মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে পদ্মা নদীর দুই প্রান্তকে যুক্ত করছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুন মাসেই সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরুর আশা করা হচ্ছে। তখন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল এই সেতুর ওপর দিয়ে চার লেন দিয়ে চলবে গাড়ি, নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুর তলদেশ দিয়ে যেকোনো ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারবে অনায়াসে। সেতুর নিচতলা দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন, যে লাইন দিয়ে গ্যাস পৌঁছাবে এই জনপদসহ আশপাশের অনেক জেলায়।
তাই পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলছে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর। এই প্রকল্পের কাজ ও প্রকল্প ঘিরে যেসব উন্নয়নমূলক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সম্প্রতি তা ঘুরে দেখেছে নিউজবাংলা। কথা বলেছে এসব জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে।
সেতুকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যেসব প্রকল্পের কাজের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা দেখে জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন একসময়কার অবহেলিত এই জনপদের মানুষ। তাই পদ্মার এপার-ওপার দুই পারের মানুষেরই এখন আগ্রহ-উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু কবে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে পদ্মা সেতু।
শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এবং মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কুতুবপুর মৌজার ১২০ একর জমিতে হচ্ছে শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী। প্রকল্পের পাশেই পদ্মা সেতুর শরীয়তপুর প্রান্তের রেল স্টেশন। এই স্টেশনের কারণে এখানকার তাঁতিরা কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য সহজে আনা-নেয়া করতে পারেন। স্থানীয় লোকজন মনে করছেন, শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। বর্তমানে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ চলছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর পুরোটাই সরকারি তহবিল থেকে দেয়া হবে। প্রথম পর্যায়ের এই কাজের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণ শেষে ভরাটের মাধ্যমে চলছে ভূমি উন্নয়নকাজ। এরপর শুরু হবে অবকাঠামো উন্নয়নকাজ। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাঁতিদের দক্ষতা বৃদ্ধি, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন, বাজারজাতকরণ, পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে তাঁতবস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তাঁতিদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই তাঁত পল্লী গড়ে উঠছে।
তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পটির আওতায় তাঁতিদের কাপড় বোনার আগে ও পরে বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হবে। সেখানে তাঁতিদের জন্য থাকবে আবাসিক ভবন, তাঁত শেড, ডরমেটরি, রেস্ট হাউস, সাইবার ক্যাফে ও বিদ্যুতের উপকেন্দ্র। সপ্তাহে এক বা দুই দিন তাঁতপণ্যের হাট বসানোর চিন্তা রয়েছে। যে হাটে সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল বিক্রয় ও প্রদর্শনী হবে। মূলত তাঁতের কাপড় বোনা থেকে শুরু করে পোশাক তৈরি ও বিক্রি পর্যন্ত সব ব্যবস্থাই করা হবে পুরো প্রকল্পের আওতায়।
শেখ হাসিনা তাঁত পল্লীর (প্রথম পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলী খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে আমরা শুধু ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন আর সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করব। এরই মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। এখন বালু ভরাট করে ভূমি উন্নয়ন করছি। বালু ভরাটের কাজ ৬০ শতাংশ হয়ে গেছে। করোনার কারণে আমাদের কাজ একটু পিছিয়ে পড়েছে। তারপরও আশা রাখি, আগামী বছরের জুনের মধ্যেই প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করতে পরব।’
তিনি জানান, প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে মূলত তাঁত পল্লীর অবকাঠামো তৈরির যাবতীয় কাজ হবে। একটি আদর্শ তাঁত পল্লীতে যা যা থাকা উচিত তার সবই থাকবে সেখানে।
শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী প্রকল্পের আওতায় কী কী হবে, তার একটা খসড়া করা হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষে আমরা তাঁত পল্লী উন্নয়নের এই খসড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিব। তারা এগুলো দেখে প্রয়োজনে নতুন কিছু যোগ করতে পারে, নাও পারে। সবমিলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনা তাঁত পল্লীর একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করবে। পরে সেটা একনেকে পাস হলেই দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে।’
জাহাঙ্গীর আলী খান বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের তাঁতশিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কারণ পদ্মার ওই এলাকা হবে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা। মানুষ সেখানে ঘুরতে গিয়ে এই তাঁত পল্লীর সঙ্গে পরিচিত হবে। তারা তাঁতের বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটা করবে।’
নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় পশ্চিম নাওডোবা ইউনিয়নের জমাদ্দারকান্দি গ্রামের মহসীন জমাদ্দারের, যার বাড়ি তাঁত পল্লীর পাশেই। পদ্মা সেতু আর এই তাঁত পল্লী তাকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
মহসীন জমাদ্দার বলেন, ‘রাস্তার পাশেই আমার মুদি দোকান, দই-মিষ্টিও বেচি। এখানে তাঁত পল্লী হলে অনেক মানুষ আসবে, বেচা-বিক্রি বাড়বে। তাই চিন্তা করছি, ডেইরি খামার দেব। খামারের দুধ দিয়ে উন্নতমানের মিষ্টি বানাব।
‘আশা করছি, সেই মিষ্টির জন্য এখানে যারা আসবে, তারা খেতে পারবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক কিনেও নিয়ে যেতে পারবে। তাঁত পল্লীতে যেমন এলাকার লোকের কাজ হবে। আমরা যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ব, সেখানেও এলাকার মানুষ কাজ পাবে।’
আলতাফ হোসেন নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এলাকাটি ছিল খুব অনুন্নত। এখন পদ্মা সেতু হচ্ছে, তাঁত পল্লী হচ্ছে। এই এলাকা এখন শহরের মতো হয়ে যাবে। আলো ঝলমল করবে। দেশি-বিদেশি মানুষ আসবে। আমাদের এলাকাটি হবে পর্যটন এলাকা। এ কথা ভাবতেই আনন্দ লাগছে।’
এই তাঁত পল্লী হওয়ার খবর শুনে পাবনা থেকে ব্যবসা করতে এখানে এসে থাকছেন বিল্লাল হোসেন। এখন ভাঙারির ব্যবসা করছেন। প্রকল্পের পাশেই জমি কেনার চিন্তা তার।
নিউজবাংলাকে বিল্লাল বলেন, ‘আমি এই এলাকার না, ব্যবসা করতে আসছি। এখানে তাঁত পল্লী হলে বিভিন্ন জায়গার লোকজন আসা-যাওয়া করবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের মান বাড়বে। এলাকাটি গ্রাম থেকে শহরে পরিণত হবে। তাই আমি পাবনা থেকে এসেছি। অনেক দিন ধরেই ভাঙারির ব্যবসা করছি।
‘এখন তাঁত পল্লী ঘিরে নতুন ব্যবসার চিন্তা করছি। এখানে বিনিয়োগ হবে বুদ্ধিমানের। আমার মতো অনেকেই আসছেন, ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিনিয়োগকারীরা আসবেন। এলাকাটি হবে দর্শনীয় ও বাণিজ্যিক এলাকা।’
প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। ফলে উন্নত হবে দেশের তাঁতশিল্প। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে তাঁতিদের। ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে তাঁতিদের। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটবে। স্থানীয় মানুষের জন্য সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।’
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মার এই পারে শুধু এই তাঁত পল্লীই নয়, হবে আইটি পার্কও। ইতিমধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় আইটি পার্কটি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই পদ্মাতীরবর্তী শিবচরে এই প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এর বাইরে আরও অনেক ছোট-বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব নার্সিং ইনস্টিটিউট অ্যান্ড কলেজ, আইএইচটি ভবন, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, মুক্তমঞ্চ ও অলিম্পিক ভিলেজ। সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তোলা হবে বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও আইকন টাওয়ার।
আইটি পার্ক
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিবচরের কুতুবপুরের কেশবপুরে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অফ ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি অ্যান্ড হাইটেক পার্ক নির্মাণে ৭০ দশমিক ৩৪ একর জায়গা নির্ধারণ করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটির অ্যাডমিন ও ফিন্যান্স বিভাগের পরিচালক এ এন এম শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটার প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছে। প্রস্তাবটা এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে। আশা করছি, দু- এক মাসের মধ্যেই এটা একনেকে উঠবে। একনেকে প্রকল্পটা পাস হয়ে গেলেই আমরা কাজ শুরু করতে পারব।
‘ইতিমধ্যে ওই এলাকায় জায়গা নির্ধারণ হয়ে গেছে। প্রকল্প পাস হলেই ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হবে। এই প্রকল্প বস্তবায়নের জন্য ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে বলে আমরা অনুমান করেছি। একনেকে পাস হওয়ার পর খরচের মূল হিসাবটা পাওয়া যাবে।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্পটা বাস্তবায়ন হলে, ওই এলাকায় বিরাট পরিবর্তন আসবে। শুধু ওই এলাকায়ই না, পুরো দেশটাকে টার্গেট করে এই প্রকল্পটা বাস্তবায়ন করা হবে। মেধাবী সমাজ গঠনের যে কথা বলা হচ্ছে, এখানে সেই মেধাবী তৈরির কাজ হবে।
‘প্রযুক্তি নিয়ে রিসার্চ হবে। বিকেএসপি যেমন খেলোয়াড় তৈরি করে, তেমনি এখানে আগামী দিনের আইটি বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে। এখানে হয়তো ১-২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হলো এখান থেকে অসংখ্য আইটি বিশেষজ্ঞ বের হবে, তারা সারা দেশে ভূমিকা রাখবে।’
মাদারীপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে।
সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রেজাউল করিম তালুকদার টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি এবং সার্কেল এএসপি অফিস-কাম-বাসভবন, বেগম রোকেয়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলসহ ট্রেনিং সেন্টার ও ডে-কেয়ার সেন্টার, শিবচর পৌর বাস টার্মিনাল, ট্রমা সেন্টার, শিবচর হাইওয়ে থানা, হাজি আবুল কাসেম উকিল ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, চৌধুরী ফাতেমা বেগম ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্য স্থানের তালিকায় এখনও শীর্ষস্থানে আছে শিবচরের নাম।
ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরীর (দাদা ভাই) নামে শিবচর উপজেলায় ‘দাদা ভাই উপশহর’ হাউজিং প্রকল্পে ৮৭৮টি প্লট প্রস্তুতির কাজ ও বরাদ্দ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু বহুতল ভবন হয়েছে এবং সেগুলোতে মানুষ বসবাস করা শুরু করেছে। প্রায় ১০৫ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই প্রকল্পে ১ লাখের বেশি মানুষের আবাসন হবে।
মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি খান মো. শহীদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু মানুষের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করে দেবে। পদ্মায় ধরা মাছ যেমন সহজেই কারওয়ান বাজারে যাবে, তেমনি যেকোনো কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা যাবে। ফলে কৃষক, জেলেসহ সব পেশার মানুষ সরাসরি লাভবান হবেন।’
তিনি বলেন, ‘তাঁত পল্লী ও আইটি পার্কের মতো প্রকল্প এই জনপদের জন্য আশীর্বাদ। এসব প্রকল্পে যাতে অনিয়ম-দুর্নীতি না হয়, সেদিকে সরকারের কড়া নজরদারি থাকা উচিত। অন্যথায় এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।’
সাজছে মুন্সিগঞ্জ
এই জেলার ওপর দিয়েই নান্দনিক ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে গেছে। অল্প সময়েই এখানকার মানুষ রাজধানী ঢাকায় যেতে পারছেন। বাড়িতে থেকেও অনেকে রাজধানীতে গিয়ে অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।
এই এক্সপ্রেসওয়ে আর পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে সাজছে মুন্সিগঞ্জ। বেড়েছে এখানকার জমির দাম। হচ্ছে নতুন নতুন আধুনিক আবাসিক এলাকা। গড়ে উঠছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ নানা অবকাঠামো। এই এলাকার অনেক লোকেরই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে পদ্মা সেতুতে।
দৃষ্টি কেড়েছে ভাঙ্গা মোড়
পদ্মা সেতুর মতোই আরেক বিস্ময় হয়ে দেখা দিয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা গোলচত্বর। এখানকার বর্তমান দৃশ্য দেখলে মনে হয়, এটি উন্নত কোনো দেশের সড়ক জংশন, যা আসলে ভাঙ্গা উপজেলার গোলচত্বর।
এই গোলচত্বরের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই অনেক মানুষ ভিড় করছেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মুন্সিগঞ্জের মঈনউদ্দিন সুমন ও শরীয়তপুরের কাজী মনিরুজ্জামান]
আরও পড়ুন:
নওগাঁ সদর উপজেলার হাসাইগাড়ী ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে প্রায় এক মাস ধরে বেড়া দিয়ে ৯টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, স্থানীয় হাসান মল্লিকসহ প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির নির্দেশে এ বেড়া দিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এক মাস আগে রাস্তার পাশে বেলাল মল্লিকের লাউ-কুমড়ার গাছ খায় একটি ছাগল। সে ছাগলকে বেলাল মল্লিক মারধর করলে প্রাণীটির একটি পা জখম হয়।
ওই ঘটনা শুনে ছাগলের মালিক হাসান মল্লিক ক্ষিপ্ত হয়ে বেলালকে মারধর করেন এবং স্থানীয় কিছু মাতুব্বরের পরামর্শে বেলাল মল্লিক, তার প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনসহ ৯টি পরিবারের বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তার তিন দিকে বেড়া দেন।
এমন পরিস্থিতিতে বেলাল মল্লিক গত ৪ সেপ্টেম্বর থানায় অভিযোগ করেন, কিন্তু ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পরিদর্শন করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই চলে যায়। এতে হাসান মল্লিক আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
বেলাল মল্লিকের অভিযোগ, তিনি এক রাতে প্রায় সাড়ে ১০টার দিকে বিলের মধ্যে মাছ ধরতে গেলে সেটি টের পেয়ে যান হাসান মল্লিক। পরে হাসান, জব্বার, দুলাল এবং তাদের পরিবারের নারীদের সঙ্গে নিয়ে বেলাল মল্লিককে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়। ওই রাতেই বেলালকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বেলাল মল্লিকের অভিযোগ, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক মাস ধরে পরিবার নিয়ে তিনি অবরুদ্ধ। এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তার ভাষ্য, বেড়া দেয়া লোকজন বর্তমানে চাঁদা দাবিও করছেন। চাঁদার টাকা না দিলে এইবার আর বেঁচে থাকার সুযোগও দেবে না বলে হুমকি দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাড়িও যেতে পারছি না। তাই আমরা প্রশাসনের কাছে আইনগত সহযোগিতা চাই।’
এ বিষয়ে হাসান ও জব্বারের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, মাতুব্বরের হুকুমে তারা বেড়া দিয়েছেন। তার অনুমতি ছাড়া বেড়া কখনোই সরাবেন না। তা ছাড়া ছাগলকে মারধরের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
স্থানীয় মাতুব্বর আক্কাস আলী বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটেছে, যা স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করা সম্ভব ছিল, তবে বেড়া দিয়ে অবরুদ্ধ করার বিষয়ে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি।’
এ বিষয়ে নওগাঁর ভীমপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) জামাল উদ্দীন বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। বেড়া সরিয়ে নিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত যে বেড়া সরিয়ে নেয়া হয়নি, তা আমার জানা নেই। পরবর্তী সময়ে কেউ আমাকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।’
আরও পড়ুন:মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আনলোডিং ড্রেজার দিয়ে যুবলীগ নেতার বালু উত্তোলনের কারণে পানির চাপে একটি সড়ক ভেঙে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
তারা জানান, বাঁশগাঁও-নয়ানগর সড়কের একাংশ ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন পাঁচ গ্রামের অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মুন্সীগঞ্জ জেলা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি ভুলু মুন্সীসহ আরও কয়েকজন ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাটের ব্যবসা করার কারণে রাস্তাটি ভেঙে যায়।
ঘটনাস্থলে মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশগাঁও-নয়ানগর সড়কের বাঁশগাঁও কবরস্থানের আনুমানিক ১৫০ ফুট সামনে সড়কটির ৩০ ফুটের মতো অংশ ভেঙে পাশের খালে পড়েছে। ওই সময় কয়েকজন মানুষকে রাস্তা মেরামতের কাজ করতে দেখা যায়।
মেরামতে আসা লোকজন জানান, ভুলু মুন্সী তাদের রাস্তা মেরামতের কাজ করতে পাঠান।
সড়কটি মেরামতের কাজ করা শ্রমিক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘ভুলু ভাই আমাদের রাস্তাটি মেরামত করতে বলেছেন। তিনি যাবতীয় সকল মালামাল কিনে দিয়েছেন।
‘আমরা শুধু তার হুকুম বাস্তবায়ন করছি। এ ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারব না।’
খবর নিয়ে জানা যায়, গজারিয়া ইউনিয়নের নয়ানগর, বালুরচর, মিয়াবাড়ী, গজারিয়া ও গোসাইরচর গ্রামের অন্তত ছয় থেকে সাত হাজার মানুষ প্রতিদিন সড়কটি ব্যবহার করত। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের গজারিয়া ডকইয়ার্ড ও বেইজ এবং গজারিয়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাও এটি। রাস্তাটি বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চলাচলকারীরা।
কী বলছেন স্থানীয়রা
স্থানীয় কয়েকজন জানান, সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ জেলা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি ভুলু মুন্সীসহ আরও কয়েকজন ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাটের ব্যবসা শুরু করেন। গজারিয়া গ্রামের বেনজিরসহ আরও কয়েকজনের জমিতে বালু ফেলার পর পানির চাপে সড়কটির একাংশে ফাটল ধরে। পানির চাপ আরও বাড়তে থাকলে শনিবার রাতে সড়কের অংশটি ভেঙে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন প্রধান বলেন, ‘শনিবার রাতের কোনো এক সময় পানির চাপে রাস্তাটি ভেঙে যায়। তারপর থেকে কয়েকটি গ্রামের মানুষ রীতিমতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
‘রাস্তাটি ভেঙে যাওয়ার কারণে কাদা-পানি মাড়িয়ে আমাদের চলাচল করতে হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব রাস্তাটি মেরামত করা দরকার।’
নয়ানগর গ্রামের বাসিন্দা ও গজারিয়া পাইলট মডেল হাই স্কুলের শিক্ষার্থী সিয়াম বলে, ‘রাস্তাটি ভেঙে যাওয়ার কারণে আমাদের স্কুলে যেতে সমস্যা হচ্ছে। বিকল্প পথে গজারিয়া বাজার ঘুরে স্কুলে যেতে ভাড়া ও সময় বেশি লাগে।’
যুবদল নেতা ও এলজিইডির ভাষ্য
অভিযোগের বিষয়ে যুবদল নেতা ভুলু মুন্সী বলেন, ‘ড্রেজার ব্যবসার সঙ্গে আমি জড়িত না।’
ভেঙে যাওয়া সড়ক কেন সংস্কার করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই রাস্তা দিয়ে আমার কিছু পাথর যাবে। রাস্তা ভেঙে পড়েছে। পাথর নিতে পারছি না। তাই নিজের স্বার্থে কোস্ট গার্ডের সঙ্গে মিলে রাস্তাটি সংস্কার করছি।’
ভাঙা সড়কের বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) গজারিয়া উপজেলা প্রকৌশলী সামিউল আরেফিন বলেন, ‘সড়ক ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি আমরা জেনেছিলাম। এরপর সেই সড়কটি সংস্কার করার জন্য স্থানীয় ইউপি সদস্যকে বলা হয়েছে, তবে সড়কটি বালু ভরাটের পানির কারণে রাস্তাটি ভেঙেছে, এমনটা আমাদের জানা ছিল না। আমরা বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’
আরও পড়ুন:সিলেট সিটি করপোরেশনে (সিসিক) গত জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলীয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রার্থী হয়েছিলেন বিএনপির ৪৩ নেতা। দলের নির্দেশনা অমান্য করায় তাদের সে সময় আজীবন বহিস্কার করে বিএনপি। এদের মধ্যে সাতজন কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলদের অপসারণের পর বিপাকে পড়েছেন সিসিকের এ সাত কাউন্সিলর। আগেই দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া এসব নেতা এখন জনপ্রতিনিধিত্বও হারিয়েছেন।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে সিলেটসহ দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়।
সিসিক সূত্রে জানা যায়, গত জুনের নির্বাচনে দলীয় সমর্থন ছাড়াই বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত সাত নেতা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন। তাদের মধ্যে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ছয়জন ও এক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। শপথ গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলরদের কাছে তারা কিছুটা কোণঠাসা থাকলেও ৫ আগস্টের পর মোড় ঘুরে যায়।
ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর সিসিকের আওয়ামী লীগ দলীয় সব মেয়রসহ কাউন্সিলররা আত্মোগপনে চলে যান। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েও যান। এরপর থেকে সিসিকে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন বিএনপিদলীয় কাউন্সিলররা।
৫ আগস্টের পর থেকে সিসিকের সব কর্মকাণ্ডে বিএনপিদলীয় এ কাউন্সিলরদের সামনের সারিতে দেখা যায়। সিসিকের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন, তবে এই ক্ষমতা বেশি দিন চর্চা করার সুযোগ পাননি তারা। ২৭ সেপ্টেম্বর সব কাউন্সিলরদের অপসারণ করে মন্ত্রনালয়।
গত নির্বাচনে সিসিকের ১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ তৌফিকুল হাদী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ চৌধুরী শামীম ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হন। অন্যদিকে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সদস্য নজরুল ইসলাম মুমিন ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। আর ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সদস্য এ বি এম জিল্লুর রহমান উজ্জ্বল এ ওয়ার্ড থেকে বিজয়ী হন।
২১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বিজয়ী হন ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল রকিব তুহিন। ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচিত হন জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসেন সুমন। এ ছাড়া মহানগর মহিলা দলের সহসভাপতি মোছাম্মৎ রুহেনা খানম মুক্তা সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচিত হন।
এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম বলেন, ‘দল আমাকে বহিষ্কার করেছে। আমি তো দলকে বহিষ্কার করিনি।
‘আমি এখনও বিএনপির কর্মী। দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘বহিষ্কার-তিরস্কার এগুলো রাজনীতিরই অংশ। অনেক নেতাকে অতীতে বিএনপি বহিস্কার করেছিল। এখন তারা দলের উচ্চপদে আছেন। আমিও আশা করি অতীতের অবদান স্মরণ করে দল আমাকে ফিরিয়ে নেবে।’
শামীম বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম জনগণের চাপে। আমার এলাকার জনগণ আওয়ামী লীগের গুন্ডাতন্ত্র থেকে মুক্তি চাইছিল।
‘তাই তারা জোর করে আমাকে প্রার্থী করে। বিএনপির শীর্ষ নেতারাও বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।’
আরও পড়ুন:১৮২৩ সাল। জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের বাবা পাল বংশের কাছে থেকে একটি মাটির দোতলা বাড়ি কেনেন। জমিদারি চালানো হতো সেই বাড়ি থেকে।
জমিদারির সময়ে সুদূর ভারত থেকে শিল্পী নিয়ে এসে এই বাড়ির উঠানে বসানো হতো নাটকের আসর। বসত যাত্রাপালার আসরও।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার মৈনম বাজারে রায় বাড়ির জমিদার বাড়িটি এখন মাটির ডুপ্লেক্স বাড়ি। ব্যাক্তি মালিকানায় থাকলেও দূরদুরান্ত থেকে পর্যটক আসেন বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
রায় বাড়ির বংশধর বুরন রায় এবং বাবন রায় ২০২১ সালে জমিজমা বিক্রি করে নাটোরে চলে যান। বর্তমানে ক্রয়সূত্রে বাড়িটির মালিক আসকার ইবনে সুলতান শান্ত।
বাড়িটি সংস্কার ও আধুনিকায়নে শান্ত স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের কারিগরদের শৈল্পিকতাকে অগ্রাধিকার দেন। সৌন্দর্য সবাই যেন উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য বাড়িটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
‘রাইজিং হেরিটেজ প্যালেস’ নামের বাড়িটিতে এখনও ১৮২৩ সালের মাটির চিহ্নগুলো রয়ে গেছে। বাড়ির দেয়ালগুলোতে মাটির স্তর দিয়ে নানা শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আসকার ইবনে সুলতান শান্ত জানান, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার আদিবাসী পল্লি থেকে ৮০ থেকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ দ্বিজেন বর্মন তার ২০ জনের একটি টিম নিয়ে চার মাস শিল্পকর্মের কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় কারিগর দিয়ে প্রায় দুই বছরে সময়ের ব্যবধানে এমন রূপ দিতে পেরেছেন।
তিনি আরও জানান, বাড়িটিতে অভ্যন্তরীণ দুটি মাটির সিঁড়ি রয়েছে, যা প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। আর সংস্কারের পর বাইরে থেকে সবার চলাচলে সুবিধার্থে সিঁড়ি করা হয়েছে।
বাড়ির মালিক বলেন, ‘প্রতিদিন লোকজন আসেন মাটির এ ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেখতে, তবে ছুটির দিনে ভিড় বাড়ে। সবাই এসে ছবি ওঠায়, ভিডিও বানায়। সকলের জন্য উন্মুক্ত করা থাকে সবসময়। আমাদেরও ভালো লাগে।
‘সবাই এসে বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমরা কাউকে নিষেধ, বারণ করিনি।’
ভিডিওগ্রাফার আশিক খান বাড়িটির চিত্র ধারণ করতে এসে বলেন, ‘পুরাতন মাটির বাড়িকে এমন ডুপ্লেক্স বাড়িতে রূপ দেয়ার শৈল্পিক নিদর্শন দেখতে ছুটে এসেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় আমরা বাড়িটি সম্পর্কে জানতে পারি।’
সাদিয়া জাহান জান্নাত নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে নওগাঁ শহর থেকে এখানে এসেছি। বাড়িটি দেখে মনে হলো যেন সেই প্রাচীন যুগের জমিদার বা রাজা-বাদশাদের বাড়িতে এসেছি।
‘কী চমৎকার কারুকাজ। সত্যিই সব মিলে অসাধারণ।’
বাড়িটিতে আছে পানির ফোয়ারা ও বসার সুব্যবস্থা। এতে শুধু পর্যটকরাই নন, বর-কনেরা ছবি তুলতেও আসেন।
আরও পড়ুন:ঋণ জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, পাচার, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনসহ নানা অপরাধের অভিযোগে এক ডজনেরও বেশি মামলা কাঁধে নিয়ে বছরের পর বছর বহালতবিয়তে থেকে গেছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ও তার পরিবাবের সদস্যরা।
দেশের আর্থিক খাতে অনিয়মের শিরোমণি এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী বিধি ভেঙে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকার দ্বিতীয় নামটি ছিল এই বিতর্কিত ব্যবসায়ীর। ২০২১ সালের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায়ও দ্বিতীয় নামটি তার।
অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার এবং অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের পৃথক তিন মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড কাঁধে নিয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী।
অবশেষে তার ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবশেষ বুধবার ওবায়দুল করিমসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আর্থিক খাতে নানামুখী অপকর্মে সিদ্ধহস্ত ওবায়দুল করিম সাজা থেকে বাঁচতে মামলার নথি গায়েব ও শুনানি পেছানোর কূটকৌশলে পার করেছেন ১৬ বছর। সাজা ঘোষণার তিনটিসহ তার বিরুদ্ধে মোট ১৪টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৪৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১১টি মামলা হয়। ২০০৭ সালে করা এসব মামলার বিচারকাজে এখন স্থবিরতা বিরাজ করছে। তবে এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ওবায়দুল করিম ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। সে সময় যৌথ বাহিনীর গঠিত দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানের সময় গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তবে দুর্নীতির মামলা ও সাজা থেকে রক্ষা পাননি। তার অনুপস্থিতিতে বিশেষ আদালতে রায় ঘোষণা হয়। একটিতে যাবজ্জীবনসহ তিনটি মামলায় তার অন্তত ৪৮ বছর কারাদণ্ড হয়। এর মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে যাবজ্জীবন (৩০ বছর) কারাদণ্ড দেওয়া হয় ও আত্মসাতের সমপরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
২ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং পাচারের সমপরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। অবৈধ উপায়ে ৫০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জরিমানা করা হয় ১০ লাখ টাকা। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
অবৈধ উপায়ে ৫২ কোটি ৯২ লাখ টাকা অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর রমনা থানায় মামলাটি করেন দুদকের উপপরিচালক আবদুল করিম। বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২৫ জুন এক রায়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছর এবং তথ্য গোপনের দায়ে ৩ বছরসহ মোট ১৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন বিশেষ জজ আদালত-৯-এর বিচারক খন্দকার কামাল উজ-জামান। রায়ে ৫২ কোটি ৯০ লাখ টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
এ ছাড়া ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। রায়ে বলা হয়, ওবায়দুল করিম পলাতক থাকায় তিনি যেদিন আত্মসমর্পণ করবেন বা গ্রেপ্তার হবেন, সে দিন থেকে সাজার মেয়াদ শুরু হবে। কিন্তু ওবায়দুল করিম রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট শুনানি শেষে রায় স্থগিত করেন। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করলে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে ওবায়দুল করিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এ মামলায় বিচারিক আদালতে মামলার নথি খুঁজে না পাওয়ায় বিচারকাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
এর মধ্যে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় উঠে আসে ওবায়দুল করিমের নাম। সে সময় তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকেই বাঁচার চেষ্টা করেন তিনি।
বিধি ভেঙে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ
বিধি লঙ্ঘন করে ওরিয়ন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন পাওয়ার প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক অগ্রণী, জনতা ও রূপালী। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুটি নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং একটিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন শিথিল করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তিনটির প্রস্তাবিত ওই ঋণের অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি।
সিন্ডিকেট ফাইন্যান্সিং বা অর্থায়নের মাধ্যমে সম্প্রতি ওই ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সমস্যা জর্জরিত জনতা ব্যাংক এ ঋণের সিংহভাগ অর্থাৎ ৫ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।
রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ ঋণ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ঋণটি বিতরণের জন্য পাইপলাইনে রয়েছে, কিন্তু ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে এ ঋণ বিতরণে দেরি হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওবায়দুল করিমের মালিকানাধীন ওরিয়ন গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ১৪৫ কোটি ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০৬ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত হাজার কোটি টাকা।
ঋণের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওরিয়ন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম একটি ব্যাংক থেকে ১৬৬ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার ৫০৮ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু কোম্পানি তো দূরের কথা, টিআইএন নম্বরেরও খোঁজ মেলেনি। বেলহাসা একম জেভি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম, এমডি সালমান ওবায়দুল করিম ও স্পন্সর পরিচালক মাজেদ আহম্মেদ সাঈফের নামে ঋণের পরিমাণ ৭৮ কোটি ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৬৪৮ টাকা। ওবায়দুল করিম আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের নামে ৫১ কোটি ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬৮ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৭১৭ টাকা পরিশোধ করেননি। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা অংশীদারত্বের কোনো বৈধ কাগজ পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে বারবার সময় নিয়েও ঋণ পরিশোধ করেনি ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। ফলে প্রতিষ্ঠানটির ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখাতে ব্যাংকটিকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্য অনুসারে, সোনালী ব্যাংককে ২২ আগস্টের মধ্যে ঋণের যথাযথ শ্রেণিবিভাগ করে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। এতে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোম্পানিটির বকেয়া ঋণ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খারাপ ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ ছিল। তখন পর্যন্ত কোম্পানিটি চারটি কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি।
জানা গেছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তির মূল অর্থের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা এবং ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা সুদ বাবদ বকেয়া ছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমতির ওপর ভিত্তি করে এতদিন এই ঋণ খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংককে দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে কিস্তি বাকি থাকায় কোম্পানিটির ঋণ খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে বলা হয়েছে।
ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে প্রায় দুই দশক আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করে ওরিয়ন গ্রুপ। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে ৪০ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অপতৎপরতাও চালায় গ্রুপটি। সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ ভাগিয়েও নেয়। গত জুন শেষে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গ্রুপটির নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার বড় একটি অংশই নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানের বাইরে গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের গ্যারান্টার হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণও হাজার কোটি টাকার বেশি। যার একটা অংশ খেলাপির হলেও প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নেন তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের মেয়াদও বারবার বাড়ানো হয়।
সম্প্রতি একটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপসহ তিনটি গ্রুপের পকেটে। এতে বলা হয়, ব্যাংকটি থেকে বেক্সিমকো, এস আলম এবং ওরিয়ন গ্রুপের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের জনতা ভবন করপোরেট শাখার ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের বড় অংশ রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপের পকেটে।
এ ছাড়া গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষের দিকে (৬ মে) রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকে ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার আরেকটি ঋণ প্রস্তাব করা হয় গ্রুপটির ওরিয়ন রিনিউয়েবলস মুন্সীগঞ্জ লিমিটেডের নামে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের জামানত বা সিকিউরিটি মর্টগেজ হিসেবে যে সম্পদ দেখানো হয়েছে তা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। সে সময় জামানতের সম্পদমূল্য ৫৪০ কোটি টাকা দেখানো হলেও তা সর্বোচ্চ ১৮০ কোটি টাকা হবে। এভাবে জামানতে ভুল তথ্য দিয়েও ঋণ ভাগিয়ে নেওয়ার আশ্রয় নিয়েছে গ্রুপটি।
গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ব্যবসায়ী গ্রুপ ওরিয়নের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ৮২০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর বাইরে ননফান্ডেড ঋণ রয়েছে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা। গ্রুপটির মোট ১২৪টি কোম্পানির মধ্যে সচল থাকা ২২টির ব্যাংক হিসাবের লেনদেন পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, গ্রুপের মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিজের ব্যক্তিগত গ্যারান্টার হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১২৯ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৮ কোটি টাকার ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে ঋণ খেলাপি হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করে দেয়। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ খেলাপি তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নেন তিনি।
২০২০ সালে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে টাকা উত্তোলনের অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ তোলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ভেঙে খাওয়ার টার্গেটে নামে গ্রুপটি। এরপর তারা হাজার হাজার কোটি টাকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায়। কোম্পানিটি ঋণ হিসাবে ৯০৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার নেওয়ার আবেদনও করে। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একটি ব্যাংক থেকে একসঙ্গে এত টাকা ঋণ পাওয়ার নজির বাংলাদেশে নেই।
গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ২০০৭ সালে ব্যাংক থেকে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের এক মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বেশ আলোচনায় আসে। তবে তিনি সেই মামলার নথি আদালত থেকে গায়েব করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। নথি হারিয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়া থমকে যায়। ফলে অন্যতম আসামি ওবায়দুল করিমসহ দোষীরা বহাল তবিয়তে থেকে যান। রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ বছরে মামলাটি নিয়ে দায়িত্বশীলদের কোনো নজরদারিও নেই।
মামলা সূত্রে জানা যায়, বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ না করেই ২০০৮ সালে ওই রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রুল শুনানি শেষে ওই বছরই বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আসামি ওয়াবদুল করিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
নিয়মানুসারে মামলার মূল নথিটি উচ্চ আদালত থেকে বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর সেই নথিপত্র গ্রহণ করেন বিচারিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এরপর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর অগ্রসর হয়নি। মামলার মূল নথি খুঁজে না পাওয়ায় বর্তমানে ‘মামলা ও আসামিদের সর্বশেষ অবস্থা’ সম্পর্কে কেউই বলতে পারছেন না।
ওবায়দুল করিম পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ
আর্থিক খাতে অনিয়মের শিরোমণি এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জন ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে বলেছে। সন্ধ্যায় বিএফআইইউর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়, হিসাব জব্দ করা ব্যক্তিদের নিজস্ব ও ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সব লেনদেন বন্ধ থাকবে। আগামী ৩০ দিন এসব হিসাবের মাধ্যমে কোনো ধরনের লেনদেন করতে পারবে না তারা। প্রয়োজনে লেনদেন স্থগিত করার এ সময় বাড়ানো হবে। লেনদেন স্থগিত করার এ নির্দেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য হবে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে। এতে ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিম, ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম, মেহেদি হাসান ও মেয়ে জারিন করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেজাউল করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যও দেওয়া আছে।
এ ছাড়া চিঠিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য (পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, পুত্র/কন্যা ও অন্যান্য) এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সকল হিসাবের কেওয়াইসি, হিসাব খোলার ফরম ও শুরু থেকে হালনাগাদ হিসাব বিবরণীসহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য আগামী দুই কার্যদিবসের মধ্যে বিএফআইইউর কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
আর্থিক অনিয়মের বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ওরিয়ন গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:বাপ্পী হোসেনের বয়স ১৯ বছর। এই তরুণ রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। সে সময় ছররা গুলিতে আহত হন তিনি। সারা শরীর তো বটেই, তার দুই চোখে বিঁধে যায় পাঁচটি গুলি, যার মধ্যে বাম চোখে তিনটি আর ডান চোখে দুটি।
বাপ্পীর সারা শরীরে এখনও রয়ে গেছে ১৯টি গুলি। চিকিৎসা চলছে রাজধানীর শ্যামলীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিটে। বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুই চোখ থেকে গুলির স্প্লিন্টারগুলো বের করা হলেও দৃষ্টিশক্তি ফেরেনি বাপ্পীর।
মা মরিয়ম বেগম জানান, বাপ্পী আর কোনোদিন দেখতে পাবে না বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অথচ বাপ্পীর মনে এখনও আশা- একদিন আগের মতোই দেখতে পাবে সে।
বরিশাল বিএম কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ২৬ বছর বয়সী রহমতউল্লাহ সরকার সাবির। মাস্টার্স শেষ করে পড়ছিলেন বরিশালের একটি ল’ কলেজে।
সাবিরের ভাই নজরুল ইসলাম ইউএনবিকে জানালেন, ৪ আগস্ট বিকেলে বিএম কলেজের সামনে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। সে সময় সাবিরের বাম চোখে তিনটি ছররা বুলেট আর ডান চোখে একটি রাবার বুলেট লাগে। বাম চোখে এখনও একটি বুলেট রয়ে গেছে। সেটা বের করতে হলে চোখই ফেলে দিতে হবে। ডান চোখে তেমন সমস্যা না থাকলেও এখন বাম চোখে কিছুই দেখছে না সাবির।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে এমনই সম্পূর্ণ বা আংশিক অন্ধত্বকে বরণ করতে হয়েছে অর্ধ সহস্রাধিক মানুষকে।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা যায়, ১৭ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৬১১ জন চোখে বুলেট নিয়ে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত ২৮ জনের, যারা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন।
এক চোখ আহত অবস্থায় এসেছেন ৫১০ জন। তাদের মধ্যে ১৭৭ জনের দু’বার সার্জারি করতে হয়েছে। বর্তমানে স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিটে ভর্তি আছেন ৪৬ জন, যারা সবাই ছররা বুলেটে আহত।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘রাবার বুলেট দিয়ে আহত কাউকে আমরা এখনও পাইনি। যারা এসেছেন তাদের চোখে বিদ্ধ সব গুলিই মেটালিক প্লেটের। এই পিলেটগুলোকে ছররা গুলি বলা হচ্ছে।
‘এগুলো যখন ছোড়া হয় তখন বুলেটের মধ্যে একটা হিট জেনারেশন হয়। এটি চোখে ঢুকলে রেটিনা তো ছিঁড়ে যায়-ই, অন্য স্ট্রাকচারগুলোও ডিসঅর্গানাইজড হয়ে যায়। এখান থেকে ব্যাক করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাদের রেটিনা ছিঁড়ে গেছে, নার্ভে কোনো ক্ষতি হয়েছে, অথবা ভেতরে কোনো হেমারেজ আছে তাদের দ্বিতীয়বারের মতো অপারেশন করতে হয়েছে। অনেক বেশি ড্যামেজ না হয়ে থাকলে আস্তে আস্তে ভালো হতেও পারে। আর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভালো হয় না।’
এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটির প্রভাব অন্য চোখেও পড়ে কি না জানতে চাইলে সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘এটা হতে পারে। আমাদের এখানে একজন রোগী আছে যার এক চোখে পিলেটের আঘাতের কারণে অন্য চোখেও ইফেক্ট পড়েছে। এটা যদিও খুব রেয়ার।’
ছাত্র আন্দোলনে ছররা গুলি কেড়ে নিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষের চোখের আলো। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি, আগ্নেয়াস্ত্রে যে বুলেট ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো প্রাণঘাতী নয়। সেগুলো এমন বুলেট যা অনেক ছোট ছোট ছররা গুলি ছুড়ে দেয়।
মূলত ‘বার্ডশট’ হিসেবে এই পরিচিত এই বুলেট শিকারের কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি। নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে এই বুলেট আঘাত করে না; বরং অনেক বিস্তৃত পরিসরে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়।
এর আকার অনুযায়ী প্রতিটি রাউন্ডে ৩০০ থেকে ৬০০টি পিলেট থাকে। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু বা ব্যক্তির পাশাপাশি তাদের চারদিকে থাকা অন্যদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এবং গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে বিক্ষোভে ছোড়া গুলিতে পথচারীরাও ব্যাপক পরিমাণে আহত হয়েছেন।
ছররা গুলির আঘাতে মৃত্যুর পরিবর্তে অন্ধত্ব, আহত বা পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বিক্ষোভ বা জমায়েত নিয়ন্ত্রণে ‘মানবিক’ ও ‘গ্রহণযোগ্য’ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, বার্ডশট মানুষের ওপর আইন প্রয়োগের জন্য ব্যবহার একেবারেই অনুপযুক্ত এবং এটি কখনোই বিক্ষোভ প্রতিহত করতে ব্যবহার করা উচিত নয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতশাসিত কাশ্মীরে পিলেট-ফায়ারিং শটগান ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
২০১৬ সালে সেখানে এক গণঅভ্যুত্থানের সময় ১১০০ জনেরও বেশি মানুষকে ছররা গুলিতে আংশিক বা পুরোপুরি অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞার এই আহ্বানে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘পিলেট-ফায়ারিং শটগানের আঘাতে আহত ব্যক্তিরা গুরুতর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন।
চোখে আঘাত পাওয়া স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের বেশ কয়েকজন যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন তারা কাজ করতে পারবেন কি না এ নিয়ে ভয়ে আছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বার বার অস্ত্রোপচার করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাননি।’
বিশ্বে অনেক দেশেই ‘পশু-পাখি শিকারের গোলাবারুদ’ মানুষের ওপর প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এজেন্ডায় পুলিশিং সংস্কারের বিষয়টি শীর্ষে থাকায়, জমায়েত বা বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ‘বার্ডশট’ বা পিলেট গানের ব্যবহারের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে।
নানা ধরনের সবজির মধ্যে বিশেষ একটি জায়গা দখল করে আছে ‘কাঁকরোল’। আর ব্যাপকভাবে এই সবজির চাষ হচ্ছে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি গ্রাম গোমড়ায়। গ্রামটিতে বসবাসকারী সবাই বিভিন্ন সবজির আবাদ করেন, যার মধ্যে কাঁকরোল অন্যতম। তাই গোমড়া গ্রামটি এখন ‘কাঁকরোল গ্রাম’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা গারো পাহাড়ের জেলা শেরপুর। এখানে ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম ‘গোমড়া’। এই গ্রামের চারশ’ একর জমিতে প্রায় ১২শ’ কৃষক কাঁকরোল চাষকে তাদের জীবিকার অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সরজমিনে জানা যায়, এই এলাকায় কয়েক বছর আগেও পানি ও বিদুতের অভাবে বহু জমি পতিত ছিলো। এখন এ দুটি সুবিধা পাওয়ায় আর পতিত পড়ে থাকছে না এসব জমি। কৃষি বিভাগের সহায়তা ও পরামর্শে গ্রামের প্রায় সবাই নিজের কিংবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে মৌসুমী সবজি চাষ করছেন।
শরৎ ঋতুর এই সময়টাতে পুরো এলাকার সবজির ক্ষেত কাঁকরোলে ছেয়ে গেছে। যদিও এসব ক্ষেতে গরম ও শীতের আগাম সবজি বেশি আবাদ করেন স্থানীয়রা। এখানকার উৎপাদিত সবজির মান ভালো হওয়ায় স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে কাঁকরোল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে।
গোমড়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগে এই এলাকায় পানির জন্য প্রায় সব জমিই পতিত থাকতো। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ আসায় পানি সমস্যার সমাধান হয়েছে। আবাদের আওতায় এসেছে অনেক জমি।
‘আমরা মৌসুমভিত্তিক সবজির আবাদ করে থাকি। আমরা এখন সবজির মধ্যে কাঁকরোল লাগিয়েছি। সবজি আবাদ করে এলাকার কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।’
কৃষক হরমুজ আলী বলেন, ‘এটা পাহাড়ি এলাকা। এই এলাকায় আমরা সবজির আবাদই করি। আমি ৫০ শতাংশ জমিতে কাঁকরোল লাগাইছি। আমি এবার কাঁকরোল বিক্রি করে অনেকটা লাভবান হয়েছি। পোলাপানের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি। পাঁচ সদস্যের সংসার চলছে এই সবজি আবাদ করেই।’
কৃষক ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমরা পাহাড়ের মানুষ। আগে কী যে কষ্ট করছি! মানষের জমিতে সারাদিন কাম করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পাইছি। কোনো কোনোদিন কামও পাইতাম না। এই টাকা নিয়া বাজার করবার গেলে কষ্ট হইছে। এখন বাড়ির পাশে রহমত ভাইয়ের জমিন বাগি (বর্গা) নিয়া শুরু করছি কাঁকরোলের চাষ। এখন আল্লাহর রহমতে নিজেরা ভালা আছি।’
তবে স্থানীয় চাষিদের অভিযোগ রয়েছে গ্রামের রাস্তা-ঘাট কাঁচা নিয়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় সবজির ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
কৃষক হারুন মিয়া বলেন, ‘আমাদের এদিকে কাঁচা রাস্তা হওয়ায় আমরা সবজি বাজারে তুলতে পারি না। নিলেও খরচ অনেক পড়ে যাওয়ায় লাভ কম হয়। সময়মতো বাজারে না নেয়ায় সঠিক দামও পাই না। আমরা কৃষকরা অবহেলিত।’
কৃষক খাইরুল বলেন, ‘এই এলাকার গ্রামীণ রাস্তাগুলো পাকা করলে আমাদের খুব উপকার হবে। আমরা কৃষকরা সবজি আবাদ করে দামটা বেশি পাইতাম। খারাপ রাস্তায় সব গাড়ি সহজে আসবার চায় না। আসলেও ভাড়া বেশি পইড়া যায়। এজন্য লাভটা কম হয়।’
যেভাবে চাষ
কাঁকরোলের বীজ কাঁকরোল গাছের নিচে হয়ে থাকে, যা দেখতে মিষ্টি আলুর মতো। মার্চ ও এপ্রিলে এই সবজির চাষ করা হয়। চারা গজানোর ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যেই এর ফলন পাওয়া সম্ভব। কাঁকরোল লতানো গাছ। স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল একই গাছে হয় না। তাই বাগানে দু’ধরনের গাছ না থাকলে পরাগায়ন ও ফলন কম হয়।
চাষে খরচ ও লাভ কেমন
কৃষকেরা বলছেন, কাঁকরোল চাষে বিঘাপ্রতি খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার। ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘায় খরচ লাখ টাকার উপরে লাভ হয়ে থাকে।
কাঁকরোলের উপকারিতা
কাঁকরোল অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি৷ এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, ক্যারোটিন, আমিষ, ভিটামিন এ, বি ও সি এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে৷ কাঁকরোলে ভিটামিন সি থাকায় শরীরের টক্সিন দূর করে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
কাঁকরোলে আছে বিটা ক্যারোটিন ও আলফা ক্যারোটিন, যা ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না; ত্বককে করে উজ্জ্বল। এছাড়া কাঁকরোলের ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে।
ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন দিলদার জানান, পাহাড়ের পাদদেশে কাঁকরোলের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের সবজির আবাদ হয়ে থাকে। সবজি চাষিদের সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। এই সবজি কৃষক সরাসরি ঢাকার বাজারে পাঠাচ্ছে। সবজির মান ভালো হওয়ায় কৃষক দামও পাচ্ছে ভালো।
‘আমি মনে করি অন্যান্য কৃষি উদ্যোক্তা জমি ফেলে না রেখে মৌসুমভিত্তিক সবজি আবাদ করলে অবশ্যই লাভবান হবে। এ বছর এই উপজেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে কাঁকরোলের আবাদ হয়েছে।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য