স্বর্গের বারান্দায় তখন গুনগুন করছিলেন কবিগুরু।
‘অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণ-দুয়ার
মর্তে এলে চলি,
অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটিরপ্রাঙ্গণে
পীতাম্বর পরি,
উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উম্মাদ পবনে
মন্দারমঞ্জরী,
দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু-
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু।
সখা, সেই অতিদূর সদ্যোজাত আদি মধুমাসে
তরুণ ধরায়
এনেছিলে যে কুসুম ডুবাইয়া তপ্ত কিরণের
স্বর্ণমদিরায়...
পুরোটা শেষ করতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, এ আপনি কী শোনালেন গুরুদেব! মধু, মধু!
গুরুদেব খুশি হলেন নাকি রাগ করলেন, বোঝা গেল না। গোঁফ যে তার মুখটাই আড়াল করে রেখেছে বিজ্ঞাপনের মতো। তবে জবাব দিলেন, এটা আমার ‘বসন্ত’ কবিতা। কেবল শুরু করেছিলাম, এর মধ্যেই বাগড়া বাধিয়ে দিলে। তুমি কে ভাই?
গুরুদেব, আমি মধুমাস।
মধুমাস! গুরুদেব পারলে লাফিয়ে ওঠেন। ওহে মধুমাস, তুমিও স্বর্গে চলে এসেছ? আহা!
আবারও গুনগুন করে উঠলেন গুরুদেব-
ব্যর্থ জীবনের সে কয়খানি পরম অধ্যায়
ওগো মধুমাস,
তোমার কুসুমগন্ধে বর্ষে বর্ষে শূন্যে জলে স্থলে
হইবে প্রকাশ।
বকুল চম্পকে তারা গাঁথা হয়ে নিত্য যাবে চলি
যুগ যুগান্তরে,
বসন্তে বসন্তে তারা কুঞ্জে কুঞ্জে উঠিবে আকুলি
কুহুকলস্বরে।
অমর বেদনা মোর হে বসন্ত, রহি গেল তব
মর্মরনিশ্বাসে
উত্তপ্ত যৌবনমোহ রক্তরৌদ্রে রহিল রঞ্জিত
চৈত্রসন্ধ্যাকাশে।
কবিতাটা শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন গুরুদেব। তারপর জানতে চাইলেন, ওহে মধুমাস, এ কবিতাখানা কেমন লাগল?
কিন্তু কোনো জবাব নেই। গুরুদেব বললেন, জবাব দিচ্ছ না কেন ওহে প্রিয় মধুমাস?
মধুমাস বলল, আমি তো মৃতপ্রায়।
আর্তনাদ করে উঠলেন গুরুদেব। বলো কী!
জি গুরুদেব। বাংলাদেশে আমি মৃতপ্রায়।
কিন্তু কেন?
তা তো জানি না। দু-একটি বাদে বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকা আমার ঠিকানাই বদলে দিয়েছে। জ্যৈষ্ঠকেই মধুমাস বলে প্রচার করছে।
গুরুদেবের কপালে এবার কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। বলো কী হে!
এই তো দেখুন না গুরুদেব।
বলেই ট্যাব খুলে কয়েকটা পত্রিকার ওয়েবসাইট দেখিয়ে দিল মধুমাস। গুরুদেবও অবাক হয়ে পত্রিকার শিরোনামগুলো দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে গুরুদেবের চেহারাটা লাল হয়ে উঠতে লাগল।
গুরুদেব বললেন, কিন্তু এ কী করে সম্ভব! বাঙালি কবিদের অন্যতম কবি পঞ্চদশ শতকের বিদ্যাপতিও বলেছেন-
‘মধু ঋতু, মধুকর পাঁতি;
মধুর-কুসুম-মধু-মাতি।
মধুর বৃন্দাবন মাঝ,
মধুর মধুর রসরাজ।
মধুর-যুবতীগণ-সঙ্গ
মধুর মধুর রস রঙ্গ।
মধুর যন্ত্র সুরসাল,
মধুর মধুর করতাল।
মধুর নটন-গতিভঙ্গ,
মধুর নটনী-নট-রঙ্গ।
মধুর মধুর রস গান,
মধুর বিদ্যাপতি ভান।’
এটা বিদ্যাপতির পদাবলী-কীর্তনের ‘মধু ঋতু মধুকর পাঁতি’ কবিতা। ষোড়শ শতকের আরেক বাঙালি কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। চণ্ডীকাব্যের ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’ কবিতায় মুকুন্দরাম লিখেছেন-
‘...মধুমাসে মলয়-মারুত বহে মন্দ
মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।
বনিতা পুরুষ যত পীড়য়ে মদনে
ফুল্লরার অঙ্গ পুড়ে উদর-দহনে।’
এটুকু বলে গুরুদেব থামলেন। মধুমাস বলল, গুরুদেব, আপনার গীতবিতানেও তো এই গানটা আছে-
এবার গুন গুন করে গাইতে শুরু করল মধুমাস-
‘বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে,
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে।
আজি মধু সমীরণে, নিশীথে কুসুম-বনে,
তারে কি পড়েছে মনে বকুল-তলে?’
এটুকু গেয়েই হঠাৎ থেমে গেল মধুমাস। বলল, আপনার আরেকটা গানের কথা মনে পড়ল গুরুদেব। এটাও আপনার গীতবিতানে ‘নাট্যগীতি’ শিরোনামে ৫৬ নম্বর গান হিসেবে আছে।
‘আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো চৈত্রনিশীথশশী।
তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে কী দেখিছ একা বসি
চৈত্রনিশীথশশী।...
এবার গুরুদেব বললেন, আমার ‘আশ্রমপীড়া’ নাটকের প্রথম দৃশ্যের কথা মনে আছে? নবকান্তের সংলাপ দিয়ে এভাবে শুরু করেছিলাম-
‘ওঃ! প্রেমের রহস্য কে ভেদ করতে পারে! না জানি সে কিসের বন্ধন যাতে এক হৃদয়ের সঙ্গে আর এক হৃদয় বাঁধা পড়ে! কী জ্যোৎস্নাপাশ, কী পুষ্পসৌরভের ডোর, কী মুকুলিত মধুমাসের মধুর মলয়ানিলের বন্ধন!’
মনে পড়ে মধুমাস?
মধুমাস মাথা নেড়ে বলল, মনে পড়ে গুরুদেব। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র সে কথাগুলোও মনে পড়ে-
‘না দিল দানব-বালা হুহুঙ্কার রবে, মাতঙ্গিনী-যূথ যথা মত্ত মধুকালে।’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসেও আছে-
‘এমত নহে যে, একেবারে বায়ু বহিতেছিল না, মধুমাসে দেহ¯স্নিগ্ধকর বায়ু অতি মন্দ-একান্ত নিঃশব্দ বায়ু মাত্র, তাহাতে কেবলমাত্র বৃক্ষের সর্বাগ্রভাগারূঢ় পত্রগুলি হেলিতেছিল, কেবলমাত্র আভূমিপ্রণত শ্যামা লতা দুলিতেছিল; কেবলমাত্র নীলাম্বরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখ-গুলি ধীরে ধীরে চলিতেছিল।’
মধুমাস এবার জানতে চাইল, গুরুদেব, ‘মধুমাস’ নামটা কী করে এল?
গুরুদেব বললেন, ওটা পাওয়া যাবে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় সমার্থকোষ অভিধান’ থেকে। ওখানে বলা হয়েছে- ‘চৈত্রমাসকে কেন মধুমাস বলা হয়, তার কারণ জানা যায় ‘বসন্ত’ শব্দ থেকে। দুধের থেকে সর, সর থেকে ঘোল-মাখন হয়ে ঘি-এ পৌঁছানো যায়। সেই সুবাদে মধু হলো ঘি। ঠিক সেইরূপ বৈশাখ থেকে বসবাস ও বর্ষের শুরু এবং তার চূড়ান্ত হয় বসন্তে। সেই বসন্তের শেষ মাস হলো চৈত্রমাস। গ্রহণ-বর্জন-পুনরুৎপাদনের নীতিতে চলা মানবজীবনের জৈবিক সার্থকতা পুনরুৎপাদনে। বসন্তের অন্তে বা চৈত্র মাসে মানুষের প্রতিপালন প্রাচীন শব্দবিদগণের অখণ্ড চিন্তাশৃঙ্খলার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সেই কারণে তারা চৈত্র মাসকে মধুমাস নাম দিয়েছিলেন।’
এছাড়া হিন্দি ভাষায় ‘বাহারি’ মানে মধুকাল বা মধুমাস। আবার ‘বাহারকে দিন’ মানে বসন্তকাল। অপরদিকে ফারসিতে ‘বহার’ মানে বসন্তকাল। ‘বহারী’ অর্থ বাসন্তী বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়। ষোড়শ শতকের বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি দৌলত উজির বাহরাম খান তার কাব্যে বলেছেন, ‘মধুমাসে উতলা বাতাস, কুহরে পিক; যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’ বসন্তের সখা কোকিল। এই কোকিলের আরেক নাম হলো ‘মধুসখা’।
মধুমাস বলল, গুরুদেব, খনার বচনেও শুনেছি-
‘মধুমাসে ত্রয়োদশ দিনে রয় শনি
খনা বলে সে বৎসর হবে শস্য হানি।’
অথবা-
‘মধুমাসে প্রথম দিবসে হয় যেই বার।
রবি শোষে, মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার।’
এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন গুরুদেব। জানতে চাইলেন, শুধু কি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাতেই তোমার ঠিকানা বদল হয়েছে মধুমাস?
জি গুরুদেব। শুধু বাংলাদেশের কিছু পত্রিকা। ভারতের বাংলা ভাষার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কোনো পত্রিকা আমার ঠিকানা বদলায়নি- চৈত্রই রেখেছে।
এবার মুচকি হাসলেন গুরুদেব। বললেন, কিন্তু সাহিত্য থেকে তোমাকে বদলাবে কেমন করে?
মধুমাসের কণ্ঠে আফসোস, ওরা তো সাহিত্য পড়ে না। দিন দিন সাহিত্যপড়ুয়ার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
গুরুদেব বললেন, তা বুঝলাম। সাহিত্য পড়ে না, কাজেই কী করে জানবে? কিন্তু অভিধানও কি দেখে না?
কী যে বলেন না গুরুদেব! কেউ অভিধান ঘাঁটলে তো! এখন কেউ আর অত কষ্ট করে না। গুগলে সার্চ দেয়। সবকিছু গুগল থেকেই জোগাড় করে।
তাহলে তো বড্ড মুশকিল হলো! বসন্তে সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে। এটুকু তো সবাই জানে?
জি গুরুদেব, এটা সবাই জানে।
তাহলে তো বিষয়টা সহজ হয়ে গেল। ফাল্গুনে ফুল ফুটতে শুরু করে। চৈত্রে গিয়ে ফুলগুলো মধুতে ভরে যায়। আর ফুল মানেই মধু। কাজেই মধুমাস মানেই চৈত্রমাস। কারণ মধু থাকে ফুলে, ফলে নয়।
গুরুদেব, আপনিই তো বসন্তকে মানে মধুমাসকে বাঙালির মধ্যে জনপ্রিয় করেছেন। উৎসব পালনের রীতি চালু করেছেন। সে জন্যই আমি আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। কিছু একটা করুন। আমি নিজের ঠিকানায় থাকতে চাই।
গুরুদেব বললেন, হতাশ হয়ো না প্রিয় মধুমাস। নিশ্চয়ই সবার মধুমাসোদয় মানে বোধোদয় হবে। মর্ত্য ছেড়ে এখানে থাকলে শেষে দেখবে তোমার ঠিকুজিই বদলে গেছে। তুমি মর্ত্যইে ফিরে যাও হে মধুমাস।
গুরুদেবের নির্দেশ। না মেনে উপায় আছে! আবার মর্ত্যের পথে পা বাড়াল মধুমাস। তার কণ্ঠে তখন শচীনদেব বর্মণের গান-
‘বঁধু গো
এই মধুমাস বুঝিবা বিফল হলো
ভুলে গেছ তুমি সেই মধু নামে ডাকা
মিলনছায়া মধুমাস আজিকে ঢাকা...’
লেখক: শিশু সাহিত্যিক, কলাম লেখক।
ভারতীয় নাগরিককে জুলাই যোদ্ধা বানিয়ে অপপ্রচার শনাক্ত করেছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)’র ফ্যাক্ট চেক ও মিডিয়া রিসার্চ টিম বাংলাফ্যাক্ট।
বাংলাফ্যাক্ট অনুসন্ধানে শনাক্ত হয় যে, ভারতীয় নাগরিককে জুলাই যোদ্ধা বানিয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক করে দেখা যায় যে, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিওটিতে হুইল চেয়ারে বসা এই ব্যক্তি কোনো জুলাই যোদ্ধা নন। রোগীর ছদ্মবেশে থাকা ওই ব্যক্তি একজন ভারতীয় নাগরিক। তার নাম নজরুল হক।
গত ১৭ মার্চ ভারতের কলকাতা থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন রোগীর ছদ্মবেশে থাকা নজরুল হক নামের এক ভারতীয় নাগরিক। সে সময় তার কাছ থেকে মদ ও কসমেটিকস উদ্ধার করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ওই ঘটনার ভিডিওকে আহত জুলাই যোদ্ধার কাছ থেকে এয়ারপোর্টে মদ উদ্ধারের ঘটনার ভিডিও দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশে চলমান গুজব, ভুয়া খবর, অপতথ্য প্রতিরোধ ও জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ায় দায়িত্ব পালন করছে বাংলাফ্যাক্ট।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। টাকা দিয়ে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ নেওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো, কমিশন বাণিজ্য, হুইলচেয়ার বাণিজ্য ও প্রথমে সাপ্লাই নেই বলে রোগীকে ওষুধ না দেওয়াসহ নানা অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। এসব কারণে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে বিপাকে রয়েছেন রোগীরা।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এসব অভিযোগ পাওয়া যায় অহরহ।
এদিকে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনীর একটি দল। এ সময় তারা সরকারি ওষুধ বিক্রি এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ রোগীকে দেওয়ার অভিযোগে মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড বয় হরষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
হরষিতের কাছ থেকে সরকারি ওষুধ কিনে বিপাকে পড়া সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া এলাকার মোহাম্মদ আলী বলেন, ঈদের পরদিন আমার স্ত্রীকে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করালে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে বলেন, এ ওষুধ সাপ্লাই নেই, বাহিরে থেকে নিয়ে আসেন। আমি প্রথম থেকেই সব ওষুধ বাহির থেকেই নিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ এক ওয়ার্ড বয় বলল চাচা ওই ওষুধটা বাহিরের থেকে কত টাকা করে কিনছেন? আমি বললাম ৮৫০ টাকা। পরে সে ওষুধ ৫০০ টাকায় ওয়ার্ড বয় আমাকে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, চারটা ওষুধ আমার স্ত্রীর শরীরে পুশ করলে জ্বালা যন্ত্রণার অনুভব করে এবং তার জ্বর আসে। পরে জানা যায় ওষুধগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ।
এদিকে, সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে ওষুধ বিক্রির কথা স্বীকার করে মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড বয় হরষিত বলেন, আমি ছয়-সাত মাস আগে হাসপাতালে ডাস্টবিন থেকে কয়েকটি ওষুধ কুড়িয়ে পাই। সুযোগ বুঝে এখন ওষুধগুলো বিক্রি করেছি।
এদিকে হরষিতের কাছ থেকে কেনা ছয়টি ওষুধের অবশিষ্ট দুটি ওষুধে দেখা গেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মেয়াদ শেষ।
আব্দুল গফুর নামে একজন বলেন, টাকা ছাড়া এখানে কোনো কাজই হয় না। রোগীর যদি কোনো পরীক্ষা করতেই হয় টাকা দিতে হয়। এরপর হুইল চেয়ারে যদি টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে ১০০ টাকা করে দিতে হয়। টাকা নিয়েই সব কাজ করে তাহলে এটি সরকারি হাসপাতাল হলো কিভাবে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, আমরা এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মেডিকেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং করেছি। হাসপাতালে ডাক্তাররা ঠিকমতো ডিউটি না করা, গাড়ির গ্যারেজে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ করেছি। ওষুধ থাকবে হাসপাতালের স্টোরে। যেখান থেকে সুষ্ঠুভাবে রোগীর হাতে পৌঁছাবে। সেই ওষুধ কীভাবে ওয়ার্ড বয়ের মাধ্যমে বিক্রি হলো এটার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. কুদরতে খোদা বলেন, ওষুধ বিক্রির বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনারা রোগীর লোককে একটু বলেন, আমার কাছে একটা অভিযোগ দিতে। তাহলে যে এ কাজ করেছে তাকে আউট করে দেব।
ইউটিউবে ভিডিও দেখে নওগাঁয় কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস ফ্লাই নামের একটি পোকা থেকে লার্ভা উৎপাদন করে সাফল্য পেয়েছেন আহসান হাবিব নামে উদ্যোক্তা। এ পোকার লার্ভা মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিক্রি করে প্রতি মাসে আয় করছেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। মাছের খাবারের বিপল্প হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় এই পোকা চাষে আগ্রহ বাড়ছে স্থানীয়দের। উদ্যোক্তা আহসান হাবিব সদর উপজেলার তিলেকপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত উলিপুর গ্রামের বাসিন্দা।
জানা যায়, আহসান হাবিব পেশায় একজন কৃষক। কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি পুকুরে মাছ চাষ করতেন। বাজারে যখন মাছের খাবারের মূল্য বৃদ্ধি তখন খরচ কমাতে বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে ইউটিউব ভিডিও দেখে কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজার চাষের আগ্রহ হয়। পরিকল্পনা করেন এই পোকা চাষের। ২০২৪ সালে খামার সম্প্রসারণে পিকেএসএফ এর কারিগরি সহযোগিতায় মৌসুমি আরএমটিপি প্রকল্প তাকে সহায়তা দেন। এরপর কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস ফ্লাই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে সাফল্য পান। মাসে এখন তার খামারে ২৫০ থেকে ২৬০ কেজি লার্ভা উৎপাদন হয়। নিজের পুকুরে মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিক্রি করে থাকেন। এলাকায় তিনি পোকা চাষি হাবিব নামে পরিচিত।
কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস ফ্লাই মূল পোকাগুলো একটি জালের মধ্যে, দিনের বেলায় আলো-বাতাস আসে এমন জায়গায় রাখা হয়। পোকাগুলো প্রজনন সম্পন্ন করার পর সেখানে কাঠের স্তরের মধ্যে ডিম পাড়ে। সেই ডিমগুলো হ্যাচিং করে ফোটানোর কিছুদিন পর আলাদা করে অন্য জায়গায় রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে তৈরি হয় লার্ভা। এসব লার্ভা উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বাসা বাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ উচ্ছিষ্ট খাবার, পচনশীল ফলমূল অথবা শাকসবজি। এসব পচনশীল আবর্জনা সংরক্ষণ করে সেটির প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তারপরও সেখানে জন্ম নয় এসব লার্ভা। এসব পোকা মাছের জন্য প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি খাবার। ব্যাপক প্রোটিনসমৃদ্ধ হওয়ায় মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এটি ব্যবহারে যেমন উৎপাদন বাড়বে তেমন কমবে খরচে উৎপাদনে। শুধু লার্ভা উৎপাদনে নয় আবর্জনা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে দূষণ কমাতে সহায়ক ভৃমিকা রাখছে এমন উদ্যোগ।
স্থানীয় মাছ চাষি রফিকুল ও রাজা বলেন, আমাদের নিজেদেরই পুকুর আছে। বাজার থেকে খাবার কিনে মাছে চাষে খরচ বেশি হয়। লাভবান হওয়া যায় না। কিন্তু কম খরচে উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস থেকে লার্ভ তৈরি করে মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করলে লাভবান হওয়া যাবে। চিন্তাভাবনা করেছি আহসান হাবিরের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে এরকম একটি উদ্যোগ নিবো।
মৌসুমি আরএমটিপি প্রকল্পের মনিটরিং কর্মকর্তা আব্দুর রউফ পাভেল বলেন, উন্নয়ন সংস্থা মৌসুমির মাধ্যমে জেলায় এই প্রথম আগ্রহী মাছ চাষিদের মাধ্যমে কালো সৈনিক পোকা চাষের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চাষিদের মাছ চাষে অধিক লাভবান করতে ও ভোক্তাদের মাঝে বিষমুক্ত মাছ পৌছে দিতেই এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামীতে এই প্রকল্পটি আরো বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
নওগাঁ সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো: বায়েজিদ আলম বলেন, এই পোকার খাবার হচ্ছে ফেলে দেওয়া বাড়ির উচ্ছিষ্ট, ময়লা আর আবর্জনা। ফেলে দেয়া এই ডাস্টগুলো রিসাইকেল হতে যে ক্ষতিকর গ্রীণ হাউজ গ্যাস নি:সরণ ঘটে সেই গ্যাসও এই পোকা শোষণ করে। মাছ চাষি ও ভোক্তাদের মাঝে এই পোকার উপকারি দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারি ভাবেও এই পোকা চাষের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণার মাধ্যমে ফিডের মতো করে এই পোকার পাউডার তৈরি করে বাজারজাত করতে পারলে চাষিদের মাছ চাষে খরচ কমার পাশাপাশি দেশের ভোক্তাদের কাছে বিষমুক্ত মাছ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হতো। এছাড়াও আবর্জনা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে দূষণ কমাতে সহায়ক ভৃমিকা রাখবে।
মানুষের আগ্রাসন অপরিকল্পিত নগরায়নে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে গাছ। বনাঞ্চলের সঙ্গে কমছে প্রাণীর সংখ্যাও। খাদ্য ও বাসস্থানের সংকট, অবৈধ শিকার, পাচার, কীটনাশকের অতি ব্যবহারের মতো নানা কারণে প্রতি বছরই পৃথিবী থেকে কোনো না কোনো প্রাণী বিলুপ্ত হয়। কুষ্টিয়াতে প্রায় বিলুপ্তির পথে জীববৈ চিত্র্য। গাছ-পালা নিধন দ্রুত শহরায়নের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে পাখি।
কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, মিল কল কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ও কারেন্ট জালের ব্যবহারের ফলে মারা পড়ছে কৃষিবান্ধব পাখি। রাস্তার দুপাশে গাছ, ক্যানাল এর দুপাশেরসহ বিভিন্ন ফসলের মাঠের ধারের বড় বড় গাছ, কলকারখানা, ইটভাটা, প্লাইউড কারখানা ও আবাসস্থল তৈরির জন্য গাছ ও বনজঙ্গল নির্বিচারে কেটে ধ্বংস করে জলবায়ু পরিবর্তন ও পাখিদের হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এক সময় বিল ও জলাশয়ের ধারে দল বেধে নামত দেশি সাদা বক। কৃষকের লাঙ্গল দিয়ে জমি কর্ষণ ও ফসল কাটার সময় পাখির দল কৃষককে ঘিরে ধরত। ওই পাখির দল ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে পেট ভরত। জীববৈচিত্র্যে আদরমাখা এই দেশি পাখি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু গ্রামগঞ্জে ফসলের জমিতে ও শহরের কিছু জলাশয়ে শীতের মৌসুমে দেখা মেলে স্বল্পসংখ্যক পাখির।
এক সময় কুষ্টিয়া জেলার গ্রামের মাঠে ধানের ক্ষেতে চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করার সময় দেখা গেল শত শত সাদা বক ও বিভিন্ন দেশী পাখি। এইসব বক ও পাখি উড়ে এসে কৃষক ও লাঙ্গলের ফলার চার পাশে ঘিরে কিচিরমিচির শব্দে উড়ে উড়ে পোকা খেত। কখনো ঝাঁক ধরে উড়ে যেত আকাশে। কখনো আবার এক জমি থেকে অন্য জমিতে উড়ে গিয়ে বসতো। এরই মাঝে ধরে ধরে জমি থেকে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় খেতে। অপূর্ব এই কোলাহল দেখে মুগ্ধ হত পথচারীরা। কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন কৃষকরা জানান, এই সাদা বক ও পাখি আমাদের অনেক উপকার করে। চারা ধানের জমিতে মাজরা পোকা ও ফড়িংসহ ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করে পাখিরা। এছাড়া ক্ষেতে পানি দেওয়ার পর যেসব পোকা ভাসতে থাকে তারা তা খেয়ে সাবাড় করে। এতে ফসলের উপকার হয়। কিন্তু এখন সৌন্দর্যের প্রতীক এই সাদাবক ও পাখি আগের মতো আর দেখা যায় না।
বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য, নির্বাচারে বৃক্ষনিধন ও পাখি শিকারিদের ফাঁদে পড়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে এই সব উপকারী পাখি।
পাখি সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ জীব ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশন (বিবিসিএফ) এর সহসভাপতি শাহাবউদ্দিন মিলন বলেন, পাখি প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেমন তাদের আবাসস্থল ঠিক রাখা উচিত তেমনি তাদের খাদ্যের উৎস রক্ষা করা জরুরি। পাখি শুধু পরিবেশের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, কৃষি ও কৃষকের বন্ধু হিসেবে কাজ করে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই পাখি সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আবাসস্থল সংরক্ষণ, শিকার ও পাচার বন্ধ করতে হবে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চরাঞ্চলের কাঁদাময় ও ভাঙ্গাচোরা রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের বয়ড়া ব্রিজপাড়সংলগ্ন গাছ বয়ড়া মানু মেম্বারের বাড়ি হতে বিন্নাফৈর মোড় হয়ে টাকুরিয়া পর্যন্ত রাস্তাটি দীর্ঘ ১০ বছর পর কাদাযুক্ত ও ভাঙ্গাচোরা কাঁচা সড়কটি সংস্কার করা হয়। জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামিম এর নির্দেশে পোগলদিঘা ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান ফরহাদের নিজস্ব অর্থায়নে এ রাস্তাটি সংস্কার করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই রাস্তাটি একাধিকবার দাবি জানালেও কোনো চেয়ারম্যান বা মেম্বার মেরামত, সংস্কার করেনি। একটু বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যায়, বিভিন্ন স্থানে কাঁদা হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। স্কুল-কলেজে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকে না। বয়ড়া ব্রিজ ও মাদারগঞ্জ-ধনবাড়ী মহাসড়কের সংযোগ সড়ক পর্যন্ত অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এই মাটির কাঁচা রাস্তাটি পাকা করা হয়নি। এর ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় কয়েকটি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষের।
পোগলদিঘা ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান ফরহাদ বলেন, এই ইউনিয়নের সব থেকে পিছিয়ে আছে এই গ্রামটি৷ কারন এই কয়েকটি গ্রামে বিএনপির সমর্থক বেশি। তাই ইচ্ছে করেই কোন চেয়ারম্যান এ রাস্তার উন্নয়ন করেনি। অনেক সময় কাঁদায় গাড়ি আটকে বিকল হয়ে গেলে গাড়ি আটকা পড়লে অন্য কোন গাড়ি আর যেতে পারে না। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানের রাস্তাটির করুন অবস্থা আমাদের জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম ভাইকে জানালে তার নির্দেশে আমি আমার নিজস্ব অর্থায়নে অবহেলিত এই গ্রামের মানুষের সঙ্গে নিয়ে পুরো রাস্তাটি সংস্কার কাজ করছি।
উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি চাঁন মিয়া চানু মন্ডল বলেন, এক যুগেও এক টুকরো মাটি দেওয়া হয়নি, উন্নয়ন বঞ্চিত এ রাস্তাটি পাকাকরণ এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় চলাচলের অযোগ্য এ রাস্তায় পানি জমে ভোগান্তি বাড়ে কয়েক গুন। বিভিন্ন স্থানের পানি রাস্তায় উঠে দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি ছড়ায় পানিবাহিত রোগও। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে দ্রুত এই রাস্তাটি পাকা করার দাবি জানান তিনি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এই সরকারের কাছে মানুষ আইনের শাসন প্রত্যাশা করে। আপনারা দৃষ্টান্ত রেখে যাবেন, যাতে করে নির্বাচিত সরকার এলে আপনাদের ভালো দৃষ্টান্তগুলো চিহ্নিত করে আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা করে।’
তিনি বলেন, কেন এই সময়ে এসে এত খুন-জখম হবে, কেন এত ডাকাতি, চুরি হত্যাকাণ্ড ঘটবে, এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। বলা হচ্ছে, পুলিশের মধ্যে এখনো আস্থা ফিরে আসেনি, কেন আস্থা ফিরবে না? গতকাল বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘আমরা বিএনপির পরিবার প্রধান পৃষ্ঠপোষক তারেক রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় জুলাই-অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রিজভী বলেন,’ ২৪ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পটভূমি রচনার প্রধান নায়ক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আমরা দেখেছি যখন ছাত্র-জনতা বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তখন তিনি দলের সব নেতা-কর্মীকে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় থাকার জন্য। কখনো তিনি লন্ডন থেকে বক্তব্যের মাধ্যমে কখনো আমাদের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই আন্দোলনে আমাদের ছাত্রদলের অনেক নেতা-কর্মী, বিএনপির সমর্থক অনেকেই আত্মহুতি দিয়েছেন গণতন্ত্রকে ফেরানোর জন্য।’ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলে রিজভী বলেন, ‘আমরা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের যে ঘটনাগুলো দেখেছি, সেখানে আমরা শুনতে পাচ্ছি, জানতে পারছি- যারা তদন্তে আছেন তারা নানা কারণেই গোপনীয়তা রক্ষা করছেন, যদিও তারা বলেছিলেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে হয়তো বিশেষ কারণে নামগুলো এখনো বলছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় যা হয়েছে এইটা বলছেন তারা। তার মানে পরিকল্পিতভাবে পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। হয়তো কারও স্বার্থে প্রভুদের স্বার্থে অথবা অন্য কোনো স্বার্থে এই ঘটনা ঘটিয়েছিল তৎকালীন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল।’ তিনি বলেন, ‘এমন দেশ তো এই দেশের মানুষ চায়নি। যে দেশ যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হতে এত মানুষের প্রাণহানি, এত ক্ষয়ক্ষতি, সেই দেশে নিজের দেশের সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে নানা ধরনের প্রকল্প তৈরি করেছিল এবং তারা যে বয়ান তৈরি করত সেই বয়ানগুলোও ছিল পরিকল্পিত। যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিপক্ষের শক্তি এমন নানা ধরনের কথা বলে গোটা দেশটাকে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে প্রতি সেকেন্ডে ওরা বিভাজন করে রেখে গেছে।’
ঢাকার পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। এ ঘটনায় তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের নানা মাত্রায় সংশ্লিষ্টতার যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে কমিশন।
গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম নতুন ভবনের সপ্তম তলায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত তদন্ত কমিশন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিভিন্ন সাক্ষ্য হতে প্রতীয়মান যে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের নামে অযথা কালক্ষেপণ করায় এবং সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে বিদ্রোহীরা নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটন করতে সমর্থ হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই পিলখানার ভেতর থেকে আটকে পড়া অফিসার ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বারংবার অনুরোধ-আকুতি সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ফজলুর রহমান বলেন, এই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এটা বলা যায় যে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। অপরাধ সংঘটনের সময় তারা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল, যার ফলে তারা বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড প্রতিহত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
তদন্ত কমিশন জানায়, তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে এই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে প্রতীয়মান। গোয়েন্দা ব্যর্থতার স্বরূপ ও কারণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং আলামত ধ্বংস করার প্রয়াস প্রতীয়মান হয়েছে। এর পেছনে দায়ী ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোকে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
কমিশনের সভাপতি বলেন, পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চলাকালে কিছু গণমাধ্যম পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচার করার মাধ্যমে বিদ্রোহ উসকে দিয়েছে। একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে সামরিক অফিসারদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস চালিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিদেশি সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কমিশন মনে করে যে সময়মতো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করা যেত।
সংবাদ সম্মেলনে পিলখানার অভ্যন্তরে সংঘটিত অপরাধের ধরন উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, বেঁচে যাওয়া কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দি থেকে পিলখানার অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এক মর্মন্তুদ চিত্র পাওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা ছাড়াও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর চালানো হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। নারী ও শিশুদের মারধর, সশস্ত্র অবস্থায় হুমকি প্রদান, বাড়িঘর ভাঙচুর, অমানবিক পরিবেশে খাবার ও পানি ছাড়া কোয়ার্টার গার্ডে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা, রাষ্ট্রের ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধ্বংস সাধন, আলামত ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ ছাড়াও নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য আরও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১৫৮ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। আরও আনুমানিক ৫০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি আছে। ৮ জন সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের সাক্ষাৎকার জেলে নেওয়া হয়েছে। তিনজন উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। দুজন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম ই–মেইলে জবানবন্দি দিয়েছেন।
তদন্ত কমিশন জানায়, এখন পর্যন্ত শহীদ পরিবারের ছয়জনের বিস্তারিত জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। সব শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুটি সম্মেলন করা হয়েছে। সেখানে পরিবারের সদস্যরা তাদের অভিজ্ঞতা ও মতামত ব্যক্ত করেছেন। সম্মেলনে সব ইচ্ছুক সদস্যদের লিখিত বা কমিশনে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত জবানবন্দি দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অনেক শহীদ পরিবারের সদস্য ইতিমধ্যেই তা করেছে। বেঁচে ফিরে আসা ১৫ জন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ৫০ জন বেঁচে যাওয়া অফিসারদের লিখিত জবানবন্দি প্রদান করার জন্য সেনাসদরের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দুটি সম্মেলনে তাদের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে মতবিনিময় হয়েছে।
তদন্ত কমিশন জানায়, ৫৫ জন সামরিক অফিসার, যারা বিভিন্নভাবে পিলখানা ট্র্যাজেডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, তাদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন একাধিক সাবেক সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর প্রধান; বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
তদন্ত কমিশন জানায়, ২০ জন অসামরিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, আমলা, আগের তদন্ত কমিটির সদস্য, তৎকালীন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার ও অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। ৯ জন বেসরকারি ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি। যাদের কাছে ঘটনাসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। কারাগারে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫ জন বিডিআর সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তারা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সে সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য দিয়েছে। যেগুলো এখন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আরও সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান। এর বাইরে ২৯ জন কারামুক্ত বিডিআর সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিশন জানায়, প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ ও তদন্ত কার্যক্রমে অধিকতর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কমিশন ৩৩ জন ব্যক্তির দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পলাতক ব্যক্তিদের সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কমিশন তিনটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
কমিশন জানায়, ৬টি দেশের দূতাবাস ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পিলখানা ট্র্যাজেডিসংক্রান্ত কোনো তথ্য আছে—এরূপ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমকে কমিশনের কাছে তথ্য প্রদান করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
কমিশনের জানিয়েছে, প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদনের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে কমিশনের সদস্যরা পর্যালোচনা করছেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ চলমান রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পুনঃসাক্ষ্য গ্রহণ প্রয়োজন হবে।
তদন্তে চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দৈনিক পত্রিকায় একাধিক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। কিছু দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে চাহিদাকৃত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-দলিলাদি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। উল্লিখিত তথ্য অনতিবিলম্বে সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৫০ জনের অধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ এখনো বাকি আছে। এছাড়া কিছুসংখ্যক ব্যক্তির পুনঃসাক্ষ্য গ্রহণেরও প্রয়োজন হবে। গৃহীত সাক্ষ্যগুলোর পূর্ণাঙ্গ লিখিত রূপ প্রস্তুত, স্বাক্ষর গ্রহণ ও বিশ্লেষণের কাজ চলমান রয়েছে। এটি একটি সময়সাপেক্ষ কাজ। কিছু বিদেশি দূতাবাস ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। যার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মেয়াদ আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।
মন্তব্য