ঘুষ আর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হওয়া ময়মনসিংহের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি নয়া উপপরিচালকের নির্দেশে স্বচ্ছ হয়েছে বলে গুণকীর্তন ছড়িয়ে দিয়েছে কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের দাবি, এখন আর দালালের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট করতে হয় না। দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আসলেই কি তাই? এর সত্যতা খুঁজতে টানা ১৫ দিন অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা তথ্য।
আঞ্চলিক এই পাসপোর্ট অফিসের বর্তমান উপপরিচালক হাফিজুর রহমান। তিনি গত বছরের ১৪ অক্টোবর ওই পদে যোগ দেন। এরপর কার্যালয়ের সামনে বড় করে প্যানা টানিয়ে দেন তিনি।
সেখানে লেখা হয়, ‘আপনার পাশে আমরা। পাসপোর্ট করতে এসে কোনো ধরনের ভোগান্তি সৃষ্টি হলে ২০৬ নম্বর কক্ষে সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
এমন লেখায় কার্যালয়টির পুরোনো চেহারা পাল্টাবে- এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল সেবাগ্রহীতারা। কোনো ধরনের সমস্যা হলে প্রধান এই কর্মকর্তার কক্ষের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে যোগাযোগও করেছেন অনেকে। কিন্তু আসলেই কি স্বচ্ছ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নাকি লোকদেখানো কিছু সেবাগ্রহীতাদের সমস্যা সমাধান করে প্রশংসা নিয়ে গেছে?
অনুসন্ধানে জানা যায়, আগের উপপরিচালক সালাহ উদ্দিন যোগদানের পর দালালদের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রতিটি পাসপোর্ট বাবদ এক হাজার ২০০ টাকা করে ঘুষ নির্ধারণ করেন। হাফিজুর রহমানের যোগদানের পরও তা পাল্টায়নি।
বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০টি আবেদন জমা পড়ছে বলে জানিয়েছেন পাসপোর্ট অফিসের একাধিক কর্মকর্তা।
এই আবেদনের ৮০ শতাংশের বেশি জমা পড়ে দালালদের মাধ্যমে। এ হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ২০০টি আবেদন জমা পড়লে একদিনে ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা। তবে ১৫০টি আবেদন জমা পড়লে প্রতিদিন ঘুষের পরিমাণ ২ লাখ ৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি মাসে ৪০ লাখ টাকার বেশি ঘুষ আদায় করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, দালালরা প্রতিটি আবেদনে ব্যবহার করে বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন। প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা বিশেষ কোড। পাসপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া এসব চিহ্ন ও কোড বোঝার কোনো উপায় নেই।
এরপর আবেদনকারী পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে এগুলো জমা দেন। কর্মকর্তারা আবেদন দেখেই বুঝতে পারেন কোন দালাল আবেদনপত্র পূরণ করে পাঠিয়েছে। কে কতটি আবেদন করেছে, তাও নোট করে রাখা হয়।
এরপর দালালরা ঘুষের নির্ধারিত টাকাগুলো যথাসময়ে পাসপোর্ট অফিসে পৌঁছে দেন। অফিসের সূত্র বলছে, এই ঘুষের টাকা ভাগাভাগি হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
মাসোয়ারা হিসেবে অফিসের খাতায় তালিকাভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে মাসের নির্দিষ্ট তারিখেই ঘুষের টাকা বণ্টন করা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার উপপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে নিউজবাংলা। সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। বলেছেন, বাইরে কিছু দালাল থাকতে পারে। তবে অফিসের কোনো কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের যোগাযোগ নেই বলে দাবি তার।
২৩ বছরের ‘অভিজ্ঞ দালালের’ গর্ব ও চ্যালেঞ্জ
এরপরই পরিচয় গোপন রেখে পাসপোর্ট অফিসের সামনে কয়েকজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। প্রথমে মুখ খুলতে রাজি হননি কেউ।
এরপর কৌশল পাল্টে দালালদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়। পাসপোর্টের আবেদনের বিষয়ে জানতে ওই নম্বরে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়। পরিচয় গোপন রেখে ধীরে ধীরে সখ্য গড়ে তোলা হয়।
কয়েকজন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করবে জানালে পাসপোর্ট অফিসের সামনে তাদের নিজস্ব অফিসে আসতে বলে দালাল। আগে টাকার অঙ্কটা পরামর্শ করা প্রয়োজন জানালে একজন দালাল রাজি হন।
গত ৩০ মার্চ বিকেল ৫টার দিকে উজ্জ্বল নামের ওই দালালকে নগরীর চরপাড়া এলাকায় ডেকে আনা হয়। এ সময় খোলামেলা আলোচনা হয় তার সঙ্গে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১০ বছরের জন্য পাসপোর্ট নিতে চাইলে আমাদের হাতে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। আর ৫ বছরের জন্য করলে ৭ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। গ্যারান্টি দিচ্ছি, এক মাসের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পাবেন৷’
এই লাইনে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার গর্বও করলেন উজ্জ্বল। বলেন, ‘২৩ বছর ধরে দালালি করছি। আজ পর্যন্ত কথার বরখেলাপ করিনি।’
নিজে আবেদন করে পাসপোর্ট অফিসে জমা দিলেই পাসপোর্ট পাওয়া যায়। তাহলে আপনাদের বাড়তি টাকা দেব কেন? এমন প্রশ্নে রীতিমতো রাগান্বিত হয়ে যান উজ্জ্বল। বলেন, ‘তাহলে ডেকেছেন কেন?’
চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘সাধারণ পাবলিক হিসেবে গিয়ে দেখেন, পাসপোর্ট সময়মতো পান কি না। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে দৌড়াদৌড়ি করে জুতা ক্ষয় করতে হবে। পরে আমাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হবে।’
একপর্যায়ে ঘুষ লেনদেনের সব তথ্য বলে দেন এই উজ্জ্বল। বলেন, ‘অফিসের তালিকাভুক্ত দালাল ছাড়াও সহযোগী দালাল রয়েছে পাঁচ শতাধিক। কিছু দালাল রয়েছে যারা সরাসরি নিজে আবেদন প্রক্রিয়া শেষ না করে আরেক দালালকে দিয়ে করায়। এ জন্য সেই দালালকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়৷
‘আবেদন প্রক্রিয়া শেষ করে বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়৷ এরপর আবেদনকারী নিজে গিয়ে আবেদন জমা দেন। ওই চিহ্ন দেখেই কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন কোন দালালের মাধ্যমে কতটি আবেদন জমা পড়েছে।’
দালাল যতটি আবেদন করবে প্রতিটি আবেদন বাবদ এক হাজার ২০০ টাকা করে জমা দিতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া যাবে- এটাও বলে দিলেন উজ্জ্বল।
আবেদনে ত্রুটি থাকলে লাভ বেশি
উজ্জ্বল জানান, কারও কোনো সমস্যা থাকলে বা আবেদনে ত্রুটি-বিচ্যুতির পাসপোর্টের জন্য দর-কষাকষি করে নেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
তিনি বলেন, ‘আমরা (দালালরা) যে আবেদনগুলো করে দেই, সেগুলো অফিসের কর্মকর্তারা ভুল ধরতে পারবেন না। ভুল থাকলেও সব ঠিক। তবে সাধারণ লোক নিজে আবেদন করে জমা দেয়ার সময় সামান্য ত্রুটি থাকলে এটিকে বড় ভুল হিসেবে ধরা হয়। ফলে আমাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে বাধ্য হয় আবেদনকারীরা।’
ঘুষ বন্ধের ‘বিজ্ঞাপন’ নিয়ে
ঘুষ বন্ধ হয়েছে, কাউকে বাড়তি টাকা দিতে হয় না বলে যে দাবি অফিস থেকে করা হচ্ছে, সে বিষয়ে উজ্জ্বলের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কটাক্ষের হাসি হাসেন।
বলেন, ‘যাদের মুখ পরিচিত, তারা অনলাইনে আবেদন করে সরাসরি জমা দিলে নির্দিষ্ট সময় পর হলেও পাসপোর্ট পাবেন। তবে এ সংখ্যাটা হাতে গোনা কয়েকজন। আর প্যানা টানানোর বিষয়টি লোকদেখানো। যদি পাসপোর্ট অফিস স্বচ্ছই হয়, তাহলে মাস শেষে বণ্টন করা টাকাগুলো আসে কীভাবে? এগুলো ঘুষের টাকা।’
কী বলছেন ভুক্তভোগীরা
উজ্জ্বলের এসব বক্তব্য যাচাই করতে গিয়ে নিউজবাংলা কথা বলে পাসপোর্ট নিয়ে কাজ করেন এমন এক কর্মকর্তার সঙ্গে। পরিচয় ও সংস্থার নাম গোপন রাখার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি এই পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে দুই হাজার করে টাকা নেই। এটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। যার রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে।’
পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে কথা হয় রাফিউল্লাহ নিলয় নামের এক যুবকের সঙ্গে। তিনি গত ২৩ মার্চ জেলার গফরগাঁও উপজেলা থেকে পাসপোর্ট করতে আসেন।
আবেদনপত্র জমা দিতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দালাল ডিঙিয়ে আবেদন জমা দিতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছি। ফলে বাধ্য হয়েই দালালদের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
‘এক দালালকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। তিনি আবেদন প্রক্রিয়া শেষ করেছেন। এরপর আমি জমা দিতে গেলে তাৎক্ষণিক জমা রাখা হয়। তখন আর কোনো সমস্যা হয়নি।’
জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার কাহালগাঁও গ্রাম থেকে এসেছেন হোসেন আলী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাসপোর্ট করেছিলাম ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি। ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ ছিল৷ দুবাই যাব, এ জন্য মেয়াদ ১০ বছরের জন্য বাড়াতে দালাল বাবলুর মাধ্যমে আরেক দালালকে ১০ হাজার টাকা খরচ করে আবেদন করেছি। দালাল লিখে দেয়ার কারণে খুব সহজেই জমা দিতে পেরেছি।’
নিজে জমা দিলেন না কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকার ও পরিচিত অনেকে দালাল ছাড়া আবেদন করে ভোগান্তিতে পড়েছে। লেখাতে সামান্য ভুল থাকলেও আবেদন গ্রহণ করা হয় না। অফিস থেকে বলা হয়, ঠিক করে নিয়ে আসেন। এ জন্য দালালের শরণাপন্ন হয়ে সহজেই আবেদন জমা করতে পেরেছি।’
ভালুকার ডাকুরা এলাকা থেকে আসা মো. নাজমুল হাসান বলেন, আমার ভোটার আইডি কার্ডে Md. Nasmol hasan ও মায়ের নাম মোছা. নাজমা খাতুন উল্লেখ থাকলেও পাসপোর্টে আমার নাম Md. Nasmul hasan ও মায়ের নাম মোছা. নাজমা আক্তার এসেছে। এটি সংশোধন করতে ফেব্রুয়ারি মাসে পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করলে ব্যস্ততা দেখিয়ে কোনো কর্মকর্তা পরামর্শ দেননি৷
‘পরে অফিসের সামনে এক কম্পিউটারের দোকানে গেলে এফিডেভিটের মাধ্যমে সংশোধন করতে বলেন। স্ট্যাম্পের মাধ্যমে সব করে দেয়ার শর্তে ওই দোকানে থাকা দালালকে ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।’
শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার মিনহাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অফিসের প্রবেশ পথের দুই ধারে সংঘবদ্ধ দালালচক্র অফিস খুলে বসেছে। পাসপোর্ট করতে আসা মানুষ অফিসে ঢোকার আগেই ওত পেতে থাকা এসব দালালের খপ্পরে পড়েন।’
তিনি বলেন, ‘দালাল অজয় বাবু আবেদন প্রক্রিয়া শেষ করে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন৷ তবুও ভোগান্তি ছাড়া পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি, এতেই খুশি।’
‘কর্মকর্তা সৎ হলে দালাল থাকবে না’
ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমীন কালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা সৎ হলে দালালদের অস্তিত্ব থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘কোন পাসপোর্ট কত দিনে পাওয়া যাবে, সরকারি খরচ কত, এগুলো সম্পর্কে এখনও অনেকে জানে না। এগুলো উল্লেখ করে কার্যালয়টির সামনে টানিয়ে সেবাগ্রহীতাদের কেন অবহিত করা হয় না?’
নাগরিক সংগঠন ‘জেলা জন-উদ্যোগ’ এর আহ্বায়ক আইনজীবী নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, ‘কার্যালয়টিতে যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন, তারাও এগুলো চুপচাপ দেখেন। এতেও বোঝা যায়, দালালদের সঙ্গে তাদের কোনোভাবে যোগসাজশ রয়েছে।’
কর্মকর্তা ও দালালদের যোগসাজশের বিষয়টি উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কমিশন জেলা শাখার সভাপতি শিব্বির আহম্মেদ লিটন।
তিনি বলেন, ‘পাসপোর্টটির যখন নিজস্ব জায়গা ছিল না, তখন কর্মকর্তারা দোহাই দিত স্থানীয় লোকজন এসে দালালির কাজগুলো করে। ভবনটি নিজস্ব জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্ব্যবহার ও নৈরাজ্যও স্থানান্তরিত করে নিয়ে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তির পাসপোর্ট করতে দালাল ধরতে হয় না। বাকিদের দালালদের কাছেই যেতে হয়।’
সব অভিযোগ অস্বীকার কর্মকর্তাদের
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই কার্যালয়ে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
দালালদের আপনাদের যোগসাজশের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে জানালে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দালালদের সঙ্গে আমাদের কারও সম্পর্ক নেই। উপপরিচালক সব বলতে পারবেন।
পরে উপপরিচালক হাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি যোগদানের পর কাজে স্বচ্ছতা আনতে চেষ্টা করছি। অফিসের বাইরে দালাল থাকতে পারে, তবে সেটা আগের চেয়ে কম৷’
দালালচক্রের অপতৎপরতা রোধে র্যাব-১৪-এর অভিযানে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১১ জনকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়। এর পরই পাসপোর্ট অফিসটির আগের উপপরিচালকসহ অন্তত সাত কর্মকর্তাকে গণবদলি করা হয়।
আরও পড়ুন:মঙ্গলবার (১৭ জুন) ভোর সাড়ে চারটার দিকে পাবনা বাইপাস মহাসড়কের ইয়াকুব ফিলিং স্টেশন এর সামনে দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত ট্রাকচালক সেলিম হোসেন (৩৮) মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের মৃত আব্দুল গনির ছেলে।
আহতরা হলেন- বাসের হেলপার তারেক (৩৫) ট্রাকের হেল্পার আলামিন (৩৫)। তাদের রাজশাহী মেডিকেল। কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস সালাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, ট্রাকচালক সেলিম সুনামগঞ্জ থেকে পাথর ভর্তি করে মাওয়া যাচ্ছিলেন।অপরদিক পাবনা এক্সপ্রেস বাসটি ঢাকা থেকে পাবনা বাস টার্মিনালে যাত্রী নামিয়ে হেলপার আলামিন গাড়ি গ্যারেজ করার জন্য দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে ইয়াকুব ফিলিং স্টেশনের সামনে পৌঁছালে ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
স্থানীয় লোকজন ফায়ার সার্ভিসকে জানালে তাৎক্ষিনক ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম আহত তিনজনকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ট্রাক চালক সেলিম কে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে আহত ট্রাকের হেলপার ও বাসের হেলপারের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্থানান্তর করা হয়।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস সালাম জানান, খবর পেয়ে পুলিশ নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে সদর থানা হেফাজতে আনা হয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাক ও বাসটি জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে নজির গাজী (৪৯) ও দিদারুল ইসলাম (৩৮) নামে দুই ’জলদস্যুকে’ আটক করেছে পুলিশ। সোমবার রাত সাড়ে ৯টা ও ১১টার দিকে উপজেলার উপকুলবর্তী যতীন্দ্রনগর ও মীরগাং এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এসময় আটক দুই জলদস্যুর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের ব্যবহৃত নৌকা থেকে একটি একনলা বন্দুক উদ্ধার করে পুলিশ। মঙ্গলবার সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করে শ্যামনগর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. হুমায়ুন কবির মোল্যা।
এর আগে সোমবার রাত আটটার দিকে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে উঠে আসার সময় স্থানীয়দের ধাওয়ার মুখে অপর কয়েক সহযোগিসহ এসব জলদস্যুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আটকরা হলেন— শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের নওশাদ গাজী এবং আশাশুনি উপজেলার চাকলা গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে দিদারুল ইসলাম।
আবু হামজা, সিদ্দিক হোসেন ও আকবর আলীসহ স্থানীয়রা জানায়, রাত সাড়ে আটটার দিকে অপরিচিত পাঁচ/সাত জন ব্যক্তি সুন্দরবন তীরবর্তী যতীন্দ্রনগর বাজারে যায়। এসময় নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্য তারা মাইক্রো বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের জন্য কথা বলছিলেন। একপর্যায়ে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নাম—পরিচয়সহ সুন্দরবন এলাকায় আসার কারণ জানতে চাইলে তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় যতীন্দ্রনগর বাজারে উপস্থিত লোকজন ধাওয়া করে দিদারুলকে ধরে পুলিশকে খবর দেয়। পরবর্তীতে শ্যামনগর থানার অফিসার ইনচার্জ হুমায়ুন কবির ঘটনাস্থলে পৌঁছে নজীরকে আটকের পাশাপাশি তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই চক্রের ব্যবহৃত মাছ শিকারের নৌকার মধ্যে থেকে একটি একনলা বন্দুক ও একটি দা উদ্ধার করে।
এদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছে, জোনাব বাহিনী এখন সুন্দরবনে খুব বেশি তৎপর না। বরং নজীর, তার ভাই নবাব ও ছেলে আব্দুর রহিম এবং মুন্সিগঞ্জ আটিরউপর এলাকার আছাদুলসহ কয়েকজনকে নিয়ে জোনাবের নামে সুন্দরবনে দস্যুতায় লিপ্ত। সোমবার রাতে নজীর আলীকে আটকের পরপরই তার ছেলে আব্দুর রহিম ও ভাই নবাব ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েন।
আটক নজীর আলীর ভাষ্য, তিনি সুন্দরবনের ত্রাস কুখ্যাত জোনাব বাহিনীর সদ্যদের উপরে তুলে দেওয়া এবং সুন্দরবনে নামিয়ে দেয়ার কাজ করেন। সোমবার ১০ হাজার টাকার চুক্তিতে জোনাব বাহিনীর দুই সদস্যকে যতীন্দ্রনগর বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন। বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে যেয়ে মাছ শিকারের পাশাপাশি তারা পরিচিত জলদস্যুদের উপরে নিচে উঠানামার কাজ করেন বলেও দাবি তার। উপরে উঠে যাওয়া দুই জলদস্যু উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি তার নৌকার মধ্যে রেখে যায় বলেও তিনি দাবি করেন।
দিদারুল জানান, তিনি নজীর আলীর শ্রমিক হিসেবে সুন্দরবনে যাওয়া জেলেদের জিম্মি করারসহ মুক্তিপণ আদায়ের কাজ করেন। লোকারয়ে পৌঁছে দেওয়া দুই জলদস্যুকে সুন্দরবনের পুটেরদুনে এলাকা থেকে নিয়ে আসার কথাও নিশ্চিত করেন তিনি। তবে তার কাছে মোবাইলের পাওয়ার ব্যাঙ্কসহ নানান সরঞ্জামাদির বিষয়ে জানতে চাইলে নিরুত্তর থাকেন।
এদিকে অস্ত্র উদ্ধারসহ দু’জনকে আটকের বিষয়ে শ্যামনগর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. হুমায়ুন কবির মোল্যা জানান, নজীরের দেওয়া তথ্যে নৌকায় থাকা ককসিটের নিচে বিশেষ কায়দায় লুকানো অবস্থায় একটি একনলা বন্দুক উদ্ধার হয়েছে। আটকের পর উভয়কে শ্যামনগর থানায় নেওয়া হয়েছে। তারা মাছ শিকারির ছদ্মবেশে সুন্দরবনে প্রবেশ করতেন বলে প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাহিনীর নাম—পরিচয়সহ বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে।
কুমিল্লায় চার জনের শরীরে নতুন ভ্যারিয়েন্টের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে এক নারী চিকিৎসকসহ তিনজন পুরুষ রয়েছেন।
শনিবার (১৪ জুন) কুমিল্লা সিটি স্ক্যান এমআরআই স্পেশালাইজড অ্যান্ড ডায়ালাইসিস সেন্টারে করোনা পরীক্ষা শেষে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে কুমিল্লা সিভিল সার্জন ডা. আলী নূর বশির এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
করোনায় আক্রান্তরা হলেন, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আবদুল মোমিন (৭০), কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকার ডা. সানজিদা (৩০), বুড়িচং উপজেলার মো. হেলাল আহমেদ (৩৮) এবং সদর উপজেলার মো. ইবনে যুবায়ের (৩৯)।
সিভিল সার্জন ডা. আলী নূর বশির বলেন, গত তিন দিনে কুমিল্লায় ১৩ জন রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা কয়। পরীক্ষা শেষে তাদের মধ্যে চারজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বাকিদের নগরীর একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নমুনা পরীক্ষায় রিপোর্ট পজিটিভ আসে।
তিনি বলেন, চারজনই বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে একজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। দুজন এরই মধ্যে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় চলে গেছেন।
তবে আরেকজনের বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি সিভিল সার্জন।
করোনার প্রথম ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর এতদিন কুমিল্লায় নতুন করে কেউ শনাক্ত হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু এখন আবার নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি দ্বিতীয় ধাপের শুরু হতে পারে এবং এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
চট্টগ্রামে নতুন করে আরো একজনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে গত ছয় দিনে মোট ৯ জনের শরীরে এ ভাইরাসের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। শনিবার (১৪ জুন) সকালে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল আটটা থেকে শনিবার সকাল আটটা) ২৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে একজনের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। ৪০ বছর বয়সী আক্রান্ত ওই ব্যক্তি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেহাবাদ এলাকার বাসিন্দা। তিনি শুক্রবার নগরের এভারকেয়ার হাসপাতালে করোনার পরীক্ষা করান। সেখানেই তার শরীরে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়।
এদিকে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্ত নয়জনের মধ্যে পুরুষ ৫ জন এবং নারী ৪ জন। এদের মধ্যে ৭ জন নগরের এবং ২ জন উপজেলার বাসিন্দা।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে করোনা শনাক্তকরণের পরীক্ষা চালু আছে। তবে শিগগিরই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) আরটি–পিসিআর পরীক্ষা শুরু করা যাবে বলে আশা করছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
কুমিল্লার দাউদকান্দি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দূর্ঘটনায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। তবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোগীদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে গিয়ে হাসপাতালের তিনজন কর্মী আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে স্থানীয় ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা ছুটে আসে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আহতরা হলেন ইয়াসিন, মেহেদি ও মুছা। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
শনিবার (১৪জুন) বেলা ১১টায় দাউদকান্দি উপজেলা গৌরীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৩য় তলায় ষ্টোর রুমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে হাসাপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের এবং বহিঃবিভাগে চিকিৎসা সেবা প্রায় দুই ঘন্টা বন্ধ থাকে৷ খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয় এবং হাসপাতালে কর্মরত স্টাফদের সহযোগিতায় অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা ১১ টার দিকে হাসপাতালের তিনতলার ষ্টোর রুমে আগুনের ধোয়া দেখা যায়। ধোয়া দেখে পাশের ওয়ার্ডের রোগীর স্বজন ও নার্সরা আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করে। এ সময় হাসপাতালে থাকা রোগী ও তাদের স্বজনরা দৌঁড়াদৌড়ি শুরু করেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পল্লী বিদ্যু ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে হাসপাতালের আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত ইয়াসিন, মেহেদি ও মুছা নামে তিন কর্মচারী আহত হয়েছেন। আহতদের ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে দাউদকান্দি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন অফিসার মোঃ ইদ্রিস বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসার পর স্থানীয় এবং হাসপাতালে কর্মরত স্টাফদের সহযোগিতায় অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। প্রাথমিক ধারনা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনে সূত্রপাত, পরবর্তীতে তদন্ত সাপেক্ষে মূল কারণ জানা যাবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, হাসপাতালের ৩য় তলায় ডেঙ্গু রোগীদের ওয়ার্ডের পাশের কক্ষে ষ্টোর রুমে ঔষধসহ রোগীদের সেবার কাজে ব্যবহৃত সব ধরনের মালামালের সাথে কিছু দামী সরঞ্জামও ছিল। ওই কক্ষে আগুনে অধিকাংশ মালামালই পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মালামাল বের করতে পারলেও তা ভালো আছে কিনা পরবর্তীতে যাচাই করে বলেতে পারবো । আগুনে ক্ষতির পরিমান এখন নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। আর আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং মালামাল বিশেষ করে অক্সিজেন সিলিন্ডার বের করতে গিয়ে আমাদের আউটসোর্সিংয়ে কাজ করা তিনজন আহত হয়েছেন। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে হাসপাতালে অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে দাউদকান্দি উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) রেদওয়ান ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন৷
ঈদের ছুটিতে সিলেটে বেড়াতে এসে হেনস্তার শিকার হয়েছেন পর্যটকরা। একদিনের ব্যবধানে জাফলংয়ে পর্যটকদের উপর হামলা ও কোম্পানীগঞ্জে পর্যটনকেন্দ্র থেকে পর্যটকদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। দুটি ক্ষেত্রেই পর্যটকদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতা ও পরিবেশ নষ্টের অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও স্থানীয় একটি অংশের অভিযোগ, নির্বিঘ্নে চোরাচালান ও পাথর লুট করতেই পর্যটকদের বাধা দেয়া হচ্ছে। পর্যটক সমাগম বাড়লে লুটপাট ও চোরাকারবারে সমস্যা হয়। তাই পর্যটকদের আসতে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
অশ্লীলতার অভিযোগ এনে সোমবার রাতে মৌলভীবাজারের রাজনগরে “রাজনগর রিসোর্ট এন্ড কফি হাউজে” তালা দিয়েছে স্থানীয় একদল লোক। এসময় স্থানীয় থানার পুলিশ সদস্যদেরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুটি স্থান জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জ। সবসময়ই এই দুই এলাকায় পর্যটকদের ভিড় থাকে। ঈদের মতো বড় ছুটিতে ভিড় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সীমান্তবর্তী এই দুই এলাকা দিয়েই ভারত থেকে দেদারছে চোরাই পণ্য আসে। এছাড়া এসব এলাকার পাথুরে নদী ও ছড়া থেকে পাথর লুটপাটও নিত্তকার ঘটনা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর চোরাচালান ও পাথর লুট অনেকটা বেড়ে গেছে। প্রশাসনও লুটপাটকারী ও চোরাকারবারীদের ঠেকাতে পারছে না।
জানা যায়, ঈদের পরদিন রোববার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের পাহাড় থেকে নেমে আসা পাথুরে ছড়া উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্রে ভিড় করেন অনেক পর্যটক। বিকেলে সেখানে কিছু সংখ্যক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কিছু লোক জড়ো হয়ে পর্যটকদের বের করে দেয়। এ রকম একটি ভিডিও সোমবার রাত থেকে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। জড়ো হওয়া যুবকরা পর্যটকদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতা, মদ্যপান ও এলাকার পরিবেশ নষ্টের অভিযোগ করেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পর্যটকদের বের করে দেয়ার একটি ভিডিওতে এক যুবককে বলতে শোনা যায়, 'এই এলাকা আলিমদের এলাকা, দ্বীনদার এলাকা। কিন্তু এইখানে অনেকে অনেক পরিবেশে থেকে আসে। এসে মদ খায়, আরও অনেককিছু করে, এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়। তাই আমাদের আবেদন, আপনারা এখানে আর আসবেন না। তাছাড়া এটি পর্যটনভুক্ত এলাকাও নয়'।
ভিডিওতে আরও বলতে শোনা যায়, ‘এই এলাকার আলেম-ওলামা ও স্থানীয়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে উৎমাছড়াকে পর্যটন করা যাবে না। তাই আপনারা যারা এখানে এসেছেন দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আপনারা এখানে থেকে এখানের পরিবেশ নষ্ট করবেন না। এই এলাকার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য আমরা এখানে পর্যটকদের আসতে নিরুৎসাহিত করছি আজকের পর আপনারা এখানে আর কোনদিন আসবেন না’।
পর্যটকদের বের করে দেয়ার এই ভিডিও যুক্ত করে পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ফেসবুকে লিখেন, ‘একদিকে চলবে পর্যটক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা অন্যদিকে পর্যটনে বাঁধা! দেশের ভেতরে সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকা ও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মালিকানাধীন জায়গা ব্যতীত কোথাও জনসাধারণের প্রবেশে বাঁধা দেয়া মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। মানুষের চলাচলে বাঁধা প্রদান ও হুমকি প্রদান দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সিলেটে এই অপরাধ ইতিপূর্বেও ঘটেছে।
কিম লিখেন, 'বছর কয়েক পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলায় এক ঈদে মায়াবন নামে পরিচিত যুগীরকান্দি জলারবনে পর্যটকদের উপর হামলা করা হয়েছিল। এরপর থেকে ওই বনে কোন পর্যটক আর পা রাখেনি। স্থানীয় মাদ্রাসা ওই জলার বনের মাছ ভোগ করে বলে এখানে পর্যটক আসুক তা চায় না। অশ্লীলতার দোহাই দিয়ে যুগীরকান্দি বন বা মায়াবন সবার দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়। উতমাছড়ার পাথর লুটে ওই মাদ্রাসার সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা জানা প্রয়োজন।'
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ বলেন, ‘উৎমাছড়ায় বেড়াতে যাওয়া জন্য নির্দিষ্ট কিংবা উপযুক্ত রাস্তা নেই। এ জন্য পর্যটকেরা স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িঘর মাড়িয়ে যাতায়াত করেন। এতে তারা অসুবিধায় পড়েন। বৈঠকে এমন দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকায় মাদক সেবন ও অশ্লীলতা হয়, এমনটিও দাবি করা হয়েছে’।
উৎমাছড়ায় পর্যটকদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘এ অঞ্চলে এমন ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি। বিষয়টি ইউএনওকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তিনি তদন্ত করে দেখছেন। ইউএনও জানার চেষ্টা করছেন, বিষয়টি কী?’
এদিকে, সিলেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে পর্যটকদের উপর হামলা চালিয়েছে স্থানীয় কিছু লোক। হামলাকারীরা চোরাকারবারের সাথে সম্পৃক্ত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সোমবার বিকেলে জাফলং বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে গোয়াইনঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কবির হোসেন বলেন, স্থানীয় বখাটেরা পর্যটকদের ওপর হামলা করেছে। পরে সাংবাদিক ও ইউপি সদস্য মিলে ঘটনাস্থলেই বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী বলেন, ‘তুচ্ছ বিষয় নিয়ে পর্যটকদের সঙ্গে ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছিল। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান হয়ে গেছে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকের ভুল ধারণা হয়েছে।’
নাফ নদীর ভাঙন যেন থামছেই না। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়ায় প্রতিদিনই নদীর গর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, ভেঙে যাচ্ছে স্বপ্ন। কিছুদিন আগেও যেখানে ছিল ঈদের প্রস্তুতি, হাসি-আনন্দে মুখর পরিবার—আজ সেখানে কান্না আর হাহাকার। প্রবল জোয়ার ও টানা বৃষ্টির তোড়ে শত শত পরিবার এখন আশ্রয়হীন, চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। বসতভিটা হারিয়ে কেউ খোলা আকাশের নিচে, কেউ গাছতলায় কিংবা নদীর পাড়েই মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে।
‘নাফের পানি ও তুফানে আমার ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। ঈদের দিনেও কোরবানি দিতে পারিনি, ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কিনতে পারিনি। এর চেয়ে বড় কষ্ট কিছু হতে পারে না।’-বলেন ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা আবুল আলী। আলোকিত শহরের ঈদ আনন্দের বিপরীতে এই দ্বীপে নেই রান্নার হাঁড়ি, নেই নতুন জামার ঝলক, শুধু অসহায়ত্ব আর কান্নার সুর।
ভাঙনের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধের আহাজারি
বৃদ্ধ আবুল আলী, কাঁপা গলায় হাতের ইশারায় দেখালেন যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানেই ছিল তার ছোট্ট ঘর। নাফের পানি একরাতে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ঘর, চুলা, শোবার জায়গা, কিছুই নাই আর। কতবার ঘর তুলুম? আমাদের দেখার কেউ নাই। বারবার আশার বাণী শুনিয়েছেন প্রশাসন। কেউ আজো কিছু দেয়নি। তবে কিছু করবে এমন আশায় আছি।’
ঈদের রান্নাও থেমে গেছে
বৃদ্ধা চলেমা খাতুন বলেন, ‘নাফের পানি চুলোতে ঢুকে ভেঙ্গে গেছে। এখনো রান্না করতে পারি না। ঈদের দিনেও ছেলে-মেয়েদের মুখে ভাত দিতে পারি নাই। নতুন কাপড় তো দূরের কথা। কোরবানিও করা সম্ভব হয় নাই। সাহায্য আসলেও তা আমরা পাই না।’
শুধু আবুল আলী বা চলেমা খাতুনই নন, এমন গল্প আজ জালিয়াপাড়ার শত শত পরিবারের। ঈদের সময় যখন দেশের অন্যপ্রান্তে আনন্দে মুখর প্রতিটি বাড়ি, তখন এই দ্বীপে ঈদ মানে কষ্ট, ভাঙা ঘর, খালি পেট, আর ভেজা চোখ।
আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি—কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেই
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, বহুবার প্রশাসনের লোকজন এসেছেন, ছবি তুলেছেন, কথা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো সহায়তা তারা পাননি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন,
‘কেবল ছবি তুললে আর রিপোর্ট করলেই কি ঘর ফিরে পাই? আমরা তো বাস্তব সাহায্য চাই।’ এক দশকের বেশি সময় ধরে চলছে নদীভাঙনের আতঙ্ক। শাহপরীর দ্বীপে নাফ নদীর ভাঙন নতুন নয়। ২০১২ সালের ভয়াবহ সামুদ্রিক জোয়ারে এই দ্বীপের চারটি পাড়ার অনেক ঘরবাড়ি, মসজিদ, দোকান সাগরে বিলীন হয়ে যায়। নোনা পানি নষ্ট করে দেয় কৃষিজমি, নিশ্চিহ্ন হয় গ্রাম, গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজারো মানুষ। কিন্তু এত বড় অভিজ্ঞতার পরও দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০২৫ সালের এই ঈদুল আজহার সময়, ইতিহাস যেন আবার নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে—আর এই পুনরাবৃত্তি শুধু কষ্টের, শুধু কান্নার। ধ্বংসের চিত্র এখনো স্পষ্ট জালিয়াপাড়ার বিভিন্ন স্থানে এখনো পড়ে আছে ভাঙা কাঠামো, উপড়ে যাওয়া গাছের শিকড়, পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া ঘরের চিহ্ন। পথচারীদের চোখে-মুখে শোক, মুখে একটাই প্রশ্ন—‘এই ভাঙন কি আর থামবে না?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন জানান, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়ায় যেসব বাংলাদেশি নাফ নদীর ভাঙনে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের তালিকা করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
মন্তব্য