১৯৬৮ সালে অপারেশন শুরু করেছিল দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)।
১৯৯৮ সালে ৩০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হলেও এখনও পুরো যৌবন ধরে রেখে উৎপাদনের রেকর্ড গড়ছে ১৫ লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতার এই তেল শোধনাগারটি। এ কারণে ২১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হবে এই প্রতিষ্ঠানকে।
ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপ-ফ্রান্সের তৈরি করা শোধনাগারটির কার্যক্ষমতায় সন্তুষ্ট সরকার এবার ওই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই দ্বিগুণ সক্ষমতার আরেকটি ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জমির অভাব, এক সাবেক জ্বালানি সচিবের অসহযোগিতা ও একটি বেসরকারি কোম্পানির ষড়যন্ত্রে গত ১০ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট। অবশেষে চলতি বছরের মধ্যেই ফরাসি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার চূড়ান্ত চুক্তি হতে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার টার্গেট নতুন শোধনাগারের।
ধারণা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য শেষ হওয়া প্যারিস সফরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সামনেই টেকনিপ-ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি সই হবে। তবে চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের বিষয়ে এখনও কিছু আলোচনা বাকি রয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা তো অনেক বড় কমপ্লেক্স। বর্তমান ইউনিটের দ্বিগুণ। আমাদের বর্তমান ইউনিটের ক্যাপাসিটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন। দ্বিতীয় যে ইউনিটটি হবে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এটা হাইলি টেকনিক্যাল প্রজেক্ট। তাই এটা শুরুতেই গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে। টেকনিপ-ফ্রান্স আমাদের যে টেকনিক্যাল অফারটা দিয়েছে, তার ইভ্যালুয়েশনের কাজ চলছে। আমাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভারতের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ইআইএল ইন্ডিয়া, ইআরএল, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও মন্ত্রণালয় মিলে আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান খোঁজা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ গত মাসে আমরা ৮টি মিটিং করেছি। টেকনিক্যাল আলোচনা শেষ পর্যায়ে আছে।’
লোকমান হোসেন জানান, এরপরই কমার্শিয়াল আলোচনা শুরু হবে। কমার্শিয়াল আলোচনা সফল হলে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি আসবে। টেকনিপ-ফ্রান্স এই কাজটি করবে। প্রকল্পের বেসিক ডিজাইনও তারা করছে। ইপিসি বা কনস্ট্রাকশন কাজটি তাদের দেয়ার জন্য আলোচনা চলছে।
পথে পথে বাধা
সরকারের জ্বালানি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, শুরু থেকেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ে প্রকল্পটি। প্রথমে প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি ও অর্থের অভাবের কথা বলা হয়। দ্বিতীয় ইউনিট তৈরিতে প্রয়োজন ছিল ১২৫ একর জমি। কিন্তু ইআরএলের ছিল মাত্র ৬৪ একর।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন জানান, ইতিমধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়নের জমির সংস্থান হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা জিএম কোম্পানি বা জেনারেল ইলেকট্রনিক্সের কাছ থেকে ৪৫ একর, পদ্মা ওয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ১১ একর ও সরকারের কাছ থেকে সাড়ে ৭ একর খাসজমিসহ ৬৪ একর লিজ নিয়েছি।’
প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়েও ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তা। কোথা থেকে অর্থ আসবে তা নিয়েও ছিল ফাইল চালাচালির লড়াই। অবশেষে সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি প্রকল্প ব্যয়ের ৮০ ভাগ অর্থায়ন করবে। বাকিটা দেবে সরকার।
এর বাইরে ফরাসি প্রযুক্তির উচ্চমূল্যের দোহাই দিয়ে একজন সাবেক জ্বালানি সচিবসহ সরকারের একটি অংশও এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিল। তারা ফরাসি কোম্পানি বাদ দিয়ে অর্ধেক দরে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইআরএলের প্রথম ইউনিটের পারফরম্যান্সের কথা বিবেচনায় নিয়ে টেকনিপকে দিয়েই প্রকল্প বাস্তবায়নে চূড়ান্ত মত দেন।
অন্যদিকে দেশের এক শীর্ষ গ্রুপ অব কোম্পানিজ শুরু থেকেই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিল বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। কোম্পানিটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি বড় ধরনের রিফাইনারি করার পরিকল্পনা করছে। দেশের একমাত্র বিটুমিন উৎপাদন প্ল্যান্টও তাদের। আবার এলপিজি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও প্রায় তাদের হাতে। ফলে তারা নানাভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিল।
তবে ইআরএল এমডি জানান, এই প্রকল্পের প্রতিবন্ধকতা মূলত কয়েকটি টেকনিক্যাল আইটেম নিয়ে। যেমন- কেয়ার এন্ড কাস্টিউর ট্রান্সফার, পার্সোনাল গ্রান্টি অফ দ্য প্ল্যান্ট। এসব নিয়ে তাদের টেকনিপের সঙ্গে আলোচনা ঝুলে যায়। তবে সেই জটিলতাগুলো এখন অনেকটাই কেটে গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, দেশের ৮০ ভাগ চাহিদা এখান থেকে পূরণ হোক। দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা তো কোনো দিনই কমবে না। বাড়তেই থাকবে। অপরিশোধিত তেল কিনে এনে তা শোধন করলে দেশ যেমন শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রারও অপচয় কমবে। জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।’
তিনি জানান, সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এ বছরের মধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ফ্রান্সের টেকনিপ-ফ্রান্স এর সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি সই হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিপিসির পরিচালক অপারেশন সৈয়দ মেহেদি হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুরুর সমস্যা কাটিয়ে প্রকল্পটি যথাসম্ভব দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে বিপিসি। এই প্রকল্পে সরকারি তরফে ২০ শতাংশ এবং বিপিসির পক্ষ থেকে ৮০ শতাংশ অর্থায়নের সিদ্ধান্তটি এখন পর্যন্ত বহাল আছে।’
অন্যদিকে বিপিসির উপব্যবস্থাপক প্ল্যানিং অ্যান্ড শিপিং মোস্তাফিজুর রহমান জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটটি নির্মাণে সরকারি অর্থায়নের ২০ শতাংশ অর্থ বিদেশি বিনিয়োগ থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী চলমান কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতিতে বিদেশি অর্থায়নের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিপিসিকে আবারও এই প্রকল্পের প্রস্তাব সংশোধন করতে হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধিত প্রস্তাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়ভার ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। এই ডিপিপি গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এখন এই প্রকল্প বাস্তবায়নের শতভাগ ব্যয়ভার বিপিসিকেই বহন করতে হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, এটি শিগগিরই অনুমোদিত হয়ে আসবে।
পরামর্শক ভারতীয় ইআইএল
ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়নে পরামর্শকের ভূমিকায় আছে ভারতের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারি কার্যালয়ে চুক্তির সময় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) মোসলেহ উদ্দিন ও ভারতের পক্ষে ইআইএলের নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং) উপেন্দর মহেশ্বরী চুক্তিতে সই করেন। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও ভারতের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ১১০ কোটি ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে এই প্রকল্পের পরামর্শক হিসেব কাজ করছে ইআইএল।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড একটি ইউনিট দিয়ে দেশের জ্বালানি চাহিদার এক-চতুর্থাংশ পূরণ করছে। আরেকটি ইউনিট বাস্তবায়িত হলে দেশের মোট জ্বালানি চাহিদার ৭৬ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে। দেশের জ্বালানি সক্ষমতা ৩ মিলিয়ন টন বৃদ্ধি পাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।’
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে একসময় রপ্তানি করত প্রতিষ্ঠানটি।
তবে এই প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হলেও নতুন কোনো প্ল্যান্ট এখনও সৃষ্টি হয়নি। ফলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি নির্ভরতাও।
চুক্তি হতেই এক যুগ
পরিশোধিত আমদানির চেয়ে তেল পরিশোধন লাভজনক হওয়ায় ২০১০ সালে সরকার দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য ৩০ মিলিয়ন পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি-২ নামের নতুন একটি প্ল্যান্ট প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সে সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু ১১ বছরেও প্রকল্প বাস্তবায়নে চূড়ান্ত চুক্তি করতে পারেনি সরকার।
অন্যদিকে ১০ বারের বেশি ব্যয় বাড়িয়ে এখন সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি খাতের রিফাইনারিদের সুযোগ দিতে বিপিসির প্রকল্পটির বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও কাজ শুরু করতে পারেননি দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। যার কারণে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও বিপিসি ও ইআরএলের নতুন প্রকল্প নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ বলে দাবি করেছেন তারা।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অনলাইনে বিপিসির বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পের পর্যালোচনা সভায় ইআরএলের দ্বিতীয় প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। প্রকল্প পরিচালকদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার জন্য প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয় এর দায় নেবে না বলে ওই সভায় জানিয়ে দেন তিনি। প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে ওই সভায় মনিটরিং জোরদার করারও নির্দেশ দেন।
মন্ত্রীর নির্দেশনার পর ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের (ইএলবিএল) এমডি লোকমানকে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ইআরএলের সদ্য সাবেক এমডি মো. আকতারুল হক প্রকল্পটির কাজের অগ্রগতি দেখাতে না পারায় তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার থেকে প্রকল্পটির কাজ শুরুর জন্য বিপিসি ও রিফাইনারির দায়িত্বপ্রাপ্তদের বারবার নোটিশ করলেও অজানা কারণে প্রকল্পের কাজ নিয়ে কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেননি তারা। এমনকি ইস্টার্ন রিফাইনারির প্রকল্পের কাজ বাদ দিয়ে বরং এই সময়ে বেসরকারি খাতের রিফাইনারির অনুমোদনের পরিমাণ বাড়ানো হয়।
এক নজরে ইআরএল
১৯৬৮ সালে ইআরএল শোধনাগারটির নকশা নির্মাণ করেছিল ফরাসি কোম্পানি টেকনিপ।
এই প্রকল্পে ১০টি প্রসেসিং ইউনিট রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিট সম্পন্ন হলে ইআরএল থেকে ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসেবে পাওয়া যাবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেসঅয়েল, জেট এ-১, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার। এতে আমদানি করা পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যে ব্যয় সাশ্রয় হবে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ৭৯৩ টন এলপিজি, ৯৬ হাজার ৮২১ টন ন্যাপথা, ৮৭ হাজার ৮৬৬ টন এমএস (পেট্রল), ৫ হাজার ৮৫৩ টন এইচওবিসি (অকটেন), ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৭ টন এসকেও (কেরোসিন), ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭০ টন এইচএসডি (ডিজেল), ২০ হাজার ২৪৯ টন জেবিও, ৩ লাখ ৩ হাজার ৫১১ টন ফার্নেস ওয়েল (এফও), ৫৮ হাজার ১৬২ টন বিটুমিন এবং ১০ হাজার ২৮৮ টন অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে।
২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ইস্টার্ন রিফাইনারি ৪৬ হাজার ৫২৭ টন হাই স্পিড ডিজেল (এইসএসডি), ২৬ হাজার ২২৭ টন হাই অক্টেন ব্লেন্ডিং কম্পোনেট (এইচওবিসি) এবং ৫০ হাজার ৫১ টন ফার্নেস ওয়েল (এইচএস) আমদানি করে।
২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯৩ হাজার ৮৬ টন ন্যাপথা রপ্তানি করলেও পরের বছর থেকে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
মেয়াদ শেষের দুই যুগের মাথায় উৎপাদনে জোয়ার
১৯৯৮ সালে জীবনকাল শেষ হয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারির প্রথম ইউনিটের। সেই হিসাবে প্রায় দুই যুগ আগে মেয়াদ শেষ হওয়া প্রতিষ্ঠানটির যৌবন এখনও শেষ হয়নি। এবার ১৫ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতার প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত ৪৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন করে রেকর্ড করেছে।
এতে খুশি হয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটিকে পুরস্কৃত করার জন্য। আগামী ২১ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে এই পুরস্কার তুলে দেবেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
প্রতিষ্ঠানের এমডি লোকমান হোসেন বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতি সেকেন্ডকে গুরুত্বের সঙ্গে কাউন্ট করেছি। বিশ্বে কখনোই কোনো প্রযুক্তির শতভাগ সাপোর্ট পাওয়া যায় না। সিস্টেম লস থাকে। অপারেশন লসও থাকে। কিন্তু এবার লক্ষ্য ছিল, যেহেতু আমাদের মুজিব শতবর্ষ চলছে, স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী চলছে, আমরা একটা কিছু করবোই। আমার টিমের সবার সহায়তায় সেটা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে ইস্টার্ন রিফাইনারির চালু ১ নম্বর ইউনিটটি ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ২৪৫ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানির জোগান দেয়। বাকি প্রায় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয় বিপিসিকে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের রুহের মাগফিরাত এবং আহতদের সুস্থতা কামনা করে গতকাল মঙ্গলবার বাদ যোহর জনতা ব্যাংক পিএলসির প্রধান কার্যালয়ের নামাজ ঘরে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে নামাজ ঘরে এক আলোচনা সভায় ব্যাংকের পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান মুহ. ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবর রহমান বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এ সময় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপকরা, জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি ও জাতীয়তাবাদী কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃরাসহ সব স্তরের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
আমদানি করা প্রসাধনী সামগ্রীর ওপর থেকে অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহার না করলে আগামী ৭ জুলাই এনবিআর ভবন ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কসমেটিকস ও টয়লেট্রিজ আমদানিকারকরা।
মঙ্গলবার (০১ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নতুন বাজেটে প্রসাধনী সামগ্রীর ওপর দেড়শ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিবাদে আয়োজিত এক মানববন্ধনে ব্যবসায়ীরা এই হুঁশিয়ারি দেন।
ব্যবসায়ীরা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে লিপ কেয়ার, ফেস ক্রিম, পাউডারসহ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীর দাম কম হলেও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে বেড়েছে দাম। এতে বাজারে বাড়ছে অবৈধ পথে আসা প্রসাধনীর সরবরাহ। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর শঙ্কাও প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাজেটে প্রসাধনী পণ্যের ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব বৈধ আমদানিকে নিরুৎসাহিত করবে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিটিআইএ)। তাদের মতে, শুল্ক বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা পাচার বাড়াবে, বাজারে নকল ও মানহীন পণ্যের দৌরাত্ম্য তৈরি করবে এবং ২৫ লাখের বেশি মানুষ বেকার হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
সংগঠনটির দাবি, এই শুল্ক কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে এবং দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর সরাসরি অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে।
বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘বর্তমানে আমদানিকৃত প্রসাধনী সামগ্রীর ওপর যে ন্যূনতম শুল্কহার বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এটি দেশের বৈধ আমদানির পথকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে, যা পরিণামে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। বাজার ভরে যাবে নকল ও নিম্নমানের পণ্যে, যা শুধু ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে ফেলবে না, বরং হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং তাদের কর্মচারীরা জীবিকা হারাবেন।’
সাধারণ সম্পাদক মো. সাহিদ হোসেন বলেন, প্রধান উপদেষ্টার অন্যতম লক্ষ্য হলো নতুন নতুন ব্যবসা সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। তবে, চলতি বাজেটে আমদানিকৃত প্রসাধনী পণ্যের উপর ১৫০% পর্যন্ত ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশ ২.০-এর লক্ষ্য এবং প্রধান উপদেষ্টার অভিন্ন লক্ষ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী।
এরপরও চলতি বাজেটে এসব পণ্যের ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা দেশের প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান ঘিরে থাকা এই খাতের ওপর এক সরাসরি আঘাত। এই বৈষম্যমূলক করনীতি কেবল বৈধ ব্যবসার পরিপন্থী নয়, বরং দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক—যারা আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
সাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে। চোরাচালান, ভুল ঘোষণা (misdeclaration) ও রাজস্ব ফাঁকির ঝুঁকি বহুগুণে বাড়বে। বেকারত্ব বাড়ায় সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।’
চোরাচালান বাড়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি সিলেটে প্রসাধনীসহ শুল্ক বেড়েছে এমন সাত কোটি টাকার চোরাই পণ্য জব্দ করেছে বিজিবি। যা আমাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করে। মানববন্ধন কর্মসূচিতে প্রসাধনী ব্যবসায়ী, অ্যাসোসিয়েশনের অন্যান্য নেতা ও সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি কমে এসেছে। সেই সঙ্গে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করবে—মন খবর বাজারে আসায় তেলের বাজারে স্বস্তি ফিরেছে। এ পরিস্থিতিতে আজ সোমবার (৩০ জুন) বিশ্ববাজারে তেলের দাম প্রায় ১ শতাংশ কমেছে।
আগস্ট মাসের জন্য ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৬৬ সেন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৬৭ দশমিক ১১ ডলার। সেপ্টেম্বর মাসের জন্য দাম আরও কমেছে। সে ক্ষেত্রে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮৩ সেন্ট কমে গিয়ে ৬৫ দশমিক ৯৭ ডলার হয়েছে। সেই সঙ্গে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুড বা ডব্লিউটিও ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯৪ সেন্ট বা ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমে ৬৪ দশমিক ৫৮ ডলারে নেমে এসেছে।
গত সপ্তাহে বড় ধরনের দরপতনের মুখে পড়েছিল তেলের বাজার। সাপ্তাহিক দরপতনের দিক থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাসের পর গত সপ্তাহে দাম কমেছে সবচেয়ে বেশি। তবে সামগ্রিকভাবে জুন মাসে তেলের দাম বেড়েছে। আজ সোমবার (৩০ জুন) শেষ দিনের দামের পূর্বাভাসসহ ধারণা করা হচ্ছে, জুন মাসে তেলের দাম ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের একটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর তেলের দাম বাড়তে থাকে। শেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার পর তা দ্রুত নেমে আসে ৬৭ ডলারে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইজি মার্কেটসের বিশ্লেষক টনি সাইকামোর বলেন, বাজারে যে আতঙ্কজনিত বাড়তি মূল্য ছিল, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির পর তা অনেকটাই মুছে গেছে।’
এদিকে ওপেক ও সহযোগী জোটের চারজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তারা আগস্ট মাসে প্রতিদিন ৪ লাখ ১১ হাজার ব্যারেল তেল উৎপাদন বাড়াতে যাচ্ছেন। মে, জুন ও জুলাই মাসেও একই পরিমাণে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। আগামী ৬ জুলাই ওপেক ও সহযোগী দেশগুলোর বৈঠকে বসার কথা। এপ্রিল মাসে উৎপাদন হ্রাসের ধারার থেকে বের হওয়ার পর এটি হবে পঞ্চম দফায় উৎপাদন বৃদ্ধি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় তেল খনির সংখ্যা আরও ছয়টি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩২-এ, অক্টোবর ২০২১ সালের পর যা সর্বনিম্ন। এ তথ্য দিয়েছে খনিজ খাতের প্রতিষ্ঠান বেকার হিউজ।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে অর্থবছরের শেষ দিন আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের সব ব্যাংকের শাখাগুলোতে ব্যাংকিং লেনদেন চলবে।
সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সমকালকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৩০ জুন সকাল ১০টা পর্যন্ত ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরের চেয়ে এবার বেশি রাজস্ব আদায় হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স খাতে এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে দেশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষ হতে এখনো দুদিন বাকি থাকলেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ ইতোমধ্যে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা ধরে)। এটি দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৪.৭৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল, যা এবার ছাপিয়ে গেছে। ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গতকাল রোববার এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
চলতি জুন মাসের প্রথম ২৮ দিনেই প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২.৫৪ বিলিয়ন ডলার (২৫৪ কোটি), যা প্রায় ৩১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। মাসের বাকি দিনগুলোতেও একই ধারা বজায় থাকলে জুন শেষে মোট রেমিট্যান্স ২.৭০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হুন্ডি প্রতিরোধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রণোদনা, প্রবাসীদের জন্য ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার সম্প্রসারণ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি—এসবই এই রেকর্ড প্রবাহে সহায়ক হয়েছে। চলতি বছর প্রাপ্ত পুরো রেমিট্যান্স এসেছে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে।
মাসভিত্তিক প্রবাহের চিত্র
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাসভিত্তিক রেমিট্যান্স পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুলাই মাসে এসেছে ১৯১ কোটি ডলার, আগস্টে ২২২ কোটি, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি, নভেম্বরে ২২০ কোটি এবং ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স। নতুন বছরের শুরুতে জানুয়ারিতে এসেছে ২১৯ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২৫২ কোটি, মার্চে সর্বোচ্চ ৩২৯ কোটি, এপ্রিলে ২৭৫ কোটি এবং মে মাসে এসেছে ২৯৭ কোটি ডলার। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মার্চ মাসে ৩৩০ কোটির বেশি ডলার এসেছে, যা দেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ বলেন, ‘এটি শুধু সংখ্যাগত সাফল্য নয়, বরং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার প্রতিফলন। সঠিক নীতিমালা, প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ ব্যাংকিং অবকাঠামো এবং আইনগত পদক্ষেপ একত্রে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়িয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও এই অর্থপ্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি দিয়েছে, ডলারের বাজারে চাপ কমিয়েছে এবং আমদানি ব্যয় মেটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। তবে এই ধারা টিকিয়ে রাখতে হলে বহুমুখী শ্রমবাজার, স্বচ্ছ অভিবাসন প্রক্রিয়া ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (জুলাই থেকে ২৮ জুন) মধ্যে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৩০.০৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬.৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ২৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রেমিট্যান্সবান্ধব নীতিমালা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আস্থা ও সহযোগিতাই এই সাফল্যের পেছনে মূল চালিকা শক্তি।
২০২৪-২৫ অর্থবছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাতে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। এই গতি ধরে রাখতে হলে হুন্ডি প্রতিরোধ কার্যক্রম আরও জোরদার করা, প্রবাসীদের আস্থার জায়গা সুসংহত রাখা এবং বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিবেশ আরও সহজতর করা অপরিহার্য। রেমিট্যান্স এখন শুধু অর্থপ্রবাহ নয়, বরং অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম কৌশলগত হাতিয়ার।
ঢাকা, ২৯ জুন ২০২৫ – অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাজারভিত্তিক উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে আইডিই বাংলাদেশ ঢাকার লো মেরিডিয়ান হোটেলে আয়োজিত “Catalyzing Markets: iDE Bangladesh Private Sector Engagement Summit 2025”-এ তাদের প্রাইভেট সেক্টর এনগেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি ২০২৫–২০৩০ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে।
সামিটে সরকারি প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন সহযোগী এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি খাতের ২০০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, এসিআই, এসএমসি, লাল তীর সিড লিমিটেড, এনআরবিসি ব্যাংক, রুরাল সার্ভিসেস ফাউন্ডেশন, রহিম আফরোজ, ইসপাহানি এগ্রো, ব্র্যাক, গ্রামীণ ড্যানন ফুডস লিমিটেড। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংক, এফসিডিও, ইউনিসেফ, জিআইজেড, ইউএনডিপি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইতালীয় ও ডেনিশ দূতাবাস-এর প্রতিনিধিরা।
সামিটে ১৪টি প্রাইভেট সেক্টর প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয় এবং একটি প্রদর্শনী আয়োজন করা হয় যেখানে কৃষি, ওয়াশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পুষ্টি ও ফিনটেক খাতের উদ্ভাবনী সমাধান তুলে ধরা হয়।
প্রধান অতিথি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি ও চেয়ারপারসন, ব্র্যাক বলেন, “আইডিইর এই স্ট্র্যাটেজি একটি সময়োপযোগী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগ, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য একটি কার্যকর কাঠামো তৈরি করবে।”
বিশিষ্ট বক্তাদের মধ্যে ছিলেন:
উজমা চৌধুরী, পরিচালক (ফাইন্যান্স), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ
মোহাম্মদ মোহিউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডিশনাল জেনারেল ম্যানেজার, এসএমসি
কাজি মো. সাফায়েত কবির, সিনিয়র EVP, এনআরবিসি ব্যাংক
ইঞ্জিনিয়ার সাদিদ জামিল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দি মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড
নিতাই পদ সাহা, সিইও, রুরাল সার্ভিসেস ফাউন্ডেশন (RSF)
সামীর কার্কি, কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইডিই বাংলাদেশ বলেন, “এই স্ট্র্যাটেজি কেবল একটি নীতি-নির্ধারণী দলিল নয়; এটি একটি যৌথ ভিশন—যেখানে ব্যবসা ও উন্নয়ন একসাথে কাজ করে টেকসই সমাধান তৈরি করে যা সকলের জন্য কার্যকর বাজার গড়ে তোলে।”
এই নতুন কৌশলগত রোডম্যাপ আইডিইর চার দশকের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে গঠিত, যার লক্ষ্য হলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে বৃহৎ কর্পোরেশন পর্যন্ত সকলের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজারব্যবস্থা তৈরি।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকারী অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরুর ৩ বছরপূর্তি ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার। ২০২২ সালের ২৬ জুনের এই দিনে বহু প্রতিক্ষিত পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। এরপর এক মুহুর্তের জন্য সেতুতে যান চলাচল বন্ধ হয়নি। আর এই তিন বছরে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৯২টি যান পারাপারে টোল আদায় হয়েছে ২ হাজার ৫ শ’ ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৬২ হাজার ৮শ’ টাকা।
পদ্মা সেতু দক্ষিণের মানুষের বিড়ম্বনা লাঘব করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এখন। উত্তাল নদী পারপারের ভোগান্তি থেকে শুধু মুক্তিই দেয়নি এই সেতু পাল্টে দিয়েছে দক্ষিণের আর্থ সামাজিক অবস্থাও। উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত, শিল্প কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যেও যুগান্তকারী পরিবর্তন। খুলে গেছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।
সেতুর উপর তলায় সড়ক পথ ও আর নিচ দিয়ে ছুটছে ট্রেন। রাতদিন দ্রত বেগে পদ্মার উপর দিয়ে চলছে ট্রেন ও সড়ক পথের যাত্রা। পদ্মা সেতুর ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন হলেও পরদিন ২৬ জুন এই দিনে পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হয়। পরের বছর ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতুর রেলপথ উদ্বোধন হয়। পদ্মা সেতু হয়ে চালু হয় ঢাকা-ভাঙ্গা নতুন রেল নেটওয়ার্ক। আর ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর রেল লিঙ্ক প্রকল্প পুরোপুরি চালু হয়। এদিন রাজধানী থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ভাঙ্গা হয়ে নতুন পথে নড়াইল ও যশোর অতিক্রম করে খুলনা পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। রাজধানী থেকে মাত্র সাড়ে ৩ ঘন্টায় খুলনা ও বেনাপোল পৌছানো যাচ্ছে। তাই এখন দক্ষিণের মানুষ সড়ক ও ট্রেন পথের সুফল পাচ্ছে।
এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা খুঁটি ব্যবহার করে। সেতু উপর দিয়ে যাওয়া উচ্চ ক্ষমতার ইন্টারনেট লাইন ব্যবহার হচ্ছে। সেতুতে নির্মাণ করে রাখা গ্যাস লাইন ব্যবহারে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে দক্ষিণের জনপদ, এখন অপেক্ষা এখন। তাই খুশি সবাই।
পদ্মা সেতুর দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়াদ বলেন, কোন হেসেল ছাড়াই টানা দিন বছর সেতুতে নিরবিচ্ছিন্নভাবর যান পারাপার করা হয়। এটি একটি বড় মাইলফলক। পদ্মা সেতুর দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) যুগ্ম সচিব আলতাফ হোসেন সেখ বলেন, দেশের এই অবকাঠামো যেমন মানুষের উপকারে লাগছে, আবার রাজস্ব আয়ও হচ্ছে। সেতু ব্যবহারে টোল আদায় আরও সহজ করা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই চলন্ত অবস্থায়ই টোল পরিশোধ করা যাবে।
স্বপ্নের সেতু চালুর তিন বছরে পারাপার হয়েছে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৯২টি। এর মধ্যে মাওয়া দিয়ে প্রবেশ করে ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ১১২টি যান। আর ৯৮ লাখ ৫৮০টি যান জাজিরা প্রান্ত দিয়ে পদ্মা সেতুতে প্রবেশ করে। মাওয়া থেকে ১ লাখ ২৯ হাজার ৪শ’৬৮ বেশি যান জাজিরা প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে।
গত ৫ জুন পদ্মা সেতুতে এক দিনে রেকর্ড পরিমান ৫ কোটি ৪৩ লাখ ২৮ হাজার টাকার টোল আদায় হয়েছে। এই ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫২ হাজার ৪৮৭টি যানবাহন পারাপার হয়। পদ্মা সেতুতে একদিনে সর্বোচ্চ টোল আদায় ও যানবাহন পারাপারের নতুন রেকর্ড এটি। এর আগে ২০২২ সালের ২৬ জুন পদ্মা সেতুর যান চলাচলের শুরুর দিনে সর্বোচ্চ ৫১ হাজর ৩১৬টি যানবাহন পারাপারের রেকর্ড ছিল। আর ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল ইদুল ফতরের আগে সর্বোচ্চ টোল আদায়ের রেকর্ড ছিল ৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭শ' টাকা।
নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়াদ বলেন, সেতু চালুর প্রথম বছর ৫৬ লাখ ৯৪ হাজার ৮৯৯টি যানবাহন পারাপারে টোল আদায় হয়েছে ৭৯৮ কোটি ৬০ লাখ ৯৩ হাজার ৭শ’ টাকা। দ্বিতীয় বছর ৬৮ লাখ ১ হাজার ৩৭৪টি যানের বিপরীতে টোল পাওয়া যায় ৮৫০ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩শ’ ৫০ টাকা। আর তৃতীয় বছর ২৫ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার ২২৯টি যান পারাপারে টোল আদায় হয় ৮৬১ কোটি ২২ লাখ ১৮ হাজার ৮৫৯ টাকা। মূল পদ্মা সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ। তবে অ্যাপ্রোচসহ প্রায় ১০ কিলোমিটার। সেতু নিরাপত্তাসহ ট্রাফিক আইন মেনে পদ্মা সেতুতে যানাবাহানের নির্বিঘ্ন চলাচলে সেতু এবং দুই প্রান্তের সড়ক জুড়ে অত্যাধুনিক ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। সেতুতে যানবাহানের গতিও বৃদ্ধি করে দুই পারের এক্সপ্রেসওয়ের মতই ঘন্টায় সর্বোচ্চ গতি করা হয়েছে ৮০ কিলোমিটার।
মন্তব্য