মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে, সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যুদ্ধ বিরতি করা যায় কি না।
৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এম এ মালিক অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির সুপারিশসহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে বার্তা পাঠান। ইয়াহিয়া খান বিষয়টি ঠেলে দেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে। বলেন, এ ব্যাপারে গভর্নরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে যিনি রাজি করিয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব।
জ্যাকবের ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ আছে পুরো ঘটনাপ্রবাহ।
জ্যাকব লেখেন, সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গভর্নরের এই বৈঠকের পরিকল্পনা তারা জেনে গিয়েছিলেন। আর ১৪ ডিসেম্বরের এই বৈঠক হামলা করে তারা ভেস্তে দেন। এই হামলা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব অংশের মনোবল ভেঙে পড়বে বলে তাদের ধারণা ছিল। আর হয়েছেও তা।
তখনকার পুরোনো গভর্নর হাউসে জ্যাকবের ভাষায়- ‘ছেলের হাতের মোয়ার মতো’ অনায়াস এই হামলার পর পরিস্থিতি একেবারেই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
পাকিস্তানের চেষ্টা ছিল যুদ্ধবিরতির
১৩-১৪ ডিসেম্বরের রাতে নিয়াজী পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল হামিদের সঙ্গে কথা বলে তাকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার অনুরোধ করেন। ১৪ ডিসেম্বর নিয়াজীর কাছে এক বার্তা পঠিয়ে ইয়াহিয়া অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
নিয়াজীকে পাঠানো ইয়াহিয়ার বার্তাটি ছিল: ‘প্রবল প্রতিকূলতার মুখেও আপনারা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। জাতি আপনাদের নিয়ে গর্বিত এবং সারা পৃথিবী প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানকল্পে মানুষের পক্ষে সম্ভব এমন সব পদক্ষেপই আমি গ্রহণ করেছি। বর্তমানে এমন একপর্যায়ে আপনারা পৌঁছেছেন যে, এরপরে প্রতিরোধের যেকোনো প্রচেষ্টাই হবে অমানুষিক এবং সেটা কার্যকরীও হবে না ; বরং তা আরও প্রাণহানি ও ধ্বংসেরই কারণ হবে। এই অবস্থায় আপনাদের উচিত হবে যুদ্ধ বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্য এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত সহযোগীর জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সমরাভিযান বন্ধ করে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর এবং অন্যান্য জনসাধারণ যারা দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে, তাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারতকে অনুরোধ করার জন্য আমি ইতিমধ্যেই জাতিসংঘে তৎপরতা চালিয়েছি।’
এই বার্তাটি ভারতীয়রা পেয়ে যান বিকেল ৩টায়। এরপর নিয়াজী ও রাও ফরমান আলি ইউনাইটেড স্টেটস কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভ্যাকের সঙ্গে দেখা করতে যান। স্পিভ্যাককে নিয়াজী যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। জবাবে স্পিভ্যাক বলেন, বিষয়টি তার এখতিয়ারের বাইরে। তার পরও তিনি একটি বার্তা পাঠাবেন।
রাও ফরমান আলি বার্তাটির খসড়া তৈরি করে স্পিভ্যাককে দেন। এতে বলা হয়:
ক্রমবর্ধমান প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের যবনিকাপাতের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সম্মানজনক শর্তসাপেক্ষে আমরা যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ইচ্ছুক:
ক . যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে যাবতীয় সামরিক অভিযান বন্ধ হবে।
খ . পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার জাতিসংঘের গৃহীত ব্যবস্থা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তরিত হবে।
গ . যে বিষয়গুলোয় জাতিসংঘ নিশ্চয়তা দেবে, সেগুলো হলো:
১. পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারেনি, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর এমন সকল সদস্যের নিরাপত্তা।
২. সকল পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক ও সরকারি চাকরিজীবী, যারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি, তাদের নিরাপত্তা।
৩. ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অস্থানীয় জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিরাপত্তা।
৪. মার্চ ১৯৭১ থেকে যারা পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন অথবা সরকারকে সহায়তা করেছেন এবং পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার নিশ্চয়তা।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (পরে শেরাটন) গভর্নরের কাছে ফরমান আলি এই বার্তার একটি অনুলিপি পাঠান। বার্তাটি ভারতে না পাঠালেও ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়। ১৪ ডিসেম্বর আনুমানিক বিকেল ৫টায় কলকাতায় কনস্যুলার অফিসের একজন কূটনীতিক স্পিভ্যাকের সঙ্গে নিয়াজীর ভাষায় যুদ্ধবিরতি অথবা আত্মসমর্পণের প্রস্তাবনা নিয়ে তার আলোচনার কথা জেনারেল জ্যাকবকে জানান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলকাতায় জাতিসংঘের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনকে ফোন করেন। কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারেননি।
জ্যাকব তার বইয়ে লেখেন, ‘জেক, সত্যি বলছি, নিয়াজির অনুরোধ সম্পর্কে আমি আসলেই কিছু জানি না।’
এরপর জ্যাকব ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেক শকে ফোন করে তাকে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন।
জেনারেল মানেক শ আলোচনা করে তাকে জানান, স্পিভ্যাককে করা কোনো অনুরোধ সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
জেনারেল মানেক শ বার্তাটি পান ১৫ ডিসেম্বর। তিনি নিশ্চয়তা দেন, পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এ বিষয়ে পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
পাকিস্তানি কমান্ডার-ইন-চিফ এই শর্ত গ্রহণ করার জন্য নিয়াজীকে সংকেত দেন। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরদিন বেলা ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির জন্য উভয়পক্ষ রাজি হয়। পরে এই মেয়াদ বেলা ৩টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
আত্মসমর্পণ তবে নাম যুদ্ধবিরতি রাখার চেষ্টা
জ্যাকব লেখেন, ‘যতটা বোঝা যায়, ইয়াহিয়া যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিলেন, যেটা ছিল আত্মসমর্পণেরই নামান্তর।
পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা হাসান জহির তার ‘দ্য সেপারেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান বইতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানিরা 'আত্মসমর্পণ' শব্দটি পরিহারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।
ঢাকায় আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনার সময় নিয়াজী আশা করেছিলেন, স্পিভ্যাককে দেয়া তাঁর প্রস্তাবনা অনুযায়ী দলিল তৈরি করা হবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ঢাকায় আত্মসমর্পণের দলিল দেখার পরে সেটা গ্রহণ করতে নিয়াজীর অনীহা দেখা যায়।
আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি
১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় জ্যাকবকে ফোন করেন জেনারেল মানেক শ। তিনি অবিলম্বে ঢাকায় গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে বলেন।
সুনির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়ে কী কাঠামোতে আলোচনা করবেন, এই প্রশ্নের জবাব জ্যাকবকে দেননি মানেক শ। কেবল ‘বেশি ঝামেলা বাধাতে’ নিষেধ করেন। বললেন যে, কী করতে হবে, এটা তিনি ভালোই বোঝেন।
এর মধ্যে নিয়াজী রেডিও বার্তায় জ্যাকবকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান। তবে জ্যাকব জানিয়ে দেন তিনি যেতে তেমন আগ্রহী নন।
এরপর জ্যাকব ব্রিফ করেন বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত সিং অরোরাকে। তিনি প্রস্তুতি নেন ঢাকায় যাওয়ার। সঙ্গে নেন কর্নেল ইন্টেলিজেন্স খারা ও অ্যাডভান্স হেডকোয়ার্টার্সের এয়ার কমোডর পুরুষোত্তমকে।
এর আগে আত্মসমর্পণের দলিলের যে খসড়াটি অনুমোদনের জন্য দিল্লিতে পাঠানো হয়, সেটার একটা কপি সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন জ্যাকব।
জ্যাকব ঢাকায় আসেন যশোর হয়ে। সে সময় মুক্তাঞ্চল এই জেলায় হেলিকপটার পাল্টান তিনি। তখন সেনা সদর দপ্তর থেকে তাকে একটি বার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, সরকার তাকে নিয়াজীর লাঞ্চের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
ঢাকার এয়ারফিল্ডের প্রবেশমুখে এসে আমরা জ্যাকব একটি হেলিকপ্টারকে চলে যেতে দেখেন। টারম্যাকে তখন ১৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিমানবিধ্বংসী একটি কামান হেলিকপ্টারের দিকে নিশানা করা ছিল।
এর মধ্যেই হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের চিফ অফ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী তখন দেখা করেন জ্যাকবের সঙ্গে। ঢাকায় জাতিসংঘ প্রতিনিধিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় তার অফিস ব্যবহারের প্রস্তাব দেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি। কিন্তু জ্যাকব তা চাননি। তিনি পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তাদের সঙ্গে হালকা ছলে আলোচনা করতে করতে সদর দপ্তরে যান।
প্রতিশোধের স্পৃহায় মুক্তিযোদ্ধারা
জ্যাকব লেখেন, পাকিস্তানি সদর দপ্তরে যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনী তাদের থামায়। তারা খুবই উত্তেজিত মেজাজে ছিল। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিদেশি সংবাদ সংস্থার কয়েকজন প্রতিনিধি।
জ্যাকব তখন তাদের জানান, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে।
এই খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা খুবই উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। বলতে থাকে, পাকিস্তানি কমান্ডের সদর দপ্তর দখল করে নিয়াজী ও তার সঙ্গীদের ‘পাওনা’ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে চায়।
এটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে জ্যাকবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেন, বিনা রক্তপাতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এবং এই সরকারের সদস্যরা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য শিগ্গির ঢাকায় এসে পৌঁছবেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে বা কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা যাতে না নেয়া হয়, সেটি মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিত করতে বলেন জ্যাকব। বলেন, যুদ্ধবিরতি যেহেতু কার্যকর হয়েছে এবং পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে, জেনেভা কনভেনশনের প্রতি সম্মান দেখাতেই হবে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা রাজি ছিল না। তারা স্লোগান দিতে থাকে এবং হুমকি দেয় যে, তারা কারও তোয়াক্কা করে না এবং তারা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করবে।
তখন জ্যাকব তাদের বলেন, জেনেভা কনভেনশনের ধারা যেন যথাযথভাবে অনুসৃত হয়, সেটি তারা নিশ্চিত করবেন।
এর পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যেতে দেয় এবং বেলা ১টায় জ্যাকবরা সেনা সদর দপ্তরে পৌঁছেন।
নিয়াজীর সঙ্গে কী কথা
নিয়াজী তার অফিসে স্বাগত জানান জ্যাকবকে। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিষয়ের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, মেজর জেনারেল জামশেদ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, বিমানবাহিনীর এয়ার কমোডর ইমাম ও ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী।
জ্যাকব তখন নিয়াজীকে বলেন, টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় তখনও সংঘর্ষ চলছে। তার উচিত লড়াই বন্ধের জন্য তার বাহিনীর প্রতি অর্ডার ইস্যু করা।
নিয়াজী যখন অর্ডার ইস্যু করছেন, তখন জ্যাকব তার কাজে মন দেন। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য ঢাকায় এনে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘরোয়া পরিবেশে আত্মসর্পণের প্রস্তাব করলেও জ্যাকব চিন্তা করেন উল্টোটা।
তিনি তার বইয়ে লেখেন, ‘আমি মনে করি, এতদিন যারা নির্যাতিত নিপীড়িত হয়েছে, সেই জনগণের সামনে প্রকাশ্যেই এই আত্মসমর্পণ হওয়া উচিত।’
কিন্তু এর জন্য পর্যাপ্ত সময়ের অভাব ছিল। দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত আলোচনা, সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।
জ্যাকব নিয়াজীকে তাদের প্যারাশুট রেজিমেন্ট ও একটি পাকিস্তানি ইউনিট দিয়ে মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে গার্ড অফ অনারের আয়োজন করতে বলেন। সেই সঙ্গে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করতে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলেন।
এর মধ্যে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তারা ঢাকায় আসতে থাকেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের অভ্যর্থনা জানাতে জ্যাকব আবার বিমানবন্দরে যান। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য বিমানবন্দরে একটি দল পাঠানোর নির্দেশও দেন।
শর্ত শুনে নিয়াজীর চোখ ছল ছল
এরপর জ্যাকব আবার নিয়াজীর অফিসে ফিরে গেলে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান।
জ্যাকব লেখেন, ‘নিয়াজীর চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।’
পাকিস্তানিদের আশা ছিল, ১৪ ডিসেম্বরে স্পিভ্যাককে দেয়া তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই দলিল হবে, যেটাতে জাতিসংঘের দেয়া ব্যবস্থা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ও প্রত্যাবর্তন কার্যকর করা হবে।
রাও ফরমান আলী সে সময় ভারতীয় ও বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
জ্যাকব জানান, তারা যে আত্মসমর্পণের দলিলটি তৈরি করেন, সেটি যেন অপমানজনক না হয়, সেটি নিশ্চিতের চেষ্টা করেছেন।
তিনি লেখেন, ‘ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, অনমনীয় নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ পরবর্তীতে সুফল বয়ে আনেনি। পরাজিত প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা না করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতে যা কিছুই ঘটুক না কেন, কিছুটা ছাড় তাদের অবশ্যই দেয়া উচিত।’
নিয়াজীকে জ্যাকব বলেন, সৈনিকের প্রাপ্য সম্মান তারা পাবেন এবং জেনেভা কনভেনশন কঠোরভাবে পালন করা হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দেন তারা।
তিনি লেখেন, ‘এ ধরনের নিশ্চয়তা ও ধারা ইতিহাসের অন্য কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে নেই।’
এরপর নিয়াজী দলিলটি অন্যদের পড়ার জন্য এগিয়ে দেন। তারা এর কিছু পরিবর্তন দাবি করেন।
জ্যাকব তাদের বলেন, এর শর্তগুলো যথেষ্ট উদার।
এরপর জ্যাকব ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে আবার কথা হয় নিয়াজীর সঙ্গে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন, দলিলটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না। কোনো মন্তব্য না করে তিনি কাগজটা ফেরত দেন। সেটাকেই নিয়াজীর সম্মতি হিসেবে ধরে নেন জ্যাকব।
এরপর আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া নিয়ে নিয়াজির সঙ্গে আলোচনা হয়। নিয়াজী তখনও তার অফিসেই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তাব দেন। কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা জানিয়ে দেন জ্যাকব।
‘এটা ঠিক নয়’ বলে নিয়াজী প্রতিবাদ করেন।
তখন জ্যাকব তাকে বলেন, ভারতীয় ও পাকিস্তানি ডিটাচমেন্ট লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোরাকে গার্ড অফ অনার দেবে। এর পর অরোরা ও নিয়াজী দলিলে সই করবেন। সবশেষে নিয়াজী তার তরবারি সমর্পণ করবেন।
নিয়াজী জানালেন, তার কোনো তরবারি নেই।
জ্যাকব বলেন, সে ক্ষেত্রে তিনি তার পিস্তল সমর্পণ করবেন।
নিয়াজী অসন্তুষ্ট হলেও নীরব ছিলেন।
এরপরে নিয়াজী জিজ্ঞেস করেন, তার অফিসার ও সৈনিকেরা তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সঙ্গে রাখতে পারবে কি না। এই অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দেন জ্যাকব।
এরপর আত্মসমর্পণের পর তার লোকজনের নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হবে- সে প্রশ্ন রাখেন নিয়াজী। জ্যাকব তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তাদের সৈন্যরা শহরে ঢুকতে শুরু করেছে এবং ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি তারা সঞ্চার করতে পারবেন।
এরপর নিয়াজী বলেন, মুক্তিবাহিনীর হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র আছে, সেহেতু পর্যাপ্ত ভারতীয় সৈন্য এসে না পৌঁছা পর্যন্ত পাকিস্তানিরা নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখতে পারবে কি না।
জ্যাকব বলেন, এটা তারা পারবেন। এ কারণে আত্মসমর্পণের পরেও পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করা হয়নি এবং এ সিদ্ধান্ত সমালোচিতও হয়।
শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি রেডিও দিয়েই জ্যাকব তাদের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে জানান, আত্মসমর্পণের সমস্ত ব্যবস্থা হয়েছে। সবাই যেন ঢাকায় চলে আসে।
নিয়াজীর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা
জ্যাকব মধ্যাহ্নভোজ সারেন নিয়াজীর সঙ্গে। এরপর বিকেল ৩টায় তাকেও বিমানবন্দরে যেতে বলেন। সামনে পাইলট- জিপ নিয়ে নিয়াজীর গাড়িতে করেই সেখানে যান।
কিন্তু সেখানে সমস্যার সূত্রপাত হয়। মুক্তিবাহিনী তাদের এয়ারফিল্ডে যেতে বাধা দেয়। তাদের কেউ কেউ গাড়ির বনেটের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তখন গাড়িতে শিখ সেনা কর্মকর্তা খারা থাকায় সুবিধা হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন যে, নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি এবং তাদের বাধা দেয়া উচিত হচ্ছে না।
তখন চার দিকে হালকা অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
জ্যাকব লেখেন, ‘এয়ারফিল্ডে নিয়াজীর নিরাপত্তা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। পাইলট-জিপে পাকিস্তানি মিলিটারি পুলিশের হাতে ছিল রিভলভার। কিন্তু দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো ভারতীয় সৈন্যের দেখা নেই।
খারাকে তখন জ্যাকব বলেন যে, তা উচিত হবে কিছু ভারতীয় সৈন্য, সম্ভব হলে কিছু ট্যাংক সংগ্রহ করা।
কিছুক্ষণ পর এক ট্রাক মুক্তিবাহিনী রানওয়ের অন্য পাশে এসে থামে। এদের মধ্যে কাঁধে মেজর জেনারেল র্যাংকের ব্যাজ লাগিয়ে কাদের সিদ্দিকী এগিয়ে যান।
জ্যাকব লেখেন, “এই লোকটিই 'বাঘা' সিদ্দিকী, যাঁকে আমি তাঁর সম্পর্কে - শোনা বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে চিনতে পারি।”
বিপদের গন্ধ পেয়ে নিয়াজীকে আড়াল করার জন্য প্যারাট্রুপার দুজনকে নির্দেশ দিয়ে কাদের সিদ্দিকীর দিকে এগিয়ে যান জ্যাকব। তিনি আশঙ্কা করছিলেন কাদের সিদ্দিকী হয়তো নিয়াজীকে গুলি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আত্মসমর্পণের জন্য নিয়াজীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল অবশ্যম্ভাবী।
জ্যাকব যখন কাদের সিদ্দিকীকে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে বলেন, সে সময় তিনি তা মানতে চাননি। কিন্তু পরে চলে যান। এর সামান্য পরে একটি ট্যাংক নিয়ে হাজির হন খারা।
বিকেল সাড়ে চারটায় ভারতীয় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা পাঁচটি এমআই ফোর ও চারটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পৌঁছেন। সেই দলে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপ প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারও।
নিয়াজী ও জ্যাকব তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান।
এরপর সেখান থেকেই সবাই গাড়িতে করে রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দিকে যাত্রা করেন। সেখানে গার্ড অফ অনার পরিদর্শনের পর জেনারেল অরোরা ও নিয়াজী টেবিলের দিকে এগিয়ে যান।
আত্মসমর্পণের সময় নিয়াজীর চোখে জল
অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল তখন টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজী সেটা আরেক বার পড়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন।
এরপর নিয়াজি তার কাঁধ থেকে সেনা অধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ খুলে ফেলেন এবং ল্যানিয়ার্ড (ছোট দড়িবিশেষ) সহ ৩৮ রিভলবার অরোরার হাতে তুলে দেন করেন।
তখন নিয়াজীর চোখে জল দেখা যাচ্ছিল বলে উল্লেখ করেন জ্যাকব।
তিনি লিখেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা তখন নিয়াজী ও পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান ও গালি দিতে থাকে।’
রেসকোর্সের আশেপাশে তেমন কোনো সৈন্য না থাকায় নিয়াজীর নিরাপত্তা আবার শঙ্কিত হয়ে পড়েন জ্যাকব। তখন কয়েকজন সিনিয়র অফিসার মিলে নিয়াজীর জন্য একটি বেষ্টনী রচনা করে তাঁকে পাহারা দিয়ে একটি ভারতীয় জিপের কাছে নিয়ে যান।
সেখানে পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করাসহ নানা বিষয়ে ব্রিফ করার পর আগরতলায় যাওয়ার উদ্দেশে বিমানবন্দরে ফিরে যান জ্যাকব।
সে সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ অ্যাডমিরাল কৃষ্ণণকে বিদায় জানাতে আসেন। শরিফকে কৃষ্ণণ পিস্তল সমর্পণ করতে বললে তিনি হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে কৃষ্ণণের হাতে তুলে দেন। এর জ্যাকবদের আমাদের হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ে।
সেই অস্ত্রটি নিয়াজীর ছিল না
আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পর নিয়াজীর সমর্পণ করা রিভলবারটি পরীক্ষা করেন জ্যাকব। তখন বুঝতে পারেন, অস্ত্রটি নিয়াজীর নয়। এটা একটা সাধারণ আর্মি ইস্যু পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলবার। ময়লা দিয়ে এর ব্যারেল বন্ধ হয়ে আছে এবং মনে হয়, বেশ কিছুদিন এটা পরিষ্কারও করা হয়নি। ল্যানিয়ার্ডটিও নোংরা, ঘর্ষণের ফলে কয়েকটি জায়গা ছিঁড়ে গেছে।
জ্যাকব তার বইয়ে লিখেন, ‘কোনো কমান্ডিং জেনারেলের ব্যক্তিগত অস্ত্র হতে পারে না। বরং মনে হয়, নিয়াজী এটা তাঁর কোনো মিলিটারি পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অস্ত্র হিসেবে সমর্পণ করেছেন।’
তিনি লিখেন, ‘আমার মনে হলো, নিয়াজির ভাগ্যে যা ঘটেছে, সেটা তাঁর প্রাপ্য ছিল।’
আরও পড়ুন:২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল আগামী রোববার শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসবে।
আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আজ জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চে শুনানির জন্য আপিলটি ছিলো। কিন্তু এই মামলায় হাইকোর্টের অথর জাজ বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান আজ আপিল বিভাগের বেঞ্চে ছিলেন।
নিয়ম অনুযায়ী হাইকোর্টে রায় দানকারী বিচারপতি একই মামলা আপিল বেঞ্চে শুনানি গ্রহণ করতে পারেন না।
এজন্য আগামী রোববার পুনর্গঠিত বেঞ্চে আপিলটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসবে। আদালত বিষয়টিতে আজ নট টুডে আদেশ দিয়েছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত ও বহু মানুষ আহত হন। ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সিআইডি এই মামলার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিলে শুরু হয় বিচার।
তবে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই মামলায় অধিকতর তদন্তে আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে।
দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত মামলার রায় দেন।
আলোচিত ওই রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন- আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি’র সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জল, এনএসআই-এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ও হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ।
বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। সে রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামীরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই ও রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
এছাড়া, বিচারিক আদালতের রায়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআই-এর মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপি’র সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডি’র সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ ও সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এই মামলার আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
বিচারিক আদালতে এই রায়ের দেড় মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্সসহ মামলার নথি হাইকোর্টে আসে। ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল শুনানি শুরু হয়। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি চলছিল।
তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনর্গঠন হলে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হয়। শুনানি শেষে গত ১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট এই মামলার সব আসামীকে খালাস দিয়ে রায় দেন। সে রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
ভূমিকম্পটি শুক্রবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে অনুভূত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের ডেটা অনুযায়ী, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের সাগাইংয়ের ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে।
এ ভূমিকম্পে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত বৃহত্তম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সাহায্য কমে যাওয়ার ফলে সংকট আরও গভীর হওয়ার উদ্বেগের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, তারা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ৭৩ মিলিয়ন (সাত কোটি ৩০ লাখ) ডলার নতুন আর্থিক সহায়তা দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক্সে একটি পোস্টে বলেন, ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিওইএফ) মাধ্যমে এ খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা ১০ লাখেরও বেশি মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদান করবে।
‘এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদাররা এ ধরনের জীবন রক্ষাকারী সহায়তার মাধ্যমে বোঝা ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গে যুক্ত।’
সিনহুয়া জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার প্রশাসন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডার অংশ হিসেবে বিদেশি সহায়তায় ব্যাপক কাটছাঁট এবং ফেডারেল ব্যয় ব্যাপকভাবে হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কিছু অংশ ভেঙে ফেলার বিস্তৃত প্রচেষ্টার মধ্যেই এ অনুদান দেওয়া হলো।
জাতিসংঘের দুটি সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছিল যে, তহবিলের ঘাটতি গত আট বছর ধরে প্রতিবেশী মিয়ানমারে সহিংসতার কারণে পালিয়ে আসা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য রেশনের পরিমাণ কমিয়ে দেবে।
রোহিঙ্গারা আশঙ্কা করছেন, তহবিল হ্রাসের ফলে ক্ষুধা পরিস্থিতির অবনতি হবে। গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা এবং জ্বালানি হ্রাস পাবে।
পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় সহায়তা প্রদানকারী দেশ ছিল। প্রায় ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়ে আসছে দেশটি। কিন্তু জানুয়ারিতে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর সাম্প্রতিক তহবিল স্থগিত করার ফলে কমপক্ষে পাঁচটি হাসপাতাল তাদের সেবা কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে।
ট্রাম্প ও বিলিয়নেয়ার মিত্র ইলন মাস্ক প্রধান মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছেন এবং এর অবশিষ্টাংশগুলোকে পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে একীভূত করেছেন। শত শত কর্মী এবং ঠিকাদারকে বরখাস্ত করেছেন এবং কোটি কোটি ডলারের পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছেন, যার ওপর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ নির্ভরশীল।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফেব্রুয়ারিতে সমস্ত জীবন রক্ষাকারী সহায়তা এবং এ ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় যুক্তিসঙ্গত প্রশাসনিক খরচ মওকুফ করেছিলেন।
ওয়াশিংটন টাইমস জানায়, এ মাসের শুরুতে ইউএসএআইডি ভেঙে দেওয়ার তত্ত্বাবধানকারী ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যায়ক্রমে সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব করেছিলেন।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে।
কক্সবাজার উপকূলের বিভিন্ন শিবিরের বাসিন্দারা এখন জনপ্রতি মাসিক ১২ ডলার করে খাদ্য বরাদ্দ পাবেন, যা আগের ১২ দশমিক ৫০ ডলার থেকে কম।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘ডব্লিউএফপি একটি চিঠিতে এই সিদ্ধান্তের কথা আমাদের জানিয়েছে, যা ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।’
তিনি আরও বলেন, ভাসানচরে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা জনপ্রতি ১৩ ডলার করে পাবে, যা কক্সবাজারের তুলনায় এক ডলার বেশি।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমানোর পরিকল্পনা ডব্লিউএফপি পূর্বে জানানোর পর এ পরিবর্তন এসেছে।
গত ৫ মার্চ বাংলাদেশের শরণার্থী কমিশন ডব্লিউএফপি থেকে একটি চিঠি পায়, যেখানে বলা হয়, তহবিল সংকটের কারণে এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাদ্য বরাদ্দ জনপ্রতি ১২ দশমিক ৫০ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলার করা হবে।
চিঠিতে শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন।
তার সফরের সময় তাকে ছয় ডলারে রোহিঙ্গারা কী খাবার পাবে তার বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করা হয়েছিল। সে সময় অপর্যাপ্ত পরিমাণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার শ্রমিকদের পাওনা বেতন-ভাতাসহ যৌক্তিক দাবির ব্যাপারে সরকার আন্তরিক ও একমত বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার শ্রমিকদের পাওনা বেতন-ভাতাদিসহ যৌক্তিক দাবির ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক ও একমত। শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং এ ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে মালিকপক্ষ ও বিজিএমইএকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং তাদের কর্মকাণ্ড মনিটর করা হচ্ছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘অন্যায্য ও অযৌক্তিক দাবির নামে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি, অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ, নৈরাজ্য ও সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং তা কখনোই মেনে নেয়া হবে না।
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় সরকার তা কঠোরভাবে প্রতিহত করবে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প কলকারখানায় সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা এবং দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে সরকার এ বিষয়ে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ উভয়ের সহযোগিতা কামনা করছে।’
আরও পড়ুন:পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আন্তসীমান্ত বায়ুদূষণ মোকাবিলায় কার্যকর আঞ্চলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের বায়ুদূষণের ৩০-৩৫ শতাংশ আসে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে। তাই এ সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক আলোচনার গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জরুরি।
তিনি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর কাঠমান্ডু রোডম্যাপ ও অন্যান্য সমঝোতার কথা উল্লেখ করে বলেন, এগুলো যথেষ্ট নয়, আরও জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন।
কলম্বিয়ার কার্টাগেনায় অনুষ্ঠিত ডব্লিউএইচওর দ্বিতীয় বৈশ্বিক সম্মেলনের বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া সাইড ইভেন্টে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে পরিবেশ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
ঢাকাস্থ বাসভবন থেকে সংযুক্ত হয়ে তিনি বাংলাদেশের বায়ুদূষণ সমস্যা, বিশেষ করে ঢাকার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন।
উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশের বহুমাত্রিক বায়ুদূষণ সমস্যা মোকাবিলায় বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা ডব্লিউএইচওর অন্তর্বর্তীকালীন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ আইনি বিধিমালায় দূষণকারী খাতগুলোর জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
তিনি জানান, ২০২৪ সালে চূড়ান্ত হওয়া জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পিছিয়ে ছিল, তবে এখন তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো মানুষের দূষণজনিত ঝুঁকি কমানো ও পরিষ্কার বায়ুর দিন বৃদ্ধির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
পরিবেশ উপদেষ্টা আরও জানান, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রকল্প চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যা সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে শিগগিরই বাস্তবায়ন শুরু হবে। এ প্রকল্প নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করা, আইন প্রয়োগ জোরদার করা, শিল্প কারখানায় দূষণ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং গণপরিবহন খাত আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্ব দেবে।
তিনি ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলোকে ইটভাটামুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার পরিকল্পনার কথা জানান, যেখানে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ থাকবে।
এ ছাড়া ২০২৫ সালের মে থেকে পুরনো বাস ধাপে ধাপে তুলে দেওয়া হবে, যা পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে।
তিনি বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ ধুলাবালি দূষণ রোধে ঢাকা শহরের খোলা সড়কগুলোতে সবুজায়নের উদ্যোগ এবং রাস্তা পরিস্কারে আরও শ্রমিক নিয়োগের পরিকল্পনার কথা জানান।
উপদেষ্টা জানান, অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযানের ফলে এরই মধ্যে বায়ুমানের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এ অগ্রগতি ধরে রাখতে কঠোর নজরদারি ও খাতগুলোর আধুনিকায়ন জরুরি।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যায় এবং ঢাকার মতো দূষিত শহরগুলোতে মানুষের গড় আয়ু ৫-৭ বছর কমে যাচ্ছে। এই সংকট আমাদের সবার জন্য, আমাদের শিশু, বাবা-মা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি। নিষ্ক্রিয়তার মূল্য অনেক বেশি। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী। কারণ আমি বিশ্বাস করি, এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রযুক্তি ও বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের হাতে রয়েছে, শুধু প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়ন দরকার।
‘বায়ুদূষণ শুধুই পরিবেশগত ইস্যু নয়, এটি মানবিক সংকট।’
সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি, পরিবেশ ও জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারক, আন্তর্জাতিক ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, গবেষক, স্থানীয় প্রশাসন, পরিবহন ও শিল্প খাতের বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তারা দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ রোধে যৌথভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
আরও পড়ুন:পবিত্র লাইলাতুল কদর বা শবে কদর বৃহস্পতিবার। এর অর্থ ‘অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত’ বা ‘পবিত্র রজনী’।
আজ সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হবে কদরের রজনী।
যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে সারা দেশে রাতটি পালন করা হবে।
মহান আল্লাহ লাইলাতুল কদরের রাতকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন। হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও এ রাতের ইবাদত উত্তম।
এ রাতে আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষণ করা হয়। নির্ধারণ করা হয় মানবজাতির ভাগ্য।
৬১০ সালে কদরের রাতেই মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানরত মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) কাছে সর্বপ্রথম সুরা আলাকের পাঁচ আয়াত নাজিল হয়। এরপর আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর বহনকৃত ওহির মাধ্যমে পরবর্তী ২৩ বছর ধরে মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে বিভিন্ন সুরা নাজিল করা হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্বন্ধে তুমি কি জানো? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
‘শান্তিই শান্তি, বিরাজ করে ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত। (সূরা আল- কদর, আয়াত ১-৫)।’
হাদিসে বর্ণিত আছে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে লাইলাতুল কদর সন্ধান করো (বুখারি ও মুসলিম)।’
মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় পবিত্র রাতটি ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে দেন। কামনা করেন মহান রবের অসীম রহমত, নাজাত, বরকত ও মাগফিরাত।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ রাত থেকে পরের দিন ভোররাত পর্যন্ত মসজিদসহ বাসা-বাড়িতে এবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আসকার, দোয়া, মিলাদ মাহফিল ও আখেরি মোনাজাত করবেন তারা।
এই উপলক্ষে শুক্রবার সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ উপলক্ষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে রাতব্যাপী ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় বয়ান ও আখেরি মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে।
এ ছাড়া দেশের সব মসজিদেই তারাবির নামাজের পর থেকে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন থাকবে।
পবিত্র লাইলাতুল কদর/শবে কদর উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি রেডিওগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
এ ছাড়া সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে।
এশীয় দেশগুলোকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও যৌথ সমৃদ্ধির জন্য সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
চীনের হাইনানে বৃহস্পতিবার বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে এশীয় দেশগুলোর ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আমাদের অবশ্যই একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে যা অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং যৌথ সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে।’
আর্থিক সহযোগিতা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এশিয়াকে অবশ্যই একটি টেকসই অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবি) ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোর এ প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন নির্ভরযোগ্য তহবিল দরকার যা আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করবে।’
বাণিজ্য সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এশিয়া এখনও বিশ্বের অন্যতম কম সংযুক্ত অঞ্চল।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এ দুর্বল সংযুক্তি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের অবশ্যই বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য দ্রুত কাজ করতে হবে।’
খাদ্য ও কৃষি সহযোগিতা বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এশীয় দেশগুলোকে অবশ্যই সম্পদ-সাশ্রয়ী কৃষিকে উৎসাহিত এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। টেকসই প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি সমাধান ও জলবায়ুবান্ধব চাষাবাদের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, এশিয়াকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যা পুনর্গঠনমূলক, সমবণ্টনমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।
তিনি বলেন,‘আমাদের জ্ঞান, তথ্য ভাগ করে নিতে হবে এবং প্রযুক্তি ইনকিউবেশন ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে। ডিজিটাল সমাধানে সহযোগিতা আমাদের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পরিশেষে বলব আমাদের সম্মিলিত কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে মেধা সম্পদ ও যুবশক্তিকে রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করতে হবে—একটি আত্মরক্ষা ও আত্মস্থায়ী সমাজ। আমাদের শূন্য-বর্জ্যের জীবনধারার ওপর ভিত্তি করে একটি পাল্টা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ভোগ সীমিত রাখতে হবে মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে।
‘আমাদের অর্থনীতিকে সামাজিক ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে, যা ভবিষ্যতের ব্যবসায়িক কাঠামো হিসেবে উদ্ভাসিত হবে, যেখানে উদ্ভাবন, লক্ষ্য ও দায়িত্ববোধ একীভূত থাকবে।’
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, বোয়াও ফোরাম ও অন্যান্য অনুরূপ উদ্যোগগুলোকে যুবসমাজ ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে হবে, যেন আগামী প্রজন্মের জন্য এশিয়াকে আরও উন্নত করা যায়।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য