ঘূর্ণিঝড় আসানির প্রভাবে উপকূলসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। থেমে থেমে আবার কখনও টানা বৃষ্টির কারণে পানি জমতে শুরু করেছে নিম্নাঞ্চলের ফসলের জমিতে। এ অবস্থায় ফসল ঘরে তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষক।
মাদারীপুরে নিম্নাঞ্চলের আধাপাকা বোরো ধান কেটে নিচ্ছেন চাষিরা। তারা বলছেন, এতে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলন পাবেন না।
কৃষি বিভাগ বলছে, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। তাই চাষিকে ধান কাটার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কালকিনির শশীকর এলাকার বিলে মাঠের পর মাঠ বোরো আবাদ হয়েছে। এরই মধ্যে গেল কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে কিছু জমিতে পানি উঠতে শুরু করেছে। ফলে কৃষকরা ফসল কাটতে মাঠে নেমে পড়েছেন।
বৃষ্টিতে ভিজে কোন রকমে ধান কেটে রাস্তার উঁচুতে রাখা হচ্ছে। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ধান কাটার শ্রমিক মিলছে না বলে জানিয়েছেন অনেক কৃষক। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে ধান কাটছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শিবচরে চরাঞ্চল বেষ্টিত জরজানাজাত, কাঠালবাড়ী, সন্ন্যাসীরচর, মাদবরেরচর, রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম, কদমবাড়ী, পাখুল্লা, বাজিরতপুর, সদর উপজেলার কুনিয়া, দৌলতপুর, কেন্দুয়া, খাটোপাড়া কেন্দুয়া, কালকিনি উপজেলার শিকারমঙ্গল, সিড়িখান, সাহেবরামপুর, আন্ডারচর, বাঁশগাড়ি, ঠেঙ্গামারা, রমজানপুর ও ডাসার উপজেলার শশীকর, ডাসার, বালিগ্রামসহ অন্তত ৪০টি গ্রামে নিম্নাঞ্চলের ধানের জমিতে পানি উঠতে শুরু করেছে। এতে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।
ডাসার উপজেলার শশীকর এলাকার কৃষক হরিপদ রায় বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে আমাদের জমিতে পানি জমতে শুরু করেছে। কিন্তু ধান এখনও পুরোপুরি পাকে নি। আর সপ্তাহখানিক থাকলে ধানটা পরিপাক্ক হতো। কিন্তু ঝড়ের কারণে বাধ্য হচ্ছি ধান কাটতে। এতে ফলন আগের বারের মতো হবে না। আমি এবার তিন বিঘা জমিতে ধান লাগাইছি। সব জমির ধান কাটতে শুরু করেছি।’
আরেক কৃষক সলেমান বেপারী বলেন, ‘ধানের গোড়ায় পানি। এখন ধান না কাটলে সব পানির নিচে যাবে। কিন্তু এই সময়ে ধানকাটা শ্রমিকও পাই না। অন্য দিনে প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। এমন থাকলে ধান ঘরে তুলতে পারব না। এখন পরিবারের লোকজন আর স্থানীয় কৃষকদের সহযোগিতায় ধান কাইটা রাস্তায় উঠাচ্ছি। আর রোদ না উঠলে ধানও পচতে শুরু করবে। এখন আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি।’
মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘এবার ধান পাকা মৌসুমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় কৃষকরা কিছুটা বিপাকে পড়েছে। তার কারণে কৃষকদের আগেভাগে নিম্নাঞ্চলের ধান কাটার আহ্বান জানিয়েছি। জেলার ৬০টি ইউনিয়নের কৃষি কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে কৃষকদের ধান কাটতে উদ্বুদ্ধ করছেন। কিছু ধান আধাপাকা হলেও ধান আগে ঘরের নেয়ার অনুরোধ করছি। ফলে কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতির থেকে রক্ষা পাবে।’
তিনি জানান, জেলায় এবার ৩৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। তবে হয়েছে এর চেয়ে কিছু কম জমিতে। এরই মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। বাকি ৭৪ শতাংশ জমির ধান কাটা হবে।
আউশের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ৬৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার প্রণোদনা দেয়া হবে। সারা দেশের ৯ লাখ ৪০ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পাবেন।
উচ্চফলনশীল আউশ ধানের উৎপাদন বাড়াতে এ প্রণোদনার আওতায় একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাবেন। অধিক ফলনশীল ব্রিধান ৪৮, ব্রিধান ৮২, ব্রিধান ৮৫, ব্রিধান ৯৮, বিনাধান ১৯ ও বিনাধান ২১ এর বীজ দেয়া হবে। খবর বাসসের
কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা এবং বীজ ও চারা খাত থেকে এ প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ ইতিমধ্যে জারি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে শিগগিরই এসব প্রণোদনা বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে।
হলুদ ও বেগুনি রঙের ফুলকপি চাষ করে সফল হয়েছেন টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের কৃষক আশরাফুল ইসলাম। বাহারি রঙের ফুলকপি চাষ করে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন তিনি। এসব রঙিন ফুলকপি দেখতে ও কিনতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। আকারে বড় এবং দামেও বেশি এসব ফুলকপি থেকে লাভবানও হচ্ছেন আশরাফুল।
রঙিন এই ফুলকপি চাষি বারোমাসি সবজিও চাষ করেন। ৩৫ বছর বয়সী আশরাফুল উপজেলার পাঁচটিকরী গ্রামের আকবর হোসেন তালুকদারে ছেলে।
আশরাফুল জানান, এ মৌসুমে তাকে রঙিন ফুলকপি চাষের পরামর্শ দেন উপজেলার পাঁচটিকরী কৃষি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌকির আহমেদ। তিনি তাকে ভারত থেকে উন্নতজাতের রঙিন ফুলকপির বীজ সংগ্রহ করে দেন।
কৃষক আশরাফুল ইসলাম বাড়ির পাশে প্রায় ৭৫ শতক জমিতে রঙিন ফুলকপির বীজ রোপণ করেন। রোপণের প্রায় আড়াই মাসের মধ্যে খেত থেকে হলুদ ও বেগুনি রঙের ফুলকপি সংগ্রহ করে প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে তার খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। বিক্রি করেছেন দুই লাখ টাকার ফুলকপি।
কৃষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যখন জমিতে রঙিন ফুলকপি চাষ করি, তখন অনেকেই বলেছিলেন ভালো ফলন হবে না। এ বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌকির আহমেদ আমাকে পরামর্শ দেন। আমি জমিতে সঠিকভাবে পরিচর্যা করেছি। ভালো ফলনে বেশ সাড়া পেয়েছি এবং আর্থিকভাবেও সফল হয়েছি। ৭৫ শতক জমিতে দুই রকমের ফুলকপি চাষে খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকার মতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার জমিতে রঙিন ফুলকপি চাষ দেখে এলাকার কৃষকরা বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আগামী বছর অনেকে বাহারি রঙের ফুলকপি চাষ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’
ওই এলাকার বাসিন্দা কৃষক মিনহাজ উদ্দিন বলেন, আগামী মৌসুমে রঙিন ফুলকপির চাষ করার চিন্তা করছেন তিনি। কারণ রঙিন ফুলকপি বাজারে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়।
উপজেলার পাঁচটিকরী কৃষি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌকির আহমেদ বলেন, এ উপজেলায় সর্বপ্রথম আশরাফুল ইসলামের মাধ্যমে এ বাহারি ফুলকপির আবাদ শুরু হয়। সফলতা আসায় আগামীতে এ অঞ্চলে সবজিটি ব্যাপকভাবে চাষাবাদ বাড়বে। এই উপজেলার কৃষিতে এটি একটি নতুন সংযোজন।
তিনি আরও জানান, বাহারি রঙের ফুলকপি চীনে খাওয়া হয় সালাদ হিসেবে। সাদা ফুলকপির চেয়ে রঙিন ফুলকপির পুষ্টিগুণ বেশি। বাজারেও চাহিদা বেশি। কম খরচ ও কম পরিশ্রমে চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মোটিভেশনের মাধ্যমে ঘাটাইলে রঙিন ফুলকপি চাষ করা হয়েছে।
তিনি জানান, জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে জৈব সার। পোকা দমনে ফেরোমন ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করা হয়েছে। চারা রোপণের ৭০-৮০ দিনের মধ্যেই রঙিন ফুলকপি বিক্রি করা যায়। একেকটি কপির ওজন হয় প্রায় এক থেকে দেড় কেজি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলশাদ জাহান বলেন, ঘাটাইল উপজেলায় প্রথমবার কৃষক আশরাফুল ইসলাম বাহারি রঙের ফুলকপি চাষ করে সফল হয়েছেন। দাম ভালো থাকায় কৃষকদের মাঝে বেশ আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। সাধারণ ফুলকপি যেখানে প্রতিকেজি ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হয়, সেখানে এটি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। আশা করছি আগামীতে রঙিন ফুলকপি চাষ আরও বাড়বে।
দিনাজপুরের হাকিমপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ৭ দিনে ২৭ ট্রাকে এসেছে ২৮৫ টন সজনে ডাঁটা। যা থেকে ৫২ লাখ ২৫ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশীদ হারুন রোববার রাতে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। খবর বাসসের
তিনি বলেন, দেশীয় সজনে ডাঁটা এখনো বাজারে আসেনি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সজনে ডাঁটার চাহিদা থাকায় ভারত থেকে এই পুষ্টিযুক্ত সবজি আমদানি করা হচ্ছে।
হারুন উর রশীদ বলেন, ৭ দিনে হিলি স্থল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে ২৭টি ট্রাকে ২৮৫ টন সজনে ডাঁটা আমদানি করা হয়েছে। আমদাানি করা সজনে ডাঁটা রোববার দুপুর পর্যন্ত সব সজনে ডাঁটা হিলি থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকাররা নিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এ মৌসুমে পবিত্র রমজান মাসের আগে এবং রমজান মাসের মধ্যে সজনে ডাঁটার প্রচুর চাহিদা থাকায় আমদানিকারকেরা আরও হাজার ডাঁটা আমদানি করতে এলসি খুলেছে। দেশীয় সজনে ডাঁটা বাজারে না আসা পর্যন্ত ভারত থেকে সজনে ডাঁটা আমদানি চলমান রাখা হবে।
তিনি বলেন, আমদানি করা এ সবজি বগুড়া, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হচ্ছে। আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে এর চাহিদা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকেরা। প্রতি টন আমদানিতে ১৫০ ডলার এবং কেজিতে ২০ টাকা হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। বন্দরের পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় কেজি হিসেবে।
পাকাইকার আব্দুল মমিন বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা সজনে ডাঁটার মান ভালো হওয়ায় এর চাহিদা বাড়ছে। তিনি হিলি স্থলবন্দর থেকে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে কিনে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে পারছেন। এতে তার লাভ ভালোই হচ্ছে।
আমদানিকারক মো. রাশিদুজ্জামান জানান, তিনি গত ৭ দিনে ৯টি ট্রাকে ৪২ টন সজনে ডাঁটা ভারত থেকে আমদানি করেছেন। তার আমদানি শজনের ডাঁটা বাংলাদেশ শুল্ক পরিশোধ করে যে মূল্যে বিক্রি করেছেন তাতে তিনি ভালো লাভ করেছেন। দেশি সজনে ডাঁটা বাজারে না আসা পর্যন্ত ভোক্তাদের কাছে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাই তিনি আরও ২০ টন সজনে ডাঁটা আগামী দু দিনের মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করবেন। তিনি আশা করছেন আগামী ৫ মার্চের মধ্যেই তার এলসি খোলা সজনে ডাঁটাগুলো হিলি স্থলবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করবে।
হিলি স্থল বন্দর কাস্টম গণসংযোগ বিভাগের পরিচালক সোহরাব হোসেন মল্লিক প্রতাপ জানান, ভারতীয় সজনে ডাঁটার চাহিদা থাকায়, স্থলবন্দর দিয়ে সজনে ডাঁটার ট্রাক প্রবেশের পর কাঁচামাল হওয়ায় দ্রুত খালাস করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এরপর আমদানিকারকেরা বাইরে থেকে আসা পাইকারদের কাছে সহজে সজনে ডাঁটা বিক্রি করে দিতে পারছেন। এ কাঁচামাল আমদানি করে আমদানিকারকেরা এখন পর্যন্ত কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। সজনে ডাঁটা আমদানি থেকে এ পর্যন্ত ৫২ লাখ ২৫ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ভালো মানের বীজ উৎপাদন ও সংগ্রহ করে তা ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়। ভালো ফসল উৎপাদন করতেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির এই কার্যক্রম।
অবাক করা বিষয় হলো, বিএডিসির বীজ ধান ও গম কৃষকদের না দিয়ে বিক্রি করা হয়েছে পাখির খাবারের দোকানে। রাজশাহীর এক পাখির খাবারের দোকানে মিলছে বিএডিসির বস্তায় ভরা এসব বীজ গম ও ধান। প্রকাশ্যেই এসব বিক্রি করা হচ্ছে।
বিএডিসি বলছে, ডিলারদের অবিক্রীত বীজ তারা যেখানে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারে। খেতেও পারে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, পাখি কিংবা মানুষ কেউই এই বীজ ধান-গম খেতে পারে না। কেননা এগুলোতে রাসায়নিক মিশ্রিত থাকে। এগুলোর দোকানে বিক্রির ঘটনায় বেশ ক্ষুব্ধ তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজশাহী নগরীর গ্রেটার রোড মসজিদের বিপরীতে পাখির খাবারের দোকান সেলিম এন্টারপ্রাইজ। এখানে নানা ধরনের পাখির খাবার বিক্রি করা হয়। সেখানে সারি সারি সাজানো আছে বিএডিসির বীজ ধান ও গমের বস্তা। এসব বস্তায় বিএডিসির সিলও মারা রয়েছে। বস্তা কেটে বিক্রি করা হচ্ছে এসব বীজ। প্রতি কেজি ধান বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায় আর গম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।
দোকানটিতে ঢুকতেই দেখা মিলছে বীজের বস্তা। এসব বস্তা আর বীজ প্রত্যয়নও দেয়া আছে। তাতে লেখা রয়েছে ট্যাগ নম্বর, ধানের জাতের নাম, লট নম্বর, প্রত্যায়ন ইস্যুর তারিখ, বৈধতার মেয়াদ, নেট ওজন। প্রতিটি ১০ কেজি ওজনের বস্তা। এসব বীজ যশোর জোনের।
বুধবার সন্ধ্যায় সেখানে দিয়ে দেখা যায়, ভ্যানে করে এসব বীজ আসছে। চটের বস্তায় মোড়ানো এসব বীজ সরাসরি দোকানে তোলা হলো। প্রায় ৩০টি বস্তা সেখানে ঢুকানো হলো। দোকানের সামনে রাখা হলো আরও ৮টি বস্তা। কিছুক্ষণ পর সেই বস্তার মুখ খুলে সরাসরি বিক্রি শুরু করলেন দোকানি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিম এন্টারপ্রাইজের মালিক সেলিম হোসেন বলেন, ‘আমরা হরিয়ানের এক ডিলারের কাছ থেকে এগুলো এনেছি। এগুলো তারা বিক্রির পর অবশিষ্ট বীজ নিলামে বিক্রি করে দেয়। আমরা দ্বিতীয় হাত থেকে কিনে নিয়েছি।’
রাসায়নিক মিশ্রিত বীজ গম ও ধান সরাসরি পাখির খাবার হিসেবে বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বীজে যাতে পোকার আক্রমণ না হয় সেজন্য কিছুটা বিষ দেয়া থাকে। তবে সেগুলো বাইরে। সরাসরি ধানে বা গমে নয়। আর এগুলো খেয়ে যদি ক্ষতি হতো তবে এতে অনেক পাখি মারা যেত। এখন পর্যন্ত তো সেরকম কিছু শুনিনি।’
বিএডিসি যশোর জোনের উপ-সহকারী পরিচালক (বীজ বিপণন) মুসা আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘চলতি ধান ও গমের মৌসুম শেষ। ডিলাররা উত্তোলন করার পরও কিছু বীজ থেকে যায়। সব বীজ তো আর বিক্রি হয় না। তখন তারা কম দামে বিক্রি করতে পারে। এটা তাদের ব্যাপার। এ বিষয়ে একান্ত এখতিয়ার ডিলারদের।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডিলাররা কেন বিক্রি করলেন সেটি আমরা বলতে পারব না। আমাদের বীজ বেচার দরকার আমার বীজ তাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। এই বীজগুলো ২৪ মৌসুমের। এসব বীজে আগামী বছর ফসল ফলবে না। আমরা মনে করি এটি বাইরে বিক্রি করা যৌক্তিক না হলেও তা ডিলারদের বিষয়। আমাদের নয়।’
বিএডিসি রাজশাহীর উপ-পরিচালক কেএম গোলাম সরওয়ার বলেন, ‘এসব বীজে সামনের বছরে আর ফসল হবে না। এই বীজ আর চলে না। আর বীজের চাহিদা নির্ণয় করা হয় মন্ত্রণালয় থেকে। চাহিদা দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এরপর এনএসবি মিটিএয় কে কত বীজ উৎপাদন করবে সেটির অনুমোদন দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘বীজের যাতে সংকট না হয় সেটি বিএনডিসি দেখভাল করে। কোনো কোনো বছর আবাদ একটু কম হয়। ওই বছর তখন বীজ বেচে যায়। এখন সিজন শেষ। ডিলার যারা এই বীজ নিয়েছেন তারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
‘ধরুন, তাদের ৬১ টাকায় কিনে ৬৯ টাকায় বিক্রি করার কথা। সিজনের পর এসব বীজ খাদ্য বা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হবে। একটা সময় আমরা এগুলো ফুডকেও দিয়ে দিতাম।’
তবে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাজদার হোসেন বলেন, ‘এসব বীজ পাখির খাওয়ার উপযোগী নয়। মানুষের খাওয়ারও উপযোগী নয়। অনেক কেমিক্যাল মেশানো হয়। আমরা এর পক্ষে নই। এটা কেন হচ্ছে আপনারা তদন্ত করতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে ধান ও গমের বীজের চাহিদা আছে সেখানে দেয়া হয়নি। অথবা যেখানে চাহিদা নেই সেখানে বেশি আনা হয়েছে। এ কারণে এগুলো হয়েছে।’
রাজশাহী গম গবেষণাগারের সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আমি গত মাসেই যশোরে বদলি হয়ে এসেছি। আমরা অনেক কষ্ট করে এসব বীজ উৎপাদন করি। এরপর বিএডিসিকে দিয়ে দেয়া হয়। এবার ব্যাপক চাহিদা ছিল গমের বীজের। তারপরও কেন এমনটি হলো আমার জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘বিএডিসির কাছে আমরা জানতে চাইব এটি কেন হলো। এটি হওয়ার কথা নয়। বিএডিসির মাধ্যমে বীজ তো কৃষক পাবে। এটি পাখির খাবারের জন্য নয়। পাখির খাবারের জন্য তো আলাদা গম উৎপাদন হয়।’
আরও পড়ুন:বারি-৩৩ ও ডাব্লিউএমআইআর দগম-৩ নামের ব্লাস্ট প্রতিরোধী দুটি গমের জাত আবিষ্কারে ফলে গম চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষিনির্ভর মেহেরপুরের চাষিদের।
চলতি মৌসুমে ফসলটির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই দুটি জাতের বাইরে অন্য জাতের গম আবাদ করে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় রয়েছে জেলার অনেক চাষি।
চলতি মৌসুমে জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক গম চাষ হওয়ায় কৃষি বিভাগ স্বস্তিতে থাকলেও গম খেতে আবারও দেখা দিয়েছে ব্লাস্ট রোগ। ফলে অস্বস্তিতে রয়েছেন জেলার অনেক কৃষক।
জেলার তিন উপজেলা- গাংনী, মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগরের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, ফসলি জমিতে থাকা গম এখনও পূর্ণ পরিপক্ব হয়ে কাটার মতো হতে সময় লাগবে কম পক্ষে তিন সপ্তাহ।
জেলার অনেক এলাকার দূর থেকে দেখে মনে হবে, গম পরিপক্ব হয়ে কাটার উপযোগী হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে তা মাইজ থেকে শিষ শুকিয়ে মরে গিয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। এটিই গমের ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ। ফসলের আশি শতাংশ পর্যন্ত ফলন বিপর্যয় ঘটাতে পারে এ রোগ।
কৃষি বিভাগ চাষিদের সর্বদা বলেছে, নতুন উদ্ভাবিত গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধী উচ্চ ফলনশীল যে দুটি জাত আবিস্কার হয়েছে, তা চাষ করতে। এমনকি প্রণোদনা হিসেবেও দেয়া হয়েছে সার ও গম বীজ।
ঝোড়াঘাট গ্রামের গমচাষি আকমল হোসেন বলেন, ‘আমাদের মাঠে এবার ব্যাপক গমের আবাদ হয়েছে। আমিও দুই বিঘা জমিতে গম আবাদ করেছি। তবে সপ্তাহখানেক হবে, গম সব হলুদ হয়ে কাটার মত অবস্থা হয়ে গেছে। কীটনাশক প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না।’
তার চাষ করা গম ‘প্রদীপ’ জাতের বলে জানান তিনি।
নওদা মটমুড়া গ্রামের চাষি মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজের সংগ্রহে থাকা বীজ দিয়ে গমের আবাদ করেছি। গমও খুব ভালো হয়েছিল। মাঠে থাকা গম এখনও কাটার মত হয়নি। তবে এখনই সব গম হলুদ হয়ে গেছে। এই গমে ভালো ফলন পাওয়া যাবে না। এ বছর গমে ধরা খায়ি গেলাম।’
তেরাইল গ্রামের চাষি আজিজুল হক বলেন, ‘ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত বের হয়েছে বলে শুনেছি। তবে আমরা সবসময়ই বাড়িতে সংগ্রহে থাকা বীজ থেকে গমের আবাদ করি। এ বছরও তাই করেছি।’
তিনি বলেন, ‘শুরুতে গম খুব ভালো হয়েছিল। শেষের দিকে এসে সব গম শুকিয়ে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকার মত খরচা হয়েছিল গম চাষে। সামনের বার আর বাড়ির বীজ দিয়ে গম চাষ করব না।’
মেহেরপুর জেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ কৃষ্ণ কুমার হালদার বলেন, ‘চলতি মৌসুমে মেহেরপুরে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১০ হাজার হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার হেক্টর জমি। কৃষি বিভাগ পক্ষ থেকে চাষিদের উদ্দেশে সবসময় বলা হয়েছে, ব্লাস্ট প্রতিরোধী উচ্চফলনশীল জাতের গম চাষ করতে। এমনকি পাঁচ হাজার চাষিকে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার দেয়া হয়েছে। যারা কৃষি বিভাগের কথা না শুনে বাড়িতে সংগ্রহে থাকা গম বীজ ব্যবহার করেছেন, তাদের খেতে ব্লাস্ট আক্রমণ করেছে।’
আরও পড়ুন:শেরপুরে বেগুনের খেতে পোকার আক্রমণ দেখা দেয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। লাভের আশায় ধার করে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা, কিন্তু বেগুন খেতে ব্যাপকভাবে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রমণ দেখা দিয়েছে। কীটনাশক ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন অধিকাংশ কৃষক।
এমন দুর্ভোগে পড়া কৃষকদের উদ্দেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বার্তা দিয়েছে, কীটনাশক দিলেও কাজ হবে না। ‘সেক্স ফেরোমন ফাঁদ’ পাতলে এ আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব।
শেরপুর সদর উপজেলার চরপক্ষীমারী ইউনিয়নের ডাকপাড়ার বেগুনচাষী আব্দুল আজিজ বলেন, ‘লাভের আশায় এ বছর সাত বিঘা জমিতে গোল বেগুনের আবাদ করেছিলাম। ধার করে ছয় লাখেরও বেশি টাকা খরচ করেছি, কিন্তু বেগুন ক্ষেতে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে বেশির ভাগ বেগুনই নষ্ট হয়ে গেছে। কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো কাজ হয়নি।
‘এতে পোকার আক্রমণে ছিদ্র করা অধিকাংশ বেগুনই ফেলে দিতে হয়েছে। ফলে খেতে বিক্রি হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেগুন। বাকি টাকা উঠবে না। এখন জমিজমা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে । তাই চরম হতাশায় দিন কাটছে।’
বেগুন চাষী আব্দুল আজিজ বলেন, ‘এবার বাগুন টালে ধরা, বাগুন ক্ষেতে এবার প্রচুর পোকা। এক মন বাগুন তুললে, এক মন
বাগুনেই পোকা থাকে। অনেক বিষ দিলাম, কিন্তু কোনো কাজ হইলো না। বিষ কোম্পানির নোক আইয়া যে বিষ দিবার কইতাছে, ওডেই দিতাছি কিন্তু কোনো কাম অইতাছে না। বাগুন তুইলে গরুরেই খাওয়াইছি বেশি, সাড়ে তিন লাখ টেহার মতো বেচছি। যে বেগুন আছে ঐডি দিয়া আর বাকি টেহা তুলবার পামুনা। এহন ঋণ দিবার গেলে জমি বেচা ছাড়া, আমার কোন বুদ্ধি নাই। সরকারি কৃষি অফিসার আহনের কথা আছিলো, আহেনাই কোনোদিনও।’
কৃষক ওসমান আলী বলেন, ‘গত বছর গোল বেগুন চাষ করে লাভ করেছিলাম। তাই এইবার বেশি কইরা লাগাইছিলাম। কিন্তু এ বছর বেগুনের টাকা পোকার পেটে চলে গেছে। কি! কইরা এহন চলি।’
কৃষকদের অভিযোগ সরকারি কৃষি বিভাগের লোকজন তাদের কাছে আসেন না। তাই তারা বাজার থেকেই কীটনাশক এনে ক্ষেতে স্প্রে করেন। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। এতে তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষকরা মহাজনের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। তাই সরকারিভাবে সহায়তা চান ক্ষতিগ্রস্তরা।
বেগুন চাষি সামিদুল হক বলেন, ‘গত বছর মনে করেন, এইখানি টাল দিয়ে খরচপাতি বাদ দিয়া লাখ খানি টেহা লাভ করছিলাম। এবার বছর পোকা জরজরা কইরা ফেলাইছে। এবার চালানই তুলা হাইতাছিনা। দশ হাজার টেহা টাইনা আইনা দিছিলাম, এই টেহাডাও তুলবার পাই নাই।’
বেগুন চাষি হোসেন বলেন, ‘টাল দেয়ার পরে যে পোহা ধরছে, এই পোহা আর ছাড়াবার পাই নাই। যে কারণে বাগুন টালে যে টেহা খরচ করছিলাম, তা আরো লছ, বাগুনের টেহা তুলবার পাই নাই। বাজারে গেলে যে বিষ দিবার কয়, সেটাই দিতাছি কিন্তু কোন কাজ অইতাছে না। এবার ঋণের টেহা গরু বেইছা দেওন লাগবো। বিএসরাও আহে না। কোম্পানির লোক পাঠাই দিছে। ওরা তো আহেনা।’
বেগুন চাষি খায়রুল বলেন, ‘বাগুন টালের আবাদ আর করন যাবে না। পোহাই সব খাইয়া হেলায়। আমরা অনেক টেহা ধরা খাইছি। আমরা সরকারের কাছে জানাইতেছি, আমগোরে কিছু একটা করুক। গুল বেগুনের চাহিদা বেশি। কিন্তু আমরা কুলেবার পাইতাছি না। পোহা সব শেষ কইরা ফালাইছে।’
শেরপুরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, বেগুন চারা বেড়ে ওঠার সঙ্গে পোকা মারার ‘সেক্স ফেরোমন ফাঁদ’ পাতলে এ আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হতো।
সেক্স ফেরোমন হচ্ছে এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ- যা কোনো প্রজাতির স্ত্রী পোকা কর্তৃক একই প্রজাতির পুরুষ পোকাকে প্রজনন কার্যে আকৃষ্ট করার জন্য প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করা হয়। সেক্স ফেরোমনের গন্ধে পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী পোকার সঙ্গে মিলনের জন্য এসে ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারায়।
শফিকুল ইসলাম বলেন, পোকা ছিদ্র করে বেগুনের ভেতর প্রবেশ করলে কীটনাশক দিলেও তখন তেমন কাজ হয় না। চলতি মৌসুমে শেরপুর জেলায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে বেগুনের আবাদ করা হয়েছে। এখানে উৎপাদিত বেগুন জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাছ চাষে লাভ বেশি হওয়ায় উত্তরবঙ্গের অন্যতম শস্যভান্ডার সিরাজগঞ্জে ফসলি জমিতে হিড়িক পড়েছে পুকুর কাটার।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পুকুর কাটায় জেলায় গত দেড় দশকে কমেছে ১ হাজার ৯২০ হেক্টর জমি।
জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধানের আবাদ হয় তাড়াশে। এ উপজেলায় এক্সক্যাভেটর দিয়ে তিন ফসলি উর্বর জমি কেটে পুকুর খনন করার ফলে প্রতি বছর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে বিপুল পরিমাণ ধান, গম, খিড়া, শসা, পাট, বেগুন, ডাল, রসুন, কাঁচামরিচ, আখসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন হয়, যার উদ্বৃত্ত অংশ দেশের অন্যত্র বিক্রি হয়, কিন্তু দিন দিন কৃষিজমি কমতে থাকলে জেলায় খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার শঙ্কা রয়েছে, যার প্রভাব পড়তে পারে সারা দেশে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেড় দশকে ২ হাজার ৫৩৯টি পুকুর খনন করা হয়েছে। এ সময়ে ১ হাজার ৯২০ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে।
পুকুর থেকে তোলা মাটি বহনকারী ডাম ট্রাক ও ট্রাক্টর চলাচলের কারণে সড়ক-মহাসড়কেরও ক্ষতি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জেল-জরিমানা করেও পুকুর খনন বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে ধানের উৎপাদন কমে আসবে। দ্রুত এর অবসান না হলে জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখে দেবে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করছেন হাজি বাবু নামের একজন। ভায়াট গ্রামের আলামিন জমি ইজারা নিয়ে পুকুর খনন করছেন। লালুয়া মাঝিড়া গ্রামের উত্তর মাঠে একটি বড় পুকুর খনন করছেন খোকা নামের এক ব্যক্তি।
রাষ্ট্রীয় দপ্তরের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অধিকাংশ গ্রামে রাতের আঁধারে কৃষিজমির ওপর এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চললেও কৃষিজমিসহ নদী ও খাস জমি দখল করে চলছে পুকুর খনন।
বাঁশবাড়িয়া গ্রামের পুকুর খননকারী হাজি বাবু ও আলামিন জানান, কয়েক বছর ধরে তাড়াশের বিভিন্ন স্থানে পুকুর খনন করা হচ্ছে। তাই তারাও করছেন। সবারটা বন্ধ হলে তারাও আর খনন করবেন না।
কালিদাসনিলি গ্রামের তারিকুল ইসলাম, শাজাহান আলী ও আখতার হোসেন জানান, হাজি বাবু বাঁশবাড়িয়া গ্রামে আবাদযোগ্য ৪৫ থেকে ৫০ বিঘা জমিতে একটি পুকুর খনন করছেন। পুকুরটির খনন শেষ হলে উত্তর ও দক্ষিণের মাঠের পানি নামতে পারবে না। তখন জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।
ট্রাকের মালিকদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রতিটি গাড়ি মাটি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়।
কালিদাসনিলি এলাকার জহুরুল ইসলাম নামের এক মাদ্রাসার শিক্ষক বলেন, ‘আমার ১০ কাঠা জমি ছিল। সলঙ্গা থানার কুমার গাইলজানি গ্রামের সাচ্চু নামের একজন মাঠের ১৫ জন কৃষকের জমি ইজারা নিয়েছেন পুকুর খননের জন্য। শেষমেশ আমিও দিতে বাধ্য হই। নয়তো আমার ওইটুকু জমি পুকুরের এক কোনায় পানিতে তলিয়ে থাকত।’
জানতে চাইলে তাড়াশ থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা লঙ্ঘন করে পুকুর খনন করার অপরাধে গত ১ মাসে জমির মালিকদের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ৮টি, ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ১০টি এবং সাধারণ কৃষকরা বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছে।’
তাড়াশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদ হাসান বলেন, ‘পুকুর খননের তথ্য পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতে বেশ কয়েকজনকে জেল ও জরিমানা করা হয়েছে।
‘সগুনা ইউনিয়নের খরখড়িয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠের আবাদযোগ্য উর্বর জমি কেটে পুকুর খনন করার অপরাধে গত ১ জানুয়ারি এক ব্যক্তিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৩ মাসের জেল দেয়া হয়েছে। নওগাঁ ইউনিয়নের ভায়াট গ্রামে পুকুর খনন করায় সুমন মোল্লা ও সাদ্দাম হোসেনকে এক মাস করে জেল দেয়া হয়েছে। পৌষার গ্রামে পুকুর খনন করার অপরাধে শাজাহান নামের এক ব্যক্তিকে ৬ মাসের জেল দেয়া হয়।’
তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘তাড়াশের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে বছরে তিন ফসলিসহ বিভিন্ন জাতের ধান ও রবিশস্যের আবাদ হয়। তারপরও কৃষকরা তাদের জমি কেটে পুকুর খনন করছেন। মূলত মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র কৃষকের সব দায়ভার নিয়ে পুকুর খনন করে দিতে উৎসাহিত করছেন।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিরাজগঞ্জের উপপরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, ‘এই জেলার মতো উর্বর এবং তিন থেকে চার ফসলি জমি দেশের খুব কম এলাকায় আছে। সে কারণে সিরাজগঞ্জ জেলা শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত। ভবিষ্যতে সেই সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হবে না। দেড় দশকে ১ হাজার ৯২০ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ কেন বুঝতে চাচ্ছে না যে, আবাদি জমি কমে গেলে তাদের জীবন সংকটাপন্ন হবে? ফসলি জমিতে পুকুর খনন বা শিল্পায়ন কঠোর হাতে দমন করা হবে।’
মন্তব্য