মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে, সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যুদ্ধ বিরতি করা যায় কি না।
৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এম এ মালিক অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির সুপারিশসহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে বার্তা পাঠান। ইয়াহিয়া খান বিষয়টি ঠেলে দেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে। বলেন, এ ব্যাপারে গভর্নরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে যিনি রাজি করিয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব।
জ্যাকবের ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ আছে পুরো ঘটনাপ্রবাহ।
জ্যাকব লেখেন, সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গভর্নরের এই বৈঠকের পরিকল্পনা তারা জেনে গিয়েছিলেন। আর ১৪ ডিসেম্বরের এই বৈঠক হামলা করে তারা ভেস্তে দেন। এই হামলা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব অংশের মনোবল ভেঙে পড়বে বলে তাদের ধারণা ছিল। আর হয়েছেও তা।
তখনকার পুরোনো গভর্নর হাউসে জ্যাকবের ভাষায়- ‘ছেলের হাতের মোয়ার মতো’ অনায়াস এই হামলার পর পরিস্থিতি একেবারেই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
পাকিস্তানের চেষ্টা ছিল যুদ্ধবিরতির
১৩-১৪ ডিসেম্বরের রাতে নিয়াজী পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল হামিদের সঙ্গে কথা বলে তাকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার অনুরোধ করেন। ১৪ ডিসেম্বর নিয়াজীর কাছে এক বার্তা পঠিয়ে ইয়াহিয়া অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
নিয়াজীকে পাঠানো ইয়াহিয়ার বার্তাটি ছিল: ‘প্রবল প্রতিকূলতার মুখেও আপনারা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। জাতি আপনাদের নিয়ে গর্বিত এবং সারা পৃথিবী প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানকল্পে মানুষের পক্ষে সম্ভব এমন সব পদক্ষেপই আমি গ্রহণ করেছি। বর্তমানে এমন একপর্যায়ে আপনারা পৌঁছেছেন যে, এরপরে প্রতিরোধের যেকোনো প্রচেষ্টাই হবে অমানুষিক এবং সেটা কার্যকরীও হবে না ; বরং তা আরও প্রাণহানি ও ধ্বংসেরই কারণ হবে। এই অবস্থায় আপনাদের উচিত হবে যুদ্ধ বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্য এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত সহযোগীর জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সমরাভিযান বন্ধ করে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর এবং অন্যান্য জনসাধারণ যারা দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে, তাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারতকে অনুরোধ করার জন্য আমি ইতিমধ্যেই জাতিসংঘে তৎপরতা চালিয়েছি।’
এই বার্তাটি ভারতীয়রা পেয়ে যান বিকেল ৩টায়। এরপর নিয়াজী ও রাও ফরমান আলি ইউনাইটেড স্টেটস কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভ্যাকের সঙ্গে দেখা করতে যান। স্পিভ্যাককে নিয়াজী যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। জবাবে স্পিভ্যাক বলেন, বিষয়টি তার এখতিয়ারের বাইরে। তার পরও তিনি একটি বার্তা পাঠাবেন।
রাও ফরমান আলি বার্তাটির খসড়া তৈরি করে স্পিভ্যাককে দেন। এতে বলা হয়:
ক্রমবর্ধমান প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের যবনিকাপাতের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সম্মানজনক শর্তসাপেক্ষে আমরা যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ইচ্ছুক:
ক . যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে যাবতীয় সামরিক অভিযান বন্ধ হবে।
খ . পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার জাতিসংঘের গৃহীত ব্যবস্থা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তরিত হবে।
গ . যে বিষয়গুলোয় জাতিসংঘ নিশ্চয়তা দেবে, সেগুলো হলো:
১. পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারেনি, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর এমন সকল সদস্যের নিরাপত্তা।
২. সকল পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক ও সরকারি চাকরিজীবী, যারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি, তাদের নিরাপত্তা।
৩. ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অস্থানীয় জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিরাপত্তা।
৪. মার্চ ১৯৭১ থেকে যারা পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন অথবা সরকারকে সহায়তা করেছেন এবং পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার নিশ্চয়তা।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (পরে শেরাটন) গভর্নরের কাছে ফরমান আলি এই বার্তার একটি অনুলিপি পাঠান। বার্তাটি ভারতে না পাঠালেও ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়। ১৪ ডিসেম্বর আনুমানিক বিকেল ৫টায় কলকাতায় কনস্যুলার অফিসের একজন কূটনীতিক স্পিভ্যাকের সঙ্গে নিয়াজীর ভাষায় যুদ্ধবিরতি অথবা আত্মসমর্পণের প্রস্তাবনা নিয়ে তার আলোচনার কথা জেনারেল জ্যাকবকে জানান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলকাতায় জাতিসংঘের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনকে ফোন করেন। কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারেননি।
জ্যাকব তার বইয়ে লেখেন, ‘জেক, সত্যি বলছি, নিয়াজির অনুরোধ সম্পর্কে আমি আসলেই কিছু জানি না।’
এরপর জ্যাকব ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেক শকে ফোন করে তাকে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন।
জেনারেল মানেক শ আলোচনা করে তাকে জানান, স্পিভ্যাককে করা কোনো অনুরোধ সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
জেনারেল মানেক শ বার্তাটি পান ১৫ ডিসেম্বর। তিনি নিশ্চয়তা দেন, পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এ বিষয়ে পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
পাকিস্তানি কমান্ডার-ইন-চিফ এই শর্ত গ্রহণ করার জন্য নিয়াজীকে সংকেত দেন। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরদিন বেলা ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির জন্য উভয়পক্ষ রাজি হয়। পরে এই মেয়াদ বেলা ৩টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
আত্মসমর্পণ তবে নাম যুদ্ধবিরতি রাখার চেষ্টা
জ্যাকব লেখেন, ‘যতটা বোঝা যায়, ইয়াহিয়া যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিলেন, যেটা ছিল আত্মসমর্পণেরই নামান্তর।
পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা হাসান জহির তার ‘দ্য সেপারেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান বইতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানিরা 'আত্মসমর্পণ' শব্দটি পরিহারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।
ঢাকায় আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনার সময় নিয়াজী আশা করেছিলেন, স্পিভ্যাককে দেয়া তাঁর প্রস্তাবনা অনুযায়ী দলিল তৈরি করা হবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ঢাকায় আত্মসমর্পণের দলিল দেখার পরে সেটা গ্রহণ করতে নিয়াজীর অনীহা দেখা যায়।
আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি
১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় জ্যাকবকে ফোন করেন জেনারেল মানেক শ। তিনি অবিলম্বে ঢাকায় গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে বলেন।
সুনির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়ে কী কাঠামোতে আলোচনা করবেন, এই প্রশ্নের জবাব জ্যাকবকে দেননি মানেক শ। কেবল ‘বেশি ঝামেলা বাধাতে’ নিষেধ করেন। বললেন যে, কী করতে হবে, এটা তিনি ভালোই বোঝেন।
এর মধ্যে নিয়াজী রেডিও বার্তায় জ্যাকবকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান। তবে জ্যাকব জানিয়ে দেন তিনি যেতে তেমন আগ্রহী নন।
এরপর জ্যাকব ব্রিফ করেন বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত সিং অরোরাকে। তিনি প্রস্তুতি নেন ঢাকায় যাওয়ার। সঙ্গে নেন কর্নেল ইন্টেলিজেন্স খারা ও অ্যাডভান্স হেডকোয়ার্টার্সের এয়ার কমোডর পুরুষোত্তমকে।
এর আগে আত্মসমর্পণের দলিলের যে খসড়াটি অনুমোদনের জন্য দিল্লিতে পাঠানো হয়, সেটার একটা কপি সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন জ্যাকব।
জ্যাকব ঢাকায় আসেন যশোর হয়ে। সে সময় মুক্তাঞ্চল এই জেলায় হেলিকপটার পাল্টান তিনি। তখন সেনা সদর দপ্তর থেকে তাকে একটি বার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, সরকার তাকে নিয়াজীর লাঞ্চের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
ঢাকার এয়ারফিল্ডের প্রবেশমুখে এসে আমরা জ্যাকব একটি হেলিকপ্টারকে চলে যেতে দেখেন। টারম্যাকে তখন ১৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিমানবিধ্বংসী একটি কামান হেলিকপ্টারের দিকে নিশানা করা ছিল।
এর মধ্যেই হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের চিফ অফ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী তখন দেখা করেন জ্যাকবের সঙ্গে। ঢাকায় জাতিসংঘ প্রতিনিধিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় তার অফিস ব্যবহারের প্রস্তাব দেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি। কিন্তু জ্যাকব তা চাননি। তিনি পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তাদের সঙ্গে হালকা ছলে আলোচনা করতে করতে সদর দপ্তরে যান।
প্রতিশোধের স্পৃহায় মুক্তিযোদ্ধারা
জ্যাকব লেখেন, পাকিস্তানি সদর দপ্তরে যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনী তাদের থামায়। তারা খুবই উত্তেজিত মেজাজে ছিল। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিদেশি সংবাদ সংস্থার কয়েকজন প্রতিনিধি।
জ্যাকব তখন তাদের জানান, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে।
এই খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা খুবই উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। বলতে থাকে, পাকিস্তানি কমান্ডের সদর দপ্তর দখল করে নিয়াজী ও তার সঙ্গীদের ‘পাওনা’ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে চায়।
এটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে জ্যাকবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেন, বিনা রক্তপাতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এবং এই সরকারের সদস্যরা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য শিগ্গির ঢাকায় এসে পৌঁছবেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে বা কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা যাতে না নেয়া হয়, সেটি মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিত করতে বলেন জ্যাকব। বলেন, যুদ্ধবিরতি যেহেতু কার্যকর হয়েছে এবং পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে, জেনেভা কনভেনশনের প্রতি সম্মান দেখাতেই হবে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা রাজি ছিল না। তারা স্লোগান দিতে থাকে এবং হুমকি দেয় যে, তারা কারও তোয়াক্কা করে না এবং তারা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করবে।
তখন জ্যাকব তাদের বলেন, জেনেভা কনভেনশনের ধারা যেন যথাযথভাবে অনুসৃত হয়, সেটি তারা নিশ্চিত করবেন।
এর পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যেতে দেয় এবং বেলা ১টায় জ্যাকবরা সেনা সদর দপ্তরে পৌঁছেন।
নিয়াজীর সঙ্গে কী কথা
নিয়াজী তার অফিসে স্বাগত জানান জ্যাকবকে। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিষয়ের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, মেজর জেনারেল জামশেদ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, বিমানবাহিনীর এয়ার কমোডর ইমাম ও ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী।
জ্যাকব তখন নিয়াজীকে বলেন, টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় তখনও সংঘর্ষ চলছে। তার উচিত লড়াই বন্ধের জন্য তার বাহিনীর প্রতি অর্ডার ইস্যু করা।
নিয়াজী যখন অর্ডার ইস্যু করছেন, তখন জ্যাকব তার কাজে মন দেন। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য ঢাকায় এনে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘরোয়া পরিবেশে আত্মসর্পণের প্রস্তাব করলেও জ্যাকব চিন্তা করেন উল্টোটা।
তিনি তার বইয়ে লেখেন, ‘আমি মনে করি, এতদিন যারা নির্যাতিত নিপীড়িত হয়েছে, সেই জনগণের সামনে প্রকাশ্যেই এই আত্মসমর্পণ হওয়া উচিত।’
কিন্তু এর জন্য পর্যাপ্ত সময়ের অভাব ছিল। দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত আলোচনা, সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।
জ্যাকব নিয়াজীকে তাদের প্যারাশুট রেজিমেন্ট ও একটি পাকিস্তানি ইউনিট দিয়ে মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে গার্ড অফ অনারের আয়োজন করতে বলেন। সেই সঙ্গে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করতে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলেন।
এর মধ্যে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তারা ঢাকায় আসতে থাকেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের অভ্যর্থনা জানাতে জ্যাকব আবার বিমানবন্দরে যান। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য বিমানবন্দরে একটি দল পাঠানোর নির্দেশও দেন।
শর্ত শুনে নিয়াজীর চোখ ছল ছল
এরপর জ্যাকব আবার নিয়াজীর অফিসে ফিরে গেলে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান।
জ্যাকব লেখেন, ‘নিয়াজীর চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।’
পাকিস্তানিদের আশা ছিল, ১৪ ডিসেম্বরে স্পিভ্যাককে দেয়া তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই দলিল হবে, যেটাতে জাতিসংঘের দেয়া ব্যবস্থা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ও প্রত্যাবর্তন কার্যকর করা হবে।
রাও ফরমান আলী সে সময় ভারতীয় ও বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
জ্যাকব জানান, তারা যে আত্মসমর্পণের দলিলটি তৈরি করেন, সেটি যেন অপমানজনক না হয়, সেটি নিশ্চিতের চেষ্টা করেছেন।
তিনি লেখেন, ‘ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, অনমনীয় নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ পরবর্তীতে সুফল বয়ে আনেনি। পরাজিত প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা না করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতে যা কিছুই ঘটুক না কেন, কিছুটা ছাড় তাদের অবশ্যই দেয়া উচিত।’
নিয়াজীকে জ্যাকব বলেন, সৈনিকের প্রাপ্য সম্মান তারা পাবেন এবং জেনেভা কনভেনশন কঠোরভাবে পালন করা হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দেন তারা।
তিনি লেখেন, ‘এ ধরনের নিশ্চয়তা ও ধারা ইতিহাসের অন্য কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে নেই।’
এরপর নিয়াজী দলিলটি অন্যদের পড়ার জন্য এগিয়ে দেন। তারা এর কিছু পরিবর্তন দাবি করেন।
জ্যাকব তাদের বলেন, এর শর্তগুলো যথেষ্ট উদার।
এরপর জ্যাকব ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে আবার কথা হয় নিয়াজীর সঙ্গে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন, দলিলটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না। কোনো মন্তব্য না করে তিনি কাগজটা ফেরত দেন। সেটাকেই নিয়াজীর সম্মতি হিসেবে ধরে নেন জ্যাকব।
এরপর আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া নিয়ে নিয়াজির সঙ্গে আলোচনা হয়। নিয়াজী তখনও তার অফিসেই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তাব দেন। কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা জানিয়ে দেন জ্যাকব।
‘এটা ঠিক নয়’ বলে নিয়াজী প্রতিবাদ করেন।
তখন জ্যাকব তাকে বলেন, ভারতীয় ও পাকিস্তানি ডিটাচমেন্ট লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোরাকে গার্ড অফ অনার দেবে। এর পর অরোরা ও নিয়াজী দলিলে সই করবেন। সবশেষে নিয়াজী তার তরবারি সমর্পণ করবেন।
নিয়াজী জানালেন, তার কোনো তরবারি নেই।
জ্যাকব বলেন, সে ক্ষেত্রে তিনি তার পিস্তল সমর্পণ করবেন।
নিয়াজী অসন্তুষ্ট হলেও নীরব ছিলেন।
এরপরে নিয়াজী জিজ্ঞেস করেন, তার অফিসার ও সৈনিকেরা তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সঙ্গে রাখতে পারবে কি না। এই অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দেন জ্যাকব।
এরপর আত্মসমর্পণের পর তার লোকজনের নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হবে- সে প্রশ্ন রাখেন নিয়াজী। জ্যাকব তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তাদের সৈন্যরা শহরে ঢুকতে শুরু করেছে এবং ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি তারা সঞ্চার করতে পারবেন।
এরপর নিয়াজী বলেন, মুক্তিবাহিনীর হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র আছে, সেহেতু পর্যাপ্ত ভারতীয় সৈন্য এসে না পৌঁছা পর্যন্ত পাকিস্তানিরা নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখতে পারবে কি না।
জ্যাকব বলেন, এটা তারা পারবেন। এ কারণে আত্মসমর্পণের পরেও পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করা হয়নি এবং এ সিদ্ধান্ত সমালোচিতও হয়।
শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি রেডিও দিয়েই জ্যাকব তাদের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে জানান, আত্মসমর্পণের সমস্ত ব্যবস্থা হয়েছে। সবাই যেন ঢাকায় চলে আসে।
নিয়াজীর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা
জ্যাকব মধ্যাহ্নভোজ সারেন নিয়াজীর সঙ্গে। এরপর বিকেল ৩টায় তাকেও বিমানবন্দরে যেতে বলেন। সামনে পাইলট- জিপ নিয়ে নিয়াজীর গাড়িতে করেই সেখানে যান।
কিন্তু সেখানে সমস্যার সূত্রপাত হয়। মুক্তিবাহিনী তাদের এয়ারফিল্ডে যেতে বাধা দেয়। তাদের কেউ কেউ গাড়ির বনেটের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তখন গাড়িতে শিখ সেনা কর্মকর্তা খারা থাকায় সুবিধা হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন যে, নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি এবং তাদের বাধা দেয়া উচিত হচ্ছে না।
তখন চার দিকে হালকা অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
জ্যাকব লেখেন, ‘এয়ারফিল্ডে নিয়াজীর নিরাপত্তা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। পাইলট-জিপে পাকিস্তানি মিলিটারি পুলিশের হাতে ছিল রিভলভার। কিন্তু দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো ভারতীয় সৈন্যের দেখা নেই।
খারাকে তখন জ্যাকব বলেন যে, তা উচিত হবে কিছু ভারতীয় সৈন্য, সম্ভব হলে কিছু ট্যাংক সংগ্রহ করা।
কিছুক্ষণ পর এক ট্রাক মুক্তিবাহিনী রানওয়ের অন্য পাশে এসে থামে। এদের মধ্যে কাঁধে মেজর জেনারেল র্যাংকের ব্যাজ লাগিয়ে কাদের সিদ্দিকী এগিয়ে যান।
জ্যাকব লেখেন, “এই লোকটিই 'বাঘা' সিদ্দিকী, যাঁকে আমি তাঁর সম্পর্কে - শোনা বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে চিনতে পারি।”
বিপদের গন্ধ পেয়ে নিয়াজীকে আড়াল করার জন্য প্যারাট্রুপার দুজনকে নির্দেশ দিয়ে কাদের সিদ্দিকীর দিকে এগিয়ে যান জ্যাকব। তিনি আশঙ্কা করছিলেন কাদের সিদ্দিকী হয়তো নিয়াজীকে গুলি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আত্মসমর্পণের জন্য নিয়াজীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল অবশ্যম্ভাবী।
জ্যাকব যখন কাদের সিদ্দিকীকে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে বলেন, সে সময় তিনি তা মানতে চাননি। কিন্তু পরে চলে যান। এর সামান্য পরে একটি ট্যাংক নিয়ে হাজির হন খারা।
বিকেল সাড়ে চারটায় ভারতীয় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা পাঁচটি এমআই ফোর ও চারটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পৌঁছেন। সেই দলে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপ প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারও।
নিয়াজী ও জ্যাকব তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান।
এরপর সেখান থেকেই সবাই গাড়িতে করে রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দিকে যাত্রা করেন। সেখানে গার্ড অফ অনার পরিদর্শনের পর জেনারেল অরোরা ও নিয়াজী টেবিলের দিকে এগিয়ে যান।
আত্মসমর্পণের সময় নিয়াজীর চোখে জল
অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল তখন টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজী সেটা আরেক বার পড়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন।
এরপর নিয়াজি তার কাঁধ থেকে সেনা অধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ খুলে ফেলেন এবং ল্যানিয়ার্ড (ছোট দড়িবিশেষ) সহ ৩৮ রিভলবার অরোরার হাতে তুলে দেন করেন।
তখন নিয়াজীর চোখে জল দেখা যাচ্ছিল বলে উল্লেখ করেন জ্যাকব।
তিনি লিখেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা তখন নিয়াজী ও পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান ও গালি দিতে থাকে।’
রেসকোর্সের আশেপাশে তেমন কোনো সৈন্য না থাকায় নিয়াজীর নিরাপত্তা আবার শঙ্কিত হয়ে পড়েন জ্যাকব। তখন কয়েকজন সিনিয়র অফিসার মিলে নিয়াজীর জন্য একটি বেষ্টনী রচনা করে তাঁকে পাহারা দিয়ে একটি ভারতীয় জিপের কাছে নিয়ে যান।
সেখানে পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করাসহ নানা বিষয়ে ব্রিফ করার পর আগরতলায় যাওয়ার উদ্দেশে বিমানবন্দরে ফিরে যান জ্যাকব।
সে সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ অ্যাডমিরাল কৃষ্ণণকে বিদায় জানাতে আসেন। শরিফকে কৃষ্ণণ পিস্তল সমর্পণ করতে বললে তিনি হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে কৃষ্ণণের হাতে তুলে দেন। এর জ্যাকবদের আমাদের হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ে।
সেই অস্ত্রটি নিয়াজীর ছিল না
আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পর নিয়াজীর সমর্পণ করা রিভলবারটি পরীক্ষা করেন জ্যাকব। তখন বুঝতে পারেন, অস্ত্রটি নিয়াজীর নয়। এটা একটা সাধারণ আর্মি ইস্যু পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলবার। ময়লা দিয়ে এর ব্যারেল বন্ধ হয়ে আছে এবং মনে হয়, বেশ কিছুদিন এটা পরিষ্কারও করা হয়নি। ল্যানিয়ার্ডটিও নোংরা, ঘর্ষণের ফলে কয়েকটি জায়গা ছিঁড়ে গেছে।
জ্যাকব তার বইয়ে লিখেন, ‘কোনো কমান্ডিং জেনারেলের ব্যক্তিগত অস্ত্র হতে পারে না। বরং মনে হয়, নিয়াজী এটা তাঁর কোনো মিলিটারি পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অস্ত্র হিসেবে সমর্পণ করেছেন।’
তিনি লিখেন, ‘আমার মনে হলো, নিয়াজির ভাগ্যে যা ঘটেছে, সেটা তাঁর প্রাপ্য ছিল।’
আরও পড়ুন:প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গঠনের জন্য ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষুধা কোনো অভাবের কারণে নয়, এটি আমাদের তৈরি করা অর্থনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতা। আমাদের এই ব্যবস্থা বদলাতে হবে।’
সোমবার ইতালির রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য ফোরাম (ডব্লিউএফএফ) ২০২৫-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মূল বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারের ছয় দফা প্রস্তাবে অধ্যাপক ইউনূস প্রথমেই বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করুন, সংলাপ শুরু করুন এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন’—এর মাধ্যমে ক্ষুধা ও সংঘাতের দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অর্থায়নের অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে, জলবায়ুুসংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার সক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করতে হবে।
তৃতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক গঠন করে খাদ্য সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখতে হবে।
চতুর্থ প্রস্তাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে সহায়তা দিতে হবে।
পঞ্চম প্রস্তাবে তিনি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাণিজ্যনীতিকে খাদ্য নিরাপত্তার সহায়ক হতে হবে, বাঁধা নয়।
ষষ্ঠ প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের তরুণ কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘২০২৪ সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল, অথচ আমরা যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করেছি। এটি উৎপাদনের ব্যর্থতা নয়— এটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা, নৈতিক ব্যর্থতা।’
তিনি বলেন, ‘ক্ষুধা দূর করতে যেখানে কয়েক বিলিয়ন ডলার জোগাড় করা যায়নি, সেখানে অস্ত্র কিনতে বিশ্ব ব্যয় করেছে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। একে কি আমরা অগ্রগতি বলব?’
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। পুরোনো মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা পদ্ধতি কোটি কোটি মানুষকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন এক নতুন ব্যবসা পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে— সামাজিক ব্যবসা, যা ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য নয়, বরং সমাজের সমস্যা সমাধানের জন্য।’
অধ্যাপক ইউনূস তাঁর স্বপ্নের ‘তিন-শূন্য বিশ্ব’ (শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ) ধারণা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এটি কোনো কল্পনা নয়, এটি অপরিহার্য— বিশ্ব বাঁচানোর একমাত্র পথ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসার সাফল্য আমরা দেখেছি। গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে, দরিদ্র নারীরাও উদ্যোক্তা হতে পারেন। গ্রামীণ দানোন শিশু অপুষ্টির বিরুদ্ধে কাজ করছে। বিশ্বজুড়ে এমন বহু সামাজিক ব্যবসা মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘তরুণ, নারী, কৃষক, কৃষিুউদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের সহায়তায় সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করতে হবে। এই ধরনের উদ্যোগের জন্য আইনগত ও আর্থিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, বাঁধা নয়।’
তরুণদের ভূমিকা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আজকের তরুণ প্রজন্ম আগের তুলনায় অনেক বেশি সংযুক্ত, সৃজনশীল ও প্রযুক্তিনির্ভর। তাদের চাকরি খোঁজার কথা বলবেন না, বরং চাকরি সৃষ্টির ক্ষমতায়ন করুন।’
তিনি বলেন, ‘তরুণদের বিনিয়োগ তহবিল ও সামাজিক ব্যবসা তহবিলের মাধ্যমে মূলধনে প্রবেশাধিকার দিতে হবে। কৃষি-উদ্ভাবন কেন্দ্র, কৃষিুপ্রযুক্তি, চক্রাকার খাদ্য ব্যবস্থা ও জলবায়ুুস্মার্ট উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা দিতে হবে।’
তিনি যোগ করেন, ‘যুব সমাজের ওপর বিনিয়োগ করলে শুধু বিশ্বকে খাদ্য দিতে পারব না, বিশ্বকেই বদলে দিতে পারব।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্েযর বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জোটের (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার অ্যান্ড পোভার্টি) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আমরা এফএও ও জি-২০-এর সঙ্গে মিলিতভাবে প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তিনি আহ্বান জানান, ‘আসুন, একটি তিন-শূন্য বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করি।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এই ফোরামের তিনটি স্তম্ভ—যুব, বিজ্ঞান ও বিনিয়োগ—শুধু স্লোগান নয়, এটি আমাদের খাদ্যব্যবস্থা ও সমাজ রূপান্তরের প্রধান হাতিয়ার।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বে সম্পদ ও প্রযুক্তি রয়েছে, ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি আসবে। এখন দরকার সৃজনশীল চিন্তা ও সঠিক ব্যবসা কাঠামো—যার মাধ্যমে আমরা নতুন বিশ্ব গড়ে তুলতে পারব। আমরা যদি কল্পনা করতে পারি, আমরা তা বাস্তবেও সৃষ্টি করতে পারব।’
বক্তৃতার শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এফএও’র ৮০ বছর পূর্তি শুধু উদযাপন নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রস্তুতির আহ্বান।’
তিনি বলেন, ‘এ বছরের প্রতিপাদ্য— ‘হাত ধরে হাতে, উন্নত খাদ্য ও উন্নত ভবিষ্যতের পথে’—আমাদের মনে করিয়ে দেয়: খাদ্য শুধু ক্যালরির ব্যাপার নয়, এটি মর্যাদার, ন্যায়ের এবং আমরা কেমন পৃথিবীতে বাস করতে চাই তার প্রতিচ্ছবি।’
তিনি এফএওুর নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী খাদ্য নিরাপত্তা ও শান্তি জোটের প্রশংসা করে বলেন, এটি ভবিষ্যতেও বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ২০২৪ সালের বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ তরুণ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘তরুণরা সাহস ও আশায় ভরপুর হয়ে গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছে। তাদের দাবি ছিল ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া, ন্যায়, অন্তর্ভুক্তি ও আস্থার ভিত্তিতে সমাজ গঠন।’
তিনি যোগ করেন, ‘এ তরুণরাই এখন নতুন বাংলাদেশ গঠনে কাজ করছে—যেখানে জনগণ শাসনের কেন্দ্রে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে, যার মাধ্যমে আমরা ন্যায় ও জনগণের ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেব।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করছে এবং মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে আছি ধান, সবজি ও স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে। কৃষকরা ফসলের নিবিড়তা ২১৪ শতাংশে উন্নীত করেছেন এবং আমরা জলবায়ুুসহনশীল ১৩৩ প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করেছি, ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছি, শক্তিশালী খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, অপুষ্টি কমিয়েছি, খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য এনেছি এবং কৃষিকে সবুজ করেছি— মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ করছি।’ সূত্র: বাসস
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলকে (আইএফএডি) বাংলাদেশের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা, নারী, কৃষক ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারীদের সহায়তার জন্য একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
রোববার ইতালির রোমে ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের ইভেন্টের ফাঁকে আইএফএডির প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিওর সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমি আপনাদের একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের আহ্বান জানাই। এমন তহবিল দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, তরুণ, কৃষক, নারী ও মৎস্য খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেবে।’
বৈঠকে দুই নেতা বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিল্প গড়ে তোলা, আম ও কাঁঠালের রপ্তানি সম্প্রসারণ, জলবায়ু সহনশীল কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি এবং মহিষের দুধ দিয়ে মোজারেলা চিজসহ দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনে সহায়তা।
অধ্যাপক ইউনূস আইএফএডি প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং কৃষি, সামাজিক ব্যবসা ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনা যাচাইয়ে একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর অনুরোধ করেন।
প্রত্যুত্তরে আইএফএডি প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিও বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথভাবে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগে কাজ করার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, বর্তমানে আইএফএডি বাংলাদেশের কৃষিখাতে অর্ধডজনেরও বেশি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।
প্রধান উপদেষ্টা ফল প্রক্রিয়াকরণ, কোল্ড স্টোরেজ, গুদাম সুবিধা ও আম-কাঁঠালের বৃহৎ পরিসরে রপ্তানিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আম রপ্তানি শুরু করেছি, তবে পরিমাণ এখনো কম। চীন বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ আম ও কাঁঠাল আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে।’
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি জানান, বাংলাদেশের নারী দুগ্ধ খামারিরা মহিষের দুধ দিয়ে মোজারেলা চিজ তৈরি করছেন। তিনি এ খাত সম্প্রসারণে আইএফএডির সহায়তা চান।
বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রের মৎস্যসম্পদ নিয়ে আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে বাংলাদেশের জেলেরা এখনো অগভীর পানিতেই সীমাবদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো গভীর সমুদ্রে যেতে সাহস পাই না। আইএফএডি এই খাতে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সহায়তার মাধ্যমে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আইএফএডি ৩৭টি প্রকল্পে অংশীদার হয়েছে, যার মোট প্রকল্প ব্যয় ৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আইএফএডি অর্থায়ন করেছে। বর্তমানে ৪১২ মিলিয়ন ডলারের ছয়টি প্রকল্প চলমান এবং আরও একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন।
অধ্যাপক ইউনূস স্থানীয় সময় রোববার বিকেল ৫টার দিকে রোমে পৌঁছেন। তিনি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামে অংশ নেবেন এবং সেখানে মূল অধিবেশনে বক্তব্য দেবেন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক ও সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ, পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম এবং আইএফএডির এসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট ডোনাল ব্রাউন। সূত্র: বাসস
লুকানো নয়, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন উপহার দিতে চান উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন বলেছেন, আমরা একটি স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চাই, রাতের অন্ধকারে গোপন কোনো নির্বাচন দিতে চাই না। আমরা চাই এমন একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নির্বাচন, যা সবাই নিজের চোখে দেখতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভোটারদের জন্য এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, যাতে প্রতিটি বাংলাদেশি ভোট দিতে পারে। প্রবাসে যারা আছেন, তাদের জন্যও আমরা ভোটের ব্যালটের ব্যবস্থা করেছি। রিটার্নিং কর্মকর্তা নিজেই ভোট দিতে পারেন না— এটা কেমন কথা ? তিনি ভোট সংগ্রহ করবেন, কিন্তু দিতে পারবেন না, এটা তো যুক্তিসঙ্গত নয়। এবার আমরা তাদেরও ভোট দেওয়ার সেই ব্যবস্থা করছি।’
আজ রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিভাগের প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।
সিইসি এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন বলেন, একটি জিনিস ধরে রাখেন—আমাদের নিয়তের মধ্যে কোনো গলদ নেই। আমরা অতি স্বচ্ছ একটি নির্বাচন চাই। সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহে কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করতে চাই না। বরং আমরা সাংবাদিকদের সহযোগিতা চাই, পার্টনার হিসেবে পাশে পেতে চাই। সিইসি হিসেবে যেমন আমার দায়িত্ব আছে, আপনাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। গণতন্ত্রের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, এখানেও আপনাদেরও অবদান রাখতে হবে। আমি যেমন সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, তেমনি নাগরিক হিসেবেও আমাদের সবার একটি দায়িত্ব আছে। আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি এবং পাশে পেতে চাই।
এনসিপির শাপলা প্রতীক প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, শাপলা প্রতীক যেহেতু আমাদের নির্ধারিত তালিকায় নেই, তাই দিতে পারিনি। দেখেন, ২০২৪-এর আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যারা ছিল, তারাই কিন্তু এনসিপির নেতৃত্বে রয়েছেন। তারা গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করবেন এটা আমি মনে করি না। কোনো অংশে তাদেরকে আমরা কম দেশপ্রেমিক ভাবতে চাই না। এনসিপিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৪-এর অভ্যুত্থানে যোগদান করেছিল। সুতরাং তারাও দেশের মঙ্গল চান, গণতন্ত্র চান, ভালো চান। আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্র উত্তরণের পথটা যাতে সুন্দর হয় সেরকম একটা পরিবেশের তারা সম্মতি দেবে।
চট্টগ্রামের ভোটের পরিবেশ প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, আমরা চট্টগ্রামের ভোটের ইতিহাস বদলাতে চাই। আগের মতো যেন না হয়, সেই নিশ্চয়তা আমি এখানে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পেয়েছি। ইনশাল্লাহ আগের মতো হবে না। আমি সাংবাদিকদের পূর্ণ সহযোগিতা চাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে চাই, যাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সুন্দরভাবে নিজের ভোট দিতে পারে নিরাপদ পরিবেশে। যাতে নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হতে না পারে সেই লক্ষ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে নাসির উদ্দিন বলেন, যখন আপনারা আমাদের সম্পর্কে প্রচার বা অপপ্রচার যা শুনবেন, দয়া করে আগে ফ্যাক্ট চেক করে নেবেন। আমরা এজন্য একটি ফ্যাক্ট চেক সেল গঠন করছি। যাতে তথ্য পেলে আগে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা হয়। সত্য হলে প্রচার করবেন।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি সমস্যা উল্লেখ করে সিইসি বলেন, এআই সমস্যাটা শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়। এটি বিশ্বের একটি সমস্যা। এআই-এর ৫০ শতাংশ সোর্স শনাক্ত করা যায় না। আলোচনায় কেউ কেউ বলেছে ইন্টারনেট বন্ধ করতে। আমরা ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে নই।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. জিয়াউদ্দীনের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। এতে চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি অংশ নেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও। সভায় বিভাগের নির্বাচন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সূত্র: বাসস
মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ের চুক্তিতে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের শতকোটি টাকার ক্ষতি সাধনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক ছয় মন্ত্রী ও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে অভিযুক্ত করে মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আজ রোববার দুদকের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বাসসকে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, আজকে তাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড (সিএনএস)-কে একক উৎসভিত্তিক দরপত্রের মাধ্যমে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পূর্বের বৈধ টেন্ডার বাতিল করে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই চুক্তিটি সম্পাদন করা হয়।
দুদক জানায়, সিএনএস লিমিটেডকে টাকার অংকে নয় বরং মোট আদায়কৃত টোলের ১৭.৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে (ভ্যাট ও আইটি ব্যতীত) কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি ৪৮৯ কোটি টাকার বেশি বিল গ্রহণ করে। অথচ ২০১০-২০১৫ মেয়াদে একই সেতুতে যৌথভাবে এমবিইএল-এটিটি কোম্পানিকে টোল আদায়ের দায়িত্ব দিতে খরচ হয়েছিল মাত্র ১৫ কোটি টাকার কিছু বেশি।
২০২২-২০২৫ মেয়াদে ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড একই ধরনের প্রযুক্তিতে তিন বছরের জন্য ৬৭ কোটি টাকায় চুক্তি পায়, যা পাঁচ বছরে রূপান্তর করলে প্রায় ১১২ কোটি টাকা হয়। ফলে সিএনএস লিমিটেডকে একক উৎসভিত্তিক চুক্তির মাধ্যমে দায়িত্ব দেওয়ায় সরকারের ৩০৯ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সচিব এম এ এন ছিদ্দিক, অতিরিক্ত সচিব মো. ফারুক জলিল, উপ-সচিব মোহাম্মদ শফিকুল করিম, প্রকৌশলী মো. ফিরোজ ইকবাল, ইবনে আলম হাসান, মো. আফতাব হোসেন খান, মো. আব্দুস সালাম, এবং সিএনএস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনীর উজ জামান চৌধুরী, পরিচালক সেলিনা চৌধুরী ও ইকরাম ইকবাল।
অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা পরস্পর যোগসাজশে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের বা অন্যকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে প্রতারণা ও আত্মসাৎমূলক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। এ ঘটনায় দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র: বাসস
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রধান প্রসিকিউটরের তথ্য উদ্ধৃত করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে সশস্ত্র বাহিনীর আর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কোনো পরিকল্পনা নেই।
শনিবার বাসসকে প্রেস সচিব বলেন, দআমরা আইসিটির প্রধান প্রসিকিউটরের দপ্তর থেকে জানতে পেরেছি যে এই মুহূর্তে সশস্ত্র বাহিনীর আর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরিকল্পনা নেই।’
শতাধিক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে শফিকুল আলম বলেন, ‘এই খবর সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মনগড়া গুজব।’
তিনি জনগণকে এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য বিশ্বাস না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই ধরনের অপপ্রচার সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে।’
শফিকুল আলম আরও বলেন, ‘আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যেই এসব অসৎ গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’
প্রেস সচিব স্পষ্ট করে জানান, সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) বিলুপ্ত করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘সংস্থাটির সীমান্তবর্তী ও বহিঃদেশীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও জোরদার করতে সরকার সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বিবেচনা করছে।’ সূত্র: বাসস
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ১৫ অক্টোবরের (বুধবার) পরিবর্তে ১৭ অক্টোবর (শুক্রবার) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এ অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আজ শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
বৈঠক শেষে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানান, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আগ্রহী জনগণের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে অনুষ্ঠানটি ১৭ অক্টোবর, শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে। যদিও এর আগে কমিশনের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে ১৫ অক্টোবর বুধবার বিকেলে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হবে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিদের এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। সূত্র: বাসস
অন্তবর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড.আ ফ ম খালিদ হোসাইন বলেছেন, আমরা সেইফ এক্সিট চাইনা, স্বাভাবিক এক্সিট নিয়ে নির্বাচন পরবর্তী এদেশেই থাকতে চাই। তিনি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারী মাসে নির্বাচন যথাসময়ে হবে এবং সুষ্ঠুভাবেই হবে। ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচিত সরকারের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করে আমরা চলে যাবো। তিনি বলেন, সেইফ একজিট বলতে আমি কিছু জানিনা। আমার কোন সেকেন্ড হোম নেই। এমনকি ঢাকায় আমার থাকার কোন বাড়ীও নেই। বর্তমানে আমি সরকারী বাড়ীতে থাকি আর চট্টগ্রামে ভাড়া বাসায় থাকি। আমি এই দেশেরই মানুষ,এই দেশ আমার আপনার, এখানেই আমি থাকব। তিনি আরো বলেছেন আমরা সম্প্রীতির বন্ধনে থাকতে চাই এবং সম্প্রীতিই একমাত্র মৌলিক বিষয়। এটা নিয়েই পার্বত্য এলাকাসহ পুরো দেশে আমরা সকলে একসাথে থাকতে পারব বলে আমি আশাবাদি।
তিনি শনিবার রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ওলামা পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপরোক্ত বক্তব্য রাখেন।
ধর্ম উপদেষ্টা ড, আ ফ ম খালিদ হোসাইন আরো বলেন, ‘কাউকে ধর্মীয়, সামাজিক বা অন্য কোনোভাবে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। আমাদের সকলের মাঝে সম্প্রীতি থাকা দরকার, কারণ এটিই আসল।’ দেশের উন্নয়নের ভিত্তি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আমি সকল সম্প্রদায়ের উপদেষ্টা। আমাদের দেশের সকল সম্প্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সকল ধর্মের জন্য বরাদ্ধ আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ওলামা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মাওলানা হাজী শরীয়ত উল্লাহর সভাপতিত্বে এবং সাধারন সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সম্প্রীতি সমাবেশে অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্য রাখেন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সাদেক হোসেন, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো: হাবিব উল্লাহ মারুফ, জেলা পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেন প্রমুখ। সম্প্রীতির এসভায় জেলা উপজেলার মসজিদ, মন্দির, বিহারসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য