× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বাংলাদেশ
Consignment of 10 trucks also contained ULFA weapons Anup Chetia
google_news print-icon
সাক্ষাৎকার

১০ ট্রাকে উলফার অস্ত্রও থাকতে পারে: অনুপ চেটিয়া

১০-ট্রাকে-উলফার-অস্ত্রও-থাকতে-পারে-অনুপ-চেটিয়া
সাক্ষাৎকারে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া। ছবি: সংগৃহীত
উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া শনিবার ঢাকায় এক হোটেলে কয়েকজন সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে তার অবস্থান ও উলফার কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বার্মায় উলফার ঘাঁটিতে যাতায়াত দুর্গম হওয়ায় আমরা বাংলাদেশে ঘাঁটি গড়ি, তবে এখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। আমি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বাংলাদেশ হয়ে অস্ত্রের চালান আনার উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকতে পারে, তবে তা উলফার জন্য ছিল নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো।’

চট্টগ্রামে ২০০৪ সালে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্রে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসামের (উলফা) অংশও থাকতে পারে। হবিগঞ্জ ও জামালপুরে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের ক্ষেত্রেও তা-ই। আর মিয়ানমারে ঘাঁটি থাকলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় একটা সময়ে বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়ে ভারতের আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি, তবে বাংলাদেশ হয়ে অস্ত্র আনা-নেয়ার চেষ্টাটা ছিল উলফার জন্য নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো।

উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া শনিবার ঢাকায় এক হোটেলে কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। ঢাকায় বসবাস করা মেয়ের সঙ্গে দেখা করে ভারতে ফিরে যাওয়ার আগে দেয়া সাক্ষাৎকারে একসময়ের এ গেরিলা নেতা বলেছেন তার না বলা অনেক কথা।

অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে ছিলেন দীর্ঘ ২৮ বছর। ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ও স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহারের অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। আদালত তিনটি মামলায় তাকে ৩, ৪ ও ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

তিনটি মামলার সাজাই একসঙ্গে কার্যকর হওয়ায় ৭ বছর পর ২০০৪ সালে তার কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়, তবে তারপরও তিনি কারাগারে আটক ছিলেন।

২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগার থেকে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার শুরুতেই অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশের জনগণ, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানান।

উলফা সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমি প্রথমে বাংলাদেশে এসেছিলাম ১৯৮৮ সালে। সে বছর আসাম ও বাংলাদেশে বড় বন্যা হয়েছিল। আমরা তখন চেয়েছিলাম বাংলাদেশে একটা ঘাঁটি গড়ব, মূলত যেটি হবে ডিপ্লোম্যাটিক ঘাঁটি। কারণ বার্মায় আমাদের শেল্টার থাকলেও প্রচুর পাহাড় থাকায় সেখানে যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা ছিল না। দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হয়। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো যোগাযোগও করা যায় না। সে জন্য আমরা সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম বাংলাদেশের ঘাঁটি গড়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনটা করব।’

বাংলাদেশে ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনা কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে অনুপ চেটিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে আসামের অনেকের আত্মীয়স্বজন আছে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক পারিবারিক সম্পর্কও আছে। মূলত তাদের মাধ্যমেই আমরা প্রথম বাংলাদেশে আসি।

‘আমরা যখন এখানে আসা-যাওয়া করছিলাম, তখন এরশাদের শাসনামল। তারপর বিএনপি ক্ষমতায় এলো। তখনও এখানে যারা আসামের মানুষ থাকত, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও ভালো সম্পর্ক ছিল।

‘শুরুতে আমরা পারমানেন্টলি (স্থায়ীভাবে) বাংলাদেশে থাকতাম না। যখন দরকার হতো তখন আসতাম, আবার ফিরে যেতাম। আর ওই সময়ে বর্ডারে এত কড়াকড়িও ছিল না। তাই আমাদের আসা-যাওয়ায় কোনো অসুবিধা হতো না।’

পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে

উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে আমি আমার পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। কারণ তখন সেখানে (আসামে) আর্মির উপস্থিতি বেড়ে গিয়েছিল, তবে বাংলাদেশে পরিবার নিয়ে এলেও এখানে আমি কম সময়ই থেকেছি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংগঠনের প্রচার, ক্যাম্পেইন ও লবিংয়ের জন্য বেশির ভাগ সময় আমাকে বিদেশেই থাকতে হয়েছে।’

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে পরিবারের লোকজন জানতেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অনুপ চেটিয়া বলেন, ‘পরিবারের সবাই আমার আসল পরিচয় জানত, তবে বাইরে আসল পরিচয়টা গোপনই রেখেছিলাম। নিজেকে বিজনেসম্যান হিসেবে তুলে ধরতাম। আমার নাম ছিল জন ডেভিড সোলাবার।

‘নিজেকে খাসিয়া উপজাতির লোক হিসেবে পরিচয় দিতাম। কারণ এখানে খাসিয়া উপজাতির অনেক লোক ছিল। আর থাকতাম মোহাম্মদপুরের আদাবরে।’

১০ ট্রাকে উলফার অস্ত্রও থাকতে পারে: অনুপ চেটিয়া

ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার সময় আমার মেয়ের বয়স ছিল দেড় বছর। আমার স্ত্রী সন্তানদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করেছে। কারণ বিশেষ করে মেয়েটা অনেক স্কুল পরিবর্তন করেছে। শেষে মাস্টার মাইন্ড স্কুলে পড়েছিল। তখন সেখানে সে মুসলিম নাম নিয়েছিল, তবে আমি জেলে যাওয়ার আগে ছেলেটা আসল নামেই স্কুলে ভর্তি হয়।

‘ওর নাম সাগর বড়ুয়াই লিখছিলাম, তবে অভিভাবকের জায়গায় নিজের নাম কী দিয়েছিলাম সেটা ভুলে গেছি। আর বাংলাদেশে অনেকেই নামের শেষে বড়ুয়া লিখে থাকে। তাই কোনো সমস্যা হয়নি।’

গ্রেপ্তারের পর উলফার নেতৃত্ব সংকট

বাংলাদেশে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর উলফার নেতৃত্ব কে দিতেন, এমন প্রশ্নের জবাবে অনুপ চেটিয়া বলেন, ‘আমি অ্যারেস্ট হওয়ার পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে, তবু আমাদের সংগঠন ভালোভাবেই চলছিল। দলে ওপরের সারিতে যারা ছিল তারা ভালোভাবেই চালিয়ে নিচ্ছিল।

‘সংগঠন বড় একটি সমস্যায় পড়ে ভুটানে আমাদের ক্যাম্পে হামলার পর। সেখানে আমাদের ২৬ জনের মতো লিডার মিসিং হয়। তারা এখনও নিখোঁজ। অনেকে মারা যায়। ওই ঘটনা ছিল আমাদের সংগঠনের ওপর বড় আঘাত।

‘আমি কারাগারে। ভুটানে হামলার পর অনেক নেতা মিসিং এবং অনেকে মারা যাওয়ার এই পর্যায়ে আমাদের বার্মা বেজ হাল ধরতে পারত, কিন্তু বার্মার ঘাঁটি থেকে সংগঠন পরিচালনায় অসুবিধা হচ্ছিল। মূল কারণটা ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকা। এ অবস্থায় আমাদের অনেক লিডার বাংলাদেশে চলে আসে।’

বাংলাদেশ থেকে উলফা পরিচালনা

বাংলাদেশে অবস্থান করে উলফার সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে এখানে কোনো বাধা বা সমস্যায় পড়তে হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে এই গেরিলা নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তবে বাংলাদেশের নিরাপত্তায় সমস্যা সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। প্রথম দিকে এখান দিয়ে অস্ত্র আনা-নেয়ার কোনো পরিকল্পনাও ছিল না, কিন্তু আমি গ্রেপ্তার হওয়ার পরই সেসব আরম্ভ হয়। আর সেটা ছিল নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার মতো।’

অস্ত্রের চালান কার

অনুপ চেটিয়াকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান উলফার জন্য এসেছিল কি না। বিষয়টি তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও একেবারে অস্বীকার করেননি।

উলফা নেতা বলেন, ‘সে সময় আমি জেলে ছিলাম। তাই সে ব্যাপারে কিছু জানি না, তবে উলফা ছাড়াও আমাদের ওই অঞ্চলে আরও অনেক পার্টি ছিল। হয়তো এই অস্ত্র উলফাসহ অন্যদের ছিল।’

অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার সময় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সঙ্গে উলফার সম্পর্ক কেমন ছিল, এমন প্রশ্নেও কৌশলের আশ্রয় নেন অনুপ চেটিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি সে সময় জেলে ছিলাম। আমার অবর্তমানে যারা উলফার দায়িত্বে ছিল, তাদের সঙ্গে এ দেশের সরকারের ভালো সম্পর্ক ছিল কি না, আমি জানি না।’

১০ ট্রাকে উলফার অস্ত্রও থাকতে পারে: অনুপ চেটিয়া

বাংলাদেশে হবিগঞ্জের সাতছড়ি ও জামালপুরের হালুয়াঘটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েক দফায় অনেক অস্ত্র পেয়েছে। এসব অস্ত্র উলফার কি না, এমন প্রশ্নের ‍উত্তরে উলফার সাধারণ সম্পাদক কৌশলী জবাব দেন।

তিনি বলেন, ‘সে সময় আমি কারাগারে ছিলাম। তাই জানি না এটা কাদের অস্ত্র, তবে আমি এটা বলতে চাই, অস্ত্র তো কেউ খাওয়ার জন্য আনে না। আর বাংলাদেশ সরকার তো এভাবে রাখঢাক করে এত অস্ত্র আনবে না।

‘শুধু উলফা বলা যাবে না, আমাদের অঞ্চলের কোনো না কোনো গোষ্ঠী এগুলো এনেছিল এটা সত্য। একইভাবে ১০ ট্রাক অস্ত্রের মধ্যেও কিছু হয়তো উলফার ছিল। আবার অন্যদেরও থাকতে পারে। আমি সে সময় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ছিলাম। সে জন্য সবটা জানি না।’

বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে উলফা টাকা লগ্নি করার খবর শোনা গেছে। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে অনুপ চেটিয়া বলেন, ‘এটা সত্য নয়। এখানে আমাদের কোনো ব্যবসা ছিল না। কোথাও অর্থ লগ্নিও করা হয়নি।’

শান্তির পথে উলফা

আসামের দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা। এই দীর্ঘ সময় শেষে বর্তমানে সংগঠনের অবস্থান ও কার্যক্রম কী, এমন প্রশ্নে অনুপ চেটিয়া শান্তিপূর্ণ পন্থায় দাবি আদায়ের কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘ভারত সরকারের সঙ্গে আমরা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দাবি হলো আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী অনেক কমে গেছে। বর্তমানে তা ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ভবিষ্যতে আমাদের আইডেন্টিটি যাতে শেষ হয়ে না যায়, আমরা যাতে টিকে থাকতে পারি, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। বিশেষ করে সাংবিধানিক সুরক্ষাটা যাতে আমাদের থাকে সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি।

‘এ ছাড়া আমাদের ভূমির অধিকার, রাজনৈতিক অধিকারের জন্যও কথা বলছি। সরকার এখনও বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কিছু বলেনি, তবে আমরা আশাবাদী।’

পরেশ বড়ুয়া মিয়ানমারে

উলফার আরেক প্রভাবশালী নেতা পরেশ বড়ুয়া। অনুপ চেটিয়ার পরই তার নেতৃত্ব সবসময় আলোচনায় থেকেছে। তার সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরেই তেমন কিছু জানা যায় না।

সে বিষয়ে জানতে চাইলে অনুপ চেটিয়া বলেন, ‘সে এখন বার্মায়। সেখানে ক্যাম্পে আছে। শুনেছি ভারত সরকার তাকে দেশে আনতে চাচ্ছে। সে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও যোগাযোগ চলছে।

‘সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সেও বলেনি যে আসবে না, তবে কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে যোগাযোগ চলছে মনে হয়। যুদ্ধ করে তো আর জিততে পারবে না! সে জন্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই দাবি আদায় করতে হবে।’

১০ ট্রাকে উলফার অস্ত্রও থাকতে পারে: অনুপ চেটিয়া

উলফা এখন কারা চালাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “উলফা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। মূল সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে ‘উলফা স্বাধীন’ নাম দিয়ে আরেকটি সংগঠন করেছে পরেশ বড়ুয়ারা। সে ওখানকার চেয়ারম্যান। আর আমরা উলফার মধ্যেই আছি। ২০১১ সালে ওরা আলাদা হয়ে গেছে।”

উলফার অর্থের জোগান

উলফা পরিচালনা করতে অর্থের জোগানটা কোথা থেকে আসত, এমন প্রশ্নের জবাবে এই গেরিলা নেতা বলেন, ‘আমরা জনগণ থেকে কালেকশন করতাম। বিশেষ করে আসামের চা বাগানের মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিতাম। বাগান মালিকদের সে সময় প্রতি কেজি চায়ের ওপর আমাদের ৫০ পয়সা হারে ট্যাক্স দিতে হতো।’

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চালাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জোগান কীভাবে পেতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক চোরাকারবারি বসে আছে। আপনার টাকা থাকলে আপনি কী না পাবেন? সেখান থেকেই আসত।’

‘আসামের মানুষ উলফার বিরুদ্ধে যায়নি’

অনুপ চেটিয়া বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সময় আমাদের হাতে অনেক লোক মারা গেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের খারাপ লাগবে। আমাদের লোকও মারা গেছে। তাদের পরিবারেরও খারাপ লাগে, তবে সার্বিকভাবে আসামের মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে যায়নি।

‘বর্তমান সময়ে এসেও আমরা আসামের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করছি। আসামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কীভাবে করা যায় সে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

‘অনুপ্রবেশের অভিযোগ রাজনৈতিক’

আসামে ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশির অনুপ্রবেশ ঘটেছে— ভারত সরকারের কেউ কেউ জোর গলায় এমনটা দাবি করেন।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে এই উলফা নেতা বলেন, ‘আসলে এটি একটি পলিটিক্যাল ইস্যু। এখন সবাই তাদের নিয়ে ইস্যু তৈরি করে। এটা রাজনৈতিক।’

তিনি বলেন, ‘আসামের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা আছে, এটা সত্য। এই ভুল ধারণাটা আমাদের দূর করতে হবে। সে জন্য আমাদের ম্যান টু ম্যান রিলেশন গড়ে তুলতে হবে।

‘আসামের অনেক মানুষই জানে না বাংলাদেশে এত অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে। আসামের লোকগুলো যদি একবার বাংলাদেশে আসে তাহলে তাদের ভুল ধারণা দূর হয়ে যাবে। কারণ আসামের লোক তো বাংলাদেশে আসে না। আবার বাংলাদেশ থেকে অনেকেই বিদেশে যান।

‘আমাদের আবেদন থাকবে, তারা যেন আসামেও যান। বাংলাদেশ ও আসামের লোকজনের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়লে সম্পর্কটা গভীর হবে। আমাদের সামাজিক অবস্থাও অনেকটা একই, ভাষাও প্রায় এক। আপনার পহেলা বৈশাখ পালন করেন, আমরাও করি। তাই আমাদের মধ্যে আসা-যাওয়া শুরু হলে বাধার প্রাচীরটা দূর হবে।’

বাংলাদেশের ব্যাপারে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে অনুপ চেটিয়া বলেন, ‘এই দেশে আমি ২৮ বছর থেকেছি। এখানেই পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করেছে। কারাগারে যেতে হয়েছে, তবে বাংলাদেশ সরকার আমাকে ধরলেও কারাগারে যথাযথ সম্মান দিয়েছিল।

‘বর্তমানে ভারতে আমার নামে দুটি মামলা রয়েছে। দুটিতেই জামিনে আছি। এখন আমি সব দেশেই যেতে পারি। সরকারের অনুমতি আছে।’

আরও পড়ুন:
বিস্ফোরক মামলায় ভারতীয় নাগরিকের ১০ বছরের সাজা

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ
Kubir Riazul is the first in the country to join postal cadre in 43rd BCS

সাফল্যের গল্প শোনালেন ৪৩তম বিসিএসে ডাক ক্যাডারে প্রথম রিয়াজুল

সাফল্যের গল্প শোনালেন ৪৩তম বিসিএসে ডাক ক্যাডারে প্রথম রিয়াজুল ৪৩তম বিসিএস ডাক ক্যাডারে সারা দেশে প্রথম এস এম রিয়াজুল করিম। ছবি: সংগৃহীত
প্রথমত প্রিলিমিনারির জন্য অনার্সে থাকা অবস্থায় ইংরেজি ও গণিতে বেসিক স্ট্রং করতে হবে। সাধারণ জ্ঞান অংশটুকু অনার্স শেষে পড়লেও চলবে। অ্যাকাডেমিক লাইফে বিষয় অনুযায়ী দুর্বলতা শেষ করে ফেলতে পারলে প্রথম বিসিএসেই প্রিলিমিনারি পাশ করা সহজ। লিখিতর ক্ষেত্রে গণিতের জন্য মাধ্যমিকের বইগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজির লিখিত ভোকাবুলারি বেসড। ভোকাবুলারি জানা থাকলে ইংরেজিতে ভালো করা যায়। সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে এগিয়ে যাওয়া যায়।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এস এম রিয়াজুল করিম ৪৩তম বিসিএস ডাক ক্যাডারে সারা দেশে প্রথম হয়েছেন। এর আগে তিনি ৪০তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার ও ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। রিয়াজুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায়।

বিসিএস যাত্রায় এস এম রিয়াজুল করিমের সাফল্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ গল্প। এ সফলতার গল্প জানতে রিয়াজুলের মুখোমুখি হয়েছিলেন নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি এমদাদুল হক।

নিউজবাংলা: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?

এস এম রিয়াজুল করিম: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমি দুটি স্বপ্ন দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া আর বিসিএস ক্যাডার হওয়া। অনার্স চতুর্থ বর্ষ থেকে আমার বিসিএসের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায়।

নিউজবাংলা: আপনার সাফল্যের পেছনে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল?

এস এম রিয়াজুল করিম: আমার অনুপ্রেরণার পেছনে ছিল আমার পরিবারের সব সদস্য। বিশেষ করে আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বড় ভাই শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ওনার কাছ থেকেই আমার পড়ালেখার হাতেখড়ি। ওনার কাছ থেকেই বেসিক জিনিসগুলো স্ট্রং করেছি।

নিউজবাংলা: বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেয়া উচিত?

এস এম রিয়াজুল করিম: প্রথমত প্রিলিমিনারির জন্য অনার্সে থাকা অবস্থায় ইংরেজি ও গণিতে বেসিক স্ট্রং করতে হবে। সাধারণ জ্ঞান অংশটুকু অনার্স শেষে পড়লেও চলবে। অ্যাকাডেমিক লাইফে বিষয় অনুযায়ী দুর্বলতা শেষ করে ফেলতে পারলে প্রথম বিসিএসেই প্রিলিমিনারি পাশ করা সহজ। লিখিতর ক্ষেত্রে গণিতের জন্য মাধ্যমিকের বইগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজির লিখিত ভোকাবুলারি বেসড। ভোকাবুলারি জানা থাকলে ইংরেজিতে ভালো করা যায়। সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে এগিয়ে যাওয়া যায়।

নিউজবাংলা: ভাইভা দেয়ার পর আপনার আত্মবিশ্বাস কেমন ছিল?

এস এম রিয়াজুল করিম: ৪০তম বিসিএসের ভাইভা দেয়ার পর আমার আত্মবিশ্বাস ছিল শিক্ষা ক্যাডার পাব। ৪৩তম বিসিএস ভাইভা দেয়ার পরও আত্মবিশ্বাস ছিল যেকোনো একটি ক্যাডার আসতে পারে। ৪০তম বিসিএসের ভাইভায় ৫ থেকে ৬ মিনিট রাখা হয়েছিল। ৪১তম বিসিএসে ১০ মিনিটের মতো ছিলাম। ৪৩তম বিসিএসে ১৫ মিনিটের মতো ছিলাম। আমার ৪৩তম বিসিএসের ভাইভা ছিল অন্যগুলো থেকে ব্যতিক্রম।

নিউজবাংলা: ডাক ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় কেমন অনুভূতি হচ্ছে?

এস এম রিয়াজুল করিম: ৪০তম বিসিএস আমার জীবনের প্রথম বিসিএস ছিল। প্রথম বিসিএসেই আমি শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। পরবর্তীতে ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। বর্তমানে ৪৩তম বিসিএসে আমি ডাক ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে খুবই আনন্দিত। প্রতিটি ক্যাডারই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডাক ক্যাডারের মাধ্যমে আমি দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করতে পারব। দেশ ও মানুষের সেবার সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।

নিউজবাংলা: এ পর্যায়ে আসতে কোনো বাধা বা সংগ্রাম অতিক্রম করতে হয়েছে?

এস এম রিয়াজুল করিম: মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম আমি। টিউশন পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়েছি। অনেক সময় বাড়ি থেকে টাকা এনেছি।

নিউজবাংলা: বিসিএসের জন্য কোচিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

এস এম রিয়াজুল করিম: কোচিং বিষয়টা আপেক্ষিক। অনেকে কোচিং এ গিয়ে ইম্প্রুভ করতে পারে। কোচিং এ গিয়ে কম্পিটিশন তৈরি হলে সেটা ভালো। আবার অনেকে বাসায় বসে পড়ালেখা করেও ভালো করে।

নিউজবাংলা: বিসিএসে সফল হতে নতুনদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

এস এম রিয়াজুল করিম: যাদের বেসিক জ্ঞান ভালো তাদের একটু পরে প্রিপারেশন শুরু করলেও হয়। গণিত, ইংরেজিতে যাদের দুর্বলতা রয়েছে তাদের একটু আগে থেকেই শুরু করা উচিত। অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা একেবারে ছেড়ে দেয়া যাবে না কারণ ভাইভাতে একাডেমিক বিষয়টা ফেইস করতে হয়।

আরও পড়ুন:
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত
ঘোষিত সময়েই ৪৫তম বিসিএস, আসনবিন্যাস প্রকাশ
৪৫তম বিসিএসে বাংলার লিখিত পরীক্ষা ৩০০ নম্বরে
বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস প্রকাশ
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু ২৭ নভেম্বর

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Saharia Kanak on special duty in the Canadian police is the winner of the difficult journey

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী! সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত
বরিশালের এই সাহারিয়াই প্রথম বাংলাদেশি কানাডিয়ান যিনি ওপিপি নীতিনির্ধারণী লেভেলে হায়ার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।

বাংলাদেশের দক্ষিণের এক জেলায় সাহারিয়া কনকের জন্ম। বাংলাদেশ থেকে কানাডার ভৌগলিক দূরত্ব ও সাংস্কৃতিক ফারাক কতটা, তা প্রযুক্তির এ যুগে এসে হয়তো সহজেই সবার বোধে এসে যায়। তবে এই ভৌগলিক, আর্থ সামাজিক দূরত্ব আর অনেকখানি বন্ধুর পথ পেরিয়ে বাঙালি একজন নারী দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করতে যোগ্য হয়ে ওঠেন তা নিয়ে ধারণা পাওয়া খুব সহজ কিছু নয়।

সেই যোগ্য বাঙালি নারী হলেন আমাদের আজকের আলোচিত সাহারিয়া কনক। তিনি কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পুলিশে অধীনে (অন্টারিও মিনিস্ট্রি অফ সলিসিটির জেনারেল) রিজিওনাল বিসনেস এনালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন।

বরিশাল থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে জাপান, এরপর জাপান থেকে কানাডা। সাহারিয়ার সব পথ একরৈখিক করেছে শিক্ষাগত যোগ্যতা, সততা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। তবে অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর ছিল না। নিরলস চেষ্টায় তিনি পৌঁছেছেন তার কাঙিক্ষত লক্ষ্যে।

সাহারিয়া নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন সেসব উদ্দীপক গল্প।

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!
কানাডার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত

বরিশাল শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই মেধাবী মানুষটির। স্কুলের শিক্ষা শেষে বিএম কলেজে, এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। এই পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বৈবাহিক সূত্রে ২০০১ সালে বাংলাদেশ থেকে জাপানে যান তিনি।

সাহারিয়া জানান, তার স্বামী সেই সময়ে এনভারনমেন্টাল ইঞ্জনিয়ারিংয়ে জাপানে পিএইচডি করছিলেন। বৈবাহিক কারণে জাপানে গেলেও নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন নিজের উচ্চ শিক্ষা এবং ক্যারিয়ার তৈরির বিষয়ে। সাহারিয়ার স্বামী ড.আনিসুর রহমান এ ব্যাপারে তার পাশে থেকেছেন সবসময়, এটি এ সফল নারীর পরম পাওয়া।

জাপানে যেখানে ছিলেন সাহারিয়া, সেখানে ভার্সিটির সোশ্যাল সাইয়েন্স ডিপাটরমেন্টে জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি ছাড়া কোনো রিসার্চ করার সুযোগ ছিল না মাস্টারস লেভেলে! আর সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে এনরোলমেন্ট হওয়ার মতো রিসার্চ ব্যাকগ্রাউন্ডও তার ছিল না। অবশ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সকালীন সময়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রজেক্টে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তার দুই বছরের অভিজ্ঞতা ছিল।

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!
স্বামীর সঙ্গে সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত

অনেক প্রচেষ্টার পরে প্রফেসর ডক্টর ইউসিয়াকি ইগুনির তত্ত্বাবধানে তার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শেখার সুযোগ মেলে সাহারিয়ার। কোনো বেতন বা স্কলারশিপ ছাড়াই দুই বছর টানা কাজ করার পর জাপান সোসাইটি ফর প্রোমোশন অফ সায়েন্সে বেশ বড় রিসার্চ প্রোজেক্ট ফান্ড/অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন তিনি। এই ফান্ড দেয়া হয় রিচার্স ফেলোশিপ ফর ইয়াং সায়েন্টিস্ট-এর আওতায়। সাহারিয়া এর আওতায় সংসার,পুত্র সবসামলে বাংলাদেশের মাইক্রোফিন্যান্স নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে ২০০৭ সালে অক্টোবরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৭ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পোস্ট ডক্টরেট ফেলো হিসেবে তিনি চাকরি করেন।

সাহারিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জাপানের পার্থক্য যা দেখেছি; দুর্দান্ত সিস্টেমেটিক, ট্রান্সপারেন্ট এবং কমিটেড সোশ্যাল কালচার। কিন্তু বাংলাদেশের মতো হাইলি পপুলেটেড, কারণ জাপানে ৭৫% পাহাড়ি বন ঘেরা এরিয়া, বাকি ২৫% ফ্লাট ল্যান্ড। জাপান বিশ্বের থার্ড লার্জেস্ট ইকোনমি এবং সেকেন্ড ডেভোলপড দেশ হলেও তা এশিয়য়ার অন্তৰ্ভুক্ত। তাই ফ্যামিলি নর্মস, ভ্যালুস, সামাজিকতায় অনেক মিল আছে আমাদের কোর ভ্যালুর সাথে জাপানিজ কালচারেরসব থেকে পজিটিভ ইনফ্লুয়েন্স ছিল আমার ক্ষেত্রে, তাদের বিনয়, ওয়ার্কম্যানশিপ, অনেস্টি এবং সিম্পল লাইফ স্টাইল।’

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!
কানাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত

এখানেই থেমে থাকেননি সাহারিয়া, ২০০৫ সালে কানাডায় নাগরিকত্ব নিলেও ২০০৮ সালের নভেম্বরে জাপান থেকে কানাডার অন্টারিও প্রদেশে অভিবাসন করেন তিনি। সে পথও কতটা বন্ধুর ছিল তা উঠে আসে সাহারিয়ার কথায়।

তিনি বলেন, ‘এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে নতুন করে ক্যারিয়ার আর জীবন শুরু, যা সব অভিবাসীর মতোই কঠিন। এ যেন কাজী নজরুলের ইসলালের ভাষায়- দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হে। লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার!

‘নতুন দেশ, নতুন কালচার সবকিছু নতুন করে জানা শেখা। সাড়ে ৪ শ’র বেশি কালচারাল অরিজিন কানাডায় বসবাস করে। তা ছাড়া ভৌগোলিক বিশালত্ব- অন্টারিও বাংলাদেশের থেকে ৭.৫ টাইমস বড়! এখানে ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে প্রতিদিন জব করা খুবই স্বাভাবিক। তাই কালচারাল শিফট ছিল সিগনিফিকেন্ট।’

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত

সাহারিয়া বলেন, ‘২০০৮ সালের নভেম্বরে যখন এসেছি, তখন ওয়ার্ল্ড রিসেশন চলছে; যার প্রভাব কানাডায় প্রকট ছিল। জব মার্কেট খুবই ভালনারবল। কিন্তু আমি আশাহত না হয়ে গভর্নমেন্ট-এর নিউ-কামার ট্রেনিং শুরু করি, যা আমাকে এই দেশ সম্পর্কে, জব নিডস এবং আমার স্কিল এসেসমেন্ট এ সাহায্য করবে বলেই বিশ্বাস ছিল।

‘কারণ কানাডা গভর্নমেন্ট বিনা খরচে প্রতিটি নিউ ইমিগ্র্যান্টকে (এন্ট্রির পরে প্রথম তিন বছর সবাইকে নিউ ইমিগ্র্যান্ট হিসাব করে যার যে ধরেন সাপোর্ট দরকার, তার এসেসমেন্টে সাহায্য করার বিভিন্ন সরকারি ফান্ডেড নন প্রফিট অর্গানিজশন আছে প্রতিটি শহরে) বিভিন্ন স্কিল ট্রেনিং এবং কালচারাল এসিমিলেশন- এর অপশন রেখেছে, যা সবাইকে এই দেশে অভিসংযোজিত হতে সাহায্য করে।’

দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে এ রকম একটি অর্গানাইজেশন নিউ-কামার সেন্টার অফ পিল-এ রিজিউম কভার লেটার রাইটিং অ্যান্ড কানাডিয়ান ইন্টারভিউ স্কিল বিল্ডআপের তিন মাসের ট্রেনিং শেষ করে ওখানেই ভলান্টিয়ার পজিশনে মাইগ্রেশন সেটেলমেন্ট অফিসে জয়েন করি। কানাডিয়ান জব এক্সপেরিয়েন্স নেয়ার জন্য দীর্ঘ ৮ মাস বিনা বেতনে ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সোমবার থেকে শুক্রবার কাজ করেছি।

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!
সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত

‘এরপর ২০০৯ সালের অক্টোবরে ওই অর্গানিজশনের ডিরেক্টরের রেফারেন্সে একটি প্রাইভেট অর্গানিজশনে অ্যাডমিন কোঅর্ডিনেটর পজিশন ইন্টারভিউ পাই। মোট ১০জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল ইন্টারভিউয়ের জন্য। এদের মধ্যে একমাত্র আমি নির্বাচিত হয়ে ওখানে জয়েন করি, যদিও বাসা থেকে বেশ দূরে এবং ড্রাইভিং করতে হতো তিনটা ব্যস্ত হাইওয়েতে। এটা এ কারণেই উল্লেখ করছি, এখানে প্রতিদিন নিউ-কামার অবস্থায় অনেকেই এটা করতে সাহস করবে না। কিন্তু আমি আমার জাপানের অভিজ্ঞতা, ওদের পরিশ্রমের সেই পজিটিভিটি মাথায় রেখে জবটা একসেপ্ট করে ওখানে ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কাজ করেছি।’

সাহারিয়া বলেন, ‘এরই মধ্যে অনেক জবে অ্যাপ্লাই করেছি, কোথাও কোথাও ইন্টারভিউ পেলেও সফল হয়নি। এটা মনে হয়েছিল যে, এখানকার এডুকেশন না থাকায় ইন্টারভিউ পেলেও ঠিকমত কম্পিট করতে পারছি না; নিজেকে আরেকটু এনরিচ করতে হবে ড্রিম জব পাবার জন্য। তাই ২০১৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলু-এর প্রফেশনাল মাস্টার্স ডিগ্র-এমপিএস (মাস্টার অফ পাবলিক সার্ভিস)- এ ভর্তি হই। ২০১৪ এর অল কোর্স ওয়ার্ক শেষ করেই দ্য অন্টারিও মিনিস্ট্রি অফ ফাইন্যান্স-এ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার হিসেবে জয়েন করি।

‘২০১৫ মার্চে এমপিএস- এর রিচার্স পেপার শেষ করে ডিগ্রি লাভের পর পাবলিক সার্ভেন্ট অফ কানাডা হিসেবে রেগুলার পজিশনে দ্য অন্টারিও মিনিস্ট্রি অফ চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ুথ সার্ভিসে রিচার্স অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করি। কিন্তু ততদিনে স্বপ্নের পরিধি বড় হচ্ছিল। এখানে প্রভিন্সিয়াল গর্ভমেন্টে এ প্রতিটি পজিশনের জন্য আলাদা সিভিল সার্ভিস কম্পিটিশন, তাই ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের এ সময়ে আমি অন্তত ৩০ ইন্টারভিউ দিয়েছি, কিন্তু জব অ্যাপ্লাই করেছি ১০০-এরও বেশি।’

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!
সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত

সাহারিয়া বলেন, ‘ওয়াটারলু-এর মাস্টার্স ডিগ্রি খুবই সহায়ক ছিল। জব সার্চিং প্রসেস ফর গর্ভমেন্ট, এই ডিগ্রি আমাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করেছে কানাডার পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য।’

তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন বাংলাদেশে। আব্বা ছিলেন আমার জীবনের আদর্শ পুরুষ। আমার শৈশব এর সব থেকে স্মৃতিময় সময় ছিল, আব্বা যখন তার ইউনিফর্ম পরে কাজ শেষে বাসায় ফিরতেন হাতে বিভিন্ন ধরেনর ফল আর চকলেট নিয়ে। সেই ক্ষণ ছিল স্বপ্নের মতো।’

বাবার কাছ থেকে বাংলাদেশ পুলিশের অনেক কিছুই তার শোনা, সাহারিয়ার প্রয়াত বাবা যেমন পুলিশ বাহিনী নিয়ে গর্বিত ছিলেন তেমনি কিছু ব্যাপারে তার দুঃখ ছিল অপিরিসীম। বাংলাদেশ পুলিশ সুযোগ-সুবিধায় সুরক্ষিত নয় ও জনগণের বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ। উদাহরণ স্বরূপ আরও বলা যেতে পারে,পুলিশ বাহিনীর জনগনকে মানবিক সেবা দিয়ে যে সম্মান পাওয়ার কথা তাতে ব্যাপক ঘাটতি, কিংবা আসামির স্বীকারোক্তি আদায়ের অমানবিক পদ্ধতি ও বাংলাদেশের স্বাক্ষী সুরক্ষা আইনের অষ্পষ্টতা নিয়েও তার বাবার মনে কষ্ট ছিল।

কানাডা পুলিশে বিশেষ দায়িত্বে সাহারিয়া কনক, কঠিন যাত্রার বিজয়ী যাত্রী!
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাহারিয়া কনক। ছবি: সংগৃহীত

কানাডার পুলিশ জনগণের আস্থা অর্জন করে তাদের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশে যেটি এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে । কানাডায় সর্বস্তরের পুলিশ বাহিনীর স্বচ্ছতা, রেস্পেক্ট এবং সর্বোপরি জনগণের আস্থা বা গ্রহণযোগ্যতা অপরিসীম। এসব সাহারিয়ার অবচেতন মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তাই কানাডার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হওয়া ছিলো তার স্বপ্নের দ্বিতীয় ধাপ। এই লক্ষকে সামনে রেখে সাহারিয়া সিটি, মিউনিসিয়াপলিটি এবং প্রভিন্সিয়াল পুলিশ -এ জব সার্চ এবং অ্যাপ্লাই শুরু করেন।

অবশেষে ২০১৮ এর এপ্রিলে ৬ মাসের ৫ লেভেল এর বাছাই পর্ব শেষে ফার্স্ট লেভেল অফ সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পার হয়ে অন্টারিও মিনিস্ট্রি অফ সলিসিটর জেনারেলের অধীনস্থ অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পুলিশে রিজিওনাল বিসনেস এনালিস্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি।

বাংলাদেশের বরিশালের এই সাহারিয়াই প্রথম বাংলাদেশি কানাডিয়ান যিনি ওপিপি নীতিনির্ধারণী লেভেলে হায়ার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The dollar crisis will not go away easily

‘ডলার সংকট সহজে কাটবে না’

‘ডলার সংকট সহজে কাটবে না’ পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। ছবি: নিউজবাংলা
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট এবং ডলার সংকট। ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভটার পতন হচ্ছে। কয়েক দিন আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ আরও কমে ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ডলারের যে সংকট চলছে, এটা সহজে যে যাবে তা আমার মনে হয় না। ২০২৩ সালজুড়েও ডলার সংকট থাকতে পারে। এটা সহজে দূর হবে না।’

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হচ্ছে রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট এবং ডলার সংকট। এ সংকটে রিজার্ভের পতন হচ্ছে। ডলারের যে সংকট চলছে, সেটি সহজে যাবে না। ২০২৩ সালজুড়ে ডলার সংকট থাকতে পারে। এটা সহজে দূর হবে না।

নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ শঙ্কার কথা জানিয়েছেন আহসান মনসুর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজবাংলার বিজনেস এডিটর আবদুর রহিম হারমাছি

দুই বছরের বেশি সময়ের করোনাভাইরাস মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় কেমন চলছে দেশের অর্থনীতি? ২০২২ কেমন গেল? ২০২৩ সাল কেমন যাবে?

২০২২ সাল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর কোনো দেশের জন্যই ভালো ছিল না। পৃথিবীর পরিস্থিতি ছিল টালমাটাল। বাংলাদেশ এটা থেকে দূরে থাকতে পারেনি। বিশ্বায়নের যুগে এককভাবে থাকা সম্ভব না। আমরাও থাকতে পারি না। আমাদের দেশের সঙ্গে সারা বিশ্বের মিল আছে। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে; আমাদের এখানেও বেড়েছিল। এখনও বেশি আছে।

ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে (বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য) বড় ঘাটতি আছে। এটাও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আছে। বিশ্বের সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াতে আমরা একটি বড় ধাক্কা খেয়েছি। তেল, চাল, ডালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। জাহাজের ভাড়া বেড়ে গেছে।

সব মিলিয়ে আমাদের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে ঘাটতি হওয়াতে আমরা একটা ধাক্কা খেলাম। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিল এক্সচেঞ্জ রেটে (টাকা-ডলারের বিনিময় হার)। আমাদের এক্সচেঞ্জ রেটে হঠাৎ করে বড় পতন হলো। যদি ভারতের মতো আস্তে আস্তে পতন হতো, তাহলে এটিকে আমরা সহনীয়ভাবে বহন করতে পারতাম। যেহেতু একবারে বোঝাটা পড়েছে, আমাদের পিঠটা ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।

মোদ্দাকথা ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার ২৫ শতাংশ ডিভ্যালুয়েশন (অবমূল্যায়ন) হয়েছে; আরও কিছু হতে পারে বলা যায় না। এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্ববাজারে ডলারের মূ্ল্যের যে বড় উল্লম্ফন, সেটা। দুটো মিলিয়ে শকটা বড় আকারের ছিল। ব্যালেন্স অফ পেমেন্টেও ছিল, মূল্যস্ফীতিতেও ছিল। আর সে জন্য আমাদের জনজীবন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই দুই-আড়াই বছরে মানুষ খুবই কষ্ট পেয়েছে; এখনও কষ্ট পাচ্ছে। আরও কতদিন এই কষ্ট করে চলতে হবে, কেউ কিছু বলতে পারছে না।

অন্যদিকে সরকারের যে বাজেট ব্যবস্থাপনা, সেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সরকার বাজেটে কাটছাঁট করছে। এর পরেও কাজ হচ্ছে না। বাজেটে ভর্তুকি ছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা। সেটি বেড়ে এখন হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।

এটি অকল্পনীয় একটি বোঝা। এত বড় ঘাটতি অনেক কঠিন! সরকার না পারছে বহন করতে, না পারছে জনগণের ওপর ফেলতে। এর ফলে বাজেট ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হচ্ছে। অর্থনীতিতে সমস্যা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালে সরকার ভালো অবস্থায় ছিল না। জনগণ ভালো অবস্থায় ছিল না। বিশ্বের কেউ ভালো অবস্থায় ছিল না।

এতসব সমস্যার মধ্যে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল চালু হয়েছে। এই দুটি বড় প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?

এই দুটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রকল্প। পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে, তবে মেট্রোরেল তো আর সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। এটার প্রভাব বোঝা যাবে ২ বছর পরে পুরোপুরি শেষ হলে, তবে বাংলাদেশে একটি আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা হলো। বাংলাদেশও যে পারে, তা প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এ কথা ঠিক যে, ২০২২ সালটা খুবই কঠিন বছর ছিল, সংকটের বছর ছিল, চাপের বছর ছিল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছে। একটার পর একটা বিপদ এসেছে। এসব সামাল দিতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। এখনও খেতে হচ্ছে। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, এখনও নিচ্ছে, কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি অনুকূলে আসছে না।

এতকিছুর মধ্যেও পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল দেশের মানুষকে আশা জাগিয়েছে, যার ইতিবাচক ফল মানুষ পাচ্ছে। সরকারও সাহস পেয়েছে। মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে এই আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পুরোপুরি সুফল পাবে মানুষ, তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। সমস্যা থাকবে, সংকট থাকবে।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালটা আরও কঠিন যাবে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে মন্দাও দেখা দিতে পারে। এর মধ্যেও আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। যেসব বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ আমরা শুরু করেছিলাম, অনেকটি শেষের দিকে, সেগুলো দ্রুত শেষ করে উৎপাদনে যেতে হবে। শুধু রাজধানীর ভেতরে নয়, আশপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করতে মেট্রোরেল করতে হবে। এই যে শুরু হয়েছে, এটা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই আমরা ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখছি, তা পূরণ করতে পারব।

দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো এখন কী অবস্থায় আছে?

আমাদের অর্থনীতির এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট এবং ডলার সংকট। ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভটার পতন হচ্ছে। কয়েক দিন আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ আরও কমে ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ডলারের যে সংকট চলছে, এটা সহজে যে যাবে, তা আমার মনে হয় না। ২০২৩ সালজুড়েও ডলার সংকট থাকতে পারে। এটা সহজে দূর হবে না।

কতগুলো বিষয় আছে, যেগুলো ২০২৩ সালজুড়েই থাকবে। এগুলো সহজে যাবে না। যেমন: ব্যক্তি খাতে যে ১৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ আছে, সেটা তো আমরা শোধ করতে পারিনি। সেটাকে আমরা সামনের দিকে ঠেলে দিয়েছি। আমরা এক বছর পিছিয়ে দিয়েছি। অনেক এলসি (ঋণপত্র) ডেফার করা হয়েছে, সেগুলোকে সামনে আমাদের পে করতে হবে। সামনের দিকে আমাদের পেমেন্টের ঝামেলাটা রয়ে গেল, শেষ হলো না। এই ডলারের টানাপোড়েন চলবে।

যতদিন পর্যন্ত না আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান দুই সূচক রপ্তানি আয় বাড়ে ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স না বাড়বে, ততদিন এই টানাপোড়েন চলবে। রেমিট্যান্সের ব্যাপারে একটু হতাশা আছে। প্রচুর লোক বিদেশ গিয়েছে। সেই দেশগুলোর কিন্তু এখন রমরমা অবস্থা। তেলের বাজার গরম। তাদের গরম অবস্থা।

গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১১ লাখ লোক কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গিয়েছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী কিন্তু আমরা রেমিট্যান্সের প্রত্যাশিত প্রবাহটা পাচ্ছি না। আমরা দেখছি, সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহটা বাড়েনি; উল্টো কমে গেছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই বৈপরীত্য কেন?

আমরা মনে করছি, অর্থ পাচারের কারণে সৌদি আরবের টাকা চলে যাচ্ছে। সে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের টাকা আমরা পাচ্ছি না। আর যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য থেকে টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে। এখানে হুন্ডিটা থাকে না। এ ক্ষেত্রে আমরা পুরো ডলারটা পাচ্ছি; আমাদের দেশি ভাইরা যে টাকাটা পাঠাচ্ছেন। আর মধ্যপ্রাচ্যের ডলারটা পাচ্ছি না। টাকাটা তাদের পরিবারের কাছে চলে আসছে ঠিক; কিন্তু ডলারটা হারিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে আসছে না।

দ্বিতীয় যে জিনিসটা আমাদের ভাবতে হবে, রাজস্বের ক্ষেত্রে আমাদের একটি সমস্যা চলছে। গত বছরও ছিল; এ বছরও থাকবে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হবে না। ২০২২ সালে কর জিডিপি রেশিও আরও কমেছে। আগে সাড়ে আটের মধ্যে ছিল, কিন্তু সেটা কমে কোথায় দাঁড়াবে আমরা জানি না, তবে এটা সাড়ে আটের নিচে হবে। এটা খুব দুঃখজনক। এটা আমাদের ব্যর্থতা। সরকারের সক্ষমতা থাকছে না।

সরকার দেশের বাইরে থেকে, দেশ থেকে ঋণ করছে। আরেকটা বিষয় না বললেই নয়, ব্যাংকিং খাতে আমরা ভালোর দিকে যেতে পারিনি। দিন যত যাচ্ছে, ব্যাংক খাতের অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালে আমরা এখানে বিশাল কিছু কেলেঙ্কারি দেখলাম। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের টাকা সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ এখানে অনেক ব্যাংকের মালিকানা একই ব্যাংকে আছে। আর ইসলামী ব্যাংক হচ্ছে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংক। সেই ব্যাংকটার অবস্থা এখন খুবই খারাপ; পর্যুদস্ত অবস্থা। তাদের এখন ৮ শতাংশ সুদে টাকা ধার নিতে হচ্ছে। এটা তো চিন্তা করা যায় না। অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি দিচ্ছে। তার মানে কী? যারা বেশি দেয় তাদের দুরাবস্থার কারণেই বেশি দিতে হয়। তারা বাধ্য দিতে। এই ব্যাংকটার অবস্থা খারাপ। আমরা আশঙ্কা করছি এই ব্যাংকটির অবস্থা খারাপ কিন্তু কতখানি খারাপ সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

সরকার কিছু বলছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে না, কিন্তু গুজব বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের তারল্য সংকটও বেড়ে যাচ্ছে। আরও কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। ২০২২ সালে ব্যাংকিং খাত নিয়ে একটি আস্থাহীনতা ছিল।

ব্যাংকের ডিপোজিটের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে নিচে ৮ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। এ রকম দেশে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা। আমরা সেটা স্বাভাবিক পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংকিং খাতে নিয়মিত খেলাপি ঋণ এখন লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন বা রাইট অফ এবং মামলার কারণে আটকে থাকা খেলাপি ঋণ যোগ করলে মোট অঙ্ক আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তাহলে ২০২২ সালই কি ব্যাংকিং খাত বেশি খারাপ গেল?

ব্যাংকিং খাত ধারাবাহিকভাবেই খারাপ যাচ্ছিল। আমরা অনেকেই উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করেছিলাম যে একটি ব্যাংকিং কমিশন হবে। সরকারও বলেছিল। সরকার সে কাজটি করেনি।

যে স্ক্যামগুলো (ঋণ অনিয়ম বা কেলেঙ্কারি) হলো, সেগুলোর একটিরও বিচার হয়নি। ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে যে প্রশ্নগুলো উঠেছে, সেগুলোর কিন্তু কোনো উত্তর সরকারের কাছ থেকে আমরা পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তারা আশ্বস্ত করছে না।

সরকার বলুক যে, তারা ভালো আছে। সেটাও বলছে না। আবার খারাপ আছে, সেটাও বলছে না। আমরা শুনতে চাই, দেশবাসী শুনতে চায়, কিন্তু সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুই বলছে না। আমি এখানে একটি দ্বিধা দেখছি, একটি শঙ্কা দেখছি। এখানে ট্রান্সপারেন্সি বাড়াতে হবে।

একটি গ্রুপের হাতে কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা। সেই ব্যাংকগুলোর অবস্থাই এখন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

এখানে দুটো বিষয় আছে। একটি হচ্ছে একজনের হাতে কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা। শেয়ারহোল্ডাররা একটি ব্যাংকের শেয়ারে থাকবে, কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে যে তারা কন্ট্রোলিং শেয়ারে থাকছে। এর ফলে ঝুঁকি একটু বেশি। এখানে যেহেতু একজন মালিক যদি একটি ব্যাংকের কিছু হয়, তাহলে অন্য ব্যাংকগুলোও সমস্যায় পড়ে যাবে। আস্থার যখন সংকট হয়, তখন সবাইকেই আস্থার সংকেটর মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। এখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ঋণের কনসেনট্রেশন। কিছু ব্যক্তি বা পরিবার হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। তারা আইন মেনে যদি নেন, সেটা এক কথা, কিন্তু নিজের ব্যাংক থেকে যদি ঋণ নেন নামে এবং বেনামে, সেটা কিন্তু আরেকটি সমস্যা। এ বিষয়ে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক সুস্পষ্টভাবে কিছু করছে না। এ বিষয়ে আমাদের জানার অধিকার আছে; দেশের মানুষের জানার অধিকার আছে, কিন্তু আমরা কিছুই জানছি না। এসব কারণে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।

আপনি অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো নিয়ে বলছিলেন। তাতে হতাশার দিকই বেশি উঠে এসেছে। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পণ্য রপ্তানিতে চমকের পর চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। নভেম্বরের পর ডিসেম্বরেও পণ্য রপ্তানি থেকে বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। আগামী দিনগুলো কেমন যাবে?

এটা খুশির খবর যে দুই-আড়াই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতিতেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা আমরা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকেই এসেছিল ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

শতাংশ হিসাবে মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশই এসেছিল পোশাক খাত থেকে। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ ছয় মাসে রপ্তানির ৮৪ শতাংশের বেশি এসেছে পোশাক থেকে।

বিস্ময়কর হলো এই কঠিন বিশ্ব পরিস্থিতিতে শেষ দুই মাসে অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। নভেম্বরে এসেছে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আর ডিসেম্বরে এসেছে আরও বেশি ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই কোনো একক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আসেনি। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, নানা বাধা-বিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বিদায়ী ২০২২ সালে রপ্তানি ভালো হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে।

নভেম্বরে আমাদের রপ্তানি আয়ে রেকর্ড হয়। ডিসেম্বরে সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড হয়। গত বছর (২০২২ সাল) তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার, যেটা আগের বছর ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বেড়েছে এক বছরে।

এর কারণ আমরা করোনা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অনেক কাজ করেছি; বিভিন্ন বাজারে গিয়েছি। আমাদের বড় বাজারগুলোতে গিয়েছি। এমার্জিং মার্কেটেও গিয়েছি, তবে এখানে ধোঁয়াশা আছে। রপ্তানির যে চাহিদা সেটা কিন্তু বাড়ছে না ব্যাপকভাবে। একই সময় আমাদের পণ্যের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের চাহিদা কিন্তু বাড়ছে না।

আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণেই হোক বা কোভিডের কারণে চীন থেকে অনেকে সরে আসছেন, অনেক বায়ার বাংলাদেশে আসছেন। সে কারণে আমাদের রপ্তানি হয়তো কিছুটা বাড়ছে। যতদিন পর্যন্ত এই ডাইভারশন থাকবে, আমাদের বাজার ভালো থাকবে।

আমার মনে হয়, আমাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়বে, তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, কোভিডের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আমাদের পোশাকের প্রধান বাজার আমেরিকা ও ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। ওই সব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি যদি আরও খারাপের দিকে যায়, তাহলে কিন্তু এখনকার রমরমা অবস্থা থাকবে না।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ানোর কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তিন মাস ধরে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে আপনি ঋণের সুদের হার বাড়ানোর কথা বলছেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কিছু বলবেন?

আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, আর দেরি না করে ব্যাংকঋণের সুদের হার এখনই বাড়ানো উচিত। বাজারব্যবস্থায় কোনো কিছুর মূল্য বেঁধে রাখা ঠিক না। সেটা তেলের মূল্য হোক, চালের মূল্য হোক বা সুদের হার হোক। কোনোটা ধরে রাখা সার্বিকভাবে ভালো না। নয়-ছয় সুদের হার পরিবর্তন না করে আমরা কী ধরনের রিস্কের মধ্যে পড়ছি। আমাদের দুইভাবে দেখতে হবে একটি হচ্ছে আমাদের কী ঝুঁকি আসবে। আমরা যদি ‍সুদের হারটাকে একটু বাড়াতাম। তাহলে কিন্তু আমাদের এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর আমাদের চাপটা কমে আসত। সেটা কিন্তু আমরা করছি না। এখন কিন্তু এক্সচেঞ্জ রেটের ওপরে আমাদের চাপটা কমে আসত। এক্সচেঞ্জ রেটগুলো একীভূত করা হয়নি। বাজারে ডলারের যে সংকট সেটা কিন্তু চলছে। এই সংকট কাটছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই সমস্যায়।

ব্যাংকগুলো মার্কেট থেকে ডলার কিনছে বেশি দামে। সুদের হার যদি বাড়ানো যেত, তাহলে রিটার্ন অন টাকা বাড়ানো যেত। তাহলে সমস্যা কমত।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন দাতা দেশ সংস্থার কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এখন তা অনেক কমে গেছে। কেন কমছে?

আমি দেখি যে বাংলাদেশের স্বাভাবিক যে লেভেলটা ছিল, সেটা ছিল ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হয়েছিল। বিদেশিরা স্বাস্থ্য খাত উন্নত করতে আমাদের সাহায্য করেছে। এ কারণে গত বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের ঋণের অর্থপ্রবাহ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, সেটা কিন্তু এ বছর হবে না। এ বছর আমরা হয়তো আবার ৮ বিলিয়নে ফেরত চলে আসব। সরকার যেটা চাচ্ছে কিছু বাজেট সাপোর্ট দিয়ে এটাকে ১০ বিলিয়নের কাছাকাছি নিয়ে আসতে। আইএমএফ থেকে কিছু পাবে। আর বাজেট সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে সবকিছু মিলিয়ে যদি এটা ১০-১১ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে আসা যায়, সেটা খুবই ভালো হবে। এই সংকটকালে কম সুদের ঋণ কাজে লাগবে।

আরও পড়ুন:
বস্তায় নয়, এখন ঘুষ লেনদেন ডলারে: হাইকোর্ট
রেমিট্যান্স পাঠাতে চার্জ লাগবে না প্রবাসীদের
ডলারসংকটে বিপাকে পোশাক রপ্তানিকারকরা
৪ মাসেই ৫ বিলিয়ন বিক্রি, তারপরও ডলার নেই ব্যাংকে
উচ্চ আয়ের প্রবাসীরাও পাবেন ডলারপ্রতি ১০৭ টাকা

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Export earnings are coming in higher than expected

প্রত্যাশার চেয়েও রপ্তানি আয় বেশি আসছে: ফারুক

প্রত্যাশার চেয়েও রপ্তানি আয় বেশি আসছে: ফারুক বিজিএমইএ সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান। ছবি: নিউজবাংলা
বিস্ময়কর হলো এই কঠিন বিশ্ব পরিস্থিতিতে শেষ দুই মাসে, অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। নভেম্বর মাসে এসেছে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আর ডিসেম্বরে এসেছে আরও বেশি ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই কোনো একক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আসেনি: ফারুক হাসান

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান বলেছেন, নানা বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ২০২২ সালে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে রপ্তানি। বিশেষ করে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রপ্তানিতে উল্লম্ফন সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এই রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে ঘুরে দাঁড়িয়ে করোনাভাইরাস মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যাবে দেশের অর্থনীতি। গত বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজবাংলার বিজনেস এডিটর আবদুর রহিম হারমাছি

সবাইকে অবাক করে দিয়ে পণ্য রপ্তানিতে চমকের পর চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ নভেম্বরের পর ডিসেম্বরেও পণ্য রপ্তানি থেকে বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে আগামী দিনগুলো কেমন যাবে?

এটা খুশির খবর যে, দুই-আড়াই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতিতেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা আমরা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকেই এসেছিল ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। শতাংশ হিসাবে মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশই এসেছিল পোশাক খাত থেকে। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এই ছয় মাসে মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশের বেশি এসেছে পোশাক থেকে।

বিস্ময়কর হলো এই কঠিন বিশ্ব পরিস্থিতিতে শেষ দুই মাসে, অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। নভেম্বর মাসে এসেছে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আর ডিসেম্বরে এসেছে আরও বেশি ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই কোনো একক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আসেনি। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, নানা বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বিদায়ী ২০২২ সালে রপ্তানি ভালো হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে।

নভেম্বর মাসে আমাদের রপ্তানি আয়ে রেকর্ড হয়। ডিসেম্বর মাসে সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড হয়। গত বছর (২০২২ সাল) তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার, যেটা আগের বছর ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বেড়েছে এক বছরে। এর কারণ আমরা করোনা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অনেক কাজ করেছি; বিভিন্ন বাজারে গিয়েছি। আমাদের বড় বাজারগুলোতে গিয়েছি। এমার্জিং মার্কেটেও গিয়েছি।

রপ্তানি ধরে রাখতে পেরেছি, এর বড় কারণ হচ্ছে আমাদের কাঁচামালের দাম কিন্তু বেড়ে গেছে। তুলা, কাপড়, কেমিক্যাল সবকিছুর দাম বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেইট কস্ট বা কনটেইনার কস্ট কিন্তু অনেক বেড়েছে। ফলে আমাদের গার্মেন্টেসে ইউনিট প্রাইস অনেক বেড়েছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। এ ছাড়া ভ্যালু অ্যাডেড অনেক প্রোডাক্টের অর্ডার নিতে পেরেছি। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করতে পেরেছি। ফলে বাংলাদেশ এখন দামি পণ্যের অর্ডারও পাচ্ছে। আগে বাংলাদেশে ১৫ ডলারের জ্যাকেট হতো। এখন বায়াররা আমাদের এখানে ৩০-৪০ ডলারের জ্যাকেট অর্ডার করছে। আমরা নতুন মার্কেটগুলোতে ঢুকতে পেরেছি; বেশি দামি পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছি। আবার পণ্যের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে রপ্তানি বেড়েছে।

তাহলে কী আশা করা যায়, রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করেই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশের অর্থনীতি?

২০২৩ সালে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আমাদের পোশাকের প্রধান দুই বাজার আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ঋণের সুদের হার অনেক বেড়েছে; মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমেছে। এখন শীত চলছে। এ সময় জ্বালানি খরচ অনেক বেশি। খাদ্যের খরচ বেড়েছে। ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার পর তাদের কাছে আর টাকা থাকছে না, যেটা দিয়ে তারা কাপড় কিনবে। তাই আগামী দিনগুলো ভালো যাবে, এটা বলা যাচ্ছে না।

গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের রপ্তানি আয়ের উল্লম্ফনের তথ্যে সার্বিকভাবে রপ্তানি বাণিজ্যে রমরমা অবস্থা চলছে, এটা বিচার করলে কিন্তু ঠিক হবে না। গত কয়েক মাস ধরে আমাদের অর্ডার কমছে। পণ্যের দাম বেড়েছে, কিন্তু পরিমাণ কমেছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কমেছে। চলতি জানুয়ারি মাস, আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে আমাদের রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমাদের কারখানায় অর্ডার কম আছে এখন। ক্রেতারা এখন অনেক অর্ডার হোল্ড করছে। কারণ তারা সন্দিহান যে, সামনে কী হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কিছুদিন আগে বলেছে, ২০২৩ সালে পুরো বিশ্বের ৩ ভাগের এক ভাগ মন্দায় চলে যাবে। এটা খুবই বিপজ্জনক, সেটার লক্ষণ আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং আমাদের এখন যে জিনিসটা করতে হবে, সেটা হলো বাজারটা ধরে রাখা। ২০২১ থেকে ২২ সালে বাজার বড় হয়েছে; আমরা মার্কেটের দখল বাড়াতে পেরেছি। ২০২৩ সালে বাজার কিন্তু আর বড় হবে না; উল্টো ছোট হয়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের শেয়ারটাকে ধরে রাখার জন্য, কিন্তু যেহেতু পুরো বাজার ছোট হয়ে যাবে, সেহেতু আমাদের বাজার ছোট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চেষ্টা করছি বাজার বাড়াতে।

আমাদের এখন সবার সাপোর্ট দরকার। আমরা যে চাকরিগুলো তৈরি করেছি বিগত বছরগুলোতে, এমনকি সংকটের মধ্যে ২০২২ সালেও কিন্তু আমরা নতুন অনেক মানুষকে চাকরি দিয়েছি। এই চাকরিগুলোকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু এটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন চাকরি তৈরি করা অসম্ভব; বরং বর্তমান চাকরিগুলো ধরে রাখার জন্য আমাদের সব ধরনের কাজ করতে হবে। আর এর জন্য সবার সহযোগিতা দরকার।

সরকারের করছাড়, ক্রেতাদের সাপোর্ট, একই সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের সহযোগিতা দরকার। এই কঠিন সময়ে কীভাবে এই খাতকে টিকিয়ে রাখা যায়, কীভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারি, সেই কাজটা করে যাচ্ছি। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাস ভালো যাবে না। এরপর যুদ্ধের ওপর ডিপেন্ড করছে কী হবে। আগামী কয়েকটি মাস পর বোঝা যাবে, কী হবে, তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এই সমস্যা কিন্তু শুধু আমাদের নয়, সারা পৃথিবীতেই একই সমস্যা।

এ ছাড়া এটা নির্বাচনের বছর। ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথমেই দেশে জাতীয় নির্বাচন হবে। সে জন্য ২০২৩ সালটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এখন কোনো সমস্যা হয়, দেশে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, হরতাল-অবরোধ-জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়, তাহলে কিন্তু এখান থেকে আমাদের বায়াররা চলে যাবে; রপ্তানি খাত ধাক্কা খাবে।

২০২২ সালটা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের জন্য ভালো বছর ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রার ওপরে চাপ আছে। ২০২৩ সালেও এই চাপ থাকবে। চাপ কমাতে হলে আমাদের প্রচুর সাপোর্ট দরকার। মনে রাখতে হবে, রপ্তানি আয় থেকে বিদেশি মুদ্রা দেশে না আসলে রিজার্ভ আরও কমে যাবে; অর্থনীতি আরও চাপের মধ্যে পড়বে। রাজনৈতিক নেতাদের এই বিষয়টি খুব ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেশের জন্য কাজ করতে হবে।

গত এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে এতে রপ্তানিকারকরা কতটা লাভবান হয়েছেন?

এ কথা আমি অকপটে স্বীকার করছি, ডলারের দাম বাড়াতে আমাদের লাভ হচ্ছে। দেরিতে হলেও এটা হয়েছে। অন্যান্য দেশে কিন্তু আরও আগেই তাদের মুদ্রা ডিভ্যালুয়েশন করেছিল। আমাদের প্রধান প্রতিযোগী চীন, ভারত, ভিয়েতনামও করেছিল, কিন্তু আমরা অনেক দেরিতে এই কাজটা করেছি। এই যে রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফনের কথা বলা হচ্ছে, তাতে ডলারের দাম বৃদ্ধির অবশ্যই অবদান আছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখেই সবকিছু তুলনা করতে হবে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল চালু হয়েছে বিদায়ী বছরে দুটি মেগা প্রকল্প দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে?

অবশ্যই বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। খুশির খবর হচ্ছে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে অবদান রাখা শুরু করেছে। মেট্রোরেলও কাজ করবে এখানে। একদিকে এই দুটি বড় প্রকল্প বিশ্ব অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি বা ইমেজ অনেক ইমপ্রুভ করেছে। অন্যদিকে অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে, তবে তাড়াতাড়ি আমাদের অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো শেষ করতে হবে। যেমন: বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্প দ্রুত শেষ করতে হবে। এটা অনেক দিন ধরে আটকে আছে। এ প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো না হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে।

আমি সরাসরি প্রতিদিন যোগাযোগ রাখছি। আশা করছি এটা জুনের মধ্যে শেষ হবে। এরপর ঢাকা-চিটাগাং রোডের কাজগুলো করতে হবে। ঢাকা এয়ারপোর্টের থার্ড টার্মিনালের কাজগুলো চলতি বছরের অক্টোবরে শেষ হবে বলে আশা করছি। কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চালু হওয়ার কথা। এগুলোর সব ইতিবাচক বলে মনে করি। প্রকল্পগুলোতে সারা বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি আরও ভালো হবে। পাশাপাশি বস্ত্র খাত এটার দ্বারা উপকৃত হবে।

বাজারে এখনও ডলার সংকট চলছে অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করছেন, তারা পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না পোশাক শিল্প মালিকরা কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমরা চাপে আছি। সেই কারণে সরকার একটু কড়াকড়ি করেছে। গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে যেহেতু আমরা কাঁচামাল আমদানি করি, এর ভিত্তিতে কিন্তু রপ্তানি করছি। ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলছি, ইমপোর্ট করছি। কাঁচামাল আমদানিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও চাপের মধ্যে পড়েছে। এতে সরকার বা অন্য কারও কোনো দোষ নেই। আমরা তো চোখের সামনে দেখছি, সরকার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে কৃচ্ছসাধন করছে; নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।

বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমরা ভালো আছি। শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের কথা না হয় বাদই দিলাম। ইউরোপের অনেক বড় বড় দেশের চেয়েও ভালো আছি আমরা। ২০২৩ সালে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আছে, সেগুলো যদি সবাই মিলে মোকাবিলা করতে পারি, তাহলে করোনার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারব। আর এতে অবশ্য তৈরি পোশাকশিল্প বড় অবদান রাখবে বলে মনে করি।

মূল্যস্ফীতির চাপে পোশাক শ্রমিকরা কষ্টে আছেন তারা যে বেতন পাচ্ছেন, এই চড়া বাজারে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি বা অন্য কোনো সহায়তার বিষয়ে ভাবছেন কী?

আমাদের শ্রমিকদের বছরে মিনিমাম একবার করে ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে। কারও কারও দুবার বেতন বাড়ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন কারখানায় কম দামে পণ্য দেয়ার চেষ্টা করছি। অনেক কারখানার পাশে টিসিবির ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে কম দামে পণ্য কিনতে পারছেন শ্রমিকরা। অনেক কারখানার মালিক নিজ উদ্যোগে কম দামে প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। আমরা চেষ্টা করছি প্রতিটা কারখানায় এটা চালু করতে।

রেশনের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেছি। টিসিবি আমাদের কারখানার কাছে চাল-ডাল বিক্রি করছে কম দামে। আমরা চাচ্ছি রেশনিংয়ের মাধ্যমে শ্রমিকদের পণ্য দিতে। আশা করি সরকার সেটা করবেন। কারখানাগুলোকে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য বলছি।

শোনা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং চীনে নতুন করে কোভিড পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দেশ থেকে অনেক অর্ডার বাংলাদেশে আসছে ভিয়েতনাম মিয়ানমার থেকেও কিছু অর্ডার আসছে সব মিলিয়ে আগামী দিন কেমন যাবে?

বলা খুব কঠিন। এ কথা ঠিক যে, চীন-ভিয়েতনাম থেকে কিছু অর্ডার আগেও এসেছিল, এখনও আসছে, কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্ডার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আর আমরা আমাদের দক্ষতা কতটা বাড়াতে পারি সেটা দেখার বিষয়। এ সময় কী কাজ করছি সেটার ওপর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ইউনিয়ন লিডার এগুলোর ওপর অর্ডার নির্ভর করে। গত দুই বছরে যেভাবে বিনিয়োগ করেছি, শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়িয়েছি, নতুন যন্ত্র কিনেছি, কমপ্লায়েন্সে বিনিয়োগ করেছি, এগুলোর ফলাফল ইতিবাচকভাবে ক্রেতাদের কাছে পাব আশা করি। সব স্টেকহেল্ডার, ট্রেড ইউনিয়ন লিডাররা এ সময় আমাদের সঙ্গে থাকবেন বলে আশা করছি।

কিছুদিন আগে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে আপনি ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অর্জিত হবে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই লক্ষ্য কী অর্জিত হবে?

আমরা নতুন পণ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্জন করা সম্ভব হবে যদি সবার সহযোগিতা পাই। ২০২৩ সালের কয়েক মাস যুদ্ধের কারণে, অন্যান্য কারণে এই মুহূর্তে অর্জন করা কঠিন মনে হচ্ছে। আশা করি সমস্যা কেটে যাবে। এখান থেকে বের হয়ে আসব। পৃথিবী বের হয়ে আসবে। যে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েছি, সেগুলোকে সুযোগে রূপান্তর করব। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য পূরণ করব।

আরও পড়ুন:
রপ্তানিতে ইতিহাস গড়ে ১ মাসে ৫ বিলিয়নের বেশি আয়
মহাসড়কে রপ্তানিপণ্য চুরি বন্ধ চায় বিজিএমইএ
নবমবারের মতো রপ্তানি ট্রফি পেল এনভয় টেক্সটাইলস
রপ্তানি ট্রফি পেল ৭১ প্রতিষ্ঠান
রপ্তানি আয় নগদায়নে সনদ ইস্যু করতে পারবে এডি শাখা

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Money laundering has increased due to the reduction of interest rates

‘সুদহার কমায় টাকা পাচার বেড়েছে’

‘সুদহার কমায় টাকা পাচার বেড়েছে’ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। ছবি: নিউজবাংলা
আমি মনে করি, বাংলাদেশে খাদ্যের সরবরাহে সমস্যা হবে না। কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ কিন্তু সরবরাহ পরিস্থিতি নাজুক হলেই হয় না। মানুষের যদি ক্রয়ক্ষমতা না থাকে তখন দুর্ভিক্ষ হয়। তাই সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক রাখতে হবে, পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ঠিক রাখতে হবে। এর মধ্যে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সাশ্রয়ী মূল্যে সরকার এক কোটি পরিবারকে খাদ্য দিচ্ছে। এগুলো আরও বাড়াতে হবে। আমি আশা করি, বিশ্বাস করি, প্রার্থনা করি, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না: গোলাম রহমান

ভোক্তাদের অধিকার ও স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, নয়-ছয় সুদহারের কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে গেছে। ব্যাংকের টাকা নিয়ে মানুষ জমি কিনছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা একটি গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। এখান থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে।

বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করা দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজবাংলার বিজনেস এডিটর আবদুর রহিম হারমাছি

বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। শীতের সবজি বাজারে এলেও দাম কমছে না। চাল-আটার দাম বেড়েই চলেছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) বলছে, জ্বালানি ও খাদ্য এক বছর আগের দামে ফিরেছে। জ্বালানি তেলের দাম ৮০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে কমছে না কেন?

আসলে বাজারে সব খাদ্যসহ সব পণ্যের দাম খুবই বেশি। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে মানুষের খুবই কষ্ট হচ্ছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় কম দামে পণ্য পেয়ে অসহায় গরিব মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। আড়াই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তাদের আয়-উপার্জন বাড়েনি; বাড়েনি ক্রয়ক্ষমতা। অথচ খরচ বেড়েই চলেছে। তাদের সংসার চালানো সত্যিই কঠিন হয়েছে পড়েছে।

এই যে শীতের সবজিতে বাজার ভরে গেছে। কিন্তু দাম কমছে না। চাল-আটার দাম বেড়েই চলেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মাঝারি মানের চালের দাম এক মাসে বেড়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ; এক বছরে বেড়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। এক মাসে সরু (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ; এক বছরে বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আটা-ময়দার দাম বেড়েছে আরও বেশি, এক বছরে খোলা আটার দাম বেড়েছে ৭৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর প্যাকেটজাত আটার দাম বেড়েছে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ববাজারে যা ঘটে তার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়ে। এটা হচ্ছে বিশ্বায়নের কুফল বা সুফল, যাই বলেন না কেন। আমাদের দেশে নানা রকম সংকট আছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম যে বেশি, সেই সংকট তো আছেই। পাশাপাশি বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় আমাদের রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে বেশি। ফলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ঋণাত্বক হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন টাকা তার মূল্য হারাচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ছে। ৯ মাস, এক বছর আগে এক ডলার কিনতে ৮৫ টাকা লাগত। এখন এক ডলার কিনতে ১১০ টাকা লাগে। আগে একটি ১০ ডলারের পণ্য যদি ৮৫০ টাকায় যাওয়া যেত সেটার এখন দাম ১ হাজার ১০০ টাকা। পাশাপাশি কর বাড়ছে। এটা দাম বাড়ার একটি কারণ।

এটা তো গেল বিশ্ব পেক্ষাপট। পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?

আমাদের এখানে পণ্যের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে এক্সপেকটেশন, ব্যবসার ক্ষেত্রে যেটাকে বলা হয়ে থাকে অতি মুনাফা বা আশা। আমাদের এখানে প্রফিট এক্সপেকটেশন মনে হয় বেড়ে গেছে। আমাদের অনেক পণ্যের আমদানিকারকের সংখ্যা অনেক সীমিত। মাত্র ৫ থেকে ৭ জন। এরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের লাভ করার মানসিকতা বেড়েছে। এরাই সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

এ ছাড়া যারা পাইকার বা খুচরা বিক্রেতা তাদের লাভ করার ইচ্ছাও বেড়ে গেছে। আগে তারা ১০০ টাকায় ২ টাকা লাভ করে সন্তুষ্ট থাকতেন। এখন তারা ১০০ টাকায় ৫ টাকা লাভ করার চেষ্টা করছেন। ভোক্তারা সেটা মেনে নিচ্ছেন বলে আমার ধারণা। এর ফলে পণ্যমূল্য যে পরিমাণ বাড়ার কথা তার চেয়ে বেশি বাড়ছে। আমাদের দেশে আরেকটা জিনিস হয়, হঠাৎ করে একটি ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। কখনো চিনি বা তেল বা পেঁয়াজ-রসুন। এখানে সরবরাহ বিঘ্নিত করে দাম বাড়ানো হয়। আমাদের ভোক্তা অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা কখনো বড় ব্যবসায়ীরা করেন। কখনো মজুতদাররা করেন। আবার পাইকাররা বা খুচরা ব্যবসায়ীরা করেন। এটাও পণ্যমূল্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার একটি অন্যতম কারণ। আমাদের দেশে মানুষের মুনাফা করার মানসিকতায় একটি স্ফীতি ঘটছে।

সরকার কী সঠিকভাবে বাজার মনিটর বা তদারক করছে?

কিছুদিন আগে আমাদের দেশের প্রতিযোগিতা কমিশন একটি কাজ করেছে। আমাদের একটি প্রতিযোগিতা কমিশন ছিল; তাদের কোনো কাজ আমরা এতদিন দেখতে পাইনি। কিন্তু কিছুদিন আগে তারা একটি কাজ করেছে। বেশি দামে পণ্য বিক্রির অভিযোগে দেশের কয়েকটি বড় বড় প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কমিশন মামলা করেছিল; তারা ভয়ও পেয়ে গিয়েছিল। দেশের মানুষ কমিশনকে বাহাবা দিয়েছিল। আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এবার বোধহয় কিছু একটা হবে। কিন্তু সেটা কেন জানি আবার ঝিমিয়ে পড়েছে। এ কাজগুলো হয়েছিল কমিশনের আগের চেয়ারম্যানের সময়ে। তিনি সম্প্রতি অবসরে গেছেন। এখন নতুন চেয়ারম্যান এসেছেন, তার কাছ থেকে আমরা আগের মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি চাই। তাহলেই একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ব্যবসায়ীদের দেশের মানুষকে জিম্মি করে অতিমুনাফা করার মানসিকতা কমবে।

প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরে যাওয়ার আগে বেশ কিছু মামলা করেছেন। মামলার নেচার কনক্লুশন হয়নি। মামলা করা তো যথেষ্ট নয়। শুধু মামলা হলে হবে না। দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, তাহলে প্রভাব পড়বে। ব্যবস্থার কথা আমরা জানতে পারিনি। এ ব্যাপারে কমিশন আরও তৎপর হবে- এটা প্রত্যাশা করি।

বাজারে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই কী সঠিক দায়িত্ব পালন করছে?

এফবিসিসিআইর তো কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই। ব্যক্তি যখন মুনাফা করার জন্য নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে, তখন এফবিসিসিআই বা অন্য কোনো সংস্থা যাদের কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই, তারা যে খুব একটা কাজ করতে পারে তা আমার মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে দেশের আইন আর যেসব সংস্থা দেশের এই আইন প্রয়োগ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ধরপাকড় করে, ভয় দেখিয়ে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে কিন্তু অনেক সময় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অনেক সময় দেখা যায়, ধরপাকড় করলে পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়, তখন ভোক্তা-ক্রেতারা আরও বেশি সংকটে পড়েন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার তাদের কাজ করছে। তবে আমি মনে করি পণ্যমূল্য কমাতে হলে মানিটারি পলিসি (মুদ্রানীতি) ও ফিসক্যাল পলিসিতে (রাজস্ব নীতি) পরিবর্তন আনতে হবে। যাতে অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়ে।

পৃথিবীর অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির পারদ নিচের দিকে নামাতে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন আনছে। আমাদেরও সেই পথে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছে। আজ এই সমস্যা তো কাল ওই সমস্যা। এর সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে তো নানা ঝামেলা আছে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে, বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজন হলে বিদ্যমান নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

এই সংকটকালে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে অর্থনীতিবিদরা ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ানোর কথা বলছেন। সরকারের দু-একজন মন্ত্রীও একই কথা বলছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী নেতারা বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ কমে যাবে। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আপনি কী মনে করেন?

সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, চীনসহ প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই একই কাজ করছে। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা ৬ শতাংশ আর ৯ শতাংশের মধ্যে আটকে গেছি। আমরা ডিপজিটরকে ৬ শতাংশ দিই। আর ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ৯ শতাংশ হারে ঋণ দিই। এর ফলে বড় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা টাকা জমা রেখেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমার মনে হয় বিষয়টি আবার ভেবে দেখা উচিত।

এখানে বলা হচ্ছে, সুদের হার বাড়লে উৎপাদন খরচ বাড়বে। সেখানে একটি ফারাক আছে। কারণ যদি উৎপাদন খরচ বাড়ে সেটা বেড়ে আবার কমতে পারে। তখন মূল্যস্ফীতিও কমবে। তাই আমি মনে করি, নয়-ছয় সুদের হার থেকে আমাদের দ্রুত বেড়িয়ে আসা উচিত। ছয় মাস-এক বছরের জন্য হলেও এটা করা উচিত। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে, ২০২৩ সাল খুবই কঠিন সময় যাবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শঙ্কাও করছে তারা। দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসও দেয়া হচ্ছে। এই তো আর ১০-১২ দিন পরই ২০২৩ সাল শুরু হবে। তাই এই কয়টা দিন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নানান কিছু চিন্তা করে, বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। মনে রাখতে হবে, ২০২৩ সালকে যদি আমরা করোনা মহামারির মতো মোটামুটি ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশকে আর পেছনে তাকাতে হবে না।

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দীর্ঘদিনের দাবির পর ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার কমিয়ে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগে শিল্প খাতে ঋণের সুদের হার ১৫, ১৬, এমনকি ২০ শতাংশ পর্যন্তও ছিল। সুদের হার কমলেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে কেন?

এখানেই তো বড় প্রশ্ন। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বলেছিলেন, সুদের হার কমলে, দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, খেলাপি ঋণ কমবে। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা, দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এখানে তারা করোনা মহামারি ও যুদ্ধের অজুহাত দেখাচ্ছেন। কিন্তু খেলাপি ঋণ বাড়ছে কেন? ছয় মাস আগে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটাকে কিন্তু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

দেশে সুদের হার কমলেও খেলাপি ঋণ কমছে না; আড়াই বছরের বেশি সময় এরপর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে মেয়াদি আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া হয়। তবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ হলেও ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ রয়ে গেছে। আমি মনে করি, নয়-ছয় সুদহারের কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে গেছে। ব্যাংকের টাকা নিয়ে মানুষ জমি কিনছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা একটি গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। এখান থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের অনেকের মধ্যে এ রকম একটি প্রবণতা আছে, ‘আমার এই চিন্তাধারা বিশ্বকে দিবে নাড়া’। বিশ্ব যেভাবে উপকার পেয়েছে সেটা না করে আমরা নিজেরা আমাদের মতো কাজ করতে চাই। আমাদের এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এই প্রবণতা সংকটকে ঘনীভূত করে। সারা বিশ্ব যা করছে আমাদের উচিত সেটা অনুসরণ করা।

এমনিতেই বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। সবাই আতঙ্কে আছেন, রমজান মাসকে সামনে রেখে আরও বাড়বে। আপনি কি মনে করেন?

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখানে বলির পাঁঠা। কোনো পণ্যের দাম বাড়লেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু এখানে মূল্যস্ফীতি কমাতে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয় আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। আর উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে যেসব মন্ত্রণালয় জড়িত তাদের যেমন-কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়।

আমরা কিছু ভালো নীতি দেখতে পাচ্ছি। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সমস্যা সমাধানের জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলা কঠিন করা হয়েছিল। রমজানকে সামনে রেখে পণ্য আমদানির এলসি সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খেজুরসহ অতিপ্রয়োজনীয় ৮ পণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে। পণ্যগুলো হলো খেজুর, ছোলা, ভোজ্যতেল, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা ও চিনি। রোজার সময় যাতে কোনো ঘাটতি না পড়ে, দাম সহনীয় থাকে- সে জন্য এই ৮ পণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকে সাপ্লায়ার্স ও বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ৯০ দিনের মধ্যে অর্থ পরিশোধের চুক্তিতে এসব পণ্য আনা যাবে।

এটাকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। সরবরাহ পরিস্থিতির যদি উন্নতি হয় তাহলে কিন্তু মূল্য কমবে না। সে ক্ষেত্রে দেখতে হবে কোনো একটি বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে সরবরাহে সমস্যা তৈরি করে কেউ অতি মুনাফা করার চেষ্টা করছে কি না। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কিন্তু সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির ব্যবহার আরও নিবিড় করতে হবে। আরও যুক্তিসংগত এবং সময় উপযোগী করতে হবে।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালে অনেক দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের অবস্থা কেমন?

খাদ্যের দিক দিয়ে আমি বলব, বাংলাদেশ এক ধরনের স্বস্তির মধ্যেই আছে। সরকারি গুদামগুলোতে ১৭ লাখ টনের মতো খাদ্য মজুত আছে। বেসরকারি পর্যায়েও প্রচুর খাদ মজুত আছে। সরকার ও বেসরকারিভাবে প্রচুর চাল ও গম আমদানি হচ্ছে। আমনের ফলন ভালো হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় আগামী দুই-এক বছর খাদ্য নিয়ে খুব একটা চিন্তার কারণ আমি দেখছি না।

আমি মনে করি, বাংলাদেশে খাদ্যের সরবরাহে সমস্যা হবে না। কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ কিন্তু সরবরাহ পরিস্থিতি নাজুক হলেই হয় না। মানুষের যদি ক্রয়ক্ষমতা না থাকে তখন দুর্ভিক্ষ হয়। তাই সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক রাখতে হবে, পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ঠিক রাখতে হবে। এর মধ্যে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সাশ্রয়ী মূল্যে সরকার এক কোটি পরিবারকে খাদ্য দিচ্ছে। এগুলো আরও বাড়াতে হবে। আমি আশা করি, বিশ্বাস করি, প্রার্থনা করি, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না।

আপনি বলছিলেন, মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তরা কষ্টে আছেন। তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় সরকারের কিছু করা উচিত কি না?

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য কিনে গরিব মানুষের কাছে কম দামে বিক্রি করছে স্থানীয় বাজারে। এর অর্থ সার্বিক সরবরাহ পরিস্থিতি কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে না। টিসিবি যদি দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহ না করে দেশের বাইরে থেকে পণ্য সংগ্রহ করত তাহলে ভালো হতো। মূল্যস্ফীতিতে সেটার একটি ভালো প্রভাব পড়ত।

সার্বিকভাবে নিম্ন মধ্যবিত্তরা যাতে ভালো থাকেন, সেটা নিয়ে সরকারকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। তাদের আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সংকট তৈরি করেছে নয়ছয় সুদের হারের বাঁধন। এর ফলে যারা ফিক্সড ইনকাম গ্রুপের লোক, যারা পেনশনভোগী, যাদের সঞ্চয় থেকে আয় দিয়ে সংসার চালান আমানতের সুদের হার কমায় তারা কিন্তু আরও সংকটাপন্ন হচ্ছেন। তাদের জন্য সরকারের অবশ্যই কিছু ভাবতে হবে, করতে হবে।

পণ্য মূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের তৎপরতাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

সরকার সচেতন। বিশেষ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুব সচেতন। তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন বলে আমাদের ধারণা। সরকারকে অনেক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। যাদের লবিং ক্ষমতা যত বেশি তাদের পক্ষে সিদ্ধান্তগুলো যায়। এখন বিত্তবানদের লবিং ক্ষমতা বেশি। সাধারণ মানুষের খুব কম। তবুও আশা করব রমজান মাস আসছে, দ্রব্যমূল্য যাতে সহনীয় থাকে, সন্তোষজনক থাকে, সাধারণ মানুষ যাতে কষ্ট না পান, এর জন্য সরবরাহ পরিস্থিতি যাতে ঠিক থাকে, মানুষের আয় যাতে ঠিক থাকে, বাড়ে। আর কেউ যাতে সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে না দেন, সেদিকে সরকারকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

আরও পড়ুন:
যুদ্ধ থেমে গেলে নতুন সম্ভাবনা
লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতির পথে বাংলাদেশ
বিদেশি ঋণেও যুদ্ধের ধাক্কা, ৪ মাসে কমল ২৫ শতাংশ
শুধু দেশে নয়, সংকট সারা বিশ্বে: এমসিসিআই
এখন অন্যরাও ঋণ দেবে, সংকট কেটে যাবে

মন্তব্য

বাংলাদেশ
New possibilities when war stops

যুদ্ধ থেমে গেলে নতুন সম্ভাবনা

যুদ্ধ থেমে গেলে নতুন সম্ভাবনা বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। ছবি: নিউজবাংলা
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের এই ব্যাকওয়ার্ড শিল্প না থাকলে আজকে পোশাকশিল্পের এমন অবদান কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে, তাতে কিন্তু আমাদেরও বড় অবদান আছে। আমরা তুলা আনি, সেখান থেকে সুতা বানাই, সুতা থেকে কাপড়, কাপড় থেকে ডাইং ফিনিশিং করছি। সেখানে প্রিন্টিং হচ্ছে, চেক হচ্ছে, ডেনিম হচ্ছে, টুইল হচ্ছে, গ্যাবার্ডিন হচ্ছে, নিট ফ্যাব্রিক হচ্ছে নিট খাতকে ৯০ শতাংশ জোগানদাতা আমরা। ওভেন খাতে আমাদের জোগান হচ্ছে রপ্তানির ৪০ শতাংশ। আর ডেনিমের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জোগানদাতা আমরা: মোহাম্মদ আলী খোকন

বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় আর চীন প্রথম, গত দশক পর্যন্ত এমনই ছিল প্রচলিত তুলনা। তবে এ বছর অন্তত ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধিতে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। আর এতে পোশাক রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি বস্ত্রশিল্প মালিকদেরও বড় অবদান রয়েছে বলে মনে করেন বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। যুদ্ধ থেমে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই আশার কথা শুনিয়েছেন মোহাম্মদ আলী খোকন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজবাংলার বিজনেস এডিটর আবদুর রহিম হারমাছি

বস্ত্রশিল্প খাতের অবস্থা এখন কেমন? দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কতটা অবদান রাখছে এই খাত?

আমরা বস্ত্র খাতের ব্যাকওয়ার্ড শিল্পের (পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প) সবচেয়ে বড় সংগঠন। আমাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে রপ্তানিতে আমাদের জোগান ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষের বস্ত্রের যে জোগান, সেটি আমরাই দিয়ে থাকি। আমরা বছরে দেশে সাত বিলিয়ন মিটার কাপড় জোগান দিই। যার অনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে আমাদের বছরের টার্নওভার প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার। আমাদের যে বিনিয়োগ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, এটি ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট। এর সঙ্গে যদি আমরা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বিনিয়োগ যোগ করি, তাহলে মোট বিনিয়োগ হবে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আমাদের এই খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। তাই সামগ্রিক বিচারে আমাদের বস্ত্র খাতের অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

সবচেয়ে বড় কথা যেটি, সেটি হচ্ছে আমাদের এই ব্যাকওয়ার্ড শিল্প না থাকলে আজকে পোশাকশিল্পের অবদান কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এই যে গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে, তাতে কিন্তু আমাদেরও বড় অবদান আছে। আমরা তুলা আনি, সেখান থেকে সুতা বানাই, সুতা থেকে কাপড়, কাপড় থেকে ডাইং ফিনিশিং করছি। সেখানে প্রিন্টিং হচ্ছে, চেক হচ্ছে, ডেনিম হচ্ছে, টুইল হচ্ছে, গ্যাবার্ডিন হচ্ছে, নিট ফ্যাব্রিক হচ্ছে নিট খাতকে ৯০ শতাংশ জোগানদাতা আমরা। ওভেন খাতে আমাদের জোগান হচ্ছে রপ্তানির ৪০ শতাংশ। আর ডেনিমের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জোগানদাতা আমরা। বাংলাদেশে জ্বালানির বড় গ্রাহক আমরা। ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমরা ব্যবহার করছি। করোনাভাইরাসের সময় আমরা বিপদে পড়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ উদ্যোগে আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই সময়ের উদ্যোগের কারণে পরবর্তী সময়ে আমরা ভালো করতে পেরেছি। আসলে এই শিল্পটি ভালোর দিকে ছিল। নতুন বিনিয়োগ আসছিল; কর্মসংস্থান বাড়ছিল।

আড়াই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে। কিছুদিন সংবাদ সম্মেলন করে বস্ত্র খাতের সংকটের কথা বলেছিলেন। এখন কেমন চলছে?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপে যখন যুদ্ধ লাগল। গত মার্চ থেকে আমাদের অবস্থা খারাপ হতে থাকল। নামতে নামতে গত অক্টোবর আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল; এখন যে ভালো সেটি বলব না। গত নভেম্বরে পোশাক রপ্তানি থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি যে আয় হয়েছে, সেটি অবশ্যই ভালো অর্জন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই যে অর্জন হয়েছে তা হচ্ছে আগে আমাদের অনেকগুলো অর্ডার ছিল, সেটির কারণে হয়েছে। সামনে আমাদের অর্ডারগুলো আছে, কিন্তু খুব স্লো (ধীর) ডেলিভারি। সেগুলোর মধ্যে ক্রেতাদের সে রকম চাপ নেই যে মালটি দিতে হবে। অন্য সময় আমাদের ওপর চাপ থাকত যে মাল দিতে হবে। এমন অবস্থা মাঝে মাঝে হতো যে প্রাইজ যেটিই হোক, আমাকে মাল দিতে হবে।

সারা বিশ্বে এখন মন্দার ভাব। সেটির প্রভাব কিন্তু আমাদের দিকে আসছে। কিন্তু একটি কথা আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমরা ভালো আছি; অনেক বড় বড় দেশের চেয়ে ভালো আছি। এই তো আমি ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে এলাম, নিজ চোখে দেখে এলাম, তাদের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। বাংলাদেশে আমরা যতটা খারাপ করি, তার তুলনায় প্রচার-প্রচারণা বেশি। যেটি ইউরোপে হয় না। ইউরোপে অনেকের ঘরে খাওয়া নেই, কিন্তু আপনি এটির খবর দেখবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে যদি ৯০টি ভালো সেবা পাওয়া যায়, আর ১০টি খারাপ সেবা পাওয়া যায়। আমরা ১০টির খবর পাই। আর ৯০টির খবর পাওয়া যায় না। আমি ৫টি কিস্তি আগে দিয়েছি এই খবর হয় না। কিন্তু বিসমিল্লাহ গ্রুপ টাকা নিয়ে গিয়েছে সেই খবর হয়। আমি গণমাধ্যমের সবাইকে বিনীত অনুরোধ করব যে আপনারা দেশকে নিয়ে পজিটিভ নিউজ করেন। বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে; আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সমালোচনার পাশাপাশি দেশের ভালো খবরও প্রচার করুন দয়া করে।

একটি কথা আমি বারবার বলে থাকি, কোনো দলের রক্ষণভাগ যত শক্তিশালী, তাকে গোল দেয়া তত কঠিন। আমাদের পোশাকশিল্পের রক্ষণভাগ শক্তিশালী, অর্থাৎ আমরা বস্ত্র খাত হলাম পোশাকশিল্পের রক্ষণভাগ। আমরা শক্তিশালী বলেই পোশাক খাতের অনেক অর্জন হচ্ছে। গ্যাস ও বিদুৎ-সংকটের কারণে আমরা সরকারকে বলেছিলাম যে দরকার হলে আমরা একটু টাকা বাড়িয়ে দিই, আপনারা আমাদের বিদ্যুৎ দেন। আমরা বলেছিলাম আমরা যদি ১ লাখ ডলারের জ্বালানি পাই, তাহলে কিন্তু আমরা ২৪ লাখ ডলার আর্ন করতে পারি। এই পরিসংখ্যান যখন আমরা তুলে ধরেছিলাম; বলেছিলাম যে আমরা সরকারকে সহায়তা করতে চাই। আমরা যদি একসঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করি, তাহলে কিন্তু সংকট কাটিয় ওঠা যায়। আমরা যদি সংকটের সময় দোষারোপ করি, তাহলে কিন্তু জাতি সংকট থেকে উদ্ধার হতে পারব না।

এখন কি গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট কেটেছে? আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি?

উন্নতি হয়েছে ঠিক; কিন্তু সংকট কিন্তু পুরোপুরি কাটেনি। আমরা এটি বুঝি যে সরকার ইচ্ছে করে ব্যয় সংকোচন করেনি। এ ক্ষেত্রে সবাই মিলে সরকারকে সহায়তা করা উচিত বলে আমি মনে করি। বিশ্বের সব দেশ সংকটকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করার কারণে কিন্তু সংকট কাটিয়ে উঠেছে। জাতীয় সংকটে সব দল এক হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশের সংকটটিকে বিশ্বের দরবারে আরও বড় করে তুলে ধরা হচ্ছে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ফায়দার জন্য। দেশকে কিন্তু আমরা ছোট করছি। আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বলব, দেশকে ছোট করে কোনো লাভ নেই। সমস্যা থাকবে, তার সমাধান থাকবে। জ্বালানির সমস্যা সারা বিশ্বের সমস্যা। সুতরাং আমরা মনে করি, সবাই মিলে কাজ করলে এই সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। আগে আমাদের কোনো জিনিস আনতে যদি ১ বিলিয়ন ডলার খরচ হতো, এখন ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এই অবস্থা হয়েছে। আমাদের টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। বাংলাদেশে যে উন্নয়নকাজ হয়েছে, গত ১০ বছরে এগুলোকে আপনি ফেলে দেবেন কীভাবে।

এখন একজন রিকশাওয়ালাও রিজার্ভ (বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা মজুত) নিয়ে কথা বলে। এটি আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিত। রিজার্ভ নিয়ে চিন্তা করার জন্য রাষ্ট্রের অনেক লোকজন আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে বলে আমি মনে করি। তখন বিশ্ব অর্থনীতির বাজার কিন্তু বিশেষভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। এই বাজারটিকে ধরার প্রস্তুতি এখন আমরা নিচ্ছি। আগামী দিনে বিশ্ব রাজনীতি ঠান্ডা হয়ে এলে অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে তখন দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এখন বিশ্ব অর্থনীতির যে খারাপ অবস্থা, সেটি একসময় সহনীয় হয়ে যাবে। আর সহনীয় হয়ে গেলে আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সবাই মিলে সেই প্রস্তুতিই নিতে হবে। যুদ্ধ থেমে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে আমার বিশ্বাস।

দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এতে কি আপনারা উদ্বিগ্ন?

আমি যখন ব্যবসায় আসি ’৮৭ সালে, তখন উত্তাল আন্দোলন এরশাদবিরোধী। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ বুকে-পিঠে লিখে শহীদ হলেন নূর হোসেন। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান, এর পরও দেশে আন্দোলন হয়েছে- এগুলো দেখতে দেখতে আমরা ব্যবসায়ীরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই বাধাবিপত্তি-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়েই আমরা ব্যবসায়ীরা ব্যবস্যা করছি। উৎপাদন করছি, কর্মসংস্থান করছি। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

৩৫ বছরের ব্যবসায়ী হিসেবে আমি মনে করি, এ ধরনের সংকট মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ব্যবসায়ীদের থাকা উচিত। প্রত্যেক জিনিসের সিজন থাকে। পিঠা উৎসব শীতকালে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো একটি ফেস্টিভ ব্যাপার। এতদিন কিছু ছিল না, এখন দেখা যাচ্ছে সমানতালে দুটো দলই করছে। দুই দলেরই প্রচুর লোকজন হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ এটিকে এনজয় করছে ফেস্টিভ হিসেবে। সুতরাং আমি আতঙ্কিত নই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট নতুন কিছু নয়। এর চেয়ে খারাপ সময় আমরা দেখেছি। সেই তুলনায় বাংলাদেশ এখন অনেক ভালো আছে। বাংলাদেশে অর্থনীতি বলেন, অর্থনীতির সাইজ বলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের অবস্থান ৪১তম। আমরা যদি ধরে নিই আগামী পাঁচ বছরে আমাদের অর্থনীতির সাইজ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে।

এখন ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। আজ থেকে ২০ বছর আগে আমাদের অর্থনীতি কত ছিল। কয়েক মিলিয়ন ডলারের ছিল। অর্থনীতি আস্তে আস্তে ট্রিলিয়ন ডলারের দিতে এগোচ্ছে। প্রাইভেট ব্যাংকগুলো নিয়ে অনেক লেখা হচ্ছে। কিন্তু এই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর যে অবদান আছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, বাংলাদেশের শিল্পে, আমাদের বস্ত্র সেক্টরে যে বিনিয়োগ আছে তার বেশির ভাগ টাকা বেসরকারি ব্যাংক থেকে আসছে। সুতরাং দু-একটি ব্যাংকের খারাপ দিক নিয়ে আপনি সারা ব্যাংকিং খাতের ওপর ঢালাও কথা বলতে পারেন না। সংকট থাকবে; এর মোকাবিলা থাকবে। এই মুহূর্তে আমাদের সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বস্ত্র খাত কতটা অবদান রাখছে?

অর্থনীতিতে আমাদের অবদান যদি হিসাব করেন, এটাকে কোনোভাবে খাটো করে দেখা যায় না। বাংলাদেশের ৫২ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে সরাসরি ১ কোটি ১০ লাখ লোক কাজ করে এখানে। ৫২ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতি, এটা হলো রপ্তানি, এতে স্থানীয়ভাবে আমাদের সেক্টরের ৮ বিলিয়ন ডলার, অন্যান্য সেক্টর মিলিয়ে ডোমেস্টিক প্রোডাক্টকে ধরলে আরও ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ১৩ বিলিয়ন ডলার হবে। সব মিলিয়ে ৬৫ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার আমাদের ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট। আমাদের টোটাল ইকোনমিতে আমাদের টোটাল ইন্ডাস্ট্রির অবদান হলো ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এটা ২০২২ সালের তথ্য হিসাব করে আমি বললাম। তাহলে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মধ্যে যদি ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ অবদান হয়, তাহলে ভেবে দেখেন কত বড় অবদান আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রির।

আমাদের কৃষির অবদান ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। সার্ভিস সেক্টর থেকে ৫১ শতাংশ পাচ্ছি। শিল্প থেকে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ অবদান আসছে তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ টেক্সটাইল থেকে আসছে। আমরা কাজ করছি, সরকারও সহায়তা করছে। আগামীতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার হবে। করোনা শেষ হয়ে গেছে। এখন চিন্তা করার সময়ে হয়েছে যে, কোন বাজারটিকে আমরা আগে দখলে নেব।

বস্ত্র খাতে নতুন বিনিয়োগ কেমন আসছে? কর্মসংস্থান কেমন বাড়ছে?

আমাদের সেক্টরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগ এসেছে। এগুলোর কোনোটাই বন্ধ হয়নি। আরও হওয়ার কথা ছিল, যুদ্ধের কারণে স্থগিত আছে। আমি বলব, ব্যাকওয়ার্ড শিল্পে আমাদের যে অবস্থানটা আছে, বর্তমানে আমাদের যে টেকনোলজি, ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশনারি মেশিনারিজ আমাদের আছে। চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, পৃথিবীর এমন কোনো টেকনোলজি নেই যে আমাদের নেই। আমরা প্রস্তুত। বলব যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ, কোনোটাতে ৭০ ও কোনোটাতে ৪৫ শতাংশ প্রস্তুত। আপনারা বলতে পারেন ৪৫ শতাংশ কেন ৭০ শতাংশ হলো না।

আমাদের জ্বালানি সেক্টরে যেটা হলো কি, আপনি জানেন যে ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কানেকশনটা খুবই মন্থর গতিতে যাচ্ছে, যেটা গ্যাসের যতটুকু চাহিদা সেই তুলনায় আমাদের কূপগুলো খনন হয়নি। আমাদের নিজস্ব যে গ্যাস বা সম্পদ সেটা ধীরে ধীরে কমে আসছে এবং যার কারণে আমাদের ওভেন শিল্পগুলোতে প্রচুর গ্যাসের দরকার হয়। এত দিন যদি আমাদের সেই পরিমাণ ইউটিলিটি থাকত, তাহলে হয়তো সেটা হয়ে যেত। যেহেতু এটা প্রাকৃতিক সম্পদ, এই সম্পদের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে, মেয়াদ থাকে, তারপর আস্তে আস্তে নিম্নমুখী হতে থাকে। সুতরাং যেটা ২৭০০ এমএমসি গ্যাস উঠত চার-পাঁচ বছর আগে, সেটা ২৩০০ এমএমসিতে নেমে এসেছে। এটাকে পূরণ করার জন্য আমরা এলএনজি কিনছি। আমরা লং টার্মে ৫০০ এমএমসিএফটি কিনছি প্রতিদিন। আমাদের শর্ট টার্মে সেখান ২০০ আমরা কিনছি। কখনো আসছে, কখনো আসতে পারছে না। যুদ্ধের কারণে বিগত দুই-তিন মাসে আসতে পারছে না। প্রাইস অনেকটা হাই হয়ে গেছে। এসব কারণে আমাদের ওভেন শিল্পগুলো আমরা সেভাবে আগাতে পারিনি। কিন্তু আমাদের যে ইয়ার্ন বলি, ইয়ার্নে আমরা ৯০ শতাংশ সফল, ম্যান-মেড ফাইবারে আরও ৫ শতাংশ এগিয়ে যাব। ২০২৩ সালে সম্ভবত আমরা ৯৫ শতাংশ অর্জন করব।

ডেনিমে আমরা প্রায় পুরোটাই সফল হয়েছি। ওভেন-নিটে তো আমাদের পুরো সাপ্লাই ঠিক আছে। আমরা আগামীতে চেষ্টা করব, আমরা দেখছি সরকার অনেক চেষ্টা করছে যে, নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করা যায় কিনা। আসলে কি, আমদানিনির্ভর জ্বালানি নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি সাসস্টেইনেবল (টেকসই) হওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের নিজস্ব যে গ্যাসগুলো আছে, আগামী পাঁচ বছরে যদি আমাদের পাইপলাইনে যুক্ত হয়, আমি জানি সরকার কাজ করছে, বিভিন্ন জায়গায় কূপ খুঁজছে, সংস্কার করছে, ভোলায় দেখে আসলাম প্রতিদিন ১ থেকে ১০০ অতিরিক্ত গ্যাস থাকে সেটা জাতীয় গ্রিডে যোগ করার জন্য চেষ্টা করছে। সেটাকে লিক্যুইড ফর্মে আনার জন্য পাইপলাইনে। এভাবে দেখা গেছে, সিলেটের হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রে নতুন আরেকটা কূপ পাওয়া গেছে। আমরা যদি নিজস্ব রিসোর্সগুলো ব্যবহার করতে পারি, আবার যদি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে গ্যাসনির্ভর পাওয়ার প্ল্যান্ট যদি কমে আসে, সেই বিদ্যুৎটা যদি শিল্পে সাপ্লাই দেয়া যায়, তাহলে আমি মনে করি যে অর্থনীতিতে পোশাকশিল্পের রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর বর্তমানে অর্থনীতিতে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ যে শিল্পের অবদান তা ৪০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। আমরা যদি গ্যাসকে রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট করতে পারি, আমরা যদি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কয়লাভিত্তিক ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে পারি এবং এটা যদি শিল্পে ব্যবহার করতে পারি, অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।

আমদানি কমছে। এটা একটা স্বস্তির খবর। তবে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বেশ কমে গেছে। এতে কি দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না?

এখাতে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ক্যাপিটাল মেশিনারি কিন্তু গ্রোসারি জিনিস নয় যে প্রতিদিন আমদানি করা হয়। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যায়, দুই বছরে একবার আনতে হয়। আপগ্রেশনের কারণে বা অন্য কারণে আমদানি করতে হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানি কমে গেছে এটা আশঙ্কার কিছু নেই। শিল্পের কাঁচামাল (র-ম্যাটেরিয়াল) আমদানি কমে গেলে আশঙ্কার কারণ আছে। ক্যাপিটাল মেশিনারি না এলে উৎপাদন হবে না, র-ম্যাটেরিয়াল আসবে না, টাকাও দরকার নাই। কিন্তু আমার মেশিন আছে, কিন্তু র-ম্যাটারিয়ালের কারণে মেশিন বন্ধ আছে এটা আশঙ্কার বিষয়। কিন্তু মেশিনারি আমদানির হ্রাসে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।

সহায়ক ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য আপনার প্রত্যাশা কী?

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা ব্যবসায়ীরা জড়াতে চাই না। বিরোধী দল হোক বা সরকারি দল হোক, দেশকে নিয়ে প্রপাগান্ডা (গুজব) ছড়ানো থেকে প্রথমে আমাদের বিরত থাকতে হবে। পৃথিবীর কোনো জাতি এটা করে না। দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী হবে, এর সুফল কিন্তু আমরা নাগরিক হিসেবে সবাই পাব।

জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব যাদের জন্য আজকে মুক্ত স্বদেশ তাদের লাল সালাম। দেশটা স্বাধীন না হলে আমরা কয়টা বাঙালি শিল্পের মালিক হতাম। সুতরাং আমি বলব, জাতি হিসেবে ’৭১ সালে একত্রিতভাবে, সম্মিলিত শক্তি না হলে আমরা কিন্তু পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারতাম না। সুতরাং প্রত্যেকটা সংকটে আমাদের এক হতে হবে। শুধু ব্যক্তিস্বার্থে কাজ-ক্ষমতা দেখলে হবে না। ’৭১ সালে যেমন জাতীয় ঐক্য হয়েছিল। আমি মনে করি অর্থনীতি সংকটে ঐক্য হওয়া উচিত। প্রপাগান্ডা ছড়ানো ঠিক নয়।

এ দেশের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। যে দেশ নিজের টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে পারে, বিভিন্ন ধরনের টানেল করতে পারে- সেই জাতিকে কখনো আপনি খারাপ বলতে পারেন না। আমি বলছি, ১০টা ব্যাংকের ক্লায়েন্ট খারাপ করছে, সেটা যদি ৩০টা টিভি চ্যানেল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচার করে, তাহলে ৯০টা ক্লায়েন্ট যে ভালো করছে তাদের আমরা কেউ চিনি না। আমরা খারাপকে চিনি, ভালোকে চিনি না। আমি মনে করি, আমাদের ঐক্য থাকতে হবে। জাতীয় অর্থনীতি ও দেশকে বাঁচাতে হবে। দেশটা আমার, আপনার দেশ। দেশর সুনাম নষ্ট করা যাবে না। জাতি হিসেবে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

মন্তব্য

p
উপরে