রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের তৃতীয় মাস মার্চে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৭৬ কোটি ২২ লাখ (৪.৭৬ বিলিয়ন) ডলার বিদেশি মুদ্রা এনেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
বর্তমান বিনিময় হার (৮৬ টাকা ২০ পয়সা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
গত বছরের মার্চের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এই মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছে ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
আর অর্থবছরের হিসাবে ৯ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে ৩৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের প্রায় সমান।
যুদ্ধের মাসেও রপ্তানি আয়ে এই বড় উল্লম্ফনে খুবই খুশি রপ্তানিকারকরা। অর্থবছরের বাকি তিন মাসেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন তারা। আর তাতে অর্থবছর শেষে এবার রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে রপ্তানি বাণিজ্যে ইতিহাস সৃষ্টি করবে বাংলাদেশ।
একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ মাসের এই আয় তৃতীয় সর্বোচ্চ; সবচেয়ে বেশি এসেছিল গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি ৭৭ লাখ (৪.৯০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৪৮৫ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার (৪.৮৫ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল ৪২৯ কোটি ৪৫ লাখ (৪.২৯ বিলিয়ন) ডলার।
এই মাসে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত বছরের মার্চ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩০৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। ।
শুধু তৈরি পোশাক নয়, প্রায় সব খাতেই রপ্তানি আয় বেড়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে ৩৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন (৩ হাজার ৮৬০ কোটি ৫৬ লাখ) ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এই আয় গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) প্রায় সমান।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি আয় দেশে এসেছে।
রপ্তানি আয় প্রায় প্রতি বছরই বাড়ে। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারে কমই। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। করোনার মধ্যেও দারুণ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি যতটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে আয় করছে বাংলাদেশ।
৯ মাসের রপ্তানি আয় এবার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। তার আগে থেকেই অবশ্য যুদ্ধের ডামাডোল চলছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের কয়েকটা দিন গেছে যুদ্ধের মধ্যে। মার্চ মাসের পুরোটা সময় ছিল যুদ্ধের উত্তেজনা। রাশিয়াসহ অন্য দেশগুলোতেও পণ্য পাঠানো ব্যাহত হয়। যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বেশ আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। তারপরও এই মাসে রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সোমবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, জুলাই-মার্চ সময়ে তৈরি পোশাক ছাড়াও কৃষি প্রক্রিয়াজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য ও হস্তশিল্প রপ্তানি বেড়েছে। ফলে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে ৭ শতাংশ।
পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৪ শতাংশ
ইপিবির তথ্যে বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৩ হাজার ১৪২ কোটি ৮৪ লাখ (৩১.৪৩ বিলিয়ন) ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এই সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৮১ দশমিক ৪৬ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১ হাজার ৭১২ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ১৭ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১ হাজার ৪৩০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। আয় বেড়েছে ৩২ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেড়েছে ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
অন্যান্য খাত
এ ছাড়া জুলাই-মার্চ সময়ে ৯৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য, ১১৫ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল, ৮৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ৮৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
হিমায়িত মাছ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪৩ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। ওষুধ রপ্তানি থেকে এসেছে ১৪ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি আয়ের মোট লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম।
আগামী কয়েক বছর এমন উল্লম্ফন থাকবে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। করোনার আতঙ্ক চলে গেছে। বড় ধরনের আর কোনো সঙ্কট না দেখা দিলে আগামী কয়েক বছর রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফন অব্যাহত থাকবে বলে আশা কথা শুনিয়েছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান তৈরি পোশাক শিল্পমালিকরা।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন,‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আমরা বেশ আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। আমাদের পোশাকের একটি সম্ভাবনাময় এবং উদীয়মান বাজার রাশিয়ার উপর বেশ কয়েকটি দেশ ব্যাপক পরিধিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বিশেষ করে সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর অ্যাক্সেস বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের বাণিজ্যে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তারপরও আমরা ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। এ সমস্যাটা না থাকলে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ত।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। দামও ভালো পাচ্ছি। করোনা চলে গেছে। যুদ্ধও স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে। এখন আর আমাদের কোনো ভয় নেই। আর যদি কোনো সঙ্কট না আসে তাহলে আগামী কয়েক বছর আমাদের রপ্তানি আরও বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছি।’
নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা খুশি। এত দ্রুত করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে আমরা ঘুরে দাঁড়াব, ভাবতে পারিনি। করোনার ভয় এখন আর নেই। শঙ্কিত ছিলাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। সেটাও কেটে গেছে। সবমিলিয়ে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বর্তমান ইতিবাচক ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা নতুন বছর শুরু করেছিলাম। সেটা অব্যাহত আছে। প্রচুর অর্ডার আছে; নতুন অর্ডার আসছে। দামও ভালো পাচ্ছি। ২০২২ সালটা উল্লম্ফনের মধ্য দিয়েই যাবে বলে আমরা আশা করছি।’
অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে এখন রপ্তানি খাত। সত্যিই অবাক করার মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে এই খাতে। এই যে করোনার ধকল সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে রপ্তানি আয়।’
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে মোট ৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
আরও পড়ুন:জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থার কারণে দেশের ব্যবসায় দৈনিক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা। দ্রুত সংকট সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপও দাবি করেছেন তারা।
২৮ জুন রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রপ্তানিমুখী বিভিন্ন শিল্পখাতের নেতারা জানান, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলম বিরতি কর্মসূচি গত ১৪ মে থেকে শুরু হলেও আজ থেকে তা পূর্ণাঙ্গ অচলাবস্থায় রূপ নিয়েছে, যা আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
সংবাদ সম্মেলনে আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, শিল্প মালিকদের সংগঠন বিএসআইসির সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পেয়ারভেজ), বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু, বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মনজুর এবং ডিএসসিসিআই সভাপতি তাসকিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান অপসারণের বিরোধীতা করে নেতারা বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান অপসারণের দাবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অচলাবস্থা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব। তবে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কেউ শ্রমিক ইউনিয়নের মতো আন্দোলনে নামতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন তারা।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তারা স্পষ্ট করেছেন, কোনো অবস্থাতেই আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো যাবে না।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এনবিআরের কলম বিরতি কর্মসূচির কারণে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা সংকট নিরসনে সরকারের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়ে বলেন, দেশের অর্থনীতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সচল রাখতে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে এই অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে হবে।
তারা বলেন, ‘আমাদের তৈরি পোশাক, চামড়া, জুতা, সিরামিকস, ওষুধ, কৃষিপণ্য এবং প্লাস্টিক খাত এখন শীতকালীন মৌসুমের কার্যাদেশ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। অথচ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ও কাস্টমস হাউজে অচলাবস্থার কারণে সময়মতো রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
নেতারা জানান, অনেক ক্রেতা কার্যাদেশ বাতিলের হুমকি দিচ্ছেন এবং নতুন কার্যাদেশ দিতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে এবং প্রতিবেশী দেশের কাছে বাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতারা এনবিআরের আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
আলোচনায় অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তারা।
একই সঙ্গে তারা আন্দোলনরত এনবিআর কর্মীদের ভবিষ্যৎ ন্যায্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান, যেন জাতীয় অর্থনীতিতে আর কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়।
নেতারা বলেন, বন্দরে পণ্য আটকে থাকায় ডিমারেজ বা জরিমানার পরিমাণ চার গুণ বেড়েছে, যা ব্যবসায়িক খরচকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
নেতারা হুঁশিয়ারি দেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজার বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। অর্ডার প্রতিবেশী দেশে চলে গেলে জাতীয় অর্থনীতির জন্য তা অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পণ্য ছাড় করতে বিলম্ব হওয়ায় বন্দরে ডিমারেজ বা অতিরিক্ত জরিমানার পরিমাণ চার গুণ বেড়েছে। এতে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি—
১. এনবিআরের আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক করা।
২. বিতর্কিত অধ্যাদেশ আলোচনার মাধ্যমে পর্যালোচনা করা— যাতে আন্তর্জাতিক মান ও দেশের বাস্তবতা সমন্বয় হয়।
৩. ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দপ্তরের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়ানো।
৪. এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সময়সীমাবদ্ধ সংস্কার কর্মসূচি চালু করা।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকারী অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরুর ৩ বছরপূর্তি ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার। ২০২২ সালের ২৬ জুনের এই দিনে বহু প্রতিক্ষিত পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। এরপর এক মুহুর্তের জন্য সেতুতে যান চলাচল বন্ধ হয়নি। আর এই তিন বছরে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৯২টি যান পারাপারে টোল আদায় হয়েছে ২ হাজার ৫ শ’ ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৬২ হাজার ৮শ’ টাকা।
পদ্মা সেতু দক্ষিণের মানুষের বিড়ম্বনা লাঘব করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এখন। উত্তাল নদী পারপারের ভোগান্তি থেকে শুধু মুক্তিই দেয়নি এই সেতু পাল্টে দিয়েছে দক্ষিণের আর্থ সামাজিক অবস্থাও। উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত, শিল্প কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যেও যুগান্তকারী পরিবর্তন। খুলে গেছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।
সেতুর উপর তলায় সড়ক পথ ও আর নিচ দিয়ে ছুটছে ট্রেন। রাতদিন দ্রত বেগে পদ্মার উপর দিয়ে চলছে ট্রেন ও সড়ক পথের যাত্রা। পদ্মা সেতুর ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন হলেও পরদিন ২৬ জুন এই দিনে পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হয়। পরের বছর ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতুর রেলপথ উদ্বোধন হয়। পদ্মা সেতু হয়ে চালু হয় ঢাকা-ভাঙ্গা নতুন রেল নেটওয়ার্ক। আর ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর রেল লিঙ্ক প্রকল্প পুরোপুরি চালু হয়। এদিন রাজধানী থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ভাঙ্গা হয়ে নতুন পথে নড়াইল ও যশোর অতিক্রম করে খুলনা পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। রাজধানী থেকে মাত্র সাড়ে ৩ ঘন্টায় খুলনা ও বেনাপোল পৌছানো যাচ্ছে। তাই এখন দক্ষিণের মানুষ সড়ক ও ট্রেন পথের সুফল পাচ্ছে।
এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা খুঁটি ব্যবহার করে। সেতু উপর দিয়ে যাওয়া উচ্চ ক্ষমতার ইন্টারনেট লাইন ব্যবহার হচ্ছে। সেতুতে নির্মাণ করে রাখা গ্যাস লাইন ব্যবহারে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে দক্ষিণের জনপদ, এখন অপেক্ষা এখন। তাই খুশি সবাই।
পদ্মা সেতুর দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়াদ বলেন, কোন হেসেল ছাড়াই টানা দিন বছর সেতুতে নিরবিচ্ছিন্নভাবর যান পারাপার করা হয়। এটি একটি বড় মাইলফলক। পদ্মা সেতুর দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) যুগ্ম সচিব আলতাফ হোসেন সেখ বলেন, দেশের এই অবকাঠামো যেমন মানুষের উপকারে লাগছে, আবার রাজস্ব আয়ও হচ্ছে। সেতু ব্যবহারে টোল আদায় আরও সহজ করা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই চলন্ত অবস্থায়ই টোল পরিশোধ করা যাবে।
স্বপ্নের সেতু চালুর তিন বছরে পারাপার হয়েছে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৯২টি। এর মধ্যে মাওয়া দিয়ে প্রবেশ করে ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ১১২টি যান। আর ৯৮ লাখ ৫৮০টি যান জাজিরা প্রান্ত দিয়ে পদ্মা সেতুতে প্রবেশ করে। মাওয়া থেকে ১ লাখ ২৯ হাজার ৪শ’৬৮ বেশি যান জাজিরা প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে।
গত ৫ জুন পদ্মা সেতুতে এক দিনে রেকর্ড পরিমান ৫ কোটি ৪৩ লাখ ২৮ হাজার টাকার টোল আদায় হয়েছে। এই ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫২ হাজার ৪৮৭টি যানবাহন পারাপার হয়। পদ্মা সেতুতে একদিনে সর্বোচ্চ টোল আদায় ও যানবাহন পারাপারের নতুন রেকর্ড এটি। এর আগে ২০২২ সালের ২৬ জুন পদ্মা সেতুর যান চলাচলের শুরুর দিনে সর্বোচ্চ ৫১ হাজর ৩১৬টি যানবাহন পারাপারের রেকর্ড ছিল। আর ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল ইদুল ফতরের আগে সর্বোচ্চ টোল আদায়ের রেকর্ড ছিল ৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭শ' টাকা।
নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়াদ বলেন, সেতু চালুর প্রথম বছর ৫৬ লাখ ৯৪ হাজার ৮৯৯টি যানবাহন পারাপারে টোল আদায় হয়েছে ৭৯৮ কোটি ৬০ লাখ ৯৩ হাজার ৭শ’ টাকা। দ্বিতীয় বছর ৬৮ লাখ ১ হাজার ৩৭৪টি যানের বিপরীতে টোল পাওয়া যায় ৮৫০ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩শ’ ৫০ টাকা। আর তৃতীয় বছর ২৫ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার ২২৯টি যান পারাপারে টোল আদায় হয় ৮৬১ কোটি ২২ লাখ ১৮ হাজার ৮৫৯ টাকা। মূল পদ্মা সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ। তবে অ্যাপ্রোচসহ প্রায় ১০ কিলোমিটার। সেতু নিরাপত্তাসহ ট্রাফিক আইন মেনে পদ্মা সেতুতে যানাবাহানের নির্বিঘ্ন চলাচলে সেতু এবং দুই প্রান্তের সড়ক জুড়ে অত্যাধুনিক ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। সেতুতে যানবাহানের গতিও বৃদ্ধি করে দুই পারের এক্সপ্রেসওয়ের মতই ঘন্টায় সর্বোচ্চ গতি করা হয়েছে ৮০ কিলোমিটার।
পুঁজিবাজারে চতুর্থ কার্যদিবসে ঢাকা-চট্টগ্রামের বাজারে সবকটি সূচকের উত্থান হয়েছে, বেড়েছে লেনদেন এবং বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম।
সারাদিনের লেনদেনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৪৯ পয়েন্ট। বাকি দুই সূচক শরিয়াভিত্তিক ডিএসইএস ১৫ এবং বাছাইকৃত কোম্পানির ব্লু-চিপ সূচক ডিএস-৩০ বেড়েছে ১৮ পয়েন্ট।
লেনদেনে অংশ নেওয়া ৪০০ কোম্পানির মধ্যে ২৯৫ কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে দর কমেছে ৪৬ কোম্পানির এবং অপরিবর্তিত আছে ৫৯ কোম্পানির শেয়ারের দাম।
এ, বি এবং জেড- তিন ক্যাটাগরিতেই দাম বেড়েছে বেশিরভাগ কোম্পানির। বিশেষ করে লভ্যাংশ দেওয়া ভালো কোম্পানির এ ক্যাটাগরির ২২০ কোম্পানির মধ্যে ১৫৯ কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে দর কমেছে ২৫ এবং অপরিবর্তিত আছে ৩৬ কোম্পানির শেয়ারের দাম।
ডিএসই ব্লক মার্কেটে ২৭ কোম্পানির ২৬ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি হয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৫ কোটি ১০ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে।
সারাদিনে ডিএসইতে ৪১৩ কোটি টাকার শেয়ার এবং ইউনিট লেনদেন হয়েছে, যা গতদিন ছিল ৩৭২ কোটি টাকা।
১০ শতাংশ দাম বেড়ে ডিএসইতে শীর্ষে ইন্দো বাংলা ফার্মাসিটিক্যালস এবং ৫ শতাংশ দাম কমে তলানিতে ভ্যানগার্ড এএমএল রুপালি ব্যাংক ব্যালেন্স ফান্ড।
এদিন লেনদেনের শীর্ষে থাকা ১০ প্রতিষ্ঠান হলো- লাভেলো আইসক্রিম, স্কয়ার ফার্মা, ব্রাক ব্যাংক, সী পার্ল, বিচ হ্যাচারি, ইন্দো বাংলা ফার্মা, বিএটিবিসি, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, ফাইন ফুডস ও মিডল্যান্ড ব্যাংক।
চট্টগ্রামেও উত্থান
ঢাকার মতো চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচকের উত্থান হয়েছে, সার্বিক সূচক বেড়েছে ২৫ পয়েন্ট।
লেনদেন হওয়া ২৩৩ কোম্পানির মধ্যে ১২১ কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে দর কমেছে ৭৯ কোম্পানির এবং অপরিবর্তিত আছে ৩৩ কোম্পানির শেয়ারের দাম।
সিএসইতে মোট ৪৩ কোটি টাকার শেয়ার এবং ইউনিট লেনদেন হয়েছে, যা গত কার্যদিবসে ছিল ২৯ কোটি টাকা।
১০ শতাংশ দাম বেড়ে সিএসইতে শীর্ষে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রি এবং ৯ শতাংশের ওপর দর হারিয়ে তলানিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস।
দেশের বাজারে ১৪ জুন স্বর্ণের দাম প্রতি ভরিতে বেড়েছিল ২ হাজার ১৯২ টাকা। তবে আবার দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এ দফায় ভরিতে সর্বোচ্চ দাম কমেছে ১ হাজার ৬৬৮ টাকা। তাতে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম কমে দাঁড়াবে ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৬০ টাকা। নতুন এই দাম গতকাল বুধবার থেকে কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) গত মঙ্গলবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বর্ণের দাম কমানোর কথা জানায়। বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে বিশুদ্ধ সোনার (পিওর গোল্ড) মূল্য হ্রাস পাওয়ায় নতুন করে দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
এর আগে সর্বশেষ ১৪ জুন দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছিল। তাতে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম বেড়ে হয়েছিল ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৮ টাকা। গতকাল বুধবার রাত পর্যন্ত এ দামেই স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে। এছাড়া গত ২৩ এপ্রিল দেশে স্বর্ণের দাম ভরিতে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৪২ টাকা বেড়েছিল। তখন ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বেড়ে হয়েছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮৮ টাকা। দেশের বাজারে সেটিই ছিল এখন পর্যন্ত স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম।
বাজুসের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে গতকাল বুধবার থেকে দেশের বাজারে হলমার্ক করা প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ২২ ক্যারেট মানের স্বর্ণ ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৬০ টাকা, ২১ ক্যারেট ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৯৯ টাকা এবং ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ৪১ হাজার ৪২৬ টাকায় বিক্রি হয় এছাড়া সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ২ টাকা।
দেশের বাজারে গত মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত প্রতি ভরি হলমার্ক করা ২২ ক্যারেট স্বর্ণ ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৮ টাকা, ২১ ক্যারেট ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৭ টাকা, ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০২ টাকা ও সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ ১ লাখ ১৮ হাজার ১৬৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাবে ২২ ক্যারেট স্বর্ণ ২ হাজার ১৯২ টাকা, ২১ ক্যারেটে ২ হাজার ১০০ টাকা, ১৮ ক্যারেটে ১ হাজার ৮০৮ টাকা ও সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ ১ হাজার ৫২৮ টাকা দাম বেড়েছে। তবে রুপার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
সমূহ সম্ভাবনার প্রত্যাশা নিয়ে দেশে চালু হলো গুগল পে। ২৪ জুন মঙ্গলবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে প্রযুক্তিগত সেবাটির উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ডক্টর আহসান এইচ মনসুর। ভিসা ও মাস্টারকার্ডের সহযোগিতায় প্রথমবারের মত গুগলের সেবাটি পরিচালনা করবে সিটি ব্যাংক পিএলসি। চলুন, গুগলের ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাটির সুবিধা ও ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
গুগল পে কি
বিশ্ব নন্দিত টেক জায়ান্ট গুগলের স্পর্শবিহীন লেনদেন ব্যবস্থার নাম গুগল পে। লেনদেনে ব্যবহারযোগ্য কার্ডের যাবতীয় তথ্যাদি সংরক্ষণের জন্য গুগলের রয়েছে একটি ডিজিটাল মানিব্যাগ। এটি গুগল ওয়ালেট নামে পরিচিত। এই ওয়ালেটে কার্ড সংযুক্ত করে গুগল পে-এর মাধ্যমে দ্রুত ও নিরাপদ উপায়ে লেনদেন করা যায়। এর জন্য সাথে প্লাস্টিক কার্ড বহনের প্রয়োজন পড়ে না; একটি স্মার্টফোন আর নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগই যথেষ্ট। এভাবে ঘরে বসে কিংবা বাইরে চলাচলে সর্বাবস্থানে যে কোনও সময় সব ধরনের আর্থিক লেনদেন করা সম্ভব।
গুগল পে’র সুবিধাসমূহ
- গুগলের এই পেমেন্ট সিস্টেমে রয়েছে উন্নত এনক্রিপশন প্রযুক্তি। এটি গ্রাহকের তথ্যের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কোনও রকম ডাটা হ্যাক বা তথ্য চুরির আশঙ্কা নেই।
- নগদ অর্থ বা কার্ড বহনের ক্ষেত্রে প্রায় সময় তা ছিনতাইয়ের ভয় থাকে। এছাড়া অসাবধানতায় হারিয়ে যাওয়ারও ভয় থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনও কাগুজে টাকা বা প্লাস্টিক কার্ড বহনের প্রয়োজন নেই বিধায় সেগুলো হারানোরও ভয় নেই।
- দেশে ও বিদেশে পস বা পিওএস (পয়েন্ট অব সেল) টার্মিনালে অর্থ পরিশোধের জন্য শুধুমাত্র অ্যান্ড্রয়েড ফোন স্পর্শ করলেই হবে। তবে পস টার্মিনালটি অবশ্যই এনএফসি (নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন) সমর্থিত হতে হবে।
এই সেবা গ্রহণের জন্য গুগলকে কোনও ফি দিতে হবে না।
- লেনদেনের মাধ্যম যেহেতু সম্পূর্ণ ডিজিটাল, তাই এর জন্য ব্যাংকে যাওয়ার দরকার নেই।
- চিরাচরিত ব্যাংকিং ট্রান্সফার সিস্টেমগুলোর তুলনায় গুগল পে’তে ফান্ড ট্রান্সফার অধিক দ্রুত গতির।
- গুগল পে’র আওতার মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের মত যাবতীয় ইউটিলিটি বিল এবং মোবাইল রিচার্জ অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
- এতে আছে বিভিন্ন উপলক্ষে ক্যাশব্যাক এবং ব্যবহারের উপর রিওয়ার্ড পয়েন্টের সুবিধা। এই পয়েন্টগুলো সেবার ব্যবহারকে আরও লাভজনক করে তোলে।
- গুগল পে’র কিউআর কোড ফিচারটি ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীদের লেনদেনকে আরও সুবিধাজনক করে তুলবে। একদিকে গ্রাহকদের কাছ থেকে সহজে ও দ্রুত পেমেন্ট নেওয়া যাবে, অন্যদিকে হিসাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হওয়ার আশঙ্কা কমবে।
গুগল পে-এর ব্যবহার পদ্ধতি
- প্রথমে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে গুগল প্লে থেকে গুগল পে অ্যাপটি ইন্স্টল করে নিতে হবে।
- এরপর অ্যাপ ওপেন করে গুগল অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করতে হবে।
- অতঃপর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ডের তথ্যাদি নির্ভুলভাবে সংযুক্ত করতে হবে।
- সবশেষে কাজ হচ্ছে একটি গোপন পিন এবং বায়োমেট্রিক সুরক্ষা সেট করা।
- এভাবে সেটাপ সংক্রান্ত ধাপগুলো সম্পন্ন হলে সিস্টেমটি লেনদেনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। কম সময়ে লেনদেনের জন্য কিউআর কোড সেট করে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া এর জন্য ফোন নাম্বারও ব্যবহার করা যায়।
শেষাংশ
বাংলাদেশে গুগল পে-এর এই যাত্রা দেশের ভবিষ্যতমুখী আর্থিক পরিমণ্ডল গঠনে এক বিশাল পদক্ষেপ। প্রযুক্তির এই সূচনালগ্নে প্রথম দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর সাথে রয়েছে সিটি ব্যাংক। পরবর্তীতে অন্যান্য ব্যাংক যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আরও প্রসারিত ও সহজলভ্য হবে গুগল পে। সর্বসাকূল্যে, এই নিরাপদ, দ্রুত গতি, ও ঝামেলাবিহীন লেনদেন ব্যবস্থায় রচিত হলো উন্নত জীবনধারায় মাইলফলক।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অঞ্চলে প্রথমবারের মতো পাইপলাইনে বাণিজ্যিকভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হয়েছে। গত রোববার বিকাল ৪টায় শুরু হয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টা নাগাদ চট্টগ্রাম থেকে এক কোটি ১২ লাখ লিটার পরিশোধিত ডিজেল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মণি লাল দাশ গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বিপিসির জ্বালানি বিপণনকারী অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানির চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ডিপোর মূল স্থাপনার ট্যাংকগুলো থেকে গোদনাইল ডিপোতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্যাংকে এই জ্বালানি তেল পাম্প করা হচ্ছে।
মণি লাল দাশ বলেন, প্রথমবারের মতো পাইপলাইনে বাণিজ্যিকভাবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল নেওয়া শুরু হয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যা থেকে পদ্মা অয়েল কোম্পানির গোদনাইল ডিপোর ট্যাংকে তেল নেওয়া হয়। গত সোমবার বেলা ১১টা থেকে মেঘনা পেট্রোলিয়াম তাদের ডিজেল পাঠাচ্ছে। মেঘনার তেল পাঠানো শেষ হলে যমুনা অয়েল তাদের প্রয়োজনীয় তেল পাঠানো শুরু করবে।
পাইপলাইনটিতে ঘণ্টায় ৩২০ মেট্রিক টন জ্বালানি পাঠানোর সক্ষমতা রয়েছে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘণ্টায় ২৮০ টনের মতো পাঠানো হচ্ছে।
বিপিসির নবগঠিত পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানি পিএলসি (পিটিসিপিএলসি) ও প্রকল্পে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা এই জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি তদারকি করছেন বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
পদ্মা অয়েল কোম্পানির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা গনমাধ্যমকে বলেন, রোববার সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইল ডিপোতে পাইপলাইনে তেল পাঠানো শুরু হয়। গত সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত পদ্মা অয়েলের গোদনাইল ডিপোতে ৬৬ লাখ লিটার ডিজেল পাঠানো হয়েছে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতাসহ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জ্বালানি পরিবহনের সিস্টেম লস কমানো, নৌপথে তেল পরিবহনের বিপুল খরচ সাশ্রয়সহ দ্রুততম সময়ে তেল পৌঁছানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত আড়াইশো কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়।
পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহনের এ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের অক্টোবরে অনুমোদন পায়। শুরুতে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরু করতেই ২০২০ সাল লেগে যায়। পরে প্রথম দফায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর এবং দ্বিতীয় দফায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।
বিপিসির এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়।
বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে ২৭ লাখ টন ডিজেল সরবরাহ করা হবে। পাইপে পরিবহন শুরু হলে বছরে সাশ্রয় হবে ২৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের নথিতে বলা হয়েছে, প্রতি বছর প্রকল্প থেকে ৩২৬ কোটি টাকা আয় হবে। পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ, ফুয়েল, বিদ্যুৎ বিল, জমির ভাড়াসহ আরও কিছু খাতে ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। এতে প্রতি বছর সাশ্রয় হবে ২৩৬ কোটি টাকা। আগামী ১৬ বছরের মধ্যে প্রকল্পের বিনিয়োগ উঠে আসবে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের গড় চাহিদা বছরে ৬৫ লাখ টন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরবরাহ করা হয়েছে ৬৭ লাখ টন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। ঢাকা বিভাগেই জ্বালানি তেলের ব্যবহার মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ।
বর্তমানে ঢাকায় তেল পরিবহনের জন্য প্রথমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নদীপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় তেল পরিবহন করা হয়। পরিবহনে ব্যবহৃত হয় প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড় জাহাজ। এতে বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছে। ব্যয় আর ভোগান্তি কমাতেই এ পাইপলাইন তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি গ্রাহকদের নিকট আস্থাশীল ব্যাংকসমূহের আমানত বৃদ্ধির ন্যায় রাষ্ট্র মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকেরও আমানতসহ কয়েকটি সূচকে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। গত ৬ মাসে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বৃহৎ অংশকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে পেরেছে। উত্তম সেবার নিশ্চয়তা দিয়ে সারাদেশে শাখা ও উপশাখা নিয়ে গড়ে তুলেছে ব্যাংকটির বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। ক্রমশই জনপ্রিয় হচ্ছে রূপালী ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা। বিশেষ করে আমানতের ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্কিম। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম যোগদান করার পর রূপালী আস্থা, রূপালী শ্রদ্ধা ও রূপালী ডাবল বেনিফিট স্কিম নামে তিনটি আকর্ষণীয় স্কিম চালু করেছেন। ইতোমধ্যে নতুন হিসাব বেড়েছে প্রায় তিন লাখ এবং আমানত বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি এবং স্পর্শ করেছে ৭৮ হাজার কোটি টাকার আমানতের মাইলফলক।
দক্ষ ব্যাংকার কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম আর্থিক খাতে নিজেদের টেকসই অবস্থান নিশ্চিতকরণে খেলাপি ঋণ আদায়, নতুন হিসাব খোলা, সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ভারসাম্য রক্ষা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে রূপালী ব্যাংকের নেতৃত্ব।
রূপালী ব্যাংকের নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের নিষ্ঠাশীল আনুগত্য ও ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার প্রমাণ পাওয়া যায় গত ৬ মাসে ব্যাংকটির নতুন হিসাব খোলার সংখ্যা বিশ্লেষণে। যেখানে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৫৩ বছরে ব্যাংকটির সক্রিয় অ্যাকাউন্ট ছিল ৩০ লাখ, সেখানে ছয় মাসে নতুন অ্যাকাউন্ট যুক্ত হয়েছে ৩ লাখ। বর্তমানে ৩৩ লাখ গ্রাহকের রূপালী ব্যাংক জাতীয় সঞ্চয়ের বড় অংশীদারে পরিণত হয়েছে। গত ছয় মাসে ৬৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ৭৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে ব্যাংকটির আমানত।
ব্যাংকটির বর্তমান অগ্রগতির কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দক্ষ ও গতিশীল নেতৃত্বের কথা। ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল হুদা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। অভিজ্ঞ পর্ষদের দিক নির্দেশনা এবং ২৭ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ব্যাংকের একটি শক্তিশালী সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম প্রতিটি আর্থিক সূচকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটিকে।
দেশীয় ও বৈশ্বিক নানামুখী অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মাঝেও ব্যাংকটির পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে।
মন্তব্য