দেশে করোনার সময়ে মানসিক বিষণ্নতায় ভোগা তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা বেড়েছে। করোনা মহামারির সময় প্রায় ৬১ শতাংশ তরুণ বয়সী মানসিক বিপর্যয়ে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকে পরিচালিত করছে।
তরুণদের সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা’ শীর্ষক শিরোনামে এ জরিপ চালানো হয় ২০২১ সালের ১ জুন থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত। উদ্দেশ্য, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, আত্মহত্যার কারণগুলো চিহ্নিত করা ও তা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা এবং সকলকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা।
শনিবার সকালে আঁচল ফাউন্ডেশনের ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এ সময় আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্লে থেরাপিস্ট মোশতাক আহমেদ ইমরান এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
আঁচল ফাউন্ডেশ জানায়, গত মার্চ মাসে তারা করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার হার সংক্রান্ত একটি জরিপ পরিচালিত করে। সেখানে তারা দেখতে পায়, আত্মহননকারীদের প্রায় ৪৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
ফলে তরুণ বয়সীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার কারণ খুঁজতে এ জরিপ পরিচালনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন।
জরিপে মোট ২ হাজার ২৬ জন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের সবচেয়ে বড় অংশ ১ হাজার ৭২০ জন ছিলেন ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী। এ ছাড়া এতে ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২৪৩ জন অংশ নেন। ৩১- ৩৫ বছর বয়সী ছিলেন ৬৩ জন। মোট অংশগ্রহণকারী নারী ১ হাজার ২৯৩ জন বা ৬৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার ছিলেন শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, ৫০ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ-তরুণী মানসিক চাপে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছেন। এদের মধ্যে করোনার সময়ে আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছেন, তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন নি। ৮ দশমিক ৩ শতাংশের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে, তারা আত্মহত্যার উপকরণ প্রস্তুত করেছেন, কিন্ত শেষে পিছিয়ে এসেছেন। ৩ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
মনরোগ বিশেষজ্ঞ ও প্লে থেরাপিস্ট মোশতাক আহমেদ ইমরান বলেন, দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের ঘুম কম হচ্ছে, বিষণ্ণতা ও হতাশা বাড়ছে, আত্মহত্যার হারও বাড়ছে।
করোনার সময়ে তরুণ-তরুণীরা প্রধাণত যে ধরণের মানসিক চাপজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা হলো: ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একাকী হয়ে যাওয়া, অনাগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপ, আর্থিক সমস্যা, সেশন জট, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, মোবাইল ফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ইত্যাদি।
জরিপে অংশ নেয়া ৬১ দশমিক ২ শতাংশ (১ হাজার ২৩৯ জন) বলেছেন, তারা বিষণ্নতায় ভুগছেন। ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ (৭৮৭ জন) বলেছেন, তারা বিষণ্নতায় ভুগছেন না। ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ তাদের বিষণ্নতার কথা কাছের মানুষদের কাছে শেয়ার করতে পারলেও ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ জানান, তারা তাদের বিষন্নতা বা মানসিক অস্থিরতা শেয়ার করার জন্য কাউকেই পাশে পান না।
জরিপে দেখা যায়, ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ বলেছেন, তাদের পরিমিত (ছয় থেকে আট ঘণ্টা) ঘুম হয়। ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীরই পরিমিত ঘুম হয় না, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
জরিপে দেখা যায়, মোট ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী বলছেন, করোনাকালীন তাদের মানসিক চাপ আগের থেকে বেড়েছে। এদের মধ্য ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ বলেছেন, এই চাপ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। আবার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ বলছেন, এই চাপ করোনাকালীন সামান্য বেশি। ১৮ দশমিক ১ শতাংশ জানিয়েছেন, চাপ আগের মতোই আছে। বাকি ১৮.৪ শতাংশ বলছেন, তাদের মানসিক চাপ আগের থেকে কমেছে ।
সাধারণত মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এ ধরণের মানসিক অসুস্থতা অনেকটা সমাধান করা সম্ভব। জরিপের ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ এ ব্যাপারে জানলেও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন মাত্র ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী কখনও কোনো বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন নি।
জরিপের বিষয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘যারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত শুধু তাদেরকে কাউন্সেলিং দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না। বরং একজন তরুণ বা তরুণী কেন আত্মহত্যাপ্রবণ বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন, তার কারণ বের করে সমাধান করে সমস্যার মূলোৎপাটন করতে হবে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের আয় কমে আসছে। অনেকে নিজের ব্যবসা হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এ কারণে বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। তবে রোগী বাড়লেও চিকিৎসার বাইরে থাকছেন অনেকে।
ইনস্টিটিউটের আরেক অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আতঙ্ক মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। মানসিক চাপ হ্রাস করতে হবে। ঘুমের চক্র স্বাভাবিক রাখতে হবে। নিজের পছন্দের বিষয় ও কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া পরিবারের সঙ্গে ঘরের মাঝেই এক সঙ্গে সময় কাটানো ও পছন্দের কাজ করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কিছু সময় অবশ্যই শারীরিক ব্যয়াম করতে হবে। সর্বোপরি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে আছি, বেঁচে আছি এ জন্য সন্তুষ্ট থাকা উচিত।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অথবা আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা যায় বলে জানান অধ্যাপক মেখলা সরকার।
আরও পড়ুন:দেশে ২০২৩ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে জানিয়ে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন বলেছে, শিক্ষার্থীদের ৬০ দশমিক ২ শতাংশই ছাত্রী।
আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি শনিবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আঁচল ফাউন্ডেশনের একদল গবেষকদের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সংগ্রহকৃত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখতে পাওয়া যায়, বিগত ২০২৩ সালে সর্বমোট ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ২২৭ জন, যা ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ। কলেজ শিক্ষার্থী ১৪০ জন যা ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন যা ১৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪৮ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
‘৫১৩ জন শিক্ষার্থীর মাঝে পুরুষ শিক্ষার্থী ছিল ২০৪ জন, যা ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থী ছিল ৩০৯ জন, যা ৬০ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী ছিল ৫৩২ জন। ২০২৩ সালে কিছুটা কমলেও ততটা আশানুরূপ নয়।’
আত্মহত্যার কারণ
আঁচল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অভিমান, যা সংখ্যায় ১৬৫ জন বা ৩২ দশমিক ২ শতাংশ। এর পরেই প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। পারিবারিক কলহজনিত কারণে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।
‘২০২৩ সালে পড়াশোনার চাপের সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ান ৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ করেন ১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অপমান বোধ করে আত্মহত্যা করেন শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।’
বিভাগ অনুযায়ী আত্মহত্যার তথ্য
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ১৪৯ জন শিক্ষার্থী। এর পরই অবস্থান করছে চট্টগ্রাম বিভাগ। চট্টগ্রাম বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ৮৯ জন। রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনা বিভাগে ৬৪ জন, বরিশাল এবং রংপুর উভয় বিভাগেই ৪৩ জন করে। ময়মনসিংহে ৩৬ জন।
‘এ ছাড়া সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ না থাকায় এখানে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।’
আরও পড়ুন:স্কুলপড়ুয়া শিশুরা আসক্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল গেম ও কার্টুনে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেরও বর্তমান চিত্র এমনই। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই মৌলভীবাজারের শিশুরা।
জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রাথমিক স্কুলগুলো পর্যবেক্ষণ করে এমন চিত্র দেখা মিলে। বিশেষ করে শিশু শ্রেশির শিক্ষার্থীদের মাঝে এ সমস্যাটি যেন প্রবল আকার ধারণ করেছে। তবে শিশু শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা শুধু নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রীরা স্মার্টফোনের গেমে আসক্ত বেশি।
বৃহস্পতিবার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রানীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বারান্দায় শিশু শ্রেণির তিন শিক্ষার্থীকে মোবাইল হাতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
কয়েকজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, এখন শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল ও তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। অথচ তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে গেমসের নেশায়। উঠতি বয়সের তরুণ প্রজন্ম প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গেম খেলায় আসক্ত হচ্ছে বেশি।
এসব থেকে ছেলে-মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে বড় ধরণের সামাজিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলেও তারা মনে করেন।
কমলগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রনেন্দ্র কুমার দেব বলেন, ‘অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানরাও অনেক দামি ফোন কিনছে। ছেলেমেয়ের শিক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করে অভিভাবকরাও ধারদেনা করে ফোন কেনার টাকা জোগাচ্ছেন। অথচ অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরিবারের মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে গেমসের সরঞ্জাম কিনছে। শিশুরা যেখানে টাকা জমিয়ে ক্রিকেট বল, ফুটবল কেনার কথা, সেখানে তারা টাকা জমিয়ে রাখছে এসব কেনার জন্য।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ফ্রি ফায়ার গেমস প্রথমে তার ভালো লাগত না। কিছুদিন বন্ধুদের দেখাদেখি খেলতে গিয়ে এখন আসক্ত হয়ে গিয়েছি। এখন গেমস না খেললে অস্বস্তি লাগে।’
কমলগঞ্জ সরকারি গণ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে অভিভাবকদের কাছ থেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোন শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়া এবং অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এমন পরিস্থিতি এমন হয়েছে।’
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিশু-বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অধ্যাপক যোগীন্দ্র সিংহ নিউজবাংলাকে জানান, নিঃসন্দেহে ডিজিটাল প্রযুক্তি তথা মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ- এসব ডিভাইস সৃজনশীল এবং সুবিধাজনক। কিন্তু শিশুদের জন্য এটি বেশ বিপদজনক। এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার অর্থাৎ, অত্যধিক স্ক্রিন টাইম শৈশবের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের ওপর ভীষণ রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব ফেলে। বাস্তব জীবনে, যেসব শিশু এসবে আসক্ত, তারা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ক্রিয়াকলাপ যেমন: খেলাধুলা, দৌঁড়ানো বা সাইকেল চালানো মিস করে। ফলে তাদের দক্ষতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, ‘মনোনিবেশ করার ও বাস্তব জীবনে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এ ধরনের আসক্তি। তাই শিশুর স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের চোখের বিশ্রামের জন্য স্ক্রিন থেকে পর্যাপ্ত সময় বিরতি নিতে উপদেশ দিতে হবে। টিভি, মোবাইল গেম বা যে কোনো ধরনের ভার্চুয়াল এন্টারটেইনমেন্ট দেখার সময় আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার বের হয়। এ ডোপামিন আমাদের মনে এক ভালোলাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। তার ফলে অতি সহজেই আমরা এ ধরণের এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়ামগুলোতে (বিনোদনের মাধ্যম) আসক্ত হয়ে পড়ি।’
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনরোগ বিভাগের প্রধান ডাক্তার আর কে এস রয়েল বলেন, ‘মোবাইল ফোন শিশুদের মস্তিষ্কের বড় ক্ষতি করে। এ বিষয়ে মনরোগ বিভাগের মাধ্যমে অভিভাবকদের মাঝ সচেতনতামূলক আলোচনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’
আরও পড়ুন:বিষণ্নতা ভুলতে ফেসবুকের নিউজ ফিডে ক্রমাগত স্ক্রল করার দিকে ঝুঁকলে অথবা রকমারি সব স্ট্যাটাস দিতে থাকলে আপনি ভুল করছেন। গবেষণা বলছে, বিষণ্ন মানুষের ফেসবুক আসক্তি মনকে আরও বিবর্ণ করে তোলে।
গবেষণাটি সম্প্রতি কম্পিউটার্স ইন হিউম্যান বিহেভিয়ার সাময়িকীতে প্রকাশ হয়েছে। এতে তুলে ধরা হয়েছে মানসিক সুস্থতার ওপর ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব।
গবেষকেরা বলছেন, যারা যত বেশি সময় ফেসবুক ব্যবহার করেন তত বেশি হতাশায় আক্রান্ত হন। আত্মমর্যাদার ঘাটতিতে ভুগতে থাকে মানুষ। বিষয়টিকে ‘ফেসবুক ডিপ্রেশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন গবেষকেরা।
অবশ্য ফেসবুকের পেছনে ব্যয় করা সময়ের চেয়ে এই মাধ্যমের প্রতি আসক্তিকে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে পাওয়া গেছে গবেষণায়। দেখা গেছে, ফেসবুকে অতিরিক্ত আসক্তি মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।
গবেষণাটির মূল লেখক মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সুন লি লি বলেন, ‘প্রযুক্তির ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়ছে। এই নির্ভরতা আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে তা জানা প্রয়োজন।’
মালয়েশিয়ায় আড়াই শ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওপর চালানো হয়েছে গবেষণাটি, যাদের প্রত্যেকেই বিষণ্নতায় ভুগছেন। অংশগ্রহণকারীরা দুটি অনলাইন জরিপে অংশ নেন। প্রথম জরিপটি করা হয় গবেষণার শুরুতে। এর ছয় মাস পর চালানো হয় দ্বিতীয় জরিপ। অংশগ্রহণকারীদের ফেসবুকনির্ভরতা ও নিজের প্রতি হতাশার প্রবণতা পর্যালোচনা করেন গবেষকেরা।
গবেষক সুনের মতে, যারা অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার করেন তারা অন্যদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে চান। এ জন্য তারা নিয়মিত তাদের পরিচিতদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপডেট জানান। এটি করার মাধ্যমে হয় তাদের ফেসবুকনির্ভরতা আরও বাড়ে, নয়তো নিজের দুর্বলতা নিয়ে হতাশাবোধ বাড়ে। এতে মানুষের আত্মমর্যাদার ঘাটতি তৈরি হওয়ার পাশাপাশি বিষণ্নতার মাত্রা বাড়তে থাকে।
গবেষণার সামগ্রিক ফল বলছে, ফেসবুকের অতি ব্যবহার হতাশাগ্রস্ত মানুষের জন্য আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আরও দুর্বিষহ করে তোলে। এমনকি ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সুন লি লির মতে, বিষণ্নতায় আক্রান্তদের ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘যারা তীব্র হতাশায় ভুগছেন তাদের জন্য আমাদের গবেষণাটি সহায়ক হবে। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির অতি ব্যবহার বিষণ্নতার তীব্রতাকে বাড়িয়ে তোলে।’
আরও পড়ুন:উত্তর ভারতের প্রয়াগরাজ শহরের ট্রাক চালক শ্যাম (ছদ্দনাম)। স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ায় ছয় মাস ধরে যৌন সম্পর্ক করতে পারছেন না তিনি। ভীষণ অস্থিরতায় ভুগছিলেন, এমন সময় ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের এক বিজ্ঞাপন দেখে পুলকিত হয়ে যান শ্যাম।
দেরি না করে গোলাপী থিমের ওয়েবসাইটে ঢোকেন শ্যাম। সেখানে তাকে ৪ হাজার ভারতীয় রুপি জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হয়েছিল।
বাড়ির পাশের ব্যাংকে অর্থ জমা দিয়ে শ্যাম বাড়ি ফিরেই ওয়েবসাইটে ঢোকেন। কিন্তু এবার সেবা দেয়ার জন্য আরও অর্থ চাওয়া হয়। বলা হয়, কেবল সাইবার-সেক্সের একটি সেশনের জন্য ৬ হাজার রুপি জমা দিতে হবে। সেই অর্থও দেন শ্যাম। তারপর তাকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি ভিডিও কলের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়।
কয়েক ঘণ্টা পর একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ভিডিও কল পান শ্যাম। শার্ট খুলে শ্যাম ফোনের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কলটা রিসিভ করে। কয়েক সেকেন্ড পর পর্দায় এক নগ্ন যুবতী হাজির হন। যুবতী তার নগ্ন দেহ হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। তারপর কলটা কেটে যায়।
হঠাৎ লাইন কেটে যাওয়ায় বিরক্ত হন শ্যাম। কল কেন কেটে গেল তা বোঝার আগেই ওই নম্বর থেকে একটা হোয়াটঅ্যাপ মেসেজ আসে তার মোবাইলে। সঙ্গে ছিল কিছুক্ষণ আগের সেই ভিডিও কলের রেকর্ডিং।
মেসেজে বলা হয়, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ হাজার রুপি জমা দিন। নয়তো এই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যাবে।’
২০ হাজার রুপি বেতনে চাকরি করেন শ্যাম। এই অর্থ দিয়ে চার সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। শ্যাম হিসাব করে দেখেন, সব খরচ বাদ দিয়ে এই ১৫ হাজার রুপি জমাতে তার ১০-১২ মাস লেগে যাবে।
শ্যাম বলেন, ‘আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। এ কারণে ছেলের টিউশনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করছিলাম, তাতে হাত দিতে বাধ্য হই।
‘তারপরের কয়েদিন স্বস্তিতে ছিলাম। একদিন আবার কল আসে। এসএমএসে আমাকে এবার ৩০ হাজার রুপি দিতে বলে। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে সে অর্থ দিই।’
ভারতে অনলাইন যৌন নির্যাতনের শিকারের সংখ্যা আশংকাজনকহারে বাড়ছে। শ্যাম সেই দলের একজন।
অনলাইন সেক্সটর্শন স্ক্যামের পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও, ২০২১ সালে ভারতে ৫২ হাজার ৯৭৪টি সাইবার ক্রাইমের রেকর্ড আছে পুলিশের কাছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৯ সালের চেয়ে সংখ্যাটা ৪৪ হাজার ৭৩৫ বেশি৷
ভারতের তথ্য-প্রযুক্তি আইন ২০০০ এর ধারা ৬৭ এর অধীনে এ সংক্রান্ত ১৩ হাজার ১৯৬টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এ আইনে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা বিতরণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ধরা হয়।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তথ্য-সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক চাপের ভয়ে অনলাইনে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো চেপে যায় বেশিরভাগ মানুষ।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রক্ষিত ট্যান্ডন বলেন, ‘এই প্রতারণাগুলো কোভিডের সময় বেশি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কারণ ওই সময় বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে থাকতেন এবং অনলাইনে বেশি সময় কাটাতেন।
‘স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটের অপ-ব্যবহারও বাড়ছে।’
স্ট্যাটিস্টা বলছে, ভারতে ৯৩২ মিলিয়নেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে, যা চীন ছাড়া অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। স্ট্যাটিস্টার ধারণা, এই সংখ্যা ২০৪০ সালের মধ্যে দেড় বিলিয়ন ছাড়াবে।
যেসব মানুষ একাকী কিংবা যৌন সম্পর্কহীন জীবনে আটকে আছেন তাদের পাশাপাশি অল্পবয়সী প্রাপ্তবয়স্করা (যৌনতায় মুখিয়ে যারা) সেক্সটর্শনের ঝুঁকিতে আছেন। অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরাও এই জালে আটকা পড়েন।
এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ডিভাইস চালাতে অদক্ষ লোকজনকে সহজেই বোকা বানাতে পারে প্রতারকরা। ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে সামাজিক মিডিয়া, ডেটিং অ্যাপস, স্প্যাম টেক্সট মেসেজ এবং অনলাইন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকেন তারা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় নারীর ছবি ব্যবহার করে তৈরি প্রোফাইল থেকে শিকারকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট বা মেসেজ দেয়া হয়। প্রতারকরা শিকারের অন্য বন্ধুদেরও সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। এতে ভুয়া প্রোফাইলটি নিয়ে সন্দেহ অনেকটায় কমে যায়।
ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টেলিগ্রাম গ্রুপে বা জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এবং ফোরামে প্রতারকরা তাদের সাইটের লিংক পোস্ট করে থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে তারা পর্নোগ্রাফিক ভিডিও বা যৌনকর্মীর ছবি ব্যবহার করেন।
বিশেষজ্ঞরা এই কৌশলটিকেও কার্যকর বলে মনে করছেন। আকর্ষণীয় কন্টেন্টের কারণে এগুলো দীর্ঘসময় মানুষ দেখে। এতে অনলাইন থেকে পোস্টকারী ভালো অর্থ উপার্জন করে।
যুক্তরাজ্যের সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম সোফোসের একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সেক্সটর্শন স্প্যাম মেসেজের মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ ডলার আয় করেছে পোস্টকারীরা।
কিছু প্রতারক তাদের ভিকটিমদের কাছ থেকে টাকা তোলার জন্য পুলিশের ছদ্মবেশ ধারণ করে বলে জানা গেছে।
রাজস্থানের নাগৌরের প্লাম্বার অজয় (ছদ্দনাম) মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার রুপি আয় করেন। তিনি বলেন, ‘একজন নিজেকে ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) সদস্য পরিচয় দিয়ে বলেন, ফেসবুকে যৌন কেলেঙ্কারিতে নাকি আমি জড়িত। ৬০ হাজার টাকার জন্য তিনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেন।
‘দ্বিতীয় দিনে আমি ওই নম্বরটি ব্লক করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পর ট্রুকলারে (কলার শনাক্তকরণ অ্যাপ্লিকেশন) ‘শ্যাম আইপিএস’ নামে একটি অজানা নম্বর থেকে কল পাই।
‘তিনি আমাকে বিষয়টি টাকার বিনিময়ে রফাদফার প্রস্তাব দেন। বলেছিলেন, তা না করলে চার বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে আমার। পরে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাউন্সেলরের সঙ্গে পরামর্শ করে নম্বরটি ব্লক করে দিই।’
ভুক্তভোগীদের ওপর যৌন নির্যাতনের প্রভাব কেবল অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যে সমাজে যৌনতা নিয়ে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা, সেখানে ভুক্তভোগীর মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
প্রয়াগরাজের ট্রাক চালক শ্যাম বলেন, ‘চলতি মাসের শুরুতে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর থেকে আমি রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার ভয় তো ছিলই। পাশাপাশি স্ত্রীর কাছে বিষয়টা ফাঁস হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকতাম।
‘একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে সন্তানের কথা ভেবে ফিরে আসি। আয়-রোজগারও বেশি ছিল না। মানসিক যন্ত্রণায় জীবন নরক হয়ে গিয়েছিল।’
‘মনস্তাত্ত্বিক খেলা’
জয়পুর পুলিশের সাইবার ক্রাইম কনসালট্যান্ট মুকেশ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতারকরা ভুক্তভোগীদের ‘অতিরঞ্জিত’ ভয়ের পাশাপাশি ভারতের সাইবার আইনের দুর্বলতায় সুযোগ নেয়।
‘ভিডিও ছড়ানোর ভয় একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। খুব কম ক্ষেত্রেই ভিডিও অনলাইনে পোস্ট করা হয়। কারণ প্রতারকরা জানেন, এটা করলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তারা ফেঁসে যাবেন। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীরা মানুষের ভয় নিয়ে নিষ্ঠুর এক খেলায় মেতে উঠেন।’
সামাজিক ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী পুলিশের পরিবর্তে এনজিওর সাহায্য নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ এতে পরিচয় গোপন থাকার নিশ্চয়তা বেশি।
ভারতের প্রথম সাইবার ক্রাইম এনজিও সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মিলিন্দ আগরওয়াল বলেন, ‘অধিকাংশ ভুক্তভোগী আমাদের কাছে বানোয়াট গল্প নিয়ে আসে। সম্মানহানির ভয়ে তারা পুলিশের কাছে যেতে চায় না।
‘শুরুতে আমরা তাদের বোঝাই ফুটেজ অনলাইনে পোস্ট করা হবে না। দ্বিতীয়ত, আমরা তাদের অ্যাকাউন্ট বা নম্বর আগামী দুই থেকে তিন দিনের জন্য ব্লক করতে বলি। অজানা কল বা মেসেজের উত্তর দিতে না বলি। বহিরাগতদের সঙ্গে যোগাযোগের খবর আমাদের জানাতে বলি।
‘প্রতারকরা দুই থেকে তিন দিন আপনাকে অনুসরণ করবে। তারপর থেমে যায়। এই কৌশলটি প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজ করেছে।’
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) বলছে, সাইবার ক্রাইম মামলার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ গঠন হয়।
পুলিশের উদাসীনতা, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং ফরেনসিক সংস্থানগুলোর ঘাটতির কারণে এসব ঘটনায় বিচার কম হয় বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
আগরওয়াল বলেন, ‘আপনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হন, তবে কেবল হুমকির অভিযোগ নিয়ে আসলে পুলিশ তা নথিভুক্ত করবে না। অনলাইনে ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ভিন্ন কথা।
‘প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।’
প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে সাইবার ক্রাইম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট আইনটি প্রায় ২০ বছরের পুরনো; কেবল একবার এটির সংশোধন হয়েছে।
মধ্যপ্রদেশের হাইকোর্টের আইনজীবী শশাঙ্ক তিওয়ারি বলেন, ‘প্রযুক্তির উন্নতির কারণে কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং নেটওয়ার্কের শক্তি বাড়ছে। এই অগ্রগতির সঙ্গে সাইবার ক্রাইমও বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ কমাতে অবশ্যই কঠোর শাস্তির আইন করতে হবে।’
স্টেট ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল শরৎ কবিরাজ বলেন, ‘রাজস্থান যৌন নির্যাতনের একটি হটস্পট। তাই আমরা অন্যান্য রাজ্যের পুলিশকে সহায়তা প্রদানের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি।
‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আন্তঃরাজ্য সাইবার ক্রাইম ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন করেছে। অপরাধীরা মূলত সিস্টেমের দুর্বলতাকে কাজে লাগায়। তাই সিম কার্ড ইস্যু করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং গ্রাহককে জানার পদ্ধতিগুলো কঠোর করা উচিত।’
সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌন নির্যাতনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়া এড়াতে ভারতকে অবশ্যই আইন সংস্কার করতে হবে। পুলিশিং ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে এবং যৌনতার সঙ্গে জড়িত ‘সামাজিক ট্যাবু’ দূর করতে হবে।
শ্যাম এবং অজয়ের মতো ভুক্তভোগীরা এখনও মনে করেন, তাদের কাছে আইনি কোনো উপায় নেই। এনজিওগুলোর কাউন্সেলিং-ই তাদের একমাত্র ভরসা।
অজয় বলেন, ‘আমার মতো একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে কেন তারা বেছে নিল? সিস্টেমের কাছে আমি কোনো বিষয় না হলেও, সমাজের কাছে আমি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।’
দেশে ক্যানসারের রোগী সংখ্যা ১৫ থেকে ১৮ লাখ এবং বছরে এক লাখের বেশি মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন। বলেছেন, করোনাভাইরাতে গত দুই বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার তিন গুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে ক্যানসারে।
এই মৃত্যুর একটি বড় অংশই হয় জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসারে। প্রতি ১৩ হাজার মানুষের মধ্যে ৭ স্তন ক্যানসারে এবং প্রতি ৮ হাজারের মধ্যে ৫ জন জরায়ু ক্যানসারে মারা যায়।
বুধবার রাজধানীতে জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার নিয়ে এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘নারীদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যানসার ও জরায়ু ক্যানসারে অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে নিজেদের প্রথমে সচেতন হতে হবে। তারপর স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে শনাক্ত করতে হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আগে জানতে হবে রোগগুলো কেন হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে হয়, পানি যদি পরিষ্কার না থাকে, আর্সেনিক থাকে তাহলেও রোগ হয়। খাবারে রঙ মেশানো হয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি খাবার আমরা খাচ্ছি। আমরা ধূমপান করি, তামাক সেবন করি। যার ফলে গলার ক্যানসার, পেটের ক্যানসার- এ রকম বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হই।’
উচ্চতর চিকিৎসা এবং চিহ্নিত করার জন্য স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ক্যানসার শনাক্ত করা যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা স্ক্রিনিং করতে আসবে, তাদেরকে পরীক্ষা করে ডাটা সংগ্রহ করে বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হবে।’
এ জন্য ২০০ টি স্ক্রিনিং স্পট চালু করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্ক্রিনিং করেই থেমে থাকা যাবে না। তার পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে।’
স্তন ক্যানসার শনাক্তে মেমোগ্রাফি নামে উচ্চতর স্ক্রিনিং ব্যবস্থা প্রতিটি হাসপাতালে চালু হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু জরায়ু এবং স্তন ক্যানসার নয়, সব ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা আমরা করব।’
বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে বলেও দাবি করেন মন্ত্রী। বলেন, ‘এই সফলতার জন্য আমাদের সব কিছু এখন স্বাভাবিকভাবে চলছে।
‘চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসক সমাজের পরিশ্রমের বিনিময়ে আমরা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি বলেই শিল্প কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে চলছে। প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিন হিরো হয়েছেন।’
প্রতিটি উপজেলায় কমিউনিটি পর্যায়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। ডায়রিয়া, কলেরা, পোলিও এখন নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বিশ্বে বাংলাদেশসই অসংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যানসার, কিডনি, হৃদরোগের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ অনিয়মিত জীবনযাপনের জন্য।’
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করে। থার্ড বা ফোর্থ স্টেজে আসার পর ডাক্তারদের আর কিছু করার থাকে না।
‘আমরা স্তন এবং জরায়ু ক্যানসারের স্ক্রিনিং এর জন্য আরও একটি ভবন তৈরি করতে যাচ্ছি। সবার সহযোগিতায় আমরা এই সেক্টরেও সফলতা অর্জন করব।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ ও শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একেএম আমিনুল মুরশিদ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও নার্সরাও।
আরও পড়ুন:
দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। অন্য কারণের পাশাপাশি অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সঠিক সচেতনতা এবং সমন্বিত চিকিৎসা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে স্ট্রোকের মৃত্যুঝুঁকি ও পঙ্গুত্ব কমানো সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রোববার আয়োজিত স্ট্রোক বিষয়ক এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এমন তথ্য তুলে ধরেন।
বিএসএমএমইউ-এর শহীদ ডা. মিল্টন হলে এই সেমিনারের আয়োজন করে নিউরো সার্জারি বিভাগ।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হলে অনেক মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। তবে স্ট্রোকের চিকিৎসা করার চেয়ে স্ট্রোক প্রতিরোধ করাটা জরুরি। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
‘খাবারে বাড়তি লবণ না খাওয়া, ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করা, নিয়মিত শরীর চর্চা করা, স্ট্রেস না নেয়া, ধূমপান না করার ওপর জোর দিতে হবে। মোবাইল ফোন কম ব্যবহার করতে হবে। অধিক সময় মোবাইল ফোন নিয়ে বসে থাকলে স্ট্রেস বেড়ে গিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।’
বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালিত হয়েছে ২৯ অক্টোবর, শনিবার। ‘জানুন স্ট্রোকের লক্ষণ, মিনিটেই বাঁচিয়ে দিন বহু জীবন’ স্লোগান নিয়ে বিএসএমএমইউ-তে দিবসটি পালিত হয়।
ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে রোববার সকালে বিএসএমএমইউ-এর নিউরোলজি, নিউরো মেডিসিন ও নিউরো সার্জারি বিভাগ পৃথক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এছাড়াও নিউরো সার্জারি বিভাগ আয়োজন করে বৈজ্ঞানিক সেমিনার।
সেমিনারে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ জন স্ট্রোকের কারণে মারা যাচ্ছে। বিশ্বে প্রতি হাজারে ৮ থেকে ১০ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। আর স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর ৪৮ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ থাকে।
বিশ্বে প্রতি লাখে ২ থেকে ১৩টি শিশু স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। শিশুদের স্ট্রোকের অর্ধেক হয় রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে। বাকি অর্ধেক হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে। ২৫ ভাগ শিশু বার বার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত ৬৬ ভাগ শিশুর হাত-পায়ের দুর্বলতা ও খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। স্ট্রোক শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়।
বাংলাদেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটা জরুরি। এই সময়ের মধ্যে জরুরি চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হলে রোগীর মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব কমানো সম্ভব। শতকরা ৮০ ভাগ স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী ওষুধের মাধ্যমেই সুস্থ হয়।
সেমিনারে আরও বলা হয়, স্ট্রোক প্রতিরোধে ৭টি পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাবারে তেল ও লবণের ব্যবহার কমানো, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখা, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা ও স্ট্রেস কমাতে নামাজ, উপাসনা বা মেডিটেশন করা।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউ-এর নিউরো সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আখলাক হোসেন খান।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন, অধ্যাপক ডা. হারাধন দেবনাথ, অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল, অধ্যাপক ডা. আবু নাসার রিজভী, অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, অধ্যাপক ডা. ধীমান চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. মওদুদুল হক, অধ্যাপক ডা. আইউব আনসারী, অধ্যাপক ডা. সুকৃতি দাস, অধ্যাপক ডা. হাসান জাহিদুর রহমান, অধ্যাপক ডা. কনোজ কুমার বর্মন, অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. সুভাষ কান্তি দে, সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে এম তারিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রকিবুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল আমিন ও ডা. খায়রুন নবী খানসহ অন্যান্য শিক্ষক ও চিকিৎসকবৃন্দ সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:সন্তান জন্মদান কেন্দ্র করে মায়ের শরীরের নানান পরিবর্তনের তথ্য কমবেশি সবার জানা। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সন্তানের কারণে বাবার শরীরেও আসে পরিবর্তন। বিশেষ করে পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করা বাবাদের মস্তিষ্কে ঘটে গঠনগত রূপান্তর।
মগজের এই পরিবর্তনের কারণে সন্তানের প্রতি বাবাদের বাৎসল্যের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে তৈরি হয় নতুন দায়িত্ববোধ।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন প্রমাণ পেয়েছেন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা। সেরিব্রাল কর্টেক্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে তারা বলছেন, বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করা পুরুষ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও দৃশ্যমানতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মস্তিষ্কের কর্টিকাল অঞ্চলে স্পষ্ট পরিবর্তন অনুভব করেন।
মাতৃত্বের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া নারীদের মস্তিষ্কে পরিবর্তন পর্যালোচনার জন্য গবেষণাটি শুরু হয়েছিল। তবে পরে এর সঙ্গে পুরুষের মস্তিষ্কে পরিবর্তনের বিষয়টিও যাচাই করা হয়।
বিজ্ঞানী দলের সদস্য ছিলেন মাদ্রিদের ইনস্টিটিউটো ডি ইনভেস্টিগেশন স্যানিটরিয়া গ্রেগোরিও মারাননের স্নায়ুবিজ্ঞানী ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ-গার্সিয়া।
তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল গর্ভাবস্থা ও প্রসবোত্তর পরিস্থিতির সঙ্গে মাতৃমস্তিষ্কের অভিযোজনকে পর্যবেক্ষণ করা। এ জন্য আমরা প্রজনন অভিজ্ঞতার বাইরের কারণ- যেমন শিশুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের পরিবর্তনের দিকটি আলাদা করতে চেয়েছি। আর সেটি করতে গিয়েই বাবাদের মস্তিষ্ক নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি হয়।’
গবেষণায় ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ ও তার সহকর্মীরা প্রথম সন্তানের জন্মের আগে ও পরে ৪০ জন পুরুষের স্ট্রাকচারাল নিউরোইমেজিং ডেটা পরীক্ষা করেছেন। পাশাপাশি নিঃসন্তান ১৭ পুরুষের মস্তিষ্কও পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করা পুরুষদের কর্টেক্সে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে থাকে। বিশেষ করে মনোযোগ, পরিকল্পনা এবং প্রয়োগ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত মস্তিষ্কের বাইরের স্তরে এই পরিবর্তন সুস্পষ্ট। বিপরীতে নিঃসন্তান পুরুষদের গ্রুপে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাবাদের ক্ষেত্রে ভিজ্যুয়াল সিস্টেম এবং মস্তিষ্কের স্বাভাবিক নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকা কর্টিকাল উপাদানের মাত্রা কমে যায়। ফলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকে বেশি মনোযোগী হন পুরুষ। অতীতের অভিজ্ঞতাকে বেশি মাত্রায় বিশ্লেষণে সক্ষম হয় মস্তিষ্ক। গবেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে নবজাতকের প্রতি মায়ের পাশাপাশি বাবাদের বাৎসল্যের মাত্রাও বাড়তে থাকে।
ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ বলছেন, ‘মায়ের গর্ভাবস্থা এবং প্রসবোত্তর কাল- দুটি সময়েই বাবা-মায়ের মস্তিষ্কের একধরনের পুনর্গঠন হয়।’
বাবা হওয়া যে ৪০ জনের মস্তিষ্কের গঠন পর্যালোচনা করা হয়েছে তাদের মধ্যে অর্ধেক স্পেনের নাগরিক, বাকি ২০ জন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। মজার বিষয় হলো, দুটি মহাদেশের এবং দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির পুরুষদের বেছে নেয়া হলেও সবার ক্ষেত্রেই কর্টেক্সে একই ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মাধ্যমে বলা যায় পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা পাওয়া বাবাদের মস্তিষ্কে পরিবর্তনের বিষয়টি সর্বজনীন।
ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ বলছেন, ‘কর্টিকাল অঞ্চলে এই পরিবর্তন সামাজিক জ্ঞান, মনোযোগ এবং সহানুভূতিবোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমরা বাবা-মা দুজনের ক্ষেত্রেই কর্টেক্সের পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছি। এই পরিবর্তন সন্তানের প্রতি তাদের মনোযোগ আরও গভীর করতে সাহায্য করে।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য