আকাশপথে সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারে যাতায়াত আরও আকর্ষণীয় করতে নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে সেখানকার বিমানবন্দর। বড় করা হচ্ছে রানওয়ে। কাজ শেষ হলে ১০ হাজার ৭০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এ রানওয়ে হবে দেশের সবচেয়ে বড়।
রানওয়েটির ১ হাজার ৩০০ ফুট থাকবে বাঁকখালী নদী ও বঙ্গপোসাগরের মোহনায়। মূলত নদীর বুক ছুঁয়েই বিমান ওঠানামা করবে এখানে।
বিমানবন্দরটির রানওয়ে সম্প্রসারণে এখন চলছে বালু ভরাটের কাজ। কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর নুনিয়ারছড়া এলাকায় নদীর পাড় ঘেঁষে চলছে এ কর্মযজ্ঞ।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে কক্সবাজার। এটি হলে বিদেশি ফ্লাইটগুলো সরাসরি নামতে পারবে এখানে। এতে কক্সবাজারের পর্যটন সম্ভাবনা অনেক গুণ বাড়বে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে কয়েকটি ধাপে কাজ চলছে। এরই মধ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ হয়েছে ৬ শতাংশের মতো। বাঁধ সুরক্ষার জন্য ব্লক ফেলার কাজও চলছে জোরেশোরে। পুরো কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালে।
বিমান ওঠানামা নির্ভুল ও নিরাপদ করতে প্রকল্পটির আওতায় পানির মধ্যে ৯০০ মিটার পর্যন্ত প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ লাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া ইন্সট্রুমেন্টাল ল্যান্ডিং সিস্টেম, নিরাপত্তা প্রাচীরের পাশাপাশি বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ হচ্ছে সংযোগ সেতু।
পুরো কাজটি শেষ করতে খরচ হবে পৌনে চার হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে শুধু রানওয়ে নির্মাণে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকাশপথে সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রধান রুট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ায় প্রতিনিয়ত সেখানে চাপ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের যেভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে এ চাপ আরও বাড়বে।
তা ছাড়া কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ঘিরে আধুনিক সুবিধা সংবলিত যেসব পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে, তাতে বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনাও। ফলে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর নির্মাণ সময়ের দাবি। এতে এভিয়েশন খাত যেমন লাভবান হবে, তেমনি বিকাশ হবে পর্যটন শিল্পেরও।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের বর্তমান অবস্থা কী
কক্সবাজার বিমানবন্দরের এখনকার টার্মিনালটি অনেক ছোট। তাই খুব বেশি যাত্রীকে সেবা দেয়ার সক্ষমতা নেই। রানওয়েটিও বড় ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা করানোর উপযোগী নয়। শুধু তা-ই নয়, একটি বিমানবন্দরে আধুনিক যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, তার কিছুই নেই এখানে।
রানওয়ে সম্প্রসারণের কারণ
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়েটির সম্প্রসারণ হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বোয়িং ৭৭৭ ও বোয়িং ৭৪৭-এর মডেলের যাত্রীবোঝাই বিমানও সেখানে ওঠানামা করতে পারবে। এমনকি নিতে পারবে জ্বালানিও। আর এ সুবিধার কারণে দেশি-বিদেশি সরাসরি ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়বে। এতে বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়ও।
কাজের অগ্রগতি
বর্তমানে বিমানবন্দরে ঢোকার রাস্তাসংলগ্ন একটি আপৎকালীন টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। আর নীল জলরাশি ছুঁয়ে নতুন রানওয়ে তৈরিতে বাঁকখালী নদীর বুকে ফেলা হচ্ছে বালু। এ জন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হয়েছে ড্রেজার ও বাল্কহেড। নদীর তীরবর্তী এলাকায় বালু ফেলছে এসব ড্রেজার। মাসখানেক আগে শুরু হয়েছে এ কাজ।
নদীর বুক চিড়ে এ রানওয়ে দৃশ্যমান করতে ফেলতে হবে অন্তত সাড়ে ছয় কোটি ঘনফুট বালু। কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে কাজ। যাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই যুক্ত হবে বাকিরাও।
সাব-কনট্রাক্টে কাজ করছে যারা
যেসব প্রতিষ্ঠান বালু ভরাটের কাজ পেয়েছে, তাদের একটি এডিসি কনস্ট্রাকশন। সাব-কনট্রাক্টে কাজ করা এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমান মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দৃষ্টিনন্দন রানওয়েটির নির্মাণের মূল কাজ পেয়েছে একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। আমরা তাদের সঙ্গে সাব-কনট্রাক্টে বালু ভরাটের কাজ করছি। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এভাবে কাজ করছে।’
মাকসুদুর বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান দুই কোটি ঘনফুট বালু ফেলবে। আশা করছি তিন-চার মাসের মধ্যে কাজটি শেষ করতে পারব।’
অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মোহাম্মদ মফিজুর রহমান জানান, সেখানে তার দুটি লোড ও দুটি আনলোড ড্রেজার কাজ করছে। কাজের গতি বাড়াতে যুক্ত করেছেন ছয়টি বাল্কহেড।
শুধু বালু ভরাটেই আটকে নেই রানওয়ের কাজ। বিমানবন্দরের সীমানার শেষ অংশে ফেলা হয়েছে বড় বড় ব্লক। আরেক পাশে দেয়া হয়েছে জিও ব্যাগ।
প্রধানমন্ত্রীর তাগিদেই হচ্ছে কাজ
বিশ্বমানের এ বিমানবন্দর নির্মাণে প্রথম তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাতে বিশ্বের দরবারে কক্সবাজারের পর্যটন সম্ভাবনাকে তুলে ধরা যায়।
অবশ্য তার আগেই অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলে সুবিধা বাড়াতে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ফুট করা হয়। আর প্রস্থ ১২০ ফুট থেকে বাড়িয়ে করা হয় ২০০ ফুট।
২০১৭ সালে সম্প্রসারিত এই রানওয়েতে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সময়ই রানওয়েটি বিশ্বমানে উন্নীত করার নির্দেশ দেন তিনি। তারই অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প নেয় সরকার।
প্রকল্পের যত ব্যয়
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য বর্তমানের চেয়ে ১ হাজার ৭০০ ফুটের মতো বাড়ছে।
মূল কাজ করছে কারা
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণে কাজ দেয়া হয়েছে চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটারওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো-চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন নামে চীনা প্রতিষ্ঠানকে। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। গত আগস্টে প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রকল্প পরিচালক মো. ইউনুস ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিমানবন্দরের বর্তমান টার্মিনালের অপর পাশে একটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ আইকনিক টার্মিনাল তৈরি করা হবে। সেটি করতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। সে জন্য আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে একটি অস্থায়ী টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে। এটি হয়ে গেলে বর্তমান টার্মিনালটি ভেঙে ফেলা হবে।
‘আশা করছি ২০২২ সালের জুন মাসে আপৎকালীন টার্মিনাল ব্যবহার উপযোগী করা যাবে।’
ইউনুস ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের মে মাসে রানওয়ের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও আমরা চেষ্টা করব ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যেই তা করতে।’
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কক্সবাজার একটা পর্যটন এলাকা। এখানে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর হলে অবশ্যই সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আরও সহজ হবে। এই বিমানবন্দরকে কাজে লাগিয়ে কক্সবাজারকে একটা অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করা যাবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বহু গুণে বাড়বে।’
আরও পড়ুন:শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য