দেশের অনেক ভাটি অঞ্চল যখন পুড়ছে তীব্র দাবদাহে, তখন সিলেট ভাসছে জলে। সেখানে বিরাজ করছে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি।
এর আগে গত এপ্রিলে বন্যায় তলিয়ে যায় সিলেটসহ আশপাশের হাওর এলাকার ফসল। এর মাসখানেক না যেতেই সিলেটে আবারও দেখা দিয়েছে বন্যা।
এবার বন্যা এসেছে আরও ভয়ঙ্কর রূপে। তলিয়ে গেছে প্রায় পুরো সিলেট। সুনামগঞ্জেরও বেশিরভাগ এলাকা জলমগ্ন।
বারবার কেন সিলেটে বন্যা হচ্ছে? বন্যা কেন এত তীব্র আকার ধারণ করছে?
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেটে প্রধান নদীগুলো বিশেষত সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, নগর ও এর আশপাশের এলাকার বিভিন্ন জলাশয় ভরাট, দখল হওয়া এবং সিলেটের উজানে মেঘালয়ে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণেই এই বন্যা।
বুধবার দুপরে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবুল মোমেনও এসব কারণকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, ‘সিলেটে এই মৌসুমে সব সময়ই ঢল নামে। আমাদের ছেলেবেলায়ও এমনটি দেখেছি। তখন পানি আটকে থাকত না, চলে যেত। কারণ আমাদের শহরে অনেক পুকুর ছিল।
‘প্রত্যেক বাড়ির সামনে পুকুর ছিল। আর সিলেটকে বলা হতো দিঘির শহর। এখন আমরা নগরের ভেতরের সব পুকুর-দিঘি ভরাট করে বড় বড় বিল্ডিং করেছি। হাওরগুলো ভরাট করে ফেলেছি। এ ছাড়া প্রধান নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। খালি মাঠগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে পানি নামতে পারতেছে না। যেকোনো দুর্যোগেই সিলেটের জন্য এটা একটা ভয়ের কারণ।’
নদীর তলদেশ ভরাট
সিলেটের প্রধানতম নদী সুরমার দুই রূপ। বর্ষায় দুকোল উপচে ডুবিয়ে দেয় জনবসতি। আর গ্রীষ্মে পানি শুকিয়ে পরিণত হয় মরা গাঙে। জেগে উঠে চড়।
প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই নদী বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে পানিহীন, মৃতপ্রায়।
পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে নদীর তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভূমি। অপরদিকে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।
ভরাট হয়ে পড়েছে এ নদীর উৎসমুখও। নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে জেগেছে ৩৫টি চর। দুই দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় যৌথ নদী কমিশনে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আটকে আছে উৎসমুখ খননও।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সুরমা নদীর উৎসমুখ খননে ২০১২ সালে সিলেট থেকে একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর নদী খননে সমীক্ষা চালানো হয়।
সমীক্ষার পর নদী খননে উদ্যোগ নেয়ার কথা ওই সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। এরপর এ বিষয়ে আর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
পরে ২০১৮ সালে সিলেট সদর উপজেলার কানিশাইলে ৬০০ মিটার সুরমা নদী খনন করা হয়। ওই সময় সিলেট সদর উপজেলা এবং কানাইঘাট উপজেলার কয়েকটি অংশে নদী খননের জন্য প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির মৌসুমে নদী উপচে পড়ে পানি। ভরাট হয়ে গেছে সিলেটের অপর প্রধানতম নদী কুশিয়ারাও। এই দুই নদী খনন ছাড়া বন্যা থেকে উত্তোরণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে আছে। এ ছাড়া নাগরিক বর্জ্য, বিশেষ করে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য সুরমা নদীর তলদেশে শক্তভাবে বসে আছে। এ কারণে নদী পানি ধারণ করতে পারছে না।
‘যৌথ নদী হওয়ায় নদীর উৎসমুখ ভরাট করতে দুই দেশের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। তাই আমরা সিলেট মহানগরের অংশে সুরমা নদী খননের দাবি অসংখ্য বার জানিয়েছি। সেই দাবি আমলে নিলে নদীর পানি উপচে বন্যা হতো না, সিলেট নগরের ছড়া ও খালের পানিও অনায়াসে নেমে যেতে পারত।’
সুরমাসহ এই এলাকার নদীগুলো খননের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুরমাসহ এই এলাকার বেশির ভাগ নদীই নাব্য হারিয়েছে। এগুলো খনন করা প্রয়োজন। নদী খননের জন্য গত বছর আমরা ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সম্ভাব্যতা যাছাই শেষে এটি এখন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন।’
আগামী বর্ষার আগেই নদী খনন করা হবে উল্লেখ করে বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সিলেটের নদীগুলো খননের ব্যাপারে আমাদের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক। আমরা নদী খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী বর্ষার আগেই নদীগুলো খনন করতে হবে।’
নগরের জলাশয় ভরাট ও দখল
সাগরদিঘির পাড়, লালদিঘির পাড়, রামেরদিঘির পাড়সহ সিলেট নগরীর অন্তত ২০/২৫টি এলাকার নাম এমন। দিঘির নামে এলাকার নাম ঠিকই আছে, কিন্তু নেই দিঘিগুলো। ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। গত তিন দশকে ভরাট হয়ে গেছে নগরীর অর্ধশতাধিক দিঘি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসেবে, ১৫/২০ বছর আগেও সিলেট নগরে অর্ধশতাধিক বৃহৎ দিঘি ছিল। অথচ এখন ঠিকে আছে মাত্র ১০/১১টি। বাকিগুলো ভরাট হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হিসাবে, সিলেটে পুকুর-দিঘি মিলিয়ে তিন শতাধিক জলাশয় ছিল। এর দুই তৃতীয়াংশই ভরাট হয়ে গেছে। অনেক জলাশয় ভরাট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।
এ ছাড়া সিলেটের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২৫টি প্রাকৃতিক খাল। যা ‘ছড়া’ নামে পরিচিত। পাহাড় বা টিলার পাদদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে ছড়াগুলো গিয়ে মিশেছে সুরমা নদীতে। এসব ছড়া দিয়েই বর্ষায় পানি নিষ্কাশন হতো। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না।
এখন অনেক স্থানে এসব ছড়ার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। ছড়াগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই নগরজুড়ে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।
সিলেট সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৩টি বড় ছড়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরেই এসব ছড়ার দু’পাশ দখল করে রেখেছে স্থাপনা নির্মাণ করেছে অবৈধ দখলদাররা।
এ ছাড়া নগরের উপশহর এলাকার হাওর ভরাট করে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। বাঘা এলাকার হাওর ভরাট করে হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট।
জলাধারগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় নগরের পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এখন বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আর ঢল নামলে বন্যা হয়ে যায়।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রায় ৩০ কিলোমিটার ছড়া উদ্ধার করেছি। এতে নগরীতে আগেরমতো আর জলাবদ্ধতা হয় না। বেশি বৃষ্টিতে নগরীর কিছু এলাকায় পানি জমলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা নেমে যায়।
‘আমরা নগরের জলাশয়গুলো রক্ষায়ও বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আর কোনো জলাশয় ভরাট করতে দেয়া হচ্ছে না।’
উজানে অতিবৃষ্টি
সিলেটে গত কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। এর চেয়েও বেশি বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে। এবার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে চেরাপুঞ্জিতে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চেরাপুঞ্জিতে গত পাঁচ দিনে ১ হাজার ২৩৮ মিলিমিটিার বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটেও অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে। এই পানি নদী ধারণ করতে পারছে না।’
বুধবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুল হক সিলেটে বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে এসেও একই তথ্য জানান। বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। এক দিনেই প্রায় ১ হাজার ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টি ঢল হয়ে সিলেটের দিকে নামছে, ফলে বন্যা দেখা দিয়েছে।’
পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘ভারতের উজানের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের সঙ্গে প্রচুর মাটি আর বালুও আসছে। কারণ উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশেষ করে মেঘালয় বৃক্ষশূন্য করার কারণেই এমন ভূমিক্ষয় হচ্ছে।
‘এতে সুরমাসহ সিলেটের অন্য নদ-নদীর তলদেশ আরও ভরাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দ্রুত সুরমা, কুশিয়ারাসহ সিলেটের অন্য নদ-নদীর খনন করা প্রয়োজন। তবেই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।’
গত এপ্রিলে সুনামগঞ্জের হাওরের পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলের নদীগুলো খননে উদ্যোগ নেয়া হবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে।’
আরও পড়ুন:রাজস্থানের উদয়পুরে দর্জি খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার দুজন পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। মুম্বাই হামলার সঙ্গেও বিষয়টি জড়িত বলে ধারণা করছে পুলিশ। কেননা ঘুষ দিয়ে খুনিদের একজন তার মোটরসাইকেল ২৬১১ নম্বরে নিবন্ধন করিয়েছিলেন। খুনের পর পালিয়ে যেতে ওই মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করেছিলেন তারা।
২৬১১ সংখ্যাটির সঙ্গে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাই হামলার যোগসূত্র থাকায় পুলিশ এর পেছনে মুম্বাই হামলাকারীদের হাত থাকার কথা ভাবছে। ওই হামলায় ১৭৫ জন নিহত হন।
মহানবীকে (সা.) নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মার পক্ষে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় গত মঙ্গলবার খুন হন উদরপুরের দর্জি কানহাইয়া লাল। তার শিরশ্ছেদ করেন গোস মোহাম্মদ ও রিয়াজ আখতারি নামে দুই যুবক। ৪৬ বছরের কানহাইয়ার শরীরে ২৬টি ছুরিকাঘাতের ক্ষত ছিল।
হত্যার দৃশ্য ভিডিও করেছিলেন খুনিরা। উদয়পুর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে রাজসামন্দ জেলায় এই মোটরসাইকেলসহ গ্রেপ্তার হন তারা। মোটরসাইকেলটি এখন উদয়পুরের ধানমান্ডি থানায় পড়ে আছে৷
বৃহস্পতিবার কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দুই অভিযুক্তকে আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের ১৪ দিনের জন্য বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠান।
পুলিশের বরাতে এনডিটিভির খবরে বলা হয়, রিয়াজ মোটরসাইকেল নিবন্ধনের জন্য ২৬১১ নম্বরটি চেয়েছিলেন। এ জন্য ৫ হাজার রুপি ঘুষও দিতে হয়েছে তাকে। এ ছাড়া রিয়াজের পাসপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে তিনি নেপালে গিয়েছিলেন। তার মোবাইল ডাটা ঘেঁটে দেখা গেছে, এই ফোন থেকে তিনি পাকিস্তানে কল করেছিলেন।
রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অফিস (আরটিও) রেকর্ড বলছে, রিয়াজ আখতারি ২০১৩ সালে এইচডিএফসি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে মোটরসাইকেলটি কিনেছিলেন। গাড়ির বিমার মেয়াদ ২০১৪ সালের মার্চে শেষ হয়েছিল।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পর উদয়পুরের ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং পুলিশ সুপারসহ ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) ৩২ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। সহিংসতার আশঙ্কায় রাজ্যজুড়ে জারি হয় এক মাসের ১৪৪ ধারা। বাড়তি পুলিশ মোতায়েন রয়েছে উদয়পুরে।
আরও পড়ুন:ঢাকার সাভারে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচদিন ধরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর শনিবার থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুছ আলী কলেজ প্রাঙ্গণে শুক্রবার দুপুরে শিক্ষক উৎপলকে স্মরণে এক শোক ও মতবিনিময় সভায় এসব কথা জানানো হয়।
কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসানের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে শিক্ষক উৎপলের মাগফিরাত কামনায় উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।
অধ্যক্ষ সাইফুল বলেন, ‘আপাতত কোনো পারিপার্শ্বিক চাপ আমরা অনুভব করছি না। এ রকম কোনো সুযোগও নেই, তবে মানসিকভাবে আমরা দুর্বল হয়ে পড়েছি। হয়তো বা জিতুর রিমান্ডে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। অন্য আসামিরা গ্রেপ্তার হলে, তখন তৃপ্তিটা পরিপূর্ণ হবে।
‘পুলিশের সঙ্গে আমাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তারা আমাদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে এতোদিন তারা বিক্ষিপ্ত ছিল এবং লেখাপড়ার ক্ষতিও হয়েছে। সামনে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা। তাদের দ্রুত ক্লাসে ফেরানোর চেষ্টা করছি।’
আধ্যক্ষ বলেন, ‘আগামীকাল থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হবে। এরই মধ্যে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। আমরা দুই, এক দিন ক্লাস নিয়ে পড়ার নির্দেশনা দিয়ে ছুটি দেব।’
এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে ক্লাসে ফিরতে পারে এ জন্য পুলিশ টহলসহ সার্বিক নিরাপত্তা জোরদারের নিশ্চিতের কথা জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘এখানে স্কুল ও কলেজ চলাকালীন সময়ে পুলিশের পেট্রোল টিম থাকবে, যা অলরেডি চলমান। কোনো জায়গায় কোনো সমস্যা থাকলে সুনির্দিষ্টভাবে অমাদের জানালে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। কোনো জায়গায় ইভটিজিং, গ্যাং তৈরি করা হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম কোনোভাবেই বিঘ্নিত হওয়ার সুযোগ নেই। সঠিক বিষয়টিই আমরা তুলে ধরব।’
গত শনিবার কলেজ প্রাঙ্গণে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার সময় দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে জখম করে। পরদিন সাভারের একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
একই দিন শিক্ষকের উৎপলের বড় ভাই অসীম কুমার সরকার আশুলিয়া থানায় জিতুকে প্রধান করে অজ্ঞাত আরও ৩ থেকে ৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। বুধবার অভিযুক্ত ছাত্র জিতু ও তার বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বর্তমানে আসামিরা আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছ পাঁচদিনের রিমান্ডে আছেন।
আরও পড়ুন:নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ঘটনায় ওই প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষককে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অচীন কুমার চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানোর নোটিশে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
দলের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া আক্তার হোসেন টিংকু ওই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তিনি নড়াইল সদরের বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
কী আছে নোটিশে
টিংকুকে দেয়া নড়াইল সদর আওয়ামী লীগের নোটিশে বলা হয়, ‘এতদ্বারা আপনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা যাচ্ছে যে, গত ১৮ জুন/২২ তারিখে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্রের মোবাইলে স্ট্যাটাস নিয়ে এক সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য আপনি উক্ত কলেজের একজন শিক্ষক এবং ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরিশেষে দেখা যায়, আপনার উপস্থিতিতে উক্ত কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে বাহির করে আনা হয়, যাহা নিন্দনীয়, শিক্ষকসমাজকে হেয়প্রতিপন্ন করার শামিল।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, মিডিয়ার খবরে আপনাকে জড়িত করে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। সে কারণে আপনি এর দায়িত্ব এড়াইতে পারেন না এবং আমরা মনে করি আপনি সভাপতি হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
‘উপরোক্ত কারণে আপনাকে উক্ত বিষয়ে এই পত্র পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে নিম্ন স্বাক্ষরকারীদ্বয়ের নিকট লিখিত কারণ দর্শাইতে বলা গেল এবং অদ্য হইতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া গেল। ইউনিয়নের সহসভাপতি মশিয়ার রহমানকে দায়িত্ব দেয়া গেল।’
ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।
এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
ঘটনা তদন্তে কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। এই কমিটিতে নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুবায়ের হোসেনের নেতৃত্বে আছেন নড়াইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবির ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান।
আরও পড়ুন: শিক্ষককে জুতার মালা: ঘুম ভাঙল প্রশাসনের, হারাচ্ছেন না পদ
কী বেরিয়ে এসেছে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে হেনস্তার পেছনে কলেজে অভ্যন্তরীণ বিরোধের বিষয়গুলোও অনুসন্ধান করছে এই তদন্ত কমিটি। কমিটির সদস্য নড়াইল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনার সঙ্গে শিক্ষকদের কেউ জড়িত কি না আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি। ঘটনার ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আমাদের এ রকম মনে হচ্ছে।
‘এত শিক্ষক থাকতে যখন ঘটনাটি অল্পের মধ্যে ছিল, তখন বিষয়টি সবাই মিলে চেষ্টা করলে সমাধান করা যেত। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ বিষয়টি জটিল করার দিকে নিয়ে এটা করেছি কি না, সে বিষয়টি আমাদের অনুসন্ধানের মধ্যে আছে। আমি বিষয়টি এখনও পরিষ্কার হতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘তদন্তে এমন কিছু এখনও প্রমাণ করতে পারিনি। তবে যারা আমাদের সাক্ষাৎ দিয়েছেন, তারা বলছেন অভ্যন্তরীণ কোনো ঝামেলা থাকতে পারে।’
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘কলেজে বেশ কয়েক বছর ধরে অধ্যক্ষের পদ ফাঁকা আছে। স্বপন কুমারের আগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন আক্তার হোসেন টিংকু নামের আরেক শিক্ষক। পরে তাকে সরিয়ে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
‘আমরা শুনেছি, এদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো বিরোধ থাকতে পারে। তবে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলেনি। হয়তো তাদের অন্তরে বিরোধিতা ছিল। প্রকাশ্যে কিছু ছিল না।’
আরও পড়ুন: পুলিশের সামনে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা কীভাবে?
আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে স্বপন কুমার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন গত বছরের ২৭ এপ্রিল। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আক্তার হোসেন জুনিয়র ছিলেন, তার ওপরে ছিলেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা আছে, অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অন্যজন দায়িত্ব পালন করবেন। সে কারণে তাকে (আক্তার) সরিয়ে নতুন একজনকে অধ্যক্ষ করা হয়েছিল।’
আইনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখার উপপরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১১ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়, বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করতে হবে।’
আক্তার হোসেনের পরিবর্তে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে অনীহা ছিল স্বপন কুমারের। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচীন চক্রবর্তী। তবে আইনি বাধ্যবাধকতার কারণেই পদটি গ্রহণ করতে হয় স্বপন কুমারকে।
অচীন চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আক্তার হোসেনের আগে কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন রওশান আলী। তিনি দুর্নীতির দায়ে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য (নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক) কলেজের সভাপতি ছিলেন, তিনি আক্তার হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। আক্তার কয়েক বছর দায়িত্বে ছিলেন।
‘পরে কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা সেলিম। তিনি পর্যালোচনা করে দেখেন, নীতিমালায় আছে অধ্যক্ষ না থাকলে টপ মোস্ট সিনিয়র শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাবেন। এরপর তিনি নীতিমালা অনুসারে স্বপনকে দায়িত্ব নিতে বলেন।
‘তিনি (স্বপন কুমার) রাজি ছিলেন না। তবে নীতিমালায় আছে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া টপ মোস্ট সিনিয়র দায়িত্ব না নিতে চাইলে তার শাস্তি হবে। তাই তিনি দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন।’
নীতিমালার এই দিকটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখার উপপরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদারও নিশ্চিত করেছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেউ দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (পরিচালনা পর্ষদ) তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে ভুক্তভোগী শিক্ষক মাউশিতে অভিযোগ করতে পারেন। এরপর মাউশি থেকে তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশ দেয়া হয়।’
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচীন চক্রবর্তীর দাবি, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পরিবর্তন নিয়ে স্বপন কুমারের সঙ্গে আক্তার হোসেনের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে আগে থেকে দ্বন্দ্ব আছে। কলেজে বিভিন্ন জটিলতার কারণে স্বপন কুমার এরই মধ্যে তিনবার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তবে আইনি বাধ্যবাধকতায় তিনি পদটি ছাড়তে পারেননি।
অচীন চক্রবর্তী বলেন, ‘স্বপন বাবু খুব ভালো মানুষ। সে কারও সাত-পাঁচে জড়ায় না, কারও সঙ্গে দ্বন্দ্বও বাধায় না। সে আগেও তিনবার আমাকে বলেছে, এই ঝামেলার জায়গায় থাকতে চায় না। বলেছে তার শরীর ভালো নেই।’
ঘটনার দিন প্রভাবশালী শিক্ষকরা ছিলেন নিশ্চুপ
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় গত ১৭ জুন রাতে ফেসবুকে নূপুরকে প্রশংসা করে একটি পোস্ট দেন। পরদিন রাহুলের বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছে যান একদল শিক্ষার্থী। কলেজের চারপাশ ঘিরে জড়ো হয় হাজারো বিক্ষুব্ধ মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে পরামর্শের জন্য স্বপন কুমার কলেজের কয়েক শিক্ষককে ডেকে নিলেও তারা নিশ্চুপ ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একপর্যায়ে এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা ওসির সামনেই
এ বিষয়ে স্বপন কুমার বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকালে কিছু ছাত্র আমাকে ঘটনাটি জানালে আমি তিনজন শিক্ষককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তাদের মধ্যে ছিলেন কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলাম, পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য ও কৃষি শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক কাজী তাজমুল ইসলাম। বাকি আরেক জন হলেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু।’
স্বপন কুমার বলেন, ‘কলেজের যেকোনো অঘটন ঘটলে আমি সব থেকে আগে এই তিন শিক্ষককে জানাই। প্রতিবারের মতো সেদিনও একইভাবে তাদের জানালাম।
‘স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেয়ার বিষয় নিয়ে আমি তাদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তবে তারা নীরব ছিলেন। কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এরই মধ্যে কলেজে গুজব ছড়িয়ে পড়ে আমি ওই ছাত্রকে সাপোর্ট করছি। তখন কিছু ছাত্র কলেজে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।’
কলেজের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে সাহায্য করেছে বলে মনে করছেন পরিচালনা পরিষদের সভাপতিও।
আরও পড়ুন: শিক্ষককে জুতার মালা: ছাত্রের বিরুদ্ধে এজাহারের ‘লেখক’ পুলিশ
তিনি বলেন, ‘যেকোনো ক্লাব, স্কুল, কলেজ, বাজার, রাজনীতিক যা বলেন সবখানে পক্ষ-বিপক্ষ আছে। সেই রকম একটি বিষয় আমাদের কলেজেও আছে। কলেজের কোনো বিষয় নিয়ে স্বপন বাবুর সঙ্গে আক্তার হোসেনের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে আক্তার হোসেনের হয়তো উদ্দেশ্য ছিল স্বপন বাবু সরে গেলে সে প্রিন্সিপাল হতে পারবে। এটা হয়তো আশা।
‘তবে কলেজের ১৮ জুনের ঘটনাটি এলাকার জামায়াত-বিএনপির লোকজনই ঘটিয়েছে। তারা চারপাশের পাঁচ থেকে সাতটি গ্রাম থেকে নছিমন ভরে ভরে লোক এনেছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, জামায়াত-বিএনপিরাই এসব করেছে। তারা হ্যান্ড মাইক নিয়ে এসে জামায়াত স্টাইলে এসব করেছে।’
কলেজের ভেতর থেকেই বাইরে গুজব ছড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করছেন অচীন চক্রবর্তী।
কলেজের কোনো শিক্ষক জড়িত থাকতে পারেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘থাকতে পারে মে বি। এটা ইন্টারনালি ইনফর্ম করে দিছে। এখন সারা দেশে জামায়াত-বিএনপি খুবই সোচ্চার। টেলিফোন পেলেই চলে আসে।’
অচীন চক্রবর্তীর দাবি, স্বপন কুমারের সঙ্গে কলেজের কোনো শিক্ষকের দ্বন্দ্ব নেই। তবে শিক্ষক আক্তার হোসেনের সঙ্গে শেখ আকিদুল ইসলাম নামের আরেক শিক্ষকের দ্বন্দ্ব আছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এই শেখ আকিদুলকেও পরামর্শের জন্য ডেকেছিলেন স্বপন কুমার।
আরও পড়ুন:ঢাকার সাভারে স্কুলছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু হিরোইজম দেখাতে গিয়ে তার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বলে জানিয়েছে র্যাব।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে বৃহস্পতিবার ব্রিফিংয়ে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানিয়েছেন।
উৎপল হত্যা মামলার প্রধান আসামি জিতুকে গাজীপুরের শ্রীপুরের নগরহাওলা গ্রাম থেকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি বুধবার সন্ধ্যায় নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন র্যাবের কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন।
জিতুকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদে কী জানা গেল, তা নিয়ে পরের দিন ব্রিফিংয়ে আসেন র্যাবের মুখপাত্র।
কোথায় ছিলেন জিতু
ঘটনার পর থেকে জিতু পালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেন বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক।
তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই জিতুকে ধরতে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করে র্যাব। ঘটনার দিন বিকেলে জিতু যখন বুঝতে পারে যে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুঁজছে, তখনই সে তার বাড়ি থেকে পালিয়ে মানিকগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয়। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সে তার অবস্থান পরিবর্তন করে আরিচা ফেরিঘাটে পৌঁছায় এবং ট্রলারে করে নদী পার হয়ে পাবনার আতাইকুলাতে তার এক পরিচিতের বাড়িতে আত্মগোপন করে।
‘পরদিন ভোরে সে আবারও তার অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য আতাইকুলা থেকে বাসে করে কাজিরহাট লঞ্চ টার্মিনালে এসে লঞ্চে করে আরিচাঘাট পৌঁছায় এবং সেখান থেকে বাসে করে গাজীপুরের শ্রীপুরের ধনুয়া গ্রামে আত্মগোপন করে। সেখান থেকেই আশরাফুল ইসলাম জিতু ওরফে জিতু দাদাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।’
শিক্ষার্থীদের প্রেষণা দিতেন উৎপল
খন্দকার আল মঈন জানান, মারধরে নিহত শিক্ষক উৎপল কুমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি ২০১৩ সালে আশুলিয়ার হাজি ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
তিনি জানান, উৎপল কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফর্ম, চুলকাটা, ধূমপান করা ও উত্ত্যক্তকরণসহ বিভিন্ন নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গজনিত বিষয় থেকে দূরে রাখতে প্রেষণা বা মোটিভেশন দিতেন। এ ছাড়াও তিনি ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলাধুলা পরিচালনা করাসহ শিক্ষার্থীদের সুপরামর্শের মাধ্যমে সৃজনশীলতা বিকাশে ভূমিকা রাখতেন।
‘উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে পরিচিত জিতু’
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার জিতু ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। তিনি শিক্ষা জীবনে বিরতি দিয়ে প্রথমে স্কুল ও পরে মাদ্রাসায় পড়েন। সর্বশেষ আবার স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বর্তমানে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।
জিতুর বিষয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সে স্কুলে সকলের নিকট একজন উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় শৃঙ্খলাভঙ্গ, মারামারিসহ স্কুলের পরিবেশ নষ্টের জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
‘স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ও স্কুল চলাকালীন ছাত্রীদের ইভটিজিং ও বিরক্ত করত। স্কুল প্রাঙ্গনে সকলের সামনে ধূমপান, স্কুল ইউনিফর্ম ব্যতীত স্কুলে আসা-যাওয়া, মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করত। সে তার নেতৃত্বে এলাকায় একটি কিশোর গ্যাং গড়ে তোলে। পাশাপাশি গ্যাং সদস্যদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে যত্রতত্র আধিপত্য বিস্তার করত।
‘পরিবারের নিকট তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে গ্রেপ্তারকৃত জিতু তার অনুসারী গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে তাদের ওপর চড়াও হতো ও বিভিন্ন সময় এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে হামলা ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে শোডাউন দিত বলে জানা যায়। একইভাবে স্কুল কমিটিতে তার পরিবারের প্রভাব থাকায় স্কুলেও শিক্ষকদের পরোয়া করত না জিতু।’
জিজ্ঞাসাবাদে কী বেরিয়ে এলো
জিতুকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই স্কুলের এক ছাত্রীর সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত জিতুর অযাচিতভাবে ঘোরাফেরা হতে বিরত থাকার বিষয়ে শিক্ষক উৎপল কুমার প্রেষণা প্রদান করেন। এই ঘটনায় সে তার শিক্ষকের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ও ওই ছাত্রীর নিকট নিজের হিরোইজম প্রদর্শন করার জন্য তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সে ঘটনার দিন সকালে একটি ক্রিকেট খেলার স্টাম্প স্কুলে নিয়ে আসে এবং তা শ্রেণিকক্ষের পেছনে লুকিয়ে রাখে ও তার শিক্ষককে আঘাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে।
‘পরবর্তী সময়ে কলেজ মাঠে ছাত্রীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালীন শিক্ষক উৎপল কুমারকে মাঠের এক কোনে শিক্ষককে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গ্রেপ্তারকৃত জিতু তার কাছে থাকা ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অতর্কিতভাবে বেধড়ক আঘাত করতে থাকে। গ্রেপ্তারকৃত জিতু তার শিক্ষককে প্রথমে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করে এবং পরবর্তী সময়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে গুরুতরভাবে জখম করে পালিয়ে যায়।’
জিতুর বয়স ১৯
র্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জিতুর শিক্ষাজীবন অনিয়মিত ছিল। প্রথমে সে স্কুলে ভর্তি হলেও পরবর্তী সময়ে সে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। এরপর সবশেষ মাদ্রাসা ছেড়ে নবম শ্রেণিতে এই স্কুলে ভর্তি হয়। এর মাঝে তার পড়াশোনায় গ্যাপও সৃষ্টি হয়েছিল। জিতুর সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্মসাল ২০০৩।
‘সে অনুযায়ী জিতুর বয়স ১৯ বছর, কিন্তু মামলার এজাহারে তার বয়স ১৬ উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়টি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে উপস্থাপন করা হবে।’
যা ঘটেছিল
সাভারে হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা ছেলেদের ফুটবল ও মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি। শনিবার স্কুলে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলছিল। এ সময় প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলা ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল ছেলে শিক্ষার্থীরা।
‘অভিযুক্ত ছাত্রও দ্বিতীয় তলায় ছিল। হঠাৎ সে নেমে মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় উৎপলকে উদ্ধার করে এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই সোমবার সকালে উৎপলের মৃত্যু হয়।’
অধ্যক্ষ জানান, উৎপলের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার এঙ্গেলদানি গ্রামে। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
তিনি আরও জানান, দায়িত্বের অংশ হিসেবেই উৎপল শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিং করতেন এবং তাদের নানা অপরাধ বা নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিচার করতেন।
আরও পড়ুন:অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ট্রাস্টির জামিন আবেদন বাতিল করেছে আদালত।
ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েসের আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী বৃহস্পতিবার জামিন আবেদন করেন।
তবে দুদকের আইনজীবী জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আসামিদের জামিন আবেদন বাতিল করে আদালত।
চার অভিযুক্ত হলেন এম এ কাশেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাজাহান।
এর আগে ২৩ মে তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে চারজনকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছিল বিচারক।
ওইদিন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের পক্ষে কোনো জামিন আবেদন না করে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন বাতিলের পক্ষে বক্তব্য দেন। তারা কারাগারে চারজনের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা চান।
দুদকের পক্ষে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘এই চারজন উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন আগাম জামিনের জন্য। কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে উচ্চ আদালত তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
‘নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ তারা হাসিল করেছেন। মামলায় আসামির তালিকায় আরও দুজনের নাম রয়েছে। তারা এখন পলাতক।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, শুধু অনুমানের ভিত্তিতে এ মামলা করা হয়েছে। অনুমানের ভিত্তিতে মানি লন্ডারিং মামলা হয় না। আর দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা হচ্ছে সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ। এখানে কোনো অভিযুক্তই সরকারি কর্মচারী নন। বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া অভিযুক্তদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তারা বয়সে প্রবীণ ও বৃদ্ধ।
এর আগে রোববার চার ট্রাস্টি আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেন। আদালত তা নাকচ করে দেয়।
সেই সঙ্গে শাহবাগ থানাকে আসামিদের গ্রেপ্তার করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়।
গত ৫ মে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী ঢাকায় তার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা করেন।
মামলার বাকি আসামিরা হলেন নর্থ সাউথের বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন আজিম উদ্দিন আহমেদ এবং আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মো. হিলালী।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হলো বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেমোরেন্ডাম অফ অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড আর্টিকেলস (রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস) অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় একটি দাতব্য, কল্যাণমুখী, অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারের সুপারিশ বা অনুমোদনকে পাশ কাটিয়ে বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের কিছু সদস্যের অনুমোদন বা সম্মতির মাধ্যমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ডেভেলপমেন্টের নামে ৯০৯৬ দশমিক ৮৮ ডেসিমেল জমির ক্রয়মূল্য বাবদ ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা অতিরিক্ত অর্থ লেনদেন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের হীন উদ্দেশে কম দামে জমি কেনা সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা দেন আসামিরা।
পরে বিক্রেতার কাছ থেকে নিজেদের লোকজনের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে আবার নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন তারা। সে এফডিআরের অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
আরও পড়ুন:নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টের জের ধরে ব্যাপক সহিংসতা ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ঘটনার পেছনে কলেজ শিক্ষকদের একটি অংশেরও উসকানি থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বপন কুমার বিশ্বাসের আগে ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু। তবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের কারণে প্রায় দেড় বছর আগে আক্তারকে সরিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় স্বপন কুমারকে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে স্বপন কুমার অনীহা দেখালেও আইনি বাধ্যবাধকতায় তিনি পদটি নিতে বাধ্য হন। এরপর বেশ কয়েকবার তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে সরে যেতে পারেননি।
কলেজসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্বপন কুমার দায়িত্ব ছেড়ে দিলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হতে আক্তার হোসেনের সামনে আইনি কোনো বাধা থাকবে না। আবার আক্তারেরও রয়েছে বিরোধী পক্ষ। কলেজে গত ১৮ জুনের ঘটনা জটিল হওয়ার পেছনে এসব হিসাব-নিকাশের ভূমিকা থাকতে পারে।
ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।
এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
ঘটনা তদন্তে কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। এই কমিটিতে নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুবায়ের হোসেনের নেতৃত্বে আছেন নড়াইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবির ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান।
আরও পড়ুন: শিক্ষককে জুতার মালা: ঘুম ভাঙল প্রশাসনের, হারাচ্ছেন না পদ
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে হেনস্তার পেছনে কলেজে অভ্যন্তরীণ বিরোধের বিষয়গুলোও অনুসন্ধান করছে এই তদন্ত কমিটি। কমিটির সদস্য নড়াইল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনার সঙ্গে শিক্ষকদের কেউ জড়িত কি না আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি। ঘটনার ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আমাদের এ রকম মনে হচ্ছে।
‘এত শিক্ষক থাকতে যখন ঘটনাটি অল্পের মধ্যে ছিল, তখন বিষয়টি সবাই মিলে চেষ্টা করলে সমাধান করা যেত। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ বিষয়টি জটিল করার দিকে নিয়ে এটা করেছি কি না, সে বিষয়টি আমাদের অনুসন্ধানের মধ্যে আছে। আমি বিষয়টি এখনও পরিষ্কার হতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘তদন্তে এমন কিছু এখনও প্রমাণ করতে পারিনি। তবে যারা আমাদের সাক্ষাৎ দিয়েছেন, তারা বলছেন অভ্যন্তরীণ কোনো ঝামেলা থাকতে পারে।’
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘কলেজে বেশ কয়েক বছর ধরে অধ্যক্ষের পদ ফাঁকা আছে। স্বপন কুমারের আগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন আক্তার হোসেন টিংকু নামের আরেক শিক্ষক। পরে তাকে সরিয়ে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
‘আমরা শুনেছি, এদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো বিরোধ থাকতে পারে। তবে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলেনি। হয়তো তাদের অন্তরে বিরোধিতা ছিল। প্রকাশ্যে কিছু ছিল না।’
আরও পড়ুন: পুলিশের সামনে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা কীভাবে?
আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে স্বপন কুমার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন গত বছরের ২৭ এপ্রিল। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আক্তার হোসেন জুনিয়র ছিলেন, তার ওপরে ছিলেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা আছে, অধ্যক্ষের অনুপস্থিতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অন্যজন দায়িত্ব পালন করবেন। সে কারণে তাকে (আক্তার) সরিয়ে নতুন একজনকে অধ্যক্ষ করা হয়েছিল।’
আইনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখার উপপরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১১ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়, বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করতে হবে।’
আক্তার হোসেনের পরিবর্তে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে অনীহা ছিল স্বপন কুমারের। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচীন চক্রবর্তী। তবে আইনি বাধ্যবাধকতার কারণেই পদটি গ্রহণ করতে হয় স্বপন কুমারকে।
অচীন চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আক্তার হোসেনের আগে কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন রওশান আলী। তিনি দুর্নীতির দায়ে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য (নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক) কলেজের সভাপতি ছিলেন, তিনি আক্তার হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। আক্তার কয়েক বছর দায়িত্বে ছিলেন।
‘পরে কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা সেলিম। তিনি পর্যালোচনা করে দেখেন, নীতিমালায় আছে অধ্যক্ষ না থাকলে টপ মোস্ট সিনিয়র শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাবেন। এরপর তিনি নীতিমালা অনুসারে স্বপনকে দায়িত্ব নিতে বলেন।
‘তিনি (স্বপন কুমার) রাজি ছিলেন না। তবে নীতিমালায় আছে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া টপ মোস্ট সিনিয়র দায়িত্ব না নিতে চাইলে তার শাস্তি হবে। তাই তিনি দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন।’
নীতিমালার এই দিকটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখার উপপরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদারও নিশ্চিত করেছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেউ দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (পরিচালনা পর্ষদ) তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে ভুক্তভোগী শিক্ষক মাউশিতে অভিযোগ করতে পারেন। এরপর মাউশি থেকে তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশ দেয়া হয়।’
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচীন চক্রবর্তীর দাবি, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পরিবর্তন নিয়ে স্বপন কুমারের সঙ্গে আক্তার হোসেনের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে আগে থেকে দ্বন্দ্ব আছে। কলেজে বিভিন্ন জটিলতার কারণে স্বপন কুমার এরই মধ্যে তিনবার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তবে আইনি বাধ্যবাধকতায় তিনি পদটি ছাড়তে পারেননি।
অচীন চক্রবর্তী বলেন, ‘স্বপন বাবু খুব ভালো মানুষ। সে কারও সাত-পাঁচে জড়ায় না, কারও সঙ্গে দ্বন্দ্বও বাধায় না। সে আগেও তিনবার আমাকে বলেছে, এই ঝামেলার জায়গায় থাকতে চায় না। বলেছে তার শরীর ভালো নেই।’
ঘটনার দিন প্রভাবশালী শিক্ষকরা ছিলেন নিশ্চুপ
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় গত ১৭ জুন রাতে ফেসবুকে নূপুরকে প্রশংসা করে একটি পোস্ট দেন। পরদিন রাহুলের বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছে যান একদল শিক্ষার্থী। কলেজের চারপাশ ঘিরে জড়ো হয় হাজারো বিক্ষুব্ধ মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে পরামর্শের জন্য স্বপন কুমার কলেজের কয়েক শিক্ষককে ডেকে নিলেও তারা নিশ্চিপ ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একপর্যায়ে এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা ওসির সামনেই
এ বিষয়ে স্বপন কুমার বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকালে কিছু ছাত্র আমাকে ঘটনাটি জানালে আমি তিনজন শিক্ষককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তাদের মধ্যে ছিলেন কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলাম, পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য ও কৃষি শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক কাজী তাজমুল ইসলাম। বাকি আরেক জন হলেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু।’
স্বপন কুমার বলেন, ‘কলেজের যেকোনো অঘটন ঘটলে আমি সব থেকে আগে এই তিন শিক্ষককে জানাই। প্রতিবারের মতো সেদিনও একইভাবে তাদের জানালাম।
‘স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেয়ার বিষয় নিয়ে আমি তাদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তবে তারা নীরব ছিলেন। কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এরই মধ্যে কলেজে গুজব ছড়িয়ে পড়ে আমি ওই ছাত্রকে সাপোর্ট করছি। তখন কিছু ছাত্র কলেজে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।’
কলেজের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে সাহায্য করেছে বলে মনে করছেন পরিচালনা পরিষদের সভাপতিও।
আরও পড়ুন: শিক্ষককে জুতার মালা: ছাত্রের বিরুদ্ধে এজাহারের ‘লেখক’ পুলিশ
তিনি বলেন, ‘যেকোনো ক্লাব, স্কুল, কলেজ, বাজার, রাজনীতিক যা বলেন সবখানে পক্ষ-বিপক্ষ আছে। সেই রকম একটি বিষয় আমাদের কলজেও আছে। কলেজের কোনো বিষয় নিয়ে স্বপন বাবুর সঙ্গে আক্তার হোসেনের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে আক্তার হোসেনের হয়তো উদ্দেশ্য ছিল স্বপন বাবু সরে গেলে সে প্রিন্সিপাল হতে পারবে। এটা হয়তো আশা।
‘তবে কলেজের ১৮ জুনের ঘটনাটি এলাকার জামায়াত-বিএনপির লোকজনই ঘটিয়েছে। তারা চারপাশের পাঁচ থেকে সাতটি গ্রাম থেকে নছিমন ভরে ভরে লোক এনেছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, জামায়াত-বিএনপিরাই এসব করেছে। তারা হ্যান্ড মাইক নিয়ে এসে জামায়াত স্টাইলে এসব করেছে।’
কলেজের ভেতর থেকেই বাইরে গুজব ছড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করছেন অচীন চক্রবর্তী।
কলেজের কোনো শিক্ষক জড়িত থাকতে পারেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘থাকতে পারে মেবি। এটা ইন্টারনালি ইনফর্ম করে দিছে। এখন সারা দেশে জামায়াত-বিএনপি খুবই সোচ্চার। টেলিফোন পেলেই চলে আসে।’
অচীন চক্রবর্তীর দাবি, স্বপন কামারের সঙ্গে কলেজের কোনো শিক্ষকের দ্বন্দ্ব নেই। তবে শিক্ষক আক্তার হোসেনের সঙ্গে শেখ আকিদুল ইসলাম নামের আরেক শিক্ষকের দ্বন্দ্ব আছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এই শেখ আকিদুলকেও পরামর্শের জন্য ডেকেছিলেন স্বপন কুমার।
শিক্ষক দ্বন্দ্বে সামনে আসছে আক্তার ও আকিদুলের নাম
স্বপন কুমারের আগে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য কবিরুল হকের সমর্থন ছিল তার সঙ্গে।
আক্তার হোসেনের দাবি, ১৮ জুনের ঘটনার পরদিন কলেজে এক সমাবেশে যোগ দিয়ে এমপি কবিরুল তাকে আবার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার প্রস্তাব করেন।
আক্তার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরের দিন স্থানীয় এমপি এসে আমাকে নতুন করে দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেছিলেন। তবে আমি রাজি হইনি। তিনি (এমপি কবিরুল) বলেছিলেন, এখানে মুসলমান লেবেলের একজন কড়া শিক্ষক দিতে হবে, যিনি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এই কথা বলে তিনি আমার নামটা বলে ফেলেছেন।’
শিক্ষককে অপদস্ত করার ঘটনায় তার নাম আলোচিত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আক্তার হোসেন বলেন, ‘এমপি সবার সামনে কথাটি বলায় অনেকে এসব ধারণা করছেন। তবে বাস্তবে আমি এর সঙ্গে জড়িত নই।’
আক্তার পাল্টা অভিযোগ তুলছেন আরেক শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত ভাবাপন্ন যারা আছেন, বিশেষ করে আকিদুল সাহেব। উনি মূলত আমার বিরোধিতা করছেন। তদন্ত কমিটির কাছে এভাবে বলেছেন যে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য সেদিনের ঘটনায় আমার ভূমিকা আছে।’
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ আকিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে আক্তার হোসেনের কোনো ঝামেলা নেই। মাঝে মাঝে কলেজে টুকটাক বিষয় নিয়ে মতের অমিল হতে পারে। ওই দিনের ঘটনায় কোনো শিক্ষকের উসকানি আছে বলে আমার মনে হয় না। ভিডিও ফুটেজ দেখলেই অনেক কিছু বোঝা যাবে।’
দলীয় কোনো পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেও দাবি করেন আকিদুল।
অন্যদিকে আক্তার হোসেনকে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করার প্রস্তাব দেয়ার বিষয়টি গত রোববার নিউজবাংলার কাছে অস্বীকার করেন নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক।
তবে পরে আবারও এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরদিনই কলেজে একটি শান্তিশৃঙ্খলার মিটিং হয়েছিল। সেখানে এলাকার উত্তপ্ত মানুষ বিভিন্ন রকম প্রস্তাব দিয়েছিল, শান্ত করার জন্য তাদের বিভিন্ন প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলাম।
‘তবে অধ্যক্ষ স্বপনকে দায়িত্ব থেকে সরানোর কোনো উদ্যোগ আমরা নেব না।’
কলেজে কর্মচারী নিয়োগ নিয়েও বিরোধ
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে সৃষ্ট পাঁচটি পদের জন্য গত মার্চে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। তবে নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে কার্যক্রম স্থগিত করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অচীন চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই নিয়োগগুলো এমপিওভুক্ত না। গ্রামের লোকদের দলাদলির কারণে নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। গ্রামের মানুষকে জোর করে কেউ কলেজে চাকরি দিতে চেয়েছিল।
‘বিষয়টি আমি এই মুহূর্তে বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না। তাহলে আমি গ্রামের মানুষের শত্রু হয়ে যাব। শহরের কলেজ হলে এ সমস্যা হতো না।’
জটিলতার কিছুটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির আত্মীয়কে নিয়োগের চাপ ছিল। তাই বন্ধ করা হয়েছিল। তিনি বারবার অনুরোধ করতেছিলেন। তারা আবার দ্বন্দ্ব করতেছিলেন। এই কারণে এটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে কলেজের ১৮ জুনের ঘটনার সঙ্গে ওই নিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই।’
আরও পড়ুন:নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টের জের ধরে ব্যাপক সহিংসতা ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ঘটনার গ্রেপ্তার চারজনকে রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে পুলিশ। এই আবেদনের ওপর ৩ জুলাই শুনানি হবে।
নিউজবাংলাকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন নড়াইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাহমুদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তারদের মধ্যে তিনজনকে ২৯ জুন ও একজনকে ৩০ জুন আদালতে তোলা হয়। তাদের প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে রিমান্ড পেতে পুলিশ আবেদন করেছে। আগামী ৩ জুলাই এই রিমান্ড শুনানির দিন রেখেছে আদালত। আসামিরা কারাগারে আছেন।’
আরও পড়ুন: লাঞ্ছিত স্বপন কুমার অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন বাধ্য হয়ে
ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।
আরও পড়ুন: অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা ওসির সামনেই
এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
নড়াইলে পুলিশের সামনে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে গলায় জুতার মালা দিয়ে অপদস্থ করার ঘটনার ৯ দিনের মাথায় ২৭ জুন এ ব্যাপারে মামলা করে পুলিশ।
আরও পড়ুন: শিক্ষককে জুতার মালা: ছাত্রের বিরুদ্ধে এজাহারের ‘লেখক’ পুলিশ
এ মামলার বাদী হয়েছেন নড়াইল সদর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক ও মির্জাপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ মোরছালিন।
দণ্ডবিধির ৩৪, ১৪৩, ৪৪৭, ৪৪৮, ৩২৩, ৩৪১, ৩৩২, ৩৫৩, ৩৫৫, ৪৩৬, ৪২৭, ৫০০ ধারায় করা এ মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলা পর ওই রাতেই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন মির্জাপুরের শাওন খান, মির্জাপুর মধ্যপাড়ার মো. মনিরুল ইসলাম এবং মির্জাপুরের সৈয়দ রিমন আলী।
এরপর বুধবার (২৯ জুন) এ মামলায় রহমত উল্লাহ রনি নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে শাওন খান ও রহমত উল্লাহ রনিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে সরাসরি অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য