নিরীহ নিশাচর এক বন্যপ্রাণী মেছো বিড়ালকে সাধারণ মানুষ ডাকে ‘মেছো বাঘ’ নামে। আর এ নামের কারণে ভুল ধারণার শিকার হয়ে প্রাণীটি বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
সিলেট অঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার হাওর-বাঁওড় ও ছোট-বড় জলাভূমির আশপাশের ঝোপঝাড়, বাঁশঝাড়জুড়ে এই প্রাণীটির আবাসস্থল। নানা কারণে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে মেছো বিড়ালের সংখ্যা। বিশেষ করে হাওর এলাকায় মাছ ও হাঁসের খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ঝোপঝাড় কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে এদের আবাসস্থল। ফলে বিভিন্ন সময় মানুষের হাতে ধরা পড়ছে মেছো বিড়াল এবং এদের শাবক। জলাভূমি ধ্বংসের কারণে মেছো বিড়াল ক্রমাগত মানুষের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। মেছো বিড়াল আর মানুষের সংঘাত নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এই গবেষণা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশের নেতৃত্বে গবেষণাটি গত মার্চে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘স্টুডেন্ট কনফারেন্স অন কনজারভেশন সায়েন্স’ শীর্ষক কনফারেন্সে পোস্টার হিসেবে প্রদর্শিত হয়। এই গবেষণাটি ৪২টি দেশের ১১৬টি পোস্টারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পোস্টার হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
এ গবেষণায় সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া এ রকম সংঘাতের খবরগুলোকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ৯টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। একটি সংবাদে মেছো বিড়ালের ছবি কিংবা বন বিভাগ বা বিশেষজ্ঞের বিবৃতি থাকলেই কেবল সংবাদটিকে সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংঘাতের স্থান, স্থানের প্রকৃতি এবং মেছো বিড়াল অবমুক্তির স্থানের বিষয়টি লক্ষ করা হয়। এ ছাড়া সংঘাত কোন সময়, কোন ঋতু এবং কোন বছরে ঘটেছে, সেটিও দেখা হয়। এর পাশাপাশি, প্রতিটি সংঘাতের পেছনের কারণ, মানুষের প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তির ধরন এবং সংঘাতে জড়িত মেছো বিড়ালের সংখ্যা, মৃত, উদ্ধারকৃত এবং অবমুক্তকৃত বিড়ালের সংখ্যাটিও লিপিবদ্ধ করা হয়।
২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেছো বিড়ালের সঙ্গে মানুষের সংঘাতের ৩৬১টি ঘটনার ৫৬৪টি খবর সংগ্রহ করেন গবেষকরা। এর মধ্যে ছিল ৩৯৫টি পূর্ণবয়স্ক এবং ১৭০টি অপ্রাপ্তবয়স্ক বা শাবক মেছো বিড়াল।
এ ঘটনাগুলোতে ১৬০টি মেছো বিড়ালের মৃত্যুর খবর উঠে এসেছে। প্রায় ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মেছো বিড়ালকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের সংবাদগুলোয় বিড়ালটিকে মেছো বাঘ, খাটাশ, চিতাবাঘের শাবক এমনকি বাঘ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
মুনতাসির আকাশ জানান, এ খবরগুলোর বিস্তৃতির মানচিত্র থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার সব জলাভূমিই মানুষ-মেছো বিড়ালের সংঘাতের হটস্পট। এ ছাড়া এ খবরগুলো থেকে সীতাকুণ্ড-চট্টগ্রাম এলাকায় মেছো বিড়ালের নতুন একটি পপুলেশনের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এর আগে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) থেকে ২০২২ সালে প্রকাশিত মেছো বিড়ালের বৈশ্বিক বিস্তৃতির মানচিত্রে সীতাকুণ্ড-চট্টগ্রাম এলাকায় মেছো বিড়ালের উপস্থিতির বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই গবেষণায় সারা বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, খুলনা বিভাগের অনেক এলাকায় মেছো বিড়ালের উপস্থিতির বিষয়টি উঠে আসে। এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অজানা ছিল।
মেছো বিড়াল-মানুষ সংঘাতের খবর সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে বলে গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়। শীতকালেই সংঘাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়। মুনতাসির আকাশ জানান, ২০১৬ সাল থেকে প্রতি ১৫ দিনে একটি করে নতুন মেছো বিড়াল-মানুষের সংঘাতের খবর সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।
এ সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ দেখামাত্র (অ্যাটাক অন সাইট) মেছো বিড়ালের প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ দেখিয়েছে। মাত্র ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সংঘাতগুলো হয়েছে মেছো বিড়ালের হাঁস-মুরগি খাওয়ার কারণে। প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে মেছো বিড়াল রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে, যার সবই বিড়ালগুলো মারা গেছে।
প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তির ধরন হিসেবে ধাওয়া করে মেছো বিড়ালকে আক্রমণ করার ব্যাপারটি প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ২০ শতাংশ ঘটনায় ফাঁদ পেতে মেছো বিড়াল ধরা হয়েছে বলে সমীক্ষায় জানা যায়।
মৌলভীবাজারে অবস্থিত সিলেট বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কার্যালয়ের উদ্যোগে মেছো বিড়াল সংরক্ষণ ও এ ধরনের সংঘাতের ঘটনা কমানোর একটি কার্যক্রমে সাফল্য পাওয়া গেছে।
বছর দুয়েক আগেও মেছো বিড়াল কিংবা মেছো বিড়ালের শাবকদের হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করে এ দপ্তরের আওতাধীন লাউয়াছড়া, সাতছড়ি কিংবা বর্ষিজোড়ার সংরক্ষিত বনে এনে অবমুক্ত করা হতো। এতে দেখা গেছে, মেছো বিড়ালগুলো তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রাণীটি নতুন স্থানে এসে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে খাদ্য ও আবাসসংকটে পড়ছে। এ ছাড়া তাদের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধিও ব্যহত হচ্ছে। এসব মেছো বিড়াল বিভিন্ন লোকালয় ডিঙ্গিয়ে হাওর বা জলাভূমিসমৃদ্ধ ঝোপঝাড়ের দিকে আবার পাড়ি জমায়। পরিণামে এগুলো লোকালয়ে আবার ধরা পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
সংরক্ষিত বনের বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতা ও পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারার কারণে দীর্ঘ দিন প্রাণীটি খাদ্যাভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে বংশবৃদ্ধির স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হয়।
মেছো বিড়ালের শাবক ধরা পড়লে এতোদিন এদের কৃত্রিম দুধ খাইয়ে বড় করে তোলার চেষ্টা করা হতো, যা বেশ কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। মায়ের যত্নবিহীন বেশির ভাগ শাবক এভাবে বাঁচানোই যেত না। কোনোভাবে দু-একটি বাঁচলেও সেগুলো বন্যতা হারিয়ে গৃহপালিত প্রাণীর মতো বেঁচে থাকত।
এসব কারণে গত দু বছর ধরে উদ্ধার হওয়া মেছো বিড়াল কিংবা এদের শাবকদের দূরের অন্য কোনো সংরক্ষিত বনে আর ছাড়া হচ্ছে না। এর বদলে এখন স্থানীয় মানুষজনকে বুঝিয়ে প্রাণীটিকে তার ধরা পড়ার স্থানেই অবমুক্ত করা হচ্ছে।
বর্তমান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বন বিভাগে যোগদান করার পর থেকেই পুরোনো উদ্যোগে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বন্যপ্রাণীর প্রতি রেজাউল করিমের ভালোবাসা, জীববিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারা, পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে মৌলভীবাজার বন বিভাগ গত ২ বছর ধরে মেছো বিড়াল, বনবিড়াল, গন্ধগোকুলের মতো ছোট আকারের মাংসাসী স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণীকে তাদের নিজস্ব পরিবেশে অবমুক্ত করা হচ্ছে। নতুন এই ধারণাটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ইতোমধ্যে ফলপ্রসূ ও কার্যকর বলে প্রমাণ হচ্ছে।
মেছো বিড়ালকে তাদের নিজস্ব আবাসস্থলে অবমুক্ত করায় এরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা, বসবাস ও প্রজনন সম্পন্ন করছে। শাবকগুলোকে তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ায় তারা মায়ের যত্নে বেড়ে উঠছে।
এভাবে এখন পর্যন্ত ৩১টি মেছো বিড়ালের শাবককে তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। নিজস্ব আবাসস্থলে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে ৫৯টি মেছো বিড়ালকে।
তিনটি মেছো বিড়াল জনরোষের শিকার হয়ে মারা যাওয়ায় মৌলভীবাজারের রাজনগর ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও সিলেট সদর থানায় মামলা দায়ের হয়। রাজনগর থানায় দায়ের করা মামলার আসামির সাজাও হয়েছে। মেছো বিড়াল হত্যায় দেশের আইনে এটি প্রথম শাস্তির ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এ গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে মেছো বিড়ালের প্রায় ৯০ শতাংশ আবাসস্থল অরক্ষিত। আহত মেছো বিড়ালের পর্যাপ্ত ও সঠিক চিকিৎসা না করতে পারা, জলাভূমির পরিবর্তে বনভূমিতে মেছো বিড়াল অবমুক্ত করা এবং একই বনভূমিতে ধারণক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত মেছোবিড়াল ছাড়বার বিষয়গুলোও গবেষণাটিতে উঠে আসে।
গবেষকদের দাবি, সুন্দরবন রক্ষায় বাঘের ভূমিকার মতোই জলাভূমি রক্ষায় মেছো বিড়ালকে ফ্ল্যাগশিপ প্রজাতি হিসেবে তুলে ধরতে হবে। সেই সাথে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মেছো বিড়াল অবমুক্ত করার পদ্ধতি প্রয়োগ করে সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ যেভাবে সফলতা পেয়েছে, তা সিলেটের পাশাপাশি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
আরও পড়ুন:৫০ ছাড়িয়ে যাওয়া ডিমের হালি কেউ যদি ৪৫ টাকা রাখে, আবার বিনা মূল্যে ঘরে পৌঁছে দেয়?
কেবল ডিম নয়, ঘরে বসেই বাজারদরের চেয়ে কম দামে পণ্য পাওয়ার সুযোগ আছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অনলাইন ঘাঁটলে এমন অনেক সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ১২ থেকে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত কম দাম নিচ্ছে তারা।
রাজধানীতে অনলাইন অর্ডারে পণ্য পৌঁছে দিতে ডেলিভারি চার্জও নিচ্ছে না বেশির ভাগ অনলাইন শপ। তবে কোনোটিতে জুড়ে দেয়া হচ্ছে শর্ত। কোথাও নির্দিষ্ট পরিমাণ কেনাকাটা করলে বিনা পয়সায় বাসায় পৌঁছে দেবে বলছে।
বাজারদরের তুলনায় এত কমে পণ্য বিক্রির কারণ হিসেবে উঠে এসেছে কয়েকটি বিষয়। বেশি বিক্রি কম লাভ- এই নীতিতে কোনো কোনো শপ পাইকারি দামে বিক্রি করে। কোনো কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রাহক ধরছে।
৪৫ টাকা হালিতে ডিম কিনুন
নিত্যপণ্যের মধ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কথা যেটি নিয়ে, সেই ডিম বাজারদরের চেয়ে ২০ শতাংশ কমে কেনার সুযোগ দিচ্ছে অনলাইন গ্রোসারি শপ ‘অথবা ডট কম’।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বৃহস্পতিবার ঢাকার বাজারে ফার্মের মুরগির এক হালি বাদামি ডিমের দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অনলাইন ঘাঁটলে এমন অনেক সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ১২ থেকে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত কম দাম নিচ্ছে তারা। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা
৫৫ টাকা হালি ধরে হিসাব করলে প্রতি পিস ডিমের দাম পড়ে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা। তবে ‘অথবা ডট কম’ বিক্রি করছে ১১ টাকা ২৬ পয়সা করে।
অর্থাৎ বাজারদরের চেয়ে প্রায় আড়াই টাকা বা ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ কমে দামে ডিম কেনা যাবে।
তবে এখানে এক হালি করে কেনার সুযোগ নেই। একসঙ্গে কিনতে হবে সাড়ে সাত হালি বা ৩০টি। আর এই ডিম ক্রেতাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে কোনো ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই।
ডায়াপার্স বিডি ডট কমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘সোপ বিডি ডট কম’ নামের অনলাইন শপে কেনা যাচ্ছে এক ডজন ডিমও। তারা ১২টি ডিমের দাম নিচ্ছে ১৪৫ টাকা। প্রতিটির দাম পড়ছে ১২ টাকা ৮ পয়সা, যা বাজারের চেয়ে ১ টাকা ৬৭ পয়সা বা ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ কম।
টিসিবির হিসাবে বৃহস্পতিবার ঢাকার বাজারে ফার্মের মুরগির প্রতি পিস ডিমের দাম ছিল ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা। তবে ‘অথবা ডট কম’ বিক্রি করছে ১১ টাকা ২৬ পয়সা করে। ডায়াপার্স বিডি ডট কমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘সোপ বিডি ডট কম’-এ পাওয়া গেছে ১২ টাকা ৮ পয়সায়। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা
সোপ বিডি কম কমে ডিম ছাড়াও বাজারদরের চেয়ে কমে পাওয়া যাচ্ছে অন্য নিত্যপণ্যও।
বাজারে পেঁয়াজের দর ৪০ থেকে ৫৫ টাকা। তবে এই শপে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি কেজি ৩৮ করে। ৩০ টাকা কেজি মূল্যের আলু এখানে মিলছে ২৫ টাকায়।
এই শপ ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য দেবে, এ জন্য কোনো বাড়তি চার্জও নিচ্ছে না।
গ্রাহক পর্যায়ে পরিচিত বাড়াতে লোকসানে পণ্য বিক্রির কথা জানিয়েছেন ডায়াপার্স বিডির কাস্টমার-কেয়ার কর্মী মোস্তফা ইমন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের নতুন ওয়েবসাইট। গ্রাহক পর্যায়ে পরিচিত হওয়ার জন্য পণ্যের কেনা রেটের চেয়েও দুই-এক টাকা কম দামে আমরা বিক্রি করছি।’
৩৬ শতাংশ পর্যন্ত কম দাম
ওয়ালটনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ওয়ালকার্ট আদা, রসুনের দামে ৩১ থেকে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। থাই আদার প্রতি কেজিতে ৪০ টাকা বা ৩৬ শতাংশ ছাড় দিয়ে ৭০ টাকায় বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। যেটি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজি। আর বাজারের চেয়ে ৩৮ টাকা কমে চায়না রসুন দিচ্ছে ১২০ টাকায়, যার বাজারমূল্য ১৫৮ টাকা।
ওয়ালকার্টের কল সেন্টার এক্সিকিউটিভ নাহিয়ান হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পাইকারি দামে অনেক পণ্য কিনি এবং সেটা কম দামে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছি। ফলে আমরা খুচরা বাজারের চেয়ে কম দামে পণ্য দিতে পারছি।’
৯৫০ টাকার যেকোনো পণ্যে ছাড় ১১০ টাকা
চেইন সুপার শপ মীনা বাজারে গিয়ে পণ্য কেনার চেয়ে ঘরে বসে কেনা অনেক বেশি লাভজনক।
এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মীনা ক্লিকে ৯৪৯ টাকার পণ্য অর্ডার করলে দিতে হবে ৮৩৯ টাকা। অর্থাৎ ১১০ টাকা ছাড় দিচ্ছে তারা। এই পণ্য বাসায় নিয়ে আসার পর কার্ড সোয়াপের মেশিনের মাধ্যমে বিল পরিশোধের সুযোগ থাকছে। ফলে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডেও সেই টাকা পরিশোধের সুযোগ আছে।
এই পণ্য হাতে পেতে আবার কোনো ডেলিভারি চার্জ দিতে হবে না।
কোনো কোনো ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে সুপারশপে কেনাকাটায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের ছাড় আসলে আরও বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী ম্যানেজার (ব্র্যান্ড ও কমিউনিকেশন) মর্তুজা আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাভ-লোকসান এভাবে হিসাব করা যায় না। আমাদের প্রমোশনের জন্য মার্কেটিং বাজেট থেকে অ্যালোকেট করা হয়। এটার কারণে আমরা কম দামে দিতে পারি।’
শুক্রবার সুপারশপে ছাড়ের ছড়াছড়ি
নাজিরশাইল প্রিমিয়াম যে চালের দর কেজিতে ৭৮ টাকায় বিক্রি হয়, গত দুই শুক্রবার মীনা বাজার সেটি বিক্রি করেছে ৬৮ টাকায়।
কেবল চাল নয়, প্রতিটি শপই শুক্রবার রীতিমতো বড় আকারের লিফলেট ছেপে বিভিন্ন পণ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে থাকে।
প্রাণের অনলাইন শপ ডেইলি শপিংয়ের পক্ষ থেকে ছাড় দেয়ার আগের দিন হোয়াটস অ্যাপে কোন পণ্য কত টাকায় বিক্রি করা হবে, সে তথ্য জানিয়ে এসএমএস পাঠানো হয়।
স্বপ্ন সুপার শপ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। আর ছুটির দিন ছাড়াও এসব শপে দুটির সঙ্গে একটি বা তিনটির সঙ্গে একটি এমনকি একটির সঙ্গে একটি ছাড় থাকে।
আবার মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো সেবা ব্যবহার করলেও দিনে ৫০ থেকে ১০০ টাকা ছাড় পাওয়ার সুযোগ আছে। স্বাভাবিক ছাড়ের সঙ্গে এই ছাড় আবার বাড়তি।
আরও পড়ুন:বন্দর নগর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১৩ জন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও তিনজন। আহত হন অন্তত ৫০ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
প্রায় ১০ বছরের ব্যবধানে এবার ঢাকায় বক্স গার্ডার চাপায় মারা গেলেন পাঁচজন।
বাস্তবতা হলো, ওই ঘটনার ১০ বছরেও মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। মামলার এই দীর্ঘসূত্রতা ঢাকায় বক্স গার্ডার পড়ে প্রাণহানির জন্য দায়ী বলে মনে করছে সচেতন নাগরিক কমিটি।
চট্টগ্রামে গার্ডার ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে কেউ মামলা করেনি। ঘটনার দুদিন পর চান্দগাঁও থানার উপপরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ মামলা করেন। তাতে প্রকল্প পরিচালকসহ ২৫ জনকে আসামি করা হয়। সাক্ষী করা হয় ২৭ জনকে।
এর প্রায় এক বছর পর ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর তদন্ত শেষে আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। ২০১৪ সালের ১৮ জুন তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ এস এম মজিবুর রহমান প্রতিবেদন গ্রহণ করে আট আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালে মামলাটি চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়।
ওই আটজন হলেন- ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতারের তৎকালীন প্রকল্প ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনজুরুল ইসলাম, প্রকল্প প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, আমিনুর রহমান, আব্দুল হাই, মোশাররফ হোসেন রিয়াজ, মান নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী শাহজান আলী ও রফিকুল ইসলাম। তাদের মধ্যে রফিকুল ইসলামের নাম মামলার এজাহারে ছিল না। তদন্ত শেষে পুলিশ তার নাম অভিযোগপত্রে যুক্ত করে।
বিচার শুরুর আট বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এ বিষয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর অনুপম চক্রবর্তী বলেন, ‘বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই মামলায় আসামিরা যেন সর্বোচ্চ শাস্তি পান আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।
‘দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে চলছিল। ২০২০ সালে সেখান থেকে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে দেয়া হয়েছে। মামলায় মোট ২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। রোববারও মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ছিল। সাক্ষী না আসায় তা সম্ভব হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘৩ অক্টোবর এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের সময় নির্ধারণ করেছে আদালত। ৩ তারিখে সাক্ষী হিসেবে চিকিৎসক পুলক কুমার বিশ্বাসের আদালতে আসার কথা রয়েছে। তার সাক্ষ্যগ্রহণ হয়ে গেলে মামলাটি ক্লোজ করতে পারব।’
চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৬ প্রাণহানির পরও দ্রুত বিচারকাজ শেষ না করাকেই ঢাকায় গার্ডার পড়ে প্রাণহানির জন্য দায়ী করছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সে সময় নিহতদের কারও ময়নাতদন্ত হয়নি। এটাই বলে দেয় এর বিচার কী হতে পারে। আর বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা নেই বলে ক্ষতিগ্রস্তরা সে সময় মামলা করেনি। অথবা মামলা না করার জন্য তাদের ফোর্স করা হয়েছিল। এ দেশে মানুষ বিচার পায় আর্থসামাজিক অবস্থান বিবেচনায়। বড় প্রোফাইলের কেউ না হলে বিচার পায় না।’
তিনি বলেন, ‘বহদ্দারহাটের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে অন্যান্য বড় প্রকল্পের ঠিকাদাররা সচেতন থাকতেন। ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করলে সবাই সতর্ক হতো। কর্তৃপক্ষ পাবলিকের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখত। চট্টগ্রামের ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেই ঢাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অসতর্ক ছিল। ফলে গার্ডার পড়ে আবারও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।’
অ্যাডভোকেট আখতার কবির আরও বলেন, ‘একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিচার নিশ্চিতে তিনটি পক্ষকে সচল থাকতে হয়। পুলিশকে দ্রুত তার কাজটা শেষ করতে হবে। দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিষয়ে আদালতকে জানাতে হবে। তাদের প্রতিবেদনের ওপরই সুষ্ঠু বিচারের বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে।
‘দ্বিতীয়ত, প্রসিকিউশন পক্ষ সাক্ষীদের হাজির করে সাক্ষ্য আদায় করবে, দোষীদের স্বীকারোক্তির ব্যবস্থা করবে। তারা বসে থাকলে মামলা এগোবে না। আর আদালতকে পুরো বিষয়টি তদারকি করতে হবে। এসব হয়নি বলেই মামলাটি এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ঝুলে আছে।’
আরও পড়ুন:সারা দেশে ডিম ও মুরগির দাম চড়ে যাওয়ার নেপথ্যে মাত্র তিন দিনের পরিবহন সংকট। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সরকারি ঘোষণার পর ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা হিসেবে পণ্য পরিবহন খাতে ছিল অঘোষিত ধর্মঘট। ফলে খামার থেকে প্রথম তিন দিন এ দুই পণ্যের সরবরাহ আসেনি।
এতে গোটা দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ে সরবরাহ সংকট। এ সুযোগ কাজে লাগায় মধ্যস্বত্বভোগী আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ও অনৈতিক বাড়তি মুনাফার চেষ্টায় প্রথম দফায় এই মধ্যস্বত্বভোগীরা যার যার আগের মজুত থেকেই দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেন। অন্যদিকে খামারিরা পরিবহন সংকটে সরবরাহ দিতে না পেরে প্রথম দিকে কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়লেও বাজারে দাম বাড়ার ফায়দা পরে তারাও নিতে শুরু করেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে ডিম ও মুরগির সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি খামার গেটে প্রতি পিস ডিমের ক্ষেত্রে ২০-৫০ পয়সা হারে এবং লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা করে বাড়াতে থাকেন খামারিরা। এভাবে খামারিরা দফায় দফায় যে হারে দাম বাড়িয়েছেন, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা স্থানভেদে নিজেদের লাভ বিবেচনায় আনুপাতিক হারে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামেন। ফলাফল বাজারে এখন এসব পণ্যের দাম নামছে না।
এ প্রসঙ্গে ফিড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আহসানুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খামার পর্যায়ে দাম বেড়েছে এটা সত্য। এই বাড়তি দামের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে মধ্যস্বত্বভোগী যারা রয়েছে, তাদের আরও বাড়তি মুনাফার একটা অপচষ্টো তো সব সময়ই থাকে। আগে ৬ টাকায় কিনে ৯ টাকায় বিক্রি করত, এখন ৯-১০ টাকায় কিনে ১৩-১৪ টাকা বিক্রি করছে। তবে এবার দাম বাড়ার এই অপচেষ্টার পেছনে ছিল জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি।’
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার জানান, সারা দেশে ডিম ও মুরগির দাম বৃদ্ধি উসকে দিয়েছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর মাত্র তিন দিনের পরিবহন সংকট।
কারওয়ান বাজারের খুচরা ডিম ব্যবসায়ী বশিররুল্লাহ বলেন, ‘বাজারে কাঁচা সবজি ও মাছ-মাংসের দাম বাড়ায় মানুষ ডিম ও ব্রয়লার বেশি খাচ্ছে। ফলে চাহিদা বাড়ায় দামও বেড়েছে।’
ভোক্তার পকেট কেটে কে কতটা লাভ করছে
খামারে একটি ডিমের উৎপাদনের পেছনে খরচ পড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকা। খামারিরা সেই ডিমে পরিচালন খরচ যোগ করার পর আনুপাতিক হারে মুনাফা নির্ধারণ করে থাকেন। খামারসংশ্লিষ্টদের দাবি, খামার গেটে একটি ডিম এখন ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখানে খামারির ডিমপ্রতি লাভ দুই থেকে আড়াই টাকা।
সেই ডিম খামার গেট থেকে আড়তদার, পাইকার ও খুচরাপর্যায়ে তিন দফা হাতবদলের পর পরিবহন খরচ যোগ হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে স্থানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকা। অর্থাৎ এই মধ্যস্বত্বভোগীরা প্রতিটি ডিম থেকে লাভ করছেন ৪ থেকে ৫ টাকা।
একইভাবে ১৩৫ টাকা আট মাস বিনিয়োগের পর খামারিরা এক কেজি ওজনের একটি ব্রয়লার থেকে লাভ করেন ১৫-২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে খামারিদের বিক্রয় মূল্য ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। হাতবদলের পর ভোক্তাপর্যায়ে সেটি বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকায়। এখানে হাতবদলে দর বৃদ্ধি ৪০-৪৫ টাকা, যা পুরোটাই যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।
বাড়তি দামে খামারিদেরও আছে যৌক্তিকতা
দেশে ছয়-সাত মাস ধরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চলছে। ১৭ টাকার ভুট্টা হয়ে গেছে ৩৬ টাকা, ৩০ টাকার সয়াবিন মিল হয়ে গেছে ৬৫ টাকা। আটার দামও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এগুলো দিয়ে পোল্ট্রি ফিড তৈরি হয়। এর দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচের ওপর।
এ ছাড়া বিদ্যুতে লোডশেডিং হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এতে আগের তুলনায় খরচ দুই থেকে আড়াই টাকা বাড়তি যোগ হয়েছে। এর সঙ্গে ওষুধের দাম বেড়েছে। পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। সব কিছুর দাম বাড়ায় ব্যবসার পরিচালন খরচও বেড়েছে। এর ফলে এক বছর আগে একটি ডিম উৎপাদনে যেখানে খরচ হতো ৬ টাকা, এখন তার খরচ পড়ছে ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকা।
অন্যদিকে এক বছর আগে এক কেজি ওজনের একটি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। এখন সেই একই ওজনের ব্রয়লারের উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা।
দাম বাড়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (বিএবি) সভাপতি ও নাহার এগ্রো কমপ্লেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রকিবুর রহমান (টুটুল) জানান, দাম বৃদ্ধির প্রবণতা যেভাবেই ঘটুক, খামারপর্যায়ে দাম যৌক্তিকভাবেই বাড়ানো হয়েছে। দামের এই বৃদ্ধি না হলে দেশি খামারিরা এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যেত।
পাইকারি ডিম ব্যবসায়ী সাত্তার মিয়া বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিম সংগ্রহ করে ঢাকায় আনা হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গাড়ি ভাড়া বেড়েছে। সেতুর টোল ভাড়া বেড়েছে। সড়কে চাঁদাবাজি বেড়েছে। সব মিলিয়ে পরিবহন ব্যয় বাড়ায় ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।’
চাহিদার তুলনায় আছে ঘাটতি
করোনা-পরবর্তী সময়ে মুরগি ও ডিমের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। ফলে প্যারেন্ট মার্কেট হোল্ডাররা মুরগির বাচ্চা উৎপাদন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক ডিমের খামারও বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া অতিমাত্রার গরম ও সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় কুলাতে না পারায় সারা দেশে এখন ছোট বেশির ভাগ খামার বন্ধ রয়েছে। এসবের প্রভাবে সারা দেশে চাহিদার তুলনায় মুরগি ও ডিমের সরবরাহ আগের চেয়ে ২০ শতাংশের বেশি কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডিমের ভোগ ৭ দশমিক ২ গ্রাম থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ গ্রাম বেড়েছে।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের উৎপাদনের তথ্য বলছে, দেশে প্রতিদিন মুরগি, হাঁস, কবুতর ও কোয়েলের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে খামার পর্যায়ে ডিম উৎপাদন হয় প্রায় চার কোটি পিস।
পোল্ট্রি খাতের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা দাবি করছেন, বিভিন্ন খামার বন্ধ হয়ে পড়ায় এখন সেই উৎপাদন নেমে এসেছে তিন কোটিতে।
১০ টাকায় ডিম খাওয়ার দিন শেষ
ফিড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহসানুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লোকসান দিয়ে কেউ ব্যবসা করবে না। সব কিছুর দামই যেখানে বেড়েছে, সেখানে খামারিরা করোনা-পরবর্তী দীর্ঘদিন লোকসান করছিল। এখন পরিস্থিতির কারণে তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। একটা ক্রাইসিস পিরিয়ডে মধ্যস্বত্বভোগীরাও হয়তো কিছুটা বাড়তি লাভের চেষ্টা করছে। তাই বলে কি লোকেরা কিনছে না? চাহিদা আছে বলেই তো কিনছে, আবার বাড়তি খরচের পাশাপাশি ঘাটতি থাকার কারণেই তো দাম বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘প্যারেন্ট হোল্ডাররা যখন ৫ টাকায় মুরগির বাচ্চা বিক্রি করেন, লোকসান দেন, তখন তো সরকার ২০ টাকা লাভ করে দিতে পারে না। যেটা বাড়ছে, সেটা বাড়তি চাহিদা এবং সরবরাহে ঘাটতি কারণেই। কিন্তু এটাকে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হচ্ছে। সবারই মনে রাখা দরকার, ৮ টাকায় ডিম খাওয়ার দিন আর নেই। ৯০ টাকার ডলার এখন অফিশিয়ালি হয়েছে ১১৪-১১৫ টাকা। ডলারের এই বাড়তি দামের কারণে এ খাতে ফিড আমদানি খরচ সরাসরি ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ডিজেলের কারণে দেড় থেকে দুই টাকা খরচ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে বাড়তি ডেলিভারি খরচ দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে পোল্ট্রি খাতটি একটি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।’
ডিম আমদানির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
খুচরা এক হালি ডিমের দাম এখন ৫৫-৬০ টাকা। স্থানভেদে এখনও প্রতি ডজন ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। যারা মাছ-মাংস ও কাঁচাবাজারের অসহনীয় দামে ভরসা করত এই ডিমের ওপর, তাদের কাছে এখন সেই ডিমও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার ডিম আমদানির পথ উন্মুক্ত করে দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিমের দাম এত বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কিছু ব্যবসায়ী ডিমের বাজারকে অস্থির করে তুলেছেন। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ভারত থেকে ডিম আমদানির বিষয়ে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছে।’
তবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন খামারিরা। এ প্রসঙ্গে ফিড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহসানুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিমের দাম বাড়ছে, সেটি ঠিক হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে মুরগির দাম অনেকটা কমে আসছে। কিন্তু খরচ অনেক বাড়ছে। সেটিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। তাই বলে ডিম আমদানি? এটা কোনোভাবেই দেশীয় শিল্পের জন্য সুখকর হতে পারে না।’
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন, ‘সরকার এখনও সেই সিদ্ধান্ত নেয়নি। শুধু পরিকল্পনায় আছে। আমার বিশ্বাস, বাস্তবে সেটির প্রতিফলন ঘটবে না, দেশীয় শিল্পের স্বার্থেই।’
আরও পড়ুন:ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে এতদিন দুশ্চিন্তায় ছিলেন যাত্রীরা। এবার এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় লঞ্চ মালিক ও শ্রমিকরা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সরকার লঞ্চের ভাড়া যেভাবে বাড়িয়েছে, সেই ভাড়ায় যাত্রী পাওয়া যাবে কি না, এ নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন বরিশালের লঞ্চসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
যে কারণে সরকার যে হারে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, নেয়া হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। আর সেই কম নিয়েও ভালোই মুনাফা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন লঞ্চসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন যারা, তারা প্রশ্ন তুলছেন, যদি নির্ধারিত হারের চেয়ে কম নিয়ে লঞ্চ লাভে থাকতে পারে, তাহলে এত বেশি হারে ভাড়া নির্ধারণ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আসলে কার স্বার্থ দেখেছে?
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এমনিতে যাত্রীসংকটে ভোগা লঞ্চগুলোতে ভাড়া কমিয়ে যাত্রী ফেরানোর চেষ্টা ছিল। এর মধ্যে ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপথে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে ৩০ শতাংশ। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ৩ টাকা।
এই হার সড়কপথে ভাড়া বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। সড়কপথে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৬ শতাংশ আর দূরপাল্লায় ২২ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। আর নগরে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া আড়াই টাকা আর দূরপাল্লায় ২ টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছে।
সড়কের চেয়ে নৌপথে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া কেন বেশি হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। তবে এই হারে যে ভাড়া আসে, তা দেখে বরিশালের যাত্রীরা রীতিমতো আঁতকে উঠেছেন। ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে নৌপথে কেন যাবেন, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
‘সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিলে যাত্রী কমবে, লোকসান হবে’
ঢাকা-বরিশাল রুটে চলা এমভি মানামীর সুপারভাইজার শাহাদাৎ ইসলাম শুভ বলেন, ‘নভেম্বরে তেলের দাম বাড়ানোর পর ডেকের ভাড়া ৩৫২ টাকা করা হয়। সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া সে সময় হয় ১ হাজার ৪০০ টাকা আর ডাবল কেবিনের ২ হাজার ৬০০ টাকা। তখনই যাত্রী কমে গিয়েছিল। এরপর পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রীর ভাটা নামে। যে কারণে ডেকে ২০০ টাকায়, সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ও ডাবল কেবিন ২ হাজার টাকা নেয়া হতো। এতে ধীরে ধীরে যাত্রী বাড়ছিল।
‘তবে ডেকে ৪৫৮ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ৮৩৬ ও ডাবল কেবিন ৩ হাজার ৬৫০ টাকা করেছে সরকার। এই ভাড়ায় যাত্রী নেয়া শুরু করলে আবারও যাত্রী কমতে থাকবে।’
তাহলে আপনারা কত টাকা ভাড়া নিচ্ছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ডেকে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার ৫৮ টাকা কমিয়ে ৪০০ টাকা করে নিচ্ছি। আর কেবিনের ভাড়া সেই আগেরটাই রয়েছে, সিঙ্গেল কেবিনে ১ হাজার আর ডাবল কেবিনে ২ হাজার টাকাই নেয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে যদি সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিতে থাকি তাহলে যাত্রী কমবে এবং লোকসান হবে। তার থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাড়া রাখার চেষ্টা করছি আমরা।’
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে আরও এক লঞ্চ মালিক বলেন, ‘সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, সেটা যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া যাবে না। ভাড়া বাড়িয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা সিন্ডিকেট করে। ঈদে লঞ্চগুলো সরকার নির্ধারিত ভাড়াই রাখবে।’
‘এত ভাড়া কি লঞ্চ মালিকদের ভালোবাইসা?’
লঞ্চ ভাড়া বাড়ার কারণে অনেক যাত্রীকেই বরিশাল নদীবন্দর থেকে ঘুরে যেতে দেখা গেছে। তারা বাসে করে পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় আসবেন বলে জানিয়েছেন।
সাইফুল শাহ নামের এক যাত্রী বলেন, ‘ডেকে এত ভাড়া বেড়েছে তা ভাবিনি। অতি জরুরি কোনো কাজও নেই। তাই লঞ্চঘাট ত্যাগ করছি। কাল ৫০ টাকা কমে বিএমএফ পরিবহনে ঢাকা যাব।’
বরিশাল নদীবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে মঙ্গলবার রাত সোয়া ৯টার দিকে ছেড়ে যায় পারাবত ১১, সুরভী ৯, সুন্দরবন ১০, অ্যাডভেঞ্চার ১ ও মানামী লঞ্চ। সব লঞ্চের ডেক ভরা দেখা গেলেও কেবিন প্রায় সব লঞ্চেই ফাঁকা ছিল।
যাত্রীদের একটি বড় অংশ বলেছে, নতুন ভাড়ার বিষয়ে তারা জানতেন না। জানলে লঞ্চে উঠতেন না। তাদের মতে, এত বেশি ভাড়ায় যাতায়াত করা সম্ভব নয়।
এক যাত্রী বলেন, ‘লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তো জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ৩০০ বা ৩৫০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী নিয়েছে। তারা তো লোকসানে ছিল না। তাহলে এত বেশি ভাড়া কেন সরকার ঠিক করে দিল?’
মানামী লঞ্চে ডেকের যাত্রী শাওন হাওলাদার বলেন, ‘গত সপ্তাহে ঢাকায় মাল আনতে গেছিলাম ২৫০ টাকা ভাড়া দিয়া পারাবাত লঞ্চে। ওই সময় অনেক লঞ্চে ৩০০ টাকা নিতেও দেখছি। এই ভাড়া কিন্তু নেয়া হইত তেলের দাম বাড়াইন্নার পর। এই ভাড়ায় যদি লঞ্চ মালিকগো ক্ষতি না অয়, তাইলে নতুন কইরা ভাড়া বাড়াইয়া কেন সাধারণ মানুষরে ভোগান্তিতে ফেলা হইতেছে? লঞ্চ মালিকদের ভালোবাইসা?’
‘সরকার কাদের পক্ষে বুঝতেছি না’
আবুল হোসেন নামের আরেক যাত্রী বলেন, ‘সরকার কাদের পক্ষে বুঝতেছি না। যেখানে অলরেডি লঞ্চ মালিকরা লাভবান, সেখানে তাদের আরও লাভবান করা হচ্ছে জনগণের পকেট কেটে। যদি লঞ্চ চালাতে লোকসান হতো, তাহলে কি মনে হয় লঞ্চ মালিকরা লঞ্চ চালাত?
‘এক টাকা লস হলেই লঞ্চ বন্ধ করে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেখানে তারা তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর আগে নির্ধারিত ৩৫০ টাকার কম ভাড়ায়ও যাত্রী পরিবহন করেছে। সেখানে নতুন করে ভাড়া বাড়ানোটা সার্কাস মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সরকার রোলার চাপা দিচ্ছে।’
লঞ্চ মালিক সমিতি অবশ্য সরকারকে ৩০ শতাংশ নয়, শতভাগ ভাড়া বাড়ার সুযোগ দিয়েছিল।
সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। ডেকের ভাড়ার থেকে চার গুণ ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে কেবিনে। আশা করছি আমাদের লোকসান কমবে এবারে। তাছাড়া ভাড়া যে পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছিলাম, সেই পরিমাণও বাড়ায়নি। আর পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা কমলেও ধীরে ধীরে এখন বাড়ছে।’
‘সরকারের ভাড়ায় যাত্রী পাব না’
কেবল বরিশাল থেকে ঢাকার পথে নয়, ঢাকা থেকে বরিশালের পথেও একই চিত্র। সদরঘাট যেন খাঁ খাঁ করছে।
বুধবার রাত ৮টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে নদীপথে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে ঘুরে দেখে মেলেনি যাত্রীর সরব আনাগোনা। চাঁদপুর, ভোলাসহ অন্যান্য নৌরুটে যাত্রী থাকলেও অন্য রুটগুলোতে যাত্রী খুবই কম।
রেডসন ৫, এম ভি কুয়াকাটা ১, ২-এর সুপারভাইজার রফিকুল ইসলাম রাজু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাত্রী অনেক কম। সচরাচর এমন কম থাকে না। ইদানীং তো আরও কম।’
এমভি পারাবাত ১৮ লঞ্চের মালিক ও সমিতির মহাসচিব শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই ভাড়া যাত্রীর কাছে চাইলে টিকিটই নিতে চাইবে না। তাই আমরা কম রাখছি।’
সুন্দরবন লঞ্চের মালিক ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের লঞ্চগুলোতে যাত্রী টানতে সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয় আমরা সরকারের নজরে আনছি। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যানজট মুক্ত করাসহ সদরঘাট এলাকায় নিরাপত্তা ও ঘিঞ্জি দূর করতে আমরা ওপর মহলে বারবার বলে আসছি।’
‘তাহলে ভাড়া বাড়ল কেন?’
যাত্রী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন বরিশাল নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আব্দুর রশিদ নিলু বলেন, ‘যদি আগের ভাড়ায় যাত্রী নিতে লঞ্চের সমস্যা না হয়, তাহলে নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর তো কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না।
‘এটাই প্রমাণ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় লঞ্চ মালিকদের কথা মতো ভাড়া বাড়িয়েছে, তারা আসলে কোনো যাচাই-বাছাই করেনি। তাদের উচিত ছিল মাঠপর্যায়ে এসে বিষয়টি দেখা।’
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ‘আগের ভাড়াতেই যখন লোকসান হচ্ছে না, তখন নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর কী দরকার? আসলে সরকারের সঙ্গে লঞ্চ মালিকদের আলোচনার সময় যাত্রীর পক্ষ হয়ে কেউ থাকে না। সেই সময়টাতেই সরকারকে ভুলভাল বুঝিয়ে লঞ্চ মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে নেয়।
‘ঢাকা-বরিশাল রুটের প্রতিটি লঞ্চে যাত্রী ধারণক্ষমতা ৯০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ পর্যন্ত। তবে তারা যাত্রী বহন করে থাকে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি। পাশাপাশি যে পণ্য পরিবহন করা হয়, সেটিও তোলা হয় না ভাড়া বাড়ানোর আলোচনায়।’
বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তার উদ্ভট যুক্তি
যে ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো মুনাফা করছে, তার চেয়ে বেশি ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পথের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, ভাড়া না বাড়ালে লঞ্চগুলো চলতে পারত না।
তার দাবি, লঞ্চে সব সময় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম নেয়া হয়। এবারও তাই হচ্ছে।
তাহলে এত ভাড়া নির্ধারণের দরকার কী- আরও কম বাড়লে পারতেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সরকারের গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত। আপনি যেটা মনে করছেন, ৩০ শতাংশ, সেটা হয়ত কথার কথা। ২৫ শতাংশ বা ২২ শতাংশ বাড়ালে যেটা হতো, সেটা আদায় করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন:দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে সরবরাহ কমিয়ে দেয়া। ফলে বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি। আর ঘাটতির কারণে বেড়ে যাচ্ছে দাম।
ভোজ্যতেলের বাজারে এমন চিত্র বরাবরের। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম বাড়াতে আবারও সেই পুরোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে চলেছেন ব্যবসায়ীরা।
সরকারের কাছে সয়াবিন ও পামওয়েল তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে আমদানি ও উৎপাদক সমিতি। এবার তাদের যুক্তি টাকার বিপরীতে ডলারের উচ্চ মূল্য। দাম বৃদ্ধির এই প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে ট্যারিফ কমিশন। কিন্তু সময় দিতে রাজি নয় কোম্পানিগুলো।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, মিরপুরের শেওড়াপাড়াসহ অলিগলির দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাজারে তেলের সংকট হয়েছে। কোম্পানির প্রতিনিধিরা পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করছেন না।
দোকানিরা বলছেন, টাকা দিলেও তেলের চাহিদা নিচ্ছে না সব কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। ফলে ক্রেতারা চাহিদামতো তেল পাচ্ছে না। কোনো কোনো দোকানে আগে সরবরাহ করা তেল থাকলে তা কিনতে পারছেন কিছু ক্রেতা। তবে চাহিদার তুলনায় তা কম।
বাজার পরিস্থিতি
রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে মদিনা স্টোরের দোকানি আলতাফ হোসেন জানান, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তেলের সরবরাহ নেই। দোকানে সরিষার তেল ছাড়া কোনো সয়াবিন তেল নেই।
তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ কোম্পানির কোনো প্রতিনিধিকে এখন দেখা যায় না। দু-একজনের দেখা পেলেও তাদের বক্তব্য- দাম বাড়বে, তাই তেল সরবরাহ করা হচ্ছে না।’
জামাল নামে আরেক দোকানি বলেন, ‘আগের কেনা সামান্য তেল আছে। তা-ও শেষ হয়ে যাবে। তেল চাইলে দেয়া হচ্ছে না। যেসব কোম্পানি বেশি পরিমাণ তেল সরবরাহ করে, তারাই চাহিদা নিচ্ছে না। ক্রেতারা পাঁচ লিটারের ক্যান চান। অথচ দোকানে এক ও দুই লিটারের মাত্র কয়েক বোতল ভোজ্যতেল আছে।’
মিরপুর ৬০ ফুট রোডের জহির জেনারেল স্টোরের জসিম জানান, ‘দোকানে তেল নেই। কোম্পানির লোকদের পাওয়া যায় না। দুই-একজনকে পেলেও তার সরবরাহের বিপরীতে অগ্রিম টাকা নেয় না। বলে, কোম্পানি থেকে তেল দেয়া হচ্ছে না।
‘বাধ্য হয়ে ক্রেতারা রাইস ব্রান অয়েল, সরিষা ও সানফ্লাওয়ার তেল নিচ্ছে। কিন্তু সাধারণ ক্রেতারা এত দামি তেল কিনতে পারছে না। এ নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডাও হচ্ছে।’
কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, ‘তেলের সরবরাহ থাকলেও আগের মতো না। দুই-একটি কোম্পানি তেল দিলেও কমিশন কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে বোতলের গায়ে লেখা দামের চেয়ে একটু ছাড় দিয়ে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।’
দামবৃদ্ধির প্রস্তাব
বিশ্ববাজারে দাম ক্রমান্বয়ে কমে আসায় দেশে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হয় ১৮ জুলাই। এক মাস না যেতেই নতুন করে আবার দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য পতনের উল্লেখ করে তেলের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে ভোজ্যতেল উৎপাদক সমিতি।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে পাঠানো প্রস্তাবে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮০, বোতলজাত ২০৫ ও পাঁচ লিটার তেলের দাম ৯৬০ টাকা করার কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বোতলজাত সয়াবিন লিটারে ২০ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৪ টাকা ও পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৫০ টাকা দাম বৃদ্ধির কথা বলা হয়।
পর্যালোচনা করছে ট্যারিফ কমিশন
সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, ১৮ জুলাই দাম সমন্বয়ের পর আবার ১৫ দিনের মাথায় দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব হাস্যকর।
‘দাম নির্ধারণ করা হয় এক মাসের জন্য। কিন্তু কোম্পানিগুলো নেই নিয়ম মানছে না। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম দ্রুত কমছে। আবার ডলারের বিপরীতে কমছে টাকার মান। সবদিক পর্যালোচনা শেষে সবশেষ যে মূল্য নির্ধারণ হয় তখনও ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখীই ছিল।’
ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, ডলারের তেজিভাব কমছে। তবে আগের তুলনায় এখনও বেশি। আমদানি পর্যায়ে ডলারের দাম এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম বিবেচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবে ট্যারিফ কমিশন। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ক্রেতার নাভিশ্বাস
প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম চড়া। বাজারে গিয়ে ক্রেতার নাভিশ্বাস উঠেছে। ভোজ্যতেল যেহেতু ক্রেতার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, তাই এই পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে কেনার ক্ষমতা হারাচ্ছে ভোক্তা। পড়ছে বাড়তি চাপ।
ক্রেতারা বলেন, সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি এর আগেও করা হয়েছে। এবারও একই কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ক্রেতাদের স্বার্থ দেখবে কে?
হাতিরপুল বাজারে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতা আলিম উদ্দিন বলেন, ‘বেতন বাড়ছে না। অথচ সবকিছুর দাম বাড়ছে। ভয়াবহ এক সংকট সামনে এসেছে। আগে সংসারে যে পরিমাণ তেল প্রয়োজন হতো, এখন তা প্রায় অর্ধেক কমিয়েও সামাল দেয়া যাচ্ছে না।’
শেওড়াপাড়া বাজারের সানজিদা খাতুন বলেন, ‘তেল পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল দিতে পারছে না। অগত্য দুই লিটার নিতে হলো।’
আলিম স্টোরে তেল কিনতে আসা ক্রেতা আমিনুল জানান, ‘তিনটি দোকান ঘুরে এক দোকানে তেল পাওয়া গেছে। তাও বোতলের গায়ে উল্লেখ থাকা দামের চেয়ে ১০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। তেল কিনতে পকেটের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা
ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তরল পদার্থ পরিমাপের একক হিসেবে লিটার ব্যবহৃত হলেও ভোজ্যতেলের পাইকারি বাজারে মণ ও খুচরা বাজারে কেজিতে বিক্রির প্রবণতা রয়ে গেছে। এতে সাধারণ ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খোলা ভোজ্যতেলের মিলগেট মূল্য অতিমাত্রায় পরিবর্তনশীল হওয়ায় সেকেন্ডারি মার্কেটে মূল্য প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। তাই খোলা ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। খোলা ভোজ্যতেলে সেকেন্ডারি বা পাইকারি বাজারে প্রবেশের পর এই তেলের কোনো ব্রান্ডিং থাকে না।
সরকারের এই প্রতিষ্ঠান মনে করে, খোলা ভোজ্যতেল সরবরাহের ক্ষেত্রে পরিশোধনকারী মিলগুলো সরবরাহ আদেশে দেয়া মেয়াদ ১৫ দিন উল্লেখ করলেও তা ৩ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত ছাড়িয়ে গ্রহণ করা হয়। এতে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের এসও (চাহিদাপত্র) বাজারে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
আরও পড়ুন:বৃহস্পতিবার জন্মাষ্টমীতে সরকারি ছুটির আগের দিন রাজধানীতে চলাচলে দুঃসহ অবস্থা। দুপুরের পর থেকে প্রধান সড়কগুলোতে ঠায় দাঁড়িয়ে যানবাহন। কোনো রুটে আবার গাড়ির অভাবে দীর্ঘ অপেক্ষা যাত্রীদের। এর কারণ, সেই রুট দিয়ে আসতে পারছে না আটকে থাকা গাড়ি।
দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটির আগে এক দিন বাড়তি ছুটির কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়নি। এটি তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি কর্মসূচিকে ঘিরে।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে একযোগে বোমা হামলার স্মরণে আওয়ামী লীগের প্রতি বছরের কর্মসূচির সঙ্গে এবারের কর্মসূচির পার্থক্য আছে। এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় ক্ষমতাসীন দল আরও বেশি কর্মী-সমর্থকদের জড়ো করতে চাইছে। কেবল ঢাকা নয়, দেশের প্রতিটি মহানগর, জেলা শহর, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়নেও একই ধরনের জমায়েতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে লোকসমাগম।
রাজধানীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জমায়েত হয়েছেন রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে। বিকেল ৪টায় জমায়েত হওয়ার কথা থাকলেও আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে আসেন নেতাকর্মীরা। ফলে কার্যত দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন সড়ক অচল হয়ে যায় মিছিলে মিছিলে। আর এর প্রভাবে তৈরি হয় দুঃসহ যানজট।
আওয়ামী লীগের এই কর্মসূচি মূলত ছয় দিন আগে বিএনপির বড় একটি জমায়েতের জবাব। সেদিনও ছিল কর্মদিবস। দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটির আগে সেদিন নয়াপল্টনের সড়কে নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন মিছিল করে। সেদিনও নয়াপল্টন, কাকরাইলসহ আশপাশের এলাকায় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। গভীর রাত পর্যন্ত রয়ে যায় এর রেশ।
জাতীয় নির্বাচনের দেড় বছর আগেই নানা ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। রাজপথে বাড়ছে কর্মসূচি। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মসূচিগুলো পালিত হচ্ছে কর্মদিবসে সড়ক বন্ধ রেখে।
বড় ধরনের কর্মসূচিগুলো ছুটির দিনে করা যায় কি না, এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার দাবি করছেন নগরবাসী।
ক্ষমতাসীন দলের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তাদের আপত্তি নেই। তবে এ জন্য সব দলের ঐকমত্য জরুরি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের জন্য উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন আহমেদ প্রিন্স মনে করেন, সরকার জনগণের দুর্ভোগ বিবেচনা করে না। এখন এসব নিয়মনীতি অলীক কল্পনা।
রাজপথে কর্মসূচি বাড়ছে
গত ৪ আগস্ট নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সড়কে অবস্থান নিয়ে ভোলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ছাত্রদল নেতা নুরে আলমের জানাজা পড়ে বিএনপি। পরে সেখানে হয় সমাবেশ।
দুই দিন পর একই সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল। এই কর্মসূচি পালনেরও কারণও ভোলায় সংঘর্ষে দলের দুই কর্মীর মৃত্যু।
ভোলার সেই ঘটনায় ৮ আগস্ট একই সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদল।
এর তিন দিন পর ১১ আগস্ট সেই সড়কে দুপুরের পর থেকে অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সমাবেশ করে বিএনপি।
একই দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখায় নতুন রাজনৈতিক জোট গণতান্ত্রিক মঞ্চ।
এর পরদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপিপন্থি পেশাজীবী সংগঠনের সমাবেশ হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। সেদিনও যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে কয়েক ঘণ্টা।
১৬ আগস্ট জ্বালানি তেল ও ইউরিয়া সারের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার এবং গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অভিমুখে মিছিল করে গণতান্ত্রিক বাম জোট। সেটি শাহবাগে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। এই কর্মসূচি ঘিরেও কয়েক ঘণ্টা ব্যস্ত এ সড়ক স্থবির হয়ে থাকে।
পরদিন নগরবাসীর দুর্ভোগ হয় আওয়ামী লীগের কর্মসূচির কারণে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বলতে গেলে স্থবির হয়ে থাকে নগরীর একটি বড় অংশ।
আগামী ২২ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী লাগাতার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে সভা, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস
বুধবার আওয়ামী লীগের কর্মসূচির দিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শরীফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজকে সারা ঢাকা সিটির লোককে হাঁটতে হচ্ছে। এই প্রোগ্রামের কারণে বেলা ৩টার দিকে যে অবস্থা এই ভোগান্তি রাত পর্যন্ত থাকবে। প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর আরও ভয়াবহ হয়েছে।
‘আমি শাহবাগ যাওয়ার জন্য বাসে উঠেছিলাম। তবে জ্যাম দেখে বাস থেকে নেমে হেঁটে যাই। অনেকেই বাচ্চা নিয়ে গরমে ঘামতে ঘামতে যাচ্ছে। ঘামে ভিজতেছে, কষ্ট করছে।’
তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা তাসিন মল্লিক বলেন, ‘ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। একটার পর একটা মিছিল যাচ্ছে। সব বাস থমকে দাঁড়িয়ে। মানুষ সব হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘এসব প্রোগ্রাম এমন দিনে হওয়া উচিত, যেদিন ছুটি থাকে অথবা এমন জায়গায় হোক যে জায়গাগুলো উন্মুক্ত।’
রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব আছে বলেও মনে করেন তাসিন। বলেন, ‘নেতাদের মধ্যে এই বোধ আছে কি না, সেটাই আমার প্রশ্ন।’
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ভাবান্তর নেই
তীব্র যানজটের মধ্যে কর্মদিবসে রাজপথে কর্মসূচিতে জনভোগান্তির বিষয়টি নজরে আনলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘ছুটির দিনে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে জনদুর্ভোগ এড়াতে হলে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য প্রয়োজন।’
ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আপনাদের দায়দায়িত্ব তো বেশি- এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কাজ করছে। জনদুর্ভোগের কর্মসূচি আমরা এড়িয়ে চলতে চাই। তবে দিবসভিত্তিক কর্মসূচিগুলো রুটিন ওয়ার্ক।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সভা, সমাবেশ, মিছিল এগুলো সাংবিধানিক অধিকার।’
তবে তার মতে, তাদের কর্মসূচিতে জনগণ খুশি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক রাস্তার ওপরে হওয়ায় কিছুটা ট্র্যাফিক সমস্যা হয়েছে। তবে এতদিন পর বিরোধী দলের বড় সমাবেশের উপস্থিতি দেখে জনগণের ভোগান্তি নয়, তারা খুশি হয়েছে।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি না দেয়াকেও সড়কে কর্মসূচি পালনের একটি কারণ হিসেবে দেখান বিএনপি নেতা। বলেন, ‘নানা রকম স্থাপনা বানিয়ে সেটা অনুপযোগী করে ফেলা হচ্ছে।’
তাহলে সমাধান কী- জানতে চাইলে যেদিন বিএনপির কর্মসূচি থাকে, সেদিন সেসব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বিকল্প রাস্তায় দিয়ে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন ফখরুল।
সেই সঙ্গে সরকারকে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সমাবেশের উপযোগী করে তোলার কথা বলেছেন।
জনগণের ‘অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে’ নতুন যে জোট গঠন হয়েছে, সেই গণতন্ত্র মঞ্চের সবচেয়ে প্রবীণ নেতা আ স ম আবদুর রবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি তার রাজনৈতিক পরামর্শক শহীদুল্লাহ ফরায়জীর মাধ্যমে জবাব পাঠান।
তিনি জানান, আন্দোলন সংগ্রামে, রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল-বিক্ষোভ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। তবে বর্তমান সরকার বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন সংগ্রামকে বল প্রয়োগে স্তব্ধ করে ক্ষমতাকে ধরে রাখার অপকৌশল নিয়েছে।
তিনি বলেন, 'এমন কর্মসূচি সবার জন্য সমান হতে হবে। বিরোধীদের সরকার কোনো সভা সমাবেশ বা জনসভা করার অনুমোদন দেয় না। কদাচিৎ শর্তের বেড়াজালে একদিন আগে অনুমোদন দিলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।
'এই সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় করতে হলে জনগণকে রাজপথই দখল করতে হবে। স্বৈরাচারের সাথে জনগণের দ্বন্দ্ব মীমাংসিত হবে রাজপথেই। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আন্দোলন সংগ্রামের প্রয়োজনে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়।'
তিনি বলেন, 'অতীতে আওয়ামী লীগ ৯৬ ঘণ্টা অবরোধ দিয়েছে, রাজপথ দখল করেছে, ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলেছে, বাসে আগুন দিয়েছে, এখন বিরোধী দলকে জনগণের দুর্ভোগের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে এক ধরনের, আর সরকারে থাকলে আরেক ধরনের আচরণ করে।'
গণ আন্দোলন গণবিস্ফোরণের প্রয়োজনে যা করার প্রয়োজনে তাই করতে হবে, সে জন্য সাময়িক দুর্ভোগ হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
একই প্রশ্নে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স দায় দেন সরকারকে। তিনি বলেন, ‘সরকার যখন নায্য আচরণ করে, তখন দায়িত্বশীল সংগঠনগুলো এগুলো মেনে চলে। তবে সরকার যখন নায্য আচরণ করতে পারে না, তখন এসব নিয়মনীতি মানার প্রশ্ন ওঠে না।’
তিনি বরং রাজপথে কর্মসূচি আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘জনগণকে আমি আহ্বান জানাব, তারা যে দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে অর্থাৎ মানুষের যে সংকট, তা সমাধানে প্রতিবাদী হয়ে উঠুক। যে যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানাবে।’
আরও পড়ুন:কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। টিফিন পিরিয়ডে মাঠে খেলা করছে সহপাঠীরা। কেউ আবার ব্যস্ত দুপুরের খাবার নিয়ে। শুধু সিফাত (প্রতীকী নাম) বসে আছে ক্লাসের এক কোণে। একা!
মঙ্গলবার দুপুরে এক আকস্মিক পরিদর্শনে সিফাতের স্কুলে গিয়ে হাজির হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষ। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নেন তিনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সুবিধা-অসুবিধা আর স্বপ্ন নিয়ে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন।
এ সময়ই ক্লাসের কোনায় বসে থাকা সিফাতকে দেখেন ইউএনও। পরনে স্কুল ড্রেস নেই তার। সবাই যখন সুন্দর স্কুল ড্রেসে পরিপাটি তখন সিফাতের স্কুল ড্রেস না থাকা বেশ ভালো করেই নজরে আসে ইউএনওর।
এ অবস্থায় সিফাতের দিকে এগিয়ে যান শুভাশিস ঘোষ। মিষ্টি কথায় তাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন। আলাপচারিতায় জানতে পারেন, কিছুদিন আগে স্কুল ড্রেস ছিঁড়ে গেছে সিফাতের। ছিঁড়ে যাওয়া স্কুল ড্রেস লজ্জায় আর গায়ে চাপায় না সে। বাবার আর্থিক অসংগতির কারণে নতুন ড্রেসও বানানো হয় না তার। তাই টিফিন পিরিয়ডে সবাই যখন স্বতঃস্ফূর্ত তখন বেমানান ড্রেসে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল সিফাত।
তুমি স্কুলের ড্রেস পরে আসোনি কেন- ইউএনওর এমন প্রশ্নে শুরুতে কিছুটা চুপসে যায় সিফাত। ইতস্তত হয়ে বলে, ‘ড্রেস সেলাই করতে দিয়েছে বাবা।’
কিন্তু সিফাতের ইতস্ততা নজর এড়ায়নি ইউএনও শুভাশিস ঘোষসহ উপস্থিত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের।
এ অবস্থায় সিফাতের পারিবারিক অবস্থা জানার চেষ্টা করেন ইউএনও। তিনি জানতে পারেন, তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট সিফাতের বাবা একজন পিকআপ ভ্যানচালক। এই ভ্যান চালিয়ে যে আয়- তা দিয়েই সংসার আর সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করেন তিনি। তার হাড়ভাঙা পরিশ্রমেই চলছে পাঁচ সন্তানের পড়াশোনা।
এসব কথা শুনে সিফাতকে নিয়ে বিদ্যালয়সংলগ্ন চৌয়ারা বাজারে যান ইউএনও। দর্জির দোকানে গিয়ে তার জন্য নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করেন। কৃতজ্ঞতায় সিফাতের চোখেমুখে তখন রাজ্যের বিস্ময়! বড় মানুষ হওয়ার তাড়না।
এ ঘটনায় বিদ্যালয়ের উচ্ছ্বসিত প্রধান শিক্ষক খোরশেদা আক্তার বলেন, ‘ইউএনও স্যারের এমন মহতী কাজে আমরা খুবই আনন্দিত।’
ইউএনও শুভাশিস ঘোষ বলেন, ‘যেখানে আর্থিক সংকটের দোহাই দিয়ে অনেকেই সন্তানদের পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ করে তাদের শিশুশ্রমে জড়ায়, সেখানে সিফাতের বাবা শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন নিয়মিত। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের বার্তা। আমরা সেই আনন্দের অংশীদার হয়েছি মাত্র।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য