× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য শিল্প ইভেন্ট উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য আফগানিস্তান ১৫ আগস্ট কী-কেন স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও যৌনতা-প্রজনন মানসিক স্বাস্থ্য অন্যান্য উদ্ভাবন প্রবাসী আফ্রিকা ক্রিকেট শারীরিক স্বাস্থ্য আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়া সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ ইউরোপ ব্লকচেইন ভাষান্তর অন্যান্য ফুটবল অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বাংলাদেশ
Tea workers still slaves
google_news print-icon

এখনও ক্রীতদাস

এখনও-ক্রীতদাস
‘আসামে গাছ নাড়া দিলেই টাকা পড়ে’ এমন নানা মিথ্যে প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সহজ-সরল ও ক্ষুধার্ত মানুষদের চা বাগানের কাজে আনা হয় বলে জানান ‘চা বাগানে মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থের লেখক ও গবেষক দীপঙ্কর মোহন্ত।

লাক্কাতুরা চা বাগান তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

নগর-লাগোয়া এই বাগানের ভেতরেই সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম। দেশের সবচেয়ে সুন্দর স্টেডিয়াম বলা হয় যাকে। এর পাশেই গলফ ক্লাব আর শেভরন পরিচালিত গ্যাসফিল্ড। দামি দামি গাড়ি যাওয়া-আসা করছে হরদম।

চারদিকে বৈভব আর উন্নয়নের প্রদর্শনী। কিন্তু বাগানের একটু ভেতরে ঢুকতেই এর ঠিক বিপরীত চিত্রের দেখা মেলে।

বাগানের ভেতর শ্রমিকরা যেখানে থাকেন, চা বাগানের ভাষায় এসব এলাকাকে বলা হয়- লেবার লাইন। ভাঙাচোরা, শীর্ণ একেকটা ঘর। আর ততোধিক শীর্ণ সেখানকার মানুষগুলো।

লাক্কাতুরা বাগানের লেবার লাইনে ঢুকতেই দেখা হলো সনকার সঙ্গে। এই সনকা চান সওদাগরের স্ত্রী নন, চা শ্রমিক। পুরো নাম সনকা মোদী। সনকা আফসোস করে বলেন, তাদের জাতভাই ইন্ডিয়ার রাজা আর তারা চা শ্রমিক।

সনকা তখন কেবলমাত্র ভাত খেয়ে উঠেছেন। কী দিয়ে খেয়েছেন?

মধ্যম আয়ের একটি দেশের একজন নাগরিক দুপুরে কেবল আলু ভর্তা আর পোড়া মরিচ দিয়ে ভাত খেয়েছেন। আর সকালে খেয়েছেন আটার রুটি ও লবণ চা।

সনকা তবু দুপুরে আলু ভর্তা আর ভাত খেতে পেরেছেন। পদ্মা গোয়ালার তাও জোটেনি। সকালে একটু ভাত খেয়েছিলেন। দুপুরে কিছুই খাননি। রাতে কী খাবেন তাও এখন পর্যন্ত জানেন না পদ্মা। আগের রাতেও উপোস কেটেছে তার। ঘরে খাবার না থাকলে খাবেন কী করে?

এমন করুণ অবস্থা প্রায় সব চা শ্রমিকের। নামমাত্র খেয়ে এবং না খেয়ে চলছে তাদের জীবন। মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে চলতে হয় তাদের।

কিন্তু এত দুরবস্থা কেন? কী করে তারা এলেন এখানে? কীভাবে হয়ে উঠলেন চা শ্রমিক?

এই প্রশ্ন করা হলো লাক্কাতুরার কয়েকজন চা শ্রমিককে। সহজ-সরল আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এই মানুষগুলো উত্তর দিতে পারেননি। তারা কেউ জানেন না তাদের আদি নিবাস কোথায়; ভূমিপুত্র থেকে কীভাবে তারা হয়ে উঠলেন উদ্বাস্তু চা শ্রমিক।

চা বাগানে কী করে এলেন এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই আশপাশের বিভিন্ন এলাকা বা অন্য চা বাগানের নাম বলেছেন।

এ অঞ্চলে চায়ের চাষ এবং চা বাগানে কাজ করার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক এনে জড়ো করার ইতিহাস পুরোনো, ঔপনিবেশিক আমলের।

চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাতে উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতে চা চাষ শুরুর উদ্যোগ নেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা।

অবিভক্ত ভারতের আসামে পাওয়া যায় চায়ের জাত। বাংলাদেশে প্রথম চায়ের চাষ শুরু হয় ১৮৪০ সালে, চট্টগ্রামে। আর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রথমে চীন থেকে শ্রমিক এনে এখানে চাষ করা হতো চায়ের। কিন্তু কিছুদিন পর চীনা শ্রমিকরা কাজ করতে রাজি না হওয়ায় খোঁজা শুরু হয় স্থানীয় শ্রমিক। কিন্তু স্থানীয়রা এমন পরিশ্রমের কাজ করতে রাজি হননি।

এরপর ব্রিটিশ শাসকরা আশ্রয় নেন নতুন কৌশলের। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। নিরন্ন মানুষের হাহাকার।

এসব দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকার মানুষদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় চা বাগান তৈরির কাজে।

ইতিহাসবিদ সুকুমার বিশ্বাস ‘আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙ্গালি প্রসঙ্গ ১৯৪৭-১৯৬১’ বইতে লিখেছেন, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আসামে শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা যখন চা-বাগান প্রতিষ্ঠা আরম্ভ করেন, তখন স্থানীয়ভাবে শ্রমিক না পাওয়ায় তারা আসাম সরকারের মাধ্যমে চা-শিল্পে কাজ করার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করেন।’

সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন- ‘বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, নাগপুর, সাঁওতাল পরগণা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে নিয়ে আসা হয় এসব চা-শ্রমিকের।’

‘আসামে গাছ নাড়া দিলেই টাকা পড়ে’ এমন নানা মিথ্যে প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সহজ-সরল ও ক্ষুধার্ত মানুষদের চা বাগানের কাজে আনা হয় বলে জানান ‘চা বাগানে মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থের লেখক ও গবেষক দীপঙ্কর মোহন্ত।

ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও এই শ্রমিকদের দাস হিসেবেই খাটানো হতো বলে জানান মোহন্ত।

ব্রিটিশ লেখিকা ক্যারোলাইন অ্যাডামস তার ‘সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে’ বইতে এই অঞ্চলে চা বাগানের উষালগ্ন সম্পর্কে লিখেছেন- ‘প্রথম দিকের বাগান মালিকেরা তাদের দুর্ব্যবহারের জন্য ছিলেন কুখ্যাত, মদ্যপ। বাগানগুলো অব্যবস্থাপনার শিকার এবং শ্রমিকেরা বঞ্চিত ও দুর্ব্যবহারের শিকার। ... বাগান শ্রমিকদের অত্যধিক খাটানো হতো, তাদের বাসস্থান নিম্নমানের এবং মজুরি ব্রিটিশ মালিকদের মুনাফার তুলনায় খুবই নগণ্য।’

২০০ বছরেও বাগানের এই চিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনও স্বল্প মজুরিতে বেশি খাটানো হয় শ্রমিকদের। নেই ন্যূনতম সম্মান আর মৌলিক অধিকার। বরং তাচ্ছিল্য করে তাদের ডাকা হয় ‘কুলি’ বলে।

গালির মতো হয়ে ওঠা এই সম্বোধন নিয়ে আফসোস সনকার কণ্ঠে। আছে ক্ষোভও।

দেশের ১৬৭ চা বাগানের একটি লাক্কাতুরা। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে বিমানবন্দর সড়কে এটি দেশের সবচেয়ে পুরোনো বাগানগুলোর একটি। এ বাগানের আরেক শ্রমিক শেলী মোদী। তার মেয়ে সুস্মিতা মোদীর কয়েক দিন ধরে শ্বাসকষ্ট। কিন্তু টাকার অভাবে মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না শেলী। শ্রমিকদের বাগানের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয় বলে দাবি করেছেন বাগান মালিকরা। তবে শেলী জানান, বাগানে নামমাত্র একটি হাসপাতাল আছে। সেখানে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। মেলে না ওষুধ ও চিকিৎসা সহায়তা।

এখানকার লাক্কাতুরা, মালনীছড়া, দলদলি চা বাগান ঘুরে দেখা গেছে, নামমাত্র একটি চিকিৎসাকেন্দ্র থাকলেও নেই তেমন কোনো ওষুধ। দলদলিতে নেই কোনো চিকিৎসকও। বেশির ভাগ বাগানেই কোনো চিকিৎসক নেই বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। আর সব রোগের জন্য একটিই ওষুধ– প্যারাসিটামল।

এই একুশ শতকেও অসুখ-বিসুখে কবিরাজ আর ঝাড়ফুঁকই ভরসা এখানকার শ্রমিকদের। চিকিৎসার বদলে অপচিকিৎসার বলি হতে হয় তাদের।

চা বাগানের স্কুলগুলোর অবস্থাও নাজুক। বাগানে শিক্ষার সুযোগ বলতে কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত। বেশির ভাগ বাগানে সেটিও নেই। যেগুলোতে আছে সেগুলোতে শিক্ষক আছেন একজন কি দুইজন। প্রাথমিক পেরোলে পড়ালেখা শেষ।

মালনীছড়া চা বাগানের রাগীব-রাবেয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার খুবই কম।

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তখন আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। আন্দোলনের কারণেই উপস্থিতির হার কমেছে বলে জানালেন এখানকার শিক্ষক।

লাক্কাতুরা চা বাগানে একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতা করেন জেনি পাল।

সিলেটের চা বাগানগুলোর শিশুদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে ঊষা নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোর বিকেলে খোলা উঠানে শিশুদের নিয়ে গান, নাচ ও আবৃত্তির ক্লাসের আয়োজন করে সংগঠনটি।

একদিন হাজির হই তাদের গানের ক্লাসে। উঠানে চাদর বিছিয়ে বসে আছে গোটা পঞ্চাশেক শিশু। সবার গায়েই ময়লা আর ছেঁড়া পোশাক। জীর্ণ শরীরের এসব শিশুর চোখে-মুখেও মলিনতার ছাপ।

আগন্তুকের অনুরোধে প্রথমে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে শিশুরা। পরে শিক্ষকের মধ্যস্থতায় লজ্জা কাটিয়ে গান ধরে তারা। শিশুরা যখন গেয়ে ওঠে... ‘এই বাগিচায় দুঃখে জনম যায় গো’।

মালনীছড়া চা বাগানের লেবার লাইন দিয়ে হাঁটার সময় দেখা হলো কয়েকজন শিশুর সঙ্গে। গোল হয়ে কাদামাটি দিয়ে খেলা করছে তারা। তাদের একজন রাকেশ ছত্রী। তার বাবা এই বাগানের শ্রমিক। একেবারে হাড় জিরজিরে শরীর রাকেশের। ভালো যে শরীরের ওপরে চামড়াটা আছে, না হলে তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অ্যানাটমি ক্লাসেই ব্যবহার করা যেত।

চা বাগানের বেশির ভাগ শিশু ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। ভগ্ন স্বাস্থ্য তাদের। চা বাগানের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা গেছে: অপুষ্টির কারণে বাগানের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ খর্বকায়, ২৭ শতাংশ শিশু শীর্ণকায় আর স্বল্প ওজনের শিশু আছে ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সারা দেশের তুলনায় চা বাগানে অপুষ্টির হার দ্বিগুণ।

এই জরিপেই দেখা গেছে, চা বাগানের ৬৭ শতাংশ পরিবার উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর ঘরেই সন্তান প্রসব করেন ৮০ শতাংশ নারী। প্রসূতিকালে ভালো খাবার বা চিকিৎসাসেবাও পান না তারা।

জরিপটি বছর চারেক আগের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে জানালেন শ্রমিকরা।

জরিপের এই করুণ দশার প্রমাণ পাওয়া গেল চা বাগানগুলো ঘুরেও। মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিক নমিতা লোহার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু এখন পর্যন্ত একবারও ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি তার। এর আগে আরও দুটি সন্তান জন্ম হয়েছে নমিতার। দুবারই ঘরেই প্রসব হয়েছে। তাও প্রশিক্ষিত কোনো ধাত্রীর সহায়তা ছাড়া।

পাঁচ বছর ধরে চা বাগানের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঊষা। এই সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক নিগার সাদিয়া জানান, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তি অনেক কম। তারা কিছু মনে রাখতেও পারে না। এখানকার কোনো শিশুই তিন বেলা খেতে পারে না।

মা-বাবা কাজে থাকায় দুপুরে চা শ্রমিকদের ঘরে রান্নাবান্না হয় না। চা বাগানের প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য মিড ডে মিল চালু করার কথা বলে আসছে সংগঠনটি।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাবে, ২০২১ সালে দেশে রেকর্ড ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর আগে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সে বছর ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ।

চায়ের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ছে। বাজার বড় হচ্ছে। বাড়ছে দাম। এতে লাভবান হচ্ছেন বাগান মালিকরা। তবে শ্রমিকদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসছে না। শ্রমিকরা থেকে যাচ্ছেন তিমিরেই।

বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় শ্রমিকদের রেশন, আবাসনসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়। শ্রমিকদের দাবি- এসব সুবিধা শুধু কাগজে-কলমেই। বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

সিলেটের বিভিন্ন বাগান ঘুরে দেখা যায়, কয়েকজনের পাকা ঘর থাকলেও বেশির ভাগ শ্রমিকের ঘর জরাজীর্ণ। বাগানেই কিছু আলিশান বাড়ি আছে। এগুলোতে থাকেন ম্যানেজার আর পদস্থ কর্মকর্তারা। মালিকদের চাকচিক্যময় বাংলোও আছে কিছু বাগানে। সেখানে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন তারা। শ্রমিকদের ঘরগুলো মাটি আর টিনের তৈরি।

অনেকের ভাঙা ঘরে আলো আর বৃষ্টির জলের অবাধ যাতায়াত। শিয়াল-কুকুরও ঢুকে পড়ে অবাধে। ছাপড়ার মতো ছোট্ট একেকটা ঘরে ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা মিলে থাকেন। একটি শয়নকক্ষেই পাঁচ-ছয়জনকে গাদাগাদি করে থাকতে দেখা গেছে।

শেলী মোদীর ঘর ঝড়ে ভেঙে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানোর পর বাগান কর্তৃপক্ষ কিছু টিন দিয়েছে। কিন্তু কেবল টিন দিলেই কি ঘর মেরামত হয়? আনুষঙ্গিক অন্য জিনিস আর মজুর কোথায় পাবেন শেলী? এসব জোগাড় করতে না পারায় ঘরও মেরামত করা হচ্ছে না শেলীর।

ঘর ভেঙে পড়লেও এখন পর্যন্ত বাগান থেকে কোনো সহায়তা করা হয়নি বলে জানালেন আরেক শ্রমিক বিমল ভূমিজ।

মুজিববর্ষে ভূমিহীন সবাইকে ঘর করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত চা শ্রমিকরা। চা বাগানের কোনো শ্রমিকেরই ভূমির অধিকার নেই। নিজের জমি নেই। প্রায় ২০০ বছর ধরে বাগানে থাকলেও জমির মালিকানা পাননি তারা।

চা শ্রমিকের সন্তান কাজল গোয়ালা। অনেক কষ্টে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিনি। চা বাগানে কাজলদের একটা সাংস্কৃতিক দলও আছে।

কাজলের আক্ষেপ, দাস হিসেবেই থাকতে হচ্ছে তাদের। কেউ কাজ না করলে বাগানে থাকতে দেয়া হয় না।

চা বাগানের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। মুসলমান আর খ্রিষ্টানও আছেন কিছু। মুসলমানরা মূলত এসেছেন বিহার থেকে। আর এখানে আসার পর ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়েছেন অনেকে। চা বাগানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন থাকলেও তাদের এখন একমাত্র পরিচয় চা শ্রমিক। হারিয়ে গেছে নিজেদের জাতিগত পরিচয়।

গবেষক দিলীপ গাইন তার ‘স্লেভ ইন দিস টাইমস: টি কমিউনিটি অফ বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বলেছেন, চা বাগানগুলোতে ৮০টি ক্ষদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস।

চা শ্রমিকদের সংস্কৃতি নিয়ে পিএচডি করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আশ্রাফুল করিম। তিনি জানান, ক্ষুদ্র্র নৃগোষ্ঠী হয়েও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত চা শ্রমিকরা।

চা বাগানের নৃগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। তবে চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তা। সিলেটের চা বাগানগুলোতে একমাত্র দুর্গাপূজা জাঁকজমক করে আয়োজন করা হয়। কিন্তু চা শ্রমিকদের নিজস্ব ফাগুয়া উৎসব সেভাবে পালন হয় না। চর্চার কোনো সুযোগ না থাকা আর অর্থাভাবে এসব জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন কাজল।

কয়েক দিন আগেও চা শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ধর্মঘট পালন করছিলেন। বাগান মালিকদের দাবি, বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে দিনে একজন শ্রমিক ন্যূনতম ৪০২ টাকা আয় করেন।

তবে মালিকদের এই দাবির সঙ্গে ভিন্নমত শ্রমিকদের। তারা জানান, ঘরের পাশে একটি সবজির গাছ লাগালেও মজুরি বা রেশন থেকে কেটে রাখে বাগান কর্তৃপক্ষ। আর কাজে না গেলে মজুরি বা রেশন মেলে না।

অনেক বাগানের শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরিও পান না বলে জানালেন গবেষক ড. আশ্রাফুল করিম।

শ্রম আইন অনুযায়ী অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের অবসরকালীন ভাতা দেওয়ার বিধান থাকলেও তারা এমন কিছু পান না বলে জানিয়েছেন চা বাগানে কাজ করে অবসরে যাওয়া কয়েকজন।

এত বঞ্চনা, এত অপ্রাপ্তি তবু বংশপরম্পরায় চা বাগানেই থেকে গেছেন শ্রমিকরা। চা শ্রমিকদের সন্তানদের মধ্যে বাগানের বাইরে কাজে যাওয়ার প্রবণতা কম। শহরের আশপাশের বাগানগুলোর শ্রমিক পরিবারের কেউ বাইরে কাজ করলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই হার একেবারেই কম।

গবেষক দীপঙ্কর মোহন্ত জানান, শুরু থেকেই চা শ্রমিকদের মূল জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকরা। কেননা, মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশলে শ্রমিকরা অধিকার সচেতন হয়ে উঠবেন। নিজেদের বঞ্চনা উপলব্ধি করতে পারবেন। তখন বাগানে কাজ করতে চাইবেন না।

এমনকি শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন রাখতে বাগানে আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে ব্রিটিশরা। বাগানে বাইরের মানুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিকদের চলাচলও সীমিত করা হয়।

দীর্ঘকাল ধরে বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে তাদের মানসিকতাই বদলে গেছে। এখনও তারা বাইরের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারছেন না। বাগানকেই তাদের জীবন মনে করছেন।

আর চা শ্রমিকের সন্তান কাজল গোয়ালা মনে করেন, অর্থাভাবে লেখাপড়া শিখতে না পারার পাশাপাশি চা শ্রমিকদের বাগানের বাইরের মানুষরা অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখার কারণেও তারা সমাজের মূল স্রোতে মিশতে পারছেন না।

ছিলেন দরিদ্র কৃষক। প্রলোভন আর প্রতারণার শিকারে হয়ে গেলেন দাস। নামমাত্র মজুরিতে, কখনওবা মজুরি ছাড়াই কঠোর শ্রম দিয়ে যেতে হয়। গহিন জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলেন চা বাগান। এমন কঠোর পরিশ্রম আর অনাহার ও অর্ধাহারে মারা যান অনেকে।

এই বঞ্চনা আর প্রতারণার বিরুদ্ধে একবারই সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন চা শ্রমিকরা। ১৯২১ সালে সবাই মিলে নিজেদের আদি নিবাসে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নেন তারা। বিভিন্ন বাগান থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন শ্রমিকরা। তাদের ঠেকাতে সেবার ব্রিটিশ সরকার রেলসহ সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। শ্রমিকরা তবু হেঁটেই রওনা দেন। মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকেন তারা। পথেই মারা যান অনেকে। তবু দৃঢ় সংকল্প শ্রমিকরা। তাদের দমাতে না পেরে আরও কঠোর হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকার।

১৯২১ সালের ২০ মে চাঁদপুরের জাহাজঘাটে বাড়ি ফেরার জন্য জড়ো হন চা শ্রমিকরা। এ সময় তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গোরখা সৈন্যরা। সরিয়ে নেওয়া হয় জাহাজের পাটাতন। বহু শ্রমিকের সলিল সমাধি ঘটে। সেবার আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাদের। আর কখনই বাড়ি ফেরার সাহস করেননি তারা।

চা বাগানগুলোকে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে ধরা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমিকদের কাছে দেবতাতুল্য। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই ১৭৭০-এর নির্বাচনে ভোটাধিকার পান চা শ্রমিকরা। এর আগে তাদের ভোটের অধিকারও ছিল না।

১৯৫৬ সালে শ্রম সচিব থাকাকালে চা শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ও বোনাস নির্ধারণ করে দেন বঙ্গবন্ধু। আর ১৯৫৭ সালে টি বোর্ডের দায়িত্ব নিয়ে শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু করেন তিনি।

এই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই চা শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অনুসারী।

দিনের কর্মব্যস্ত চা বাগানের বিপরীত চিত্র রাতে। রাতের বাগান একেবারে সুনসান। বাইরে যদিও তীব্র গরম, তবে রাতের চা বাগানে শীত নামতে শুরু করেছে। বাতাসে শীতের মিষ্টি ঘ্রাণ।

রাতে যখন দলদলি চা বাগানে ঢুকি, বাগানের প্রবেশমুখে দেখা যায় অট্টালিকাসম একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। শ্রমিকরা জানালেন, ইসকনের মন্দির তৈরি হচ্ছে এখানে। নিজেরা যদিও ছাপড়া ঘরে থাকেন, তবু চাঁদা তুলে মন্দিরের জন্য সুরম্য ভবন বানাচ্ছেন তারা। প্রতিটি বাগানেই আছে সুরম্য মন্দির। মসজিদ আর গির্জাও আছে অনেক বাগানে। মালনীছড়া বাগানের পাশাপাশিই রয়েছে মন্দির, মসজিদ ও গির্জা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

চা বাগানগুলোতে রয়েছে মদের পাট্টা। রাত হলেই অনেক শ্রমিক ভিড় করেন সেখানে। কম দামে অস্বাস্থ্যকর বাংলা মদে বুঁদ হয়ে থাকেন তারা। শ্রমিকদের বিভিন্ন বাড়িতেও বিক্রি হয় মদ। কম পারিশ্রমিকে অধিক কাজ করানোর জন্য ব্রিটিশরাই বাগানে এসব মদের দোকান চালু করে। প্রথমদিকে শ্রমিকদের জোর করেই মদ খাওয়ানো হতো। মদপানে উৎসাহ দেয়া হতো।

দলদলিতে বাগানে ঢুকতেই একটি ঘর থেকে ভেসে এলো কীর্তনের সুর। হরিনামসংকীর্তন চলছে। একটু সামনে এগোতেই শোনা গেল মদ নিয়ে দুই শ্রমিকের হল্লা। বঞ্চনা আর যন্ত্রণা ভোলার বাহারি সব আয়োজন।

এসবে ভুলেই চা পাতার মতো সবুজ আর ঘ্রাণময় এই মানুষগুলো বংশপরম্পরায় কাটিয়ে যাচ্ছেন ক্রীতদাসের জীবন। নিজেদের ঘাম আর রক্তে টিকিয়ে রেখেছেন দুটি পাতা একটি কুড়ির চা শিল্পকে। সবার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন প্রতিদিনকার আবশ্যিক পানীয় চা।

গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সতেজ হয়ে ওঠা মানুষরা কতটুকুইবা জানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের দুঃখের কথা?

আরও পড়ুন:
কী ঘটেছিল জিয়ার মৃত্যুর পর
যে গ্রামে অপরাধ কম, কালেভদ্রে পুলিশ  
রহস্যে ঘেরা মানুষশূন্য মঙ্গলপুর গ্রাম
ষাটের দশকের সেই হেলিকপ্টার সার্ভিস ও ভুলে যাওয়া দুর্ঘটনা
যে রহস্যের কিনারা নেই

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ
Banking sector corruption with reserve theft The ACC sought the documents of the former Governor and two Indian officials

রিজার্ভ চুরিসহ ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি, সাবেক ৩ গভর্নর ও ২ ভারতীয় কর্মকর্তার নথি চেয়েছে দুদক

রিজার্ভ চুরিসহ ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি,
সাবেক ৩ গভর্নর ও ২ ভারতীয় কর্মকর্তার নথি চেয়েছে দুদক

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাতে রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের ঋণ জালিয়াতিসহ ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাংক খাত ‘ধ্বংসের’ অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন সাবেক গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক-বর্তমান ১৯ কর্মকর্তা এবং দুজন ভারতীয় কর্মকর্তার নথি তলব করে ফের চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া এসব বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত জুনে প্রথম দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদারের নথিসহ ২৩ ধরনের নথি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। তবে সে দফায় কাঙ্ক্ষিত তথ্য না মেলায় গত সেপ্টেম্বরে কমিশন তৃতীয়বারের মতো আবার নথি তলব করে।
এই তলবকৃত নথির তালিকায় রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর টেকনিক্যাল দায়িত্বে থাকা দুজন ভারতীয় কর্মকর্তার নথিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এখনও সব নথিপত্র হাতে পায়নি বলে জানিয়েছে দুদক।


জানা গেছে, সম্প্রতি গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তাদের প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট নম্বর, দায়িত্বের পরিধি এবং অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যাদের নাম তালিকায় রয়েছে তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলা, নীতি শিথিলতা এবং অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলছে। দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। রিজার্ভ চুরির সময় গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন ড. আতিউর রহমান, যিনি একই বছরের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন।
এছাড়া সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, আবু হেনা মো. রাজী হাসান, এসএম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, আহমেদ জামাল এবং বিএফআইইউয়ের সাবেক প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসের সম্পর্কেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহার নামও রয়েছে এ তালিকায়।
বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী অফিসের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক (যিনি সম্প্রতি এক মাসের নোটিশে পদত্যাগ করেছেন) এবং আইসিটি বিভাগের দেবদুলাল রায়। আরও আছেন কমন সার্ভিস বিভাগ-২-এর পরিচালক মো. তফাজ্জল হোসেন, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ এবং আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তা মসিউজ্জামান খান ও রাহাত উদ্দিন।
দুদকের চিঠিতে মসিউজ্জামানের নাম দুইবার এসেছে—একবার অতিরিক্ত পরিচালক, আবার উপপরিচালক হিসেবে—যা একই ব্যক্তিকে নির্দেশ করে বলে জানা গেছে।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় নেওয়া দুই কোটি ডলার ফেরত আসে এবং ফিলিপাইন থেকে প্রায় দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এখনো প্রায় ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধারের প্রক্রিয়া ফিলিপাইনের আদালতে চলছে।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও ছাড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকের চারটি বিভাগ—ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট, আইটি, পেমেন্ট সিস্টেম এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং—এই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দুদকের চিঠিতে আরও দুটি ভারতীয় নাগরিকের তথ্য চাওয়া হয়েছে—নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা। নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির আগে ‘সুইফট’ সংযোগ স্থাপনের কাজ করেছিলেন, আর রাকেশ আস্তানা চুরির পর নিরাপত্তা ভেদ সংক্রান্ত তদন্তে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের আমলে।
এদিকে গতকাল সোমবার আলাদা এক অনুসন্ধানে দুদক চট্টগ্রামের বন সংরক্ষক ড. মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে এক দিনেই ৭৭ জন কর্মচারীকে বদলি করার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
গেল ফেব্রুয়ারিতে অভিযান চালিয়ে দুদক রেজাউল করিমের নামে লালমাটিয়ায় ৭ কোটি টাকার দুটি ফ্ল্যাট, ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট এবং সাতক্ষীরার তালা থানায় জমি কেনার প্রাথমিক দুর্নীতির উপাদান খুঁজে পেয়েছিল।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
ACCs campaign in the establishment on charges of irregularities and corruption

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ৪ প্রতিষ্ঠানে দুদকের অভিযান

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ৪ প্রতিষ্ঠানে দুদকের অভিযান

অর্থ আত্মসাৎ, পাচার, অনৈতিক আর্থিক লেনদেন, হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন জায়গায় চারটি প্রতিষ্ঠানে পৃথক এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

রোববার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের জনসংযোগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

দুদক জানায়, মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ এবং এডিপি প্রকল্পের অর্থায়নে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কালভার্ট-সেতু নির্মাণের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বক্তব্য গ্রহণ করা হয় এবং কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডপত্রের আলোকে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়।

অপর অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের নিমিত্তে এনফোর্সমেন্ট টিম মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের ছয়না গ্রামে পাথরিয়া পাড় রাস্তা সংলগ্ন ৯ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কালভার্ট সরেজমিন পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে দেখা যায়, উক্ত কালভার্টটি কেবলমাত্র একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ির যাতায়াতের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছে।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পূর্বাঞ্চলের শতকোটি টাকার পুরাতন মালামাল ও স্ক্র্যাপ সংঘবদ্ধ অসাধু চক্রের মাধ্যমে পাচারের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে অভিযোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্রাদি সংগ্রহ করা হয়।

অপরদিকে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা প্রদানে হয়রানি ও নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযান পরিচালনাকালে দেখা যায়, হাসপাতালে রোগীদের সেবা প্রদানে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক উপস্থিত না থাকায় রোগীরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া রোগীদের খাবার সরবরাহে নানাবিধ অনিয়ম এনফোর্সমেন্ট টিমের নিকট পরিলক্ষিত হয়।

এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে খুলনা ও রাজশাহী নগরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নিমিত্তে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে পৃথক একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The locals are overwhelmed by the misdeeds of Kuddus and Minu forces in Ashashuni

আশাশুনিতে কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর অপকর্মে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ

আশাশুনিতে কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর অপকর্মে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ

সাতক্ষীরার আশাশুনিতে জমি দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজিতে অন্যতম অবস্থানে রুহুল কুদ্দুস ও মিনু বাহিনী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তেলবাজি, দালালি করত বিএনপি নেতা বনে যাওয়া রুহুল কুদ্দুস। চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস ও তার আপন সহোদর আমিনুর রহমান মিনুর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। অভিযোগ আছে, ওই চক্রটির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই বেধড়ক মারপিট, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এমনকি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে থাকে। রুহুল কুদ্দুস ও আমিনুর রহমান মিনু বাহিনীর রয়েছে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি সক্রিয় সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা দুইজন, এদের মধ্যে একজন আশাশুনি আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস এবং অপর ব্যক্তি রুহুল কুদ্দুসের আপন ভাই কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-যোগাযোগ সম্পাদক আমিনুর রহমান মিনু।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে রুহুল কুদ্দুস আমিনুর রহমান মিনু, মমিনুর রহমান মন্টু, খোরশেদ আলম, মফিজুল ইসলাম, শামীম মোস্তফা শুভসহ তাদের সঙ্গপাঙ্গদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষ সহায় সম্বল হারিয়ে এখন নিঃস্ব। আশাশুনি উপজেলার ৯ নং আনুলিয়া ইউনিয়নের মাধ্যম একসরা গ্রামের প্রয়াত আবু দাউদ সানার ছেলে সাদ্দাম সানা বলেন, ‘৫ আগস্টের পরের দিন ৬ আগস্ট রাতে আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস ও তার বাহিনী আমার মৎস্য ঘেরে সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালায়।’ ভুক্তভোগী সাদ্দাম সানা বলেন, ‘রুহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যানের ঘেরের পাশে আমার মৎস্য ঘের। রুহুল কুদ্দুস দাঁড়িয়ে থেকে তার পোষ্য বাহিনী দিয়ে আমার ঘেরের ভেড়ি কেটে দিয়ে দখলে নেয়।’

সাদ্দাম সানা বলেন, রুহুল কুদ্দুস ও তার ভাই আমিনুর রহমান মিনুকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও আমার মৎস্য ঘের ফেরত পাইনি। আমার রেকর্ডীয় ৫ বিঘা ১০ কাঠা জমি অবৈধভাবে ভোগ দখল করছে রহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যান। এ ঘটনায় প্রশাসনের সহযোগিতাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ নাংলা গ্রামের মো. আব্দুল সানার ছেলে আকবর সানা মাঝি বলেন, ৫ আগস্টের পর রুহুল কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর ইন্ধনে তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালায়। এ সময় দোকানের তালা ভেঙে আনুমানিক ৩ লাখ টাকার শ্যালো মেশিনসহ মেশিনের পার্টসের মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। একই সময় আমার ভাই আক্তার সানার দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে আড়াই লাখ টাকার মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়।

আশাশুনি, আনুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ একসরা গ্রামের রোকনুজ্জামান মোল্যা বলেন, ‘আনুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে মান্নান মোল্যা, সুমন মোল্যা, খোরশেদ শিকারীসহ সন্ত্রাসী বাহিনী জোর করে মৎস্য ঘেরে লুটপাট চালিয়ে ৩ লাখ টাকার মাছ ধরে নেয়। ভুক্তভোগী রোকনুজ্জামান মোল্যা জানান, আশাশুনি থানাধীন একসরা মৌজায় জেএল নং-১৪১, সাবেক ৫১ নং, হাল ৬৩, এসএ দাগ ১৫৫৩/১৫৯৫ নং ও আমার ডিসিআর ২২/৮৫, আরএস ২৮৪১, ২৮৪২, ২৮৪৩, ২৮৪৪ ও ২৮৪৫ দাগে আমার ডিসিআরকৃত ০.৮৮ একর এবং রেকর্ডীয় ১.৪২ একর সর্বমোট ২.৩০ একর জমির একটি মৎস্য ঘের ছিল। যা আমি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা করার একপর্যায়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখ সকাল ৯টায় রুহুল কুদ্দুস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমার মৎস্য ঘেরে প্রবেশ করে জোর করে মাছ লুটপাট করে এবং আমার জমি দখলে নেয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী রোকনুজ্জামান মোল্যা গত ২০ এপ্রিল ২৫ তারিখ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার, খুলনা বিভাগের ডিআইজি, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পসহ সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এদিকে ৫ জানুয়ারি ২০২২ সালে আশাশুনি ৯ নং আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন রুহুল কুদ্দুস। তৎকালীন সময় রুহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে জনসম্মুখে একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণের একটি ভিডিওতে রুহুল কুদ্দুসকে বলতে শোনা যায়, এই নৌকা বঙ্গবন্ধুর নৌকা, এই নৌকা শেখ হাসিনার নৌকা, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতীক নৌকা। এর আগে রুহুল কুদ্দুস ও আমিনুর রহমান মিনু বাহিনীর ভয়াবহ সন্ত্রাসী তাণ্ডবের শিকার হন ভুক্তভোগী আনুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রফি মেম্বারসহ একাধিক ব্যক্তি। ৫ আগস্টের পর রফি মেম্বারের দুটি মৎস্য ঘের লুটপাট ও দখল করার ঘটনায় বিভিন্ন মিডিয়ায় কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উন্মোচন করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর সন্ত্রাসীরা রফি মেম্বারকে বেধড়ক মারপিট করে। আশাশুনি উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান, রহুল কুদ্দুস একজন সুবিধাবাদী ব্যক্তি। নিজ স্বার্থ ও চরিতার্থ হাসিলের জন্য সে যা খুশি তাই করে থাকে।

ফোনে আলাপকালে রুহুল কুদ্দুস তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এ বিষয়ে কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-যোগাযোগ সম্পাদক আমিনুর রহমান মিনু বলেন, এসব ঘটনার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Chief prosecutors commentary

চিফ প্রসিকিউটরের ভাষ্যে গোপন বন্দিশালার নির্মমতা

চিফ প্রসিকিউটরের ভাষ্যে গোপন বন্দিশালার নির্মমতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ছবি: বাসস
গোপন বন্দিশালার আলামত নষ্টের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘অনেক আলামত আমরা জব্দ করেছি। তবে আমরা দেখেছি গোপন বন্দিশালা বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর ব্যাপক আলামত নষ্ট করা হয়েছে।’

একজন মানুষকে পৈশাচিকভাবে কতটা নির্মম নির্যাতন করা যায়, তা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন না করলে বিশ্বাস করাটা কঠিন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত পাওয়া গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল (বুধবার) তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। গুম কমিশন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কসহ আমি (চিফ প্রসিকিউটর) বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করেছি এবং বীভৎসতার চিত্র আমরা দেখেছি।

‘সেখানে ইলেক্ট্রনিক শক দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বন্দিদের চোখ বেঁধে রাখা হতো। তিন ফিট বাই তিন ফিট এবং দুই ফিট বাই দুই ফিট অমানবিক সব সেল। একটা মানুষকে পৈশাচিকভাবে কতটা নির্মম নির্যাতন করা যায়, তা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন না করলে মানুষের পক্ষে এগুলো বিশ্বাস করাটাই কঠিন ছিল।’

গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্ধতিগতভাবে ভিন্নমত দমন করার জন্য নির্যাতন ও গোপন হত্যাকে যে সংস্কৃতিতে পরিণত করেছিল, সেটি উন্মোচিত হয়েছে উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন,‘যারা এই নির্যাতন বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর সাথে সম্পৃক্ত, আমরা তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে চাই।’

মায়ের সঙ্গে এক মেয়ের বন্দিদশার কথা তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘একটা ১১ বছরের মেয়েকে তার মাসহ তুলে নেওয়া হয়েছিল। মেয়েটির সামনে মাকে হাতকড়া দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। মেয়েটির মা মোটা ছিল বলে হাতকড়া কেটে তার শরীরের মধ্যে বসে গিয়েছিল। ১১ বছরের মেয়েটাকে পাশেই চোখ বেঁধে রাখা হতো। বাথরুম করার সময়ও মেয়েটির মায়ের হাতকড়া খুলে দেওয়া হতো না।

‘১১ বছরের মেয়েসহ একজন নারী রেহাই পায়নি। পুরুষ সদস্যরা নির্যাতন করেছে। এমনকি মেয়েটির মা আজও ফিরে আসেনি। আমরা ধারণা করছি, হয়তো তাকে হত্যা করে তার লাশ কোথাও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ১১ বছরের মেয়েটি কিন্তু চিহ্নিত করতে পেরেছে কোথায় তাদের রাখা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল।’

গোপন বন্দিশালার আলামত নষ্টের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘অনেক আলামত আমরা জব্দ করেছি। তবে আমরা দেখেছি গোপন বন্দিশালা বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর ব্যাপক আলামত নষ্ট করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন:
জুলাই গণহত্যার ‘টপ কমান্ডার’দের বিচার এক বছরের মধ্যে
আত্মহত্যার চিরকুট লিখে আত্মগোপনে
ধর্ষণ মামলায় ১৮ বছর পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার
গ্রেপ্তার আতঙ্কে চট্টগ্রাম বিএনপির নেতা-কর্মীরা
দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষোভে স্বামীর গোপনাঙ্গ কাটলেন প্রথম স্ত্রী

মন্তব্য

বাংলাদেশ
No one is taking responsibility for the construction of Sylhet District Hospital

সিলেট জেলা হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শেষ, দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ

সিলেট জেলা হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শেষ, দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে নির্মাণ করা হয় সিলেট জেলা হাসপাতাল। ছবি: নিউজবাংলা
নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে নির্মাণ করা হয় ২৫০ শয্যার সিলেট জেলা হাসপাতাল। নাগরিক সমাজের আপত্তি উপেক্ষা করে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ দায়িত্বশীলরা অনেকটা জোর করে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন এই হাসপাতাল। নির্মাণকাজ ২০২৩ সালে শেষ হলেও এখন এটির দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ।

নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে নির্মাণ করা হয় সিলেট জেলা হাসপাতাল। নাগরিক সমাজের আপত্তি উপেক্ষা করে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ দায়িত্বশীলরা অনেকটা জোর করে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন এই হাসপাতাল।

২৫০ শয্যার এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ ২০২৩ সালে শেষ হলেও এখন এটির দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ।

স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টদের মতামত না নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করায় এই হাসপাতাল ভবনের দায়িত্ব নিতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। ফলে হাসপাতাল কমপ্লেক্স বুঝিয়ে দেয়ার মতো কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে না গণপূর্ত বিভাগ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সিভিল সার্জন অফিসসহ কেউই এর দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। ফলে হাসপাতাল চালু করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। যদিও নির্মাণ কাজের শুরুতে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, এটি চালু হলে ওসমানী হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে। সিলেট অঞ্চলের রোগীরা এখান থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা নিতে পারবেন।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৬ দশমিক ৯৮ একর জায়গার ওপর এই জেলা হাসপাতাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণপূর্ত অধিদপ্তর হাসপাতালটির অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, ভবন নির্মাণসহ রংকরণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। তবে ভবনে হাসপাতালের কোনো যন্ত্রপাতি আনা হয়নি। এর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনীও দেয়া হয়নি।

নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মওদুদ আহমদ জানান, তাদের কাজ শেষ। তারা ভবনটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে তুলে দিতে প্রস্তুত।

জানা গেছে, হাসপাতাল ভবন নির্মাণ শেষ হলেও ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয় নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা পরিচালনা করবে, সেটি এখনও নির্ধারণ হয়নি। হাসপাতাল হস্তান্তরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ না পাওয়ায় গণপূর্ত বিভাগ এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে।

গণপূর্ত বিভাগ জানায়, ১৫ তলা হাসপাতাল ভবনে আটতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রঙের কাজ, ইলেক্ট্রিক, টাইলস, গ্লাস, দরজা, জানালা লাগানোও সম্পন্ন। হাসপাতাল ভবনের বেসমেন্টে রয়েছে কার পার্কিং; প্রথম তলায় টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুম; দ্বিতীয় তলায় আউটডোর, রিপোর্ট ডেলিভারি ও কনসালট্যান্ট চেম্বার; তৃতীয় তলায় ডায়াগনস্টিক; চতুর্থ তলায় কার্ডিয়াক ও জেনারেল ওটি, আইসিসিইউ, সিসিইউ; পঞ্চম তলায় গাইনি বিভাগ, অপথালমোলজি, অর্থোপেডিক্স ও ইএনটি বিভাগ এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় ওয়ার্ড ও কেবিন। এর মধ্যে আইসিইউ বেড ১৯টি, সিসিইউ বেড ৯টি এবং ৪০টি কেবিন রয়েছে।

জেলা গণপূর্ত অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাফর বলেন, ‘আমরা এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে দেব। বাই মিসটেক এখানে যেহেতু লোকাল অথরিটি পাওয়া যায়নি। সেহেতু আমরা অথরিটি নির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘টেন্ডার সিডিউল, নকশাসহ কাগজপত্র সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগকে দেয়া হয়েছে। প্রতি তলায় ছাদ ঢালাইয়ের সময় তারা এসেছিল। এই হাসপাতালের জমি, ভবন, টাকা- সব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; আমরা শুধু কাজ করে দিচ্ছি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে হাসপাতালটি পরিচালনা বা তদারকির কথা ছিল। আমরা মন্ত্রণালয়কে সেভাবেই চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব যখন মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন গণপূর্ত বিভাগ আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। শুনেছি, হাসপাতালের কাজ শেষ। এখন তারা আমাদের গছাতে চাচ্ছে। অথচ এখানে কী আছে না আছে- সেটি আমাদের জানা নেই। তাই এ অবস্থায় আমরা হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে পারি না।

‘কারণ, আমাদের আগের পরিচালক (ডা. হিমাংশু লাল) এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে গেছেন মন্ত্রণালয়ে। তাতে তিনি লিখে যান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অগোচরেই সিলেটে অনেক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। তারা যেন না বুঝে এসব স্থাপনার দায়িত্ব কোনোভাবেই না নেন।’

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘হাসপাতালের স্থাপত্য নকশা, কর্মপরিকল্পনা, সেবা প্রদানের জন্য সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় কক্ষের সুবিন্যাসকরণ ইত্যাদির কাগজপত্র সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পরিচালক অথবা ওসমানী হাসপাতালের পরিচালকের কাছে দাখিল করা হয়নি। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এটি বাসাবাড়ি নয়; আমাকে দায়িত্ব দিয়ে দিল আর নিয়ে নিলাম। এটি একটি হাসপাতাল। এটি নির্মাণে আমাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয়নি।’

হাসপাতালটি নির্মাণের আগে কোনো মতামত নেয়া হয়নি জানিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, ‘এভাবে হুট করে আমরা কোনো হাসপাতালেল দায়িত্ব নিতে পারি না। এই ভভনের অবকাঠামো হাসপাতালের উপযোগী কী না তাও আমাদের জানা নেই।

‘তাছাড়া ওসমানী হাসপাতালের অধীনে আরও কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে। সীমিত জনবল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে এগুলো পরিচলানা করতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। নতুন করে কোনো হাসপাতালের দায়িত্ব নেয়া এখন সম্ভব নয়।’

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেট জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এমন ঠেলাঠেলি বন্ধ হোক। এখানে কারও স্বার্থ বা কোনো কুচক্রী মহল আছে কিনা, সেটি খুঁজে দেখা দরকার। এ প্রকল্প যখন পাস হয়, তখনই বলে দেয়া হয়েছে কারা পরিচালনা করবে। নির্মাণের পর কেউ দায় নিতে না চাওয়া অন্য অর্থ বহন করে।’

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Irregularity corruption through promotion without qualification
খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা

যোগ্যতা ছাড়াই পদোন্নতি বাগিয়ে ঢালাও অনিয়ম-দুর্নীতি

যোগ্যতা ছাড়াই পদোন্নতি বাগিয়ে ঢালাও অনিয়ম-দুর্নীতি খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম। ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিজ জেলাতেই ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছেন খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিস্তর অভিযোগ শিক্ষকদের।

পদোন্নতি পাওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা তার ছিল না। অবৈধ উপায়ে পদ বাগিয়ে দফায় দফায় শুরু করেন নানামুখী দুর্নীতি। বিগত কয়েক বছর ধরেই খেয়াল-খুশিমতো বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন। পদে পদে তার স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছেন জেলার প্রাথমিক শিক্ষকরা।

আলোচ্য ব্যক্তিটি হলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিজ জেলাতেই ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে অবস্থান করা খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম।

১৯৯৭ সালের ২৮ এপ্রিল উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন শেখ অহিদুল আলম। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পান তিনি।

উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদ থেকে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য ১৯৮৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক গেজেটে কিছু যোগ্যতার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ওই গেজেটের ৩২ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর বিএড ডইগ্র অথবা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রি থাকতে হবে।

খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে চলতি বছরের আগস্ট মাসে শেখ অহিদুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. মোসলেম উদ্দিন।

তদন্তকালে শেখ অহিদুল আলম চাহিদা অনুযায়ী বিএড সার্টিফিকেট দিতে পারেননি। তার বদলে ২০০২ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) থেকে পাস করা এমএড সার্টিফিকেট দাখিল করেন।

তবে বিএড ও এমএড ডিগ্রি সমমান নয় বলে জানিয়েছেন বাউবির অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. মোহসীন উদ্দিন। গত ২৮ আগস্ট তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, বিএড ডিগ্রির বিকল্প হিসেবে এমএড ডিগ্রিকে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।

বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে গত ২০ অক্টোবর বাউবির ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. হাবিবুল্যাহ মাহমুদ তদন্ত কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বিএড ডিগ্রি অর্জনের জন্য শ্রেণীকক্ষে ৯০টি অনুশীলনী পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের দক্ষতা, শিক্ষার্থী মূল্যয়নের দক্ষতা, শ্রেণী ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের ধারণা অর্জনের ব্যবস্থা নেয়া হয়।

একইসঙ্গে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের প্রাক-যোগ্যতা অর্জনের জন্য পরিসংখ্যানগত ধারণা, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা দর্শনের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের কিছু বিষয় যুক্ত থাকে। কিন্তু এমএড ডিগ্রি প্রোগ্রামে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান-সংশ্লিষ্ট দক্ষতা অর্জনের কোনো সুযোগ নেই।

তবে বিএড ডিগ্রি নেই এরূপ শিক্ষার্থীদের এক সেমিস্টার পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক চারটি কোর্স সম্পন্ন করে এমএড ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ ২০০০ সালে এমএড শিক্ষাক্রমে ছিল। এজন্য এমএড প্রোগ্রামকে বিএড-এর বিকল্প বিবেচনার সুযোগ নেই।

এছাড়া ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৫৮ জন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিএড বা ডিপ্লোপা ইন এডুকেশন ডিগ্রি না থাকায় তাদের পদোন্নতি দেয়নি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তদন্তের সত্যতা জানিয়ে মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমি গত ২৪ অক্টোবর অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) চলে এসেছি। তাই তদন্তের সব কাজ শেষ করে আসতে পারিনি। বাকি কাজটুকু বর্তমান উপ-পরিচালক সম্পন্ন করবেন।’

তবে খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো মানতে নারাজ। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এমএড ডিগ্রি থাকলে বিএড আছে কিনা এটা কোনো বিষয় না। আমাদের ব্যাচে ১৩৭ জনের একযোগে পদোন্নতি হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে দেখেন সেখানে কতজনের বিএড ছিল না। আমার বিএড-এর থেকেও উচ্চতর এমএড ডিগ্রি তো আছেই। তাই আমার পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।’

শিক্ষক বদলিতে স্বেচ্ছাচারিতা

শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল একযোগে ১৭ জন শিক্ষকে বদলি করেন। তবে পরবর্তীতে অনলাইনে শিক্ষকরা দেখতে পান যে তাদের বদলি আদেশে আন্তঃজেলা বদলির নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর আবেদন করেন। একইসঙ্গে খোদ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ওই শিক্ষকদের বদলির আদেশ বাতিলের জন্য আবেদন করেন। পরবর্তীতে তিনি নামমাত্র একটি সুপারিশ কমিটি করে তাদের বদলি বহাল রাখেন।

৩ জুন অধিদপ্তর বরাবর পাঠানো চিঠিতে অহিদুল আলম উল্লেখ করেন, যেহেতু অনলাইনে তাদের বদলির আদেশ অনুমোদন হয়ে গেছে, তাই এই আদেশ বহাল রাখা যায়।

ওইসব শিক্ষক জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ জারিকৃত পত্রে চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধান শিক্ষকদের বদলিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ১৭ জনের মধ্যে চারজন প্রধান শিক্ষককেও বদলি করা হয়েছিল। এটা তিনি করেছিলেন পছন্দের ব্যক্তিদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বানানোর জন্য।

প্রতিবাদ করলেই শাস্তি

এই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যারা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের একজন বটিয়াঘাটা উপজেলার বারোভূঁইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষক নীহার রঞ্জন রায়।

তিনি জানান, ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর পিআরএল-এ যাওয়ার দিন তাকে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে লঘুদণ্ড দিয়ে বেতনের এক ধাপ অবনমিত করা হয়। এর বিরুদ্ধে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষা কর্মকর্তা অহিদুল আলমের সঙ্গে মতের মিল না হলেই বিপদে পড়তে হয়। তিনি ২০১২ সালে এক মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়ে ২৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন।

একই জেলায় ১৪ বছর

শেখ অহিদুল আলম ইতোপূর্বে খুলনা সদর থানার শিক্ষা অফিসার পদে তিন বছর, খুলনা বিভাগীয় অফিসে ছয় বছর ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে তিন বছর কর্মরত ছিলনে।

২০২৩ সালের ২০ জুন আবারও খুলনাতে তার বদলি হয়। সে সুবাদে তিনি খুলনাতেই প্রায় ১৪ বছর কর্মরত রয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনাতেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডাটাবেইজের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, শেখ অহিদুল আলমের স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার নলডাঙ্গা গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। তবে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া গেছে খুলনা সিটি করপোরেশনের দৌলতপুরের কালিবাড়িতে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ অহিদুল আলম খুলনার বিএল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তার শ্বশুরবাড়ি দৌলতপুরের কালিবাড়িতে। দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। স্থানীয় সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে আঁতাত করেই তিনি দীর্ঘদিন খুলনায় থাকার সুযোগ পেয়েছেন।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে শেখ অহিদুল আলম বলেন, ‘একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা নানারকম ষড়যন্ত্র করছে।’

আরও পড়ুন:
ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় উপপরিচালকের বিরুদ্ধে ডিলারকে মারধরের অভিযোগ
১৫ বছরে সেবা খাতে ঘুষ লেনদেন ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার: টিআইবি 

মন্তব্য

বাংলাদেশ
An allegation of embezzlement of crores of rupees against the agricultural officer in Kishoreganj

কিশোরগঞ্জে কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

কিশোরগঞ্জে কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অভিযুক্ত ফাহিমা আক্তার ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় কর্মরত। ছবি: নিউজবাংলা 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ছয়টি প্রকল্প থেকে (ফ্রিপ প্রকল্প, ময়মনসিংহ প্রকল্প, পার্টনার, অনাবাদি, রাজস্ব প্রকল্প ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী) কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেন ফাহিমা। 

কিশোরগঞ্জে বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

প্রকল্পগুলোর প্রদর্শনী নামমাত্র বাস্তবায়ন, কোথাও আবার বাস্তবায়ন না করেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, পুরো উপজেলায় বেশির ভাগ প্রদর্শনীতে মোট বরাদ্দের ৩০ শতাংশও কৃষক পাননি।

অভিযুক্ত কর্মকর্তার নাম ফাহিমা আক্তার, যিনি ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে সদর উপজেলায় কর্মরত।

এর আগে একই উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা পদে ছিলেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ছয়টি প্রকল্প থেকে (ফ্রিপ প্রকল্প, ময়মনসিংহ প্রকল্প, পার্টনার, অনাবাদি, রাজস্ব প্রকল্প ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী) কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেন ফাহিমা।

ফ্রিপ প্রকল্প

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ফ্রিপ প্রকল্পে বিভিন্ন ফসলের মোট ৫০৯টি প্রদর্শনী ও কৃষক প্রশিক্ষণ বাবদ ১ কোটি ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে।

এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা। যেগুলো করেছেন, সেগুলোও নামমাত্র বাস্তবায়ন দেখানো হলেও কৃষকরা তার সুফল পাননি।

ফ্রিপ প্রকল্পের রোপা আমন ধানের প্রদর্শনী করেন কাটাবাড়িয়া এলাকার কৃষক খোকন মিয়া। পাঁচ কেজি বীজ, ১৫ কেজি ডিএপি, ২০ কেজি ইউরিয়া সার আর কিছু কীটনাশক পেয়েছেন তিনি। তার পাওয়া উপকরণের বাজার মূল্য সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ তার অনূকূলে বরাদ্দ ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তার অনূকূলে মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ উপকরণ পেয়েছেন খোকন।

হাজিরগল গ্রামের কৃষক মুখলেছ, কাদির, হাসেম ও আতাউর মিলে ৫ একর জমিতে করেন ফ্রিপ প্রকল্পের বীজ গ্রাম প্রদর্শনী।

৪০ কেজি বীজ, পাঁচ বস্তা ইউরিয়া, চার বস্তা পটাশ, তিন বস্তা ডিএপি ও ১০ বস্তা জৈব সার পেয়েছেন এসব কৃষক, যার বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। অথচ তাদের অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয় দেড় লাখ টাকা। তারা তাদের মোট বরাদ্দের ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ উপকরণ পেয়েছেন।

খোকন, মুখলেছদের মতো এমন শত শত কৃষককে এভাবেই নামেমাত্র উপকরণ দিয়ে প্রদর্শনী বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার।

তার অভিযোগ, ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ফ্রিপ প্রকল্পে কৃষকের ৯৯টি গ্রুপ গঠনের জন্য চার লাখ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে।

প্রতিটি গ্রুপের অনূকূলে পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা দেড় হাজার করে টাকা পান বলে জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, শুধু গ্রুপ গঠন থেকেই আত্মসাৎ করা হয়েছে তিন লাখ ৪৬ হাজার টাকা।

ময়মনসিংহ প্রকল্প

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পেও ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমার বিরুদ্ধে।

২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একটি মডেল গ্রামের জন্য ২ লাখ ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। এরপর ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি মডেল গ্রামের জন্য বরাদ্দ আসে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা।

এ দুটি প্রদর্শনীতে বরাদ্দের ৪ লাখ ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করে কৃষি কর্মকর্তা একটিও বাস্তবায়ন করেননি বলে অভিযোগ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার।

পাঁচধা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান। পার্টনার প্রকল্পের কমিউনিটি বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি প্রদর্শনী, ময়মনসিংহ প্রকল্পের ভার্মি কম্পোস্ট, অনাবাদি প্রকল্পের পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী রয়েছে তার বাড়িতে। আবার ময়মনসিংহ প্রকল্পের মডেল গ্রাম প্রদর্শনীর বরাদ্দ দেখানো হয়েছে তার নামে।

সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে মডেল গ্রামের কোনো সাইনবোর্ড বা অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। তার দাবি, মডেল গ্রামের বরাদ্দটি তিনি পেয়েছেন, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অসুস্থতার কারণে করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শুরু করবেন।

সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়িতে থাকা অন্য প্রদর্শনীর সাইনবোর্ড সরানোর চেষ্টাও করেন এ কৃষক।

ময়মনসিংহ প্রকল্পের লতিকচু প্রদর্শনী করেছিলেন বেত্রাটী গ্রামের মিলন ভূঁইয়া। তার অনূকূলে ৩৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও এই প্রদর্শনীতে ১০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি পটাশ, এক বস্তা ডিএপি সার ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। মিলন যা পেয়েছেন তার বাজারমূল্য আনুমানিক ১ হাজার ২৪০ টাকা। মিলনের নামে প্রদর্শনীর সাইনবোর্ডটি আবার পাওয়া গেছে হৃদয় নামে আরেক লতিকচু চাষির বাড়িতে।

হৃদয়ের বাবা আবদুল হেকিম জানান, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাদের এই সাইনবোর্ডটি দিয়ে ছবি তুলেছেন।

এ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা আক্তারের দাবি, মিলনকে কোনো প্রদর্শনী দেয়া হয়নি।

সদর উপজেলার বাগপাড়া এলাকায় রফিকুল ইসলাম সৈয়দও করেছিলেন লতিকচুর প্রদর্শনী। ইউরিয়া, পটাশ, ডিএপি জাতের ৪০ কেজি সার আর ২ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়া আর কিছুই পাননি তিনি। অথচ তার অনূকূলে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার টাকা। বরাদ্দের ১০ শতাংশও পাননি এ কৃষক।

ময়মনসিংহ প্রকল্পের হলুদের প্রদর্শনী করেছিলেন কাশোরারচর এলাকার বাবলু মিয়া। তার অনূকূলে ২৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও তিনি পান বীজ কেনার জন্য ৪ হাজার টাকা, এক বস্তা জৈব সার, ১০ কেজি ইউরিয়া আর ১০ কেজি পটাশ।

৫০০ বস্তায় আদা চাষ প্রদর্শনী করেন সদর উপজেলার আগপাড়া এলাকার এমদাদুল হক রুবেল। কৃষি অফিস থেকে ২০ কেজি পটাশ, ২০ কেজি ডিএপি, ১৫ কেজি আদা আর ৩৫০টি বস্তা ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। অথচ এ কৃষকের অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৪৪ হাজার টাকা।

এ কৃষক বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যেগুলো করেছেন, সেগুলোতে সুফল পেলেও বিপাকে পড়েন প্রদর্শনী করে।

ফাহিমাঘনিষ্ঠ আবুল হাসেমের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ

২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর একটি কমিউনিটি বেজড ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপনের জন্য বরাদ্দ আসে ৭০ হাজার টাকা। সেটি বরাদ্দ দেয়া হয় কৃষি কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবুল হাসেমের শ্বশুরবাড়িতে।

কিশোরগঞ্জে কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
অভিযুক্ত আকুল হাসেম। ছবি: নিউজবাংলা

এ আবুল হাসেম কৃষি কর্মকর্তার সব অনিয়মের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে অভিযোগ এক কর্মকর্তার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের ওই কর্মকর্তা জানান, অফিসে উচ্চমান সহকারী থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ আর্থিক ফাইল করেন আবুল হাসেম, যেটার কোনো বিধান নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিউনিটি বেজড ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপনের বিষয়টি স্বীকার করেন আবুল হাসেম।

অনিয়ম ও আর্থিক ফাইল করার বিষয়টি অস্বীকার করে দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে মিথ্যা হিসেবে আখ্যা দেন তিনি।

অনাবাদি প্রকল্প

অনাবাদি প্রকল্পে আরও বেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমার বিরুদ্ধে।

এ প্রকল্পের পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী করেছেন কাটাবাড়িয়া এলাকার আছমা খাতুন। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন জাতের সবজির বীজ আর একটি সাধারণ নেট ছাড়া তেমন কিছুই পাননি তিনি। তার দাবি, সব মিলিয়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকার মতো উপকরণ পেয়েছেন।

এ কিষাণীর অভিযোগ, বাগানে পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে বারবার কীটনাশক চেয়েও পাননি তিনি। আছমার প্রাপ্ত উপকরণের বাজারমূল্য মোট বরাদ্দের ২৫ শতাংশ।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় অনাবাদি প্রকল্পের মোট ৯৩২টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ আসে ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে পারিবারিক পুষ্টি বাগান ৪১৯টি আর পুষ্টি বাগান পুনঃস্থাপন ৫১৩টি।

উপ-সহকারী এক কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, এসব প্রদর্শনীতে আছমা খাতুনের মতো শত শত কৃষক/কিষাণীকে নামমাত্র উপকরণ দিয়ে বাস্তবায়ন করেন ফাহিমা।

পার্টনার প্রকল্প

চলতি বছরের ২৮ ফ্রেব্রুয়ারিতে আটটি এবং ৩ এপ্রিলে সাতটি (মোট ১৫) পার্টনার ফিল্ড স্কুলের জন্য ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে।

উপ-সহকারী এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, যেখানে কৃষকদের নাশতার জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ টাকা, সেখান থেকে নামেমাত্র বিস্কুট আর পানি খাইয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী

২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনীর জন্য ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। বছরের শুরুতে বরাদ্দ আসলেও কাজ শুরুই করেন অক্টোবর শেষ সাপ্তাহে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত প্রকল্পটিও আত্মসাৎ করার পাঁয়তারা করেছিলেন কৃষি কর্মকর্তা। পরে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বাস্তবায়ন শুরু করেন তিনি।

শহরের তারাপাশা এলাকার বাসিন্দা মারিয়াতুল কিপতিয়া পাপিয়া। বিগত তিন বছর ধরে নিজ উদ্যোগে মাশরুম উৎপাদন করছেন তিনি। অক্টোবরের শেষ দিকে কৃষি অফিস থেকে স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী বরাদ্দ পান তিনি। ২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি আসা প্রকল্পটির বরাদ্দ ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা হলেও এ কিষাণী পান আড়াই লাখ টাকা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবেমাত্র ঘর নির্মাণকাজ শুরু করেছেন তিনি।

অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্য

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমা আক্তারের দাবি, দুটি মডেল গ্রাম বাস্তবায়ন করেছেন, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কৃষকের অসুস্থতার জন্য খানিকটা বিলম্ব হয়েছে।

বাস্তবায়িত মডেল গ্রামে সাইনবোর্ড আছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে।’

যদিও কৃষক জানিয়েছেন, তিনি এখনও সাইনবোর্ড পাননি।

মাশরুমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি চলমান প্রক্রিয়া। বাস্তবায়নে কোনো অনিয়ম হয়নি।’

তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও অভিযোগ পেয়েছেন। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।

আরও পড়ুন:
বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে জলমহাল দখলের অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতার 
নিহত লেফটেন্যান্ট তানজিমের বাড়িতে যাচ্ছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা
ইটনায় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ, যুবদল নেতা গ্রেপ্তার
কাশিমপুর কারাগার থেকে পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কিশোরগঞ্জে গ্রেপ্তার
কিশোরগঞ্জে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

মন্তব্য

p
উপরে