দেশের সমাজ বাস্তবতার কারণে মানসিক বিষণ্নতায় ভোগেন অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েরা। তাদের এই সংকট দূর করতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার একটি মডেল দাঁড় করিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, স্কুলভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের বিষণ্নতার অবস্থা পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব। এর জন্য একজন মাকে গুণতে মাত্র ৮০ টাকা।
গবেষণার মাধ্যমেই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে আইসিডিডিআরবি।
রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্লোবাল মেন্টাল হেলথ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি সম্পর্কে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নেতিবাচক ধারণা ও সেবাদানে বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশে যে শিশুদের অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার রয়েছে, তাদের মায়েদের প্রতি দুই জনের মধ্যে একজন বিষণ্নতায় ভোগেন।
২০১৭ সালে একটি গবেষণার অংশ হিসেবে বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সার্ভিস নামে একটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করে ঢাকার অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এবং সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অফ অটিস্টিক চিলড্রেন।
গবেষণাটির শিরোনাম ছিল ফিজিবিলিটি অফ ইমপ্লেমেন্টিং আ মেন্টাল হেলথ কেয়ার প্রোগ্রাম অ্যান্ড হোম বেসড ট্রেইনিং ফর মাদারস অফ চিলড্রেন উইথ অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ইন এন আরবান পপুলেশন ইন বাংলাদেশ (মেনথল)।
গবেষণায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবার একটি পদ্ধতি পরীক্ষা করেন গবেষকরা। দেশের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিটি প্রণয়নে সহায়তা করেন।
বিশেষভাবে সাজানো এই সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সেবাটি বিদ্যালয় দুটিতে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ছয় মাসের জন্য চালু করা হয়েছিল। এটি ওইসময়ে বিদ্যালয় দুটিতে অধ্যয়নরত সব শিশুর মায়েদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
এই পদ্ধতিটি প্রয়োগে বেশির ভাগ মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি।
সংস্থাটি বলছে, বিষণ্ণতা পরিমাপের স্কেল অনুযায়ী যেসব মায়েদের পূর্বে বিষণ্নতা ছিল তাদের ৪০ শতাংশ এবং যেসব মায়েদের বিষণ্নতা ছিল না তাদের ২৩ শতাংশের মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। সেবাটি নিতে একজন মাকে খরচ করতে হয়েছিল মাত্র ৮০ টাকা।
চারটি সেশন নেয়ার পর প্রায় অর্ধেক মায়েদের মানসিক অবস্থার উন্নতি দেখা গেছে বলেও জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি। এত তাদের জীবনযাত্রার মানেও উন্নতি দেখা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্যানেলের সদস্য, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ এই গবেষণাপত্রের একজন লেখক।
তিনি বলেন, ‘অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বাবা-মা শুধুমাত্র শিশুকে লালন-পালনের চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করে না বরং প্রতিনিয়ত সামাজিক বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা এখনও একটি অবহেলিত বিষয়।’
মেনথল গবেষণা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কীভাবে দেয়া যেতে পারে এবং কীভাবে একটি বিশেষায়িত সেবায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে সেবাটিকে কার্যকর করা যায়।’
মেনথল গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক প্রফেসর কেরিম এম মুনির বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের বিষণ্নতার হার বেশি এবং এই বিষণ্নতা জীবন যাপনের মান অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, যা শিশুর যত্ন নেয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’
মেনথল সার্ভিস মডেল অটিজম এবং মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মতো দুটি সংবেদনশীল বিষয়কে একসঙ্গে সেবা দিতে পারছে বলেও মনে করেন তিনি।
কেরিম এম মুনির বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, খুব অল্প খরচে এবং খুব অল্প সময়ের ভেতরে এই পদ্ধতি সুফল দিয়েছে, যা সত্যিই অসাধারণ।’
হার্ভাড মেডিক্যাল স্কুল গ্লোবাল হেলথ ডেলিভারি-দুবাইয়ের ডিরেক্টর প্রফেসর সালমান এ কেশাভজি বলেন, ‘এই গবেষণাটি দেখিয়েছে যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকেও কীভাবে উচ্চ মানের সেবা প্রদান করা যায়, যেটি তাদের ভীষণ প্রয়োজন।’
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটিকে একটি রোডম্যাপ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
গবেষণার ফল নিয়ে প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. আলিয়া নাহিদ বলেন ‘আমি আনন্দিত যে আমরা একটি সাশ্রয়ী মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মডেল খুঁজে পেয়েছি, যা বাংলাদেশ এবং অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে বড় পরিসরে সহজে প্রয়োগ করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে৷’
বাংলাদেশের যেখানেই অটিজম সেবার সুযোগ রয়েছে সেখানেই দ্রুততম সময়ে এই সেবা মডেলটি চালুর সুপারিশ করেছেন তিনি।
আলিয়া নাহিদ বলেন, ‘নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে তাদের অটিজম সেবার সঙ্গে মেনথল সার্ভিস মডেলকে যুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করার কাজটি এখনই শুরু করা উচিত।’
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সব শ্রেণীর জনগণের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহজে পৌছে দেয়া সম্ভব বলেও মনে করেন আলিয়া।
আইসিডিডিআরবির সায়েন্টিস্ট ও ইনিশিয়েটিভ ফর ননকমিউনিকেবল ডিজিজেসের হেড ড. আলিয়া নাহিদের গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন।
আর এতে সহযোগিতা যুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন চিলড্রেন্স অ্যান্ড হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল, সূচনা ফাউন্ডেশন, ইন্সটিটিউট অফ পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড হসপিটাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটাল।
বিষণ্নতা ভুলতে ফেসবুকের নিউজ ফিডে ক্রমাগত স্ক্রল করার দিকে ঝুঁকলে অথবা রকমারি সব স্ট্যাটাস দিতে থাকলে আপনি ভুল করছেন। গবেষণা বলছে, বিষণ্ন মানুষের ফেসবুক আসক্তি মনকে আরও বিবর্ণ করে তোলে।
গবেষণাটি সম্প্রতি কম্পিউটার্স ইন হিউম্যান বিহেভিয়ার সাময়িকীতে প্রকাশ হয়েছে। এতে তুলে ধরা হয়েছে মানসিক সুস্থতার ওপর ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব।
গবেষকেরা বলছেন, যারা যত বেশি সময় ফেসবুক ব্যবহার করেন তত বেশি হতাশায় আক্রান্ত হন। আত্মমর্যাদার ঘাটতিতে ভুগতে থাকে মানুষ। বিষয়টিকে ‘ফেসবুক ডিপ্রেশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন গবেষকেরা।
অবশ্য ফেসবুকের পেছনে ব্যয় করা সময়ের চেয়ে এই মাধ্যমের প্রতি আসক্তিকে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে পাওয়া গেছে গবেষণায়। দেখা গেছে, ফেসবুকে অতিরিক্ত আসক্তি মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।
গবেষণাটির মূল লেখক মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সুন লি লি বলেন, ‘প্রযুক্তির ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়ছে। এই নির্ভরতা আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে তা জানা প্রয়োজন।’
মালয়েশিয়ায় আড়াই শ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওপর চালানো হয়েছে গবেষণাটি, যাদের প্রত্যেকেই বিষণ্নতায় ভুগছেন। অংশগ্রহণকারীরা দুটি অনলাইন জরিপে অংশ নেন। প্রথম জরিপটি করা হয় গবেষণার শুরুতে। এর ছয় মাস পর চালানো হয় দ্বিতীয় জরিপ। অংশগ্রহণকারীদের ফেসবুকনির্ভরতা ও নিজের প্রতি হতাশার প্রবণতা পর্যালোচনা করেন গবেষকেরা।
গবেষক সুনের মতে, যারা অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার করেন তারা অন্যদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে চান। এ জন্য তারা নিয়মিত তাদের পরিচিতদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপডেট জানান। এটি করার মাধ্যমে হয় তাদের ফেসবুকনির্ভরতা আরও বাড়ে, নয়তো নিজের দুর্বলতা নিয়ে হতাশাবোধ বাড়ে। এতে মানুষের আত্মমর্যাদার ঘাটতি তৈরি হওয়ার পাশাপাশি বিষণ্নতার মাত্রা বাড়তে থাকে।
গবেষণার সামগ্রিক ফল বলছে, ফেসবুকের অতি ব্যবহার হতাশাগ্রস্ত মানুষের জন্য আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আরও দুর্বিষহ করে তোলে। এমনকি ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সুন লি লির মতে, বিষণ্নতায় আক্রান্তদের ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘যারা তীব্র হতাশায় ভুগছেন তাদের জন্য আমাদের গবেষণাটি সহায়ক হবে। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির অতি ব্যবহার বিষণ্নতার তীব্রতাকে বাড়িয়ে তোলে।’
আরও পড়ুন:উত্তর ভারতের প্রয়াগরাজ শহরের ট্রাক চালক শ্যাম (ছদ্দনাম)। স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ায় ছয় মাস ধরে যৌন সম্পর্ক করতে পারছেন না তিনি। ভীষণ অস্থিরতায় ভুগছিলেন, এমন সময় ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের এক বিজ্ঞাপন দেখে পুলকিত হয়ে যান শ্যাম।
দেরি না করে গোলাপী থিমের ওয়েবসাইটে ঢোকেন শ্যাম। সেখানে তাকে ৪ হাজার ভারতীয় রুপি জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হয়েছিল।
বাড়ির পাশের ব্যাংকে অর্থ জমা দিয়ে শ্যাম বাড়ি ফিরেই ওয়েবসাইটে ঢোকেন। কিন্তু এবার সেবা দেয়ার জন্য আরও অর্থ চাওয়া হয়। বলা হয়, কেবল সাইবার-সেক্সের একটি সেশনের জন্য ৬ হাজার রুপি জমা দিতে হবে। সেই অর্থও দেন শ্যাম। তারপর তাকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি ভিডিও কলের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়।
কয়েক ঘণ্টা পর একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ভিডিও কল পান শ্যাম। শার্ট খুলে শ্যাম ফোনের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কলটা রিসিভ করে। কয়েক সেকেন্ড পর পর্দায় এক নগ্ন যুবতী হাজির হন। যুবতী তার নগ্ন দেহ হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। তারপর কলটা কেটে যায়।
হঠাৎ লাইন কেটে যাওয়ায় বিরক্ত হন শ্যাম। কল কেন কেটে গেল তা বোঝার আগেই ওই নম্বর থেকে একটা হোয়াটঅ্যাপ মেসেজ আসে তার মোবাইলে। সঙ্গে ছিল কিছুক্ষণ আগের সেই ভিডিও কলের রেকর্ডিং।
মেসেজে বলা হয়, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ হাজার রুপি জমা দিন। নয়তো এই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যাবে।’
২০ হাজার রুপি বেতনে চাকরি করেন শ্যাম। এই অর্থ দিয়ে চার সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। শ্যাম হিসাব করে দেখেন, সব খরচ বাদ দিয়ে এই ১৫ হাজার রুপি জমাতে তার ১০-১২ মাস লেগে যাবে।
শ্যাম বলেন, ‘আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। এ কারণে ছেলের টিউশনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করছিলাম, তাতে হাত দিতে বাধ্য হই।
‘তারপরের কয়েদিন স্বস্তিতে ছিলাম। একদিন আবার কল আসে। এসএমএসে আমাকে এবার ৩০ হাজার রুপি দিতে বলে। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে সে অর্থ দিই।’
ভারতে অনলাইন যৌন নির্যাতনের শিকারের সংখ্যা আশংকাজনকহারে বাড়ছে। শ্যাম সেই দলের একজন।
অনলাইন সেক্সটর্শন স্ক্যামের পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও, ২০২১ সালে ভারতে ৫২ হাজার ৯৭৪টি সাইবার ক্রাইমের রেকর্ড আছে পুলিশের কাছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৯ সালের চেয়ে সংখ্যাটা ৪৪ হাজার ৭৩৫ বেশি৷
ভারতের তথ্য-প্রযুক্তি আইন ২০০০ এর ধারা ৬৭ এর অধীনে এ সংক্রান্ত ১৩ হাজার ১৯৬টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এ আইনে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা বিতরণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ধরা হয়।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তথ্য-সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক চাপের ভয়ে অনলাইনে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো চেপে যায় বেশিরভাগ মানুষ।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রক্ষিত ট্যান্ডন বলেন, ‘এই প্রতারণাগুলো কোভিডের সময় বেশি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কারণ ওই সময় বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে থাকতেন এবং অনলাইনে বেশি সময় কাটাতেন।
‘স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটের অপ-ব্যবহারও বাড়ছে।’
স্ট্যাটিস্টা বলছে, ভারতে ৯৩২ মিলিয়নেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে, যা চীন ছাড়া অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। স্ট্যাটিস্টার ধারণা, এই সংখ্যা ২০৪০ সালের মধ্যে দেড় বিলিয়ন ছাড়াবে।
যেসব মানুষ একাকী কিংবা যৌন সম্পর্কহীন জীবনে আটকে আছেন তাদের পাশাপাশি অল্পবয়সী প্রাপ্তবয়স্করা (যৌনতায় মুখিয়ে যারা) সেক্সটর্শনের ঝুঁকিতে আছেন। অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরাও এই জালে আটকা পড়েন।
এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ডিভাইস চালাতে অদক্ষ লোকজনকে সহজেই বোকা বানাতে পারে প্রতারকরা। ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে সামাজিক মিডিয়া, ডেটিং অ্যাপস, স্প্যাম টেক্সট মেসেজ এবং অনলাইন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকেন তারা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় নারীর ছবি ব্যবহার করে তৈরি প্রোফাইল থেকে শিকারকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট বা মেসেজ দেয়া হয়। প্রতারকরা শিকারের অন্য বন্ধুদেরও সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। এতে ভুয়া প্রোফাইলটি নিয়ে সন্দেহ অনেকটায় কমে যায়।
ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টেলিগ্রাম গ্রুপে বা জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এবং ফোরামে প্রতারকরা তাদের সাইটের লিংক পোস্ট করে থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে তারা পর্নোগ্রাফিক ভিডিও বা যৌনকর্মীর ছবি ব্যবহার করেন।
বিশেষজ্ঞরা এই কৌশলটিকেও কার্যকর বলে মনে করছেন। আকর্ষণীয় কন্টেন্টের কারণে এগুলো দীর্ঘসময় মানুষ দেখে। এতে অনলাইন থেকে পোস্টকারী ভালো অর্থ উপার্জন করে।
যুক্তরাজ্যের সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম সোফোসের একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সেক্সটর্শন স্প্যাম মেসেজের মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ ডলার আয় করেছে পোস্টকারীরা।
কিছু প্রতারক তাদের ভিকটিমদের কাছ থেকে টাকা তোলার জন্য পুলিশের ছদ্মবেশ ধারণ করে বলে জানা গেছে।
রাজস্থানের নাগৌরের প্লাম্বার অজয় (ছদ্দনাম) মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার রুপি আয় করেন। তিনি বলেন, ‘একজন নিজেকে ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) সদস্য পরিচয় দিয়ে বলেন, ফেসবুকে যৌন কেলেঙ্কারিতে নাকি আমি জড়িত। ৬০ হাজার টাকার জন্য তিনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেন।
‘দ্বিতীয় দিনে আমি ওই নম্বরটি ব্লক করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পর ট্রুকলারে (কলার শনাক্তকরণ অ্যাপ্লিকেশন) ‘শ্যাম আইপিএস’ নামে একটি অজানা নম্বর থেকে কল পাই।
‘তিনি আমাকে বিষয়টি টাকার বিনিময়ে রফাদফার প্রস্তাব দেন। বলেছিলেন, তা না করলে চার বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে আমার। পরে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাউন্সেলরের সঙ্গে পরামর্শ করে নম্বরটি ব্লক করে দিই।’
ভুক্তভোগীদের ওপর যৌন নির্যাতনের প্রভাব কেবল অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যে সমাজে যৌনতা নিয়ে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা, সেখানে ভুক্তভোগীর মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
প্রয়াগরাজের ট্রাক চালক শ্যাম বলেন, ‘চলতি মাসের শুরুতে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর থেকে আমি রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার ভয় তো ছিলই। পাশাপাশি স্ত্রীর কাছে বিষয়টা ফাঁস হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকতাম।
‘একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে সন্তানের কথা ভেবে ফিরে আসি। আয়-রোজগারও বেশি ছিল না। মানসিক যন্ত্রণায় জীবন নরক হয়ে গিয়েছিল।’
‘মনস্তাত্ত্বিক খেলা’
জয়পুর পুলিশের সাইবার ক্রাইম কনসালট্যান্ট মুকেশ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতারকরা ভুক্তভোগীদের ‘অতিরঞ্জিত’ ভয়ের পাশাপাশি ভারতের সাইবার আইনের দুর্বলতায় সুযোগ নেয়।
‘ভিডিও ছড়ানোর ভয় একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। খুব কম ক্ষেত্রেই ভিডিও অনলাইনে পোস্ট করা হয়। কারণ প্রতারকরা জানেন, এটা করলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তারা ফেঁসে যাবেন। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীরা মানুষের ভয় নিয়ে নিষ্ঠুর এক খেলায় মেতে উঠেন।’
সামাজিক ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী পুলিশের পরিবর্তে এনজিওর সাহায্য নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ এতে পরিচয় গোপন থাকার নিশ্চয়তা বেশি।
ভারতের প্রথম সাইবার ক্রাইম এনজিও সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মিলিন্দ আগরওয়াল বলেন, ‘অধিকাংশ ভুক্তভোগী আমাদের কাছে বানোয়াট গল্প নিয়ে আসে। সম্মানহানির ভয়ে তারা পুলিশের কাছে যেতে চায় না।
‘শুরুতে আমরা তাদের বোঝাই ফুটেজ অনলাইনে পোস্ট করা হবে না। দ্বিতীয়ত, আমরা তাদের অ্যাকাউন্ট বা নম্বর আগামী দুই থেকে তিন দিনের জন্য ব্লক করতে বলি। অজানা কল বা মেসেজের উত্তর দিতে না বলি। বহিরাগতদের সঙ্গে যোগাযোগের খবর আমাদের জানাতে বলি।
‘প্রতারকরা দুই থেকে তিন দিন আপনাকে অনুসরণ করবে। তারপর থেমে যায়। এই কৌশলটি প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজ করেছে।’
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) বলছে, সাইবার ক্রাইম মামলার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ গঠন হয়।
পুলিশের উদাসীনতা, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং ফরেনসিক সংস্থানগুলোর ঘাটতির কারণে এসব ঘটনায় বিচার কম হয় বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
আগরওয়াল বলেন, ‘আপনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হন, তবে কেবল হুমকির অভিযোগ নিয়ে আসলে পুলিশ তা নথিভুক্ত করবে না। অনলাইনে ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ভিন্ন কথা।
‘প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।’
প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে সাইবার ক্রাইম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট আইনটি প্রায় ২০ বছরের পুরনো; কেবল একবার এটির সংশোধন হয়েছে।
মধ্যপ্রদেশের হাইকোর্টের আইনজীবী শশাঙ্ক তিওয়ারি বলেন, ‘প্রযুক্তির উন্নতির কারণে কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং নেটওয়ার্কের শক্তি বাড়ছে। এই অগ্রগতির সঙ্গে সাইবার ক্রাইমও বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ কমাতে অবশ্যই কঠোর শাস্তির আইন করতে হবে।’
স্টেট ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল শরৎ কবিরাজ বলেন, ‘রাজস্থান যৌন নির্যাতনের একটি হটস্পট। তাই আমরা অন্যান্য রাজ্যের পুলিশকে সহায়তা প্রদানের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি।
‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আন্তঃরাজ্য সাইবার ক্রাইম ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন করেছে। অপরাধীরা মূলত সিস্টেমের দুর্বলতাকে কাজে লাগায়। তাই সিম কার্ড ইস্যু করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং গ্রাহককে জানার পদ্ধতিগুলো কঠোর করা উচিত।’
সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌন নির্যাতনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়া এড়াতে ভারতকে অবশ্যই আইন সংস্কার করতে হবে। পুলিশিং ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে এবং যৌনতার সঙ্গে জড়িত ‘সামাজিক ট্যাবু’ দূর করতে হবে।
শ্যাম এবং অজয়ের মতো ভুক্তভোগীরা এখনও মনে করেন, তাদের কাছে আইনি কোনো উপায় নেই। এনজিওগুলোর কাউন্সেলিং-ই তাদের একমাত্র ভরসা।
অজয় বলেন, ‘আমার মতো একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে কেন তারা বেছে নিল? সিস্টেমের কাছে আমি কোনো বিষয় না হলেও, সমাজের কাছে আমি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।’
দেশে ক্যানসারের রোগী সংখ্যা ১৫ থেকে ১৮ লাখ এবং বছরে এক লাখের বেশি মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন। বলেছেন, করোনাভাইরাতে গত দুই বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার তিন গুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে ক্যানসারে।
এই মৃত্যুর একটি বড় অংশই হয় জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসারে। প্রতি ১৩ হাজার মানুষের মধ্যে ৭ স্তন ক্যানসারে এবং প্রতি ৮ হাজারের মধ্যে ৫ জন জরায়ু ক্যানসারে মারা যায়।
বুধবার রাজধানীতে জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার নিয়ে এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘নারীদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যানসার ও জরায়ু ক্যানসারে অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে নিজেদের প্রথমে সচেতন হতে হবে। তারপর স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে শনাক্ত করতে হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আগে জানতে হবে রোগগুলো কেন হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে হয়, পানি যদি পরিষ্কার না থাকে, আর্সেনিক থাকে তাহলেও রোগ হয়। খাবারে রঙ মেশানো হয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি খাবার আমরা খাচ্ছি। আমরা ধূমপান করি, তামাক সেবন করি। যার ফলে গলার ক্যানসার, পেটের ক্যানসার- এ রকম বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হই।’
উচ্চতর চিকিৎসা এবং চিহ্নিত করার জন্য স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ক্যানসার শনাক্ত করা যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা স্ক্রিনিং করতে আসবে, তাদেরকে পরীক্ষা করে ডাটা সংগ্রহ করে বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হবে।’
এ জন্য ২০০ টি স্ক্রিনিং স্পট চালু করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্ক্রিনিং করেই থেমে থাকা যাবে না। তার পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে।’
স্তন ক্যানসার শনাক্তে মেমোগ্রাফি নামে উচ্চতর স্ক্রিনিং ব্যবস্থা প্রতিটি হাসপাতালে চালু হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু জরায়ু এবং স্তন ক্যানসার নয়, সব ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা আমরা করব।’
বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে বলেও দাবি করেন মন্ত্রী। বলেন, ‘এই সফলতার জন্য আমাদের সব কিছু এখন স্বাভাবিকভাবে চলছে।
‘চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসক সমাজের পরিশ্রমের বিনিময়ে আমরা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি বলেই শিল্প কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে চলছে। প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিন হিরো হয়েছেন।’
প্রতিটি উপজেলায় কমিউনিটি পর্যায়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। ডায়রিয়া, কলেরা, পোলিও এখন নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বিশ্বে বাংলাদেশসই অসংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যানসার, কিডনি, হৃদরোগের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ অনিয়মিত জীবনযাপনের জন্য।’
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করে। থার্ড বা ফোর্থ স্টেজে আসার পর ডাক্তারদের আর কিছু করার থাকে না।
‘আমরা স্তন এবং জরায়ু ক্যানসারের স্ক্রিনিং এর জন্য আরও একটি ভবন তৈরি করতে যাচ্ছি। সবার সহযোগিতায় আমরা এই সেক্টরেও সফলতা অর্জন করব।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ ও শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একেএম আমিনুল মুরশিদ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও নার্সরাও।
আরও পড়ুন:
দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। অন্য কারণের পাশাপাশি অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সঠিক সচেতনতা এবং সমন্বিত চিকিৎসা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে স্ট্রোকের মৃত্যুঝুঁকি ও পঙ্গুত্ব কমানো সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রোববার আয়োজিত স্ট্রোক বিষয়ক এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এমন তথ্য তুলে ধরেন।
বিএসএমএমইউ-এর শহীদ ডা. মিল্টন হলে এই সেমিনারের আয়োজন করে নিউরো সার্জারি বিভাগ।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হলে অনেক মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। তবে স্ট্রোকের চিকিৎসা করার চেয়ে স্ট্রোক প্রতিরোধ করাটা জরুরি। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
‘খাবারে বাড়তি লবণ না খাওয়া, ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করা, নিয়মিত শরীর চর্চা করা, স্ট্রেস না নেয়া, ধূমপান না করার ওপর জোর দিতে হবে। মোবাইল ফোন কম ব্যবহার করতে হবে। অধিক সময় মোবাইল ফোন নিয়ে বসে থাকলে স্ট্রেস বেড়ে গিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।’
বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালিত হয়েছে ২৯ অক্টোবর, শনিবার। ‘জানুন স্ট্রোকের লক্ষণ, মিনিটেই বাঁচিয়ে দিন বহু জীবন’ স্লোগান নিয়ে বিএসএমএমইউ-তে দিবসটি পালিত হয়।
ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে রোববার সকালে বিএসএমএমইউ-এর নিউরোলজি, নিউরো মেডিসিন ও নিউরো সার্জারি বিভাগ পৃথক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এছাড়াও নিউরো সার্জারি বিভাগ আয়োজন করে বৈজ্ঞানিক সেমিনার।
সেমিনারে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ জন স্ট্রোকের কারণে মারা যাচ্ছে। বিশ্বে প্রতি হাজারে ৮ থেকে ১০ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। আর স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর ৪৮ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ থাকে।
বিশ্বে প্রতি লাখে ২ থেকে ১৩টি শিশু স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। শিশুদের স্ট্রোকের অর্ধেক হয় রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে। বাকি অর্ধেক হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে। ২৫ ভাগ শিশু বার বার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত ৬৬ ভাগ শিশুর হাত-পায়ের দুর্বলতা ও খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। স্ট্রোক শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়।
বাংলাদেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটা জরুরি। এই সময়ের মধ্যে জরুরি চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হলে রোগীর মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব কমানো সম্ভব। শতকরা ৮০ ভাগ স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী ওষুধের মাধ্যমেই সুস্থ হয়।
সেমিনারে আরও বলা হয়, স্ট্রোক প্রতিরোধে ৭টি পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাবারে তেল ও লবণের ব্যবহার কমানো, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখা, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা ও স্ট্রেস কমাতে নামাজ, উপাসনা বা মেডিটেশন করা।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউ-এর নিউরো সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আখলাক হোসেন খান।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন, অধ্যাপক ডা. হারাধন দেবনাথ, অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল, অধ্যাপক ডা. আবু নাসার রিজভী, অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, অধ্যাপক ডা. ধীমান চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. মওদুদুল হক, অধ্যাপক ডা. আইউব আনসারী, অধ্যাপক ডা. সুকৃতি দাস, অধ্যাপক ডা. হাসান জাহিদুর রহমান, অধ্যাপক ডা. কনোজ কুমার বর্মন, অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. সুভাষ কান্তি দে, সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে এম তারিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রকিবুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল আমিন ও ডা. খায়রুন নবী খানসহ অন্যান্য শিক্ষক ও চিকিৎসকবৃন্দ সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:সন্তান জন্মদান কেন্দ্র করে মায়ের শরীরের নানান পরিবর্তনের তথ্য কমবেশি সবার জানা। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সন্তানের কারণে বাবার শরীরেও আসে পরিবর্তন। বিশেষ করে পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করা বাবাদের মস্তিষ্কে ঘটে গঠনগত রূপান্তর।
মগজের এই পরিবর্তনের কারণে সন্তানের প্রতি বাবাদের বাৎসল্যের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে তৈরি হয় নতুন দায়িত্ববোধ।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন প্রমাণ পেয়েছেন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা। সেরিব্রাল কর্টেক্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে তারা বলছেন, বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করা পুরুষ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও দৃশ্যমানতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মস্তিষ্কের কর্টিকাল অঞ্চলে স্পষ্ট পরিবর্তন অনুভব করেন।
মাতৃত্বের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া নারীদের মস্তিষ্কে পরিবর্তন পর্যালোচনার জন্য গবেষণাটি শুরু হয়েছিল। তবে পরে এর সঙ্গে পুরুষের মস্তিষ্কে পরিবর্তনের বিষয়টিও যাচাই করা হয়।
বিজ্ঞানী দলের সদস্য ছিলেন মাদ্রিদের ইনস্টিটিউটো ডি ইনভেস্টিগেশন স্যানিটরিয়া গ্রেগোরিও মারাননের স্নায়ুবিজ্ঞানী ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ-গার্সিয়া।
তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল গর্ভাবস্থা ও প্রসবোত্তর পরিস্থিতির সঙ্গে মাতৃমস্তিষ্কের অভিযোজনকে পর্যবেক্ষণ করা। এ জন্য আমরা প্রজনন অভিজ্ঞতার বাইরের কারণ- যেমন শিশুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের পরিবর্তনের দিকটি আলাদা করতে চেয়েছি। আর সেটি করতে গিয়েই বাবাদের মস্তিষ্ক নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি হয়।’
গবেষণায় ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ ও তার সহকর্মীরা প্রথম সন্তানের জন্মের আগে ও পরে ৪০ জন পুরুষের স্ট্রাকচারাল নিউরোইমেজিং ডেটা পরীক্ষা করেছেন। পাশাপাশি নিঃসন্তান ১৭ পুরুষের মস্তিষ্কও পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করা পুরুষদের কর্টেক্সে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে থাকে। বিশেষ করে মনোযোগ, পরিকল্পনা এবং প্রয়োগ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত মস্তিষ্কের বাইরের স্তরে এই পরিবর্তন সুস্পষ্ট। বিপরীতে নিঃসন্তান পুরুষদের গ্রুপে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাবাদের ক্ষেত্রে ভিজ্যুয়াল সিস্টেম এবং মস্তিষ্কের স্বাভাবিক নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকা কর্টিকাল উপাদানের মাত্রা কমে যায়। ফলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকে বেশি মনোযোগী হন পুরুষ। অতীতের অভিজ্ঞতাকে বেশি মাত্রায় বিশ্লেষণে সক্ষম হয় মস্তিষ্ক। গবেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে নবজাতকের প্রতি মায়ের পাশাপাশি বাবাদের বাৎসল্যের মাত্রাও বাড়তে থাকে।
ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ বলছেন, ‘মায়ের গর্ভাবস্থা এবং প্রসবোত্তর কাল- দুটি সময়েই বাবা-মায়ের মস্তিষ্কের একধরনের পুনর্গঠন হয়।’
বাবা হওয়া যে ৪০ জনের মস্তিষ্কের গঠন পর্যালোচনা করা হয়েছে তাদের মধ্যে অর্ধেক স্পেনের নাগরিক, বাকি ২০ জন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। মজার বিষয় হলো, দুটি মহাদেশের এবং দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির পুরুষদের বেছে নেয়া হলেও সবার ক্ষেত্রেই কর্টেক্সে একই ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মাধ্যমে বলা যায় পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা পাওয়া বাবাদের মস্তিষ্কে পরিবর্তনের বিষয়টি সর্বজনীন।
ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ বলছেন, ‘কর্টিকাল অঞ্চলে এই পরিবর্তন সামাজিক জ্ঞান, মনোযোগ এবং সহানুভূতিবোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমরা বাবা-মা দুজনের ক্ষেত্রেই কর্টেক্সের পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছি। এই পরিবর্তন সন্তানের প্রতি তাদের মনোযোগ আরও গভীর করতে সাহায্য করে।’
আরও পড়ুন:যান্ত্রিক এই রাজধানী শহরে শিশুদের জন্য নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। সে কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুদের সেই চাহিদা পূরণে কাজ করছে ‘বাবুল্যান্ড’।
রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ‘বাবুল্যান্ড’-এ শনিবার আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।
‘বাবুল্যান্ড’ দেশের সবচেয়ে বড় ইনডোর প্লে-গ্রাউন্ড। এখানে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার শিশুকে পরিষেবা দেয়া হয়ে থাকে।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, ঢাকায় খেলার মাঠের অভাব ঘুচাতে বর্তমানে শিশুরা উদ্বেগজনক হারে ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এটা মনস্তাত্ত্বিকভাবেও তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় ‘বাবুল্যান্ড’ শিশুদের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
সেমিনারে প্রধান বক্তা প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইশনাদ চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা শহরে মাত্র ২৯৪ একর খেলার মাঠ রয়েছে, যেখানে প্রয়োজন ১৮৭৬ একর বা ১৬ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রতিদিন ৭৭ শতাংশ শিশু পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম থেকে বঞ্চিত হয়। এটা পরবর্তীতে তাদের জন্য বিভিন্ন হৃদরোগ, এমনকি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর ইনডোর প্লে-গ্রাউন্ডের মাধ্যমে এই শূন্যতা পূরণ করতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তাই আমাদের এই উদ্যোগের লক্ষ্য।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের (বিআইপি) জরিপমতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে, যেখানে প্রয়োজন দুই হাজার চারশ’টি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান উই আর সোশ্যাল ও হুট স্যুটের দেয়া তথ্যমতে, খেলাধুলার সুযোগের অভাবে শিশুরা প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে কাটাচ্ছে। অল্প বয়স থেকে এমন বিঘ্নিত মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ পরবর্তীতে কিশোরদের মধ্যে তৈরি করতে পারে হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা।
প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক বলেন, “শিশুদের সেবা ও সঠিক যত্ন নিশ্চিত করতে আমরা ‘বাবুল্যান্ড সায়েন্স’ তৈরি করেছি। আমাদের শাখাগুলোতে রয়েছে অভিজ্ঞ ‘হ্যাপি হেলপার’, যাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেবা বৃদ্ধিতে আমরা প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করি। একইসঙ্গে নিয়মিত সুপার ফান ইভেন্ট, ভালো ভালো অভ্যাস গড়ার চর্চা, অ্যাক্টিভিটি ক্লাস ইত্যাদিও এখানে আয়োজন করা হয়।”
বর্তমানে রাজধানীর বাড্ডা, মিরপুর, উত্তরা ও ওয়ারীতে বাবুল্যান্ডের চারটি শাখা রয়েছে। সম্প্রতি বাবুল্যান্ড এঞ্জেল বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে ৪ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ পেয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটিকে দেশব্যাপী তাদের সেবার মান সম্প্রসারণ করতে এবং এর ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল চালুর মাধ্যমে আনন্দকে আরও ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে।
সেমিনারে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়িক অংশীদারসহ শিশু বিকাশে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিরা আলোচনা করেন।
আরও পড়ুন:গভীর প্রেমের সম্পর্ক নিমেষেই ভেঙে গেছে? যাকে প্রাণপণ ভালোবেসেছেন সেই মানুষটিই ছুড়ে ফেলেছে আপনাকে?
নিঃসন্দেহে সময়টি খুব খারাপ কাটছে আপনার, বেখাপ্পা লাগছে এতদিনের ভালোলাগা গানের কলি। বুকে চেপে বসা ভীষণ যন্ত্রণা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, সাড়া দিচ্ছেন না ফোনকলে। ফেসবুকের ওয়ালটি বড্ড পানসে লাগছে।
প্রতিটি সম্পর্কের আকস্মিক ফাটলের পেছনের গল্পগুলো সাধারণত এ রকমই। যে মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন প্রাণের অবলম্বন, তার বিদায়পর্ব মেনে নেয়ার কাজটি মোটেই সহজ নয়। পুরো দুনিয়া আপনার কাছে ঠেকতে পারে স্বার্থপর, আকস্মিক ভীষণ একা হয়ে পড়তে পারেন আপনি।
তবে সত্যিটা হলো, সময় ধীরে ধীরে মনের সব ক্ষত সারিয়ে দেয়। একটা সময় পর আমরা আবার স্বাভাবিকতায় অভ্যস্ত হতে শুরু করি। নতুন করে সাজিয়ে নিই জীবন।
তবে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের পক্ষে ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক ভুলে যাওয়া খুব কঠিন। এসব মানুষের জন্য দরকার হতে পারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। এ ছাড়া এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যারা গেছেন, তারাও হতে পারেন আদর্শ।
ব্রেকআপের ধাক্কা সামলানোর কিছু উপায় জানিয়েছে সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইস। সেগুলো তুলে ধরা হলো নিউজবাংলার পাঠকের জন্য।
বিচ্ছেদ যন্ত্রণাকে অনুভব করতে দিন
বেলজিয়ামের এন্টওয়ার্প শহরের শিক্ষক শার্লট ভ্যান গিন্সবার্গেনের বয়স ৩৬। ব্রেকআপের পর একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন শার্লট। তিনি বলেন, ‘ব্রেকআপটি আমার জন্য একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। অনেক বছর আমরা একসঙ্গে ছিলাম। ভেবেছিলাম সারা জীবন এভাবেই কাটবে। ব্রেকআপের পর প্রায়ই মনে হতো, আবার হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।
‘ফেসবুক মেসেঞ্জারে ও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথাটি জানিয়েছিল। ও তখন দেশে ছিল না। বিদেশ থেকেই আমার সঙ্গে প্রতারণা করে।’
আপনি যদি জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তবে শুরুতেই নিজের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। মনে রাখবেন, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা খুব স্বাভাবিক। ঘুম ভাঙলেই মনে হতে পারে আপনি জলন্ত উনুনে পুড়ছেন। কষ্টের এই মুহূর্তটিকে এড়ানোর চেষ্টা করার দরকার নেই।
সাইকোথেরাপিস্ট লরি সিঙ্গার বলেন, ‘ভালো না লাগা বিষয়গুলো মেনে নেয়া আমাদের জন্য কঠিন। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে গেলে প্রথমেই মেনে নিতে হবে এই কষ্ট পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। দুঃসময় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরুর প্রথম ধাপ এটাই হতে পারে।’
যোগাযোগ একদম বন্ধ করে দিন
যার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপনি কথা বলেছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছেন, তাকে নিমেষে অগ্রাহ্য করা সহজ কিছু না। ব্রেকআপের পর আপনি বারবার প্রাক্তনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অধীর হয়ে উঠতে পারেন। ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে তার কোনো পোস্টে কমেন্ট করতে ব্যাকুল হতে পারে মন। তবে একদম এটা করবেন না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন।
জৈবিক নৃতাত্ত্বিক এবং ডেটিং অ্যাপ ম্যাচের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ডা. হেলেন ফিশার বলেন, ‘এটা প্রমাণিত, যখন ব্রেকআপ হয় তখন আসক্তি থেকে মস্তিষ্কের মৌলিক অঞ্চলের ক্রিয়াকলাপ অব্যাহত থাকে।
‘যে মানুষটি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন তিনি তার টেবিলে মদের বোতল রাখবেন না। ছেড়ে যাওয়া মানুষের ছবি, চিঠি দূরে রাখুন। তাকে ফোন করবেন না, মেসেজ দেবেন না। ফেসবুকে মিচ্যুয়াল ফ্রেন্ডের মাধ্যমে তাকে খুঁজবেন না। মনে রাখবেন সে আপনার মাথায় ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকতে চাইছে। তাকে আপনার ঝেড়ে ফেলতে হবে।’
সঙ্গীর সিদ্ধান্ত মেনে নিন
‘প্রাক্তনকে কীভাবে ফিরিয়ে আনবেন’ শিরোনামে কিছু বাজে নিবন্ধ অনলাইনে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। এতে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে ন্যূনতম ৩০ দিন সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়, যাতে এ সময়ের মধ্যে প্রাক্তন তার ভুল ভুল বুঝতে পারেন।
তবে এভাবে প্রাক্তনের মন পরিবর্তনের ভাবনা মাথা থেকে দূর করুন। চলে যাওয়া সঙ্গীর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানান। তার জন্য অপেক্ষা বন্ধ করুন। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সঙ্গী ফিরে আসে না।
কঠিন হলেও এটা বাস্তবতা। আপনি এমন কারও জন্য কেন অপেক্ষা করবেন যিনি তার জীবন থেকে আপনাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে!
নিজেকে সম্মান করা শিখুন। নিজেকে বেশি বেশি ভালোবাসুন।
অনুসরণ করা বন্ধ করুন
রাত গভীর হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি কি প্রাক্তনের ছায়া অনুসরণ করছেন? ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে অন্যের ট্যাগ করা কোনো ছবিতে তাকে খুঁজছেন? প্রাক্তন কী করছেন, কাদের সঙ্গে তার মেলামেশা তা নিয়ে নানান অনুমানে নিজেকে মগ্ন রাখছেন? এসবই বন্ধ করুন।
উইল্টশায়ারের ২২ বছরের তরুণী সাশা মেইনকে তিন বছর আগে আকস্মিক তার সঙ্গী ছেড়ে যান। সে সময়ে অনেক ভুগেছেন সাশা। তিনি বলছিলেন, ‘আমার মনে হয় তখন যে কাজটি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে সেটি হলো তাকে ফেসবুকে ব্লক না করা।’
প্রাক্তন কী করছেন তা জানার চেষ্টা করা অবশ্যই স্বাভাবিক, তবে আপনি যা-ই খুঁজে পান না কেন তা আপনাকে প্রশান্তি দেবে না।
সাশা বলেন, ‘তখন করোনার কারণে লকডাউন চলছিল। সব সময় ওর ফেসবুক প্রোফাইল চেক করতাম। নতুন গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে যখন ওর ছবি দেখতাম, তখন ভেঙে পড়তাম।
সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং ডেটিং অ্যাপ সো সিঙ্কডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেসিকা অ্যাল্ডারসন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাক্তনের প্রোফাইল ঘেঁটে আপনি কখনোই ইতিবাচক কিছু অনুভব করবেন না। আপনাকে আসলে ভাবতে হবে কী করলে আনন্দিত হবেন। মনে রাখবেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও স্ট্যাটাস দেখে মানুষের সত্যিকারের অবস্থান বোঝা বেশ কঠিন।’
নিজের প্রতি মনোযোগ দিন
এখনই সেই সময় যখন আপনাকে বিশ্বের সবচেয়ে স্বার্থপর ব্যক্তি হতে হবে। আপনি যা চান তার সবকিছু করুন। রেস্তরাঁয় সঙ্গীর অপছন্দের কারণে যে খাবারটি এতদিন মুখে তোলেননি, সেটি এবার পেটপুরে খান। তার কারণে যদি আপনি যদি নাকে ছিদ্র না করে থাকেন, তাহলে এখনই সময়। পারলারে ছুটে যান।
ইচ্ছা থাকলেও যে সিনেমাগুলো সঙ্গীর কারণে দেখেননি, সেগুলো চুটিয়ে দেখতে বসুন। নতুন নতুন রান্নাপ্রণালি আবিষ্কারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করুন। সপ্তাহান্তে কোথাও ঘুরে আসুন।
বিশ্বাস করুন আপনি পারবেন। আপনাকে আনন্দ দেয়া বিষয়গুলো খোঁজা অনেক জরুরি। এই অন্বেষণ আপনার হৃদয়ের ক্ষত পূরণে সাহায্য করতে পারে।
শার্লট বলেন, ‘বছরের পর বছর মনে হতো সে ছিল আমার পারফেক্ট ম্যাচ। এমন সঙ্গী জীবনে আর পাব না। এই ভাবনা আমাকে পিছিয়ে দিয়েছিল। আসলে কেউ কারও জন্য পারফেক্ট নয়। এটা করে নিতে হয়।’
আপন গতিতে এগিয়ে যান
বলা হয়ে থাকে, কাউকে পেতে হলে তার কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়। এটা কি সত্যিই জরুরি? উষ্ণ কোনো নতুন শরীর অবশ্যই আপনাকে পুরোনো সুখ দিতে পারে। তবে তাই বলে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কাটাতে হুট করে কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন না। এটা দুই পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য সম্পর্কে জড়াতে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। খারাপ সময় কাটিয়ে ওঠার জন্য নিজেকে আগে সময় দিন। আপনি নতুন একটি সম্পর্কে যেতে চান কিংবা সম্পর্কে থাকা দরকার কি না, তা আগে ভাবুন। সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত না নিলে পরে পস্তাতে হতে পারে।
প্রাক্তনের স্বাভাবিক জীবন দেখতেও নিজেকে তৈরি করুন
আপনার সাবেক সঙ্গী এখন হয়তো অন্য কারও সঙ্গে বিছানা গরম করছেন। আপনাকে নিয়ে তিনি যে রেস্তরাঁয় যেতেন সেখানে হয়তো যোগ হয়েছেন নতুন কেউ।
যেভাবে আপনাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলেন, সেই চুমুর অভিজ্ঞতা নেয়ার ঠোঁট এখন হয়তো অন্য কারোর। শুরুর দিকে এসব ভাবনা আপনাকে যন্ত্রণাকাতর করতেই পারে। তবে প্রাকৃতিকভাবেই ধীরে ধীরে এই অনুভূতি হালকা হয়ে আসবে।
নতুন এই সময়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। পরিস্থিতি হাসিমুখে গ্রহণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আপনাকে মনে রাখতে হবে যে সম্পর্কটি অস্বাস্থ্যকর ছিল। আপনি এখন এগিয়ে যাচ্ছেন, অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখছেন।’
মনে রাখবেন একদিন আর কষ্ট হবে না
শার্লট বলেন, ‘সবকিছু যেভাবে চলছিল, সেভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা একে-অপরকে সময় দেয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের বয়স কম ছিল। জানতাম না একটা সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নিতে হয়। সেটা বোঝার চেষ্টাও করিনি। আমার দারুণ যুগল ছিলাম। ভালোবাসায় পূর্ণ ছিল আমাদের জীবন।
‘আমি মনে করি শেষ পর্যন্ত আমরা দুজনেই একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমরা একসঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি এবং সময়ের পরিক্রমায় একে অপরকে হারিয়েছি।’
হয়ত শিগগিরই, হয়তো এখন থেকে কয়েক বছর পর আপনি বুঝতে পারবেন, ওই সম্পর্কটি আপনার পুরো পৃথিবী ছিল না; কিছু সময়ের জন্য প্রাক্তনের সঙ্গে আপনার পৃথিবী ভাগ করে নিয়েছিলেন মাত্র।
সঙ্গী চলে যাওয়া পর ইচ্ছামতো কাঁদুন, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যান। কিছুদিন পর নতুন সঙ্গী খুঁজে নিন। মনে রাখবেন, জীবন খুবই চমৎকার, যদি সেটা আপনি নিজের মতো গড়ে নিতে পারেন।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য