× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বাংলাদেশ
All local Dhaka city transport
google_news print-icon

‘পুরোই লোকাল’ ঢাকা নগর পরিবহন

পুরোই-লোকাল-ঢাকা-নগর-পরিবহন
অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় এখন লোকাল বাসকেও যেন টেক্কা দিচ্ছে ঢাকা নগর পরিবহন। ছবি: নিউজবাংলা
ঢাকা নগর পরিবহনে এ পর্যন্ত তিনটি রুট চালু হয়েছে। কোনোটিতেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস নেই। কোনো কোনো রুটে টিকিট কাউন্টারও তুলে দেয়া হয়েছে। রুট ছেড়ে বাস চলছে বাণিজ্য মেলায়। যততত্র যাত্রী উঠা-নামা, ভাড়া নিয়ে টিকিট না দেয়া, বাসগুলোতে ধুলো-ময়লা, বাসের জন্য যাত্রীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকা- এমন নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা সব রুটে।

আসাদগেট, ফার্মগেট, শাহবাগ, কাকরাইল…। ভাই আসেন। ওঠেন। কই যাবেন? রাস্তায় অপেক্ষমাণ যাত্রীর উত্তর- ধানমন্ডি। হেলপার বলছেন- না ভাই, এটা ফার্মগেট রুটের বাস।

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করা লোকাল বাসের কর্মীদের এমন হাঁক-ডাক বরাবরের চিত্র। যাত্রীরা রাস্তার যেকোনো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে হাত তুললেই থেমে যাবে বাস। যাত্রীর ভিড়ে পা ফেলার জায়গা না থাকলেও হেলপারের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। চিঁড়েচ্যাপ্টা করে হলেও যাত্রী তুলতে থাকেন। নারী-পুরুষ নির্বিচারে যাত্রীরাও প্রয়োজনের তাগিদে ঠ্যালা-ধাক্কা দিয়ে একটু জায়গা করে নেন।

যাত্রীদের এমন হয়রানি আর ভোগান্তি থেকে রেহাই দিতেই রাজধানীতে চালু করা হয়েছে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। শুরুতে কিছুটা ভিন্নতা দেখা গেলেও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় এখন লোকাল বাসকেও যেন টেক্কা দিচ্ছে এই বিশেষ পরিবহনের বাসগুলো। রাস্তায় আর ১০টা লোকাল বাসের মতোই যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। নামার ক্ষেত্রেও যাত্রীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে যেখানে ইচ্ছা বাস থামিয়ে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে।

রাজধানীবাসীকে লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহনের হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহনের ২১ নম্বর রুট। পরিকল্পনা রয়েছে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ রাজধানীকে একটা কোম্পানির আওতায় আনার।

যাত্রীরাও আশায় বুক বাঁধেন- যাক, নগরে ভালো একটা পরিবহন সেবা মিলবে। তবে দিন যত যাচ্ছে, ততই নিরাশ হতে হচ্ছে তাদেরকে।

শুধু ২২ নম্বর রুট নয়, বাকি দুই রুটেরও বেহাল দশা। শুরুতে ২১ নম্বর রুটের সমস্যাগুলোকে পাইলট প্রজেক্ট বলে অযুহাত দেখাতেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বাকি দুই রুট চালু হওয়ার পর সমস্যার সমাধান মিলবে- এমন আশ্বাসও দেন তারা। কিন্তু সমাধান তো দূরের কথা, দিনকে দিন সমস্যা আরও বেড়েছে। আর পুরো বিষয়টিতে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও চোখে পড়ার মতো।

ঢাকা নগর পরিবহনের ২২, ২৩ ও ২৬ নম্বর রুট চালু হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর। পরবর্তীতে সময় পিছিয়ে ২২ ও ২৬ নম্বর রুট উদ্বোধন করা হয় ২৩ অক্টোবর। ২৩ নম্বর রুটটি এখনও চালুই হয়নি।

ঢাকা নগর পরিবহনের চলমান তিনটি রুট নিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়েছে নিউজবাংলা। তাতে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা কেবলই হতাশার। সর্বত্রই হ-য-ব-র-ল অবস্থা।

রুট-২১

বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২১ নম্বর রুটে (ঘাটারচর-মোহাম্মদপুর-জিগাতলা-প্রেস ক্লাব-মতিঝিল-যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর) পাইলট প্রকল্প হিসেবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে বাস সেবা শুরু হয়।

বিআরটিসির ৩০টি ডাবল ডেকার এবং ট্রান্স সিলভা পরিবহনের ২০টি বাস দিয়ে এই রুট চালু হওয়ার কথা ছিল। পরে দুই মাসের মধ্যে এতে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল ১০০টি বাস। তবে এই দীর্ঘ ১৩ মাসে এই রুট ৫০টি বাসেরও মুখ দেখেনি।

শুরু থেকেই এই রুটে চলাচল করা বিআরটিসি বাসে চালকের কোনো সহকারী নেই। এটা যাত্রীদের জন্য বাড়তি বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা নগর পরিবহনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২১ নম্বর রুটে বাস চলে ২৫ থেকে ৩৫টি। এর মধ্যে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের বাস ৮টি। বাকিগুলো বিআরটিসির ডবল ডেকার।’

ট্রান্সসিলভার ২০টি বাস চলার কথা থাকলেও কেন তা হয়নি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে বনিবনা হয় না। তারা বাস দিতে চায় না।’

যাত্রীদের আরেকটি বড় অভিযোগ, এই রুটে চলাচল করা বাসগুলো দেরি করে আসে। বাসের ভেতরের অবস্থা নোংরা।

তাদের একজন মো. সুমন বলেন, ‘২১ নম্বর রুটের বাসগুলো মোড়ে মোড়ে থামিয়ে যাত্রী তোলে। আর বাড়তি এই টাকাটা যায় ড্রাইভারের পকেটে। ট্রান্সসিলভার বাসেও একই অবস্থা। লোকাল বাস আর নগর পরিবহনের বাসের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দিন যত যাচ্ছে সেবার মান ততো খারাপ হচ্ছে।’

লোকালের নামান্তর ২২ নম্বর রুট

ঢাকা নগর পরিবহনের ২২ নম্বর রুটে চলে হানিফ পরিবহনের বাস। এই রুটে তাদের ৫০টি বাস চলার কথা থাকলেও শুরু হয়েছিল ৩০টি বাস দিয়ে। তা না বেড়ে উল্টো কমে দাঁড়িয়েছে ২০টিতে। শুরুতে টিকিট কাউন্টার থাকলেও পরে তা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বাস কমে যাওয়ায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের।

প্রতিদিন এই রুটে চলাচল করা অন্তত ১০ জন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তাদের একজন মো. শাহীন বলেন, ‘শুরু থেকেই ২২ নম্বর রুটে চলাচল করা হানিফ পরিবহনের বাসগুলো শুরু থেকেই রাস্তার যেখানে সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলে। অন্য দুই রুটের কাউন্টার থাকলেও এই রুটের কাউন্টার উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা এখন লোকাল বাসের মতো যাত্রী নিচ্ছে। অনেক কন্ড্রাক্টর টিকিটও দিচ্ছে না।

‘দীর্ঘক্ষণ বাসের অপেক্ষায় থাকতে হয়। আর বাস কম থাকায় যাত্রীর ভিড়ে গাদাগাদি করে চলতে হয়। রাজধানীর আর ১০টা পরিবহনের মতোই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় চলছে এই রুটের বাসগুলো।’

‘পুরোই লোকাল’ ঢাকা নগর পরিবহন
অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় চলছে ২২ রুটের বাসগুলো।ছবি: নিউজবাংলা

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক টিকিট বিক্রেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকিট পদ্ধতি উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বাস এখন চলছে কন্ট্রাক্টে। এছাড়া এই রুটে চলাচল করা বাস বিভিন্ন সময় কোনো প্রোগ্রামে অন্যত্র রিজার্ভেও ভাড়া দেয়া হয়। বাস কন্ট্রাক্টে চলার কারণে যে যেমনে পারে ওঠে-নামে, ভাড়া নিচ্ছে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ২২ নম্বর রুটের ইনচার্জ মো. আরমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম সমস্যা হচ্ছে আমাদের গাড়ি বসে থাকে। ড্রাইভারসহ অন্যান্য স্টাফ পাই না। আমাদের লোকসান হচ্ছিল। কাউন্টারের লোকদের টাকা দিতে পারছিলাম না। তাই কাউন্টার উঠিয়ে দিয়েছি।’

বাসে যাত্রীর উপচেপড়া ভিড়, তারপরও কিভাবে লোকসান হয়- এমন প্রশ্নে আরমান বলেন, ‘ঘাটারচর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ভিড় থাকে। তার পর আর যাত্রী তেমন একটা থাকে না।’

গাড়ির ভেতরে টিকিট কাটার ব্যবস্থা রাখার কারণে অনেক সময় কন্ডাক্টর অনিয়ম করছেন। ফলে টাকাটা কোম্পানি পায় না। এমন তথ্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওদের খরচ লাগে তো! এটা আপনার বুঝতে হবে। আপনি মানবিক দৃষ্টিতে চিন্তা করেন, ওদেরও একটা খরচ আছে।

‘ওরা দুই-এক টাকা সরাবে, এটা আপনাকে বুঝতে হবে। সবাইকে টিকিট দিলে তো টাকাটা জায়গামতো চলে যাবে। ওদের বেতন দেয়া হয় রাতে। সারাদিন ওরা খাবে কি?’

৫০টি বাস চলার কথা ছিল। তা থেকে এখন চলছে ২০টি। এর কারণ জানতে চাইলে আরমান বলেন, ‘সেটা আমি বলতে পারব না। ৩০টা চলত, এখন চলে ২০টা। ড্রাইভারের সংকটে আমরা বাস চালাতে পারছি না।’

২৬ নম্বর রুটের বাস চলে বাণিজ্য মেলায়

২৬ নম্বর রুটে বিআরটিসির ৫০টি ডবল ডেকার বাস দেয়ার কথা ছিল এই রুটে। তবে এখন পর্যন্ত বাস চলেছে সর্বোচ্চ ২৫টি।

এদিকে বাণিজ্য মেলা শুরু হওয়ার পর এখন ১৭ থেকে ১৮টি বাস চলছে। বাকি বাসগুলো বাণিজ্য মেলা রুটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাস কমে যাওয়ায় যাত্রীদের দীর্ঘ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

এই রুটের বাসে চালকের কোনো সহকারী নেই। যত্রতত্র বাস থামিয়ে তোলা হয় টিকিট ছাড়া যাত্রী।

এই রুটে নিয়মিত চলাচল করা মো. মহসিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা লাগে। বাসের পরিবেশ নোংরা। সিটগুলোতে ধুলা পড়ে থাকে। চালক মোড়ে মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলে। মানা করলেও শোনে না।

‘বসিলা থেকে শুরু হয় টিকিট ছাড়া যাত্রী তোলা। সারা পথেই চালক সামনের দরজা খোলা রেখে যাত্রী তোলেন। টিকিট ছাড়া যাত্রীরা নামার সময় চালকের হাতে টাকা দিয়ে যান।’

এই রুটের এক চালককে যাত্রীর কাছ থেকে টাকা নেয়ার সময় অনিয়ম করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোন উত্তর দেননি। বলেন, ‘মাফ করে দেন, আর হবে না।’

পরে তার নাম জিজ্ঞাসা করলেও একই কথা বলেন, ‘মাফ করে দেন।’

তিনি কিছুই জানেন না

নগর পরিবহনে কম বাস চলার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক ও বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য সচিব সাবিহা রহমানের কাছে। মোবাইল ফোনে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২১ নম্বর রুটে ৩০টি বিআরটিসির বাস ও ২০টি ট্রান্সসিলভার বাস চলার কথা। তবে তাদের কিছু অসুবিধা আছে, যে কারনে ৫০টি বাস দেখছেন না আপনারা।’

কখনোই ৫০টি বাস চলেনি- এমন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

২২ নম্বর রুটে বর্তমানে ২০টি বাস চলে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে সাবিহা রহমান বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই। আমার একটি পরিদর্শন টিম আছে। তারা আমায় জানিয়েছে যে, বাস রাস্তার মাঝে থামে। ড্রাইভারও টাকা আদায় করছে। কিন্তু বাস কম চলার বিষয় আমার নলেজে নেই। আগামী মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।’

‘পুরোই লোকাল’ ঢাকা নগর পরিবহন
লোকাল বাসের মতো দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে যাত্রীরা। ছবি: নিউজবাংলা

টিকিট কাউন্টার উঠিয়ে বাসের ভেতরে টিকিট কাটা হচ্ছে। এছাড়া লোকাল বাসের মতো যত্রতত্র যাত্রী উঠানো ও নামানো হচ্ছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের সচেতন হতে হবে। জনগণেরও দায়িত্ব আছে। জনগণও যেখানে সেখানে নামতে চায়। আমি আজ জানলাম। এটা আমার জানার বাইরে ছিল। বিষয়টি খোঁজ নেব।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিদর্শন টিম আমাকে রিপোর্ট দিয়েছে। ওরা তো আর সব সময় বসে থাকে না।’

২৬ নম্বর রুটের বাস বাণিজ্য মেলার যাত্রী টানছে তা-ও জানেন না এই কর্মকর্তা। বলেন, ‘আগামী ৭ তারিখ মিটিং আছে। তখন এটা আলোচনা করব। আর আমি এখনই বিআরটিসির চেয়ারম্যানকে ফোন করব।’

বিআরটিসির বক্তব্য

নিউজবাংলার পক্ষ থেকে এর আগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। বিআরটিসির বাস কম চলা ও চালকদের দুর্নীতির বিষয়ে জানানো হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজেই আজ থেকে নগর পরিবহনের তদারকি করব। আশা করছি আর কোনো সমস্যা থাকবে না। বাস চালকের সহকারীও দেয়া হবে।’

তার ওই আশ্বাসের পর কয়েক মাস কেটে গেছে। কিন্তু সমস্যা কমেনি, বরং বেড়েছে।

মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানানোর পর তাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২১ নম্বর রুটে আমার ৩০টি গাড়ি চলে। আপনার কোনো কথা থাকলে আমার অফিসে এসে বলুন। আমার ২০০ রুটে বাস চলে; আমি কি সব রুটের খবর রাখি?’

বাণিজ্য মেলায় নগর পরিবহনের বাস চলছে জানালে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মেলায় চলবে কেন? বাণিজ্য মেলার যাত্রীদের নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয়া সরকারের এজেন্ডা এবং আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সিনিয়র ডিরেক্টর, জিএমরা রাস্তায় তদারকি করছেন। আর কী করতাম বলেন? আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’

‘পুরোই লোকাল’ ঢাকা নগর পরিবহন
বিআরটিসির ড্রাইভার যাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। ছবি: নিউজবাংলা

বিআরটিসির চালকেরা মোড়ে মোড়ে বাস থামিয়ে টিকিট ছাড়া যাত্রী তুলছেন। এ তথ্য জানানোর পর বিআরটিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘পুরো বিষয়টি দেখার জন্য আমাদের সিনিয়র লেভেলের কর্মকর্তাদের কমিটি করে পাঠাচ্ছি। এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট সামারাইজ করে আমরা বুঝতে পারব কোথায় কোথায় আমাদের গ্যাপ আছে। আপনার তথ্য পজিটিভলি আমলে নিচ্ছি।’

‘এখানে হরিলুট চলছে’

ঢাকা নগর পরিবহনের কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি নগর পরিবহন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, টিকিটের টাকাটাই শুধু কোম্পানি পায়। এর বাইরে টিকিটবিহীন যাত্রী তুলে অনেক বড় অংকের টাকা চালক এবং সহযোগী ভাগাভাগি করে নিয়ে নেয়। ইতোমধ্যে আমি বিআরটিসির চেয়ারম্যানকেও এ বিষয়ে অভিযোগ করেছি।

‘এমনকি আমি যে গাড়িগুলোতে ভ্রমণ করেছি, তার পাঁচটা ভিডিও চেয়ারম্যানকে আমার মোবাইল থেকে করে পাঠিয়েছি। তিনি আমাকে বলেন- ভিডিও দেখে কিছু বুঝতেছেন না। এখানে একটা হরিলুট চলছে। প্রকল্পটি ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে।’

মোজাম্মেল বলেন, ‘নগর পরিবহনের পরিণতি হবে- তারা বলবে যে আমরা চেষ্টা করেছি। এই নগরীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হবে না। আর এমনটা বলে কোনো একদিন তারা এই প্রকল্প বন্ধ করে দেবে।

‘যাত্রীদের কাছ থেকে এখনও যে পরিমাণ টাকা কালেকশন হয় তাতে লোকসান হওয়ার কথা না। যেখানে মালিক সমিতির একটা ভয়ঙ্কর ঐক্য গড়ে উঠেছে সেখানে নগর পরিবহন টেকা দায়।’

আরও পড়ুন:
নাইকো মামলা: খালেদার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি ১৭ জানুয়ারি
৬ মাস ধরে পার্কে ঝড়ে ভাঙা গাছ
ঋণ নিতে ‘বাড়তি খরচ দিতে হয় তাকে’
সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ: ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলবে
গরিবের ভাতার ৫০০ টাকা ‘চেয়ারম্যানের পকেটে’

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ
Madans Farmers League leader was caught trying to trap UNO

ইউএনওকে ফাঁসাতে গিয়ে ফাঁসলেন মদনের কৃষক লীগ নেতা

ইউএনওকে ফাঁসাতে গিয়ে ফাঁসলেন মদনের কৃষক লীগ নেতা কৃষক লীগ নেতার অভিযোগপত্র (ডানে); পাল্টা অভিযোগপত্র। কোলাজ: নিউজবাংলা
মদন উপজেলা শাখা কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল আলম কামাল মণ্ডল প্রতিবেশী খায়রুল ইসলামের নাম ব্যবহার করে ইউএনওর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ দেন জেলা প্রশাসকের কাছে। এ খবর জানতে পেরে খায়রুল উল্টো ওই কৃষক লীগ নেতার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে নালিশ দিয়েছেন।

নেত্রকোণার মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আলম মিয়াকে ফাঁসাতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন নূরুল আলম কামাল মণ্ডল নামে এক কৃষক লীগ নেতা।

জানা গেছে, ওই কৃষক লীগ নেতা প্রতিবেশী খায়রুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে ইউএনওর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ দেন জেলা প্রশাসকের কাছে। পরে ওই অভিযোগের সূত্রে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়। এ নিয়ে এলাকায় শুরু হয় তোলপাড়।

প্রতারণা করে তার নাম ব্যবহার করে মিথ্যা অভিযোগের বিষয়টি জানতে পেরে খায়রুল ইসলাম চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রতি এলাকায় এসেছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারেন যে তার নাম ব্যবহার করে কৃষক লীগ নেতা নূরুল আলম কামাল মণ্ডল ইউএনওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনায় ওই কৃষক লীগ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেন খায়রুল ইসলাম।

রোববার সকালে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস।

খায়রুল ইসলাম নেত্রকোণার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের মৃত সুলতু মিয়ার ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই চট্টগ্রামে পরিবারসহ বসবাস করেন এবং সেখানে দিনমজুরের কাজ করেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত নূরুল আলম কামাল মণ্ডল মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের মাওলানা আব্দুল মন্নাফের ছেলে। তিনি মদন উপজেলা শাখা কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।

স্থানীয় লোকজন ও লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, জলমহাল থেকে রাজস্ব আত্মসাতের কথা উল্লেখ করে গত ৪ সেপ্টেম্বর মদনের ইউএনওর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন গোবিন্দশ্রী গ্রামের খায়রুল ইসলাম। কিন্তু খায়রুল ইসলাম কয়েক বছর ধরে জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে বসবাস করছেন। ইউএনওর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

খায়রুল ইসলাম নিরক্ষর। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার টিপসহি থাকলেও অভিযোগে খায়রুল ইসলামের স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি হলে খায়রুল ইসলামের সঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যোগাযোগ করেন। খবর পেয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে মদনে আসেন। পরে জানতে পারেন তার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কৃষক লীগ নেতা গোবিন্দশ্রী গ্রামের প্রতিবেশী নূরুল আলম কামাল মণ্ডল ইউএনওর বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ দায়ের করেছেন।

প্রতারণা করে হয়রানি করার জন্য কামালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে ২ অক্টোবর জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন খায়রুল ইসলাম।

খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাই। ছয় মাস আগে একবার বাড়িতে এসেছিলাম। এর পর আর বাড়ি আসা হয়নি। এখন আমার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ইউএনও স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি তো ইউএনও স্যারকে চিনি না। জীবনে কখনও তাকে দেখিনি। আমি জীবনে ডিসি স্যারের অফিসেও যাইনি।’

তিনি বলেন, ‘বাড়িতে এসে জানতে পারলাম প্রতিবেশী কৃষক লীগ নেতা কামাল মণ্ডল আমার নাম ব্যবহার করে ডিসি অফিসে অভিযোগ করেছেন। ওই ভুয়া অভিযোগপত্রে দেখলাম আমার স্বাক্ষর রয়েছে। অথচ আমি নিরক্ষর মানুষ, ভোটার আইডিতেও টিপসহি দিয়েছি। তাই এই ঘটনায় জড়িত কামাল মণ্ডলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ডিসি মহোদয়ের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। আমি চাই এমন প্রতারণা করার সাহস আর কেউ যেস না করে।’

গোবিন্দশ্রী গ্রামের মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কৃষক লীগ নেতা কামাল মণ্ডল দলীয় প্রভাবে এলাকার খাল ও খাস জমি দখল করে বিক্রি করেছেন। প্রভাব টিকিয়ে রাখতে কয়েক মাস আগে তিনি সাংবাদিক পরিচয়ে কার্ডও নিয়েছেন। খায়রুল ইসলামের মতো একজন নিরীহ মানুষের নাম ব্যবহার করে ইউএনওর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করার আমরা প্রতিবাদ জানাই।’

অভিযুক্ত কৃষক লীগ নেতা কে এইচ এম নূরুল আলম কামাল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এটা কাদা ছোড়াছুড়ি ছাড়া আর কিছু নয়।’

মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহ আলম মিয়া বলেন, ‘গত মাসে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার খবর শুনেছি। আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে প্রশাসন অবশ্যই আমার বিরুদ্ধে যথাযথ নেবে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেউ এ কাজ করে থাকলে তদন্তের মাধ্যমে তা বের হয়ে আসুক। অপরাধী যেই হোক তার বিরুদ্ধে যেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।’

জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘দুটি অভিযোগই পেয়েছি। তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আরও পড়ুন:
ছাত্র আন্দোলনে নাশকতার মামলায় নেত্রকোণার পৌর কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
শ্রম-সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন
নেত্রকোণার সাবেক পৌর মেয়র বিমানবন্দরে আটক
নেত্রকোণায় চাঁদাবাজির অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার
নেত্রকোণায় ‘ভুল বুঝিয়ে’ থানায় অপমৃত্যুর অভিযোগ, স্থানীয়দের ক্ষোভ 

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Irregularity in allocation money against upazila agriculture officer

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বরাদ্দের টাকায় অনিয়মের অভিযোগ

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বরাদ্দের টাকায় অনিয়মের অভিযোগ নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াত হোসেন। ছবি: নিউজবাংলা
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনটি বরাদ্দে ১০০টি বেডের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও জানেন না কৃষকরা। আলাদা তিনটি স্মারকে বরাদ্দের তিনটি কপি এসেছে নিউজবাংলার প্রতিবেদকের হাতে, যেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা। 

কিশোরগঞ্জে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনটি বরাদ্দে ১০০টি বেডের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও জানেন না কৃষকরা।

আলাদা তিনটি স্মারকে বরাদ্দের তিনটি কপি এসেছে নিউজবাংলার প্রতিবেদকের হাতে, যেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা।

কৃষকদের জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বরাদ্দের পুরোটাই এ কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালে একটি স্পেশাল বরাদ্দ আসে কিশোরগঞ্জে। সেটিও এ কর্মকর্তা ভাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ বরাদ্দে ছিল চার লাখ ৬০ হাজার টাকা।

এসবের বাইরে কৃষকের মাঠ দিবস, প্রশিক্ষণের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযুক্ত সাখাওয়াত হোসেন ২০২৩ সালের ২৮ মে থেকে নিকলী উপজেলায় কর্মরত।

প্রকল্পগুলো কী ও বরাদ্দের পরিমাণ কত

কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের অনুকূলে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ভাসমান বেডে মসলা, লতাজাতীয় ও লতাবিহীন সবজি প্রদর্শনী রাজস্ব ব্যয় বাবদ নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অনুকূলে ব্যয় মঞ্জুরিসহ চার লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। লতাজাতীয় ২৩টি প্রদর্শনীর জন্য দুই লাখ ৩০ হাজার (প্রতিটি প্রদর্শনীর ব্যয় ১০ হাজার) টাকা ও লতাবিহীন ২৩টি প্রদর্শনীর জন্য দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২৪ সালের ২ মে পাওয়া এ বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি ও লতাবিহীন সবজি প্রদর্শনীর জন্য ২০২৪ সালের ২১ মে নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অনুকূলে ব্যয় মঞ্জুরিসহ বরাদ্দ দেয়া হয় তিন লাখ টাকা।

ভাসমান বেডে মসলা প্রদর্শনীতে পাঁচটিতে বরাদ্দ ৫০ হাজার টাকা (প্রতিটি প্রদর্শনীতে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ)। ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি প্রদর্শনীর জন্য ১০টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ১ লাখ টাকা। এ ছাড়াও ভাসমান বেডে লতাবিহীন সবজির ১৫টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় দেড় লাখ টাকা। এখানে ৩০টি প্রদর্শনীতে মোট তিন লাখ টাকা বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

একই বছরের ৬ জুন ভাসমান বেডে মসলা প্রদর্শনীর ১১টিতে বরাদ্দ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা (প্রতিটি প্রদর্শনীতে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ)। ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি প্রদর্শনীর জন্য ৯টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ৯০ হাজার টাকা।

এ ছাড়াও ভাসমান বেডে লতাবিহীন সবজি চারটি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ৪০ হাজার টাকা। এখানে ২৪টি প্রদর্শনীতে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

কোন খাতে কী বরাদ্দ জানেন না উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, প্রদর্শনীর বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় বাবদ সরকার বরাদ্দ দেয় উপজেলা কর্মকর্তা বরাবর। প্রদর্শনী অনুযায়ী কৃষক নির্বাচন করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে। তারা কৃষক নির্বাচন করে নিশ্চিত করেন উপজেলা কর্মকর্তাকে।

একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে উপসহকারীদের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা।

নিয়ম অনুযায়ী, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষক নির্বাচন করে উপজেলা অফিসে জমা দেবেন। পরবর্তী সময়ে কৃষি কর্মকর্তা উপকরণ কিনে নির্ধারিত একটি তারিখে কৃষকদের অফিসে আসতে বলবেন। পরে সেখান থেকে উপকরণ বিতরণ রেজিস্ট্রারে (স্টক রেজিস্ট্রার) সাক্ষর রেখে মালামাল বুঝিয়ে দেয়া হয় কৃষককে। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো উপসহকারীর সঙ্গে সমন্বয় করেননি।

সমন্বয় না করলে প্রদর্শনীতে কী কী উপকরণ বরাদ্দ এসেছে সেগুলো উপসহকারী কর্মকর্তা কিংবা কৃষকদের জানারও সুযোগ থাকে না।

নিকলী সদর ইউনিয়নের ষাইটধার গ্রামের কৃষক মিয়া হোসেন জানান, বিগত দুই বছর পূর্বে ৮০ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন তিনি। তখন ১০ কেজি বীজ, এক বস্তা ইউরিয়া আর এক বস্তা ডিএপি সার ছাড়া কিছুই পাননি। এরপর আর তার অনুকূলে কোনো বরাদ্দ আসেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিকলী উপজেলার গুরই, সিংপুর ও সদর ইউনিয়নের একাধিক কৃষক জানান, অন্যান্য বছর আগস্টের মধ্যেই তাদের ভাসমান বেড তৈরির বরাদ্দ দেয়া হতো। এবার তাদের কাউকেই কোনো প্রকার বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে তারা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করার পর তাদের জানানো হয়েছে, এ বছরের বরাদ্দ আসেনি।

কৃষকরা জানান, বরাদ্দ এলে তাদের দেয়া হবে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

প্রান্তিক কৃষকদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান শুরু করে নিউজবাংলা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় আলাদা তিনটি বরাদ্দে ১০০টি বেডের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। আলাদা তিনটি স্মারকে বরাদ্দের তিনটি কপি আসে এ প্রতিবেদকের হাতে, যেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা।

অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্য

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন বরাদ্দ আসার বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করেন। খানিকটা পর বলেন, ‘কয়েকটা ছোট বরাদ্দ এসেছে। পানি বেশি থাকায় সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অচিরেই সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।’

একপর্যায়ে বরাদ্দের কপি দেখানোর পর বিশেষ বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বিবেকানন্দ হীরা তার ব্যাচমেট। হঠাৎ একদিন হীরা তাকে ফোনে বলেন, ‘তোমার নামে একটি স্পেশাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তুমি বরাদ্দের টাকাটা উত্তোলন করে আমাকে পাঠিয়ে দাও। অফিসের বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খরচে সেটি ব্যয় করা হবে।’ তিনিও তার কথামতো সেটি করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আপনারাও তো বোঝেন, অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও সেটি করেছি।

‘তারপরও বিষয়টি যেহেতু আপনাদের নজরে চলে এসেছে আমি তার সাথে কথা বলে অচিরেই বাস্তবায়ন করে নেব।’

এ কথার একপর্যায়ে তিনি ফোনে কথা বলেন হীরা নামের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে।

সাখাওয়াত তাকে বলেন, ‘তুমি যে একটা স্পেশাল বরাদ্দ দিয়েছিলে, সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে।’

নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আরও আছে। এর আগে এ কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। সেখানেও তার বিরুদ্ধে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ, সার, বীজসহ বিভিন্ন প্রণোদনার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে।

এ বিষয়ে জাতীয় একটি পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। পরে সেখান থেকে তাকে বদলি করা হয় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে, তবে সেখানে গিয়ে বেশি দিন থাকতে হয়নি তার। তিনি চলে আসেন কিশোরগঞ্জের নিকলীতে।

মোহনগঞ্জে থাকা অবস্থায় অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সেখানে কোনো প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি করেননি বলে দাবি করেন সাখাওয়াত।

এ কর্মকর্তার দাবি, সেখানকার এক সাংবাদিক তার কাছে থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। দেননি বলে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন।

যা বললেন তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক

কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বিবেকানন্দ হীরার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ প্রকল্পের মেয়াদ আগস্টেই শেষ হয়ে যায়। এ প্রকল্পের সবকিছুই ক্লোজ হয়ে গেছে। তিনিও বর্তমানে এ প্রকল্পের দায়িত্বে নেই।

তিনি জানান, তার জানা মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দও কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। তারপরও যদি কোনো কর্মকর্তা সেটি বাস্তবায়ন না করে আত্মসাৎ করে থাকেন, তবে এর দায়ভার একান্তই তার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালকের ভাষ্য

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যদি কোনো কর্মকর্তা এ ধরনের অনিয়ম বা আত্মসাৎ করে থাকেন এবং তদন্তে এসবের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।’

আরও পড়ুন:
মিঠামইনে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে বৃক্ষরোপণ 
বিলে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে দুজন নিহত 
ভৈরবে গণজমায়েত প্রতিরোধে মহাসড়কে আওয়ামী লীগ
কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The police commissioner built a blackmail empire across Khulna

খুলনায় চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়েছিলেন পুলিশ কমিশনার

খুলনায় চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়েছিলেন পুলিশ কমিশনার খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদ্য সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হক। ছবি: সংগৃহীত
খুলনা মহানগর পুলিশের কমিশনার মোজাম্মেল হক চাঁদা আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দিতেন ওসি-ডিসিদের। তিনি দুর্নীতিবাজ সহকর্মীদের খুলনায় এনে সংগঠিত করেন চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য। আর ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ পেতে তার প্রধান অস্ত্র ছিল চাটুকারিতা। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এই পুলিশ কর্মকর্তার অপরাধের বিচারের দাবি উঠেছে জোরেশোরে।

খুলনার বুকে মোজ্জামেল হক ছিলেন যেন এক অদৃশ্য সম্রাট, যার অধীনে গড়ে উঠেছিল চাঁদাবাজির এক অভিজাত সাম্রাজ্য। শহরের প্রতিটি কোণ- আবাসিক হোটেল, বাসস্ট্যান্ড, স্বর্ণ পাচার, জুয়ার আসর, ক্লাব, এমনকি পরিবহন ব্যবস্থাতেও ছিল তার নেটওয়ার্কের শক্তিশালী হাত।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) শীর্ষ পদটিতে বসে টাকার নেশায় বুঁদ হয়ে কমিশনার মোজাম্মেল হক প্রতি মাসে চাঁদা আদায়ের টার্গেট বেঁধে দিতেন থানার ওসি-ডিসিদের। বিশ্বস্ত দুর্নীতিবাজ সহকর্মীদের খুলনায় এনে, ধীরে ধীরে এই সংগঠিত চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

চাঁদাবাজির এই সাম্রাজ্য থেকে প্রতি মাসে খুলনার পুলিশ কমিশনারের কাছে জমা পড়ত বিপুল পরিমাণ অর্থ, যার অংশবিশেষ ভাগ-বাটোয়ারা হতো স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে।

রাজনৈতিক সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জামায়াত- সময়মতো সব দলের চাটুকারিতাও চালিয়ে গেছেন ওই দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা। ‘জয় বাংলা’ থেকে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’- সব স্লোগানই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।

শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর খুলনার পুলিশ কমিশনারের সেই ক্ষমতার দম্ভ ধূলিসাৎ হয়েছে। টাকার মোহে অন্ধ মোজ্জামেল হককে অবশেষে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকের বিদায়ের পর খুলনার সুশীল সমাজ মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা এখন দাবি জানাচ্ছেন, মোজ্জামেল হকের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হোক।

টার্গেট নির্ধারণ করে চাঁদা আদায়

কেএমপির পরিদর্শক পদমর্যাদার চারজন কর্মকতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসে খুলনা সদর থানা থেকে পাঁচ লাখ টাকা আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দেন কমিশনার। এছাড়া অন্য সাতটি থানায় প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা করে মোট ২১ লাখ টাকা আদায়ের মাত্রা নির্ধারণ করে দেন তিনি।

মাসিক তিন লাখ টাকা জমা দিতে না পারায় ১০ মাস আগে এক থানার ওসিকে বিএনপির অনুসারী আখ্যা দিয়ে বদলি করে দেন কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল।

ওই ওসি বলেন, ‘আমাকে জমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে বলা হয়েছিল। তবে তিন লাখ টাকা বৈধভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে এই পুলিশ কমিশনারের আন্ডারে আর চাকরি করা সম্ভব ছিল না।

‘আমার ডেপুটি কমিশনার ভালো ছিলেন। তিনি আমাকে সেইভ করার চেষ্টা করেন। পরে কমিশনার আমাকে বদলি করে দিয়ে নতুন এক ওসিকে এনে সেই থানায় বসান।’

পরিদর্শকরা জানান, কমিশনারের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস ছিল পরিবহন খাত। নগর ট্রাফিক বিভাগকে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এই টাকা আদায় করার জন্য শহরের ইজিবাইকগুলো থেকে মাসিক চাঁদা আদায় শুরু করেছিলেন সার্জেটরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সার্জেট বলেন, ‘খুলনা শহরে প্রচুর সংখ্যক ইজিবাইক রয়েছে। এই কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইজিবাইক থেকে মাসিক চাঁদা আদায়ের নির্দেশ দেন। কিভাবে আদায় করতে হবে, সেই দিকনির্দেশনাও দিয়ে দেন তিনি।

‘ইজিবাইকগুলো নিয়ম না মেনে কোথাও পার্কিং করলে এক হাজার ৫০০ থেকে দু’হাজার টাকা করে জরিমানা করতে বলেন। তবে যদি কোনো ইজিবাইক মাসিক তিন হাজার টাকা করে সার্জেন্টদের পরিশোধ করতো, তবে সেই মাসে অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য তাকে কোন মামলা দেয়া হতো না।’

তিনি বলেন, ‘মাসিক চাঁদা দেয়া ইজি বাইকগুলোকে কোনো টোকেন বা রং দিয়ে চিহ্নিত করা হতো না। বরং চালকদের নামের তালিকা করে সার্জেন্টরা এই হিসাব রাখতেন। মাসিক চাঁদার টাকা আদায় করা হতো বিকাশের মাধ্যমে।’

থানার ওসিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি কেএমপির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকেও টাকার ভাগ নিতেন কমিশনার।

এর পাশাপাশি নগর ডিসি অফিসেও তার চাঁদা আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে বিশেষ মূল্যবান কোনো কিছু জব্দ করতে পারলে ওই টাকার ভাগ নিতেন কমিশনার।

এছাড়াও, পুলিশ লাইনের মেস থেকে মাসিক দুই লাখ, রেশন স্টোর থেকে এক লাখ ও কেএমপির গাড়িগুলোর জন্য প্রতি মাসে ইস্যুকৃত জ্বালানি তেল খাত থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করতেন মোজাম্মেল হক। নগর পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে প্রতিটি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য কমিশনারকে ২০০ টাকা করে দিতে হতো।

ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের এনে দল গঠন

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাত্র কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে পুরো নগর পুলিশ জিম্মি ছিল। কেএমপিতে যোগদানের পর নিজের বিশ্বস্ত সব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন স্থান থেকে তিনি খুলনায় বদলি করে নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছেন খালিশপুর থানার বর্তমান ওসি আনোয়ার হোসেন, যিনি পুলিশ কমিশনারের নিজ জেলা পাবনার সন্তান।

পরিদর্শকরা জানান, ওসি আনোয়ারের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন অপরাধে পর যেসব ওসি ও এসআইর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়, তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মাফ পেয়ে যাওয়ার উপায় বের করে দেয়া।

এছাড়া থানার ওসিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমান ও বিশেষ শাখার এএসআই মো. আব্দুর রাজ্জাক।

বর্তমানে কমিশনারের বাংলোর দায়িত্বে রয়েছেন এএসআই মো. আব্দুর রাজ্জাক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাকা আদায়ের বিষয় অস্বীকার করে বলেন, ‘এসবের সাথে আমি জড়িত ছিলাম না।’

অন্যদিকে ওসি আনোয়ার বলেন, ‘আমি মোবাইলে এই বিষয়ে কোনো কথা বলবো না।’

কমিশনারকে বিএনপির ‘গণদুশমন’ আখ্যা ও ছাত্রদের বয়কট

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারে পতনের পর বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মিলে খুলনার যে পুলিশ সদস্যরা নানাভাবে প্রতারণা ও অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, তাদের ‘গণদুশমন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ৭ আগস্ট একটি তালিকা প্রকাশ করে মহানগর বিএনপি। ওই তালিকায় নাম ছিল কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল হকের।

এ প্রসঙ্গে খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘কেএমপি কমিশনার ছাত্র-জনতার বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে সহায়তা করেছিলেন।’

এরপর ৮ আগস্ট কেএমপির সম্মেলন কক্ষে শিক্ষাথীদের তোপের মুখে পড়েন কমিশনার মোজ্জামেল হক।

সেখানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আল মুজাহিদ আকাশ। তিনি পুলিশ কমিশনারের কাছে প্রশ্ন করেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে কেন আপনারা আমাদের ওপর গুলি চালালেন? ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর আপনারা কে? কার নির্দেশে আপনারা আমাদের ওপর গুলি চালালেন?’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক তানভীর বলেন, ‘আপনার মতো পুলিশ কমিশনারকে আমরা খুলনাতে চাই না। আপনি আমাদের নিরীহ ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছেন।’

সেই সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের কর্মকাণ্ডের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান কমিশনার মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কেন এগুলো করতে হয়েছিল তা এই সরকারের অধীনে চাকরিতে থাকলে তোমরা বুঝতে। এ নিয়ে আমি তোমাদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’

‘জয়বাংলা’ থেকে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান

জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ২০২৩ সালের ১৬ এক প্রজ্ঞাপনে মোজাম্মেল হককে কেএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। খুলনায় যোগদান করেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। একইসঙ্গে খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকর ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন। কমিশনার যে কোনো সভায় যোগ দিয়ে তাদের পা ছুয়ে সালাম করতেন, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বেশ জোরেশোরেই উচ্চারণ করতেন।

খুলনা মহানগর বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিলটন বলেন, ‘এই পুলিশ কমিশনার খুলনায় যোগদানের পর বিএনপির কোনো নেতা রাতে নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারতেন না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে তিনি নিয়মিত বিএনপির নেতাদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছিলেন। প্রতিনিয়ত গায়েবি মামলা ও গণগ্রেপ্তার করাটা যেন তার নেশা ছিল।’

তিনি বলেন, ‘কমিশনার মোজাম্মেল আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাদের পা ছুঁয়ে সালাম করতেন। পাশাপাশি চাঁদাবাজি করে নেয়া টাকার একটা অংশ তিনি ওই নেতাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।’

তবে ৫ আগস্ট সরকার পতদের পর কমিশনার মোজ্জামেল হক মিশে যান বিএনপি নেতাদের সঙ্গে। তাদের নানা সভায় অংশ নিয়ে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেয়া শুরু করেন। পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রশংসা শুরু করেন।

কমিশনার মোজাম্মেল হক ৮ আগস্ট ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে কেএমপিতে দাওয়াত দেন বিএনপি নেতাদের। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। সে সময় কমিশনারকে সংশোধন হতে হুঁশিয়ারি দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক তানভীর বলেন, ‘আপনারা এতদিন একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছেন৷ এখন আরেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে আমাদের সভা করার জন্য ডেকেছেন।

‘আপনাদের চাটুকারিতা কমে নাই। আমরা আপনাদের মতো চাটুকার পুলিশ কর্মকর্তাদের চাই না। আপনারা নিজ বিভাগের মধ্যে সংস্কার করেন। চাটুকারিতা বাদ দেন।’

তদন্তের দাবি সুশীল সমাজের

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হককে ২৭ আগস্ট সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ওই রাতেই তিনি খুলনা ছেড়ে চলে যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে তার অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য শুধু বাধ্যতামূলক অবসর নয়, তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি সুশীল সমাজের।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনা শাখার সভাপতি কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘পুলিশের যে পর্যায়ের কর্মকর্তা হোক না কেন, তাকে শুধু অবসরে পাঠালে হবে না। অন্যায়ের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

‘রাষ্ট্রে শাসন ফিরে এসেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র থেকে জনগণের রাষ্ট্র হয়েছে। এতদিন যারা অন্যায় করেছে, তদন্ত করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।’

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The arbitrariness of the two frauds pushed Farmers Bank to ruin
ম খা আলমগীর ও বাবুল চিশতী

দুই জালিয়াতের স্বেচ্ছাচারিতা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় ফারমার্স ব্যাংককে

দুই জালিয়াতের স্বেচ্ছাচারিতা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় ফারমার্স ব্যাংককে ম খা আলমগীর ও বাবুল চিশতী। কোলাজ: নিউজবাংলা
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে মূল্যায়ন না করা, অনুমোদনের আগেই ঋণের টাকা সরবরাহ, গ্রাহকের হিসাব থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন, ঋণ দিতে কমিশন বাণিজ্য এবং শেয়ার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ম খা আলমগীরের বিরুদ্ধে। আর এসব অপকর্মে এই জালিয়াতকে সহায়তা করেছেন ব্যাংকটির ইসি কমিটির চেয়ারম্যান আরেক জালিয়াত মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী।

‘জন্মদাতার হাতেই সন্তানের ভবিষ্যৎ ভস্মীভূত’- ঠিক এমনটাই ঘটেছে চতুর্থ প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ভাগ্যলিপিতে। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর নিজেই ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেন।

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে মূল্যায়ন না করা, অনুমোদনের আগেই ঋণের টাকা সরবরাহ, গ্রাহকের হিসাব থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে নেয়া, ঋণ দিতে বিপুল অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য এবং শেয়ার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে ম খা আলমগীরের বিরুদ্ধে।

আর এসব অপকর্মে এই জালিয়াতকে সহায়তা করেছেন ব্যাংকটির ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী। তিনি নিজেও তার পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দিতে ব্যাংকটিকে ব্যবহার করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংকের এই দুই কুশীলবের বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অভিযোগ উঠে আসে। এমনকি ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানেও ব্যাংকটিকে ধ্বংসে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততার তথ্য মেলে।

এ বিষয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘লুটপাটে ফারমার্স ব্যাংক শেষ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠাতারাই ব্যাংকটিকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকের গুলশান শাখা কর্তৃক তনুজ করপোরেশনের বিপরীতে বড় অঙ্কের একটি ঋণ ক্রেডিট কমিটির সুপারিশ ছাড়া এবং পর্ষদ বা ইসি কমিটির অনুমোদন ছাড়াই মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণে অনিয়ম হয়েছে। ব্যাংকের পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ম খা আলমগীর, তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম এবং ওই শাখার ব্যবস্থাপক এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

এ ছাড়া গুলশান শাখায় কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো ‘সেংশন লেটার’ বা অনুমতি পত্র ছাড়াই শুধু চেয়ারম্যানের সুপারিশে বড় বড় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। ২০১৭ সালে গুলশান শাখাসহ বেশ কয়েকটি শাখা থেকে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্টে ৪০ কোটি, ১২ কোটি ৪৫ লাখ, ৯ কোটি ১৫ লাখ, ১০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রদান করা হলেও কোনোটির ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনা কমিটি ‘লোন সেংশন’ করেনি।

একই বছরের ১৮ অক্টোবর ৪০ কোটি টাকার ঋণ বর্ধিতকরণের জন্য চেয়ারম্যান ও এমডি ফরমাল সুপারিশ করলেও তার আগেই ঋণটি প্রদান করা হয়। সেখানে কোনো প্রকার ব্যাংকিং নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই গুলশান শাখায় তনুজ করপোরেশনের মেয়াদি ঋণের হিসাব থেকে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা গ্রাহকের চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। একই দিনে এ হিসাব থেকে ৪২ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন এবং অবশিষ্ট ৮০ লাখ টাকা পে-অর্ডার হিসেবে স্থানান্তর করতে পিও ইস্যু করা হয়।

একদিন পর ২০ জুলাই পে-অর্ডারটি বাতিল করে পার্কিং হিসেবে (টিওএস) স্থানান্তর করা হয়। ওইদিনেই আবার তা থেকে ১৮ লাখ টাকা এবং ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। এর একটিতে ম খা আলমগীরের নাম এবং অন্যটিতে বাবুল চিশতীর নাম উল্লেখ রয়েছে। এভাবে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনের মাধ্যমে নিজস্ব প্রয়োজনে পে-অর্ডার করে অনিয়ম/জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন ম খা আলমীগ ও বাবুল চিশতী।

ব্যাংকের গুলশান শাখার ৩টি ঋণ (তনুজ করপোরেশন, জাহান ট্রেডার্স এবং এস২আরএস করপোরেশন) হিসাবের অনুকূলে বিতরণকৃত ঋণের অধিকাংশ অর্থেরই প্রকৃত সুবিধাভোগী সাবেক পর্ষদ চেয়ারম্যান ম খা আলমগীর এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান বাবুল চিশতী।

এ ছাড়া ওই তিন গ্রাহকের বিভিন্ন ঋণ হিসাব থেকে ম খা আলমগীর এবং বাবুল চিশতী কর্তৃক ব্যাংকের অন্য উদ্যোক্তা পরিচালকদের থেকে শেয়ার কেনার জন্য একাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরও করা হয়। এ ক্ষেত্রে সন্দেহজনক বেশ কিছু লেনদেনের তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। এ ছাড়া শাখার গ্রাহক এডিএম ডাইং অ্যান্ড ওয়াশিং এবং সাবাবা অ্যাপারেলসের অনুকূলে বিতরণকৃত মোট ৫৭ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী ওয়েলটেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুল হক চিশতী (শামীম চিশতী)। তিনি সম্পর্কে বাবুল চিশতীর ভাই। ছেলে রাশেদুল হক চিশতীও এমন সুবিধা নিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, যেসব কোম্পানিকে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হতো, বেশিরভাগের ব্যাংক হিসাব তার কিছুদিন আগে করা। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার জন্যই হিসাব খোলা হয়েছে।

কাগজে-কলমে নানা রকমের ব্যবসার কথা বলা হলেও ঋণ নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সিংহভাগ টাকা তোলা হতো নগদে। অর্থাৎ সেই টাকা কার অ্যাকাউন্টে বা কোথায় যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করেন, এভাবে প্রচুর টাকা দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর দুটি অ্যাকাউন্টে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছিল মোটা অঙ্কের অর্থ। প্রথমটির নামে দেখা যায়, ফারিব অটো রাইস মিলস, দ্বিতীয়টির নাম এসএনডি। তাদের দুটি হিসাবে স্থানান্তর করা হয় যথাক্রমে ৬ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার ও ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অবাক করা বিষয় হলো- এ দুটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় ২৭ নভেম্বর। অর্থাৎ যেদিন অ্যাকাউন্ট খোলা হয় সেদিনই ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বাবুল চিশতীর ভাই ও তার ছেলের কয়েকটি কোম্পানি ছিল- যেসব কোম্পানির নামে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া হয় ফারমার্স ব্যাংক থেকে। শুধু তা-ই নয়, ভুয়া ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে মোটা কমিশনের বিনিময়ে বড় অঙ্কের লোন দিতেও কার্পণ্য করত না এই চক্র।

এসব ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে দুদকে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করা হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় ম খা আলমগীর। অবশ্য ২০১৮ সালে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে আসে, বাবুল চিশতী ও রাশেদুল হক চিশতী ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে ফারমার্স ব্যাংক থেকে কৌশলে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

আরও পড়ুন:
ম খা আর বাবুল চিশতী যেভাবে লুটপাট করে ফারমার্স ব্যাংক
ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা ম খা আলমগীর ও বাবুল চিশতী

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Rohingyas are coming through Teknaf border with brokers

সীমান্তের অরক্ষিত জায়গা দিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা

সীমান্তের অরক্ষিত জায়গা দিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা টেকনাফ-উখিয়ার ক্যাম্পে দালালের আশ্রয়ে রয়েছেন মঙ্গলবার রাতে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের কয়েকজন। ছবি: নিউজবাংলা
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও সীমান্তের ফাঁক-ফোকর দিয়ে রোহিঙ্গাদের এপারে নিয়ে আসছে দালালরা। মঙ্গলবার রাতেও ২০ জনের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।

কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে কড়া নজরদারি। সীমান্ত এলাকায় কড়া পাহারা বসিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এতোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার পরও মিয়ানমারে জান্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গারা আবার অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে বিজিবি ও কোস্টগার্ড কার্যত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি ঠেকাতে পারছে না।

বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তাদের দাবি, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা সামান্যই। রোহিঙ্গা বোঝাই অনেক নৌকাকে অনুপ্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে এবং অনেক রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করা হয়েছে।

মঙ্গলবার রাতের বেলায় কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি।

শাহপরীর দ্বীপ বিওপির কোম্পানি কমান্ডার আব্দুর রহমান বাহার এমনটা দাবি করলেও বস্তুত মঙ্গলবার রাতেও ২০ জনের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এখন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।

অনুপ্রবেশকারী মোশাররফ, এরশাদ, রাজু আক্তার, মরিয়ম বেগম, সমজিদা, রফিক, মকবুল হোসেন, জিয়া উদ্দিনসহ আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মগদের সশস্ত্র বাহিনী আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়েছে।

আরাকান আর্মি গ্রামে প্রবেশ করে এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে গ্রামটি খালি করতে বলে। গ্রাম না ছাড়লে সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। আবার তাদের সঙ্গে যুক্ত না হলে পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে।

এ অবস্থায় প্রাণের ভয়ে তারা গ্রাম ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ওপারে সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় তাদের মতো আরও অনেকে এপারে চলে আসার পথ খুঁজছে।

অনুপ্রবেশকারী মোশাররফ জানান, মংডুর নলবাইন্যা ও মেরোংলা এলাকায় সোমবার তাণ্ডব চালিয়ে আরাকান আর্মি ২০টি ঘরে আগুন দিয়েছে। এ সময় তাদের গুলিতে ১০ জন রোহিঙ্গা গুরুতর আহত হয়েছে। অনেকে মারাও গেছে। প্রাণে বাঁচাতে তারা নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

জান্তা বাহিনী আগে এসব এলাকায় তাণ্ডব করেনি। এখন মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি বেশি নির্যাতন করছে আরাকান আর্মি। তাদের দলে যোগ না দিলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। নইলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলছে।

আরেক অনুপ্রবেশকারী এরশাদ বলেন, ‘আরাকান আর্মি ১৫টি গ্রামে তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের মদদ দিচ্ছে বলে নাটক করছে। তারা এখন রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে নতুন নতুন এলাকা বেছে নিচ্ছে।

‘ওদিকে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের এলাকায় এসে যুদ্ধ শুরু করলে তখন আমাদের গ্রামকে লক্ষ্য করে মিয়ানমার বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এতে আমরা দুই পক্ষ থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। নারী-শিশু ও বৃদ্ধ নিহত হচ্ছে।’

রাজু আক্তার নামের এক নারী বলেন, মংডু সুএজাতে আমাদের গ্রামে মগবাগি ঢুকে আছে। আমরা বেশি কষ্টে ছিলাম। আমাদের নির্যাতন করতেছে। আমরা ঘরবাড়ি ফেলে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।

‘আমাদের এলাকার দুজন তাদের বাড়িঘর দেখতে গেছিল। আরাকান আর্মি তাদের গলা কেটে হত্যা করেছে। আমরা আসার আগেও হত্যা করছে তিনজনকে। তাই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে চুরি করে চলে আসি। পথে আমার স্বামীকে গুলি করে আরাকান বাহিনী। টাকা ও গয়না যা ছিল সব লুট করে নিয়েছে তারা।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, সীমান্তে বিজিবি ব্যাটালিয়নের সীমান্ত চৌকি আছে এক থেকে দুই কিলোমিটার পর পর। চৌকিগুলোতে বিজিবি সদস্যরা সতর্কতার সঙ্গে পাহারা দিচ্ছেন। কিন্তু এক চৌকি থেকে অন্য চৌকি দেখা যায় না। আঁকাবাঁকা নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা কিছু সড়ক অংশ কিংবা উপকূলীয় প্যারাবন থাকায় দৃষ্টিসীমা খুব বেশি দূরে যায় না। এ কারণে কোথায় কোন সময় রোহিঙ্গাদের নৌকা ভিড়ছে তা বিজিবি সদস্যরা সহজে বুঝতে পারেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে টেকনাফ ২ বিজিবি অধিনায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকবার কল করলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম কোস্টগার্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সবসময় চেষ্টা আছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। অনেক রোহিঙ্গা পুশব্যাক করা হয়েছে ইতোমধ্যে।’

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্তে কঠোর নজরদারি রেখেছে। তারপরও ফাঁকফোকর দিয়ে দালালের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। সেসব দালালকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক জানান, টেকনাফ উপজেলার সঙ্গে নদীপথে মিয়ানমারের ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান থাকলেও অসংখ্য ফাঁকফোকর থাকায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সহজেই অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। তাই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের টহল আরও জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি সীমান্তে সক্রিয় দালালগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

বিজিবির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে তিন হাজার ৩৫৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে তাদের মিয়ানমারে (স্বদেশে) ফেরত পাঠায় বিজিবি। তাদের মধ্যে ৮৪৮ জন নারী, ৭৪৯টি শিশু ও ১৭৫৭ জন পুরুষ। আর তিন রোহিঙ্গাকে থানা পুলিশে দেয়া হয়।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন চালায়। সে সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। আগে আসা রোহিঙ্গাসহ ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ঠাঁই হয় উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।

আরও পড়ুন:
সেন্টমার্টিনে অনুপ্রবেশ ৩১ রোহিঙ্গা দুই বিজিপির
রাখাইনে সংঘাত, সীমান্তে ফের জড়ো হচ্ছে রোহিঙ্গারা

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Porter to millionaire PSC driver Abed Ali

কুলি থেকে কোটিপতি পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী

কুলি থেকে কোটিপতি পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী মাদারীপুরে গ্রামের বাড়িতে কোটি টাকা খরচ করে বানানো অট্টালিকায় ঝুলছে আবেদ আলী ও তার ছেলে সিয়ামের ঈদ শুভেচ্ছার ব্যানার। ছবি: নিউজবাংলা
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস চক্রের হোতা সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বেতলা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান মীরের ছেলে। পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালকের চাকরি করলেও এলাকায় তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে। চড়তেন দামি গাড়িতে। তার ছেলে সোহানুর রহমান সিয়ামও ব্যবহার করতেন একাধিক দামি গাড়িতে।

জীবিকার তাগিদে মাত্র আট বছর বয়সে পাড়ি জমান ঢাকায়। সদরঘাটে শুরু করেন কুলির কাজ। রাতে থাকার মতো জায়গা না থাকায় ঘুমিয়েছেন ফুটপাতে। এর ফাঁকেই গাড়ি চালানো শেখেন। এক পর্যায়ে বাগিয়ে নেন বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) গাড়িচালকের চাকরি।

ব্যস, আবেদ আলী ঘুরাতে থাকেন তার ‘ভাগ্যের চাকা’। নানা ফন্দি-ফিকিরে কামিয়ে নেন বিপুল অর্থ। সঙ্গে ক্ষমতাও।

তবে শেষরক্ষা হয়নি। পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস চক্রের হোতা ধরা পড়েছেন পুলিশের অপরাধ তদ্ত বিভাগ-সিআইডির জালে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকেসহ মোট ১৭জনকে।

করিৎকর্মা আবেদ আলী পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত- সম্প্রতি মিডিয়ায় এমন খবর প্রচার হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে তার নিজ এলাকা মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামে।

কুলি থেকে কোটিপতি পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী
মাদারীপুরে সরকারি জায়গা দখল করে আবেদ আলী নির্মাণ করছেন মার্কেট ও গরুর খামার। ছবি: নিউজবাংলা

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বেতলা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান মীরের ছেলে। আব্দুর রহমান মীরের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আবেদ আলী মেজ। রহমান মীরের বড় ছেলে জবেদ আলী কৃষি কাজ করেন। ছোট ছেলে সাবেদ আলী এলাকায় অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আবেদ আলী এলাকার মানুষের কাছে নিজেকে পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে। চড়তেন দামি গাড়িতে। তার ছেলে সোহানুর রহমান সিয়ামও ব্যবহার করতেন দামি গাড়ি। অথচ এলাকার কেউ জানতেনই না যে তিনি সামান্য বেতনভুক্ত একজন গাড়িচালক।

ঢাকায় আবেদ আলী রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করেন বলে এলাকায় প্রচার ছিল। কয়েক বছর ধরে এলাকায় ব্যাপক দান-খয়রাতও করে আসছিলেন পিএসসির প্রশ্নফাঁস চক্রের এই হোতা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিত্ত-বৈভব ফুলে-ফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবেদ আলী মীর পদবি পাল্টে নামের আগে সৈয়দ পদবি ব্যবহার শুরু করেন। বাবার উত্থান নিয়ে ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামও সম্প্রতি এক সমাবেশে বক্তব্য দেন।

বাবার উত্থানের গল্প বলতে গিয়ে সিয়াম বলেন, ‘আমার বাবা একদম ছোট থেকে বড় হয়েছেন। আমার বাবার বয়স যখন আট বছর তখন পেটের দায়ে তিনি ঢাকায় চলে গেছেন। ঢাকায় গিয়ে কুলিগিরি করে ৫০ টাকা রুজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি একটি লিমিটেড কোম্পানির মালিক। তিনি কষ্ট করে বড় হয়েছেন।’

কুলি থেকে কোটিপতি পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী
পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। ফাইল ছবি

আবেদ আলী নিজ গ্রামে কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ। এছাড়াও সরকারি জায়গা দখল করে তার গরুর খামার ও মার্কেট নির্মাণাধীন। উপজেলার পান্তাপাড়া ও পূর্ব বোতলা গ্রামে কিনেছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ।

সরেজমিনে জানা যায়, পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী। কিন্তু এলাকার মানুষ তার এই পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। গত কোরবানির ঈদে দামি গাড়িতে চড়ে একশ’ পরিবারের মধ্যে এক কেজি করে মাংস বণ্টন করেন তিনি। সেই ভিডিও শেয়ার করেন নিজের ফেসবুকে।

আবেদ আলীর ছেলে সিয়াম শুধু একটি গাড়ি নয়, একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। সবই নতুন, ঝকঝকে। পড়েছেন ভারতের শিলংয়ে। দেশের একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি পড়ালেখা করেন।

স্থানীয় আব্দুল হক নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘তিনি এলাকায় এলে মানুষকে দায়-খয়রাত করতেন। তার সঙ্গে আমাদেরও ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি যে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তা আমাদের ভাবনায়ও ছিল না। আমরা এলাকাবাসী হতবাক! আমরা চাই বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীর বিচার হোক।’

মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘যারা অস্বাভাবিকভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের নিয়ে সচেতন মহলের প্রশ্ন তোলা উচিত। সরকারের উচিত, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। প্রশ্ন ফাঁস করে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করার কারণে তার কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।’

এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত-সমালোচিত পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ১৭ জনের মধ্যে সৈয়দ আবেদ আলী ছাড়াও রয়েছেন পিএসসি’র ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তা ও একজন অফিস সহকারী।

বেসরকারি টেলিভিশনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযুক্ত পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির ও নিখিল চন্দ্র রায়, চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন ও অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান।

সংঘবদ্ধ চক্রটি বিপিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্ন ফাঁস করে অর্থ লোপাটে মেতে উঠত।

চক্রটি ৫ জুলাই (শুক্রবার) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগ পরীক্ষাকে টাকা কামানোর মওকা হিসেবে বেছে নেয়। এই পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতির তথ্য ফাঁস করতে ছদ্মবেশ ধারণ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিক টিম। ছদ্মবেশী এক নিয়োগপ্রত্যাশী প্রার্থীকে তুলে দেয়া হয় চক্রের সদস্যদের হাতে। এরপর ৫ জুলাই সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত যে প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, হোয়াটসঅ্যাপে তার একটা কপি পাঠানো হয় পরীক্ষার অন্তত এক ঘণ্টা আগে। আর অজ্ঞাত স্থানে রেখে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীদের তা পড়ানো হয় আগের রাতেই।

চক্রটির প্রধান বিপিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘উপ-পরিচালক মো. আবু জাফরের মাধ্যমে দুই কোটি টাকার বিনিময়ে শুক্রবার (৫ জুলাই) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। তিনি বড় কর্মকর্তাদের ট্রাঙ্ক থেকে পরীক্ষার আগের দিন আমাকে প্রশ্ন সরবরাহ করেন। আমি এটাও জানি যে ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়।’

প্রকাশিত সংবাদে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে আলোচনায় আসেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। সোমবার দুপুর থেকে বাবা ও ছেলের নানা কর্মকাণ্ডের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।

আরও পড়ুন:
পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস: সেই গাড়িচালক আবেদ আলীসহ গ্রেপ্তার ১৭

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Kishoreganj Chhatra League president in sugar smuggling ring

চিনি চোরাচালান চক্রে কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগ সভাপতি

চিনি চোরাচালান চক্রে কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন (ডানে) ও নাজমুল হীরা। ছবি: সংগৃহীত
জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের বিরুদ্ধে চোরাচালানে সম্পৃক্ততা ছাড়াও সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, স্থানীয় পর্যায়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। আর চোরাচালান চক্রে জড়িত রয়েছে তার অনুসারীরাও।

ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে চিনি এনে দেশে বিক্রি চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন ও তার স্বজন নাজমুল হীরার বিরুদ্ধে। হীরা নিজেও ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন। সুমন-হীরা একা নন, তাদের অনুসারীরাও এই অপকর্মে জড়িয়েছেন। এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কথোপকথনের স্ক্রিনশট ফাঁস হয়েছে।

সম্প্রতি চোরাচালানের চিনিসহ একটি ট্রাক আটক করে পুলিশ। ট্রাকটি সুমন ও হীরার ঘনিষ্ঠ একজন আনেন বলে খবর চাউর হয়। অথচ মামলার আসামি করা হয় ছাত্রলীগের অন্য এক নেতাকে। ওই নেতার দাবি- চোরাই চিনিবোঝাই ট্রাক ধরিয়ে দিতে তিনি সহযোগিতা করেছেন।

দেশে প্রতি কেজি চিনির দাম ১৪০ টাকা হলেও ভারতে দাম ৫০ রুপির মতো। ফলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অনেকে চিনি নিয়ে এসে অবৈধভাবে দেশে বিক্রি করেন। সম্প্রতি সিলেট ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চিনি চোরাকারবারে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।

একই অভিযোগ এবার কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধেও। তাদের মধ্যে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে মেসেজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে।

সুমনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

অনেক আগে থেকেই সুমন ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে শহরের সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা আদায়, টাকার বিনিময়ে উপজেলা কমিটির অনুমোদনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। আর এসব অভিযোগ এনেছেন ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই।

দৃশ্যমান আয়ের উৎস না থাকলেও ছাত্রলীগের কমিটিতে নাম আসার পর সুমন বেশ বিত্তশালী হয়ে গেছেন। তার নির্মিত ডুপ্লেক্স বাড়িতে বিলাস আর খরচের ছাপ স্পষ্ট।

স্থনীয়রা জানান, শহরের একাধিক এলাকায় জমি কিনেছেন মোল্লা সুমন। এর একটি জমির দামই নাকি কোটি টাকার বেশি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম পান্ত বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে। সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

চিনি চোরাচালান চক্রে কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগ সভাপতি
চিনি চোরাচালান নিয়ে হোয়াটঅ্যাপে মোল্লা সুমনের বার্তা আদান-প্রদানের স্ক্রিনশট।

চোরাই চিনির ট্রাক ধরিয়ে দিয়ে মামলার আসামি

গত ১৪ জুন শুক্রবার সকালে ভারতীয় অবৈধ চিনিসহ একটি ট্রাক আটক করে কিশোরগঞ্জ পুলিশ। এ ঘটনায় ট্রাকটির চালক ও সহযোগীসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৫-৬ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে থানায় মামলা হয়। মামলায় আসামি হয়ে কারাগারে আছেন শহরের মনিপুরঘাট এলাকার রাতুল মিয়া ও পূর্ব তারাপাশা এলাকার মো. রাজিব। তারা ট্রাকের চালক ও সহযোগী।

অন্য দুজনের একজন হলেন মো. জনি, যিনি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নাজমুল হীরার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। অপরজন হলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আল জুবায়েদ খান নিয়াজ।

নিয়াজের দাবি, ট্রাকটি ধরিয়ে দিতে তিনিই পুলিশকে সহযোগিতা করেছেন।

শুক্রবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে জেলা শহরের তালতলা এলাকা থেকে চিনিভর্তি ট্রাকটি আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রাকটি আটক করেন সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মনির।

সে সময় থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, চোরাই চিনি কারবারে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নাজমুল হীরা দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত বলে তাদের কাছে তথ্য আছে। ছাত্রলীগ নেতা নিয়াজ তাকে ধরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন। তিনিই পুলিশকে চিনিবোঝাই ট্রাক আসার বিষয়ে তথ্য দেন।

তথ্য পেয়ে শহরের বড়বাজার এলাকায় অবস্থান নেয় পুলিশ। কিন্তু নাজমুল হীরা ও তার সহযোগীরা ট্রাকটিকে শহরের মোরগমহলে নিয়ে যান। সেখানে নিয়াজ ও তার অনুসারীরা অবস্থান নিলে হীরা ও তার সহযোগীরা সটকে পড়েন। আর চালক দ্রুতগতিতে ট্রাকটি নিয়ে শহরের তালতলা এলাকায় চলে যান।

তালতলা থেকে নিয়াজের সহযোগিতায় চালক ও সহযোগীসহ ট্রাকটিকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয় বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

সেদিন চোরাচালানটি ছাড়িয়ে নিতে পুলিশকে হীরা ঘুষের প্রস্তাব দেন বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

অথচ মামলার পর দেখা যায়, আসামির তালিকায় মোল্লা সুমন ও নাজমুল হীরার নাম নেই। পরিবর্তে সুমন ও হীরার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত জনি নামের এক যুবককে মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশকে সহযোগিতা করে আসামি হয়েছেন নিয়াজও।

পুলিশ জানায়, ট্রাকটি এনেছিলেন জনি; তার আশ্রয়দাতা হলেন নাজমুল হীরা। ট্রাকটি যখন হীরার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখনই সহযোগিতার জন্য এসআই রুহুল আমিনকে ফোন করেন তিনি। হীরা জানান, নিয়াজ তাদের ট্রাকটি নিয়ে গেছেন। আর নিয়াজের কাছ থেকে ট্রাকটি উদ্ধারের উদ্দেশ্যেই ঘুষের প্রস্তাব দেয়া হয়।

তাহলে নিয়াজ কীভাবে আসামি হলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে দুজনের নাম দেয়া হয়েছে।’

‘নিয়াজ তো বলেছেন, তিনি সেদিন পুলিশকে সহযোগিতা করতে গিয়েছিলেন’- সাংবাদিকের এই মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টির তদন্ত করছি। তদন্তে যদি কারও সম্পৃক্ততা না পাওয়া যায়, তবে তাকে মামলা থেকে বাদ দেয়ারও সুযোগ রয়েছে।’

জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, ‘যারা চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদেরকে খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে।’

চোরাকারবারীদের সঙ্গে সুমনের বার্তা ভাইরাল

ভারতীয় অবৈধ চিনিবোঝাই ট্রাকটি আটকের পর চোরাকারবারীদের সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন যেসব বার্তা আদান-প্রদান করেছেন, তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

বার্তা আদান-প্রদানের স্ক্রিনশটে দেখা যায়, সুমন নিয়মিত খোঁজ রাখছেন কয়টা গাড়ি শহরে প্রবেশ করেছে এবং তাকে কী পরিমাণ টাকা দিতে হবে।

একটি বার্তায় সুমন লেখেন, ‘কত করে কত দিনের দিছস?’ জবাবে তাকে বলা হয়, ‘ছয় দিনের ১০ করে।’ উত্তরে সুমন লেখেন, ‘তোরে না বলছি প্রতিদিন ১৫ করে দিতে?’

আরেকটি মেসেজে সুমন জানতে চেয়েছেন, ‘সকালে গাড়ি কয়টা এসেছে?’ জবাব আসে, ‘ওইদিকে ঝামেলা। কালকে দুইটা আসবে।’

সুমন ও হীরার প্রতিদিনের বখরা

নাম না প্রকাশ করার শর্তে কিশোরগঞ্জ বড়বাজারের এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রতিদিন কমপক্ষে দুটি ট্রাক বড়বাজারে প্রবেশ করত। কখনও আবার ৭টা থেকে ৮টাও আসত। রাস্তায় ঝামেলা থাকলে ট্রাক আসা বন্ধ রাখতেন তারা।

এই ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন যদি ২০ হাজার টাকা পান, তাহলে মাসে ছয় লাখেরও বেশি টাকা সুমনের ভাগে যুক্ত হয়েছে। বছরে সে হিসাবটা কোটি টাকার কাছাকাছি চলে যায়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের সঙ্গে একবার ফোনে সংক্ষিপ্ত কথা হয়। চিনির ট্রাক আটকের ঘটনায় সে সময় তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ যাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ ঘটনায় যদি আমার কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে আমার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ হবে। এতে তো কোনো সমস্যা নেই!’

তবে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের এই চোরাচালানে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি।

সুমন বলেন, ‘যারা চোরাই কারবারের জড়িত, তারা মূলত নামধারী ছাত্রলীগ। তারা কোনো পদ-পদবিতে না থাকায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ থাকে না।’

স্ক্রিনশট ভাইরাল হলে পরবর্তীতে এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে বার বার কল করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নাজমুল হীরার দাবি, মেসেজের স্ক্রিনশটগুলো সুমনের নয়।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে এগুলো বানানো যায়। তাছাড়া মেসেজের কোথাও কি লেখা আছে যে, কিসের গাড়ি? বৈধ চিনির গাড়ি, নাকি অবৈধ চিনির গাড়ি?’

তারা নিকটাত্মীয়

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের আপন ভাগ্নে এই নাজমুল হীরা। তবে তাদের চলাফেরাটা বন্ধুর মতো। সুমনের ‘ডান হাত’ হিসেবেই এলাকায় পরিচিত হীরা।

তাদের ঘনিষ্ঠরা জানান, সুমনের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ হীরাই করে থাকেন।

হীরার বাড়ি নেত্রকোণার মদন উপজেলার ফেকনী গ্রামে হলেও শৈশব থেকেই তার বেড়ে ওঠা মামার বাড়িতে। তার বিরুদ্ধে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ একাধিক মামলা রয়েছে।

জেলা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ভারতীয় অবৈধ পণ্যভর্তি ট্রাকগুলো শহরে প্রবেশ করার আগে হীরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। হীরা ‘সবুজ সংকেত’ দিলেই সেগুলো রওনা হয়।

তারা জানান, হীরা ও তার অনুসারীদের মোটরসাইকেল পাহারায় সেসব ট্রাক শহরের বড়বাজারে প্রবেশ করে। ট্রাকগুলো আনলোড হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তারা। রাস্তায় কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে ছাড়িয়ে আনার কাজটাও তারাই করে থাকেন।

তবে নাজমুল হীরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। বলেন, ‘এ ঘটনায় যদি আমার সম্পৃক্ততা থাকত, তবে আরও আগেই শুনতেন। এগুলো মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে।’

তার দাবি, চোরাচালানে পুলিশ যাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে।

অটোরিকশা স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি

শহরের বিভিন্ন সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে জেলা ছাত্রলীগের এই নেতার বিরুদ্ধে।

সংগঠনের জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান নয়ন বলেন, ‘এমন কোনো দপ্তর নেই যেখানে জেলা ছাত্রলীগের নামে চাঁদাবাজি হয় না। স্ট্যান্ডগুলোতে ছাত্রলীগের সভাপতি ও তার অনুসারীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাদের অত্যাচার ও মামলার হুমকি দেয়া হয়।’

তার দাবি, শহরের একরামপুর ও পুরানথানা- এ দুটি সিএনজি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন হীরা।

তিনি জানান, সিএনজি অটো স্ট্যান্ডের জায়গা মালিকপক্ষ ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের কাছ থেকে দৈনিক ভিক্তিতে ভাড়া নিয়েছেন নাজমুল হীরা। একেক দিন একেক লোককে সুপারভাইজার হিসেবে নিয়োগ করে অটোরিকশা থেকে প্রতি ট্রিপে ৫০ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে থাকেন তিনি।

প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি অটোরিকশা পুরানথানা ও একরামপুর থেকে চামটাঘাট ও বালিখলায় যায়। একরামপুর থেকে কিছু অটোরিকশা ভৈরব এবং গাজীপুরেও যায়। সে হিসাবে দিনে ১৫০ থেকে ২০০ অটোরিকশা চলে।

প্রতিদিন এভাবে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়, যা মাসে দাঁড়ায় চার লাখ টাকার মতো।

কমিটি গঠনে বাণিজ্য

২০২২ সালের ৫ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হোসেনপুর ও পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে জেলা ছাত্রলীগ।

পরদিন সকালে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হোসেনপুর উপজেলা ছাত্রলীগের একাংশ। তারা জানায়- বিবাহিত, অছাত্র, বয়সোত্তীর্ণ ও মাদকাসক্তদের কমিটিতে জায়গা দেয়া হয়েছে।

টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ এনে হোসেনপুর উপজেলা ছাত্রলীগের নবগঠিত কমিটিকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হয় ওই সংবাদ সম্মেলনে।

একইদিন পাকুন্দিয়াতেও বিক্ষোভ কর্মসূচি ও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে ছাত্রলীগের একাংশ। তাদের অনেকেই ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেন।

সেসময় পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. আরমিন দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার কথা বলে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হন।

তিনি বলেছিলেন, ‘বিবাহিত, অছাত্র, মাদকাসক্ত, বয়সোত্তীর্ণ, বিএনপি-জামায়াত পরিবার থেকে উঠে আসা সুবিধাবাদীদের দিয়ে টাকার বিনিময়ে কমিটিতে নেয়া হয়েছে। এটা উপজেলা ছাত্রলীগের কাঠমোকে দুর্বল করে দেয়ার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র।’

এ বিষয়ে তখন মৌনতা অবলম্বন করেন মোল্লা সুমন।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিন সদস্যের জেলা কমিটির অনুমোদন দেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।

কমিটিতে আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনকে সভাপতি, ফয়েজ ওমান খান সাধারণ সম্পাদক ও লুৎফর রহমান নয়নকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। সেই কমিটি পার করে চারটি বছর। শুরু থেকেই এই কমিটিকে মানতে নারাজ ছাত্রলীগের একটি পক্ষ।

জেলা ছাত্রলীগ নেতা হয়েও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ

চার বছর আগে অর্থকষ্টে ভুগতেন সুমন। জেলা ছাত্রলীগে পদ বাগানোর পর থেকেই তার অর্থকষ্ট অর্থের প্রাচুর্যে রূপ নেয়। এখন তিনি বিপুল সম্পদের মালিক।

সুমনের বাড়ি সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নে হলেও বর্তমানে থাকেন শহরের বয়লা এলাকায়। জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পরই একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণে হাত দেন তিনি। সেই বাড়িটির নির্মাণ কাজ বর্তমানে শেষ হয়েছে।

বয়লা এলাকা ছাড়াও সদর উপজেলার বৌলাই, নাকভাঙ্গা এলাকাতেও তিনি জমি কিনেছেন বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোন করে এবং একাধিকবার মেসেজ পাঠিয়েও মোল্লা সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন:
ববির আবাসিক হলে ছাত্রলীগের ভাঙচুর মারধরের অভিযোগ
সংঘর্ষের ঘটনায় শাবি ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মী হল থেকে বহিষ্কার
রাবিতে শিক্ষার্থীকে মারধর করে হলছাড়া, অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
ছাত্রলীগের সহসভাপতির নামে গরু ছিনতাইয়ের মামলা

মন্তব্য

p
উপরে