নড়াইলের সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টের জের ধরে ব্যাপক সহিংসতা ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ফেসবুকে পোস্ট দেয়া শিক্ষার্থী রাহুল দেব রায় এখন কারাগারে আছেন।
তবে মামলার বাদী বলছেন, রাহুল ফেসবুকে কী পোস্ট দিয়েছেন তা তিনি দেখেননি। পুলিশের অনুরোধে তিনি মামলার বাদী হয়েছেন, এমনকি এজাহারও লিখে দিয়েছে পুলিশ। তিনি শুধু সই করেছেন। ঘটনার পরদিন ১৯ জুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি হলেও ২০ জুন পুলিশ বাদীর বাড়ি গিয়ে এজাহার ‘সংশোধন’ করে আবার তার সই নিয়েছেন।
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাস ১৮ জুন আকস্মিকভাবে উত্তাল হয়ে ওঠে। একদল শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, আগের দিন একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে পোস্ট দিয়েছেন।
বিষয়টি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জানান ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আশপাশের এলাকার হাজারও মানুষ ক্যাম্পাসে জড়ো হয়। স্বপন কুমার সাহায্য চান স্থানীয় থানার।
একপর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। বিক্ষুব্ধরা স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ কলেজের আরও দুই হিন্দু শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ।
পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পুলিশের সামনে শিক্ষকের এমন অপদস্ত হওয়ার ঘটনায় তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
নূপুর শর্মাকে সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী রাহুল দেবের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। তবে কলেজে হামলা ও শিক্ষক হেনস্তার ঘটনায় ৯ দিন পর মামলা করেছে পুলিশ। এই সময়ের মধ্যে পুলিশের দাবি ছিল, স্বপন কুমারকে জুতার মালা পরানোর ঘটনা তারা ‘দেখেনি’। ভাইরাল ভিডিওটিও তাদের চোখে পড়েনি। এরই মধ্যে স্বপন কুমারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার তোড়জোড় শুরু করে কলেজ পরিচালনা কমিটি।
বিষয়টি নিয়ে রোববার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজবাংলা।
আরও পড়ুন: পুলিশের সামনে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা কীভাবে?
শিক্ষক স্বপন কুমারকে নিয়ে নিউজবাংলার প্রতিবেদনটি নজরে আসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ সোমবার নিউজবাংলাকে জানান, স্বপন কুমারকে তার চলতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এমন চেষ্টা করলেও মাউশি তাতে অনুমোদন দেবে না।
স্বপন কুমার ইস্যুতে সমালোচনার মুখে পড়া নড়াইলের প্রশাসনও নড়েচড়ে বসে।
আরও পড়ুন: শিক্ষককে জুতার মালা: ঘুম ভাঙল প্রশাসনের, হারাচ্ছেন না পদ
কলেজে হামলা ও শিক্ষক হেনস্তার ঘটনায় সোমবার দুপুরে নড়াইল সদর থানায় মামলা করেন পুলিশের উপপরিদর্শক ও মির্জাপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ মোরছালিন। রোববার রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। বিষয়টি নিউজবাংলাকে মঙ্গলবার নিশ্চিত করেন নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় এবং সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবীর।
কলেজে সহিংসতার পরদিন ফেসবুকে বিতর্কিত পোস্ট দেয়া শিক্ষার্থী রাহুল দেব শর্মার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় রাহুল এখন কারাগারে।
রাহুলের বিরুদ্ধে মামলার বাদী যা বলছেন
শিক্ষার্থী রাহুল দেব রায়ের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার বাদী মির্জাপুর হাজীবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী শিক্ষক মো. ফারুক হোসেন। তিনি বলছেন, এজাহারে কী আছে সেটি তার জানা নেই। তিনি রাহুলের ফেসবুক পোস্টও দেখেননি। সহিংসতার পরদিন পুলিশ তাকে থানায় ডেকে নিয়ে তাদের লেখা এজাহারে সই করিয়ে নিয়েছে।
ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরের দিন দুপুরের দিকে ওসি সাহেব আমারে ফোন দিছেন যে, মামলার একজন বাদী হতে হবি, একজন বাদী বের করেন। কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করলাম, কেউ যাতি রাজি না।
‘আমি (ওসিকে) বললাম, মাগরিবের পরে আলোচনা করে কিডা যাবে আমি জানাচ্ছি আপনাদের। সে বলল, না, দেরি হয়ে যাবে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হবে। তাহলে একটা কাজ করেন, আপনি নিজেই বাদী হন। আমরা গাড়িতে করে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, আবার দিয়ে যাব।’
ফারুক হোসেন বলেন, ‘পরে ওসি সাহেবের গাড়িতে করে গেলাম নড়াইল। নড়াইল গেলে ওসি সাহেব সব লিখে-টিখে সব কমপ্লিট করার পর আমি বললাম যে, আমার তো আবার মিটিং আছে, একটু তাড়াতাড়ি যাতি হবে।
‘তখন কলো (বলল), ঠিক আছে, কমপ্লেইন নিয়ে আমি এসপির কাছে যাব। ওখানে ডিআইজির সঙ্গে ফোন করে এডা আলোচনা করে আপনার স্বাক্ষর নেব। আপনার একটু দেরি করে যাতি হবে। তখন আমি ওখানে মাগরিবের নামাজ পড়লাম।’
এর পরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওসি সাহেব এরপর যাইয়ে এসপির সঙ্গে আলোচনা করে। ওইটা দেখাদেখি করার পর আমার কাছ থেকে একটা স্বাক্ষর নিল কেসে। যা লেখার উনারা লিখেছেন, আমি কিছু লেখিনি। আমি বলিওনি।
‘আমাক পড়ে শোনাল যে, এই ঘটনা। দেখলাম ওখানে যা হইছে, তাই। আমি যতদূর জানি সব সঠিক। সেইভাবে আমি স্বাক্ষর করি আসলাম।’
মামলা হয়ে যাওয়ার পর এজাহারের কপি পরিবর্তনের অভিযোগও উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, পরদিন পুলিশ তার বাসায় এসে জানায় এজাহারে কিছু সংশোধন করা হয়েছে। এরপর সেই ‘সংশোধিত’ কপিতে আগের দিনের তারিখেই ফারুক হোসেনের সই নেয়া হয়।
এজাহারের প্রথম দিনের এবং পরদিনের দুটি কপিই পেয়েছে নিউজবাংলা। ফারুক হোসেনকে পুলিশ বলেছিল এজাহারের নতুন কপিতে কিছু বানান সংশোধন করা হয়েছে। তবে নিউজবাংলা দেখেছে, দুটি কপির মধ্যে ‘উক্ত সময়ে পুলিশ আইন শৃংখলা রক্ষার্থে ০৬ রাউন্ড গ্যাস গান ফায়ার করে‘- এই বাক্যটির হেরফের রয়েছে। একটি কপিতে বাক্যটি থাকলেও আরেকটিতে নেই।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবীর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
আর পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়ের দাবি, মামলার এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি তার জানা নেই। রাহুলের বিরুদ্ধে মামলার এজাহার লিখে ফারুক হোসেনের সই নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘জোর করে কাউকে তো বাদী বানানোর কথা নয়। ওই প্রসঙ্গটা আমার জানা নেই, থানায় যখন মামলা হয়েছে ওসি সাহেব জানেন। আমি তো এই ব্যাপারটা জানি না। যদি কেউ মামলা না করতে চায়, যদি কোনো বাদী না পাওয়া যায় তখন তো একভাবে না একভাবে মামলা করতেই হবে। উনি যদি মামলা করতে না যেত, তাহলে কি আমরা মামলা করতে পারতাম? যদিও এটা আমার জানা নেই।’
পুলিশ সুপার অবশ্য অভিযোগ অনুসন্ধানের আশ্বাস দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি যেহেতু বলেছেন, আমি খোঁজ নেব জিনিসটা কী হয়েছিল। যদি কোনো ব্যত্যয় হয়ে থাকে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
এ ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাদী মামলার একটা বড় অনুষঙ্গ। মামলা করতে গেলে বাদী লাগবেই। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা সুয়োমোটো মামলা নেই, যেটাতে পুলিশই বাদী হয়।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার বাদী (ফারুক হোসেন) যেটা বলেছেন, সেটা ওনার ব্যক্তিগত মতামত। মামলার বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়ালে হয় না। সাক্ষীসাবুদ নিয়েই এজাহার করা হয়। বাদী এখন বলছেন যে তাকে বাদী বানানো হয়েছে, তিনি কিছু জানেন না। তিনি এটা বলতে পারেন। এটা যদি আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা তদন্তসাপেক্ষে দেখব।’
কোনো ব্যক্তির করা মামলার এজাহার পরে সংশোধন বা পরিবর্তন করার সুযোগ পুলিশের নেই বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। বিষয়টি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ বাদী হয়ে কোনো মামলা করলে পরে পুলিশ চাইলে সেটি পরিবর্তন করতে পারে। তবে কোনো সাধারণ মানুষ বাদী হয়ে এজাহার তৈরির পর মামলা দায়ের হয়ে গেলে, তা আর পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এটি পরিবর্তন করা হলে তার আইনগত কোনো ভিত্তিও নেই।’
শিক্ষক হেনস্তার ৯ দিন পর মামলা
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে সহিংসতা ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ঘটনার ৯ দিন পর সোমবার এ-সংক্রান্ত মামলা করেছে পুলিশ।
দণ্ডবিধির ৩৪, ১৪৩, ৪৪৭, ৪৪৮, ৩২৩, ৩৪১, ৩৩২, ৩৫৩, ৩৫৫, ৪৩৬, ৪২৭, ৫০০ ধারায় করা এ মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এরপর রোববার রাতেই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে আছেন কলেজের পাশের মির্জাপুর বাজারে মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী শাওন খান। লাল গেঞ্জি পরা ৩০ বছর বয়সী শাওনকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ভিডিওতে চিহ্নিত করা গেছে।
শাওনের মা হোসনেয়ারা বেগম মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল রাতে আমার ছেলেকে দেখা করতে বলে মির্জাপুর ক্যাম্প পুলিশ। দেখা করতে গেলে তাকে আটকায় দিছে।’
হোসনেয়ারা বেগম দাবি করেন, তার ছেলে ঘটনার দিন শিক্ষক বা অভিযুক্ত ছাত্রকে বিক্ষুব্ধ লোকজনের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এর পরেও ‘বিনা কারণে’ পুলিশ তাকে নিয়ে গেছে। তবে স্বপন কুমারকে জুতা পরানোর ভিডিওতে শাওনকে শনাক্ত করেন হোসনেয়ারা।
এ মামলায় গ্রেপ্তার আরও দুজন হলেন মির্জাপুর মধ্যপাড়া মো. মনিরুল ইসলাম এবং মির্জাপুরের সৈয়দ রিমন আলী।
কী আছে মামলার ধারায়
কলেজে হামলা ও শিক্ষক হেনস্তার ঘটনায় সোমবার দুপুরে নড়াইল সদর থানায় পুলিশের উপপরিদর্শক ও মির্জাপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ মোরছালিনের করা মামলায় দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা রয়েছে।
এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যখন কিছু ব্যক্তি মিলে সবার একই অভিপ্রায় পূরণের জন্য কোনো অপরাধমূলক কাজ করেন তখন ওইসব ব্যক্তির প্রত্যেকেই ওই কাজের জন্য এভাবে দায়ী হবেন যেন কাজটি ওই ব্যক্তি এককভাবে করেছেন।’
মামলায় ১৪৩ ধারাও দিয়েছে পুলিশ। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বেআইনি সমাবেশের সদস্য হবেন তিনি যেকোনো বর্ণনার সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৩২৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ধারা৩৩৪ এ ব্যবস্থিত ক্ষেত্র ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত দান করলে তিনি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ এক বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে- যার পরিমাণ এক হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
দণ্ডবিধির ৩৪১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কেউ কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে বাধাদান করলে তিনি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ এক মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে- যার পরিমাণ পাঁচশ টাকা পর্যন্ত হতে পারে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৩৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীকে তার কর্তব্য পালনে বাধাদান করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করলে যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৩৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্তব্য পালনে বাধাদানের উদ্দেশ্যে আক্রমণ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করলে যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে অথবা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৩৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘মারাত্মক প্ররোচনা ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে অপমান করার জন্য আক্রমণ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করলে যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে অথবা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৪২৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি অনিষ্ট সাধন করে এবং তার মাধ্যমে ৫০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি লোকসান বা ক্ষতি করলে সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৪৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘গৃহ ইত্যাদি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আগুন বা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করে অনিষ্ট সাধন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে-দণ্ডিত হবেন, এর সঙ্গে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।’
৪৪৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ করলে তিনি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ তিন মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে যার পরিমাণ পাঁচশ টাকা পর্যন্ত হতে পারে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৪৪৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি অনধিকার গৃহপ্রবেশ করলে তিনি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ এক বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে যার পরিমাণ এক হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
৫০০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কারও মানহানি করলে তিনি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
আগের অবস্থান থেকে সরেছে প্রশাসন
শিক্ষক স্বপন কুমারকে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে দেয়ার দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হলেও পুলিশ সপ্তাহখানেক পরেও দাবি করেছিল, তারা এ সম্পর্কে কিছু জানে না।
নড়াইল জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় রোববার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অধ্যক্ষকে যখন কলেজের কক্ষ থেকে বের করে আনা হয়, তখন সেখানে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। এ ছাড়া নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। তখন কেউ তাকে জুতার মালা দিয়েছে কি না, আমরা দেখতে পারি নাই। এটা আমার জানাও নেই।’
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমি এখনও কোনো ভিডিও দেখি নাই। জুতার মালার ব্যাপারটাও জানি না। এ ঘটনায় আমি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তারা প্রতিবেদন দিলে যে বা যারা দোষী হবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তবে পুলিশ সুপার মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে বলেন, ঘটনার দিন তিনি বেশ খানিকটা দূরে অবস্থান করছিলেন। এ কারণে স্বপন কুমারকে জুতার মালা পরিয়ে দেয়ার ঘটনা তার চোখে পড়েনি।
তিনি বলেন, ‘ওইদিন চারিদিক থেকে বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার জনতা ছিল। তাদের নিবৃত্ত করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। ওখানে স্বয়ং ডিসি সাহেব ছিলেন, আমি ছিলাম। আমরা সর্বদা চেষ্টা করেছি, যতটুকু কম বলপ্রয়োগ করে রক্তপাতহীনভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, সেইভাবে আমরা চেষ্টা করেছি।
‘ডিসি সাহেব, আমরা অনেক বুঝিয়েছি লোকদের। ডিসি সাহেব এবং আমরা চেয়েছিলাম তাদের (ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও অভিযুক্ত ছাত্র) দ্রুত গাড়িতে তুলে রেসকিউ করতে। আমরা চেষ্টা করেছি সেইভাবে। বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঠান্ডা করার জন্য, কথা বলার জন্য আমি এবং ডিসি সাহেব মেইন যে রাস্তা… ওই জায়গায় ছিলাম।’
পুলিশ সুপার বলেন, ‘যখন ওখান থেকে (কলেজ) তাদেরকে (ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও অভিযুক্ত ছাত্র) নামায়, আমি আর ডিসি সাহেব ছিলাম অন্য জায়গায়। মেইনে যে রাস্তা, যেখানে টার্ন করবে ওই জায়গাতে আমরা। আমাদের মুখটা ছিল উল্টোদিকে, জনগণকে আমরা বুঝাচ্ছিলাম, ওইটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
‘এদিকে তারা টান দিয়ে নিয়ে যেয়ে গাড়িতে তুলবে সেই সময় হয়তো হঠাৎ করে এই কাজটা হয়তো হয়ে গেছে। এটাতে কিন্তু আমাদের নিজেদের কোনো ইয়ে ছিল না যে এ রকম হতে পারে। হওয়ার পরপর, কিছুক্ষণ পর হয়তো যখন তাদেরকে গাড়িতে তুলেছি হুড়োহুড়ির ভেতরে, তখন তার কিন্তু গলায় এটা দেখি নাই। একটু পরে যখন গাড়িতে তুলেছি হুড়োহুড়ির ভেতরে কেউ হয়তো খুলে ফেলে দিছে। ওই সময় তাদের নিয়ে মুভ করানোর সময় হয়তো কাজটা হয়ে গেছে।’
আরও পড়ুন:পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাতে রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের ঋণ জালিয়াতিসহ ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাংক খাত ‘ধ্বংসের’ অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন সাবেক গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক-বর্তমান ১৯ কর্মকর্তা এবং দুজন ভারতীয় কর্মকর্তার নথি তলব করে ফের চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া এসব বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত জুনে প্রথম দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদারের নথিসহ ২৩ ধরনের নথি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। তবে সে দফায় কাঙ্ক্ষিত তথ্য না মেলায় গত সেপ্টেম্বরে কমিশন তৃতীয়বারের মতো আবার নথি তলব করে।
এই তলবকৃত নথির তালিকায় রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর টেকনিক্যাল দায়িত্বে থাকা দুজন ভারতীয় কর্মকর্তার নথিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এখনও সব নথিপত্র হাতে পায়নি বলে জানিয়েছে দুদক।
জানা গেছে, সম্প্রতি গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তাদের প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট নম্বর, দায়িত্বের পরিধি এবং অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যাদের নাম তালিকায় রয়েছে তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলা, নীতি শিথিলতা এবং অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলছে। দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। রিজার্ভ চুরির সময় গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন ড. আতিউর রহমান, যিনি একই বছরের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন।
এছাড়া সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, আবু হেনা মো. রাজী হাসান, এসএম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, আহমেদ জামাল এবং বিএফআইইউয়ের সাবেক প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসের সম্পর্কেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহার নামও রয়েছে এ তালিকায়।
বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী অফিসের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক (যিনি সম্প্রতি এক মাসের নোটিশে পদত্যাগ করেছেন) এবং আইসিটি বিভাগের দেবদুলাল রায়। আরও আছেন কমন সার্ভিস বিভাগ-২-এর পরিচালক মো. তফাজ্জল হোসেন, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ এবং আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তা মসিউজ্জামান খান ও রাহাত উদ্দিন।
দুদকের চিঠিতে মসিউজ্জামানের নাম দুইবার এসেছে—একবার অতিরিক্ত পরিচালক, আবার উপপরিচালক হিসেবে—যা একই ব্যক্তিকে নির্দেশ করে বলে জানা গেছে।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় নেওয়া দুই কোটি ডলার ফেরত আসে এবং ফিলিপাইন থেকে প্রায় দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এখনো প্রায় ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধারের প্রক্রিয়া ফিলিপাইনের আদালতে চলছে।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও ছাড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকের চারটি বিভাগ—ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট, আইটি, পেমেন্ট সিস্টেম এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং—এই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দুদকের চিঠিতে আরও দুটি ভারতীয় নাগরিকের তথ্য চাওয়া হয়েছে—নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা। নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির আগে ‘সুইফট’ সংযোগ স্থাপনের কাজ করেছিলেন, আর রাকেশ আস্তানা চুরির পর নিরাপত্তা ভেদ সংক্রান্ত তদন্তে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের আমলে।
এদিকে গতকাল সোমবার আলাদা এক অনুসন্ধানে দুদক চট্টগ্রামের বন সংরক্ষক ড. মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে এক দিনেই ৭৭ জন কর্মচারীকে বদলি করার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
গেল ফেব্রুয়ারিতে অভিযান চালিয়ে দুদক রেজাউল করিমের নামে লালমাটিয়ায় ৭ কোটি টাকার দুটি ফ্ল্যাট, ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট এবং সাতক্ষীরার তালা থানায় জমি কেনার প্রাথমিক দুর্নীতির উপাদান খুঁজে পেয়েছিল।
অর্থ আত্মসাৎ, পাচার, অনৈতিক আর্থিক লেনদেন, হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন জায়গায় চারটি প্রতিষ্ঠানে পৃথক এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রোববার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের জনসংযোগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।
দুদক জানায়, মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ এবং এডিপি প্রকল্পের অর্থায়নে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কালভার্ট-সেতু নির্মাণের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বক্তব্য গ্রহণ করা হয় এবং কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডপত্রের আলোকে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়।
অপর অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের নিমিত্তে এনফোর্সমেন্ট টিম মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের ছয়না গ্রামে পাথরিয়া পাড় রাস্তা সংলগ্ন ৯ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কালভার্ট সরেজমিন পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে দেখা যায়, উক্ত কালভার্টটি কেবলমাত্র একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ির যাতায়াতের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পূর্বাঞ্চলের শতকোটি টাকার পুরাতন মালামাল ও স্ক্র্যাপ সংঘবদ্ধ অসাধু চক্রের মাধ্যমে পাচারের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে অভিযোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্রাদি সংগ্রহ করা হয়।
অপরদিকে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা প্রদানে হয়রানি ও নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযান পরিচালনাকালে দেখা যায়, হাসপাতালে রোগীদের সেবা প্রদানে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক উপস্থিত না থাকায় রোগীরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া রোগীদের খাবার সরবরাহে নানাবিধ অনিয়ম এনফোর্সমেন্ট টিমের নিকট পরিলক্ষিত হয়।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে খুলনা ও রাজশাহী নগরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নিমিত্তে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে পৃথক একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে।
সাতক্ষীরার আশাশুনিতে জমি দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজিতে অন্যতম অবস্থানে রুহুল কুদ্দুস ও মিনু বাহিনী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তেলবাজি, দালালি করত বিএনপি নেতা বনে যাওয়া রুহুল কুদ্দুস। চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস ও তার আপন সহোদর আমিনুর রহমান মিনুর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। অভিযোগ আছে, ওই চক্রটির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই বেধড়ক মারপিট, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এমনকি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে থাকে। রুহুল কুদ্দুস ও আমিনুর রহমান মিনু বাহিনীর রয়েছে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি সক্রিয় সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা দুইজন, এদের মধ্যে একজন আশাশুনি আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস এবং অপর ব্যক্তি রুহুল কুদ্দুসের আপন ভাই কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-যোগাযোগ সম্পাদক আমিনুর রহমান মিনু।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে রুহুল কুদ্দুস আমিনুর রহমান মিনু, মমিনুর রহমান মন্টু, খোরশেদ আলম, মফিজুল ইসলাম, শামীম মোস্তফা শুভসহ তাদের সঙ্গপাঙ্গদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষ সহায় সম্বল হারিয়ে এখন নিঃস্ব। আশাশুনি উপজেলার ৯ নং আনুলিয়া ইউনিয়নের মাধ্যম একসরা গ্রামের প্রয়াত আবু দাউদ সানার ছেলে সাদ্দাম সানা বলেন, ‘৫ আগস্টের পরের দিন ৬ আগস্ট রাতে আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস ও তার বাহিনী আমার মৎস্য ঘেরে সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালায়।’ ভুক্তভোগী সাদ্দাম সানা বলেন, ‘রুহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যানের ঘেরের পাশে আমার মৎস্য ঘের। রুহুল কুদ্দুস দাঁড়িয়ে থেকে তার পোষ্য বাহিনী দিয়ে আমার ঘেরের ভেড়ি কেটে দিয়ে দখলে নেয়।’
সাদ্দাম সানা বলেন, রুহুল কুদ্দুস ও তার ভাই আমিনুর রহমান মিনুকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও আমার মৎস্য ঘের ফেরত পাইনি। আমার রেকর্ডীয় ৫ বিঘা ১০ কাঠা জমি অবৈধভাবে ভোগ দখল করছে রহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যান। এ ঘটনায় প্রশাসনের সহযোগিতাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ নাংলা গ্রামের মো. আব্দুল সানার ছেলে আকবর সানা মাঝি বলেন, ৫ আগস্টের পর রুহুল কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর ইন্ধনে তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালায়। এ সময় দোকানের তালা ভেঙে আনুমানিক ৩ লাখ টাকার শ্যালো মেশিনসহ মেশিনের পার্টসের মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। একই সময় আমার ভাই আক্তার সানার দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে আড়াই লাখ টাকার মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়।
আশাশুনি, আনুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ একসরা গ্রামের রোকনুজ্জামান মোল্যা বলেন, ‘আনুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে মান্নান মোল্যা, সুমন মোল্যা, খোরশেদ শিকারীসহ সন্ত্রাসী বাহিনী জোর করে মৎস্য ঘেরে লুটপাট চালিয়ে ৩ লাখ টাকার মাছ ধরে নেয়। ভুক্তভোগী রোকনুজ্জামান মোল্যা জানান, আশাশুনি থানাধীন একসরা মৌজায় জেএল নং-১৪১, সাবেক ৫১ নং, হাল ৬৩, এসএ দাগ ১৫৫৩/১৫৯৫ নং ও আমার ডিসিআর ২২/৮৫, আরএস ২৮৪১, ২৮৪২, ২৮৪৩, ২৮৪৪ ও ২৮৪৫ দাগে আমার ডিসিআরকৃত ০.৮৮ একর এবং রেকর্ডীয় ১.৪২ একর সর্বমোট ২.৩০ একর জমির একটি মৎস্য ঘের ছিল। যা আমি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা করার একপর্যায়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখ সকাল ৯টায় রুহুল কুদ্দুস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমার মৎস্য ঘেরে প্রবেশ করে জোর করে মাছ লুটপাট করে এবং আমার জমি দখলে নেয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী রোকনুজ্জামান মোল্যা গত ২০ এপ্রিল ২৫ তারিখ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার, খুলনা বিভাগের ডিআইজি, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পসহ সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এদিকে ৫ জানুয়ারি ২০২২ সালে আশাশুনি ৯ নং আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন রুহুল কুদ্দুস। তৎকালীন সময় রুহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে জনসম্মুখে একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণের একটি ভিডিওতে রুহুল কুদ্দুসকে বলতে শোনা যায়, এই নৌকা বঙ্গবন্ধুর নৌকা, এই নৌকা শেখ হাসিনার নৌকা, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতীক নৌকা। এর আগে রুহুল কুদ্দুস ও আমিনুর রহমান মিনু বাহিনীর ভয়াবহ সন্ত্রাসী তাণ্ডবের শিকার হন ভুক্তভোগী আনুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রফি মেম্বারসহ একাধিক ব্যক্তি। ৫ আগস্টের পর রফি মেম্বারের দুটি মৎস্য ঘের লুটপাট ও দখল করার ঘটনায় বিভিন্ন মিডিয়ায় কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উন্মোচন করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর সন্ত্রাসীরা রফি মেম্বারকে বেধড়ক মারপিট করে। আশাশুনি উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান, রহুল কুদ্দুস একজন সুবিধাবাদী ব্যক্তি। নিজ স্বার্থ ও চরিতার্থ হাসিলের জন্য সে যা খুশি তাই করে থাকে।
ফোনে আলাপকালে রুহুল কুদ্দুস তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-যোগাযোগ সম্পাদক আমিনুর রহমান মিনু বলেন, এসব ঘটনার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
একজন মানুষকে পৈশাচিকভাবে কতটা নির্মম নির্যাতন করা যায়, তা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন না করলে বিশ্বাস করাটা কঠিন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত পাওয়া গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল (বুধবার) তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। গুম কমিশন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কসহ আমি (চিফ প্রসিকিউটর) বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করেছি এবং বীভৎসতার চিত্র আমরা দেখেছি।
‘সেখানে ইলেক্ট্রনিক শক দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বন্দিদের চোখ বেঁধে রাখা হতো। তিন ফিট বাই তিন ফিট এবং দুই ফিট বাই দুই ফিট অমানবিক সব সেল। একটা মানুষকে পৈশাচিকভাবে কতটা নির্মম নির্যাতন করা যায়, তা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন না করলে মানুষের পক্ষে এগুলো বিশ্বাস করাটাই কঠিন ছিল।’
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্ধতিগতভাবে ভিন্নমত দমন করার জন্য নির্যাতন ও গোপন হত্যাকে যে সংস্কৃতিতে পরিণত করেছিল, সেটি উন্মোচিত হয়েছে উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন,‘যারা এই নির্যাতন বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর সাথে সম্পৃক্ত, আমরা তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে চাই।’
মায়ের সঙ্গে এক মেয়ের বন্দিদশার কথা তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘একটা ১১ বছরের মেয়েকে তার মাসহ তুলে নেওয়া হয়েছিল। মেয়েটির সামনে মাকে হাতকড়া দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। মেয়েটির মা মোটা ছিল বলে হাতকড়া কেটে তার শরীরের মধ্যে বসে গিয়েছিল। ১১ বছরের মেয়েটাকে পাশেই চোখ বেঁধে রাখা হতো। বাথরুম করার সময়ও মেয়েটির মায়ের হাতকড়া খুলে দেওয়া হতো না।
‘১১ বছরের মেয়েসহ একজন নারী রেহাই পায়নি। পুরুষ সদস্যরা নির্যাতন করেছে। এমনকি মেয়েটির মা আজও ফিরে আসেনি। আমরা ধারণা করছি, হয়তো তাকে হত্যা করে তার লাশ কোথাও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ১১ বছরের মেয়েটি কিন্তু চিহ্নিত করতে পেরেছে কোথায় তাদের রাখা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল।’
গোপন বন্দিশালার আলামত নষ্টের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘অনেক আলামত আমরা জব্দ করেছি। তবে আমরা দেখেছি গোপন বন্দিশালা বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর ব্যাপক আলামত নষ্ট করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন:নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে নির্মাণ করা হয় সিলেট জেলা হাসপাতাল। নাগরিক সমাজের আপত্তি উপেক্ষা করে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ দায়িত্বশীলরা অনেকটা জোর করে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন এই হাসপাতাল।
২৫০ শয্যার এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ ২০২৩ সালে শেষ হলেও এখন এটির দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ।
স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টদের মতামত না নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করায় এই হাসপাতাল ভবনের দায়িত্ব নিতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। ফলে হাসপাতাল কমপ্লেক্স বুঝিয়ে দেয়ার মতো কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে না গণপূর্ত বিভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সিভিল সার্জন অফিসসহ কেউই এর দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। ফলে হাসপাতাল চালু করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। যদিও নির্মাণ কাজের শুরুতে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, এটি চালু হলে ওসমানী হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে। সিলেট অঞ্চলের রোগীরা এখান থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা নিতে পারবেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৬ দশমিক ৯৮ একর জায়গার ওপর এই জেলা হাসপাতাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণপূর্ত অধিদপ্তর হাসপাতালটির অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, ভবন নির্মাণসহ রংকরণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। তবে ভবনে হাসপাতালের কোনো যন্ত্রপাতি আনা হয়নি। এর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনীও দেয়া হয়নি।
নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মওদুদ আহমদ জানান, তাদের কাজ শেষ। তারা ভবনটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে তুলে দিতে প্রস্তুত।
জানা গেছে, হাসপাতাল ভবন নির্মাণ শেষ হলেও ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয় নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা পরিচালনা করবে, সেটি এখনও নির্ধারণ হয়নি। হাসপাতাল হস্তান্তরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ না পাওয়ায় গণপূর্ত বিভাগ এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে।
গণপূর্ত বিভাগ জানায়, ১৫ তলা হাসপাতাল ভবনে আটতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রঙের কাজ, ইলেক্ট্রিক, টাইলস, গ্লাস, দরজা, জানালা লাগানোও সম্পন্ন। হাসপাতাল ভবনের বেসমেন্টে রয়েছে কার পার্কিং; প্রথম তলায় টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুম; দ্বিতীয় তলায় আউটডোর, রিপোর্ট ডেলিভারি ও কনসালট্যান্ট চেম্বার; তৃতীয় তলায় ডায়াগনস্টিক; চতুর্থ তলায় কার্ডিয়াক ও জেনারেল ওটি, আইসিসিইউ, সিসিইউ; পঞ্চম তলায় গাইনি বিভাগ, অপথালমোলজি, অর্থোপেডিক্স ও ইএনটি বিভাগ এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় ওয়ার্ড ও কেবিন। এর মধ্যে আইসিইউ বেড ১৯টি, সিসিইউ বেড ৯টি এবং ৪০টি কেবিন রয়েছে।
জেলা গণপূর্ত অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাফর বলেন, ‘আমরা এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে দেব। বাই মিসটেক এখানে যেহেতু লোকাল অথরিটি পাওয়া যায়নি। সেহেতু আমরা অথরিটি নির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘টেন্ডার সিডিউল, নকশাসহ কাগজপত্র সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগকে দেয়া হয়েছে। প্রতি তলায় ছাদ ঢালাইয়ের সময় তারা এসেছিল। এই হাসপাতালের জমি, ভবন, টাকা- সব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; আমরা শুধু কাজ করে দিচ্ছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে হাসপাতালটি পরিচালনা বা তদারকির কথা ছিল। আমরা মন্ত্রণালয়কে সেভাবেই চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব যখন মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন গণপূর্ত বিভাগ আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। শুনেছি, হাসপাতালের কাজ শেষ। এখন তারা আমাদের গছাতে চাচ্ছে। অথচ এখানে কী আছে না আছে- সেটি আমাদের জানা নেই। তাই এ অবস্থায় আমরা হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে পারি না।
‘কারণ, আমাদের আগের পরিচালক (ডা. হিমাংশু লাল) এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে গেছেন মন্ত্রণালয়ে। তাতে তিনি লিখে যান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অগোচরেই সিলেটে অনেক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। তারা যেন না বুঝে এসব স্থাপনার দায়িত্ব কোনোভাবেই না নেন।’
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘হাসপাতালের স্থাপত্য নকশা, কর্মপরিকল্পনা, সেবা প্রদানের জন্য সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় কক্ষের সুবিন্যাসকরণ ইত্যাদির কাগজপত্র সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পরিচালক অথবা ওসমানী হাসপাতালের পরিচালকের কাছে দাখিল করা হয়নি। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এটি বাসাবাড়ি নয়; আমাকে দায়িত্ব দিয়ে দিল আর নিয়ে নিলাম। এটি একটি হাসপাতাল। এটি নির্মাণে আমাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয়নি।’
হাসপাতালটি নির্মাণের আগে কোনো মতামত নেয়া হয়নি জানিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, ‘এভাবে হুট করে আমরা কোনো হাসপাতালেল দায়িত্ব নিতে পারি না। এই ভভনের অবকাঠামো হাসপাতালের উপযোগী কী না তাও আমাদের জানা নেই।
‘তাছাড়া ওসমানী হাসপাতালের অধীনে আরও কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে। সীমিত জনবল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে এগুলো পরিচলানা করতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। নতুন করে কোনো হাসপাতালের দায়িত্ব নেয়া এখন সম্ভব নয়।’
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেট জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এমন ঠেলাঠেলি বন্ধ হোক। এখানে কারও স্বার্থ বা কোনো কুচক্রী মহল আছে কিনা, সেটি খুঁজে দেখা দরকার। এ প্রকল্প যখন পাস হয়, তখনই বলে দেয়া হয়েছে কারা পরিচালনা করবে। নির্মাণের পর কেউ দায় নিতে না চাওয়া অন্য অর্থ বহন করে।’
পদোন্নতি পাওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা তার ছিল না। অবৈধ উপায়ে পদ বাগিয়ে দফায় দফায় শুরু করেন নানামুখী দুর্নীতি। বিগত কয়েক বছর ধরেই খেয়াল-খুশিমতো বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন। পদে পদে তার স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছেন জেলার প্রাথমিক শিক্ষকরা।
আলোচ্য ব্যক্তিটি হলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিজ জেলাতেই ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে অবস্থান করা খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম।
১৯৯৭ সালের ২৮ এপ্রিল উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন শেখ অহিদুল আলম। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পান তিনি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদ থেকে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য ১৯৮৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক গেজেটে কিছু যোগ্যতার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ওই গেজেটের ৩২ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর বিএড ডইগ্র অথবা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রি থাকতে হবে।
খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে চলতি বছরের আগস্ট মাসে শেখ অহিদুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. মোসলেম উদ্দিন।
তদন্তকালে শেখ অহিদুল আলম চাহিদা অনুযায়ী বিএড সার্টিফিকেট দিতে পারেননি। তার বদলে ২০০২ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) থেকে পাস করা এমএড সার্টিফিকেট দাখিল করেন।
তবে বিএড ও এমএড ডিগ্রি সমমান নয় বলে জানিয়েছেন বাউবির অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. মোহসীন উদ্দিন। গত ২৮ আগস্ট তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, বিএড ডিগ্রির বিকল্প হিসেবে এমএড ডিগ্রিকে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।
বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে গত ২০ অক্টোবর বাউবির ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. হাবিবুল্যাহ মাহমুদ তদন্ত কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বিএড ডিগ্রি অর্জনের জন্য শ্রেণীকক্ষে ৯০টি অনুশীলনী পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের দক্ষতা, শিক্ষার্থী মূল্যয়নের দক্ষতা, শ্রেণী ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের ধারণা অর্জনের ব্যবস্থা নেয়া হয়।
একইসঙ্গে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের প্রাক-যোগ্যতা অর্জনের জন্য পরিসংখ্যানগত ধারণা, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা দর্শনের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের কিছু বিষয় যুক্ত থাকে। কিন্তু এমএড ডিগ্রি প্রোগ্রামে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান-সংশ্লিষ্ট দক্ষতা অর্জনের কোনো সুযোগ নেই।
তবে বিএড ডিগ্রি নেই এরূপ শিক্ষার্থীদের এক সেমিস্টার পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক চারটি কোর্স সম্পন্ন করে এমএড ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ ২০০০ সালে এমএড শিক্ষাক্রমে ছিল। এজন্য এমএড প্রোগ্রামকে বিএড-এর বিকল্প বিবেচনার সুযোগ নেই।
এছাড়া ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৫৮ জন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিএড বা ডিপ্লোপা ইন এডুকেশন ডিগ্রি না থাকায় তাদের পদোন্নতি দেয়নি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তদন্তের সত্যতা জানিয়ে মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমি গত ২৪ অক্টোবর অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) চলে এসেছি। তাই তদন্তের সব কাজ শেষ করে আসতে পারিনি। বাকি কাজটুকু বর্তমান উপ-পরিচালক সম্পন্ন করবেন।’
তবে খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো মানতে নারাজ। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এমএড ডিগ্রি থাকলে বিএড আছে কিনা এটা কোনো বিষয় না। আমাদের ব্যাচে ১৩৭ জনের একযোগে পদোন্নতি হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে দেখেন সেখানে কতজনের বিএড ছিল না। আমার বিএড-এর থেকেও উচ্চতর এমএড ডিগ্রি তো আছেই। তাই আমার পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।’
শিক্ষক বদলিতে স্বেচ্ছাচারিতা
শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল একযোগে ১৭ জন শিক্ষকে বদলি করেন। তবে পরবর্তীতে অনলাইনে শিক্ষকরা দেখতে পান যে তাদের বদলি আদেশে আন্তঃজেলা বদলির নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর আবেদন করেন। একইসঙ্গে খোদ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ওই শিক্ষকদের বদলির আদেশ বাতিলের জন্য আবেদন করেন। পরবর্তীতে তিনি নামমাত্র একটি সুপারিশ কমিটি করে তাদের বদলি বহাল রাখেন।
৩ জুন অধিদপ্তর বরাবর পাঠানো চিঠিতে অহিদুল আলম উল্লেখ করেন, যেহেতু অনলাইনে তাদের বদলির আদেশ অনুমোদন হয়ে গেছে, তাই এই আদেশ বহাল রাখা যায়।
ওইসব শিক্ষক জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ জারিকৃত পত্রে চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধান শিক্ষকদের বদলিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ১৭ জনের মধ্যে চারজন প্রধান শিক্ষককেও বদলি করা হয়েছিল। এটা তিনি করেছিলেন পছন্দের ব্যক্তিদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বানানোর জন্য।
প্রতিবাদ করলেই শাস্তি
এই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যারা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের একজন বটিয়াঘাটা উপজেলার বারোভূঁইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষক নীহার রঞ্জন রায়।
তিনি জানান, ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর পিআরএল-এ যাওয়ার দিন তাকে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে লঘুদণ্ড দিয়ে বেতনের এক ধাপ অবনমিত করা হয়। এর বিরুদ্ধে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষা কর্মকর্তা অহিদুল আলমের সঙ্গে মতের মিল না হলেই বিপদে পড়তে হয়। তিনি ২০১২ সালে এক মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়ে ২৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন।
একই জেলায় ১৪ বছর
শেখ অহিদুল আলম ইতোপূর্বে খুলনা সদর থানার শিক্ষা অফিসার পদে তিন বছর, খুলনা বিভাগীয় অফিসে ছয় বছর ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে তিন বছর কর্মরত ছিলনে।
২০২৩ সালের ২০ জুন আবারও খুলনাতে তার বদলি হয়। সে সুবাদে তিনি খুলনাতেই প্রায় ১৪ বছর কর্মরত রয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনাতেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডাটাবেইজের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, শেখ অহিদুল আলমের স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার নলডাঙ্গা গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। তবে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া গেছে খুলনা সিটি করপোরেশনের দৌলতপুরের কালিবাড়িতে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ অহিদুল আলম খুলনার বিএল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তার শ্বশুরবাড়ি দৌলতপুরের কালিবাড়িতে। দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। স্থানীয় সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে আঁতাত করেই তিনি দীর্ঘদিন খুলনায় থাকার সুযোগ পেয়েছেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে শেখ অহিদুল আলম বলেন, ‘একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা নানারকম ষড়যন্ত্র করছে।’
আরও পড়ুন:কিশোরগঞ্জে বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
প্রকল্পগুলোর প্রদর্শনী নামমাত্র বাস্তবায়ন, কোথাও আবার বাস্তবায়ন না করেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, পুরো উপজেলায় বেশির ভাগ প্রদর্শনীতে মোট বরাদ্দের ৩০ শতাংশও কৃষক পাননি।
অভিযুক্ত কর্মকর্তার নাম ফাহিমা আক্তার, যিনি ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে সদর উপজেলায় কর্মরত।
এর আগে একই উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা পদে ছিলেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ছয়টি প্রকল্প থেকে (ফ্রিপ প্রকল্প, ময়মনসিংহ প্রকল্প, পার্টনার, অনাবাদি, রাজস্ব প্রকল্প ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী) কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেন ফাহিমা।
ফ্রিপ প্রকল্প
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ফ্রিপ প্রকল্পে বিভিন্ন ফসলের মোট ৫০৯টি প্রদর্শনী ও কৃষক প্রশিক্ষণ বাবদ ১ কোটি ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে।
এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা। যেগুলো করেছেন, সেগুলোও নামমাত্র বাস্তবায়ন দেখানো হলেও কৃষকরা তার সুফল পাননি।
ফ্রিপ প্রকল্পের রোপা আমন ধানের প্রদর্শনী করেন কাটাবাড়িয়া এলাকার কৃষক খোকন মিয়া। পাঁচ কেজি বীজ, ১৫ কেজি ডিএপি, ২০ কেজি ইউরিয়া সার আর কিছু কীটনাশক পেয়েছেন তিনি। তার পাওয়া উপকরণের বাজার মূল্য সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ তার অনূকূলে বরাদ্দ ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তার অনূকূলে মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ উপকরণ পেয়েছেন খোকন।
হাজিরগল গ্রামের কৃষক মুখলেছ, কাদির, হাসেম ও আতাউর মিলে ৫ একর জমিতে করেন ফ্রিপ প্রকল্পের বীজ গ্রাম প্রদর্শনী।
৪০ কেজি বীজ, পাঁচ বস্তা ইউরিয়া, চার বস্তা পটাশ, তিন বস্তা ডিএপি ও ১০ বস্তা জৈব সার পেয়েছেন এসব কৃষক, যার বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। অথচ তাদের অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয় দেড় লাখ টাকা। তারা তাদের মোট বরাদ্দের ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ উপকরণ পেয়েছেন।
খোকন, মুখলেছদের মতো এমন শত শত কৃষককে এভাবেই নামেমাত্র উপকরণ দিয়ে প্রদর্শনী বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার।
তার অভিযোগ, ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ফ্রিপ প্রকল্পে কৃষকের ৯৯টি গ্রুপ গঠনের জন্য চার লাখ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে।
প্রতিটি গ্রুপের অনূকূলে পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা দেড় হাজার করে টাকা পান বলে জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, শুধু গ্রুপ গঠন থেকেই আত্মসাৎ করা হয়েছে তিন লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
ময়মনসিংহ প্রকল্প
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পেও ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমার বিরুদ্ধে।
২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একটি মডেল গ্রামের জন্য ২ লাখ ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। এরপর ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি মডেল গ্রামের জন্য বরাদ্দ আসে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
এ দুটি প্রদর্শনীতে বরাদ্দের ৪ লাখ ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করে কৃষি কর্মকর্তা একটিও বাস্তবায়ন করেননি বলে অভিযোগ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার।
পাঁচধা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান। পার্টনার প্রকল্পের কমিউনিটি বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি প্রদর্শনী, ময়মনসিংহ প্রকল্পের ভার্মি কম্পোস্ট, অনাবাদি প্রকল্পের পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী রয়েছে তার বাড়িতে। আবার ময়মনসিংহ প্রকল্পের মডেল গ্রাম প্রদর্শনীর বরাদ্দ দেখানো হয়েছে তার নামে।
সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে মডেল গ্রামের কোনো সাইনবোর্ড বা অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। তার দাবি, মডেল গ্রামের বরাদ্দটি তিনি পেয়েছেন, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অসুস্থতার কারণে করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শুরু করবেন।
সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়িতে থাকা অন্য প্রদর্শনীর সাইনবোর্ড সরানোর চেষ্টাও করেন এ কৃষক।
ময়মনসিংহ প্রকল্পের লতিকচু প্রদর্শনী করেছিলেন বেত্রাটী গ্রামের মিলন ভূঁইয়া। তার অনূকূলে ৩৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও এই প্রদর্শনীতে ১০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি পটাশ, এক বস্তা ডিএপি সার ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। মিলন যা পেয়েছেন তার বাজারমূল্য আনুমানিক ১ হাজার ২৪০ টাকা। মিলনের নামে প্রদর্শনীর সাইনবোর্ডটি আবার পাওয়া গেছে হৃদয় নামে আরেক লতিকচু চাষির বাড়িতে।
হৃদয়ের বাবা আবদুল হেকিম জানান, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাদের এই সাইনবোর্ডটি দিয়ে ছবি তুলেছেন।
এ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা আক্তারের দাবি, মিলনকে কোনো প্রদর্শনী দেয়া হয়নি।
সদর উপজেলার বাগপাড়া এলাকায় রফিকুল ইসলাম সৈয়দও করেছিলেন লতিকচুর প্রদর্শনী। ইউরিয়া, পটাশ, ডিএপি জাতের ৪০ কেজি সার আর ২ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়া আর কিছুই পাননি তিনি। অথচ তার অনূকূলে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার টাকা। বরাদ্দের ১০ শতাংশও পাননি এ কৃষক।
ময়মনসিংহ প্রকল্পের হলুদের প্রদর্শনী করেছিলেন কাশোরারচর এলাকার বাবলু মিয়া। তার অনূকূলে ২৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও তিনি পান বীজ কেনার জন্য ৪ হাজার টাকা, এক বস্তা জৈব সার, ১০ কেজি ইউরিয়া আর ১০ কেজি পটাশ।
৫০০ বস্তায় আদা চাষ প্রদর্শনী করেন সদর উপজেলার আগপাড়া এলাকার এমদাদুল হক রুবেল। কৃষি অফিস থেকে ২০ কেজি পটাশ, ২০ কেজি ডিএপি, ১৫ কেজি আদা আর ৩৫০টি বস্তা ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। অথচ এ কৃষকের অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৪৪ হাজার টাকা।
এ কৃষক বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যেগুলো করেছেন, সেগুলোতে সুফল পেলেও বিপাকে পড়েন প্রদর্শনী করে।
ফাহিমাঘনিষ্ঠ আবুল হাসেমের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ
২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর একটি কমিউনিটি বেজড ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপনের জন্য বরাদ্দ আসে ৭০ হাজার টাকা। সেটি বরাদ্দ দেয়া হয় কৃষি কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবুল হাসেমের শ্বশুরবাড়িতে।
এ আবুল হাসেম কৃষি কর্মকর্তার সব অনিয়মের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে অভিযোগ এক কর্মকর্তার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের ওই কর্মকর্তা জানান, অফিসে উচ্চমান সহকারী থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ আর্থিক ফাইল করেন আবুল হাসেম, যেটার কোনো বিধান নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিউনিটি বেজড ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপনের বিষয়টি স্বীকার করেন আবুল হাসেম।
অনিয়ম ও আর্থিক ফাইল করার বিষয়টি অস্বীকার করে দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে মিথ্যা হিসেবে আখ্যা দেন তিনি।
অনাবাদি প্রকল্প
অনাবাদি প্রকল্পে আরও বেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমার বিরুদ্ধে।
এ প্রকল্পের পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী করেছেন কাটাবাড়িয়া এলাকার আছমা খাতুন। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন জাতের সবজির বীজ আর একটি সাধারণ নেট ছাড়া তেমন কিছুই পাননি তিনি। তার দাবি, সব মিলিয়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকার মতো উপকরণ পেয়েছেন।
এ কিষাণীর অভিযোগ, বাগানে পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে বারবার কীটনাশক চেয়েও পাননি তিনি। আছমার প্রাপ্ত উপকরণের বাজারমূল্য মোট বরাদ্দের ২৫ শতাংশ।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় অনাবাদি প্রকল্পের মোট ৯৩২টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ আসে ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে পারিবারিক পুষ্টি বাগান ৪১৯টি আর পুষ্টি বাগান পুনঃস্থাপন ৫১৩টি।
উপ-সহকারী এক কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, এসব প্রদর্শনীতে আছমা খাতুনের মতো শত শত কৃষক/কিষাণীকে নামমাত্র উপকরণ দিয়ে বাস্তবায়ন করেন ফাহিমা।
পার্টনার প্রকল্প
চলতি বছরের ২৮ ফ্রেব্রুয়ারিতে আটটি এবং ৩ এপ্রিলে সাতটি (মোট ১৫) পার্টনার ফিল্ড স্কুলের জন্য ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে।
উপ-সহকারী এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, যেখানে কৃষকদের নাশতার জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ টাকা, সেখান থেকে নামেমাত্র বিস্কুট আর পানি খাইয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী
২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনীর জন্য ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। বছরের শুরুতে বরাদ্দ আসলেও কাজ শুরুই করেন অক্টোবর শেষ সাপ্তাহে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত প্রকল্পটিও আত্মসাৎ করার পাঁয়তারা করেছিলেন কৃষি কর্মকর্তা। পরে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বাস্তবায়ন শুরু করেন তিনি।
শহরের তারাপাশা এলাকার বাসিন্দা মারিয়াতুল কিপতিয়া পাপিয়া। বিগত তিন বছর ধরে নিজ উদ্যোগে মাশরুম উৎপাদন করছেন তিনি। অক্টোবরের শেষ দিকে কৃষি অফিস থেকে স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী বরাদ্দ পান তিনি। ২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি আসা প্রকল্পটির বরাদ্দ ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা হলেও এ কিষাণী পান আড়াই লাখ টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবেমাত্র ঘর নির্মাণকাজ শুরু করেছেন তিনি।
অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্য
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমা আক্তারের দাবি, দুটি মডেল গ্রাম বাস্তবায়ন করেছেন, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কৃষকের অসুস্থতার জন্য খানিকটা বিলম্ব হয়েছে।
বাস্তবায়িত মডেল গ্রামে সাইনবোর্ড আছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে।’
যদিও কৃষক জানিয়েছেন, তিনি এখনও সাইনবোর্ড পাননি।
মাশরুমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি চলমান প্রক্রিয়া। বাস্তবায়নে কোনো অনিয়ম হয়নি।’
তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও অভিযোগ পেয়েছেন। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য