১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। আর মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন স্টেশন ও সাবস্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনটিতে মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ হয়েছে ২০০ মেগাওয়াটেরও কম।
বিজয়ের ৫০ বছরে এসে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াটে। কেবল সরকারের নীতি পরিবর্তনের কারণে এই রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইপিপি (বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র) নীতি গ্রহণ করা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আসেন। এ ছাড়া ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ নীতি করে শিল্পে বিদ্যুৎ দেয়া হয়। তখন আইপিপি করার ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যেও দ্বিধা ছিল। সে সময়ের অর্থসচিব আকবর আলী খান আইপিপি করাকে আত্মঘাতী হবে উল্লেখ করে অর্থ দিতে চাননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এসব সমস্যা সমাধান করেন। এরপর ২০০৯ সালে আবার বিদ্যুৎ-সংকটের মধ্যে সরকার দায়িত্ব নিল। তখন থেকে নানারকম নীতির পরিবর্তন করে সরকার বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার করে আজকের এ অবস্থায় পৌঁছেছে।’
অন্যদিকে বিদ্যুৎ জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০০৯ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করে। ইতোমধ্যে গ্রিডের বিদ্যুৎ ৯৯ ভাগ মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে। আশা করছি, আগামী মার্চের মধ্যে ১০০ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।’
একটা সময় ছিল, যখন সারা দেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। জেলার পর জেলা থাকত অন্ধকারে। বিদ্যুতের অভাবে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ বিভিন্ন উপকেন্দ্রে হামলা করত। হরতালসহ বড় আন্দোলনও হতো এই বিদ্যুতের দাবিতে।
সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। দেশ এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণ। ৯৯ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। মাথাপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষমতা ৫১২ কিলোওয়াট ঘণ্টা। তবে বিদ্যুৎ বিতরণে এখনও কমবেশি সমস্যা রয়েছে। ফলে কোনো কোনো স্থান থেকে এখনও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবর আসে।
বিষয়টি স্বীকার করছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নিজেও। তিনি বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছি। এখন আমাদের কোয়ালিটি সরবরাহের দিকে যেতে হবে। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছি।’
কেবল উৎপাদন ও সরবরাহ লাইনের উন্নতি নয়, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর অঙ্গীকার পূরণে প্রতিকূলতা আছে দেশের ভৌগলিক আবস্থানেও। দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বড়বড় নদী। সাগর মোহনায় আছে অসংখ্য দ্বীপ ও জনবসতি। সেসব স্থানে গ্রিডের বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়াও ছিল চ্যালেঞ্জ। শরীয়তপুরের চর আত্রা, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, ভোলার চরকুকরিমুকরি, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মতো স্থানগুলোতে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে সাবমেরিন কেবল প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়েছে।
দেশে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের পরিকল্পনা সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন দেশে ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ-সুবিধা পাচ্ছে। মুজিববর্ষের মধ্যে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কাজ চলছে। এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।’
৫০ বছরে বিদ্যুতের পথচলা
একেবারেই সহজ ছিল না ৫০ বছরের এই পথচলা। একাত্তরের মার্চে শুরু হওয়া বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সমগ্র বাংলাদেশ। ওই সময়ে ঠিক কত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল, তার বিশ্বাসযোগ্য কোনো হিসাব নেই সংশ্লিষ্ট বিভাগে।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৪৭৫ মেগাওয়াট। ১৯৭২ সালে দেশে স্থাপিত বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। এই ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন করা যেত না। এই সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এখন উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। যদিও বর্তমানে সংযোগ-চাহিদা আছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ সক্ষমতা দ্বিগুণ।
প্রায় ১২৫ বছর আগে ব্রিটিশ শাসিত পূর্ববঙ্গে গাজীপুর জেলার ভাওয়াল পরগনার রাজা প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। তিনি বিলেত থেকে জেনারেটর এনে রাজবাড়ি আলোকিত করেন।
এর পর ১৯০১ সালে ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর বাসভবনে একটি জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পর্যায়ক্রমে ঢাকার কয়েকটি অভিজাত ভবনকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়।
সরকারের জ্বালানি বিভাগ জানায়, উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি বিদ্যুৎ হলেও এ খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। স্বাধীনতার আগে থেকেই বিদ্যুৎ খাত ছিল সরকারনির্ভর। বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ছিল অত্যন্ত ঢিমেতালে। আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা এ খাতে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকে।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে এ খাতে কমবেশি বিনিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন সময়সাপেক্ষ। ফলে রাতারাতি এ খাতে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ সময় বিদ্যুৎ খাত বেসরকারি মালিকানার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আইপিপি অর্থাৎ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার নীতিমালা করা হয়। এ সরকারের আমলেই দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগ হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। বেসরকারি খাত থেকেই ১২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি করা হয়। বিদ্যুৎ খাতে এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এরপর ক্রমেই উৎপাদন বাড়তে থাকে। বর্তমানে বেসকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৮৯; উৎপাদন হয় ৯ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট। আর সরকারি খাতে কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৪; উৎপাদন হয় ৯ হাজার ৫৪৪ মেগাওয়াট।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় আরইবি অর্থাৎ রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড। উদ্দেশ্য ছিল দেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ করা। এটি বিদ্যুৎ খাতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ সংস্থার দায়িত্ব ছিল পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন নির্মাণ করা। এই বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে থাকে। কিন্তু উৎপাদন ঘাটতি থাকার কারণে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল খুবই কম। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে পল্লী অঞ্চলে বিতরণ অবকাঠামোও দ্রুত বাড়তে থাকে। এখন সারাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আছে। পাহাড়ি ও দুর্গম কিছু এলাকা ছাড়া সারাদেশেই পল্লী বিদ্যুতের লাইন আছে। বর্তমানে আরইবির গ্রাহকই ৩ কোটি ১১ লাখ। ৮০টি সমিতির মাধ্যমে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে এ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
একবিংশ শতকের শুরুতে ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের গতি আবারও শ্লথ হয়ে পড়ে। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কারণে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যদিও প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। ঘাটতির কারণে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ২০০৬ সালের মে মাস নাগাদ ১ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করে।
এ সময় বিদ্যুতের দাবিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। একই সময় রাজধানীর শনিরআখড়ায় হাজার হাজার এলাকাবাসী বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। বিদ্যুৎ অফিসে হামলা, আগুন, ভাঙচুর ছিল নিয়মিত ঘটনা।
এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরেও এ খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে বার বার পরিবর্তন আসে। কিন্তু এ খাতের চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এই সরকার জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার। ২০০৯ সালের শুরুতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। প্রকৃত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল যদিও ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট (৬ জানুয়ারি, ২০০৯)। এরপরই বিদ্যুৎ খাতে এক প্রকার বিপ্লব সূচিত হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ৩৮ বছরে যা হয়েছে, গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি উন্নতি হয়েছে। এই ১২ বছরকে বিদ্যুৎ খাতের সোনালি অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।
২০০৯ সালের শুরুতে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মাত্র ২৭টি। বর্তমানে ১৪৪টি। ১২ বছরে বেড়েছে ১১৭টি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াট। বেড়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। সঞ্চালন লাইন ছিল ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার; বর্তমানে ১২ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। বেড়েছে ৪ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। গ্রিড উপকেন্দ্র ছিল ১৫ হাজার ৮৭০টি। বর্তমানে ৪৯ হাজার ৩৮৪টি। বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫১৪টি। বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে ৬ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। বেড়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটার। বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। বর্তমানে ৩ কোটি ৯৬ লাখ। বেড়েছে ২ কোটি ৮৮ লাখ। সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বর্তমানে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কমেছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও এ অবধি সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। ব্যাখ্যা হলো, বিদ্যুৎ এমনই একটা পণ্য, এটা মজুদ করা যায় না। যখন যতটুকু উৎপাদন হয়, তখন ততটুকুই বিতরণ হয়ে যায়। সারা দেশে বর্তমানে যে সংযোগ আছে, (আবাসিক, বাণিজ্য, শিল্প মিলিয়ে) সেখানে সংযোগ চাহিদা ওই ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ কাঠামো সর্বোচ্চ ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ কোনো একদিন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বর্তমানে এর দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদন করার সুযোগ আছে। বর্তমানে চাহিদা বাড়লেও তা পূরণ করা কোনো সমস্যা হবে না। কারণ ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।
বিশ্লেষকরা জানান, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎপাদন-ক্ষমতা সবসময় কিছুটা উদ্বৃত্ত রাখা হয়। কারণ, যেকোনো সময় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল হয়ে পড়তে পারে।
মাস্টারপ্ল্যান ২০৪১
বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ নীতি অনুসরণ করা হয়। কারণ বিশ্ববাজারে বিভিন্ন রকম জ্বালানির মূল্য ওঠানামা করে। আমাদের দেশে এক সময় অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ছিল প্রাকৃতিক গ্যাস। এখন গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পারমাণবিক শক্তি, ডিজেল, পানি, সৌরশক্তি, বায়ু ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির কথা বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এ জন্য সোলার বা সৌর, বায়ু, পানির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান ভিশন-২০৩০ এ বলা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ মুখ্য জ্বালানির উৎস তৈরি করতে হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৫০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা মেটাতে হবে, যার ২৫ শতাংশ হবে কয়লা, ২০ শতাংশ হবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাকি ৫ শতাংশ হাইড্রো ও নবায়নযোগ্য শক্তি।
তবে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত মোকাবিলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে সরকার মাস্টারপ্ল্যানে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। এ ক্ষেত্রে কয়লাভিত্তিক ১০টি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল করে নবায়নযোগ্য ও গ্রিন এনার্জির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের নতুন মাস্টারপ্ল্যানকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত টার্গেট ধরা হয়েছে।
২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ৫২ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল ২৭ শতাংশ, ডিজেল ৬ শতাংশ, কয়লা ৮ শতাংশ, জল ১ দশমিক ১ শতাংশ, গ্রিড সোলার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ আমদানি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ভিশন ২০৩০-এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবেশ দূষণ ও এসডিজির দিকে লক্ষ্য রেখে সরকার মাস্টারপ্ল্যানে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জ্বালানি উন্নয়নে শীর্ষ ১০ এ বাংলাদেশ
ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিলের প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এনার্জি ট্রিলেমা ইনডেক্স-২০২০-এর তথ্য বলছে, জ্বালানি খাতের দ্রুত উন্নয়ন করছে এমন শীর্ষ দশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। জ্বালানি নিরাপত্তায় বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৩৯। একই মানদণ্ডে পরিবেশগত টেকসই বিষয়ে বাংলাদেশের স্কোর ৫৬ এবং জ্বালানি সরবরাহ ও প্রাপ্যতায় ৫০ দশমিক ৪। সদস্যভুক্ত ৮৪টি দেশসহ মোট ১৩৩টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই র্যাংকিং প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিল।
সংস্থাটি বলছে, জ্বালানি খাতের উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের জিডিপিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে।
জ্বালানি সরবরাহ বিবেচনায় গত পাঁচ বছরে মানসম্মত জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে বাংলাদেশে। এ সময়ে জ্বালানির প্রাপ্যতা বেড়েছে ৬ শতাংশ, সরবরাহ সক্ষমতা বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে ৯ শতাংশ।
সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেসারাট নিউজে নিবন্ধ লিখেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে গত বছর বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি। এতে প্রফেসর ইউনূস জানিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। আর নির্বাচন শেষেই তিনি রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে সেটির কোনো পদেই থাকবেন না বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
ড. ইউনূস লিখেছেন, ‘আমি স্পষ্ট করেছি : জাতীয় নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে। এরপর যে সরকার আসবে সেখানে নির্বাচিত বা নিযুক্ত করা কোনো পদে আমি থাকব না।’
তিনি বলেছেন, ‘আমার সরকারের মূল লক্ষ্য হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সঙ্গে তাদের পরিকল্পনাগুলো বলতে পারবে। আমাদের মিশন হলো, সব বৈধ ভোটার যেন তাদের ভোট দিতে পারে, যারা প্রবাসে আছেন তারাও। এটি একটি বড় কাজ। কিন্তু আমরা কাজটি সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
প্রফেসর ইউনূসের নিবন্ধটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
এক বছর আগে, এই মাসেই বাংলাদেশের হাজার হাজার সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষার্থী, যাদের পেছনে ছিল সমাজের সব স্তরের অগণিত মানুষের সমর্থন, আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যা শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল, তার মাধ্যমেই তারা একজন স্বৈরাচারকে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য করে।
এরপর যে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ছাত্রনেতারা আমাকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানায়। এই সরকারের দায়িত্ব ছিল দেশকে স্থিতিশীল করা এবং গণতন্ত্রের নতুন পথ তৈরি করা। শুরুতে আমি রাজি হইনি। কিন্তু যখন তারা জোর করল, তখন আমি তরুণদের জীবন উৎস্বর্গের কথা ভাবলাম, আমি তাদের ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট, সুশীল সমাজের নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা পরিষেদের সঙ্গে আমি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করি।
এই গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা থেকে। এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম ‘জেনারেশন জেড’ বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। এই বিপ্লব তরুণদের জন্য একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে, যা দেখায় কীভাবে তারা মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো—যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বৈষম্য—মোকাবিলার জন্য এগিয়ে আসতে পারে।
আমরা ভাগ্যবান যে তারা ‘তাদের পালা আসার জন্য’ অপেক্ষা করেনি। যখন সভ্যতা অনেক দিক থেকে ভুল পথে চালিত হচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।
স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে আমাদের উত্তরণের একটি স্পষ্ট প্রমাণ ছিল যখন দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকী বাংলাদেশকে তাদের ‘২০২৪ সালের সেরা দেশ’ হিসেবে ঘোষণা করে। আমরা তখন অর্থনীতি পুনর্গঠন, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং চুরি যাওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ উদ্ধারে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আমরা তখনো বুঝতে পারিনি বিশ্ব আমাদের এই অগ্রগতিকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করছে। ডেসারেট নিউজ আমাদের এই যাত্রার চমৎকার কাভারেজ দিয়েছে, যা আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি।
আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল গণঅভ্যুত্থানে যারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল এবং যারা গুরুতর আহত হয়েছিল—সেই হাজার হাজার পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। এরসঙ্গে আমরা বিগত সরকার ও তার সহযোগীদের লুট করা অর্থ উদ্ধারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে সাবেক স্বৈরাচারী সরকার বছরে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে। এই অর্থ পুনরুদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যখন আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন অব্যবস্থার মাত্রা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছিল না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছিল।
সরকারি কর্মচারীরা, যারা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য না দেখানোর কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তারা ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন।
ধীরে ধীরে আমরা পুনর্গঠন শুরু করেছি। যেসব রাজনৈতিক দল স্বৈরাচারের প্রতিরোধ করেছিল, তাদের পাশাপাশি নতুন গঠিত দলগুলোও নতুন ধারণা, শক্তি এবং কর্মপ্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সশস্ত্র বাহিনী, যারা ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের ওপর গণহত্যা চালাতে দেয়নি, তারা তাদের পেশাদারিত্ব বজায় রেখেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে।
আমি এটি স্পষ্ট করে দিয়েছি: আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি এরপরের সরকারের কোনো নির্বাচিত বা নিযুক্ত পদে থাকব না।
আমাদের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকসহ সব যোগ্য নাগরিককে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া একটি বিশাল কাজ। কিন্তু আমরা এটি সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন এনেছি। যেন আমাদের প্রতিবেশী এবং বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক জোরদার করা যায়।
বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির একটি মূল কেন্দ্র হতে পারে এবং হওয়া উচিতও। আমরা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞ।
রুবিওরে সঙ্গে সম্প্রতি আমার একটি ফলপ্রসূ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে, যা আমাদের উভয় দেশের বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক ছিল।
যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী এবং জাতিসংঘও আমাদের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। আমরা এই পথে একা নই।
নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের নিয়ে একটি ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছি। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি সাংবিধানিক সংশোধনী আনা। যা এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে যাতে বাংলাদেশ আর কখনো স্বৈরাচারী শাসনে ফিরে না যায়।
বাংলাদেশ যদি শেষ পর্যন্ত এমন একটি দেশে পরিণত হয় যেখানে দেশের সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। তবে তা হবে লাখ লাখ বাংলাদেশির দৃঢ়তা, কল্পনা এবং সাহসের ফল।
এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে যারা আছেন তাদের সকলের দায়িত্ব রয়েছে। তারাই আমাদের সর্বোত্তম আশা—এবং সম্ভবত আমাদের শেষ আশা।
সরকারি এবং কূটনীতিক পাসপোর্টে পারস্পারিক ভিসা অব্যাহতি সুবিধা পেতে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান।
প্রেস সচিব বলেন, ‘পাকিস্তানের মতো এ রকম চুক্তি আমরা আরও ৩১টি দেশের সঙ্গে করেছি। এই চুক্তি পাঁচ বছরের জন্য করা হবে । এর ফলে যারা অফিসিয়াল পাসপোর্ট এবং কূটনীতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন, তারা এখন বিনা ভিসায় পাকিস্তান সফর করতে পারবেন। একইভাবে পাকিস্তানের যারা অফিসিয়াল এবং কূটনীতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন— তারাও বাংলাদেশে সফর করতে পারবেন কোন ভিসা ছাড়াই। এটা একটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস।’
উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের সম্মতি পাওয়া গেছে।
উপদেষ্টা পরিষদের ৩৯তম বৈঠকে আজ ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে।
ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
বৈঠকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীগণের পারস্পরিক ভিসা অব্যাহতি চুক্তির খসড়া অনুমোদন করা হয়।
এছাড়া, উপদেষ্টা পরিষদকে সংস্কার কমিশনসমূহের সুপারিশ বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউছুফ উপস্থিত সকলের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যে গতিতে এগোচ্ছে আরও গতি বাড়াতে সমন্বয় টিমের মাধ্যমে কাজ করতে চাই। আমি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় সেবা দরিদ্র, দুঃস্থ, অসহায়, অসচ্ছল মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সকলের সহযোগিতা চাই। এজন্য আমরা সবাই একসাথে কাজ করবো।
তিনি আজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের সাথে পরিচিতি ও মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথা বলেন।
নতুন সচিব বলেন,
আমি এই মন্ত্রণালয়ের সুনাম কাজের মাধ্যমে, আইন কানুন মেনে মানুষের সেবা দ্রুত নিশ্চিত করতে আপনাদের সহযোগিতা চাই। তিনি বলেন, সচিবের রুম আপনাদের জন্য সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে এবং ফাইল দ্রুত নিষ্পত্তি করে কাজের যথার্থতা নিশ্চিত করবেন। আপনারা নির্ভয়ে কাজ করবেন, আমার সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি আমিও আপনাদের থেকে শিখতে চাই এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের নয়টি সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আয়োজন করা হচ্ছে জাতীয় নীতি প্রতিযোগিতা ২০২৫। জাতীয় নীতি প্রতিযোগিতা ২০২৫ এর প্রতিপাদ্য "বাংলাদেশ ২.০: তারুণ্যের নেতৃত্বে আগামীর পথে " নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা ধারণাপত্র জমা দিয়ে শুরু করবে এবং নির্বাচিত দলসমূহ পূর্ণাঙ্গ নীতিপত্র প্রস্তুত ও উপস্থাপনা করবে। বিজয়ীরা পুরস্কৃত হওয়ার পাশাপাশি তাদের নীতি প্রস্তাবগুলো সরকারিভাবে পলিসি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
নীতি প্রতিযোগিতার বিষয়গুলো হল-
১. রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
২. জুলাই পরবর্তীতে সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি: জাতীয় স্বার্থ ও বৈদেশিক সম্পর্কের পুনঃসংজ্ঞায়ন
৩. নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ: শিক্ষা ও দক্ষতার রূপান্তর
৪.দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সাংস্কৃতিক সংযোগ: জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশী তরুণদের ভূমিকা
৫. গুজব প্রতিরোধে বাংলাদেশের করণীয় ও বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি
৬. জুলাই গণভুত্থান ও সাংবিধানিক পুনর্গঠন: তরুণদের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ
৭.বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ: সম্ভাবনার ব্যবহার ও নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা প্রস্তুতি
৮. সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের পথে: ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
৯. চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: বাংলাদেশের উদ্বোধনী সম্ভাবনা ও প্রয়োগের ক্ষেত্র
রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী বিষয়সহ রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে তারুণ্যের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ অপরিহার্য। আমাদের কাঙ্ক্ষিত দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নীতিগতভাবে অগ্রসর হওয়া। তরুণদের চিন্তাপ্রক্রিয়া, মননশীলতা এবং গবেষণাধর্মী সক্ষমতাকে সামনে রেখে এক নতুন পরিবর্তনের সূচনা করা সম্ভব আর সেটি হতে হবে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় তারুণ্যের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে।
এ সময় যুব ও ক্রীড়া সচিব বলেন, এই প্রতিযোগিতা কেবল একটি প্রতিযোগিতা নয় এটি আগামী প্রজন্মের নেতৃত্বে বিনিয়োগ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তরুণদের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণই আমাদের রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেবে এবং বাংলাদেশ ২.০-কে বাস্তবায়নের ভিত্তি গড়ে তুলবে।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আজ বুধবার ইসির উপ-সচিব মো. মাহবুব আলম শাহ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে, যা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২৫’ কমিশনে অনুমোদিত হয়েছে এবং তা ২৬ জুন ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৮ (১) ও (২) অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রের তালিকা সংরক্ষণ ও চূড়ান্তকরণের জন্য গেজেটে কমপক্ষে ২৫ দিন পূর্বে তা প্রকাশ করার বিধান রয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে এলাকা ভিত্তিক ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশ, এই তালিকার ওপর দাবি/আপত্তি গ্রহণ এবং তা নিষ্পত্তির মাধ্যমে নীতিমালা অনুযায়ী চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কমিশন নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী : খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, দাবি/আপত্তি গ্রহণের শেষ তারিখ: ২৫ সেপ্টেম্বর, দাবি/আপত্তি নিষ্পত্তির শেষ তারিখ: ১২ অক্টোবর, সম্ভাব্য চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ: ২০ অক্টোবর।
উল্লেখিত সময়সূচি অনুযায়ী এবং ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা অনুসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে জেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্ধারিত ছকের আলোকে খসড়া ও সম্ভাব্য চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাগত তথ্য (সফটকপিসহ) আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন সহায়তা-১ শাখায় পাঠাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, সারাদেশ জলাশয়গুলো চিহ্নিত করে দেশি মাছের প্রজাতি রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন জলাশয়ে মাছের নানান প্রজাতি রয়েছে। এসব জলাশয় চিহ্নিত করে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করতে হবে।
উপদেষ্টা বুধবার (২০ আগষ্ট) রাজধানীর ফার্মগেটে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে 'টেকসই মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনায় অভয়াশ্রমের গুরুত্ব ও ভবিষ্যত করণীয়' -শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথা বলেন। সেমিনারটির আয়োজন করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, অভয়াশ্রম গড়ে তোলা ও রক্ষা করা মৎস্যসম্পদ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখানে আগে নীতি-নির্ধারণীতে হয়তোবা মনোযোগ কমছিল। তাই আমরা এখাতে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের মুক্ত জলাশয় গড়ে তুলতে যা করণীয় তা করতেই হবে।
জিনগত বিলুপ্তি রোধ করা দরকার উল্লেখ করে মৎস্য উপদেষ্টা বলেন, মাছের প্রজাতিগুলো রক্ষা করা এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং আন্তর্জাতিক মৎস্যসম্পদের প্রয়োজনে করতে হবে। কারণ আমরা প্রাকৃতিকভাবে এমন স্থানে রয়েছি যেখানে মাছ না খেয়ে বাঁচার উপায় নেই।
৪১ প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনা হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, দেশে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। সেখানে বিএফআরআইর গবেষণার ফলে ৪১ প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
মাছ শিকারে বিষ ও বিদ্যুতের ব্যবহারকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ কত নিষ্ঠুর তারা মাছ শিকারে বিষ ও বিদ্যুতের ব্যবহার করছে। এটি হচ্ছে মানুষের লোভ ও তাৎক্ষণিক লাভের কারণে।
প্লাস্টিকদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মৎস্যসম্পদ ধ্বংসের পেছনে পানি ও প্লাস্টিকদূষণ অন্যতম ক্ষতির কারণ। সম্প্রতি প্লাস্টিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কোন সমঝোতায় আসতে পারেনি। প্লাস্টিক চুক্তি মানুষের পক্ষে ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় বাংলাদেশও স্বাক্ষর না করে চলে এসেছে।
বিএফআরআইর মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্রের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. তোফাজ্জেল হোসেন, সম্মানিত অতিথি ছিলেন মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ফারাহ শাম্মী ও মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএফআরআইর ঊধ্বর্তন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মশিউর রহমান। এসময় বিএফআরআই এর বিজ্ঞানীবৃন্দ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, মৎস্যজীবী ও সুধীজন উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য