বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার বিরুদ্ধে হাতিয়ার মোটা চাল। দেশেও সরকারের দারিদ্র্যবান্ধব প্রায় সব কর্মসূচিই চলে মোটা চালে। অথচ ধান উৎপাদন পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেয়া হয় চিকন চালকে। আর্থসামাজিক উন্নতি এবং ভোক্তার রুচিবোধের পরিবর্তন বোঝাতে মোটা চাল ছেড়ে চিকন চাল বেছে নেয়াকে মাপকাঠি করা হয়।
উৎপাদন ও বাজার পরিস্থিতিতে চিকন ও মোটা চালের বাস্তবতা কী, তা জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে এখনও ৩ কোটি ৯১ লাখ থেকে ৪ কোটি ৮ লাখ ভোক্তা মোটা চাল খাচ্ছে। ভোক্তার মোটা চাল খাওয়ার প্রবণতা গত ২০ বছরে মাত্র ১ শতাংশ ওঠানামা করেছে। সেটিও হয়েছে বছরওয়ারি ধান উৎপাদনের তারতম্যের কারণে।
হাউব্রিড ধান থেকে পাওয়া যায় মোটা চাল। এর অনেক জাত থাকলেও সব কটি উৎপাদনে নেই। মূলত হীরা-২, হীরা-৫, হীরা-১৯সহ স্থানীয় কয়েকটি জাত মোটা চালের বড় অংশ সরবরাহ করে।
এর বিপরীতে মোট জনগোষ্ঠীর ৯ কোটি ৫২ লাখ তার সাধ্য অনুযায়ী খাচ্ছে বিভিন্ন মানের ‘মাঝারি মোটা চাল’। এর সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় ৫০ শতাংশ চালের জোগান দিচ্ছে উচ্চ ফলনশীল দুটি জাত ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯। বাকি অংশ মিলছে অন্যান্য হাইব্রিড ও উফশী জাত থেকে।
অন্যদিকে দেশে ১১ কোটি ৯০ লাখ ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি থাকলেও মাত্র ৩ কোটি ৪০ লাখ ভোক্তা খাচ্ছে চিকন চাল। অর্থাৎ দেশে অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে চিকন চালের ভোক্তা বাড়েনি। যেটুকু বেড়েছে, তা চালের বাজারে প্রবেশ করা মিলার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কারসাজির কল্যাণে।
এদিকে যে পরিমাণ চিকন চাল খাওয়া হয়, তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পশুখাদ্য হিসেবে যে চাল ব্যবহার হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই মিলাররা মিলপর্যায়ে মাঝারি মোটা ও মাঝারি চিকন চালকে মিলিং ও ওভার পলিশিং করে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে বের করছেন। কিছু চাল এনিমেল ফিড ঘোষণা দিয়ে আমদানিও হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে মোটা চালের ভোক্তা কমেনি।
তার প্রমাণ মেলে গত পাঁচ বছরের ভোগের পরিসংখ্যানে।
মোটা চালের ভোক্তা বরং বাড়ছে
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য অনুযায়ী, মোটা চাল খাওয়ার পরিমাণ নিছক কম নয়। গত পাঁচ বছরে মোট ৪ কোটি ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ৩৬০ টন মোটা চাল খাওয়া হয় দেশে। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোটা চাল খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮১ লাখ ১২ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৭ লাখ ৬ হাজার ৯৬০ টন। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাওয়া হয় ৮৭ লাখ ৩৬ হাজার টন। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৬ লাখ ৪ হাজার টন মোটা চাল খাওয়া হয়।
বর্তমানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতে রয়েছে দেশ। গত দুই বছরে সামাজিক শ্রেণি কাঠামোয় করোনার যে আঘাত লেগেছে, তার নেতিবাচক প্রভাবে আগের কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে। এতে দিন দিন মোটা চালের ভোক্তা আরও বাড়ছে। বিষয়টি টের পেয়েছে সরকারও। তাই আগের অবস্থান থেকে বের হয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নীতিনির্ধারকরা এখন মোটা চালের উৎপাদন বাড়ানোর রোডম্যাপের কথা বলছেন।
পরিকল্পনায় বদল আসছে
সরকারের উৎপাদন পরিকল্পনায় কেন মোটা চাল গুরুত্ব পাচ্ছে না, জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী দিনে অধিক উচ্চ ফলনশীল মোটা জাতের ধানের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর।’
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এ পদক্ষেপের ভালো একটা ফলাফল আমরা আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে পাব।’
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন ও কৃষি বিজ্ঞানী ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস নিউজবাংলাকে মোটা চাল প্রসঙ্গে বলেন, ‘ময়মনসিংহে বিরুই চালের ব্যাপক উৎপাদন হয় এবং স্থানীয়রা এই চাল খায়; আবার সাপ্লাইও দেয়। এটা কিন্তু চিকন না। বরিশালে প্রচুর মোটা ধান হয় এবং লোকে মোটা চাল খায়। সারা দেশের গ্রামেগঞ্জে এখনও বেশির ভাগ মানুষ মোটা চালের ভাত খায়। যারা বলেন, রিকশাওয়ালাও মোটা চাল খায় না কিংবা গরুকে খাওয়ানো হয়, এগুলো অপ্রাসঙ্গিক ও বিচ্ছিন্ন কথাবার্তা; অজ্ঞতাবশতও হতে পারে। এ ধরনের আলোচনা না টানাই ভালো।’
এসবে না গিয়ে তিনি যত দ্রুত সম্ভব অতি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত (হাইব্রিড) মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ধরে রাখার পরামর্শ দেন।
চাল চার ধরনের
দেশে বোরো, আমন ও আউস– এই তিন মৌসুমেই ধান উৎপাদন হয়, তবে সব মৌসুমের সব ফলনেই চাষ হয় উফশী এবং হাইব্রিড বা উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় জাত। বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য ২০১টি উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের ছাড়পত্র রয়েছে, তবে কৃষক পর্যায়ে সারা দেশে ১০৮টি জাতের ধান কম-বেশি চাষ হয়। এগুলো থেকেই চাহিদা অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রার ধান উৎপাদন হয়।
এসব ধান থেকে সাধারণত চার প্রকার চাল পাওয়া যায়। সেগুলো হলো মোটা, মাঝারি মোটা, মাঝারি চিকন ও চিকন চাল। এর মধ্যে কোন ক্যাটাগরির চালের কত শতাংশ ভোক্তা রয়েছে, তা জানার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কৃষি অর্থনীতি বিভাগ।
এ লক্ষ্যে সারা দেশে একটি জরিপ চালানো হয়। এই জরিপের সময় বিবেচনায় নেয়া হয় ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ২০ বছরকে। কোন বছর দেশে মোট কী পরিমাণ ধান-চাল উৎপাদন হয়েছে এবং ওই উৎপাদন থেকে কোন ক্যাটাগরির চাল কত শতাংশ মানুষ খেয়েছে, তা ছিল জরিপের বিষয়বস্তু।
২০২০ সালে এই জরিপটি শেষ হলেও অজ্ঞাত কারণে তা দেশে এখনও অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ জরিপটি সরকারের দায়িত্বশীল সব সংস্থার কাছে সংরক্ষিত।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে সেই অপ্রকাশিত জরিপের সারাংশ উঠে এসেছে।
ব্রি পরিচালিত এই জরিপে দাবি করা হয়, দেশে ১৭ কোটি মানুষ। বছরওয়ারি উৎপাদন বিবেচনায় মোটা চাল খায় জনগোষ্ঠীর ২৩ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া মাঝারি মোটা ও মাঝারি চিকন চাল খায় ৫৬ শতাংশ মানুষ। আর ২০ শতাংশেরও কম মানুষ খাচ্ছে চিকন চাল। এ তথ্যের সূত্র ধরেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিভিন্ন রকম চালের উল্লিখিতসংখ্যক ভোক্তার সংশ্লিষ্টতা মিলেছে।
‘গুরুত্বহীন’ মোটা চালেও কেন সংকট
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হালনাগাদ জরিপ অনুযায়ী দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ অতিদরিদ্র। আয়সীমা ও ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় এই দুই শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীই মোটা চালের ভোক্তা, যাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকার ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।
দরিদ্ররাই মোটা চালের একমাত্র ভোক্তা নয়। পারিবারিক সমৃদ্ধি আছে গ্রামের এমন অনেক পরিবারও মোটা চালে অভ্যস্ত। কিছু পরিবার নিজেরাই খাওয়ার জন্য ধান উৎপাদন করে, যেগুলো স্থানীয় ও মোটা জাতের।
এভাবে প্রতি বছর উৎপাদিত চালের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাজারে যাওয়ার আগেই অদৃশ্য হয়ে যায়। এসব কারণে মোটা চালের যত উৎপাদন হয়, তার সবটাই বাজারে পাওয়া যায় না। এর বাইরে ভোক্তাকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চিকন চাল খাওয়ানোর গোপন অপতৎরতা তো রয়েছেই।
এ কারণে সবখানে দোকানজুড়ে বস্তার খোলামুখে সাজানো থাকে বাড়তি দামের মাঝারি চিকন চাল কিংবা তার চেয়েও দামি চিকন চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল)। চিকন চালের দাম বেশি হওয়ায় এখন মোটা চালের দামও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম হলো কোনো পণ্যের সরবরাহ কম হলে এবং তার বিপরীতে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে। অর্থনীতির সেই চিরাচরিত প্রভাবই এখন বাজারে পড়ছে।
বাজারে এখন বছরজুড়ে মোটা চাল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, মাঝারি মোটা ৪৬ থেকে ৫২ টাকা, মাঝারি চিকন ৫২ থেকে ৫৮ টাকা ও চিকন (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা কেজির মধ্যে উঠানামা করছে, তবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত চালের দাম আরও বেশি।
এসব কারণে বর্তমান বাজার কাঠামো অনুযায়ী এ চাল কেনার রসদ জোগাতেও অনেকে দিনভর দিচ্ছে হাড়ভাঙা শ্রম। কেউ বা লজ্জা ভুলে মাসের হিসাবটা একটু সহজ করতে বিকল্প উপায় খুঁজছে। আরও একটু সস্তায় মোটা চাল পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সরকারের সুলভ মূল্যের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ওএমএসের দীর্ঘ লাইনে।
মোটা চালের সরবরাহ সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেশে চালের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে, তবে চাহিদা অনুযায়ী মোটা চাল কম। এতে দাম বেড়ে যাচ্ছে।
‘দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা ২০ লাখ টন চাল আমদানির মাধ্যমে মজুত বাড়িয়েছি। বিভিন্ন কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করছি। কিন্তু বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণেই দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।’
খাদ্যসচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, ‘প্রতি বছরই সরকার (খাদ্য মন্ত্রণালয়) দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে বাফার মজুতের চেষ্টায় থাকে। স্থানীয় পর্যায় থেকেই তা সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। গত বোরো মৌসুমেও সরকার ১৯ লাখ ৮০ হাজার টন ধান-চাল সংগ্রহের কর্মসূচি নিয়েছে।
‘এরই মধ্যে আমরা সেই লক্ষ্যমাত্রার প্রায় শতভাগ পূরণ করেছি। এর বাইরে বৈশ্বিক বাস্তবতায় আমরা চাল আমদানিও করেছি। দেশে এখন চালের স্মরণকালের রেকর্ড মজুত রয়েছে।’
পশুখাদ্যের দাবি অনর্থক
জাতিসংঘ বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা নিরসনে মোটা চালের উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড ধানের ফলন মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। ধান উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশও মোটা চালকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা ওই চাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করছে, কিন্তু বাংলাদেশের উন্নতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহ্মুদ মোটা চাল খাওয়া ও কুঁড়েঘরের ব্যবহার কমে যাওয়াকে নজির হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন রিকশাওয়ালাও মোটা চাল খায় না; মোটা চাল এখন গরুকে খাওয়ানো হয়।’
চালের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে উত্তর দিতে গিয়ে খোদ কৃষিমন্ত্রীও অনেক কারণের মধ্যে মোটা চালের কিছু অংশ এনিমেল ফিড হিসেবে ব্যবহারের তথ্য দেন, তবে উভয়ের মন্তব্যই অনর্থক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, “পশুখাদ্যের জন্য যে মোটা চালের কথা বলা হয়, তা খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দিয়েই কিছু পরিমাণ লো কোয়ালিটির ‘এনিমেল ফিড’ হিসেবে আমদানি করে থাকেন। সেগুলো কখনও কখনও অনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় অন্যভাবে মার্কেটে চলেও আসতে পারে, যা ভোক্তাকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে বিক্রি করতে গিয়ে এ রকম প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে আমদানি করা লোয়ার কোয়ালিটির চালের বাইরেও ভালো মানের মাঝারি মোটা ও মাঝারি চিকন চালের উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে এনিমেল ফিড তৈরি হচ্ছে।”
এত চিকন চাল আসে কোথা থেকে
কৃষিবিদ পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘বাজারে চিকন চালের যে ছড়াছড়ি, তার অর্ধেকও দেশে উৎপাদন হয় না। চিকন চালের ফলন রেকর্ডও খুব একটা ভালো না। তাহলে এর উৎস কোথায়? মূলত মাঝারি মোটা চালকেই মেশিনে কেটে চিকন করা হচ্ছে। আর যে অংশকে ছাঁটা হচ্ছে, তা দিয়ে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে রাইস ব্র্যানসহ বহুমুখী এনিমেল ফিড তৈরি হচ্ছে।’
এই কৃষিবিদের ভাষ্য, ‘চালে এই কাটাছেঁড়া বন্ধ করতে না পারলে একদিকে ভোক্তারা যেমন মারাত্মক পুষ্টি সংকটে পড়বে, অন্যদিকে চালের বাজারে নৈরাজ্যও বন্ধ হবে না। যতদূর জানি সরকার তা বন্ধ করতে কার্যকর উদ্যোগও নিতে শুরু করেছে।’
ব্রির মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবির বলেন, ‘ভোক্তারা যতক্ষণ না সচেতন হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ভালো ফলাফল পাব না। কারণ ছেঁটে চিকন করার ফলে চালে যে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট থাকে, যা পুষ্টির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর আর অস্তিত্বই থাকে না। এসব ঝামেলা এড়াতে মোটা চাল খাওয়াটাই হচ্ছে ভোক্তার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ।’
দেশে চাল প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান বলেন, ‘দেশে এত এত চিকন চালের সবটা দেশে উৎপাদন হয় না। আবার মিনিকেট নামেও কোনো ধান নেই। তাহলে এত চিকন চাল আসে কোথা থেকে?’
তিনি বলেন, ‘আসলে নাজিরশাইল (নাজিরশাহী), জিরাশাইল, শম্পা কাটারি ছাড়াও ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯সহ বিভিন্ন মাঝারি চিকন হাইব্রিড জাতের ধানকে স্থানীয় পর্যায়ের মিলগুলোয় প্রসেস করে চিকন করা হয়। আর পলিশ করা অংশ দিয়ে বিভিন্ন বাইপ্রোডাক্ট তৈরি করা হয়।’
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম তালুকদার বলেন, ‘বাজার থেকে বেশি জনপ্রিয় আটটি ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, এ চালগুলোর সবই মোটা। বিভিন্ন ধরনের মেশিনে ব্লেন্ডিং করে কেটে-ছেঁটে পলিশ করা হয়েছে। ওই ফেলে দেয়া অংশ দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পশুখাদ্য।’
মিলারদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ মণ ধান থেকে ফ্রেশ মিনিকেট চাল পাওয়া যায় সাড়ে ছয় মণ। এ প্রক্রিয়ায় উচ্চমূল্যের হ্যাচারি ফিড পাওয়া যায় ১৫ কেজি, রাইসব্র্যান পাওয়া যায় ৫ থেকে ৬ কেজি। এ ছাড়া এগুলোর বাইরে পশুখাদ্য কালো চাল বা খুদ পাওয়া যায় ৭ থেকে ১০ কেজি; কুঁড়া হয় ৭০ থেকে ৮০ কেজি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক হাজার কেজি মোটা চাল প্রসেস করে চিকন চাল বা মিনিকেট চাল পাওয়া যায় সাধারণত ৯৩৩ কেজি। এ ছাড়াও সাদা খুদ ২৬.৫ কেজি, কালো খুদ ১৪ কেজি, মরা চাল ৪.৫ কেজি, ময়লা ০.৭৫ কেজি ও পলিশ ২৭ কেজি পাওয়া যায়।
বেশি জাত চিকন চালে
ধানের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের পরিকল্পনায় মোটা জাতের হাইব্রিড ধান চাষাবাদের চেয়ে মাঝারি চিকন ও চিকন হাইব্রিড ধান উৎপাদনই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ঠিক, ধান উৎপাদনে আমরা রেকর্ড গড়লেও মোটা জাতের হাইব্রিড ধান উৎপাদন সেভাবে বাড়াতে পারিনি। এটা বাড়াতে পারলে স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি খরচও বাঁচাতে পারি। মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবির জানান, ‘বিষয়টি ঠিক। অনেকেই বলেন, মোটা চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে, আসলে তো মাঠপর্যায়ে মোটা চালের উৎপাদনই কম। আমাদের ‘৭৪’ ছাড়া ‘৪৯’ এর পরে ‘১০৮’ পর্যন্ত যে ভ্যারাইটিগুলো (জাত) আছে, তার বেশির ভাগই চিকন। এসব কারণে মোটা চালের পরিমাণ বাজারে কমে গেছে এবং মাঝারি চিকন ও চিকন চালের সরবরাহ বেড়ে গেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মোটা চালের অনেক ভ্যারাইটি আমাদের আছে। চাইলেই রিলিজ করতে পারি, কিন্তু মোটা চাল ক্রেতারা খুব একটা নিচ্ছে না।
‘আমরাও সার্বিক পরিস্থিতি অবজার্ভ করছি। যদি ভালো ভালো লাইনের ভ্যারাইটি রিলিজ করতে পারি, তাহলে এ চালের উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব।’
মাঝারি মোটা ও চিকন চালের ভোগের পরিমাণ
গত পাঁচ বছরে দেশে চাল উৎপাদনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে মাঝারি মোটা ছিল ১ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টন এবং চিকন চাল ছিল ৬৯ লাখ ৪২ হাজার টন।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন, যেখানে মাঝারি মোটা চালের ভোগ হয় ১ কোটি ৮৯ লাখ ২৮ হাজার টন। অন্যদিকে চিকন চালের ভোগ ছিল ৬৭ লাখ ৬০ হাজার টন।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টন উৎপাদন থেকে মাঝারি মোটা চাল খাওয়া হয় ২ কোটি ৩ লাখ ১৬ হাজার ২৪০ টন। চিকন চাল খাওয়া হয় ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ৮০০ টন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাঝারি মোটা চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩ লাখ ৮৪ হাজার টন। চিকন চালের উৎপাদন ৭২ লাখ ৮০ হাজার টন। মোট চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন।
সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। সেখানে চিকন চাল খাওয়া হয় ৭১ লাখ ৭০ হাজার টন। অন্যদিকে মাঝারি মোটা চাল খাওয়া হয় ২ কোটি ৭৬ হাজার টন।
ক্যাটাগরি অনুযায়ী চালের পরিমাপ
মোটা, মাঝারি কিংবা চিকন চালের আকার পরিমাপ জটিল হলেও তা চোখে দেখলে সহজেই চেনা যায়, তবে মোটা বা মাঝারি ক্যাটাগরিতে ফেলতে হলে ধান থেকে খোসা ছাড়ানো অবস্থায় চালটি লম্বায় যতটুকু, তার তিন ভাগের পৌনে এক ভাগ হতে হবে চওড়া। চালটি সরু হলে তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত হবে ৩:৫:১।
বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, ৩ মিলিমিটার (এমএম) থেকে ৬ এমএম লম্বা সাইজের চাল মোটা বা মাঝারি মোটা শ্রেণিভুক্ত। ৬ এমএম থেকে এর বেশি লম্বা হলে ওই চালটি চিকন বা সরু হয়। অন্যদিকে ৬.৫ এমএম থেকে ৭ এমএম বা তার চেয়ে বেশি লম্বা ও সুগন্ধিযুক্ত হলে সেটা ‘সরু ও অ্যারোমেটিক’ শ্রেণিভুক্ত।
লম্বায় ৩ এমএম ও সুগন্ধি হলে সেটাকে শুধু অ্যারোমেটিক শ্রেণিভুক্ত বলা হয়। যেমন: চিনিগুঁড়া, কালিজিরা বা এ জাতীয় অন্যান্য সুগন্ধিযুক্ত চাল। এ ছাড়া কিছু জাতের চাল আছে, যা ৬ এমএম লম্বা। পার্শ্ব মাপ ২ এমএমের ঊর্ধ্বে হলে সেগুলোকে মোটা বা মাঝারি মোটা বা মাঝারি চিকন শ্রেণিভুক্ত হয়।
সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞরা
খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করবে। এ ছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ জাতিসংঘঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের তাগিদ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তন হয়েছে। তাদের আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং মানুষ চিকন চাল খেতে পছন্দ করে, এটা মিথ্যা নয়। আবার এসডিজির লক্ষ্য হচ্ছে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, কাউকে পেছনে ফেলে রাখা নয়। এ বাস্তবতাও পরিকল্পনায় থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে করোনাজনিত সার্বিক দারিদ্র্য পরিস্থিতি, কর্মহীনতা এবং ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় মোটা চালের গুরুত্বকেও অস্বীকারের উপায় নেই। তা ছাড়া মোটা চালের ভোগ মানুষ কিংবা গরু যেই করুক, তা কিন্তু অন্য খাতেও ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ মোটা চালের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাই প্রায় প্রতি বছর যে চাল আমদানি করা হচ্ছে, তার প্রায় সবই মোটা চাল।
‘যদি দেশেই মোটা চালের উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে সরকারকে আমদানি করতে হবে না। সেদিকে গুরুত্ব দিয়েই আগাম পরিকল্পনা নিতে হবে। কারণ জীবনধারণে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ধান-চালের উৎপাদনে স্বনির্ভরতা এবং তা বাজার পর্যায়ে সুষ্ঠু সরবরাহের মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখাও জরুরি।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার বা সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ যদি মোটা চালকে গুরুত্ব না দেয়, তাতে কিছু যায়-আসে না। বাস্তবতা হলো মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যে পণ্যের চাহিদা থাকে, সে পণ্যের উৎপাদন বা আমদানি বেশি হয়। দেশে মোটা চালের উৎপাদন তো হচ্ছে। আবার দেখছি আমদানিও হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে মোটা চাল গুরুত্ব হারায়নি।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাজ হলো জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিবেচনায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে লক্ষ্যমাত্রার উৎপাদন এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা। সেটি যদি ধান হয়, তাহলে সরকারকে সেভাবেই পরিকল্পনা সাজাতে হবে।’
কৃষি বিজ্ঞানী ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন জোরদারের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে মোটা চালের উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া প্রান্তিক, অতি দরিদ্র ও দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা সার্বক্ষণিক ধরে রাখাও সম্ভব নয়।’
আরও পড়ুন:মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফে উপজেলার একটি পৌরসভা ও পাঁচটি ইউনিয়নের মোট ৫২৩ জন ভূমি ও গৃহহীনের মাঝে ঘর বিতরণ করা হয়। মাথা গোঁজার স্থায়ী একটি আবাসন পেয়ে নতুন জীবন শুরু করেন ভূমিহীন অসহায় মানুষ।
তবে এখানে ঘর বরাদ্দ পাওয়া অনেকেই ভূমিহীন নন। অভাবগ্রস্তও নন। দুর্নীতি ও প্রভাব খাটিয়ে ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত অনেকেই সচ্ছল। আশ্রয়ণের সেসব ঘর মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য।
আশ্রয়ণের ঘর বরাদ্দে অনিয়ম ও ভাড়া আদায়ের এমন একাধিক ঘটনা নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বুধবার সরেজমিনে গিয়ে সেসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নে নয়াপাড়ার শেষ মাথায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের তালিকায় ৫ নম্বর সিরিয়ালে রয়েছে নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. কামালের ঘর। ওই গ্রামেই তার নিজস্ব টিনশেড ঘর রয়েছে। তারপরও প্রভাব খাটিয়ে তিনি আশ্রয়ণের ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। কামালের নিজের ঘর থাকায় এখন আশ্রয়ণে বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকেন আরেকজন।
আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের অভিযোগ, কামাল হোসেন নিজের নামে বরাদ্দ ঘরে কখনোই বসবাস করেননি। কামালসহ প্রভাবশালী সাতজন একটি করে ঘর বরাদ্দ নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। তাদের মধ্যে কামাল দুই লাখ টাকার বিনিময়ে ঘরটি বিক্রি করে দেন রাশেদা নামের এক নারীর কাছে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে ওই নারীকে তিনি টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে জানান বাসিন্দারা।
নয়াপাড়ায় (পুরান পাড়া) আশ্রয়ণের ঘরে বসবাসকারী এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের এখানে ১০টি ঘরের মধ্যে মাত্র তিনটিতে আমাদের মতো অসচ্ছল উপকারভোগী বসবাস করে। বাকি সাতটি ঘরে বরাদ্দপ্রাপ্তরা কেউ থাকেন না।
‘৫ নম্বর ঘর বিক্রি করলেও পরে টাকা ফেরত নিছে। আর ১ নম্বর ঘর সাইফুল ইসলাম ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছিল। এখন সেই টাকা ফেরত দিছে কিনা তা জানি না। কেউ কেউ নিজের নামে বরাদ্দ ঘরটি দীর্ঘদিন তাদের আত্মীয়দের কাছে ভাড়া দিয়েছিল। বর্তমানে সেই সাতটি ঘরে তালা ঝুলিয়ে রাখলেও তারা নতুন ভাড়াটে খোঁজ করছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কামাল ও সাইফুল মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ঘর আগে বিক্রি করেছিলাম। এখন আর ঘর বিক্রি করব না। ভাড়াও দেব না। অন্যদের পাঁচটি বাড়ি ভাড়া চলে। আমাদের ঘর তালাবদ্ধ করে রাখছি।’
বিষয়টি নিয়ে কোনো খবর প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন তারা।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের তালিকা সঠিকভাবে করা হয়নি। তালিকা প্রস্তুতকারীরা প্রকৃত ভূমিহীনদের বদলে নিজেদের পছন্দের লোকের নাম দিয়েছেন। ফলে প্রকৃত অভাবীদের অনেকে আশ্রয়ণের ঘর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সচ্ছল ব্যক্তিরা ঘর বরাদ্দ পেয়ে সেগুলো মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দিয়ে রাখছেন।
টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মুফিত কামাল ও ফেরুজা বেগম বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে সরকার গুচ্ছগ্রাম করে টিনের ঘর বানিয়ে বরাদ্দ দিয়েছিল। সেখানে প্রতিটি ঘরেই বরাদ্দপ্রাপ্ত অভাবী মানুষগুলো থাকে। বর্তমানে ওইসব ঘর জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।
‘পাশেই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকা ঘর রয়েছে। অথচ অনেকে বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকছেন না। সবময় তালাবদ্ধ থাকে। আর যারা বসবাস করেন তাদের সিংহভাগই অন্যের বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকেন। অনেকে উপহারের ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার অনেকে ভাড়া দিয়েছেন।’
আশ্রয়ণ প্রকল্পের যেসব ঘর তালাবদ্ধ থাকে, সেগুলো গুচ্ছগ্রামে জরাজীর্ণ ঘরে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
স্থানীয় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র মো. শাহ্ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সিংহভাগ ঘরে বরাদ্দপ্রাপ্তরা থাকেন না। শুধু সাবরাং নয়, টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে এই প্রকল্পের আওতায় যেসব ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সবখানেই এমন অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যাদের ঘরের প্রয়োজন নেই তারাই এসব ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের কাছের লোক এবং আত্মীয়দের ঘর দিয়েছেন। তাই সিংহভাগ ঘর তালাবদ্ধ থাকছে।’
প্রশাসনের কাউকে কোনোদিন আশ্রয়ণ প্রকল্পে এসব ঘর তদারকি করতেও দেখেননি বলে উল্লেখ করেন তিনি। বরাদ্দ পাওয়া যেসব ঘরে প্রকৃত মালিকরা থাকেন না, সেগুলো ফেরত নিয়ে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে বণ্টন করার দাবি জানান এই শিক্ষার্থী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের ঘর কেউ বিক্রি করে থাকলে এবং ভাড়া দিয়ে থাকলে যাচাই-বাছাই করে তাদের দেয়া ঘরের বরাদ্দ বাতিল করা হবে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিজের নামে বরাদ্দ পাওয়া ঘর ভাড়া দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব বিষয়ে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি। দ্রুত তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
আরও পড়ুন:গাইবান্ধা জেলা কারাগারে এক নারী হাজতিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অমানুষিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিতার মায়ের অভিযোগ, এক প্রধান কারারক্ষীর সঙ্গে এক নারী কয়েদির ‘অবৈধ কর্মকাণ্ড’ দেখে ফেলায় তার মেয়েকে এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
ভুক্তভোগী ওই নারী হাজতির নাম মোর্শেদা খাতুন সীমা। তিনি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার চৌপুকুরিয়া গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের মেয়ে। সীমা মাদক মামলায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে গাইবান্ধা কারাগারে বন্দি।
লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরে হাজতি সীমার উন্নত চিকিৎসা ও নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীর মা করিমন নেছা। সেই অভিযোগের কপি নিউজবাংলার হাতেও এসেছে।
অভিযুক্তরা হলেন- গাইবান্ধা জেলা কারাগারের প্রধান কারারক্ষী (সুবেদার) আশরাফুল ইসলাম, নারী কয়েদি মেঘলা খাতুন, রেহেনা ও আলেফা, কারারক্ষী তহমিনা ও সাবানা, সিআইডি আনিছ ও হাবিলদার মোস্তফা।
মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) জেলা প্রশাসককে দেয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, হাজতি মোর্শেদা খাতুন সীমা একটি মামলায় (হাজতি নং-৫০৮) প্রায় ৫ বছর ধরে গাইবান্ধা জেলা কারাগারে বন্দি। কিছুদিন আগে কারাগারে কর্মরত সুবেদার আশরাফুল ইসলাম ও মহিলা কয়েদি (রাইটার) মেঘলা খাতুনের মধ্যে চলমান অবৈধ কার্যকলাপ দেখে ফেলেন নারী হাজতি সীমা।
বিষয়টি জানতে পেরে সুবেদার আশরাফুল ও মহিলা কয়েদি মেঘলা খাতুন সীমার ওপর ক্ষিপ্ত হন। ঘটনা জানাজানির ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তারা কারাগারের ভেতরে সীমাকে বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করতে থাকেন।
একপর্যায়ে সুবেদার আশরাফুল ও তার সহযোগীরা হাজতি সীমার স্বামী খোকন মিয়াকে গাইবান্ধা কারাগারে ডেকে আনেন। তারা অভিযুক্তরা সীমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা ও আপত্তিকর তথ্য দিয়ে সীমার সংসার ভেঙে দেন।
এতোসবের পর হাজতি সীমা এসব ঘটনা জানিয়ে জেল সুপারের কাছে বিচার দেবেন জানালে সুবেদার আশরাফুল তাকে ভয়-ভীতি ও হুমকি দেন। এক পর্যায়ে ২০ মার্চ দুপুরে সুবেদার আশরাফুলের নেতৃত্বে মহিলা কয়েদি মেঘলা খাতুন, রেহেনা ও আলেফা এবং কারারক্ষী তহমিনা ও সাবানা কারাগারের মহিলা ইউনিটের ভেতরের বারান্দায় লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন। পরে সেলের ভেতরে নিয়ে সীমাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রশি দিয়ে দুই পা বেঁধে আবারও মারধর করেন। উপরন্তু নির্যাতনের এসব ঘটনা বাইরে প্রকাশ করলে সীমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, করিমন নেছা একাধিকবার তার মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেও সে সুযোগ দেয়া হয়নি। অবশেষে হাজিরার তারিখে আদালতে মেয়ের সাক্ষাৎ পান মা করিমন নেছা। এদিন সীমা মায়ের কাছে নির্যাতনের ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন দেখান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা কারাগারের অভিযুক্ত প্রধান কারারক্ষী আশরাফুল ইসলাম মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টির সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমার নামটা কেন আসতেছে জানা নেই।
‘ঘটনাটি এক মাস আগের। আরেক প্রধান কারারক্ষী মোস্তফার ডিউটির সময়ের। কিন্তু আমার নাম কেন হচ্ছে বিষয়টি জানি না।’
অপর অভিযুক্ত মহিলা কারারক্ষী তহমিনা আক্তার মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। সেদিন যা ঘটেছিল তার বিপরীত ঘটনা তুলে ধরে অভিযোগ করা হয়েছে। আরেফিন নামে এক নারী কারারক্ষী ও তার স্বামীর মদদে এই বন্দি এসব মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।’
কারারক্ষী তহমিনা আরও বলেন, ‘এই বন্দী (সীমা) একাধিক মামলার আসামি। প্রশাসনের লোকজনের ওপর হাত তোলার একাধিক অভিযোগ ও মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঘটনার দিনও সাবানা নামে এক নারী কারারক্ষীর গায়ে হাত তুলেছিলেন এই বন্দি।’
এ ব্যাপারে গাইবান্ধা কারাগারের জেল সুপার জাভেদ মেহেদী মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) এডিসি মহোদয় তদন্তে এসেছিলেন। ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের বিষয়ে রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে ভেতরের ব্যাপারে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে একটি ব্যাপার তৈরি হয়েছে, যা ফোনে বলা সম্ভব নয়। তবে ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিসি) মো. মশিউর রহমান মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অভিযোগ পেয়ে গতকাল (মঙ্গলবার) বিষয়টির তদন্ত করেছি। খুব দ্রুত জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব। এরপরই জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে জেলা প্রশাসন।’
ফরিদপুরের কানাইপুরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। দুর্ঘটনায় এক পরিবারের চার সদস্যসহ মোট ১৪ জন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও দুজন।
মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে ফরিদপুর-খুলনা মহাসড়কের কানাইপুরের দিগনগর তেঁতুলতলায় ঢাকা থেকে মাগুরা অভিমুখী ইউনিক পরিবহনের একটি বাস ও পিকআপের সংঘর্ষে সড়কেই ঝরে পড়ে ১১ প্রাণ। হাসপাতালে নেয়ার পর আরও তিনজনের মৃত্যু হয়।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দেবে বলে জানিয়েছেন ফরিদপুর জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার।
তবে সরেজমিনে ঘুরে প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনার বেশ কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছে নিউজবাংলা। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, মহাসড়কে উল্টো লেনে গাড়ি চালানো ও এবড়ো খেবড়ো সড়কের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। ফরিদপুর পুলিশ সুপার, ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ম্যানেজার ও স্থানীয়দের দাবি অন্তত তা-ই।
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত বাস ও পিকআপ দুটিরই অতিরিক্ত গতি ছিল। আর পিকআপচালক তার নির্দিষ্ট লেন ছেড়ে বিপরীত লেনে চলে আসেন। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বাসের চালক ফিট ছিলেন কি না, পিকআপটির চালকের লাইসেন্স ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।’
ফরিদপুর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার সুবাস বাড়ৈ বলেন, ‘গাড়িটি (বাস) ওভার স্পিডে (অতিরিক্ত গতি) চলছিল। এ কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে।’
দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই শেখ লিমনের বাড়ি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখানে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে কিছু বিট ও তার পাশে গর্ত আছে, রাস্তাও এবড়ো থেবড়ো। ঈদের আগেও এখানে বিশ-বাইশটি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। সকালে ওই বিটের কাছেই দুর্ঘটনা ঘটে।’
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার জানান, নিহতদের দাফনের জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। নিহতদের স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের পরবর্তীতে ৫ লাখ এবং গুরুতর আহতদের ৩ লাখ টাকা করে প্রদান করা হবে।
আরও পড়ুন:কর্ণফুলীর সল্টগোলা-ডাঙারচর ঘাটসহ ২০টি নদী পারাপার ঘাট ইজারা না হওয়ায় নামমাত্র ‘খাস কালেকশন’ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) বিরুদ্ধে। এতে করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চসিক রাজস্ব শাখার কর্মকর্তারা স্থানীয় পর্যায়ের পুরনো ইজারাদারদের সঙ্গে আঁতাত করে খাস আদায়ে উঠেপড়ে লেগেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মেয়রের নামও ভাঙাচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চসিকের এসব ঘাট দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ যাত্রীসহ পণ্য আনা-নেয়া করা হয়। ঘাটগুলো নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকায় ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে ২০ ঘাটের ইজারা দেয়া সম্ভব হয়নি।
ঘাট ইজারা না হওয়াটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে চসিকের রাজস্ব শাখা ‘খাস কালেকশন’ আদায়ের দিকে হাঁটছে। এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিতে ইজারালোভী সিন্ডিকেটকে সহায়তা করছেন। খাস কালেকশনের নামে রাজস্ব আদায় কম দেখানোর সুযোগ তৈরি করছেন তারা।
এই খাস কালেকশনকে রাজস্ব ফাঁকির কৌশল হিসেবে অভিহিত করেছে পাটনিজীবী একাধিক সমিতি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন পুরনো ইজারা ব্যবসায়ী বলেন, খাস কালেকশনে টাকা আদায় কম দেখানো গেলে পরবর্তী বছরের ইজারা মূল্য কমানোর আইনগত পথ সৃষ্টি হয়। এছাড়া একাধিকবার খাস কালেকশনে পরের বছর আইনগত ঝামেলা এড়িয়ে কম টাকায় ইজারা নিতে পারেন ব্যবসায়ীরা। এভাবেই কিছু অসৎ কর্মকর্তার কারসাজিতে কয়েক বছর পর পর গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোর ইজারা মূল্য কমে যায় এবং সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়।
তারা বলেন, এই পদ্ধতিতে সরকারি কোষাগারে নামমাত্র অর্থ জমা হলেও বড় অংকের টাকা চলে যাবে চসিক সিন্ডিকেটের পকেটে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এ বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হবে চসিক কিংবা সরকার।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, হাইকোর্ট বিভাগের রিট (১৫১৬৩/২৩) পিটিশনের কারণে এবার বাংলা ১৪৩১ সনে চসিক নিয়ন্ত্রণাধীন ঘাটগুলোর ইজারা স্থগিত রয়েছে। ঘাটে ঘাটে আবার কানাঘুষাও চলছে যে এসব চসিকেরই কৌশল। কেননা এতে কপাল খুলে যায় একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও চসিক-সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের।
চসিকের নিয়ন্ত্রণাধীন ঘাটগুলো হলো- পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট, সল্টগোলা ঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, নয়ারাস্তা পাকা পুলঘাট, সদরঘাট, ফিশারীঘাট, নতুনঘাট, এয়াকুব নগর লইট্যা ঘাট, পতেঙ্গা ১৪ নংম্বর ঘাট ও গুচ্ছগ্রাম ঘাট, ১১ নম্বর মাতব্বর ঘাট, ১২ নম্বর তিনটিংগা ঘাট, ৭ নম্বর রুবি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি সংলগ্ন ঘাট, ৯ নম্বর বিওসি ঘাট, অভয় মিত্র ঘাট, চাক্তাই খালের পাশে পানঘাট থেকে গাইজ্জের ঘাট, পতেঙ্গা চাইনিজ ঘাট, বাকলিয়া ক্ষেতচর ঘাট, চাক্তাই ঘাট ও চাক্তাই লবণ ঘাট।
চলতি বছরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘাটের সম্ভাব্য ইজারা মূল্য ছিল- পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট ২ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সল্টগোলা ঘাট ৫৭ লাখ ৩২ হাজার ১০০ টাকা, বাংলাবাজার ঘাট ২৪ লাখ ৪ হাজার ৬০০ টাকা, সদরঘাট ২১ লাখ ৯৭ হাজার ১২৪ টাকা, ফিশারি ঘাট ২৪ লাখ ১৭ হাজার ৬৭ টাকা, পতেঙ্গা ১৪ নম্বর ঘাট ও গুচ্ছগ্রাম ঘাট ৪২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, ১১ নম্বর মাতব্বর ঘাট ৮৭ লাখ ৩২ হাজার ৪০০ টাকা এবং ৯ নম্বর বিওসি ঘাট ৩৫ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা।
হিসাব করলে দেখা যায়, পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাটের সম্ভাব্য ইজারা মূল্যের সঙ্গে ২০ শতাংশ ভ্যাট যোগ করলে মোট ইজারা দাঁড়ায় ৩ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে দৈনিক কিস্তি পড়ে ৮৮ হাজার ৬০২ টাকা। অনুরূপভাবে সল্টগোলা ঘাটের দৈনিক কিস্তি ১৮ হাজার ৮৪৫ টাকা।
এভাবে প্রতিটি ঘাটে দৈনিক ১০ হাজার থেকে ৮৮ হাজার টাকার মতো ইজারা আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু অতি কৌশলে চসিকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে দৈনিক মাত্র ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার নামমাত্র মূল্যে খাস কালেকশন আদায়ের প্রক্রিয়া নিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
অভয় মিত্র ঘাটের খাস কালেকশনকারী মো. আবুল জানান, দৈনিক দু’হাজার টাকা হিসাবে তিনি এই ঘাট নিয়েছেন। বাংলাবাজার ঘাটের লোকমান দয়াল জানান, দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার টাকায় তিনি এই ঘাট দেখাশোনা করছেন।
চসিক নীতিমালায় ঘাট ইজারা কিংবা খাস আদায়ে সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত স্থানীয় পাটনিজীবী সমিতিকে ঘাট পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু খাস আদায়ের জন্য স্থানীয় পাটনিজীবী সমিতিগুলো মেয়রের কাছে ধর্না দিয়েও সাড়া না পায়নি। অনন্যোপায় হয়ে তারা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন কিংবা মানববন্ধন কর্মসূচির চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে।
সল্টগোলা ডাঙ্গারচর পাটনিজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সাম্পান মাঝিরা সাম্পান চালিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে দুমুঠো ডাল-ভাত খেতে চাই। আমরা চাই কেউ আমাদের পেটে লাথি না মারে। টোল কিংবা খাস কালেকশন যে আদায় করবে করুক, আমরা এই ঘাটের মাঝি; আমরা যাত্রী পারাপার করতে চাই।
‘বর্তমানে সাড়ে ৭ হাজার টাকা করে খাস কালেকশন দিচ্ছি। এখনও চসিক থেকে কেউ আসেনি। আমরা সরকারি রেজিস্ট্রেশনধারী পাটনিজীবী সমিতি। কিন্তু বাইরের কিছু লোক ঘাট দখলের পাঁয়তারা করছে ঘাটে চাঁদাবাজি করার জন্য। আমরা এসব হতে দেব না।’
বেশিভাগ ঘাটের ইজারাদার আব্দুল শুক্কুর প্রকাশ তেল শুক্কুর বলেন, ‘আমরা কয়েকটি ঘাটের খাস কালেকশন করতেছি। ১৫ দিন পর পর সিটি করপোরেশনে টাকা দিতে হয়।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কিছু পাটনিজীবী সমিতি মিলে হাইকোর্টে রিট করে স্টে-অর্ডার করেছে; যাতে ইজারা টেন্ডার বন্ধ থাকে। সে কারণে ঘাটগুলোর ইজারা বন্ধ রয়েছে। আমরা ডকুমেন্টস সংগ্রহ করছি। শিগগিরই রিট শুনানি করে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর বর্তমানে ঘাটগুলো বিভিন্নজনকে বিভিন্নভাবে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এস্টেট শাখা ভালো বলতে পারবে।’
চসিকের রাজস্ব কর্মকর্তা সাব্বির রাহমান সানি বিশেষ ট্রেনিংয়ে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে চসিকের সহকারী এস্টেট অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের আইন শাখা কাজ করছে। শিগগিরই হাইকোর্টের স্টে-অর্ডারটি ব্যাকেট করা হবে। তারপর ঘাটগুলোর টেন্ডার কল করা হবে। বর্তমানে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব লোকজন ঘাটগুলো দেখাশোনা করছে। আর সল্টগোলা ডাঙারচর ঘাটে লোকজন গেছে।’
চসিক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (সিআরও) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশ মানতে হবে। কিছু করার নেই। খাস কালেকশনে ঘাট চলছে। যেহেতু আদালতের নির্দেশে স্থগিত ইজারা। রিট শুনানির জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। কিন্তু এভাবে খাস কালেকশন চলতে থাকলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসবে না সেটাও সত্য।’
রেলওয়ের ৬৬ শতক জলাশয় ভরাট করে দখলে রেখেছেন স্থানীয় কাউন্সিলর। এক্ষেত্রে তিনি অজুহাতের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন খুলনা সিটি করপোরেশনকে (কেসিসি)। তার দাবি, মেয়র ওই জায়গায় পার্ক বানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাই পুলিশে অভিযোগ দিয়েও সেই সম্পত্তি উদ্ধার করতে পারছে না রেলওয়ে।
তবে কেসিসি থেকে জানানো হয়েছে, সেখানে কোনো নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয়নি। আর কাউন্সিলের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কিছুই জানেন না মেয়র।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, খুলনা নগরের খালিশপুর এলাকায় খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পশ্চিম পাশে রেলওয়ের ৬৬ শতক জমি রয়েছে। কয়েক বছর আগে স্থানীয় জনি মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে ওই জমি ইজারা দেয়া হয়েছিল। ওই জমিটুকু জলাশয় হওয়ায় ইজারার শর্তে উল্লেখ ছিল যে তা ভরাট করা যাবে না। তবে ইজারা নেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জায়গাটি ভরাট করে ফেলা হয়।
রেলওয়ের যশোর ও খুলনার ভূমি কর্মকর্তা মহসিন আলী বলেন, ‘স্থানীয় কাউন্সিলরের নির্দেশে ওই জমি ভরাট করা হয়েছে। জনি মিয়ার দায়িত্ব ছিল ওই জলাভূমি রক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের। কিন্তু তিনি ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম মুন্নার সঙ্গে যোগসাজস করে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ফেলেছেন।’
শর্ত ভঙ্গ করে ভূমি ভরাট করায় জনি মিয়ার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর সরকারি রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) স্টেশনে একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন ভূমি কর্মকর্তা। তবে প্রভাবশালী কাউন্সিলরের চাপে পুলিশ কিছুই করতে পারেনি।
মহসিন আলী বলেন, ‘তৎকালীন ভূমি কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম জিআরপি থানায় যে ডায়েরি করেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছিল। ওই সময়ে কাউন্সিলর মুন্না ও তার লোকজন প্রভাব খাটিয়ে ওই তদন্ত বন্ধ করে দেন। অবশেষে রেলওয়ের ৬৬ শতক জমির পুরো জলাশয়টি ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যায়।’
সম্প্রতি রেলওয়ের ওই সম্পত্তি পরিদর্শন করেন এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, জলাশয়টির কোনো অস্তিত্ব নেই। পুরো জায়গাটি সমতল মাঠে পরিণত হয়েছে। আর কিছু শ্রমিক ভরে ফেলা জায়গাটি সমতল করছে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, রেলওয়ের ওই জমিতে শিশুপার্ক, কাউন্সিলর কার্যালয়, দোকানপাট ও বহুতল মার্কেট নির্মাণ করা হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ইমতিয়াজ শেখ বলেন, ‘রেলওয়ের মালিকানাধীন ওই জায়গা যখন ভরাট করা হয় তখন কাউন্সিলর মুন্না কেসিসির প্যানেল মেয়র ছিলেন। তাই প্রকাশ্যে জমি ভরাট করলেও তাকে বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি রেলওয়ের কর্মকর্তারা এখানে এসে অসহায় বোধ করেন। মুন্না স্পষ্ট করেই তাদেরকে বলে দেন- এটি কেসিসির মালিকানাধীন পরিত্যক্ত জমি এবং তারা শিশুদের জন্য একটি পার্কসহ সেখানে কিছু স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। তখন রেলওয়ের কর্মকর্তারা পুলিশের সহায়তা নেন।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় খুলনার জিআরপি থানার ওসি ইদ্রিস আলী মৃধার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় কাউন্সিলর দাবি করেন যে ড্রেন সংস্কারের সময় জমে থাকা মাটি ফেলার জায়গা নেই, তাই কেসিসি মেয়রের নির্দেশে তারা মাটি দিয়ে জলাশয়টি ভরাট করছেন।’
যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম মুন্নাও দাবি করেন, কেসিসি মেয়রকে জানানোর পর তিনি জলাশয়টি ভরাট করেছেন।
তিনি বলেন,’ জলাশয়টি মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। আর তা স্থানীয়দের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আমি মেয়রের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি এবং জনগণের স্বার্থে জলাশয়টি ভরাট করে দিয়েছি। অদূর ভবিষ্যতে সেখানে একটি শিশুপার্ক নির্মাণ করা হবে।
অনুমতি ছাড়া রেলওয়ের সম্পত্তি জলাশয় ভরাট করা আইনসঙ্গত কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলাম জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘ওই জমিতে সিটি করপোরেশনের পার্ক স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা নেই। আর জমি ভরাট ও দখলের ব্যাপারে মেয়র কোনো কিছুই জানেন না।’
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল। তিনি বলেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে জলাশয় দখল করে নিলেন। আর জমির মালিক সরকারি প্রতিষ্ঠান পুলিশের আশ্রয় নিয়েও তা রক্ষা করতে পারলো না। এখানে আইন অন্ধ দৃষ্টির ভূমিকা রেখেছে।’
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের বিভাগীয় ভূমি সম্পত্তি কর্মকর্তা (পাকশী জোন) মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘যারা জলাশয়টি ভরাট করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি ইতোমধ্যে স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তাকে জায়গাটির চারপাশে বেড়া দেয়ার নির্দেশ দিয়েছি।’
আরও পড়ুন:সিরাজগঞ্জের বেলকুচি জনতা ব্যাংকের তামাই শাখার ম্যানেজার আল-আমিনের জালিয়াতির নতুন নতুন খবর বেরিয়ে আসছে। ব্যাংক ও গ্রাহকের টাকা নয়-ছয় করে এই কর্মকর্তা ব্যক্তি জীবনে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন। চাকরির আড়ালে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ব্যাংকের ক্যাশ ভল্টের ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার খোঁজ এখনও মেলেনি। বিষয়টি নিয়ে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের উদ্যোগে তদন্ত চলছে। এরই মাঝে তথ্য মিলেছে, ব্যাংকের ম্যানেজারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চক্র গ্রাহকদের বিপুল টাকা তাদের অগোচরে তুলে নিয়েছে। আর এভাবে ব্যাংকের বিপুল টাকা সরিয়ে নিয়ে চাকরির আড়ালে নিজের ব্যবসা ফেঁদেছেন ম্যানেজার আল-আমিন। ঠিকাদারিসহ পার্টনারশিপে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা ও দোকানপাট।
সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
এদিকে জনতা ব্যাংক প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো পাঁচ সদস্যের তদন্ত দল বুধবার সকাল থেকে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এর আগে সোমবার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই সদস্যের তদন্ত দলও তাদের মতো করে তদন্ত করছে।
ব্যাংকের ক্যাশ ভল্টের বিপুল পরিমাণ টাকার হদিস মিলছে না- এমন খবরে জনতা ব্যাংক তামাই শাখার হিসাবধারী গ্রাহকরাও উৎকণ্ঠিত। তারা নিজ নিজ হিসাবের টাকার খবর জানতে ভিড় করছেন ব্যাংক কার্যালয়ে।
ইতোমধ্যে গ্রাহকদের সিসি একাউন্টসহ বিভিন্ন হিসাব থেকে বড় অংকের টাকা নয়-ছয় হওয়ার শঙ্কা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। তবে এখনই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে চাচ্ছেন না তদন্তকারী দলের সদস্যরা।
জনতা ব্যাংক এরিয়া কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নজরুল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতে জনতা ব্যাংক তামাই শাখা থেকে ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের দায়ে রোববার রাতে গ্রেপ্তার হন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ তিন কর্মকর্তা। এর আগে অভিযুক্তরা আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করে ২০ লাখ টাকা ভল্টে ফেরত দিয়েছেন- এমন তথ্য অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
বুধবার ও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অনুসন্ধানে গিয়ে ব্যবস্থাপক আল-আমিনের পার্টনারশিপে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়। আল-আমিনের বসবাস সিরাজগঞ্জ শহরের ধানবান্ধি মতি সাহেবের ঘাট মহল্লায়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ছয়-মাস ধরে ব্যবস্থাপক আল-আমিন তার বসতবাড়ির পাশে আবুল পাটোয়ারীর পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে গড়ে তুলেছেন বৈদ্যুতিক তার উৎপাদনের কারখানা। ‘এম আর ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের কারখানাটিতে পিভিসি ইনস্যুলেটেড ক্যাবল তৈরি হয়।
এই কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার জন্য সিরাজগঞ্জ শহরের বড়বাজার পাতিলাপট্টিতে পুরাতন হিরাঝিল মার্কেটে ‘আবরার এন্টারপ্রাইজ’ নামে ইলেক্ট্রিক দোকানের প্রোপ্রাইটার হিসেবে ব্যবসায় করছেন আল-আমিনের ভাতিজা মঈন উদ্দিন পলাশ। ‘আবরার এন্টারপ্রাইজ’-এর আবরার নামটি আল-আমিনের ছোট ছেলের।
আল-আমিনের ব্যবসার গণ্ডি ছড়িয়েছে রাজধানীতেও। ঢাকার নবাবপুর ও মিরপুরে এম আর এন্টারপ্রাইজ নামে ইলেক্ট্রিক সামগ্রীর দুটি দোকান রয়েছে তার। গাইবান্ধায় যমুনা নদী তীর রক্ষাবাঁধের কাজে সিসি ব্লক তৈরি প্রকল্পেও আল-আমিন টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের হোসেনপুর মোল্লাবাড়ি মহল্লার মিজানুর রহমানের সঙ্গে পার্টনারশিপে এসব ব্যবসা কারখানা ও দোকানপাট পরিচালনা করেন ব্যাংক ম্যানেজার আল-আমিন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তাদের ব্যবসায়িক অফিস রয়েছে।
মঈন উদ্দিন পলাশ অবশ্য ‘আবরার এন্টারপ্রাইজের মালিকানা নিজের বলে দাবি বলেন, ইলেক্ট্রিক তার উৎপাদন কারখানাটি তার চাচার নয়, মিজানুর রহমানের।
অপরদিকে আল-আমিনের বন্ধু মিজান বলেন, ‘আবরার এন্টারপ্রাইজের মালিক আমি। আল-আমিন বা তার ভাতিজা পলাশ নয়।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক যৌথভাবে ব্যাংক ম্যানেজার আল-আমিন ও মিজানুর রহমান।
বুধবার দুপুরে আল-আমিনের ধানবান্ধি মহল্লার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার স্ত্রী রুনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মিজানের সাথে আমার স্বামী আল-আমিনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আছে। কিন্তু তার সাথে কোনো প্রকার অংশীদারত্বমূলক ব্যবসার কথা আমি জানেন না।’
একইসঙ্গে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন, তার স্বামী আল-আমিন কারও খপ্পরে পড়ে এরকম পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন।
একই দিন সকালে বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামে গিয়ে ব্যাংকের বিভিন্ন গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তামাই গ্রামের তাঁত ব্যবসায়ী শামীম সেখের ছেলে সাদি সেখ বলেন, “এই ব্যাংকে ‘শামীম ব্রাদার্স’ ও ‘সাদি এগ্রো ফার্ম’ নামে আমাদের দুটি একাউন্ট আছে। এর মধ্যে শামীম ব্রাদার্স-এর হিসাবের ২৩ লাখ আর সাদি এগ্রো’র হিসাব থেকে ৩২ লাখ টাকা ডামি চেকে স্বাক্ষর জাল করে তুলে নেয়া হয়েছে।”
মুসলিম উইভিং ফ্যাক্টরি নামীয় হিসাবধারী মোতালেব জোয়ার্দার বলেন, ‘আমার হিসাবে ৪৮ লাখ টাকার সিসি লোন পাস করা আছে। আমি ২০২২ সালের পর ব্যাংকের এই শাখা থেকে কোনো টাকা উত্তোলন করি নাই। ব্যাংকের এই অবস্থা জেনে হিসাবের প্রতিবেদন তুলে দেখা যায় যে, ৪৮ লাখ টাকাই তুলে নেয়া হয়েছে।’
জনতা ব্যাংক তামাই শাখার অনেক গ্রাহকেরই এমন অভিযোগ। শাহিন কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজের সিসি হিসাব থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। তাঁত ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলামের ১৫ লাখ, চান টেক্সটাইলের চান মিয়া আকন্দের ১০ লাখ, হাজী আব্দুল্লাহ আকন্দের পাঁচ লাখসহ অনেক গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা তাদের একাউন্ট থেকে তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও বেশ কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে নগদ হাওলাতি টাকা নিয়েছেন শাখা ব্যবস্থাপক আল-আমিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক বলেন, ‘২৪ মার্চ বিপদের কথা বলে স্বল্প সময়ে পরিশোধের আশ্বাসে ২০ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলেন আল-আমিন। দুই লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা দিতে অস্বীকার করায় তিনি না জানিয়ে আমার ব্যাংক হিসাব থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে নেন। আর একই দিন সন্ধ্যায় ব্যবস্থাপক তার নামে আমার কাছ থেকে পিয়ন শহিদুল মারফত ১০ লাখ টাকার চেক লিখিয়ে নিয়েছেন।’
মোহাম্মদ আলী উইভিং ফ্যাক্টরির মালিক হাজী আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা ব্যাংককে বিশ্বাস করে টাকা রাখি। সেই ব্যাংক যদি এরকম কাজ করে তাহলে আমরা যাব কোথায়?’
বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শামছুল হক জানান, ম্যানেজার আল-আমিন বিভিন্ন সময় লুজ চেক ব্যবহার করে সিসি একাউন্টের টাকা তুলে নিয়েছেন। তাতে স্বাক্ষরের মিল নেই, চেকের সিরিয়ালের পরম্পরা নেই।
ব্যাংকের ক্যাজ্যুয়াল পিয়ন শহিদুল বলেন, ‘ম্যানেজার স্যার বিভিন্ন সময়ে আমার নাম ব্যবহার করে আমার মাধ্যমে বিভিন্ন একাউন্টে টাকা জমা দিয়েছেন। টাকা উত্তোলনে তিনি আমার নাম লিখে দিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আমি জানি না।’
জনতা ব্যাংক এরিয়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জনতা ব্যাংক তামাই শাখার ভল্টের ক্যাশ লিমিট ৭৫ লাখ টাকা। তাহলে সেই ভল্টে আত্মসাৎ করা পাঁচ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থাকলো কীভাবে- এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
জনতা ব্যাংক সিরাজগঞ্জ এরিয়া অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্ত চলছে, তদন্তে সঠিক বিষয়টি বের হয়ে আসবে। তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করাই ভাল। তদন্ত শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।’
প্রসঙ্গত, রোববার রাতে জনতা ব্যাংক সিরাজগঞ্জ এরিয়া কার্যালয়ের ডিজিএম নজরুল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের দায়ে জনতা ব্যাংক তামাই শাখার ব্যবস্থাপক আল-আমিন, সহকারী ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম ও ব্যাংকের কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামকে আটক করে পুলিশ। পরদিন সোমবার আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে জেল-হাজতে পাঠানো হয়। পরে অভিযোগটি বিধি মোতাবেক সাধারণ ডায়েরি আকারে গ্রহণ করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবনা অফিসে পাঠানো হয়।
দুদক সমন্বিত পাবনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক খায়রুল হক বলেন, ‘অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি চেয়ে কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আরও পড়ুন:ব্যাংকিং নিয়মে নয়, নিজের বানানো নিয়মে ব্যাংকের কার্যক্রম চালাতেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচির জনতা ব্যাংকের তামাই শাখার ব্যবস্থাপক আল আমিন। নিজের ইচ্ছেমতো গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন ও জমা দিতেন।
এদিকে ব্যাংকের ক্যাশ ভল্টের ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার হদিস এখনও মেলিনি।
বুধবার সকালে জনতা ব্যাংকের তামাই শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকদের হিসাবে থাকা টাকা তাদের অজান্তে তুলে নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ক্যাশ ভল্টের ওই পরিমাণ টাকাই শেষ কথা নয়? গ্রাহকদের অজান্তে তাদের হিসাবে জমা বিপুল পরিমাণ টাকাও হাতিয়ে নেয়া হয়েছে?
শাখাটিতে অবস্থানকালে সাংবাদিকদের কথা হয় তামাই বাজারের মেসার্স মুসলিম উইভিং ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী আব্দুল মোতালেব জোয়ারদারের সঙ্গে।
তিনি জানান, তার একটি ৪৮ লাখ টাকার সিসি লোন করা ছিল। তবে তিনি এখনও লোনটি উত্তোলন করেননি। অথচ তার ব্যাংক হিসাব ঘেটে দেখা যায় যে তিনি পুরো টাকাই উত্তোলন করেছেন। তার এই টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে তার সিরিয়ালের চেক ব্যবহার করা হয়নি। অন্য একটি চেকে ওই পরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এমন ঘটনায় মোতালেব জোয়ারদার হতবাক! এ অবস্থায় তার করণীয় কী হতে পারে বুঝতে পারছেন না।
শুধু আব্দুল মোতালেব নন, আরও অনেক গ্রাহকের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটেছে। একই এলাকার ব্যবসায়ী চান টেক্সটাইলের আকন্দের হিসাব থেকে তার অজান্তেই ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। আল ফারুক স্টোরের শহিদুল ইসলামের ২৪ লাখ টাকার সিসি লোনের মধ্যে তার অজান্তেই চেক জালিয়াতে করে ৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাবেও এমন জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসছে। ঝিন্না মোল্লার ব্যক্তিগত হিসাবে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯১০ টাকা থাকার কথা। কিন্তু ওই হিসাবে আছে মাত্র এক লাখ ৫ হাজার ১১২ টাকা।
তাৎপর্যের বিষয় হল, এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকরা তাদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাওয়ার কথা থাকলেও কোন এসএমএস আসেনি। গ্রাহকরা এ বিষয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললে তিনি তাদেরকে জানান- সার্ভারে ত্রুটি থাকার কারণে গ্রাহক এসএমএস পাচ্ছেন না।
বুধবার সকালে দেখা যায়, তামাই শাখার নতুন ব্যবস্থাপক কামরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পাঁচজন সদস্য বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন।
জনতা ব্যাংক হেড অফিসের এজিএম সাদিকুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে আরও রয়েছেন- ব্যাংকের এসপিও মোস্তফা কামাল, সিনিয়র অফিসার মাসুদুর রহমান, প্রিন্সিপাল অফিসার শরীফ মোহাম্মদ ইশতিয়াক ও এরিয়া ম্যানেজার সঞ্জিত কুমার।
এর আগে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের বগুড়া অফিসের যুগ্ম পরিচালক এস এম সাজ্জাদ হোসেনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তামাই শাখার ক্যাজুয়াল পিয়ন শহিদুল ইসলাম জানান, গত ৭ /৮ মাস ধরে শাখা ব্যবস্থাপক আল আমিনের কথা অনুসারে তিনি বিভিন্ন গ্রাহকের চেকে নিজে স্বাক্ষর দিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন। ব্যবস্থাপকের কথায় অনেক জমা ভাউচারেও তিনি স্বাক্ষর করেছেন।
কেন স্বাক্ষর করেছেন- এমন প্রশ্নে শহিদুল বলেন, ‘আমরা তাদের চাকরি করি। তিনি যা অর্ডার করতেন আমাদের তাই করতে হতো। আমি তো শুধু স্বাক্ষর দিয়েছি, ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তার আইডির মাধ্যমে টাকাগুলো দেয়া হতো। অনেক সময় গ্রাহকের হিসাবে টাকা না থাকলেও ম্যানেজার নিজে এসে তাদের টাকা দিতেন।’
এসব বিষয়ে নতুন ব্যবস্থাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তদন্ত শেষে স্যাররাই ব্যবস্থা নেবেন।’
তদন্ত কমিটির প্রধান এজিএম সাদিকুর রহমান বলেন, ‘ঠিক কত টাকা গরমিল হয়েছে তার তদন্ত চলছে। গ্রাহকদের টাকার বিষয়ে হেড অফিস সিদ্ধান্ত নেবে। যেসব গ্রাহকের হিসাবে ঝামেলা হয়েছে তাদেরকে দরখাস্ত দিতে বলা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এর বাইরে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
ব্যাংকের বিপুল টাকার হদিস না পাওয়ার এই ঘটনায় রোববার রাতে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। তারা হলেন- সিরাজগঞ্জের বেলকুচি জনতা ব্যাংক তামাই শাখার ব্যবস্থাপক আল আমিন, সহকারী ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম ও ব্যাংক অফিসার রাশেদুল ইসলাম।
আল আমিন সিরাজগঞ্জের ধানবান্দি পৌর এলাকার মো. হারান শেখের ছেলে, রেজাউল করিম বগুড়ার ধুনট থানার বেলকুচি গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে এবং রাশেদুল ইসলাম সিরাজগঞ্জের বনবাড়িয়া কাদাই গ্রামের জিয়াউল হকের ছেলে। তারা বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
প্রসঙ্গত, ২৪ মার্চ রোববার জনতা ব্যাংক পিএলসি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই শাখার ক্যাশ ভল্টে ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার গরমিল ধরা পড়ে।
পরে এ বিষয়ে জনতা ব্যাংক পিএলসি সিরাজগঞ্জের এরিয়া অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম তামাই শাখার ম্যানেজারসহ চারজনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।
এ ঘটনায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ তিন জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। হিসাব অনুসারে ভল্টে মোট ৭ কোটি ১১ লাখ ২৪০ টাকা থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে এক কোটি ৭৭ লাখ ৬১ হাজার ২৪০ টাকা। বাকি ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার কোনো খোঁজ মেলেনি।
মন্তব্য