করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমে এলেও বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। আগের বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর উপসর্গ কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসছে। কিছু বোঝার আগেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। এ কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় আক্রান্তরা দ্রুত মারা যাচ্ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের সেবা দেয়া একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হওয়ায় বিপদে রয়েছে নগরবাসী। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় বড় ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা।
তারা বলছেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অন্য বছরের তুলনায় আলাদা হওয়ায় মারা গেছে অর্ধশতাধিক মানুষ। তাই প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু ভালো হয়ে যাওয়ার পর শকড সিনড্রম বা নিউমোনিয়া দেখা দিচ্ছে। এককভাবে শুধু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে না কেউই। ডেঙ্গুর সঙ্গে ডেঙ্গু-পরবর্তী জটিলতাও মানুষকে ভোগাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, জ্বর ভালো হয়ে গেলেও চার থেকে সাত দিন সতর্ক থাকতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু শনাক্ত ও চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০০০ সাল থেকে মূলত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুবিষয়ক তথ্য দিয়ে আসছে তারা। ওই বছর ৯৩ জনের মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়।
২০০১ সালে ৪৪ ও ২০০২ সালে ৫৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ দেয় সরকারি এ সংস্থাটি। এরপর ডেঙ্গু সহনশীল পর্যায়ে ছিল। এ নিয়ে তেমন আলোচনাও ছিল না।
গত ২০ বছরে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর ১৭৯ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৫৪ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ১৩ হাজার ৭ জনের দেহে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, ডেঙ্গু রোগের অনেক ধরন রয়েছে। তবে এবার ‘ডেনভি-৩’-এর প্রভাব বেশি।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে দেশে প্রথম এই ধরন শনাক্ত হয়। এর আগে ডেনভি-১ ও ডেনভি-২-এ আক্রান্ত হয়ে অনেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। কিন্তু ডেনভি-৩-এর বিরুদ্ধে এই ক্ষমতা কার্যকর হচ্ছে না।
সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, ‘যারা আগের দুই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত, তারা নতুন করে ডেনভি-৩-এ আক্রান্ত হলে হেমোরেজ বা সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ছেন। এ কারণে এবার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এর জিনোম সিকোয়েন্সিং ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সহায়ক হবে।’
তিনি বলেন, ‘এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশিরভাগের শরীরে ডেনভি-৩ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। আর ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে অন্য বছরের তুলনায় মৃত্যুও বেশি হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৯ সালেও ডেনভি-৩-এর ধরনের কারণে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিয়েছিল। এবারও এই ধরনের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে বলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি।
‘যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা বেশি মারা যাচ্ছেন। এ কারণে শিশুরা আক্রান্ত হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া বয়স্ক ও যারা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, তারা আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেশি।’
এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার একটি বড় কারণ দেরিতে হাসপাতালে আসা। জ্বর-সর্দি দেখা দিলে শুরুর দিকে অনেকে এটাকে তেমন পাত্তা দেয় না। এটাই সমস্যা তৈরি করে।
এ কারণে কারও সামান্য জ্বর-সর্দি দেখা দিলে অবহেলা না করে ডেঙ্গু ও করোনা পরীক্ষা করতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
শুরু থেকে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু ভাইরাস না ছড়াতে এডিস মশা যাতে বংশবিস্তার করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধ সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এবারের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘সাধারণ ডেঙ্গুতে অনেক বেশি জ্বর থাকে। তবে এবারের ডেঙ্গুতে শরীরের তাপমাত্রা ১০১-১০২ ডিগ্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।’
তিনি বলেন, ‘হেমোরেজিক নয়, শকড সিনড্রোম হয়, তবে হাড় বা শরীরের সংযোগস্থলে ব্যথাও হয় না। তাই অনেকেই বুঝতে পারে না। তারা ভাবেন, দু-এক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। তবে দ্রুত সময়ে অবস্থা জটিল হয়ে উঠছে। সাধারণত ডেঙ্গুতে এমন লক্ষণ দেখা যায় না।’
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে শিশুদের শরীরে পানির স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। তাই শুরুতে পানির শরবত ও পানি জাতীয় ফল বেশি খেতে দিতে হবে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এবার শকড সিনড্রোম বেশি হচ্ছে। এর আগে হেমোরেজিক ডেঙ্গু বেশি দেখেছি। শকড সিনড্রোমে শরীরে পানি কমে যায়, তাপ বেড়ে যায়, হার্টবিট কমে যায়, ব্লাডপ্রেশার কমে যায় এবং রোগী জ্ঞান হারাতে পারে। ফুসফুস ও পেটে পানি জমে।
‘আর হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ হয়, শরীরে র্যাশ ওঠে, তাপমাত্রা ১০৪ থেকে ১০৫ হয়। এটার সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। তাই সে বুঝতে পারে কী করতে হবে।’
তিনি বলেন, এবারের ডেঙ্গুতে তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি থাকছে, র্যাশ দেখা যায় না, রক্তক্ষরণও হয় না। ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না যে, তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত বা গুরুত্ব দেন না। জ্বর চলে যাওয়ার পরে প্লাটিলেট ভেঙে ব্লাডপ্রেশার কমে কলাপস করে। ফলে এবার মৃত্যুর হার বেশি।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুসরাত সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু ও করোনা মহামারি একই সঙ্গে আসার কারণে পরীক্ষা না করে নিশ্চিত করে বলা যায় না রোগী ডেঙ্গু নাকি করোনায় আক্রান্ত। এ কারণে চিকিৎসা করতেও দেরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর ভালো হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এ ভালো হয়তো অনেক খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসতে দেরি হচ্ছে। হাসপাতালে জটিল অবস্থায় আসার কারণে তাদের আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে।
নুসরাত আরও বলেন, ‘করোনা রোগীতে অধিকাংশ আইসিইউ পূর্ণ থাকায় ডেঙ্গু রোগীদের দ্রুত আইসিইউ সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
‘সাধারণত ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে নেয়ার ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মারা যায়। তবে এবার এর চেয়ে কম সময়ের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে।’
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১২টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যায়নি। আজ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। এ দিন প্রতি ১০০ নমুনায় শনাক্তের হার ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ‘২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু ২৯ হাজার ৫২১ জন। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। এছাড়া ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে মোট শনাক্ত হয়েছে ২০ লাখ ৫২ হাজার ১২৭ জন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৫৮২ জন।
এডিশ মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সারা দেশে মশা নিধন কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে। চলতি বছরের মে মাসের তুলনায় জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। জানুয়ারিতে ১,১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬ এবং এপ্রিলে ৭০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে মে মাস থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে এবং জুনে এসে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে, বিশেষ করে বরগুনায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি।
এদিকে চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ২৯৬ জনে পৌঁছেছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৪২৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন শনাক্ত ৪২৯ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে— বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৪৯ জন; চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৭ জন; ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬১ জন; ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৪২ জন; ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৪৫ জন; খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন ও রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৪ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৫৮ জন রোগী। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।
চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং নারী ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪২ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে একজন রাজশাহী বিভাগের বাসিন্দা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এডিস মশার বিস্তার এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, 'মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ে এ সংখ্যা চার থেকে পাঁচগুণ এবং আগস্টে দশগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।'
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৯৬ জনে। এর আগে ২০২৩ সালের পুরো বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালের পুরো বছরের (১ জানুয়ারি–৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) সর্বমোট হিসাব অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৭৫ জন।
করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের মধ্যে দেশে আরও ২১ জনের শরীরে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছে।
রবিবার (২৯ জুন) সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় এসব শনাক্ত হয়েছে। তবে, নতুন করে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এই সময়ের মধ্যে।
সোমবার (৩০ জুন) স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২০ লাখ ৫২ হাজার ১১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২২ জন। আর দেশে ভাইরাসটিতে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫২১ জনের।
গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৩৮৩ জন রোগী। এসব রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৬ জন আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৩৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৫ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৮, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৮, খুলনা বিভাগে ৪১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৩৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে গত এক দিনে সারাদেশে ৩৪৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮ হাজার ৭২৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৮৬৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের।
সারাদেশে করোনা ভাইরাসের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পর সিলেট এ ভাইরাসে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার দুপরে এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছে সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন করে করোনার আক্রমন শুরুর পর সিলেটে প্রথম এই কোন রোগী মারা গেলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, করোনায় আক্রান্ত ৬৯ বছর বয়েসি পুরুষ ১৯ জুন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান তিনি। এছাড়া সিলেটে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ জন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মো. মিজানুর রহমান জানান, নিহত ব্যক্তির বাড়ি সিলেট সদর উপজেলায়। তিনি করোনা ছাড়াও আরও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে; গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন আরও ছয়জন। এ নিয়ে চলতি জুন মাসেই জেলায় করোনায় মৃতের সংখ্যা সাতজনে দাঁড়াল।
২৮ জুন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাঠানো সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলার মিরসরাই উপজেলার বাসিন্দা সালেহা বেগম (৪০) নামে এক নারী শুক্রবার নগরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই তিনি হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
এদিকে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৯১টি নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন নগরের এবং দুজন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে নগরের শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চারজন এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে দুজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে চলতি জুন মাসে মোট ১৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৬ জন পুরুষ, ৬৩ জন নারী ও একজন শিশু রয়েছে।
মশাবাহীত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালের দুই জেলায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় গোটা বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন আরও ১০৫ জন আক্রান্ত রোগী। এ নিয়ে বর্তমানে বিভাগের ছয় জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন। মৃত্যুবরণ করা দুজন হলেন- বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আ. করিম (৫০) ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের রাজপাড়া এলাকার মো. ইউসুফ খন্দকার (৭২)। এর মধ্যে আ. করিম বরিশাল শেরইবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে ও বৃদ্ধ মো. ইউসুফ খন্দকার কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক। এ পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হবে। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি। তাই মশার বিস্তার রোধ করতে বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৩০৫ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন।
বরগুনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মৃত ১১ জনের মধ্যে ছয়জনেরই বরগুনার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। শুধু মৃত্যুই নয় এ জেলায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি, বরগুনা জেলায় এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬৩২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মন্তব্য