৯ দফা দাবিতে ফের রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় রাজধানীর গুলিস্তানে নটর ডেম কলেজের নাঈম হাসানের নিহতের ঘটনায় বিচার নিশ্চিত এবং বাসে হাফ পাস কার্যকর করা।
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর মোড়ে রোববার বেলা সাড়ে ১২টা থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। একই সময়ে শান্তিনগর মোড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। রামপুরা ব্রিজের ওপর অবস্থান নিয়েছে ইমপিরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা।দাবি আদায়ে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে সপ্তাহের প্রথম কর্ম দিবসেই ধানমন্ডি, রামপুরা, শান্তিনগর এলাকায় দেখা দিয়েছে যানজট। এর প্রভাব পড়ছে অন্যান্য সড়কগুলোতে।
ডিএমপির ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ইহসানুল ফিরদাউস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণদের ভোগান্তি যেন না হয় সেজন্য আমরা যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। স্টুডেন্টদের বুঝিয়ে কিছুক্ষণ পর আমরা রাস্তা ক্লিয়ার করে দেব।’
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন বলেন, ‘ইমপেরিয়াল কলেজের ৪০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী রাস্তা অবরোধ করেছে। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা কিছুক্ষণ তাদের দাবি জানিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেবে।’
গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের দক্ষিণ পাশে নটর ডেম কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানকে ধাক্কা দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লাবাহী ট্রাক। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার বিচার, বাসে হাফ পাস কার্যকর এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে টানা দুই দিন বিক্ষোভের পর শুক্রবার বিরতি দিয়ে ফের রাস্তায় নেমেছে তারা।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হল:
০১. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শিক্ষার্থীসহ সকল সড়ক হত্যার বিচার করতে হবে ও পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
০২. ঢাকাসহ সারা দেশে সকল গণপরিবহনে (সড়ক, নৌ, রেল ও মেট্রোরেল) শিক্ষার্থীদের হাফ পাস নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
০৩. গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং জনসাধারণের চলাচলের জন্য যথাস্থানে ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্রুততর সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
০৪. সড়ক দুর্ঘটনায় আহত সকল যাত্রী এবং পরিবহন শ্রমিকের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পূনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
০৫. পরিকল্পিত বাস স্টপেজ ও পার্কিং স্পেস নির্মাণ ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে (এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে)।
০৬. দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ও যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের দায়ভার সংশিষ্ট ব্যক্তি বা মহলকে নিতে হবে।
০৭. বৈধ ও অবৈধ যানবাহন চালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈধতার আওতায় আনতে হবে এবং বিআরটিএর সকল কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
০৮. আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অবিলম্বে স্বয়ংক্রিয় ও আধুনিকায়ন এবং পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
০৯. ট্রাফিক আইনের প্রতি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে।
দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন:মৌলভীবাজারে জনগণের দোরগোড়ায় পুলিশি সেবা পৌঁছে দিতে অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এমকেএইচ জাহাঙ্গীর হোসেন। ‘আপনার এসপি’ নামে নতুন এই সেবায় জেলার ৭টি থানায় বসেই নাগরিকরা সরাসরি এসপির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে পারছেন। অভিযোগ জানাতে, পরামর্শ নিতে বা ন্যায়বিচার চাওয়ার জন্য এখন আর জেলা সদরে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হবে না সেবা গ্রহীতাদের।
জানা গেছে, প্রতিটি থানায় ‘আপনার এসপি’ নামে একটি করে ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে এসপির মনোনীত কনস্টেবল পদমর্যাদার একজন অপারেটর দায়িত্ব পালন করছেন। অফিস সময়ের মধ্যে এই ডেস্কে এসে যে কেউ সরাসরি ভিডিও কলে এসপির সঙ্গে কথা বলতে পারেন। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন থানায় গিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ এই সেবা গ্রহণ করেছেন।
রুবিনা আক্তার নামে এক গৃহবধূ বলেন, আগে মনে হতো এসপির সঙ্গে দেখা করা মানে অনেক ঝামেলা। এখন থানায় গিয়ে সহজে কথা বলা যায়। আমি আমার পারিবারিক সমস্যার কথা জানিয়েছি, স্যার খুব সহানুভূতির সঙ্গে শুনেছেন।
কুলাউড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি এম শাকিল রশীদ চৌধুরী বলেন, এসপি জাহাঙ্গীর হোসেনের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সাধারণ মানুষ সরাসরি পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে- এতে জবাবদিহিতা যেমন বাড়ছে, তেমনি পুলিশের ভাবমূর্তিও ইতিবাচক হচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ড. মো. আব্দুল মতিন চৌধুরী বলেন, জনগণ যাতে ভয় ছাড়াই নিজের সমস্যা বলতে পারে- ‘আপনার এসপি’ ডেস্ক ঠিক সেই সুযোগ তৈরি করেছে। এতে বিচারপ্রাপ্তির পথ আরও সহজ হচ্ছে।
এসপি এমকেএইচ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, মানুষের দুর্ভোগ লাঘব ও দ্রুত সেবা পৌঁছে দিতেই এই উদ্যোগ। এখন গ্রামের সাধারণ মানুষও থানায় বসেই এসপির সঙ্গে কথা বলতে পারছেন- এটা পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বাড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সারাদেশের মধ্যে মৌলভীবাজারেই এটি প্রথম ধরনের উদ্যোগ।
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) জুমার নামাজের আগে মিম্বারে বসে জামায়াতে ইসলামী থেকে পাঠানো সতর্কতামূলক চিঠি প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করে নিজ হাতে ছিঁড়ে ফেলেন।
চিঠিতে অভিযোগ আনা হয়, ১০ অক্টোবরের জুমার খুতবায় খতিব বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, খতিবের এই বক্তব্য ছিল হীনমন্যতা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক, যা সমাজে বিভেদ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। চিঠিতে তিনি অবিলম্বে বক্তব্য প্রত্যাহার এবং ভবিষ্যতে এমন বক্তব্য না দেওয়ার আহ্বান পেয়েছিলেন।
তবে শুক্রবার খুতবায় মাওলানা কাসেমী বলেন,“রোজা আর পূজা এক নয়। গত শুক্রবারও বলেছি, আজ আবারও বলছি—আপনারা সংযত ও সংশোধন হোন, তাওবা পড়ুন।”
এরপর তিনি মুসল্লিদের সামনে চিঠিটি প্রদর্শন করে ঘোষণা করেন, তিনি এটি মানছেন না। উপস্থিত মুসল্লি ও মসজিদ কমিটির সদস্যরা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দেন। এরপর খতিব নিজ হাতে চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলেন।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, খতিব একজন নাগরিক হিসেবে যে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন করতে পারেন, কিন্তু মসজিদের মিম্বারে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া অনুচিত। মসজিদে বিভিন্ন মত ও দলের মানুষ নামাজ আদায় করেন; তাই মিম্বারে কোনো দলের এজেন্ডা প্রচার করা যাবে না।
চিঠির একটি অনুলিপি পাঠানো হয়েছে ডিয়ারাবাড়ী আর্মি ক্যাম্প, উত্তরা; উপ-পুলিশ কমিশনার, উত্তরা বিভাগ (ডিএমপি); অফিসার ইনচার্জ, উত্তরা পশ্চিম থানা; এবং ১২ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে।
অর্থ সংকটে ১৫ শতাংশ বাজেট হ্রাসের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জাতিসংঘ ৫টি শান্তিরক্ষা মিশন থেকে ১৩১৩ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা।
গত ১৪ অক্টোবর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স কার্যালয়ের (ওএমএ) ভারপ্রাপ্ত সামরিক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল শেরিল পিয়ার্স বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহার সম্পর্কিত চিঠি প্রেরণ করেন। চিঠিটি বাংলাদেশের সামরিক উপদেষ্টাকে এবং জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনকে পাঠানো হয়। চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ওএমএ’র চিফ অব স্টাফ ক্যাপ্টেন লনি ফিল্ডস জুনিয়র, এবং খসড়া প্রস্তুত করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তানবির আলম, যিনি কার্যালয়ের মিলিটারি পিস অপারেশন সাপোর্ট শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের নির্দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে চলমান আর্থিক সংকটের কারণে ১৫ শতাংশ বাজেট হ্রাস কার্যকর করা হচ্ছে। এর ফলে ইউনিফর্মধারী সদস্যদের বরাদ্দ অর্থ কমানো হবে এবং মাঠপর্যায়ে শান্তিরক্ষীর সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পাবে।
প্রত্যাহারের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অংশগ্রহণকারী পাঁচটি মিশন থেকে প্রত্যাহার করা হবে। সংখ্যাগত বিবরণ নিম্নরূপ:
ইউএনমিস (দক্ষিণ সুদান): ৬১৭ জন
মিনুসকা (মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র): ৩৪১ জন
ইউনিসফা (সুদানের আবেই অঞ্চল): ২৬৮ জন
মনুসকো (কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র): ৭৯ জন
মিনুরসো (পশ্চিম সাহারা): ৮ জন
চিঠিতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের লজিস্টিক বিভাগ, ইউনিফর্মড ক্যাপাবিলিটিজ সাপোর্ট বিভাগ এবং মিশন সাপোর্ট বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালে মাত্র ১৫ জন পর্যবেক্ষককে ইরাক-ইরান মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ মিশনে পাঠিয়ে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শুরু করে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ যোগ দেয়। ১৯৯৩ সালে নৌ ও বিমানবাহিনীও মিশনে যুক্ত হয়।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রায় ৪৩টি অঞ্চলে ৬৩টি শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছে। এতে ১,৭৮,৭৪৩ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বের ১০টি অঞ্চলে ৫,৬১৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন।
উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশ পুলিশের একমাত্র অবশিষ্ট কন্টিনজেন্ট কঙ্গো থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৮০ সদস্যের এই কন্টিনজেন্টে ৭০ জন নারী পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা আগামী নভেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন।
কুমিল্লা শহরের রেসকোর্স এলাকার নিজ বাসা থেকে মিলন আক্তার (৫৪) নামে এক নারীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটের খাটের নিচ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত মিলন আক্তারের বাড়ি বুড়িচং উপজেলার নিমসার (শিকারপুর) গ্রামে। তিনি রেসকোর্স মজুমদার ভিলায় বসবাস করতেন।
জানা গেছে, প্রায় ১৫ বছর আগে মিলন আক্তারের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে মায়ের সঙ্গে বাসায় থাকতেন তিনি। চার-পাঁচ দিন আগে তার মা নোয়াখালীতে চিকিৎসার জন্য যান। এই সময় তিনি একাই বাসায় ছিলেন। এদিকে মিলনের তিন মেয়ের একজন থাকেন ইউরোপে স্বামীর সঙ্গে, একজন বিবাহসূত্রে থাকেন নোয়াখালী। আর তানজিনা আক্তার নামের আরেক মেয়ে থাকেন রেসকোর্স এলাকার একটি ভাড়াবাসায়৷ বৃহস্পতিবার থেকে তানজিনা আক্তার কল দিয়ে তার মাকে না পাওয়ায় শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি এসে দরজা খুলে দেখেন মা নেই। পরে খাটের নিচে রক্ত দেখে তাকিয়ে দেখেন মায়ের মরদেহ। পরে খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে।
নিহতের ভাতিজা মো. মাসুদ বলেন, ‘গতকাল সকালে সাড়ে ৯টায় আমার সঙ্গে ফুফুর কথা হয়েছিল। আজ শুনি ফুফু মারা গেছে। খাটের নিচে ফুফুর মরদেহ কীভাবে গেলো? এটি নিশ্চয়ই হত্যাকাণ্ড। তা ছাড়া সেখানে একটি ছুরিও পাওয়া গেছে।’
কোতয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম জানান, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। বিষয়টি তদন্ত করে বিস্তারিত বলা যাবে।
তিনি আরও জানান, মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে, যা আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধির পথে জাতিকে এগিয়ে নেবে এবং গত ১৬ বছরের নৃশংসতার অবসান ঘটাবে।
তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের নতুন জন্মের দিন। এই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই আমরা নতুন বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করছি।’১৭ আগস্ট ২০২৫ শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ–সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ কমিশনের সদস্যরাও জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বলেন, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আমরা যে ঐক্যের সুর বাজালাম, সেই সুর নিয়েই নির্বাচনে যাব। যারা স্বাক্ষর করলেন, তারা প্রয়োজনে আবার বসেন। ঠিক করেন কীভাবে নির্বাচন সুন্দর করা যায়। যেনতেন নির্বাচন করে কোনও লাভ নেই।
রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, মানুষ যেন মনে রাখে এই সনদে যারা স্বাক্ষর করেছেন তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে। পুলিশ এসে কেন ধাক্কাধাক্কি করবে। নিজেদের নির্বাচন নিজেরা করবো। কারও এসে আমাদের সোজা করতে হবে না, দেখিয়ে দিতে হবে না, ধাক্কাধাক্কি করতে হবে না।
সনদে স্বাক্ষর নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজকের দিনটি বিশেষ। আজ সমস্ত জাতি, রাজনৈতিক নেতা একত্রিত হয়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছেন। এরকম ঘটনা আমরা চিন্তাও করতে পারিনি। যখন ঐকমত্য কমিশন গঠন করলাম, তখন মনে হয়েছিল হয়তো দুই-একটি বিষয়ে একমত করতে পারব। তাই ভয়ে ভয়ে এটা শুরু হয়েছিল। আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তিনি যদি বুঝিয়ে কিছু করতে পারেন। অবাক হয়ে দেখলাম, সব রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হলো। সবাই আলোচনা করলেন। এটা না দেখলে বিশ্বাস হতো না।
ঐকমত্য কমিশন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সনদের মধ্য দিয়ে আমরা বর্বরতা থেকে সভ্যতায় এলাম। আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম। যেখানে কোনও আইন-কানুন ছিল না। এখন আমরা সভ্যতায় এলাম। এমন সভ্যতা গড়ে তুলবো যে মানুষ ঈর্ষার চোখে দেখবে। আমাদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত চমৎকার। শুধু মানুষ নিয়ে সমাজ গঠন করতে হবে।
জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের স্মরণ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই কমিশন ও সনদ করার সুযোগ যারা দিয়েছে আজ তাদের স্মরণ করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের নায়কদের কথা মনে রাখতে হবে। যারা জীবন দিয়েছেন, আহত হয়ে বেঁচে আছেন তাদের কাছে জাতি চির কৃতজ্ঞ।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আজকে এই দিনটি যে পেলাম, এটা মহান দিন। এটার কথা চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে। এমন একটি দিন, সেটা শুধু জাতির জন্য না, সারা পৃথিবীর জন্য একটা বড় রকমের উদাহরণ হয়ে থাকবে। বহু জায়গায়, যেটা পাঠ্যপুস্তকে থাকবে, সেটার ক্লাসরুমে আলোচনা হবে। রাজনৈতিকদের মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা হবে বিভিন্ন দেশে। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, তারা কী বলল, আমরা কী চাই। তারা সেটা পারে কি না, সেটা চেষ্টা করে দেখবে—তাদের দেশে এটা সম্ভব কি না। যেই উদাহরণ আমাদের দেশের রাজনৈতিকবৃন্দ সৃষ্টি করেছেন, সেটা দেশের জন্য তো বটেই, সারা পৃথিবীর জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে তরুণদের সম্ভাবনা, সমুদ্র বন্দরের উপযুক্ত ব্যবহারের প্রসঙ্গও উঠে আসে। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের অংশ। একটি নিয়মের মধ্যে চললে এই সম্পদের ব্যবহার করতে পারব। যদি গভীর সমুদ্র বন্দর করে দেই তাহলে দুনিয়ার অনেক জাহাজ আমাদের বন্দরে ভিড়তে পারবে। আমাদের জাহাজ সিঙ্গাপুরে আটকে থাকবে না। এটি একটি বিরাট সুযোগ।
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, অন্য দেশের জেলেরা এসে বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে যায়। আমরা হা করে তাকিয়ে থাকি। কক্সবাজার, মাতারবাড়ি ও মহেশখালী মিলিয়ে যদি একযোগে বন্দর উন্নত করি, তাহলে পুরো এলাকা নতুন সিঙ্গাপুরে পরিণত হবে। সকল দেশের মানুষ এখানে আসবে। আমরা নেপাল, ভূটান ও সেভেন-সিস্টার্সের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারবো এসব বন্দরের কারণে।
এর আগে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক স্রোত, কিন্তু মোহনা একটি। সেটি হলো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করা। সেই স্বপ্ন, প্রত্যাশার স্মারক যতটুকু অর্জিত হয়েছে- জুলাই জাতীয় সনদ সেটির প্রথম পদক্ষেপ।’
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, এই অগ্রসরমানতায় বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের ভূমিকা আছে। প্রত্যাশা থাকবে রাজনৈতিক দলগুলো মত ও পথের পার্থক্য থাকা স্বত্ত্বেও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
রাজনৈতিক দল ও শহীদ পরিবারের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছেন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বিএনপি, জামায়াত, খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ মোট ২৫টি দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠান মঞ্চে দলীয় প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ছাত্র-জনতার পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা বেগম মঞ্চে উপস্থিত হয়ে এই সনদের প্রতি সমর্থন জানান।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও বাসদ (মার্কসবাদী) আগেই এই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দল ও জোটের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন:
১। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
২। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী: কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের এবং সেক্রেটারী জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
৩। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ: প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।
৪। গণসংহতি আন্দোলন: প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল।
৫। নাগরিক ঐক্য: সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার।
৬। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) : সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি মিসেস তানিয়া রব।
৭। গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি) : সভাপতি নুরুল হক নুর এবং সাধারণ সম্পাদক মোঃ রাশেদ খাঁন।
৮। খেলাফত মজলিস: আমীর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ এবং মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের।
৯। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস: সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা ইউসুফ আশরাফ এবং মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ।
১০। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) : মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নেয়ামূল বশির।
১১। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন: প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম এবং মিডিয়া সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন।
১২। আমার বাংলাদেশ পাটি (এবি পার্টি) : চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু এবং সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।
১৩। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) : চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ এবং মহাসচিব মোমিনুল আমিন।
১৪। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি: সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এবং রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য বহ্নিশিখা জামালী।
১৫। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট: জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা’র সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান।
১৬। ১২ দলীয় জোট: জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপি’র চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম।
১৭। গণফোরাম: জ্যেষ্ঠ এডভোকেট ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. মিজানুর রহমান।
১৮। জাকের পাটি: ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শহীদুল ইসলাম ভুইয়া এবং গাজীপুর জেলা ছাত্রফ্রন্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হাসান শেখ।
১৯। জাতীয় গণফ্রন্ট: কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক আমিনুল হক টিপু বিশ্বাস এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আরেফিন লিটু বিশ্বাস।
২০। বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি: সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী এবং মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার।
২১। বাংলাদেশ লেবার পার্টি: চেয়্যারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান এবং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার মিরাজুল ইসলাম।
২২। ভাসানী জনশক্তি পার্টি: চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম (বাবলু) এবং মহাসচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ (সেলিম)।
২৩। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ: সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী এবং মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।
২৪। ইসলামী ঐক্যজোট: চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল কাদের এবং মহাসচিব মুফতী সাখাওয়াত হোসাইন রাজী।
২৫। আমজনতার দল: সভাপতি কর্নেল মিয়া মশিউজ্জামান (অব.) এবং সাধারণ সম্পাদক মো. তারেক রহমান।
আমাগো কষ্ট দেহনের কেউ নাই। জীবনডা কষ্ট করেই পার করলাম। বেশ আক্ষেপ ও চাপা কষ্ট নিয়ে প্রায় বছর দুয়েক আগে কথাগুলো বলেছিলেন মাঝি সুজন শেখসহ মজলিশপুর চরাঞ্চলের মানুষ।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের শেষ সীমনা ৯ নং ওয়ার্ডের প্রত্যন্ত দূর্গম চরাঞ্চল মজলিশপুর ও চরমহিদাপুর যাত্রী পারাপারে পদ্মার মাঝি সুজন শেখ, স্থানীয় বাসিন্দা শাজাহান শেখ, জহিরুল শেখসহ অনেকেই খুব কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন।
তারা বলেন, বছরের প্রায় ছয়মাস পানিতে ভরে থাকে মজলিশপুর ও চরমহিদাপুর গ্রামটি। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। তবে অনেকেই আবার নানান পেশার সাথে জড়িত। কেউ পদ্মার বুকে মাছ ধরে সংসার চালান। শহরের সাথে তেমন ভালো যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই গ্রামটির। রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা। এ অঞ্চলের কৃষিপণ্য আনা-নেয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল ঘোড়ার গাড়ি। উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৫-৭ কিলোমিটার চিপা রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতে হয় এলাকার প্রায় ৮-১০ হাজার মানুষের। শুকনা মৌসুমে ওই রাস্তায় কম-বেশি ভ্যান-রিক্সা চলাচল করলেও বর্ষা মৌসুমে চলাচল তো দূরের কথা ঘোড়ার গাড়ী চলাচলেও বড় মুশকিল হয়ে পরতো। সবচেয়ে বড় অসুবিধায় পরতে হয় বর্ষা মৌসুমে। তখন ওই চিপা রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটায় মুশকিল। শহরের সাথে একমাত্র যোগাযোগের জন্য যে রাস্তাটা রয়েছে সেখানে একটা জায়গায় প্রায় হাফ কিলোমিটার রাস্তা নিচু থাকায় বর্ষা মৌসুমে ওই রাস্তা দিয়ে পারাপারের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। তবে এবার ব্রিজ নির্মাণ হওয়ায় কষ্ট লাঘব হয়েছে চরবাসীর।
এলাকার বেশ কয়েকজন লোকের সাথে কথা হলে তাদের মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলেন, বছর দুয়েক আগেও বর্ষা মৌসুমে আমাদের অনেক কষ্ট করে নদী পার হওয়া লাগতো। প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা বছরের প্রায় অর্ধেক মাস পানিতে ভরে থাকে। ফসল আনা-নেওয়া করতে নৌকা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। এই হাফ কিলোমিটার জায়গায় চলাচলের জন্য সুন্দর একটি ব্রিজ নির্মাণ করেছে সরকার। আমরা এখন খুব খুশি।
সরেজমিনে দেখা যায়, মজলিশপুর ও চরমহিদাপুর গ্রামে প্রবেশ করতে হাফ কিলোমিটার রাস্তায় চওড়া একটা ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজ হওয়ায় এখন আর আগের মতো ভোগান্তি পোহাতে হয় না।
স্থানীয় চর দৌলতদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বলেন, ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনাময় চর এটি। এ চরে মৌসুমীভিত্তিক সব ধরনের ফসল খুব ভালোই উৎপাদন হয় কিন্তু যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এখানকার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম পেত না। এর আগে ব্রিজের জন্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরে ব্রিজটি নির্মাণ করেন সরকার। এখন কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়াই খুব সহজে এলাকার মানুষ চলাচল করতে পারছে।
উজানচর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড সদস্য শেখ রাসেল আহম্মেদ জানান, এ অঞ্চলের মানুষের নদীর সাথে যুদ্ধ করেই চলতে হয়। এখন চরাঞ্চলের মানুষ রিকশা, ভ্যান, অটো এমনকি বড় বড় যানবাহনে তাদের কৃষি পন্য খুব সহজেই আনা নেয়া করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, ব্রিজটি নির্মাণ হওয়াতে স্বস্তির নিঃশ্বাস পেয়েছে চরবাসী।
মধুপুর গড়ের শাল বনের লাল মাটিতে ছিল হরেক জাতের বন আলু বুনো খাদ্যের বিশাল ভাণ্ডার। এ খাদ্যই ছিল এ জনপদের গারো সম্প্রদায়ের প্রিয় খাদ্যের অন্যতম উৎস। জীবন-জীবিকার অনন্য উপাদান। স্বাদ-পুষ্টিগুণের এ আলু তোলা তেমন আনন্দের তেমনি স্থানীয়দের কাছে ঐতিহ্যের একটা অংশ হিসেবেও মনে করে তারা। তবে সেই ঐতিহ্যে ভরা স্বাদ গুণেমানের এ আলুর আর সেদিন নেই। নানাভাবে নান কারণে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ায় বিলীন হচ্ছে অফুরন্ত এ খাদ্য ভাণ্ডার। অবশিষ্ট যে বন টিকে আছে, তাতেও আগের মতো নেই হরেক জাতের বন আলু। এমনটাই জানা গেছে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে।
জানা গেছে, ইতিহাস ঐতিহ্য খ্যাত মধুপুর শাল বন ছিল গভীর অরণ্যে ঘেরা। বনের চারপাশে ছিল গারো মান্দিদের বসবাস। গারো সম্প্রদায়ের খামালরা বনের নানা গাছগাছরা দিয়ে তাদের চিকিৎসা করত। স্থানীয় বসতিরাও ভেষজ চিকিৎসা নিত। অরণ্যচারী গারো সম্প্রদায়ের লোকের ভক্ষণ করত বাহারি বুনো খাবার। বনের বিশাল খাদ্য ভাণ্ডারে হতো তাদের বাড়তি অন্নের জোগান। খারি গপ্পার নানা উপকরণ আহরণ হতো বন থেকেই। পুষ্টিগুণে ভরা বন আলু ছিল তাদের খাদ্যের মধ্যে অন্যতম। গারোরা তাদের ভাষায় বন আলুকে ‘থামান্দি বা থাজং’ বলে থাকে। থামান্দি আচিক শব্দ। এর অর্থ বন আলু।
মধুপুরের গায়ড়া, পীরগাছা, ধরাটি, মমিনপুর, জলছত্র, গাছাবাড়ি, ভুটিয়া ও চুনিয়াসহ বিভিন্ন গারোপল্লীতে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আবিমা অঞ্চলের গারোরা বন আলুকে তাদের গারো বা আচিক ভাষায় ‘থামান্দি বা থাজং’ বলে থাকে। তাদের মতে, গারো সম্প্রদায়ের লোকেরাই মধুপুর শালবনে প্রথম বন আলুর সন্ধান পান বলে জানা গেছে। প্রাকৃতিক শালবনের মধুপুর, ঘাটাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা, হালুয়াঘাটে এ আলু পাওয়া যেত। লালমাটির শালবনে প্রাকৃতিকভাবে এসব আলু জন্মায়। এ আলু ছাড়াও বনের অভ্যন্তরে পাওয়া যেত বাহারি রকমের নাম জানা-অজানা অনেক ধরনের আলু। অরণ্যচারী গারোরা বনের চারপাশে বাস করার কারণে তারা এর সন্ধান পান। এক সময় জুম চাষের কারণে এসব আলুর সন্ধান পেতে সহজ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ওই সময় ছনের ছোট ঘর বা মাচাং তুলে তারা থাকার জায়গা করতেন। ছাউনিতে বনের ছন আর বনের তারাই বাঁশ কিংবা ছোট ছোট সরু আকারের ছোট গাছ দিয়ে সুন্দরভাবে বানাতেন ঘর। আগের দিনে খাবার সংকট হলেই ছুটে যেতেন বনে। আধাবেলা আলু সংগ্রহ করলেই পরিবারের অন্নের জোগান হতো কয়েক দিনের এমনটাই জানান তারা।
বন আলু সংগ্রহ যেন সংস্কৃতির একটা অংশ। মনের আনন্দে বা স্বাচ্ছন্দ্যে তারা তাদের দ্বিতীয় প্রধান বনোখাদ্য আলু সংগ্রহ করত। এসব আলু সিদ্ধ করে খেত। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ছিল ভরপুর। তাদের অন্যতম উৎসব ওয়ানগালায় সালজং দেবতা বা শস্য দেবতাকে উৎসর্গ করে থাকে বন আলু। কৃষ্টি-কালচার-ঐতিহ্যে বন আলুর জুড়ি ছিল না। অতিথি কিংবা আত্মীয়-স্বজন এলে আপ্যায়নের জন্য দেওয়া হতো বন আলু। এখনো বনে বিভিন্ন জাতের যত বন আলু সামান্য পাওয়া যায়।
বন এলাকার আদিবাসী গারোদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, এক সময় মধুপুরের এই বনে গাতি আলু, গারো আলু, পান আলু, গইজা আলু, দুধ আলু, শিমুল আলু, কাসাবা, ধারমচআলুসহ বিভিন্ন ধরনের বন আলু পাওয়া যেত। এসব আলু তাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও প্রিয় খাবারের তালিকায় অন্যতম।
অর্চনা নকরেক (৫০) বলেন, অনেকেই আবার স্থানীয়ভাবে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করত। এই আলু দূরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও পাঠানো হতো। বন আলুর বংশবিস্তারের জন্য আলু সংগ্রহের পর গাছগুলো আবার মাটিতে পুঁতে দিতেন আদিবাসীরা। আবার গাছ বেড়ে উঠত। শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে থাকত। এ আলু ফাল্গুন-চৈত্রমাসে সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ করা হতো। রোদে শুকিয়ে ঘরে তুলে রাখা হতো। প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো আলু পাওয়া যায় না।
বৃহত্তর ময়মনসিহ ডেভেলপমেন্ট কালচারাল ফোরামের সভাপতি অজয় এ মৃ বলেন, প্রাকৃতিক বন উজাড়ের ফলে বন আলু কমে গেছে। সামজিক বনায়ন ও অন্যান্য প্রকল্পের ফলে বন ও বনের ঝোঁপঝার উজাড় হওয়ায় বন আলু জীব বৈচিত্র্য পশুপাখিও কমে যাচ্ছে। আদিবাসী ছাড়া অন্য যারা আলু তোলে বিক্রি করে তারা আলু তোলার পর গাছ লাগিয়ে দেয় না। ফলে কমছে বন আলু। তিনি বলেন সামাজিক বনায়ন বন্ধ করে প্রাকৃতিক বন বাড়াতে হবে, আলু তোলার পর আবার গাছ লাগিয়ে দিতে হবে জনসচেতনতা বাড়ানোর কথা বলেন তিনি।
মন্তব্য