× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বাংলাদেশ
Why reckless Ener bus on the street
google_news print-icon

রাস্তায় এনার বাস কেন ‘বেপরোয়া’

দুর্ঘটনা
রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় গত ২৮ ডিসেম্বর রোড ডিভাইডার টপকে মাইক্রো বাসকে ধাক্কা দেয় এনা পরিবহনের একটি বাস। ছবি: নিউজবাংলা
সড়কসংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, এনা পরিবহনের বাসগুলো অন্য কোম্পানির বাসের চেয়ে ‘বেপরোয়া’ গতিতে রাস্তায় চলছে। এর পেছনে চালকদের একটানা দীর্ঘ সময় গাড়ি চালনা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, ক্ষমতার অপপ্রয়োগসহ বেশ কয়েকটি কারণ জানা গেছে অনুসন্ধানে।

রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় গত ২৮ ডিসেম্বর একটি সড়ক দুর্ঘটনার ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওই ছবিতে দেখা যায়, এনা পরিবহনের একটি বাস সড়ক বিভাজক ভেঙে রাস্তার অন্য পাশের একটি মাইক্রোবাসের ওপরে উঠে গেছে।

দুর্ঘটনায় আহত হন মাইক্রোবাসটির চালক। ওই দুর্ঘটনার পর এনা পরিবহনের বাসের বেপরোয়া চলাচলের পুরোনো অভিযোগ নতুন করে আলোচনায় আসে।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার খবর নিয়মিত হলেও আলাদাভাবে এনা পরিবহন কেন বারবার আলোচনার জন্ম দিচ্ছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা।

দেখা গেছে, সড়কসংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, এনা পরিবহনের বাসগুলো অন্য কোম্পানির বাসের চেয়ে ‘বেপরোয়া’ গতিতে রাস্তায় চলছে। এর পেছনে চালকদের একটানা দীর্ঘ সময় গাড়ি চালনা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, ক্ষমতার অপপ্রয়োগসহ বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

তবে বাস কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। দুর্ঘটনা এড়াতে সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে তাদের।

অভিযোগ অনেক, আছে প্রশংসাও

এনা পরিবহনে চলাচল করা একাধিক যাত্রী ও অন্য পরিবহনের চালকদের সঙ্গে কথা বলে এনার বাসের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এর সঙ্গে রয়েছে খানিকটা প্রশংসাও।

এনা পরিবহনে নিয়মিত ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যান মো. সোহান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এনা পরিবহন নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া যাত্রী তোলে না। এ কারণে তাদের সুনাম আছে।

‘তবে এনা ফাঁকা রাস্তা পেলে উড়ে চলে। আমি কখনোই এনা পরিবহনের গাড়ির সামনের দিকে বসি না, ভয় লাগে। তারা ওভার স্পিডে গাড়ি চালানোর জন্য বিখ্যাত।’

ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটের শাহ জালাল ট্রাভেলসের একটি বাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এনার গাড়ি রাফ চালালেও প্রতিবাদ করার কেউ নাই। তাদের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার আগেই আমরা সেভ হয়ে (নিরাপদ দূরত্বে চলে) যাই। এনার ড্রাইভাররা মাহাজনের (মালিক) সাপোর্ট পায়। তাই তাদের অন্য রকম দাপট আছে।’

এনার সব ড্রাইভার অবশ্য বেপরোয়া গাড়ি চালান না বলেও জানান ওই বাসচালক। তিনি বলেন, ‘কিছু ড্রাইভার আছে রাফ গাড়ি চালান। এই ড্রাইভারদের কারণে সব ড্রাইভারের দোষ হয়। আমাদের মাহাজন তো সাধারণ মাহাজন, তাই আমাদের মেনে নিতে হয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সৌখিন পরিবহনের এক চালক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এনার এক গাড়িতে দুই ড্রাইভার থাকেন। এক ড্রাইভার টানা ১০-১৫ দিন গাড়ি চালান, এরপর আরেকজন। প্রথম ড্রাইভার যে কয় দিন চালান, অন্য ড্রাইভারকেও সেই কয় দিন চালাতে হয়।

‘এমনও আছে সারা মাস একজনই গাড়ি চালান। ময়মনসিংহ রুটে একজন ড্রাইভার প্রতিদিন তিন, চার এমনকি পাঁচটা ট্রিপও মারেন। বেশি ট্রিপ মারার জন্যই অ্যাকসিডেন্ট হয়।’

তিনি বলেন, ‘ড্রাইভাররাও তো মানুষ। টানা গাড়ি চালালে শরীর দুর্বল হয়ে ঘুম আসবে এটাই স্বাভাবিক। এনার মালিক ক্ষমতাবান হওয়ায় এদের বাস সবাই সাইড দিয়ে চলে। আটকাইয়া রাখলেই সমস্যা।’

চালকদের নেই নিয়োগপত্র

এনা পরিবহনের ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের এক সুপারভাইজার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই রুটে প্রতি ট্রিপে হেলপার ২১০ টাকা, সুপারভাইজার ২২০ টাকা এবং ড্রাইভার ৫০০ টাকা পান। দুইজন ড্রাইভার কম্প্রোমাইজ করে একজনের পর একজন টানা ১০-১৫ দিন করে গাড়ি চালাতে পারেন।’

এনা পরিবহনের ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের এক চালক বলেন, ‘আগে দিনে চারটা ট্রিপ মারতে পারতাম। এখন যানজটের কারণে সর্বোচ্চ তিনটা ট্রিপ মারতে পারি। জ্যামের কারণে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে চার, পাঁচ, ছয় ঘণ্টাও লেগে যায়।’

তিনি বলেন, ‘এনার গাড়ি কাউন্টার ছাড়া যাত্রী নেয় না। সময় মেইনটেইন করে বলে সবাই এনা পরিবহনে চড়তে চায়। এই কারণে গাড়িটা একটু টেনে চলে।’

দিনের পর দিন টানা গাড়ি চালানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পেটের দায়ে চালাই। সংসারের দিকে তাকালে তখন চালাতেই হয়। আমরা তো নিরুপায়, আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই আমাদের। আমাদের কর্মঘণ্টা কে ঠিক করবে!’

দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অ্যাকসিডেন্ট ড্রাইভারের নিজের দোষে হয়, আবার গাড়ির দোষেও হয়। বড় কারণ টেনশন। কয় টাকা পাই আমরা? পরিবার তো চালানো লাগে। যদি সংসার ভালোভাবে চলত, তাইলে কোনো টেনশন থাকত না।

‘টানা গাড়ি চালানোর জন্য শরীরে সমস্যা হয়। এক গাড়ি দুইজন চালানোর জন্য মাসে ১৫ দিন ট্রিপ পাই। এর মধ্যে গাড়ি নষ্ট হয়ে দুই-এক দিন মিস হয়। এই কারণে বেশি ট্রিপ মারার চিন্তা থাকে, যে কারণে শরীর দুর্বল হয়ে অ্যাকসিডেন্ট বেশি হয়।’

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘গাড়ি আট ঘণ্টা চালানোর কথা, কিন্তু চালাতে কি দিচ্ছে? মাসিক বেতন দিচ্ছে? নিয়োগপত্র দিচ্ছে? কই কোনো খবরই তো নাই। মালিক নেতারা এটা নিয়ে ভাবেন না। আমরা পরিবহন শ্রমিকরা সুখে নাই। তেলের দাম বাড়ায় মালিকেরা লাভবান হইছে, আমরা আগের মতোই আছি।’

এনার হবিগঞ্জ রুটের এক চালক বলেন, ‘ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ যেতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লাগে। তবে জ্যামের কারণে এখন বেশি সময় লাগে। আমরা দিনে তিন ট্রিপও মারি। আমাদের রুটে এক দিন পরে এক দিন গাড়ি চালান ড্রাইভারেরা। ঈদের সময় তো টানা ৩০ ঘণ্টাও গাড়ি চালাইছি।’

বিয়ানীবাজার রুটের এনা পরিবহনের এক সুপারভাইজার বলেন, ‘এনা পরিবহনের প্রধান রুট চিটাগাং, কক্সবাজার, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর। এনার সব রুট মিলিয়ে গাড়ি রয়েছে পাঁচ-ছয় শ। যে কোম্পানির গাড়ি যত বেশি, অ্যাকসিডেন্ট তত বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। যার গাড়ি কম তার অ্যাকসিডেন্টও কম। আমাদের গাড়ির স্পিড ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটারে ফিক্সড, তবে চিটাগাং রোডে সর্বোচ্চ ১০৫ কিলোমিটারে ওঠে।’

অভিযোগের বিষয়ে কী বলছে এনা কর্তৃপক্ষ

একজন চালকের দীর্ঘ সময় ধরে টানা গাড়ি চালানোর অভিযোগ মানতে রাজি নন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘না, এটা নিয়ম না। ময়মনসিংহ রুটে একজন ড্রাইভার ৮-১০ দিন টানা গাড়ি চালায়, এটা আমার নলেজে নাই। ময়মনসিংহ রুটে তো দুই দিন পরপর শিফট পরিবর্তন হয়।’

এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে এনা পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আতিকুল আলম আতিকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন এনায়েতুল্লাহ।

তিনি দাবি করেন, এনার চালকদের ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি এলাকায় গিয়ে গিয়ে এই ট্রেনিং দেয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা এড়াতে আমি যত কাজ করে থাকি, খুব কম মানুষ তা করে। আমরা এমন ব্যবসা করি যে ড্রাইভাররা অপরাধ করলে আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। আমার কাগজপত্র, রোড পারমিট সব ঠিক আছে। একজন ড্রাইভারের ১০-১৫ দিন টানা গাড়ি চালানোর প্রশ্নই আসে না। কেউ বললে এটা অতিরিক্ত বলেছে, মিথ্যা বলেছে।’

এ বিষয়ে এনা পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আতিকুল আলম আতিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ময়মনসিংহ রুটে রাতে গাড়ি চলে না, শুধু দিনে চলে। রাতের লাস্ট ট্রিপ ৯টায়। কাছাকাছি রুট হওয়ায় ড্রাইভাররা টানা এক, দুই বা তিন দিন চালাতে পারে। তবে লং রুটে এক দিন পর এক দিন করে মাসে ১৫ দিন গাড়ি চালায়।’

ড্রাইভাররা নিজস্ব সমঝোতার ভিত্তিতে টানা গাড়ি চালাচ্ছেন কি না, প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এর কোনো সুযোগ নাই। আমাদের প্রতিটা গাড়ি বের হওয়ার সময় কত নম্বর গাড়ি, ড্রাইভার, সুপাইভাইজার সব লেখা থাকে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ রুটে এক-দুই দিন চালালে আমরা তাকে অফ করে দেই। এটা যে আপনাকে বলেছে সে আমাদের ড্রাইভার কি না জানি না।’

বাসশ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। গাড়ি একবার পৌঁছিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা রেস্ট নিয়ে এর পরে আসবে। যদি কোনো ড্রাইভার স্টাফের সঙ্গে কথা বলে ২৪ ঘণ্টায় তিন ট্রিপ মারে. তবে সে অন্যায় করছে। এটা যদি কেউ করে থাকে সেটা আমাদের নলেজের বাইরে।’

এনা পরিবহনের বেপরোয়া গতিতে চলা এবং মালিকের ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের গাড়িতে অভিযোগ করার জন্য নম্বর দেয়া আছে। কেউ অভিযোগ দিলে আমরা ওই গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে এনে ব্যবস্থা নেই। আমাদের গাড়ি সিল করে দিছে, গতি কখনও ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটারের বেশি উঠবে না।

‘মাঝেসাঝে এর কম-বেশি হয়ে যায়। ড্রাইভার যখন অতিরিক্ত রেস দেয় সে ইচ্ছা করে পিকআপে বাড়ি দিয়ে এটা ওঠাতে পারে। কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার গতি লক করা আছে।’

বাসচালকদের নিয়োগপত্র না দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে আতিক বলেন, ‘শুধু আমাদের না, পরিবহনের সিস্টেম হলো সবার বেলায় বায়োডাটা, কাগজপত্র জমা রেখে আমরা চাকরি দেই। এই এতটুকই। বায়োডাটা, কাগজপত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক আছে কি না দেখি। আমাদের গাড়ি চালানোর উপযুক্ত কি না, সেটা দেখে নিয়োগ দেই।’

নিয়োগপত্র দেয়ার কোনো সিস্টেম দেশের পরিবহন খাতে এখন পর্যন্ত নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘নিয়ম আছে ঠিক আছে, কিন্তু লিখিতভাবে কেউ দেয় নাই। মৌখিকভাবে নিয়োগ হয় আরকি।’

রাজধানীর রাস্তায় সম্প্রতি এনা পরিবহনের বাসের দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টায় এই গাড়ি সিলেট থেকে ছেড়ে আসছে। টার্মিনালে জ্যাম থাকার কারণে গাড়িটা টার্মিনালে ঢুকতে পারে নাই। রাস্তার পাশে পার্কিং করে ড্রাইভার ঘুমাতে গিয়েছিল। টার্মিনালে এসে গাড়ি প্লেস করার পরে সব গাড়ির চাবি স্টিয়ারিংয়ে থাকে। গাড়ির হেলপার গাড়িতে ঘুমায়। ধারণা করছি, ওই হেলপার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল।

‘কামারপাড়া আমাদের একটা ডিপো আছে। সে কি ডিপোতে যাচ্ছিল, না অন্য কোথাও যাচ্ছিল আমার জানা নাই। সে এখনও পলাতক। আর ড্রাইভারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।’

এনা পরিবহনের কয়েকটি দুর্ঘটনা

গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে একটি পেট্রলপাম্পের কাছে এনা পরিবহন ও লন্ডন এক্সপ্রেসের দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে ছয়জন ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়।

২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর হবিগঞ্জে মাধবপুরে এনা পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের এক আরোহী নিহত হন।

২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এনা পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে অটোরিকশার সংঘর্ষ ঘটে। এতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুজন আহাম্মেদ নিহত হন। এ ছাড়া অটোরিকশার চালক ও সুজনের মা, ভাবিসহ কয়েকজন বাসযাত্রী আহত হন।

ওই বছরের ৬ মার্চ রাজধানীর বনানী এলাকায় এনা পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ নিহত হন।

২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভাওয়াল উদ্যানের পাশে ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কে এনা পরিবহনের একটি বাস কাভার্ড ভানের পিছনে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলে দুইজনের মৃত্যু হয়।

২০২০ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঢাকাগামী এনা পরিবহনের একটি বাস অটোরিকশাকে চাপা দিলে অটোরিকশার চালক আবু সাঈদ নিহত হন।

২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বিয়ানীবাজারগামী এনা পরিবহনের একটি বাস খাদে পড়ে যায়। তবে দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।

২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ওসমানীনগরের দয়ামীরে এনা পরিবহনের বাসের ধাক্কায় ১৪ বছরের এক কিশোর গুরুতর আহত হয়।

২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় এনা পরিবহনের বাস খাদে পড়ে তিন যাত্রী নিহত হন।

২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট নরসিংদীর শিবপুরে এনা পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের চাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের অভিযোগ, ‘এনা পরিবহনের মালিক পরিবহন মালিকদের শীর্ষস্থানীয় নেতা। এ কারণে তার বাসের চালক ও শ্রমিকেরা বেপরোয়া আচরণ করেন। রাস্তায় তারা অন্য কোনো গাড়িকে সাইড দেন না। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।’

গণপরিবহনের চালকদের নির্দিষ্ট বেতন ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করার ওপরেও জোর দিচ্ছেন তিনি।

পরিবহনের নামে নয়, নম্বর প্লেটে মামলা

পরিবহন হিসেবে এনার বাসের অনিয়ম বা দুর্ঘটনার বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই হাইওয়ে পুলিশের কাছে।

হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর বিভাগের পুলিশ সুপার আলী মোহাম্মদ খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেকোনো গাড়ি ওভার স্পিডে চললে আমরা মামলা দিয়ে দেই। আমাদের যে সফটওয়্যার আছে সেখানে গাড়ির নম্বর ধরে মামলা দেয়া হয়। কোনো পরিবহনের বিরুদ্ধে মামলা হয় না।’

হাইওয়ে পুলিশের সিলেট বিভাগের পুলিশ সুপার মো. তরিকুল্লাহ বলেন, ‘কোন পরিবহনের গাড়ি কী করল সেটা আমরা দেখি না। গাড়ি চালায় মানুষে, ড্রাইভার ডেসপারেট হয়ে গেলে সে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। মানুষ মারা গেলে আমরা মামলা করে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে চার্জশিটের ব্যবস্থা করি। কোন পরিবহন কী করল সেটা আমরা দেখতে যাই না। স্পেসিফিক কোনো পরিবহন না, আমরা গাড়ির নম্বর নিয়ে মামলা দেই।

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ
Praveen Hitaishi Sangh is drowning in syndicate corruption

সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ

সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)। ছবি: নিউজবাংলা
বাইগামের নবনিযুক্ত প্রশাসক ড. মো. মোকতার হোসেন বলেন, ‘অপ্রয়োজনে অসংখ্য নিয়োগ, এফডিআর ভেঙে ৫ কোটি টাকা তসরুপ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মানে দুর্নীতি, কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিং কেনায় অনিয়ম, সমান্য একটা বনভোজনে ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় এবং হোটেল ইজারার ঘটনাগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছি। আরও নানা অনিয়ম রয়েছে, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধিভুক্ত ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে অনিয়ম আর দুর্নীতি। অপ্রয়োজনীয় নিয়োগ, কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য, ব্যক্তিগত কাজে প্রতিষ্ঠানের সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, অযাচিত ব্যয়- এমন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে এতো সব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে তিন মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রশাসক।

সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ
বাইগামে সিন্ডিকেটের তিন সদস্য (বাঁ থেকে)- উপ-পরিচালক বদরুল আহসান, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নান ও মহাসচিব আমির হোসেন মোল্লাকে সামনে রেখে বাইগামের উপ-পরিচালক বদরুল আহসান, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমনের সীমাহীন দুর্নীতি আর অনিয়েমেই বাইগাম-এর আজ এই অবস্থা। তাদের কারণেই তিন মাস ধরে তারা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। পরিবার নিয়ে দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে।

বাইগামের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘এখানে দুর্নীতির শেষ নেই। গত কমিটির সভাপতি-মহাসচিবের ছত্রছায়ায় বাইগামের তিন কর্মকর্তা দুর্নীতির একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তারাই সব অপকর্মের হোতা।

‘এই সিন্ডিকেটই নিয়মবর্হিভূতভাবে বাইগামের ১১ কোটি টাকার বেশি এফডিআর ভেঙে তা থেকে ৪ কোটি টাকা তসরুপ করেছে। ওই এফডিআর করা হয়েছিল প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য। তাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করার জন্য। অথচ ওই এফডিআরের টাকা দিয়ে পিকনিক, অফিসের বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠান পালনের নামে অর্ধেকটাই গায়েব করা হয়েছে।’

দীর্ঘদিন ধরে বাইগামে এতো সব অনিয়ম-দুর্নীতি চললেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি সমাজসেবা অধিদপ্তর। দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করার পর টনক নড়ে তাদের। গঠন করা হয় ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত করতে গিয়ে দেখি এখানে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে অনিয়ম হয়নি। এই প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে পরিচালনা করা হতো।

‘ইতোমধ্যে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে বাইগামের বর্তমান প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমরা যা যা পেয়েছি তার সবই প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি।’

বিনা প্রয়োজনে ৬৮ জনের নিয়োগ

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, গত তিন বছরে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কেবল নিয়োগ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে (বাইগাম) নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬৮ জনকে। আর এসব নিয়োগের মাধ্যেমে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন ৯ জন চিকিৎসক, ৯ জন নার্স এবং বাকি ৫০ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। এর মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে ১১ জনের। বাকিদের নিয়োগ হয়েছে নিয়মবর্হিভূতভাবে। আর এই ৬৮ জনকে নিয়োগ দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে বেতন-ভাতা বাবদ গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ২২ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে নিম্নমান সহকারী হিসেবে কর্মরত এবিএম জাকারিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এই হাসপাতালে এমনিতেই কম রোগী আসে। আর প্রবীণ নিবাসও থাকে নিরিবিলি। আমাদের আগের কর্মচারী দিয়েই ভালোভাবে কাজকর্ম চলছিল। তারপরও এখানে প্রায় ৬৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন এইখানে রোগী আর প্রবীণদের চেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এখন ওই অতিরিক্ত জনবলের কারণে আমরা ৩ মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না।

সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ
দিনের বেশিরভাগ সময়ই রোগী না থাকায় সুনসান হাসপাতাল। অথচ অপ্রয়োজনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬৮ জনকে। ছবি: নিউজবাংলা

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘মূলত টাকা খাওয়া জন্য সিন্ডিকেট এসব অবৈধ নিয়োগের ব্যবস্থা করে। এই নিয়োগের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু সরকারের কোন জায়গা থেকেই এই নিয়োগের অনুমতি নেয়া হয়নি। প্রতিটি পদের বিপরীতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খেয়ে তারা নিয়োগ দিয়েছে। আর কিছু পদে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছে।’

বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন স্থাপনে দুর্নীতি

বাইগামের বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থা উন্নত করতে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে একটি এক হাজার কেভি সাব-স্টেশন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে সর্বনিন্ম দরদাতাকে কাজ না দিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা এ আর পাওয়ারটেক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কম্পানিকে ৭২ লাখ টাকায় কাজ দেয়া হয়।

বাইগামের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই কাজে প্রথমেই দুর্নীতি করা হয় সর্ব্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে। এর পরে হয় মহা দুর্নীতি। কাজ পাওয়া কোম্পানিটি কাজ শুরুর এক পর্যায়ে জানায় যে সাব-স্টেশনটি ১ হাজার কেভি হবে না, ৮০০ কেভি হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৭৫ শতাংশ বিল দেয়ার পর জানা গেল সাব-স্টেশনটি আসলে ৪০০ কেভির। এছাড়া দরপত্রে এই স্টেশনের সঙ্গে সোলার প্যানেল দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। বুয়েটের মাধ্যমে সার্টিফায়েড হওয়ার শর্তও পূরণ হয়নি।

তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই অনিয়ম করার সাহস পেয়েছে আমাদের এখানকার তিন কর্মকর্তার সিন্ডিকেটের সহায়তায়। এই তিনজন হলেন উপ-পরিচালক বদরুল আহসান, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম এবং সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন। এরাই কারসাজি করে কমিশন খেয়ে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এনেছে। আর পরিচালনা কমিটিকে নানা বুঝ দিয়ে তা পাস করিয়ে নিয়েছে।’

কিডনি ডায়ালাসিস মেশিন কেনায় অনিয়ম

তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, গত অথর্বছরে প্রবীণ হাসপাতালের জন্য কেনা হয় ৫টি কিডনি ডায়ালাসিস মেশিন। এখানেও সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে ৬৬ লাখ টাকায় মেশিন সরবরাহের কাজ দেয়া হয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যে ডায়ালাসিস মেশিন সরবরাহ করেছে সেটি ২০১৮ সালের পুরনো মডেলের। অথচ শর্ত ছিল আধুনিক আপডেটেড মেশিন সরবরাহ করতে হবে।

এ বিষয়ে ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের চাকরি থাকবে না। সমস্যা তো শুধু কেনাকাটায় না, পরিচালনায়ও আছে। ৫টি ডায়ালাইসিস মেশিন কেনা হলেও হাসপাতালে কোনো আইসিইউ-এসডিইউ নেই। তাই এই মেশিন প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

‘ডায়ালাইসিস করার পর অনেক সময় আইসিইউ জরুরি হয়ে পড়তে পারে। আইসিইউ না থাকলে অনেক সময় রোগী মারাও যেতে পারে। তাই আমরা ডায়ালাসিস মেশিন আইসিইউর অভাবে বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করি না। এগুলো আসলে পরিকল্পনা করে কেনা হয়নি। কমিশন বাণিজ্য করার জন্য কেনা হয়েছে।’

এক বনভোজনেই খরচ ৪৩ লাখ টাকা

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ সদস্যদের চাঁদার অর্থে প্রায় ১২ কোটি ৫০ লাখ এবং ৭০ লাখ টাকার দুটি এফডিআর ছিল। তা প্রবীণদের কল্যাণে ব্যয় করার কথা ছিলো। কিন্তু দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট সেই এইফডিআর থেকে ৪ কোটি টাকার বেশি নিজেদের আমোদ-প্রমোদে ব্যয় করেছে।

চলতি বছর এফডিআররের ৪৩ লাখ টাকায় করা হয় বনভোজন। এছাড়া বিভিন্ন দিবস পালন, উৎসবের নামেও খরচ করা হয় এই টাকা। মূলত এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাইগামের তহবিল বন্ধ করে দেয়।

স্বজনদের নিয়োগ দিতে হিসাব সফটওয়্যার স্থাপন

প্রতিষ্ঠানটির হিসাব ঠিক রাখার জন্য ৩ লাখ টাকা মূল্যের সফটওয়ার ৭ লাখ টাকায় কেনার অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, এই সফটওয়‍্যার পরিচালনার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সফটওয়ার অনেক কোম্পানিই মাত্র ৩ লাখ টাকায় করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কমিশন খেয়ে নামসর্বস্ব এক কোম্পানির কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা তা কেনা হয়।

‘সফটওয়্যার স্থাপনের পর তা পরিচালনার নামে নতুন নিয়োগ দিতে উঠেপড়ে লাগেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। অথচ ওই সফটওয়্যার আমাদের পুরনো লোকেরাই চালাতে সক্ষম। বাস্তবতা হলো, সফটওয়্যার কেনা ও নতুন লোক নিয়োগ দেয়ার পরও হাসপাতাল চলছে সেই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে।’

সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ
বাইগামের সামনে স্থাপিত এই হোটেল ইজারা নিয়েও হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। ছবি: নিউজবাংলা

হাসপাতালের সামনে হোটেল বসিয়ে ৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ

আগারগাঁওয়ে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সামনে একটি হোটেল স্থাপনের অনুমতি দেয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ। তিন বছরের জন্য ১৫ লাখ টাকায় এটি ইজারা নেন সুলতান কিচেন নামের হোটেলের মালিক নাসির উদ্দিন। তিনি প্রবীণ সংঘের অফিসে ১৫ লাখ টাকা জামা দিলেও পরে জানতে পারেন যে জমা হয়েছে ১০ লাখ টাকা।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কী একটা বিপদে যে পড়ছি বলে বোঝাতে পারবো না ভাই। আমি নিজ হাতে ১৫ লাখ টাকা অফিসে জমা দিয়ে আসছি। অথচ পরে শুনি জমা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। বাকি ৫ লাখ টাকা নাকি জমাই হয়নি। তারা টাকা খেয়ে ফেলেছে। এখন বলছে আমাকে আরও ৫ লাখ টাকা দিতে হবে।’

কারা টাকা খেয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এই অফিসের সবাই জানে যে টাকা কে বা কারা খাইছে। তবে আমি তাদের নাম বলতে পারব না। আমাকে তো এখানেই ব্যবসা করতে হবে, তাই না!’

বন্ধ হওয়ার উপক্রম প্রবীণ নিবাস

বাইগাম কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের প্রবীণ নিবাসও বন্ধ হওয়ার পথে। কারণ এই প্রতিষ্ঠান চলে এখানে থাকা প্রবীণদের দেয়া কিছু টাকা আর প্রবীণ সংঘের ভর্তুকির টাকায়।

বর্তমানে এখানে ৩৬ জন প্রবীণ থাকেন। সেখান থেকে মাসে আয় হয় দেড় লাখ টাকা। আর মাসে খরচ হয় ৭-৮ লাখ টাকা। তাছাড়া ৩ মাস আমাদের বেতন না হওয়ায় ডাক্তাররাও আর আগের মতো এখানে রোগী দেখেন না। তাই হাসপাতালে আর আগের মতো রোগী নেই। এখন হাসপাতালের বেডে রোগী আছে ৫-৬ জন। তাই প্রতিষ্ঠানের আয়ও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বরাদ্দ না পেলে প্রবীণ নিবাসই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাইগামের একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের উপ পরিচালক বদরুল আহসান এখন এলপিআর-এ আছেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি অফিস না করেও বেতন-ভাতা পাবেন। অথচ শুধু দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি এখনও নিয়মিত অফিস করে যাচ্ছেন।

‘দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা ইতোমধ্যে তিনি তার বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে বাইগামে চাকরি দিয়েছেন। সঙ্গে অন্যান্য পদে নিয়োগ বাণিজ্য তো আছেই। তারই নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটিতে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের অপর দুই প্রভাবশালী সদস্য হলেন- বাইগামের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন।’

তারা জানান, সিন্ডিকেট সদস্য এই সহকারী পরিচালক মাসুম প্রতিষ্ঠানটিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগদান করলেও উপ-পরিচালক বদরুল আহসানের সহযোগিতায় হয়ে যান প্রশাসনিক বিভাগের সহকারী পরিচালক। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাইগামে নিয়োগ দিয়েছেন তার বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে। বাইগামের সব দুর্নীতিতেই রয়েছে তার হাত। অফিসে নারী কর্মীদের যৌন হয়রানির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছেন বর্তমান প্রশাসক।

সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ
প্রবীণ হাসপাতালের পাশেই প্রবীণ নিবাস। ছবি: নিউজবাংলা


অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার: আয় ৭ হাজার, ব্যয় ৮ লাখ

বাইগামের কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ছিল। তবে তিন বছর ধরে রয়েছে মাত্র একটি। এই তিন বছরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে হাসপাতালের আয় হয়েছে ৭ হাজার টাকা। অথচ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮ লাখ টাকা।

কারণ হিসেবে বাইগামের কর্মকর্তরা বলছেন, সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সুমন বাইগামের পরিবহন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকাকালে অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। মূলত সে কারণে অ্যাম্বুলেন্সের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। এছাড়া সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ায় বাইগামের আরও অনেক অপকর্মের সঙ্গে তার নাম রয়েছে। তদন্ত কমিটিও তার ব্যাপারে নানা অনিয়মের তথ্য পেয়েছে।

সিন্ডিকেটের এই প্রভাবশালী সদস্য পুরো প্রতিষ্ঠানেই ধরাকে সরাজ্ঞান করে চলেন। নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি করে চললেও তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিছু বলার সাহস পান না। কিছু বলতে গেলেই তিনি মারমুখী হয়ে ওঠেন। সুমনের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের ভিডিও ফুটেজও নিউজবাংলার হাতে এসেছে।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় বছরে ৮ থেকে ৯ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে হাসপাতাল আর প্রবীণ নিবাস ও অন্যান্য খাত থেকে ৩-৪ কোটি টাকা ইনকাম হয়। বাদবাকি ৫ কোটি টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। এখন এসব দুর্নীতির কারণে মন্ত্রণালয় বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে।

‘এসব দুর্নীতি তদন্ত করতে ৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সহকারী পরিচালক মাসুমকে তার পদ থেকে সরিয়ে হাসপাতালের ফার্মেসির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আর সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা সুমনকে বসানো হয়েছে হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারে। আশা করি সঠিক তদন্ত করে এসব দুর্নীতিবাজকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

সিন্ডিকেটের তিন কর্মকর্তার অভিযোগ অস্বীকার

এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাইগামের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন।

মাসুম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ দেয়া হয়েছে এবং তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে জানি না। তবে এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ।’

তাহলে আপনাকে নিজের পদ থেকে সরিয়ে হাসপাতালের ফার্মেসির দায়িত্বে দেয়া হলো কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুম বলেন, ‘আমি জানি না কেন আমাকে এতো নিম্ন পদে দেয়া হলো। আসলে চাকরি করতে গেলে কর্তৃপক্ষ যে পদে দেবে আমাকে তো সেই পদেই কাজ করতে হবে। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’

আব্দুর রহমান সরকার সুমনকে প্রশ্ন করলে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনার যা জানার সেটা আপনি আমাদের প্রশাসককে প্রশ্ন করেন। তিনিই সব উত্তর দেবেন।’

হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠান চলে একটি কমিটির মাধ্যমে। কমিটির বাইরে গিয়ে তো আমি একা একা কোনো কিছু ব্যবহার করতে পারি না। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় বাইগামের উপ-পরিচালক বদরুল আহসানের সঙ্গে।

দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই অভিযোগ মিথ্যা। যারা এই কথা বলছে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলছে। একটা অফিস তিনজন দিয়ে চলে নাকি?’

আপনার বিরুদ্ধে বাইগামের কেনাকাটা ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ কেন আসছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। আর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমি এখনও দেখিনি। তাই এসব নিয়ে আমি কিছু বলব না।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে বদরুল আহসান বলেন, ‘এক্সিকিউটিভ কমিটি যে নির্দেশ দিয়েছে অফিসিয়াল প্রধান হয়ে কেবল সেটা বস্তাবায়ন করেছি। এই অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে আপনি আমাদের আগের কমিটির মহাসচিব আমির হোসেন মোল্লাকে প্রশ্ন করেন। তিনিই সব বলতে পারবেন।’

তবে আমির হোসেন মোল্লা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ যেন ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না প্রবাদের মতো। তারা অফিসিয়াল লোক, অফিসে কতজন নিয়োগ হবে, কী কী কেনাকাটা হবে সেসব তারাই তৈরি করে দিত। আমরা কমিটির নেতা হিসেবে সেগুলো পাস করে দিতাম। অফিসে সব কাগজপত্রই আছে। সেগুলো দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কারা এগুলো করেছে।’

নবনিযুক্ত প্রশাসক যা বললেন

বাইগামের নবনিযুক্ত প্রশাসক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামজিক নিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব ড. মো. মোকতার হোসেন বলেন, জানুয়ারি মাসে ওরা বনভোজন করেছে ৪৩ লাখ টাকা খরচ করে। এখানে অনিয়মের গন্ধ পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। তাই ৩ মাস ধরে বেতন বন্ধ রয়েছে। আমি এখন প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে তাদের বেতন দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আয় কম হওয়ায় বেতন দিতে দেরি হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে সেটা দেখে বোঝা যায় এই প্রতিষ্ঠান (বাইগাম) চলতো ম্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে। যে যার মতো নিয়োগ নিতো, যোগ্যতা না থাকলেও নিয়োগ নিতো অনেক বেতনে। প্রয়োজন ছাড়া কেনাকাটাও করতো। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের উপ-পরিচালক বদরুল আহসান নিজেকে উপ-সচিব পদমর্যদার দাবি করত। এবং তার যোগ্যতার চেয়েও অনেক বেশি বেতন নিতো।’

তদন্ত প্রতিবেদনে কী কী অনিয়ম পেলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অপ্রয়োজনে অসংখ্য নিয়োগ, এফডিআর ভেঙে ৪ কোটি টাকা তসরুপ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মানে দুর্নীতি, কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিং কেনায় অনিয়ম, সমান্য একটা বনভোজনে ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় এবং হোটেল ইজারার ঘটনাগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছি। আরও নানা অনিয়ম রয়েছে, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

‘মোট কথা, তৎকালীন কমিটির কয়েকজন আর বাইগামের কয়েকজন কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন এখন আমাদের হাতে। তারা সিন্ডিকেট করে এগুলো করতো বলে আমরা জানতে পেরেছি।

‘এখন আমি এই তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয় এই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে।’

আরও পড়ুন:
প্রবীণ হিতৈষী সংঘে কর্মকর্তার ঢালাও যৌন হয়রানি!

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Veterans benevolent association of officials pouring sexual harassment

প্রবীণ হিতৈষী সংঘে কর্মকর্তার ঢালাও যৌন হয়রানি!

প্রবীণ হিতৈষী সংঘে কর্মকর্তার ঢালাও যৌন হয়রানি!
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)-এর কর্মী মরিয়ম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রতিষ্ঠানে ১২ বছর ধরে চাকরি করছি। শুরু থেকেই সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম স্যার আমাকে উত্ত্যক্ত করে আসছেন। তিনি নানাভাবে প্রলোভন দিয়ে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। লিফটের মধ্যে একা পেলেই জড়িয়ে ধরেন। আমার মতো ১০ থেকে ১২ জন নারী কর্মী মাসুম স্যারের এমন যৌন হয়রানির শিকার।’

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)-এর সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে নিজ প্রতিষ্ঠানের একাধিক নারী কর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ভয়ে কেউ মুখ না খুললেও এখন একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন নির্যাতিতরা। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসকের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়েছে।

যৌন হয়রানির শিকার একাধিক নারী নিউজবাংলার কাছে অভিযোগ করে বলেন, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের নানাভাবে যৌন হয়রানি করে থাকেন। নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তিনি টার্গেট করা নারী কর্মীদের চাকরিগত নানা সমস্যা তৈরি করে রাখেন। আর সেসব সমস্যা নিয়ে নারী কর্মীদের তার কাছে ধরনা দিতে বাধ্য করেন।

একাধিক নারী কর্মীর অভিযোগ, সহকারী পরিচালকের সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধানে তার কাছে গেলে তিনি নানা অনৈতিক প্রস্তাব দেন। তাতে রাজি না হলে সুযোগ বুঝে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ, ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আটকে দেন।

বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর প্রায় সব নারী কর্মীকে এভাবে বিপাকে ফেলে আশরাফুল আলম মাসুম নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেন। এমনকি নারী কর্মীদের অনেকটা বিপাকে ফেলে বা জবরদস্তি যৌন হররানি করেন।

বেশ কয়েকজন নারী কর্মী এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মাসুমের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ দিলেও বরাবরই বাইগামের আগের কর্তৃপক্ষ অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। উপরন্তু অভিযোগ দেয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত নারী কর্মীরা ১০-১২ বছর চাকরি করেও ইনক্রিমেন্ট, পদোন্নতিসহ সব ধরনের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।

মৌখিকভাবে অভিযোগ করে কোনো কাজ না হওয়ায় ১২ এপ্রিল বাইগামের বর্তমান প্রশাসকের কাছে সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটিতে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত এক নারী কর্মী।

লিখিত অভিযোগকারী ওই নারী কর্মীর সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তার পুরো বক্তব্যই সংরক্ষিত আছে আমাদের কাছে। তবে সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে তার নাম প্রকাশ করা হলো না। ওই অফিসের আরও একাধিক নারী কর্মী সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। তবে লোকলজ্জার ভয়ে তারা নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।

ভুক্তভোগীদের একজন মরিয়ম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহায়ক পদে (এমএলএসএস) ১২ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে আসছি। আমি কাজে যোগদানের শুরু থেকেই প্রশাসন বিভাগের আশরাফুল আলম মাসুম স্যার আমাকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করেন। সে সময় আমি এ বিষয়ে তৎকালীন মহাসচিবকে মৌখিকভাবে জানালে তিনি আমাকে প্রশাসন বিভাগ থেকে সরিয়ে হাসপাতাল বিভাগে ডিউটি দেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা থেকে রেহাই মেলেনি।

‘মাসুম স্যার নানাভাবে প্রলোভন দিয়ে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। বিষয়টি আমি আমাদের তৎকালীন অনেক ইসি সদস্যকে জানাই। তারা সে সময় মাসুম স্যারকে মৌখিকভাবে সাবধান করে দেন। এরপর কিছু দিনের জন্য চুপ থাকলেও তিনি আবার আমাকে হয়রানি করতে শুরু করেন।’

মরিয়ম বলেন, অফিসে লিফটের ভেতর কয়েকবার একা পেয়ে মাসুম স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এমনকি বিভিন্ন ছুতোয় অফিসে লোকজন কম থাকলে বিভিন্ন জায়গায় আমার কাছে গিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেন। সেসব ঘটনায় আমি চিৎকার করে কোনোরকম বেঁচে যাই।’

তিনি বলেন, মাসুম স্যার যে আমাকে মাঝেমধ্যেই যৌন হয়রানি করেন সেটা আমাদের অফিসের সবাই জানে। আর স্যারের কথায় আমি সায় দেইনি বলে এই অফিসে ১২ বছর চাকরি করেও আমি কোনো প্রমোশন বা ইনক্রিমেন্ট পাইনি। অফিসে আমি প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকি- কখন স্যার আমাকে জাপটে ধরেন সেই ভয়ে।

ভুক্তভোগী এই নারী বলেন, ‘এখন আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। তাই আমি আর মৌখিক অভিযোগ না করে এবার সরাসরি প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি। আমি জানি এবার মাসুম স্যারের বিচার না হলে আমার আর এখানে চাকরি করা হবে না। আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। এখন দেখি বর্তমান স্যারেরা কী বিচার করেন।

‘আমি এখন আর ভয় পাই না। আপনারা পত্রিকায় আমার নামসহ বক্তব্য ভিডিও আকারে প্রকাশ করে দিন। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমার এই কথার কারণে যদি আমার অফিসে আরও অনেক মেয়ের জীবন এই মাসুম স্যারের থাবা থেকে বেঁচে যায় সেটাকেই বড় পাওনা মনে করব।

‘মাসুম স্যারের যৌন হয়রানির শিকার শুধু আমি একা নই। এই প্রতিষ্ঠানে আমার মতো আরও ১০ থেকে ১২ জন নারী কর্মী তার যৌন হয়রানির শিকার। অফিসের সবাই তা জানে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে নির্যাতিতরা কেউ মুখ খোলেন না। তাই আমি এবার প্রকাশ্যে এসে স্যারের এসব অপকর্মের বিচার চাইছি।’

মরিয়মই ছাড়াও বাইগামে কর্মরত আরও দুই নারী কর্মী নিউজবাংলার কাছে সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘আমরা সব সময় মাসুম স্যারের ভয়ে থাকি। চেষ্টা করি একা না থেকে ২-৩ জন এক সঙ্গে থাকতে। কারণ আমাদের একা দেখলেই মাসুম স্যার যে কোনো ছুতোয় কাছে এসে আমাদের শরীরে হাত দেন। এমনকি কোনো অফিস ফাইল স্যারের কাছে নিয়ে গেলেও ২-৩ জন একসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করি।

‘তারপরও মাসুম স্যার বিভিন্ন ছুতোয় আমাদের আলাদা আলাদা করে অফিসের বিভিন্ন জায়গায় ডেকে নিয়ে যান। সে সময় স্যার আমাদের নানাভাবে হয়রানি করেন, যেসব মুখে বলা সম্ভব নয়। আমাদের পরিবার আছে। তাই চুপ করে সব সয়ে যাই। মরিয়ম লিখিত অভিযোগ দিয়ে আমাদের মনের কথা বলেছে। আমরা ওর সঙ্গে আছি।’

এ বিষয়ে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘মাসুমের বিরুদ্ধে এই যৌন হয়রানির অভিযোগ নতুন নয়। অনেক আগেই আমাদের কাছে এমন অভিযোগ এসেছিল। তখন শুনেছিলাম আমাদের প্রতিষ্ঠানের ছাদে দারোয়ানদের একটা রুম ছিলো। মাসুম ওই রুমে মেয়েদের ডেকে নিয়ে হয়রানি করতো।

‘সে সময় মাসুমকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। তবে ওই একবার নয়, আরও কয়েকবারই তাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার তো আর ওইরকম ক্ষমতা নেই যে ব্যবস্থা নেবো। যাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারাই তো চুপ থাকে। আর তাদের সঙ্গেই মাসুম চলাফেরা করে।’

এদিকে অধস্তন নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানির এসব অভিযোগকে অপপ্রচার বলে উল্লেখ করেন বাইগামের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ দিয়েছেন কিনা সেটা আমার জানা নেই। এমনও হতে পারে- কেউ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এটা মিথ্যা অভিযোগ।’

তবে বাইগামের বর্তমান প্রশাসক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ড. মো. মোকতার হোসেন জানান, মাসুমের বিরুদ্ধে তারই প্রতিষ্ঠানের এক নারীর যৌন হয়রানির একটি লিখিত অভিযোগ তিনি পেয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে আগেও এরকম অভিযোগ শুনেছিলাম। কোনো লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় ব্যবস্থা নিতে পারিনি। তবে কিছুদিন আগে বাইগামেরই এক নারী কর্মী এই মাসুমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এখন বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলে মাসুমের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ড. মোকতার হোসেন জানান, ইতোমধ্যে সহকারী পরিচালক মাসুমকে তার পদ থেকে সরিয়ে প্রবীণ হাসপাতালের ফার্মেসির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন:
মেয়েকে যৌন হয়রানি, বাবার আত্মহত্যা
অনলাইন যৌনতার ফাঁদে সর্বনাশ
যৌন হয়রানি প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা জানাল ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
যৌন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক ৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ
যৌন হয়রানি: সত্যতা পেলেও শিক্ষকের বিরুদ্ধে নেই ব্যবস্থা

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Unbelievable Low Price Traps in Facebook Marketplace

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’ মার্কেটপ্লেসে অতি কম মূল্য লেখা কিছু পণ্য। ছবি: সংগৃহীত
যেসব পণ্যের দাম ১ টাকা লেখা থাকে, কথা বলে দেখা যায় সেগুলোর মূল্য হাজারের বেশি। বিকাশে ডেলিভারি চার্জ অথবা কিছু টাকা অগ্রিম দিতেও বলেন বিক্রেতারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে পণ্য ডেলিভারির নামে চলছে প্রতারণা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রিম টাকা বিকাশে নিয়ে দেয়া হচ্ছে না পণ্য।

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে পণ্যের পাশে ফ্রি থেকে শুরু করে অতি কম মূল্য লেখা থাকে, যা দেখে যে কেউ আগ্রহী হয়ে পণ্য কিনতে চাইতে পারেন। যেসব পণ্যের দাম ১ টাকা লেখা থাকে, কথা বলে দেখা যায় সেগুলোর মূল্য হাজারের বেশি। বিকাশে ডেলিভারি চার্জ অথবা কিছু টাকা অগ্রিম দিতেও বলেন বিক্রেতারা। যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স গাইডলাইন অনুসরণ করে না।

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

ভুক্তভোগী দাবিদারদের ভাষ্য

একটি পোশাক কারখানায় স্যাম্পল সেকশনে কর্মরত মো. আলফি বলেন, ‘আমি ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে দাম কম দেখে আমার বউয়ের জন্য একটা জামা অর্ডার করছিলাম। দাম লেখা ছিল ৫ টাকা। পরে চাইল ১ হাজার ৩০০ টাকা।

‘আমি দামাদামি করে ১ হাজার টাকা ঠিক করলাম। বলল ৩০০ টাকা বিকাশে অ্যাডভান্স করতে হবে। দোকানে গিয়ে তাদের নম্বরে বিকাশ করলাম। পাঁচ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেবে বলছিল, কিন্তু প্রায় ১ মাসেও দেয় নাই। ওই বিকাশ নম্বরও বন্ধ। এইভাবে কতজন ঠকছে কে জানে!’

একই মার্কেটপ্লেসে ‘রোজেন মুড’ নামে প্রোফাইলে একটি বিদেশি পরিবারের ছবি দেয়া বিক্রেতার সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন আফরোজা আক্তার। সেখানে কিয়াম কোম্পানির ৭টি মারভেল কোটিং নন স্টিক সেটের মূল্য লেখা ছিল ২৬০ টাকা।

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

আফরোজার ভাষ্য, সেটটি কিনতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, দাম ৩ হাজার ৪৫০ টাকা। সে সময় ২৬০ টাকা লিখে রেখেছেন কেন জানতে চাইলে মেসেজ দেখেও কোনো উত্তর দেননি বিক্রেতা।

নিউজবাংলার অনুসন্ধান

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে পণ্যের ডিসপ্লে মূল্যের সঙ্গে বাস্তবের এত ব্যবধানের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে নিউজবাংলা। এর অংশ হিসেবে ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক।

মার্কেটপ্লেসে এক বিক্রেতা পার্টি ড্রেসের দাম লিখে রেখেছিলেন ২২০ টাকা। এ পণ্যটির বিষয়ে সজল হাকিম নামের একটি আইডিতে যোগাযোগ হয়। দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১ হাজার ৩০০ টাকা। এরপর আবার বলেন, ‘যদি নেন ১ হাজার ১০০ টাকা রাখব।’

১ হাজার টাকা দেয়া যাবে কি না জানতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রেতা রাজি হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘ডেলিভারি চার্জ ৮০ টাকা অ্যাডভান্স করতে হবে।’ সে সময় বারবার ২২০ টাকা লিখেছেন কেন জানতে চাইলেও বিক্রেতা কোনো উত্তর দেননি।

কোনো শোরুম আছে কি না জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, ‘আমাদের এটা অনলাইন।’ পরে অ্যাডভান্স করতে বিকাশ নম্বর চাওয়া হয়। তার দেয়া বিকাশ নম্বরে যোগাযোগ করে জিজ্ঞাসা করা হয়, দাম ২২০ কেন।

তখন তিনি বলেন, ‘মার্কেটপ্লেসের এসে মানুষ বোঝে না, দাম কম দেখে ভুল করে। আসলে এগুলো সবই অফার।’

মার্কেটপ্লেসে পণ্যের ডিটেইল সেলার নাকি ফেসবুকের কেউ আপলোড করে জানতে চাইলে ওই বিক্রেতা বলেন, ‘আমরাই করি।’ তাহলে অফার না লিখে শুধু মূল্য লিখে রেখেছেন কেন জানতে চাইলে আমতা আমতা করে সজল হাকিম বলেন, ‘এরপর চেষ্টা করব।’

তিনি কোথায় আছেন জানতে চাইলে সজল বলেন, ‘আমরা মিরপুর থেকে বিজনেস করি। এখানেই আছি।’

অবস্থানে গরমিল

সজল নামের সেই বিক্রেতার নম্বরটির লোকেশন জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ আমার বিজনেস মিরপুরে। আাম এখানেই আছি।’ নম্বরটি দেয়া হয় পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগে। সেখান থেকে জানানো হয়, ওই নম্বরের লোকেশন গাজীপুরের ভোগড়ায়। মতিঝিল ডিবির এক কর্মকর্তা একই লোকেশনের কথা জানান।

সজল হাকিমের মতো আরেকজন বিক্রেতা শুভ ঘোষ, যিনি ভ্যানিটি ব্যাগ বিক্রি করেন ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে। ব্যাগের দাম লেখা ১ টাকা। শুভর আইডিতে প্রোফাইল ও কাভারে মুখ দেখা যায় না, এমন দুই মেয়ের ছবি।

সেখানে মেসেঞ্জারে কল দিলে একটি মেয়ে রিসিভ করেন। তারা কোথায় বিজনেস করেন জানতে চাইলে বলেন, ‘পুরান ঢাকা।’ পরে তার লোকেশন পাওয়া যায় নাটোর।

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

ব্যাগের দাম ১ টাকা লিখেছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসল দাম দেইনি তাই।’

‘এতে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। আসল দাম না দিলে কোনো দামই দেবেন না, কিন্তু ১ টাকা কেন?’

উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তরের শুভ লিখেন, ‘এটা নিয়ম। আপনি বুঝবেন না। তাই না বুঝেই কথা বলবেন না।’

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

পরে ব্যাগটি কেনার প্রক্রিয়া জানতে চাইলে বিকাশে ১৫০ টাকা অগ্রিম চার্জ দিতে হবে বলে জানান। সেই নম্বরে কল করা হলে রিসিভ করেন এক নারী।

শুভর আইডি কার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার আইডি।’ ছেলের নামে আইডি কেন, তা জানতে চাইলে এই প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যান বারবার। তাদের পেজ থেকেই এভাবে কম মূল্য লেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান মেয়েটি। নিজের নাম দোলা ঘোষ বলে পরিচয় দেন তিনি।

আর শুভ ঘোষের আইডি থেকে যে মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়, সে তার লোকেশন জানায় পুরান ঢাকা। থানা থেকে ট্র‍্যাক করে জানা যায়, তার অবস্থান নাটোরে। বাকি যে নম্বরগুলোর সঙ্গে কথা হয়, সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।

মো. বনি নামের এক সেলার ব্যাগের দাম লিখে রাখেন ৭ টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্রেতার সঙ্গে অসদাচরণ করে বলেন, ‘ব্যাগের দাম ৭ টাকা? আপনার শ্বশুরে দেবে? নিলে নেন, না হলে নিয়েন না। এটা কোড নম্বর।’

টাকা কীভাবে কোড নম্বর হয় বললে তিনি রেগে যান। পরে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে কেনার প্রক্রিয়া জানতে চাইলে অ্যাডভান্স ৮০ টাকা চান।

বিকাশ নম্বর পেয়ে কল দিয়ে কৌশলে জেনে নেয়া হয় তারা কেন এই দাম লিখে রাখেন।

বনি বলেন, ‘এই কম দাম দেখলে কাস্টমাররা ক্লিক করবে। প্রতি ক্লিকে আরও বেশি জনের কাছে এটা রিচ করবে। ১০০ জন ক্লিক করলে ১০ জন তো কিনবে। এটা না করলে তো ক্লিক বাড়বে না। এটা আমাদের পলিসি।’

এতে বেশিরভাগ ক্রেতা বিভ্রান্ত হতে পারেন বললে তিনি চুপ করে থাকেন। পরে তাকে ডেলিভারি চার্জ বিকাশে পাঠিয়ে প্রোডাক্ট কবে দেবেন জানতে চাইলে কোনো রেসপন্স আসে না।

আরেকটি ডিনার সেটে অফার চলছে দেখে নক দেয়া হয়। সেখান থেকে এ রকম একটি অটো টেক্সট আসে- ‘ডিনার সেট ৩২ পিস মাত্র ৮০০ টাকা; অফার সীমিত সময়ের জন্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। হোম ডেলিভারি পণ্যটি নিতে আপনাকে যা করতে হবে। ডেলিভারি খরচ আগে দিয়ে অর্ডার কনফার্ম করতে হবে এবং বাকি টাকা পণ্য হাতে পেয়ে দিবেন। ঢাকার ভিতরে ১০০ টাকা ঢাকার বাহিরে ১৫০ টাকা ডেলিভারি চার্জ বিকাশ করতে হবে। বিকাশ পার্সোনাল (01704334900) আপনি চাইলে আমাদের দোকানে এসে নিতে পারেন। ঢাকা নিউমার্কেট ৪ নং গেইট থেকে ঢুকে বলবেন দোকানের নাম এশা মনি ডিনার শোরুম, দোকান নং ০১৩।’

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

নিউ মার্কেটে গিয়ে এই নামে কোনো ডিনার সেটের দোকানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একজন ক্রোকারিজ বিক্রেতা বলেন, ‘সকাল থেকে অন্তত ২০ জন এই নামে দোকান খুঁজেছে, কিন্তু আমরা কেউ বলতে পারিনি। কোনো দোকান নেই এই নামে।’

নিউ মার্কেটের চার নম্বর গেটের পাশের কাপড় বিক্রেতা বলেন, ‘চার নম্বর গেটের আশেপাশের পুরো এরিয়ায় কোনো ডিনার সেটের দোকান নেই এবং সেটি দেখাও যায়।’

যে নম্বর দেয়া আছে তাতে অনেকবার কল করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

ফেসবুকের বিধি কী বলছে

ফেসবুকের মার্কেটপ্লেস এর বিধিতে বলা হয়, ‘একটি পণ্য কেনার আগে আমরা ক্রেতাদের দাম তুলনা করতে বলি। লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পর বিক্রেতা শিপিংয়ের জন্য অতিরিক্ত চার্জ করার অনুরোধ করলে সম্মত হওয়া যাবে না।’

এতে আরও বলা হয়, ‘যে পণ্যটি কিনছেন, তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে আসল কি না।’উচ্চমূল্যের ঘড়ি, বিলাসবহুল ব্যাগ কেনার প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজ বা রসিদ চাওয়ার কথা বলা হয়েছে বিধিতে।

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

যা বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হায়দার বলেন 'ডিজিটাল মার্কেটিং এর জন্য আমাদের কিছু গাইডলাইন আছে। যারা নিবন্ধিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করতে পারবে। এখন ফেসবুকের মাধ্যমে হাজার হাজার বিক্রেতা পণ্য বিক্রি করছে।'

তারা পণ্যের দাম কম লিখে বেশি দামে বিক্রি করছে এমনকি অ্যাডভান্স নিচ্ছে। এই প্রশ্নে তিনি বলেন 'আমাদের ডিজিটাল ট্রেড এর গাইডলাইনে এরকম কোনো বিধান নেই যে দাম একটা লিখবে আর আরেকটা চাইবে। এটা তো চলতে পারে না। তাদেরকে সঠিক সিস্টেমের আওতায় আনার জন্য আমি কথা বলবো।'

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’
বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স গাইডলাইন

পুলিশের ভাষ্য

সাইবার ক্রাইম তদন্ত বিভাগের এ্যাসিসট্যান্ট ডেপুটি কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে প্রতারণার বিভিন্ন রকমফের আছে। প্রত্যেক ধরণের প্রতারণা নিয়েই পুলিশ কাজ করছে। বিশেষ করে সাইবার তদন্ত বিভাগ। আমরা মনিটর করছি। মনিটর করে এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত অনেককে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। টিম কাজ করছে।

‘সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ থাকলে আমাদের আরও বেশি সুবিধা হবে কাজ করতে। যারা ভুক্তভোগী তাদেরকে আহবান করবো পুলিশকে রিপোর্ট করতে। বিশেষ করে সাইবার পুলিশকে রিপোর্ট করবে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিবো’

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রিতে নানা অসঙ্গতি নিয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল ডিবির কর্মকর্তা বলেন, ‘এরা তো ফ্রড। লোকেশন বলছে মিরপুর, দেখা যাচ্ছে ভোগড়া, গাজীপুর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কাজ করতে হবে। আমরা এটা নিয়ে দ্রুতই কাজ শুরু করব।’

শেরেবাংলা নগর থানার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলব। এটা কোনো চক্র কি না সেটা দেখা অবশ্যই জরুরি।’

ওই কর্মকর্তাকে জানানো হয়, দাম কম লিখে গ্রাহককে বিভ্রান্ত করা এবং পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে যার কাছে যা পারছে অ্যাডভান্স নিচ্ছে কথিত বিক্রেতারা। যতজন সেলারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটি ফেসবুক আইডি ভুয়া মনে হয়েছে।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।’

আরও পড়ুন:
প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নামে প্রতারণা  
সেই আবুকে পুলিশে দিল হাইকোর্ট
পিবিআই সেজে প্রতারণা, গ্রেপ্তার পিবিআইয়ের হাতেই
ভূমিহীন ও দুস্থরাই ছিলেন তার টার্গেট
নলকূপ অপারেটরের চাকরি ছাড়লেন সেই কনস্টেবল

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Mamun died due to bleeding in the head in gang beating

দলবদ্ধ পিটুনিতে মাথায় রক্তক্ষরণে মামুনের মৃত্যু

দলবদ্ধ পিটুনিতে মাথায় রক্তক্ষরণে মামুনের মৃত্যু মো. মামুন। ফাইল ছবি
ডিএমপির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ১০ থেকে ১৫ জন মামুনকে হাসপাতালের বাইরে থেকে ধরে গেটের ভেতরে আনে। সব মিলিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে পুরো ঘটনাটি ঘটে। তারা প্রথমে মামুনকে ধরে এনে টানাহেঁচড়া শুরু করে। এরপর ২ মিনিটের মধ্যে দলবদ্ধভাবে কিল-ঘুষি ও লাথি মেরে তাকে হত্যা করে।’

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে মো. মামুনকে দলবদ্ধভাবে টানা ২ মিনিট পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। ১০ থেকে ১৫ জন মিলে ১০ মিনিটের মতো তাকে টানাহেঁচড়া করে। এক পর্যায়ে টানা ২ মিনিট কিল-ঘুষি ও লাথি মেরে তাকে হত্যা করা হয়। চিকিৎসকের বক্তব্য, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণই মৃত্যুর মূল কারণ।

রোববার দুপুর ১টার দিকে হাসপাতালের ভেতরে মামুনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই মাসুদ রানা অজ্ঞাতদের আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেছেন।

পুলিশ জানায়, এই মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- আশরাফুল, বাদশা ও সুমন। তাদের মধ্যে আশরাফুলকে রোববার এবং বাকি দুজনকে সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সবাই শিশু হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

আশরাফুলকে সোমবার আদালতে পাঠিয়ে পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড চায়। আদালত তাকে একদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে।

দলবদ্ধ পিটুনিতে মাথায় রক্তক্ষরণে মামুনের মৃত্যু
শিশু হাসপাতালের এই স্থানটিতেই পড়ে ছিল মামুনের মরদেহ। ছবি: নিউজবাংলা

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, রোববার সকাল ১০টায় মামুনকে তার স্ত্রী রহিমা বেগম ও মা শাহানারা বেগম শানু শ্যামলীতে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। কিন্তু মাদকাসক্ত কেন্দ্র মামুনকে ভর্তি নেয়নি। পরে মামুন তার স্ত্রী ও মাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন এবং তিনি ওই এলাকায়ই থেকে যান। পরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ভেতরে সাইকেল চুরির চেষ্টাকালে মামুনকে দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।

নিহতের পরিবারের দাবি, চোর সাব্যস্ত করে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে দায়িত্বরত আনসার সদস্য এবং অ্যাম্বুলেন্স চালক ও চালকের সহকারীরা মিলে মামুনকে হত্যা করেছেন।

মাসুদ রানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আনসার সদস্য ও হাসপাতালের অ্যাম্বুলেসের চালক ও হেলপাররা চোর বলে ধাওয়া দিয়ে ধরে পিটিয়ে আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। এই ঘটনায় আনসার সদস্য হীরা ও মাহবুব জড়িত। তারা এখনও হাসপাতালে ডিউটি করছেন।

‘আমার ভাই কোনো অপরাধ করে থাকলে তার বিচারের জন্য দেশে আইন আছে। একজন মানুষকে এভাবে কেন ওরা পিটিয়ে মারবে? আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই।’

মামলার এজাহারে আনসার সদস্যদের নাম উল্লেখ করেননি কেন- এমন প্রশ্নে মাসুদ বলেন, ‘আমাকে থানা থেকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয় যে এখানে স্বাক্ষর করেন। আমি কিছু না বুঝেই স্বাক্ষর করেছি। আমি তো এতো কিছু বুঝি না।’

তবে আনসার সদস্য হীরা ও মাহবুব এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হাসপাতালের আনসার সদস্যদের প্রধান প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) সুজন চক্রবর্তী।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় মাহবুব ঘুমাচ্ছিলেন। তখন তার ডিউটি ছিল না। আর হীরা ছিলেন টহল ডিউটিতে। তারা কেউই ঘটনাস্থলে ছিলেন না।’

আনসারের তদন্ত কমিটি

মামুনকে পিটিয়ে মারার ঘটনাস্থলের ছিলেন আনসার সদস্যরা। তারা মামুনকে কেন তাদের হেফাজতে নেননি? এটা তাদের দায়িত্বে অবহেলা কীনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর আনসারের উত্তর জোন কমান্ডার মো. আম্বার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে পারব না। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কাজ করছে।

‘আনসার সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কীনা বা তারা কে কোথায় ছিলেন এটা তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন দিলে বিস্তারিত জানা যাবে।’

সুরতহাল প্রতিবেদন ও চিকিৎসকের তথ্যে গরমিল

মামুনের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক এস এম আল-মামুন। তিনি মামুনের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করার সময় উপস্থিত লোকজন ও মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে, অজ্ঞাতনামা লোকজন ভিকটিমকে চোর সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। যার ফলে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। আমিও তাদের সঙ্গে একমত।’

দলবদ্ধ পিটুনিতে মাথায় রক্তক্ষরণে মামুনের মৃত্যু

সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মামুনের মাথায় কোনো ফোলা চিহ্ন নেই, মাথা স্বাভাবিক।

তবে ময়নাতদন্ত করা চিকিৎসক জানিয়েছেন, মামুনের মাথার পেছনের অংশ ফোলা ছিল। এছাড়া শরীরের বাকি অংশ অনেকটাই স্বাভাবিক।

সুরতহাল প্রতিবেদনে এই ভুল তথ্য দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-পরিদর্শক এস এম আল-মামুন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি সুরতহাল প্রতিবেদন কোথায় পেলেন? ভাই, থানায় আসেন; আপনার সঙ্গে কথা বলি।’

আপনি কি মামুনের মাথার পেছনে ফোলা দেখতে পাননি নাকি ইচ্ছে করে লিখেননি- এমন প্রশ্ন করার পর তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যু

মামুনের ময়নাতদন্ত করেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক কে এম মঈন উদ্দিন।

মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মামুনের ময়নাতদন্ত করে দেখলাম তার মাথায় প্রচুর আঘাত। মাথায় আঘাতের কারণে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে শক্ত কোনো বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন পাইনি। সম্ভবত হাত দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।

‘মামুনের মাথার পেছনের অংশ ফোলা ছিল। তবে মাথা থেতলানো বা ক্ষতচিহ্ন নেই। মামুনের সারা শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। হার্টও স্বাভাবিক ছিল।’

যেভাবে হত্যা

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ১০ থেকে ১৫ জন মামুনকে হাসপাতালের বাইরে থেকে ধরে গেটের ভেতরে আনে। সব মিলিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে পুরো ঘটনাটি ঘটে। তারা প্রথমে মামুনকে ধরে এনে টানাহেঁচড়া শুরু করে। এরপর ২ মিনিটের মধ্যে দলবদ্ধভাবে কিল-ঘুষি ও লাথি মেরে মামুনকে হত্যা করে।’

তবে ভিডিও ফুটেজে আসনার সদস্যদের মারতে দেখা যায়নি বলে দাবি করেন তিনি।

মামলার সবশেষ অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি দ্রুতই তাদেরকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।’

পুলিশ নিজেই এজাহারের বক্তব্য লিখে দিয়ে তাতে স্বাক্ষর নিয়েছে এবং নিহতের ভাই কিছু না বুঝেই তাতে স্বাক্ষর করেছেন- বাদীর এমন বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘সব কিছু জেনেশুনেই মামুনের পরিবার মামলা করেছে। এখন তারা যদি এমন অভিযোগ করে থাকে সেটা তাদের বিষয়।’

আরও পড়ুন:
মামুন হত্যায় আনসার জড়িত থাকলে ব্যবস্থা: তেজগাঁও ডিসি
শিশু হাসপাতালে দলবদ্ধ পিটুনিতে যুবক নিহত

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Collection of silent money in government hospitals

সরকারি হাসপাতালে ‘নীরবে টাকা আদায়’

সরকারি হাসপাতালে ‘নীরবে টাকা আদায়’ নার্স, আয়া ও ওয়ার্ড বয়দের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার ও নীরবে টাকা আদায়ের অভিযোগ করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সেবা নিতে আসা অনেক রোগীর স্বজন। কোলাজ: নিউজবাংলা
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মাকে ভর্তি করা বাবু নামের এক ব্যক্তি সম্প্রতি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো ডাক্তার, নার্স আসছেন না। ডাক্তাররা ভালো ব্যবহার করলেও প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয় ওয়ার্ড বয় ও আয়াদের কাছে। টাকা না দিলে তারা কোনো হেল্প করতে চায় না; আবার খারাপ ব্যবহার করে। মায়ের এমন অবস্থা যে, খুব দ্রুত চিকিৎসা দরকার। দুই ঘণ্টা ধরে ছোটাছুটি করছি। কেউ এগিয়ে আসছে না।’

রাজধানীর রায়ের বাজার থেকে অসুস্থ মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন মো. বাবু। তার মায়ের পায়ুপথ দিয়ে ক্রমাগত রক্ত ঝরছিল।

মাকে একটু স্বস্তি দিতে কেবিনের জন্য কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ করেও তা মেলাতে পারেননি বাবু। তাকে নিয়ে অবস্থান করতে হয় বারান্দায়।

সম্প্রতি নিউজবাংলাকে বাবু বলেন, ‘কোনো ডাক্তার, নার্স আসছেন না। ডাক্তাররা ভালো ব্যবহার করলেও প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয় ওয়ার্ড বয় ও আয়াদের কাছে।

‘টাকা না দিলে তারা কোনো হেল্প করতে চায় না; আবার খারাপ ব্যবহার করে। মায়ের এমন অবস্থা যে, খুব দ্রুত চিকিৎসা দরকার। দুই ঘণ্টা ধরে ছোটাছুটি করছি। কেউ এগিয়ে আসছে না।’

একই অভিযোগ পুরান ঢাকা থেকে আসা মামুন চঞ্চলের। তিনি জ্বর ও হাত-পা ফোলা অবস্থায় থাকা মাকে ভর্তি করেন হাসপাতালটিতে।

মামুন চঞ্চল বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যালের মতো হাসপাতালে সারা দেশ থেকে রোগী আসে। অথচ এখানে নার্সদের, ওয়ার্ড বয় এবং আয়াদের ব্যবহার খারাপ। নার্সদের রোগীর সঙ্গে ব্যবহারের ওপর আলাদা ট্রেনিং দেয়া প্রয়োজন। কারণ রোগী এবং তার সঙ্গে থাকা সবার মানসিক অবস্থা এমনিতেই ভালো থাকে না।

‘আবার ক্যাথেটার লাগানো নিয়েও তাদের কাছে ভোগান্তি। একটা ক্যাথেটারের দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, যেটা হাসপাতাল থেকে দেয়ার কথা, কিন্তু দেয় না। সেখানে একজন আয়া ক্যাথেটার লাগিয়ে দিতে দাবি করে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।’

আরেকটি বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কেবিন তো মেলেই না, বরং ওয়ার্ডে একটা বেডে চারজন পর্যন্ত রাখতে দেখেছি!’

এত ছোট বেডে চারজন কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা সম্ভব করছেন। আমি দেখেছি। রোগী আসছে। নার্স বা আয়া তাদের বেডে ফেলে চলে যাচ্ছেন।

‘এদিকে সপ্তাহে দুই দিন সরকারি ছুটিতে ডাক্তার পাই না। আবার একুশে ফেব্রুয়ারির ছুটিতেও পাব না। গত ৫ দিনে এগুলোই দেখছি। এই ভোগান্তি বন্ধ হওয়া জরুরি।’

সরকারি হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পুরোনো। সম্প্রতি অব্যবস্থাপনার নতুন কিছু অভিযোগ উঠে এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে, যা খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে নিউজবাংলা।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোগী, স্বজন, ওয়ার্ড বয়, আয়া, নার্স ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক।

এক বেডে দুই রোগী

ঢাকা মেডিক্যালের ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, একটি বেডে দুজন করে রোগী। যেখানে একজনই ভালোভাবে থাকতে পারেন না, সেখানে গাদাগাদি করে দুজন।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এক সহযোগী অধ্যাপক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ মাঝে মাঝেই শোনা যায়, কিন্তু আমাদের হাতে এটা না। হাসপাতাল প্রশাসন দেখে বিষয়গুলো।

‘আমাদের সামনে এ রকম কিছু চোখে পড়লে তখনই সতর্ক করে দিই। চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা কোনো ত্রুটি রাখি না। অন্তত আমার জায়গা থেকে এটা বলতে পারি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আইসিইউতে চিকিৎসাকালে মৃত্যু হয় শাপলা বড়ুয়ার মা নন্দিতা বড়ুয়ার, যিনি মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন।

হাসপাতালে মায়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে শাপলা বড়ুয়া অভিযোগ করেন, ‘আমার মা দেহদান করে গেছেন, কিন্তু বিভিন্ন হাসপাতালে তার যে ভোগান্তি হয়েছে, অন্যান্য রোগীদের যে ভোগান্তি হয় সেগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না। হাসপাতালে নীরব চাঁদাবাজি চলে। আমি মেডিক্যাল অব্যবস্থাপনা দেখে এসেছি।

‘ওয়ার্ড বয়কে টাকা না দিলে আমার মাকে ডায়াপার পরাবে না। অনেক দিন বেডে থাকায় মায়ের মাংস খুবলে পড়েছে। সেই দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়েছে। টাকা ছাড়া কেউ পরিষ্কার করবে না। সরকারি হাসপাতালে আমি কেন টাকা দেব তাদের?’

তিনি বলেন, ‘সকালবেলাতেই ২০০ থেকে ৩০০ টাকা তাদের দিতে হয়। আমার মা যেদিন মারা যান, আমাদের জানানো হয় তিনি নেই। আমরা জানিও না কখন মারা গেছেন।’

তিনি আরও বলেন, “পাশে আরেকজন রোগী ছিলেন। তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, ‘আমাকে তো এখানে খাবার খেতে দেয় না।’ তখনই একজন নার্স দৌড়ে এসে ধমকে বলেন, ‘আপনিই তো খেতে চান না। আমরা দেই না বলছেন কেন?’ সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক ভয় পেয়ে স্ত্রীকে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমিই খেতে চাই না। তুমি কেন উনাদের বলো না কিছু।’ এভাবে ধমকাধমকি করা হয় রোগীদের। আমি প্রত্যেকটা রোগীকে কাঁদতে দেখেছি তাদের (নার্স) খারাপ ব্যবহারের জন্য। আমরা তো তাদের কাছে জিম্মি।”

বিএসএমএমইউর একটি ওয়ার্ডে থাকা এক রোগীর ভাতিজা শুভ বলেন, ‘আমরা ১৫ দিন ধরে কাকাকে নিয়ে আছি। কেউ খারাপ ব্যবহার না করলেও ডাক্তাররা একেক সময় একেক কথা বলছেন। কাকা উঁচু টেবিল থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। শুরুতে হাত ভেঙে গেছে বলেছিলেন। অপারেশন করতে হবে।

‘পরীক্ষার পর আজ বললেন, কোমরের চোটের জন্য ফ্র‍্যাকচার আছে। হাতে অপারেশন লাগবে না; কোমরের জন্য অপারেশন করতে হবে। সে জন্য এক লাখ টাকা লাগবে। আমাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ বা সময় দেন না তারা। আগে বললে টাকাটা আগে ম্যানেজ করতে পারতাম।’

বিএসএমএমইউর অ্যাম্বুলেন্সের দায়িত্বে থাকা আলাউদ্দিন বলেন, ‘এ রকম টাকা আদায় অহরহ হয়। আমাদের এখানে একটু কম, তবে আমার চোখের সামনে দেখেছি।

‘যারা টাকা নেয়, তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেন। কেউ স্বীকার করবে না।’

অভিযোগ নিয়ে প্রশাসনের ভাষ্য

হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে ওয়ার্ড বয়, আয়াদের টাকা আদায় এবং নার্সদের খারাপ ব্যবহার নিয়ে কথা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

ওয়ার্ড বয়, নার্স ও আয়াদের ব্যবহার নিয়ে রোগীদের অভিযোগের প্রশ্নে ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে সেটার জন্য ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়। আমরা সবসময় স্পিকারে এবং সরাসরি তাদের নির্দেশনা দিই রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যেন কোনো রকম অসাদাচরণ না ঘটে। আর টাকা না দিলে কাজ না করার অভিযোগ হলে আমাদের কাছে অভিযুক্তের নাম ও পদবিসহ দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রমাণ পেলে কঠোর পদক্ষেপ নেব।

‘এর আগে অনেককেই বেতন বন্ধ করে এবং নানাভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে। সবাইকে গণহারে বললে কেউ শুনবে, কেউ শুনবে না।’

‘ক্যাথেটার হাসপাতালের দেয়ার কথা। সেটাও রোগীদের কিনতে হচ্ছে। আবার তা লাগিয়ে দিতেও টাকা দিতে হচ্ছে।’

উল্লিখিত বক্তব্যের জবাবে ঢামেকের পরিচালক সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাথেটারের অর্ডার দেয়ার নির্দেশ দেন, যা আগেও দেয়া ছিল।

অভিযোগের পর ক্যাথেটার বিনা মূল্যে দেয়ার বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে বলেন পরিচালক। সেই সঙ্গে টাকা আদায়ের বিষয় খতিয়ে দেখবেন বলেও জানান তিনি।

বিএসএমএমইউয়ের পরিচালক রেজাউর রহমান বলেন, ‘যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের নম্বর এবং অভিযোগের ভিডিও লাগবে। অডিও দিলেও হবে না। কারণ অডিও চেক করার টেকনোলজি আমার কাছে নেই।

‘প্রমাণ ছাড়া প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। কাউকে শাস্তি দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণসহ থাকতে হবে।’

‘সাধারণ মানুষ তো ভিডিওতে সবাই কথা বলবেন না। আর তারা প্রশাসন পর্যন্ত যাওয়ার মানসিক অবস্থাতেও থাকেন না, রোগীকে নিয়ে চিন্তিত থাকেন বলে। অনেকে সাহসও পান না। আর শাস্তি না দিয়ে মুখে বললেও তো তারা সচেতন হবেন।’

উল্লিখিত বক্তব্যের জবাবে রেজাউর রহমান বলেন, ‘এভাবে আপনাদের কাছে না বলে আমাদের কাছে আসলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। প্রশাসন তো সে জন্যই রয়েছে, কিন্তু দুই-একজনের কথায় এভাবে সবাইকে বলার চেয়ে অভিযোগ পেলে ব্যাপারটা জোরদার করা সম্ভব।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বরত উপাচার্য অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সে রকম অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব, তবে সুনির্দিষ্ট নাম থাকলে সহজ হয় কাজটা।’

‘সাধারণ মানুষ তো হাসপাতাল প্রশাসন পর্যন্ত যেতে পারেন না অথবা ভয় পান। সে ক্ষেত্রে আপনারা মৌখিকভাবেও নির্দেশনা দিতে পারেন কি না?’

উল্লিখিত প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ বলেন, ‘সেটা অবশ্যই করা যায়। তাদেরকে বলা হয় সবসময়। আপনার নিয়ে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের আবারও নির্দেশনা দেয়া হবে।’

বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট অনেককেই পাওয়া যায়নি ফোনে। কথা হয় অধিদপ্তরের মেডিক্যাল অফিসার (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. দেওয়ান মো. মেহেদী হাসানের সঙ্গে।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ এর আগেও অনেকবার পাওয়া গিয়েছে, তবুও বন্ধ হচ্ছে না অনিয়ম।’

কোনো নির্দেশনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজে-কলমে তো সুনির্দিষ্টভাবে টাকা নেয়া বা খারাপ ব্যবহার করা যাবে না, সে রকম নির্দেশনা নেই, তবে অনিয়ম করা যাবে না, সেটা অবশ্যই বলা আছে।

‘আর এই অভিযোগগুলো অনিয়মের মধ্যেই পড়ে। আর এগুলো হসপিটালের ডিরেক্টর এবং প্রশাসনই দেখে থাকেন। তারাই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নেন।’

এক বেডে দুই রোগী নিয়ে হাসপাতাল প্রশাসনের ভাষ্য

কোনো ওয়ার্ডে এক বেডে দুই থেকে তিন রোগী রাখা হয়েছে। এ অভিযোগ নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক নাজমুল হক বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যালে ২ হাজার ৬০০ বেড আর কেবিন মাত্র ২০টা। এর চেয়ে বেশি রোগী আসলে তো আমার সিট দেয়া সম্ভব না। তারা তো অন্য কোথাও যায় না। অন্য হাসপাতালে কেবিন খালি থাকে।

‘তারা এখানেই এভাবে থেকে চিকিৎসা নিতে চাইলে আমার তো কিছু করার নেই, তবে সিট ৫ হাজার করার সুপারিশ করা হয়েছে সরকারের কাছে। পেয়ে যাব প্রক্রিয়া শেষে।’

এই ধরনের অভিযোগ নিয়ে কথা হয় নার্স, আয়া ও ওয়ার্ড বয়দের সঙ্গে। তাদের বেশির ভাগই বিষয়টি অস্বীকার করেন।

ঢাকা মেডিক্যালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রিতা রাণী বলেন, ‘আপনি যে অভিযোগের কথা বলছেন, সেটা একেবারে হয় না, তা না। সবাই সমান না। অনেকেই খারাপ ব্যবহার করে। আমি নিজে তাদের বলি এভাবে রোগী বা অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার না করতে।’

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে ইমারজেন্সিতে কাজ করেন আয়া মনি আক্তার। অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, ‘হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না। অনেকেই খারাপ ব্যবহার করে, কিন্তু আপনারা টাকা না দিলে আমাদের সংসার কীভাবে চলবে?’

‘আপনারা তো বেতন পান।’

উল্লেখিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনি বলেন, ‘আমাদের সংসার তো এই ছয় হাজার টাকায় চলে না। রোগীর কেউ খুশি হয়ে বকশিস দিলে সেই টাকা দিয়া তেল, সাবান কিনি। কারও থেইকা জোর কইরা নিই না।’

আরও পড়ুন:
তুরস্কের সহায়তায় চট্টগ্রামে নতুন হাসপাতাল গড়তে চান মেয়র
আড়াই বছরেও চালু হয়নি রংপুর শিশু হাসপাতাল
জন্ম নিবন্ধনে অনিয়ম, ফেনী পৌরসভার ২ কর্মচারী বরখাস্ত
ভালো রাস্তা সংস্কার, একই রাস্তায় দুই প্রকল্প
হাসপাতালে বিজয় দিবসের সজ্জায় কনডম-কাণ্ড তদন্তে কমিটি

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Brothers prostitution card is rolling on the pavement of Dhaka

ঢাকার ফুটপাতে গড়াচ্ছে ‘ভাই’দের দেহব্যবসার কার্ড

ঢাকার ফুটপাতে গড়াচ্ছে ‘ভাই’দের দেহব্যবসার কার্ড রাজধানীর শ্যামলীতে শিশুমেলার সামনের ফুটওভার ব্রিজে পড়ে থাকা দালালদের কার্ড। ছবি: নিউজবাংলা
ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক, ফুটপাত ও ফুটওভারব্রিজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় হাজারও ভিজিটিং কার্ড। সেগুলোতে বড় করে লেখা থাকে ‘... ভাই’। সঙ্গে মোবাইল ফোন নম্বর। নিচে লেখা- ১০০% নিরাপদ আবাসিক হোটেল। আপাতদৃষ্টিতে এটি আবাসিক হোটেলের বিজ্ঞাপনের কার্ড মনে হলেও ফোন করলেই বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। ফোনে আরেক প্রান্ত থেকে যিনি কথা বলেন তিনি যৌনকর্মীদের দালাল।

রাজধানী ঢাকার প্রধান প্রধান রাস্তা, ফুটপাত ও ফুটওভারব্রিজে পড়ে থাকে নানা রঙের অজস্র ভিজিটিং কার্ড। পথচলতি নগরবাসী অনেকে সেসব লক্ষ্য করেন, কেউবা দৃষ্টিই দেন না। তবে একটু লক্ষ্য করলেই চোখে পড়বে ব্যতিক্রমটা।

উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম- নগরীর প্রায় সব এলাকায় এসব কার্ডের দেখা পাওয়া যায়। তবে জনসমাগম বেশি হয় এমন এলাকার ফুটপাতে এসব কার্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেগুলোতে বড় করে লেখা থাকে ‘... ভাই’। সঙ্গে থাকে মোবাইল ফোনের একটি নম্বর। নিচের দিকে লেখা থাকে- ১০০% নিরাপদ আবাসিক হোটেল।

আপাতদৃষ্টিতে যে কেউ ধরে নেবে যে এটি কোনো আবাসিক হোটেলের বিজ্ঞাপনের কার্ড। তবে এসব ভিজিটিং কার্ডে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন করলে বেরিয়ে আসে আসল রহস্যটা। ফোনে আরেক প্রান্ত থেকে যিনি কথা বলেন তিনি যৌনকর্মীদের একজন দালাল।

সরেজমিনে কারওয়ান বাজার, শ্যামলী, কলেজ গেট, মগবাজার, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মতিঝিল, কমলাপুরসহ নগরীর জনবহুল প্রায় সব এলাকার প্রধান প্রধান সড়কের ফুটপাত ও ওভারব্রিজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমন ভিজিটিং কার্ড পড়ে থাকতে দেখা গেছে। লাল, নীল, হলুদ, সাদা, সবুজ রংয়ের এসব ভিজিটিং কার্ডে সিরাজ ভাই, সিদ্দিক ভাই, নিরব ভাই, ডালিম ভাই, ইমরান ভাই, তুষার ভাইসহ অসংখ্য ভাইয়ের নাম ও ফোন নম্বর লেখা থাকে।

কারওয়ানবাজার এলাকার ফুটপাত থেকে এমন কিছু কার্ড কুড়িয়ে হাতে নিয়ে তাতে পাওয়া গেল বাদশা ভাই, ডালিম ভাই, ইমন ভাইসহ আরও অনেক নাম।

পেট্রোবাংলার ভবনের সামনে চায়ের দোকানি ফয়সাল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমিও ভাই অনেক দিন ধরেই ফুটপাতে এমন ভিজিটিং কার্ড পড়ে থাকতে দেখছি। আমারও আগ্রহ জাগে কার্ডগুলো কারা এখানে ফেলে রেখে যায় তা দেখতে। একদিন খেয়াল করলাম বোরকা পরা এক মেয়ে এমন বেশকিছু কার্ড আমার দোকানের পাশের ফুটপাতে ফেলে দ্রুত হাঁটা শুরু করলো। পেছন থেকে ডাক দিলে ওই মহিলা হাঁটার গতি বাড়িয়ে কেটে পড়লো।’

তিনি জানালেন, আগে ফুটপাতে এই কার্ড কম দেখা যেতো। এখন প্রায় প্রতিদনই যেন কার্ডের সংখ্যা বাড়ছে। কোনো কোনো দিন ওরা দুই-তিনবার করে এসে এসব কার্ড ফেলে রেখে যায়। কিন্তু সারাক্ষণ তাকিয়ে না থাকলে ওদের চেনা বা ধরা মুশকিল।

কারওরান বাজার এলাকার ফুটপাত থেকে ‘ডালিম ভাই’ নামের একটি কার্ড হতে নিয়ে সেখানে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন দেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক।

সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আপনার জন্য আমরা কী কী সেবা দিতে পারি স্যার? আমাদের এখানে সব ধরনের ফ্যাসালিটি আছে।’

কী ধরনের সুবিধা আছে- এমন প্রশ্নে ওই ব্যক্তি উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘ঘণ্টায় নাকি নাইট করবেন? আমাদের এখানে সবই আছে ভাই। এটা আমাদের আবাসিক হোটেল। এখানে কোনো রিক্স (রিস্ক) নাই।’

ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ঠিকানা দেওয়ার কোনো নিয়ম নাই। আপনি শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে এসে এই নম্বরে ফোন দিলেই হবে। আমরা আপনাকে নিয়ে আসব। আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই ভাই। থানা পুলিশ থেকে স্থানীয় সবাইকে আমাদের ম্যানেজ করা।

‘আমাদের এখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ভালো মেয়ে আছে। আপনাকে ১৪-১৫টা দেখাবো। এর মধ্যে আপনি আপনারটা বেছে নিবেন। আমাদের রেট ঘণ্টায় ১৫শ’ আছে, ২ হাজারও আছে। আর নাইট করলে সাড়ে ৩ হাজার আছে, আবার ৪ হাজার টাকারও মেয়ে আছে। আমরা এখানে ২৪ ঘণ্টাই সার্ভিস দেই।’

ঢাকার ফুটপাতে গড়াচ্ছে ‘ভাই’দের দেহব্যবসার কার্ড
শ্যামলী শিশুমেলার সামনে ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়িতে পড়ে আছে অজস্র কার্ড। ছবি: নিউজবাংলা

শ্যামলীর শিশুমেলার সামনের ফুটওভারব্রিজের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এমন শত শত ভিজিটিং কার্ড। তবে কারা এই ভিজিটিং কার্ড ফেলে রেখে যায় সেটা বলতে পারেননি ওভারব্রিজের ওপর বসা ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা।

এখানে মাস্ক বিক্রেতা মোস্তাফিজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকাল ৭-৮টার দিকে যখন আমি এখানে দোকান বসাই তখন এই ব্রিজে ভিজিটিং কার্ডের জ্বালায় হাঁটা যায় না। কারা যেন সকালে শত শত কার্ড ছিটিয়ে রেখে যায়। আমিসহ এখানকার দোকানদাররা প্রতিদিন সকালে এসে প্রথমেই ঝাড়ু দিয়ে এই কার্ড পরিষ্কার করি।’

এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজ বলেন, ‘বিভিন্ন বয়সের মানুষ এগুলো ছিটিয়ে দ্রুত চলে যায়। তবে তাদের বেশিরভাগই ২০-২৫ বছরের ছেলেপেলে। প্রথমে ওরা এখানে আসে, কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে যখন লোকজন কম থাকে তখন পকেট থেকে মুঠিভর্তি কার্ড নিয়ে পুরো ওভারব্রিজে ছিটিয়ে চলে যায়। দিনের বেলায়ও দুই-একবার ওরা এখানে কার্ড ফেলে যায়। মাঝে মাঝে বোরকা পরে মেয়েরাও এসে এই কার্ড ছিটিয়ে যায়।’

কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো খারাপ কাজের জন্য ফেলে রাখে ভাই। এইসব যৌনকর্মীর দালালদের নম্বর। আবার কিছু কিছু যৌনকর্মী নিজেও এই ভিজিটিং কার্ডে থাকা নম্বর ব্যবহার করে।’

ওভারব্রিজের নিচে আগারগাঁওয়ের রাস্তায় বাদাম বিক্রি করেন আব্দুর রহমান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে এই কার্ড কম দেখা যেতো। কিন্তু এখন আপনি যেখানেই তাকাবেন এই কার্ড দেখতে পাবেন। গতকাল দেখি বোরকা পরা এক মহিলা এই ফুটপাতে আর ওভারব্রিজে কার্ড ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি ডাক দিলে দ্রুত সে দৌড়ে চলে যায়।’

‘এ ধরনের হোটেল ঢাকা শহর জুড়েই আছে। এই এলাকায়ই ৭টি হোটেল আছে যেগুলোতে দেহব্যবসা চলে। এর মধ্যে গাবতলী এলাকায় আছে ৫টি- নিউ আগমন হোটেল, হোটেল যমুনা, নিউ বলাকা হোটেল, রজনীগন্ধা হোটেল ও স্বাগতম হোটেল। আর টেকনিক্যাল এলাকায় আছে ধানসিঁড়ি হোটেল ও বানাম সিটি হোটেল।

শ্যামলী ওভারব্রিজের ওপর থেকে তুষার ভাই লেখা একটি কার্ডের নম্বরধারীর কথা হয় নিউজবাংলার সঙ্গে। ফোন করা মাত্র ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘তুষার ভাই বলছি। আপনার জন্য আমরা কী সেবা দিতে পারি?’

এটা কী ধরনের আবাসিক হোটেল জানতে চাইলে ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘শটে আছে, ঘণ্টায় আছে, নাইট আছে। আপনি কিভাবে নিবেন? আমাদের এখানে শটে ৫৫০ টাকা, ঘণ্টায় ১৮ শ থেকে ২৫ শ টাকা। আর নাইট ৩ হাজার আছে, ৪ হাজার আছে। আমাদের এখানে ভালো ঘরের পড়াশুনা করা মেয়েরা আছে। আপনার পছন্দ হবে।’

আপনার ভিজিটিং কার্ডটা আমি শ্যামলী থেকে পেয়েছি। কিন্তু এখানে হোটেলের কোনো ঠিকানা নেই। এমন প্রশ্নের জবাবে ফোনের ওপাশ থেকে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আপনি শ্যামলী থেকে একটা বাসে উঠে গাবতলী বাস টার্মিনালের এক নম্বর গেটের বিপরীত পাশে এসে এই নম্বরে কল দিয়েন। আমি আপনাকে নিয়ে আসব।’

এই তুষার ভাইয়ের কথার সূত্র ধরে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় অনুসন্ধান চালায় নিউজবাংলা। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে পর্বত সিনেমা হলের পাশে দেখা মেলে এ ধরনের ভিজিটিং কার্ড হাতে এক ব্যক্তিকে। তিনি ফুটপাত ধরে হাঁটা সাধারণ মানুষের হাতে গুঁজে দিচ্ছিলেন একটি করে ভিজিটিং কার্ড।

প্রথমে কাস্টমার ও পরে এক পর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হয় ওই ব্যক্তির সঙ্গে।

নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘ভাই, এই কার্ডে আমার যে নাম আছে সেটা নকল। এই নাম মিডিয়ায় দিলে আমার লাইনের (ব্যবসায়িক) লোক চিনে ফেলবে। আর আসল নাম দিলে আমার পরিবার চিনে ফেলবে। এগুলো পেটের দায়ে করছি। আগে কাপড়ের দোকানে কাজ করতাম। চাকরি চলে গেলে এই কাজে জড়িয়ে পড়ি।’

‘আমি ভিজিটিং কার্ড রাস্তায় ছিটাই না। রাস্তায় ছিটালে পরিবেশ নষ্ট হয়। তাই আমি মানুষের হাতে হাতে কার্ড দিই। এই কার্ড দিলে হোটেল মালিক আমাকে দিনে ৭০০ টাকা দেয়। এছাড়া আমার কার্ডের নম্বর থেকে আসা কাস্টমার কাজ শেষে আমাকে বকশিস দেয়। সব মিলে মাসে আমার ৩০-৩৫ হাজার থাকে।

‘আমাদের হোটেল মালিক সব কিছু ম্যানেজ করে চলেন। তাই কোনো ঝামেলা হয় না। মাসিক টাকা দিয়ে থানা-পুলিশ, নেতা-গুতা সব হাতে রাখেন তিনি।’

দেহব্যবসায়ীর এই দালাল আরও বলেন, ‘এ ধরনের হোটেল ঢাকা শহর জুড়েই আছে। এই এলাকায়ই ৭টি হোটেল আছে যেগুলোতে দেহব্যবসা চলে। এর মধ্যে গাবতলী এলাকায় আছে ৫টি- নিউ আগমন হোটেল, হোটেল যমুনা, নিউ বলাকা হোটেল, রজনীগন্ধা হোটেল ও স্বাগতম হোটেল। আর টেকনিক্যাল এলাকায় আছে ধানসিঁড়ি হোটেল ও বানাম সিটি হোটেল।

‘এছাড়া অনেকে বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে অস্থায়ীভাবে দেহব্যবসা চালায়। আর মিরপুর, মগবাজার, পল্টন, যাত্রাবাড়ীসহ পুরো ঢাকা শহরে এ ধরনের হোটেল বা বাসাবাড়ি আছে শত শত। সংখ্যাটি হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।’

গাবতলীর এসব হোটেল মালিক কোনো বোর্ডার না থাকলেও কেবল দেহব্যবসা করে মাসে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে বলে দাবি করেন এই দালাল। তিনি বলেন, ‘প্রতিটা হোটেলেরই ২০-২৫টি নিজস্ব মেয়ে থাকে। এরা সারাদিনই হোটেলেই থাকে। এছাড়া প্রতিটি হোটেলেরই নিজস্ব কিছু দালাল থাকে। তারা কিছু মেয়ে সরবরাহ করে।

‘দালাল এমনকি মেয়েরাও কাস্টমার এনে দেয়। আর প্রতিটি হোটেলেই আমার মতো ৬-৭ জন লোক থাকে যারা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে প্রতিদিন কিছু না কিছু কাস্টমার এনে দেয়।

‘তাছাড়া কাস্টমারদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলে তাদের হোম সার্ভিসও দেই। মানে তাদের (কাস্টমার) দেয়া ঠিকানায় মেয়ে পাঠিয়ে দিই। আমাদের এই এলাকা দারুস সালাম থানার আন্ডারে। আমাদের হোটেল মালিক সব কিছু ম্যানেজ করে চলেন। তাই কোনো ঝামেলা হয় না। মাসিক টাকা দিয়ে থানা-পুলিশ, নেতা-গুতা সব হাতে রাখেন তিনি।’

গাবতলী এলাকা মিরপুরের দারুস সালাম থানাভুক্ত এলাকা। থানার ওসি শেখ আমিনুল বাসার এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এই থানায় নতুন এসেছি। তাই এ ধরনের আবাসিক হোটেল বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই। তবে আমি মাঝে মাঝেই গাবতলী এলাকার বিভিন্ন হোটেলে ফোর্স পাঠাই। আমাদের পুলিশ সদস্যরা খারাপ কিছু পেলে আমাকে জানানোর কথা। তবে তারা এখনও তেমন কিছু পায়নি।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের ভিজিটিং কার্ড ফেলে অনৈতিক ব্যবসার বিষয়টি আমি এখনও পুরোপুরি অবগত নই। মনে হচ্ছে এই অনৈতিক ব্যবসার এটি নতুন কোনো ফাঁদ। আমি খোঁজখবর নিচ্ছি। ঘটনা সত্য হলে আমরা অবশ্যই অ্যাকশনে যাব।’

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Life is uncertain in the journey of happiness and dreams

সুখ-স্বপ্নের যে যাত্রায় জীবনই অনিশ্চিত

সুখ-স্বপ্নের যে যাত্রায় জীবনই অনিশ্চিত অবৈধ পথে ইউরোপে মানবপাচারের রোড। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ-দুবাই-ইরান হয়ে তুরস্কে যাওয়ার পথে শতাধিক অভিবাসন প্রত্যাশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে নাঈমের। সেসব ঘটনা ও নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তিনি জানিয়েছেন নিউজবাংলাকে। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে অবৈধ উপায়ে ইউরোপ যাত্রায় ব্যবহৃত দুবাই-ইরান-তুরস্ক রুটের ভয়াবহ চিত্র।

‘ইউরোপে কোনোভাবে পা রাখতে পারলেই হলো। কিছুদিন চেষ্টা করলেই থাকা ও কাজের অনুমতিপত্র মিলে যাবে। কাগজ পেয়ে গেলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।’

উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতা মানবপাচার চক্রের এসব কথার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই। যাত্রাপথে শিকার হতে হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতনের। দিতে হচ্ছে মুক্তিপণ। সবশেষ জেলও খাটতে হচ্ছে।

লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন একটি পথ বেছে নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা।

বাংলাদেশ থেকে দুবাই, ইরান হয়ে তুরস্ক যাচ্ছে শত শত মানুষ। আর যাওয়ার পথে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি সঙ্গে থাকা সর্বস্ব হারাচ্ছেন বিদেশগামীরা। নির্যাতনের মুখে মুক্তিপণ হিসেবে দেশ থেকে স্বজনদের পাঠাতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

গড়ে ৮-১০ লাখ টাকা খুইয়ে তুরস্কে পৌঁছার পর কেউ কেউ অবৈধ পথে প্রবেশ করছেন ইউরোপের অন্যান্য দেশে। আবার অনেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জেল খেটে শূন্য হাতে ফিরছেন বাংলাদেশে।

মানব পাচারকারী চক্রে ফাঁদে পড়া অসংখ্য তরুণ-যুবকের একজন হারিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা নাঈম (ছদ্মনাম)। দেশ ত্যাগের প্রায় এক বছরে সবকিছু হারিয়ে তুরস্ক থেকে শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন তিনি। ২০২২ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় দেশে ফেরা সম্ভব হয়েছে তার।

গত এক বছরে নাঈমের মতো আড়াই হাজার অবৈধ অভিবাসী বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সিআইডির বিশেষায়িত একটি টিমের সংগ্রহ করা তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে। এক থেকে ৫-৭ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে থাকার পর তাদের দেশে ফেরার তথ্য পেয়েছে সিআইডি।

বাংলাদেশ-দুবাই-ইরান হয়ে তুরস্কে যাওয়ার পথে শতাধিক অভিবাসন প্রত্যাশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে নাঈমের। সেসব ঘটনা ও নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তিনি জানিয়েছেন নিউজবাংলাকে। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে অবৈধ উপায়ে ইউরোপ যাত্রায় ব্যবহৃত দুবাই-ইরান-তুরস্ক রুটের ঝুঁকির চিত্র।

ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট

অভিবাসন বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার জন্য ১৮টি রুট ব্যবহার করছে মানব পাচারকারীরা। তারা ভুক্তভোগী নাঈমকে তুরস্কে পাঠিয়েছিল দুবাই-ইরান রুট ব্যবহার করে।

স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রা কীভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন নাঈম। তিনি জানান, ২০২১ সালের মার্চ মাসে আলী হোসেন নামে এক ইউরোপ প্রবাসীর সন্ধান পান তিনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ ও আলাপচারিতা শেষে সাড়ে ৬ লাখ টাকায় ইউরোপে পাড়ি জমানোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান নাঈম।

এরপর শুরু হয় মানব পাচারকারী চক্রের তৎপরতা। আব্দুল হান্নান নামে একজনের সঙ্গে নাঈমকে পরিচয় করিয়ে দেন আলী হোসেন। এই হান্নানের সঙ্গে নাঈমের যোগাযোগ হয় হোয়াটসঅ্যাপে। আলী নাঈমকে জানান, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল তার ফ্লাইটের তারিখ। এরপর নাঈমকে রাজধানীর উত্তরায় হাজী ক্যাম্প এলাকায় সালাম নামে এক ব্যক্তি পাসপোর্ট, টিকিট বুঝিয়ে দেন।

নাঈম বলেন, ‘আমিসহ চারজন ছিলাম। আমাদের গ্রুপ ভিসায় দুবাই পাঠানো হয়। দুবাইয়ের শারজায় যাওয়ার পর আব্দুল হান্নানের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাদের রিসিভ করে একটি গাড়িতে করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে রাতের খাবার খাওয়ান।

‘এই ফাঁকে তিনি কৌশলে আমার কাছে থাকা ৬শ’ ডলার ও পাসপোর্ট নিয়ে নেন। ডলার নেয়ার পর তিনি আরও টাকা চান। আলীর সঙ্গে কথা বলার পর আমার ভাই দেশের একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৭ হাজার ২শ’ টাকা পাঠায়। ওখানে ৬-৭ দিন থাকার পর হান্নান কয়েকজনকে নিয়ে এসে আমাদেরকে গাড়িতে করে অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যান।’

ট্রলার-স্পিডবোটে পারস্য উপসাগর পাড়ি

গাড়িতে করে নেয়ার পর হান্নান চার বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেন। পরে নাঈমসহ অন্যদের গাড়িতে করে সমুদ্র বন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সমুদ্র বন্দরে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদেরকে জোর করে একটি মাছ ধরার ট্রলারে উঠানো হয়। ওই ট্রলারে তারা একসঙ্গে ৫৩ জন বাংলাদেশি ছিলেন। যাওয়ার পথে তাদের ট্রলার নষ্ট হয়ে যায়। এরপর ৪টি স্পিডবোটে ভাগ করে সবাইকে তুলে ইরানের সীমান্তে নিয়ে যায় পাচারকারীরা।

ইরানের বন্দর আব্বাসে নেমে আসে আমানুষিক নির্যাতন

স্পিডবোটে বন্দর আব্বাসে পৌঁছার পর সেখান থেকে ৫-৬টি মাইক্রোবাসে করে সবাইকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে দুটি রুমে আটকে রাখে চক্রটি। এরপর পালাক্রমে ৫-৬ জন মিলে দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। বেধড়ক মারধর করে চাওয়া হয় মুক্তিপণ।

নাঈম বলেন, ‘ওদের কথামতো মুক্তিপণ দিতে না চাওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে আলী হোসেন ও হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা একটি একাউন্ট নম্বর দিলে সেখানে আমার ভাই ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠায়। টাকা দেয়ার পর ইরানিরা আরও টাকা চায়। আলী ও হান্নানকে অনুরোধ করে নিজের অপারগতা প্রকাশ করলে ইরানিরা তিন দিন পর আমাদেরকে গাড়িতে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।’

দুর্গম মরুযাত্রা

বন্দর আব্বাস থেকে গাড়িতে করে ৫৩জনকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। মরুভূমিতে সারাদিন আটকে রাখার পর রাতে শুরু হয় সিরাজ শহরের উদ্দেশে যাত্রা।

নাঈম বলেন, ‘মরুভূমিতে সারাদিন আটকে রাখার পর আফগান, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি নারী-পুরুষ মিলে ১০০ জনের মতো লোককে ৬টি গাড়িতে একটি স্থানে নেয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে ৬ ঘণ্টা হেটে ও দৌড়ে আমাদেরকে মেইন রোডে নিয়ে তোলে পাচারকারীরা। আরও ৩-৪ ঘণ্টা পর দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমাদেরকে গাড়িতে করে ইরানের সিরাজ শহরে নেয়া হয়।

সিরাজ শহরে নাঈমসহ অন্যদের রিসিভ করে আলীর ছেলে সাব্বির। নাঈম জানান, সিরাজ শহরে এশিয়ান, আফ্রিকান অনেককে নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে দুই-একদিন এখানে রেখে নিয়ে যাওয়া হয় ইরানের রাজধানী শহর তেহরানে।

অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি

তেহরানে নাঈমসহ তিনজনকে আলাদা আলাদা রুমে রাখা হয়। পরদিন হান্নানের পরিচিত এক বাংলাদেশি মিজাদুলের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় নাঈমকে। নির্যাতন আর দুর্গম যাত্রার ধকলে সেখানে যাওয়ার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

নাঈম বলেন, ‘আলী হোসেনকে টাকা দেয়ার পর আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর সহ্য করতে না পেরে মিজাদুলকে বলি আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু মিজাদুল জানিয়ে দেন- সেজন্য দেড় লাখ টাকা লাগবে। আর তেহরান থেকে তা সম্ভব নয়। প্রথমে তুরস্কে পাঠিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।’

তুরস্কে পৌঁছে পুলিশের হাতে ধরা

মিজাদুলের কথায় রাজি হলে একটি গাড়িতে করে নাঈমসহ চারজনকে তুরস্কে পাঠানো হয়। রাতের আঁধারে তারা তুরস্কে প্রবেশ করেন। সেখানে তাদেরকে একটি ‘সেফ হোমে’ রাখা হয়। সেখানে দেড় লাখ টাকা দেয়ার পর তাকে দালালদের মাধ্যমে পাঠানো হয় তুরস্কের তাৎবান শহরে।

নাঈমের ভাষ্য, ‘১৮ মে মিজাদুলকে দেড় লাখ টাকা দেয়ার পর গাড়িতে করে আমাদেরকে একটি নদীর পাড়ে নামিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে জাহাজে ৪ ঘণ্টা যাওয়ার পর দুটি পাহাড়ের মাঝে আমাদের নামিয়ে দেয় দালাল। সারারাত হাঁটার পর তাৎবান শহরে পৌঁছাই। একটি রুমে রাখা হয় ৩ ঘণ্টা। পরে মিজাদুল একটি প্রাইভেট কার পাঠায়। কারে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নামিয়ে দিয়ে বলা হয় আমাদেরকে নিতে বাস আসবে। কিন্তু বাস আর আসেনি। চার ঘণ্টা পর মিজাদুল একটি ট্যাক্সি পাঠায়। ট্যাক্সিতে করে তাৎবান শহরে পৌঁছাই।

‘দুদিন পর মিজাদুল ও আলী হোসেন একটি গাড়ি পাঠান। তাতে উঠিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় তুরস্কের আদানা শহরে। সেখান থেকে ইস্তাম্বুল যাওয়ার পথে চেকপোস্টে পুলিশ আমাদের আটক করে। ১১ দিন কারাগারে থাকার পর মুক্তি পাই।’

বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি ও আইওএম-এর সহায়তায় দেশে ফেরা

তুরস্কের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বাংলাদেশ অ্যাম্বেসিরর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন নাঈম। কিন্তু বাদ সাধে তার সঙ্গে কোনো কাগজ না থাকা। বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করে আউট পাস ম্যানেজ করে দেশে ফিরতে আরও ছয় মাস লেগে যায় তার।

২০২২ সালের ২৮ মার্চ দেশে ফেরেন নাঈম। দেশে ফেরার পর আলী ও তার চক্রের কাছ থেকে টাকা উদ্ধাারের চেষ্টা করেন তিনি। উপায় না পেয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। আসামি করা হয় চক্রের প্রধান আলী হোসেন, দুবাইয়ে বসবাসকারী আব্দুল হান্নান, ইরানে থাকা মিজাদুল, আলী হোসেনের স্ত্রী রাশিয়া বেগম, শাহাদাৎ হোসেন ও সাব্বিরসহ অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনকে।

পাচার চক্রের চারজন গ্রেপ্তার

মামলাটির তদন্ত শুরুর পর পাচার চক্রে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ।

তারা হলেন- মাহামুদুল হাছান, জাহাঙ্গীর আলম বাদশা, সালামত উল্লাহ ও রাশিয়া বেগম। মাহামুদুল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে অগ্রগামী ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের এয়ার কন্ডিশন সার্ভিসে এবং জাহাঙ্গীর সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত বলে জানিয়েছে সিআইডি। সালামত উল্লাহ দালাল এবং রাশিয়া বেগম ইউরোপে বসবাসকারী এই চক্রের প্রধান আলীর স্ত্রী।

অধরা বিদেশে থাকা গডফাদাররা

দেশে জড়িত চারজন গ্রেপ্তার হলেও চক্রের হোতাসহ দেশের বাইরে যারা আছে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের পর দেশের বাইরে থাকা জড়িতদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম।

বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের প্রবণতার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে যাওয়ার জন্য ১৮টা রুট আছে। সবচেয়ে প্রচলিত রুট হচ্ছে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি বা গ্রিসে যাওয়া।

‘গত ১৩-১৪ বছরে ৬৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি এভাবে ইউরোপে ঢুকেছে। তাদের অর্ধেকের বেশি ঢুকেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে। দুবাই থেকে ইরান, তুরস্ক বা গ্রিস হয়ে ইউরোপে প্রবেশও এখন কমন একটি রুট। অনেক বছর ধরেই এই রুটে অবৈধভাবে লোকজন যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বর মাসে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিনিধিসহ অন্য কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে তারা জানান, অনেক বাংলাদেশি এভাবে তুরস্কে গিয়ে আটক হচ্ছেন। যারা অবৈধভাবে ইউরোপ যেতে চাচ্ছেন, তাদেরকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তারা সচেতন না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঠেকানো সম্ভব নয়।’

শরিফুল হাসান বলেন, ‘ভিজিট ভিসা কাজের নিশ্চয়তা দেয় না। তারপরও এসব জেনে-বুঝেই ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়ে অনিয়মিত পন্থায় অনেকে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এই সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে।

‘বাংলাদেশের ৮-১০টি মানুষের মধ্যে অবৈধভাবে ইউরোপ যাত্রার প্রবণতা প্রবল। এর মধ্যে শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ একটি জোন। সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার আরেক জোন। আরেকটা জোন হলো ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো- নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও নোয়াখালী।’

আরও পড়ুন:
ভারতে পাচারের জন্য চুরি করা হয় শিশুটিকে
সৌদি পাঠানোর কথা বলে ‘ধর্ষণ’, গ্রেপ্তার ৪
মালয়েশিয়ার কথা বলে সেন্টমার্টিনে ‘পাচার’, গ্রেপ্তার ৫
মানব পাচার মামলায় নদীর জামিন দেয়নি হাইকোর্ট
লিবিয়ায় জিম্মি মাদারীপুরের ৯ যুবক

মন্তব্য

p
উপরে