দেশ থেকে টাকা পাচার রোধে কঠোর আইন করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আহ্বান জানিয়েছে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-ইআরএফ।
মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এনবিআর সম্মেলন কক্ষে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এই প্রস্তাবসহ মোট ২১ দফা সুপারিশ করেছে ঢাকায় কর্মরত অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠনটি।
টাকা পাচার বন্ধে কঠোর আইনসংক্রান্ত প্রস্তাবে ইআরএফ বলেছে, দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। এই পাচার রোধে ২০১৩ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছিল। বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু সেটা দেশবাসী জানে না। বর্তমান বাস্তবতায় মুদ্রা পাচার রোধে ভারত অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কঠোর আইন করা এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম। সভাপতি শারমীন রিনভী এবং ইআরএফের অন্য নেতারা বক্তব্য রাখেন।
ইআরএফের সুপারিশের ভূমিকায় বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অনেক দেশের সঙ্গেই এফটিএ বা পিটিএর মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হবে। সে কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শুল্ক আদায় তথা রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার ধাক্কা মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
আয়করসংক্রান্ত প্রস্তাব
>> এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ইটিআইনধারীর সংখ্যা ৭০ লাখের মতো। এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন ২৪ থেকে ২৫ লাখ। অথচ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। রিটার্ন দাখিল না করা এ বিপুল পরিমাণ টিআইএনধারীকে কর নেটের আওতায় আনতে আইনের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতনা করা দরকার।
>> সিটি করপোরেশন এলাকার নাগরিকদের সর্বনিম্ন কর ৫ হাজার টাকা। করের এ পরিমাণটি কমিয়ে সব টিআইএনধারীকে কর প্রদানে উৎসাহী করতে হবে।
>> দেশের অর্থনীতির পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দশ বছরে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর প্রদানে সামর্থ্যবান হয়েছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, এই মুহূর্তে দেশে করযোগ্য মানুষ অন্তত ২ কোটি। আবার কেউ বলছেন, এই সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। করযোগ্য নাগরিকের সংখ্যা নিয়ে এই বিভ্রান্তি দূর করতে কিংবা দেশে করযোগ্য প্রকৃত নাগরিকের সংখ্যা নিরুপণে এনবিআরের একটি ব্যাপকভিত্তিক জরিপ চালানো জরুরি। একই সঙ্গে তাদের করের আওতায় আনতে সারা দেশের উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।
>> স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জাতীয় সংসদে বলেছেন, বাংলাদেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। কিন্তু এনবিআরের আয়কর জমা দেন মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিক। দেশে কর্মরত বিদেশিরা বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায় বলে এক গবেষণায় জানিয়েছে টিআইবি। বিদেশি নাগরিকদের করের আওতায় আনতে এনবিআরের উদ্যোগ আরও জোরালো করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
>> বর্তমান আইন অনুযায়ী কাঁচামাল বা পণ্য আমদানির সময় ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে উৎসে কর কাটা হয়। এটি পরবর্তীতে সমন্বয় করে এনবিআর। তবে পণ্য বিক্রি করে কর সমন্বয়ের আগ পর্যন্ত ব্যবসায়ীর বড় আকারের মূলধন আটকে যায়। আমরা কর আদায়ের বিরোধিতা করছি না। তবে এভাবে ব্যবসার মূলধন আটকে না রেখে অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে কর আহরণ করা যায় কি না, তা ভাবতে অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে কোনো ব্যবসায়ী যেন কর ফাঁকি দিতে না পারেন সে জন্য এনবিআরের অটোমেশন ও কঠোর মনিটরিংয়ের সুপারিশ করছি।
>> অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে আরও জনপ্রিয় করতে ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা চালানো দরকার।
>> রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটটি আপগ্রেড করার প্রস্তাব করছি। এতে অনেক হালনাগাদ তথ্য ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে বোর্ডের গবেষণা সেলটি আরও কার্যকর ও যুগোপযোগী করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। একজন সদস্যের নেতৃত্বে গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
>> দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে, এই পাচার রোধে ২০১৩ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছিল। বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু সেটা আমরা জানি না। মুদ্রা পাচার রোধে ভারত অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কঠোর আইন করা যায় কি না সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
>> বিনিয়োগকারীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর কাঠামো প্রণয়ন করা যেতে পারে। এটি হলে উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
১০. আমরা জানি আয়কর নিয়ে একটি আইন হচ্ছে। এ আইনটি আধুনিক এবং সহজবোধ্য ভাষায় হচ্ছে। তবে আইনটির খসড়া হওয়ার পরপরই দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার। আইনটি বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসে তাদের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত করার অনুরোধ করছি।
>> কাঠামোগত সমস্যা বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এ দুর্বলতা কাটিয়ে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুর্নগঠন জরুরি। ভারতের মতো ডাইরেক্ট ট্যাক্স এবং ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স নামে দুটি বিভাগ গঠন করা যেতে পারে। দুই বিভাগে দুইজন সচিব নিয়োগ করা হবে। অথবা একটি রেভিনিউ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এর একজন প্রধান কমিশনার থাকবেন, যার অধীনে অন্য কমিশনাররা থাকবেন। সরকার তাদের নিয়োগ দেবে।
ভ্যাট ও কাস্টমস-সংক্রান্ত প্রস্তাব
>> বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে এনবিআর আইনি কাঠামোয় পরিবর্তনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এ খাতে অনিয়ম রোধ এবং আরও রপ্তানিবান্ধব বন্ড ব্যবস্থাপনা তৈরির জন্য এনবিআরের নেয়া বন্ডেড ওয়্যারহাউস অটোমেশন প্রকল্পের কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে পুরো প্রক্রিয়াকে অটোমেশনের আওতায় আনা দরকার।
>> এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের সমন্বয়ে একটি ট্যারিফ কমিশন পলিসি করা হয়েছে। তবে ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু এনবিআরের। কোন খাতের জন্য ট্যারিফ কেমন হবে, কীভাবে রেশনালাইজ করা উচিত তা আউট লাইন করা রয়েছে ওই পলিসিতে। স্থানীয় শিল্পের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী কী সুবিধা দেয়া উচিত তা নির্ধারণ করে ট্যারিফ পলিসিটি দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করছি।
>> রপ্তানিতে তৈরি পোশাকশিল্পের সফলতা অসামান্য। এর পেছনে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ডেড সুবিধাসহ নানা ট্যারিফ সুবিধা। রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্য সম্ভাবনাময় খাত যেন তৈরি পোশাকশিল্পের মতো নিয়মিত বন্ডেড সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
>> একই এইচ এস কোডে মাল্টিপল ট্যারিফ রয়েছে। এক ট্যারিফের পণ্য অন্য পণ্যের এইচ এস কোডে আমদানি করতে গেলে ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। অনেক সময় শুল্ক কর্তৃপক্ষের স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়। প্রতিটি পণ্যের জন্যই আলাদা এইচ এইচ কোড নির্ধারণ প্রয়োজন।
>> ব্যবসায় পরিবেশ সহজ করা এবং এনবিআরের কার্যক্রমকে অটোমেশন করতে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো করার উদ্যোগ রয়েছে এনবিআরের। ২০২২ সালে এটির উদ্বোধন হওয়ার কথা। আমরা প্রত্যাশা করব এ কাজটি যেন নির্ধারিত সময়েই শেষ হয়।
>> বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, সারা দেশে খুচরা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই কমপ্ল্যায়েন্ট নয়। স্বভাবতই তাদের বড় অংশ ভ্যাট দেয় না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাটের আওতায় আনার সুপারিশ করছি। পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের ভ্যাট পণ্য মূল্যের ওপর নির্ধারণ না করে সংযোজিত মূল্যের ওপর নির্ধারণ করা দরকার। কারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা ভ্যাট রিফান্ড পান না।
>> ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে ইএফডির ব্যবহার নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
>> পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এনবিআর সাধারণ কারখানা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের মধ্যে করপোরেট করের ব্যবধান কমপক্ষে ৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব কারখানায় অতিরিক্ত বিনিয়োগের তুলনায় বিদ্যমান ২ শতাংশ কর সুবিধা অপ্রতুল বলে মনে করছে অনেকে।
>> করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে বোতলজাত পানির ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক শিথিল করা যায় কি না সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে।
>> জেলা শহরের বাইরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উৎসাহ প্রদানে ওই বিনিয়োগকে করমুক্ত সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করছে ইআরএফ।
আরও পড়ুন:
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য অক্ষুণ্ন রেখে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০ বছর মেয়াদি ‘সুন্দরবন ইকোট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান (২০২৫-২০৪৫)’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি গতানুগতিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের মতো নয়, বরং সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষুন্ন রেখে কীভাবে টেকসই পর্যটন বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন করা যায়, তার একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ করা হয়েছে।
মাস্টারপ্ল্যানটি বন বিভাগ অনুমোদন দিলে ইউনেস্কো ঘোষিত এই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইউএসএআইডির আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশ বন বিভাগ ও সোলিমার ইন্টারন্যাশনাল এই উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ইউএসএআইডি ইকোট্যুরিজম অ্যাক্টিভিটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে তিন বছর মেয়াদে এ মাস্টারপ্ল্যানের বড় একটি অংশ বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে।
ডেপুটি চিফ অব পার্টি হিসেবে এ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে নেতৃত্ব দেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম।
তিনি জানান, এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছে। এটি মূলত সুন্দরবনের পরিবেশ ও অর্থনীতির সমন্বয়ে একটি টেকনিক্যাল রোডম্যাপ। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশীয় পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধি ঘটবে, স্থানীয়দের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত হবে এবং এর মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।’
ড. মো. ওয়াসিউল বলেন, ‘সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও খুলবে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি পর্যটকরা সুন্দরবনের কোলাহলমুক্ত, শান্ত, সুনিবিড় পরিবেশ এবং রাতের জ্যোৎস্না বিশেষভাবে উপভোগ করে থাকেন। এই চাহিদা কাজে লাগাতে পারলে পর্যটন খাত দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।’
মাস্টারপ্ল্যানটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর কমিউনিটিভিত্তিক ইকোট্যুরিজম মডেল। বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, ট্যুরিস্ট পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ও আঞ্চলিক ট্যুর অপারেটর এবং স্থানীয় বাসিন্দাসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে এটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
ড. ওয়াসিউল বলেন, ‘স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে পরিকল্পনাটি তৈরি হওয়ায় বিরোধের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। স্থানীয়রা সরাসরি ইকোট্যুরিজমে অংশ নেবে এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে উপকৃত হবে।’
পরিকল্পনায় বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরতা কমানোর বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। পর্যটনের মাধ্যমে বিকল্প ও টেকসই জীবিকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে সুন্দরবনের পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় থাকে।
তিনি আরও বলেন, ‘এই পদ্ধতি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ওপর চাপ কমাবে এবং ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ার-ভাটার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে এর সহনশীলতা বাড়াবে।’
এই প্রকল্পের অধীনে ২০০ জনের বেশি ইকো-গাইডকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা পর্যটকদের গাইড করবে এবং মানুষ-বন্যপ্রাণীর সংঘাত কমিয়ে আনবে। তাদের তত্ত্বাবধানে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিশ্চিত হবে, যা পরিবেশের ক্ষতি কমাবে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক জানান, দাকোপ এলাকায় যে সকল ইকো-কটেজ স্থাপন করা হয়েছে, সেসব কটেজে কর্মরত স্থানীয় কর্মচারীদেরও গেস্ট ম্যানেজমেন্ট এবং পর্যটক সেবা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে পর্যটকদের সাথে কোনো ধরনের সংঘাত বা ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার সুযোগ কম থাকে।
পর্যটকদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য মাস্টারপ্ল্যানে প্রধান তিনটি প্রবেশপথ মোংলা, মুন্সীগঞ্জ ও শরণখোলায় তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো পর্যটকদের নৌকা ভাড়া করা, ইকো-গাইড নিয়োগ করা এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক পর্যটন সুবিধা পেতে সাহায্য করবে।
বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বাসসকে জানান, প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ পর্যটক সুন্দরবনে ভ্রমণ করতে আসেন।
তিনি বলেন, ‘এ বিপুল সংখ্যক পর্যটককে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। এই মাস্টারপ্ল্যানটি বনের ক্ষতি না করে দায়িত্বশীল ইকো-ট্যুরিজমকে উৎসাহিত করছে। এটি একটি সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
ইমরান আহমেদ জানান, পরিকল্পনাটি বর্তমানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনভিত্তিক ইকোট্যুরিজম খুলনাকে জাতীয় রাজস্বের একটি বড় উৎসে পরিণত করবে।’
সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামবাসীরাও পরিকল্পনাটি নিয়ে আশাবাদী। তারা জানান, আগে কিছু ব্যক্তিগত কটেজে অনিয়ম ও অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছিল। তবে নতুন পরিকল্পনায় সরকারি তত্ত্বাবধান থাকায় একসঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জনকল্যাণ নিশ্চিত হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০ বছর মেয়াদি এই মাস্টারপ্ল্যান সুন্দরবনকে টেকসই পর্যটনের আদর্শ রূপে গড়ে তুলবে, যা বন সংরক্ষণকে উৎসাহিত করবে, স্থানীয়দের শক্তিশালী করবে এবং বিশ্বজুড়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করবে।
সূত্র: বাসস
বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ঢাকা ইলেকটিক্স সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ১২৫ কোটি টাকার বেশি লোকসান করেছে। রোববার প্রকাশিত কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি গত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি ।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডেসকোর শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩ টাকা ১৫ পয়সা। ডেসকোর মোট শেয়ারের সংখ্যা ৩৯ কোটি ৭৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮০৪। সে হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট লোকসান হয়েছে ১২৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা ৪৪ হাজার ৮৮২ টাকা।
নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত অর্থবছর শেষে ডেসকোর শেয়ার প্রতি নিট সম্পত্তি দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকা ৩৩ পয়সা, শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ৯৩ পয়সা।
কোম্পানির মূল্য-সংবেদনশীল তথ্যের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেহেতু কোম্পানির চলতি বছরে লোকসান হয়েছে এবং অবণ্ঠিত পুঞ্জীভূত মুনাফা ঋণাত্মক, তাই পরিচালনা পর্ষদ এ বছর কোনো লভ্যাংশ সুপারিশ করতে পারেনি।
টানা তিন বছর ধরে লোকসানে রয়েছে ডেসকো। এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১২ টাকা ৭২ পয়সা। সে হিসেবে নিট লোকসান হয় ৫০৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানি শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১৩ টাকা ৬১ পয়সা। সে হিসাবে নিট লোকসান হয় ৫৪১ কোটি ২১ লাখ টাকা।
কোম্পানির মূল্য-সংবেদনশীল তথ্যের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত শনিবার ডেসকোর পরিচালনা পর্ষদের সভায় গত ৩০ জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব বিবরণী অনুমোদিত হয়। সভায় ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি সকাল ১০টায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ২৯তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। এর জন্য রেকর্ড ডেট রাখা হয়েছে আগামী ২০ নভেম্বর।
প্রায় এক মাসের স্থিতিশীলতা ভেঙে আবারও বেড়েছে এশিয়ার স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম। ইউরোপে আগেভাগে শীত শুরু হওয়া এবং ইউক্রেনের গ্যাস অবকাঠামোয় রাশিয়ার হামলার প্রভাবেই এই জ্বালানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। খবর: রয়টার্স ও মার্কেট স্ক্রিনার।
শিল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় নভেম্বরে সরবরাহের জন্য গত সপ্তাহে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির গড় মূল্য ছিল ১১ ডলার, যা আগের সপ্তাহে ছিল ১০ ডলার ৬০ সেন্ট। ডিসেম্বর সরবরাহের জন্য গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে ১১ ডলার ২০ সেন্ট প্রতি এমএমবিটিইউ।
এফজিইর গ্যাস ও এলএনজি সাপ্লাই অ্যানালিটিকস বিভাগের পরিচালক সিয়ামাক আদিবি বলেন, ‘ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেছে, কারণ অক্টোবরের শুরুতেই ঠাণ্ডা আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। ফলে বৈশ্বিক বাজারে এলএনজির দামও ঊর্ধ্বমুখী।’
তিনি আরও জানান, ‘ইউরোপে গ্যাস মজুত বাড়ানোর গতি কমলেও রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল থেকে সরবরাহ উচ্চমাত্রায় রয়েছে। তবে এশিয়ার বাজারে চাহিদা এখনো তুলনামূলক কম। মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার বাজারেও মৌসুমি প্রভাবে চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ফলে চলতি শীত মৌসুমে এলএনজির দিকনির্দেশনা নির্ভর করবে ইউরোপের ওপর।’
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটস জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে নভেম্বরে সরবরাহের জন্য এলএনজির গড় মূল্য ছিল প্রতি এমএমবিটিইউ ১০ ডলার ৩৩ সেন্ট, যা নেদারল্যান্ডসের টিটিএফ ফিউচার সরবরাহ চুক্তির তুলনায় ৬৩ সেন্ট কম।
অন্যদিকে, আর্গাস এলএনজির মূল্য নির্ধারণ করেছে ১০ ডলার ৩৬ সেন্ট এবং স্পার্ক কমোডিটিস ১০ ডলার ৩০ সেন্ট প্রতি এমএমবিটিইউ।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের আটলান্টিক এলএনজির ব্যবস্থাপক এলি ব্লেকওয়ে জানান, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্প্রতিক হামলায় প্রায় ৩০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন ব্যাহত হয়েছে। তা ছাড়া অক্টোবরেই ইউরোপে শীত শুরু হওয়ায় গ্যাস মজুত থেকে উত্তোলন শুরু হয়েছে, যা দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত গত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশের বেশি কম। ফলে পর্যাপ্ত সরবরাহ বজায় রাখতে শীত মৌসুমে ইউরোপকে তুলনামূলক বেশি দামে এলএনজি আমদানি করতে হতে পারে।’
তবে আইসিআইএসের সিনিয়র এলএনজি বিশ্লেষক অ্যালেক্স ফ্রোলি মনে করেন, সেপ্টেম্বরে চীনের এলএনজি আমদানি হ্রাস এবং মিসরের দুর্বল চাহিদা ইউরোপীয় বাজারের দামের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে।
অন্যদিকে স্পার্ক কমোডিটিসের বিশ্লেষক ম্যাক্স গ্লেন-ডোয়েপেল জানান, ‘বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে রপ্তানির প্রণোদনা এখনো বেশি, কারণ উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় সরবরাহের তুলনায় ইউরোপীয় বাজারে মূল্য সুবিধা বেশি।’
এদিকে এলএনজির পরিবহন খরচও কিছুটা কমেছে। গত শুক্রবার পর্যন্ত আটলান্টিক রুটে পরিবহন ব্যয় কমে দৈনিক ২২ হাজার ডলার, আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় রুটে তা স্থির হয়েছে ২৪ হাজার ডলারে।
শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে বেসরকারি খাতের পুঁজি, উদ্ভাবন ও সম্পৃক্ততা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে আইসিসি বাংলাদেশের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংলাপে ইউনিসেফের প্রাইভেট ফান্ডরেইজিং ও পার্টনারশিপস বিভাগের পরিচালক কার্লা হাদ্দাদ মারদিনি এ আহ্বান জানান।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশ ও ইউনিসেফের মধ্যে আয়োজিত এ সংলাপে শিশুদের অধিকার রক্ষা, টেকসই উন্নয়ন এবং সামাজিক কল্যাণে বেসরকারি খাতের ভূমিকা নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা হয়। রোববার আইসিসি বাংলাদেশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আইসিসি বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিশ্রুতিবদ্ধভাবে কাজ করছে। প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের বাংলাদেশ অধ্যায় হিসেবে আইসিসি বাংলাদেশ দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনা ও নৈতিক কর্পোরেট চর্চা প্রচারে নিরলসভাবে কাজ করছে, যা জাতীয় অগ্রাধিকার ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তিনি আরও জানান, ইউনিসেফের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আইসিসি বাংলাদেশ নিয়মিত সহযোগিতা করে আসছে। ২০২২ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় ইউনিসেফ বাংলাদেশের কার্যক্রমে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেয় সংস্থাটি। পরে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার শিশুদের জন্য চিকিৎসা, খাদ্য ও মানবিক সহায়তায় ইউনিসেফ প্যালেস্টাইনের কার্যক্রমে তিন কোটি টাকা অনুদান প্রদান করে।
সংলাপে ইউনিসেফের পরিচালক কার্লা হাদ্দাদ মারদিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখনই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, উদ্ভাবন ও সহযোগিতাকে কাজে লাগানো জরুরি। ব্যবসায়ী সমাজকে একত্রিত করে যৌথ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমরা আইসিসি বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন আইসিসি বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এ. কে. আজাদ, এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি. রহমান, ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ, বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, বিজিএমইএ সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার বিদ্যা অমৃত খান, প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের এমডি ফজলুল হক, উত্তরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান, সায়হাম কটন মিলসের এমডি প্রকৌশলী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আইসিসি বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল আতাউর রহমানসহ ইউনিসেফ ও আইসিসি বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ইউনিসেফ প্রতিনিধি দল বৈঠকে বলেন, বেসরকারি খাত শুধু অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমেই নয়, তাদের প্রভাব, প্ল্যাটফর্ম ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে শিশু অধিকার, লিঙ্গ সমতা ও তরুণদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সভা শেষে আইসিসি বাংলাদেশ ও ইউনিসেফ ভবিষ্যৎ সহযোগিতার জন্য একটি যৌথ রোডম্যাপ প্রণয়নে সম্মত হয়। এই রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য হবে করপোরেট সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, নীতিগত সংলাপ জোরদার এবং শিশু ও তরুণদের কল্যাণে সম্প্রদায়ভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। এটি ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর স্বাক্ষরিত আইসিসি বাংলাদেশ–ইউনিসেফ সমঝোতা স্মারকের আওতায় পরিচালিত হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, লালদিয়ার চর এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনাল ডিসেম্বরের মধ্যে বিদেশি অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ।
তিনি বলেন, তিন টার্মিনালের মধ্যে পানগাঁও ছেড়ে দিতে কিছুটা সময় নেওয়া হবে।
এছাড়া নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) অক্টোবরের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল, সেটারও কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছে।
রোববার রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইকোনমিক রিপার্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে বিনিয়োগ সম্ভাবনা’ বিষয়ক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সচিব এ কথা বলেন।
মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আলোচনা শুরু হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি অপারেটরদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক ইস্যু আছে, ভৌগোলিক ইস্যু আছে। আমরা মনে করি, সেটা বড় কোনো বিষয় হবে না। শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরে বিদেশি অপারেটর কাজ করছে। সেখানে কোনো সমস্যা না হলে এখানে সমস্যা হবে কেন?
চট্টগ্রাম বন্দরের ক্যাপাসিটি বাড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও যেটা নেই, আমরা তা করছি, বন্দরের মধ্যে কন্টেইনার খুলে পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছি। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩টি গেট আছে, এর মধ্যে স্ক্যানিং মেশিন আছে মাত্র ৬টি। তার মধ্যে আবার ৩-৪টি নষ্ট থাকে। এভাবে বন্দর চলতে পারে না। এজন্য আমরা বন্দরের ক্যাপাসিটি বাড়াতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। এটা করতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যাবে।
‘ব্যবসায়ীরা বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিরোধিতা করছেন, এরপরও বন্দর কি ছেড়ে দেওয়া হবে?’— এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, তারা আগে এমন নানা কথা বলেন, কিন্তু পরে পরিস্থিতি দেখে আর কথা বলেন না।
‘বন্দরের উন্নয়নে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে, এজন্য খরচ বাড়ানো হবে, এটা বহন করতে পারবেন কি না’—এমন এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, সেবার মান বাড়ানো হলে, দ্রুত সেবা দেওয়ার মাধ্যমে বন্দরে অযথা জাহাজ বসিয়ে রাখা হ্রাসের মাধ্যমে ড্যামারেজ কমিয়ে আনতে পারলে বাড়তি খরচ দিতে কোনো সমস্যা হবে না।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, জাহাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে একই দেশে দুই ধরনের পতাকার অস্তিত্ব রয়েছে। আইন অনুযায়ী সরকারি টাকায় কেনা পণ্য শুধু দেশের পতাকাবাহী জাহাজ বহন করতে পারবে। সরকার মালিকানাধীন জাহাজ বোঝাতে সরকারি পতাকাবাহী জাহাজের কথা বলা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, তাহলে দেশের বেসরকারি জাহাজ কোন দেশের পতাকা বহন করে?
মূল প্রবন্ধে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়দী সাত্তার বলেন, দেশে জাহাজভাঙা শিল্প ও ছোট জাহাজ নির্মাণ খাত বড় জাহাজ নির্মাণের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে। জাহাজ রপ্তানির জন্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ আছে। এগুলো ঠিক মতো সরবরাহ করতে পারলে কার্যাদেশ আরও বাড়বে। এজন্য প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে জাহাজ নির্মাণশিল্প উপযোগী ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নির্ভর করে জাহাজ নির্মাণশিল্প। বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য এখন ইতিবাচক রয়েছে। এ সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে জাহাজ নির্মাণশিল্প দুই বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত করা সম্ভব।
স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী শিল্পের দিকে যেতে হবে। জাহাজ নির্মাণশিল্প সেই শিল্প যা শুধু তৈরি পোশাক নির্ভর শিল্পের বাইরে টেকসই শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফের সভাপতি দৌলত আক্তার মালা, পরিচালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
চট্টগ্রাম বন্দরের বর্ধিত ট্যারিফ স্থগিত করার দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। অস্বাভাবিক ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রতিবাদে রোববার চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু বে ভিউতে ব্যবসায়ীদের সমন্বয় সভায় বক্তারা এ দাবি করেন। বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনা না করা পর্যন্ত এ ট্যারিফ স্থগিত করার দাবি জানানো হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের ব্যানারে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এসএম আবু তৈয়বের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন এশিয়ান গ্রুপের প্রধান এমএ সালাম।
এতে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক, বিজিএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি সেলিম রহমান, মেট্রোপলিটন চেম্বারের
সহ-সভাপতি এএম মাহবুব চৌধুরী, শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন, সাবেক পরিচালক খায়রুল আলম সুজন, বিজিপিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী, বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরীসহ, বেপজার সিনিয়র সহ-সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভিরসহ ব্যবসায়ী নেতারা বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ২০০৩ সালে বাফার সঙ্গে গার্মেন্টসের যখন সমস্যা হয়েছিলো তখন আমি চেম্বারের সভাপতি ছিলাম। বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ একসঙ্গে প্রতিরোধ করতে পেরেছিলাম। এবার বন্দরের নতুন ট্যারিফ সাধারণ মানুষকে দিতে হবে। বন্দর নিয়ে যে খেলা শুরু হয়েছে তা খেলতে দেওয়া হবে না। বন্দরে চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে একজন প্রতিনিধিকে পরিচালক করতে হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, বন্দরের মাশুল ব্যবসায়ীরা পেমেন্ট করব না। এটা জনগণকে পেমেন্ট করতে হবে। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে স্বাধীন পরিচালক আছে, বন্দরে নেই কেন? আমরা কারও গোলাম না। আমার টাকায় আপনারা চালান। ট্যারিফ বাড়ানো ষড়যন্ত্র। মোংলা, পায়রায় বাড়াননি। আমি ৪০ বছর ব্যবসা করছি। কচি খোকা নই। বন্দর বাঁচাতে হবে। বন্দরকে কস্ট বেইজড ট্যারিফ করতে হবে। আমরা কি গোলাম? কলুর বলদ? অন্তর্বর্তীকালীন কেন ট্যারিফ বাড়াবে? আর কোনো টাকা বন্দরের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। এনসিটির পর একটি পতেঙ্গা টার্মিনাল হয়েছিল, সেটি দিয়ে দিয়েছেন!
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান বলেন, আরএমজি ব্যবসায়ীরা বন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি দুটোই করে। ভিয়েতনাম, ভারত ও মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বেশি। ২৯ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতায় বন্দরকে লস করতে দেখিনি। তাহলে বন্দরে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ কেন বাড়াতে হবে?
মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহ সভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, আমরা ট্যারিফ বাড়ানোর বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম বন্দর জনগণের টাকায় তৈরি সেবার জন্য। ২০২৩ সালের বন্দর আইনে উপদেষ্টা পরিষদ বাতিল করেছে। স্বাধীনতার সময় বন্দরে কাঁটাতারের বেড়া ছিল। পৃথিবীতে সাড়ে চার হাজার বন্দর আছে। আড়াই হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বাড়াতে হলে জাতীয় সংসদ বাড়াবে। এ দেশের গার্মেন্টস থেকে বায়ার পোশাক কিনবে না। ভিয়েতনাম, ভারতে চলে যাবে বায়ার। বন্দর আমাদের কাছে নেই। আমাদের চুষে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করছে। আমদানি খরচ বাড়লে রপ্তানি খরচ বাড়বে। সব শিপিং এজেন্টদের সমভাবে নির্ধারণের দায়িত্ব চিটাগাং চেম্বারের।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি এবং পরবর্তীতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে আগ্রহী বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে এ আগ্রহের কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
রোববার সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার অফিসে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন(ইইউ) বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার। ইইউ-এর সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্ভাবনার সম্ভাব্যতা যাচাই ও বাণিজ্যিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি এবং পরবর্তীতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে চায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের প্রধান মাইকেল মিলার বলেন, সম্পর্কোন্নয়নে বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে উভয় পক্ষেরই সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ আছে।
বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান, স্পেনের রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েল সিসটিয়াগা, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টিয়ান ব্রিক্স মুলার, ফ্রান্স দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন ফ্রেডরিক ইনজা, জার্মান দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন এনজা ক্রিস্টেন, ইতালি দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন ফ্রেডরিকো জামপ্রেল্লি, সুইডেন দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন ইভা স্মেডব্রেগ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ ডেলিগেশনের ট্রেড অ্যাডভাইজার আবু সাইদ বেলাল উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য