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। রোগীদের জন্য টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ব্লাড, এক্সরে, ইসিজি ছাড়া অন্য কোনো রোগের পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই।
১০০ শয্যার ওই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেখানে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের ১৮৪ জন জনবলের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১২২ জন। এর মধ্যে দুজন বিশেষজ্ঞসহ ১১ জন চিকিৎসকের পদ রয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক ও বাকি চারজন মেডিক্যাল অফিসার এখন কর্মরত রয়েছেন, বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক সেখানে নেই।
তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, ‘হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু আন্তঃবিভাগে ভর্তিকৃত যক্ষ্মা বা টিবি রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী ছয় মাস থেকে ৯ মাস পর্যন্ত চিকিৎসা দেয়া হয়। জরাজীর্ণ ভবন এবং পরিত্যক্ত আবাসিক ভবনগুলো মেরামতের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। খুলনা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (এইচইডি) এসব ভবন পুনঃনির্মাণের জন্য প্রাক্কলন তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।’
খুলনার সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ বলেন, ‘বক্ষব্যাধি ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোর সমস্যা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। তবে সমস্যা হলো, চিকিৎসকরা সেখানে কাজ করতে চান না। সেখানে কেউকে পদায়ন করলে, তারা নানাভাবে বদলি হয়ে যান।’
পর্যবেক্ষণ চিকিৎসা বঞ্চিত যক্ষ্মা রোগীরা
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, ‘যক্ষ্মা এমনি একটি রোগ যা নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন। এর মধ্যে একনাগাড়ে রোগীকে ৬ মাস থেকে ৯ মাস ওষুধ সেবন করতে হব এবং কোনো একদিন বিরত থাকা উচিত নয়।
‘প্রায় দেখা যায়, প্রথম ১০ দিন ওষুধ সেবনের পরে রোগীর কাশি বন্ধ হয়ে গেছে ও বুকে ব্যাথা কমে গেছে। তখন তিনি ওষুধ সেবন করা বন্ধ করে দেন। এতে কিছুদিন পরে তার আবারও সেই রোগ শুরু হয়। আর পরে যেটা হয়, সেটা আরও ভয়ংকরভাবে হয়।’
তিনি বলেন, ‘যক্ষ্মা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা একটি রোগ। ওষুধের ডোজ পূর্ণ না করলে সেই সব ব্যাকটেরিয়া মারা যায় না। তাদের কিছু ব্যাক্টেরিয়া বেঁচে থাকে। তাখন ওষুধে কাজ করতে চায় না। মাল্টি ড্রাগ বা ড্রাগ রেজিস্টেন্স। আগে যেখানে ৬ বা ৯ ওষুধ খেলে রোগ ভালো হত, শরীরে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্স সৃষ্টির কারণে এবার সেই রোগীকে ওষুধ সেবন করতে হতে পারে ১৮ মাস পর্যন্ত। আর এই যক্ষা ছড়িয়ে যেতে পারে ফুসফুসসহ এটি শরীরের অন্যান্য অংশেও, যেমন মস্তিষ্ক, কিডনি বা মেরুদণ্ডে।’
তিনি বলেন, ‘যক্ষ্মা রোগীদের জন্য সব থেকে কর্মকরী চিকিৎসা হল সরাসরি পর্যবেক্ষণ চিকিৎসা (ডাইরেক্ট অবজারবেশন ট্রিটমেন্ট –ডিওটি)। যেখানে একজন অভিজ্ঞতা সম্মন্ন চিকিৎসক বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মী যক্ষ্মা রোগীকে নির্ধারিত ওষুধ খাওয়া নিশ্চিত করতে পারেন। ডিওটি’র মাধ্যমে রোগীরা দ্রুত ডোজ সম্পন্ন করেন, অসম্পূর্ণ চিকিত্সার ফলে ড্রাগ রেজিস্টেন্স সৃষ্টি হয় না, একই রোগী পুনরায় সংক্রমিত হন না ও অন্যকে সংক্রমিত করেন না। আমাদের দেশে বক্ষব্যাধি হাসপাতালগুলির এই সেবা নিশ্চিত করা উচিত। তবে কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ওপর এই দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তা সঠিক মনিটরিং কম হয়।’
যক্ষ্মায় প্রতিদিন দেশে মারা যায় ১২০ জন
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের অধীনে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনটিপি), যক্ষ্মা প্রতিরোধে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার (ডাব্লিউএইচও) ২০২২ সালের যক্ষ্মা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে এনটিপি জানায়, বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ যক্ষ্মায় সংক্রমিত হয়, আর এর মধ্যে মারা যায় ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি।
এনটিপি’র লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, ‘ডাব্লিউএইচও ২০২২ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের ২০২১ সালের যক্ষ্মা রোগের পরিসংখ্যান রয়েছে। আর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি, সেখানে ২০২২ যক্ষ্মা রোগের পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের নতুন করে বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৬২ জন। এই সময়ে মোট ২৯ লাখ মানুষ যক্ষ্মার পরীক্ষা করেছেন। আর মারা গেছেন ৪২ হাজারের বেশি। অর্থাৎ প্রতিদিন মারা যান প্রায় ১৫৫ থাকে ১২০ জনের কাছাকাছি।’
ডাব্লিউএইচও পৃথিবীর ৩০ টি দেশকে উচ্চ যক্ষ্মাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর করোনার পরে বৈশ্বিক মহামারিতে যক্ষ্মারই অবস্থান রয়েছে বলে জানান তিনি।
ডা. মো.মাহফুজার রহমান সরকার আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সফল হয়েছে।
ডাব্লিউএইচও’র প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত প্রতি লাখে মারা যেত ৫৪ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন ও ২০২১ সালে মারা গেছে ২৫ জন। সুতরাং আমরা মৃত্যুর হার অনেক কমিয়েছি।’
তিনি জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে এনটিপি পরিচালিত ৭টি হাসপাতাল, ৪২টি ক্লিনিকসহ সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যক্ষ্মার চিকিৎসা দেয়া হয়। এ সকল হাসপাতালে ৫০০ বেশি জিন এক্সপার্ট মেশিন, ১১৯টি মাইক্রোস্কোপ, ২০৫টি ডিজিটাল এক্সরে ও ৩৮টি ট্যুয়েন্ট রয়েছে, যা দিয়ে যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করা হয়।
আরও পড়ুন:ভারত ও পাকিস্তানের চলমান সংঘাতকে ঘিরে যশোরের ৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। তবে বিজিবি টহল জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোয় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
বিজিবির দেওয়া তথ্যমতে, যশোরে ৭০ কিলোমিটার এই সীমান্ত রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সাতক্ষীরার ৭০ ব্যাটালিয়ন রয়েছে। সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নীরব নজরদারির সঙ্গে বিজিবি জোরদার করেছে টহল। এলাকাবাসীও সীমান্তের দিকে নজর রাখছেন।
সীমান্তবাসী আল মামুন জানিয়েছেন, এখনও যশোর সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বিএসএফের অপতৎপরতায় কোনো প্রকার অনুপ্রবেশ বা চোরাচালান বিজিবির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিহত করতে প্রস্তুত এলাকাবাসী।
সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের থাকলেও এই সীমান্ত এখন স্বাভাবিক। তবে আগে ৫০০ গজ অন্তর একজন বিএসএফ সদস্য দায়িত্ব পালন করলেও এখন ৩০০ গজ অন্তর দেখতে পাওয়া গেছে। এটা কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছে। যদি বিএসএফ কোনোরকম তৎপরতা দেখায়, তাহলে বিজিবিকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।’
৪৯ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী জানান, সীমান্তে বিজিবিকে কঠোর আবস্থানে রাখা হয়েছে।
নিরাপওা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ভারত থেকে যাতে কোনো অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সেজন্য বিজিবিও টহল ব্যবস্থা জোরদার করেছে।
বঙ্গোপসাগরের মোহনা ও ৯০ কিলোমিটার পায়রা নদীতে অবাধে অবৈধ জাল দিয়ে রেণু পোনার সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা নিধন করছে জেলেরা। এতে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
মৎস্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ অবৈধ সুবিধা নিয়ে পোনা নিধনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এমন অভিযোগ সচেতন জেলেদের। এতে অসাধু রেণু পোনা ব্যবসায়ীরা আরও উৎসাহিত হচ্ছেন।
দ্রুত রেণু পোনা নিধনের সঙ্গে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সাগর ও পায়রা নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন জেলেরা।
জানা গেছে, বছরের মধ্য ফাল্গুন থেকে শুরু করে মধ্য জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চিংড়ি ও বাগদা মা-মাছ সাগরের মোহনা ও নদ-নদীর মিঠা পানিতে রেণু পোনার জন্ম হয়। বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত রেণু পোনা মিঠা পানিতে থাকে। ওই সময় জেলেরা অবৈধ মশারি জাল ফেলে ওই পোনাগুলো শিকার করেন। এ রেণু পোনা শিকারের সঙ্গে আমতলী-তালতলী উপজেলার অন্তত ৩০ হাজার জেলে পরিবার জড়িত। প্রতিদিন তারা অন্তত এক কোটি রেণু পোনা আহরণ করেন। ওই রেণু পোনার সঙ্গে অন্তত ১০ গুণ বিভিন্ন প্রজাতির পোনা নিধন হচ্ছে। এতে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
দাদন ব্যবসায়ীরা জেলেদের থেকে ১০০ চিংড়ি ও বাগদা রেণু পোনা ১৫০-২০০ টাকা দরে ক্রয় করেন। ওই পোনা খুলনা, বাগেরহাট ও যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার ঘের মালিকদের কাছে ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে গত আড়াই মাসে অন্তত কয়েকশ কোটি টাকার চিংড়ি ও বাগদার রেণু পোনা আহরণ করেছেন জেলেরা।
অভিযোগ রয়েছে দাদন ব্যবসায়ীরা উপজেলা মৎস্য অফিস, পুলিশ ও নৌপুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে অবৈধ নেট মশারি জাল ফেলে জেলেদের দিয়ে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ রেণু পোনা শিকার করাচ্ছে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মিল রেখে জেলেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় পড়ে ওই রেণু পোনা শিকার করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ী বলেন, তালতলী উপজেলা মৎস্য অফিসার ভিক্টর বাইনকে প্রতি মাসে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। ফলে তারা অবাধে জেলেদের থেকে রেণু পোনা সংগ্রহ করে গাড়িতে রপ্তানি করতে পারছেন। তারা আরও বলেন, পুলিশ ও নৌপুলিশ সবাই এ বিষয়টি জানে।
আমতলী-তালতলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নারী-পুরুষ ও শিশুরা নেট মশারি জালের মাধ্যমে বাগদা ও চিংড়ির রেণু পোনা শিকার করছে। লাভজনক হওয়ায় জেলে পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুরা এ পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন।
আমতলী-তালতলী উপজেলার শতাধিক পয়েন্টে আড়তদাররা জেলেদের থেকে রেণু পোনা সংগ্রহ করে গভীর রাতে মিনি ট্রাক, মোটরসাইকেল ও বাসে করে খুলনা, বাগেরহাট, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করছে।
গতকাল দুপুরে তালতলী উপজেলার রেণু পোনার আড়তদার দুলাল মিয়ার আড়তে গিয়ে দেখা গেছে, আড়ত ঘরের সামনের তালা দেওয়া, পেছনের দরজা দিয়ে জেলেরা পোনা নিয়ে আসেন। দুলালের কর্মচারী শহিদুল ইসলাম ওই পোনা গণনা করে পাত্রে রাখছেন।
জেলে মালেক ও জয়নাল বলেন, জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মিল রেখে রেণু পোনা শিকার করতে হয়। রেণু পোনা শিকার করা অন্যায় কিন্তু কেউ তো নিষেধ করছে না। তারা আরও বলেন, মহাজনদের যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে রেণু পোনা আহরণে আসতে হয়।
শিশু নাদিম বলেন, ‘হুনছি পোনা ধরা নিষেধ কিন্তু স্যারেরা তো মোগো মানা হরে নাই।’
তালতলীর অবৈধ বাগদা রেণু পোনা ব্যবসায়ী বশির হাওলাদার বলেন, ‘বাগদা ও চিংড়ির রেণু আহরণ নিষিদ্ধ তা জানি। কিন্তু জেলেরা নিয়ে এলে আমরা তো ফেলে দিতে পারি না। তারা আরও বলেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, নৌপুলিশ ও থানা পুলিশ সবই জানেন, তারা তো কিছু বলেন না। শুধু আপনারাই (সাংবাদিক) মোদের ডিস্টার্ব করেন।’
তালতলী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ১২টা অভিযান চালানো হয়েছে। বেশ কিছু জাল পুড়ে ফেলেছি।’ উপজেলা শহরের নিকটবর্তী দুলাল মিয়া ও বশির উদ্দিনের আড়তে রেণু পোনা জেলেদের থেকে সংগ্রহ করে গাড়িতে চালান করছে, এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা নিয়েছেন? এমন প্রশ্নের তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি।
আমতলী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তন্ময় কুমার দাশ বলেন, অবৈধ রেণু পোনা নিধন বন্ধে অভিযান পরিচালনা করে শতাধিক নেট মশারি জাল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং অভিযান অব্যাহত আছে।
তালতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মে সামলা বলেন, রেণু পোনা আহরণ অবৈধ। রেণু পোনা নিধন বন্ধে প্রতিদিন অভিযান অব্যাহত আছে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান বলেন, উপজেলা মৎস্য অফিসারকে নিয়ে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়।
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসিন বলেন, রেণু পোনা নিধন রোধে অভিযান অব্যাহত আছে। উপজেলার কোনো মৎস্য কর্মকর্তা রেণু পোনা নিধনের যোগসাজশের সঙ্গে জড়িত থাকলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সফিউল আলম বলেন, ‘যারা অবৈধভাবে রেণু পোনা মজুত করে বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি ও পরিবহনের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এ মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেব।’
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও আওয়ামী নেতা শেখ মো. নিজামের বালুর রাজ্যে হানা দিয়েছেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নাহিদুর রহমান।
বুধবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার পশ্চিম উজানচর এলাকায় শেখ নিজামের মালিকানাধীন গোধূলি পার্কে অভিযান চালিয়ে সেখানকার বিশাল জলাশয় থেকে বালু উত্তোলনের দায়ে ৩টি ড্রেজার মেশিনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং ৫টি বালুবাহী ট্রাক জব্দ করেন ইউএনও।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে শেখ নিজাম সেখানে তার ক্রয়কৃত কয়েক শ বিঘা জমিতে মৎস্য প্রকল্পের পুকুর খননের নামে বিপুল পরিমাণ মাটি ও বালু উত্তোলন করে আসছিলেন। এভাবে সেখানে পুকুরের নামে বড় বড় দিঘির সৃষ্টি করে তিনি কোটি কোটি টাকার মাটি ও বালু বিক্রি করেন।
এ বিষয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধেও ছিল সহায়তার অভিযোগ। প্রকল্পের আশপাশের বহু লোকের কৃষি জমি ওই জলাশয়ে ধসে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। হয়েছে একাধিকবার মানববন্ধন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে অনেক সংবাদ।
কিন্তু শেখ নিজাম রাজবাড়ীর সাবেক এমপি ও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর একান্ত স্নেহধন্য হওয়ার সুবাদে সেখানে প্রশাসন কখনোই কোনো ধরনের অভিযান চালায়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। কাজী কেরামত আলী বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত তিন দিনে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে মোট ৪টি ড্রেজার মেশিন ধ্বংস এবং মাটি ও বালু পরিবহনের দায়ে ১০টি মাটি বহনকারী ড্রাম ট্রাক জব্দ করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাহিদুর রহমান।
এদিকে গত ৬ মে মঙ্গলবার বিকেলে উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের মাখন রায়ের পাড়া এলাকায় মরা পদ্মা নদী হতে বালু উত্তোলনের দায়ে শহিদ নামের এক বালু ব্যবসায়ীর একটি ড্রেজারের ৫০-৬০টি পাইপ ধ্বংস করে উপজেলা প্রশাসন।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে সহায়তার অভিযোগ এনে স্থানীয় দুলাল বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির উপর চড়াও হয়েছেন বালু ব্যবসায়ী সহিদ ও স্থানীয় ইউপি সদস্য লিপু মন্ডল।
তবে ইউএনও নাহিদুর রহমান জানান, লিপু মন্ডলের সেখানে একটি সরকারি রাস্তায় বালু ফেলার কথা থাকলেও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে বালু ফেলা হচ্ছিল। সে জন্য সেখানে অভিযান চালানো হয়েছে। দুলাল বিশ্বাস বা এলাকার অন্য কেউ এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেনি।
ইউএনও আরও জানান, অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন কিংবা নদী ও জলাশয় হতে বালু উত্তোলন বন্ধ করে সড়কে জান-মালের নিরাপত্তা ও ক্ষতিরোধ নিশ্চিত করতে এ ধরনের অভিযান আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও চলবে।
অভিযানে আটক করা মাটিবাহী ড্রাম ট্রাকগুলোর চালকরা পলাতক রয়েছেন। মালিকরা এলে তাদের কাছ থেকে বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা আদায়সহ সতর্ক করা হবে।
বেগমগঞ্জ উপজেলা উপজেলা নির্বাচন অফিস অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। টাকা না দিলে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়। এই অফিসের ঘুষ ও দুর্নীতির বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) ভুক্তভোগীরা পোস্ট দিচ্ছেন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ভোটার জটিলতার কারণে নাগরিক নানান সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নতুন ভোটার হওয়া, জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল সংশোধন ও ভোটার স্থানান্তরসহ সব কাজেই গুনতে হয় টাকা। ২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলা থেকে নির্বাচন অফিসার বুলবুল আহমেদ এখানে যোগদান করেন। যোগদানের পরেই তিনি বিভিন্ন ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রবাসীরা তাদের ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করতে এলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তিনি ঘুরাতে থাকেন। পরে জরুরী ভিত্তিতে করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মোট অংকের টাকা দাবি করেন ওই কর্মকর্তা। তার অফিসে প্রায় ১ হাজার সেবা প্রার্থীর ভোটার স্থানান্তর ও সংশোধনের তদন্ত প্রতিবেদন আটকে রয়েছে। এই কর্মকর্তাকে ৩ বছর আগে এ ধরনের অনিয়ম ও সেবাপ্রার্থীদের সাথে দুর্ব্যবহার করায় কুমিল্লার সদর থেকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায়।
সরেজমিনে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, দুপুরের দিকে নির্বাচন অফিসের সামনে ও বিভিন্ন কক্ষের ভেতর সেবাগ্রহীতাদের ঘুরতে দেখা যায়। নির্বাচন কর্মকর্তা ভিড় ঠেকাতে অফিসের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রাখেন। নতুন আইডি কার্ড করতে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে শতাধিক সেবাগ্রহীতা এসেছেন। বেশ কয়েকজন দালাল অফিসের ভেতরে অবস্থান করে। সেবা গ্রহীতারা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই অফিসের পিয়ন শহীদ রুমে ঢুকতে দেন। পরে মেলে কাজের রাস্তা। দালালদের অধিকাংশই নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মচারীদের সাথে রয়েছে সখ্যতা।
ভুক্তভোগী শাহিদুর রহমান অভিযোগ করে জানান, গত ৩০ এপ্রিল বেলা ২ টার দিকে নতুন ভোটার হতে বেগমগঞ্জ নির্বাচন অফিসে যান। নির্বাচন কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ আবেদনে কাগজপত্রের ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে তাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। তিনি একইভাবে অন্যান্য নতুন ভোটারদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন।
বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর গ্রামের শাকিল তার ফেইসবুক আইডিতে লিখেছেন, তিনি এরআগে এনআইডি সংশোধন করতে উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়েছিলেন। নির্বাচন কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ সংশোধন হবে না মর্মে জানিয়ে দেন। পরে তার কাছে সংশোধন করিয়ে দিতে ১০ হাজার টাকা ঘুষ করেন। দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় তার সাথে দুর্ব্যবহার করে ওই কর্মকর্তা তার রুম থেকে তাড়িয়ে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেগমগঞ্জ নির্বাচন অফিসের এক কর্মচারী অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ এই অফিসে যোগদান করার পর অনিয়ম ও দুর্নীতি বেড়েছে। তিনি নিজেই সেবা প্রার্থীদের কাছে এনআইডি সংশোধন, স্থানান্তর ও নতুন ভোটার হতে ঘুষ নেন। আর সেবা প্রার্থীদের সাথে প্রতিদিন দূর ব্যবহার করে থাকেন। বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, নতুন ভোটার হতে সেবা প্রার্থীরা ত্রুটিপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে আসেন। তাই তিনি একটু রাগান্বিত হন। এখান থেকে সেবা না পেয়ে ফিরে যাওয়া লোকজনই ফেইসবুকে দুর্নাম ছড়াচ্ছে।
ময়লা-আবর্জনা আর অবৈধ দখলের কারণে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ জারিরদোনা শাখা খালটি। এ জন্য যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব ও প্রশাসনের উদাসীনতাকে দুষছেন এলাকাবাসী।
উপজেলা সদর হাজিরহাট বাজার অংশে জারিরদোনা খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ছোট-বড় বহু দোকানপাট ও বহুতল ভবন। কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই খালের পানি বাধাগ্রস্ত করে ইচ্ছামতো সরু পুল, কালভার্ট নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালীরা। সেই সঙ্গে গড়ে তুলেছেন অবৈধ দোকানপাট। এ ছাড়া এলাকার কিছু প্রভাবশালী বাজারের আবর্জনা দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে খালটি ভর্তি করে ফেলেছেন। যাতে করে পরে সময় সুযোগ বুঝে ওই স্থান দখলে নেওয়া যায়।
এলাকাবাসী জানান, চরফলকন, চরলরেন্স, হাজিরহাট ও সাহেবেরহাট ইউনিয়নসহ উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিকাজ এ খালের পানি প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। পানির স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে যেমন পানি সংকটে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়, তেমনি বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনজনিত সমস্যায় সয়াবিন, ধান, মরিচ, বাদাম ও সবজীসহ বিভিন্ন ফসল ও বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বর্তমান এ অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা চলছে। খালটি দখলের কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকায় জীবনযাত্রা চরম দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে মানুষের। বন্যার পানি না নামার কারণ হিসেবে খাল দখলকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
হাজিরহাট এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নূর সেলিম বলেন, জারিরদোনা শাখা খালটির সংযোগ সরাসরি মেঘনা নদীর সঙ্গে। আশির দশক পর্যন্ত এ খালটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হিসেবেই বিবেচিত ছিল। এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যেও এর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ওই সময়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাস-ট্রাক যাতায়াত করা ছিল দুর্সাধ্য। এমনকি ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এ অঞ্চলের সড়ক পথই ছিল না।
এদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ৮০ দখলবাজের কবজা থেকে খালটি উদ্ধার করতে উচ্ছেদের আদেশ হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। তারা খাল উদ্ধারে গড়িমসি করে সময় পার করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্যমতে, পিএস জরিপে হাজিরহাট বাজার অংশে খালের প্রশস্ততা ছিল গড়ে প্রায় ৩২ ফুট। বর্তমান আরএস জরিপে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০ ফুটে। কিন্তু কিছু ইমারত (ভবন) এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে ওই সব অংশে খালের প্রশস্ততা বর্তমানে ২ থেকে ৩ ফুটের বেশি নেই।
হাজিরহাট বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল হাছান বলেন, ‘এলাকার বৃহত্তর স্বার্থে খালটি সংস্কার করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা একান্ত জরুরি। পুরো খাল দখল করে যারা ইমারত তৈরি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে খালটি দখলমুক্ত করা এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি।’
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ আরাফাত হুসাইন বলেন, ‘জারিরদোনা খাল দখলমুক্ত করতে ইতোমধ্যে আদেশ হয়েছে। আমরা দ্রুত কাজ শুরু করব।’
এ বিষয়ে কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাহাত-উজ জামান বলেন, খালটি সংস্কার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
গত মার্চের ১৯ তারিখে চাল না দেওয়া ও চাল সংগ্রহে চুক্তি না করায় রাজশাহী বিভাগে ৯১৩টি চালকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে খাদ্য বিভাগ। রাজশাহী আঞ্চলিক খাদ্য বিভাগ থেকে চাল সংগ্রহ মৌসুম শেষ হওয়ার পর সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এই সুপারিশ পাঠানো হয়। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেও চাল সরবরাহ না দেওয়ায় রাজশাহী বিভাগের ৬১টি চালকলের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ হয়েও কোনো চাল সরবরাহ করেনি এসব চালকল মালিকরা। এছাড়া চাল সংগ্রহ কার্যক্রমে অসহযোগিতাকারী ৯১৩টি চালকলকেও সাবধান করা হয়েছে।
খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের সাথে চুক্তি করেও ঠিকভাবে চাল সরবরাহ দেয়নি এমন চালকলের সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে চুক্তির ৮০ ভাগ চাল দিয়েছে এমন চালকলের সংখ্যা ৩০টি। ৫০ ভাগ চাল দিয়েছে- এমন চালকলের সংখ্যা ৭১টি। আর চুক্তিবদ্ধ হয়েও কোনো চালই দেয়নি এমন চালকলের সংখ্যা ৬১টি। এছাড়া, ব্যবসা করলেও চাল সরবরাহের চুক্তি না করা চালকলগুলোরও লাইসেন্স বাতিল করেছে খাদ্য বিভাগ।
রাজশাহী খাদ্য অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহী বিভাগে আমন সংগ্রহ ২০২৪-২০২৫ মৌসুমে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৫৬,৩৫৯ টন, সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩৯৫ টন (লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৭%), সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ৯৪ হাজার ৭০৭ মেট্রিক টন। আর আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২১ হাজার ৮৯১ মেট্রিক টন। সংগ্রহ হয়েছে ১৯ হাজার ৫২৯ মেট্রিক টন।
৬১টি চালকলের মধ্যে যারা সিদ্ধচালের কোনো চালই প্রদান করেনি- এমন চালকল রাজশাহীর একটি, নওগাঁয় ৮টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ তিনটি, পাবনায় ১১টি, বগুড়ায় ৩৪টি ও জয়পুরহাটে তিনটি। আর আতব চাল দেয়নি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একটি মিল। এর আগে এসব চালকল মালিকদের ব্যাখ্যা তলব করা হয়। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় এসব চালকলের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
রাজশাহী খাদ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারি উপপরিচালক ওমর ফারুক বলেন, সরকারি যেকোনো কাজে চুক্তিবদ্ধ হলে তা বাস্তবায়ন না করতে পারলে অপরাধ বলে গণ্য হবে। যেসব মিল চুক্তি করেও ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ চাল সরবরাহ করেছে, তাদের জামানত থেকে জরিমানা কেটে নেওয়ার আর যারা কোনো চাল সরবরাহ করেনি, তাদের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেছিলাম। রাজশাহী বিভাগের যে সব মিল চাল দেয়নি বা চুক্তিযোগ্য ছিল কিন্তু চুক্তি করেনি- এমন মিল ৯১৩টি মিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে দিয়েছিলাম। এদের মধ্যে ৬১টি চালকলের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। বাকিদের শোকজ করা হয়েছে। পরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যারা চাল সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
নীলফামারীর জলঢাকায় ইজারাবিহীন খাসে যাওয়া মীরগঞ্জ হাট-বাজারে গরু-ছাগল ক্রেতা বিক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার সরেজমিনে গিয়ে অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়ে সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, সরকারি খাস খতিয়ানে যাওয়া মীরগঞ্জ হাট-বাজারের পশুরহাটে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গরু ক্রেতার কাছ থেকে রশীদ ফি ৬০০ টাকা ও বিক্রেতার কাছ থেকে অতিরিক্ত ২০০ টাকা চাঁদাসহ গরু প্রতি মোট ৮০০ টাকা আদায় করছেন হাট-বাজারের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ। এ হাট-বাজারে প্রশাসনের কাউকে দেখা না গেলেও সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে দুইজন ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক হাট বাজারের অফিসে উপস্থিত হতে দেখা যায়। তারা হলেন গোলনা ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম ও কাঁঠালী ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। মীরগঞ্জ হাট-বাজারের টোল আদায়ের মুল দায়িত্বে ছিলেন ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা সঠিক সময়ে হাটে এসেছি। তারা আমাদের চাপে ফেলে হাটের টোল আদায় করছেন। আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করেছি।
তারা কারা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরা বিএনপি-জামায়াতের লোকজন। সংবাদকর্মীদের দেখে হাট-বাজারের থাকা ক্রেতা বিক্রেতা এগিয়ে এসে বলেন, গত ৩টা হাটে শুধু গরু ক্রেতার কাছে রশীদের ফি বাবদ ৬০০ টাকা নিয়েছেন। আর যারা গরু বিক্রেতা ছিলাম আমাদের কাছ তেকে কোন প্রকার চাঁদা নেয়নি। কিন্তু আজকের হাটে গরু ক্রেতার কাছে রশীদের মাধ্যমে ৬০০ টাকা এবং বিক্রেতার কাছে বিধি পরিপন্থি অতিরিক্ত ২০০ টাকা চাঁদা নেয়। হাটের লোকজন আমাদের কাছে জোরপূর্বক ভয়ভীতি দেখিয়ে অতিরিক্ত ২০০ টাকা চাঁদা নিচ্ছেন। একপর্যায়ে একদল লোক দৌড়ে এসে সংবাদকর্মীদের ওপর চড়াও হয় এবং আক্রোশমুলক গালমন্দ করতে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা এবং হত্যার হুমকি প্রদর্শন করেন।
লোকমুখে জানা যায়, তারা উপজেলা বিএনপির একাংশ একটি গ্রুপের বাহিনী। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরের বাংলা ১৪৩২ সালে উপজেলার ২৬টি হাট ইজারা দেওয়ার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরমধ্যে ১৭টি হাটের দরপত্র জমা হলে বিধিমোতাবেক দরপত্র দর দাতাদের মধ্যে হাট-বাজার গুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে ৯টি হাটের কোন দরপত্র জমা না হওয়ায় হাট-বাজার গুলো খাস খতিয়ানে চলে যায়। খাস খতিয়ানে যাওয়া হাট-বাজার গুলো হলো, মীরগঞ্জ হাট-বাজার, পাঠানপাড়া হাট-বাজার, হলদিবাড়ী নালারপাড় হাট-বাজার, হলদিবাড়ী জয়বাংলা হাট-বাজার, নবাবগঞ্জ হাট-বাজার, ডিয়াবাড়ী হাট-বাজার, বালারপুকুর চৌধুরীর হাট-বাজার, হরিশ্চন্দ্রপাঠ হাট-বাজর, খুটামারা রহমানিয়া হাট-বাজার ইত্যাদি। এই হাটগুলো বর্তমানে উপজেলা প্রশাসন তাদের নিজেদের নিয়োগকৃত জনবল দিয়ে হাট-বাজারের টোল আদায় করছেন। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন বলেন, লিখিতভাবে কাউকে হাট-বাজার দেওয়া হয়নি। কিন্তু খাস খতিয়ানের হাট-বাজারে কিছু লোকের সহযোগিতা নিয়ে টোল আদায় করা হচ্ছে। অতিরিক্ত ২০০ টাকা টোল আদায়ের কোন এখতিয়ার নেই। যদি এরকম কোনো প্রমাণ আপনারা দিতে পারেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য