২০২১ সালের ৩ এপ্রিল। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে আলোড়ন তোলা ঘটনা।
স্ত্রী নন, এমন নারীসহ সেখানে আটক হয়েছেন হেফাজতে ইসলামের সে সময়ের ব্যাপক প্রভাবশালী নেতা মামুনুল হক। স্থানীয়দের জেরার মুখে যখন সঙ্গিনীকে স্ত্রী দাবি করার পর সত্যিকার স্ত্রীর সঙ্গে তৈরি হয় বিবাদ। সন্তানসহ ঘর ছাড়েন তিনি। এখনও ফিরেছেন কি না জানা যাচ্ছে না কোনোভাবে।
সেই রাতে অবরুদ্ধ মামুনুলকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে ধর্মভিত্তিক দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। মসজিদে মাইকিং করে জড়ো হয়ে চলে রিসোর্টে হামলা। প্রধান ফটক থেকে ভেতরের সাজানো গোছানো রিসোর্টটি তছনছ করে দেয় তারা।
এরপর মামুনুল সেখান থেকে ঢাকায় ফেরেন। কিন্তু সেই ঘটনাটি তার সে সময়ের প্রভাবশালী অবস্থানকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।
ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। হামলা হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, মহাসড়কে যানবাহনে।
এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর সেই রয়েল রিসোর্ট কেমন আছে?
রিসোর্টের ব্যবস্থাপক খাইরুল কবির লাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে মেরামত কাজে। এর পুরোটাই তো লোকসান।
‘করোনার কারণে এই সময়ে ব্যবসায় এমনিতেই মন্দা। তার ওপর এত টাকার ধকল। সব মিলিয়ে ভালো থাকার তো সুযোগ নেই।’
এই হামলার ঘটনায় রয়েল রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ কোনো মামলা করেনি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর ও উপজেলা যুবলীগ রফিকুল ইসলাম নান্নু তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা করেন৷
খাইরুল কবির বলেন, ‘আমাদের এই রিসোর্টে দেশীয় গেস্টের চেয়ে বিদেশি গেস্ট বেশি আসে। আর আসে কাপল। তবে মামুনুল হক কাণ্ডের পর আগের মতো আর কাপল আসে না। মাঝেমধ্যে কিছু গেস্ট আসে। ওই ঘটনায় শুধু রিসোর্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ব্যবসারও লোকসান হয়েছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে, আগের অবস্থানে ফিরে যেতে।’
রিসোর্টের মতোই ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির কথা বলছেন সেই রাতের বেপরোয়া হামলার ভুক্তভোগীরা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘আমাদের আওয়ামী লীগের অফিসে ভাঙচুর করে অনেক ক্ষয়ক্ষতি করা হয়। পরে আমরা নিজ উদ্যোগে সেগুলো মেরামত করেছি।’
যুবলীগের সোনারগাঁ কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু বলেন, ‘মামুনুলের ঘটনায় হেফাজত নেতা-কর্মীদের হামলা, ভাঙচুরে আমার প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা আর পূরণ হয়নি।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেসব যানবাহন পুড়িয়েছে তার ক্ষতিপূরণ পাননি যানবাহনের মালিকরা।
পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম জানান, যতদিন পর্যন্ত মামলা শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে বলা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘সবকিছু নির্ভর করছে আদালতের ওপর।’
সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি হাফিজুর রহমান জানান, এসব ঘটনায় মোট সাতটি মামলা হয়েছে। সব কটি মামলা তদন্তাধীন।
বিচার কতদূর
ঘটনার প্রায় এক মাস পর ৩০ এপ্রিল সোনারগাঁ থানায় মামুনুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন তার রিসোর্ট সঙ্গিনী জান্নাত আরা ঝর্ণা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম গত ১০ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ৩ নভেম্বর মামুনুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত।
২৪ নভেম্বর আদালতে জবানবন্দি দেন ঝর্ণা। আদালতে বলেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে রয়েল রিসোর্ট ছাড়াও আরও বিভিন্ন স্থানে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করেছে মামুনুল।
এর পর থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
১৩ ডিসেম্বর মামুনুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন রয়েল রিসোর্টের সুপারভাইজার আব্দুল আজিজ, রিসিপশন অফিসার নাজমুল ইসলাম অনিক ও নিরাপত্তা প্রহরী রতন বড়াল।
২৫ জানুয়ারি সাক্ষ্য দিয়েছেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু, রয়েল রিসোর্টের এক্সিকিউটিভ মাহাবুবুর রহমান ও নিরাপত্তা প্রহরী ইসমাইল হোসেন।
মামলার আরও সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আসবেন পর্যায়ক্রমে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রকিবুদ্দিন আহমেদ জানান, ধর্ষণ মামলায় মামুনুলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তিনজনই সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তবে মামুনুল হকের আইনজীবী ওমর ফারুকের দাবি, তার মক্কেলকে ফাঁসাতে সাক্ষীরা আদালতে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরছেন।
যুবলীগ নেতা নান্নুর বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে এখনও প্রতিবেদন দেয়া যায়নি।
আদালতে এলেই হম্বিতম্বি
ধর্ষণ মামলায় মামুনুল হককে যতবার আদালতে আনা হয়েছে, ততবার তিনি কোনো না কোনো ঘটনা ঘটিয়েছেন। পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত হওয়া, মামলার বাদীর সঙ্গে উচ্চবাচ্য করাও বাদ যায়নি।
মামুনুল যতবার হাজির হয়েছেন ততবার তার অনুসারীরা আদালত চত্বরে হট্টগোল করেছেন।
শুরুর দিকে মামুনুলকে অন্যান্য আসামির মতো আদালতে হাজির করা হলেও তার এসব কর্মকাণ্ডে পুলিশের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে জানিয়েছেন আদালত পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামুনুল হককে যখন শুনানিতে আনা হয়, সে তারিখে আদালতের প্রবেশ ফটকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পাশাপাশি বহিরাগতের প্রবেশের সময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে থাকে। কারণ বিগত সময় নানা ঘটনা ঘটেছে।’
হরতালের সহিংসতা
রিসোর্টকাণ্ডের আগে ২৮ মার্চ হেফাজতের হরতালেও ব্যাপক সহিংসতা হয়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারতের সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে ওই বছরের ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে হেফাজতকর্মীদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়।
ওই সংঘর্ষের জেরে সহিংসতা হয় নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জসহ আরও কয়েক জেলায়।
চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তিতে হামলা ঠেকাতে পুলিশের গুলিতে প্রাণহানির প্রতিবাদে ২৮ মার্চ হরতাল ডাকে হেফাজত।
সেদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড মোড় থেকে শিমরাইল মোড় পর্যন্ত টায়ার ও গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় সংগঠনের নেতা-কর্মী ও তাদের সমর্থকরা। ভাঙচুর করে ৫০টির বেশি যানবাহন। আগুন দেয়া হয় ১১টিতে। বাদ যায়নি অ্যাম্বুলেন্স ও রোগী বহনকারী গাড়িও।
এসব ঘটনায় র্যাব ও পুলিশ ছয়টি মামলা করেছে। এসব মামলার তদন্ত শেষ করে এখনও বিচারের পর্যায়ে যায়নি।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সহিংসতায় মামুনুল হকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
হরতালে নাশকতা, পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা, যানবাহন ভাঙচুর ও আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ছয়টি মামলা হয়।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, ওই ঘটনায় পুলিশ মামলা করে তিনটি। দুটি মামলা করেন ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের মালিকরা। র্যাব করে একটি।
এর মধ্যে দুটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি ও পিবিআই। বাকি মামলাগুলো থানা-পুলিশ দেখছে। সব কটি মামলার তদন্ত চলমান।
গত বছরের ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে মামুনুলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগ। তাকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের সহিংসতা ছাড়াও ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে তাণ্ডবের আটকে থাকা মামলাও নতুন করে সচল হয়।
আরও পড়ুন:পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ঝালকাঠিতে আনন্দ র্যালি হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের আয়োজনে শনিবার সকাল ৯টায় কার্যালয়ের সামন থেকে র্যালিটি বের হয়। বিভিন্ন ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে হয় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে গিয়ে।
জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলীসহ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ র্যালিতে লোক অংশ নেন। এসময় নাচে-গানে আনন্দে মেতে উঠেন তারা।
জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আজ। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ খুব উচ্ছ্বসিত। ঝালকাঠিতে আনন্দের বন্যা বইছে।’
কিছুক্ষণ পরই মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় উদ্বোধন করা হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। এ সেতুর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় কুমিল্লার তেমন সম্পর্ক না থাকলেও উদ্বোধন উপলক্ষে জেলাবাসীর উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো।
শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে শুরু হয়ে নগরীর প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে টাউনহলে এসে মিলিত হয়। আনন্দ শোভাযাত্রায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ গ্রহণ করে।
শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ, জেলা পরিষদের প্রশাসক রিয়ার এডমিরাল অবসরপ্রাপ্ত আবু তাহের, বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হাসান পাখি, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী সফিকুর রহমান।
আরও উপস্থিত ছিলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. আবু খান, কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জামাল নাছের, র্যাব ১১ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন, নেত্রী পাপড়ি বসুসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের উধর্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।
এ দিকে সকাল ১০টার দিকে নগরীর টাউনহলে দেখা যায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মূল অনুষ্ঠান বড় পর্দায় দেখতে হাজার খানেক মানুষ ভীড় করেছেন।
নিজের রিকশা থামিয়ে টাউনহলের বাইরে থেকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেখতে আসা জমির হোসেন জানান তার বাড়ি পিরোজপুর।
জমির বলেন, ‘আমাদের মনে আনন্দের বন্যারে ভাই। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে আমাদের কেমন মনে হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না। এখন আর ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। সেতুর উপর দিয়া দ্রুত চলে যাবো বাড়ি।’
জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, ‘পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আমাদের আরেক বিজয়। সবাই হয়তো অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে উদ্বোধন দেখতে পারবেন না, তাই কুমিল্লাবাসীর জন্য জেলা প্রশাসনের আয়োজনে নগরীর টাউনহলে উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা করেছি।
‘আয়োজনে সব শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণে বলা যায় আজ কুমিল্লার জন্যও আনন্দের দিন।’
আরও পড়ুন:পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সুধী সমাবেশে যোগ দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। হুইলচেয়ারে করে তিনি সুধী সমাবেশে আসেন।
শনিবার সকাল ৮টার দিকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সমাবেশস্থলে ডা. জাফরুল্লাহকে দেখা যায়। এ সময় তার পরনে ছিল সাদা-কালো রঙের শার্ট ও খাকি লুঙ্গি।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সকাল ১০টায় মাওয়া প্রান্তে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার পর মাওয়ার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। সকাল ১০টার দিকে তিনি মাওয়া প্রান্তে পৌঁছান।
প্রধানমন্ত্রী মাওয়ায় যোগ দেন সুধী সমাবেশে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সাড়ে তিন হাজার নাগরিককে আমন্ত্রণ জানানো হয় এই সমাবেশে। ভোর সাড়ে ৬টা থেকে শুরু হয় অতিথিদের আগমন।
ফুরিয়ে এলো ক্ষণগণনার পালা। আর অল্প সময়ের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উচ্ছ্বাসে মুখর গোটা মাওয়া প্রান্ত। অপেক্ষার অবসান হলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আগমনের মধ্য দিয়ে।
দুর্নীতিচেষ্টার মিথ্যে অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর নিজস্ব অর্থায়নের এই সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তার নেতৃত্বেই নির্মিত হয়েছে সেতুটি। আজ তার হাত ধরেই খুলে যাবে সেতুটি।
এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল সরাসরি যুক্ত হচ্ছে রাজধানীর সঙ্গে।
সুধী সমাবেশ শেষে বেলা ১১টার দিকে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর অবমুক্ত করবেন সরকারপ্রধান। পদ্মা সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেয়ার কথাও রয়েছে তার।
বেলা ১১টা ১২ মিনিটে টোল দিয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ১১টা ২৩ মিনিটের দিকে পদ্মা সেতু পাড়ি দেবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ওই সময় কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থেকে নেমে সেতুতে পায়চারি করতে পারেন তিনি।
বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পৌঁছেই পদ্মা সেতুর আরেকটি উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর কাঁঠালবাড়ীর ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাটে আওয়ামী লীগের জনসভায় দলপ্রধান হিসেবে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন:খুলনা থেকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস উদ্দিন। বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই।
শনিবার সকাল ৮টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি সারা রাত ঘুমাতে পারে নাই। কখন আসব, আর মুক্তির গান শুনব।’
আর কিছু মুহূর্ত। এরপরই বর্ণিল আয়োজনে উন্মোচিত হবে দেশের সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতুর।
এই দিনটি বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তির দিন। আর এমন দিনে না আসলে আক্ষেপ থেকে যেত আজীবন। তাই এখানে আসতে পেরে উচ্ছ্বসিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। যে উচ্ছ্বাস তার কাছে ঈদের আনন্দের চেয়েও কম নয়।
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এই বিজয় ঈদের আনন্দের চেয়ে কম নয়। সারা জীবন ঘাটে এসে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তির দিন আজ। এমন দিনে আসনে না পারলে মনে দুঃখ থেকে যেত। এখন মনে হয় পরিপূর্ণতা পেয়েছে। আর কয় দিনই বাঁচব। যে কয় দিন আসি, সেই কয় দিন শান্তিতে পার হতে পারব।’
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু ঘোষণার দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে আসব। শুক্রবারই আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরিবারের লোকজন আসতে দেয় নাই। পরে রাত ৩টার দিকে গাড়িতে করে রওনা দেই। সকাল ৭টায় শিবচর উপজেলার পাচ্চর নামিয়ে দেয়। পরে প্রায় ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সভামঞ্চের কাছে এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন শান্তি পাচ্ছি। প্রশাসনের ভাইরা খুব সহযোগিতা করছে, না হলে মঞ্চের কাছে আসতে পারতাম না।’
আরও পড়ুন:‘আমাগো আর গাঙ্গে ডুইববা মরতে অইবো না। লঞ্চ ডুইবা আমি পোলারে হারাইছি। এই দিনে পোলাডারে মনে পারতাছে। আর কয় বছর আগে সেতুডা হইলে পোলাডা হয়ত জীবিত থাকত। আইজ এই দিনে আমি ঘরে বিয়া থাকতে পারি? বয়স ওইছে তো কী হইছে। আমিও যাইতাছি প্রধানমন্ত্রীরে ধন্যবাদ দিতে।’
কথাগুলো বলছিলেন ৬৫ ঊর্ধ্ব আমজাদ হোসেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যে কোনো মূল্য সামিল হতে চান তিনি। তাই তো পথের ক্লান্তি আর বয়সের ভার তোয়াক্কা না করে তিনি যোগ দিয়েছেন বিজয় মিছিলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিতে।
শুধু আমজাদ হোসেন নন, বিজয় মিছিলে সমাবেত হয়েছেন শত শত মানুষ। জেলা শহর থেকে মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে তারা ছুটছেন সমাবেশস্থল কাঁঠালবাড়ির পানে। আর যারা যানবাহন পাননি তারাও বসে নেই। হেঁটে ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে রওনা করেছেন অনেকে।
তাদেরই একজন রেজা শামিম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার বিজয় দেখিনি কিন্তু পদ্মা বিজয়ের উৎসব দেখছি। আমাদের জন্মান্তরের ভোগান্তি লাঘব হবে। পদ্মা সেতু উপহার দেয়ায় সড়কের ভোগান্তির তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছি।’
জাজিরা টিঅ্যান্ডটি মোড় থেকে কাঁঠালবাড়ি পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়েছে। সমাবেশে যোগ দিতে শহর থেকে ৩ হাজার মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। উৎসবে যোগ দিতে লঞ্চ ও ট্রলারে করে আসছেন ভেদেরগঞ্জ নড়িয়া, সখিপুর ও চরাঞ্চলের মানুষ।
শহর থেকে কাঁঠালবাড়ি পর্যন্ত ছেয়ে গেছে পদ্মা সেতু, প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত ব্যানার ফেস্টুনে। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পদ্মা বিজয়ের উৎসব পালন করছি আমরা। ৩ লাখ মানুষ সড়ক ও নৌপথে শেখ হাসিনার জনসভায় যোগ দিতে জেলা থেকে কাঁঠালবাড়ি এসেছে।’
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে বর্ণিল সাজে সেজেছে শরীয়তপুর শহর। শহরের প্রতিটি সড়কে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। বাদ পড়েনি সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনাও। জেলাব্যাপী শুরু হয়েছে ৩ দিনের বিজয় উৎসব।
আরও পড়ুন:পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার সকাল ৯টার দিকে মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়।
জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে শোভাযাত্রায় সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।
শোভাযাত্রায় জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ গোলাম আজাদ খান, সিভিল সার্জন মোয়াজ্জেম আলী খান চৌধুরী, র্যাব-৪-এর লেফটেন্যান্ট কোম্পানি কমান্ডার মো. আরিফ হোসেন, পৌর মেয়র মো. রমজান আলী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম মহিউদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালামসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের গর্ব। কারণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু আমরা নির্মাণ করতে পেরেছি। বিশ্বকে আমরা আমাদের সক্ষমতার কথা জানিয়ে দিলাম। আমরা পিছিয়ে নেই, আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি।’
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পারছেন না মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন।
শুক্রবার বিকেল ৬টায় আব্দুল মোমেনের করোনা পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসে।
সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যারা অংশ নেবেন তাদের সবার করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনুষ্ঠানের ৪৮ ঘণ্টা আগে নমুনা পাঠান এসপি।
এসপি মোমেন বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬টার দিকে জানতে পারি আমার করোনা পজিটিভ। তাই হোম আইসোলেশনে আছি। তবে যেহেতু জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্বে আছি, তাই ঘরে থেকেও কাজ করছি।
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। এই অনুষ্ঠানে থাকতে পারলে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি পেতাম।’
মন্তব্য