স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সফলতা ও গর্বের অন্যতম নিদর্শন ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্প খাত। সরকারের সময়োপযোগী নীতিসহায়তায় এ খাতের সুনাম ও অবদান দেশ থেকে ছড়িয়েছে বিশ্বেও।
কম্প্রেসর ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে বাংলাদেশ অনন্য মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। তাই করোনা-পরবর্তী ক্ষতি কাটিয়ে দেশীয় ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্যের বিকাশে বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বাড়ানোর পক্ষে অভিমত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা, অর্থনীতিবিদ এবং উদ্যোক্তা সংগঠনের নেতারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত এক যুগে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তি শিল্প খাতের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। যার মূলে রয়েছে বর্তমান সরকারের নেয়া শিল্পবান্ধব বিভিন্ন নীতিমালা, শতভাগ বিদ্যুতায়ন এবং এ খাতের উদ্যোক্তাদের দেয়া বিভিন্ন সুবিধা। সরকারের এসব শিল্পমুখী নীতি এবং উন্নয়নের ফলে দেশের ইলেকট্রনিকস খাতে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। আগে এ খাত ছিল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। তখন রেফ্রিজারেটরের বার্ষিক চাহিদা ছিল মাত্র ৩ লাখ ইউনিট। আর এ খাতে কর্মসংস্থান ছিল শ পাঁচেক মানুষের। এক যুগের ব্যবধানে সে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। দেশের ইলেকট্রনিকস খাতে বর্তমানে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। ৩ লাখের জায়গায় রেফ্রিজারেটরের বার্ষিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে ৩০ লক্ষাধিক। এ খাতকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতিরও বিকাশ ঘটেছে। যা সম্ভব হয়েছে এ খাতে স্থানীয় শিল্পের বিকাশের ফলে।
দেশীয় ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য খাতের বিকাশের ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্যের আমদানি ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। এ শিল্প হয়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। তৈরি পোশাকের পর এ খাতটিকে রপ্তানি আয়ের ভবিষ্যৎ বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
যার মধ্যে অন্যতম কম্প্রেসর ও এর যন্ত্রাংশ, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি। বাংলাদেশে তৈরি এসব পণ্য বিশ্ববাজারে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। যা দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখছে। পাশাপাশি শিল্পোন্নত বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্টরা এ খাতে সব ধরনের সুবিধা দেয়ার পক্ষে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, দেশীয় উৎপাদিত পণ্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা আরও অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। দেশে যেসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোকে উৎসাহ দেয়া দরকার। এর ফলে দেশে আমদানির ওপর চাপ কমবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মোশারফ হোসেন বলেন, ‘সরকার বিশ্বাস করে দেশীয় শিল্প বিকাশে সহায়তা দিলে এবং বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো হলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে, একই সঙ্গে দেশীয় শিল্প বিকশিত হবে। সুনির্দিষ্ট কোনো খাত নিয়ে এখনই অগ্রিম কিছু বলা হচ্ছে না, তবে এতটুকু বলতে পারি, আগামী বাজেটও দেশীয় শিল্প বিকাশে সহায়ক হতে যাচ্ছে।’
জানা গেছে, রপ্তানি টার্গেট করে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য খাতে ব্যাপক নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ইনভার্টার এবং ফিক্সড স্পিড কম্প্রেসর ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট, গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) মেধাসম্পদ (প্যাটেন্ট, ডিজাইন এবং সফটওয়্যার লাইসেন্স), ৫৭টি দেশে ট্রেডমার্কসহ ৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী তিনটি ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের যথা এসিসি, জানুসি ইলেকট্রোমেকানিকা (জেম) এবং ভার্ডিকটারের স্বত্ব পেয়েছে।
ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে রপ্তানির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি এ উদ্যোগ নিয়েছে। যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী পণ্য উৎপাদন, টেকসই লক্ষ্যমাত্রা উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
এ বিষয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশের শিল্প সহায়ক যেকোনো বিষয়েই সরকারের আগ্রহ রয়েছে। এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে আমি মনে করি।’
আর বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন জানিয়েছেন, দেশীয় শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা নীতিগত বা কোনো রকম সহায়তা চাইলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন তারা।
এদিকে করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। কিন্তু সরকারের গৃহীত সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি রয়েছে প্রবৃদ্ধির ধারায়। উন্নয়নের এ ধারা বজায় রাখতে দেশের ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তি খাতে নীতিসহায়তা বাড়ানোর দাবি করেছেন উদ্যোক্তা সংগঠনের নেতারা।
বাংলাদেশ রেফ্রিজারেটর ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআরএমইএ) মহাসচিব জাহিদুল আলম বলেন, ‘দেশের ইলেকট্রনিকস এবং প্রযুক্তি শিল্প খাত এ ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্যের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রাংশের দাম ব্যাপক বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্প খাতে।
‘ইতোমধ্যেই ভোক্তা পর্যায়ে এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন অবস্থায় স্থানীয় ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক সহায়তার প্রয়োজন। বর্তমানে সরকারের দেয়া সুবিধা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়ছে। তা না হলে এসব পণ্যের দাম আরও বাড়বে। যা ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসেছে। এর পুরো সুফল পেতে প্রয়োজন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার।’
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি বাংলাদেশে কান্ট্রি ইকনোমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট শিল্পবান্ধব এবং কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেট। এই বাজেটে চেষ্টা করা হয়েছে জীবন-জীবিকার মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে দেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনার। আগামী বাজেটেও বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা যায়। সে হিসেবে দেশীর শিল্পের ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা রয়েছে, সেগুলোও অব্যাহত থাকতে পারে। দেশীয় শিল্পসহায়ক সুবিধাগুলো আরও কয়েক বছর থাকা ভালো হবে।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য খাতে যে সুবিধা দিচ্ছে, এ খাতের উদ্যোক্তারা তার অনেক বেশি ফেরত দিচ্ছেন। এতে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিযোগ হচ্ছে, কর্মসংস্থান ও দেশীয় উৎপাদন বাড়ছে, আমদানি ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে, বিপরীতে বাড়ছে রপ্তানি আয়। যা রাজস্ব খাতে অবদান রাখছে। তাই এ খাতে বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত এবং তা বাড়ানোর এখনই উপযুক্ত সময়।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য