আব্বা হয়তো চাইতেন আমাকে বৈশ্বিক করে তুলতে, কিন্তু রেডিও আর দুদিন পর ঢাকা থেকে আসা ইত্তেফাক ছাড়া তখন তো আর কোনো উপায় নেই জানলা খুলে আকাশ দেখার!
বাড়িতে চার ব্যাটারির একটা ওয়ান ব্যান্ড রেডিও ছিল। তা দিয়েই খবর, আধুনিক গানের অনুরোধের আসর, নাটক বা কথিকা শুনতাম, আর ছিল সিনেমা হল।
সিনেমা হলে শো ছিল তিনটি। ম্যাটিনি, ইভিনিং আর নাইট শো। তবে ‘মর্নিং শো’ নামে ছুটির দিনের সকালে মাঝেমধ্যে বিদেশি ইংরেজি ছবি দেখানো হতো।
আব্বা আমাকে মর্নিং শো দেখতে নিয়ে যেতেন। কাহিনি, সংলাপ কিছুই বুঝতাম না। ঘোড়ার দৌড়, গোলাগুলি, খুব জোরে গাড়ির চলা ছাড়া আর যে দৃশ্যের কথা এখনও মনে আছে তা হলো চুম্বন।
প্রায়ই দেখতাম পুরুষ আর নারী মুখে মুখ লাগিয়ে পরস্পরের ঠোঁট চুষছে। ব্যাপারটা বুঝতাম না। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম ওরা এমন করে কেন?
আব্বার জবাব, ‘ওরা চুমু খাচ্ছে।'
পানজর্দা বা ভাতমাছ খাওয়া জ্ঞান নিয়ে চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হতো না। আবারও প্রশ্ন করলাম, ‘কেন চুমু খাচ্ছে?’
আব্বার জবাব, ‘ওরা একজন স্বামী আর একজন স্ত্রী, দুজন দুজনকে ভালোবাসে, তাই চুমু খাচ্ছে।’
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা থাকলে চুমু খায়, এ পর্যন্ত বুঝলাম। আর কোনো প্রশ্ন ছাড়া এটাও বুঝলাম, আমার বাবা-মায়ের মধ্যে কোনো ভালোবাসা নেই। কারণ, তারা স্বামী-স্ত্রী হলেও চুমু খায় না।
এ রকম সময়েই একদিন বাড়িতে একটা মলাট দেয়া বই পেলাম ‘স্বামী-স্ত্রীর মিলন রহস্য’। বইয়ের একটা অধ্যায় ছিল ‘বাসর রাত’।
সেখানে বাসর রাতে স্বামীর করণীয় হিসেবে নববিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি আচরণের স্টেপ বাই স্টেপ বিবরণ দেয়া ছিল। যেমন স্বামী বাসরঘরে ঢুকবেন, এক গ্লাস দুধ খাবেন, তারপর স্ত্রীর ‘কপোলদেশে চুম্বন’ করবেন।
এ পর্যন্ত পড়ে আমাকে থামতে হয়। কারণ, তখন আমি কপাল চিনি, কপোল চিনি না। বাংলাদেশ চিনি কপোলদেশ চিনি না। চুমু চিনি, চুম্বন চিনি না!
‘স্বামী-স্ত্রীর মিলন রহস্য’ লুকিয়ে পড়ার পর চুম্বন বিষয়ে আগ্রহ বেড়ে গেল। একদিকে বই পড়া ধারণা, আরেক দিকে বাস্তবের সঙ্গে অমিল।
এর মধ্যে হাতে এলো ঝিনুক প্রকাশনীর সুলভ সংস্করণের ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’। বাড়িতেই ছিল। হয়তো আব্বাই চেয়েছেন আমি পড়ি। তাই বইটি বাইরে ফেলে রেখেছেন যেন আমার চোখে পড়ে।
আমি তখন ক্লাস সেভেন বা এইটের ছাত্র। আব্বাকে ভয় নেই, তিনি সারা দিন অফিসে থাকেন। মার চোখ ফাঁকি দেয়া কঠিন নয়। অতএব বইটা পড়ে ফেললাম এবং প্রায় কিছুই বুঝলাম না।
অনেক ধোঁয়াটে বাংলা শব্দ, যা কোথাও কোনো দিন পড়িনি বা শুনিনি। তবে প্রবল এক আকর্ষণ বোধ করলাম বইটার ওপর। পড়ার বইয়ের ফাঁকে, লেপের ভাঁজে, বালিশের খোলের ভিতর লুকিয়ে রাখি আর বারবার পড়ি। শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে বোঝার চেষ্টা করি। যেমন: ওষ্ঠ মানে যেহেতু ঠোঁট, তাহলে উপরোষ্ঠ হলো ওপরের ঠোঁট, আর নিম্নোষ্ঠ হলো নিচের। ঠোঁট তাহলে দুটো! একটা না, কী আশ্চর্য! শব্দে শব্দে বিস্ময়!
ততদিনে আমি জেনে গেছি যাহা চুমু তাহাই চুম্বন। এই বইয়ে পেলাম চুম্বন নামে একটি আলাদা অধ্যায়। যেখানে দেখলাম কেবল ওষ্ঠ নয় বরং আরও অন্তত ১০টি জায়গায় চুম্বন করা যায়, যার কোনোটাই আমি চিনি না।
সিনেমায় দেখা কেবল ওই এক রকম নয় বরং আরও অন্তত সাত রকমভাবে চুম্বন করা যায়। যেমন নায়ক যখন কাজে ব্যস্ত থাকে তখন তাকে বিরক্ত বা বিব্রত করার জন্য ইয়ার্কি ধরনের চুম্বনকে ‘চলিতক’ বলে।
আবার নায়ক ও নায়িকা একজন আরেক জনকে মনের ভাব জানানোর জন্য দূর থেকে ইশারায় যে চুমু দেয় তাকে ‘ছায়াচুম্বন’ বলে (এই ছায়াচুম্বনকেই সম্ভবত আজকাল ফ্লাইংকিস বলা হয়)।
যাহোক, আগেই বলেছি, পাতায় পাতায় বিস্ময়! এক অধ্যায় ছেড়ে আরেক অধ্যায় বানান করে করে পড়ি আর যেন দুধের সাগর থেকে ক্ষীরের সাগরে হাবুডুবু খাই।
মজার ব্যাপার হলো, আব্বা বলেছিলেন, স্বামী আর স্ত্রী ‘চুমু খায়’, তবে এই বইয়ে লেখা ‘নায়ক আর নায়িকা’। কোথাও স্বামী-স্ত্রীর কথা নেই।
তাহলে কি স্বামী-স্ত্রী না হলেও চুমু খাওয়া যায়? তাহলে কি সিনেমার বাইরেও মানুষ নায়ক বা নায়িকা হতে পারে?
ঝিনুকের ওই সংক্ষেপিত সুলভ সংস্করণে সব প্রশ্নের জবাব নেই। আব্বাকে প্রশ্নেরও সুযোগ নেই। মনে প্রবল জানার ইচ্ছা, শরীরে অজানা শিহরণ। আমি তখন ১৪ বছর, আমার তখন বয়ঃসন্ধিকাল।
মহর্ষি বাৎস্যায়নের কামসূত্রের ‘চুম্বন’ অধ্যায় আমার সামনে যেন এক মহা রহস্যের হাতছানি হয়ে দাঁড়াল। ঠাকুরমার ঝুলির দৈত্য বা পাতালপুরির রাজকন্যা আমাকে আর টানে না। দস্যু বনহুরের সবগুলো সিরিজ পড়ি। নূরি আর মনিরা, একজন জঙ্গলে আরেকজন শহরে, বনহুরের দুই স্ত্রী। তাদের সঙ্গে বনহুরের সম্পর্ক ভালোবাসার। অথচ তাদের মধ্যে চুম্বন নেই।
বাৎস্যায়ন লিখেছেন, কেবল নায়কই চুম্বন করবে তা নয়, নায়িকাও চুম্বন করতে পারে। তবে যা পড়ি তাতে কোথাও এসবের উল্লেখ নেই।
এ রকম প্রশ্নময় বয়ঃসন্ধিতে আব্বা কুষ্টিয়ার কুমারখালী বদলি হলেন। আমি যোগেন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি, পাবলিক লাইব্রেরিটা পাশেই। লাইব্রেরির শিশু সদস্য হলাম। ছোটদের রবীন্দ্রনাথ, ছোটদের শেক্সপিয়ার এ রকম ছোটদের বই অনেক। তবে আমার আগ্রহ বড়দের বইয়ে। লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ি, বই বাড়িতেও আনি।
অনেক উপন্যাসও পড়ছি তখন। প্রেম-ভালোবাসা বিরহের সব কাহিনি। ভালো লাগছে। মনে আছে ‘শাপমোচন’ পড়ে জীবনের বইপড়া কান্নার শুরু। সরলরেখার মতো কাহিনি অথচ প্রচণ্ড ভালো লাগা। এক বিজয়ার দিনে চাকরিপ্রার্থী মহেন্দ্র আসে ধনী মাধুরীদের বাড়িতে। মাধুরী তাকে ভালোবাসতে শুরু করে, কিন্তু সে ভালোবাসায় সাড়া না দিয়ে মহেন্দ্র গ্রামে ফিরে যায়। হারিয়ে যায় মাধুরীর জীবন থেকে। অথচ বিরহী মাধুরী অপেক্ষায় থাকে। প্রত্যেক বিজয়ার দিনে মহেন্দ্রকে চিঠি লেখে, ভাবে একবার যদি এই চিঠি মহেন্দ্রর হাতে পড়ে, যদি আবার মহেন্দ্র ফিরে আসে! সেইসব চিঠির কোনো দিন কোনো উত্তর আসে না।
মহেন্দ্রর এই ভীরুতা ভালো লাগে না আমার। মনে হয়, সে যদি শহরে থেকে যেত, সেও যদি ভালোবাসত, তাহলে তাদের মধ্যে চুম্বন হতে পারত। আর একবার চুম্বন হয়ে গেলে এই বিরহ মিলনে রূপ নিত। কতই না ভালো হতো সেটা।
দেবদাস পড়েও একই রকম মনে হয়েছিল। মনে পড়ে সেই অংশটা। দেবদাস ছিপ ফেলে বসে আছে, পার্বতীও ঠিক সময়ে এসে পড়েছে পুকুর ঘাটে।
“-আমি এসেচি পারু !
পার্ব্বতী কিছুক্ষণ কথা না কহিয়া, শেষে অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল,
-কেন?
-তুমি আসতে লিখেছিলে, মনে নেই?
-না।
-সে কি পারু! সে রাত্রের কথা মনে পড়ে না?
-তা পড়ে। কিন্তু সে কথার আর কাজ কী?”
এরপর দেবদাস রেগে গিয়ে ছিপ দিয়ে পার্বতীর মাথায় বাড়ি দেয়। পার্বতীর কপাল কেটে ‘সমস্ত মুখ রক্তে ভাসিয়া গেল। মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া বলিল, দেবদা, করলে কী!’
ঠিক এই সময়ে আমার মনে হয়, ছিপের বাড়ির চেয়ে একটা চুমুর অ্যাকশন বেশি হতে পারত। দেবদাস সাহস করে পার্বতীকে একটা চুম্বন দিয়ে দিলে সব মান, অভিমান, ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যেত। ফলে দেবদাসকে মরতে হতো না, আবার পার্বতীকেও বুড়ো দোজবরকে বিয়ে করতে হতো না।
যে বই-ই পড়ি সবখানেই ‘হতে হতেও হয় না’। কোথাও চুমুর কোনো বাস্তব বিবরণ নেই। তবে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটা পড়ে ধারণাটি একটু স্পষ্ট হয়।
‘চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর’ পড়ে মনে হয় চুম্বনের মধ্যে একটা কম্পনের, একটা আবেশের, একটা মুগ্ধতার ব্যাপার আছে। সুতরাং এটা বেশ স্পেশাল একটা ব্যাপার। এটা যে সত্যি স্পেশাল তা বুঝলাম রবীন্দ্রনাথের ‘চুম্বন’ কবিতাটি পড়ে।
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।
আর এই কবিতা পড়া মাত্র আমার বোঝার উপর শাকের আঁটি উঠে গেল! কারণ ওষ্ঠ জানি, অধর জানি না। দোঁহা বা দোঁহে কী জানি না। আর সংগম তো জানিই না।
রবীন্দ্রনাথের ‘চুম্বন’ পড়ার পর আমাকে ডিকশনারি কিনতে হলো। মানে আব্বাকে বলে কেনাতে হলো। আর আমি সাগ্রহে অধর, দোঁহা, সংগম ইত্যাদি শব্দের অর্থ খুঁজে নিলাম।
পুরো কবিতাটি আমি বারবার পড়ি আর অজানা শিহরণ, অচেনা অনুভব আর অনাস্বাদিত পুলকে দেহ-মন জেগে ওঠে। একি অকালবোধন নাকি নবজন্ম?
পরে জেনেছি, সেটাই ছিল আমার যৌনজাগরণ (sexual awakening) এবং আমার যৌনদিকস্থিতি (sexual orientation)।
রবীন্দ্রনাথ আমাকে বোঝালেন, চুম্বন কোনো যেনতেন ব্যাপার নয়। কেবল ঠোঁট চোষা নয়। চুম্বন হলো একজনের হৃদয় অন্যজনে পান করা। সাগরের গভীরে ঢেউয়ের উদ্ভব হলে তাকে যেমন একসময় তীরে এসে আছড়ে পড়তেই হয়; তেমন দুটি মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক প্রেমের নিয়মে যে উচ্ছ্বাস আর অনাবিল কামনা তৈরি হয়; সেটাই অবশেষে চুম্বন হয়ে ‘ভাঙ্গিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে’।
দুজনের অবরুদ্ধ ব্যাকুল বাসনা দেহের সীমায় এসে দুজনকে খুঁজে পায়। অতঃপর প্রেমের যে গান তার চূড়ান্ত স্বরলিপি লেখা হয় ঠোঁটে ঠোঁটে-
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থর থরে চুম্বনের লেখা।
লাইব্রেরির বই পড়ি। হলরুমে টিভিতে ইংলিশ সিরিজ দেখি। ‘হাওয়াই ফাইভ ও’ নামে একটা সিরিজ চলত তখন। কুমারখালী শহরে তখন টিভি দেখা যায় তিন জায়গায়- লাইব্রেরি, কলেজ আর গার্লস স্কুলে।
বই পড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলি তখন নিয়মিত। পুকুরে বা গড়াই নদীতে সাঁতার দিয়ে গোসল করি। গড়াই তখনও প্রাণময়, সেখানে আমি ইলিশ ধরতেও দেখেছি।
শীতে আমাদের স্কুলের মাঠে যাত্রা হতো রুপালি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে। বন্ধু উমর সেখানে শিশু চরিত্রে অভিনয় করত। আব্বা সৌজন্য প্রবেশপত্র পেতেন, আর সেটার ব্যবহার করতাম আমি।
লাকি খান নামে একজন নৃত্যশিল্পী ঢাকা থেকে এসেছিলেন একবার। তার নাচ দেখলাম কাছ থেকে। ছোট কাপড়ে সেই প্রথম নারীদেহের চড়াই-উতরাই দেখা। একদিকে চুম্বনের প্রতি আগ্রহ, অন্যদিকে নারীদেহের পৃথক বৈশিষ্ট্য আমাকে বড় করে তুলছিল। আমার কথা বলা কমল, কল্পনা করা বাড়ল।
কৌতূহলের মাত্রা যাই হোক, সত্যি বলছি, নিজে চুম্বন করব বা আমাকে কেউ চুম্বন করবে এমন কোনো ভাবনা তখনও মনে আসেনি। তবে প্রশ্ন এসেছে। বাৎস্যায়ন, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের বর্ণিত চুম্বনের সঙ্গে মর্নিং শোর সিনেমায় দেখা সাদা মেম-সাহেবদের চুম্বনে মিল নেই কেন? এদের চুম্বনে ওই কম্পন, আবেশ বা হৃদয় পান করার মেজাজটা নেই কেন?
ফলে নিজেদের দেশের দুটি মানুষ চুম্বন করছেন এটা দেখার, দেখে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করে বোঝার ইচ্ছাটা যেন আরও জোরালো হলো।
এই সময়ে আশার আলো নিয়ে এলো ‘অনন্ত প্রেম’। চিত্রালীতে পড়লাম ‘অনন্ত প্রেম’ নামে একটা সিনেমা আসছে যেখানে রাজ্জাক-ববিতা চুম্বন করবে। কুমারখালীর ‘জলি’ সিনেমা হলে আসার আগেই নতুন সিনেমাগুলো প্রথমে আসত কুষ্টিয়ার বনানী, রক্সি বা কেয়া হলে। আমি অপেক্ষায়। এই সিনেমা আমাকে দেখতেই হবে।
সিনেমা এলো রক্সি হলে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে দেখলাম। কিন্তু চুমু তো নেই! তাহলে?
‘অনন্ত প্রেম’-এ চুম্বন না দেখতে পেয়ে ভাঙা মনের রথে চেপে রক্সি হল থেকে বেরিয়ে বড় বাজার রেলগেট পার হয়ে রবীন্দ্রনাথের টেগর লজ ডানে রেখে কুষ্টিয়া স্টেশনে এসে ট্রেনে চেপে কুমারখালী ফিরলাম।
ছবিটা সুন্দর, ভীষণ রোমান্টিক। কিন্তু রাজ্জাক আর ববিতার চুম্বন দৃশ্য দেখা হলো না বলে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল টাকাই নষ্ট। এতগুলো টাকা জোগাড় করতে হলে আমাকে এরপর বহুবার বাসার বাজার করতে যেতে হবে।
পরে চিত্রালীতেই পড়েছিলাম, এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য ববিতার পারিশ্রমিক ছিল ৫০ হাজার টাকা। পরিচালক রাজ্জাক ছবির শেষ দৃশ্যে চুম্বন যুক্ত করায় ববিতা আরও ২০ হাজার টাকা বেশি নিয়েছিলেন। দৃশ্যটি সেন্সরে ছাড়ও পেয়েছিল, কিন্তু রাজ্জাক ছবিটি বাজারজাত করার আগে চুম্বনটি বাদ দেন।
ববিতা তখন ১৭ বছরের অবিবাহিতা। তিনি তার বিয়ের ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত ছিলেন। হয়তো সে কারণেই রাজ্জাক দৃশ্যটি আর রাখেননি।
কবিতার কোনো চল ছিল না বাড়িতে। আব্বা মাঝে মাঝে স্মৃতি থেকে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কবিতা আওড়াতেন। ক্লাসের বইয়ে গদ্যের সঙ্গে পদ্যও থাকত। তবে কেবল কবিতা নিয়েই আলাদা বই হতে পারে এমন ধারণা ছিল না। এমন সময়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে একদিন বুদ্ধদেব বসুর একটা কবিতার বই পেলাম। নাম মনে নেই, কিন্তু মনে আছে একটা কবিতা ছিল এমন-
রুপোলি জল শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছে সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর সূর্যের চুম্বনে।
কিংবা-
শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
তাহলে মানব-মানবী নয় কেবল, সূর্যও চুমু খায় রুপোলি জলকে? আমার আরেক সর্বনাশ ঘটল এই কবিতার বইটি পড়ে। কত কত সুন্দরের বিবরণ! অধরা, অদেখা সব শব্দের খেলা। কিছু বুঝি, বেশির ভাগই বুঝি না।
জীবনে কবিতা এলো। রোদ, আলো, সমুদ্রের উপমা এলো। এখন বুঝি, সেই সময়ে, আজকের যে আমি, তার নির্মাণ ঘটছিল। প্রতিদিন নতুন কিছু যুক্ত হচ্ছিল অনুভবে, কল্পনায়। আমি বড় হয়ে উঠছিলাম সেই চৌদ্দ বছর বয়সে।
লেখক: জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তরের হিউম্যান রাইটস অফিসার
আরও পড়ুন:মেডিক্যাল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যার প্রতিবাদে ভারত জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে কঠোর শাস্তির আহ্বান জানিয়েছে।
মোমবাতি ও পোস্টার হাতে নিয়ে নারীরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় শহর কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে মিছিল করেছে। কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। সেখানে গত সপ্তাহে একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সহকর্মী চিকিৎসকরা আরও ভাল ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেছেন।
জুনিয়র ডাক্তাররা নির্যাতিতার ন্যায়বিচারের দাবিতে বাইরে বসে প্রতিবাদ করায় ভারতের বিভিন্ন শহরে অনেক সরকারি হাসপাতালে জরুরি বিভাগ ছাড়া সব চিকিৎসাসেবা স্থগিত রয়েছে।
শুক্রবার ৩১ বছর বয়সী ওই চিকিৎসককে কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ জানিয়েছে যে তাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত একজন পুলিশ স্বেচ্ছাসেবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভারতের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আমি এই ক্ষোভের মাধ্যমে অনুভব করতে পারছি যে সমাজে আমাদের মা, কন্যা ও বোনদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হচ্ছে তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এ নিয়ে দেশে ক্ষোভ বিরাজ করছে।’
এই ধর্ষণ ঘটনা ২০১২ সালে নয়াদিল্লির একটি ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সেখানে একদল লোক দিল্লির চলন্ত বাসে ২৩ বছর বয়সী এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে গুরুতর আহত অবস্থায় ফেলে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত সেই ছাত্রীর মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন:সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা করার নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে। রিটে বাদী হয়েছেন ছয় মাস বয়সী এক শিশু ও তার মা। তবে শিশুটির পক্ষে আইনগত অভিভাবক হিসেবে হলফনামায় সই করেছেন তার বাবা।
বুধবার এই রিট করা হয় বলে জানান শিশুটির মা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান।
রিট আবেদনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, আইন সচিব, সংসদবিষয়ক সচিব, নারী ও শিশুবিষয়ক সচিব, সমাজ কল্যাণ সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, শ্রম সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
রিটে বলা হয়েছে, নবজাতকের যত্নে কেবল মায়ের ভূমিকা মুখ্য- এ ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বাবার ভূমিকাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাহায্য নেয়ার সুযোগ সীমিত।
এ ছাড়া সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার বাংলাদেশে অনেক বেশি। সিজারের পর মায়ের সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগে। এ সময়ে নবজাতক ও মায়ের নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।
পিতৃত্বকালীন ছুটির সুযোগ না থাকায় যারা নতুন বাবা হন, তাদের স্ত্রী ও নবজাতকের দেখাশোনা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়। বিশ্বের ৭৮টিরও বেশি দেশে পিতৃত্বকালীন ছুটির বিধান রয়েছে।
২০১৯ সালে ওই শিশুর বড় ভাই নয় মাস বয়সে কর্মক্ষেত্র, শপিংমল, বিমানবন্দর, বাস স্টেশন, রেলওয়ে স্টেশনসহ জনসমাগমস্থওলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেছিল। ওই রুলের শুনানি শেষে গত বছরের ২ এপ্রিল হাইকোর্ট এ বিষয়ে রায় দেয়।
বেকারত্ব, সামাজিক ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা এবং যৌন হয়রানির মতো সমস্যার সমাধান এবং সম্ভাব্য সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে শিশু ও কিশোরীদের সুরক্ষার লক্ষ্যে জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের উদ্যোগে কক্সবাজারে ‘স্বপ্নের সারথি- সী-শোর গার্লস প্রজেক্ট’ শুরু হয়েছে।
ইউনিসেফের সহযোগিতা ও অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পটির অবহিতকরণ সভা বুধবার কক্সবাজারের বেস্ট ওয়েস্টার্ন অ্যান্ড হেরিটেজ হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রকল্পটি মূলত কক্সবাজার এলাকায় শিশু ও কিশোরীকেন্দ্রিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তথা সেইফগার্ড মেকানিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে। এজন্য ইউনিসেফের চাইল্ড প্রটেকশনস স্পোর্টস ফর ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ-এর অধীনে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এলাকায় একটি সী-শোর গার্লস হাব চালু করা হয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় খেলাধুলা, বিশেষ করে সার্ফিংয়ের মাধ্যমে মেয়েদের মানসিক বিকাশ, জীবন দক্ষতা এবং কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সরবরাহ করবে। তিন বছরের মধ্যে মোট ৩০০ কিশোরী ও তরুণীকে এই প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, যাতে তারা নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশে নিজেদের ক্ষমতায়ন করতে পারে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জেনারেশন আনলিমিটেডের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারিয়ান ওয়েলার্স বলেন, ‘মেয়েদেকে শোষণ এবং সহিংসতা থেকে রক্ষার জন্য তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। স্বপ্নের সারথি প্রকল্পটি সার্ফিং, লাইফগার্ড প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক চিকিৎসা, সাঁতার এবং সফট স্কিলসের মাধ্যমে মেয়েদের দক্ষতা ও ক্ষমতায়ণ বৃদ্ধি করতে কাজ করছে। প্রকল্পটিতে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করছি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলার আসামি সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবেদন বাতিল করেছে আদালত।
দুই পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লার মুখ্য বিচারিক আদালতের বিচারক আবু বকর সিদ্দিকী জামিন আবেদন বাতিল করেন।
অবন্তিকার আইনজীবী সৈয়দ নুরুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
একদিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে কারাগারে পাঠায় আদালত।
এদিকে অবন্তিকার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিক আম্মানের দুই দিনের রিমান্ড শেষে আজ তাকে কুমিল্লার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়েছে। বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে প্রিজনভ্যানে করে আম্মানকে কুমিল্লা জেল হাজতে নিয়ে যায় পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আত্মহত্যা নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রী অবন্তিকাকে ১৫ মার্চ রাতে মৃত ঘোষণা করেন কুমিল্লা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক।
ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা নামের ওই ছাত্রী জবির আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের রাত্রিকালীন দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক মো. জুবায়ের বলেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে আসার পর তার (অবন্তিকা) গলায় একটি দাগ দেখতে পাই। তার দেহ নিথর অবস্থায় ছিল। আমরা তাকে মৃত অবস্থায় পেয়েছি।’
মৃত্যুর আগে জবির এ ছাত্রী ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন, যাতে তিনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন বলে জানান। আত্মহত্যার জন্য সহপাঠী আম্মান ও জাবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করেন এ শিক্ষার্থী।
অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় আম্মান ও দ্বীন ইসলামকে পুলিশ আটক করার কথা শনিবার রাতে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান।
জবির এ ছাত্রী কুমিল্লা নগরের শাসনগাছা এলাকার প্রয়াত জামাল উদ্দিনের মেয়ে। তার বাবা কুমিল্লা সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তার মা তাহমিনা শবনম কুমিল্লা পুলিশ লাইনস উচ্চ বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক।
কুমিল্লায় ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার বেলা তিনটার দিকে অবন্তিকার প্রথম জানাজা ও বেলা পৌনে চারটার দিকে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুন:‘কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর ক্ষমতায়ন বা সামাজিক মর্যাদা বাড়েনি। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন জরুরি।
‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে নারীদের কথা বলার জায়গাটা তৈরি করে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে নারীদের নিয়ে আসতে হবে।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম।
তিনি বলেন, ‘নারী পরিচয়ের আগে আমার বড় পরিচয় হলো আমি একজন মানুষ। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ তৈরি, নারীকে হেয় করা, শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরুষের চেয়ে দুর্বল মনে করা হয় আজও।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের মূল্যায়ন সম্পর্কে সাদেকা হালিম বলেন, ‘সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন হয়েছে যে সমাজে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়; যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষ সমান। কিন্তু বাস্তবে কোনো দেশই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নারীকে পুরুষের সমান ভাবা হয়।’
‘সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীত্ব নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। সেটা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, ভাগ-বাটোয়ারার ক্ষেত্র, এমনকি ধর্মীয়ভাবেও। পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে।’
‘এমনকি নারীর সন্তান জন্ম দেয়ার বিষয় নিয়েও রাজনীতি করা হয়। সন্তান জন্মের পর পরই সন্তানের অধিকার কিভাবে হবে সেটা আমরা ধর্মীয়ভাবে নির্ধারণ করি। বাবা ও মায়ের অধিকার কতটুকু, আমাদের সিভিল ল’তে কতটুকু, শরিয়া ল’তে কতটুকু- এসব বিষয় অনেকটাই পুরুষকেন্দ্রিক। পুরুষকে সব সময় প্রাধান্য দেয়া হয়। পুরুষরাই এ সমাজে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।’
এই উপমহাদেশে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘ভারত উপমহাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন যে এখন হয়েছে তা নয়। অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশে নারীরা কিন্তু ইউরোপের নারীদের আগেই ভোটাধিকার পেয়েছিল। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় নারীরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, রানি হয়েছে, ট্যাক্স সংগ্রহ করেছে।
‘আধুনিক রাষ্ট্রে পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের কাজের পরিধি বেড়েছে, কিন্তু নারীদের পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। তার কাজকে কাজ হিসেবে আমরা দেখিনি। নারীরা স্ত্রী, মা বা মেয়ে হিসেবে যে ভূমিকা পালন করে সেটিকেও অবমূল্যায়ন করা হয়।
‘কোনো নারী চাকরি করলেও তাকে আমরা প্রশ্ন করি তার স্বামী কী করে। সে যদি স্বামীর থেকে বেশি বেতন পায়, তাহলে পুরুষও হীনম্মন্যতায় ভোগে।’
সমাজের সাধারণ নারীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে জবি উপাচার্য বলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তো নারীদের অনেকেরই হয়েছে। গার্মেন্ট সেক্টর, চিংড়ি মাছের ঘের, কল-কারখানায় নারীরা কাজ করছে। এটি ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু নারীর সামাজিক মর্যাদা কি বেড়েছে? এটা খুবই জটিল একটি বিষয়।
‘চরম দারিদ্র্যের শিকার নারীরা কোনো কিছু ভাবে না, বা ভাবার সুযোগ পায় না। তারা জানে তাদেরই কাজ করতে হবে, ক্ষুধা মেটাতে হবে। তারাই শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। সাধারণ নারীরা অনেক পরিশ্রমী। সামাজিক সমালোচনা গ্রাহ্য না করে তারা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে।’
নারীর সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে সাদেক হালিম বলেন, ‘আমরা নারীর নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে পারিনি। বাংলাদেশে বা প্রবাসে যে পরিমাণ নারী কাজ করে সেখানেও আমরা দেখি যে নারীরা নিরাপদ নয়। এমনকি খুব নিকট আত্মীয়ের মাধ্যমে তারা ধর্ষণের শিকার হয়।’
তিনি বলেন, ‘তবে বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। এবারকার কেবিনেটে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হয়ে আসছেন। এটা ইতিবাচক দিক।
‘সংখ্যার দিক থেকে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেশি, কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন বা সামাজিক মর্যাদার জায়গায় গুণগত মানের দিক থেকে কতটা বদলেছে সেটি বড় বিষয়। যখন নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আসবে, নেতৃত্ব দেবে, তখনই বদলাবে সমাজ।’
আরও পড়ুন:দেশের ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য বই বিতরণ করে আসছে সরকার। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী কেবল তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্তই মাতৃভাষায় পড়তে পারবে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা।
এতদিন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, আচিক ও সাদ্রি- এই পাঁচটি ভাষায় বই বিতরণ হলেও প্রথমবারের মতো এবার গারো শিক্ষার্থীদের জন্য আচিক ভাষায় পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়েছে। মাতৃভাষায় পাঠ্যবই পেয়ে আনন্দিত সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার গারো শিশুরা।
বুধবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত আচিক ভাষার পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, মধ্যনগরে ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত বংশীকুন্ডা উত্তর ইউনিয়নের বাঙালভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাঙালভিটা মিশন প্রাইমারি স্কুল, কাইটাকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাইটাকোনা মিশন প্রাইমারি স্কুল ও ইছামারী মিশন প্রাইমারি স্কুল- এই পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠরত গারো শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় শতাধিক। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৮৪ জন গারো শিক্ষার্থীর মধ্যে আচিক ভাষার পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়েছে।
কাইটাকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তূর্ণা মানকিন বলেন, ‘আজকে শিক্ষার্থীদের মাঝে আচিক ভাষায় প্রণীত বই বিতরণ করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। মনে নতুন আলোর সঞ্চার হলো। আমরা আমাদের অর্থাৎ গারো আদিবাসীর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার একটা উপায় পেয়েছি।’
এতে আচিক ভাষার শুদ্ধ ও সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ধারণা লাভ করতে পারবে বলে জানান তিনি।
বাঙালভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়ূস দাজেল বলেন, ‘আমি নিজেও একজন গারো। দেরিতে হলেও এই প্রথম শিশুদের হাতে মাতৃভাষায় সরকারি পাঠ্যবই তুলে দিতে পেরে আমি গর্ববোধ করছি।’
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় গারোদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মানবেন্দ্র দাস বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীর গারো শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে সরকারি পাঠ্যবই পৌঁছে দিতে পেরে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। আমার নিজ খরচে জেলা শহর থেকে এসব বই এনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেছি।’
আরও পড়ুন:গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় স্ত্রীর দাবি নিয়ে আহাদ মোল্লা নামে এক প্রকৌশলীর বাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন এক নারী। স্ত্রীর স্বীকৃতি না দিলে এখানেই আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন তিনি।
অভিযুক্ত আহাদ মোল্লা কোটালীপাড়া উপজেলার সিতাইকুন্ড গ্রামের মোস্তফা মোল্লার ছেলে। তিনি হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের প্রকৌশলী বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ওই নারী।
বুধবার সন্ধ্যা থেকে ওই নারী প্রকৌশলী আহাদ মোল্লার বাড়ির উঠোনে একটি গাছের নিচে অবস্থান নিয়েছেন।
ওই নারী বলেন, ‘দীর্ঘদিন প্রেম করার পর ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর আমার সঙ্গে প্রকৌশলী আহাদ মোল্লার বিয়ে হয়। বিয়ের পর আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঢাকায় বসবাস করতে থাকি। এ খবর দুই পরিবারে জানাজানি হলে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুনরায় সামাজিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়।
‘কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ের কিছুদিন পর হঠাৎ করে আহাদ আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে সে কোনো যোগাযোগ করছে না। নিরুপায় হয়ে স্ত্রীর দাবি নিয়ে আহাদের বাড়িতে এসে উঠেছি। সে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা না দিলে এ বাড়িতেই আত্মহত্যা করব।’
এদিকে ওই নারী বাড়িতে এসে ওঠার খবর পেয়ে প্রকৌশলী আহাদ মোল্লা ও তার পরিবারের লোকজন অন্যত্র চলে যান।
প্রতিবেশী নেয়ামুল ফকির ও খলিল শেখ বলেন, ‘আহাদ মোল্লার সঙ্গে ওই নারীর সামাজিকভাবে যে বিয়ে হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। বিয়ের পর আহাদ মোল্লা তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করত। এখন তাদের মাঝে কী হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য আহাদ মোল্লার বাড়িতে গিয়ে তাদের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। আর আহাদ মোল্লা ঢাকায় থাকায় তার সঙ্গে একাধিক বার মোবাইল ফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
মন্তব্য