× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য শিল্প ইভেন্ট উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য আফগানিস্তান ১৫ আগস্ট কী-কেন স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও যৌনতা-প্রজনন মানসিক স্বাস্থ্য অন্যান্য উদ্ভাবন প্রবাসী আফ্রিকা ক্রিকেট শারীরিক স্বাস্থ্য আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়া সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ ইউরোপ ব্লকচেইন ভাষান্তর অন্যান্য ফুটবল অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বাংলাদেশ
Even after 2 years of the death of that bus driver Jamirs wife is still in doubt
google_news print-icon

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী

তারেক মাসুদ
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর ও চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসের চালক জামির হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
দুই বছর আগে কারাগারে মারা যাওয়া বাসচালক জামির হোসেনের স্ত্রী রাশিদা বেগমের অবস্থা সংকটাপন্ন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। অন্যদিকে বিচারিক আদালতে জামির দোষী সাব্যস্ত হলেও অধ্যাপক ড. সামছুল হকের একটি অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, বাসচালক ছিলেন ‘নির্দোষ’। এ বিষয়ে তিনি উচ্চ আদালতে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হলেও বিষয়টিতে কোনো অগ্রগতি নেই।

মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার মামলায় বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান বাসচালক জামির হোসেন।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তির আগেই কারাবন্দি অবস্থায় ২০২০ সালের ১ আগস্ট মারা যান জামির। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার সময়ে ঈদের দিন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, পরে রাজধানীর হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

দুর্ঘটনার জন্য জামির হোসেনকে দায়ী করে বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন সাজা দেয়ার পাশাপাশি আরেকটি মামলায় তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাসমালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে বিবাদীদের আপিল শুনানির অপেক্ষায়।

এ ছাড়া মিশুক মুনীরের পরিবারের পক্ষ থেকে করা ক্ষতিপূরণের আরেকটি মামলা হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ওই দুর্ঘটনার ১১ বছর পরও তিনটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি আদালতে। বাসচালক জামিরও মারা গেছেন দুই বছর আগে। তার সাজার বিরুদ্ধে আপিল এবং ক্ষতিপূরণের মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হতে পারে, সে বিষয়ে বাদী-বিবাদী কোনো পক্ষেরই ধারণা নেই।

সারা দেশকে নাড়া দেয়া ২০১১ সালের ওই সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ছাড়াও তাদের মাইক্রোবাসচালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রডাকশন সহকারী মোতাহার হোসেন ওয়াসিম ও জামাল হোসেন মারা যান। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল-মামুনসহ আহত হন পাঁচজন।

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরদের দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাস

দুর্ঘটনার জন্য বিচারিক আদালতে জামির দোষী সাব্যস্ত হলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সামছুল হকের একটি অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, বাসচালক জামির ছিলেন ‘নির্দোষ’।

সরেজমিন অনুসন্ধান, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ড. সামছুল হক বলছেন, সেদিন রাস্তায় সঠিক লেনেই ছিল জামিরের বাস। একটি বাঁকের মুখে তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি আকস্মিকভাবে ভুল লেনে চলে আসার কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা জামিরের বাসটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।

বিচারিক আদালতে ওই দুর্ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়ায় বেশ কিছু ত্রুটি ঘটেছিল বলেও মনে করছেন অধ্যাপক ড. সামছুল হক। এ কারণে হাইকোর্টে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। সাক্ষী হিসেবে তার নাম আদালতে দাখিলও করেছে বিবাদীপক্ষ। তবে এরপর বিষয়টিতে আর কোনো গতি নেই।

বাসচালক জামির হোসেনের স্ত্রী রাশিদা বেগমের অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। সপ্তাহখানেক আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা বলছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। স্বজনদের দাবি, স্বামীর মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।

অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স বাসের মালিক মুজিবুল হক খোকন জানিয়েছেন, মামলার পেছনে ছুটতে ছুটতে তিনি এখন প্রায় সর্বস্বান্ত। নানান শারীরিক জটিলতায় প্রায় দুমাস ধরে তিনি শয্যাশায়ী।

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সামছুল হক

কী আছে ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানে

মর্মান্তিক ওই সড়ক দুর্ঘটনাটি নিয়ে নিউজবাংলার কাছে গত বছর নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন অধ্যাপক সামছুল হক। সে সময় তিনি বলেন, ‘তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যু অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা। ওই দুর্ঘটনার পর পরই আমি এর কারণ গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে শুরু করি। অনুসন্ধানের একদম শুরুতে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন।

‘তারা প্রথম দিনে ঘটনাস্থলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। কিছু ছবি তোলা হয়েছিল উঁচু গাছ থেকে, যেগুলো আমার কাছে ছিল সারকামসটেন্সিয়াল এভিডেন্সের মতো। সেসব ছবি দেখে আমি বুঝেছিলাম, এখানে অনেক কিছু বলার মতো বিষয় লুকিয়ে আছে।’

তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছ থেকে আরও বেশ কিছু কনটেন্ট পেয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি ভিডিও ছিল, যেখানে বাসের উইন্ডশিল্ডের কাছে বসা একজন নারীর কথা ছিল। তার সাবলীল বিবরণ থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেক নতুন কিছু পাওয়ার আছে।’

ড. সামছুল হক নিজেও পরদিন দুর্ঘটনাস্থলে যান। বিভিন্ন আলামত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি কথা বলেন স্থানীয় লোকজন ও তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘একে একে বিভিন্ন বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সাধারণ বিবরণের মধ্যে গোঁজামিলগুলোও ধরা পড়ছিল। তখনও আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি ভালোভাবে দেখতে পারিনি। ওটা একদম চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। মাইক্রোবাসে কে কার পাশে বসেছিলেন, সেটা তখনও আমি জানতাম না।’

তিনি বলেন, ‘অনুসন্ধানের পাশাপাশি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের অপেক্ষা করছিলাম। তিন সদস্যের এ কমিটির সঙ্গে আমার একজন সাবেক ছাত্রও যুক্ত ছিলেন। তিনি আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। একই সঙ্গে আমার কাছে যেসব তথ্য-প্রমাণ ছিল, সেগুলো একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করছিলাম। তবে এর মধ্যে খণ্ড খণ্ড বেশ কিছু মিসিং লিংক ছিল।

‘এর মধ্যেই ডেইলি স্টারে তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। মনীশ ছিলেন মাইক্রোবাসচালকের ঠিক পাশের আসনে; দুর্ঘটনায় তিনিও সামান্য আহত হন। মনীশের বক্তব্য থেকে এমন কিছু বিষয় পাই, যেটি আমার প্রাথমিক অনুসন্ধানকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।’

ড. সামছুল হক বলেন, ‘সাধারণভাবে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষার কথা। হার্ড ব্রেক অ্যাপ্লাই করলে রাস্তায় একটি স্পিড মার্ক পাওয়া যায়। আর সেই স্পিড মার্ক পেলে গাড়ির আসল অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। অথচ আমি রাস্তায় কোনো স্পিড মার্ক পাইনি।

‘আমরা যারা দুর্ঘটনা বিষয়ে কাজ করি, তাদের কাছে বিষয়টি গোলমেলে। আমি তখন ভাবার চেষ্টা করছিলাম, বৃষ্টির কারণেই রাস্তায় হয়তো স্পিড মার্ক নেই। তবে সেটা মিলছিল না। স্পিড মার্ক এমন একটি বিষয় যার কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবেই। কারণ এ সময় চাকার প্রচণ্ড ঘর্ষণে রাস্তার পাথরকুচি উঠে যায়।’

তিনি বলেন, ‘তাহলে কেন এ ধরনের চিহ্ন নেই- সেটি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। অবশেষে সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল মনীশ রফিকের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছিলেন, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মাইক্রোবাসের পেছন দিকে যাত্রীরা মুখোমুখি বসে তুমুল আড্ডায় মেতেছিলেন। তার কথার প্রতিটি বিষয় আমার সামনে একেকটি চিত্র তৈরি করছিল। মাইক্রোবাসে মুখোমুখি কী করে বসা যায়! তার মানে সেটির আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। মনীশ আরও বলেন, হঠাৎ একটি বাস দৈত্যের মতো তাদের মাইক্রোবাসে আঘাত করে।’

এই ‘হঠাৎ’ শব্দটি অনেক প্রশ্নের জবাব পাইয়ে দেয় ড. সামছুল হককে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ হলেই তো গাড়ির স্পিড মার্ক পাওয়া যায় না! কিছু দূর আগে থেকে দেখতে পেলেও হার্ড ব্রেক কষা সম্ভব, কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয়েছিল যে কারণে বাসটিকে তারা হঠাৎ দেখতে পেলেন!’

এরপর আবার দুর্ঘটনাস্থলে যান ড. সামছুল হক। এ সময় স্থানীয় একজনের বক্তব্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য ছাপা হয়।

এসব থেকে পরিষ্কার হয়, দুর্ঘটনার ঠিক কিছু আগে একটি বড় বাস রাস্তার বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিকশাকে ওভারটেক করে। ওই বাসটির পিছু পিছু একই দিকে যাচ্ছিল তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাস। ওই বাসটির পিছু নিয়ে তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটি অটোরিকশাকে একইভাবে ওভারটেক করতে বাঁকের মুখে নিজের ডান লেনে চলে গিয়েছিল। এ সময়েই বাঁকের বিপরীত দিক থেকে আসা জামির হোসেনের বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসটির সংঘর্ষ হয়।

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
ড. সামছুল হকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থান

ড. সামছুল হক বলেন, ‘অটোরিকশাকে ওভারটেক করা বাসটির চালক কিন্তু বাঁকের অন্য প্রান্তে বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটিকে দেখতে পেয়েছিলেন। এর পরও তিনি ক্যালকুলেটেড (হিসাব করা) ঝুঁকি নিয়ে অটোরিকশাকে ওভারটেক করে আবার নির্ধারিত বাম লেনে বাসটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। মহাসড়কে চলাচলকারী বাস-ট্রাক সাধারণত এ ধরনের হিসাবি ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত।

‘তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটিও সামনের বাসটিকে অনুসরণ করে ডান লেনে চলে যায়। তবে একজন শহুরে চালকের জন্য কাজটি ছিল মারাত্মক ভুল। সামনের বাসের মতো তিনি আর মাইক্রোবাসকে আবার বাম লেনে নিতে পারেননি। আর এই ভুলের কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটির সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়।’

বিপরীত দিকের বাসের চালক জামির বাঁকের মুখে নিজের সঠিক বাম লেনেই ছিলেন বলে মনে করছেন ড. সামছুল হক।

তিনি বলেন, ‘উল্টো দিকে আকস্মিকভাবে ভুল লেনে চলে আসা মাইক্রোবাসের বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসচালক জামির হোসেনের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কারণ বাঁকের উল্টো দিক থেকে তিনি মাইক্রোবাসটিকে দেখতেই পাননি। আর এ জন্যই সেই হঠাৎ দুর্ঘটনা, যেখানে বাসচালক ব্রেক কষারও সময় পাননি।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
মাইক্রোবাসের সঙ্গে যেভাবে বাসের সংঘর্ষ

দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রাস্তায় এর বাম দিকের লেনে পাওয়া যায়। ফলে মামলার রায়ে বিচারিক আদালতের বিচারক বিষয়টির উল্লেখ করে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে মাইক্রোবাসটি তার সঠিক লেনেই ছিল।’

তবে ড. সামছুল হক বলেন, এখানে বোঝার ভুল আছে। বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ড. সামছুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, “সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটির টার্মিনাল পজিশনের বেশ কিছু ছবি পেয়েছিলাম। একটি দুর্ঘটনাকে বিশ্লেষণের জন্য ‘টার্মিনাল পজিশন’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা হলো দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটির চূড়ান্ত অবস্থান।”

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
মাইক্রোবাসে যাত্রীদের অবস্থান এবং যেভাবে আঘাত

তিনি বলেন, “এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কোনো মাইক্রোবাস যদি তার ‘সঠিক’ লেনে থাকে (যদিও সে অবস্থানটিও ছিল রাস্তার মাঝ বরাবর), তাহলে ধরে নিতে হবে দুর্ঘটনার আগের চিত্র ছিল অন্যরকম। কারণ একটি বাসের যে ভর ও গতি, তাতে সংঘর্ষের পর মূল অবস্থান থেকে মাইক্রোবাসটির বেশ কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার কথা। মাইক্রোবাসের জীবিত আরোহীদের বক্তব্যেও সেটি জানা গেছে। ফলে দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে রাস্তার মাঝ বরাবর পাওয়ার অর্থ হলো, প্রকৃতপক্ষে সেটি রং সাইডে ছিল। ধাক্কা খাওয়ার পর এর টার্মিনাল পজিশনটি পাওয়া গিয়েছিল মধ্যরাস্তায়।

“আর দুর্ঘটনার আগে মাইক্রোবাসটি সত্যিই নিজের বাম লেনে থাকলে ধাক্কা খাওয়ার পর সেটির রাস্তার কিনারায় বা রাস্তার পাশে চলে যাওয়ার কথা ছিল। এটাই হলো বিজ্ঞান। অথচ বিচারপ্রক্রিয়ায় এই বিজ্ঞানকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।”

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাস ও বাসটির অবস্থান

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসের অবস্থা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেছে, বাসের সঙ্গে এর আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। ডিভাইডারবিহীন একটি সড়কে এ ধরনের আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হলে দুটি যানের যেকোনো একটিকে রং সাইডে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থান এবং সংঘর্ষে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, মাইক্রোবাসটিই ওভারটেক করতে গিয়ে রং সাইডে ছিল। দুর্ঘটনার পর সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি ও মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তবে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটির ‘টার্মিনাল পজিশন’ ছিল রাস্তার মাঝখানের লাইন ঘেঁষে

দুর্ঘটনার জন্য সে সময় রাস্তার ‘অবৈজ্ঞানিক’ বাঁককেও দায়ী করছেন ড. সামছুল হক।

তিনি বলেন, ‘১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল। তবে বাস্তবে তা ছিল না। একই সঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম।

‘ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাকস্পট ছিল, এই বাঁকটি তার একটি। মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতি বছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল। এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর দুর্ঘটনা হচ্ছে না।’

ড. সামছুল হকের অনুসন্ধান যেভাবে ‘অন্ধকারে’

দুর্ঘটনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর পর সেটি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের কাছে তুলে ধরেন অধ্যাপক ড. সামছুল হক, তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে সবার অনীহা ছিল বলে অভিযোগ তার।

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পরিস্থিতি পুনর্নির্মাণের পর আমি প্রেজেন্টেশনটি কিছু সাংবাদিককে দিয়েছিলাম। তবে সেটি কোথাও প্রকাশ করা হয়নি।

‘বাসচালক জামির হোসেনের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জের আদালতে মামলার বিচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে একদিন ব্র্যাকে একটি সেমিনারে আমি অনুসন্ধানটি সবার সামনে উপস্থাপন করলাম। সেখানে ক্যাথরিন মাসুদের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেনও ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে সারা হোসেন বললেন, আমি যে বিষয়টি বের করেছি সেটির সঙ্গে তাদের ভিন্ন মত নেই, তবে তাদের ফাইন্ডিংস আলাদা। আমি তখন তাকে (সারা হোসেন) বললাম, আপনি আপনার জায়গা থেকে কখনই বাসচালকের বাইরে যেতে পারবেন না, কিন্তু আমার বিশ্লেষণের পরিসর আরও বিস্তৃত।’

ড. সামছুল হক বলেন, ‘এরপর সারা হোসেনের টিম আমার কাছে এসেছিল, আমাকে সাক্ষ্য দিতে মানিকগঞ্জের আদালতে যেতে বলা হয়েছিল। তবে আমি তখন বলেছিলাম, একজন শিক্ষক হিসেবে দিনের পর দিন আমার পক্ষে মানিকগঞ্জে গিয়ে সাক্ষ্য দেয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমি তখন ভেবেছিলাম, আদালত নিশ্চয়ই দুর্ঘটনার সব দিক চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করেই রায় দেবে।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ

২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রায়ে জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। রায়ের পর জামিরকে প্রথমে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগার ও পরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

এ ঘটনায় চমকে যান ড. সামছুল হক। সিদ্ধান্ত নেন, উচ্চ আদালতে তিনি অনুসন্ধানের বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। এ জন্য যোগাযোগ শুরু করেন বিভিন্ন মহলে।

তিনি বলেন, ‘একটি সড়ক দুর্ঘটনার বিচার ও সাধারণ বিচারের মধ্যে যে মাত্রাগত পার্থক্য থাকা প্রয়োজন, সেটি রায়ে দেখতে পাইনি। মনের মধ্যে ছটফট অবস্থা তৈরি হলো। পুরো বিষয়টি আবার নতুন করে কীভাবে সবার সামনে আনা যায়, সেই চেষ্টা শুরু করলাম। মিডিয়া শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে রক্ষণশীলতা দেখাচ্ছিল, ফলে সেখানকার অনেকেই গুরুত্ব দিতে চাইলেন না। কেউ কেউ এমনও বললেন, আমি বাসচালকের পক্ষে কাজ করছি।

‘তবে আমি বারবারই বলেছি, এখানে বিজ্ঞান কথা বলছে, আমি নিজে কিছু বলছি না। এটা কার পক্ষে যাচ্ছে বা বিপক্ষে যাচ্ছে, সেটা কোনো বিষয় নয়।’

ড. সামছুল হক জানান, একপর্যায়ে ২০২০ সালের শুরুতে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান।

তিনি বলেন, ‘আমার শুধু মনে হচ্ছিল, একটি অন্যায় হয়ে যাচ্ছে। সেটা জেনেও চুপ করে থাকা আরও ঘোরতর অন্যায় হবে। এ কারণে আমি নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করেছিলাম।’

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সামনে দেড় ঘণ্টার একটি প্রেজেন্টেশন দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভূমিকা দেয়ার পর তাকে চারটি বা পাঁচটি দিক থেকে ভুল দেখাচ্ছিলাম। মন্ত্রীকে দেখিয়েছিলাম, জামিরের বাস বেপরোয়া গতিতে চলছিল বলা হলেও বাস্তবে এর গতি ছিল নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যেই। আইনমন্ত্রী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়ার সমস্যাটি ধরে ফেললেন। উনি বললেন, সড়ক দুর্ঘটনার মতো বিষয়গুলোকে সাধারণ মামলার মতো করে বিচার করা তো মোটেই ঠিক হচ্ছে না।

‘আমি উচ্চ আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তবে তখনই জানলাম, কোনো মামলা উচ্চ আদালতে যাওয়ার পর নতুন করে সাক্ষী যুক্ত করা যায় না। এটা করতে হলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পড়ে।’

এরপর বিবাদীপক্ষ হাইকোর্টে ড. সামছুল হককে সাক্ষী হিসেবে পক্ষভুক্ত করার আবেদন করে। তবে করোনা মহামারির কারণে সেই আবেদনের শুনানি তখন হয়নি। এখনও সেটি সেখানেই আটকে আছে। এরই মধ্যে ২০২০ সালের ১ আগস্ট কারাগারে মারা যান বাসচালক জামির হোসেন।

ড. সামছুল হক বলেন, ‘বৈশিষ্ট্যগত নানান কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা আর সব ঘটনা থেকে আলাদা। একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারে যেমন শুধু সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রায় দেয়া হয়, সেখানে সড়ক দুর্ঘটনার বিচারে সাক্ষীর বাইরেও পারিপার্শ্বিক আরও অনেক কিছু বিবেচনায় নেয়া দরকার।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
বাসচালক জামির হোসেন

তিনি বলেন, “জামিরের মামলায় আদালত ‘সর্বোৎকৃষ্ট সাক্ষী’ হিসেবে যাদের বিবেচনা করেছে, তারা সবাই মাইক্রোবাসের আরোহী৷ দুর্ঘটনার সময় তারা হয় উল্টো দিকে ঘুরে আড্ডা দিচ্ছিলেন, নয়তো ছিলেন একদম পেছনের সিটে। অথচ যিনি মাইক্রোবাসচালকের একদম পাশের সিটে ছিলেন, সেই মনীশ রফিকের সাক্ষ্য নেয়া হয়নি। কোনো বাসযাত্রী বা স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যও গুরুত্ব পায়নি।”

জামিরকে যাবজ্জীবনের রায়ে যা বলেছিলেন বিচারক

বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনকে হত্যার দায়ে বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজ আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর রায় ঘোষণার পর পরই কারাগারে পাঠানো হয় জামিরকে।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কয়েক দিন পরই জামির হোসেন মেহেরপুর গাংনীর চৌগাছা থেকে গ্রেপ্তার হন। তবে কয়েক মাস পরই জামিনে মুক্তি পান তিনি। এরপর ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়ার দিন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন।

রায় ঘোষণা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিচারক দণ্ড ঘোষণার সময় আদালতের কাঠগড়ায় ‘নির্লিপ্ত’ দেখা যাচ্ছিল জামিরকে। রায়ের পর পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে পাঠায়।

বিচারক আদেশে বলেন, ‘জামির হোসেনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৪২৭ ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাকে ৩০৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। আর দণ্ডবিধির ৪২৭ ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর কারাগারে নেয়ার পথে জামির হোসেন

আসামির উভয় দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলেও আদেশ দেন বিচারক।

বিচার চলার সময় ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। এর মধ্যে ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা। আসামির পক্ষে দুজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।

বিচারক রায়ে বলেন, ‘এজাহার, অভিযোগপত্র, খসড়া মানচিত্র, বিআরটিএর চিঠি, জব্দ করা ভুয়া ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর অভিন্ন ও অকাট্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আসামি বাসটিকে বৃষ্টি ও বাঁকের মধ্যে অবহেলার সঙ্গে বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে একটি মিনিবাসকে ওভারটেক করে মাইক্রোবাসটিকে নির্মমভাবে আঘাত করেন। ফলে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচটি তরতাজা প্রাণ ঝরে যায়। আসামির বেপরোয়া আচরণ ও অবহেলার কারণেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়।’

আসামির পক্ষে আদালতে সাফাই সাক্ষ্য দেন চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটির যাত্রী শাহনেওয়াজ রয়েল ও অধ্যাপক নাসরিন আশরাফী।

তবে বিচারক রায়ে বলেন, ‘তাদের কেউই ওই বাসের যাত্রী হওয়ার প্রমাণ হিসেবে বাসের টিকিট আনেননি। এ দুজন সারা জীবনে এবং ঘটনার পর থেকে অসংখ্যবার বাসে ওঠার কথা। একটি নির্দিষ্ট দিনে কোন বাসে উঠেছিলেন তা মনে রাখা দুঃসাধ্য। তারা যদি ঘটনার পর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিতেন, তাহলে অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য হতো।

‘এ ছাড়া শাহনেওয়াজ সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন, দুর্ঘটনাস্থলে কোনো বাঁক নেই। আর তিনি ছিলেন বাসের বাঁ দিকে চার আসন পেছনে। ফলে ডান দিকের বিষয় দেখা সম্ভবপর নয়। আর নাসরিন আশরাফীও বলেছেন, সেখানে বাঁক ছিল না। তার চশমার পাওয়ার ৩.৫০। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির একজন বয়স্ক মহিলার পক্ষে দীর্ঘদিনের আগের বৃষ্টির মধ্যে সংঘটিত কোনো ঘটনার সঠিক বিবরণ দেয়া আদৌ সম্ভবপর নয়।’

মাইক্রোবাসের বেঁচে যাওয়া আরোহীরা যা বলছেন

ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন।

গত বছর তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাইক্রোবাসটি ছিল তারেকের, যেটা শুটিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হতো। সেদিন আমরা ঢাকায় ফিরছিলাম। চালকের পরের সিটটা ব্যাক টু ব্যাক করা ছিল। তার পরের সিটটা যেভাবে থাকে, সেভাবেই ছিল। আমরা পাঁচজন সামনাসামনি বসেছিলাম।

‘তারেক আর ক্যাথরিন চালকের পেছনে ছিল। আর উল্টো দিকে মিশুক আমার ডান পাশে ছিল; বাঁ পাশে ছিল আমার স্ত্রী। সামনে দুই জন ছিল। তার মধ্যে একজন ছিল তারেকের সহকারী পরিচালক। আমরা মোট ১০ জন ছিলাম।’

দুর্ঘটনার সময়ের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, সে কারণে আমাদের গাড়ির গতি ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটারের বেশি ছিল না। আমরা তখন একটি খাবার দোকান খুঁজছিলাম। সে কারণে গাড়ি স্লো ছিল। আমাদের গাড়ি কখনোই রাস্তার সাদা লাইন ক্রস করেনি।

‘দুর্ঘটনায় গাড়িতে ডান পাশে বসা পাঁচজন স্পট ডেট হয়। আর বাকিরা আহত হই। তার মধ্যে আমার অবস্থা সব থেকে খারাপ ছিল। পরে আমাকে ব্যাংকক নিয়ে যেতে হয়েছিল।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর

অন্যদিকে মাইক্রোবাসে থাকা প্রডাকশন কন্ট্রোলার সাইদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা লোকেশন দেখে ফিরছিলাম। মোটামুটি একটা লেভেলে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি গাড়ির একেবারে পেছনের সিটে হাতের বাম পাশে ছিলাম। সামনের সিটগুলা ঘোরানো ছিল। চালকের পাশে বসা ছিলেন মনীশ রফিক। উনি কিছুই দেখেননি, কিছুই বলতে পারেননি। তার কারণ উনি পেছনের দিকে তাকানো ছিলেন।’

সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যেখানে বসা ছিলাম সেখান থেকে একদম পরিষ্কার সামনে দেখা যাচ্ছিল। তারেক ভাই এবং ক্যাথরিন আপার মাঝখান দিয়ে একটা ফাঁকা ছিল। সেখান দিয়ে সামনে দেখা যাচ্ছিল। সে সময় তারেক ভাই কথা বলছিলেন। আমি দেখলাম, আমাদের সামনে একটা ছোট পিকআপের মতো আছে। দেখলাম একটা ছোট মিনিবাস আমাদের অপর দিক থেকে আসছে। আমরাও ওই পিকআপটার পেছনে আছি। এ সময় পেছন থেকে একটা বড় বাস আমাদের কাছাকাছি এসেছে।

‘আমাদের গাড়ি তখন বাম পাশে যে সাদা দাগ থাকে তার মধ্যেই ছিল। যখন আমাদের গাড়িটি কার্ব হয়ে ঢুকছিল, তখন উল্টো দিক থেকে একটা বাস এসে সজোরে ধাক্কা দেয়। তখন আমি দুই সিটের মাঝখানে যে জায়গা থাকে সেখানে পড়ে যাই। এরপর আমার আর কিছু মনে নাই। পরে আমাকে যারা তুলেছে তারা বলেছেন, আমার ওপর তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর পড়েছিলেন। ক্যাথরিন আপা আমাকে নাকি টেনে বের করে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।’

ঝুলে আছে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি

আলোচিত ওই দুর্ঘটনার পর ঘিওর থানার তখনকার উপপরিদর্শক লুৎফর রহমান একটি মামলা করেন। অন্যদিকে ঘটনার দুই বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অর্ডিন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাসমালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা করেন।

পরে সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনস্বার্থে হাইকোর্টে বদলির নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করলে ক্ষতিপূরণের মামলা দুটি হাইকোর্টে চলে আসে।

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাখা সেই মাইক্রোবাসটির সামনে ক্যাথরিন মাসুদ

দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাসমালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে নির্দেশ দেয় বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ের কপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়।

ক্ষতিপূরণের অর্থের মধ্যে বাসের (চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স) তিন মালিকের ৪ কোটি ৩০ লাখ ৮৫ হাজার ৪৫২ টাকা, বাসচালক জামির হোসেনের ৩০ লাখ টাকা এবং রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ৮০ হাজার টাকা দেয়ার কথা। এ টাকা ক্যাথরিন মাসুদ, তারেক মাসুদের ছেলে নিষাদ মাসুদ ও বৃদ্ধা মা নুরুন নাহার পাবেন বলে রায়ে বলা হয়।

হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে বাস মালিকপক্ষ, সেটি এখন আপিলে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। অন্যদিকে মিশুক মুনীরের পরিবারের ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলাটি হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

ক্ষতিপূরণের মামলার শুনানির বিষয়ে তারেক মাসুদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে প্রশ্ন করা হলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগে যে আপিলটা পেন্ডিং আছে, সেটি যাতে শুনানি হয় সে বিষয়ে আমরা অবশ্যই উদ্যোগ নেব। এত বছর হয়ে গেছে আমরা শেষ করতে পারছি না। এ মামলাটি শুধু তারেক মাসুদের পরিবারের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
তারেক মাসুদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন

তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে দুটো বিষয়- একটি হলো ক্ষতিপূরণের, আরেকটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দায়িত্বটা আসলে কী সেটি। এ প্রশ্নগুলো কিন্তু আদালতের সামনে উত্থাপিত হয়েছে। এখন আদালতের রায়ের মাধ্যমে যদি এ প্রশ্নের সুরাহা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য একটা বড় উপকার হবে। তার কারণ হলো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দায়দায়িত্ব নিলে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আমরা দেখতে পারব।’

সারা হোসেন জানান, তারেক মাসুদের মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারের অপেক্ষায় আছে। আর মিশুক মুনীরের মামলাটি হাইকোর্টে তালিকাভুক্ত ছিল ঈদের আগে।

তিনি বলেন, ‘সেখানে প্রক্রিয়াগত একটা সমস্যা হয়েছে যে, বাসের চালক মারা গেছেন। এখন তার উত্তরসূরিদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেটা নিয়ে এখন কাজ চলছে। এটা হয়ে গেলে হাইকোর্টে এ মামলাটির শুনানি হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের পক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাস মালিক খুবই অসুস্থ। মৃত্যুপথযাত্রী। এ মামলায় এখন আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।’

জামিরের স্ত্রী জীবন সংকটে, বাসমালিক অসুস্থ

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বাসচালক জামির হোসেন মারা যান ২০২০ সালের ১ আগস্ট। পরিবার এখন কেমন আছে জানতে রোববার তার স্ত্রী রাশিদা বেগমের নম্বরে ফোন করা হলে সেটি ধরেন সুমি নামে এক নারী।

সুমি নিজেকে বাড়ির ভাড়াটিয়া পরিচয় দিয়ে জানান, রশিদা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার দেখাশোনা করতে মেয়ে আরিফা খানম জ্যোতি ও জামাই ইব্রাহিম হোসেনও হাসপাতালে আছেন।

এরপর ইব্রাহিম হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে আমার শাশুড়ি স্ট্রোক করেছেন। এখন তিনি কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার অবস্থা ভালো না। বলা যায় তিনি এখন মৃত্যুশয্যায়।’

জামির হোসেনের মৃত্যুর পর থেকেই তার স্ত্রী বিভিন্ন অসুস্থতার মধ্যে ছিলেন বলে জানান ইব্রাহিম।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে সোমবার সকাল ৯টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ৩ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন রাশিদা। পাশে উদ্বিগ্ন তার একমাত্র মেয়ে জ্যোতি।

জ্যোতি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক দুর্ঘটনায় আমার পুরো পরিবার শেষ হয়ে গেল। বাবা জেলে মারা গেলেন, আর মায়ের এই অবস্থা। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থা খারাপ হলে মাকে গত ২৭ তারিখে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। ডাক্তার বলেছেন, ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। আরও কিছু সমস্যা আছে।

‘মাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছি। আমরা খুব খারাপ পরিস্থিতিতে আছি। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’

রাশিদার চিকিৎসা চলছে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আক্রামুজ্জামান মিন্টুর তত্ত্বাবধানে।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রোগীর ব্রেইনে ছোট্ট একটি স্ট্রোক করেছে। তার শরীরে লবণের ঘাটতি ছিল। রক্তে ইনফেকশন আছে। সব মিলিয়ে তিনি ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতিতে আছেন। আমরা বেডে রেখে তাকে অবজার্ভ করছি। লবণ কারেকশন করা হচ্ছে।

‘রক্তে ইনফেকশনের জন্য উচ্চ ক্ষমতার অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছি। আর জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করছি। বেড ফাঁকা হলে আমরা তাকে হাই ডিপেডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) নিয়ে যাব। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন রাশিদা বেগম

রাশিদার সঙ্গে গত বছরের আগস্টে কথা বলেছিল নিউজবাংলা। সে সময় তিনি জানান, মানিকগঞ্জের দুর্ঘটনাটি ছাড়া জামির হোসেন আর কখনও বড় কোনো দুর্ঘটনার মুখে পড়েননি। ওই দুর্ঘটনার পর তাকে মেহেরপুরের গাংনীর চৌগাছা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন তিনি তিন মাস জেলে ছিলেন। সে সময় বারবার বলতেন, তার কিছুই হবে না, কারণ তিনি নির্দোষ।

রাশিদা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের খুব কষ্টের সংসার। কোনো জমিজমা নেই। খুব কষ্টে মামলার খরচ চালাতাম। তার ডায়াবেটিস ছিল, তেমন কিছু খেতে পারতেন না।’

আবেগাপ্লুত রাশিদা বলেন, ‘জেলে যাওয়ার পর চিন্তায় চিন্তায় আমার স্বামীর জীবনটা চলে গেল। সেই থেকে আমাদের বাড়ি থেকে আনন্দ চলে গেছে। কেউ আর হাসে না। যে যাবার সে চলে গেছে। এখন এসব বলে বা নিউজ করে কী হবে? তখন তো কেউ আসেনি।’

মানিকগঞ্জে দুর্ঘটনার পর স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন জামির হোসেন।

সেই সময়ের কথা জানিয়ে রাশিদা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিনি কাঁপতে কাঁপতে বলেন, আমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি অনেকবার হর্ন দিছি। গাড়ি রাস্তার পাশের খাদের দিকে নিয়ে গেছি।

‘আমার গাড়িতে অনেক যাত্রী ছিল। মাইক্রোবাসটি ভুল পথে এসে দ্রুত আমার গাড়িতে ধাক্কা মেরে দিল। আমার গাড়ি রাস্তার ঠিক দিকেই ছিল। মনে হচ্ছে খুব দামি মানুষ এরা। আমি পরে কথা বলব।’

রাশিদা জানান, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পর মুষড়ে পড়েন জামির। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সুষ্ঠু বিচার পাইনি। আমি অপরাধী না হয়েও অপরাধী হলাম।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
নিজ বাড়ির সামনে জামির হোসেন

জামির হোসেনের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দৌলতদিয়া স্কুলপাড়া এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, দরিদ্র জীবনযাপন করতেন জামির। বসতভিটা ছাড়া কোনো জমিজমা নেই। ২০০৮ সালে মেয়ে আরিফা খানমকে বিয়ে দেন কলেজশিক্ষক ইব্রাহিমের সঙ্গে। জামিরের মৃত্যুর পর জামাতার বাড়িতেই ছিলেন রাশিদা বেগম।

অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের মালিক মুজিবুল হক খোকনও অসুস্থতার কারণে দুই মাস ধরে প্রায় শয্যাশায়ী। তিনি জানান, মামলার পেছনে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছুটতে ছুটতে এখন বলতে গেলে নিঃস্ব।

ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে খোকন নিউজবাংলাকে বলেন, ’মাঝে দুইবার তারিখ পড়েছিল। কিন্তু হাইকোর্ট থেকে আমার বাসের চালক জামিরের মৃত্যুর নথি তলব করেছে। সেই নথি এখনও আদালতে পৌঁছায়নি। ওই নথি এলে পরবর্তী কী হবে সেটা আমার আইনজীবী বলতে পারবেন।’

আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অসুস্থতার কারণে আমি যোগাযোগ করতে পারিনি। তবে আমার পক্ষ থেকে একজন যোগাযোগ করেছেন। এই মামলা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেটাই আমার চাওয়া। আর কতদিন এটা এভাবে ঝুলে থাকবে।’

তারেক মাসুদের পক্ষে ক্ষতিপূরণের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদনের বিষয়েও শুনানির কোনো তারিখ পড়েনি বলে জানান তিনি।

খোকন বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা হলো মামলাগুলো দ্রুত শুনানি শেষ হয়ে যেন চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে। এটা তো আমাদের জন্য একটা বড় ব্যথার কারণ হয়ে আছে। আল্লাহই জানেন এটা থেকে কবে পরিত্রাণ পাব!’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার জান্নাতুল মাওলা কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে জামির হোসেনকে

মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার আশা ছাড়েননি ড. সামছুল হক

আলোচিত মামলাটির এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে ড. সামছুল হক। তিনি চাইছেন, দুর্ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানতে উচ্চ আদালতে তার ডাক পড়বে।

ড. সামছুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক আগে বাসচালক জামির হোসেনের পক্ষ থেকে একবার আমার এনআইডি ও নামটাম নিয়েছিল। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নাই। এটাও অনেক আগে।’

সড়ক দুর্ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক প্রমাণকে প্রধান সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে প্রয়োজনে বিশেষ আইন করার দাবি তুলে তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় হওয়া মামলার বিচারের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সাক্ষ্য হিসেবে নেয়া উচিত, বিশেষ করে যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনায় সাক্ষী থাকে না।

‘এর কারণ চলন্ত অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটে। যাত্রীরা যে যেখানকার সেখানে চলে যান। ফলে এসব মামলায় সাক্ষী পাওয়া দুরূহ হয়। এমনকি মামলার বিচারেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না। এ কারণে ঘটনায় দোষ কার, সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে পারলে দোষী শনাক্ত সহজ হবে।’

সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
দুর্ঘটনার পর প্রশস্ত করা হয়েছে রাস্তার বাঁক, বসানো হয়েছে ডিভাইডার

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রতিটি দেশে এ ধরনের বিশেষ আইন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও একটি হত্যা মামলার মতোই যেমন কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, চালক ব্রেক কষেছিল কি না, কত দূর থেকে কষেছিল, কে রং সাইডে ছিল, গাড়িটির শেষ অবস্থান কী- ইত্যাদি বিষয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে হয়।

‘এটা তদন্ত কর্মকর্তা বা বাইরে থেকে কাউকে সাক্ষী বানিয়ে প্রমাণ করা যায় না। সব কিছু মিলিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের জন্য একটা বিশেষ আইন করা হলে হয়তো সঠিকভাবে নিরূপণ করা সহজ হবে।’

এ মামলায় অধ্যাপক সামছুল হক পক্ষভুক্ত হয়ে সাক্ষ্য দেয়ার আগ্রহের বিষয়ে গত বছর আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রশ্ন করেছিল নিউজবাংলা। বিষয়টি তোলার পর মন্ত্রী বলেন, ‘এটার বিষয়ে আমার কোনো এখতিয়ার নাই। এটা হাইকোর্টের এখতিয়ার। হাইকোর্টে ওনারা দরখাস্ত দেবেন, হাইকোর্ট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।’

আরও পড়ুন:
‘এলাকায় একসঙ্গে এত লাশ কখনও দেখিনি’
‘আব্বু আমি চলে যাব, দোয়া করিয়েন’
‘ওরে পুত, কেন গেলি?’
রেলের দাবি নাকচ মাইক্রোযাত্রীর
পুরো দায় মাইক্রোচালকের: রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ
Sheikh Hasina Asaduzzaman Khan Kamals death sentence appeal

শেখ হাসিনা-আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন

শেখ হাসিনা-আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। টানা পাঁচদিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের চরম দণ্ড (মৃত্যুদণ্ড) চেয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে এ আবেদন জানান তিনি। একইসঙ্গে রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের শাস্তির বিষয় আদালতের ওপর ছেড়ে দেন তিনি।

ট্রাইব্যুনালকে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। একজন মানুষকে হত্যার জন্য যদি একবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ১৪০০ মানুষকে হত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে ১৪০০ বার ফাঁসি দিতে হবে। কিন্তু আইনে এটা সম্ভব নয়। এজন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমরা তার চরম দণ্ড দেওয়ার জন্য আবেদন করছি। যদি তাকে এ দণ্ড দেওয়া হয় তাহলে ন্যায়বিচার পাবে দেশের জনগণ।

পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ থেকে অপরাধ সংঘটনের পর পালিয়ে গেলেও ভারত থেকে ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। যারা বিচার চেয়ে মামলা করেছেন তাদেরও নির্মূলের কথা বলেছেন। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে যে এত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার পরও তার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। তিনি একজন হার্ডনট ক্রিমিনালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সুতরাং এই ট্রাইবুনালের মামলায় তিনি যেহেতু সব অপরাধীদের প্রাণভোমরা ছিলেন, তাই তাকে আইনানুযায়ী চরম দণ্ড দেওয়া শ্রেয়। তাকে যদি চরম দণ্ড না দেওয়া হয় এটা অবিচার করা হবে।

আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাং অব ফোরে’র সদস্য ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তার বাসায় বসে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ড্রোন ওড়ানোসহ হেলিকপ্টার থেকে মারণাস্ত্র ছোড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি নিজে গ্রাউন্ডে গিয়ে গিয়ে দেখেছেন সঠিকভাবে হত্যা করা হচ্ছে কি না। তাকে ভিডিও দেখানো হয়েছে। তিনি কমান্ড স্ট্রাকচারে দ্বিতীয় পজিশনে ছিলেন। এ কারণে তার ব্যাপারেও চরম দণ্ড চেয়েছি ট্রাইব্যুনালে।

তবে রাজসাক্ষী হয়ে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন যেহেতু আইন অনুযায়ী আদালতকে তথ্য দিয়ে বা সত্য উদঘাটনে সাহায্য করেছেন তার ব্যাপারে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। এছাড়া যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন, তারা হয়তো পরিবারের আলোর প্রদীপ ছিলেন। ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নিতেন তারা। সুতরাং এসব পরিবারের ক্ষতিপূরণের জন্য আসামিদের সম্পদ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে আদালতের কাছে আমরা আদেশ চেয়েছি।

গতকাল বুধবার এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে চতুর্থ দিনের মতো প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক চলে। এদিন নানা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। এর আগের দিন মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের মতো দিনভর রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তিনি। ওই দিন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্যচিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু, শেখ ফজলে নূর তাপসের কথোপকথনসহ কয়েকটি ফোনালাপ বাজিয়ে শোনানো হয়। একইসঙ্গে এ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষীর বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়।

তার আগের দিন ১৩ অক্টোবর দ্বিতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। ওই দিন বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। যা এ মামলার বিচারকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানায় প্রসিকিউশন। ১২ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছিল। ওই দিন দুপুর পৌনে ১২টা থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের ইতিহাস তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। একইসঙ্গে গুম-খুনসহ নারকীয় সব ঘটনার বর্ণনা দেন।

গত ৮ অক্টোবর মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে তৃতীয় দিনের মতো জেরা শেষ করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মোট ২৮ কার্যদিবসে এ মামলায় ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Police will be arrested in court within 24 hours Chief Prosecutor

গ্রেপ্তার করবে পুলিশ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে আনতে হবে: চিফ প্রসিকিউটর

গ্রেপ্তার করবে পুলিশ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে আনতে হবে: চিফ প্রসিকিউটর

কোন জায়গাকে কারাগার ঘোষণা করা হচ্ছে, সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয় বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, আসামিকে গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে আনতে হবে।
গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম এ কথা বলেন। ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা করে রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকেরা।
এ সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত জানি না যে আদৌ কোনো সাবজেল ঘোষণা হয়েছে কি না। কোনো ডকুমেন্ট আমার হাতে নেই, যেহেতু আপনারা বলছেন। যদি সরকার কোনো নির্দিষ্ট জায়গাকে সাবজেল ডিক্লেয়ার (উপকারাগার ঘোষণা) করে, সরকারের সেই ক্ষমতা আছে। কোন জায়গাটাকে তারা জেল ঘোষণা করবেন, প্রিজন অথরিটির আওতায় নিয়ে আসবেন, সেটা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। সুতরাং এটা আমাদের কোনো কনসার্ন হওয়ার কোনো বিষয় নয়।’
সরাসরি কাউকে জেলে নেওয়ার বিধান নেই উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আইন হচ্ছে আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে আনতে হবে। আদালতে আনার পর আদালত যদি ফারদার অর্ডার (পরবর্তী আদেশ) দিয়ে বলেন—কারাগারে পাঠান, তখন কারাগার বলতে সেটা কেন্দ্রীয় কারাগারও হতে পারে, সেটা জাতীয় সংসদ ভবনের মধ্যেও হতে পারে, এমপি হোস্টেল হতে পারে বা অন্য কোনো জায়গাকেও যদি সরকার কারাগার ঘোষণা করেন, সে জায়গায় পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু সেটা জেল বা কারাগার হিসেবে গণ্য হবে।’

সুতরাং কোন জায়গাকে কারাগার ঘোষণা করা হচ্ছে, তা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষ) বা তদন্ত সংস্থার বিবেচ্য বিষয় নয় বলে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, আইন অনুযায়ী কাজটা করতে হবে। আসামিকে গ্রেপ্তার যদি করা হয়, করা মাত্রই উইদিন টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স (২৪ ঘণ্টার মধ্যে) তাকে আদালতে আনতে হবে। এটা হচ্ছে মোদ্দাকথা। সেটা সংবিধানে যেমন আছে, আইসিটির আইনে আছে, সিআরপিসিতে (ফৌজদারি কার্যবিধি) আছে।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানেই পুলিশ উল্লেখ করে ব্রিফিংয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, আর্মির (সেনাবাহিনী) হাতে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা নেই।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

ওই সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই আদেশ (গ্রেপ্তারি পরোয়ানা) পালনের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসকে অবহিত করা হয়েছে। তারা কিন্তু গ্রেপ্তার করবে না। তারা অবহিত থাকার অর্থ হচ্ছে যখন পুলিশ এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করতে যাবে, তারা অবহিত থাকলে এই পরোয়ানা তামিল করতে তাদের সাহায্য করবে। সুতরাং অ্যারেস্টিংয়ের পাওয়ার (গ্রেপ্তারের ক্ষমতা) কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, অন্য কারও নয়।

তাহলে হেফাজতে থাকার ব্যাখ্যা কী, এ প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, যখনই গ্রেপ্তার দেখানো হবে, গ্রেপ্তার করা হবে, তখন থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই তাকে আদালতে আনতে হবে।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Twenty four mass uprising became inevitable Chief Prosecutor

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল : চিফ প্রসিকিউটর

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল : চিফ প্রসিকিউটর চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্বে বিগত প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ছবি: বাসস

গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে দানবে পরিণত হওয়ার কারণেই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্বে বিগত প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি একথা বলেন।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে দানবে পরিণত হয়েছিল। প্রথমে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডটাকে ভেঙ্গে দেয়। পরবর্তীতে গুম-খুনের কালচার চালু করে। এরপর তারা আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। দেশে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ পায়। এ সবের মাধ্যমেই তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) ক্রমান্বয়ে একটা দানবীয় সরকারে পরিণত হয়েছিল।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আরো বলেন, ‘জনগণকে নির্যাতন করা, হত্যা করা ও একটা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করা ছিলো তাদের (আওয়ামী লীগ সরকারের) টার্গেট। এই দানবীয় শাসকই একটা পর্যায়ে ২০২৪ সালে আমাদের তরুণ-তরতাজা প্রজন্মের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়।’

আজ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের আগে গত বুধবার এই মামলার শেষ সাক্ষী (৫৪তম) তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আলমগীরের জেরা শেষ হলে, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়।

ঐতিহাসিক এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক শহীদ আবু সাঈদের পিতাসহ স্বজনহারা পরিবারের অনেকে। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। সর্বমোট সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৪ জন সাক্ষী।

এই মামলায় প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করছেন।

সেই সাথে অপর প্রসিকিউটররা শুনানিতে উপস্থিত থাকেন।

পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আছেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্র্যাইব্যুনাল। পরবর্তীতে এই মামলার রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে।

এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে।

অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে। সূত্র: বাসস

মন্তব্য

বাংলাদেশ
A fine of 2 unemployed in a mobile court operation

ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২ বেকারিকে জরিমানা

ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২ বেকারিকে জরিমানা

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২টি বেকারিকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তারাশী গ্রামের লোকনাথ বেকারি ও শ্রী দুর্গা বেকারিতে এ অভিযান পরিচালনা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বিল্লাহ।

জানা যায়, বেকারি ২টিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছিল। শ্রমিকরা কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই কাজ করে আসছিল। উৎপাদন কক্ষে খোলা জায়গায় পাওয়া যায ময়লা-আবর্জনা ও ধুলাবালিযুক্ত কাঁচামাল এবং ছত্রাকযুক্ত ট্রে ।

এ অবস্থায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ও খাদ্য নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী লোকনাথ বেকারিকে ৮০ হাজার টাকা এবং শ্রী দুর্গা বেকারিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

অভিযান পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান নিয়মিত চলবে। কোনোভাবেই খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বরদাশত করা হবে না। ব্যবসায়ীদের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রেখে খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করতে হবে।’

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The husband of the husband to kill a wife without getting dowry

যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে হত্যা, স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে হত্যা, স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

সুনামগঞ্জে যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে হত্যার দায়ে স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়ে়ছে। রোববার সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ এই রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন- সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার পৈলনপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহীন মিয়া (৪৮)। তিনি পলাতক আছেন।

রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. শামছুর রহমান।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ছাতক উপজেলার পৈলনপুর গ্রামের শাহীন মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল একই উপজেলার মৈশাপুর গ্রামের সৌদি আরব প্রবাসী ছবদর আলীর মেয়ে সুহেনা বেগমের। বিয়ের পর থেকেই শাহীন মিয়া ব্যবসার জন্য বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে সুহেনা বেগম চাপ দিতে থাকেন। বিভিন্ন সময় এ জন্য তাকে শারীরিক নির্যাতন করতেন। শাহীন ও সুহেনার দুই সন্তান আছে। সুহেনার বাবা ছবদর আলী মেয়ের সংসার টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন সময় টাকাও দিয়েছেন। এক পর্যায়ে শাহীন পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। কিন্তু সুহেনা বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে অস্বীকার করেন। ২০১২ সালে ২০ মার্চ সন্ধ্যায় সুহেনা বেগম তার মা হালিমা বেগমকে ফোন করে জানান যৌতুকের টাকার জন্য তার স্বামী তাকে মারধর করেছেন। এরপর রাত ২টার দিকে শাহীন মিয়া হালিমা বেগমেক ফোন করে বলেন, সুহেনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। হালিমার স্বামী তখন প্রবাসে। পরদিন সকালে তিনি পৈলনপুর গ্রামে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাননি। তখন শাহীনও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে তিনি থানায় একটি জিডি করেন। এর দুদিন পর গ্রামের পাশের সুরমা নদীতে সুহেনার লাশ পাওয়া যায়।

এ ঘটনায় সুহেনার মা হালিমা বেগম ছাতক থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় আটজন সাক্ষ্য দেন। মামলার দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে রোববার রায় ঘোষণা করেন আদালতের বিচারক।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The tribunal took three charges against Inu

ইনুর বিরুদ্ধে ৮ অভিযোগ আমলে নিল ট্রাইব্যুনাল

মানবতাবিরোধী অপরাধ
ইনুর বিরুদ্ধে ৮ অভিযোগ আমলে নিল ট্রাইব্যুনাল

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদের) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
তার বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন পর্যায়ে উসকানি, ষড়যন্ত্র, হত্যা, আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগ ও নিপীড়নমূলক কৌশলে সমর্থনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউশন। শুনানির পর তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
এই ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারক মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।
অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগটি ৩৯ পৃষ্ঠার। চারটি ভলিউমে এক হাজার ৬৭৯ পৃষ্ঠার ডকুমেন্টারি এভিডেন্স আমরা দাখিল করেছি। সঙ্গে তিনটি অডিও ও ছয়টি ভিডিও দাখিল করা হয়েছে। এই মামলায় ২০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলার একমাত্র আসামি হাসানুল হক ইনু। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখাতে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
প্রথম অভিযোগ (গণমাধ্যমে প্ররোচনা): জুলাই আন্দোলনকারীদের বিএনপি-জামায়াত, সন্ত্রাসী ট্যাগ দিয়ে আন্দোলন দমন এবং আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আসামি হাসানুল হক ইনু জাসদের প্রধান হিসেবে গত বছর ১৮ জুলাই ‘মিরর নাও’ নামের একটি ভারতীয় গণমাধ্যমে উসকানি দিয়েছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ (দেখামাত্র গুলি) : গত বছর ১৯ জুলাই গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলীয় জোটের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ইনু উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন, কারফিউ জারি এবং আন্দোলনকারীদের ‘শুট অ্যাট সাইট’ অর্থাৎ দেখামাত্র গুলি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হাসানুল হক ইনু ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়নে প্ররোচনা ও উসকানি দেওয়ার পাশাপাশি তাতে সহায়তা করেছেন।

তৃতীয় অভিযোগ (কুষ্টিয়ায় দমন-পীড়ন): গত বছর ২০ জুলাই হাসানুল হক ইনু তার নিজ জেলা কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারকে ফোন করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্র-জনতার ছবি দেখে তালিকা তৈরি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশের ফলে কুষ্টিয়া পুলিশের একটি অংশ এবং ১৪ দলীয় জোটের সশস্ত্র ক্যাডাররা গত বছর ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালালে ছয়জন নিহত হন।
চতুর্থ অভিযোগ (লিথাল উয়েপন): সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলন দমনে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহার, ছত্রীসেনা নামিয়ে ও হেলিকপ্টার দিয়ে বোম্বিং করে আন্দোলনকারীদের হত্যা ও নির্যাতনের ষড়যন্ত্র করেন ইনু। গত বছর ২০ জুলাই তিনি এ নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন।

পঞ্চম অভিযোগ (টিভি চ্যানেলে উসকানি): গত বছরের ২৭ জুলাই আসামি হাসানুল হক ইনু নিউজ টোয়েন্টিফোর চ্যানেলে আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি আখ্যা দিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। ওইসময় তিনি দেশে সরকারের কারফিউ জারি, আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার ও নির্যাতনের কৌশলকে সমর্থন করেন তিনি।

ষষ্ঠ অভিযোগ (জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব): গত বছর ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত ১৪ দলীয় জোটের সভায় হাসানুল হক ইনু আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী জোটের ক্যাডারদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনকে বৈধতা দেন।

সপ্তম অভিযোগ (কারফিউ ও গুলিবর্ষণে সমর্থন): গত বছর ৪ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে আন্দোলন দমনে কারফিউ জারি ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত সমর্থন ব্যক্ত করে তার দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন ইনু।

অষ্টম অভিযোগ (কুষ্টিয়ায় আন্দোলনে হত্যা): সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং হাসানুল হক ইনুর ষড়যন্ত্র ও নির্দেশে গত বছর ৫ আগস্ট কুষ্টিয়ায় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা পুলিশের উপস্থিতিতে নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। তাদের গুলিতে শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম, সুরুজ আলী বাবু, শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, মো. উসামা, ব্যবসায়ী বাবলু ফরাজী এবং চাকরিজীবী ইউসুফ শেখ শহীদ হন।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Order issuing the Red Notice to Interpol against three persons including S Alam Group Chairman

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আদেশ

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আদেশ

ঢাকার একটি আদালত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ ও পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হাসানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আদেশ দিয়েছেন।

আজ দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ সাব্বির ফয়েজ এ আদেশ দেন। দুদকের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম এ তথ্য জানান।

আবেদনে বলা হয়, সাইফুল আলম, আব্দুস সামাদ ও আব্দুল্লাহ হাসান পরস্পরের যোগসাজশে অপরাধমূলক অসদাচরণ ও বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে ‘এএম ট্রেডিং’ নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে জাল নথি তৈরি ও ব্যবহার করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণের নামে ১০৪ কোটি ২০ লাখ ৭৭ হাজার ৭০৮ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সাইফুল আলম দুর্নীতির মাধ্যমে এই অর্থ এস আলম সুপার ইডিবল ওয়েলের স্বার্থে স্থানান্তর বা পুনর্বিন্যাস বা রূপান্তর করেছেন, যার পরিমাণ ৩৪০ কোটি টাকা বলে অভিযোগে উল্লেখ আছে।

তদন্ত চলাকালে আসামিরা বিদেশে পলাতক থাকায় তাদের আটক করা যায়নি। তাই আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করে।

মন্তব্য

p
উপরে