রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ২৯ প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৫ ধারা অনুসারে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সরকার।
ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ধারা অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে কেউ বেআইনি প্রবেশ করলে অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন বা বিনষ্ট অথবা অকার্যকর করা বা করার চেষ্টার শাস্তি হবে অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
এই ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণার ফলে দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য প্রকাশে সাংবাদিককেরা নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বেন- এমন উদ্বেগ জানাচ্ছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা।
বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের অবস্থান রয়েছে আইনজ্ঞদের মধ্যে। একটি অংশ বলছে, সরকারের এই গেজেট দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নতুন কোনো বাধা তৈরি করবে না। তবে অন্য অংশের আশঙ্কা, সরাসরি না হলেও এটি সংবাদকর্মীদের মনে পরোক্ষ ভীতির জন্ম দেবে।
বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বেগের ‘কারণ নেই’ বলে দাবি করছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক। তিনি বলছেন, সাইবার স্পেসে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা নিরাপদ রাখা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্যই ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণা করা হয়েছে।
‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ কী?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২(ছ) ধারায় ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’র সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো (Critical Information Infrastructure)’ অর্থ সরকার ঘোষিত এমন কোনো বাহ্যিক বা ভার্চুয়াল তথ্য পরিকাঠামো যা কোনো তথ্য-উপাত্ত বা কোনো ইলেকট্রনিক তথ্য নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চারণ বা সংরক্ষণ করে এবং যা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংকটাপন্ন হলে জননিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা জনস্বাস্থ্য, জাতীয় নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বা সার্বভৌমত্বের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এই সংজ্ঞা অনুযায়ী অপরাধ বিবেচনায় নিতে হলে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষিত প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক বা ভার্চুয়াল তথ্য পরিকাঠামোতে ‘বেআইনি প্রবেশ বা ক্ষতিসাধন’-এর ঘটনা ঘটতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সাধারণ অবকাঠামো এর আওতাভুক্ত নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-এর ২(থ) ধারায় ‘বেআইনি প্রবেশ’-এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘বেআইনি প্রবেশ’ অর্থ কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বা অনুমতির শর্ত লঙ্ঘন করে কোনো কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা ডিজিটাল তথ্যব্যবস্থায় প্রবেশ, বা প্রবেশের মাধ্যমে তথ্যব্যবস্থার কোনো তথ্য-উপাত্তের আদান-প্রদানে বাধা প্রদান বা এর প্রক্রিয়াকরণ স্থগিত বা ব্যাহত করা বা বন্ধ করা, বা ওই তথ্য-উপাত্তের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন বা সংযোজন বা বিয়োজন করা অথবা কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে কোনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বেআইনি প্রবেশ’ সংজ্ঞা অনুযায়ী, অপরাধের বিষয়টি সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল তথ্য পরিকাঠামোসংশ্লিষ্ট।
সাংবাদিকতায় বাধা কতটা
ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের অধীনে ২৯ প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আসায় এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বা অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশে বিশেষ কোনো বাধা তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এগুলো হলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ডেটাবেজ-সংক্রান্ত। ধরুন কেউ একজন এনআইডি ডেটাবেজে ঢুকে আপনার নাম বদলিয়ে দিল বা জন্মতারিখ বদলে দিল। অথবা কেউ ব্যাংকে ঢুকে ডেটাবেজ থেকে আমাদের ডাটা মুছে দিল, এটা কি ভালো হবে?
‘অথবা কেউ ব্যাংকের ডেটাবেজে ঢুকে আমার অ্যাকাউন্টের টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে দেখিয়ে দিল, এতে আপনি খুশি হলেও আমি কিন্তু হব না। এ জন্যই সরকার ২৯টি প্রতিষ্ঠানের বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে।’
ড. শাহদীন মালিক মনে করছেন, আইনের বিষয়গুলো যথেষ্ট পর্যালোচনা না করেই অনেকে ‘তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন’।
তিনি বলেন, ‘এই যে চার বছর ধরে ডিজিটাল আইন বলে অনেকে চিৎকার করছেন। অথচ কতজন সাংবাদিককে দেখাতে পারবেন যারা আইনটি ভালো করে পড়েছেন? চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে অনেকেই দৌড়াচ্ছেন।’
সুপ্রিমকোর্টের আরেক আইনজীবী তানজীব উল আলমও মনে করছেন সরকারি গেজেটে সাংবাদিকদের উদ্বেগের বিশেষ কোনো কারণ নেই।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি এই তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের জন্য কোনো বাধা নেই। কারণ এখানে তথ্য সংগ্রহে কোনো বাধা প্রদান করা হয়নি। যেটা করা হচ্ছে সেটা হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
‘এখানে যদি সেটি নাও থাকত তাহলেও ডিজিটাল নিরাপত্তার অন্য বিধানে বেআইনি প্রবেশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তালিকা প্রকাশের ফলে এখন একটাই পার্থক্য হলো, বিষয়টি এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ধারায় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এর ফলে সাজার মাত্রা বেশি হবে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণাকে স্বাগত জানাচ্ছেন ব্যারিস্টার তানজীব।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি একটা গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন বলা যায়, সেটা হলো এসব প্রতিষ্ঠানের যেসব তথ্য ডিজিটালি সংরক্ষণ করা হয় তা গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য পরিকাঠামোতে কেউ যদি অ্যাকসেস করে তাহলে তা ১৭ ধারার অধীনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।’
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর আওতায় আরও প্রতিষ্ঠানের নাম আসা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তিনি।
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় বাদ পড়েছে, সেটা হলো মানুষের স্বাস্থ্যগত যে বিষয়গুলো আছে, সেটারও সুরক্ষা থাকার দরকার ছিল। তালিকায় কোনো সরকারি হাসপাতালের নাম আসেনি। তাছাড়া এখানে শুধু সরকারি ব্যাংকগুলোর কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি টেলিকম প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকও আনা দরকার ছিল। সব মিলিয়ে তালিকাটি অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে।’
তবে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার আশংকা এই প্রজ্ঞাপন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা বাড়াবে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণার সুযোগ রাখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো যে ২৯ প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়া হয়েছে, সেখানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণার কিছু নেই।
‘ধরুন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি ব্যাংকগুলোতে কত ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম হয় আমরা দেখেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা এটা নিয়ে তেমন কিছু বের করতে পারেননি। অথচ একই বিষয়ে ফিলিপাইনে কী হয়েছে সেটা কিন্তু সবাই দেখতে পেয়েছি, যা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। আর আমাদের দেশের ব্যাংকে কী হয়েছে তা জানা গেল না।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, ‘এমনিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণার আগেই কোনো রকম সাংবাদিকতার সুযোগ ছিল না। সেখানে এ রকম একটা ঘোষণা আসার পর তো সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে আর কেনো সাহস করবে না।’
আরও উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ধরুন এখন যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে, এটা তো একটা বড় সমস্যা। এখানে বড় কোনো দুর্নীতি থাকলে সেখানে অ্যাকসেস করতে গেলে তো আপনাকে তথ্য পরিকাঠামোয় ঢুকতে হচ্ছে, তাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে।
‘এখন তথ্য পরিকাঠামো বলতে এই ওয়েবসাইট অ্যাকসেসকেও বোঝাবে, সেটি কিন্তু ঘোষণা বা আইনে পরিষ্কার করা নেই। এখন ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলেও আপনাকে এই আইনের মধ্যে ফেলে মামলায় জড়ানো সম্ভব।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, ‘এই আইনে (ডিজিটাল নিরাপত্তা) এত কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু আইনটাকে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা হয়নি। এতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পরিকাঠামোর মধ্যে আনলে সেখানে তেমন কিছু বলার ছিল না। তবে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রাখা হয়েছে যেগুলোর প্রয়োজন ছিল না।’
‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসেবে ঘোষণা করা ২৯টি প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড, সেতু বিভাগ, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, জাতীয় ডেটা সেন্টার (বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ (নির্বাচন কমিশন সচিবালয়), সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক।
এছাড়া তালিকায় রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইমিগ্রেশন পুলিশ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অফ বাংলাদেশ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বাংলাদেশ, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শিশির মনির মনে করছেন, এই তালিকায় এমন প্রতিষ্ঠানের নামও রয়েছে যেগুলো রাখার কোনো যুক্তি নেই।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই ২৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সোনালী, রূপালী, অগ্রণীর মতো ব্যাংকগুলোতে জাতীয় নিরাপত্তা ভঙ্গ হওয়ার কী আছে! তবে হ্যা মহামান্য রাষ্ট্রপতির দপ্তর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এনআইডি বা ডেটা সংরক্ষণ সেটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে সরকারি ব্যাংকগুলোকে কেন এর আওতায় আনা হলো তা বুঝতে পারছি না।’
শিশির মনির বলেন, ‘একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকতে পারে। তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি থাকতে পারে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে তাকে আইনের আওতায় আনা উচিত। এগুলো সুরক্ষার বিধান থাকা উচিত।
‘তবে এখানে কথা হলো এই যে ২৯ প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করা হলো এর মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বা অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ থাকতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, অনিয়ম বা বেআইনি কাজ প্রকাশের সুযোগ না থাকলে সংবিধানের ২৯ ধারা অনুযায়ী স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে।’
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের সুযোগ রাষ্ট্রকেই করে দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, দাবি প্রতিমন্ত্রীর
সরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণা করে ২১ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগ। আইসিটি বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয় ২৬ সেপ্টেম্বর।
বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বেগের কারণ নেই বলে দাবি করছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহ্মেদ পলক।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কিছু অবকাঠামো আছে যেগুলো আইসিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এগুলো সাইবার হামলার শিকার হলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বেশিসংখ্যক তথ্য ও অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি হতে পারে।
‘এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আমরা এই ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে আইডেন্টিফাই করেছি।’
তিনি বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার হবে, যাতে করে আমাদের যে ইনফরমেশন সিকিউরিটি ম্যানুয়াল আছে, তাতে হাই প্রায়োরিটি দিয়ে, আমরা এগুলোর দেখাশোনা করতে পারি। আবার প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের নিয়মিত আইটি অডিট প্রস্তুতি ও যেসব সতর্কতা মেনে চলা প্রয়োজন সেটা করতে পারবে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সাইবার স্পেসে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা নিরাপদ রাখা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। যেমন ধরুন সরকারের কোনো একটি ওয়েবসাইট আছে, সেখানে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের শুধু তথ্য আছে, সেটি হ্যাকড হলে আমরা যাতে এক ঘণ্টার মধ্যে সেটি রেস্টোর করতে পারি।
‘সাইবার ক্রিমিনালরা বাংলাদেশ ব্যাংক বা সিভিল এভিয়েশন বা পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি হামলা চালায় বা তথ্য চুরি করতে পারে তাহলে ক্ষতির পরিমাণটা অনেক বেশি ও মারাত্মক হবে। এসব গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছি।’
বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই আমি সাংবাদিকদের সামনে পুরো ব্যাখ্যাটি তুলে ধরব।’
আরও পড়ুন:ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এজলাসকক্ষে সময় টিভির প্রতিবেদক আসিফ হোসাইনকে মারধরের প্রতিবাদে গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গণমাধ্যমকর্মীরা মানববন্ধন করেন।
মানববন্ধনে অভিযুক্ত আইনজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ তাঁকে আদালত থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান গণমাধ্যমকর্মীরা।
গণমাধ্যমকর্মীরা বলেছেন, সাংবাদিকদের মারধর করা এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এজলাসের মতো জায়গায় বিচারকের সামনে সাংবাদিককে মারধর করা হলো, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
৪ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার সাংবাদিক মনজুরুল আলমের (পান্না) জামিন শুনানি চলাকালে মারধরের শিকার হন আসিফ হোসাইন। তিনি অভিযোগ করেন, আইনজীবী মহিউদ্দিন মাহি তাকে মারধর করেছেন। তবে আইনজীবী তা অস্বীকার করেছেন।
মানববন্ধনে অভিযুক্ত আইনজীবীর শাস্তি দাবি করে সময় টিভির সাংবাদিক ফারুক ভূঁইয়া বলেন, ‘আদালতের এজলাসে মব সৃষ্টি করে হামলা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেল না।’ এই ঘটনায় কোনো বিচার হবে কি না, সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
সময় টিভির আরেক সাংবাদিক হারুনর রশীদ বলেন, অপরাধীকে আদালত থেকে বহিষ্কার করা হোক। সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিতে হবে।
একাত্তর টিভির সাংবাদিক শাহনাজ শারমিন বলেন, সাংবাদিকেরা নির্যাতিত হলে কেউ প্রতিবাদ করে না। সবার কাছেই সাংবাদিকেরা মার খায়। সাংবাদিক মারা এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। একসময় সাংবাদিকেরা মার খেলে সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এসে সুরাহা করত। কিন্তু এখন প্রতিবাদটুকুও হয় না। কারণ, সাংবাদিকদের মধ্যে সেই ঐক্য নেই। সাংবাদিকদের এক হতে হবে।
মানববন্ধনে গণমাধ্যমকর্মীরা বলেন, সাংবাদিকেরা এখন আদালতেও মার খাচ্ছেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে হবে, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এজলাসে হামলার মতো ঘটনা লজ্জার।
মানববন্ধনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) ও তার স্ত্রী শেরীফা কাদেরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ইব্রাহিম মিয়া এ আদেশ দেন।
আজ দুদক-এর জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
আবেদনে বলা হয়েছে, গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও অন্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানটি চলমান রয়েছে।
অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং দেশের বাইরে দুর্নীতি ও অবৈধভাবে অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। গোপন ও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও তার স্ত্রী দেশ ছেড়ে বিদেশে পালানোর জন্য তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন।
তারা বিদেশে পালিয়ে গেলে অনুসন্ধানকার্য ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায়, অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জবানবন্দি শেখ হাসিনার দুঃশাসনের এক অকাট্য দলিল।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বুধাবার বাসস’কে বলেন, ‘চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা অবশ্যই শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অকাট্য দলিল।’
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মঙ্গলবার জবানবন্দি দেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
সেসময় তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাকে ফোন করে জানান যে আন্দোলন দমনে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তখন তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছিলেন এবং তার সামনে ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার। পরে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের এই নির্দেশনা তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ সারাদেশে পৌঁছে দেন প্রলয় কুমার। সেদিন থেকেই মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়।
চৌধুরী মামুন আরও জানান, এই মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর ও ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। এ ক্ষেত্রে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশ ছিল, যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে হবে।
সাবেক আইজিপি তার জবানবন্দিতে বলেন, শেখ হাসিনাকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করতেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমাতে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার বিষয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। যার পরামর্শ দিয়েছিলেন র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ। আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে ব্লক রেইড দিয়ে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করা হয়। আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেন আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও ব্যবসায়ীরা।
জবানবন্দিতে ‘কোর কমিটি’র মিটিং বিষয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাসায় ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হত। সব বৈঠকেই আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হত। একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়।
ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয় উল্লেখ করে মামুন বলেন, তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পরে রাজি হন। আর সমন্বয়কদের আটকের দায়িত্ব তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনকে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও ডিবি তাদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে। সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য চাপ দেওয়া হয় এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের ডিবিতে এনে চাপ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন সাবেক এই আইজিপি। তিনি জানান, ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুনকে ‘জিন’ বলে ডাকতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির বৈঠক সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি জানান, ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবির প্রধান, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এনএসআইয়ের প্রধানের সঙ্গে তিনিসহ মোট ২৭ জন উপস্থিত ছিলেন। জুলাই আন্দোলন দমন এবং নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। সেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরছিল। কিন্তু চারদিকে পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠকটি মুলতবি করা হয়।
তবে ওইদিন রাতে গণভবনে আবারও বৈঠক ডাকা হয় বলেও জবানবন্দিতে জানান সাবেক আইজিপি মামুন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের মহাপরিচালক ও সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মজিবুর রহমানসহ তিনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান ও এসবির প্রধান বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন।
ওই বৈঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে। ওই বৈঠক থেকে সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যান বলে জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সেখানে (কন্ট্রোল রুম) তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এসবির প্রধান ও মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় এবং ৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টায় সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে তারা সবাই চলে যান।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বিষয়ে জবানবন্দিতে তিনি জানান, সেদিন সকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দপ্তরে যাই। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে ছাত্র-জনতা স্রোতের মত প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা জানতাম না। এরপর বিকেলে আর্মির হেলিকপ্টার এসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবি প্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন।
পরে হেলিকপ্টারে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদেরও সেখানে নেওয়া হয়। পরদিন ৬ অগাস্ট আইজিপি হিসেবে তার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয় এবং ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালে ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলেও জানান মামুন।
আন্দোলনের দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি।
ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও দেখান ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন যে, ‘গুলি করি, একজন মরে। সেই যায়। বাকিরা যায় না।’ পরবর্তীতে এই ভিডিও সারাদেশে ভাইরাল হয়।
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্বে ছিলেন উল্লেখ করে জবানবন্দিতে আল-মামুন বলেন, তখন পুলিশের আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামশর্ও শেখ হাসিনাকে এই জাবেদ পাটোয়ারী দিয়েছিলেন বলেও দাবী করেন।
পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সেই নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং তারা সেটা বাস্তবায়ন করেন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করেছেন, তাদের পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, র্যাব সদর দপ্তর পরিচালিত উত্তরাসহ র্যাব-১ এর কার্যালয়ের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। র্যাবের অন্যান্য ইউনিটের অধীনেও অনেক বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটকে রাখা হত, যা একটা কালচারে (সংস্কৃতি) পরিণত হয়েছিল।
তার ভাষ্যমতে, অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মত কাজগুলো র্যাবের এডিজি (অপারেশন) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকেরা সমন্বয় করতেন। আর র্যাবের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত এবং এই নির্দেশনাগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মাধ্যমে আসত বলে জানতে পারেন বলেও জবানবন্দি দেন সাবেক আইজিপি।
সেসব নির্দেশনা চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপারেশন) ও র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো বলে উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
ব্যারিস্টার আরমান আটক থাকার বিষয়টি তিনি আইজিপি’র দায়িত্ব গ্রহণের সময় জানানো হয় বলেও উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। তাকে তুলে আনা এবং গোপনে আটক রাখার সিদ্ধান্ত সরকারের ছিল।
বিষয়টি জানার পর আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন, ‘ঠিক আছে, রাখেন। পরে বলব।’ কিন্তু পরে আর কিছু তিনি জানাননি। এরপর আমি কয়েকবার বিষয়টি তুলেছিলাম, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারের আদেশে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার জন্য আমি অপরাধবোধ ও বিবেকের তাড়নায় রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরবর্তী সময়ে আমি ট্রাইব্যুনালে স্বজন হারানোদের কান্না, আকুতি ও আহাজারি দেখেছি। ভিডিওতে নৃশংসতা দেখে অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত আমি যৌক্তিক মনে করছি।
তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের পর আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মত বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে। আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে আমার দায়িত্বশীল সময়ে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর দায় আমি স্বীকার করছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। আমি প্রত্যেক নিহতদের পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন। আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত (বাঁচিয়ে রাখেন) দান করেন, বাকি জীবনে কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।
এদিকে, সাবেক আইজিপি’র জবানবন্দি দেওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রাজসাক্ষী হওয়া চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ক্ষমা পাবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত ট্রাইব্যুনাল নেবেন। তিনি নিজের বিবেকের তাড়নায় অপরাধ স্বীকার করেছেন। নিজের পক্ষ থেকে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছিলেন।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, সাবেক আইজিপি ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, বিশ্বের কোন আদালতেই এ সাক্ষ্যকে দুর্বল প্রমাণ করার সুযোগ নেই। এটি একটি অকাট্য অপ্রতিরোধ্য সাক্ষ্য। এটি শুধু জুলাই-আগস্টের ঘটনা নয়, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে যত গুম-খুন হয়েছে তার বিরুদ্ধে অকাট্য দলিল হিসেবেও কাজ করবে।
ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন বিএম সুলতান মাহমুদ, প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্য প্রসিকিউটররা।
এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ ছাড়াও রায়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন বাতিল করে পূর্বের (১৯৭২ সালের) অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে এ সংক্রান্ত রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ আজ এই রায় দেন।
আদালতে এ সংক্রান্ত রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অ্যামিকাস কিউরি (আদালত বন্ধু) হিসেবে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। আর ইন্টারভেনর হিসেবে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ, ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবী রিটটি করেন। তারা হলেন মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো. জহিরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, আবদুল্লাহ সাদিক, মো. মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল ও যায়েদ বিন আমজাদ।
এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছর ২৭ অক্টোবর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এ সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় কেন প্রতিষ্ঠা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রগতি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
গত ২৫ মার্চ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠান। সে অনুযায়ী এই বেঞ্চে উভয় পক্ষে কয়েকদিন রুল শুনানির পর ২ সেপ্টেম্বর (আজ) রায়ের দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলো।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আজ এই মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এরপর আবু সাঈদকে গুলি করার দুটি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়। এ সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন মনিটরে ছেলেকে গুলির দৃশ্যের ভিডিও দেখে বার বার চোখ মুছছিলেন।
এরপর প্রসিকিউসনের আবেদনে আগামীকাল এই মামলায় প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ৩০ জুলাই প্রসিকিউসনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই মামলায় অভিযোগ গঠনের প্রার্থনা করেন।
অন্যদিকে, আসামী পক্ষে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাওয়া হয়।
এরপর গত ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ২৭ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
এই মামলার যে ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনা হয়, তাদের মধ্যে গ্রেফতার ৬ জন আজ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন।
এরা হলেন-বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী মো. আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।
আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৩০ জুন ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ।
২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে, সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।
ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে, একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে।
জাজ্জ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
ঢাকাসহ ১৯ জেলায় ৪১ জন জেলা জজসহ একযোগে জেলা আদালতের ২৩০ বিচারককে বদলি করা হয়েছে। বদলি করা এসব বিচারকের মধ্যে রয়েছেন ৫৩ জন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ৪০ জন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং ৯৬ জন সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
গতকাল সোমবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে পৃথক চারটি প্রজ্ঞাপনে তাদের বদলির আদেশ দেয়।
বদলি করা জেলা ও দায়রা জজদের আগামী ২৮ আগস্টের মধ্যে বর্তমান পদের দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়েছে।
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার দ্বিতীয়তলার নারী ব্যারাকে ঢুকে নারী পুলিশ সদস্যকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা একই থানায় কর্মরত সাফিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ২১ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি আমলে নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৫ দিন ধরে ঘুরে মামলা দায়ের করতে না পারা ভুক্তভোগীকে পুলিশ লাইন্স থেকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় নিয়ে তাকে বাদী করে ধর্ষণ মামলা রুজু করানো হয়েছে। আর ওই মামলাতেই সাফিউরকে আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে ভুক্তভোগীর শারীরিক পরীক্ষা করানোর জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মোহাম্মদ আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের অভিযোগের যাচাই-বাছাই শেষে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল সাফিউরের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। ভুক্তভোগী নারী পুলিশ সদস্য নিজে বাদী হয়ে শুক্রবার মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলাতেই গত শুক্রবার রাতে সাফিউরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার সকালে তাকে আদালতে চালান করা হয়। বিষয়টি আরও গভীরভাবে জানতে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল সাফিউরের বিরুদ্ধে আদালতের কাছে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। একইসঙ্গে ভুক্তভোগীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুরো বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এর আগে ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার দ্বিতীয়তলার নারী ব্যারাকে ঢুকে এক নারী পুলিশ সদস্যকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে একই থানায় কর্মরত সাফিউর রহমান নামে আরেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে গত ৬ মাস ধরে থানা ব্যারাকেই ওই নারী সদস্যকে ধর্ষণ করে ওই পুলিশ সদস্য। সবশেষ গত ১৫ আগস্ট রাত আড়াইটার দিকেও সাফিউর থানা ব্যারাকের ওই নারীর রুমে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করে। এর প্রতিকার চেয়ে গত ৫ দিন ধরে ঘুরেও থানায় মামলা করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান ভুক্তভোগী নারী পুলিশ সদস্য। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
মন্তব্য