ঠিকমতো মজুরি দেয়া হয় না, মজুরি আটকে রাখা হয় দীর্ঘদিন, দেয়া হয় না ছুটি, চুক্তি শেষেও ভাটা ছেড়ে যেতে দেয়া হয় না। কেউ চলে যেতে চাইলে করা হয় মারধর।
এসব অভিযোগ খুলনার বিভিন্ন ইটভাটার শ্রমিকের। রূপসা উপজেলায় ভাটার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হওয়ায় অভিযোগও এখানে বেশি।
তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে ভাটার মালিক ও সরকারি কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনার নয় উপজেলায় ১৫৩টি লাইসেন্সধারী ইটভাটা আছে। আর জেলা ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়ন জানিয়েছে, সব মিলিয়ে খুলনায় ৩০০টি ইটভাটা আছে। এসব ভাটায় শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
বাগেরহাটের ৩০ বছর বয়সী রুহুল আমিন শেখ কাজ নিয়েছিলেন রূপসার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের আজাদ ব্রিকসে।
২০২১ সালের নভেম্বরে তিনি এখানে কাজ শুরু করেন। মো. সালাম নামের এক শ্রমিক সর্দারের সঙ্গে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসের কাজের চুক্তি হয়েছিল।
রুহুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আমি আর আমার স্ত্রী আসমা বেগম কাজে যোগ দেই। ওই ভাটায় শ্রমিকদের জন্য অস্থায়ী বসতি আছে। সেখানেই আমাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে থাকতাম।
‘ছয় মাস পর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও সর্দার আমাদের ছাড়তে চাননি। তিনি বলেছিলেন, বর্ষাকাল না আসা পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হবে।’
রুহুল আরও বলেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ভাটার বাইরে বের হওয়ায় সর্দারের লোকরা মনে করেছিল আমি পালিয়ে যাচ্ছি। তখন তারা আমাকে ভাটার একটি ঘরে ধরে নিয়ে যায়। রাতভর আমার ওপর নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন তারা আমার স্ত্রীকেও শারীরিক নির্যাতন করে।
‘তারা আমার মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল যেন কাউকে নির্যাতনের কথা বলতে না পারি। পরদিনও ওই ঘরে আমাদের আটকে রাখা হয়। বিকেলে এক শ্রমিকের সহায়তায় আমার স্ত্রী সেখান থেকে পালিয়ে পুলিশের কাছে যায়। পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।’
আশিকুর রহমান নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘আমি প্রায় আট বছর ধরে বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করছি। মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনোদিনই ছুটি পাওয়া যায় না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে এক থেকে দুই দিন ছুটি দেয়। এর বেশি নয়।
‘অনেক সর্দার শ্রমিকদের ভাটার বাইরেও যেতে দিতে চান না।’
ইটভাটায় যিনি বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিক জোগাড় করেন তাকে বলে শ্রমিক সর্দার। তার তত্ত্বাবধানে শ্রমিকরা মাটি কাটা থেকে শুরু করে ইট বিক্রির আগ পর্যন্ত সব কাজ করেন।
সবুর আলী নামের এক শ্রমিক সর্দার বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে শ্রমিক সংগ্রহ করি। আবার মৌসুম শেষে তাদের ছেড়ে দিই। কাজের শুরুতে শ্রমিকদের সঙ্গে মজুরির চুক্তি করে নিই।
‘অনেক সময় ছয় মাসেও মৌসুম শেষ হয় না। বর্ষা না আসা পর্যন্ত ইট তৈরির কাজ চলে। তখন নতুন করে আর শ্রমিক পাওয়া যায় না। সেজন্য আগের শ্রমিকদেরই থাকতে বলা হয়। তবে জোরাজুরি বা মারধর করা হয় না।’
বেতনের বিষয়ে ভাটার শ্রমিকরা জানান, কাজভেদে শ্রমিকদের মজুরি ভিন্ন ভিন্ন হয়। ভাটা ভেদেও পার্থক্য আছে।
মাটি কাটা শ্রমিকদের কোথাও মজুরি দেয়া হয় দিন হিসেবে, কোথাও কাজের পরিমাণ হিসেবে। যারা বর্গফুট হিসেবে মজুরি পান, তারা প্রতি এক হাজার ফুট মাটি কাটলে পান সাড়ে ৩ হাজার টাকা। যারা দিনমজুর তারা সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মাটি কেটে পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
ইট বানানোর জন্য যারা কাদামাটি তৈরি করেন তারা ভোর ৪টা থেকে কাজ শুরু করেন। প্রতি হাজার ইটের সমপরিমাণ কাদামাটি তৈরি করে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পান।
ইট প্রস্তুতকারী কারিগররা প্রতি হাজার ইটে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান। কারিগরের সহযোগীরা পান, প্রতি হাজারে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা।
যেসব শ্রমিক কাঁচা ইট চুল্লি পর্যন্ত বহন করেন তারা প্রতি হাজার ইটে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পান। ভাটার চুল্লি থেকে পোড়া ইট যারা বের করেন তাদের দেয়া হয় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।
প্রতি হাজার ইট তৈরির জন্য শ্রমিক সর্দাররা ভাটার মালিকের কাছ থেকে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা নেন। টিকিট মাস্টার, রাবিশ ম্যান এবং ফায়ার ম্যানরা কাজ করেন মাসিক বেতনের ভিত্তিতে। তাদের বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
লিয়াকত আলী নামের এক শ্রমিকের অভিযোগ, মৌসুম শেষের দিকে শ্রমিক সর্দাররা কিছু টাকা আটকে রাখে যেন মৌসুম শেষ হওয়ার আগে কোনো শ্রমিক চলে যেতে না পারে।
ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়নের রূপসা থানা শাখার সভাপতি জলিল মোড়ল বলেন, ‘অধিকাংশ ভাটায় শ্রমিকরা ঠিকমতো মজুরি পায় না। একদিকে ইট বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত মালিকরা টাকা দিতে চায় না অন্যদিকে সর্দাররা দীর্ঘদিন বেতন আটকে রাখে।
‘এখন বাজারে সবকিছুর দাম অনেক বেশি। শ্রমিকরা পর্যাপ্ত মজুরি তো পায়ই না, সেই সঙ্গে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।’
এমন অভিযোগের বিষয়ে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জলিল খান কালাম বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের মজুরি কম দেই এটা সঠিক না। প্রতি বছর মজুরি পর্যালোচনা করা হয়। এবারও বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক আরিফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে এক সময় ছুটি দেয়া হতো না। শ্রমিদের নানা রকমের নির্যাতন করা হতো। এখন আমরা ইটভাটা মালিক সমিতির সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করি। শ্রমিকদের সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করি।’
আরও পড়ুন:বন্যার ধাক্কায় টালামাটাল হয়ে পড়েছে সিলেটের স্বাস্থ্যসেবা খাত। বিভাগের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অন্তত ২৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছিল। এতে ওই হাসপাতালগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো আর আসবাবপত্রেরও।
যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ায় ওসমানী হাসপাতালেও বন্ধ রয়েছে রোগ নির্ণয়ের কয়েকটি পরীক্ষা ও কিছু সেবা। উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অবস্থা আরও করুণ।
মস্তিষ্কে রক্ষক্ষরণজনিত কারণে রোববার ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দা লায়েক আহমদ। চিকিৎসকরা তাকে সিটি স্ক্যান করানোর কথা বললেও ওসমানী হাসপাতালে তিনি পরীক্ষাটি করাতে পারেননি।
রোববার দুপুরে লায়েকের ভাই সায়েক আহমদ বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে বন্যার পানি ঢুকে সিটি স্ক্যান যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বাইরে থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে বলা হয়েছে। কিন্তু রোগীর যে অবস্থা তাতে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়াও কষ্টকর।’
গত ১৫ জুন সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। আর ১৮ জুন সিলেট বিভাগের প্রধান স্বাস্থ্যকেন্দ্র এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পানি ঢুকে পড়ে। নিচ তলায় হাঁটু পানি জমে যায়। এতে হাসপাতালটির সিটি স্ক্যান, এমআরআই, রেডিওথেরাপি যন্ত্র ছাড়াও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স, জেরারেটরসহ বেশকিছু আসবাবপত্রও নষ্ট হয়েছে।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘বন্যায় হাসপাতালের নিচতলা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিচতলায় থাকা এমআরআই, সিটি স্ক্যান ও রেডিওথেরাপি মেশিন জলমগ্ন ছিল।’
পরিচালক জানান, রেডিওথেরাপি যন্ত্রটি চালুর চেষ্টা চললেও এমআরআই, সিটি স্ক্যান যন্ত্র আবার চালু করা সম্ভব হবে কি-না তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। এগুলো নষ্ট থাকায় রোগীরা বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়ে আনছেন।
হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স, পরিচালকের গাড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চিত করতে আরও সময় লাগবে।
শুধু ওসমানী হাসপাতালই নয়, স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে- সিলেট বিভাগের ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে অন্তত ২৪টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবগুলো কমপ্লেক্সেই গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ৮৫টি ইউনিয়ন সাব সেন্টারের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ৩১টি এবং ৯২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৪১৪টি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
সিলেটের জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ বাদে বাকি ১০ উপজেলার সব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালসহ এই জেলার সবকটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছিল। এখনও এই জেলার অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় থেকে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বন্যা কবলিত সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচীর (ইপিআই) ফ্রিজ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, এক্স-রে মেশিন, এমএসআর সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। জলমগ্ন এসব যন্ত্র কার্যক্ষম কি না, পানি না সরায় তা এখনো যাচাই করা যাচ্ছে না। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে আরো সময় লাগবে।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কামরুজ্জামান রাসেল বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলায় ১০ ফুট পানি ছিল। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে। অনেক আসবাব ভেসে গেছে। ফলে পানি কমতে শুরু করলেও সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’
ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘চলমান বন্যা স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। অবকাঠামো, আসবাবপত্রের পাশপাশি অনেক যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়ে গেছে।’
হিমাংশু জানান, পানি নামতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে। পানিবাহিত রোগের প্রকোপও বেড়েছে। বন্যায় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ সামলাতে সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পরিদর্শনে সোমবার সকালে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে আসবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক।
আরও পড়ুন:পদ্মা সেতু বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদীর দুই পাড়কে যুক্ত করেছে বটে, তবে স্রোতের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নদীর নিচে শক্ত মাটির অনুপস্থিতি। বিশ্বের অনেক জায়গায় এ রকমই প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে গড়ে উঠেছে কিছু সেতু। কোথাও খরস্রোতা নদী, কোথাও সুউচ্চ পাহাড়, কোথাও সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। প্রকৌশলীদের দক্ষতায় দুর্গম সব স্থানেও মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক সেতু। এ রকমই পাঁচ সেতুর কথা।
দানিয়াং-কুনশান সেতু, চীন
চীনের দানিয়াং-কুনশান সেতুটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটির দৈর্ঘ্য ১৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সেতুটি চীনের দুটি বড় শহর সাংহাই এবং নানজিংকে যুক্ত করেছে।
সেতুটি বেইজিং-সাংহাই হাই-স্পিড রেলওয়ের অংশে দানিয়াং এবং কুনশানকেও সংযুক্ত করেছে, যা বেইজিং পশ্চিম স্টেশন এবং সাংহাই হংকিয়াও স্টেশনকে সংযুক্ত করে।
কমপক্ষে ১০ হাজার কর্মী চার বছরে এটির নির্মাণ শেষ করেন। সেতুটির ৯ কিলোমিটার অংশ ইয়াংচেং হ্রদের ওপর বিস্তৃত। বড় এই অংশে সেতুটিকে সাপোর্ট দিচ্ছে ২ হাজার পিলার।
পুরো অবকাঠামোয় সাড়ে ৪ লাখ টন স্টিল ব্যবহার করায় এটি প্রবল টাইফুন এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ সহ্য করতে পারে অনায়াসেই। পিলারগুলো এতটাই মজবুত যে তিন লাখ টন ওজনের নৌযানের ধাক্কাতেও কিছুই হয় না এই সেতুর।
সেতুতে উচ্চগতিসম্পন্ন ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা আছে। ট্রেনের গতি ২৫০-৩৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত তোলা যায়।
দ্য মিলিউ ভিয়াডাক্ট, ফ্রান্স
এই সেতুটিকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হতো। উচ্চতার দিক থেকে এটি আইফেল টাওয়ারকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এটি একটি মাল্টি-স্প্যান কেব্ল-স্টেড ব্রিজ, যা টার্ন নদীর গর্জ উপত্যকার ওপর দিয়ে গেছে। সেতুটি ১ লাখ ২৭ হাজার কিউবিক মিটার কংক্রিট এবং ২৬ হাজার ২০০ টন রিইনফোর্সিং ইস্পাত দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টন প্রি-স্ট্রেসড স্টিল কেব্লে পুরো সেতুটি ঢাকা।
এই সেতুর নকশার অন্যতম আকর্ষণ এটির স্প্যানগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ ওজনের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। অতি উচ্চতার কারণে সেতুটি বাঁকানো। তাই পিলারগুলোকে প্রশস্ত এবং শক্তিশালী করে ডিজাইন করতে হয়েছে।
আকাশি কাইকিও সেতু, জাপান
জাপানের আকাশি কাইকিও সেতু বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুগুলোর একটি। এটি ৩ হাজার ৯১১ মিটার দীর্ঘ। এটির সাপোর্ট টাওয়ারগুলো মাটি থেকে প্রায় ২৯৮ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে।
স্টিল ট্রাস স্ট্রাকচারে ডিজাইন করা পাইলনগুলো তারের স্যাডলকে টেনে সেতুর বেশির ভাগ লোড সাপোর্ট করে। পাইলনের মধ্যে দূরত্ব ১ হাজার ৯৯১ মিটার। এটিতে এমন দুই-স্তরের গার্ডার সিস্টেম আছে, যা সেতুর কাঠামোকে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৫ পর্যন্ত ভূমিকম্প এবং ২৮৬ কিলোমিটার বেগের ঝোড়ো বাতাস থেকে রক্ষা করতে পারে।
এই বিশেষ সেতুতে বেশ কিছু উদ্ভাবনী প্রকৌশল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার একটি হলো এটির প্রতিটি টাওয়ারে ২০টি টিউনড মাস ড্যাম্পার (টিএমডি)। টিএমডিগুলো সেতুকে বাতাসের দোলা থেকে রক্ষা করে।
যখন বাতাস সেতুটিকে একদিকে দেয়, তখন টিএমডিগুলো বিপরীত দিকে দোলে। এতে সেতুর ভারসাম্য বজায় থাকে।
আকাশি কাইকিও সেতুটি ‘পার্ল ব্রিজ’ নামেও পরিচিত। রাতে ২৮টি বিভিন্ন প্যাটার্ন এবং আলো সেতুটিকে আলোকিত করে।
ইনচিওন ব্রিজ, দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন ব্রিজ ১৩ কিলোমিটার লম্বা একটি সেতু। কেব্লে ঝোলানো ব্রিজের অংশটিকে কোরিয়ার দীর্ঘতম বিশ্বের দশম বড় ঝোলানো ব্রিজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার কেন্দ্রের মূল স্প্যান ৮০০ মিটার।
সেতুটির মূল উদ্দেশ্য হলো সোংদো এবং ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন। শক্তিশালী ইঞ্জিনিয়ারিং সফটওয়্যার মিডাস সিভিল ব্যবহার করে সেতুটির নকশা এবং কাঠামো বিশ্লেষণ করা হয়।
এই সেতু ৭২ এমপিএস বায়ুসহ ঝড় এবং রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। সেতুটি ইনচিওন বন্দরের কাছে অবস্থিত। নিচে ৮০ মিটার উচ্চতাসহ ইউ আকৃতির ডিজাইন করা। এতে প্রধান দুটি টাওয়ারের মাঝ দিয়ে নিরাপদে জাহাজ পার হতে পারে। ইনচিওন ব্রিজের নিচের স্তম্ভ ৬ হাজার টন পর্যন্ত ওজন সহ্য করতে পারে, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মাত্র আট মাসে সেতুর নির্মাণ শেষ হয়।
রুস্কি আইল্যান্ড সেতু, রাশিয়া
রুস্কি আইল্যান্ড সেতুটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম কেব্ল সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটির মোট দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ১০০ মিটার। টাওয়ারগুলোর মধ্যে দূরত্ব এক হাজার ৪ মিটার।
এই সেতুর নকশা নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ এটি এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানকার আবহাওয়া চরম বৈরী।
ব্লাদিভোস্টকের আবহাওয়া মাইনাস ৪০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠা-নামা করে। তাই এটির নির্মাণ ছিল শক্ত চ্যালেঞ্জের।
এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রকৌশলীরা মিডাস সিভিল সফটওয়্যার ব্যবহার করেন, যা তারের অপ্টিমাইজেশনের মাধ্যমে অজানা লোড ফ্যাক্টরগুলোর কাঠামোগত বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা হয়।
কেব্ল সিস্টেমের জন্য কমপ্যাক্ট পিএসএস সিস্টেম নামে একটি উন্নত সিস্টেম ব্যবহার হয়েছে এটি নির্মাণে। এই সিস্টেমটি একটি কম্প্যাক্ট ডিজাইনের জন্য ব্যবহার করা হয়। ছোট ব্যাসের সঙ্গে খাপ খাওয়ার পাশাপাশি সেতুর কাঠামোতে বাতাসের গতি কমাতে সাহায্য করে এটি।
চরম তাপমাত্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য উচ্চ-ঘনত্বের পলিথিন (এইচপিডি) দিয়ে তৈরি প্রতিরক্ষামূলক কাভার ব্যবহার হয়েছে। এটি সেতুর কেবল-স্টেয়েড সিস্টেমের তারগুলোকে ঢেকে রাখে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই বিশাল বিনিয়োগের প্রাপ্তি হিসাবের দুটি উপায় আছে। একটি হলো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি বিবেচনা, অন্যটি সেতু দিয়ে পারাপার হওয়া বিভিন্ন যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট হারে টোল আদায়ের মাধ্যমে সরাসরি খরচ উঠিয়ে আনা।
কোন উপায়ে কত বছরে পদ্মা সেতুর ব্যয় উঠে আসতে পারে, সরকারিভাবে তার সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায় না। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
এই সেতু দিয়ে দেশের ২৩ জেলায় প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে, যা ২০২৫ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়াবে ৪১ হাজার ৬০০। এদের সবার থেকে টোল বাবদ যে আয় হবে, শুধু তা দিয়ে সেতুর ব্যয় উঠে আসতে সময় লাগবে সাড়ে ৯ বছর।
অন্যদিকে সেতু চালু হওয়ার কারণে আগামী এক বছর বা ১২ মাসে অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি যোগ হবে চলতি বাজারমূল্যে ৪২ হাজার ৩৬২ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, যা জিডিপির ১.২ শতাংশের সমান।
এই বিবেচনায় মাত্র ৯ মাসে উঠে আসবে ৩১ হাজার ৭৭১ কোটি ৬৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা, অর্থাৎ অর্থনীতিতে মাত্র এই ৯ মাসের প্রাপ্তি হবে পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের সমান।
যে তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসাব
বিশাল বিনিয়োগের প্রকল্প শুরু করার আগে সেটি অর্থনৈতিকভাবে কতটা সুফল দেবে এবং তার প্রাপ্তি কতকাল ধরে অর্থনীতি পেতে থাকবে, তার আগাম সমীক্ষা করা হয়ে থাকে। প্রকল্পের গুরুত্ব বুঝে এ ধরনের সমীক্ষায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশি স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকার এ মূল্যায়নে সম্পৃক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক ও জাইকাকে। জাতীয়ভাবে সরকারও প্রকল্পের সমীক্ষা চালায়।
সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের আয় বাড়বে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ৭ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সমীক্ষাতেও বলা হয়, জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় বলা হয়, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ শতাংশ হারে।
সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে পদ্মা সেতুর প্রভাবে জিডিপি ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ার তথ্য দেন। এ ছাড়া দেশীয় একাধিক গবেষণা সংস্থার দাবি, জিডিপি বাড়বে দেড় থেকে দুই শতাংশ পর্যন্ত।
টোল থেকে ব্যয় তুলে আনার হিসাব
সেতু পারাপারে টোল হার কার্যকরের মাধ্যমে সরাসরি ব্যয় তুলে আনার বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) একটি নিজস্ব গণনা পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতিকে যে এলাকায় সেতু নির্মিত হবে, ওই এলাকায় ফেরি পারাপার থেকে দৈনিক যে পরিমাণ টোল আদায় করা হয়, সেতু পারপারে তার দেড় থেকে দুই গুণ টোল ধার্য করার নিয়ম রয়েছে।
পদ্মা সেতুতেও টোল হার নির্ধারণ করার আগে ফেরিতে কী পরিমাণ টোল আদায় হয় এবং কী পরিমাণ যানবাহন পারাপার হয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই সংস্থার তথ্য মতে, ২০২০ সালের নভেম্বরে মাওয়া এবং জাজিরার মধ্যে ফেরিতে যানবাহন পারাপারে দৈনিক ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা আয় হয়েছে।
সেতু বিভাগ (বিবিএ) এ পরিসংখ্যানকে ভিত্তি ধরে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা টোল আদায়ের আশা করছে। অর্থাৎ বিআইডব্লিউটিএর আয়ের দেড় গুণের বেশি এবং দুই গুণের কম আয়ের একটি মধ্যবর্তী ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে টোল হার যেটিই নির্ধারণ করা হোক না কেন, ব্যয় উঠে আসার সময়সীমার ক্ষেত্রে পরিষ্কার কিছু বলা হয়নি। এ নিয়ে নানা গণমাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে খবর হয়েছে। এতে সেতু বিভাগের প্রাথমিক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৫ বছরে উঠে আসবে পদ্মা সেতুর ব্যয়। একই ইস্যুতে দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বলছেন, সময় লাগবে ২০ থেকে ২৫ বছর এবং কেউ আবার ১৭ বছরের কথা বলছেন।
নিউজবাংলা এসব তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে দেখেছে, টোল থেকে পাওয়া সমুদয় হিসাব বিবেচনায় নিলে সেতুর ব্যয় তুলে আনতে ৯ বছর ৫ মাস ৬ দিনের বেশি লাগবে না।
তবে এ হিসাবে সেতুর পরিচালন খরচ এবং এর সঙ্গে ১৪৭ কিস্তির ১ শতাংশ সুদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টোল হিসাবে যে রাজস্ব আসবে, সে হিসাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় উঠে আসার কথা ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। সেতুটি নিয়ে যখন প্রজেক্ট ডিজাইন করা হয়েছে, তখন এমন সম্ভাব্যতার কথাই বলা হয়েছে। তবে আদায় পর্যায়ে টোল হার বিবেচনায় এই সময় আরও কমবেশি হতে পারে।’
অন্যদিকে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোরুল ইসলাম মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ১৭ বছরে উঠে আসতে পারে পদ্মা সেতুর ব্যয়।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে ১ শতাংশ হারে সুদে সরকারকে ফেরত দিতে হবে। ফিজিবিলিটি স্টাডিতে বলা হয়েছে, ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে টাকাটা (নির্মাণ ব্যয়) উঠে আসবে। এখন মনে হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই টাকাটা উঠে আসবে, কারণ মোংলা পোর্ট যে এত শক্তিশালী হবে, পায়রা বন্দর হবে, এত শিল্পায়ন হবে, সেগুলো কিন্তু ফিজিবিলিটি স্টাডিতে আসেনি।’
জিডিপি বিবেচনায় সেতু থেকে বাড়তি প্রাপ্তির হিসাব
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সবশেষ পূর্ণাঙ্গ হিসাব আছে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের। সেখানে টাকার অঙ্কে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ১৮৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
আগামী বছর পদ্মা সেতুর প্রভাবে জিডিপি দেড় শতাংশ বাড়লে অর্থনীতিতে প্রথম বছর এর বাড়তি অর্থমূল্য দাঁড়াবে ৫২ হাজার ৯৫২ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। জিডিপি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়লে সার্বিক অর্থনীতিতে ৪৫ হাজার ৮৯২ কোটি ৪০ লাখ ২৪ হাজার টাকার বাড়তি স্ফীতি ঘটবে। আর জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়লে টাকার অঙ্কে জিডিপির বাড়তি প্রাপ্তি আসবে মোট ৪২ হাজার ৩৬২ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। জিডিপি সর্বনিম্ন ১ শতাংশ ধরা হলে আগামী বছর জিডিপির অতিরিক্ত প্রাপ্তি মিলবে মোট ৩৫ হাজার ৩০১ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, ‘আমরা সম্ভাব্যতার বড় জায়গাটায় না গেলাম, সর্বনিম্ন সমীক্ষাটিই যদি গ্রহণ করি, তাও তো জিডিপি বাড়ার হার ন্যূনতম ১ শতাংশ হবে। এটাই হলো আমাদের পদ্মা সেতু, যা বাংলাদেশের সক্ষমতা, সমৃদ্ধি, অহংকার ও সাহসের প্রতীক, যার স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘উত্তরবঙ্গে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে বিরাট বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যার ধারাবাহিকতা এখনও আছে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে আগামীর অর্থনীতিতে তার চেয়েও বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে।
সম্ভাব্যতার ভিত্তি যেখানে
পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৭টি জেলার কৃষি খাত বেগবান হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতে বিপ্লব ঘটবে। এতে শিল্পোৎপাদন বাড়বে। দ্রুত পণ্য আনা-নেয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ার প্রভাবে সারা দেশের বাণিজ্য নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে শিক্ষা ব্যবস্থায়। এ ছাড়া কুয়াকাটা, সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটন খাত বিকশিত হবে। ফলে হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ গড়ে উঠবে।
মোংলা বন্দর, পায়রা বন্দর ও এনার্জি হাব, ইপিজেড, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বরিশাল-পিরোজপুরে শিপ বিল্ডিং শিল্পসহ সার্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উল্লম্ফন দেখা যাবে কর্মসংস্থানে।
এখন জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের যেসব মানুষ জীবিকার তাগিদে ঢাকামুখী হয়েছে, তারা এলাকায় ফিরে যাবে এবং সেখানেই উৎপাদন, সেবা ও বাণিজ্যমুখী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে। এসবেরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জিডিপি এবং টোল আদায়ে।
আরও পড়ুন:
সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। পদ্মার তীরে মৃদুমন্দ বাতাস। একটা মিনি ট্রাক ওঠার পর বন্ধ হয়ে গেল ফেরির দরজা। গগনবিদারী শব্দ তুলে সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় কুঞ্জলতায় বাজল প্রস্থান ঘণ্টা।
নদীর অন্য প্রান্তে মাঝেরকান্দি ঘাট। কুঞ্জলতা যখন পদ্মায় ভাসে এই ঘাটের পথে, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তখন শিমুলিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে মাঝিরকান্দিতে নোঙর করা ফেরি ‘বেগম রোকেয়া’। এই দুটি ফেরির ঘাট ছাড়ার মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে দক্ষিণের পথে সড়কযাত্রায় পদ্মার মাওয়া-জাজিরা নৌরুটে ফেরি যুগের দৃশ্যত অবসান ঘটল।
দেশের অহংকার হয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে নির্মিত হয়েছে সেতু। সেই সেতু খুলে দিতে শনিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর রোববার ভোরে পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে যান চলাচলের জন্য।
সেতুটি উদ্বোধনের পর স্থানীয় পর্যায়ের নৌযান পারাপারে সীমিত পরিসরে এই রুটে ফেরি থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে দূরপাল্লার প্রায় সব যানবাহন ২৬ জুন থেকে সহজ চলাচলের জন্য ব্যবহার করবে পদ্মা সেতু।
কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতুর উদ্বোধন কেন্দ্র করে শনিবার রাত পর্যন্ত এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে কয়েক দিন ধরে পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে প্রতি রাতেই ফেরি বন্ধ রাখা হয়েছে। একই অবস্থা শনিবার রাতেও থাকলে যান চলাচলের জন্য রোববার ভোরে সেতু খুলে দেয়ার আগে শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি নৌরুটে আর ফেরি চলাচলের সম্ভাবনা নেই।
কুঞ্জলতার শেষ প্রাইভেট কার
নদী পার হয়ে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছেন ঢাকার বাসিন্দা মো. খোকন। সব শেষ ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে তার চালিত প্রাইভেট কারটি ‘দ্য লাস্ট ফেরি’ কুঞ্জতলায় ওঠে।
শেষ ফেরির যাত্রায় উচ্ছ্বসিত খোকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এতদিন আমাদের যে কী ভোগান্তিটা না হতো- ঘাটে এসে বসে থাকা কিংবা সিরিয়াল মেইনটেইন করা। ওই সব আর হবে না। ঢাকা থেকে সরাসরি হাইওয়ে দিয়া এসে ব্রিজ দিয়ে চলে যাব।’
পদ্মা সেতু তৈরি করে সরকার দক্ষিণবঙ্গবাসীকে ঋণী করে ফেলেছে বলেও মন্তব্য খোকনের। তিনি বলেন, ‘অনুভূতি বলার মতো না। দক্ষিণাঞ্চলে আমরা যারা চলাচল করি, বিভিন্ন জায়গায় যায়, আগে যেমন একটা মানুষ মারা গেলেও ফেরির জন্য বসে থাকতে হতো। এখন আর বসে থাকার অপশন নাই। এখন আমরা সরাসরি সেতু দিয়া যামুগা।’
ফেরির শেষ গাড়ি
কুঞ্জলতা ফেরির সব শেষ গাড়ি ‘ঢাকা মেট্রো- ন ১৬-৭২৭০’ নম্বরের একটি মিনিট্রাক। ফরিদপুরের কিশোর বয়সী লিমন চালাচ্ছিলেন গাড়িটি। বললেন, সামনে আর কখনও ফেরিতে উঠতে চান না। সেতু পাড়ি দিয়ে সোজা চলে যেতে চান গন্তব্যে।
দুই বছর হলো এই পেশায় এসেছেন লিমন। ফেরি পারাপারের এই অভিজ্ঞতা মোটেও তার কাছে সুখকর নয়।
লিমন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ওপর দিয়া যামু। ভালো উপকার হইল। এই যে আমি আম টানি। সেদিনকা পইচা গেছিল প্রায়, যদি রাইতে না যাইতে পারতাম।’
ফেরির ইনচার্জ মাস্টার সাইফুল আবেগতাড়িত
কুঞ্জলতাকে মাঝিরকান্দি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছে ইনচার্জ মাস্টার সামশুল আলম সাইফুলের কাঁধে। এই নৌরুটে সাড়ে চার বছর ধরে ফেরি চালাচ্ছেন তিনি। সেতু উদ্বোধনের আগে শেষবারের যাত্রায় নিজের আসনে বসে আপ্লুত সাইফুল। একের পর স্মৃতি ভর করে কথায়।
সাইফুল বলেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত থাকার কারণে আন্তরিকতা কাজ করতেছে। পদ্মা সেতু জাতির জন্য খুব প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। যখন ওয়েদার খারাপ থাকে, যখন স্পিডবোট, লঞ্চ এসব বন্ধ থাকে, তখন পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের অনেক কষ্ট হয়। আমি নিজে দেখছি। অনেক সময় দেখা যেত, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসে মানুষ যেতে পারছে না।’
দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে সাইফুল জানালেন, দাফনের সময় নির্ধারণ করেও ফেরি পারাপারের জটিলতায় ঠিক সময়ে মরদেহ দাফন না করার ঘটনাও ঘটেছে।
তিনি বলেন, ‘এই পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে এই কষ্ট আর থাকবে না। আমরা চাকরি করছি। আমাদের হয়তো যেখানে প্রয়োজন ম্যানেজমেন্ট সেখানে নিয়ে যাবে। সর্বশেষ ফেরিটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। তবে যতটুকু জেনেছি, এখানে ওভারলোড গাড়ি এলে বা সেতুর ওপর যেসব গাড়ি চলতে পারবে না, সেগুলো পারাপারে ফেরির দরকার পড়তে পারে।’
এই রুটে যানবাহনবোঝাই শেষ ফেরি চালানোর অনুভূতি জানাতে গিয়ে ইনচার্জ মাস্টার বলেন, ‘এই পারাপারে কথা আসলে…সবকিছু তো স্মৃতি হয়ে থাকবে। এগুলো জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হয়ে থাকবে।’
সাইফুল বলেন, ‘নিরাপদে পার করে দেয়ার চেষ্টা সব সময় ছিল, আজকেও আছে। সব সময় চেষ্টা থাকে জানমাল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, জনগণের সম্পদ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার। এটাই কাম্য, এটাই কামনা করি। এই যাত্রাতেও যেন অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা পথে না ঘটে।’
এ রুটের যাত্রীদের খুব ‘মিস করবেন’ সাইফুল। বলেন, ‘যাত্রীরা এসে কতক্ষণ আনন্দ উল্লাস করে এ রুট-ওই রুট পার হয়ে চলে গেছেন। আবার করোনার মধ্যে কয়েকজন যাত্রী মারা গেছেন তীব্র গরমে। এগুলো হৃদয়বিদারক ঘটনা। স্মৃতি হয়ে মনে থাকবে।’
আবেগতাড়িত সাইফুল বলেন, ‘অনেক যাত্রী এসে স্টিয়ারিং ধরে বলতেন আমি একটু চালাই। আমি ভিডিও নিয়েছি, তারা সেলফি তুলেছেন। আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে দেখিয়েছেন তিনি ক্যাপ্টেন। এসব মিস করব।’
খরস্রোতা পদ্মা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় যখন বাংলাবাজার থেকে এপারে আসতাম, স্রোতের কারণে ফেরি সোজা রাখা কঠিন হয়ে পড়ত। আড়াআড়ি হয়ে যেত ফেরি।’
ফেরি চালাতে গিয়ে তার জীবনে ওই সময়টায় খুব কষ্ট হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাইফুল বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে যাতে আঘাত না লাগে, যাত্রী আর গাড়িগুলো যেন নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারি, সেই চেষ্টাটা থাকত।’
ফেরিতে সুখ-দুঃখ
কুঞ্জলতা ফেরির লস্কর নাজমুলকে সেতু ও ঘাটের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই চটজলদি উত্তর, ‘পদ্মা ব্রিজ হইছে খুব খুশি হইছি, মানুষের কষ্ট কমব, দেশের উন্নতি হইব। আমরা এই ঘাট ছাইরা হয়তো অন্য ঘাটে ডিউটি করমু, কিন্তু এই ঘাটের সঙ্গে বহু বছরের সম্পর্ক।
‘ব্রিজের জন্য মানুষ অহন কম আসব। ফেরিতে গাড়ি লোড-আনলোড করলে গাড়ির ড্রাইভাররা খুশি হইয়া পাঁচ-দশ টাকা দিত, এইডা আমাগো বাড়তি ইনকাম ছিল। তবে দেশের ভালো তো সবার ভালো, আমাগো ইনকাম কম হইলেও সমস্যা নাই, দেশ উন্নতি করুক।’
কুঞ্জলতার কোয়ার্টার মাস্টার মো. মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবাই একত্রিত হলে আনন্দ লাগত। সব সময় মানুষ দেখছি। সব সময় হৈ-হুল্লোড়, উল্লাসে দিন কাটাচ্ছি। এখন আমরা হয়তো আস্তে আস্তে পণ্যবোঝাই ট্রাক নেব। মানুষ থাকবে না। এত আনন্দও লাগবে না।’
শেষ ফেরি কুঞ্জলতায় ওঠা অ্যাম্বুলেন্সচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এই ঘাট দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে কত রোগী নিয়ে গেছি। ঘাটের জ্যামে আটকে আমার গাড়িতে ছেলের সামনে বাবা মারা গেছে, ছোট বাচ্চা মারা গেছে। কতবার চোখের পানি মুছছি।
‘পদ্মা খালি ব্রিজ না, আল্লাহর রহমত। আমি চাই না আমার গাড়িতে আর কেউ মারা যাক।’
ফেরিঘাটে এতদিন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ যাদের নিত্যসঙ্গী ছিল, সেই ট্রাকচালকরাও শেষ ফেরিতে চড়তে তিন দিন ঘাটে অপেক্ষা করেছেন।
পণ্যবাহী ট্রাকের চালক মিজান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত তিন দিন এই ঘাটে বসা। ১ হাজার ৫০০ টাকা এই কয়দিন এখানে বসেই খরচ করছি। শেষে উপায় না পাইয়া ঘাটে ৩০০ টাকা ঘুষও দিছি। অহন ফেরিতে উঠলাম। আল্লায় হাতে ধইরা না তুললে আর কখনও ফেরিতে উঠমু না, অহন আমাগো ব্রিজ আছে।’
আরেক ট্রাকচালক রাব্বানি অবশ্য ভাবছেন খরচ নিয়ে। এখন ফেরির খরচ কমলে তিনি সেতুর পাশাপাশি ফেরিতেও চড়তে চান।
রাব্বানি বলেন, ‘ব্রিজ হইছে ভালা কথা। কিন্তু ব্রিজের যে টোল এত টাকা দিলে আমরা পোষামু কেমনে? অহন যদি ফেরির ভাড়া কমে তাইলে আমি জরুরি কিছু না হইলে ফেরিতেও যামু। এত বছর ধইরা ঘাটের লগে পরিচয় আমার, তারে ভুইলা গেলে কেমনে হইব। আর যদি কখনও ঘাট না থাকে তাইলে মাঝেমইধ্যে বেড়াইতে আমু।’
আরও পড়ুন:খুলনা থেকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস উদ্দিন। বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই।
শনিবার সকাল ৮টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি সারা রাত ঘুমাতে পারে নাই। কখন আসব, আর মুক্তির গান শুনব।’
আর কিছু মুহূর্ত। এরপরই বর্ণিল আয়োজনে উন্মোচিত হবে দেশের সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতুর।
এই দিনটি বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তির দিন। আর এমন দিনে না আসলে আক্ষেপ থেকে যেত আজীবন। তাই এখানে আসতে পেরে উচ্ছ্বসিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। যে উচ্ছ্বাস তার কাছে ঈদের আনন্দের চেয়েও কম নয়।
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এই বিজয় ঈদের আনন্দের চেয়ে কম নয়। সারা জীবন ঘাটে এসে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তির দিন আজ। এমন দিনে আসনে না পারলে মনে দুঃখ থেকে যেত। এখন মনে হয় পরিপূর্ণতা পেয়েছে। আর কয় দিনই বাঁচব। যে কয় দিন আসি, সেই কয় দিন শান্তিতে পার হতে পারব।’
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু ঘোষণার দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে আসব। শুক্রবারই আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরিবারের লোকজন আসতে দেয় নাই। পরে রাত ৩টার দিকে গাড়িতে করে রওনা দেই। সকাল ৭টায় শিবচর উপজেলার পাচ্চর নামিয়ে দেয়। পরে প্রায় ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সভামঞ্চের কাছে এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন শান্তি পাচ্ছি। প্রশাসনের ভাইরা খুব সহযোগিতা করছে, না হলে মঞ্চের কাছে আসতে পারতাম না।’
আরও পড়ুন:পদ্মা সেতুর আদলে এবার পুকুরের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মিত সেতুটির দেখা মেলে পটুয়াখালী শহরের সার্কিট হাউসের সামনের পুকুরে।
শনিবার পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জনমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সেতুটি নির্মিত হয়েছে বলে জানা গেছে। সেতুটি দেখতে ভিড় করতে দেখা যায় স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। সেতুতে উঠে অনেকে তুলছেন সেলফি, আবার গোটা সেতুকেও ক্যামেরাবন্দি করছেন অনেকে।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে জানা যায়, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে শনিবার সকালে পুকুরের এই সেতুতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার যৌথ এই আয়োজনে অনেক মানুষ অংশ নেবেন বলে প্রত্যাশা করছেন সেতু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সেতু নির্মাণের দায়িত্বে থাকা গোবিন্দ ঘোষাল জানান, ২৪ জন মানুষের ছয় দিন সময় লেগেছে সেতুটি নির্মাণ করতে। শুক্রবার কাজ শেষ করে জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপর সেখানে আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ১৯টি স্প্যানের ওপরে নির্মাণ করা সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ ফুট। পানি থেকে ছয় ফুট উপরে সেতুতে নির্মাণ করা হয়েছে নমুনা রেললাইন। উপরে দুই পাসে ২০টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। সেতুটি আলোকিত ও দৃষ্টিনন্দন করতে বিভিন্ন রঙের লাইটিং করা হয়েছে।
এটি নির্মাণে ৪৮৫টি বাঁশ, ৫০০ ঘনফুট কাঠ এবং ১৫০টি প্লাইউড ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান সেতুর নির্মাতা গোবিন্দ।
সেতু দেখতে আসা শহরের মিঠাপুকুর পাড় এলাকার মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সময় ও সক্ষমতার অভাবে সরাসরি পদ্মার পাড়ে গিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে পারিনি। কিন্তু কাঠের এ সেতু, এর নিচের পিলার ও রেললাইনের অংশ দেখে মনে হয়, এ যেন হুবুহু পদ্মা সেতু।’
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে জেলাবাসীর কাছে স্মরণীয় করে রাখতে ব্যতিক্রম এই আয়োজন করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন:উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও এর ইতিবাচক প্রভাবের কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ। আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’তে সম্প্রতি একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। নিউজবাংলার পাঠকের জন্য সেটি ভাষান্তর করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্যের জন্য জনসংখ্যা যে দায়ী নয়, বাংলাদেশিরা তা ভালো করে জানে। দারিদ্র্য কাটিয়ে ওঠার অন্যতম বাধা সম্পদ কিংবা প্রতিভার অভাব। অন্য জায়গার মতো বাংলাদেশেও অতিদরিদ্ররা এটি মেনে নেয়ার অনন্ত চক্রে আটকা পড়ে।
তবে এটি পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি দুর্বল জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে তুলে আনছে।
এ লক্ষ্যে সরকারের কার্যকর উদ্যোগগুলোর একটি হলো আবাসন প্রকল্প। এই চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করে। গৃহহীন এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ঘর তৈরি করে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ প্রকল্পের ৩০ হাজার ঘর দেড় লাখের বেশি পরিবারকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দেবে।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের মধ্যে আছে সড়ক নির্মাণ, খাওয়ার পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। এটি কৃষিকাজ, পশুসম্পদ পরিচালনা এবং ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ দেয়। বছরের পর বছর ধরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ২ লাখ ৯৮ হাজারের বেশি পরিবার সহায়তা পেয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্প লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন হচ্ছে, পুরুষ-শাসিত সমাজব্যবস্থা থেকে দেশ বের হয়ে আসছে। নারীদের এখন পুরুষদের সমান সম্পত্তির অধিকার রয়েছে। জমিসহ আশ্রয়ণের সম্পদ স্বামী-স্ত্রীর যৌথ মালিকানাধীন। এই সম্পত্তি অধিকারের কারণে নারীরা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
একটি প্রাণবন্ত ও আধুনিক জাতি হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স’ ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি করেছে।
যদিও অনেক কাজ বাকি, তবে বাংলাদেশি নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ ভোগ করছেন। নারীর মর্যাদা উন্নত করার কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য পাচ্ছে।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ১৯৯৬ সালে ছিল ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২০ সালে তা ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। চরম দারিদ্র্যের হার (যাদের দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারের কম) ২০০৯ সালে ছিল ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির’ প্রশংসা করেছে। এটিকে ‘দারিদ্র্য নিরসনের মডেল’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন ৭১০ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬৪ ডলার হয়েছে। এইচএসবিসি ব্যাংক সম্প্রতি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি দেশ হবে। কারণ গত ২০ বছরে প্রায় ৬ শতাংশ টেকসই জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে এখানে।
ভৌত অবকাঠামো এবং অনলাইন সংযোগকে শক্তিশালী করছে বাংলাদেশ। সরকারের অর্থায়নে পদ্মা সেতু একটি মেগা প্রকল্প; যা দেশের সঙ্গে গোটা অঞ্চলকে সংযুক্ত করে। সেতুটি বাংলাদেশের জিডিপিকে বাড়তি ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। যানজট কমাতে এবং যাতায়াতের সময় বাঁচাতে রাজধানী ঢাকায় একটি মেট্রোরেল, বেশ কয়েকটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ চলছে।
অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যও সাহায্য করছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক দশকে তিন গুণ বেড়ে ২০২১ অর্থবছরে ২ হাজার ২২৭ ডলার হয়েছে, যা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। একসময় পশ্চিমে ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবে উল্লেখিত একটি দেশের জন্য এটি এক অসাধারণ পরিবর্তন।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এ বছর দরিদ্রতম দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত হওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাস্তব ফলাফল কখনও বিমূর্ত হয় না। আলেয়া বেগমের কথাই ধরা যাক। ৩০ বছর ধরে আলেয়া এবং তার পরিবার একটি খাল-পরিবর্তিত-আবর্জনার স্তূপের পাশে বাস করেছিল। তার ছেঁড়া জামাকাপড় দারিদ্র্য জীবনের সাক্ষ্য দিচ্ছিল। আলেয়ার আট ছেলে এবং এক মেয়ে মারা যায় একটি দুর্ঘটনায়। এ ঘটনার পর পরই আলেয়ার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনি একা, নিঃস্ব এবং আশ্রয়হীন ছিলেন।
আলেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে একটি বাড়ির জন্য নির্বাচিত হন। তার জীবনের গতিপথ বদলে যায়। বাসস্থান এবং খাবারের ফলে আলেয়া এখন আর ক্ষুধার্ত বা জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে নেই। বরং তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে কাজ শিখে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
এমন গল্পগুলোর অসংখ্য পুনারাবৃত্তি বাংলাদেশে ঘটছে এবং আরও অনেক দেশেও ঘটার সুযোগ রয়েছে।
ভাষান্তর: সারোয়ার প্রতীক
মন্তব্য