‘স্ত্রী-সন্তান কেউ এখন আর আমাকে বিশ্বাস করে না। সন্তানরা বলে, আমাদের জন্য কিছুই করতে পার নাই। আত্মীয়স্বজনও দুর্ব্যবহার করে সারাক্ষণ। মৃত্যুই এখন একমাত্র কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু চোখ বুজলে তো পাওনাদাররা মাফ করবে না।’
যুব কর্মসংস্থান সোসাইটিতে (যুবক) ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখন আক্ষেপ করছেন মো. মোজাম্মেল হোসেন। বলেন, ‘এক বুক স্বপ্ন নিয়ে নিজের এবং আত্মীয়দের অর্থ এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করি, কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, মূল টাকাই পেলাম না। টাকার শোকে কেটে গেছে এক যুগের বেশি সময়। আর কবে পাব টাকা, কবে একটু স্বস্তি নিয়ে মরতে পারব?’
উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নেয় যুবক। নিবন্ধন না নিয়েই ১৯৯৪ সাল থেকে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান।
২০১৬ সালে যুবকের ব্যবসাকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর শুরু হয় হইচই। এরই মধ্যে যুবকের কাছে ৩ লাখ ৩ হাজার গ্রাহকের পাওনা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা।
গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে গঠন করা হয় কমিটি। এরপর সাবেক যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় যুবক কমিশন। এ ছাড়া আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দায়দেনা নিরূপণ এবং তা পরিশোধে প্রশাসক নিয়োগের পরামর্শ দেয় সবাই, কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
ফরাসউদ্দিন কমিটি
যুবকের গ্রাহকদের পাওনা অর্থ কীভাবে উদ্ধার করে দেয়া যায়, তা বের করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে সভাপতি করে ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ফরাসউদ্দিন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুবকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য গ্রাহকদের পাওনার চেয়ে বেশি। তবে কমিশন স্থির করে যে, যুবক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এ সম্পত্তি দখলে নিয়ে সেখানে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে তা বিক্রি করে গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যুবক যাতে এসব সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে না পারে, সে জন্য স্থগিতাদেশ আবশ্যক বলে মত দেয় কমিটি।
যুবক নিয়ে তৈরি করা প্রথম কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, যুবক ও যুবকের কর্মকর্তাদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং নামে-বেনামে হস্তান্তর করা সম্পত্তি প্রশাসনিক বা বিচারিক আদেশের মাধ্যমে সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা যায়। এ সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের আসল টাকা পরিশোধ করা যাবে। যুবক বা এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী কোনো গোষ্ঠী যাতে আর গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য অর্থ বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্থায়ী সংস্থা বা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এমএলএম কোম্পানির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।
রফিকুল ইসলাম কমিশন
দুই বছর মেয়াদে ২০১১ সালের ৭ মে সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে ‘যুবক কমিশন’ গঠন করে সরকার। এই কমিশন পাঁচটি সুপারিশ করে। যুবক গ্রাহকদের অর্থের পরিমাণ সুনির্দিষ্টকরণ, অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি নির্ধারণ, সকল সম্পত্তি বিক্রি এবং হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ছাড়াও প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ দেয় কমিশন। মেয়াদ পূর্তিতে কমিশন সুপারিশসহ প্রতিবেদনও দেয়। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি
যুবক গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেবার কৌশল বের করতে ২০১৪ সালের শেষ দিকে আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
১০ সদস্যের ওই কমিটির সুপারিশে বলা হয়, ‘কমিশন অব ইক্যুইটি অ্যাক্ট, ১৯৫৬ অনুযায়ী সরকার/বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুবক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধি নিয়ে প্রশাসনিক আদেশে জনস্বার্থ সম্পৃক্ত বিষয়ে কমিশন গঠন করে ধারা-১১ ক্ষমতাবলে ওই আইনের পুরো আইনি ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার একজন হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি/অবসরপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা/অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন অথবা পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করতে পারে।’
প্রশাসক নিয়োগ আর হয় না
অদৃশ্য কারণে এক যুগেরও বেশি সময় পরও যুবক নিয়ে কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়নি কেউ। বাধা কোথায় তাও স্পষ্ট না। তবে, আইনগত দিক সামনে আসায় এ বিষয়ে দায়িত্ব নেয়নি কেউ। মামলা থাকায় এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে দায় এড়িয়েছে মন্ত্রণালয় ও সংস্থা।
সম্পদ বিক্রি করছে যুবক
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কমিটি সম্পদের হিসাব চাইলে সেখানে তথ্য দেয় যুবক। তাদের তথ্যে দেখা যায়, ১৮টি বাড়ি, ১৮টি প্রকল্পসহ ২ হাজার ২০০ একর জমির মালিক যুবক।
এ ছাড়া অন্যান্য হিসাব বলছে, যুবকের মোট জমির পরিমাণ ৩ হাজার একর। প্রকল্প রয়েছে ১৮টি। আর বাড়ি রয়েছে ১৮টি, বর্তমান বাজারমূল্যে যা দাঁড়ায় ৬ হাজার কোটি টাকা। কার্যক্রম বন্ধের পর যে সম্পদ ছিল, এখন তা নেই। কোনোটি বিক্রি হয়েছে, কোনোটি আবার দখল হয়ে গেছে। নেপথ্যে থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় যুবকের একটি শিল্প প্লট ভোগদখল করছে যুবকের পুরোনো কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া পল্টনে বি কে টাওয়ার এখন দখল হয়ে গেছে। সেখানে দোকান দিয়ে ব্যবসা করছে প্রভাবশালী একটি মহল। ৫৩/১ নয়াপল্টনের একটি চারতলা বাড়ি দখলে নিয়েছে প্রভাবশালী মহল। সেখানে মাদ্রাসার নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, যুবকের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা জামিনে বের হয়ে নেপথ্যে থেকে সম্পদ বিক্রি এবং ভোগদখলে নেমেছেন।
যুবক ক্ষতিগ্রস্ত কমিটির সুপারিশ
যুবক গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষায় গঠন করা হয়েছে যুবক ক্ষতিগ্রস্থ জনকল্যাণ সোসাইটি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত এই সংগঠন এ সংকট সুরাহায় নানাভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কেউ সুরাহায় এগিয়ে আসেনি।
সবশেষ ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয়া হয়। সেখানে যুবক বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি কামনা করে প্রশাসক নিয়োগের দাবি তোলা হয়। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রশাসক নিয়োগের পরামর্শ দেন। বলেন, প্রশাসক নিয়োগের এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।
এর পরেও কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাণিজ্যসচিবকে চিঠি দেয়া হয়। উপসচিব মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘যুবকের সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে গ্রহণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও বিক্রয়পূর্বক এর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের জমাকৃত মূল আমানত পরিশোধের লক্ষ্যে একজন রিসিভার বা প্রশাসক নির্বাচন করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’
উদ্যোগ নিচ্ছেন বাণিজ্যমন্ত্রী
সম্প্রতি সাংবাদিকদের এক কর্মশালায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডেসটিনি ও যুবকের প্রতারিত গ্রাহকেরা অন্তত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ টাকা ফেরত পেতে পারেন বলে মন্তব্য করেন ।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ডেসটিনি ও যুবকের সম্পদগুলোর দাম বর্তমানে বেড়েছে অনেক। ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করলেও যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে গ্রাহকদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ টাকা ফেরত দেয়া যাবে।
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘আইনমন্ত্রী আমাকে বললেন, এটা আদালতের বিষয়। কোনো সংস্থা দিয়ে সংযুক্ত করে ক্ষতিপূরণ দেয়া যেতে পারে। আইন মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কাজ করছে।’
আরও পড়ুন:শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য