‘সময় এখন বাংলাদেশের। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আরও এগিয়ে যাব। কেউ আটকে রাখতে পারবে না। করোনা জয় করেছি। প্রচুর অর্ডার আসছে। সবার ব্যবসাই এখন রমরমা। সময় এখন আমাদের, পোশাকের দামে ছাড় দিচ্ছি না। বাধ্য হয়ে বায়াররা বেশি দামে পোশাক কিনছে। দেশে একটার পর একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। এগুলো ঠিকঠাক মতো পরিচালনা করতে পারলে বিনিয়োগে যে স্থবিরতা, সেটা কেটে যাবে; কর্মসংস্থান বাড়বে। অর্থনীতিতে আরও গতি আসবে। পাল্টে যাবে দেশের চেহারা। একটা ভিন্ন বাংলাদেশ দেখবে বিশ্ব।’
মঙ্গলবার রাজধানীতে এক গোলটেবিল আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহীর।
অনন্ত গ্রুপ দেশের অন্যতম প্রধান তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৯১ সালে শিল্পপতি হুমায়ুন জহীর অনন্ত গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৩ সালে আততায়ীর হাতে হুমায়ুন জহীর নিহত হওয়ার পর স্ত্রী কামরুন নাহার জহীর প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। এখন মায়ের সঙ্গে দুই ভাই শরীফ জহীর ও আসিফ জহীর এগিয়ে নিয়ে চলেছেন প্রতিষ্ঠানটি।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ব্যবসার প্রয়োজনে একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে অনন্ত গ্রুপ। প্রতিটি উদ্যোগই ব্যবসাসফল। মাত্র ৫০০ কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্মীসংখ্যা ২৮ হাজার। এর ২৫ হাজারই শ্রমিক। গ্রুপের লক্ষ্য, ২০২৪ সালের মধ্যে কর্মীর সংখ্যা ৮০ হাজারে উন্নীত করা। আর এককভাবে ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করা।
গোলটেবিল আলোচনা শেষে শরীফ জহীর বাংলাদেশকে নিয়ে আশার কথা শুনিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা অদ্ভুত অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। সেই শক্তি দিয়ে তারা যেকোনো বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। করোনা জয় করে তারা সেটা আবার প্রমাণ করেছে। এখন আমাদের জন্য খুবই ভালো সময়। সময় এখন বাংলাদেশের।
‘করোনা আমাদের অনেক সম্ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে। চায়না, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে ক্রেতারা এখন বাংলাদেশে আসছেন। বেশি দামে পোশাক কিনছেন তারা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও ২০ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে নেয়া সম্ভব। পোশাক খাতকে ঘিরেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতি। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশা করি।’
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ঘাটলে শরীফ জহীরের কথার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সত্যিই করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছাড়া অন্য সব সূচকই এখন ইতিবাচক। রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। আমদানি বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। রাজস্ব আদায়ের গতিও বেশ ভালো। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আছে। পুঁজিবাজারেও কিছুদিন ধরে চাঙা ভাব।
মাথাপিছু আয়ে ফের ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে বন্ধুপ্রতিম দেশ শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের শরণাপন্ন হওয়ায় দেশটিকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে বিনিয়োগে স্থবিরতা এখনও রয়েই গেছে। ইতিবাচক খবরে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে সরকারকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
মাঝে সমস্যা হলেও প্রায় ৫ কোটি মানুষকে এরই মধ্যে করোনার টিকা দিয়ে ফেলেছে সরকার। বাকিদের টিকার আওতায় আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বদলে যাওয়া শুরু
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
এরপর আরও দুই দফায় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সময়ে বাংলাদেশ অর্জন করেছে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ এখন আর স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ নয়, উন্নয়নশীল দেশ।
অর্থনৈতিক সূচকের পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে এই সাড়ে ১২ বছরে। অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এখন আলোচিত। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের এই সাফল্যের কথা দেশি-বিদেশি মানুষকে শোনান।
পাকিস্তানের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা আবিদ হাসান গত মে মাসে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে দিয়েছেন চমকপ্রদ তথ্য। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে দেশটিকে বাংলাদেশের কাছে হাত পাততে হতে পারে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি এ মন্তব্য করেন।
জিডিপি
করোনাভাইরাস মহামারির আগপর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) বেড়েই চলেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি।
গত এক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর চার বছরে এই হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে।
তবে করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
মহামারির কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। কোনো কোনো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।
সরকার চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, এবার বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে আশার কথা শুনিয়ে উন্নয়ন সংস্থাটি বলেছে, ভবিষ্যতে দেশটির অর্থনীতি আরও চাঙা হবে।
গত ৭ অক্টোবর প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস’ নামক প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
মালদ্বীপ ও ভারতের পরই বেশি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে
করোনার ধাক্কা কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ ও ভারতের পরই সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশের।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই অর্থবছরে মালদ্বীপের প্রবৃদ্ধি হবে সবচেয়ে বেশি ১১ শতাংশ। ভারতে হবে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এর পরই বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে সুখবর দেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে।
এর আগে গত জুন মাসে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্ট’ রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, এই অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। আর আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে হবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
ভারতকে আবারও ছাড়িয়ে বাংলাদেশ
মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে আবারও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার। ফলে এই নিয়ে পর পর দুই বছর ভারতকে পেছনে ফেলল বাংলাদেশ।
আইএমএফ গত ১২ অক্টোবর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইও) প্রকাশ করেছে। সেখানে সংস্থাটি বলছে, করোনার প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় দেশই বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। এর মধ্যে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বেশি, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ভারতের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আগের বছর ভারতের অর্থনীতি বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়েছিল। এ কারণেই আবার এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের সামনে।
ঠিক এক বছর আগে আইএমএফ এবারের মতোই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ করে জানিয়েছিল, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ঋণাত্মক, অর্থাৎ (-) ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার ও ভারতের হবে ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। সুতরাং গতবার বাংলাদেশ ছিল ঠিক এক ডলারে এগিয়ে।
আইএমএফ অবশ্য এখন এসে বলছে, ২০২০ সালে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক, (-) ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হয় ১ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬১৪ ডলার এবং ভারতের ১ হাজার ৯২৯ দশমিক ৬৭৭ ডলার। আসলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হয়েছিল ৩১ দশমিক ৯৩৭ ডলার।
মূলত এবার রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার কথা বলা হলেও আগের বছরের উচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির প্রভাবেই এখনও পিছিয়ে আছে ভারত। এমনকি আগামী বছরও ভারত পিছিয়ে থাকবে বলে আইএমএফ মনে করে। চলতি বছরের পূর্বাভাসে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হবে ২২ দশমিক ৩৫ ডলার।
তবে, বাংলাদেশ জিডিপিসহ অর্থনীতির সব সূচকের হিসাব করে থাকে আর্থিক বছর (জুলাই থেকে জুন) ধরে। সেই হিসাবে বিবিএস ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি প্রাথমিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৭৫৯ ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক যুগে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি কিছুদিন ধরে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে গত সেপ্টেম্বর মাসে পয়েন্ট টু ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
রেমিট্যান্সে ভাটা
গত অর্থবছরে অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও বছরজুড়ে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সপ্রবাহে ভাটার টান লক্ষ করা যায়। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছে আরও কম, ১৭২ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৫৪০ কোটি ৮০ লাখ (৫.৪০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৬৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
চলতি অক্টোবর মাসেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ১২০ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের অক্টোবর মাসে এসেছিল ২১০ কোটি ২১ লাখ ডলার।
রিজার্ভেও টান
রেমিট্যান্স কমায় আর আমদানি বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।
গত ২৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১৪৪ কোটি ৮০ লাখ (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন) ডলার এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) ঋণ রিজার্ভে যোগ হওয়ায় এক লাফে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
এর পর থেকে তা কমতে কমতে গত সপ্তাহে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গত কয়েক দিনে খানিকটা বেড়ে রোববার ৪৬ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
রপ্তানি আয়ে ভর করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতি
মূলত রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। করোনা মহামারির মধ্যেই পণ্য রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশের উদ্যোক্তারা মোট ৪১৭ কোটি ডলার বা ৩৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছেন। অতীতে আর কোনো মাসেই এই পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়নি। এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।
পণ্য রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। গত মাসে এই খাত থেকে ৩৪২ কোটি ডলার বা ২৯ হাজার ৭০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
গত মাসে রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানির ফলে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে সব মিলিয়ে ১ হাজার ১০২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি।
চলতি বছর রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাকের পাশাপাশি হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল ও রাসায়নিক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
এই তিন মাসে মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৯০৫ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই সময়ের ৮১৩ কোটি ডলারের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি।
আলোচ্য সময়ে ৫১৬ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে ৩৯০ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতোই ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়। তার আগে থেকেই কিছু ক্রয়াদেশ চীন থেকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। ভিয়েতনামে লম্বা সময় লকডাউন থাকার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ এসেছে।
রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলে আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। প্রচুর অর্ডার আসছে। ভালো দামও পাচ্ছি। বার্গেনিং (দেনদরবার) করে বেশি প্রাইস আদায় করে দিচ্ছি। এইটা আমরা ধরে রাখতে চাই। আমরা আর কম দামে কোনো পোশাক বিক্রি করব না; অর্ডার নেব না। সব রপ্তানিকারকদের এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।’
‘তবে এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে; এই যে আমরা পোশাকের বেশি দাম পাচ্ছি, সেটাতে কিন্তু আমাদের আয় বাড়ছে না। সুতাসহ সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে।’
অন্যদিকে নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কারখানাগুলোতে প্রচুর ক্রয়াদেশ রয়েছে। সে জন্য আগের চেয়ে দামও কিছুটা বেশি নিতে পারছেন উদ্যোক্তারা। আশা করছি, আগামী মাসগুলোতে নিট পোশাক রপ্তানিতে ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হবে।’
তবে সুতার দামের অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারকরা খুব একটা স্বস্তিতে নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আমদানির পালে হাওয়া
রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমদানি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া লেগেছে আমদানির পালে। আর এই আমদানি বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বলছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, সব মিলিয়ে এই দুই মাসে ১ হাজার ১৭২ কোটি ৪৪ লাখ (১১.৭২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি।
খাদ্যপণ্যের পাশপাশি নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি সবই বাড়ছে।
করোনা মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
রাজস্ব আদায়েও জোয়ার
সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হচ্ছে রাজস্ব আদায়ে জোয়ার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা রাজস্ব আদায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
করোনার প্রভাবে সৃষ্ট গভীর খাদ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে দেশের রাজস্ব খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায় বেড়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বা রাজস্ব আহরণে সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
এই তিন মাসে মোট রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৫৮ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৪৯ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের এই চিত্র সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে রেকর্ড তৈরি করেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২১ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে রাজস্ব আয়ে গতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে গতি আরও বেড়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলছেন, ‘আমদানি-রপ্তানিতে গতি এসেছে। চাঙা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে।’
পুঁজিবাজারও চাঙা
পুঁজিাবাজরেও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। টানা কয়েক মাসের উত্থানের পর মাঝে কয়েকদিন কিছুটা খারাপ অবস্থা গেলেও প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এখনও ৭০০০ পয়েন্টের ওপরে অবস্থান করছে। বুধবার এই সূচক খানিকটা বেড়ে ৭ হাজার ১২ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন থাকবেই। ঝুঁকি থাকবে। এটা জেনে-বুঝেই বিনিয়োগ করতে হবে। ধৈর্য্য ধরতে হবে বিনিয়োগকারীদের। গুজব শুনে শেয়ার কেনা যাবে না; আবার বিক্রিও করা যাবে না। আমি মনে করি, বাজার এখনও ভালো অবস্থায় আছে। ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে।’
বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটছে না
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল পাঁচের ঘরে। ১০ বছরে সেই প্রবৃদ্ধি বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উঠেছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, গত ১২ বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে সামান্যই। সেই ৩১/৩২ শতাংশেই আটকে আছে বিনিয়োগ।
করোনার ধাক্কায় গত দেড় বছরে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৪২ শতাংশে (আগস্ট) নেমে এসেছে। অথচ মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
করোনাকালে প্রণোদনার ঋণ ছাড়া অন্য ঋণ খুব একটা বিতরণ হয়নি। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নেও গতি নেই।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার হলো ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তিন মাসে এক হাজার ৫৯১ প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৫৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ।
গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ১০.২১ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.২৫ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮.০৬ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮.০৬ শতাংশ।
তবে, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘মহামারি করোনার ফলে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যার প্রভাব এডিবি বাস্তবায়নে পড়েছে। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এডিপি বাস্তবায়নেও গতি আসবে। সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগও বাড়বে বলে আশা করছি।’
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে কারণেই হোক না কেন, এখন পর্যন্ত কোভিড বাংলাদেশকে খুব বেশি কাবু করতে পারেনি। মাঝে টিকা নিয়ে সমস্যা হলেও এখন সে সমস্যা আর নেই। ভালো গতিতেই চলছে, টিকাপ্রদান কর্মসূচি।’
তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে করোনা মোকাবিলায় আমরা ভালো করেছি। টিকার পাশাপাশি সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতিকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে রাজস্ব আদায়ে বেশ ভালো গতি এসেছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে।
‘তবে এতে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। আমাদের ব্যাংকিং খাত কিন্তু ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। ব্যাংকগুলো যে বিপুল অঙ্কের প্রণোদনার ঋণ দিচ্ছে, সেগুলো যদি ঠিকমতো আদায় না হয়, তাহলে আরও সংকটে পড়বে।
‘রাজস্ব আদায় আরও বাড়াতে হবে; ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ১৪-১৫তে নিয়ে যেতে হবে। যে করেই হোক বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে।’
আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘সংকটের সময় নতুন নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমরা যদি সেগুলো ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে সেসব সম্ভাবনার সুফল পাব।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই সময় যদি আমরা বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে সুনির্দিষ্ট খাত চিহ্নিত করে বিনিয়োগ করি, সহায়তা দেই, তাহলে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারও ধরতে পারব।’
‘এই যে রপ্তানি আয় বাড়ার একটা সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, চায়না, ভিয়েতনাম ও মায়ানমারের বাজার দখলের একটা সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে; প্রাইস বাড়ানোর সুযোগ এসেছে - এর সবগুলো ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে দ্রুত গতিতে এই কাজগুলো করতে হবে।’
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহীর বলেন, ‘আগামী বছর বাংলাদেশের জন্য হবে একটি বিশেষ বছর। এ বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প চালু হয়ে যাবে। ২০২২ সালে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে; চলবে ট্রেনও। একই সময় রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্রোরেল। দেশের দক্ষিণ-পূবের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে ততদিনে। এই টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। সম্প্রতি পায়রা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে, যা দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও সক্ষমতা বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হতে চলেছে।’
‘সবকিছু যদি ঠিকঠাক মতো চলে, আর যদি কোনো দৈব-দুর্বিপাক না আসে, তাহলে সত্যিই আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। সময় এখন সত্যিই বাংলাদেশের।’
আরও পড়ুন:শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য