চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে এ মেগা প্রকল্পের প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী দুই বছরের মধ্যেই ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৬ দশমিক ৫ মিটার চওড়া এই অবকাঠামোর কাজ শেষ হবে। তখন বন্দরনগরীর যানজট কমবে, নগরীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগও সহজ হবে।
সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিমানবন্দর সড়ক ও শেখ মুজিব সড়ক অংশে রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই কাজ করছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, কর্মচারী ও শ্রমিকরা। সিডিএ অ্যাভিনিউ অংশের কাজও শিগগিরই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
বন্দরনগরীর যানজট লাঘবে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে একনেক সভায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প অনুমোদন পায়। ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। যৌথভাবে নির্মাণকাজ পায় বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ও চীনা প্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিন।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার পাইলিং কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতার করণে মেয়াদ ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, কাজের শুরুর দিকে জমি অধিগ্রহণ ও বৈদ্যুতিক তার নিয়ে জটিলতার কারণে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সহজ হবে না।
নির্মাণকাজে ভোগান্তি
সরেজমিনে দেখা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য বিমানবন্দর সড়ক ও শেখ মুজিব সড়কের বিভিন্ন অংশে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পানি জমে পথচারীদের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। তবে সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় এই যানজট ও ভোগান্তিকে মেনে নিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
তারা বলছেন, প্রতিদিন চলাচলের সময় ভোগান্তির সময়টুকু বিরক্তিকর। তবে উন্নয়নকাজের জন্য সাময়িক এই ভোগান্তি মেনে নিলে পরবর্তী সময়ে সুফলটা কয়েক গুণ বাড়বে।
এর ব্যাখ্যায় নগরীর বাসিন্দা ইফতেখার সবুজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সল্টগোলা এলাকায় থাকি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ এলাকায় জ্যাম লেগেই থাকে। এটা অনেক বড় কাজ হচ্ছে। তাই বেশি দিন ধরে নির্মাণকাজ চলছে।
‘আমার মনে হয়, এটা হয়ে গেলে শহরে জ্যাম বলতে তেমন কিছুই থাকবে না। মানে এখন এক জায়গায় অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হলেও ওপরের রাস্তাটি চালু হয়ে গেলে সিগন্যালের বাইরে হয়তো আর যানজট হবে না। তাই এখন একটু ভোগান্তি হলেও পরে সেটা পুষিয়ে নেয়া যাবে।’
ইমরান হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির কাজ চলার কারণে দুর্ভোগ বেড়েছে। কারণ বর্তমানে লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।
‘তবে শুনছি এটার কাজ শেষ হয়ে গেলে লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। তাহলে তো এই ভোগান্তি একটু সহ্য করা লাগবে। কারণ এটা তো চলাচলের রাস্তার ওপরই হচ্ছে, তাই ভোগান্তিটা চোখে পড়ছে। হয়ে গেলে চট্টগ্রামবাসীরই বড় সুবিধা।’
কাজের অগ্রগতি
সিডিএ বলছে, এ প্রকল্পের অধীনে ৯টি জংশনে ২৪টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) হবে। এর মধ্যে টাইগারপাসে ৪টি, আগ্রাবাদে ৪টি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে ২টি, নিমতলা মোড়ে ২টি, কাস্টম মোড়ে ২টি, সিইপিজেডে ৪টি, কেপিজেডে ২টি, কাঠগড়ে ২টি ও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় ২টি র্যাম্প থাকবে। চার লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ততা হবে ৫৪ ফুট। এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে আড়াই হাজার এলইডি লাইট।
সিডিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এ কাজ এগিয়ে আসছে উত্তরের দিকে, যা থামবে লালখান বাজার এলাকায়। ১৬ কিলোমিটারের এই প্রকল্পের সি-বিচ থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার অংশের কাজ চলছে এখন। এই অংশে এখন পর্যন্ত ২৩০টি পিয়ার, ১৭১টি পিয়ারক্যাপ, ১৯২৮টি পাইল, ২০১টি পাইলক্যাপ, ৫৮৩টি গার্ডার ও ৫৭টি ডেকস্ল্যাবের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানায় প্রকল্পটির কিছু অংশ পড়েছে। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে কাস্টম থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার অংশে পাইলিংয়ের কাজ চলছে। বারিক বিল্ডিং থেকে কাস্টম পর্যন্ত ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার অংশে ড্রেন ও রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে, যা শেষ হলে শুরু হবে পাইলিং। এই অংশেই এখন পর্যন্ত ৩৭টি পিয়ার, ৩৭৪টি পাইল ও ৪০টি পাইলক্যাপের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া দেওয়ানহাট থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত অংশের অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত হয়েছে। সে অনুযায়ী অল্প সময়ের মধ্যে কাজও শুরু হবে।
পতেঙ্গা থেকে কাঠগড় পর্যন্ত এলাকায় গার্ডার ও স্ল্যাব বসে গেছে। বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত এলাকার এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের যে আপত্তি ছিল, তারও সুরাহা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিডিএ।
প্রকল্প প্রসঙ্গে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে অত্যন্ত নান্দনিক নকশার এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হচ্ছে। এর জন্য কোনো পাহাড় কাটতে হবে না। সৌন্দর্য নষ্টের প্রশ্নই ওঠে না। বরং এলাকাটি যেন আরও উদ্ভাসিত হয়, সেভাবেই হবে এই উড়ালসড়ক।’
প্রকল্প পরিচালক সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, প্রকল্প এলাকাকে চার ভাগে ভাগ করে নির্মাণকাজ চলছে। এগুলো হচ্ছে পতেঙ্গা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং মোড়, সিমেন্ট ক্রসিং থেকে সল্টগোলা, সল্টগোলা থেকে বারিক বিল্ডিং মোড় এবং বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে দেওয়ানহাট। এর মধ্যে পতেঙ্গা থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত দুই অংশের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বারিক বিল্ডিং থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত পাইলিং চলছে।
যেসব সুবিধা মিলবে
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে চট্টগ্রাম শহর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ উন্নত হবে; কমবে যানজট ও যাতায়াতের সময়।
সিডিএর দাবি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি একই সঙ্গে সিইপিজেড, কেইপিজেড ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত করবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে, যা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থার মাইলফলক হিসেবে পরিচিতি পাবে।
প্রকল্পের বিদ্যমান সমস্যা ও সমাধান
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিউজবাংলাকে জানিয়েছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্টের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বৈদ্যুতিক পিলার থাকায় পাইলিং শুরুর জন্য রাস্তা সম্প্রসারণ করা কঠিন। তাই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে রাস্তার সঙ্গে থাকা বৈদ্যুতিক পিলার অপসারণের মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রকল্প এলাকার কিছু অংশে রেললাইন থাকায় সেখানেও কাজ করা নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। তা সমাধানে বাংলাদেশ রেলওয়েকে স্মারকলিপি দিয়েছে সিডিএ।
যা বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা
আলোচিত এই প্রকল্প নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রথমে যখন শুরু হয়, সেভাবে যদি থাকত, তাহলে তেমন একটা কাজে আসত না। তবে বর্তমানে সিডিএ ডিজাইনের কিছুটা সংশোধন করে অনেক জায়গায় মূল সড়কের সঙ্গে র্যাম্প দিয়ে সংযোগ করছে। এখন এটা জনগণের কাজে লাগবে।
‘কারণ সব এলাকার মানুষের সঙ্গে যখন এটার কনেকশন তৈরি হবে, তখন এটার সুফল সার্বিকভাবে চট্টগ্রামবাসী পাবে। এগুলোর কাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম শহরের জ্যাম কমবে। তবে শহরকে পুরোপুরি জ্যামমুক্ত করতে হলে, আধুনিক শহর করতে হলে, এখনই মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের কথা ভাবা দরকার।’
আরও পড়ুন:দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে নব্বইয়ের দশকে নির্মিত ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি।
এমন পরিস্থিতিতে চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও আদালতে কর্মরতদের।
সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থদের অবহিত করে গণপূর্ত বিভাগের ঝালকাঠি অফিস ২০১৯ সালে চিঠি চালাচালি করলেও বিষয়টি এখনও ফাইলবন্দি।
ভবনটি দ্রুত সময়ের মধ্যে টেকসই সংস্কার অথবা পুনর্নির্মাণের দাবি আদালত সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।
ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগ ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর জরাজীর্ণ জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে ৫ নভেম্বর বরিশালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরাবর পরিদর্শন প্রতিবেদন পাঠান।
ভবন পরিদর্শনকালে তিনজন উপসহকারী প্রকৌশলী, গণপূর্তের ঝালকাঠির নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ উপস্থিত ছিলেন। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি সংগ্রহ করেছে নিউজবাংলা।
কী ছিল পরিদর্শন কপিতে
ঝালকাঠি গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী অনিরুদ্ধ মন্ডল, মো. বদরুজ্জামান, মো. ইমরান বিন কালাম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ আল-মাসুম স্বাক্ষরিত ওই পরিদর্শন কপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ভবনটির দুই তলায় করিডোরের বেশ কিছু স্থানে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়ছে। এ ছাড়াও নলছিটি কোর্ট রুমের পরিদর্শনকারীদের বসার ওপরের ছাদের অংশ খসে পড়েছে। এ সমস্ত স্থানে মরিচা পড়ে রড উন্মুক্ত হয়ে আছে। দ্বিতীয় তলা এবং নিচ তলার করিডোরের বেশ কিছু বিম ও কলামে ফাটল লক্ষ করা গেছে।
‘ভবনটির নিচ তলায় হাজতখানার ছাদের বেশ কিছু অংশসহ করিডোরের বিভিন্ন অংশে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়েছে। এসব স্থানেও মরিচা পড়ে রড বের হয়ে আছে। নিচ তলার বিভিন্ন কলাম এবং বিমের ফাটল লক্ষ করা গেছে। কিছু স্থানে কলাম ফেটে রড বের হয়ে গেছে।’
পরিদর্শন প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ‘ভবনটির দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ১৯৮৯-৯০ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ২০০৪-০৫ সালে তৃতীয় তলার উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে বিম কলামে ফাটল থাকায় এবং ছাদের কনক্রিট খসে পড়ায় বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
‘এমতাবস্থায়, উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত ডিজাইন বিভাগের মতামতসহ পরবর্তী প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রয়োজন।’
প্রতিটি কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ
সম্প্রতি জজ আদালত ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, ভবনের ছাদের ওপর থেকে খসে খসে পড়ছে পলেস্তারা। ফাটল ধরেছে অনেক পিলারেও। ভারি বৃষ্টি এলেই ছাদ ও দেয়াল চুষে পানি পড়ে মেঝেতে। নষ্ট হয়ে যায় প্রয়োজনীয় নথিপত্র।
দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় তিন তলা ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিচারকের এজলাস, খাসকামরা, পেশকার, সেরেস্তাদারের কক্ষ, নকল কক্ষ, হাজতখানাসহ প্রতিটি কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যেই চলছে আদালতের কার্যক্রম। এতে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
যা বলছেন আদালত সংশ্লিষ্টরা
আদালতের জরাজীর্ণ অবস্থার বিষয়ে কথা হয় আবদুর রহমান, তৈয়ব আলী, কামরুল ইসলাম, মুরাদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে।
তাদের একজন বলেন, ‘আদালত ভবনের ভিতরে প্রবেশের পর কার্যসম্পাদন করে বের হওয়া পর্যন্ত আমরা থাকি আতঙ্কে। প্রায় সময়ই ছাদের পলেস্তারা খসে নিচে পড়ে।
‘বর্ষায় তো বারান্দায় পানি জমে যায়। দেয়ালে পানি চুষে অনেক ফাইল নষ্ট হয়ে যায়।’
আইনজীবী মানিক আচার্য্য বলেন, ‘ভবনটি ধীরে ধীরে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তার সংস্কার করছে না কর্তৃপক্ষ। বিচারকরা যদি ভালো পরিবেশে বিচারকার্য পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে বিচারকার্যে মনোনিবেশও করতে পারেন না।
‘ঝালকাঠির বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীসহ সকলেই আমরা এ ভোগান্তিতে রয়েছি। বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থদের বিষয়টি অবগত করলেও এখনও কোনো ভূমিকা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’
আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট ফয়সাল বলেন, ‘ড্যামেজড ভবনে দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিচারিক কার্যক্রম। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে।
‘আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা এবং নতুন ভবন নির্মাণ অথবা টেকসই সংস্কারের জন্য গণপূর্তের চিঠি চালাচালি হলেও দীর্ঘদিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাইনি। জনস্বার্থে দ্রুত নতুন আদালত ভবন নির্মাণ জরুরি।’
আইনজীবী আক্কাস সিকদার বলেন, ‘বর্তমানে এ আদালতে ১৬ হাজার দেওয়ানি মামলা এবং দেড় হাজার ফৌজদারি মামলা চলমান। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে।
‘আদালত ভবনের নিচ তলায় হাজতখানার পশ্চিম দিকে মসজিদের সামনে একাধিকবার ধসে পড়েছে ছাদের অংশ। এখন এই ভবন অস্থায়ী সংস্কার না করে এটি ভেঙে এখানে নতুন ভবন করা উচিত।’
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘নব্বই দশকে দোতলা জজ আদালত ভবনটি নির্মাণের পর ২০০৬ সালে এর ওপর আরও এক তলা বর্ধিত করে তৃতীয় তলায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে নিচ তলার অনেক পিলারে ফাটল ধরেছে। ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আদালতের স্টাফ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা রয়েছেন আতঙ্কে।
‘হাজতখানা সরিয়ে পার্শ্ববর্তী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনে নেওয়া হয়েছে। ভবনে আগতদের নিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। দ্রুত এটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।’
জরাজীর্ণ ভবনের বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ ঝালকাঠির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফয়সাল আলম ও বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী আমানুল্লাহ সরকার একই ধরনের বক্তব্য দেন।
তাদের একজন বলেন, ‘ভবন পরিদর্শনের রিপোর্ট ২০১৯ সালে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে নতুন ভবনের জন্য সম্ভাব্য বাজেট তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে আছে।
‘সেখান থেকে অর্ডার হলেই গণপূর্ত বিভাগ টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কার্যসম্পাদন করবে।’
ক্যাপশন: ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবন। ছবি: নিউজবাংলা
ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের ভেতরের জরাজীর্ণ অংশ। ছবি: নিউজবাংলা
আরও পড়ুন:ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুকানপুকুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) আওয়ামী লীগের পলাতক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমানকে কৌশলে পুনর্বাসনের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলীসহ স্থানীয় একাধিক রাজনীতিক ও কিছু ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট এ ইউপি চেয়ারম্যান পরিষদ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
জনসেবা অব্যাহত রাখতে নিয়ম অনুসারে ইউপি সদস্য সুমন রানাকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ করে বাকি প্যানেল গঠন করা হয়।
বর্তমানে ইউপিতে নাগরিক সেবা অব্যাহত থাকলেও প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কৌশলে অনাস্থা এনে এরশাদ আলীসহ অন্যরা পলাতক চেয়ারম্যানকে পুনর্বাসনের চেষ্টায় আছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি কৌশল জানাজানি হলে ইউনিয়নবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এমন বাস্তবতায় যেকোনো সময় ওই ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
পলাতক চেয়ারম্যানকে পুনর্বাসনের ‘কৌশল’
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রথমে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক বরাবর শুকানপুকুরী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব এনে একটি আবেদন জমা দেওয়া হয়। সেখানে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ৯ জন ইউপি সদস্য।
পরে সেই আবেদনের জের ধরে ১৩ জানুয়ারি ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডের পাতায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২ মো. এরশাদ আলী স্বাক্ষরিত এক পাতার একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের রেজুলেশন ও অপর একটি পাতায় আটজন ইউপি সদস্যের স্বাক্ষর সংবলিত পাতা সংযুক্ত করা হয়। এ পাতায় সভার স্থান দেখানো হয় ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমে।
ওই রেজুলেশনে বলা হয়, ‘অদ্যকার অত্র আলোচনায় শুকানপুকুরী ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমানের (পলাতক) মাধ্যমে ইউপির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সভায় বিস্তর আলোচনা করা হয়। এরপর সভার সভাপতি প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলীর উপস্থিতিতে সদস্যদের জানান, প্যানেল চেয়ারম্যান-১ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে স্বেচ্ছাচারিতা করে আসছেন, যা জেলা প্রশাসকের বরাবরে অনাস্থার প্রস্তাব আনয়ন করি।
‘তাই ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানের (পলাতক) মাধ্যমে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা তথা জনসেবা অব্যাহত রাখা একান্ত জরুরি মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
রেজুলুশনে উল্লেখ করা হয়, সর্বসম্মতিক্রমে পলাতক চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পরিষদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা তথা জনসেবা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং জেলা প্রশাসক ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়।
প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা নিয়ে দুই ইউপি সদস্যের ভাষ্য
কারণ জানতে এ প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন অনাস্থা কাগজে স্বাক্ষর করা দুজন ইউপি সদস্যের সঙ্গে। তারা হলেন মো. আমজাদ ও ধর্ম নারায়ণ রায়।
ইউপি সদস্য আমজাদ বলেন, ‘৪ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে আমার বাড়ির সামনে স্থানীয় সাবেক দুজন সদস্য মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন। তারা আমাকে কৌশলে ইউনিয়ন বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি অন্যান্য ইউপি সদস্যরাসহ বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা উপস্থিত। রাতের খাবারের বিশাল আয়োজনও করা হয়েছে। আমি কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
‘পরে জানানো হলো, আমাকে বর্তমান প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে স্বাক্ষর করতে হবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তা মিথ্যা। তিনি খুব ভালোভাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এসবই আলোচনা হচ্ছে। এরপর এক প্রকার জোর করেই আমাকে রাতের খাবার খাওয়ানো হলো এবং পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করতে হলো। কিন্তু আমি সিলমোহর দিইনি।’
ইউপি সদস্য ধর্ম নারায়ণ রায় বলেন, ‘একই তারিখে স্থানীয় বাসিন্দা তোষর এবং রফিকুল আমাকে একটা জায়গায় সমস্যার কথা বলে কৌশলে ইউনিয়ন বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি বিএনপির অন্যান্য রাজনীতিক নেতাসহ অন্যান্য ইউপি সদস্যরা রয়েছেন। আমাকে রাতের খাবারের জন্য বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু কী কারণে এত আদর-আপ্যায়ন, বুঝতে পারছিনা। জিজ্ঞাসা করলেও কোনো উত্তর পাই না।
‘সমাজ রক্ষার্থে সকলের সাথে রাতের খাবার খেলাম। এরপর আমাকে এক প্রকার চাপ দেওয়া হয় প্যানেল চেয়ারম্যান সুমন রানার বিরুদ্ধে অনাস্থা কাগজে স্বাক্ষর করতে। কিন্তু আমি তার সমর্থক। তিনি ভালো মানুষ।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাক্ষর দিতে প্রথমে রাজি না হলেও পরে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাক্ষর করেছে। আমি কেন করব না, এ কথা তোলে। অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্কের পর সই করে সেখান থেকে আসতে হয়েছে। পরে আমি লিখিত চিঠি দিয়ে বিষয়টি প্যানেল চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি।’
ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ভবেষ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে অনাস্থা আনা হয়েছে, তা আমার কাছে ভিত্তিহীন মনে হয়েছে।’
সচিব আরও বলেন, ‘পরিষদে তিনি (সুমন রানা) সবার সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন এবং নাগরিক সেবা অব্যাহত রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে আমাকেও কেউ কোনো দিন কোনো মৌখিক অভিযোগ দেননি।’
সভার বিষয়ে যা বললেন ইউপি সচিব ও সদস্য
ইউনিয়ন পরিষদ সচিব বলেন, ‘৪ জানুয়ারি, ৭ জানুয়ারি ও ১৩ জানুয়ারি কোনো সভা ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমসহ পরিষদের কোনো স্থানে অনুষ্ঠিত হয়নি। যেসব সভার কথা বলা হচ্ছে, তা গোপনে বা প্রকাশ্যে অন্য কোথাও হয়ে থাকতে পারে। তা আমার জানা নাই।’
ইউপি সদস্য ধর্ম নারায়ণ রায় বলেন, ‘১৩ তারিখ সকাল ১১টায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২ সভা ডেকেছিল। আমি সময়মতো পরিষদে আসলেও সভা হয়নি।
‘আমি জানতে চাইলে তিনি গোপনে স্থানীয় দুলাল নামের এক লোকের বাসায় মিটিং হবে বলে জানান। কিন্তু আমি সেখানে যাইনি। পরিষদের কাজ শেষে বাড়ি চলে আসি।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যানের ভাষ্য
স্থানীয় বাসিন্দা জিলানি হোসেন বলেন, ‘যে চেয়ারম্যান জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি, তিনি জনগণের কথা ভাববেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাই তিনি আমাদের দুর্ভোগে ফেলে আজও পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন। আমরা নাগরিকসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা তার পুনর্বাসন চাই না।
‘পরিষদ তাকে ছাড়া বেশ ভালো চলছে। আমরা সুন্দর সেবা পাচ্ছি। শুনছি অনেকে পলাতক চেয়ারম্যানের টাকার কাছে বিক্রি হয়েছে। আমরা নতুন কোনো ষড়যন্ত্র মেনে নেব না।’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলী ইউনিয়ন পরিষদে সভা না করা এবং কোনো ব্যক্তির বাসায় বসে সভা করার বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণে পরিষদে সভা করতে পারেননি।
তিনি কেন পলাতক ও বিতর্কিত চেয়ারম্যানকেই পুনর্বাসন করতে চান, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বর্তমান দায়িত্বরত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তোলেন।
অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যান সুমন রানার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং পরিষদে নাগরিক সেবা অব্যাহত আছে কি না, তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করার আহ্বান জানান।
ইউনিয়ন বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়িতে পরিষদের কোনো বৈঠক হয়নি; সিদ্ধান্তও হয়নি। আমার হাত ভেঙে যাওয়ায় আমি অসুস্থ। তাই রাজনীতিক নেতা ও পরিষদের সদস্যরা দেখতে এসেছিল। এর বেশি কিছু না।’
তবে চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার) সরদার মোস্তফা শাহিন বলেন, ‘আবেদনসহ অন্যান্য কাগজ আমি পেয়েছি। উভয় পক্ষকে ডেকে শুনানি করা হবে এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
‘কোনো কৌশলগত বিষয় আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হবে। তবে নিয়ম-বহির্ভূত কাউকে পুনর্বাসন করার সুযোগ নেই।’
আরও পড়ুন:টানা তিন দিন ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পানির সংকটে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল।
পানি না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা।
এদিকে দুই দিন ধরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে ভর্তি থাকেন হাসপাতালে। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে রোগী ও স্বজনসহ সহস্রাধিক মানুষ অবস্থান করছেন। প্রতিদিন এখানে ২০ হাজার লিটার পানি প্রয়োজন।
হাসপাতালটিতে শনিবার বেলা ১১টা থেকে শৌচাগারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে সোমবার গিয়ে দেখা যায়, রোগী ও তাদের স্বজনরা বাইরে থেকে পানি এনে জরুরি কাজ সারছেন।
এদিকে পানি সংকটে শৌচাগার থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে পানির জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও করা হয়নি।
শৌচাগারে ব্যবহারের জন্য পানিও লোকজনকে কিনে আনতে হচ্ছে। রোগীর স্বজনরা আশপাশের দোকান থেকে কিনে কিংবা অনেক দূর থেকে হেঁটে ফিল্টার ও বাসাবাড়ি থেকে বোতল, বালতিতে করে পানি নিয়ে আসছেন।
বিশুদ্ধ পানি না থাকায় রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
জেলার তাড়াইল উপজেলার রাউতি গ্রামের বাসিন্দা শাহিনুল ইসলাম জানান, গত তিন দিন যাবত তার চাচাত বোনকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
তিনি বলেন, ‘আসার পর থেকে দেখলাম বাথরুমে পানি নেই। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে বলার পর তিনি জানিয়েছিলেন আজকের মধ্যেই সমস্যা সমাধান হবে। কিন্তু আজকে তিন দিন হয়ে গেলেও সমস্যাটি সমাধান হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম দিন কোনো রকম আশপাশে গিয়ে জরুরি প্রয়োজন সেরে এসেছি। দ্বিতীয় দিন রোগীসহ বিপদে পড়েছি। পরে নিচে নেমে অটোরিকশা করে শহরের খরমপট্টি এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে গোসলসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে এসেছি।’
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কাশোরারচর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাদির বলেন, ‘একটা সরকারি হাসপাতালের টয়লেটে পানি নেই, এটা হতে পারে? ময়লা আর দুর্গন্ধে আশপাশেও থাকা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘অসুস্থ মানুষ সুস্থ হওয়ার জন্য হাসপাতালে আসে। আর এই হাসপাতালের যে পরিবেশ, তাতে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হতে সময় লাগবে না।’
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবুজর গিফারী জানান, রবিবার রাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খবর পেয়ে দুটি গাড়িতে করে ৮ হাজার ৬০০ লিটার পানি দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রাত ১১ টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সেখানে কাজ করেছেন বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের (ভারপ্রাপ্ত) তত্ত্বাবধায়ক ডা. নূর মোহাম্মদ শামসুল আলম সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, রবিবার রাতে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি আনা হয়েছিল, সে পানি দিয়ে গতকাল রাত থেকে সকাল পর্যন্ত চলছে। এখন আবার জনস্বাস্থ্য থেকে খাবার পানি আনা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ছয় তলায় ১০ ঘোড়ার একটি বড় মোটর রয়েছে। ২০২০ সালে লাগানো মোটরটি প্রায়ই সমস্যা করে। কিন্তু এবার একেবারে বিকল হয়ে যাওয়ায় পানির সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে টানা দুই দিন ধরে পানি না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগী ও তাদের স্বজনরা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোববারের মধ্যেই সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা চলছে।
রোগী নিয়ে গত তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছেন নিকলী উপজেলার সিংপুর গ্রামের বাসিন্দা আতিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘বাথরুমে পানি নেই। ময়লা আর দুর্গন্ধে আশপাশেও থাকা যাচ্ছে না। রোগী বা সাথের কারও বাথরুমে যেতে হলে নিচ তলায় যেতে হচ্ছে।’
তিনি জানান, এ অবস্থায় রোগীর চিকিৎসায় সময় দেবেন নাকি পানি আনতে দৌড়াবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না।
হাসপাতালে রোগী নিয়ে এসেছেন সদর উপজেলার নীলগঞ্জের বাসিন্দা জুবেদা খাতুন।
তিনি রোববার সকালে বলেন, ‘অসুস্থ মানুষ সুস্থ হওয়ার জন্য হাসপাতালে আসে। আর এ হাসপাতালের যে পরিবেশ, তাতে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হতে সময় লাগবে না।’
৫৫ বছর বয়সী এ নারী জানান, লিফট থাকলেও সেটার ব্যবহার না জানায় বারবার সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে হচ্ছে তার।
জেলা সদর উপজেলার কাটাবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের সমস্যার দিক একটুও চিন্তা করেন না।’
চিকিৎসার ক্ষেত্রে রীতিমতো অবহেলার শিকার হচ্ছেন দাবি করে এ যুবক বলেন, ‘এখানে নামমাত্র সেবা প্রদান করা হচ্ছে। কারও কোনো সমস্যা হলে সময়মতো ডেকেও ডাক্তার পাওয়া যায় না।’
সদর উপজেলার কাশোরারচর এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদির বলেন, ‘দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজন পড়ে পানির। কিন্তু এখানে সেই ব্যবস্থাটাই নেই। একটা মানুষ জরুরি প্রয়োজনে বাথরুমে গিয়ে যখন দেখেন পানিটাই নাই, তখন কোন ধরনের সমস্যায় পড়েন, সেটা তো বুঝতেই পারছেন।
‘এ সমস্যাটা কিছুক্ষণের জন্য হলে হতেই পারে। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু টানা দুই দিন যাবত এই হাসপাতালে পানি নেই। অথচ কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই।’
জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের (ভারপ্রাপ্ত) তত্ত্বাবধায়ক ডা. নূর মোহাম্মদ শামসুল আলম সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ছয় তলায় ১০ ঘোড়ার একটি বড় মোটর রয়েছে। ২০২০ সালে লাগানো মোটরটি প্রায়ই সমস্যা করে। কিন্তু এবার একেবারে বিকল হয়ে যাওয়ায় পানির সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আজকের মধ্যেই সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দূরে কুঞ্জবন গ্রাম। এ গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আত্রাই নদী।
এ নদীর দুই পারের সড়কের পাশে অসংখ্য গাছ। বহতা সে নদীর স্বচ্ছ জলে পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে চারপাশ।
শীতের শুরু থেকেই অসংখ্য পরিযায়ী পাখি এসে আবাস গড়েছে আত্রাই নদীতীরের পুরো কুঞ্জবন এলাকাজুড়ে। তাদের কিচিরমিচির শব্দে এখন ঘুম ভাঙে নদীর দুই পারের বসবাসকারী মানুষদের। নিরাপদে পাখিগুলোর বসবাসের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ১১ বছর ধরে নওগাঁর মহাদেবপুরের আত্রাই নদীর কুঞ্জবন এলাকাজুড়ে অতিথি পাখি আসছে শীত মৌসুমে। শীতপ্রধান দেশ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিযায়ী পাখিরা এসে কুঞ্জবনের নদীতে আশ্রয় নেয়।
শীতের শুরুতে আসতে থাকে পাখি। নদীতে বছরের চার থেকে পাঁচ মাস পাখিগুলো থাকে। সারা দিন নদীতে থাকলেও রাতে তারা ফিরে যায় পাশের রামচন্দ্রপুর, মধুবনসহ কয়েকটি স্থানের গাছে। ভোরে আবারও ফিরে আসে আত্রাই নদীতে।
প্রতিদিনই পরিযায়ী এসব পাখি দেখতে দূরদুরান্ত থেকে আসেন নানা বয়সী দর্শনার্থীরা।
পাখি দেখতে নওগাঁ শহরের তাজের মোড় থেকে এসেছেন সারোয়ার হোসেন দম্পতি।
কথা হলে সারোয়ার বলেন, ‘আত্রাই নদীতে পাখির কলরবে পুরো কুঞ্জবন এলাকা যেন মুখরিত হয়ে গেছে। এখানে এসে আমাদের খুব ভালো লাগছে। পাখিগুলোকে কেউ যেন বিরক্ত না করে, সেই দিকে প্রশাসনের খেয়াল রাখতে হবে।’
নওগাঁ শহরের চকদেবপাড়া থেকে আসা সজিব হোসেন বলেন, ‘প্রতি বছর এখানে অনেক পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটে বলে জানতে পেরে এসেছি। এতগুলো পাখি একসাথে কখনো দেখিনি। খুব ভালো লাগছে এখানে এসে।
‘নদীতে ড্রেজার মেশিন নামিয়ে বা কেউ যাতে পাখিগুলোকে শিকার না করে, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে কর্তৃপক্ষের।’
মহাদেবপুর উপজেলা সদরের সুমন হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবী মিলে পাখিগুলো দেখতে এসেছি। শীত মৌসুম ছাড়া এখানে এত পাখির বিচরণ হয় না।
‘স্থানীয় সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি যদি সরকারিভাবে পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে আগামীতে এই এলাকায় পাখিদের আরও বেশি আগমন ঘটবে এবং সেই সাথে এটাকে ঘিরে বিনোদনের কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে বলে মনে করছি।’
কথা হয় স্থানীয় বিচিত্র পাখি উৎপাদন গবেষণা পরিষদ নামের সামাজিক সংগঠনের পরিচালক মুনসুর সরকারের সঙ্গে।
এ পাখিপ্রেমী বলেন, ‘পরিযায়ী পাখিদের নিরাপদ অবস্থানের জন্য নদীর পানিতে বেশ কিছু বাঁশ দিয়ে ঘের তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে এসে পানিতে পড়ছে।
‘কেউ গা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ গা পরিষ্কার করছে। আবার কেউ বাঁশের ওপর বসে আরাম করছে।’
তিনি বলেন, ‘চলতি শীত মৌসুমে বালিহাঁস, সরালি হাঁস, পানকৌড়ি, রাতচোরাসহ প্রায় ১৫ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বিচরণ ঘটেছে আত্রাই নদীতে। এ ছাড়া পিয়াং হাঁস, পাতি সরালি, লেঙজাহাঁস, বালিহাঁস, পাতিকুট, শামুকখোল, পানকৌড়ি, ছন্নি হাঁসসহ প্রায় ১২ জাতের দেশি পাখির সমাগম ঘটেছে।’
মুনসুর সরকার আরও বলেন, ‘কেউ যেন পাখি শিকার বা মাছ শিকার করতে গিয়ে পাখিদের বিরক্ত না করে, সে জন্য আমরা কাজ করছি। মাঝে মাঝেই আমরা মাইকিং করে জনসাধারণকে সতর্ক করছি।
‘সরকারি উদ্যোগ নিয়ে এখানে পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল হতে পারে।’
এ বিষয়ে মহাদেবপুর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শিল্পী রায় বলেন, ‘আত্রাই নদীতে যেসব স্থানে পাখিদের অবাধ বিচরণ আছে, সেই সব স্থানে যাতে কেউ নৌকা দিয়ে মাছ শিকার করার কারণে পাখিদের অবাধ বিচরণে বাধাগ্রস্ত না হয় এবং কেউ যেন পাখি শিকার করতে না পারে, সে বিষয়ে মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে নজরদারি রয়েছে।
‘এ ছাড়া কেউ যদি পাখি শিকার করে, আমরা জানতে পারলে বন বিভাগের সাথে সমন্বয় করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোও পাখির অবাধ বিচরণে কাজ করে যাচ্ছে।’
আরও পড়ুন:সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা থেকে বিশেষ একটা খাবারের খোঁজে নগরের চাঁদনীঘাট এলাকায় এসেছেন বদরুল আলম। তার চাচি যুক্তরাজ্যে থাকেন।
চাচিকে যুক্তরাজ্যে বিশেষ খাবারটি পাঠাবেন বদরুল। এটি আবার চাঁদনীঘাট এলাকা ছাড়া তেমন কোথাও পাওয়া যায় না। তাই বিয়ানীবাজার থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দূরে এসেছেন তিনি।
শুনে আশ্চর্য লাগবে, বিশেষ খাবারটি মাটি দিয়ে তৈরি। বিস্কুটের আদলে তৈরি বলে একে ‘মাটির বিস্কুট’ বলে থাকেন অনেকে, তবে সিলেটে খাবারটি ‘ছিকর’ নামে পারিচিত।
বিস্কুটের মতো কামড়ে কামড়ে খাওয়া হয় ছিকর। সিলেট অঞ্চলে ছিকর খাওয়ার প্রচলন অনেক দিনের।
চাঁদনী ঘাট এলাকায় বুধবার বিকেলে কথা হয় বদরুল আলমের সঙ্গে, যিনি বলেন, ‘আমার চাচি লন্ডন থাকেন। সেখান থেকে চাচি অনেকদিন থেকে ছিকর পাঠাতে বলছেন। তাই এটি এখানে কিনতে এলাম।
‘এক কেজি কিনেছি। আগামী সপ্তাহে এক আত্মীয় লন্ডন যাবেন। তার সাথে এগুলো পাঠিয়ে দেব।’
সুরমা নদীর তীরঘেঁষা চাঁদনীঘাট এলাকায় পাশপাশি সিলেটের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। কিন ব্রিজ, আলী আমজদের ঘড়ি, সারদা হলের অবস্থান এখানেই।
সারদা হলের সামনের ফুটপাতে মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করেন চার থেকে পাঁচজন বিক্রেতা। তাদের সবার কাছেই পাওয়া যায় এ মাটির বিস্কুট।
বিক্রেতারা জানান, তাদের মূল ক্রেতা নারীরা। বিশেষত গর্ভবতী নারীরা ছিকর খেয়ে থাকেন, তবে দেশের চেয়ে বিদেশে বসবাসরত সিলেটের লোকজনই এটির প্রধান ক্রেতা। সিলেট থেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে যায় এ বিস্কুট।
ছিকর কী
ছিকর হচ্ছে পাহাড়ের এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি এক প্রকার পোড়ামাটির বিস্কুট।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ছিকর তৈরি প্রথম শুরু হয় হবিগঞ্জে। এরপর এটি সিলেটসহ আশপাশের জেলার ছড়িয়ে পড়ে।
ছিকর শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘ছিয়া’ তথা কালো এবং ‘কর’ (মাটি) থেকে। ছিয়াকর শব্দটিই পরে ছিকর হিসেবে পরিচিতি পায়।
ছিকর কেন খাওয়া হয়
চিকর কেন খাওয়া হয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে একেকজন একেক তথ্য দিয়েছেন।
সিলেটের প্রবীণ ও মধ্যবয়সী কয়েকজন নারী ও পুরুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আগে দরিদ্র লোকজন খাবারের বিকল্প হিসেবে পাহাড়ের মাটি পুড়িয়ে তৈরি এ বিস্কুট খেতেন। ছিকরে অনেক খনিজ উপাদান রয়েছে এবং রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে এটি কার্যকর ও শক্তিবর্ধক বলেও জানিয়েছেন তাদের কয়েকজন। তাই খনিজ উপাদানের ঘাটতি কাটাতে গ্রামীণ নারীরা গর্ভাবস্থায় ছিকর খেয়ে থাকেন। এ ছাড়া পান-তামাকের মতো দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশতও অনেক প্রবীণ নারী ও পুরুষ ছিকর খেয়ে থাকেন।
নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার গৃহিনী লাইলী বেগম পাঁচ বছর আগে সন্তানের জন্ম দেন। গর্ভবতী অবস্থায় তিনি এই ‘মাটির বিস্কুট’ খেয়েছেন।
কেন খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গর্ভবতী অবস্থায় এটি খাওয়ার ইচ্ছা হয়। তা ছাড়া মুরব্বিরাও খেতে বলেন। তাই খেয়েছি। তবে এতে কোনো উপকার হয়েছে কি না জানি না।’
স্ত্রী লাইলী বেগমের সঙ্গে তখন তার স্বামী মুরাদ আহমদও ছিকর খেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘এটি খেতে মজাই লাগে। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ। তাই একবার খেলে আবার খাওয়ার ইচ্ছা জাগে।’
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রাখালগঞ্জ এলাকার প্রায় ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা রেখা রানী দাস বলেন, ‘ছিকর শক্তি বাড়ায় ও রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে বলে শুনেছি। আগে তো মানুষজন তেমন ওষুধপত্র খেত না। ডাক্তারের কাছে যাওয়া বা ওষুধ খাওয়ার সামর্থ্যও তখন ছিল না।
‘সে সময় মানুষজন ছিকর খেত। বিশেষ করে প্রায় সব গর্ভবতী নারী এটি খেতেন, তবে এখন ছিকর খাওয়া অনেক কমে গেছে।’
এ জিনিস কেন খাওয়া হয়, তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি চাঁদনীঘাট এলাকার কোন বিক্রেতাই। প্রায় ২০ বছর ধরে এ এলাকায় মাটির জিনিসপত্র ও ছিকর বিক্রি করেন শহিদ আহমদ।
তিনি বলেন, ‘অনেকেই এটি কিনে নেয়, তবে কেন খায় জানি না। শুনেছি এটি খেলে শক্তি বাড়ে ও খাওয়ার রুচি বাড়ে।
‘এ ছাড়া আয়রন ট্যাবলেটের বিকল্প হিসেবেও ছিকর খাওয়া হয়। তাই গর্ভবতী নারীরা এটি বেশি খায়।’
তিনি বলেন, ‘যারা রক্ত বিক্রি করে তাদের অনেকেও ছিকর কিনে খায়।’
এ ব্যাপারে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘ছিকরের কোনো উপকারিতা আছে বলে আমার জানা নেই। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিতও নয়।’
তিনি বলেন, ‘গর্ভবতী অবস্থায় নারীদের ক্যালসিয়াম ও আয়রনের সাপ্লিমেন্টারি দেয়া হয়, কিন্তু মাটির মধ্যে এই দুই উপাদান নেই। বরং এর মাঝে অনেক ক্ষতিকারক ব্যকটেরিয়া থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর বা ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া কোনো কিছু খাওয়াই ঠিক নয়।’
কোথায় ও কীভাবে তৈরি হয় ‘মাটির বিস্কুট’
সিলেটের লালাবাজারের সনাতন পাড়ার সজিব মালাকার প্রায় ৪৫ বছর ধরে ছিকর তৈরি করেন। তার বাবা এবং দাদাও এই কাজ করতেন।
ছিকরের প্রস্তুতপ্রণালী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাহাড়-টিলার তলদেশের এঁটেল মাটি দিয়ে ছিকর তৈরি করা হয়। প্রথমে গর্ত খুঁড়ে পাহাড়ের তলা থেকে লম্বা বাঁশ দিয়ে মিহি মাটি সংগ্রহ করা হয়। এগুলো সারা রাত ভিজিয়ে রেখে নরম করা হয়। তারপর তা মাখিয়ে খাই বানিয়ে মন্ড তৈরি করা হয়।
‘পরে এগুলো কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। এরপর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দুই-এক দিন শুকানোর পর মাটির চুলায় এগুলো পোড়ানো হয়। ঘণ্টা দুয়েক পর ছিকর কালচে বর্ণ ধারণ করে সুঘ্রাণ ছড়াতে থাকে। এতে গোলাপজলসহ বিভিন্ন সুগন্ধি মেশানো হয়।’
তিনি বলেন, দেশের চেয়ে বিদেশে এটি বেশি বিক্রি হয়। লন্ডনের ক্রেতারা এটি সবচেয়ে বেশি কিনে নেন।
ছিকর এক ধরনের নেশাজাতীয় খাবার উল্লেখ করে সজিব বলেন, ‘সিগারেটের মতো এটিও এক ধরনের নেশাজাতীয় খাবার। দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে অনেকে এটি খান। সবচেয়ে বেশি খান নারীরা।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের লালাবাজার ও গোয়ালাবাজার, সুনামগঞ্জের ছাতক, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, বাহুবল ও মাধবপুর এবং মৌলভীবাজারের কয়েকটি এলাকায় ছিকর তৈরি করা হয়। এসব এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোক বংশ পরম্পরায় ছিকর তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত, তবে এখন বিক্রি কমে যাওয়ায় বেশির ভাগই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মৌলভীবাজারের জগৎসী এলাকার ব্যবসায়ী বিষ্ণপদ দে বলেন, ‘আগে শহরের পাশের শব্দকর ও কুমার সম্পদায়ের লোকজন ছিকর তৈরি করতেন। আমাদের ছোটবেলায় ওই সম্প্রদায়ের নারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছিকর বিক্রি করতেন, তবে এখন আর কেউ বাড়িতে গিয়ে ফেরি করে ছিকর বিক্রি করে না।’
কেমন ব্যবসা
চাঁদনীঘাট এলাকার ছিকর বিক্রেতা শহিদ আহমদ জানান, প্রতি কেজি ছিকর ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি।
প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি ছিকর বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।
শহিদ আহমদ বলেন, ‘প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনই বেশির ভাগ ক্রেতা। তারা এগুলো কিনে প্রবাসে তাদের আত্মীয়দের কাছে পাঠান। আবার অনেকে আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানিও করেন।
‘রপ্তানির জন্য আমরা বিশেষভাবে তৈরি ছিকর দিয়ে থাকি। এগুলোর দাম একটু বেশি হয়।’
শহিদ আমাদের পাশেরই আরেক বিক্রেতা আল কাইয়ুম রনি বলেন, ‘এখন ছিকরের বিক্রি একেবারে কমে গেছে। বয়স্ক মানুষরা এটি কিছু কিনে নেন, তবে কম বয়সীরা এসব প্রায় কিনেনই না। এখন প্রতিদিন ৪/৫ কেজি ছিকর বিক্রি করি।’
লালাবাজারের ছিকরের কারিগর সজিব মালাকার বলেন, ‘আমরা পাইকারি দরে প্রতি কেজি ছিকর ৪০/৫০ টাকা করে বিক্রি করি।
‘আবার বিদেশে পাঠানোর জন্য তৈরি ছিকর প্রতি কেজি ৮০/৯০ টাকায় বিক্রি করি।’
আরও পড়ুন:হাতে নিয়ে চাপ দিলেই ভেঙে গুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলভদ্রপুর, কালিখোলা-বালিয়াডাঙ্গা সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত ইটের খোয়া।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিজি বাংলার হয়ে স্থানীয় সাবেক এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নিম্নমানের এ খোয়া সরবরাহ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিষয়টি টের পেয়ে প্রতিবাদ করলে ওই ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের মারধরের শিকার হতে হয়েছে। এমন অবস্থায় তাদের (স্থানীয়) তীব্র প্রতিবাদে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বাবুল শেখ এ খোয়া সরবরাহ করেন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সড়কের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মো. মোরশেদ বলেন, ‘সরবরাহকারী বাবুল শেখ ভালো খোয়া দেখিয়ে আমাদের নিম্নমানের খোয়া দিয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা খোয়া অপসারণ শুরু করেছি।
‘ভালো মানের নির্মাণসামগ্রী দিয়েই কাজ করা হবে।’
জায়েদ শেখ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘খোয়া এত পচা যে, চাপ দিলেই ভেঙে যায়। রাবিশ খোয়া দিয়ে রাস্তা করা যাবে না এটা বললে খোয়া সরবরাহকারী মাহবুবুল হক বাবুল ওরফে বাবুল মেম্বর আমাকে ও আমার ছোট ভাইকে মারধর করে। আমরা তার বিচার চাই।’
স্থানীয় সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হেমায়েত শেখ বলেন, ‘সড়কটি নির্মাণের শুরু থেকেই মাহবুবুল হক বাবুল শেখ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি নানা জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এখন নিম্নমানের খোয়া দিয়ে রাস্তা করার চেষ্টা করছে।
‘লোকজন বাধা দিলে বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে তাদের মারধর করে এবং ভয়ভীতি দেখায়। বিএনপি-আওয়ামী লীগ বুঝি না। আমাদের দাবি একটাই–রাস্তা নির্মাণ হবে ভাল খোয়া দিয়ে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খোয়া সরবরাহকারী মাহবুবুল হক বাবুল ওরফে বাবুলকে মোবাইল ফোনে কল করে পাওয়া যায়নি।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে ঠিকাদারকে সড়কে ব্যবহার করা নিম্নমানের খোয়া অপসারণ করতে বলা হয়েছে। ঠিকাদার নিম্নমানের খোয়া অপসারণ শুরু করেছেন।
‘ভালো মানের নির্মাণসামগ্রী দিয়েই কাজ করতে হবে। সড়কের কাজে কোনোভাবে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে পারবে না।’
মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কালিখোলা বলভদ্রপুর কালিমন্দির-বালিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পিচের সড়ক ও একটি কালভার্ট নির্মাণ করছে। দুই কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিজি বাংলা নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি করছে। চলতি বছরের ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় বৃদ্ধি করেছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য