সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার জয়াখালী গ্রামের ৪০ বছর বয়সী রহিমা বেগম প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া, সঙ্গে রক্তস্রাব ও সাদাস্রাবে ভুগছিলেন। মাস সাতেক আগে চিকিৎসার জন্য যান উপজেলা সদরে ডা. সুজিত রায়ের কাছে। তিনি সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার; কিন্তু নিয়মিত রোগী দেখেন বেসরকারি চেম্বারে আর চুক্তিতে অস্ত্রোপচার করেন স্থানীয় ‘সুন্দরবন অ্যাপোলো হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এ। রোগীর অবস্থা দেখে-শুনে ওই দিনই তিনি জানিয়ে দেন, রহিমার একটি অঙ্গ অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে।
দুশ্চিন্তায় পড়ে যান রহিমা। পরে আরেক ক্লিনিকে গিয়ে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে তার ওষুধ খেয়ে কিছুদিন ভালো থাকেন। কিন্তু করোনাকালের নানা সমস্যায় পড়ে সেই ডাক্তারের কাছে আর যেতে না পেরে আবারও যান ডা. সুজিতের কাছে।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর রহিমা বেগম বলেন, ‘ডাক্তার তখন বেশ রাগ করেন- কেন আমি তার পরামর্শমতো অপারেশন করাইনি।’
ডাক্তারের ধমক খেয়ে স্বামীকে নিয়ে রহিমা এবার গেলেন এলাকার ‘বড় ডাক্তার’ বলে পরিচিত সুন্দরবন অ্যাপোলো ক্লিনিকেরই মালিক মো. শাহজাহান সিরাজের কাছে। সব শুনে তিনিও বলে দেন, অপারেশনই একমাত্র সমাধান। কিন্তু মন সায় দেয় না কিছুতে। আরও যাচাইয়ের জন্য স্বামী-স্ত্রী গেলেন অ্যাপোলো হাসপাতালেরই ডা. শেখ আরাফাতের কাছে। তিনি আবার রহিমাকে কিছু ওষুধ লিখে দিলেন।
এভাবে চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে শেষমেশ এই দম্পতি ‘এলাকার ছেলে শাহজাহান ডাক্তার’-এর ওপর ভরসা করে অপারেশনেই রাজি হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন অ্যাপোলোর ওটিতে ডা. সুজিত রায় নিজ হাতে অপারেশন করে রহিমার দেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ কেটে ফেলে দেন।
আরেক ঘটনা শ্যামনগরেরই কৈখালী গ্রামের খাদিজা বেগমের। উপকূলবাসী এই নারীর সমস্যা ছিল অনিয়মিত পিরিয়ড এবং তলপেটে ব্যথা। চিকিৎসার জন্য স্থানীয় এমআরএ ক্লিনিকে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক ডা. আনিছুর রহমানকে দেখাতে গেলে তিনিও খাদিজার একটি অঙ্গ ফেলে দেয়ার পরামর্শ দেন। গত ২৮ আগস্ট ওই বেসরকারি ক্লিনিকের ওটিতে নিয়ে ৩২ বছর বয়সী খাদিজা বেগমের শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি কেটে বাদ দেন সরকারি চিকিৎসক আনিছুর রহমান।
এই দুই বয়সের দুই নারীর দেহ থেকে যে অঙ্গটি অবলীলায় কেটে ফেলা হলো, সেটি সাধারণ অঙ্গ নয়; মানুষ যেখানে জন্ম নেয় সেই মাতৃগর্ভ; যাকে বলা হয় জরায়ু। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মতো উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নোনা পানির আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। সারাটা বছর তাদেরকে নোনা পানির সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হচ্ছে; বিশেষ করে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে। কিন্তু মানবপ্রজাতির বংশবৃদ্ধির জন্য সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি রোগাক্রান্ত হলে কোনো রকম চিকিৎসার উদ্যোগ না নিয়ে সরাসরি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন এ অঞ্চলের এক শ্রেণির চিকিৎসক।
শ্যামনগরে গত ৬ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ১৫ দিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত ‘টাকার লোভে’ চিকিৎসক আর তাদের সহযোগী হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকেরা এমন কাজ করে চলেছেন। বিশিষ্ট নাগরিক ও আইন বিশেষজ্ঞরা একে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ বলে অভিহিত করেছেন।
উপকূলের নারীরা একদিকে নোনা পানির প্রভাবে চর্ম ও জরায়ুসংক্রান্ত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন; অন্যদিকে আবার সেই রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অকালে জরায়ু খুইয়ে সন্তানধারণের ক্ষমতা হারাচ্ছেন। এখানেই শেষ হচ্ছে না তাদের দুর্বিষহ জীবনগাথা; এরপর শুরু হচ্ছে নানামুখী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ানক যন্ত্রণা, যা বাকি জীবন একাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই নারীদের।
সরেজমিন অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, রহিমা-খাদিজা-ফিরোজার মতো নানা বয়সী নারীরা অহরহ শিকার হচ্ছেন এ রকম ‘অপচিকিৎসা’র। চিকিৎসাশাস্ত্রে জরায়ু অপসারণকে বলা হয় হিস্টেরেক্টমি। এই অপারেশন করা হয়েছে- এমন অন্তত ৭৫ জন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের সবার বেলায়ই সংশ্লিষ্ট ‘ডাক্তার’ অন্য কোনো চিকিৎসা না দিয়ে সরাসরি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হিস্টেরেক্টমির বা জরায়ু কেটে ফেলার।
ধর মুরগি, কর জবাই!
অনুসন্ধানে এমন সব ঘটনার কথা জানা যায়, সেগুলো যেন চিকিৎসার নামে ‘ধর মুরগি, কর জবাই’। বছর চারেক আগের ঘটনা। খাদিজার মতো লক্ষণ নিয়ে গ্রাম্য ডাক্তারের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান শ্যামনগরের বৈশখালী গ্রামের ফিরোজা বেগম। জরায়ুতে ‘ঘা হয়েছে’ জানিয়ে তা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট। পরে রিপোর্ট দেখে গ্রাম্য ডাক্তারও একই পরামর্শ দেন। দিশেহারা ফিরোজা তখন এক দালালের মাধ্যমে গিয়ে ভর্তি হন উপজেলা সদরের সেবা ক্লিনিকে। সেখানে এক রাতে কলে এসে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. কবিরুল ইসলাম কবির নিজের হাতে মাত্র ২৬ বছর বয়সী মেয়েটির জরায়ু কেটে ফেলে দেন।
ফিরোজা ও তার স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, ডাক্তার কবির এই রোগীকে কখনও দেখেনইনি। প্রথমে ক্লিনিকের পক্ষ থেকে কয়েকটি টেস্ট করানো হয়। পরে ক্লিনিকে এসে সেই রিপোর্ট দেখেই ফিরোজাকে অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দেন ডা. কবির।
জানা গেল, একই গ্রাম্য ডাক্তারের পরামর্শে ওই সেবা ক্লিনিকেই সেই কবির ডাক্তারের কাছে গিয়ে ফিরোজার বাড়ির আরেক নারী রোমেছা বেগমও (৩৫) জরায়ু অপসারণ করান কয়েক বছর আগে।
জানতে চাইলে গত ৬ ডিসেম্বর ডা. কবিরুল ইসলাম কবির অকপটে স্বীকার করেন ‘ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় রোগী বা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই’ অপারেশন করার কথা।
তিনি বলেন, ‘শুধু আমি একা না, প্রতিটি সার্জনই এই রকম পরিস্থিতির শিকার হন। আমরা তো সাতক্ষীরা থেকে সপ্তাহে একদিন অ্যানেসথেশিয়া টিম নিয়ে শ্যামনগরে যাই। আমার হয়তো ৫-৭টা অপারেশন থাকে। এর মধ্যে হয়তো ২-১টা রোগী আমার দেখা থাকে না।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, প্রয়োজনে জরায়ু কেটে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত ডাক্তাররা নিতেই পারেন; কিন্তু তার আগে কয়েকটি ধাপে রোগীর চিকিৎসা করাতে হবে।
হিস্টেরেক্টমি করা হয়েছে- শ্যামনগরের এমন অন্তত ১০ জন রোগীর চিকিৎসাপত্র ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ঢাকার তিনজন এবং ময়মনসিংহ মেডিকেলের দুইজন গাইনি বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়। ১০ জনের ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞরা মত দেন, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই হিস্টেরেক্টমির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখনই হিস্টেরেক্টমি করে ফেলার মতো লক্ষণ কোনো রোগীরই ছিল না। বরং আরও কিছুদিন চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের অসুখটা সারানো যেত।
অথচ অনুসন্ধানকালে ওই ১০ জন রোগীর সবাই বলেছেন, ডাক্তারের কাছে গেলে তাদের কাউকেই ওষুধপত্রের মাধ্যমে চিকিৎসার কথা বলা হয়নি; বরং তাদের অসুখ অনিরাময়যোগ্য- এমনটি বুঝিয়ে জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারপর তারা সেই ডাক্তার অথবা দালালদের দেখানো ক্লিনিকে গিয়ে অপারেশন করিয়ে নিয়েছেন। শ্যামনগরে ১৩টির মধ্যে সাতটি ক্লিনিকেই খোঁজ নিয়ে এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরায়ু ফেলতে আসা প্রতিটি রোগীকেই তারা অপারেশন করেছেন, কাউকেই ফেরাননি।
শ্যামনগরের খাদিজা বেগমের আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন ডা. ইশরাত জাহান স্বর্ণার কাছে মেইল পাঠিয়ে তাকে জানানো হয়, স্থানীয় চিকিৎসক এই রোগীর জরায়ু কেটে ফেলতে বলেছেন। রোগী সেটা করবেন কি না, পরামর্শ চাইছেন। ডা. স্বর্ণা রিপোর্ট দেখে গত ১৩ অক্টোবর বলেন, ‘রিপোর্টে যে টার্ম ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি। খাদিজার রোগের ইতিহাস পিআইডির (পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ) লক্ষণের সঙ্গে কিছুটা মিললেও, সেটা একিউট কন্ডিশনের নয়। আর এমন রোগীর জরায়ু কেটে ফেলা কোনোভাবেই উচিত নয়।’
পরে ডা. স্বর্ণাকে যখন জানানো হয় যে, স্থানীয় ডাক্তাররা ইতোমধ্যে খাদিজার জরায়ু কেটে বাদ দিয়েছেন এবং ক্লিনিকের ছাড়পত্রে তার অসুখের নাম বলা হয়েছে পিআইডি, তখন তিনি বলেন, ‘পিআইডি যদি একিউট কন্ডিশনে থাকে অর্থাৎ রোগীর সবগুলো সিম্পটম যদি অতি তীব্র হয়, তাহলে গাইনি রোগ সংক্রান্ত জাতীয় গাইডলাইন অনুযায়ী ওষুধের মাধ্যমেও চিকিৎসা আছে। এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে একিউট লেভেলের পিআইডি ভালো হয়ে যায়। তবে ওষুধের সঙ্গে রোগীকে কিছু নিয়ম মানতে হয়।’
আবার ক্রনিক কন্ডিশনের ক্ষেত্রেও ওষুধের রেজিম আছে। তারপরেও যদি রোগী ভালো না হয়, তখন হিস্টেরেক্টমির (জরায়ু কেটে ফেলা) অপশন আসে। তবে সেক্ষেত্রেও কিছু প্রটোকল রয়েছে- বলেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ডা. স্বর্ণা বলেন, ‘আমাদের গাইডলাইনে পিআইডির ক্ষেত্রে হিস্টেরেক্টমি করার কথা বলা আছে তবে সেটাও অনেক জাজমেন্টের পরে। পিআইডির লক্ষণ পেলাম আর হিস্টেরেক্টমি করলাম, সেটা ঠিক নয়।’
তার মতে, ‘জরায়ু কাটার ক্ষেত্রে রোগীর বয়স বড় বিবেচ্য বিষয়। ৪৫ বছরের নিচে কোনো নারীর জরায়ু ও ওভারি কেটে ফেললে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ।’
একইভাবে রহিমা বেগমের অস্ত্রোপচারপূর্ব রিপোর্ট ময়মনসিংহ মেডিক্যালেরই আরেক চিকিৎসককে পাঠিয়ে তার হিস্টেরেক্টমি জরুরি কি না, জানতে চাওয়া হয়। রহিমার রোগের পুরো হিস্ট্রি জেনে তিনি বলেন, ‘কোনোভাবেই নয়। তবে রোগীর সার্ভিক্যাল ক্যান্সার আছে কি না জানতে ভিআইএ (Visual Inspection of the cervix with Acetic acid) পরীক্ষা ও চিকিৎসা শুরু করা দরকার।’
পরে প্রকৃত ঘটনা জানানো হলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘এই রোগীর জরায়ু কেটে ফেলা উচিত হয়নি।’ তবে তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
রহিমা বেগমের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, অপারেশনের আগে তার রক্তের গ্রুপ, আল্ট্রাসনোগ্রাম, হিমোগ্লোবিন, আরবিএস, ক্রিটিনিন, এইচবিএসএজি-আইসিটি পরীক্ষা করা হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জরায়ু অপসারণের আগে এগুলোর সঙ্গে সিবিসি, ইউআরই, ইসিজি, পেলভিক অর্গানের আল্ট্রাসনোগ্রাম, টিভিএস, ভিআইএ পরীক্ষা করাতেই হবে। আর হিমোগ্লোবিন কমপক্ষে ১১ না থাকলে জরায়ু অপারেশন না করাই ভালো। কারণ, এই অপারেশনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তবে খুব জরুরি হলে রক্তের ব্যবস্থা রেখে অপারেশন করা যেতে পারে।
জানা গেল, রহিমা বেগমের রক্তে হিমোগ্লোবিন ছিল ৮.৪। অপারেশনের সময় পাঁচ ব্যাগ রক্ত লেগেছে তার। আগের আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে এবং হাসপাতালের ছাড়পত্রে দুই জায়গাতেই তার অসুখের নাম বলা হয়েছে, মাইল্ড বাল্কি ইউটেরাস (ঈষৎ ভারী জরায়ু)।
দেশের উপকূলীয় এলাকায় দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে সুইডেনে আছেন গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. তাসনুভা আফরিন। অনলাইনে রহিমার নথিপত্র পাঠালে সব দেখে তিনি মন্তব্য করেন, ‘জরায়ু কাটার সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে রোগীর টিভিএস (ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড) এবং ভিআইএ টেস্ট অবশ্যই করাতে হবে। তার জরায়ু ভারী বলছে কেন, সেটা জানতে হবে। সেটা কোনো টিউমার কি না, টিভিএস ছাড়া বোঝা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘রক্তক্ষরণ, ব্যথা, টিউমারের মতো জরায়ুর যেকোনো সমস্যায় দীর্ঘ সময় ধরে ভুগলে হিস্টেরেক্টমি করা যায়। কিন্তু এসব সমস্যার সবগুলোরই ওষুধে চিকিৎসা আছে এবং সেটা করে দেখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পুরো জরায়ু না কেটে আক্রান্ত স্থানটুকু শুধু অপারেশন করে বাদ দেয়া যায়।
‘তবে ওষুধে কোনোভাবেই কাজ না হলে অথবা জরায়ু ক্যান্সারে রূপ নিতে যাচ্ছে- এমন অবস্থা হলে হিস্টেরেক্টমি করা যায়। তবু তার আগে কমপক্ষে টিভিএস এবং ভিআইএ পরীক্ষা করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কোনো ক্লিনিকেই এই চর্চা নেই।’
জানতে চাইলে অবস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি (ওজিএসবি), বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বেগম বলেন, ‘পিআইডির কিংবা জরায়ুর যেকোনো ধরনের সংক্রমণের তীব্রতার মাত্রা আছে। পিআইডি একজন কিশোরীরও থাকতে পারে। তাই শুধু একটা আল্ট্রাসোনো করেই জরায়ু কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।’
টাকার লোভেই অমানবিকতা!
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল বললেন, ‘দুই বছর আগে এখানে এসে দেখেছি, ২২-২৩ বছর বয়সী মেয়েদের জরায়ু কেটে ফেলেছে। খুব খারাপ লাগতো। অনেক দিন ধরে ব্লিডিং হওয়া মানে জরায়ু কেটে ফেলতে হবে, এটা ঠিক না- এই কথাটা তাদেরকে বলার কেউ ছিল না।’
তিনি বলেন, “পিল অনিয়মিত খাওয়ার কারণে হরমোনাল ইমব্যালেন্সে মাসিক অনিয়মিত হয়ে গেছে- এমন লক্ষণ নিয়ে রোগী কোনো সার্জনের কাছে গেলে, জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আবার অল্প বয়সে বিয়ে হয় বলে কম বয়সেই এখানকার মেয়েদের একাধিক সন্তান হয়। তখন ‘ফ্যামিলি কমপ্লিট’ যুক্তি দেখিয়ে জরায়ু কেটে ফেলেন অনেক সার্জন বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।”
কেন এমন অবলীলায় জরায়ু কেটে ফেলছেন- সে প্রশ্নের জবাব কেউ সরাসরি দিতে চান না। তবে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, এর নেপথ্যে রয়েছে টাকার লোভ। জরায়ু অপারেশন বাবদ রহিমা বেগমকে সুন্দরবন অ্যাপোলো হসপিটালে পরিশোধ করতে হয়েছে ১২ হাজার টাকা। ওষুধপত্র কেনার খরচ আলাদা। সব মিলিয়ে এই অপারেশন বাবদ তার প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
আর খাদিজার স্বামী মো. ইব্রাহিম জানান, স্ত্রীর জরায়ু অপারেশনের পর থেকে এ পর্যন্ত তার ৪২ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এর মধ্যে এমআরএ ক্লিনিককে দিতে হয়েছে ১২ হাজার টাকা; সেখানে ১১ দিন থাকাকালে ওষুধ কিনতে হয়েছে ১১ হাজার টাকার। এখনও ওষুধপত্র লাগছেই।
শ্যামনগরের মতো উপকূলীয় এলাকার বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালগুলো আয়ের জন্য যে অস্ত্রোপচারের দিকেই তাকিয়ে থাকে, তার সাক্ষ্য মেলে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াতের কথায়। তিনি বলেন, ক্লিনিকগুলো আসলে বাণিজ্যিক কারণেই বানানো হয়ে থাকে। তাদের সিংহভাগ আয় আসে গাইনি ও অবস্টেটিকস থেকে।
তিনি বলেন, ‘এর আগে ক্লিনিক মালিকদের সঙ্গে একটি মিটিংয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে আমি বলেছিলাম, আপনারা সিজারের রোগীদেরকে সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবেন। তখন তারা প্রায় সমস্বরে বলে ওঠেন, তাহলে অর্ধেকের বেশি ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাবে।’
বিভিন্ন ক্লিনিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জরায়ু অপারেশনপ্রতি ডাক্তারদেরকে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়।
সিভিল সার্জনের হিসাবে- শ্যামনগরে নিবন্ধিত ও নিবন্ধনের জন্য আবেদনকারী ক্লিনিক-ডায়গনস্টিক সেন্টার রয়েছে ৯টি আর শুধু ডায়গনস্টিক সেন্টার আছে পাঁচটি। তবে এলাকা ঘুরে এবং বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর বাইরেও আরও অনেক ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। নিবন্ধিত হোক আর অনিবন্ধিত হোক, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসেবার মানে রয়েছে যথেষ্ট ঘাটতি।
নগর প্রাইভেট হাসপাতালের কর্ণধার হাফিজুর রহমান জানান, তার ক্লিনিকটিতে মাসে ৩০-৩৫টি অপারেশন করা হয়। এর মধ্যে জরায়ু অপারেশন হয় ২-৩টি।
সুন্দরবন অ্যাপোলা হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা যামিনী রায় জানান, গত ১৭ জানুয়ারি থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে ১২ জনের হিস্টেরেক্টমি করা হয়েছে। আর শুধু অক্টোবর মাসে অপারেশন হয়েছে মোট ৭৯ জনের, এর মধ্যে জরায়ু কাটার অপারেশন তিনটি।
রহিমা ও খাদিজার খরচের হিসাবকে গড় ধরলে গত ১৭ জানুয়ারি থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবন অ্যাপোলা হসপিটাল শুধু জরায়ু অপসারণ করেই প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করেছে। এর সঙ্গে রোগীদের নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেও তাদের আয় যথেষ্ট। করোনা মহামারি না থাকলে এই আয় যে আরও অনেক বেশি হতো, তা ক্লিনিকগুলোর কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন।
নগর প্রাইভেট হাসপাতালের কর্ণধার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০২০ সালে মাত্র ৪০ জন রোগীর হিস্টেরেক্টমি করানো হয়। করোনার কারণে গত বছর থেকে শুধু সিজারের মতো জরুরি অপারেশনগুলোই বেশি করা হয়।’
অথচ সঠিক চিকিৎসা দিলে যে এসব রোগী জরায়ু কাটার অভিশাপ থেকে রেহাই পেতেন, সে উদাহরণও উঠে আসে অনুসন্ধানে। বেশ কিছুদিন ধরে অনিয়মিত রক্তপাত আর তলপেটে ব্যথায় ভুগতে থাকা মাজেদা বেগম মর্জিনার (৩৫) একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম করানোর পর জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দেন একজন গ্রাম্য ডাক্তার। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন মর্জিনা। যোগাযোগ হয়েছিল একটি ক্লিনিকের দালালের সঙ্গেও। এরই মাঝে এক স্বজনের পরামর্শে শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে যান তিনি। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেখানকার একজন চিকিৎসক মর্জিনাকে ১৫ দিনের ওষুধ দেন এবং বলে দেন যে, কোনো অবস্থাতেই তার জরায়ু অপসারণের দরকার নেই।
গত ২৩ নভেম্বর যোগাযোগ করা হলে মর্জিনা এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি এখন ভালো আছেন।
আরেক ভালো দৃষ্টান্ত মেলে শ্যামনগরের বিদেশি সহায়তায় পরিচালিত ‘ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’-এ। ২০২০ সালে জরায়ুর অসুখের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে প্রায় ৪০০ নারীর ভিআইএ করা হয়। এদের মধ্যে ৬৭ জনের ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি পাওয়া যায়। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তাদের খুলনা ও ঢাকায় রেফার করা হয়। বাকি সবাইকে ওষুধপত্রের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়েই ভালো রাখা হয়। কারও জরায়ু কেটে ফেলতে হয়নি।
এসব ঘটনার কথা জানালে মানবাধিকার-কর্মী ও আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ‘নারীকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছে এই জরায়ু। অথচ সামান্য কটা টাকার লোভে অসাধু ডাক্তার-ক্লিনিক-হাসপাতাল চক্র কোনো রকম চিকিৎসা-উদ্যোগ ছাড়াই নারীদের জরায়ু কেটে চলেছে, যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। যারা এসব করছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।’
বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে অযথা অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলা হলে সেটি একজন নারীর জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি; নারীত্বের জন্য চরম দুর্ঘটনা। দেশের বিভিন্ন উপজেলা বা গ্রামাঞ্চলে গজিয়ে ওঠা শত শত ক্লিনিকের কিছু কিছু চিকিৎসক আছেন, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করেন; আবার অনেকের অবহেলাও রয়েছে। এসব ডাক্তারের বিরুদ্ধে বিএমডিসিতে (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) আবেদন করে লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা করা যতে পারে; আবার ফৌজদারি মামলাও করা যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারও রাখেন। কিন্তু সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষ এত কিছু জানেন না। আবার এতো প্রতিকূলতার মধ্যে আইনি যুদ্ধ করার শক্তিও তাদের নেই। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থা বা সামাজিক সংগঠনগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।’
অযাচিতভাবে জরায়ু কেটে ফেলা মানবাধিকার লঙ্ঘন মন্তব্য করে এই আইনজ্ঞ বলেন, ‘একজন নারীর জরায়ু যদি সেরকম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে অপসারণের প্রয়োজন না হয়; তাহলে বেঁচে থাকার অধিকারের মতোই নারীর অধিকার আছে তার জরায়ু সংরক্ষণ করার।’
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দুর্বিষহ জীবন
জরায়ু কাটলেই যে নারীরা ভালো থাকছেন, তাও নয়। কথা বলে জানা যায়, নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গত ৪ নভেম্বর দুই সন্তানের মা খাদিজা বেগম বলেন, ‘আগে তো মাসের কিছুদিন শুধু পেটে ব্যথা করতো। অপারেশনের পর এখন সারাক্ষণ গা দিয়ে দাহ ওঠে। কাটা জায়গায় জ্বালা-যন্ত্রণা করে। মনে হয়, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি, তাহলে একটু আরাম পাব।’
জরায়ু অপারেশনের পর থেকেই প্রচণ্ড রকম মাথা ও শরীর জ্বালায় ভুগছেন বলে জানান ৩০ বছর বয়সী ফিরোজা বেগম। এমনকি স্বামীর সঙ্গও ভালো লাগে না। সংসারেও অশান্তি লেগে থাকে সারাক্ষণ। সংসার টেকানো দায় হয়ে গেছে।
ফিরোজা বলেন, ‘এমন সমস্যা হবে জানলে আমি অপারেশন করতামই না।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যালের ডা. ইশরাত জাহান স্বর্ণা বলেন, ‘মেয়েদের শরীরে আলাদা হরমোন আছে, যা দিয়ে মাসিক চক্র, মেজাজ, স্মৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু জরায়ু কেটে ফেললে এসব হরমোনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। জরায়ুর সঙ্গে আবার ওভারি কেটে ফেললে এসব হরমোনের সোর্স নষ্ট হয়ে যায়।
‘ফলে একজন অল্পবয়সী রোগী যার মেনোপেজ হওয়ার কথা ছিল না, তার জরায়ু ও ওভারি কেটে ফেললে ভয়াবহ সব সিম্পটম হবে। তার তীব্র গরম লাগবে, মনে হবে মরে যাচ্ছে। তার ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হবে অর্থাৎ মাসিকের রাস্তা শুকনো হয়ে যাবে, ফলে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারবে না; কষ্ট হবে। তার হাড় ক্ষয়ে যেতে থাকে। সার্বিক ভালোলাগা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে বলা হয়, হিস্টেরেক্টমি ডিম্বাশয়ের রক্ত সরবরাহ এবং কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল বলেন, ‘অল্প বয়সে জরায়ু কেটে ফেললে নারীদের হট ফ্লাস (হাত-পা ও শরীর জ্বালাপোড়া), অল্পতে মেজাজ উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতেই থাকে।’
প্রায় সব রোগী জানিয়েছেন, জরায়ু কেটে ফেলার পর চিকিৎসকরা জ্বালাপোড়া কমাতে আজীবনের জন্য ‘টিবোনর’ ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকরাও জানান, নারীদের মেনোপজ-পরবর্তী বা অস্ত্রোপচারের ফলে মেনোপজের উপসর্গের চিকিৎসায় এই ট্যাবলেট দেয়া হয়।
তবে বেশির ভাগ রোগীই বলেছেন, এক পাতা (১০টি ট্যাবলেট) টিবোনর কিনতে প্রায় ২০০ টাকা লাগে। যেখানে অভাব সবার নিত্যসঙ্গী, সেখানে সারা জীবন এই ওষুধ কিনে খাওয়া কি সম্ভব?
আরও পড়ুন:ঋণ জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, পাচার, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনসহ নানা অপরাধের অভিযোগে এক ডজনেরও বেশি মামলা কাঁধে নিয়ে বছরের পর বছর বহালতবিয়তে থেকে গেছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ও তার পরিবাবের সদস্যরা।
দেশের আর্থিক খাতে অনিয়মের শিরোমণি এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী বিধি ভেঙে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকার দ্বিতীয় নামটি ছিল এই বিতর্কিত ব্যবসায়ীর। ২০২১ সালের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায়ও দ্বিতীয় নামটি তার।
অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার এবং অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের পৃথক তিন মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড কাঁধে নিয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী।
অবশেষে তার ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবশেষ বুধবার ওবায়দুল করিমসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আর্থিক খাতে নানামুখী অপকর্মে সিদ্ধহস্ত ওবায়দুল করিম সাজা থেকে বাঁচতে মামলার নথি গায়েব ও শুনানি পেছানোর কূটকৌশলে পার করেছেন ১৬ বছর। সাজা ঘোষণার তিনটিসহ তার বিরুদ্ধে মোট ১৪টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৪৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১১টি মামলা হয়। ২০০৭ সালে করা এসব মামলার বিচারকাজে এখন স্থবিরতা বিরাজ করছে। তবে এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ওবায়দুল করিম ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। সে সময় যৌথ বাহিনীর গঠিত দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানের সময় গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তবে দুর্নীতির মামলা ও সাজা থেকে রক্ষা পাননি। তার অনুপস্থিতিতে বিশেষ আদালতে রায় ঘোষণা হয়। একটিতে যাবজ্জীবনসহ তিনটি মামলায় তার অন্তত ৪৮ বছর কারাদণ্ড হয়। এর মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে যাবজ্জীবন (৩০ বছর) কারাদণ্ড দেওয়া হয় ও আত্মসাতের সমপরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
২ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং পাচারের সমপরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। অবৈধ উপায়ে ৫০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জরিমানা করা হয় ১০ লাখ টাকা। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
অবৈধ উপায়ে ৫২ কোটি ৯২ লাখ টাকা অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর রমনা থানায় মামলাটি করেন দুদকের উপপরিচালক আবদুল করিম। বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২৫ জুন এক রায়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছর এবং তথ্য গোপনের দায়ে ৩ বছরসহ মোট ১৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন বিশেষ জজ আদালত-৯-এর বিচারক খন্দকার কামাল উজ-জামান। রায়ে ৫২ কোটি ৯০ লাখ টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
এ ছাড়া ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। রায়ে বলা হয়, ওবায়দুল করিম পলাতক থাকায় তিনি যেদিন আত্মসমর্পণ করবেন বা গ্রেপ্তার হবেন, সে দিন থেকে সাজার মেয়াদ শুরু হবে। কিন্তু ওবায়দুল করিম রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট শুনানি শেষে রায় স্থগিত করেন। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করলে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে ওবায়দুল করিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এ মামলায় বিচারিক আদালতে মামলার নথি খুঁজে না পাওয়ায় বিচারকাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
এর মধ্যে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় উঠে আসে ওবায়দুল করিমের নাম। সে সময় তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকেই বাঁচার চেষ্টা করেন তিনি।
বিধি ভেঙে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ
বিধি লঙ্ঘন করে ওরিয়ন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন পাওয়ার প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক অগ্রণী, জনতা ও রূপালী। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুটি নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং একটিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন শিথিল করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তিনটির প্রস্তাবিত ওই ঋণের অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি।
সিন্ডিকেট ফাইন্যান্সিং বা অর্থায়নের মাধ্যমে সম্প্রতি ওই ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সমস্যা জর্জরিত জনতা ব্যাংক এ ঋণের সিংহভাগ অর্থাৎ ৫ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।
রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ ঋণ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ঋণটি বিতরণের জন্য পাইপলাইনে রয়েছে, কিন্তু ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে এ ঋণ বিতরণে দেরি হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওবায়দুল করিমের মালিকানাধীন ওরিয়ন গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ১৪৫ কোটি ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০৬ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত হাজার কোটি টাকা।
ঋণের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওরিয়ন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম একটি ব্যাংক থেকে ১৬৬ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার ৫০৮ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু কোম্পানি তো দূরের কথা, টিআইএন নম্বরেরও খোঁজ মেলেনি। বেলহাসা একম জেভি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম, এমডি সালমান ওবায়দুল করিম ও স্পন্সর পরিচালক মাজেদ আহম্মেদ সাঈফের নামে ঋণের পরিমাণ ৭৮ কোটি ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৬৪৮ টাকা। ওবায়দুল করিম আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের নামে ৫১ কোটি ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬৮ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৭১৭ টাকা পরিশোধ করেননি। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা অংশীদারত্বের কোনো বৈধ কাগজ পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে বারবার সময় নিয়েও ঋণ পরিশোধ করেনি ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। ফলে প্রতিষ্ঠানটির ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখাতে ব্যাংকটিকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্য অনুসারে, সোনালী ব্যাংককে ২২ আগস্টের মধ্যে ঋণের যথাযথ শ্রেণিবিভাগ করে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। এতে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোম্পানিটির বকেয়া ঋণ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খারাপ ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ ছিল। তখন পর্যন্ত কোম্পানিটি চারটি কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি।
জানা গেছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তির মূল অর্থের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা এবং ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা সুদ বাবদ বকেয়া ছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমতির ওপর ভিত্তি করে এতদিন এই ঋণ খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংককে দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে কিস্তি বাকি থাকায় কোম্পানিটির ঋণ খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে বলা হয়েছে।
ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে প্রায় দুই দশক আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করে ওরিয়ন গ্রুপ। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে ৪০ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অপতৎপরতাও চালায় গ্রুপটি। সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ ভাগিয়েও নেয়। গত জুন শেষে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গ্রুপটির নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার বড় একটি অংশই নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানের বাইরে গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের গ্যারান্টার হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণও হাজার কোটি টাকার বেশি। যার একটা অংশ খেলাপির হলেও প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নেন তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের মেয়াদও বারবার বাড়ানো হয়।
সম্প্রতি একটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপসহ তিনটি গ্রুপের পকেটে। এতে বলা হয়, ব্যাংকটি থেকে বেক্সিমকো, এস আলম এবং ওরিয়ন গ্রুপের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের জনতা ভবন করপোরেট শাখার ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের বড় অংশ রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপের পকেটে।
এ ছাড়া গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষের দিকে (৬ মে) রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকে ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার আরেকটি ঋণ প্রস্তাব করা হয় গ্রুপটির ওরিয়ন রিনিউয়েবলস মুন্সীগঞ্জ লিমিটেডের নামে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের জামানত বা সিকিউরিটি মর্টগেজ হিসেবে যে সম্পদ দেখানো হয়েছে তা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। সে সময় জামানতের সম্পদমূল্য ৫৪০ কোটি টাকা দেখানো হলেও তা সর্বোচ্চ ১৮০ কোটি টাকা হবে। এভাবে জামানতে ভুল তথ্য দিয়েও ঋণ ভাগিয়ে নেওয়ার আশ্রয় নিয়েছে গ্রুপটি।
গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ব্যবসায়ী গ্রুপ ওরিয়নের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ৮২০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর বাইরে ননফান্ডেড ঋণ রয়েছে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা। গ্রুপটির মোট ১২৪টি কোম্পানির মধ্যে সচল থাকা ২২টির ব্যাংক হিসাবের লেনদেন পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, গ্রুপের মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিজের ব্যক্তিগত গ্যারান্টার হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১২৯ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৮ কোটি টাকার ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে ঋণ খেলাপি হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করে দেয়। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ খেলাপি তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নেন তিনি।
২০২০ সালে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে টাকা উত্তোলনের অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ তোলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ভেঙে খাওয়ার টার্গেটে নামে গ্রুপটি। এরপর তারা হাজার হাজার কোটি টাকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায়। কোম্পানিটি ঋণ হিসাবে ৯০৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার নেওয়ার আবেদনও করে। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একটি ব্যাংক থেকে একসঙ্গে এত টাকা ঋণ পাওয়ার নজির বাংলাদেশে নেই।
গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ২০০৭ সালে ব্যাংক থেকে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের এক মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বেশ আলোচনায় আসে। তবে তিনি সেই মামলার নথি আদালত থেকে গায়েব করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। নথি হারিয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়া থমকে যায়। ফলে অন্যতম আসামি ওবায়দুল করিমসহ দোষীরা বহাল তবিয়তে থেকে যান। রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ বছরে মামলাটি নিয়ে দায়িত্বশীলদের কোনো নজরদারিও নেই।
মামলা সূত্রে জানা যায়, বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ না করেই ২০০৮ সালে ওই রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রুল শুনানি শেষে ওই বছরই বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আসামি ওয়াবদুল করিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
নিয়মানুসারে মামলার মূল নথিটি উচ্চ আদালত থেকে বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর সেই নথিপত্র গ্রহণ করেন বিচারিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এরপর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর অগ্রসর হয়নি। মামলার মূল নথি খুঁজে না পাওয়ায় বর্তমানে ‘মামলা ও আসামিদের সর্বশেষ অবস্থা’ সম্পর্কে কেউই বলতে পারছেন না।
ওবায়দুল করিম পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ
আর্থিক খাতে অনিয়মের শিরোমণি এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জন ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে বলেছে। সন্ধ্যায় বিএফআইইউর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়, হিসাব জব্দ করা ব্যক্তিদের নিজস্ব ও ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সব লেনদেন বন্ধ থাকবে। আগামী ৩০ দিন এসব হিসাবের মাধ্যমে কোনো ধরনের লেনদেন করতে পারবে না তারা। প্রয়োজনে লেনদেন স্থগিত করার এ সময় বাড়ানো হবে। লেনদেন স্থগিত করার এ নির্দেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য হবে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে। এতে ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিম, ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম, মেহেদি হাসান ও মেয়ে জারিন করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেজাউল করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যও দেওয়া আছে।
এ ছাড়া চিঠিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য (পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, পুত্র/কন্যা ও অন্যান্য) এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সকল হিসাবের কেওয়াইসি, হিসাব খোলার ফরম ও শুরু থেকে হালনাগাদ হিসাব বিবরণীসহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য আগামী দুই কার্যদিবসের মধ্যে বিএফআইইউর কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
আর্থিক অনিয়মের বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ওরিয়ন গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:বাপ্পী হোসেনের বয়স ১৯ বছর। এই তরুণ রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। সে সময় ছররা গুলিতে আহত হন তিনি। সারা শরীর তো বটেই, তার দুই চোখে বিঁধে যায় পাঁচটি গুলি, যার মধ্যে বাম চোখে তিনটি আর ডান চোখে দুটি।
বাপ্পীর সারা শরীরে এখনও রয়ে গেছে ১৯টি গুলি। চিকিৎসা চলছে রাজধানীর শ্যামলীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিটে। বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুই চোখ থেকে গুলির স্প্লিন্টারগুলো বের করা হলেও দৃষ্টিশক্তি ফেরেনি বাপ্পীর।
মা মরিয়ম বেগম জানান, বাপ্পী আর কোনোদিন দেখতে পাবে না বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অথচ বাপ্পীর মনে এখনও আশা- একদিন আগের মতোই দেখতে পাবে সে।
বরিশাল বিএম কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ২৬ বছর বয়সী রহমতউল্লাহ সরকার সাবির। মাস্টার্স শেষ করে পড়ছিলেন বরিশালের একটি ল’ কলেজে।
সাবিরের ভাই নজরুল ইসলাম ইউএনবিকে জানালেন, ৪ আগস্ট বিকেলে বিএম কলেজের সামনে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। সে সময় সাবিরের বাম চোখে তিনটি ছররা বুলেট আর ডান চোখে একটি রাবার বুলেট লাগে। বাম চোখে এখনও একটি বুলেট রয়ে গেছে। সেটা বের করতে হলে চোখই ফেলে দিতে হবে। ডান চোখে তেমন সমস্যা না থাকলেও এখন বাম চোখে কিছুই দেখছে না সাবির।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে এমনই সম্পূর্ণ বা আংশিক অন্ধত্বকে বরণ করতে হয়েছে অর্ধ সহস্রাধিক মানুষকে।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা যায়, ১৭ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৬১১ জন চোখে বুলেট নিয়ে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত ২৮ জনের, যারা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন।
এক চোখ আহত অবস্থায় এসেছেন ৫১০ জন। তাদের মধ্যে ১৭৭ জনের দু’বার সার্জারি করতে হয়েছে। বর্তমানে স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিটে ভর্তি আছেন ৪৬ জন, যারা সবাই ছররা বুলেটে আহত।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘রাবার বুলেট দিয়ে আহত কাউকে আমরা এখনও পাইনি। যারা এসেছেন তাদের চোখে বিদ্ধ সব গুলিই মেটালিক প্লেটের। এই পিলেটগুলোকে ছররা গুলি বলা হচ্ছে।
‘এগুলো যখন ছোড়া হয় তখন বুলেটের মধ্যে একটা হিট জেনারেশন হয়। এটি চোখে ঢুকলে রেটিনা তো ছিঁড়ে যায়-ই, অন্য স্ট্রাকচারগুলোও ডিসঅর্গানাইজড হয়ে যায়। এখান থেকে ব্যাক করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাদের রেটিনা ছিঁড়ে গেছে, নার্ভে কোনো ক্ষতি হয়েছে, অথবা ভেতরে কোনো হেমারেজ আছে তাদের দ্বিতীয়বারের মতো অপারেশন করতে হয়েছে। অনেক বেশি ড্যামেজ না হয়ে থাকলে আস্তে আস্তে ভালো হতেও পারে। আর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভালো হয় না।’
এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটির প্রভাব অন্য চোখেও পড়ে কি না জানতে চাইলে সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘এটা হতে পারে। আমাদের এখানে একজন রোগী আছে যার এক চোখে পিলেটের আঘাতের কারণে অন্য চোখেও ইফেক্ট পড়েছে। এটা যদিও খুব রেয়ার।’
ছাত্র আন্দোলনে ছররা গুলি কেড়ে নিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষের চোখের আলো। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি, আগ্নেয়াস্ত্রে যে বুলেট ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো প্রাণঘাতী নয়। সেগুলো এমন বুলেট যা অনেক ছোট ছোট ছররা গুলি ছুড়ে দেয়।
মূলত ‘বার্ডশট’ হিসেবে এই পরিচিত এই বুলেট শিকারের কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি। নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে এই বুলেট আঘাত করে না; বরং অনেক বিস্তৃত পরিসরে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়।
এর আকার অনুযায়ী প্রতিটি রাউন্ডে ৩০০ থেকে ৬০০টি পিলেট থাকে। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু বা ব্যক্তির পাশাপাশি তাদের চারদিকে থাকা অন্যদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এবং গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে বিক্ষোভে ছোড়া গুলিতে পথচারীরাও ব্যাপক পরিমাণে আহত হয়েছেন।
ছররা গুলির আঘাতে মৃত্যুর পরিবর্তে অন্ধত্ব, আহত বা পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বিক্ষোভ বা জমায়েত নিয়ন্ত্রণে ‘মানবিক’ ও ‘গ্রহণযোগ্য’ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, বার্ডশট মানুষের ওপর আইন প্রয়োগের জন্য ব্যবহার একেবারেই অনুপযুক্ত এবং এটি কখনোই বিক্ষোভ প্রতিহত করতে ব্যবহার করা উচিত নয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতশাসিত কাশ্মীরে পিলেট-ফায়ারিং শটগান ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
২০১৬ সালে সেখানে এক গণঅভ্যুত্থানের সময় ১১০০ জনেরও বেশি মানুষকে ছররা গুলিতে আংশিক বা পুরোপুরি অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞার এই আহ্বানে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘পিলেট-ফায়ারিং শটগানের আঘাতে আহত ব্যক্তিরা গুরুতর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন।
চোখে আঘাত পাওয়া স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের বেশ কয়েকজন যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন তারা কাজ করতে পারবেন কি না এ নিয়ে ভয়ে আছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বার বার অস্ত্রোপচার করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাননি।’
বিশ্বে অনেক দেশেই ‘পশু-পাখি শিকারের গোলাবারুদ’ মানুষের ওপর প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এজেন্ডায় পুলিশিং সংস্কারের বিষয়টি শীর্ষে থাকায়, জমায়েত বা বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ‘বার্ডশট’ বা পিলেট গানের ব্যবহারের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে।
নানা ধরনের সবজির মধ্যে বিশেষ একটি জায়গা দখল করে আছে ‘কাঁকরোল’। আর ব্যাপকভাবে এই সবজির চাষ হচ্ছে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি গ্রাম গোমড়ায়। গ্রামটিতে বসবাসকারী সবাই বিভিন্ন সবজির আবাদ করেন, যার মধ্যে কাঁকরোল অন্যতম। তাই গোমড়া গ্রামটি এখন ‘কাঁকরোল গ্রাম’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা গারো পাহাড়ের জেলা শেরপুর। এখানে ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম ‘গোমড়া’। এই গ্রামের চারশ’ একর জমিতে প্রায় ১২শ’ কৃষক কাঁকরোল চাষকে তাদের জীবিকার অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সরজমিনে জানা যায়, এই এলাকায় কয়েক বছর আগেও পানি ও বিদুতের অভাবে বহু জমি পতিত ছিলো। এখন এ দুটি সুবিধা পাওয়ায় আর পতিত পড়ে থাকছে না এসব জমি। কৃষি বিভাগের সহায়তা ও পরামর্শে গ্রামের প্রায় সবাই নিজের কিংবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে মৌসুমী সবজি চাষ করছেন।
শরৎ ঋতুর এই সময়টাতে পুরো এলাকার সবজির ক্ষেত কাঁকরোলে ছেয়ে গেছে। যদিও এসব ক্ষেতে গরম ও শীতের আগাম সবজি বেশি আবাদ করেন স্থানীয়রা। এখানকার উৎপাদিত সবজির মান ভালো হওয়ায় স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে কাঁকরোল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে।
গোমড়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগে এই এলাকায় পানির জন্য প্রায় সব জমিই পতিত থাকতো। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ আসায় পানি সমস্যার সমাধান হয়েছে। আবাদের আওতায় এসেছে অনেক জমি।
‘আমরা মৌসুমভিত্তিক সবজির আবাদ করে থাকি। আমরা এখন সবজির মধ্যে কাঁকরোল লাগিয়েছি। সবজি আবাদ করে এলাকার কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।’
কৃষক হরমুজ আলী বলেন, ‘এটা পাহাড়ি এলাকা। এই এলাকায় আমরা সবজির আবাদই করি। আমি ৫০ শতাংশ জমিতে কাঁকরোল লাগাইছি। আমি এবার কাঁকরোল বিক্রি করে অনেকটা লাভবান হয়েছি। পোলাপানের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি। পাঁচ সদস্যের সংসার চলছে এই সবজি আবাদ করেই।’
কৃষক ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমরা পাহাড়ের মানুষ। আগে কী যে কষ্ট করছি! মানষের জমিতে সারাদিন কাম করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পাইছি। কোনো কোনোদিন কামও পাইতাম না। এই টাকা নিয়া বাজার করবার গেলে কষ্ট হইছে। এখন বাড়ির পাশে রহমত ভাইয়ের জমিন বাগি (বর্গা) নিয়া শুরু করছি কাঁকরোলের চাষ। এখন আল্লাহর রহমতে নিজেরা ভালা আছি।’
তবে স্থানীয় চাষিদের অভিযোগ রয়েছে গ্রামের রাস্তা-ঘাট কাঁচা নিয়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় সবজির ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
কৃষক হারুন মিয়া বলেন, ‘আমাদের এদিকে কাঁচা রাস্তা হওয়ায় আমরা সবজি বাজারে তুলতে পারি না। নিলেও খরচ অনেক পড়ে যাওয়ায় লাভ কম হয়। সময়মতো বাজারে না নেয়ায় সঠিক দামও পাই না। আমরা কৃষকরা অবহেলিত।’
কৃষক খাইরুল বলেন, ‘এই এলাকার গ্রামীণ রাস্তাগুলো পাকা করলে আমাদের খুব উপকার হবে। আমরা কৃষকরা সবজি আবাদ করে দামটা বেশি পাইতাম। খারাপ রাস্তায় সব গাড়ি সহজে আসবার চায় না। আসলেও ভাড়া বেশি পইড়া যায়। এজন্য লাভটা কম হয়।’
যেভাবে চাষ
কাঁকরোলের বীজ কাঁকরোল গাছের নিচে হয়ে থাকে, যা দেখতে মিষ্টি আলুর মতো। মার্চ ও এপ্রিলে এই সবজির চাষ করা হয়। চারা গজানোর ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যেই এর ফলন পাওয়া সম্ভব। কাঁকরোল লতানো গাছ। স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল একই গাছে হয় না। তাই বাগানে দু’ধরনের গাছ না থাকলে পরাগায়ন ও ফলন কম হয়।
চাষে খরচ ও লাভ কেমন
কৃষকেরা বলছেন, কাঁকরোল চাষে বিঘাপ্রতি খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার। ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘায় খরচ লাখ টাকার উপরে লাভ হয়ে থাকে।
কাঁকরোলের উপকারিতা
কাঁকরোল অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি৷ এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, ক্যারোটিন, আমিষ, ভিটামিন এ, বি ও সি এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে৷ কাঁকরোলে ভিটামিন সি থাকায় শরীরের টক্সিন দূর করে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
কাঁকরোলে আছে বিটা ক্যারোটিন ও আলফা ক্যারোটিন, যা ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না; ত্বককে করে উজ্জ্বল। এছাড়া কাঁকরোলের ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে।
ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন দিলদার জানান, পাহাড়ের পাদদেশে কাঁকরোলের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের সবজির আবাদ হয়ে থাকে। সবজি চাষিদের সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। এই সবজি কৃষক সরাসরি ঢাকার বাজারে পাঠাচ্ছে। সবজির মান ভালো হওয়ায় কৃষক দামও পাচ্ছে ভালো।
‘আমি মনে করি অন্যান্য কৃষি উদ্যোক্তা জমি ফেলে না রেখে মৌসুমভিত্তিক সবজি আবাদ করলে অবশ্যই লাভবান হবে। এ বছর এই উপজেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে কাঁকরোলের আবাদ হয়েছে।’
আরও পড়ুন:মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াইয়ের মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে চাচাত ভাই নুর আলমের সঙ্গে নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছে ১০ বছরের উম্মে সালমা। তার ভাই, মা, বাবা ও বোনের মধ্যে কেউ বেঁচে আছে কি না, তা সে জানে না।
সে শুধু এতটুকু জানে, আরকান আর্মি তার পরিবারের সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে। এরপর বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
শিশুটির ভাষ্য, তার বাবাকেও গ্রামের অন্য পুরুষদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যায় সেনারা। আর যখন ঘরে আগুন দেয়া হয়, তখন তার মা ঘরেই ছিলেন। উম্মে সালমা বাইরে উঠানে ছিল। ওই সময় ড্রোন এসে তার বাম হাতে লাগে।
চাচাত ভাই উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গা নিয়ে যায় উম্মে সালমাকে।
‘পালিয়ে আসার সময় গ্রামের পথে পথে ফাঁকা স্থানে শুধু রক্তের দাগ দেখেছি’, বলে রোহিঙ্গা শিশুটি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর সুয়েজা এলাকায় উম্মে সালমার বাড়ি। কখন তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছিল, তা সে বলতে পারে না।
উম্মে সালমা জানায়, গত ৮ সেপ্টেম্বরের আগে এক শুক্রবার আগুন দেয়া হয় তাদের বাড়িতে। এটাই মনে আছে তার।
বর্তমানে কক্সবাজারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে শিশুটি।
আরেক রোহিঙ্গা শিশু রহিমা, যার বয়স ৯ বছর। তার পাঁচ বছর বয়সী এক বোন আছে, যার নাম সাদিয়া। চাচা নুরুল করিমের সঙ্গে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
এ পরিবারে দুই সহোদর ও চাচা ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।
শিশুটি বলে, ‘বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে আরাকান আর্মি। পুড়িয়ে দিয়েছে সব। বাবা-মা মারা গেছে।
‘আমার পায়ে আগুন লাগছে। আর মৃত্যুর ভয় নিয়ে পালিয়ে এসেছি।’
আরেক শিশু সাত বছরের উম্মে কায়দা বলে, ‘বাবাকে নিয়ে চলে এসেছি। মা ড্রোন হামলায় মারা গেছেন।’
সে জানায়, তারা দুজন গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হন।
উম্মে কায়দাদের বাড়ি মংডুর নলবাইন্যা এলাকায়। তার বাবা আছে, তবে পরিবারের অন্য কেউ বেঁচে আছে কি না, সে জানে না। বর্তমানে সে তার মামাতো বোন রাজিয়ার সঙ্গে আছে।
উম্মে কায়দা নিউজবাংলাকে বলে, ‘আরাকান আর্মি বাড়িতে আগুন দেয়ার পর সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলেছে।’
মংডুতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ড্রোন হামলায় ১১ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশু নূর শাহেরা গুরুতর আহত হয়। সে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস তথা এমএসএফ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়, কিন্তু এখনও তার আঘাত থেকে সেরে উঠতে পারেনি।
নূর শাহেরার ভাষ্য, অনেক রোহিঙ্গা সম্প্রতি গুলি ও ড্রোন হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
উম্মে সালমা, রহিমা, উম্মে কায়দা কিংবা নূর শাহেরাই নয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ৮ সেপ্টেম্বর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আহত অনেক শিশু রয়েছে। এসব শিশু বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন জায়গায় আছে।
জীবিতদের মধ্যে আয়াশ নামে ৩৭ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ছিলেন, যিনি তার মেয়েসহ আহত হন।
ভয়াল সেই দৃশ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার বড় ছেলে ও খালাকে আমার সামনে আরকান আর্মি গুলি করে হত্যা করেছে। তখন আমি নদীর তীরে মারা যাওয়ার ভান করছিলাম।
‘আমার স্ত্রী, আমাদের ছোট ছেলেকে নিয়ে আলী পাড়ায় বেঁচে গেলেও তার পুরো পরিবার গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।’
কথা হয় ১২ বছর বয়সী রোহিঙ্গা বালক মুহাম্মদ ত্বকির সঙ্গে। সে গত ২০ আগস্ট সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে আসার সময় নদীর তীরে আরাকান আর্মির ছোড়া ভারী মর্টার শেলের আঘাতে গুরুতর আহত হয়।
আহত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আশিকুর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বিপুলসংখ্যক আহত রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ জনের বেশি রোহিঙ্গা শিশু ছিল। কারও হাতে আঘাত, কারও পায়ে আঘাত। চিকিৎসা শেষে তারা বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়।
‘তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারছি, অনেকেই ড্রোন হামলায় আহত হয়েছেন। তারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার। শিশু আইন অনুযায়ী, ৮ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের কাউন্ট করা হচ্ছে।’
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি তুলে ধরে আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ডা. জুবায়ের বলেন, ‘মিয়ানমারে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর লড়াই দেখিয়ে রোহিঙ্গা নির্মূল করা হচ্ছে। সে কারণে নিরস্ত্র, নিরীহ রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
‘তাদের দুই বাহিনীর নির্যাতনে অনেক রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শিশু আহত হয়ে এপারে চলে আসছে বাধ্য হচ্ছে। তারা অবুঝ শিশুদের পর্যন্ত হত্যা করছে। এখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আওয়াজ তুলতে হবে।’
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা ইয়ুথ কোয়ালিশনের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালের চেয়েও ভয়ংকর এ যুদ্ধ। রোহিঙ্গা এলাকায় আরাকান আর্মি ঘাঁটি করে যুদ্ধ করছে, যাতে করে রোহিঙ্গারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
‘এর মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। তাদের সঙ্গে মৃত্যুর বিভীষিকার দৃশ্য দেখে ২০ জনের ওপরে আহত রোহিঙ্গা শিশু উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।’
জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু–দ্দৌজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এর মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা আহত আছে।
‘তাদের এনজিও সংস্থার মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।’
কত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন:ভারত সীমান্তবর্তী ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে ওঠা জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলীর বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, দেশসেরা হওয়া চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য সরকারকে যে জমি রেজিস্ট্রি দেয়া হয়েছিল, সেখানে ২০০০ সালে স্কুল নির্মাণ করা হয়েছিল। স্কুলটি প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০১১ সালে পাঠদানের অনুমোদন দিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অফিসের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়। ২০১৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হলে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতাদের অবৈধ মদদে ক্ষমতার জোরে স্কুলটি সরিয়ে নিজ জমিতে স্থাপন করে রাতারাতি প্রধান শিক্ষক হন এরফান আলী।
তাদের অভিযোগ, এরফান স্কুলে যোগদানের পরের দিনই সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যান তার স্ত্রী সুরাইয়া পারভীন ও দুই বোন রেহেনা খাতুন এবং মিতালি পারভিন।
গ্রামের এক যুবকের অভিযোগ, ২০১৪ সালে স্কুলটি আগের জায়গা থেকে তুলে নিয়ে এসে নিজের জমিতে স্থাপন করেন এরফান। সে সময় তাকে (যুবক) শিক্ষকতার চাকরির কথা বলে সাত লাখ টাকা নেন এরফান আলী৷
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘২০১৪ সালে এরফান আলী যখন স্কুল আগের জায়গা থেকে খুলে নিয়ে তার নিজ জমিতে নিয়ে আসেন, তখন আমাকে তাদের সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব দেন এবং আমার থেকে সাত লাখ টাকা নেন। তারপরও চাকরি দেননি। এখনও পুরো টাকা ফেরত দেননি তিনি।’
চাকরিপ্রত্যাশী ওই যুবক বলেন, ‘২০১৪ সালের আগে এরফান আলী কোনো শিক্ষকতা করেননি। তিনি যে ২০০৮ সালে তার চাকরিতে যোগদান দেখাচ্ছেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ২০১৪ সালের আগে তার কোনো স্কুল ছিল না।’
সম্প্রতি সংবাদকর্মীদের কাছে উল্লিখিত অভিযোগগুলো তুলে ধরে তদন্ত দাবি করেন স্কুলের তৎকালীন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষকের চাকরিপ্রত্যাশী একাধিক যুবক এবং স্কুলের তৎকালীন সভাপতি খলিলুর রহমান।
গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রত্যেক ওয়ার্ডে দুইটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার ঘোষণা আসে। সেই বাস্তবতায় গ্রামের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে ২০০০-২০০১ সালের দিকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামবাসী।
এর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হলে কীভাবে স্কুল চালু করতে হবে, সে নিয়ম জানিয়ে চিঠি দেয়া হয় আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সব নিয়মকানুন মেনে স্কুলের জন্য ৩৩ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে দেন গ্রামের দুই ব্যক্তি আবদুর রহমান ও কদম আলী।
তারা আরও জানান, দান করা জমিতে টিনের বেড়া দিয়ে স্থাপন করা হয় চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। গ্রামের লোকজন এক সভা আহ্বান করে গ্রামের বাসিন্দা খলিলুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি করে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে।
চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, ‘সে সময়কালে আমাকে সভাপতি করে একটি ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই বছরে একটি দৈনিক পত্রিকায় একজন প্রধান শিক্ষকসহ তিনজন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আলতাফুর রহমানসহ আরও তিনজন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়।’
তার দাবি, সে সময় নিয়মিত উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের একাধিক কর্মকর্তা স্কুলটি পরিদর্শন করে যান। সে সময় শিক্ষক হিসেবে ছিলেন আলতাফুর রহমান, নাসরিন আক্তার, নুর নাহার ও জসিম উদ্দীন।
তৎকালীন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষিকা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘গ্রামের কিছুসংখ্যক শিশুকে নিয়ে ওই স্কুলে পাঠদান করানো হতো। যেহেতু ২০১১ সালের আগে পাঠদানের অনুমোদন পায়নি স্কুলটি, তাই সেসব শিশুকে পার্শ্ববর্তী স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো হতো।
‘প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল। পাঠদানের সরকারি অনুমতি নেই, শিক্ষকদের বেতন ভাতা নেই। একটা সময় খুব স্বাভাবিক কারণেই স্কুলটির কার্যক্রম ঢিলেঢালা চলতে থাকে। এ ছাড়াও অভিভাবকগণের অনিচ্ছার কারণে ছাত্র-ছাত্রীও কমতে শুরু করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে বিদেশে চলে যায়। অন্য শিক্ষকদেরও জীবিকার জন্য অন্যখানে যেতে হয়, তবে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের স্বপ্ন নিয়ে আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম।
‘২০১৩ সালে যখন বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়, তখন আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম, কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আমাদের লাগানো গাছের ফল এখন ক্ষমতার জোরে ভোগ করছে অন্যজন।’
তার অভিযোগ, ‘এরফান যেহেতু আমার মামাতো ভাই হয়, ২০১৪ সালে সে আমার বাসায় আসে এবং বলে আমার চাকরি বহাল থাকবে যদি আমি সাত লাখ টাকা দিই। সেদিনই সে দুই লাখ টাকা নেয়।
‘পরবর্তী সময়ে দেখি সে চাকরি দিতে টালবাহানা করে। এখনও পুরো টাকা ফেরত দেয়নি।’
এই শিক্ষকের স্বামী সাবেক সেনা সদস্য রবিউল আওয়াল বলেন, ‘২০০২ সালে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন আমার স্ত্রী শিক্ষকতা করতেন। আর আমার আত্মীয় এরফান আলী ছিলেন চায়ের দোকানদার।
‘২০১৪ সালে তিনি আমাকে জানান, আগের স্কুলের সবকিছু নাকি বাদ হয়ে গেছে। তাই নিজ জমিতে তিনি একটা বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন নিয়ে এসেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালের আগে এরফান আলী কোথাও কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি। অথচ আমি এখন তার যোগদানের কাগজে দেখছি। তিনি নাকি ২০০৮ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন।
‘তিনি যোগদানের পরের দিন তার স্ত্রী ও দুই বোনও সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। এটা আপাতদৃষ্টিতে প্রতারণা আর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কী হতে পারে?’
আওয়াল বলেন, ‘এখানে কোনো অনিয়ম নিশ্চয়ই হয়েছে। ২০০৮ সালে কোন ম্যানেজিং কমিটি তাদের নিয়োগ দিলেন, যেখানে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এরফানের জমিতে কোন বিদ্যালয় ছিলে না।
‘আমরা তদন্ত চাই। এরফানের কর্মরত বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র এবং শিক্ষকদের নিয়োগ ও শিক্ষাগত সনদসহ সকল কাগজপত্র যাচাই করা হোক।’
কী আছে নথিতে
২০১১ সালের ৮ মে রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের এক কাগজ এ প্রতিবেদকের হাতে আসে। সে কাগজে সিংহাড়ী মৌজার ১৯৯০ ও ১৯৯১ দাগে ৩৩ শতক জমিতে নির্মিত চরভিটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের প্রাথমিক অনুমোদন দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ২০১১ সালে যেসব দাগ উল্লেখ করে চরভিটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছিল রংপুর বিভাগের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর, সে জমিতে কোনো স্কুল নেই। সেখানে ধানের চাষাবাদ হচ্ছে। এলাকাবাসী বলছে এটিই সেই জমি, যার মালিক এখনও সরকারই।
নিউজবাংলার হাতে আসা নথির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে এরফান আলী যে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছেন, সেখানে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে কি না।
এ বিষয়ে নিউজবাংলার কথা হয় গ্রামের বর্ষীয়ান একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে, যার নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তাদের একজন জানান, চা বিক্রেতা এরফান আলীর শিক্ষকতা করার ইচ্ছা থাকলেও যোগ্যতা ছিল না৷ গ্রামে ২০০০-২০০১ সালের দিকে স্কুল হওয়াতে তিনি নকল শিক্ষাগত সনদসহ নানা কৌশল অবলম্বন করেন।
তারা আরও জানান, কোনোভাবে পেরে না ওঠায় নিজে থেকে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেন এবং গ্রামবাসী অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রামছাড়া করার পাঁয়তারা করেন।
গ্রামের একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, ২০১৩ সালে দেশের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ হলে শিক্ষক হওয়ার লোভ মাথাচাড়া দেয় এরফান আলীর। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতাদের মদদে সরকার অনুমোদিত জমিতে অস্থায়ী স্কুল ঘর খুলে দিনে-দুপুরে গায়েব করে দেন। পরবর্তী সময়ে নিজের জমিতে স্কুলটি স্থাপন করেন এবং প্রভাব খাটিয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে যান।
এ ঘটনায় ঠাকুরগাঁও আদালতে একটি মামলা করেন স্কুলের তৎকালীন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আলতাফুর রহমান।
কী বলছেন এরফান
এ বিষয়ে জানতে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলীর দেয়া নির্ধারিত দিনে তার স্কুলে কাগজপত্র যাচাই করতে গেলে তিনি সেগুলো দিতে রাজি হননি।
সে সময় সব অভিযোগ অস্বীকার করে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলীর দাবি, তিনি কোনো স্কুল সরাননি।
তার ভাষ্য, ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবধি নিজের স্থাপিত চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করে আসছেন।
ওই বক্তব্যের পর মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে স্কুলের বৈধ কাগজপত্র চাওয়া হলে তিনি এ প্রতিবেদককে কোনো কাগজপত্র দেননি।
পরে কাগজপত্র তিন দিনের মধ্যে দেয়ার অনুরোধ করে মেসেজ পাঠালেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
স্কুলে দানকৃত একটি জমির কাগজ এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে, যাতে এরফান আলীর স্বাক্ষর আছে। সেখানে ২০১৫ সালে ২০১৪, ২০২২ ও ২০৫৪ তিন দাগে ২৪ শতক জমি তিনি স্কুলের নামে দান করেছেন। যদিও এরফান আলী এ কাগজের সত্য-মিথ্যা নিয়ে কিছু বলেননি এবং এ কাগজ তাকে পাঠালেও কোনো জবাব দেননি।
স্থানীয়দের দাবি, এরফান আলী স্বাক্ষরিত কাগজে এ তিন দাগে উল্লেখিত জমিতে স্কুলের অ্যাকাডেমিক ভবন, অফিস কক্ষ ও একটি পুকুর রয়েছে।
তাদের একজনের প্রশ্ন, ‘চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১৩ সালে জাতীয়করণ হলে ২০১৫ সালে এরফান আলীর দানকৃত জমিতে নির্মিত স্কুলটি কিভাবে জাতীয়করণ হয়? ব্যক্তিগত জমিতে নির্মিত স্কুল কি জাতীয়করণের আওতায় আসতে পারে? যদি তা না হয়, এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।’
কাগজে-কলমে দেখা যাচ্ছে ২০০৮ সালে ২৭ ডিসেম্বর এরফান আলী চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছেন এবং এই বছরের পহেলা ডিসেম্বরে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যদিও তার শিক্ষাগত সনদপত্র নিয়ে সন্দেহ আছে এলাকাবাসীর।
স্থানীয়দের প্রশ্ন, ২০০৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলে এবং সে বছরে চাকরিতে যোগদান করলে ২০০১ সাল থেকে কোথায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি।
তৎকালীন চরভিটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলতাফুর রহমান বলেন, ‘যখন স্কুলঘরটি ভাঙা হয়, তখন আমরা এরফান আলীর ভয়ে ছিলাম। সে সবসময় আমাদের হুমকি ও মামলার ভয় দেখাত, তবে শেষমেশ আমি সাহস করে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেছি।
‘স্কুল জাতীয়করণ হবার আগে আমরা যত নথিপত্র তৎকালীন রাজশাহী বোর্ডে প্রেরণ করেছিলাম, তার নথি কীভাবে যেন গায়েব হয়ে গেছে। আমরা বর্তমান চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারের নিয়ম মেনে হয়েছে কি না তার সত্যতা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে জানতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি উপজেলা প্রশাসনকে অভিযোগ দিয়েছি। যদি এরফান আলী প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সাথে প্রতারণা করে থাকে, তাহলে আমরা তার বরখাস্তের দাবি জানাই।’
তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষর জাতীয় কমিটির ঠাকুরগাঁওয়ের সদস্য সচিব মাহবুব আলম রুবেল বলেন, ‘স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে অনেক অপরাধ ও বেইনসাফ বৈধতা পেয়েছে। চরভিটা সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে কি না, অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন।
‘অনিয়ম হয়ে থাকলে এর পেছনে কারা কারা জড়িত, তাদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়ে আমি একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। তদন্তের আগে কিছু বলা ঠিক হবে না।’
আরও পড়ুন:শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আনোয়ারজ্জামান চৌধুরী। খোঁজ মিলছে না তিন প্যানেল মেয়রসহ আওয়ামীপন্থি অন্য কাউন্সিলরদেরও।
এমন পরিস্থিতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে সিসিকের কর্মকাণ্ডে; ব্যাহত হচ্ছে সেবা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর দেশ ছেড়েও চলে যান তিনি।
ওই দিনই নগর ভবন ও মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা, তবে তখন তিনি বাসায় ছিলেন না। এরপর থেকে খোঁজ মিলছে না মেয়রের। তার ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
সিসিক সূত্রে জানা যায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করার পর থেকে বিশেষত এক দিনে ছয়জন নিহত হওয়ার পর থেকে অফিস করছেন না মেয়র। ১ আগস্ট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শোক র্যালিতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
গত ৫ আগস্টের পর থেকেই ব্যক্তিগত অফিস ও নগর ভবনে আসছেন না প্যানেল মেয়র মখলেসুর রহমান কামরান, তৌফিক বকস লিপনসহ বেশির ভাগ কাউন্সিলর।
সিসিকের ৪২টি ওয়ার্ডে অন্তত ৩০ জন কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের। ৫ আগস্টের পর তাদের অনেকের বাসাবাড়ি ও অফিস ভাঙচুর করা হয়। এরপর থেকে তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের না পেয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের। সিসিকের প্রতিদিনকার কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
মায়ের মৃত্যু সনদ নিতে সোমবার নগরের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিক্রম কর সম্রাটের অফিসে গিয়েছিলেন অনিল দাশ, কিন্তু কাউন্সিলরকে না পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘তিন দিন ধরে নগর ভবন ও কাউন্সিলর অফিসে ঘুরছি, কিন্তু মেয়র, কাউন্সিলর কাউকেই পাচ্ছি না। কবে তারা আসবেন, এ তথ্যও কেউ জানাতে পারছে না। ফলে খুব সমস্যায় আছি।’
অনিলের মতো আরও অনেককে জনপ্রতিনিধিদের না পেয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন ও বাসাবাড়ির নকশা অনুমোদনসহ বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।
সব সংকট কাটিয়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিতে সিসিক সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্বৃত্তদের হামলা ও ভাঙচুরের আতঙ্কে চার দিন নগরের বর্জ্য অপসারণও বন্ধ ছিল। এতে নগরজুড়ে আবর্জনার স্তূপ জমে। পরে সবেক মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আরিফুল হক চৌধুরী উদ্যোগ নিয়ে বর্জ্য অপসারণ শুরু করেন।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম দুই- এক দিন কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। মেয়র মহোদয় অফিস না করলেও ফোনে আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘কোনো নাগরিক কাউন্সিলরদের অফিসে গিয়ে সেবা বঞ্চিত হলে নগর ভবনে আসলে আমরা তা করে দিচ্ছি।’
ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী জানান, বর্জ্য অপসারণেও সিসিক কর্মীরা কাজ করছেন।
গত বছরের ২১ জুন সিসিকের পঞ্চম নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুলকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। ওই বছরের নভেম্বরে তিনি মেয়র পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিএনপিহীন ওই নির্বাচনে ৪২টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগেই কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতারা।
আরও পড়ুন:রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে যে পুলিশ বাহিনী, তারা কেন মাঠে নেই, এমন প্রশ্ন এখন অনেক মানুষের মুখে মুখে। পুলিশ না থাকার সুযোগে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে ঢাকা ও বাইরের জেলাগুলোতে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন দেশব্যাপী আন্দোলনের সময় একের পর এক গুলি ও মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ছিলেন পুলিশের অনেক সদস্য। সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা ছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশ কর্তৃক গুলি করে হত্যার ঘটনাটি। সেই ভিডিও ঝড় তোলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের একটা পর্যায় নাগাদ পুলিশ উল্লেখযোগ্য সহিংসতায় জড়ায়নি, তবে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ অনেকের অভিযোগ, সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ শিক্ষার্থীদের ভয় দেখাতে বিভিন্ন জায়গায় গুলি করেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের দিন ৫ অক্টোবরও ঘটে ভয়াবহ ঘটনা। ওই দিন দেশের অন্তত ১০০টি থানায় হামলা-ভাঙচুর হয়। সেদিনও আত্মরক্ষার্থে পুলিশের কিছু সদস্য গুলি ছোড়েন। তাতে কয়েকটি থানায় ব্যাপক রক্তপাত হয়।
রাজধানীর উত্তরা পূর্ব, যাত্রাবাড়ী থানাসহ বেশ কয়েকটি থানায় প্রাণহানি হয় সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের।
এমন বাস্তবতায় প্রাণহানি ও হামলার শঙ্কায় বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন, তবে চাকরির নিয়ম অনুযায়ী এভাবে থাকার সুযোগ নেই তাদের।
এদিকে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের উচ্চ পদে হয়েছে ব্যাপক রদবদল। নতুন করে আইজিপি করা হয়েছে মো. ময়নুল ইসলামকে। তিনি বুধবার নির্দেশনা দিয়েছেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগদানের। এর পরও পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি।
কর্মস্থল যোগদান না করার অন্যতম কারণ জানতে পেরেছে নিউজবাংলা। সংবাদমাধ্যমটির কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংস্কার চেয়ে কর্মবিরতি পালন করছেন।
পুলিশের ওই কর্মীদের ১১ দফা দাবির তালিকা এসেছে নিউজবাংলার কাছে। এসব দাবিতে পুলিশ সদস্যরা উল্লেখ করেছেন, ওপরের নির্দেশনা মেনেই তাদের জনতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে।
গত মঙ্গলবার ‘অধস্তন পুলিশ সংস্কার প্ল্যাটফর্ম’ নামে করা ১১ দফা তৈরি করে পুলিশের সব স্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানান কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, তবে সেই দাবিগুলো কারা কোথা থেকে দিয়েছে, তেমন কিছু উল্লেখ নেই। কোনো পুলিশ সদস্যের নামও উল্লেখ নেই সেখানে।
ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব দাবি পুলিশের সব অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীর। সেখানে বলা হয়, ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর যে হামলা-নির্যাতন করা হয়েছে তা ছাত্ররা করেনি।
১১ দফা দাবির প্রথমটিতে বলা হয়েছে, ছাত্র আন্দোলনে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে।
যেসব পুলিশ নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ, আজীবন রেশন-পেনশন দেয়ার কথা রয়েছে দ্বিতীয় দাবিতে।
এসআই ও সার্জেন্ট নিয়োগ পিএসসির অধীনে এবং কনস্টেবল নিয়োগ শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে হতে হবে বলে দাবি করা হয়েছে।
পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পুলিশের জন্য কর্মঘণ্টা কমিয়ে আট ঘণ্টায় আনা, ছুটি ও ওভারটাইম নিশ্চিত করার দাবিও করা হয়েছে।
৯ নম্বর দাবিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, পুলিশকে যেন কোন রাজনৈতিক সরকার তাদের কর্মী হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, তেমন ব্যবস্থা তৈরি করা। সে জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করার দাবিও রয়েছে। আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি থানা ও ব্যারাকগুলোকে আধুনিক করে গড়ে তোলার দাবি করা হয়েছে শেষ দুটি দফায়।
কর্মস্থলে যোগদান না করার বিষয়ে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা মুখ খুলতে রাজি হননি।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য