১৯৬৮ সালে অপারেশন শুরু করেছিল দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)।
১৯৯৮ সালে ৩০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হলেও এখনও পুরো যৌবন ধরে রেখে উৎপাদনের রেকর্ড গড়ছে ১৫ লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতার এই তেল শোধনাগারটি। এ কারণে ২১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হবে এই প্রতিষ্ঠানকে।
ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপ-ফ্রান্সের তৈরি করা শোধনাগারটির কার্যক্ষমতায় সন্তুষ্ট সরকার এবার ওই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই দ্বিগুণ সক্ষমতার আরেকটি ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জমির অভাব, এক সাবেক জ্বালানি সচিবের অসহযোগিতা ও একটি বেসরকারি কোম্পানির ষড়যন্ত্রে গত ১০ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট। অবশেষে চলতি বছরের মধ্যেই ফরাসি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার চূড়ান্ত চুক্তি হতে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার টার্গেট নতুন শোধনাগারের।
ধারণা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য শেষ হওয়া প্যারিস সফরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সামনেই টেকনিপ-ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি সই হবে। তবে চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের বিষয়ে এখনও কিছু আলোচনা বাকি রয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা তো অনেক বড় কমপ্লেক্স। বর্তমান ইউনিটের দ্বিগুণ। আমাদের বর্তমান ইউনিটের ক্যাপাসিটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন। দ্বিতীয় যে ইউনিটটি হবে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এটা হাইলি টেকনিক্যাল প্রজেক্ট। তাই এটা শুরুতেই গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে। টেকনিপ-ফ্রান্স আমাদের যে টেকনিক্যাল অফারটা দিয়েছে, তার ইভ্যালুয়েশনের কাজ চলছে। আমাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভারতের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ইআইএল ইন্ডিয়া, ইআরএল, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও মন্ত্রণালয় মিলে আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান খোঁজা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ গত মাসে আমরা ৮টি মিটিং করেছি। টেকনিক্যাল আলোচনা শেষ পর্যায়ে আছে।’
লোকমান হোসেন জানান, এরপরই কমার্শিয়াল আলোচনা শুরু হবে। কমার্শিয়াল আলোচনা সফল হলে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি আসবে। টেকনিপ-ফ্রান্স এই কাজটি করবে। প্রকল্পের বেসিক ডিজাইনও তারা করছে। ইপিসি বা কনস্ট্রাকশন কাজটি তাদের দেয়ার জন্য আলোচনা চলছে।
পথে পথে বাধা
সরকারের জ্বালানি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, শুরু থেকেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ে প্রকল্পটি। প্রথমে প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি ও অর্থের অভাবের কথা বলা হয়। দ্বিতীয় ইউনিট তৈরিতে প্রয়োজন ছিল ১২৫ একর জমি। কিন্তু ইআরএলের ছিল মাত্র ৬৪ একর।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন জানান, ইতিমধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়নের জমির সংস্থান হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা জিএম কোম্পানি বা জেনারেল ইলেকট্রনিক্সের কাছ থেকে ৪৫ একর, পদ্মা ওয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ১১ একর ও সরকারের কাছ থেকে সাড়ে ৭ একর খাসজমিসহ ৬৪ একর লিজ নিয়েছি।’
প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়েও ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তা। কোথা থেকে অর্থ আসবে তা নিয়েও ছিল ফাইল চালাচালির লড়াই। অবশেষে সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি প্রকল্প ব্যয়ের ৮০ ভাগ অর্থায়ন করবে। বাকিটা দেবে সরকার।
এর বাইরে ফরাসি প্রযুক্তির উচ্চমূল্যের দোহাই দিয়ে একজন সাবেক জ্বালানি সচিবসহ সরকারের একটি অংশও এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিল। তারা ফরাসি কোম্পানি বাদ দিয়ে অর্ধেক দরে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইআরএলের প্রথম ইউনিটের পারফরম্যান্সের কথা বিবেচনায় নিয়ে টেকনিপকে দিয়েই প্রকল্প বাস্তবায়নে চূড়ান্ত মত দেন।
অন্যদিকে দেশের এক শীর্ষ গ্রুপ অব কোম্পানিজ শুরু থেকেই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিল বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। কোম্পানিটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি বড় ধরনের রিফাইনারি করার পরিকল্পনা করছে। দেশের একমাত্র বিটুমিন উৎপাদন প্ল্যান্টও তাদের। আবার এলপিজি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও প্রায় তাদের হাতে। ফলে তারা নানাভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিল।
তবে ইআরএল এমডি জানান, এই প্রকল্পের প্রতিবন্ধকতা মূলত কয়েকটি টেকনিক্যাল আইটেম নিয়ে। যেমন- কেয়ার এন্ড কাস্টিউর ট্রান্সফার, পার্সোনাল গ্রান্টি অফ দ্য প্ল্যান্ট। এসব নিয়ে তাদের টেকনিপের সঙ্গে আলোচনা ঝুলে যায়। তবে সেই জটিলতাগুলো এখন অনেকটাই কেটে গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, দেশের ৮০ ভাগ চাহিদা এখান থেকে পূরণ হোক। দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা তো কোনো দিনই কমবে না। বাড়তেই থাকবে। অপরিশোধিত তেল কিনে এনে তা শোধন করলে দেশ যেমন শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রারও অপচয় কমবে। জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।’
তিনি জানান, সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এ বছরের মধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ফ্রান্সের টেকনিপ-ফ্রান্স এর সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি সই হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিপিসির পরিচালক অপারেশন সৈয়দ মেহেদি হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুরুর সমস্যা কাটিয়ে প্রকল্পটি যথাসম্ভব দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে বিপিসি। এই প্রকল্পে সরকারি তরফে ২০ শতাংশ এবং বিপিসির পক্ষ থেকে ৮০ শতাংশ অর্থায়নের সিদ্ধান্তটি এখন পর্যন্ত বহাল আছে।’
অন্যদিকে বিপিসির উপব্যবস্থাপক প্ল্যানিং অ্যান্ড শিপিং মোস্তাফিজুর রহমান জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটটি নির্মাণে সরকারি অর্থায়নের ২০ শতাংশ অর্থ বিদেশি বিনিয়োগ থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী চলমান কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতিতে বিদেশি অর্থায়নের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিপিসিকে আবারও এই প্রকল্পের প্রস্তাব সংশোধন করতে হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধিত প্রস্তাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়ভার ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। এই ডিপিপি গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এখন এই প্রকল্প বাস্তবায়নের শতভাগ ব্যয়ভার বিপিসিকেই বহন করতে হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, এটি শিগগিরই অনুমোদিত হয়ে আসবে।
পরামর্শক ভারতীয় ইআইএল
ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়নে পরামর্শকের ভূমিকায় আছে ভারতের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারি কার্যালয়ে চুক্তির সময় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) মোসলেহ উদ্দিন ও ভারতের পক্ষে ইআইএলের নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং) উপেন্দর মহেশ্বরী চুক্তিতে সই করেন। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও ভারতের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ১১০ কোটি ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে এই প্রকল্পের পরামর্শক হিসেব কাজ করছে ইআইএল।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড একটি ইউনিট দিয়ে দেশের জ্বালানি চাহিদার এক-চতুর্থাংশ পূরণ করছে। আরেকটি ইউনিট বাস্তবায়িত হলে দেশের মোট জ্বালানি চাহিদার ৭৬ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে। দেশের জ্বালানি সক্ষমতা ৩ মিলিয়ন টন বৃদ্ধি পাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।’
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে একসময় রপ্তানি করত প্রতিষ্ঠানটি।
তবে এই প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হলেও নতুন কোনো প্ল্যান্ট এখনও সৃষ্টি হয়নি। ফলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি নির্ভরতাও।
চুক্তি হতেই এক যুগ
পরিশোধিত আমদানির চেয়ে তেল পরিশোধন লাভজনক হওয়ায় ২০১০ সালে সরকার দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য ৩০ মিলিয়ন পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি-২ নামের নতুন একটি প্ল্যান্ট প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সে সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু ১১ বছরেও প্রকল্প বাস্তবায়নে চূড়ান্ত চুক্তি করতে পারেনি সরকার।
অন্যদিকে ১০ বারের বেশি ব্যয় বাড়িয়ে এখন সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি খাতের রিফাইনারিদের সুযোগ দিতে বিপিসির প্রকল্পটির বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও কাজ শুরু করতে পারেননি দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। যার কারণে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও বিপিসি ও ইআরএলের নতুন প্রকল্প নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ বলে দাবি করেছেন তারা।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অনলাইনে বিপিসির বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পের পর্যালোচনা সভায় ইআরএলের দ্বিতীয় প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। প্রকল্প পরিচালকদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার জন্য প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয় এর দায় নেবে না বলে ওই সভায় জানিয়ে দেন তিনি। প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে ওই সভায় মনিটরিং জোরদার করারও নির্দেশ দেন।
মন্ত্রীর নির্দেশনার পর ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের (ইএলবিএল) এমডি লোকমানকে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ইআরএলের সদ্য সাবেক এমডি মো. আকতারুল হক প্রকল্পটির কাজের অগ্রগতি দেখাতে না পারায় তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার থেকে প্রকল্পটির কাজ শুরুর জন্য বিপিসি ও রিফাইনারির দায়িত্বপ্রাপ্তদের বারবার নোটিশ করলেও অজানা কারণে প্রকল্পের কাজ নিয়ে কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেননি তারা। এমনকি ইস্টার্ন রিফাইনারির প্রকল্পের কাজ বাদ দিয়ে বরং এই সময়ে বেসরকারি খাতের রিফাইনারির অনুমোদনের পরিমাণ বাড়ানো হয়।
এক নজরে ইআরএল
১৯৬৮ সালে ইআরএল শোধনাগারটির নকশা নির্মাণ করেছিল ফরাসি কোম্পানি টেকনিপ।
এই প্রকল্পে ১০টি প্রসেসিং ইউনিট রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিট সম্পন্ন হলে ইআরএল থেকে ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসেবে পাওয়া যাবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেসঅয়েল, জেট এ-১, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার। এতে আমদানি করা পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যে ব্যয় সাশ্রয় হবে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ৭৯৩ টন এলপিজি, ৯৬ হাজার ৮২১ টন ন্যাপথা, ৮৭ হাজার ৮৬৬ টন এমএস (পেট্রল), ৫ হাজার ৮৫৩ টন এইচওবিসি (অকটেন), ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৭ টন এসকেও (কেরোসিন), ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭০ টন এইচএসডি (ডিজেল), ২০ হাজার ২৪৯ টন জেবিও, ৩ লাখ ৩ হাজার ৫১১ টন ফার্নেস ওয়েল (এফও), ৫৮ হাজার ১৬২ টন বিটুমিন এবং ১০ হাজার ২৮৮ টন অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে।
২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ইস্টার্ন রিফাইনারি ৪৬ হাজার ৫২৭ টন হাই স্পিড ডিজেল (এইসএসডি), ২৬ হাজার ২২৭ টন হাই অক্টেন ব্লেন্ডিং কম্পোনেট (এইচওবিসি) এবং ৫০ হাজার ৫১ টন ফার্নেস ওয়েল (এইচএস) আমদানি করে।
২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯৩ হাজার ৮৬ টন ন্যাপথা রপ্তানি করলেও পরের বছর থেকে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
মেয়াদ শেষের দুই যুগের মাথায় উৎপাদনে জোয়ার
১৯৯৮ সালে জীবনকাল শেষ হয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারির প্রথম ইউনিটের। সেই হিসাবে প্রায় দুই যুগ আগে মেয়াদ শেষ হওয়া প্রতিষ্ঠানটির যৌবন এখনও শেষ হয়নি। এবার ১৫ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতার প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত ৪৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন করে রেকর্ড করেছে।
এতে খুশি হয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটিকে পুরস্কৃত করার জন্য। আগামী ২১ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে এই পুরস্কার তুলে দেবেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
প্রতিষ্ঠানের এমডি লোকমান হোসেন বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতি সেকেন্ডকে গুরুত্বের সঙ্গে কাউন্ট করেছি। বিশ্বে কখনোই কোনো প্রযুক্তির শতভাগ সাপোর্ট পাওয়া যায় না। সিস্টেম লস থাকে। অপারেশন লসও থাকে। কিন্তু এবার লক্ষ্য ছিল, যেহেতু আমাদের মুজিব শতবর্ষ চলছে, স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী চলছে, আমরা একটা কিছু করবোই। আমার টিমের সবার সহায়তায় সেটা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে ইস্টার্ন রিফাইনারির চালু ১ নম্বর ইউনিটটি ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ২৪৫ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানির জোগান দেয়। বাকি প্রায় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয় বিপিসিকে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য