অসময়ের পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের বাঁধ ভেঙে তলিয়েছে বহু ধানি জমি। বাঁধ রক্ষায় যে কৃষকরা দিন-রাত খেটেছেন, তারা এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ধান রক্ষার লড়াইয়ে।
জেলার শাল্লা, তাহিরপুর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরের ধান কেটে নিচ্ছেন কৃষকরা। কোমর সমান পানিতে নেমেও ধান কাটছেন তারা। তবে এসবের মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক সংকট।
কৃষকের আশঙ্কা, আর কয়েক দিন উজানের পানি বাড়লে অবশিষ্ট ধানও তলিয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বেশি মজুরি দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয়সংখ্যক শ্রমিক।
তাই এ সংকট সমাধানে প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বিজন সেন রায়। যদিও কৃষি বিভাগের দাবি, হাওরে শ্রমিক সংকট তেমন একটা নেই।
শাল্লার ছায়ার হাওরে সাড়ে ৪ একর জমিতে ধান আবাদ করেছেন রতি দাশ। তার জমির ধান আধাপাকা। পানি বাড়ছে, তাই আধাপাকা ধানই কেটে নেবেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটে তা পারছেন না।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কষ্ট করে ফসল লাগাইয়া এখন হাওরও পানি বাড়ের, কিন্তু ধান কাটার মানুষ ফাইরাম না। ছেলে আর আমি যতটুকু পাররাম কররাম, এখনও বিশাল পরিমাণে ধান হাওর রয়ে গেছে। কি করমু কিচ্ছু বুঝরাম না।’
শান্তিগঞ্জে দেখার হাওরে হাঁটু পানিতে ধান কাটছেন কৃষক নুর উদ্দিন। তার অধিকাংশ ধানগাছ অর্ধেক পানির নিচে। তিনি বলেন, ‘বাজান এবার আমরার শনি লাগছে। ধান ভালা অইছিল। কিছু পোকায় খাইছে, এখন পানি সব নিরোগি। কয়েকজন মিলিয়া ধান কাটরাম মানুষ, কিন্তু পাচ্ছি না। আসমানও মেঘ, মরি আর বাঁচি, ধান না খাটলে ফুরুতা না খাইয়া থাকবও।’
শনির হাওরের কৃষক জব্বার আলী বলেন, ‘ধান কাটার মানুষ নাই, যাও পাইলায় তারা রোজ ৫০০-৭০০ করি টাকা চায়। এত টাকা কই পাইতাম। এমনেই অবস্থা ভালা না, তাড়াতাড়ি কাটতে না পারলে সব শেষ।’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বিজন সেন রায় বলেন, ‘এ শ্রমিক সংকট দূর করতে সব বালুমহাল ও পাথর কোয়ারি আপাতত বন্ধ করে শ্রমিকদের হাওরে পাঠাতে হবে। তা না হলে আমরার যা পাওয়ার ছিল, তাও পাব না।’
তবে সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি কর্মকর্তা বিমল চন্দ্রের দাবি উল্টো। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলায় এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। হাওরে শ্রমিক সংকট তেমন একটা নেই, ধান কাটার হারভেস্টার মেশিন আছে। আর বৃষ্টি না হলে ধান আমরা ভালোভাবেই তুলতে পারব।’
আরও পড়ুন:সিলেটে ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে বোরো ধান। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আউশ ধান চাষে মনোযোগী হয়ে ছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলং এলাকার কৃষক নিজাম উদ্দিন।
দুই একর জমিতে আউশের বীজ রোপন করেছিলেন। বীজ থেকে চারাও গজিয়ে ছিল। কিছুদিনের মধ্যে এই চারা রোপনের পরিকল্পনা করছিলেন নিজাম। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় গুড়েবালি। বন্যায় তলিয়ে গেছে নিজামের বীজতলা।
নিজাম উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘৪ দিন ধরে বীজতলা পানিতে ডুবে আছে। সব চারা পচে যাবে। গত মাসে বন্যায় বোরো ধান গেছে। এবার আউশও চলে গেলে আমাদের বছর চলবে কী করে? খাবো কী?
কেবল নিজাম উদ্দিন নন, এই আক্ষেপ এখন সিলেটের বেশিরভাগ কৃষকের। গত মার্চ-এপ্রিলের অসময়ের বন্যায় সিলেটের সুনামগঞ্জে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এবারের বন্যায় বোরোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আউশও।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের হিসেবে, চলমান বন্যায় বুধবার পর্যন্ত আউশ ধানের বীজতলা এক হাজার ৩০১ হেক্টর, বোরো ধান এক হাজার ৭০৪ হেক্টর এবং গ্রীষ্মকালীন সবজি এক হাজার ৪ হেক্টর পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে সিলেটে বৃহস্পতিবারও অব্যাহত রয়েছে পানি বৃদ্ধি। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। অব্যাহত রয়েছে বৃষ্টিও। জেলা প্রশাসনের হিসেবেই, সিলেটে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের সহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে পাওয়া হিসেবে, সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৭৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ৩৪ বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকেছে বিভিন্ন এলাকায়।
বন্যায় সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পর এবার বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলারও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পানি উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলা কমপ্লেক্সে। এসব উপজেলার অনেক বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রেও পানি উঠে গেছে। এতে আশ্রিতরা পড়েছেন বিপাকে।
সিলেট জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে এবং ১৫টি ইউনিয়ন আংশিকভাবে প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে সিলেট সদর ও জৈন্তাপুর উপজেলায় নৌকাডুবিতে ৩ জন মারা গেছেন। গোলাপগঞ্জে পাহাড় ধসে একজন মারা গেছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, ‘জেলায় ২৭৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বর্তমানে ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬৪৭৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদিপশুর জন্য ২২০টি আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বন্যার্তদের মধ্যে এরই মধ্যে ৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, ১৪৯ টন চাল, ১৭৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আশয়কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবা ও বিশুদ্ধ পানি দেয়া হচ্ছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আরও ২৫ লাখ টাকা, ২০০ টন চাল ও ৪০০০ প্যাকেট শুকনো খাবার পাওয়া গেছে।’
আরও পড়ুন:ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোথাও স্থায়ী হাট-বাজার বসানো হলে তা অধিগ্রহণের বিধান রেখে আনা হাট-বাজার (স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা) আইন-২০২২ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই অনুমোদন দেয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এটা আগে ১৯৫৯-এর একটা অর্ডিন্যান্স ছিল। সেটিকে যুগোপযোগী করে আইনের খসড়া বানানো হয়েছে। এতে প্রায় ২৬টি ধারা রয়েছে। এই আইনের বিধান না মেনে কোথাও হাট-বাজার বসানো যাবে না। হাট-বাজার বসানো হলে ওই জমি খাস হিসেবে গণ্য করে নিয়ে নেবে সরকার।
‘আমি যদি আমার বাড়িতে কোনো হাট-বাজার বসাই, এটা মোহন মিয়ার একটি মামলা ছিল সরকারের সঙ্গে। উনি তখন কোর্টে গিয়ে এটা ব্যক্তিগত হাট-বাজার উল্লেখ করে মামলায় জিতে গেলেন। এটা বিখ্যাত একটি মামলা। পরবর্তীতে সরকার ডেফিনেশন পরিবর্তন করে বলল- যেখানেই কেউ হাট-বাজার বসাবে সেটা খাস জমি হয়ে যাবে। এখনও সরকারের পারমিশন ছাড়া কোনো হাট-বাজার বসানো যাবে না। এখানেও আগের ডেফিনেশন স্ট্যান্ড করবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক অনুমতি দেবেন।’
খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, ‘হাট-বাজারের কোনো জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত করা যাবে না। তবে এ সংক্রান্ত বিধিমালা অনুসরণ করে জেলা প্রশাসক অস্থায়ীভাবে একজনের বিপরীতে সর্বোচ্চ আধা শতক জায়গা দিতে পারবে। এর বেশি একজনকে দেয়া যাবে না।
‘সরকার গেজেট দিয়ে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইনের অধীনে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পর অথবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯২ ধারা অনুসারে খাস ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত তারিখ থেকে যে কোনো হাট ও বাজার দখল করতে পারবে।’
সচিব বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে বলা হয়েছে। বছরে যদি একদিন হাট-বাজার বসে সেটা অন্য কথা। কিন্তু স্থায়ীভাবে হাট-বাজার বসলে সরকার ওই জমি নিয়ে নেবে।
‘ডেফিনেশনটা হলো- হাট ও বাজার অর্থ যে স্থানে জনসাধারণ দৈনিক অথবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট কোনো দিন কৃষিপণ্য, ফলমূল, হাঁস-মুরগি, ডিম, মাছ, মাংস, দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় পণ্য বা অন্য কোনো পণ্য বা শিল্পজাত পণ্য ও দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয় হয়। সেই স্থানে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য স্থাপিত দোকানও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।’
আরও পড়ুন:‘প্রথমে হাওর জুড়িয়া পানি আইলো, তাড়াহুড়া করিয়া গিয়া ধান কাটলাম। এখন গেল দুই দিনের বৃষ্টিতে ঘরেও পানি আইয়া কাটা ধান নষ্ট করি দিসে। এখন এই ভিজা ধান কিলান কিতা করতাম বুঝিয়া উঠতে পাররাম না।’
এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন সুনামগঞ্জের লালপুর এলাকার কৃষক শফিক।
টানা ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের হাওর ও নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে তা প্রবেশ করছে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল এলাকাগুলোতে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন হাওরের মানুষেরা।
বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সুনামগঞ্জের নদনদীর পানি কমতে শুরু করলেও এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
এদিকে সরেজমিনে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লালপুর গৌরারং, সাহেববাড়ি ঘাট এলাকায় ঘুরে দেখা যায় অনেক ঘরের মধ্যে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক কাঁচা সড়ক পানিতে ধসে গেছে। ওইসব এলাকায় এখন যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছে নৌকা। সেই নৌকা করে ধান নিয়ে রাস্তায় শুকাচ্ছেন স্থানীয় লোকজন।
এ সময় দেখা যায়, যাদের ধান আর ঘর দুটোই পানিতে ডুবে গেছে তারা বেশি বিপাকে পড়েছেন। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে সেই শঙ্কায় দিন কাটছে হাওর এলাকার মানুষজনের।
লালপুর এলাকার জামিলা বেগম বলেন, ‘১০ কেয়ার (একর) জমিত ধান করছিলাম। মাত্র দুই কেয়ারের ধান তুলতে পারছি। এখন এই ধানগুলোও ভেজা। তিন দিন ধরি ধানগুলো পানিত ভিজেছে। আজ রোদ ওঠায় রাস্তার নিয়ে শুকাচ্ছি। ধান বেচলে এই টাকা দিয়া সংসার কয়দিনইবা চলব।’
সিলেটের শাহপরান থানায় কাজ করেন হোসেন মিয়া। ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসেন তিনি। বাড়িতে এসে মাথায় হাত পড়েছে তার।
তিনি বলেন, ‘বড় শখ করে ধান করেছিলাম। আমার ধানগুলো বৈশাখ মাসেই পাকে। কিন্তু বাড়ি না থাকায় পাকা ধান মাঠেই ছিল। এখন ধান কাটতে বাড়িতে এসে এক দিনও রেস্ট নিতে পারিনি। এরই মধ্যে এক রাতের বৃষ্টি আমার পাকা ধান সব নষ্ট করে দিয়েছে।’
বাজারে পণ্যের দামে দিশেহারা হাওরের ক্ষতিগ্রস্তরা
একে তো ধানের ক্ষতি এর ওপর বাজারে পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছেন হাওরের কৃষকরা। চাল ঘরে থাকলেও তেল, নুন আর সবজি কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
গৌরারং এলাকায় ঘরে পানি ঢোকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নুর আলী। তিনি বলেন, ‘আমার ধান করার জমি নেই। মানুষের জমির ধান কেটে কিছু ধান পেয়েছিলাম। এর থেকে চাল করেছি। কিন্তু শুধু চাল দিয়ে কী করব। তেল, নুন, সবজিও তো লাগে। তেলের দামও ২০০ টাকা লিটার। দরিদ্ররা বাঁচবে কী করে।’
রথি দাশ নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘ধানের দাম সরকার ঠিক করে দিলেও আমরা এই দামে ধান দিতে পারি না। আমাদের থেকে যে দামে ধান নেয়া হয় তা দিয়ে এক মাস ভালো করে খাওয়া যায় না। বাজারে যাইতেও ভয় লাগে। এর মধ্যে পানি বাড়ছে। ছোট ছেলে জাল নিয়ে মাছ ধরতে গেছে। মাছ আনলে ভাত খাইতে পারতাম।’
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি কার্যালয়ের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘গত তিন দিনের বৃষ্টিতে হাওরের অনেক পাকা ধান পানিতে ডুবে গেছে। এখন পর্যন্ত ৬৫০ হেক্টর জমির পাকা ধান পানিতে ডুবে গেছে।’
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘সব নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। পানি খুবই ধীরে কমছে। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পানি আরও বাড়তে পারে।’
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের সহায়তা দেয়া হবে।’
আরও পড়ুন:ভারত থেকে বেসরকারিভাবে গম আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বুধবার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দেশে গমের সরবরাহ নিয়ে কোনো ধরনের সংকটের শঙ্কা উড়িয়ে দেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, গম আমদানির ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং ভারতের বিকল্পও খোঁজা হচ্ছে।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতীয় হাইকমিশন একটি প্রেস কনফারেন্স করেছে। সেই প্রেস কনফারেন্সের কপি তারা আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। তারা বলেছে, প্রতিবেশী দেশের জন্য গম আমদানিতে কোনো অসুবিধা নেই। তার আলোকে আমরা টেন্ডারও করে যাচ্ছি। আগামী ২৩ ও ২৯ মে আমাদের টেন্ডার আছে। তাদের ঘোষণার পর জি-টু-জি (সরকার বনাম সরকার) প্রস্তাবও পেয়েছি আমরা।
‘সরকারিভাবে গম নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না। আমরা বলেছি বেসরকারিভাবে যারা আমদানি করে তাদের কী হবে? ভারত বলেছে যে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিতেও সমস্যা হবে না। মন্ত্রণালয় লিখলে তারাও (বেসরকারি আমদানিকারক) পারবে। অনেকেই ভারতীয় গম কিনে রেখেছে। এলসি হয়তো করেনি। সেগুলো তারা সরকারের অনুমতি নিয়ে আনবে।’
গম আমদানির ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ভারতের বিকল্পও খোঁজা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘রাশিয়া ও ভারতের বাইরে অন্যান্য উৎসও খুঁজছি আমরা। বুলগেরিয়ার সঙ্গে আমাদের এমওইউ হয়েছে। তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসবো আমরা। কোনো অসুবিধা হবে না।’
‘চালের দাম বৃদ্ধি সাময়িক’
চালের দামে ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যে সময়টা যাচ্ছে সেটাকে মৌসুমের সন্ধিক্ষণ বলা যেতে পারে- পুরনো চালের শেষ সময় আর নতুন চালের আগমন। এই সন্ধিক্ষণে মিলাররা বাজার থেকে ধান কেনায় ব্যস্ত, তারা এখনও পুরো মাত্রায় উৎপাদনে যায়নি। তারপরও আমরা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের মনিটরিং খুব শক্ত। আশা করি চালের দাম সহনশীল পর্যায়ে চলে আসবে।’
সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘অটো রাইস মিল ছাড়া হাস্কিং চাতাল যেগুলো রয়েছে, এরা তখন বাজারটা কন্ট্রোলে রাখে। দুই গাড়ি কেনে, দুই গাড়ি ছাড়ে। অটো রাইস মিলগুলো মজুদ সম্পন্ন করে এখনও উৎপাদনে যায়নি। হাস্কিং চাতালে ধান সিদ্ধ করে শুকাতে দু-তিন দিন লাগে। সেখানে বৃষ্টির কারণে তিন-চারদিন লেগে যাচ্ছে।
‘আমাদের ১১ লাখ টন চাল কেনার ঘোষণা আছে। ১৬ মে ছিল চুক্তির শেষ তারিখ। এ সময়ের মধ্যে ১০ লাখ ৭৬ হাজার টনের মতো চাল কেনার চুক্তি হয়ে গেছে। প্রায় ৯৮ শতাংশ সংগ্রহের জন্য চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। সেদিক দিয়ে মনে করছি আমরা সফল।’
চাল-গমসহ পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের সমালোচনা করেন খাদ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ফায়দা লুটার জন্য, রাজনীতির জন্য কেউ বক্তব্য দিলে তা ভিন্ন কথা। সরকারের পরিকল্পনার অভাবে প্রতিদিনই চালের দাম বাড়ছে- বিএনপি মহাসচিবের এ বক্তব্য সত্য নয়।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, হাওরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হলেও সেখানে আহামরি কোনো ফসলের ক্ষতি হয়নি। হাওরে ২ থেকে ৩ শতাংশ ধান নষ্ট হয়েছে। তবে এবার অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে।’
আরও পড়ুন:পুনর্ভবা নদীর পানি বেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে প্রায় আড়াই হাজার বিঘা জমির পাকা ধান তলিয়ে গেছে। এমন বিপর্যয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
গোমস্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন রাধানগরের কুজাইন বিলে বছরে একবার ধান ও বাকি সময় মাছ চাষ হয়।
কৃষকরা জানান, কয়েক বছর ধরে ধান ঘরে তোলার আগে উজানের পানিতে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বছর এখন পর্যন্ত অর্ধেক জমির ধান কাটা হয়েছে। অনেকেই ধান কেটে আঁটি করে জমিতে রেখেছিলেন। পানিতে সব ভেসে গেছে। আর যেসব ধান এখনও কাটা হয়নি সেগুলো ডুবে গেছে।
ভেসে যাওয়া ধানই নৌকায় করে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, ‘গত বছরও পানি অ্যাসাছিল (এসেছিল)। তবে সে বার পানি কম থাকায় ধানের ক্ষতি একটু কম হয়্যাছিল (হয়েছিল)। ধানও কেটে তুলতে প্যারাছি (পেরেছি)। এবার ধান একবারই (পুরোপুরি) ডুব্যা গেছে। কিচ্ছু পাব না।’
রাধানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্ধেকের বেশি জমির ধান কাটা শেষ হয়ে গেছিল। বাকি জমির ধান কাটা চলছিল। হঠাৎ করেই শনিবার থেকে পুনর্ভবা নদীতে পানি বাড়তে থাকে।
‘একপর্যায়ে পানি পুনর্ভবার শাখা নদী জামদাড়া নালায় ঢোকে। জামদাড়া উপচে পানি কুজাইনে ঢুকে পড়ে। এতে কেটে রাখা ধানগুলো ভেসে গেছে। তবে কার কার ধান ভেসে গেছে সেটা এখন বোঝার কোনো সুযোগ নেই। ধানগাছগুলোও এখন পানির নিচে।’
মতিউর জানান, তার নিজেরই ২২ বিঘা জমির ধান ভেসে গেছে। মাড়াই করার জন্য ধান কেটে জমিতে রেখেছিলেন। তার মতো দেড় থেকে দুই হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রোকনপুর, ইসলামগঞ্জ ও চেরাডাঙ্গার কৃষকদের।
গোমস্তাপুরের কৃষি কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ সরকার জানান, বিল কুজাইনে প্রায় আড়াই হাজার বিঘা জমির ধান ডুবে গেছে। এতে প্রায় দেড় হাজারের মতো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কয়েক বছর ধরেই এমন ঘটনা ঘটছে। ধান ঘরে তোলার ঠিক আগে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
তানভীর বলেন, ‘গত বার ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দেড় হাজার কৃষককে উচ্চ ফলনশীল ধানবীজ ও সার প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল। তারা সেই বীজ লাগিয়েছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছিল। তবে ধান ঘরে তোলার আগেই বিপর্যয় ঘটে গেল।
‘বিল কুজাইনে বছরে একটা ফসলই হয়। ধানটা ভালোও হয়। ধান ছাড়া এখানে অন্য ফসল করার খুব বেশি সুযোগ নেই। ধান উঠলে বাকি সময়টা মাছ চাষ হবে।’
ক্ষতি কতটা পুষিয়ে নেয়া যাবে সে বিষয়ে তানভীর বলেন, ‘যাদের ধান ভেসে গেছে তারা ধানগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। আর যাদের এখনও কাটা হয়নি তারা পানি কমলে হয়তো শুধু ওপরের অংশটা কেটে নেবেন। তবে কতটা রিকভার করা সম্ভব হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না।
‘এ বছরও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের প্রণোদনার বীজ ও সার দেয়ার চেষ্টা করা হবে।’
আরও পড়ুন:সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বগুড়ায় কৃষিপণ্য উৎপাদন প্রতিযোগিতা-২০২২ পরিদর্শন করেন। এছাড়াও তিনি বগুড়া আর্মি মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শন ও প্রকল্পের অগ্রগতি দেখেন। এ সময় তিনি কলেজ প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ করেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।
আইএসপিআর জানায়, সেনাপ্রধান স্টেশন বোট ক্লাব লেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন। এ সময় তিনি সেনাবাহিনীর এই বিশেষ উদ্যোগ জাতীয় মোট উৎপাদনে কিভাবে ভূমিকা রাখছে সে বিষয়ে কথা বলেন।
সেনাবাহিনী প্রধান বগুড়া সেনানিবাসের বিভিন্ন স্থান এবং কর্মকাণ্ডও পরিদর্শন করেন। সেনানিবাসে কর্মরত অফিসারদের জন্য একটি অফিসার্স কোয়ার্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম, মেজর জেনারেল এফ এম জাহিদ হোসেন এবং ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী পদক্ষেপ ‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না’ বাস্তবায়নে সেনাপ্রধানের দিকনির্দেশনায় সেনাবাহিনীর সব এরিয়া/ফরমেশনে মৌসুমভিত্তিক অব্যবহৃত ও পতিত জমি কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেনানিবাসের সব অনাবাদি জমিতে, এমনকি প্রতিটি বাসা-বাড়ির আনাচে-কানাচে লাগানো হয়েছে বনজ, ঔষধি ও ফলের গাছ। উন্মুক্ত স্থানে চাষ করা হচ্ছে নানা জাতের মৌসুমী ও বারোমাসি ফল এবং নানা ধরনের মৌসুমী শাকসবজি। পুকুর ও জলাভূমি ব্যবহার করা হচ্ছে মাছ চাষ ও হাঁস পালনে। বিভিন্ন প্রকার খামার ছাড়াও বায়োফ্লক পদ্ধতিতে উৎপাদিত হচ্ছে শিং ও তেলাপিয়া মাছ।
প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় সেনাবাহিনী প্রধানের বিশেষ উদ্যোগে সব সেনানিবাসে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এবং বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ প্রয়াস আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।
আরও পড়ুন:তীব্র দাবদাহের প্রভাবে উৎপাদন হ্রাস ও স্থানীয় বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। তবে এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কি না তা নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।
ভারত সরকার শুক্রবার হঠাৎ করেই গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করার পর থেকে বাংলাদেশেও এটি বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ী পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণের মধ্যেও এই আলোচনায় ডালপালা গজিয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এই অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। রোববার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দাবি করেন, গম রপ্তানিতে ভারত সরকার নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আর সোমবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশকে গম দেবে।
প্রকৃত ঘটনা হলো, গম রপ্তানির ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার খবর যেমন সত্য, তেমনি বাংলাদেশের দুই মন্ত্রীর দাবিও অসত্য নয়।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) শুক্রবার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে বিশ্বব্যাপী গম রপ্তানির ওপর সরকারি-বেসরকারি আমদানিকারকদের জন্য সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
তবে প্রজ্ঞাপনে দুটি ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগও রাখা হয়েছে। একটি হলো ১২ মের আগে খোলা যেসব ঋণপত্র (এলসি) বাতিলযোগ্য নয়, তার বিপরীতে গম রপ্তানি করা যাবে।
অর্থাৎ এখানে সরকারি-বেসরকারি দুভাবেই ১২ মের আগে চুক্তির বিপরীতে সম্পন্ন হওয়া এলসির বিপরীতে চাহিদাকৃত গম রপ্তানি করা যাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তৈরি হলে বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা নিতে পারবেন।
তবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে খোলা এলসির বিপরীতে গম রপ্তানির সুযোগ কোনো দেশের ক্ষেত্রেই বিবেচিত হবে না।
প্রজ্ঞাপনে রাখা অপর সুযোগটি হলো খাদ্য ঘাটতিতে থাকা দেশের সরকারের অনুরোধের বিপরীতে ভারত সরকার অনুমতি দিলে সে দেশে গম রপ্তানি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আবার প্রতিবেশী দেশকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের ভালো বোঝাপড়া রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে গম রপ্তানির অনুরোধ করা হলে বাংলাদেশের ডাকে ভারত সরকার সাড়া দেবে বলেই আশা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার বনাম সরকার (জিটুজি) পদ্ধতিতে ভারত থেকে গম আমদানির সুযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি বলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যে দাবি করেছেন সেটি মূলত ভারত সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনের দ্বিতীয় সুযোগটিকে ভিত্তি করে। একইভাবে ভারত বাংলাদেশকে গম দেবে- বাণিজ্যমন্ত্রীর এমন দাবির সারকথাও সেটিই।
ভারতের বাণিজ্য দপ্তরের সচিব বি ভি আর সুব্রহ্মণ্যমের বক্তব্যে বাংলাদেশের দুই মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সত্যতা মেলে। রোববার তিনি সাংবাদিকদের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও খাদ্যসংকটে থাকা দেশগুলোতে সরকারি পর্যায়ে গম রপ্তানির সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া আগের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার বেসরকারি সংস্থাগুলোকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৪৩ লাখ টন গম রপ্তানির অনুমতি দেবে।
এদিকে গমের বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি এবং রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাকে কিছুটা হুমকির মুখে ফেলছে।
যদিও ভারতের বাণিজ্য দপ্তর দাবি করেছে, গম রপ্তানির ওপর এ নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী নয় এবং যেকোনো সময় সিদ্ধান্তে বদল আসতে পারে।
ভারতের বর্তমান অবস্থান পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে জিটুজি পর্যায়ে অনুরোধ সাপেক্ষে আমদানির সুযোগ থাকলেও ভারত থেকে বেসরকারি পর্যায়ে দেশে গম আমদানি আপাতত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
দেশে বার্ষিক গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাদ দিলে বছরে ৬২ থেকে ৬৫ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। এর প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি হয়ে থাকে বেসরকারিভাবে। আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর গত তিন মাসে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির ৬৩ শতাংশই এসেছে ভারত থেকে। এর পরিমাণ ২৭ লাখ ১৫ হাজার টন। এ অবস্থায় ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বে শীর্ষ গম রপ্তানিকারক দেশ হলো রাশিয়া, ইউক্রেন, চীন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, বুলগেরিয়া ও ভারত। চীনে এ বছর গমের উৎপাদন ভালো হয়নি। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। ইউরোপে যুদ্ধের প্রভাব পড়ায় আমদানি অনিশ্চয়তা আছে কানাডার বাজার থেকেও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গম রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা।
এত সব ঘটনায় ইতোমধ্যে দেশে গম নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গমের অভ্যন্তরীণ মজুতও শক্তিশালী অবস্থানে নেই।
বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, গম রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা সাময়িক হলে দাম বৃদ্ধি ছাড়া বড় কোনো সমস্যা হবে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. আব্দুর রাজ্জাক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে একক কোনো দেশের ওপর নির্ভর করা কখনোই সুখকর হয় না। অতীতে বারবার তা প্রমাণ হয়েছে। সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব অল্টারনেটিভ সোর্স কান্ট্রি নির্ধারণ করা এবং সেসব বাজার থেকে গম আমদানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
‘একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতিতে অতিসত্বর আরও গম আমদানির চুক্তি করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ দুইয়ের ব্যত্যয় হলে এবং সেটি দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে স্বল্প মেয়াদে কোনো ঝুঁকি না থাকলেও দাম বৃদ্ধির প্রবণতা ভোক্তাকে বেশ ভোগাবে।’
অনুরূপ মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারত বেসরকারি খাতের জন্য রপ্তানি বন্ধ করলেও সেখানে সরকারিভাবে আমদানির সুযোগ এখনও রয়েছে। সরকারকে দ্রুত ভারত সরকারের সঙ্গে কথা বলে এই জিটুজি পর্যায়ের সুযোগটি নিতে হবে। এর মাধ্যমে বড় চালানের প্রয়োজনীয় গম আনতে পারে সরকার। পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও যাতে গম আমদানি করা যায় তার অনুরোধ করতে হবে। আর ভারতের বাইরে অন্য দেশগুলো থেকেও দ্রুত গম আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মনুশি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর সরকার আরও পাঁচটি দেশ থেকে গম আমদানির পথ খুঁজছে। ইতোমধ্যে কানাডার হাইকমিশনারের সঙ্গে গম আমদানির বিষয়ে কথা হয়েছে। বুলগেরিয়ার সঙ্গেও চুক্তি পর্যায়ে পৌঁছানো গেছে। আর ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও প্রতিবেশী হিসেবে তারা আমাদের গম দেবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানিয়েছেন, জিটুজিতে গম আনার বিষয়ে ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আমরা প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে কাজ করছি। এ ছাড়া বেসরকারি খাত যদি গম আমদানির ব্যাপারে সহায়তা চায়, আমরা অবশ্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেই সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করব।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য