কুমিল্লায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে চলতি শতকের দুই দশক তো বটেই আরও বেশি দশক পর নগরের ভোটে জয় পেলেও আওয়ামী লীগ খুব স্বস্তির বার্তা পেল এমন নয়।
জয় পেলেও সেখানে ক্ষমতাসীন দলের ভোট কমে গেছে অনেকটাই। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের ভোট বেড়েছে। বিরোধী পক্ষে ভোট ভাগাভাগির কারণেই নৌকার জয় হয়েছে, এটি স্পষ্ট।
ক্ষমতাসীন দলের দুইজন কেন্দ্রীয় নেতাও বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে কুমিল্লায় ভোটের এই বার্তা তারা খতিয়ে দেখবেন।
বাংলাদেশে একটি নির্বাচন থেকে আরেকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট কমার উদাহরণ খুব একটা বেশি নয়। এটি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে যতগুলো জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে আগেরবারের চেয়ে বেশি। কেবল সামগ্রিক ফলাফল নয়, প্রতি আসনের ভোট বিবেচনা করলেও দেখা যায়, প্রায় সব আসনেই নৌকার ভোট আগের নির্বাচনের চেয়ে বেশি হয়েছে। আর ভোট বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। খুব কমসংখ্যক আসনেই উল্টো চিত্র দেখা গেছে।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে রাজশাহী বিভাগে এমন সব আসন ছিল যেখানে আওয়ামী লীগ তৃতীয়, চতুর্থ, এমনকি পঞ্চম হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ভোট বাড়তে বাড়তে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ও তুলে এনেছে।
কুমিল্লা শহরের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি প্রযোজ্য। ১৯৭৩ সালের পর থেকে সদর আসনে নৌকা মার্কা প্রতিটি নির্বাচনে হারতে থাকলেও ২০০৮ সালে বাজিমাত করেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার।
তবে ২০১২ সালের প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচন, ২০১৭ সালের দ্বিতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে যায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তবে প্রথম নির্বাচনের তুলনায় দ্বিতীয়বার দলের ভোট বাড়ে অনেকটাই।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি কুমিল্লা সিটিতে প্রথম ভোটে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আফজল খানকে ৩০ হাজার ৩১১ ভোটে হারান বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে নাগরিক কমিটির ব্যানারে প্রার্থী হওয়া সাক্কু।
ওই নির্বাচনে আফজল খান পান ৩৫ হাজার ৪২৯ ভোট। সাক্কু পান ৬৫ হাজার ৭৪০ ভোট।
২০১৭ সালের ৩০ মার্চের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে আফজলকন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে। তিনি সাক্কুর কাছে হেরে যান ১১ হাজারের কিছু বেশি ভোটে। তবে তিনি তার বাবার চেয়ে ২২ হাজার ৪৩৪ ভোট বেশি পান।
ওই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। বুধবারের ভোটে একই মার্কা নিয়ে আরফানুল হক রিফাত ভোট পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০টি। অর্থাৎ পাঁচ বছর আগের তুলনায় নৌকায় ভোট কম পড়েছে ৭ হাজার ৫৫৩টি।
ভোট কমার পরও আওয়ামী লীগের জয় এসেছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভোট ভাগাভাগি হওয়ায়। এই নির্বাচন বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করলেও দলটির দুইজন নেতা লড়াই করেন। এর মধ্যে দুইবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু নৌকার তুলনায় কম পেয়েছেন ৩৪৩ ভোট। অন্যদিকে বিএনপিরই সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিজামউদ্দিন কায়সার পেয়েছেন ২৯ হাজার ভোট।
অর্থাৎ বিএনপি ঘরানার একজন প্রার্থী থাকলে আওয়ামী লীগের বড় পরাজয় হতে পারত।
বিএনপি ঘরানার ভোট হিসাব করলে দেখা যায়, গত নির্বাচনের তুলনায় তাদের ভোট বেড়েছে। ওই বছর সাক্কু ধানের শীষ নিয়ে ভোট পেয়েছিলেন ৬৮ হাজার ৯৪৮টি। এবার টেবিল ঘড়ি মার্কায় পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭টি। স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা কায়সার ঘোড়া মার্কা নিয়ে পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯টি।
দুই জনের ভোট যোগ করলে হয় ৭৯ হাজার ৬৬টি, যা গত নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ১০ হাজার ১১৮টি বেশি।
অথচ ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সাক্কুর ভোট বেড়েছিল ৩ হাজার ২০৮টি।
দলের নেতারা চিন্তিত
কুমিল্লায় ভোট কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ঠিক, আমাদের প্রার্থী গতবার আরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন। এবার তো তারও ভোট কমে গেছে। এই যে ভোট কম পেয়েছে, এটা আমরা আমাদের গবেষণা উইংয়ের মাধ্যমে খতিয়ে দেখব।’
তিনি বলেন, ‘কুমিল্লার বিষয়ের যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। সেই বিষয়টা আমরা দেখছি।’
আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, যিনি চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনুসন্ধান ছাড়া এক দিন পরেই এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন। আমরা সর্ববিশারদ নই। আপনার উপস্থাপিত প্রশ্নটি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে স্টাডি করা প্রয়োজন। আমরা তা করব। কারণ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের অবস্থান আরও সংহত করতে হবে।’
নৌকা প্রতীকের বিজয়ী প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত অবশ্য ভোট কমার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘ভোটের সকালে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। যদি বৃষ্টি না হতো তাহলে আরও অনেক বেশি ভোট কাস্ট হতো। তখন বেশি ভোট পেতাম।’
প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর সম্মিলিত ভোট আগের নির্বাচনের চেয়ে বাড়ার বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পুরো প্রশ্নটি না শুনেই ফোন কেটে দেন রিফাত।
আওয়ামী লীগের ভোট ক্রমেই বেড়েছে
নির্বাচনে জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন, ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে দেখা দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোটের হার বেড়েছে।
সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরুদ্ধ পরিবেশে আওয়ামী লীগ ভোট পায় ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
১৯৮৬ সালে আরেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট বেড়ে হয় ২৬ দশমিক ২০ শতাংশ।
এরশাদ আমলে ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বর্তমানের ক্ষমতাসীন। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে নৌকার ভোট আরও বাড়ে। ওই নির্বাচনে মোট ভোটের ৩০ দশমিক ০১ শতাংশ ভোট পায় নৌকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা আওয়ামী লীগ পরের নির্বাচনও বর্জন করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই নির্বাচনের কিছুদিন পর ১২ জুন হয় আরেকটি ভোট। ওই নির্বাচনে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে দলটি।
সেই নির্বাচনে নৌকায় ভোট এক লাফে বেড়ে যায় ৭ শতাংশের বেশি। সেই নির্বাচনে ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোটের পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জেতে দলটি।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির একাংশ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সম্মিলিত শক্তির কাছে আসনের হিসাবে ভরাডুবি হয় আওয়ামী লীগের। আসন নেমে আসে ৬২টিতে।
তবে আগের নির্বাচনের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ ভোট বাড়াতে সক্ষম হয় দলটি। সেই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৪০ দশমিক ১৩ শতাংশ পড়ে নৌকার বাক্সে।
২০০৬ সালের শেষে নবম সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে না নিয়ে আন্দোলনে যায় আওয়ামী লীগ। কে এম হাসান এককালে ছিলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। আন্দোলনের মুখে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না জানানোর পর এই সরকারের প্রধান হন বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।
ওই সরকার ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ দিলেও ভোট হয়নি। ১১ দিন আগে জরুরি অবস্থা জারি হলে প্রায় দুই বছর দেশে সাংবিধানিক শাসন থাকে স্থগিত।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ভোটে আবার লাফ দেয় আওয়ামী লীগের ভোট। ওই বছর নৌকায় ভোট পড়ে ৪৯ শতাংশ। আর এই ভোট বাড়ায় আসন সংখ্যা দেয় লাফ। ৬২ আসন থেকে বেড়ে হয় ২৩০টি।
এর পরের দুটি নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে এক কথায় ওয়াকওভার পায় আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সেই নির্বাচনে না গিয়ে সহিংস আন্দোলনে যায়। এর মধ্যে দেড় শতাধিক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় নির্ধারণ হয় যাদের সিংহভাগেই জয় পান নৌকার প্রার্থী।
বাকি যে আসনগুলোতে ভোট হয়, সেগুলোতে যত ভোট পড়েছে, তার মধ্যে ৭৯ দশমিক ১৪ শতাংশ ভোট পড়ে নৌকার বাক্সে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন নিয়েও নানা বিতর্ক আছে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট হয় ৭৬ শতাংশের কিছু বেশি।
থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙুর। আর কয়েকদিন পর পেকে গেলে তা গাছ থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করা হবে। বাতাসে দোল খাওয়া আঙুর বাগানের এমন দৃশ্য দেখা গেল কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বলরামপুর গ্রামে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা কাজী বিল্লাল হোসেন খোকন পেশায় কলেজ শিক্ষক। শখ করে করা আঙুর বাগানটি এখন তাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে আঙুর উৎপাদনের।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চারপাশে বিস্তৃর্ণ ধানি জমি। তার মাঝেই উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে বাঁশের মাচা। সেই মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে গাঢ় সবুজ রঙের আঙুর।
বাগানে নিবিষ্ট চিত্তে গাছের পরিচর্যা করছিলেন বিল্লাল হোসেন। এ সংবাদ সগ্রাংহককে দেখে এগিয়ে আসেন তিনি। এরপর আগ্রহ নিয়ে ঘুরিয়ে দেখান তার শখের আঙুর বাগান।
বাগানের প্রতিটি কোণায় যত্নের ছাপ স্পষ্ট। শিক্ষকের হাতের ছোঁয়ায় আঙুর গাছগুলো সজীব ও সতেজ হয়ে বাগানে শোভা ছড়াচ্ছে।
বিল্লাল জানান, বছর দুই আগে শখ করে তার নার্সারিতে দুটি আঙুর চারা রোপণ করেন তিনি। সেবার গাছ দুটি থেকে তিনি প্রায় ১৮ কেজি আঙুর পেয়েছিলেন। তারপর ইউটিউব দেখে আঙুর বাগান করার উদ্যোগ নেন তিনি।
তিনি জানান, এ বছর ১৪ শতক জমিতে আঙুর বাগান করেছেন। মোটামুটি লাখ খানেক টাকা খরচ হয়েছে তার। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বাগান থেকে অন্তত ৫ লাখ টাকার আঙুর তিনি বিক্রি করতে পারবেন।
শখের এ কৃষকের চিন্তা, আগামী বছর তিনি বাগানের পরিসর আরও বড় করবেন।
কুমিল্লা জেলার মাটিতে আঙুর চাষের উপযোগিতা আছে কি না তা এ মুর্হুতে বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে এ জেলার মাটি সব ধরনের ফল উৎপাদনে সহায়ক বলে জানান অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আইয়ুব মাহমুদ।
কৃষি বিভাগের অব্যাহত সহযোগিতা পেলে আঙুর চাষেও সফলতা আসবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আঙুর চাষে শিক্ষক খোকনের প্রচেষ্টা অন্যদের উৎসাহিত করবে। পাশাপাশি জেলায় ফলের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।’
কাঠফাটা রোদ আর ভ্যাপসা গরমে প্রকৃতি যেন পুড়ে যাচ্ছে। এমন বৈরী আবহাওয়াতে কুমিল্লার কৃষকরা মেতে উঠেছেন রোরো ধান ঘরে তোলার উৎসবে। পাকা ধানের ঘ্রাণে মোহিত হচ্ছে চারপাশ।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর কুমিল্লায় এক লাখ ৬১ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এ মৌসুমে ব্রি ধান ৯৬, ব্রি ধান ৮৯, ব্রি ধান ৯২ ও বঙ্গবন্ধু ধান ১০০ আবাদে কৃষকের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ১৩ এপ্রিল দেবিদ্বার উপজেলার ইউসুফপুর ইউনিয়নের ইউসুফপুর গ্রামে বোরো ধান কাটার উদ্বোধন করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক আইউব মাহমুদ। তিনি জানান, বোরো ধান তোলার উৎসবে শুরু হয়েছে। ভালো ফলনে খুশি কৃষকরা।
তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের আঘাতে রবি ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের মৌসুমের শুরু থেকেই আধুনিক উফশী জাত ও হাইব্রিড জাতের বোরো ধান আবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সেচ নিশ্চিতকরণ, কালবৈশাখি ঝড়, অতিবৃষ্টি, তাপদাহ, রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাবসহ নানা প্রতিকূলতা ছিল।
‘নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও সঠিক পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত মাঠের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বছর বোরো মৌসুমে ভালো ফলন আশা করা হচ্ছে।’
জেলার দেবিদ্বার এলাকা ঘুরে শুক্রবার দেখা যায়, ফসলের মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। জমিতে ব্রি ধান ৯৬ জাতের একটি জমিতে প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া গেছে ৪ দশমিক ১৮ টন।
কৃষি বিভাগের পরামর্শে প্রথমবারের মতো ব্রি ধান ৯৬ জাতটি চাষ করেছেন কৃষক আবুল কালাম আজাদ। মাত্র ১৩০ দিনের জীবনকালে বাম্পার ফলন পেয়ে বেজায় খুশি তিনি।
দেবিদ্বার উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ বানিন রায় জানান, এ বছর দেবিদ্বার উপজেলায় ১২ হাজার ৬৯০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা গত বছর ছিল ১২ হাজার ৬৩০ হেক্টর। বোরো ধানে ব্রি ধান ২৮ এর পরিবর্তে একই জীবনকালের, তবে অধিক ফলনের ব্রি ধান ৯৬ চাষের পরামর্শ প্রদান ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলমান ছিল।
তিনি জানান, স্বর্ণা ধানের মতো রঙের এ ধানটিতে প্রোটিনের পরিমাণ ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ও এমাইলোজের পরিমাণ ২৮ শতাংশ হওয়ায় ভাত খেতে সুস্বাদু ও ঝরঝরে।
আরও পড়ুন:চলমান তাপপ্রবাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান অর্থকরী ফসল আমের গুটি ঝরে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন আম বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এমনিতেই এ বছর মুকুল এসেছিল কম, গাছে যে কয়টা আমের গুটি টিকে আছে, তাপদাহের প্রভাবে সেগুলোর বৃদ্ধিও ঠিকমত হচ্ছে না বলে দাবি বাগান মালিকদের। এরই মধ্যে রোদের তাপে শুকিয়ে সেগুলো ঝরে পড়তে শুরু করেছে।
আমের গুটি যাতে শুকিয়ে না যায়, তার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, তাপদাহ থেকে আমের গুটি বাঁচাতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে; প্রয়োজনে গাছে পানি স্প্রে করার পরামর্শও তাদের।
‘আমের রাজধানী’ খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার কিছুটা দেরিতেই এসেছিল মুকুল। পরিমাণেও ছিল অন্য বছরের তুলনায় বেশ কম। তারপরও শুরু থেকেই বাড়তি যত্নে বাগানগুলোতে মুকুল থেকে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আম। তবে কয়েক দিনের তীব্র তাপপ্রবাহ ভীষণ শঙ্কায় ফেলেছে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের। গাছে থাকা আমের গুটির বৃদ্ধি ও টিকে থাকা নিয়ে তারা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।
জেলার মহারাজপুর এলাকার আম বাগান মালিক রাজন ইসলাম বলেন, ‘খরার কারণে আমের গুটির বড় হচ্ছে না, বোটা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। আকাশের পানি না হলে হয়? সেচ দিয়াও খুব বেশি কাজ হচ্ছে না, শ্যালো (সেচ পাম্প) যতক্ষণ চলছে ততক্ষন পানি থাকছে। বন্ধ করলেই সব তিলিকে (দ্রুত) শুষে লিছে (নিচ্ছে)।’
আম সংগঠনের নেতারাও বলছেন একই কথা। এ বছরের শুরু থেকেই বৈরী আবহাওয়ার কারণে তারা আমের কাঙ্ক্ষিত ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। চলমান তাপপ্রবাহ তাদের সেই দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আম ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর শীতের কারণে মুকুল আসতে দেরি হয়েছে, তার ওপর মার্চ মাসে অসময়ের বৃষ্টিতে একবার মুকুল ঝরে যায়।
‘তখন বৃষ্টির দরকার ছিলো না, তাই বৃষ্টির কারণে মুকুলের ক্ষতি হয়েছিল, আর এখন বৃষ্টির অভাবে গাছে যে কয়টা আমের গুটি ছিল, তাও ঝরে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহ আরও কিছুদিন চললে ব্যবসায়ীদের আরও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর আম উৎপাদনের খরচ সব ক্ষেত্রেই বেড়ে গেছে। আবার এখন সেচ দেয়ার জন্য অনেকের খরচ আরও বাড়ছে। সবমিলিয়ে এ বছর খুব বেশি স্বস্তিতে নেই আম বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। অনেকেই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।’
তবে এখনই আশাহত না হয়ে বাগানের সঠিক পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়া ও তাপপ্রবাহ যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত বাগানে সেচ দেয়া, তাপমাত্রা আরও বাড়লে সকালে বা বিকেলে গাছে সরাসারি পানি স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান।
বাগান মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের বড় গাছগুলোতে এবার মুকুল কম এসেছে, তবে ছোট গাছে ভালো মুকুল আছে। সঠিকভাবে পরিচর্যা করা গেলে কৃষি বিভাগ যে সাড়ে চার লাখ টন আমের উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তার কাছাকাছি অন্তত যাওয়া যাবে বলে আশা করছি আমরা।’
আরও পড়ুন:দেশের উষ্ণতম মাস এপ্রিল। এ মাসে সাধারণত অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে গরম। চলতি বছরের এপ্রিলে তাপপ্রবাহ বা দাবদাহ বইছে বিভিন্ন জেলায়, যার ফলে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ভুগছেন বিভিন্ন বয়সীরা।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানায়, দেশের ছয়টি জেলার ওপর দিয়ে বইছে তীব্র দাবদাহ।
এমন বাস্তবতায় অধিদপ্তরের এক আবহাওয়াবিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ সময়ে এমন গরম অস্বাভাবিক কি না। জবাবে খন্দকার হাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অ্যাবনরমাল (অস্বাভাবিক) কোন সেন্সে বলবেন? আমাদের দেশে ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রারও রেকর্ড আছে কিন্তু। এখন তো গ্রীষ্মকাল। মার্চ, এপ্রিল, মে এই তিন মাস গ্রীষ্মকাল। এ সময়ে বৃষ্টিপাত হলে তাপমাত্রাটা কম হবে।
‘বৃষ্টিপাত যখনই বন্ধ হবে, তাপমাত্রাটা বাড়বে, তবে এখন তাপমাত্রা যেটা স্বাভাবিক কথার কথা, তার চাইতে বেশি আছে। দিন এবং রাতের তাপমাত্রা দুইটাই বেশি আছে স্বাভাবিকের চাইতে। দিনের তাপমাত্রা প্রায় তিন থেকে চার ডিগ্রি বেশি আছে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় এক থেকে দুই ডিগ্রি বেশি আছে।’
দুপুর দুইটার দিকে এ প্রতিবেদন লেখার সময় অ্যাকুওয়েদার ডটকম নামের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৫১ শতাংশ।
একই সময়ে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাওয়া অঞ্চল চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যেখানে বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ১৭ শতাংশ।
তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ার বিষয়ে আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ুগতভাবে কিন্তু এপ্রিল মাসটা আমাদের উষ্ণতম মাস। এ সময়ে দিনের স্থায়িত্বটা বড় (বেশি)। সূর্য মাথার ওপর। তা ছাড়া বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। বৃষ্টিপাত যে এলাকাগুলোতে, সেখানে তাপমাত্রা কিছুটা কমছে।
‘আর যে জায়গাগুলোতে বৃষ্টিপাত নাই, সেই জায়গাগুলোতে কিন্তু আপনার তাপমাত্রার ইয়েটা বেশি হচ্ছে। গরমটা বেশি হচ্ছে।’
গরম বাড়ার পেছনে মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণ তুলে ধরে এ আবহাওয়াবিদ বলেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমাদের জলাশয়গুলো ভরাট হচ্ছে; গাছগাছড়া কমে যাচ্ছে। মানুষের এসি (এয়ার কন্ডিশনার), ফ্রিজ ব্যবহার বেশি হয়ে যাচ্ছে।’
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ ক্লাইমেট চেঞ্জে (জলবায়ু পরিবর্তন) অবদান রাখছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ তো আছেই।’
আরও পড়ুন:আবারও আগুনে পুড়লো সিলেটের কুমারগাঁওয়ে অবস্থিত বিদ্যুতের ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র। সোমবার সকালে লাগা এই আগুনে সিলেট নগর ও আশপাশের এলাকার লক্ষাধিক গ্রাহককে প্রায় ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়েছে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ নিয়ে গত চার বছরে তিনবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। কেপিআইভুক্ত দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনায় কেন বার বার আগুনের ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও।
২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে এই উপকেন্দ্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই সময় সিলেট নগরীসহ আশপাশের এলাকায় টানা ৩১ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। তারও আগে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
প্রথমবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ১৯৬৭ সালে স্থাপিত উপকেন্দ্রটির প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন না করা এবং কর্তৃপক্ষের সঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করা হয়। একইসঙ্গে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রহমত উল্লাহ্ মো. দস্তগীরকে আহ্বায়ক করে গঠিত সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশে বলা হয়, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অফ বাংলাদেশের (পিজিসিবি) নিয়ন্ত্রণাধীন ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের ইকুইপমেন্টসের কন্ট্রোল ও প্রটেকশনের জন্য ডিসি সিস্টেম (ডিসি সোর্স ব্যাটারি, চার্জার ও ডিস্ট্রিবিউশন প্যানেল) এবং বিউবোর নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩ কেভি বাস ও ইকুইপমেন্টসের কন্ট্রোল ও প্রটেকশনের জন্য ডিসি সিস্টেম জরুরিভিত্তিতে সম্পূর্ণ পৃথক করা প্রয়োজন।
এছাড়া ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন, জরুরিভিত্তিতে গ্রাউন্ডিং সিস্টেম বৃদ্ধিপূর্বক যথাযথ মানে উন্নয়ন/সম্প্রসারণ করা, ভূগর্ভস্থ কন্ট্রোল ক্যাবলিং সিস্টেম জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করা, ফল্ট লেভেল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৩২ কেভি ও ৩৩ কেভিতে প্যারালালে সংযুক্ত পাওয়ার ট্রান্সফরমারগুলো জরুরিভিত্তিতে পৃথক করা এবং পাওয়ার ট্রান্সফরমার, কারেন্ট ট্রান্সফরমার, পটেনশিয়াল ট্রান্সফরমার, সার্কিট ব্রেকার ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্টগুলো উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।
ওই কমিটি আরও সুপারিশ করে- তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দক্ষ কারিগরি জনবল দ্বারা দেশের সব গ্রিড উপকেন্দ্র ইন্সপেকশনের ব্যবস্থা করা, উপকেন্দ্রের সংরক্ষণ কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে তদারকি আরও জোরদার করা, উপকেন্দ্রের পরিচালন ও সংরক্ষণ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য পিজিসিবি ও বিউবোর আলাদাভাবে জনবল পদায়ন করা এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টির ব্যবস্থা করা দরকার।
এছাড়া গ্রিড উপকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্টগুলো নিয়মিত পরীক্ষা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং এসব যন্ত্রপাতির জন্য হিস্ট্রি বুক সংরক্ষণ করা, জরুরিভিত্তিতে কুমারগাঁও ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের বিকল্প সোর্স তৈরির সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
ওই প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, ‘প্রতিটি গ্রিড বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাইবার সিকিউরিটি ও ফিজিক্যাল সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করা প্রয়োজন। লোকবল স্বল্পতার দোহাই দেয়া হয়। কিন্তু নিজেদের আপগ্রেড করার বিষয়ে কাউকেই ততটা আন্তরিক মনে হয় না। রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের দায়িত্বহীনতা এই দুর্ঘটনার জন্য অনেকটাই দায়ী। সিলেট অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য জনগণের যে অবর্ণনীয় কষ্ট ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার দায়ও এরা এড়াতে পারে না।’
তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেন প্রতিমন্ত্রী।
সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা প্রসঙ্গে সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, ‘কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। জেআইএস নির্মাণের কাজ চলমান। এটি বাজেটের অভাবে কিছুদিন বন্ধ ছিলো। এখন আবার শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নিরাপত্তা অবস্থা আরও জোরদার হবে।’
তিনি বলেন, মূল সমস্যা হলো সমন্বয়হীনতা। এখানে পিজিসিবি ও পিডিবিসহ বেসরকারি আরও কয়েকটি বিদ্যুৎ কোম্পানির যন্ত্রপাতি রয়েছে। সবার মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। আমরা সবাইকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চিঠি দিচ্ছি।
‘এটি পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় অনেক যন্ত্রপাতি পুরনো হয়ে গেছে। নতুন গ্রিড সাবস্টেশন হচ্ছে। কাজ শেষ হলে সেখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে।’
প্রসঙ্গত, সোমবার সকাল ৯টার দিকে কুমারগাঁও উপকেন্দ্রের ভেতরের ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩৩ কেভি লাইনের নিচে বিদ্যুতের হাইভোল্টেজের তার ছিঁড়ে স্পার্কিং হয়। ওই সময় নিচে ডাম্পিং করে রাখা পরিত্যক্ত এয়ার ফিল্টারে আগুন লেগে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট এসে এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা বেলাল হোসেন বলেন, ‘এয়ার ফিল্টারগুলো সেখানে রাখা ঠিক হয়নি। সেগুলো দাহ্য হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’
কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন জানান, সোমবারের অগ্নিকাণ্ডের পর দুটি ফিডারের আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। তবে অন্য ফিডার থেকে কিছু এলাকায় ওই সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। বিকেলে ক্ষতিগ্রস্ত লাইন মেরামত করার পর সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।
আরও পড়ুন:১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। হাতে তেমন সময় নেই। কেউ নিয়ে এলেন চেয়ার-টেবিল, কেউ নিয়ে এলেন বাঁশ-খুঁটি।
বাড়িতে পরার নতুন কাপড় ব্যবহার করা হলো প্যান্ডেল ঘেরাওয়ের কাজে। আগের দিনের অর্ধেক সময় আর রাত জেগে পাহারা দেয়া হলো মেহেরপুরের তৎকালীন বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন।
শুরুটা শপথের অনুষ্ঠান থেকে হলেও মুক্তিকামী মানুষকে সহযোগিতা করতে গিয়ে কেটে গেল যুদ্ধের পুরোটা সময়।
সময় গড়িয়েছে, মত-পথ পাল্টেছে। তবে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক সেই শপথ অনুষ্ঠানের পেছনের কারিগরদের কেউ মনে রাখেনি। খোঁজ নেয়নি কেউ।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো দূরে থাক, স্থানীয়ভাবেও তারা পাননি যথাযথ সম্মান। এই আক্ষেপ নিয়ে কেউ পাড়ি দিয়েছেন পরপারে, কেউবা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর ডাকে গঠিত বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি নিয়ে।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন কয়েক যুবক।
সে সময়ের এমএনএ ছহি উদ্দীন বিশ্বাস এবং এসডিও তৌহিক-এলাহি চৌধুরীর পরামর্শে তারা ঐতিহাসিক শপথের সব আয়োজন করেছিলেন। শপথ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, বাইবেল পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনসহ বিভিন্ন কাজে যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদেরকে আম্রকাননে নিয়ে এসেছিলেন সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা।
প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের পর গোটা এলাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তারপরও জীবনের পরোয়া না করে সংগ্রাম কমিটির অকুতোভয় সদস্যরা ত্রাণ সংগ্রহের কাজ করেছিলেন। তাদের অনেকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্মান না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই-একজন যারা বেঁচে আছেন তারা মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রের স্বীকৃতিটুকু পেতে চান।
সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য বল্লভপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ থিওফিল মণ্ডল বলেন, ‘প্রাণের টানে প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ছুটে আসি। পঁচাত্তর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ১৯৭৬ সালে কেউ মুজিবনগর দিবস পালন করতে আসেনি। আমরা মাত্র ১৯ জন লোক বাগানে গিয়ে মুজিবনগর দিবস পালন করেছিলাম।’
রাষ্ট্রীয় সম্মান-স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ করে এই বীর মুক্তিযাদ্ধা বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুনেছিলাম হাতেগোনা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। পরবর্তীতে দেখি শতাধিক মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছে। তারপরও সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা অবহেলিত।’
একই কথা জানালেন মানিকনগর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ দোয়াজ উদ্দীন মাস্টার। তিনি বলেন, ‘সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা সব আয়োজন করেছিল। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য আমার ছাত্র দারিয়াপুর গ্রামের বাকের আলীকে ডেকে নিয়ে আসি। সে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও সংগ্রাম কমিটির আরেক সদস্য আব্দুল মোমিন চৌধুরী স্বীকৃতি পেয়েছেন।’
সংগ্রাম কমিটির সদস্যসহ যারা সেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদের সবার স্বীকৃতি দাবি করেন তিনি।
বাংলা একাডেমী প্রণীত ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস: মেহেরপুর জেলা’ গ্রন্থের মাধ্যমে মূলত সংগ্রাম কমিটির বিষয়টি সবার নজরে আসে। এই গ্রন্থের লেখক মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশিদ বলেন, ‘অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার হাত বাড়ানো এসব মানুষের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়াটা খুবই প্রয়োজন। তারা শুধু শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজনই করেননি, কুষ্টিয়া অঞ্চলে সম্মুখ যুদ্ধে সব রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন জীবন বাজি রেখে।
বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেনও সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করেন।
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক মুহূর্তে ঐতিহাসিক ভূমিকার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে উত্থাপন করা হয়েছে।’
‘রাজাকার-আলবদর থাকে আজ রাজপ্রাসাদে, আমি শহীদুল ইসলাম বীর প্রতীক থাকি একটা কুইড়াঘরে (কুঁড়েঘরে) তার কারণ কী?’
২০০৩ সালে ধারণ করা এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার সূতী গ্রামের হেলাল উদ্দিনের ছেলে শহীদুল ইসলাম।
তার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ছোট থেকেই অনেক সাহসী ও বুদ্ধিমান ছিলেন শহীদুল। তাই তো দেশকে হানাদার মুক্ত করতে ১২ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ির অধীনে।
দেশের সর্বকনিষ্ঠ এ বীর প্রতীকের পরিবারের নেই স্থায়ী কোনো নিবাস। সন্তানদের জন্য নেই চাকরির ব্যবস্থা। তিনি কুলির কাজ ও খাবার হোটেলের কাজ করে কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীকের পরিবার বসবাস করছেন ঢাকার মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্পের সরকারি জমিতে। প্রথম সন্তান মুক্তা বেগম (৩৫) পেশায় গৃহিণী, স্বামীর বাড়ি রাজশাহীর নাটোরে। দ্বিতীয় সন্তান আক্তার হোসেন (৩২) পেশায় গাড়ি চালক, তৃতীয় সন্তান সোহাগ হোসেন (২৭) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন, চতুর্থ সন্তান শিখা আক্তার (২০) ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ভারতে ট্রেনিং চলাকালে সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় সহযোদ্ধারা তাকে লালু আর তার চেয়ে বয়সে বড় শ্যামলকে ভুলু নামে ডাকতে শুরু করেন। দেশে ফিরলে তার বুদ্ধিমত্তায় একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণে বাঁচেন।
সেই ঘটনাই বর্ণনা করে তার পরিবার, কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডারের নির্দেশে ছদ্মবেশ ধারণ করেন চতুর শহীদুল ইসলাম। কৌশলে এক রাজাকারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে গোপালপুর থানা কম্পাউন্ডের, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাংকারে ঢুকে পরেন। তার কৌশল ও দুঃসাহসিক গ্রেনেড হামলায় একাধিক বাংকার ধ্বংস করলে গোপালপুর থানা হানাদার মুক্ত হয়।
শহীদুলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বীর প্রতীক উপাধি লাভ করেন তিনি। রাইফেলের সমান উচ্চতা হওয়ায় ভারতে প্রশিক্ষণ চলাকালে তাকে স্টেনগান চালনা ও গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কাদেরিয়া বাহিনী ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অস্ত্র সমর্পণের সময় সময় ১২ বছরের কিশোর শহীদুলের বীরত্বের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে কোলে তুলে নেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ছবিটি সামরিক ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
শহীদুলের জীবন সংগ্রাম
শৈশবে বাবা-মা আর মুক্তিযুদ্ধের সময় এক ভাই-এক বোনের মৃত্যু হলে দারিদ্র্যতায় উপায়ান্তর না দেখে মুক্তিযুদ্ধের পর দুই ভাইকে রেখে জীবিকার তাগিদে বাড়ি ছাড়া হন শহীদুল। ঢাকার সোয়ারীঘাটে বালু টানা, ঠেলা গাড়ি চালানো, রাজমিস্ত্রীর হেলপারের কাজ, শেষে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কুলির কাজ শুরু করেন।
একপর্যায়ে কুলির কাজ শেষে হোটেলে কাজ শুরু করেন। যাযাবর অবস্থায় বিয়েও করেন, এক মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম নেয়া সেই সংসার স্থায়ী হয়নি।
পরবর্তী সময় কুমিল্লায় হোটেলে কাজ করা অবস্থায় সহকর্মীকে জীবনের সব ঘটনা খুলে বলেন। দুই সন্তানকে নিয়ে ওই সহকর্মীর সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর চলে যান। ১৯৯৬ সালে সেই সহকর্মীর নিকটাত্মীয় মালা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
এ দম্পতির ছেলে সন্তান সোহাগ হোসেনের জন্মের পর সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। ঢাকার পোস্তগোলায় নিজের খাবার হোটেল চালু করার কিছু দিনের মধ্যেই ১৯৯৮ সালে জটিল কিডনি রোগে আক্রান্তের কথা জানতে পারেন শহীদুল।
কোনো উপায় না পেয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ঢাকার বাসার ঠিকানা জোগাড় করে দেখা করেন। কাদের তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করান, উপস্থিত সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন তার কাগজপত্র সংগ্রহ করতে। কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধা বীর প্রতীক আবদুল্লাহকে নির্দেশ দেন, ঢাকার মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্পে শহীদুলের পরিবারের জন্য জায়গা দিতে। সে অনুযায়ী তার পরিবারের ঠাঁই হয় সেখানে।
বীর প্রতীক খেতাব লাভ
চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হন শহীদুল ইসলাম। কাগজপত্র সংগ্রহের পর জানতে পারেন তিনি বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিনিই সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীক। পরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক তাকে ৩০ হাজার টাকা অনুদান প্রদানের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে অপর দুইভাই তাকে খুঁজে পায়।
শহীদুলের চিরবিদায়
অসুস্থতার কারণে শেষ সময়ে কোনো কাজকর্ম করতে পারেননি শহীদুল। শুভাকাঙ্ক্ষীদের অর্থে চলেছে চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ। ২০০৯ সালে ২৫ মে অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
পরিবারের বক্তব্য
বীর প্রতীক শহীদুল ইসলামে স্ত্রী মালা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্বামীর জীবদ্দশায় ভাতাপ্রাপ্ত ছিলেন না, তাই শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় চিকিৎসা করাতে হয়েছে। উনার মৃত্যুর পর চার সন্তানকে অনেক কষ্টে লালনপালন করি। এরপর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর কাছে গেলে ২০১৪ সালে দুই হাজার টাকা ভাতা চালু হয়।
‘মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্পের সরকারি জমিতে একাধিক রুম বানিয়ে ভাড়ার টাকায় সন্তানদের বড় করি। সন্তানদেরকে শিক্ষিত বানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার দাবি সন্তানদের জন্য উপযুক্ত চাকরি ও আমাদের স্থায়ী নিবাসের ব্যবস্থা করে দেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার নিজ এলাকার মানুষের থেকে সে তেমন মূল্যায়ন পায়নি, এই ক্ষোভে তিনি মৃত্যুর আগে কখনও গোপালপুর যাননি, তবে সন্তানদের নিয়ে আমি একাধিকবার গোপালপুর গিয়েছিলাম।’
সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীকের সন্তান সোহাগ হোসেন বলেন, ‘মানুষের মৌলিক চাহিদার একটি বাসস্থান। আমরা বিশেষ পরিবারের সন্তান হলেও ঢাকার মিরপুরে সরকারি জমিতে বসবাস করতেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট দাবি, স্থায়ী বাসস্থান ও আমাদের জন্য উপযুক্ত চাকুরির ব্যবস্থা যেন উনি করেন।’
নিয়মিত সরকারি রেশন ও ভাতা পাচ্ছেন বলেও জানান তারা।
জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য
গোপালপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদ্য সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরেন্দ্রনাথ সরকার বিমল বলেন, ‘সূতী মীরপাড়ায় গোপালপুরের একমাত্র বীর প্রতীক শহীদুল ইসলামের জন্ম হলেও, এখানে তার বাড়ি-ঘর নেই। তার পরিবার এখানে এসে কিছু চায় নাই, তাই বীর নিবাসসহ অন্যান্য সুবিধাদি পায়নি। তার পরিবার বীর প্রতীক ভাতা পাচ্ছেন।’
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর নিবাস তৈরি করে দেয়ার একটি প্রকল্প চলমান আছে। গোপালপুরে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ৬২টি বীর নিবাস নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং ছয়টি নির্মাণাধীন রয়েছে।
‘উনাকে আবেদন করে রাখতে বলেন। পরের অর্থবছরে আবার যদি বরাদ্দ আসে তবে হয়ত এগুলো পাঠাতে পারব।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য