পদ্মা সেতুর আদলে এবার পুকুরের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মিত সেতুটির দেখা মেলে পটুয়াখালী শহরের সার্কিট হাউসের সামনের পুকুরে।
শনিবার পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জনমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সেতুটি নির্মিত হয়েছে বলে জানা গেছে। সেতুটি দেখতে ভিড় করতে দেখা যায় স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। সেতুতে উঠে অনেকে তুলছেন সেলফি, আবার গোটা সেতুকেও ক্যামেরাবন্দি করছেন অনেকে।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে জানা যায়, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে শনিবার সকালে পুকুরের এই সেতুতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার যৌথ এই আয়োজনে অনেক মানুষ অংশ নেবেন বলে প্রত্যাশা করছেন সেতু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সেতু নির্মাণের দায়িত্বে থাকা গোবিন্দ ঘোষাল জানান, ২৪ জন মানুষের ছয় দিন সময় লেগেছে সেতুটি নির্মাণ করতে। শুক্রবার কাজ শেষ করে জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপর সেখানে আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ১৯টি স্প্যানের ওপরে নির্মাণ করা সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ ফুট। পানি থেকে ছয় ফুট উপরে সেতুতে নির্মাণ করা হয়েছে নমুনা রেললাইন। উপরে দুই পাসে ২০টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। সেতুটি আলোকিত ও দৃষ্টিনন্দন করতে বিভিন্ন রঙের লাইটিং করা হয়েছে।
এটি নির্মাণে ৪৮৫টি বাঁশ, ৫০০ ঘনফুট কাঠ এবং ১৫০টি প্লাইউড ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান সেতুর নির্মাতা গোবিন্দ।
সেতু দেখতে আসা শহরের মিঠাপুকুর পাড় এলাকার মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সময় ও সক্ষমতার অভাবে সরাসরি পদ্মার পাড়ে গিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে পারিনি। কিন্তু কাঠের এ সেতু, এর নিচের পিলার ও রেললাইনের অংশ দেখে মনে হয়, এ যেন হুবুহু পদ্মা সেতু।’
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে জেলাবাসীর কাছে স্মরণীয় করে রাখতে ব্যতিক্রম এই আয়োজন করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন:কলেজছাত্র মামুন হোসেনকে বিয়ে করার আট মাসের মাথায় শিক্ষক খাইরুন নাহারের মৃত্যু-ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মামুন-খাইরুন গত ১২ ডিসেম্বর বিয়ে করেন, তবে এর ছয় মাস পর জুলাইয়ে ঘটনাটি নিয়ে ফলাও করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। দুজনের ভিডিও সাক্ষাৎকারও টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এতে ‘টক অফ দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয় বিষয়টি।
খাইরুন নাহারের মরদেহ উদ্ধারের পর প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মামুন হোসেনকে আটক করা হয়েছে।
নাটোরের পুলিশ সুপার (এসপি) লিটন কুমার সাহা রোববার সকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষক ও ছাত্রের প্রেমের কাহিনি ছড়িয়ে পড়লে দুজনই বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন; কিন্তু সামাজিক, পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়।
‘তাদের বিয়ের পর বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে অনেক আলোচিত ও সমালোচিত হয়। মানসিক এ চাপের কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন কি না, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।’
পুলিশ সুপার বলেন ‘ভাইরাল হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনের বিরূপ মন্তব্যে খাইরুন নাহার এমনিতেই বিপর্যস্ত ছিলেন। এরপর মামুনের সঙ্গে দাম্পত্য কলহে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।’
খাইরুনের মৃত্যুতে সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনের নীতি ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অতি উৎসাহ এবং পাঠক আকর্ষণ তৈরিতে সংবাদমাধ্যম মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরকে ঝুঁকিতে ফেলছে কি না, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
সংবাদমাধ্যম-সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার সময় এসেছে। ‘ভাইরাল প্রতিবেদন’ করার প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে সংবাদমাধ্যমের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন।
বেসরকারি এখন টেলিভিশনের সম্পাদক তুষার আব্দুল্লাহর মতে, ‘যেখানে ভাইরালিজম থাকবে সেখানে জার্নালিজম হবে না।’ তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যম এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর গণমাধ্যম এক হয়ে গিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেমন খুশি তেমন লিখছেন, এখন সেটা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও হয়ে গেছে।
‘ব্যক্তি যা খুশি তাই করতে পারে, কিন্তু যখন একটা প্রতিষ্ঠান একটা খবর ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কিন্তু দায়িত্বশীলতার জায়গা নিশ্চিত করতে হয়। এখন আমরা যেটা করছি ওই যে লাইক ভিউ বিভিন্ন রেটিং। আমরা এখন জার্নালিজম করছি না, করছি ভাইরালিজম। যেখানে ভাইরালিজম থাকবে, সেখানে জার্নালিজম হবে না।’
তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষিকা তার ছাত্রকে বিয়ে করেছে এমন ঘটনা অতীতে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় হয়েছে। রসাত্মক কোনো বিষয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ রয়েছে। তারা (বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম) এটিকে পুঁজি করেই ব্যবসা করতে চেয়েছিল। এ খবর হয়তো সবাই ক্লিক করবে, তাহলে এটা মানুষ খাবে।
‘এই যে খাওয়া-দাওয়া, খবর তো খাওয়া-দাওয়ার জিনিস নয়। আমরা যেটা করছি যে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে বেশি ঝুঁকে পড়ছি। মানুষের বেডরুমে পর্যন্ত আমরা ঢুকে যাচ্ছি। যেখানে এ ধরনের ভাইরালিজম জনপ্রিয় হবে, সেখানে এ ধরনের ঘটনাই আমরা দেখতে থাকব।’
সংবাদভিত্তিক বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের বার্তাপ্রধান প্রভাষ আমিন মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা সংবাদ হওয়ার মতোই নয়।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন শিক্ষিকা তার ছাত্রকে বিয়ে করেছেন। এখানে তো আমি কোনো অপরাধ দেখি না। পাত্র বড় হতে হবে, পাত্রী ছোট হতে হবে, এমন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। স্ত্রীর বয়স কম হতে হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই। আমরা যুগ যুগ ধরে এটা তৈরি করেছি।’
তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম যে রিপোর্ট করেছে, আমি মনে করি এটা রিপোর্ট হওয়ার কোনো বিষয়ই না। একজন নারী ও পুরুষ ভালোবেসে বিয়ে করেছেন এটা নিউজের বিষয় নয়। প্রথম অপরাধ গণমাধ্যমের যে, তারা নিউজটা করেছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেটা হলো, আমি যখন ট্রলগুলো দেখছিলাম, তখন নিজেকে সেই নারীর জায়গায় ভাবছিলাম। এত ট্রল, এত গালিগালাজ, এত বিদ্রূপ নেয়ার মতো মানসিক শক্তি আমার আছে কি না। আমি নিজেও এটা নিতে পারতাম না। এটা খুবই অন্যায়, খুবই অন্যায়।’
সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠুর মতে, সংবাদ যেন কারও প্রাণসংহারের কারণ না হয় সেদিকে নজর দেয়া জরুরি।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সোসাইটিতে কোনো রকম ইমব্যালান্স যদি থাকে, সেখানে মিডিয়ার একটা ভূমিকা থাকে। কোনো নিউজ যেন কারও প্রাণসংহারের কারণ না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
‘কোনো নিউজের কারণে কেউ অপমানিত বা ক্ষুব্ধ বা লজ্জিত হচ্ছে কি না, সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। একটা জীবন শেষ হয়ে গেলে সেই নিউজের কোনো ভ্যালু থাকল না, এটা গুড জার্নালিজম নয়।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষিকা কম বয়সী ছাত্রকে বিয়ে করে এমন কোনো নিন্দনীয় কাজ করেননি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো তার টিচারকে বিয়ে করেছিলেন। সেটা যদি কোনো অন্যায় না হয়, সোসাইটিতে কোনো রিপারকেশন না থাকে, তাহলে আমার এখানে থাকবে কেন?
‘কোনো নিউজ করার ক্ষেত্রে এই সোশ্যাল ভ্যালুজগুলো আমাদের মাথায় রাখা দরকার। রেসপনসেবল জার্নালিজম করাটাই আসলে মুখ্য ব্যাপার।’
তবে খাইরুনের মৃত্যুর পেছনে সংবাদমাধ্যমের দায় মানতে রাজি নন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষিকার আত্মহত্যার পেছনে কেউ যদি মিডিয়ার প্রচারণাকে দায়ী করে, তবে সেটা ঠিক নয়৷ এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা ঠিকই ছিল। আমাদের দেশের কালচার সাধারণত পুরুষ-নারী সমবয়সী বা নারী পুরুষের তুলনায় কম বয়স হলে বিয়ে হয়। শিক্ষিকা ও ওই ছেলের বিষয়টা অন্যরকম ছিল। শিক্ষিকা ছেলেটির তুলনায় বয়সে অনেক বড় ছিলেন।
‘কুকুর মানুষকে কামড় দিলে নিউজ হয় না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড় দিলে নিউজ হয়। এখানে ঘটনাটি সে রকম ঘটেছে। এখানে গণমাধ্যমের কোনো দায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে কোনো নিউজ না দেয়া হলে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটা প্রচার হবেই। বর্তমান প্রযুক্তির বাস্তবতায় এগুলো লুকিয়ে রাখার সুযোগ নেই। প্রচারণার চেয়ে সামাজিক যে নর্মসগুলো, বিয়ে কেন, কীভাবে হয়েছিল সেগুলোর দিকে নজর দেয়া উচিত।’
প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদের পর এক সন্তানকে নিয়ে নিজ বাড়িতে থাকতেন খায়রুন। ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ২০২১ সালের ২৪ জুন মামুনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এর ছয় মাস পর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর কাজি অফিসে গিয়ে তাকে বিয়ে করেন খায়রুন।
খায়রুনের মৃত্যুর জন্য সংবাদমাধ্যমকে একক দায় দিতে চান না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনওয়ার হোসেন। তার মতে, এ জন্য রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থাও দায়ী।
ড. মোহাম্মদ আনওয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় এবং মিডিয়ার আসপেক্টে বাংলাদেশে প্রাইভেসি পলিসিটা কী? রাষ্ট্র এবং সমাজ দুইটার মাঝামাঝি জায়গা থেকে মিডিয়া বিষয়গুলো ডিল করার চেষ্টা করে। এখানে মিডিয়াকর্মীদের যে ট্রেনিংয়ের দরকার ছিল, অর্থাৎ ফিলোসোফিকাল জায়গাটা, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের ওপর নির্ভর করে।
‘সোশ্যাল, রাষ্ট্রীয় আর ইউনিভার্সিটি কারিকুলাম এগুলো মিলিয়েই মিডিয়ার রুলস। মিডিয়া সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এখানে মিডিয়ার কিছু ইন্টারেস্ট আছে। তারা তাদের… বাড়ানোর জন্য অনেক কিছু দেখে। যদি আমাদের একটা নর্ম গড়ে উঠত, তাহলে মিডিয়া অনেক কিছু প্রচার করতে চাইত না।’
তিনি বলেন, ‘এখানে ফেমিনিস্ট পার্সপেক্টিভ প্রাইভেসির জায়গাটায় কন্ট্রিবিউট করতে পারত। আর আমাদের ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট পার্সপেক্টিভ ওয়েস্টার্ন কনটেক্সট দ্বারা ডমিনেটেড। সেদিক থেকে এটাকে আইসোলেটেডভাবে না দেখে ব্রডার পার্সপেক্টিভে দেখা দরকার। এখানে মিডিয়াকে একক দোষ না দিয়ে বা কাউকে দোষারোপ না করে বৃহৎ পরিসের চিন্তা করা দরকার।
‘তবে যে সম্মানিত নারী ভিকটিম হলেন সেটা দুঃখজনক। আমরা তাকে প্রাইভেসির যে কমফোর্ট, সেটি দিতে পারিনি।’
ড. মোহাম্মদ আনওয়ার হোসেন বলেন, ‘এটা নিয়ে নিউজ করার জন্য প্রথমে আমাদের বোঝাতে হবে প্রাইভেসির জায়গাটাকে আমি কীভাবে ডিল করছি। ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট পার্সপেক্টিভ সেটাকে কীভাবে আমাদের শিখিয়েছে বা সোশ্যাল নর্মস তৈরির ক্ষেত্রে কী ধরনের রুল প্লে করে?
‘বা রাষ্ট্র প্রাইভেসিগুলোকে কীভাবে দেখে বা রেগুলেট করে- এসবের সংমিশ্রণেই বিষয়গুলো রেগুলেটেড হওয়া উচিত।’
আরও পড়ুন:বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমবে বলে মনে করছেন পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রিয়াজ খান।
তিনি বলেছেন, ‘নতুন গভর্নর মহোদয় এসে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠনে ব্যাংকগুলোর ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই নির্দেশনা মানলে, সঠিকভাবে এ-সংক্রান্ত সার্কুলার ব্যাংকগুলো অনুসরণ করলে আমরা আমাদের ব্যাংকব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারব। ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ সামনের দিনে কমে আসবে।’
নিউজবাংলাকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এই আশার কথা শুনিয়েছেন তারেক রিয়াজ খান।
২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পদ্মা ব্যাংকের নবযাত্রা হয়। নবজন্মের পর সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এ সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমেছে, মূলধন বেড়েছে। আমানত বেড়েছে কয়েক গুণ।
ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ ইক্যুইটি রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কাছে। ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক। এ বছরের শেষ নাগাদ বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটিতে আসছে বিদেশি বিনিয়োগ।
মহামারি করোনার ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ, মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা, খেলাপি ঋণ, নতুন গভর্নরের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপসহ ব্যাংক খাতের নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলছেন পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী তারেক রিয়াজ খান।
নিউজবাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রিয়াজ খান। ছবি: নিউজবাংলা
নিউজবাংলা: করোনা-যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নেই। করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংক খাত গ্রাহকদের সেবা দিয়েছে। সেই ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা এখন কেমন?
তারেক রিয়াজ খান: করোনার সময় সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিটা থেমে যায়নি। বিভিন্ন সময়ে লকডাউন দেয়া হয়। সব কিছু বন্ধ থাকলে পুরো সময় ব্যাংক খাতের কর্মীরা প্রচণ্ডভাবে এবং সাংঘাতিক একটা হেরোইক পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের অর্থনীতির পাশে থেকেছেন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারের বড় পদক্ষেপ ছিল প্রণোদনা প্যাকেজ। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা বাস্তবায়নে সব সময় সাপোর্ট দিয়েছে। এ জন্য আমি সাধুবাদ জানাই। প্রণোদনার সুফল প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়ার ফলে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা থেমে যায়নি।
করোনায় এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি, তৃতীয় ঢেউ চলমান। করোনা-পরবর্তী এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। গ্লোবাল ইকোনমিতে এটার প্রভাব পড়ছে। জ্বালানি তেল, খাদ্যপণসহ সব কমোডিটির মূল্যের ওপর বেশি প্রভাব পড়েছে।
সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। ফলে কৃচ্ছ্রসাধন করছে সবাই। আমাদের দেশেও কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে আমি মনে করি।
নিউজবাংলা: সারাবিশ্বে অস্থির ডলার বাজার। মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জ ও ব্যাংকগুলোতে চলছে পরিদর্শন কার্যক্রম। ডলার সাশ্রয়ে আমদানির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে আমদানি কমতে শুরু হয়েছে। আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে কি এর সুফল পাওয়া যাবে?
তারেক রিয়াজ খান: ডলারের যে সংকট হচ্ছে- এটা কমন ফেনোমেনা। কারণ আমদানি খরচ বেড়েছে। কমোডিটি প্রাইস বেড়েছে। আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি করতে হয়। কমোডিটি, ফুয়েল, এনার্জি প্রাইস ওভার না হলে ঘাটতি হতো না।
এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্যও পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। টাকা অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমদানি কমানোর জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এর সুফল আমরা পাচ্ছি।
ব্যাংক রেটের সঙ্গে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের পার্থক্য বেশি। কার্ব মার্কেটে বা মানি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো চড়া দামে ডলার বিক্রির কারণে আমাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আরও কঠোর হয়েছে। বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠানের লাভের আগে দেশের ভালো সবার মাথায় রাখতে হবে। দেশ ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকব।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলেছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে আমরা ভালো দিন দেখতে পাব। আমিও সে ব্যাপারে আশাবাদী।
নিউজবাংলা: ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার কারণে অনেকে ইচ্ছা করে ঋণ পরিশোধ করেন না। এই ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’দের থেকে ঋণ আদায় কি ধরণের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন।
তারেক রিয়াজ খান: খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ‘আগ্রাসী ব্যাংকিং’ শব্দটা মাঝে মাঝে আমরা ব্যবহার করি। আগ্রাসী ব্যাংকিং ও প্রুডেন্ট ব্যাংকিং-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রফেশনাল ব্যাংকারদের এ বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে।
আমরা অনেক ক্ষেত্রে বলছি, ঋণগ্রহীতারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাদের দোষ দেয়ার আগে নিজের কাঁধে দোষটা নিতে হবে। আমি কেন, ওই লোনগুলো এক্সটেন করছি, কেন আননেসাসারিলি নর্মস ও ক্রেডিটের যে স্ট্যান্টার্ডগুলো আছে, ক্রেডিট পলিসির যে গাইডলাইন আছে সেগুলো বাইপাস করে কেন আমরা একটা অসুস্থ প্রতিয়োগিতায় লিপ্ত?
ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি ও প্রফেশনাল ব্যাংকাররা যদি স্ট্রং হয়ে যায়, কঠিন একটা জায়গায় যদি চলে যায় যে, না আমরা আমাদের ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাব, দেশকে বাঁচাব তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের অবস্থা অনেক ভালো হবে।
সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপর যে খেলাপি ঋণ সেখানে বসে থাকলে হবে না। এর থেকে আলোর পথে এগোতে হবে। সেই পথে এগোনোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া পদক্ষেপের আবারও স্যালুট জানাই। কারণ সম্প্রতি ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠনে মাস্টার সার্কুলার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নির্দেশনার আলোকে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ অপারেশনাল না। নতুন গভর্নর এসে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠনে ব্যাংকগুলোর ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই নির্দেশনা মানলে, সঠিকভাবে সার্কুলার অনুসরণ করলে আমরা আমাদের ব্যাংকব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারব। ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ সামনের দিনে কমে আসবে।
পদ্মা ব্যাংক সম্পর্কে বলতে হয়, ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ব্যাংকটির নবজন্ম হয়েছে। এরপর থেকে আমাদের টিম খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনেছে। ৭৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ এখন ৬৭ শতাংশে নেমেছে। এ বছরে আরও ১০ শতাংশ কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের লোন রিকভারি ডিভিশনকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। রিকভারি রিলেশনশিপ অফিসার হিসেবে যারা ফ্রন্ট লাইনে আছেন তারা ছাড়াও হেড অফিসের মনিটরিং আরও জোরদার করা হয়েছে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে আমরা খেলাপি ঋণের কশাঘাত থেকে বেরিয়ে আসব।
নিউজবাংলা: নতুন গভর্নর যোগদান করার পর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো দুর্বল ১০ ব্যাংককে সবল করার উদ্যোগ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই না কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাক, যারা দুর্বল তাদের সবল করতে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আমানতকারীদের ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ধরে রাখতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ নতুন গভর্নরের নতুন এ প্রচেষ্টা আপনি কিভাবে দেখছেন?
তারেক রিয়াজ খান: নতুন গভর্নর মহোদয় যোগদানের পর ব্যাংক খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেগুলো খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। দিকনির্দেশনাগুলো খুব ইউনিক। আমাদের বর্তমানে ৬২টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি নয়, খেলাপি ঋণ, মূলধন পর্যাপ্ততার হারের দিকে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। ব্যাসেল-৩-এর গাইডলাইন অনুসরণ করে মূলধন সংরক্ষণের বিষয়ে যা বলা হয়েছে, অধিকাংশ ব্যাংক সেটা বাস্তবায়নে স্ট্রাগল (লড়াই) করে যাচ্ছে। কিন্তু চারটি প্রাইমারি ইন্ডিকেটরের (সূচক) ওপর বেজ করে ১০টি ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার, লিকুইডিটি, মূলধন সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা সঞ্চিতি- এ চারটি ইন্ডিকেটর ছাড়াও আরও কিছু সাব-ইন্ডিকেটর রাখা হয়েছে।
নতুন গভর্নর যে স্ট্রাটেজিক প্ল্যান নিয়েছেন, সেটা শুধু ব্যাংকগুলো বাঁচানোর জন্য নয়। এরা যেন আরও শক্তিশালী হয়, সে চেষ্টাও করছেন। এসব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করে কিছু ইন্ডিকেটরের ব্যাপারে উল্লেখ করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব তদারকি করবেন।
পদ্মা ব্যাংকে রেগুলেটর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অলরেডি তিনটি পলিসি সাপোর্ট দিয়েছে। যেমন- আমাদের ফিন্যানশিয়াল স্টেটমেন্ট রিস্ট্রাকচারিং করে দিয়েছে।দ্বিতীয়ত- ক্যাপিটাল রিস্ট্রাকচারিংয়ের ফলে পেইড আপ ক্যাপিটাল ফিরে পেয়েছি। তৃতীয়ত-রিভাইজড লিক্যুইডিটি ফ্রেমওয়ার্ক। এটার ফলে ব্যাংকে নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ সংরক্ষণের হারের (এসএলআর) ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু সুবিধা দিয়েছে। ফলে আমাদের লিক্যুইডিটির অনেক উন্নতি হয়েছে। রিভাইজড লিক্যুইডিটির ফলে আমরা এ মুহূর্তে মানি মার্কেটে নেট বরোয়ার না, নেট লেন্ডার। আমরা অন্যান্য ব্যাংককে লিক্যুইডিটি সাপোর্ট দিচ্ছি।
নিউজবাংলা: এখন দেশে অনেক ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এ সময়ে ব্যাংক খাতের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
তারেক রিয়াজ খান: আমাদের ব্যাংক খাত ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রাডিশনাল ব্যাংকিং দিয়ে আমরা বেশি দিন চালাতে পারব না। নতুন জেনারেশন ব্যাংকে যায় না। মোবাইল অ্যাপ-ইন্টারনেটে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। এ কম্পিটিশনে বেঁচে থাকা এবং নিজেকে সেভাবে গড়ে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ।
পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে অলরেডি কোর ব্যাংকিং সিস্টেম মাইগ্রেশন অ্যাপ্রুভাল পেয়েছি। পদ্মা ওয়ালেট ও পদ্মা ইন্টারনেট ব্যাংকিং পুরোপুরি ঢেলে সাজাচ্ছি। আমরা নিজেদের ভালোভাবে তৈরি করছি, আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে ডিজিটাল স্যাভিব্যাংকে পরিণত হওয়ার জন্য। এ প্রতিযোগিতায় পদ্মা ব্যাংক অবশ্যই টিকে থাকবে।
পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রিয়াজ খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক মৌসুমী ইসলাম। ছবি: নিউজবাংলা
নিউজবাংলা: পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
তারেক রিয়াজ খান: গ্রাহকের বলতে চাই, ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পদ্মা ব্যাংকের নবযাত্রা হয়েছে। ব্যাংকের ৬০ শতাংশ ইক্যুইটি হোল্ড করছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ। আমাদের শক্তিশালী পরিচালনা পর্ষদ আছে। এখানে ইনডিভিজ্যুয়াল কোনো ডিরেক্টর নেই। সবাই প্রাতিষ্ঠানিক ও নমিনেটেড। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নির্দেশে খুব তাড়াতাড়ি একটা এমওইউ করব। সেখানে অনেকে কী পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর এগ্রি করব। বেশ কিছু সাপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেয়েছি। এ বছরের শেষ নাগাদ পদ্মা ব্যাংকে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের (এফডিআই) মাধ্যমে ফরেন ইক্যুইটি ইনজেক্ট করে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থান আরও বাড়িয়ে নেব।
আমানতকারীদের উদ্দেশে বলতে চাই, ব্যাংকের কাছে আপনাদের যে টাকা জমা সেটা সম্পূর্ণ নিরাপদ। গত বছরের তুলনায় আমানত চার গুণ বেড়েছে এবং এটা হয়েছে আমানতকারীদের আস্থার কারণে। আমানতকারীদের এই আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্ষদ বদ্ধপরিকর।
আরও পড়ুন:তেলের দাম বাড়ানোর পর কেবল বেসরকারি পরিবহন কোম্পানি নয়, ভাড়ার নৈরাজ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানও। রাজউক পরিচালিত হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসের পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাসেও ঢাকায় বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ মিলছে।
যাত্রীরা নিত্যদিন ঠকছে। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে চাপে থাকা যাত্রীরা পরিবহনের ক্ষেত্রে যতটা ব্যয় করার কথা ছিল, তার চেয়ে বেশি দিতে বাধ্য হওয়ায় নগরবাসীর পকেটে টান পড়ছে আরও বেশি।
শুক্রবার মোহাম্মদপুর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত চলাচল করা বিআরটিসির ডবল ডেকার বাসগুলোতে বেশি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই রুটে ই-টিকিটিং পদ্ধতিতে ভাড়া আদায়ের কথা থাকলেও ভাড়া আদায়ে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে না। পুরোনো টিকিটের পেছনে টাকার অঙ্ক বসিয়ে যাত্রীদের দেয়া হচ্ছে।
বেশি ভাড়া নেয়ায় যাত্রীরা কথা বলতে গেলে টিকিট বিক্রেতা বলছেন, ‘এটাই নতুন ভাড়া।’
ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করার পর সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা এবং প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আড়াই টাকা।
অর্থাৎ কোনো বাসে চার কিলোমিটার গেলে একজন যাত্রী ভাড়া দেবেন ১০ টাকা। এরপর প্রতি কিলোমিটারের জন্য যোগ হবে আড়াই টাকা।
বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলো এই নিয়মের পরোয়া না করে পুরো রুটকে কিছুদূর পরপর চেক বানিয়ে ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। বিআরটিসির বাসে এই ওয়েবিল না থাকলেও জনগণের নির্ধারিত ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ রাখা হয়নি।
বিআরটিসি পরিবহনের বাস মোহাম্মদপুর থেকে তিতুমীর কলেজ পর্যন্ত ভাড়া নিচ্ছে ২৫ টাকা। বিআরটিএর হিসাবে এই পথে ৮ দশমিক ২০ কিলোমিটারে ভাড়া আসে ২০ টাকা ৫০ পয়সা। বেশি নেয়া হচ্ছে ৪ টাকা ৫০ পয়সা।
চার্টে ২১ টাকা, আপনারা ২৫ টাকা কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে টিকিট বিক্রেতা মো. হাসান বলেন, ‘চার্টে ২১ টাকা না, ২২ টাকা আছে।’
পরে চার্টের ভাড়া ২১ টাকা দেখালে তিনি বলেন, ‘দুই-চার টাকা ভাংতি কই পাব?’
ভাংতি দিতে পারবেন না তাই বলে ৪ টাকা বেশি নেবেন সবার থেকে? -উত্তরে হাসান বলেন, ‘আমি বেশি নিচ্ছি না।’
মহাখালী ওয়ারলেসের ভাড়াও নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। এই ভাড়ায় অবশ্য গুলশান-১ পর্যন্ত যাওয়া যাচ্ছে।
মোহাম্মদপুর থেকে মহাখালী ৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার। ভাড়া আসে ১৮ টাকা। তবে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা।
একই রুটের বিআরটিসির আরেকটি বাসে আসাদগেট থেকে বাড্ডা ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা। এই দূরত্বে বিআরটিএর চার্টে ভাড়া লেখা ২১ টাকা। ভাড়া বেশি নিচ্ছে ৯ টাকা।
টাউন হল থেকে মহাখালী ভাড়া নিয়েছে ২০ টাকা। তবে বিআরটিএর চার্টে এই দূরত্বে ভাড়া লেখা ১৫ টাকা।
আসাদগেট থেকে বাড্ডার ভাড়া চার্টে লেখা ২১ টাকা আপনি ৩০ টাকা কেন নিয়েছেন? উত্তরে ফজলে রাব্বি বলেন, না বেশি নিচ্ছি না।
পরে প্রমাণ দিলে তিনি বলেন, ‘ভাই ফেরত দিচ্ছি।’
টাউন হল থেকে ১৫ টাকার ভাড়া কেন ২০ টাকা নিয়েছেন- উত্তরে রাব্বি বলেন, পাঁচ টাকা ভাংতি নাই।
এ সময় বেশি টাকা যে যাত্রীর কাছ থেকে নিয়েছেন তিনি এসে বলছেন, কই তুমি তো আমার কাছ থেকে ভাড়া ২০ টাকা বলেই নিয়েছ।
তখন রাব্বি বলেন, ভাই ভাংতি ছিল না তাই ২০ টাকা নিয়েছি।
বাড়তি ভাড়া আদায়ের আরেক কৌশল
এই রাস্তার যাত্রী মো. সুজন বলেন, ‘অন্যদের মতো বিআরটিসিও ভাড়া বেশি নিচ্ছে। ভাড়া বাড়ানোর পর প্রথম দিন মোহাম্মদপুর থেকে আমতলী ২৫ টাকা ভাড়া নিয়েছে। আজকে নিয়েছে ২০ টাকা। ১২ টাকা, ১৮ টাকা, ২৩ টাকা, ২৭ টাকা এ রকম খুচরা টাকাকে তারা রাউন্ড ফিগারে ভাড়া নেয়। ১২ টাকার ভাড়া ১৫ টাকা নেয়। ১৮ টাকার ভাড়া ২০ টাকা, ২৩ টাকার ভাড়া ২৫, ২৭ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পাশের দেশে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, যারা ভাড়া আদায় করে তাদের কাছে একটা ব্যাগ থাকে। সেখানে খুচরা পয়সা থাকে। তারা ১১, ১৩, ১৭, ২১ টাকা ভাড়া রাখে এবং বাকি খুচরা টাকা ফেরত দেয়।
‘কিন্তু আমাদের দেশে বেসরকারি থেকে শুরু করে সরকারি কোনো বাসেই খুচরা টাকা ফেরত দেয়া হয় না। তারা এক টাকা ভাড়া বাড়লে তার সঙ্গে ৪ টাকা যুক্ত করে রাউন্ড ফিগার করে নেয়।’
গাড়ির নম্বর চাইলেন বিআরটিসি চেয়ারম্যান
বাড়তি ভাড়া নেয়ার বিষয়ে জানালে বিআরটিসি চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গাড়ির নম্বরসহ আমাকে দেন। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
সকল গাড়িতেই একই ভাড়া নিচ্ছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থেকে আমরা ই-টিকিটিং সিস্টেমে ভাড়া নেই।’
ই-টিকিটিং পদ্ধতিতে তারা ভাড়া নিচ্ছে না। পুরোনো টিকিটের পেছনে ভাড়ার অঙ্ক লিখে ভাড়া আদায় করছে- এমন তথ্য জানালে তিনি বলেন, ‘আপনি বলেছেন যেহেতু আমরা কালকেই অ্যাকশন নেব। সকালেই আমাদের অপারেশন অফিসার পাঠাচ্ছি।’
যাত্রী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি অতিরিক্ত ভাড়া নেয়, অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাতে আরও উৎসাহিত হয়। বিআরটিসি বাস বেশির ভাগই লিজে চলছে। লিজ প্রথা বাদ দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চালনোর অনুরোধ করব।’
তিনি বলে, ‘লিজ যারা নিচ্ছেন, তারা অবশ্যই মুনাফা করছেন। এই মুনাফাটা যদি যাত্রীদের মধ্যে বণ্টন করা যায় তাহলে বিআরটিসি নিজে এবং জনগণ উভয়েই লাভবান হবেন। তাতে বিআরটিসি একটা মডেল হিসেবে দাঁড়াতে পারে।’
আরও পড়ুন:সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতি কিলোমিটারের বাসভাড়া আড়াই টাকা হিসাব করে ন্যূনতম ১০ টাকা করলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
ওয়েবিলের নামে কালশী থেকে জোয়ারসাহারা পর্যন্ত ভাড়া ২৫ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এই পথের দূরত্ব ৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সরকারি হিসাবে ভাড়া আসে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা। আইন অনুযায়ী ১১ টাকা নেয়া সম্ভব নয় বিধায় নিতে হতো ১০ টাকা। ফলে এই গন্তব্যেও যাত্রী ঠকছে ১৫ টাকা।
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে উত্তরার কামারপাড়া রুটে চলাচল করে প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহন। তাদের ভাড়ায় এমন চিত্র দেখা গেছে। এই বাসগুলোতে একটি চেকে সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ২৫ টাকা।
নির্ধারিত চেকের আগে উঠলে যাত্রী যেখানেই নামুক, তাকে এই পরিমাণ ভাড়া দিতেই হবে। তবে এমন নয় যে, সেই চেকের পর পরবর্তী চেক পর্যন্ত পুরো ভাড়াই আদায় করা হয়। আবার এমনও না যে, দুই চেকের মধ্যে দূরত্ব ১০ কিলোমিটার, যার ভাড়া বর্তমান হারে ২৫ টাকা হয়। দূরত্ব প্রায় অর্ধেক।
মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর বাংলা কলেজ পর্যন্ত ৫.৩ কিলোমিটার দূরত্বে যাত্রী যেখানেই নামুক না কেন ভাড়া দিতে হবে ২৫ টাকা। অথচ সরকারি হিসাবে এই পথের ভাড়া আসে ১৩ টাকা ২৫ পয়সা। ভাড়ায় এখন আর পয়সার ব্যবহার নেই বলে সেটা সর্বোচ্চ নেয়া সম্ভব ১৩ টাকা। কারণ আইন অনুযায়ী ভোক্তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবামূল্যের কম নেয়া গেলেও বেশি নেয়া সম্ভব নয়।
এই হিসাবে এই গন্তব্যে একজন যাত্রীর কাছ থেকে বেশি নেয়া হচ্ছে ১২ টাকা। আর কিলোমিটারপ্রতি আড়াই টাকার বদলে ভাড়া পড়ছে ৪ টাকা ৭১ বয়সা। এই ২৫ টাকায় অবশ্য মিরপুর ১ ও ১০ নম্বরেও যাওয়া যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ভাড়ার হার কিছুটা কম পড়লেও তা সরকার নির্ধারিত হারের দেড়গুণেরও বেশি।
মিরপুর-১ বা ১০ বা ১১ থেকে বাসে উঠে কেউ বিমানবন্দর সড়কে যেতে চাইলে আবার এভাবে ঠকতে হয়। কালশীতে একটি চেক বসিয়েছে। সেটি পার হলেই ভাড়া দিতে হচ্ছে ৩৫ টাকা। আর কালশী চেক থেকে খিলক্ষেত গেলে ভাড়া দিতে হচ্ছে উত্তরা পর্যন্ত পুরো গন্তব্যের, যদিও খিলক্ষেত থেকে দূরত্ব কমসে কম সাত কিলোমিটার।
খিলক্ষেতের যাত্রীরা পুরো পথের ভাড়া দিতে না চাইলে তাদের নামতে হবে জোয়ারসাহারা পর্যন্ত। তবে সেখানে যাত্রী নামে কমই। ইচ্ছা করেই এমন একটি জায়গায় চেক বসানো হয়েছে, যেখানে যাত্রীর উঠানামা কম। কেবল এক কিলোমিটারের জন্য বাড়তি ১৫ টাকা আদায় করা হয়।
আবার পুরো পথের ভাড়া নিলেও মাঝে যাত্রী উঠানামা করা হয় না, এমন নয়। কালশীর পর পুরো পথে যেখানেই যাত্রী হাত তোলে, বাস ফাঁকা থাকলে সব জায়গায় থামে বাস, আর ইসিবি চত্বরে পুরো একটি স্টপেজ আছে। কিন্তু যাত্রী সেখানে নামলেও তাকে ভাড়া দিতে হবে কমসে কম জোয়ারসাহারা পর্যন্ত। অথচ এর পরে আরও একটি স্টপেজ আছে এমইএইচে।
এটি অবশ্য কেবল এই দুটি পরিবহন কোম্পানির চিত্র নয়, রাজধানীতে বছরের পর বছর ধরে প্রায় প্রতিটি পরিবহন কোম্পানি এই প্রতারণা করে আসছে। এমনকি এ থেকে বাদ নয় সরকারি সংস্থা রাজউক পরিচালিত চক্রাবাস বাস, যেটি বলে হাতিরঝিলে। বরং ইজারাদারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে রাজউক জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করছে। আর থেকেই দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা এই বাসে এবার আরও বেশি আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু নগরবাসীর স্বার্থ দেখার দায়িত্ব যাদের, তারা পুরোপুরি চুপ।
গত নভেম্বরে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর নগরীকে বাসভাড়া কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করার পর ভাড়ার এই প্রতারণার প্রমাণ পেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ ২৫টি বাস কোম্পানির রুট পারমিট বাতিলের সুপারিশ করলেও তা কার্যকর হয়নি।
কোম্পানিগুলো সে সময় মুচলেকা দেয় যে, তারা বাড়তি ভাড়া আদায় করবে না। কিন্তু বাড়তি ভাড়াই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তেলের দাম এবার লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর সেই বাড়তির ওপর আরও বাড়তি আদায় করা হচ্ছে। বিভিন্ন গন্তব্যে দেখা গেছে, বর্তমান হারের চেয়ে বেশি আদায় করা হচ্ছিল আগে থেকেই, এবার নেয়া হচ্ছে আরও বেশি।
বাস ভাড়ার এই প্রতারণার প্রমাণ হাতেনাতে দেখে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ কথা বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। এরপর মন্ত্রী তার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে আইন মেনে চলার জন্য বাস কোম্পানির সুমতির ওপর ভরসা করার কথা বলেছেন। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন তারা।
তবে এমন হুঁশিয়ারি গত নভেম্বরেও এসেছিল। ব্যবস্থা আসলে নেয়া হয়নি। আর বিআরটিএ কর্মকর্তারা এবার গণমাধ্যমকে এড়াচ্ছেন। সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার থেকে অন্য কর্মকর্তাদের বারবার ফোন করলেও কেউ সাড়া দিচ্ছেন না।
গতবারের মতোই সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলেছে, বৃহস্পতিবার থেকে বাস ওয়েবিলে চলবে না। যাত্রীরা ভাড়া দেবেন কিলোমিটার হিসেবে।
এই ঘোষণা বাস্তবায়নের দিন প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহন দুটিকে দেখা যায় অবৈধ ওয়েবিলে ভাড়া নিতে।
পরিস্থানের বাসের যাত্রী মো. সুমন বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থেকে আমি বাংলা কলেজ যাব। স্টুডেন্ট ভাড়া দিয়েছি ১০ টাকা। বাসে যিনি টাকা উঠাচ্ছেন তিনি আমার কাছে আরও পাঁচ টাকা দাবি করেন। আমি দিতে না চাইলে জোর করেন।’
বাসে ভাড়া কাটার দায়িত্বে থাকা আল-আমিন বলেন, ‘সব বাসে ওয়েবিল বন্ধ হলেও প্রজাপতি, পরিস্থান ও বসুমতিতে ওয়েবিল চলে।’
বাংলা কলেজের ভাড়া ২৫ টাকা কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে আল-আমিন বলেন, ‘এই পথে একটা ১৩ টাকা ও একটা ১২ টাকার চেক আছে।’
প্রজাপতি বাসে আসাদ গেট থেকে বাংলা কলেজের ভাড়া নিচ্ছে ২০ টাকা। চার কিলোমিটারের এই পথে ভাড়া আসে ১০ টাকা। বেশি নিচ্ছে ১০ টাকা। অর্থাৎ দিগুণ হারে দিতে হচ্ছে যাত্রীদের।
প্রজাপতি বাসের যাত্রী আল নাহিয়ান বলেন, ‘প্রজাপতি বাস মিরপুর-১ নম্বর থেকে টোলারবাগ পার হলেই দেড় কিলোমিটার পথে ১৫ টাকা ভাড়া রাখে। এই ভাড়ায় আসা যায় কলেজগেট পর্যন্ত। ভাড়া আগে ছিল ১০ টাকা। এখনও ওয়েবিলে চলতেসে। মিরপুর রোডের ম্যাক্সিমাম গাড়ির এখনও ওয়েবিল চালু।’
দিগুণ ভাড়া কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে ভাড়া কাটার দায়িত্বে থাকা মো. হাফিজ বলেন, ‘আমি জানি না, চেকারকে জিজ্ঞাসা করেন।’
দারুসসালাম পয়েন্টের প্রজাপতি বাসের চেকার মো. জালাল বলেন, ‘আমাদেরকে মালিক পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয় নাই। তারা আগে যেভাবে বলছে সেই ভাবে ভাড়া নিচ্ছি।’
আরও পড়ুন:বাসভাড়া নিয়ে রাজধানীতে যে নিত্য প্রতারণা চলছে, তার বাইরে নয় সরকারি সংস্থা রাজউক পরিচালিত বাসও।
রাজধানীর হাতিরঝিলে চক্রাকার যে বাস পরিচালনা করা হয়, তাতে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর নির্ধারণ করে দেয়া হারের আড়াই গুণের বেশিও ভাড়া আদায় করা হয়। বিআরটিএ সর্বনিম্ন যে ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে, রাজউকের কোম্পানি আদায় করে তার দ্বিগুণ।
রাজউক নিজে অবশ্য এই বাস পরিচালনা করে না। অর্থের বিনিময়ে ইজারা নিয়েছে কোম্পানি। আর ইজারাদারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে উপেক্ষা করছে জনগণের স্বার্থ।
বিআরটিএর হারের দ্বিগুণের বেশি ভাড়া আদায়ের পেছনে এক রাজউক কর্মকর্তার দাবি, তাদের বাসযাত্রী পরিবহনের সাধারণ বাহন নয়, এটি পর্যটন সংশ্লিষ্ট। ফলে বেশি ভাড়া আদায় করা যায়। অথচ এই বাসে ঢাকার লোকাল যেকোনো বাসের মতোই দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করা হয়। আর পর্যটন নয়, হাতিরঝিলের এক পাশ থেকে অপর পাশে যাতায়াতের জন্যই যাত্রীরা বাসটি ব্যবহার করে।
রাজধানীর হাতিরঝিলে চক্রাকার যে বাস পরিচালনা করা হয়, তাতে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর নির্ধারণ করে দেয়া হারের আড়াই গুণের বেশিও ভাড়া আদায় করা হয়। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
২০১৬ সালে এই সড়কে যাত্রী পরিবহনে ১০টি মিনিবাস চালু হয়। বর্তমানে চলছে ২০টি। ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে সেগুলো।
এইচআর ট্রান্সপোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান রাজউকের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে চালাচ্ছে এগুলো।
গত নভেম্বর এবং চলতি আগস্টে তেলের দাম দুই দফা বাড়ানোর পর বাসের ভাড়া দুই দফা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে ফেলা হয়েছে। অথচ দুইবার বাড়ানোর পর যে বাসভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভাড়া আগেই আদায় করা হতো।
২০১৬ সালে রাজধানীর হাতিরঝিলে যাত্রী পরিবহনে ১০টি মিনিবাস চালু হয়। বর্তমানে চলছে ২০টি। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে সেগুলো। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
দূরত্ব, বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া- কোনো কিছুই খাটে না এখানে
গত শুক্রবার লিটারে ৩৪ টাকা করে ডিজেলের দাম বাড়ানোর পরদিন বিআরটিএ রাজধানীতে প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া আড়াই টাকা নির্ধারণ করে জানায়, সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ১০ টাকা। অর্থাৎ চার কিলোমিটার যাওয়া যাবে এই ভাড়ায়। এরপর প্রতি কিলোমিটার হিসেবে যোগ হবে আরও আড়াই টাকা করে।
কিন্তু নিউজবাংলা হিসাব করে দেখেছে, হাতিরঝিলে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কিলোমিটার প্রতি ৬ টাকারও বেশি হারে।
এফডিসি কাউন্টার থেকে রামপুরা পর্যন্ত ৪ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরত্বে এখানে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। প্রতি কিলোমিটার ভাড়া পড়ছে ৫ টাকা ৯৫ পয়সা।
এত দিন আদায় করা হতো ২০ টাকা। তখন কিলোমিটার পড়ত ৪ টাকা ৭৬ পয়সা। তাতেও পোষেনি ইজারাদারের।
অথচ বিআরটিএর বেঁধে দেয়া হিসেবে ভাড়া আসে ১০ টাকা ৫০ পয়সা। এই হারের চেয়ে বেশি নেয়া সম্ভব নয় বিধায় যাত্রীদের আসলে ১০ টাকায় চলাচল করার কথা ছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ১০ টাকায় বাসে ওঠারই জো নেই। প্রথম যখন বাস চালু করা হয়, সে সময়ই এই পথের ভাড়া ঠিক করা হয় ১৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল ১০ টাকা।
এরপর নভেম্বরে সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করা হয় ১৫ টাকা, এবার ঠিক করা হয়েছে ২০ টাকা।
এই ২০ টাকায় কত দূর যাওয়া যায়?
এফডিসি বাসস্টপ থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার আর পুলিশ প্লাজা থেকে রামপুরা পর্যন্ত আরও ১ দশমিক ১ কিলোমিটারের জন্যও এই ভাড়া ঠিক করা হয়েছে।
বিআরটিএ সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা ঠিক করে না দিলে প্রথম গন্তব্যে সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়া উচিত ছিল ৭ টাকা ৭৫ পয়সা এবং দ্বিতীয় গন্তব্যে হওয়া উচিত ছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা।
কিন্তু এখন এফডিসি থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত ভাড়া পড়ছে ৬ টাকা ৪৫ পয়সা হারে, আর পুলিশ প্লাজা থেকে রামপুরা পর্যন্ত ১৮ টাকা ১৮ পয়সা হারে।
রামপুরা থেকে মধুবাগ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটারের জন্যও আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা, যা আগে ছিল ১৫ টাকা।
আগে ভাড়ার হার ছিল ৪ টাকা ১৬ পয়সা, এখন হয়েছে ৫ টাকা ৫৫ পয়সা।
শুরু থেকেই হাতিরঝিলের চক্রাকার পুরো পথ যাওয়ার সুযোগ ছিল। একেবারে শুরুতে ঠিক করা হয় ৩০ টাকায় যাওয়া যাবে ৭ দশমিক ৪ কিলোমিটারের এই পথ। দুই বার ৫ টাকা করে বাড়িয়ে এখন তা করা হয়েছে ৪০ টাকা।
প্রতি কিলোমিটার ভাড়া পড়ছে ৫ টাকা ৪০ পয়সা হারে।
ভাড়া বাড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ, নেই কারও সই
গত মঙ্গলবার থেকে বাড়তি ভাড়া কার্যকর করা হয়েছে। কাউন্টারের সামনে একটি তালিকা টানানো হয়েছে ভাড়া বাড়ানোর। নিচে লেখা আছে ‘কর্তৃপক্ষ’। তবে এই কর্তৃত্ব কার তা জানা যায়নি, কারণ, কোনো কর্মকর্তার সই নেই।
এফডিসি বাস স্টপেজের টিকিট বিক্রেতা মাসুদ করিমকে ১৫ টাকা দিয়ে পুলিশ প্লাজার টিকিট দিতে বলা হলে তিনি বলেন, ‘১৫ টাকার কোনো টিকিট নেই, ২০ টাকা।’
এরপর তিনি ভাড়া বাড়ানোর বিজ্ঞপ্তি দেখতে বলেন। বিজ্ঞপ্তিতে কারও সই না থাকার বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ‘এইটাই। গেলে ২০ টাকা দেন।’
যাত্রীরা রাগে গজ গজ করতে করতে টিকিট কাটছিলেন আর একজন আরেকজনের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে থাকেন, বলতে থাকেন, কোন যুক্তিতে এইটুকু পথের জন্য এত ভাড়া হয়।
আবার বাড়তি ভাড়া নেয়া হলেও টিকিট দেয়া হচ্ছে আগের হারের। সেই টিকিটে একটা সিল দেয়া হয়েছে কেবল। এ নিয়ে টিকিট বিক্রেতার মন্তব্য দায়সারা গোছের।
কখনও চলেনি বিআরটিএর অভিযান
জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর গত নভেম্বরে বাস ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়ার পর বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে বিআরটিএ রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে যে অভিযান চালায়, তখন বাদ পড়ে হাতিরঝিলের চক্রাবাস বাস।
এবার যখন বাড়তির ওপর আরও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, তখনও বিআরটিএ এই পথের বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।
গতবার বাসভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের বিষয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ফোন দিলে তারা কথা বলতেন। এবার কোনো ফোনই তারা রিসিভ করছেন না। একবার বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার কল রিসিভ করার পর তিনি এসএমএস করতে বলেন। বাসভাড়ায় নৈরাজ্য এবং বিআরটিএর কার্যত ঘুমিয়ে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন লিখে পাঠানো হলে তিন দিনেও তার জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি।
সুপারভাইজারের দাবি, এই জগত ভিন্ন
নির্ধারিত হারের দ্বিগুণের বেশি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে লাইন সুপারভাইজার শওকত হোসেনের বক্তব্য বিবেচনায় নিলে বলতেই হয়, হাতিরঝিল একটি ভিন্ন জগৎ। এখানে সরকারের করা নিয়মকানুন খাটে না। তারা যা বলবে, সেটিই বিধান।
তিনি বলেন, ‘বাইরের ভাড়ার সঙ্গে এখানের ভাড়া কমপেয়ার করলে হবে না। এই গাড়িগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। এটা হাতিরঝিল প্রজেক্টের গাড়ি। এটা টুরিস্ট বাস হিসেবে চলে।’
বাইরের বাসের সঙ্গে এই বাসের সার্ভিসের কী পার্থক্য- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাতিরঝিলে টুরিস্ট বাস হিসেবে বরাদ্দ।’
যাত্রীরা তো দাঁড়িয়ে যায় আপনাদের বাসে। তাহলে বেশি ভাড়া কেন নিচ্ছেন- উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে প্রজেক্ট এইভাবেই চুক্তিবদ্ধ।’
ভাড়ার চার্টে বিআরটিএ বা রাজউকের কোন স্বাক্ষর নাই। কীভাবে বুঝব আপনারা প্রতারণা করছেন না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনার তো অপশন আছে। আপনি রাজউকের কাছে যান।’
এইচআর ট্রান্সপোর্টের ফিল্ড অফিসার মাসুদ করিমও বলেন, ‘আপনি রাজউকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’
বিআরটিএ বা রাজউকের সই ছাড়া এই চার্ট কেন ভিত্তিহীন ধরা হবে না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজউক স্বাক্ষরিত যে চার্ট, সেটা অফিসে আছে।’
তবে রাজউকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। ফলে তারা কোনো নতুন চার্ট তৈরি করে দেননি।
এই বিষয়টি জানালে মাসুদ করিম বলেন, ‘তাহলে আমি জানি না। আপনি রাজউকে যোগাযোগ করেন।’
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন) এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে রাজউকের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু রাজউক তো অনুমোদন দেয় নাই এখনও।’
রাজউকের অনুমোদন ছাড়া কি বাড়তি ভাড়া নিতে পারে?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজউক অনুমোদন দেবে না দেবে না, সে জন্য তো তেলের দাম বাড়া বসে থাকে না। আমরা স্বাক্ষর দিয়ে দেব।’
তাহলে আপনাদের কথাতেই তারা ভাড়া বাড়িয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা বলতে যাব কেন। তারা তাদের হিসেবে বাড়িয়েছে।’
সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার দুই গুণের বেশি ভাড়া নিচ্ছে তারা। আপনাদের হিসাব কীভাবে হয়- এমন প্রশ্নে রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, ‘এখানে কিলোমিটার ধরে ভাড়া নিচ্ছে না তো। এখানে কিলোমিটারের হিসেব চলে না।’
‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে এমন নৈরাজ্য হলে অন্যরা করবেই’
যাত্রী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন সরকারের বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে ভাড়ার নৈরাজ্য হয় তখন নগরীর অন্য বাসগুলো আরও সুযোগ নিতে চায়। আমি মনে করি রাজউকের এখানে দায়বদ্ধতা আছে, বিআরটিএ এর দায়বদ্ধতা আছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের দায়বদ্ধতা আছে।’
আরও পড়ুন:ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর পুতিনের ক্ষমতা ধসে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল পশ্চিমা বিশ্ব। তবে ছয় মাস পর উল্টো ফল দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া জ্বালানি গ্যাস ও তেলের জোগান কমিয়ে দিয়ে ইউরোপকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গে এক নিবন্ধে জ্বালানি ও পণ্যবিষয়ক প্রতিবেদক হাভিয়ের ব্লাস লিখেছেন, চলমান লড়াইয়ে পুতিনের জয়কে নিশ্চিত করছে দেশটির বিপুল জ্বালানি সক্ষমতা। নিবন্ধটি ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।
যেভাবেই দেখা হোক না কেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জ্বালানি বাজারে জিতে যাচ্ছেন। মস্কো তেলের খনি থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার আয় করছে। এই মুনাফা তারা ইউক্রেনে সামরিক অভিযান ও নিজ দেশে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন অর্জনের পেছনে খরচ করছে।
রাশিয়ান বাণিজ্যের ওপর নভেম্বরে ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা শুরু হলে জ্বালানি সংকট নিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে ভোক্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়তে পারে।
জ্বালানি তেলের বাড়তি চাহিদার কারণে পুতিন ইউরোপে গ্যাসের সাপ্লাই কমিয়ে দেবেন। এর ফলে অক্টোবর থেকে ঘরে ও অফিসে বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে যাবে। যুক্তরাজ্যে দাম বাড়বে প্রায় ৭৫ শতাংশ আর জার্মানিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়বে শতভাগেরও বেশি।
জ্বালানিকে রাশিয়া সাফল্যের সঙ্গে অস্ত্রে পরিণত করেছে। পশ্চিমা সরকারগুলো গৃহস্থালি খরচের ভর্তুকি দিতে শত শত কোটি ডলার খরচের চাপে পড়বে। এ সমস্যা নিয়ে ফ্রান্স এরই মধ্যে সমস্যায় পড়েছে।
তীব্র জ্বালানি সংকট
পুতিন যেভাবে জ্বালানি তেলের সুবিধা নিজের দিকে ঘুরিয়েছেন তা রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। গত মাসে দেশটির উৎপাদন যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ব্যারেল উৎপাদন হচ্ছে, যা ইউক্রেন আক্রমণের ঠিক আগে জানুয়ারিতে উৎপাদিত ১ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল থেকে সামান্য কম। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত তেলের উৎপাদন ওই হারের চেয়েও বেশি।
এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। জুলাইয়ে টানা তৃতীয় মাসের মতো তেলের উৎপাদন আগের অবস্থায় ফিরেছে। চলতি বছর এপ্রিলে ইউরোপীয় দেশগুলো তেল কেনা বন্ধ করে দেয়ার পর উৎপাদন ১ কোটি ব্যারেলে নেমে এসেছিল। মস্কো তখন বাধ্য হয়ে নতুন ক্রেতা খোঁজায় মনোযোগী হয়।
উৎপাদন আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া
মার্চ ও এপ্রিলে রাশিয়ার তেলের উৎপাদন দ্রুত কমে যায়। তবে এখন তা ইউক্রেন আক্রমণের আগের অবস্থার কাছাকাছি পর্যায়ে ফিরে এসেছে।
ইউরোপীয় দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার পর তাদের কাছে প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল বিক্রি করতে পারছিল না মস্কো। তবে এখন তারা নতুন ক্রেতা খুঁজে পেয়েছে।
রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড অয়েল) ক্রেতা এখন এশিয়া, বিশেষ করে ভারত। মধ্যপ্রাচ্য ও তুরকিয়েকেও তারা নতুন ক্রেতা হিসেবে পেয়েছে। ইউরোপেও নভেম্বরে আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞার আগে কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনেছে।
যারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, রাশিয়ার তেলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় সূচকটি হলো, রাশিয়ান তেলের দাম। প্রাথমিকভাবে মস্কো ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন দেশের কাছে বিশাল ছাড়ে অপরিশোধিত তেল বিক্রি করেছে। এরপর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ক্রেমলিন একটি আঁটসাঁট বাজারের সুবিধা নিয়ে মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে।
নতুন এ ধারার ভালো উদাহরণ হচ্ছে ইএসপিও ক্রুড। এটি বিশেষ এক ধরনের তেল, যা রাশিয়ার দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসে। এ বছরের শুরুর দিকে এটি এশিয়ার তেলের বেঞ্চমার্ক দুবাই ক্রুডের কাছে ব্যারেল প্রতি ২০ ডলারের বেশি ছাড়ে বিক্রি করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি ইএসপিও ক্রুড অয়েল দুবাইয়ে তেলের সমতায় পরিবর্তন এনেছে।
রাশিয়ার মধ্যবর্তী ও ইউরোপের নিকটবর্তী উরাল অঞ্চলের ক্রুড অয়েল ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত মস্কো। এখন আর উরাল ক্রুড অয়েল থেকে ইএসপিওর মতো লাভ হচ্ছে না। কারণ এর মূল ক্রেতা ঐতিহ্যগতভাবে জার্মানির মতো দেশ। তবে সম্প্রতি এর দামও আগের মতো হয়ে আসছে।
মস্কো নতুন পণ্যের বাজারও খুঁজছে। এসব বাজার মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় এবং যেখানে রাশিয়া অর্থায়ন করে। এরা রাশিয়ার ক্রুড অয়েল কিনতে ও চাহিদার বাজারে পাঠাতে ইচ্ছুক। ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি থাকা ও রাশিয়া বিপুল ছাড় দিতে সক্ষম হওয়ায় ক্রেমলিনে প্রচুর অর্থ আসছে। ফলে আপাতত জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা কাজ করছে না।
রাশিয়ান সাফল্যের সবশেষ সূচকটি সরাসরি বাজার সম্পর্কিত নয়, সেটি রাজনৈতিক। মার্চ ও এপ্রিলে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের আশা ছিল, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বে ওপেক রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। অথচ বাস্তবে উল্টোটা ঘটেছে।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রিয়াদ সফরের পরেও পুতিন ওপেক প্লাস জোটে তার প্রভাব বজায় রেখেছেন। বাইডেন সৌদি আরব থেকে চলে যাওয়ার পরপরই ওপেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী মূল ব্যক্তি রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক সৌদি আরবে যান। তার কয়েক দিন পর ওপেক বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারের ওপর চাপ বজায় রেখে তেলের উৎপাদন সামান্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়।
জ্বালানি বাজারে জয়ের অর্থ হল পুতিন ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি সীমাবদ্ধ করে বার্লিন, প্যারিস ও লন্ডনের ওপর চাপ সৃষ্টির সক্ষমতা রাখেন। এসব দেশ এবারের শীতে রেশনিং হতে পারে এমন খুচরা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও সম্ভাব্য ঘাটতির জন্য প্রস্তুত। মস্কো তেল বিক্রি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। এ জন্য রাশিয়া পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ সীমিত করে দিলেও বিশেষ ক্ষতির মুখে পড়বে না।
শীতল আবহাওয়া, বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বছরের শেষ দিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সব মিলিয়ে ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমাদের সমর্থন কমিয়ে দেয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ইউরোপীয় রাজনীতিকরা এতদিন কিয়েভের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্তর্জাতিক প্রশংসা পেতে আগ্রহী ছিলেন। এখন তারা ভোটারদের জ্বালানি সংকটে পড়া ঠেকাতে নিজের দেশে পণ্যমূল্য বাগে আনতে চাইবেন।
জনসমক্ষে ইউরোপীয় সরকারগুলো রাশিয়ান শক্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য দৃঢ়সংকল্পে অটুট। তবে গোপনে তাদের স্বীকার করতেই হচ্ছে, এমন অবস্থান অর্থনীতিতে আঘাতের হুমকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন:নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকার বাংলামোটরে এসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সজীব খান। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বাসভাড়া দিতেন ৪০ টাকা। তেলের দাম বৃদ্ধির পর ২০ টাকা বেড়ে সেই ভাড়া হয়েছে ৬০ টাকা।
অর্থাৎ আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ৪০ টাকা। তবে ব্যয় বৃদ্ধির এই হিসাবই শেষ নয়।
গুলিস্তান থেকে বাংলামোটরে আসা-যাওয়া করেন তিনি। আগে এই পথে ভাড়া নিত ১০ টাকা করে। চার কিলোমিটার পথের ভাড়া এখনও ১০ টাকাই হয়। কিন্তু বাসগুলো আদায় করছে ১৫ টাকা করে ৩০ টাকা।
অর্থাৎ এই পথেও ১০ টাকা মিলিয়ে প্রতিদিন সজীবের বাস ভাড়া বেড়েছে ৫০ টাকা। মাসে ২৬ দিন অফিস করলে বাড়তি ব্যয় করতে হবে ১ হাজার ৩০০ টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সবজি, মাছসহ অন্যান্য খাদ্যপণের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে সজীবকে।
তিনি বলেন, ‘মাসে বেতন ২৫ হাজার টাকা। এই বেতন নিয়ে এমনিতেই সংসারে টানাটানি অবস্থা। তার মধ্যে হঠাৎ করেই যদি বাস ভাড়াই ১ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয় বাড়ে, তাহলে জীবন ধারণ করাই কঠিন হবে।’
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। স্কুল, বাজার, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাস, নৌযান অর্থাৎ জ্বালানি তেলনির্ভর সব যানবাহনে বেড়েছে ভাড়া। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে অন্যান্য নিত্যপণ্যে।
করোনা-পরবর্তী বিশ্বে যখন নিত্যপণ্য ও জ্বালানির দামে ঊর্ধ্বগতি, এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা পৃথিবীকেই ফেলে দিয়েছে বিরাট অনিশ্চয়তার মধ্যে। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা, দেশে দেশে মুদ্রার দরপতনে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, তার সঙ্গে বেড়ে যাওয়া খরচের সঙ্গে যখন নাভিশ্বাস, সে সময় জ্বালানি তেলের দামে দিল লাফ।
ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা আর অকটেন-পেট্রলের দাম ৪৪ ও ৪৬ টাকা করে বাড়ানোর পর দেশে বাস ভাড়া বেড়েছে নগর পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ৩৫ পয়সা, দূরপাল্লায় ৪০ পয়সা।
কিন্তু ভাড়া আসলে যতটা হওয়ার কথা, আদায় চলছে তার চেয়ে বেশি। আবার ট্রাক ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি দর। আবার কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১ টাকা বাড়লে ছোট নোটের অভাবে আদায় হচ্ছে ৫ থেকে ১০ টাকা। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
কেউ শখ আহ্লাদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ সন্তানদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ ঘোরাঘুরি বাদ দিচ্ছে, কেউ আড্ডায় কম যাচ্ছে, কেউবা কম খাচ্ছে।
পরিবহন ব্যয়ে লাফ
মিরপুর-১ নম্বর থেকে নিজের মোটরসাইকেলে করে ফার্মগেটে বেসরকারি ব্যাংকে অফিস করেন বিল্লাল হোসেন। বাইকে ৫০০ টাকার তেল নিলে আগে ৬ থেকে ৮ দিন চলাচল করা যেত। এখন সেই পরিমাণ তেল কিনতেই ব্যয় হবে ৬৫০ টাকার বেশি। অর্থাৎ মাসে ব্যয় বাড়বে অন্তত ৬০০ টাকার বেশি।
বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘মাসের এই ব্যয় সমন্বয় করতে হবে অন্য কোনো চাহিদা বাদ দিয়ে। বেতন যেহেতু এক টাকাও বাড়েনি, তাই এই ব্যয় সমন্বয় করতে ইচ্ছার মৃত্যু ঘটাতে হবে।’
নিজের বাইক আছে বলে বিল্লালের খরচ তাও কিছুটা কম বেড়েছে। শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব মোড়ের অফিসে যাওয়া আলিম উদ্দিনের বেড়েছে আরও বেশি।
মাঝবয়সী এই ব্যক্তি জানান, বাসেই যাতায়াতের চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু যেখান থেকে তিনি বাসে চাপেন, সেখান থেকে ওঠাই কঠিন। মাসের অন্তত ২০ দিনই ব্যর্থ হন। এরপর উপায়ান্ত না দেখে বাইকে করে যান।
তিনি বলেন, ‘আগে বাইকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকায় যাওয়া যেত। কিন্তু এখন আড়াই শ থেকে ৩০০ টাকা চায়।’
আক্ষেপ করে আলিম উদ্দিন বলেন, ‘সর্বসাকল্যে বেতন পাই ৪২ হাজার টাকা। পথেই চলে যায় বড় অঙ্কের অর্থ। এর সঙ্গে দুই বাচ্চার স্কুলের ব্যয়, সংসারের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে চোখেমুখে অন্ধকার অবস্থা। বলেন, মাসের ২০ দিন রাইড শেয়ারে যেতে যদি ৫০ টাকা করে বেশি দিতে হয় তাহলে মাস শেষে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এই টাকার সংস্থান কোথা থেকে আসবে?’
ফার্মগেট থেকে মিরপুর ৬০ ফিট রোডের একটি স্কুলে এসে শিক্ষকতা করেন তৌহিদা আহমেদ। ফার্মগেট থেকে টেম্পোতে এতদিন ভাড়া ছিল ২০ টাকা। সেই ভাড়া ৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৬ টাকা।
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই করোনার কারণে স্কুলের বেতন কমিয়ে দিয়েছে, তার পরও আসা-যাওয়ায় এভাবে ব্যয় বাড়লে চাকরি করে লাভ কী?’
মিরপুর ৬০ ফিট রোডের পাকা মসজিদ থেকে মিরপুর-২ নম্বরের মণিপুর স্কুলের মূল শাখায় ছেলেকে টেম্পোতে নিয়ে এবং ফিরতে এতদিন শায়লা ইসলামের ব্যয় হতো ৪০ টাকা। জনপ্রতি ভাড়া ছিল ১০ টাকা। তেলের দাম বৃদ্ধির পর ভাড়া বেড়ে এখন হয়েছে ৬০ টাকা। জনপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে এখন ভাড়া হয়েছে ১৫ টাকা। অর্থাৎ সামান্য এই পথ যাতায়াতেই দিনে ব্যয় বেড়েছে ২০ টাকা। তাহলে মাসের ২৫ দিন স্কুলে যাওয়া আসায় ব্যয় বাড়ছে ৫০০ টাকা।
ব্যয় সামাল দিতে চাহিদায় কাটছাঁট
রাজধানীর নিকুঞ্জ নিবাসী পার্থ রায় বলেন, ‘মাসে দুই দিন মাংস খাওয়ার রেওয়াজ ছিল পরিবারে। কিন্তু এখন এক দিন খাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।’
তিনি বলেন, ‘নিকুঞ্জ থেকে মৌচাক পর্যন্ত যেতে বাস ভাড়া বেড়েছে। বাসে যাওয়া কঠিন হওয়ায় রাইড শেয়ারে যেতে হয়। সেখানেও বাড়তি ব্যয় করতে হবে।’
সংসারে ব্যয়ের খতিয়ান তুলে ধরে বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি খাবারের ব্যয় কমিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না।
তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি মাসে বাসা ভাড়া ৫০০ টাকা বেড়েছে। মে মাসে পানির বিল ৫০০ থেকে এক হাজার করেছে বাসার মালিক। সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য দিনে আগে ভাড়া লাগত ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এখন লাগে ৬০-৭০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই বাড়তি। অফিসে যাওয়া-আসা করতেও বাস ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু আয় দুই বছর আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। সংসার চালাতে এখন প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে।’
পরিত্রাণ কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা নেই। সংসারে পাঁচজন মানুষ। এখন খাওয়া কমিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় কী? আগে সপ্তাহে তিন দিন মাছ খেতাম, এখন সেটা এক দিন করতে হবে। ন্যূনতম পোশাক দিয়ে চলতে হবে। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।’
‘অনেক ব্যয় কাটছাঁট করে টিকে থাকতে হবে’
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমনিতেই মানুষ ব্যয়ের চাপে আছে, তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সামনে এসেছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বৃদ্ধিতে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘সীমিত আয়ের মানুষ, যাদের আয় নির্দিষ্ট তাদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে এত কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি কেউ হয়নি। এ থেকে উত্তরণ কীভাবে, সেটাও জানা নেই।
‘করোনার সময়ে অনেকের আয় কমে যায়। ধারদেনা করে চলার চেষ্টা করেছে সবাই। অনেকে গ্রামে গিয়ে বিকল্পভাবে চলার চেষ্টা করছে। মানুষ যখন একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়া নতুন করে বড় ধাক্কা দিচ্ছে। মানুষ তো কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকবে। পারিপার্শ্বিক অনেক ব্যয় কাটছাঁট করে জীবনযাত্রায় টিকে থাকতে হবে।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য