করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই শেষ হয়ে গেল আরও একটি বছর। এই বছরেই পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ, পেয়েছে এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত ঘোষণা।
সব মিলিয়ে কেমন গেল ২০২১ সাল? কেমন ছিল অর্থনীতির হালচাল? ব্যবসা-বাণিজ্য চলেছে কেমন? কেমন যাবে নতুন বছর ২০২২? সামনে চ্যালেঞ্জগুলোই বা কী?
এসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন সরকারের নীতিনির্ধারক, অর্থনীতির গবেষক ও ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা।
মহামারির ধকল সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফেরায় স্বস্তির কথা শুনিয়েছেন তারা। প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রপ্তানি আয়। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় আছে দীর্ঘদিন ধরে। মূল্যস্ফীতি চোখ রাঙালেও এখনও সহনীয় পর্যায়েই আছে।
ভয় এখন শুধু করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে। এটাকে সামাল দেয়া গেলে আর পেছনে তাকাতে হবে না; দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ- এমনটাই মনে করেন সবাই।
২০২২ সাল হবে বাংলাদেশের বাঁক বদলের বছর; একটি বিশেষ বছর। নতুন উদ্যমে ৫০ বছরের সাহসী অর্জনকে সাক্ষী করে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করার বছর। এই বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প চালু হয়ে যাবে।
২০২২ সালে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে; চলবে ট্রেনও। একই সময় রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্রোরেল। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে ততদিনে। এই টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় একক অবকাঠামো প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ হয়ে যাবে এই বছরে; ২০২৩ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় ৩০ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীসহ আরও কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
ফলে ২০২৩ সালে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। তবে বাংলাদেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা এখনও রয়েই গেছে। ইতিবাচক খবরে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে সরকারকে বেশি নজর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
রাজনৈতিক স্থিতির সঙ্গে মহামারির খাদ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২১ সাল। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট: করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউকে সঙ্গী করে ২০২১ সালে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ওলটপালট হয়ে যায় সব হিসাব-নিকাশ। তবে বছরের শেষ দিকে এসে করোনার ধকল কাটিয়ে স্বাভাবিক গতিতে ফিরে বেশ মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
আর এ কারণেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) পূর্ভাবাস নিয়ে সব সময় ‘রক্ষণশীল’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আগের হিসাব থেকে সরে এসে বলেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন অবশ্য এই ঘুরে দাঁড়ানোর পুরো কৃতিত্ব দিয়েছেন এ দেশের তৃণমূলের অদম্য মানুষকে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অদ্ভুত এক অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। বিশেষ করে তৃণমূলের অদম্য মানুষগুলো কোনো কিছুতেই দমে যায় না। কোভিড-১৯ মোকাবিলা তারই প্রমাণ। সরকারের নীতিসহায়তায় অল্প সময়ের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটির মানুষ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমানও আশার কথা শুনিয়ে বলেছেন, নতুন বছর হবে সময়কে অতিক্রম করার, দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার বছর।
কিন্তু স্বস্তি নেই; আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। করোনার নতুন ধরনের ভয় নিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন বছর ২০২২।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ একটাই; ওমিক্রনের সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি। ওমিক্রন ভালোভাবে সামাল দিতে না পারলে অর্থনীতি ফের নাজুক অবস্থায় পড়ে যেতে পারে। সেই প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।’
তবে আশার কথা হলো, পৌনে দুই বছরের মহামারি যতটা বিপদে বাংলাদেশকে ফেলবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, সরকারের সময়োচিত বিভিন্ন পদক্ষেপে তা অনেক ক্ষেত্রে এড়ানো গেছে। দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিদায়ী বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই মহামারিতে পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সে কারণেই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ সবাই আমাদের প্রশংসা করছে। ২০২২ সাল থেকে শুরু হবে আমাদের নতুন পথচলা।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মহামারির মধ্যেও দেশের মানুষ ভালো আছে। ভালো আছে অর্থনীতি। নতুন বছরে আরও ভালো হবে।’
বছরজুড়ে রপ্তানির পালে হাওয়া
বিদায়ী বছরে অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল রপ্তানি খাত। মহামারির মধ্যেও বেড়ে চলেছে এই সূচক। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গতি আরও বেড়েছে। মূলত পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করেই বছরজুড়ে রপ্তানির পালে হাওয়া লেগেছিল।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) আর্থিক বছর ধরে রপ্তানি আয়ের তথ্য প্রকাশ করে। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে (২০২০ সালের ছয় মাস, জুলাই-ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের ছয় মাস, জানুয়ারি-জুন) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি (৩৮.৭৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকেই এসেছে ৮২ শতাংশের মতো।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের পাঁচ মাসের তথ্য পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে যদি ৪ বিলিয়ন ডলার আসে, তাহলে সব মিলিয়ে ২০২১ সালে মোট রপ্তানি আয় ৪৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে, যা হবে ক্যালেন্ডার বছরের হিসাবে এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশি।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি সহিদুল্লাহ আজিম নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘ভয় এখন আমাদের একটাই– ওমিক্রন। যদি এটা তেমন বাধা হয়ে না দেখা দেয়, তাহলে আগামী চার-পাঁচ বছর রপ্তানি আয়ের এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। কেননা, এখন আমরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি; দামও বেশ ভালো পাচ্ছি।’
আমদানিতেও জোয়ার বইছে
করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমার পর দেশে পণ্য আমদানির বন্যা বইতে শুরু করেছে। প্রতি মাসেই রেকর্ড হচ্ছে। গত অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরে চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, এই চার মাসে ২৫ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫২ শতাংশ বেশি।
ঋণপত্র বা এলসি খোলার ক্ষেত্রে আরও উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। প্রতি মাসেই রেকর্ড হচ্ছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে ৮১০ কোটি ৭০ লাখ (৮. ১০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিপুল অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা খরচ দেখা যায়নি।
এর আগে গত অক্টোবর মাসে ৭৪২ কোটি ১৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল; যা ছিল এক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন (৩ হাজার ৫৪২ কোটি ৯২ লাখ) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের একই সময়ে ২৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে দেশে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে গড়ে ৭ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে দেশে।
হোঁচটের পরও ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স
গত কয়েক মাস ধরে টানা কমলেও বিদায়ী বছরে ২ হাজার ২০০ কোটি (২২ বিলিয়ন) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাবে বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি।
এর আগে মহামারির মধ্যেও এক বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালে; ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসের ২৭ দিনে (১ থেকে ২৭ ডিসেম্বর) ১৪৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সব মিলিয়ে শেষ হতে যাওয়া ২০২১ সালে ২ হাজার ১৮৭ কোটি ১৮ লাখ (২১.৮৭ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, ডিসেম্বর মাসের শেষ চার দিনে (২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর) কমপক্ষে ২০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসবে দেশে। তা হলেই অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচকের অঙ্ক ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান বিনিময় হার (৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত (প্রায় ৬ মাস) ১ হাজার ৩ কোটি ৮০ লাখ (১০.০৩ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ১ হাজার ২৬৬ কোটি ৬০ লাখ (১২.৬৬ বিলিয়ন) ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই ছয় মাসে দেশে রেমিট্যান্স কমেছে ২০ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
তবে নতুন বছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মহামারির মধ্যে একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছিল। যার কাছে যা জমানো টাকা ছিল, পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে সব দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। করোনায় সব কিছু বন্ধ থাকায় অবৈধ পথে (হুন্ডি) কোনো রেমিট্যান্স আসেনি; সব এসেছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে। সে কারণেই গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
‘এরই মধ্যে একটি সুসংবাদ এসেছে। তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্রমিক যাবে সেখানে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। সেখান থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসবে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমার বিশ্বাস, জানুয়ারি থেকেই বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে।’
রাজস্ব আদায়ের গতিও ভালো
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১ লাখ ২৬৭ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি।
মূল্যস্ফীতি নিয়েই বড় উদ্বেগ
জানুয়ারিতে ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বছর শুরু হয়। পরের ছয় মাস কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে। গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। পরের পাঁচ মাস মূল্যস্ফীতি টানা বেড়েছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। করোনার ধকল কাটিয়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে মানুষের হাতে টাকা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় দেশেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম বেড়েছে। ফলে পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। করোনার কারণে কাজ হারানো মানুষও কাজ পেতে শুরু করেছেন। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছে।
অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতিই এখন বড় উদ্বেগ। বেশ কয়েক বছর ধরে এই সূচক সহনীয় ছিল। এটার লাগাম টেনে ধরাই এখন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি।’
জিডিপিতে হোঁচট
ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) অর্জন করা বাংলাদেশ করোনার ছোবলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে নেমে আসে। ২০২০২১ অর্থবছরে তা খানিকটা বেড়ে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশে উঠেছে বলে প্রাথমিক হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জোর দিয়ে বলছেন, ‘অর্থনীতি করোনার আগের আবস্থায় ফিরে আসছে। এবার লক্ষ্য অবশ্যই পূরণ হবে।’
বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আইএমএফ বলছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ । আর এডিবি বলছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ অর্জিত হবে।
মাথাপিছু আয় বেড়েছে
নতুন ভিত্তিবছরের (২০১৫-১৬) হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে; বেড়েছে ৩২৭ ডলার। ডলারের বর্তমান বাজার অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা।
তবে মনে রাখতে হবে, মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি রেমিট্যান্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়।
দুই অঙ্কের ঘরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি
তলানিতে নামার পর বেশ ভালোই গতিতে ফিরেছে দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ। টানা ছয় মাস ধরে বাড়তে বাড়তে দুই বছর পর নভেম্বরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট, ১০ শতাংশের ওপরে) ঘরে পৌঁছে করোনা মহামারির আগের অবস্থায় ফিরেছে।
নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি অক্টোবরের চেয়ে দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১০ দশমিক ১১ শতাংশে উঠেছে।
এর অর্থ হলো, গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে এই নভেম্বরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি ঋণ পেয়েছেন।
আগের মাস অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
করোনা মহামারির ধাক্কায় কমতে কমতে গত মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। এর পর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে নভেম্বরে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে।
তবে এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে রয়ে গেছে এই সূচক।
লেনদেন ভারসাম্যে বড় ঘাটতি
বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের চার মাসেই (জুলাই-অক্টোবর) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭৭ কোটি (৪.৭৭ বিলিয়ন) ডলার।
অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৩৬৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
আমদানি বাড়ায় আর রেমিট্যান্স কমায় এই ঘাটতি বলে জানিয়েছেন আহসান মনসুর।
বিদেশি ঋণে স্বস্তিতে সরকার
বিদেশি ঋণে স্বস্তিতে রয়েছে সরকার। গত দুই অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণসহায়তা পাচ্ছে সরকার। এতে করোনা মহামারিকালেও সরকারকে অর্থসংকটে পড়তে হয়নি।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাংলাদেশের অনুকূলে ৩০৮ কোটি ৯৫ লাখ (৩.০৯ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করেছে দাতারা। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) এই অর্থের পরিমাণ ২৬ হাজার ৫১২ কোটি টাকা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৯৯ কোটি ৭৯ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করেছিল দাতারা। এ হিসাবে এই চার মাসে বিদেশি ঋণসহায়তা বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।
সমৃদ্ধির স্বীকৃতি পাওয়ার বছর
ছয় বছর আগে থেকেই প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। ২০১৫ সালে প্রথম এই প্রত্যাশার পারদ ওপরে উঠতে শুরু করে। কিন্তু সে বছর তিনটি সূচকের মধ্যে একটিতে মান অর্জন করে বাংলাদেশ। অর্থাৎ আশায় গুড়ে বালি।
তিন বছর পর ২০১৮ সালে জাতিসংঘের পরবর্তী মূল্যায়নে তিনটি সূচকের সব কটিতেই মান অর্জন করে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক সুপারিশ পায় বাংলাদেশ। এরপর আরও তিন বছর কেটে যায়। অবশেষে ২০২১ সালের শুরুর দিকে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করে এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে। তারা ঠিক করে দেয়, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
গত নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশ সম্পর্কে সিডিপির সুপারিশ গ্রহণ করে। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বীকৃতি হলো এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার আরেক ধাপ উত্তরণ। আর্থসামাজিক অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে ২০২১ সালেই অন্যতম বড় স্বীকৃতি মিলল। এটি সমৃদ্ধির স্বীকৃতি।
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান কোথায় বা এই মুহূর্তে কোন কোন দেশের কাতারে আছে, তা দেখা যাক। সোজা কথায় উগান্ডা, কিরিবাতি, হাইতি, টুভালু, জিবুতি, গিনির মতো দেশের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয় বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে ২০২৬ সালে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের কাতারে থাকবে বাংলাদেশ।
আরেক সুখবর
বছরের শেষ দিকে এসে আরেকটা সুখবর পেল বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) বলেছে, অর্থনৈতিক বিকাশের চলতি ধারা বহাল থাকলে ২০৩৬ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৪তম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম।
সিইবিআর তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২২’ নামের এই প্রতিবেদনটি ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
এতে মূলত সামনের বছর এবং আগামী ১৫ বছরে বিশ্বের কোনো দেশের অর্থনীতি কী হারে বাড়বে, তারই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সিইবিআর প্রতি বছর এই রিপোর্ট প্রকাশ করে।
সংস্থাটি বলছে, ১৫ বছর পর ২০৩৬ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার আড়াই গুণের বেশি বেড়ে ৮৮৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার হবে। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৭৩ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বা জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার ৩২৫ বিলিয়ন ডলার।
প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করে সিইবিআর। এবার ১৯১টি দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরে তারা। এ বছর বাংলাদেশের বিষয়ে তারা বলছে, কোভিড-১৯ মহামারি সত্ত্বেও এ বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকুচিত হবে না।
সিইবিআর বলছে, চলতি বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ৪২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে হবে ৪১তম। আর অর্থনীতির এই গতিশীলতা ধরে রাখা গেলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ৩৪তম, ২০৩১ সালে ২৯তম এবং ২০৩৬ সালে হবে ২৪তম।
২০২২ থেকে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৯১টি দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই তালিকা প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
নতুন বছরে পরামর্শ
গত বছর এবং নতুন বছরকে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশের সার্বিক অর্থনীতি সামাল দেওয়া গেছে। কোভিডের কারণে অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। কিছুটা মচকে গেছে। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া আছে। অবশ্য বিশ্বজুড়েই এখন মূল্যস্ফীতি বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও চালের দাম চড়া। এর প্রভাব বাংলাদেশেও কিছুদিন থাকবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সব সময় খারাপ।
‘অন্যদিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে অসামঞ্জস্য আছে। আমদানি বেশি হচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ যা বেড়েছিল, তা থাকেনি। বিদেশে শ্রমিক কম যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতেও রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমতে পারে।
‘মুদ্রা বিনিময় হারে অসামঞ্জস্য আছে। ডলারের মূল্য ব্যাংকে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। আর খোলাবাজারে তা ৯১-৯২ টাকা। পার্থক্য অনেক বেশি। এতে ব্যাংক ব্যবস্থায় অর্থের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হতে পারে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজেট ব্যবস্থাপনা নিয়েও অস্বস্তিতে আছে সরকার। অবশ্য রাজস্ব আদায় কম হলে সরকার খরচ কমিয়ে সামাল দিতে পারে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি করোনার আগের পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু লক্ষ্য বেশি থাকায় এবারও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে রাজস্ব অর্জিত হবে না।
‘ফলে সরকারকে উন্নয়ন খরচ কমাতেই হবে, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। উন্নয়ন খরচ কমালে মানুষের কাছে টাকার প্রবাহ কমবে। এ ছাড়া সামনে ওমিক্রনের সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি আছে। ওমিক্রন ভালোভাবে সামাল দিতে না পারলে সামনে অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় পড়ে যেতে পারে। সেই প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।’
আরও পড়ুন:পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য বাড়াতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন করা হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তান থেকে যাতে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে আমদানি করতে পারি সেজন্য এ কমিশন করা হবে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশকিছু সমঝোতা স্বাক্ষর হবে বলে জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা উভয় পক্ষ খুব খোলামেলা আলোচনা করেছি। আমরা দুই দেশের বাণিজ্য বাড়াতে একমত হয়েছি। খাদ্য ও কৃষি উন্নয়নে আমরা কাজ করতে চাই। কিছু কিছু মধ্যবর্তী পণ্য যৌথভাবে উৎপাদনে যেতে পারলে উভয় দেশ উপকৃত হবে। খাদ্য ও কৃষি পণ্যে জোর দেওয়া হয়েছে। আমাদের ফল আমদানি ও রপ্তানি নিয়ে কথা হয়েছে। আমরা আনারস রপ্তানির কথা বলেছি। স্থানীয়ভাবে চিনি উৎপাদনে পাকিস্তানের সাহায্য চেয়েছি। তারা সব বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘এন্টি-ডাম্পিং বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর বাহিরেও আমাদের পাকিস্তান হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আমদানির ওপর এন্টি-ডাম্পিং ট্যাক্স আরোপ করেছিল আমরা সেটা সরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছি। তারা এটা রাখবে আশা করি। আমরা পাকিস্তান বাজারে ডিউটি ফ্রি ১ কোটি কেজি চা রপ্তানির কথা জানিয়েছি। পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী আরো তিনদিন থাকবেন, এটা নিয়ে আরো আলোচনা হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বেশকিছু সমঝোতা স্বাক্ষর হবে। এরমধ্যে জয়েন্ট ট্রেড কমিশন গঠন, কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি। এই ট্রেড কমিশন বন্ধ ছিল না। সেখানে কিছু আলোচনা হতো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দুই দেশের মধ্যে ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কমিশন করতে চাই। আমাদের দুই দেশে ব্যবসার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।’
পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ালে ভারতের সঙ্গে আরো বৈরিতা বাড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার কাজ হচ্ছে বাণিজ্যে সক্ষমতা তৈরি করা। এ বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করুন। এটা আমার কনসার্ন নয়। আমরা দেশের স্বার্থে কাজ করছি। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দেশের স্বার্থে অন্য যে যে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো প্রয়োজন হয় আমরা সেটা করব।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমার কাছে সবার আগে দেশের স্বার্থ। দেশের স্বার্থে আমাদের যা যা করণীয় সেটা আমরা করব। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে পাওনা-দেনা ছিল সেটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বাণিজ্যের কোনো বিষয় না। আর এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’
বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘প্রায় দেড় দশক বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্য ছিল না বললেই চলে। তারা আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছে। আমরাও বাণিজ্য বাড়াতে অসুবিধা দেখি না। আমাদের উভয় দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে এ বাণিজ্য বাড়ানো যায়। আমাদের উপদেষ্টা ধারণা দিয়েছেন পাকিস্থানে কি কি বিষয় রপ্তানি করতে পারে। আমরা পাকিস্তান থেকে বেশি আমদানি করি কিন্তু রপ্তানি করি কম। আমরা চাই এটা পরিবর্তন হোক। আমরাও যাতে বেশি রপ্তানি করতে পারি। এতে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।’
বাংলাদেশ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে কিনা এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সবার দিকে ঝুঁকছি।, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছি। ভারত থেকেও পেঁয়াজ আনছি। সর্বাগ্রে বাংলাদেশের স্বার্থ, যেখানে দেশের স্বার্থ আছে, সেখানেই ঝুঁকছি।’
বাণিজ্যসচিব মাহবুবর রহমান বলেন, ‘গত দেড় দশক পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য তেমন ছিল না বললেই চলে। খাদ্য ও পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য আমরা নানা দেশ থেকে আমদানি করি, প্রতিযোগিতা দরে পাকিস্তান থেকে এসব পণ্য আনা গেলে সমস্যা নেই। একই সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর গুরুত্ব দিয়েছি। বর্তমানে পাকিস্তান থেকে ইম্পোর্ট করি বেশি, রপ্তানি কম করি। আমরা রপ্তানি বাড়াতে পারলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। গত অর্থবছর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৭৮৭ মিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানে রপ্তানি করেছে ৭৮ মিলিয়ন ডলার।’
বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্থানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার, বাংলাদেশে পাকিস্থানের হাইকমিশনের রাজনৈতিক কাউন্সিলর কামরান ধাংগাল, বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক প্রতিনিধি জাইন আজিজ এবং বাণিজ্য সহকারী ওয়াকাস ইয়াসিন।
বাংলাদেশে সফররত পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান আজ রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) কার্যালয়ে চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।
সাক্ষাৎকালে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের দিক দিয়ে দুদেশের মানুষের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। আর পাকিস্তানের টেক্সটাইল ও বিশেষ করে জুয়েলারি পণ্য এদেশের মানুষের মাঝে বেশ চাহিদা রয়েছে।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়নে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য এদেশের বেসরকারি খাত সবসময়ই সরকারকে প্রস্তাব দিয়ে আসছে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ স্বাক্ষর হলে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত হবে।
তিনি বলেন, দুদেশের মধ্যে সরাসরি বিমান ও কার্গো যোগাযোগ চালু হলে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশই রপ্তানির ক্ষেত্রে তৈরি পোষাক এবং টেক্সটাইল খাতের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। দুদেশেরই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ইউরোপের দেশগুলোসহ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত পোশাকের নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে পুনঃব্যবহারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। যেখানে দুদেশের পোষাক খাতের উদ্যোক্তাদের মনোনিবেশ করা আবশ্যক। যার মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে দুদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়াতে একযোগে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও সিমেন্ট, চিনি, পাদুকা ও চামড়া প্রভৃতি খাতে পাকিস্তান বেশ ভালো করছে এবং বাংলাদেশ চাইলে পাকিস্তান থেকে এ পণ্যগুলো আমদানি করতে পারে। পাশাপাশি ঔষধ খাতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা পাকিস্তানের জন্য বেশ কার্যকর হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, দুদেশের কৃষি কাজ এবং পণ্যের উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি ও মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি করা গেলে এখাতে বৈশ্বিক বিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।
জাম কামাল খান জানান, পাকিস্তানের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে শিগগিরই বাংলাদেশে ‘সিঙ্গেল কান্ট্রি এক্সিবিশন’-এর আয়োজন করা হবে। যার মাধ্যমে দুদেশের বেসরকারি খাতের সম্পর্ক আরও জোরাদারের সুযোগ তৈরি হবে।
এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার, ডিসিসিআই জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা এবং পাকিস্তান হাইকমিশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ২৭ আগস্ট পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এর আগে গত ১৩ আগস্টের এক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হলেও ব্যাংকখাতের বর্তমান বাস্তবতায় কয়েকজন পরিচালক নতুন কোনো ব্যাংকের অনুমোদনের বিপক্ষে মত দেন।
২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনুমোদন পাওয়া নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি এবং কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি।
সূত্র জানায়, ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো বাংলাদেশে পুরোপুরি তৈরি হয়নি। একই সময়ে কয়েকটি প্রচলিত ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনেকেই নতুন লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন।
তবে পরিকল্পনা থেমে নেই। আগ্রহীদের কাছ থেকে নতুন ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদন চাওয়া হতে পারে শিগগির। ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আবেদন আহ্বান করে। তখন ৫২টি আবেদন জমা পড়ে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে ৯টি প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিচালনা পর্ষদের সভায়।
এর মধ্যে নগদ ও কড়ি ছাড়াও স্মার্ট ডিজিটাল ব্যাংক, নর্থ ইস্ট ডিজিটাল ব্যাংক এবং জাপান-বাংলা ডিজিটাল ব্যাংককে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওএল) দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিকাশ, ডিজি টেন এবং ডিজিটাল ব্যাংককে পৃথক লাইসেন্স না দিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিং উইং খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আবেদন বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগেরবার রাজনৈতিক বিবেচনায় যে প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, এবার তার চেয়ে অনেক স্বচ্ছ ও কঠোর মানদণ্ডে নতুন আবেদনগুলো যাচাই করা হবে।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশের ব্যাংক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত ‘ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট ২০২৪’-এ এসব তথ্য ওঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের শেষে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ১ বছরে তা ৪৪.২১ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক। আইএমএফের সংজ্ঞা অনুযায়ী, খেলাপি, পুনঃতফসিল এবং অবলোপনকৃত (রাইট-অফ) ঋণকে সম্মিলিতভাবে ‘দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা এবং রাইট-অফ করা ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও তদবিরের মাধ্যমে দেওয়া ঋণ এখন খেলাপিতে রূপ নিচ্ছে। আগে এসব তথ্য গোপন থাকলেও এখন আইএমএফের চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে এসব তথ্য প্রকাশ করছে।
প্রতিবেদনে আরও ওঠে এসেছে, ২০২৪ সালে দেশের ব্যাংক খাত চরম চাপের মুখে পড়ে, বিশেষ করে মূলধন পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে। সিআরএআর (ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েইটেড অ্যাসেট রেসিও) মাত্র ৩.০৮ শতাংশে নেমে আসে, যেখানে তা কমপক্ষে ১০ শতাংশ থাকার কথা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও বেশকিছু ইসলামী ব্যাংক।
মূলধন অনুপাত ও লিভারেজ অনুপাত যথাক্রমে ০.৩০ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গোটা ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাব স্পষ্ট করে।
তবে ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি এখনো তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। অ্যাডভান্স-ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) ৮১.৫৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, দেশের আর্থিক খাত সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও খেলাপি ঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ এবং সুশাসনের অভাব এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সময়োপযোগী নীতিমালা, কঠোর তদারকি এবং প্রযুক্তিনির্ভর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এই খাতকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
সীমান্ত ব্যাংক এবং এবিসি রিয়েল এস্টেট এর মধ্যে সম্প্রতি এবিসি রিয়েল এস্টেট এর প্রধান কার্যালয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় গ্রাহকেরা এবিসি রিয়েল এস্টেট এর ফ্ল্যাট ক্রয়ে সীমান্ত ব্যাংক এর হোমলোন ”সীমান্ত নিবাস” গ্রহনের ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত ইন্টারেস্ট রেট ও লোন প্রসেসিং ফি সুবিধা পাবেন ।
সীমান্ত ব্যাংকের হেড অব বিজনেস মোঃ শহিদুল ইসলাম এবং এবিসি রিয়েল এস্টেট এর পরিচালক সৌগত ঘোষ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে সাক্ষর করেন। এ সময় সীমান্ত ব্যাংকের রিটেইল অ্যাসেট ও লাইবিলিটি এর ইনচার্জ মোহাম্মদ মাসুদ সাজ্জাদ, এবিসি রিয়েল এস্টেট এর জেনারেল ম্যানেজার (সেলস) মোহাম্মদ জাকির হোসেন-সহ উভয় প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উভয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট পরিষেবা বিকাশে যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে বদ্ধ পরিকর।
পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি হিসেবে লিড প্লাটিনাম সনদ অর্জন করলো বাংলাদেশের সুপারব্র্যান্ড ও টেক জায়ান্ট ওয়ালটনের মোল্ড অ্যান্ড ডাই ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্স। টেকসই উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব অবস্থানের কারনে লিড সনদ প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। লিড সনদ অর্জনের মধ্য দিয়ে গ্রিন ফ্যাক্টরি স্থাপনায় ওয়ালটনের ঝুড়িতে যুক্ত হলো আরেকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
বুধবার (২০ আগস্ট, ২০২৫) রাজধানীতে ওয়ালটন করপোরেট অফিসে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লিড প্লাটিনাম সনদ গ্রহণ করেন ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি’র চেয়ারম্যান এস এম শামছুল আলম এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর এস এম মাহবুবুল আলম।
অনুষ্ঠানে ওয়ালটনের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণসহ লিড সনদ অর্জনের ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ৩৬০-ডিগ্রি টোটাল সলিউশন লিমিটেডের আন্তর্জাতিক গ্রিন বিল্ডিং বিশেষজ্ঞ অনন্ত আহমেদ ও অন্য কর্মকর্তাগণ।
লিড সনদ অর্জনের প্রতিক্রিয়ায় ওয়ালটন হাই-টেকের চেয়ারম্যান এস এম শামছুল আলম বলেন, পরিবেশবান্ধ কারখানার স্বীকৃতি হিসেবে ওয়ালটন মোল্ড অ্যান্ড ডাই কারখানা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ লিড প্লাটিনাম সনদ অর্জন করায় ওয়ালটন পরিবার অত্যন্ত আনন্দিত। আমরা চাই- ভবিষ্যত প্রজম্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে। সেজন্য কারখানা থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সর্বত্র টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন ও গ্রিন ফ্যাক্টরি স্থাপনে লিড সনদ ওয়ালটনকে আরো বেশি উৎসাহিত করবে।
মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশবান্ধব লিড সনদ অর্জনে কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করায় ৩৬০-ডিগ্রি টোটাল সলিউশনকে ধন্যবাদ জানান ওয়ালটন হাই-টেকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এস এম মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, পরিবেশ সুরক্ষায় ওয়ালটন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার লক্ষ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে ওয়ালটন কারখানায় পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন গ্রিন প্রকল্প ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে জিরো কার্বন নিঃসরণ, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানির ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গ্রিন স্ট্রাকচারাল ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে। রুফটপ সোলার পাওয়ার প্রজেক্ট, ফ্লোটিং বা ভাসমান সোলার পাওয়ার প্রজেক্ট, রেইন ওয়াটার বা বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও পুনঃব্যবহার নিশ্চিত, অ্যাডভান্সড ভেন্টিলেশন সিস্টেম, প্লাস্টিক ও মেটাল রিসাইক্লিং ইত্যাদি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষায় ওয়ালটনের এসব গ্রিন ইনিশিয়েটিভ অব্যাহত থাকবে।
আন্তর্জাতিক গ্রিন বিল্ডিং বিশেষজ্ঞ অনন্ত আহমেদ জানান, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পখাতে ওয়ালটনই প্রথম বিশ্বব্যাপী মর্যাদাপূর্ন লিড প্লাটিনাম সনদ অর্জন করেছে। এই সনদ একটি বিল্ডিং বা প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব এবং কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করে। এর মাধ্যমে একটি বিল্ডিং কতটুকু পরিবেশ-বান্ধব, তা বোঝা যায়। লিড সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে শক্তি ও পানির ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণ, উপকরণ নির্বাচন এবং অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত গুণমানসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হয়। এসব বিষয়ে কোন বিল্ডিং বা প্রকল্প কত স্কোর করে, তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের লিড সার্টিফিকেশন প্রদান করা হয়। ওয়ালটনের মোল্ড অ্যান্ড ডাই ফ্যাক্টরি সর্বোচ্চ স্কোর পাওয়ায় লিড প্লাটিনাম সনদ অর্জন করেছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক টেকসই মানদন্ড অনুসরণে ৩ লাখ ৭৬ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে গ্রিন স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে মোল্ড অ্যান্ড ডাই কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। কারখানায় বৈদ্যুতিক আলোর চেয়ে দিনের আলোর পর্যাপ্ত ব্যবহারের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে ২.১ মেগাওয়াটের রুফটপ সোলার পাওয়ার পয়েন্ট। ওয়ালটন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরি করছে, তার চেয়েও কম পরিমাণ বিদ্যুৎ কারখানায় ব্যবহার করছে। এছাড়া কারখানার আভ্যন্তরীণ পরিবেশ ও বাতাসকে আরামদায়ক রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যাডভান্সড ভেন্টিলেশন সিস্টেম। বৃষ্টির পানি ব্যবহার ও পুণঃব্যবহারেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
এনআরবিসি ব্যাংকের ১২তম বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় গত বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন, লভ্যাংশ, ২০২৫ সালের জন্য নিরীক্ষক নিয়োগ ও তাদের সম্মানী অনুমোদন করা হয়। ২১ আগস্ট, ২০২৫, বৃহস্পতিবার, কুর্মিটোলা গল্ফ ক্লাবে ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান মো. আলী হোসেন প্রধানিয়ার সভাপতিত্বে হাইব্রিড পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত সভায় স্বশরীর ও অনলাইন প্লাটফর্মে স্বতন্ত্র পরিচালক, উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডারবৃন্দ অংশ নেন।
সভায় স্বতন্ত্র পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ, এফসিএ, স্বতন্ত্র পরিচালক ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান মো. নুরুল হক, স্বতন্ত্র পরিচালক মো. আবুল বশর, মো. আনোয়ার হোসেন ও ব্যারিস্টার মো: শফিকুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. মো. তৌহিদুল আলম খান, ডিএমডি ও সিএফও হারুনুর রশীদ এবং কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আহসান হাবিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় শেয়ারহোল্ডারদের অনলাইন প্লাটফর্মে প্রদত্ত সর্বোচ্চ ভোটের মাধ্যমে ৪ টি এজেন্ডা পাস করা হয়। এছাড়া অনলাইন এবং সশরীরে উপস্থিত বিনিয়োকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া।
এজিএমে অংশগ্রহণকারী সকল স্বতন্ত্র পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার, গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চেয়ারম্যান মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, আমানতকারী ও সাধারন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় এনআরবিসি ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমরা ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার মাধ্যমে নতুন পরিচালনা পর্ষদ আমনতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও শেয়ারহোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। তিনি আরও বলেন, ঋণশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ব্যাংকের গুণগত সম্পদ ও মুনাফা বৃদ্ধি করাই এই পর্ষদের লক্ষ্য। এক্ষেত্রে, তিনি সবাইকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ, এফসিএ, বলেন, ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার কারণে আমানতের পরিমান ২০ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক অতিক্রম করেছে। সুবিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে টেকসই ব্যবসায়িক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা সফল হলে শেয়ারহোল্ডারগণ তাদের বিনিয়োগের কাঙ্খিত সুফল পাবেন বলে আমরা আশাবাদী।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ড. মো. তৌহিদুল আলম খান বলেন, আমানতকারী ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এনআরবিসি ব্যাংকের প্রাণশক্তি। আমরা দক্ষ পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্বে ব্যাংকের স্বার্থ সংরক্ষণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কমপ্লায়েন্স, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে চাই।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে যাত্রা করা এনআরবিসি ব্যাংক পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয় ২০২১ সালে। বর্তমানে সারাদেশে ব্যাংকটির ১০৯টি শাখা এবং ৪১৫টি উপশাখার মাধ্যমে প্রথাগত ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি শরীয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং সেবাও প্রদান করছে।
মন্তব্য