জড়াজড়ি করে আছে দুটি বোয়াল। তবে মাছের আড়ত কিংবা মৎস্যজীবীর জালে নয়; বোয়াল দুটি জড়াজড়ি করে আছে বাজারের মোড়ে- ভাস্কর্যে!
এই মোড়ের নাম বোয়াল চত্বর। আর এলাকার নাম কারেন্টের বাজার। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার এই বাজারের মোড়ে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে বোয়াল মাছের ভাস্কর্যটি।
সুনামগঞ্জের হাওরের বোয়াল মাছের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। খ্যাতি থেকেই বোয়ালের এই ভাস্কর্য। কিন্তু বোয়াল চত্বরের পাশের কারেন্টের বাজারে ঢুকে কোনো বোয়াল মাছ পাওয়া গেল না। আরেকটু এগিয়ে গেলেই বিশ্বম্ভরপুর বাজার, সেখানেও নেই বোয়াল মাছ। এমনকি টাঙ্গুয়ার হাওরঘেরা তাহিরপুর বাজারেও নেই হাওরের কোনো মাছ!
এই সবকটি বাজার ঘুরেই দেখা গেছে, খামারের মাছের আধিক্য। বিশেষত, গরিবের আমিষের উৎস হিসেবে খ্যাত পাঙাশ মাছের ছড়াছড়ি সবখানে।
মিঠাপানির মাছের অন্যতম উৎস হিসেবে খ্যাত হাওর। অথচ হাওর এলাকার বাজারেই খামারের মাছের আধিক্য কেন- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, হাওরের ধানই আসলে মাছের জন্য কাল হয়েছে। বন্যার হাত থেকে ধান বাঁচাতে হাওরের যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ, অবাধে কীটনাশক ব্যবহার, পোনা নিধন, সেচ দিয়ে মাছ ধরাসহ নানা কারণে কমছে হাওরের মাছ। ইতোমধ্যে হাওরের মাছের অনেক জাত বিলুপ্তও হয়ে গেছে।
হাওরে কেন খামারের মাছ
‘হাওরের পানি নাইরে, হেথায় নাইরে তাজা মাছ’- সিলেট ছেড়ে কলকাতায় থিতু হওয়ার আক্ষেপ নিয়ে লেখা গানে এমনটি বলেছিলেন গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। কিন্তু হাওর এলাকায়ই এখন নেই হাওরের মাছ।
দেশের অন্যতম বৃহৎ হাওর টাঙ্গুয়া। এই হাওর ঘেঁষেই তাহিরপুর বাজার। গত ২৭ এপ্রিল বিকেলে তাহিরপুর বাজারে প্রবেশের আগ মুহূর্তেই দেখা যায়, হাতে মাছ ঝুলিয়ে বাজার থেকে ফিরছেন নানা বয়সের লোক। প্রায় সবার হাতেই একই মাছ- পাঙাশ। বাজারে ঢুকেও দেখা যায় এখানকার প্রায় সব বিক্রেতার কাছেই চাষের মাছ। এর মধ্যে পাঙাশই বেশি। এ ছাড়া চাষের তেলাপিয়া, পাবদা, কৈও আছে কিছু। শুধু এক বিক্রেতাকে দেখা গেল, স্থানীয় বিল থেকে ধরে আনা কিছু ছোট মাছ নিয়ে বসেছেন।
এই বাজারেই মাছ কিনতে আসা এরশাদুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখন তো হাওরে মাছই পাওয়া যায় না। আগে আমরা কী বড় বড় মাছ দেখতাম। জালে ধরা পড়ত বিশাল একেকটা বোয়াল। এখানকার বাচ্চাকাচ্চারা এগুলো মনে করে গল্প।’
আক্ষেপের সুরে তিনি আরও বলেন, ‘কী দিন আইল, মাছের দেশের মানুষেরও খামারের মাছ খাইতে হয়। এসব মাছে কোনো স্বাদ নাই।’
তবে এই মৌসুমে বাজারে হাওরের মাছ এমনিতেই কম থাকে বলে জানান মাছ বিক্রেতা রবীন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘এখন নয়া (নতুন) পানি আইতেছে। হাওরে এখন মাছ ঢুকব। বর্ষার পর এইগুলা ধরা অইব।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রাধানগর বাজারে গিয়েও দেখা যায়, সড়কের ধারে বসে পাঙাশ মাছ বিক্রি করছেন এক বিক্রেতা। তিনি বলেন, ‘পাঙাশ দামে সস্তা। এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষই গরিব। তারা দামি মাছ কিনতে পারে না। তাই পাঙাশ মাছই বেশি আনি।’
পরদিন ২৮ এপ্রিল দিরাই বাজারে গিয়েও দেখা যায়, চাষের মাছের ছড়াছড়ি। কিছু রুই, মৃগেল, গ্রাসকার্পও আছে এই বাজারে। তবে এগুলো সুনামগঞ্জের বাইরে থেকে আনা।
এখানকার মাছ বিক্রেতা সিরাজ মিয়া বলেন, ‘হাওরে তো এখন মাছ পাওয়া যায় না। তাই চাষের মাছই ভরসা।’
মাছ কিনতে আসা চেরাগ মিয়া বলেন, ‘এই সময়ে হাওরে মাছ পাওয়া যায় না। কারণ শুষ্ক মৌসুমে হাওরের বিল শুকিয়ে সব মাছ ধরে ফেলা হয়। এখন নতুন পানির সঙ্গে নতুন মাছ আসবে। আগামী শুষ্ক মৌসুমে আবার সেগুলো ধরা হবে। ফলে এই সিজনে বাজারে হাওরের মাছ পাওয়া যায় না।’
বিল শুকিয়ে মাছ ধরার কারণেই হাওরের মাছের উৎপাদন ও বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, দাবি করেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশ বায়োলজি ও জেনেটিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায়। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বিলগুলো একেবারে শুকিয়ে মাছ ধরা হয়। এটা খুবই ক্ষতিকর। এতে অনেক জাত হারিয়ে যায়। এটা নিষিদ্ধও। তবু কেউ তা মানছে না।’
ধানের জন্যে মাছের ক্ষতি!
জামালগঞ্জের হালির হাওরের একটি বিল কয়েক বছর ধরে ইজারা নিচ্ছে স্থানীয় একটি মৎস্যজীবী সমিতি। এই সমিতির সদস্য তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘বিল ইজারা নিয়ে লাভের চেয়ে এখন লোকসানই বেশি গুনতে হয়। হাওরের ধান বাঁচাতে বিলে সবদিকে বাঁধ দেয়া হয়। এই বাঁধের কারণে মাছ ঢুকতে পারে না। যেগুলো আছে সেগুলোও চলাচল করতে পারে না। ফলে শুষ্ক মৌসুম বিল সিচেও তেমন মাছ পাওয়া যায় না।’
হাওর এলাকায় বছরে একবারই ধান হয়। স্থানীয়দের কাছে ‘বৈশাখী’ হিসেবে পরিচিত বোরো ধানই তাদের খাদ্যের প্রধানতম উৎস। প্রায় প্রতি বছরই মার্চের দিকে ঢল আর ভারি বৃষ্টিতে হাওর এলাকায় অকাল বন্যা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় ফসল। এই ধান রক্ষায় হাওরে যেন ঢলের পানি প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ।
এ বছরও সুনামগঞ্জে ১২৪ কোটি টাকা ব্যয় করে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর তীরবর্তী তাহিরপুর উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন মনে করেন, ধান রক্ষায় নির্মাণ করা এসব বাঁধই হাওরের মাছের জন্য বড় বাধা। তিনি বলেন, ‘দিন দিন বাঁধ উঁচু হচ্ছে। এতে ধান হয়তো রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু সময়মতো পানি হাওরে ঢুকতে পারছে না। এতে মাছও আসছে না। মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাঁধের কারণে মাছ ইচ্ছামতো পানিতে ঘুরে বেড়াতে পারছে না। এ কারণে হাওরের মাছ কমে যাচ্ছে।’
এদিকে রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য ধানগাছে কীটনাশক প্রয়োগ করেন কৃষকরা। বৃষ্টি আর বন্যায় এই কীটনাশক গিয়ে মিশে হাওরের পানিতে। অতিমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগেও হাওরের মাছের ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে মৎস্য কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘কীটনাশকের কারণে মাছ ডিম কম দিচ্ছে। সব ডিম থেকে পোনাও ফুটছে না। অনেক সময় হাওরে মাছ মরে ভেসে উঠতেও দেখা যায়।’
এ ছাড়া রামসার সাইট (মাছের অভয়াশ্রম) হিসেবে ঘোষণার পর টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে মাছ ধরা বন্ধ থাকা, সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়া, হাওরে সময়মতো পানি না আসা আর অবাধে মাছ শিকারের কারণেও হাওরের মাছ এখন কম পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণকে হাওরের মাছ কমে যাওয়ার বড় কারণ বলে মনে করেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডও।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন চলাচল খুব জরুরি। এটি বাধাগ্রস্ত হলে মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে কমে যায়। হাওরে এটা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নদীর মাছ আগে হাওর ও বিলে গিয়ে আশ্রয় নিতো। এখন বাঁধের কারণে মাছ নদী থেকে হাওর বা বিলে যেতে পারছে না।’
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক বলেন, ‘ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। স্বাভাবিকভাবেই সরকার ধান রক্ষায় অধিক মনোযোগ দেবে। তবে কীটনাশক ব্যবহারে আমরা সব সময়ই কৃষকদের নিরুৎসাহিত করি।’
তবে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায় মনে করেন, ধান ও মাছ দুটির ব্যাপারেই সরকারের মনোযোগী হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রকৃতির অনুকূলে কাজ করতে হবে। যে জায়গায় ধান হয় সেখানে ধান চাষ করতে হবে। আর যে জায়গায় ধান হয় না, অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সেখানে ধান চাষ না করে মাছ চাষে মনোযোগী হতে হবে।’
এই গবেষক বলেন, ‘কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমরা বাঁধ দিচ্ছি ধান চাষের জন্য। কিন্তু ধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এই টাকা মাছ চাষে খরচ করলে আরও অনেক বেশি টাকার মাছ পাওয়া যেত।’
তিনি বলেন, ‘আবার এসব বাঁধের মাটি বৃষ্টি আর পানির স্রোতে হাওর ও বিলে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মাটি জমছে হাওরে। ফলে বিলের পানি বেশি সময় থাকছে না। অদূর ভবিষ্যতে তো বিলগুলোই থাকবে না। সব সমতল ভূমি হয়ে যাবে! ফলে ধান ও মাছ দুটিরই ক্ষতি হবে।’
এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডল দাবি করেছেন, হাওরের মাছ কমলেও সুনামগঞ্জে মাছের উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়েছে। কারণ মানুষজন মাছ চাষে আগ্রহী হয়েছে, মাছের খামার গড়ে তুলছে। সরকারও তাদের সহায়তা করছে।
তিনি জানান, মাছের উৎপাদন বাড়াতে এই এলাকায় এখন ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষে প্রযুক্তি সহায়তা সম্প্রসারণ প্রকল্প এবং জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প নামে দুটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের কারণে মাছ চাষ বেড়েছে। কিন্তু চলতি বছরই এই দুই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পগুলোর মেয়াদ আরও বাড়ানো প্রয়োজন।’
অবাধে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন
‘আজই আপনি সিলেটের যে কোনো বাজারে যান, দেখবেন- অবাধে বিক্রি হচ্ছে রেণু পোনা। প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে এগুলো। কেউ বাধা দিচ্ছে না!’
হাওরের মাছ নিয়ে গবেষণা করা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায়ের এই মন্তব্যটি যে যথার্থ, তা বোঝা গেল গত ২৯ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে। সব বাজারেই দেদার বিক্রি হচ্ছে রেনু পোনা। বৈশাখের নতুন পানির সঙ্গে নদী ও হাওরে প্রবেশ করেছিল এই পোনাগুলো। জেলেরা এগুলো অবাধে শিকার করে বাজারে আনছে।
এ ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে যে সচেতনতার অভাব, তা সাইফুল ইসলাম নামে এক কিশোরের বক্তব্যে স্পষ্ট। দেখার হাওরে ঠেলা-জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরছিল সে।
সাইফুল বলে, ‘আমরা তো সব সময়ই এগুলো ধরি। জালে যা উঠে তাই-ই ধরি। কেউ কখনো মানা করেনি। তা ছাড়া মাছ না ধরলে খামু কি?’
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায় বলেন, ‘মাছের প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে ও উৎপাদন বাড়াতে অবশ্যই পোনা মাছ এবং ডিমওয়ালা মাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে ক্ষতিকর জালের ব্যবহারও। হাওর এলাকায় এসব কেউ মানছে না।’
শান্তিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ ধরা বন্ধে জেলেদের সচেতন করতে তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন।
বিলুপ্ত অনেক প্রজাতি
সুনামগঞ্জসহ সিলেটের বিভিন্ন হাওর থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৩২ প্রজাতির মাছ।
সিলেট মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে- হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, দেখার হাওর, শনির হাওরসহ সিলেট বিভাগের হাওরগুলোতে এক যুগ আগেও প্রায় ১০৭ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে বেশকিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হওয়ার পথে আরও কিছু প্রজাতি।
বছর তিনেক আগে মৎস্য অধিদপ্তরের সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপকূলীয় ও জলাভূমি প্রকল্প জরিপ নামে একটি জরিপ চালানো হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এনসিআরএস, আইডিয়া ও প্রচেষ্টা এই জরিপ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে।
জরিপে দেখা গেছে, সিলেটের হাওরগুলোর ১০৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৩২ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জরিপের ফলাফলে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- মহাবিপন্ন, সঙ্কটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি।
এর মধ্যে মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে- টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রাণী, পাঙাশ, বামোশ, নাফতানি, চিতল, একথুটি ও চাকা।
সংকটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে- বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়।
আর বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে- গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড় বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালিবাউশ।
এ বিষয়ে আইডিয়ার নির্বাহী পরিচালক নজমুল হক বলেন, ‘হাওরের মাছের বিলুপ্তি রোধ ও বিস্তারে অসময়ে পোনা মাছ ধরা বন্ধসহ ডিম ছাড়ার মৌসুম বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত মৎস্যজীবীদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিল শুকিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা ও মৎস্য আইন সম্পর্কেও মৎস্যজীবীদের সচেতন করতে হবে। এ ছাড়া হাওরের যত্রতত্র বাঁধ ও সড়ক নির্মাণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কমাতে হবে কীটনাশকের ব্যবহারও।’
সুনামগঞ্জে মাছের উৎপাদন কত
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত অর্থ বছরে এই জেলা থেকে ৯০ হাজার ১৩০.২৫ মেট্রিক টন মাছ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নদী থেকে ৪ হাজার ৫৪৪.৪৫ মেট্রিক টন, বিল থেকে প্রাকৃতিকভাবে ২৮,৬২৪.৩৯ মেট্রিক টন, বিলে পোনা অবমুক্তের মাধ্যমে ৬০.৯০ মেট্রিক টন, হাওর থেকে ৩৪ হাজার ১৩৪.০৭ মেট্রিক টন এবং প্লাবনভূমি থেকে ২৭১৫.২৫ মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যায়।
ওই কার্যালয় আরও জানায়, জেলায় ৩ হাজার ১৭০ হেক্টর জায়গাজুড়ে ২০ হাজার ৭৬৯টি মৎস্য খামার আছে। গত অর্থবছরে খামারগুলোতে উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৭৯৮.৮৫ মেট্রিক টন মাছ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডল বলেন, ‘মাছ আরও বেশি পাওয়া যায় আসলে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কর ফাঁকি দিতে অনেক সময় তথ্য গোপন করে।’
আরও পড়ুন:আঠারো ও উনিশ শতকের ক্রান্তিকালে বাংলার সমাজে চলছিল গভীর টানাপড়েন- বহিরাগত শাসনের নিপীড়ন, অভ্যন্তরীণ শোষণের বেদনা আর নিজস্ব পরিচয় নিয়ে এক অন্তর্গত সংগ্রাম। এই সময়েই আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও অধিকারবোধ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন বিদগ্ধ সমাজচিন্তক ও রাজনৈতিক নেতারা। জাতীয় রাজনীতির কোলাহলে যখন অধিকাংশ নেতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও সাংবিধানিক প্রশ্নে ব্যস্ত, তখন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক স্বীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে একেবারে শিকড় থেকে বদল আনার কথা চিন্তা করেছেন। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির বহুমাত্রিক ঐতিহ্যে- ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কৃষিনির্ভর জীবনের সংমিশ্রণে খুঁজতে চেয়েছেন এক পরিপূর্ণ জাতিসত্তা। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন জমিদারি শোষণ ও নিপীড়নের শিকার, ঋণের জালে বন্দি নিঃস্ব ও নিরন্ন, অধিকারবঞ্চিত প্রান্তিক কৃষকের কণ্ঠস্বর।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর তৎকালীন বরিশাল জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে এক মধ্যম জমিদার পরিবারে বেড়ে ওঠায় ফজলুল হক শৈশব থেকেই প্রান্তিক মানুষের জীবনের কষ্ট, অবহেলা ও বঞ্চনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আর এ কারণেই পরবর্তীতে কৃষক-শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়ানো তার রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি হয়ে ওঠে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো অমানবিক জমি ব্যবস্থার নির্মমতা তাকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। কেননা হাল টেনে, ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলানো কৃষকশ্রেণিই ছিল অত্যাচারের মূল শিকার। তাদেরই ওপর চাপানো হতো অযৌক্তিক হারে খাজনা। সেই খাজনা দিতে না পারলে ছিল জমি হারানোর ভয়। অন্যদিকে জমিদাররা নিজেদের আরাম-আয়েশের খরচ জোগাতে কৃষকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত ফসলে ভাগ বসাতো। আর কৃষকদের ভাগ্যে জুটতো অনিশ্চয়তা, অনাহার আর ঋণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বেঁচে থাকা। ফলে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও মহাজনি শোষণ বন্ধ করার লক্ষ্যে শেরে বাংলার নেতৃত্বে বাংলায় শক্তিশালী প্রজা আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯২৯ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ যা পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যা ছিল কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ। তার নেতৃত্বে দলটি কৃষকদের সমস্যাগুলো সামনে এনে শুরু করে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ফলে ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশগুলোতে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের আয়োজন হয়। বিপুল জনসমর্থনে অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন এ কে ফজলুল হক। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি একের পর এক সংস্কার শুরু করেন। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য ১৯৩৮ সালে তিনি ‘ফ্লাউট কমিশন’ গঠন করেন। জমিদাররা যাতে বিনা কারণে ইচ্ছেমতো জমির প্রকৃত চাষি অর্থাৎ প্রজাকে উচ্ছেদ করতে না পারে, সেই জন্য তিনি ওই বছরই বঙ্গীয় প্রজাসত্ত আইন সংশোধন করে জমিদারের অধিকার হ্রাস এবং কৃষকদের অধিকার বৃদ্ধি করেন। এটি ছিল জমিদার শাসনের বিরুদ্ধে এক সাহসী পদক্ষেপ।
এরপর ১৯৩৫ সালের Bengal Agricultural Debtors Act অনুসারে ১৯৩৮ সালে তিনি গঠন করেন ঋণ-সালিশি বোর্ড, যা ছিল কৃষকের ঋণ সমস্যা সমাধানে আদালতের বিকল্প একটি মানবিক পথ। Bengal Agricultural Debtors Act অনুসারে গঠিত এই বোর্ডে স্থানীয় প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিতেন কৃষকের ঋণের ন্যায্য পরিমাণ, অতিরিক্ত সুদ মাফ করে দিতেন, আর সহজ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সুযোগ তৈরি করতেন। এর ফলে বহু কৃষক ঋণের জাল থেকে মুক্ত হয়ে আবার চাষাবাদ শুরু করতে সক্ষম হন; কিন্তু সবকিছু সহজ ছিল না। জমিদার-মহাজনরা বোর্ডে যেতে কৃষকদের ভয় দেখাত, বাধা দিত। এমনকি ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ প্রশাসনও এই মানবিক প্রচেষ্টাকে সন্দেহের চোখে দেখত। কিন্তু শেরে বাংলার অদম্য নেতৃত্বে এই বোর্ড অনেক কৃষকের জীবনে আশার আলো জ্বালাতে সক্ষম হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার কৃষিতে চরম পশ্চাৎপদতা লক্ষণীয় ছিল। আধুনিক কৃষি শিক্ষা, গবেষণা বা প্রযুক্তির কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা ছিল কম এবং কৃষকের জীবন ছিল দুর্বিষহ। তাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় এসে শেরে বাংলা কৃষকের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেন। তার প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ১৯৩৮ সালে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল এগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট, যা ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম কৃষি শিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান। এর মূল লক্ষ্য ছিল আধুনিক কৃষি শিক্ষা প্রদান, গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং কৃষককে আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ করা। যা ছিল বাংলার কৃষকের প্রতি একটি কার্যকর দায়বদ্ধতার প্রকাশ। এই ইনস্টিটিউটই পরবর্তীতে ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে, যা আজও বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষার অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৪০ সালে তিনি প্রণয়ন করেন আরেকটি যুগান্তকারী আইন- Bengal Moneylenders Act। এই আইন মহাজনদের লাগাম টানার প্রথম বড় পদক্ষেপ। এতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৬-৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, মৌখিক ঋণের বদলে লিখিত হিসাব বাধ্যতামূলক করা হয়, এবং অতিরিক্ত সুদের ভিত্তিতে মামলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মহাজনদের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে তাদের শোষণক্ষমতা সীমিত করা হয়। যদিও অনেক মহাজন পরে ভুয়া হিসাব বা ‘কাঁচা খাতা’ দেখিয়ে আইনকে পাস কাটানোর চেষ্টা করে, তবুও এই আইন স্পষ্ট বার্তা দেয়- রাষ্ট্র এবার কৃষকের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ববাংলা একটি নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। এ সময় শেরে বাংলা কৃষিনীতি এবং কৃষকের উন্নয়নকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নেন। তিনি পূর্ববাংলার কৃষিনির্ভর সমাজের স্বার্থরক্ষায় নতুন প্রশাসনিক কাঠামোর প্রস্তাব দেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে কৃষিকে বের করে এনে স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ করা। এই কাঠামোতে গ্রামাঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, কৃষকদের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার এই পদক্ষেপ পূর্ববাংলার কৃষিনীতিকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর ভিত্তি দেয়, যা পরবর্তীতে কৃষি গবেষণা, সেচব্যবস্থা এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অন্যদিকে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অধীনে ভূমি সংস্কার ও কৃষি উন্নয়নকে শেরে বাংলা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। সেই কারণে তিনি জমির সর্বোচ্চ মালিকানা সীমা নির্ধারণ, খাজনা হ্রাস, বর্গাদারদের সুরক্ষা এবং কৃষকদের জন্য ঋণসুবিধা নিশ্চিতকরণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই সংস্কার কর্মসূচি সামন্ততান্ত্রিক জমিদার প্রথাকে দুর্বল করে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষি ও কৃষক-কেন্দ্রিক রাজনীতি ও মানবিক রাষ্ট্রচিন্তা ছিল এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত, যা আজও আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে ওঠে। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন তার সবচেয়ে প্রান্তিক নাগরিকও ন্যায় ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে। কৃষকদের শুধু উৎপাদক নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ববান ও অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য তার যে অগ্রণী ভূমিকা, তা বাংলার ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে এই কিংবদন্তি নেতার জীবনাবসান ঘটে; কিন্তু কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার ত্যাগ, সাহস ও দূরদর্শিতা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়।
শেরে বাংলার যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলোর সবই ছিল এক অর্থবহ সামাজিক চুক্তির অংশ, যেখানে কৃষকের কষ্টকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। জমিদার-মহাজন ও ঔপনিবেশিক শোষণের চক্রে পিষ্ট কৃষকের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যেভাবে কৃষিবান্ধব প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, তা আজও আমাদের সামনে এক অনুকরণীয় পথ।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের বাংলাদেশেও শেরে বাংলার স্বপ্নের সেই কৃষকবান্ধব রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয়নি। এখনো আমরা দেখি- কৃষক কখনো নিজের ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্ষোভে নিজ হাতে তা পুড়িয়ে দেন, ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্ব হারিয়ে বেছে নেন আত্মহননের পথ। ঋণের দুঃসহ ভারে ক্লিষ্ট হয়ে, সারা জীবন শ্রম দিয়ে উৎপাদন করেও তিনি পান না নিজের প্রাপ্য সম্মান বা সুরক্ষা।
তাই বর্তমান বাস্তবতাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে আমাদের আবারও কৃষিকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে আনতে হবে। যেখানে কৃষক হবে সম্মানিত, স্বনির্ভর এবং ভবিষ্যৎ গঠনে সক্রিয় অংশীদার। এতে বাস্তবায়িত হবে একটি মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কৃষকবান্ধব বাংলাদেশের স্বপ্ন।
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল লতিফ
উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের অন্যতম আম উৎপাদকারী জেলা নওগাঁ। গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার আমের মুকুল সবচেয়ে বেশি এসেছে জেলার আমের বাগানগুলোতে।
নওগাঁর বাতাসে এখন মুকুলের মো মো ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েক দিনের বেশির ভাগ সময় আবহাওয়া আম উৎপাদনের জন্য অনুকূল রয়েছে।
এবার গাছে গাছে মুকুলের আধিক্য দেখে ব্যাপক ফলনের আশা করছেন আমচাষিরা।
কৃষিবিদরা বলছেন, এখন পর্যন্ত আবহাওয়া আম চাষের অনুকূলে রয়েছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এ বছর আমের বাম্পার ফলন হবে। এবার গত বছরের চেয়ে ২০০ হেক্টর জমিতে বেড়েছে আমের বাগান। আশা করা হচ্ছে, গত বছরের চেয়ে এবার ২৫ হাজার টন ফলন বাড়তে পারে।
একজন কৃষিবিদের আশা, এবার জেলায় আমের বাণিজ্য হবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার।
আমচাষিরা বলছেন, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী এক মৌসুমে ভালো ফলন হলে পরেরবার আমের ফলন কম হয়। সে হিসেবে গত বছর নওগাঁয় আমের ফলন কম হওয়ায় এবার তারা আমের বাম্পার ফলনের আশায় বুক বেঁধেছেন।
বাগানে প্রায় সব গাছেই মুকুল এসেছে। মুকুলকে ছত্রাকের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে কীটনাশক স্প্রে করছেন তারা। ক্ষেত্রবিশেষে ছিটানো হচ্ছে পানি। আমগাছের গোড়াতেও পানি দিচ্ছেন চাষিরা।
এদিকে বাগানে মুকুল আসা শুরু করতেই মৌসুমি বাগান ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা মাঠে নেমে পড়েছেন। তারা মুকুল দেখে বাগান কেনার জন্য মালিকদের কাছে যাচ্ছেন।
কয়েক দিন ধরে মুকুলে গুটি হওয়ার পর বাগান কেনাবেচার জন্য আমবাগানিদের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা বাগান কেনাবেচা নিয়ে কথা শুরু করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৩০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বাগানে আম চাষ করা হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর। গত বছর আমের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩১ হাজার টন। উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ২৫ হাজার টন। এবার ৪ লাখ ৫০ হাজার টন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।
নওগাঁর সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়। এ ছাড়াও নিয়ামতপুর, পত্নীতলা, ধামইরহাট, বদলগাছী উপজেলা আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী নওগাঁ জেলায় নাগফজলি, ল্যাংড়া, আম্রপালি, গোপালভোগ, আশ্বিনা, কাটিমন, বারি আম-৪, বারি আম-১১, গুটি আম ও ফজলি জাতের সুস্বাদু আমের উৎপাদন বেশি।
সাপাহার উপজেলার গোডাউনপাড়া এলাকাসহ ২০০ বিঘা জমির ওপর তিনটি আম বাগান রয়েছে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার। তিনি স্থানীয় বাজারে আম বিক্রি ছাড়াও বিদেশে আম রপ্তানি করে থাকেন।
সোহেল রানা জানান, গত বছর তার বাগানে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছিল। এবার এখন পর্যন্ত তার বাগানে ৮০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে। ফাল্গুন মাস আমের মুকুল আসার উপযুক্ত সময়।
তার ভাষ্য, আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে বাকি গাছগুলোতেও মুকুল আসবে। আবহাওয়া এখন পর্যন্ত আমের জন্য অনুকূলে আছে। রোদের তাপ কম পেলে ও প্রকৃতি কুয়াশায় ঢেকে থাকলে মুকুলে ছত্রাকের আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য গাছে ছত্রাকনাশক কীটনাশক স্প্রে করছেন তিনি।
পোরশা উপজেলার বড়গ্রাম এলাকার আমাচাষি রায়হান আলম বলেন, ‘গত বছর শীতের কারণে অনেক দেরিতে মুকুল এসেছিল। গাছে মুকুল আসতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন দেরি হয়েছিল। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়েও অনেক গাছে মুকুল ধরেছিল।
‘সে তুলনায় এবার অনেক আগেই মুকুল এসেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার আমের বাম্পার ফলন হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সাধারণত ধরা হয় দীর্ঘস্থায়ীভাবে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকলে আমের মুকুল ধরতে চায় না। তবে এবার জানুয়ারি মাসে দুই-এক দিন করে শৈত্যপ্রবাহ থাকলেও দীর্ঘস্থায়ী শৈত্যপ্রবাহ ছিল না। গড় তাপমাত্রা প্রায় ২০ ডিগ্রির কাছাকাছি ছিল। এই তাপমাত্রা আমের জন্য অনুকূল।
‘কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে কুয়াশা থাকছে। তবে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে। কুয়াশার কারণে মুকুলে ছত্রাকের আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য আমরা আমচাষিদের ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছরে কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে নওগাঁর আমের বাগান থেকে সাড়ে চার লাখ টন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।
‘আমের বাজার ভালো থাকলে এ বছর নওগাঁ জেলায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।’
আরও পড়ুন:বাগেরহাটে উঠতে শুরু করেছে তরমুজ। ফলের দোকানে পসরা সাজিয়ে কিংবা ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছে রসালো এ ফল। প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।
বিভিন্ন জাত ও নানা আকারের তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে বাগেরহাটের বাজারে। ক্রেতাদের কাছে অন্যান্য ফলের চেয়ে তরমুজের চাহিদা বেশি। ইফতারে তরমুজের প্রাধান্য বেশি।
এ বছর তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।
বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে আলদাভাবে তরমুজ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সাইজের তরমুজ পথচারীদের নজর কাড়ে। পথচারী থেকে শুরু করে করে অনেকে যানবাহন থামিয়ে তরমুজ কিনেছেন। তিন কেজি থেকে শুরু করে আট কেজি ওজনের তরমুজ দেখা গেছে সেখানে।
পথচারী হালিম শেখ জানান, রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা এত তরমুজ এই মৌসুমে প্রথম দেখা গেল। ৫০ টাকা কেজি দরে ৬ কেজি ওজনের একটি কেনেন তিনি।
মিল্টন, আলম, তৌহিদ, অমলসহ বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানান, তরমুজ তাদের অনেক পছন্দ। এ কারণে দাম যাই হোক, তারা তরমুজ কিনে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন।
তবে কয়েকজন সাধারণ ক্রেতা জানান, ৫০ টাকা তরমুজের কেজি তাদের কাছে বেশি হয়ে গেছে। মৌসুমের প্রথম ফল ও তরমুজ তাদের সবার পছন্দ থাকায় প্রয়োজনের তুলনায় ছোট সাইজের তরমুজ কিনেছেন।
হাবিব হোসেন পটুয়াখালীর চাষিদের জমি থেকে প্রায় দেড় হাজার তরমুজ কিনে ট্রাকবোঝাই করে বাগেরহাট মিঠাপুকুর পাড়ে নিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, ‘তরমুজের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যবসা করছি। মিঠাপুকুর পাড়ে বিক্রির জন্য স্তূপ করে তরমুজ রাখা হয়েছে। ট্রাক থেকে তরমুজ নামানোর পর থেকে ক্রেতারা আসছেন তরমুজ কিনতে।
‘খুচরা প্রতি কেজি তরমুজ ৫০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এভাবে তরমুজ বিক্রি করতে পারলে বেশ টাকা লাভ হবে।’
এ মৌসুমে তরমুজ বাজারে প্রথম উঠছে। এ কারণে দাম একটু বেশি বলেও জানান তিনি।
কয়েক দিন পর তরমুজের দাম কমে আসবে বলেও জানান হাবিব হোসেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাগেরহাটের উপপরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন, ‘সারা বছর কম-বেশি তরমুজ পাওয়া যায়। তরমুজের প্রধান মৌসুম মার্চ মাস।’
তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা জাতের হাইব্রিড তরমুজ চাষ হচ্ছে। এ বছর তরমুজের ফলনও ভালো। তরমুজ হাট-বাজারে নতুন আসায় এর দামও বেশি।’
শঙ্কর কুমার মজুমদার আরও বলেন, ‘গ্রীষ্ম ও শীতকালে বেশি তরমুজ চাষ হয়। গ্রীষ্মকালের তরমুজের চারা নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে রোপণ করা হয়।’
ড্রাগন কিং, পাকিজা, বিগফ্যামিলি, এশিয়ান ও বাংলালিংকসহ বিভিন্ন নামে হাইব্রিড তরমুজ চাষ করা হয়েছে বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন:শেরপুরের সমতল অঞ্চলে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে কফির চাষ। এতে মিলছে ভালো ফল।
কৃষি বিভাগ জানায়, চাষের পরিধি বাড়লে আগ্রহী কৃষকদের বিপণনসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে।
প্রথমবারের মতো কফি চাষ করা কৃষি উদ্যোক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসাইন তুলিপ জানান, ২০২১ সালে বান্দরবানে চাকরির সুবাদে কফি চাষের অভিজ্ঞতা নেন তিনি। এরপর শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় ২৫০টি কফির চারা নিয়ে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেন। সফলতা দেখে ২০২২ সালে রোপণ করেন ১ হাজার কফি চারা। এখন তার তিন বিঘা জমিতে রয়েছে ৮০০টি কফি গাছ।
কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসাইন তুলিপ আরও বলেন, ‘আমার খামারে ৬০০থেকে ৭০০ গাছ রয়েছে, যেগুলো থেকে ফল সংগ্রহ করে আমি বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করছি। পাশাপাশি আমার এ খামারে এখনও ২০ হাজারের মতো চারা আছে।
‘এ ছাড়া শেরপুরের পাঁচ উপজেলা ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি জেলার কৃষকদের মাঝে ৫০ হাজার কফি চারা বিনা মূল্যে বিতরণ করেছি।’
কফি চারা রোপণের ২ বছর পর ফল দিতে শুরু করে এবং এটি টিকে থাকে ৩০ বছর পর্যন্ত।
ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে ফল সংগ্রহের পর পালপিং, রোদে শুকিয়ে পার্চমেন্ট করে বাদামের মতো অংশ বের করে এবং রোস্টিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হয় রোস্টেড কফি বিন।
একটি পরিপক্ব গাছ থেকে বছরে পাঁচ থেকে ছয় কেজি ফল পাওয়া যায়, যা থেকে ১ কেজি রোস্টেড বিন তৈরি হয়। এর বাজার মূল্য প্রায় দুই হাজার টাকা।
বাড়ির পতিত জমি বা ছায়াযুক্ত স্থানে কফি গাছ রোপণ করা যায়। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার কফি আমদানি করা হয়।
দেশে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ সফল হলে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে এ ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর শেরপুরের উপপরিচালক সাখাওয়াত হোসাইন বাসসকে বলেন, কফি চাষের উপযোগী মাটি ও আবহাওয়া এখানে রয়েছে। সে অনুযায়ী কৃষকদের কফি চাষের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শেরপুরের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি এলাকার সমতল ভূমিতেও কফি চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
কফি চাষে আগ্রহী কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন জেলা কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন:নড়াইল সদর উপজেলায় প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন।
উপজেলার গোপালপুর গ্রামের দীপক বিশ্বাস এ সার উৎপাদন করে এখন স্বাবলম্বী।
যেভাবে তৈরি
প্রথমে সংরক্ষণের জন্য টিনের চালায় রাখা হয় গোবর। তারপর সেই গোবর হালকা শুকিয়ে রিং বা হাউসে কয়েক দিন রাখার পরই তাতে কেঁচো দিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ দিন রাখার পর উৎপাদিত হয় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার।
দীপক বিশ্বাস ব্যক্তিগত চাষাবাদের প্রয়োজনে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন। বাড়ির আঙিনায় পরিত্যক্ত জায়গায় ছোট পরিসরে শুরু করলেও বর্তমানে চাহিদা থাকায় উৎপাদন করছেন বাণিজ্যিকভাবে।
বাড়িতে প্যাকেটজাত করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন তিনি। রাসায়নিক সার বর্জন করে তার উৎপাদিত এ জৈব সার শীতকালীন সবজি চাষে ব্যবহার করছেন চাষিরা। ফলে বিষমুক্ত হচ্ছে সবজি।
দীপক বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষি অফিসের পরামর্শে আমি কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করি। প্রথম পর্যায়ে কৃষি অফিস আমাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে। গোবর দিয়ে এ সার উৎপাদনে আমার তেমন কোনো খরচ নেই।
‘এ সার দিয়ে আমি আমার নিজের বাগানের চাহিদা পূরণ করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছি। গ্রামের অধিকাংশ লোক এখান থেকে সার নিয়ে শীতকালীন সবজি উৎপাদন করছেন।’
কৃষক পলাশ শেখ বলেন, ‘আমি ২৬ শতক জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ করেছি। এখানে কোনো রাসায়নিক সার দেয়া হয়নি।
‘অল্প টাকায় দীপকের বাড়ি থেকে জৈব সার কিনে এনে ব্যবহার করছি। সবজির ফলনও ভালো হয়েছে।’
সিংগিয়া গ্রামের হাসিবুর ইসলাম বলেন, ‘ফুলকপি, বাঁধাকপি ও বস্তা পদ্ধতিতে আমি শিম চাষ করেছি। সব ধরনের ফসলে আমি এ কেঁচো সার দিয়েছি। আশা করছি ভালো ফলন হবে।’
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান বলেন, ‘সবজি চাষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের প্রাধান্য দিলে উৎপাদিত সবজি হবে বিষমুক্ত। অপরদিকে মাটির গুণাবলী বাড়বে।
‘তার এই সার উৎপাদন দেখে স্থানীয় অনেকেই এগিয়ে আসবে এবং তার মতো স্বাবলম্বী হবে।’
আরও পড়ুন:বন্য খেজুর থেকে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ভিনেগার উৎপাদনের দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনিছুর রহমান মজুমদার ও তার গবেষক দল।
বন্য খেজুর থেকে ভিনেগার তৈরি বাংলাদেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন এ অধ্যাপক।
গবেষক আনিছুর রহমান বলেন, ‘বন্য খেজুর থেকে ভিনেগার উৎপাদনে প্রক্রিয়াকরণের জন্য গাজন প্রক্রিয়াটি পরিবেশবান্ধব। স্থানীয় কৃষিসম্পদ কাজে লাগিয়ে এবং অপচয় কমিয়ে এ পদ্ধতি খাদ্য উৎপাদনের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতেও সহায়ক হতে পারে। গবেষণাটি বাংলাদেশের বৃহত্তর টেকসই উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’
উৎপাদিত ভিনেগারটির দেশের বাজারে প্রভাব সম্পর্কে অধ্যাপক আনিছুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে এই গবেষণার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ভিনেগার উৎপাদন কেবল খাদ্য ও পানীয় হিসেবে ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্যাকেজিং, কসমেটিক ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পেও ব্যবহৃত হতে পারে।
‘বিশেষ করে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের কাছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পুষ্টিকর ভিনেগারের চাহিদা বাড়ছে, যা বাজারে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে।’
বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য স্থানীয় কৃষি সম্পদের টেকসই ব্যবহারের ওপর বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আনিছুর বলেন, ‘বাংলাদেশে বন্য খেজুর ইদানীং ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে। এটি বেশ সস্তা ও স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য।
‘এই খেজুর গাছ সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় এবং রাস্তার পাশের জমিতে পাওয়া যায়, তবে নানা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ হওয়ার পরও এই বন্য খেজুর দেশের প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অব্যবহৃত একটি সম্পদ।’
গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আনিছুর বলেন, ‘বন্য খেজুরের রস ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়া মাধ্যমে ভিনেগারে পরিণত করা হয়েছে। এ গবেষণায় এক ধরনের ইস্ট ব্যবহার করে ওই রসে অ্যালকোহল তৈরি করা হয় এবং পরে অ্যাসিটোব্যাক্টর প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া দিয়ে অ্যালকোহলকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে রূপান্তর করা হয়।’
গবেষক আরও বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে যে, রসের ঘনত্ব যত বেশি হয়, তত বেশি অ্যালকোহল ও অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি পায়। বেশি ঘনত্বের রসটি সবচেয়ে ভালো পুষ্টিগুণ, অ্যাসিডিটি ও ম্যাক্রো মিনারেলস (পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম) সমৃদ্ধ হয়। তাই এটি স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় পণ্যও বটে।’
গবেষণাটি বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশনা এলসভিয়ারের নামী সাময়িকী অ্যাপ্লায়েড ফুড রিসার্চে সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে।
ভিনেগার তৈরির এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও মাঠ পর্যায়ে সফলতা সম্পর্কে এ অধ্যাপক বলেন, ‘এই গবেষণা স্থানীয় কৃষকদের জন্য একটি নতুন আয় সৃষ্টির পথ খুলতে পারে। একদিকে খেজুর থেকে তৈরি ভিনেগারের উচ্চমান এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়ায় বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের স্থানীয় কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়াতে সাহায্য করবে।’
অধ্যাপক আনিছুর রহমানের নেতৃত্বে বাকৃবি, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি) ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) আরও ছয় জন গবেষক এই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। বাকৃবি থেকে গবেষক দলে রয়েছেন ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলিম, একই বিভাগের অধ্যাপক ড. পলি কর্মকার এবং ওই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা ও আ ন ম ইফতেখার আলম।
এ ছাড়া সিকৃবির খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ফাহাদ জুবায়ের এবং ডুয়েটের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক লোপা আনসারী গবেষক দলে যুক্ত ছিলেন।
আরও পড়ুন:অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নিজেদের মধ্যে পলিটিকাল ইস্যু থাকতে পারে, কিন্তু নদীর পানির হিস্যা নীতি ছিল। ভারতের কোনো যুক্তিই নেই আমাদের পানি না দেয়ার। এটা নিয়ে ভারতকে চাপ দিতে হবে।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ‘উজানে যৌথ নদীর পানি প্রত্যাহার: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি, বাংলাদেশ।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভারতে যখন পানির চাপ থাকে তখন আমাদের এদিকে স্লুইস গেটগুলো খুলে দেয়। আবার ওখানে যখন পানির স্বল্পতা থাকে তখন গেটগুলো বন্ধ করে দেয়।
‘তারা ইচ্ছেমতো এটা করছে। আর সেজন্য আমরা পানি পাচ্ছি না। এতে করে আমাদের চাষাবাদে সমস্যা হচ্ছে। দিন দিন মরুভূমির মতো হয়ে হচ্ছে। গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল নেমে যাচ্ছে। আমরা আর কত সহ্য করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে কাজগুলো করছি সেগুলো অনেক চ্যালেঞ্জিং। এগুলোতে জনগণের সাপোর্ট প্রয়োজন। শুধু ফারাক্কা নয়; অভিন্ন আরও যে ৫৪টি নদী আছে, সেগুলো থেকে যাতে ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পায় সেজন্য আমরা কাজ করব।’
আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সমন্বয়ক মোস্তফা কামাল মজুমদারের সভাপতিত্বে সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন নিউ ইয়র্কের আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ টিপু সুলতান, আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমাদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু প্রমুখ।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য