সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গত কয়েকদিন ধরে দেশের তরুণ সাহিত্যিকদের মধ্যে উত্তপ্ত তর্ক চলছে। তর্কের বিষয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও সাহিত্যকর্মে সেটির প্রভাব।
সাহিত্যিকদের অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কেউ কেউ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। পদের কারণে তাদের সাহিত্যকর্ম বেশি গুরুত্ব পায় বলে অনেকে অভিযোগ করেন। আবার এমন অভিযোগও আছে যে, অনেকে করপোরেট পেশাজীবীদের সাহিত্যকর্মের প্রশংসা করে তাদের আনুকূল্য লাভের চেষ্টা করেন বা আনুকূল্যের প্রতিদান হিসেবে প্রশংসা করেন। বিপরীত দিকে, উৎকৃষ্ট প্রতিভাদীপ্ত সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করা সত্ত্বেও কেবল উচ্চপদে চাকরির ‘অপবাদে’ অনেকে মনোযোগবঞ্চিত ও অবিচারের শিকার হয়ে থাকেন বলে অনুযোগ আছে।
এই তর্কে অংশ নিয়েছেন সাহিত্যিক সুমন রহমান, রাজু আলাউদ্দিন, মাসরুর আরেফিন, ব্রাত্য রাইসু, মাহবুব মোর্শেদ, কামরুজ্জামান কামু প্রমুখ।
এই আলোচনায় প্রবল ব্যক্তি-আক্রমণ থাকলেও এর ভেতর দিয়ে বর্তমান সময়ের সাহিত্যিকদের শিল্পভাবনা, সাহিত্যের রাজনীতি ও ক্ষমতাকাঠামোর প্রতি তাদের সংবেদনশীলতা, একটি সক্রিয় সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের বোধ, তাদের ঈর্ষাকাতরতা ইত্যাদি উন্মোচিত হয়েছে। এ কারণে ফেসবুকের পাতায় মন্তব্য পাল্টা-মন্তব্যের তাৎক্ষণিকতার বাইরে এটির দালিলিক মূল্যও আছে।
আলোচনাটি ১২ অক্টোবর শুরু হয়েছিল গল্পকার, কবি সুমন রহমানের একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে। আলোচনাটি এখনও চললেও এখানে তা শেষ করা হয়েছে ১৮ অক্টোবর কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদের পোস্ট দিয়ে। এইসব আলোচনা ফেসবুকের পাতা থেকে সংকলন করে এখানে কালানুক্রমিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
তর্ক শুরুর সেই পোস্টে সুমন রহমান লেখেন:
সুমন রহমানের পোস্ট–১২. ১০. ২০/ দুপুর ২টা ১৭ মিনিট
‘বিলম্বিত পুঁজিবাদের এই ভুবনজোড়া ফাঁদে সাহিত্য একলা বসে থাকে! তার কোনো সহযাত্রী নাই। বাজারব্যবস্থার ঠাপে রুচিবোধ উধাও হয়ে গেছে। বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ছদ্মপাঠক, সুবিধাভোগী সম্পাদক আর ভৌতিক লম্পট। টাপুর টুপুর টাইপরাইটারের ছন্দে বৃষ্টি নামে সারা মতিঝিলে। করোনায় চাকরিশূন্য কবি হানা দেয় কর্পোরেটের দুয়ারে, নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয় সাহিত্যের ইতিহাস। নাছোড়বান্দা শ্রাবণে ভিজে ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাওয়া উপমাগুলির জন্য তেমন কোনো শুশ্রুষা নাই। তাদের সামান্য ফিসফাস এই হল্লাময় দাসবাজারে আজ আর কারো কান অব্দি পৌঁছায় না।
সাহিত্যের এই নিউ নরমাল হেটেরোটোপিয়ায় নিজেকে চিনতে পারছেন তো? নাকি বাজার-স্পন্দিত বুকে নিজেরেই বোর্হেস ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন?’
এখানে উল্লেখ্য, ঔপন্যাসিক মাসরুর আরেফিন গত ৩ সেপ্টেম্বর তার ফেসবুক পেজে আর্জেন্টাইন কবি ও গল্পকার হোর্হে লুইস বোরহেসকে নিয়ে প্রবন্ধ-আকারের একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছিলেন, যেটির শিরোনাম ছিল: ‘আমাদের বোরহেস প্রেম—রাজু আলাউদ্দিন, আমি আর প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে ব্রাত্য রাইসু।’
সুমন রহমানের ফেসবুক পোস্টে স্পষ্টতই মাসরুর আরেফিনের পোস্টকে কটাক্ষ করা হয়েছে। সুমন রহমানের পোস্টের তিন দিন পর দৃশ্যত সেটির জবাব হিসেবে অনুবাদক ও গবেষক রাজু আলাউদ্দিন একটি পোস্ট দেন:
রাজু আলাউদ্দিনের পোস্ট–১৫. ১০. ২০/ দুপুর ১২টা ৪২ মিনিট
‘ও এক ত্যাঁদড় লোক
ইতর প্রাণিদের সঙ্গে কখনোই বিরোধে যাওয়ার মতো ইচ্ছে যেমন নেই, তেমনি রুচিও নেই। তদুপরি সময়ের অভাব আমাকে নিরুৎসাহিত করে আরও বেশি। যার মধ্যে সততা নেই বিন্দুমাত্র, বরং সততার মুখোশে যে অসততার ফেরি করে, তার প্রতি বিবমিষা জানানো ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে। কথা বলে কর্পোরেটের বিরুদ্ধে, কিন্তু কার্যত যে কিনা কর্পোরেটের ঘেটুপুত্র হিসেবে নিজের পায়ুপথকে এজমালি করে রেখেছে, সে কিনা ইনিয়ে বিনিয়ে কর্পোরেটের বিরুদ্ধে বলে। অন্য কোনো প্রতিভাবানের পুস্তক নয়, নিজেরই কর্পোরেট প্রভু, যে- প্রভুর কিতাবের স্তুতিবাক্য লিখতে হয় গোলামিবোধ থেকে। এই গোলাম দার্শনিকতার কথা শোনায়—কোথায়? কানার হাটবাজারে। নিজের কর্পোরেটের পক্ষপাতিত্ব করে এই `লিবারেল' দার্শনিক। কেন করে? কারণ এক কর্পোরেটের বিরুদ্ধে অন্য কর্পোরেটের অর্থনৈতিক লড়াইয়ে সে বেতনভুক্ত পদাতিক সৈনিক। তদুপরি আছে সাহিত্যিক স্বার্থ। স্বার্থের কারণে পুরুষ-বেশ্যারা নির্লজ্জের মতো যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। জীবনানন্দ-প্রশ্নে সে অখাদ্য এক কমলালেবুর পাশে দাঁড়ায়। সাহিত্যে এসব পুরুষ-বেশ্যার প্রাদুর্ভাব অনেক।
আশ্চর্য দূরদর্শিতা নিয়ে ভলতেয়ারের মতো লেখক দু’শ বছর আগেই এদের কীটোপম উপস্থিতি সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা দিয়েই আমার পয়গাম তুলে ধরছি:
“ও এক ত্যাঁদড় লোক। সমস্ত নাটক এবং বইয়ের নিন্দে করেই ও জীবিকানির্বাহ করে। যে-কেউ সাফল্য লাভ করে তাকেই ও ঘৃণা করে, যেমন নপুংসকরা সম্ভোগীদের ঘৃণা করে। ও হলো সাহিত্যের সেই সাপদের একজন যারা নোংরায় আর বিষে নিজেদের পুষ্ট করে। ও এক পেশাদার লিখিয়ে।” (কাঁদিদ, ভলতেয়ার)’
এই পোস্টে অনেকে মন্তব্য করেন। মন্তব্যকারীদের একজন ছিলেন মাসরুর আরেফিন। তিনি লেখেন:
মাসরুর আরেফিনের মন্তব্য: ‘Sumon Rahman: কথাশিল্পী সুমন রহমান দুদিন আগে যখন আমাকে আর রাজুকে জড়িয়ে একটা নোংরা পোস্ট দিলেন, তখনই ফিল করেছিলাম, কাজটা ঠিক করেননি তিনি, আরও বড় কথা কাজটার কোনোই দরকার ছিল না।
তিনি কর্পোরেট পুঁজি, কর্পোরেট পুঁজি বলে গালি ঝাড়লেন, শেষে বোর্হেস প্রসঙ্গে আমাকে ও রাজুকে উদ্দেশ করে ইঙ্গিতপূর্ণ শ্লেষ রাখলেন, আর "চাকরিশূন্য কবির কর্পোরেটে হানা দেওয়া" নিয়ে কামরুজ্জামান কামুকে খোঁটা, ইত্যাদি দিলেন। তার লেখাটা ছিল কারও নাম না নিয়ে এক টিপিকাল লেখা, রাজুর লেখাটাও তাই। কিন্তু সবাই এখানে সব বোঝে যে কে কাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপটা করল।
সত্যি এসব বন্ধ করা উচিত। রাজুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব রাজুর সঙ্গে কোনো কর্পোরেটের বন্ধুত্ব না। আমি মাসরুর আরেফিন লেখক ও কবি, জাস্ট চাকরি করি একটা বড় কর্পোরেটে। কামু যখন বিপদে, আমি তখন তাকে হেল্প করি আমার এখানে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়ে, তাতে আমাদেরই একজন কবির একটু হলেও ভাল হয়। এটুকুও কি বোঝেন না কেউ? এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে লেখকের পাশে লেখককেই দাঁড়াতে হবে। কেউ এখানে কারো পাশে দাঁড়ায় না। আমি যা করি তা স্বচ্ছ, স্পষ্ট। তা নিয়ে অযথা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কেন করেন?
রাজু আর আমার বোর্হেস প্রীতি নিয়ে এই নাম-না-বলা বাঁকা কথা আমরা দুজনের কেউই ডিজার্ভ করি না, তাও এক কথাশিল্পীর কাছ থেকে যার লেখা আমার পছন্দের।
কে কাকে এ দেশে কর্পোরেট বলে? প্রথম আলোর মত বড় কর্পোরেটে চাকরি করা লোক (ট্রান্সকম গ্রুপ যে কত বড় এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তা কি আপনারা জানেন না?) যাদের এক টুকরো খবরে একটা মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে, সেরকম ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানের লোক আমাকে বলবে কর্পোরেট লেখক? কেন?
সুমন নিজেও এক বড় লোকাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে আছেন, আমাদের ব্যাংকও যেমন লোকাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। আর রাজুর পোস্ট ধরে আমি দেখলাম সুমন তার মালিকদের একজনের বইয়ের রিভিউও করেছেন, যেটা নিয়ে তাকে খোঁটা দিলেন রাজু। ওই মালিক আবার আমার বন্ধু কাজী আনিস আহমেদ, যাকে আমি মেধা মনন পড়াশোনার বেলায় বেশ উঁচুতে মাপি। কিন্তু রাজুর কথা হচ্ছে তুমি নিজে কর্পোরেট চাকরি করবা, তোমার মালিকের বইয়ের রিভিউ করবা, আবার আমাকে কিম্বা মাসরুরকে নিয়ে নোংরা খোঁচা দিবা, আমরা নিজেদেরকে বোর্হেস ভাবছি কিনা ইত্যাদি বলবা, তা কেন মেনে নেব?
এ সবই বন্ধ হওয়া উচিত। লেখকের মূল্যায়ন হওয়া উচিত শুধু তার লেখা দিয়ে। এ সবই আমাদের ফোকাস আমাদের আসল কাজ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। সুমন ওই মেসেজ লিখে কিছুই অর্জন করেন নি। আজকে রাজুও না। আমিও না। আমরা সবাই এভাবে আসল কাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
আমরা কেউই পারফেক্ট না। একজনও না। আমরা সবাই, প্রত্যেকেই, কোনো না কোনোভাবে কোনো না কোনোকিছুর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেই এই সিস্টেমের মধ্যে কোনো একভাবে টিকে আছি মাত্র। সেটা আমাদের সবারই বোঝা উচিত। এই সিস্টেমে কারো পক্ষে সম্ভব না পুঁজির হাইড্রার মতো থাবার বাইরে যাওয়া, গিয়ে বাঁচা।
কিন্তু এই আমাদেরই পক্ষে সম্ভব ভাল লেখক হতে চেষ্টা করা, শুধু সেই কাজটা করা।
পুনশ্চ: স্নেহভাজন শিমুল সালাহ্উদ্দিন সুমনের কর্পোরেট পুঁজির ওই পোস্টে তার ভাললাগার কমেন্ট করেছিলেন। মন খারাপ হয়েছিল আমার। শিমুল কিন্তু তার অনুষ্ঠানটা চালাচ্ছেন কর্পোরেট সিটি ব্যাংক থেকে স্পন্সরশিপ নিয়েই। তাহলে শিমুল কেন সুমনের পোস্টকে সমর্থন জানালেন। তিনি কি কাজটা বুঝে করেছেন, নাকি না বুঝে? আমি জানি না। শুধু বলব, সবাই আমরা আসেন আমাদের আসল কাজে ফোকাস করি। এসব অনেক দিন হল। এবার লেখালেখি হোক, লেখকদের একটা সুস্থ সমাজ গড়ে উঠুক। দায়িত্বটা আমাদেরই ঘাড়ে।’
রাজু আলাউদ্দিনের পোস্টে মাসরুর আরেফিনের এ মন্তব্যের জবাবে সেখানেই সুমন রহমান পাল্টা মন্তব্য করেন-
সুমন রহমানের মন্তব্য: ‘Mashrur Arefin: নোংরামিটা খুব চালাকির সাথে আপনি করলেন। রাজুর লেখা আমি পড়ি না। রাজুর জন্য বা আপনাকে কিংবা রাজুকে নিয়ে লিখিও নাই। আমি কিছু অভারঅল পর্যবেক্ষণ হাজির করেছিলাম। কারো নাম না লিখে। কাউকে গালাগাল দিই নি। আপনি রাজুর এই কুৎসিত লেখাকে আমার সমপর্যায়ের বলে সার্টিফাই করলেন। আমাকে ট্যাগ করলেন। তারপর সভাপতির ভূমিকা নিলেন। এসব বহু পুরানা রাজনীতি মাসরুর। আমি ভাবি নি আপনি ততটুকু করবেন।
এখন সময় নাই। পরবর্তীতে আমার পেজে লিখব। যারা এই অতি কুৎসিত পোস্টে লাইক অব্যাহত রাখছেন, তারা দয়া করে আমাকে আনফ্রেন্ড করে নেবেন।’
এর পরপরই কবি কামরুজ্জামান কামু ওই একই পোস্টে মন্তব্য করেন-
কামরুজ্জামান কামুর মন্তব্য: ‘আমি লজ্জিত যে, সুমনের মত আমাকেও কোথাও না কোথাও কাজ করেই খাইতে হয়! এই পেট নিয়ে জন্মানোর অপরাধে আমি সুমন বা এই ধরনের অন্যদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি তাঁর প্রথমত বৈষয়িক, দ্বিতীয়ত লেখক জীবনের আরও উন্নতি কামনা করি।’
একই পোস্টে সুমন রহমানের মন্তব্যের জবাবে মাসরুর আরেফিন মন্তব্য করেন-
মাসরুর আরেফিনের মন্তব্য: ‘Sumon Rahman: সুমন, যে অর্থে চালাকি বললেন, আমার সেই চালাকির জন্য কোনোই খ্যাতি নেই। কোনোদিন ওসব চালাকি করিনি। মাথা খারাপ, রাগী, ক্রোধে ভরা, এসব খ্যাতি আমার আছে। সাহিত্য অঙ্গনের কেউ আমাকে চালাক বলেনি কোনোদিন, বোকাই বলেছে। চালাক হলে আমি নাম না বলেই ইঙ্গিতে সব বুঝিয়ে লিখে যেতাম আপনাদের মতো।
কারো নাম না লিখে সেই কারো উদ্দেশে সব লেখার এই কালচারের সুবিধা ফেসবুকে অনেক নিচ্ছে, নিয়েছে, আপনিও উপরের ছোট উত্তরে এখন নিতে চেষ্টা করলেন।
তবে যেহেতু আপনি আপনার লেখায় কারো নাম না বলে সব বলেছিলেন, তাই আমিই হারলাম এখন আপনার এই অস্বীকারের পরে। ক্ষমাপ্রার্থী এখন।’
এর জবাবে সুমন রহমান লেখেন-
সুমন রহমানের মন্তব্য: ‘Mashrur Arefin: মাসরুর, আপনার "ক্ষমাপ্রার্থনা" তো আমার জীবনে মরুঝড় নিয়ে আসবে। পদাতিকেরা এরই মধ্যে নেমে পড়েছে! আমার ছোট্ট লেখাটা যে কত মর্মান্তিকরকম সত্য, তা আমাকে প্রচুর গালাগাল খেয়েই প্রমাণ করে যেতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই সেখানেও মধ্যস্থতা করবেন!’
প্রতি-উত্তরে মাসরুর আরেফিন বলেন-
মাসরুর আরেফিনের মন্তব্য: ‘Sumon Rahman: সুমন, আমি মধ্যস্থতাকারীর রোলে ছিলাম না। ভুল বুঝেছেন। মধ্যস্থতা করলে রাজুর মন্তব্যের পরে আমি চুপ করে বসে থেকে তারপর বেশি হলে আপনার নাম না নিয়ে একটা পোস্ট দিতাম এখানে। আমি সরাসরি আপনাকে আক্রমণ করেছি। একে মধ্যস্থতা বলে না। আপনার লেখাটার পরে ভাবছিলাম আমি লিখব। রাজু ভাবছিলেন রাজু লিখবেন। সকালে উঠে দেখি রাজু লিখে ফেলেছেন।
তারপর এলো আপনার ওই লেখা যে, আপনার পোস্টটা আমাকে বা রাজুকে নিয়ে ছিলই না। আপনার এই অস্বীকারে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি, কারণ সেটা আপনি করবেন আমি কল্পনাও করিনি। আপনি ওখানে লেখা আপনার কথাগুলোর লাইন-বাই-লাইন ধরে কী ব্যাখ্যা দেবেন আমি জানি না।
আপনি ওভাবে অস্বীকার করে বসলে, লিগালি স্পিকিং, কী আর বলার থাকে কারও। তাই "লিগ্যাল ক্ষমার" কথা বলেছি।
আর লিগ্যাল-এর বাইরে বিশ্বাসের যে জায়গা, সেখান থেকে বলি যে, আমি বিশ্বাস করি আপনার ওই পোস্ট আমাকে আর রাজুকে নিয়েই ছিল।
লেখকদের মধ্যে এই বেনামে পোস্ট, নাম-না-লেখা, নাম-না-বলা পোস্ট বন্ধ হোক। আমরা যা বলার তা উদ্দিষ্ট মানুষটাকে যেন সরাসরি বলি, সরাসরি নাম ধরেই শিষ্টাচার মেনে বলি।’
মাসরুর আরেফিনের মন্তব্যের জবাবে একই পোস্টে সুমন রহমান মন্তব্য করেন-
সুমন রহমানের মন্তব্য: ‘Mashrur Arefin: মাসরুর, আপনি দেখি খুব আনইন্টেলেকচুয়াল কথাবার্তা বলছেন! মানুষ স্বনামে লিখবে বেনামে লিখবে। নাম ধরে বলবে, নাম না-ধরেও বলবে। আপনি আমি সেসব ঠিক করে দেয়ার কেউ না। আবার শিষ্টাচার শেখাচ্ছেন! যে পোস্টের নিচে শিষ্টাচার শেখাচ্ছেন, সেটা ভাল করে পড়ে নিয়েছেন তো? আর যে পোস্টের জবাবে এসব করছেন, তাতে শিষ্টাচারের অভাব ছিল কোথায়?
না, মাসরুর। সেই পোস্টের লক্ষ কোনো ব্যক্তি না। একটা সিস্টেম। উপলক্ষ ব্যক্তি হতে পারে, কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। ব্যক্তি আক্রমণ দিয়ে সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। আমি সিস্টেমটার বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছি, ব্যক্তি আপনার প্রতি ভালোবাসা বহাল রেখে।’
রাজু আলাউদ্দিনের একই পোস্টে কথাসাহিত্যিক ও দেশ রূপান্তরের অনলাইন ইনচার্জ সালাহ উদ্দিন শুভ্র মাসরুর আরেফিনের প্রতি মন্তব্য করেন-
সালাহ উদ্দিন শুভ্রর মন্তব্য: ‘Mashrur Arefin: সুমন রহমানের স্ট্যাটাসে কামু ভাইয়ের উল্লেখ নাই। বোর্হেস অর্থে যদিও কল্পনা কইরা রাজু আলাউদ্দিনকে টানার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু মাসরুর আরেফিন এখানে কামু ভাইকে (কামরুজ্জামান) দেখতে পাওয়াটা তার ছোট মাস্তানির বহিঃপ্রকাশ।’
সালাহ উদ্দিন শুভ্রর মন্তব্যের জবাবে মাসরুর আরেফিন মন্তব্য করেন-
মাসরুর আরেফিনের মন্তব্য: ‘Salah Uddin Shuvro: মাস্তানি যারা করার তারা করে করে সবকিছু এই অবস্থায় এনেছে। আমি এই মাঠে ছিলামই না। স্রেফ এক অনুবাদক হয়ে পড়ে ছিলাম ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারির "আগস্ট আবছায়া" পর্যন্ত। কিন্তু তারপর গত দেড় বছরে যত মাস্তান দেখলাম তা সাহিত্য বাদে অন্য এরিয়ার সকল মাস্তানের যোগফলেরও বেশি।
আপনি যেহেতু তার হয়ে সবই জানেন, তাহলে তাকেই জিজ্ঞাসা করেন যে, “চাকরিশূন্য কবির কর্পোরেটে হানা দেওয়া”বলতে উনি আমাদের কোন কবিকে বুঝিয়েছেন? আমরা তো প্রত্যেককে চিনি। কে তার ভাষায় ওই "চাকরিশূন্য" কবি? আপনিই বলেন না?
বুঝে ফেলার মধ্যে মাস্তানি থাকে না, ভাই। মাস্তানির মধ্যে মাস্তানি থাকে।’
মাসরুর আরেফিনের মন্তব্যের জবাবে একই পোস্টে সালাহ উদ্দিন শুভ্র মন্তব্য করেন-
সালাহ উদ্দিন শুভ্রর মন্তব্য: ‘Mashrur Arefin: সুমন রহমান লিখেছেন “করোনায় চাকরিশূন্য কবির কর্পোরেটে হানা দেওয়া'' কামরুজ্জামান কামু করোনায় চাকরি হারান নাই। আপনি একজন কবির চাকরি পাওয়াকে আপনার অনুদান হিসাবে এখানে দেখিয়েছেন। এটা ব্যাড।
আর আমাকে সুমন রহমানের 'হয়ে' চিহ্নিত করাটাও মাস্তানি হইল।’
এই বিতর্ক শুরু হওয়ার একদিন পর সুমন রহমান তার ফেসবুক পেইজে আরেকটি মন্তব্য প্রকাশ করেন:
সুমন রহমানের পোস্ট–১৬. ১০. ২০/ দুপুর ১১টা ৫৪ মিনিট
‘১.
পৃথিবীতে ধনী ও গরিব সাহিত্যিক সবসময়ই ছিল। কর্পোরেট সাহিত্য বলে কিছু নেই। আছে কর্পোরেট প্রিডেটরি আচরণ। পুঁজির মায়াবি আবরণে। সাহিত্য এখানে পুঁজির একটা ডিসকার্সিভ স্পেইসমাত্র।
সাহিত্য ও সাহিত্যিকের যে ময়দানটিতে আমরা দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে সহযোগিতা আছে, সহমর্মিতা আছে, ক্লিশেপনা আছে, বিলো দ্য বেল্ট আছে, গোষ্ঠীসংঘাত আছে, নিন্দামন্দ মিথ্যার বেসাতিও আছে। প্রচারণা কিংবা আত্মপ্রচারণা যেমন আছে, তেমনি প্রতারণা কিংবা আত্মপ্রতারণাও কম নাই। এগুলোই একেকটি সময়ের সাহিত্যিক রাজনীতির সমাজতত্ত্ব। এটা একজন নির্ধারণ করে না। সমবায়িকভাবে নির্ধারিত হয়।
বড় লেখক যারা, তারা কখনো এককভাবে এসব রীতিকে পাল্টে দিতে পারেন। সেটি তাদের লেখার জোরে। দলবাজি, টাকা কিংবা ক্ষমতার জোরে নয়।
সাহিত্যের এই ছোট তরীতে বৃহৎ পুঁজি ঢুকে পড়লে কী ঘটে? পুঁজির ধর্মই ক্রমাগত নিজেকে বিস্তৃত করতে থাকা। কখনো কখনো নির্মমভাবে। মার্ক্স যেটাকে বলেছিলেন, প্রিমিটিভ অ্যাকিউমুলেশন। সারপ্লাস ভ্যালু তৈরি করা। সেটা শুধু অর্থনৈতিক ক্যাপিটাল তৈরির মাধ্যমে নয়, সোশ্যাল ও কালচারাল ক্যাপিটাল তৈরির মাধ্যমেও। কারণ ওসব সোশ্যাল ও কালচারাল ক্যাপিটাল একসময় ফাইনানশিয়াল ক্যাপিটালে কনভার্টেড হবে। ফলে মায়াবি পুঁজির দান-দক্ষিণা লোকদেখানো সিএসআর প্রজেক্ট! কিন্তু আড়ালে সে সবকিছু ভেঙেচুরে নিজের রাজ কায়েম করতে চায়। সাহিত্যের বিদ্যমান গোষ্ঠীগুলোকে ভেঙে দেয়, বিবাদগুলোকে পিষে ফেলে, বাঘে-ছাগে একঘাটে পানি খায়। সাহিত্য একপ্রকার সমবায়িক সামন্তদশার মধ্যে ছিল এতদিন, বাংলাদেশে। ফলে, এই বৃহৎ পুঁজির আগমনী তাকে টালমাটাল করে দেবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
কায়েমি পুঁজি যখন সমবায়িক সাহিত্যিক লেনদেনগুলোর মূল্য নির্ধারণ করতে শুরু করে, ব্যক্তি সাহিত্যিক তখন একটা অবভিয়াস অফেন্স অনুভব করতে শুরু করেন। মার্কস যাকে বলেছিলেন এলিয়েনেশন। কিংবা পিয়েরেঁ বোর্দো যাকে বলেন, সিম্বলিক ভায়োলেন্স।’
একই দিন রাত রাত ৮টা ২৮ মিনিটে মাসরুর আরেফিন ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ধর্ম ব্যবসা, এদেশের ‘এলিট’ ও ‘কর্পোরেট’ লেখক এবং ভাষিক খ্যাপামি নিয়ে মাসরুর আরেফিন’ শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বলেন:
মাসরুর আরেফিনের পোস্ট–১৬. ১০. ২০/ রাত সাড়ে ৮টা
‘… কাজী আনিস আহমেদকে না পড়েই এলিটিস্ট বলে খারিজ করতে চান, আমাকে কিংবা অনুবাদক ও গল্পকার ফারুক মঈনউদ্দিনকে ব্যাংক এমডি বলে উড়িয়ে দিতে চান, কবি ও নৃ-গবেষক কামাল চৌধুরীকে বড় আমলা বলে বাঁকা হাসি হাসতে চান।...এখানে ‘কর্পোরেট‘ নামের একটা গালি বানানো হয়েছে পুঁজির দৌরাত্ম্যকে বোঝাতে। একদম ক্লিশে একটা গালি। গালিটা আমাকে দেয় আবার ট্রান্সকম গ্রুপের মতো, তাদের প্রতিষ্ঠান ‘প্রথম আলো‘-র মতো বিগ কর্পোরেটে তেল ঢালতে থাকা লোকেরাই। শেয়াল শেয়ালকে বলে তুই শেয়াল। তাতে কোনো লাভ হয় না। সিস্টেম তখন হেসে বলে, ‘তুমি যে আমাকে চিনে আমাকে আমি যা তা-ই বলছ, সেটা জারি রাখো হাঁদারাম‘। পুঁজির সিস্টেম ওমনিপ্রেজেন্ট [সর্বত্র পরিব্যাপ্ত] একটা সিস্টেম, সে উপর-নিচ-বাম-ডান-সামনে-পেছনে সবখানে আছে। আপনি ওটার মাঝখানে ওটার মাখন খেতে খেতে দাঁড়িয়ে ওকে নিয়ে বলবেন তো, সবাই বুঝবে আপনার বেদনা আরও মাখন না পাওয়ার বেদনা।’
পর দিন সুমন রহমান তার মন্তব্যের দ্বিতীয় পর্বটি পোস্ট দেন:
সুমন রহমানের পোস্ট–১৭. ১০. ২০/ দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিট
‘২.
সাহিত্যিক ধনী কিংবা গরিব হওয়ার সাথে সাহিত্যের ধনী গরিব হওয়ার সম্পর্ক নাই। রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, সুকুমার রায়, সুধীন্দ্রনাথ এরা প্রত্যেকেই যথেষ্ঠ ধনাঢ্য ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে। ব্যক্তিগত উপার্জনের মাধ্যমে হুমায়ুন আহমেদ, পাওলো কোয়েলহো, জে কে রাউলিং ধনবান হয়েছেন। পাবলো নেরুদা, অকটাভিও পাজ, এইমে সেজেয়ার, নিকোলাস গ্যিয়েন, লিওপোল্ড সেংঘর, আহমাদ সেকেতুরে, সৈয়দ শামসুল হক, শশী থারুর এরা যথেষ্ঠ ক্ষমতাবান ছিলেন/আছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক অর্থে। এদের সাহিত্যকে কেউ বড়লোকের সাহিত্য বলে না। সাহিত্যের বিচারে, ধনী সুধীন্দ্রনাথ আর গরিব জীবনানন্দকে আমরা একবর্গেই রাখি। যেমন রাখি ধনী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর গরিব বিনয় মজুমদারকে।
"আগস্ট আবছায়া"র লেখক মাসরুর আরেফিন সম্প্রতি কোনো সাক্ষাৎকারে বলেছেন: "যারা এসব বলেন তারা ওরাই যারা সাহিত্যকে সাহিত্যের বাইরের মাপকাঠি দিয়ে মাপতে চান—কাজী আনিস আহমেদকে না পড়েই এলিটিস্ট বলে খারিজ করতে চান, আমাকে কিংবা অনুবাদক ও গল্পকার ফারুক মঈনউদ্দিনকে ব্যাংক এমডি বলে উড়িয়ে দিতে চান, কবি ও নৃ-গবেষক কামাল চৌধুরীকে বড় আমলা বলে বাঁকা হাসি হাসতে চান।"
মাসরুর সম্পর্কে পরে বলছি, বাকি তিনজন সম্পর্কে বলি। কাজী আনিস আহমেদ, ফারুক মঈনউদ্দিন কিংবা কামাল চৌধুরী কখনোই তাঁদের ব্যক্তিগত/সামাজিক/রাজনৈতিক ক্ষমতা সাহিত্যিক প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য ব্যবহার করেছেন -- এমনটা শুনি নি। কাজী আনিস আহমেদ ঢাকায় একটা লিটারারি ফেস্টিভ্যালের সাথে যুক্ত আছেন অনেক বছর ধরে। কখনো দেখি নি সেখানে তাঁর নিজের লেখা সাহিত্য নিয়ে কোনো আলোচনা/সেশন হয়েছে। তার The World in My Hands উপন্যাস বেরিয়েছে ২০১৩ সালে। বাংলা অনুবাদ বেরিয়েছে ২০১৭ সালে। তেমন কোনো রিভিউ চোখে পড়ে নি। চাইলে তিনি নিশ্চয়ই ভুরি ভুরি করিয়ে নিতে পারতেন। ২০২০ সালে আমি এই বইয়ের রিভিউ করলাম, কারণ আমার বিচারে গত দশ বছরে বাংলাদেশের লেখকদের লেখা উপন্যাসগুলো মধ্যে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। নানান কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্যকর্ম।
ফারুক মঈনউদ্দিন যে বড় ব্যাংকার, সেটি মাসরুর না জানালে মনে হয় বুঝতেই পারতাম না। এমনি অন্তরাল পছন্দ করা একজন নিমগ্ন সাহিত্যিক তিনি। কামাল চৌধুরীও তাই। নিজের সাহিত্য নিয়ে কোথাও তাঁকে কোনো উচ্চকিত আওয়াজ দিতে শুনি নি। এরা প্রত্যেকেই সাহিত্য এবং সাহিত্যের বাইরের মানুষজনকে নানাভাবে সহায়তা করেন, কিন্তু সেই শব্দ কখনোই বাইরে পৌঁছায় না। যারা বিভিন্ন সময়ে তাঁদের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছেন, তাদের বরাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি এটুক জেনেছি।
ফলে, মাসরুর আরেফিনকে এই বর্গে কল্পনা করাটা আমার জন্য কষ্টকর। তিনিও বহু মানুষকে সহায়তা দিয়েছেন মনে হয়। কিন্তু সেটি পাবলিকলি প্রচার করতে একেবারেই পিছপা নন। তাঁর বক্তব্য থেকেই জানলাম তিনি একজন কবিকে চাকরি দিয়েছেন, একজন লেখকের বই প্রকল্পে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, একজন অনুষ্ঠান নির্মাতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্পন্সর করছেন। কামাল চৌধুরী, ফারুক মঈনউদ্দিন কিংবা কাজী আনিস আহমেদরা এ ধরনের আলাপ পাবলিক পরিসরে কখনই করেন বলে শুনি নি।
একজন লেখক হিসেবে আমি সবচে কষ্ট পেয়েছি মাসরুর আরেফিন এর হাসান আজিজুল হক কাণ্ডে। আমাদের এই শীর্ষস্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিককে নিয়ে তিনি যে কাণ্ডটি ঘটালেন সেটি আমার মত বহু সাহিত্যিক ও পাঠককে বেদনা ও লজ্জা দিয়েছে। হাসান আজিজুল হক এবং অন্যান্যদের টাকা দিয়ে বইয়ের ব্লার্ব লিখাতেই পারেন তিনি। তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু হাসান আজিজুল হক যখন তাঁর নামে ছাপা হওয়ার বক্তব্য অস্বীকার করলেন, এবং মাসরুরের বইকে "বিদেশী সাহিত্যের বমন" জাতীয় অভিধা দিলেন, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মাসরুরের পোষা ভক্তকূল হা.আ.হককে নিয়ে যে ধরনের গুণ্ডাগার্দি করলেন, সেটা অবিশ্বাস্য। আরো অবিশ্বাস্য হল, পরবর্তীতে হাসান আজিজুল হক লিখিত ব্লার্বই দিলেন, মাসরুরের বইতে। অন্তরালে কী ধরনের তৎপরতা ঘটতে থাকলে এই বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে তাঁর বক্তব্য নিয়ে এমন ধকল পোহাতে হয়, সেটা অনুমান করা যায়। তাতে আমরা ভীত হয়েছি। বুঝতে পেরেছি যে, হাসান আজিজুল হকের মত মানুষেরই যদি এই দশা হয়, তবে আমাদের মত সামান্য লেখকদের গরিবি মর্যাদা যে কোনো সময়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে এই আগ্রাসী পুঁজির তাণ্ডবে।’
সুমন রহমানের দ্বিতীয় পোস্টের কিছুক্ষণ পরেই কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ তার ফেইসবুক পেইজে মন্তব্য করেন:
মাহবুব মোর্শেদের পোস্ট–১৭. ১০. ২০/ দুপুর দেড়টা
‘কাউকে চাকরি দিয়ে, স্পন্সর করে, আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে নানা উপলক্ষে সেটা প্রচার করা কোনোভাবেই ভাল ও সভ্য আচরণ নয়। তদুপরি, উপকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঋণের দায় হিসেবে পাবলিকলি প্রশংসা করে দেবার পর তো আর উপকারী ব্যক্তির আর কিছু বলার থাকতে পারে না।’
একই দিন ব্রাত্য রাইসু পোস্ট দেন:
ব্রাত্য রাইসুর পোস্ট–১৭. ১০. ২০/ বিকাল ৪টা ৪০ মিনিট
‘কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত সাহিত্য কি প্রকাশযোগ্য নয়?
প্রথম আলো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা সংস্থার নাম প্রথমা?
এখান থেকে কর্পোরেট বিরোধী কার কার বই বাইর হইছে? বা কার কারটা হয় নাই?
এ দেশের বেশিরভাগ সাহিত্যবোদ্ধারা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেন করে।
তারা কী হইলে সাহিত্য হবে কী হইলে হবে না এগুলি ঠিকঠাক করে।
ফকিন্নি প্রতিষ্ঠানের যেমন বই বের করার বা সাহিত্য করার রাইট আছে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানেরও বই বের করার এবং তা প্রচার করার রাইট আছে।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান যদি তাদের নিজস্ব লেখকদের দিয়া বই বের করে, বইয়ের আলোচনা করায় তাতে আপনার কী সমস্যা?
প্রথম আলোর কোলের মধ্যে বইসা কে পুরস্কার পাবে কে পাবে না সে বই বাছাইয়ের কাম কইরা এত বড় কথা চলে না।
সাহিত্য কোনো পবিত্র মাধ্যম নয়। যে কেউ সাহিত্য করতে পারবে।
এমনকি যারা কর্পোরেট, সরকার ও বড়লোকদের বই বের করার বিরোধী তারাও সাহিত্য করতে পারবে।
সাহিত্য কারা কারা করতে পারবে না বলেন?’
একই দিন দ্বিতীয় পোস্টে মাহবুব মোর্শেদ মন্তব্য করেন:
মাহবুব মোর্শেদের পোস্ট–১৭. ১০. ২০/ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা
‘এনারা সবাই কম বেশি ভাল লেখেন। তা সত্ত্বেও সুমন রহমান তার শিক্ষক শাহাদুজ্জামানের কাছ থেকে নানাবিধ শিক্ষা, বৃত্তি ও সুবিধার বিনিময়ে লেখক শাহাদুজ্জামানের অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক যে প্রশংসা করেন সেটা এক প্রকার দুর্নীতি।
তেমনিভাবে কামরুজ্জামান কামু তার ব্যাংকের বস মাসরুর আরেফিনের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তার লেখার যে অনর্থক প্রশংসা করেন সেটাও দুর্নীতিই।
ব্রাত্য রাইসু যখন কুড়ি বছর পর মেয়র ও মিউল নিয়ে অনুষ্ঠান করেন তার সঙ্গেও প্রাপ্তিযোগ আছে বলেই অনুমান করা যায়।
ফলে, বাংলা সাহিত্য মোটামুটিভাবে লেনদেনের মধ্যেই আবর্তিত হইতেছে। লেনদেন ছাড়া খুব একটা সাহিত্য আশপাশে দেখা যায় না।
হাসান আজিজুল হকের মতো সাহিত্যিকও যারপরনাই লেনদেনের শিকার হয়েছিলেন।’
এখানে উল্লেখ্য, সুমন রহমান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক। এই ইউনিভার্সিটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সহ-সভাপতি কাজী আনিস আহমেদ একজন ঔপন্যাসিক। ঢাকা লিস্ট ফেস্টের পরিচালক তিনি। এছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আওতাধীন প্রাথমিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে চার বছরের জন্য সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসাবে বৃত্তি পেয়েছেন সুমন রহমান। সুমন রহমানের শিক্ষক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের বাস যুক্তরাজ্যে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সে চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক তিনি। এর আগে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অধ্যপনা করেছেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়, নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও। তাছাড়া ২০২০ সালে প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই পুরস্কারের জুরি কমিটির একজন সদস্য ছিলেন সুমন রহমান। সে বছর শাহাদুজ্জামানের মামলার সাক্ষী ময়না পাখি সৃজনশীল শাখায় প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পায়। সুমন রহমানের নিরপরাধ ঘুম বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পায় ২০১৯ সালে।
মাসরুর আরেফিন দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এই ব্যাংকে জানুয়ারিতে ‘সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন’ হিসেবে যোগ দেন কবি কামরুজ্জামান কামু। একই ব্যাংকে ‘এক্সটারনাল কনসালটেন্ট অব সোশ্যাল মিডিয়া’ হিসেবে কাজ করেন কবি ব্রাত্য রাইসু। তিনি ‘দ’ এবং ‘বহিঃপ্রকাশ’ নামে দুটি প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী। ‘দ’ থেকে মাসরুর আরেফিনের প্রথম বই ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। মাহবুব মোর্শেদ দৈনিক সংবাদপত্র ‘দেশ রূপান্তর’-এর উপসম্পাদক। রাজু আলাউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন।
মাহবুব মোর্শেদের উপরোল্লিখিত পোস্টে ব্রাত্য রাইসু মন্তব্য করেন:
ব্রাত্য রাইসুর মন্তব্য: ‘না মাহবুব, প্রাপ্তিযোগ এর ব্যাপার ছিল না। কিন্তু প্রাপ্তিযোগ নিয়া অনুষ্ঠান করাতেও আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি আপনার থেকে একেবারেই ভিন্ন নৈতিকতার লোক।
আমি সাহিত্যে দলবাজি, বন্ধুকৃত্য, প্রাপ্তিযোগ-এর কারণে সাহিত্য সবকিছুকে বৈধ মনে করি।
এমনকি গরিবের জমি বড়লোকরা দখল করবে সাহিত্যের নামে, তাতেও আপত্তি দেখি না। যদি সব লিগ্যাল কাগজপত্রসহ হয়।’
একই পোস্টে মাহবুব মোর্শেদের উদ্দেশে সুমন রহমান মন্তব্য করেন:
সুমন রহমানের মন্তব্য: ‘শাহাদুজ্জামান আমার শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে আমরা সহ-গবেষক। আমি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথভাবে গবেষণা করি। আপনারা যারা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে শিক্ষামূলক পেশার সাথে যুক্ত নন, তাদের পক্ষে জিনিসটা বোঝা একটু কঠিন হতে পারে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এরকম কাজের সম্পর্ক খুবই কমন ঘটনা।
শাহাদুজ্জামান খুব ভাল একজন শিক্ষক। অনুপ্রাণিত করতে পারেন। প্রশংসা করতে পারেন। সাহিত্যিক হিসেবেও আমার পছন্দের। কিন্তু তার "অপ্রয়োজনীয়" লেখার প্রশংসা কোথায় করেছি মাহবুব? দৃষ্টান্ত দেয়ার অনুরোধ জানাই।’
একই দিন তৃতীয় পোস্টে মাহবুব মোর্শেদ লেখেন:
মাহবুব মোর্শেদের পোস্ট–১৭. ১০. ২০/ রাত সাড়ে ৮টা
‘চাকরি দিয়ে কেউ যদি কাউরে বসায়ে বেতন দেয় তাহলে সেটাকে একধরনের অনুদান বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু চাকরি দিয়ে কাজ করায়ে নিলে কেমনে সেটা আর অনুদান থাকে?’
মাহবুব মোর্শেদের পোস্টের পর কামরুজ্জামান কামু তার ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করেন:
কামরুজ্জামান কামুর পোস্ট–১.৭ ১০. ২০/ রাত সাড়ে ১১টা
‘মাহবুব মোর্শেদ ছেলেটা বড়ো হীনমন্য ছেলে। একবার নয় বার বার, যুগ যুগ ধরে সে আমাকে ছোট করার চেষ্টা করে আসতেছে। আমি তাকে স্নেহের জায়গা থেকে বরাবর ছাড় দিয়ে আসছি। আমি মাসুদ খানের লেখা পছন্দ করি কেন, রাইসুর লেখা আমার ভালো লাগে কেন, এখন মাসরুরের লেখা আমার ভালো লাগে কেন, এইসব নিয়ে তার সমস্যা! সে নিজের প্রচার চায়। ভালো কথা, তোমার প্রশংসা তো আমি করছি। এখন তোমার চাহিদামত আমাকে চলতে হবে? বাংলা সাহিত্যে কি তুমি একলাই থাকতে চাও? আর কাউরে বিকশিত হইতে দিবা না? তোমার এতো সমস্যা কেন দুনিয়ায়? বড়ো হও। তোমার পত্রিকায় চাকরি হইতে দেও নাই ঠিকাছে। আমারে কোথাও চাকরি করে খাইতে দিবা না।’
এরপর ১৭ অক্টোবর রাত ১১টা ২২ মিনিটে সুমন রহমান একটি পোস্ট দিয়ে সেখানে এই তর্কের বিভিন্ন মন্তব্যগুলো পুনরায় তুলে ধরেন। শেষে তিনি মাসরুরকে উদ্দেশ্য করে এই মন্তব্য করেন:
সুমন রহমানের পোস্ট–১৭. ১০. ২০/ রাত সাড়ে ১১টা
‘… আপনি পরিষ্কার করে জানালেন, এই রাজু আলাউদ্দিন যাকে "কর্পোরেটের ঘেঁটুপুত্র" কিংবা "পুরুষবেশ্যা" বলছেন, সেটা আমি। কেন? কারণ আমি কাজী আনিস আহমেদের বই রিভিউ করেছি, এবং শাহাদুজ্জামানের লেখার পক্ষে দাঁড়িয়েছি। আপনার প্রতি আমার কয়েকটা জিজ্ঞাসা, মাসরুর:
১. কাজী আনিস কিংবা শাহাদুজ্জামান বাংলাদেশের বা বাংলা সাহিত্যের কী এমন ক্ষতি করে ফেললেন যে, তাদের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করলে কাউকে "ঘেঁটুপুত্র" কিংবা "পুরুষবেশ্যা" গালাগাল শুনতে হবে? রাজুর এই বক্তব্যের দায় আপনি কেন নিতে গেলেন?
২. আমার লেখায় শিষ্টাচারের কোনো অভাব ছিল কিনা, আমি কোনো ব্যক্তির নামোল্লেখ করেছিলাম কি না, যার কারণে রাজু আলাউদ্দিনের এই নোংরা বক্তব্যকে আপনার এনডোর্স করতে হল?
৩. রাজুর এই বক্তব্য যদি আপনার কাছে নোংরা কিংবা আপত্তিকর মনে হয়, তবে সেটি থেকে আপনার সমর্থন প্রকাশ্যে প্রত্যাহার করে নেবেন কিনা?
৪. এরকম নোংরা বক্তব্য দেয়ার জন্য রাজু আলাউদ্দিনকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলবেন কিনা?’
সুমন রহমানের পোস্টে মাহবুব মোর্শেদ মন্তব্য করেন:
মাহবুব মোর্শেদের মন্তব্য: ‘আপনারা যারা একই রকম তারা এক থাকলেই খুশী আমরা। আমার মনে হয়, রাজু আলাউদ্দিন মাফ না চাইলেও মিলে যাওয়া উচিত। রাজু ভাই বয়সে সবার চেয়ে বড়। একটু বকা তো দিতেই পারে। তবে রাজু ভাইয়ের সুক্ষ্ম ব্যাপারগুলো চলে যাচ্ছে। কেমন র হয়ে যাচ্ছে। তার ভাষা বিস্ময়কর রকমে আপত্তিকর।’
পরদিন ব্রাত্য রাইসু পোস্ট দেন:
ব্রাত্য রাইসুর পোস্ট–১৮. ১০. ২০/ সকাল ১০টা
‘কর্পোরেট হিপোক্রিসি ~
এরা কর্পোরেট হাউজে চাকরি করে।
কপোর্রেট বসকে বই উৎসর্গ করে।
কপোর্রেট মালিকের বই আলোচনার নামে বইয়ের প্রশংসা করে।
কর্পোরেটের দেওয়া সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করে।
কর্পোরেট কাকে সাহিত্য পুরস্কার দিবে সে বই বাইছা দেওয়ার কাজটি করে।
তারপরে বলে, কপোর্রেট সাহিত্য চলবে না।
বলে, কর্পোরেট বসদের বই আলোচনা করা যাবে না।
বলে, বন্ধুদেরকে কর্পোরেট অফিসে চাকরি দিলে সে বন্ধুদের কোনো প্রশংসা গ্রহণ করা যাবে না। করলে তা দুর্বৃত্তায়ন হবে। ইত্যাদি।
এই ইত্যাদিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
গণতন্ত্র হিপোক্রিসিকে জায়গা দেয়।
তাই আমি গণতন্ত্র ভালোবাসি।
হিপোক্রিসিকে তো অবশ্যই।’
একই দিন মাহবুব মোর্শেদ ব্রাত্য রাইসুকে উদ্দেশ্য করে একটি পোস্ট দেন:
মাহবুব মোর্শেদের পোস্ট–১৮. ১০. ২০/ দুপুর সাড়ে ১২টা
‘আমি কি কর্পোরেট বিরোধিতার কথা বলছি? প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলছি? অবস্থাপন্ন সাহিত্যিকদের শ্রেনীগত অবস্থানের বিরুদ্ধে বলছি? বিপ্লব করতে চাচ্ছি? গরিব মানুষের সাহিত্য তৈরির কথা বলছি?
সাম্প্রতিক কিছু বিতর্ক কেন্দ্র করে ব্রাত্য রাইসু এমন অনেক প্রশ্ন তুলছেন। তার প্রশ্নগুলোর মধ্যে প্রশ্নের চেয়ে কৌশল বেশি। প্রথমে তিনি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, আমি কর্পোরেট বিরোধিতা করছি। পরে দেখাচ্ছেন, আমি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। তারমানে আমার কর্পোরেট বিরোধিতা আসলে স্ববিরোধী।
তেমনিভাবে তিনি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করছি। পরে দেখাচ্ছেন আমি নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। ফলে আমার অবস্থানটা গুরুত্ব বহন করে না।
একইভাবে, অবস্থাপন্ন অনেক সাহিত্যিক বন্ধু আমারও আছে। ফলে অবস্থাপন্নদের বিরোধিতা আসলে আমার একটা ভান।
বিপ্লব করতে চাইছি? বিপ্লব করার জায়গা তো সাহিত্য না। গরিব মানুষের সাহিত্য রচনা তো পুরনো মার্কসবাদী ব্যাপার। বাকী থাকে কী? ব্যক্তিগত অসূয়া? ব্রাত্য রাইসু ভোট আয়োজন করছেন। কর্পোরেট ক্ষমতা বাদ দিয়ে বলেন কে বড় ঔপন্যাসিক।
এগুলো সবই তার চালাকি। তিনি যেখানে দেখাতে চাইছেন সমস্যা আসলে সেখানে না। তবু তিনি ওই জায়গাগুলোতে আঙ্গুল তুলছেন। কারণ সমস্যাগুলো থেকে তিনি অন্যদিকে মনোযোগ সরাতে চান।
তর্ক যেহেতু মাসরুর আরেফিনকে নিয়ে হচ্ছে। তাকে দিয়েই আলোচনা শুরু করি। আমার পরিচিত একজন সাহিত্যিক একটা বড় ব্যাংকের এমডি এটা ব্যক্তিগতভাবে গর্বের বিষয়। তদুপরি তার সঙ্গে আমার আলাপ আছে। তিনি অল্প যে কয়জন লোককে তার পোস্টে ট্যাগ করেন তার মধ্যে আমার গর্বিত উপস্থিতি আছে। তিনি আমার ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের চাকরি দেন। বিজ্ঞাপন দেন। স্পন্সর করেন। সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানে অনুদান দেন। এগুলো সবই আমার জন্য খুশীর খবর। বাংলাদেশে কত ব্যাংক। কই তেমন কোনো ব্যাংক তো এমন সাহিত্যবান্ধব নয়। ফলে, মাসরুর আরেফিনকে আলাদা করে ধন্যবাদ দিতে হবে। তার অবস্থান, অবস্থা, অবস্থাপন্নতা নিয়ে আপত্তির কিছু নাই। শ্রেণী বিপ্লবেরও কিছু নেই। বলতে গেলে, এত কিছুর পরও কোনো দরকারে আমি মাসরুর আরেফিনের কাছে যেতেই পছন্দ করবো। যেহেতু তিনি আমার পরিচিত এবং তার ফোন নাম্বার আমার কাছে আছে। পাশাপাশি, অবস্থাপন্ন ও উচ্চপদস্থ বলে তাকে সমীহও করবো।
কিন্তু তার উপকার নিয়ে আমি কখনো সামাজিক পরিমণ্ডলে তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো না যাতে তাকে ব্রাত্য রাইসু বা কামরুজ্জামান কামুর চেয়ে বড় কবি মনে হয়। কেননা তার অর্থনৈতিক অবস্থান সহসা সাহিত্যিক অবস্থানে কনভার্ট হবে না। সুবিধাজনক আর্থিক অবস্থানের কারণে তিনি সুবিধাজনক সাহিত্যিক অবস্থান পাবেন না। তিনি যাতে সেটা না পান সেটা নিশ্চিত করাই সাহিত্য সমাজের কাজ। এই কাজটা না করতে পারলে এরশাদ কত আগে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের চাইতে বড় কবি হয়ে যেতেন।
কিন্তু, সমাজের বিপদগ্রস্ত লোকদের জন্য কাজটা পারা যায় না। ফলে, ক্ষমতাবানরা কিছু বাড়তি সুযোগ পেয়েই যান। কিন্তু সেটারও রাশ টানা উচিত। যে কারণে আমার এই সমালোচনামূলক অবস্থান। এটুকু বলা যে, আপনারা যা করছেন, এটা আমরা বুঝি। দেখছি। ওকে করতে থাকেন।
সাহিত্যে নানা পলিটিকসের জনক হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যের রাজনীতির শিকার হিসেবে আমি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কথা বলি। উনি নানা কারণে আমার অপছন্দের ব্যক্তি। আমার সাথে যোগাযোগ বলতে কিছুই নেই। কিন্তু তার অনেক কবিতা আমার ভাল লাগে। একটা উপন্যাস ও গল্পের বই বেরিয়েছে। সেগুলো অসাধারণ। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ কোনো পুরস্কার পান না। তিনি দেশে এলে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। তার বইয়ের ওপর তেমন কেউ লেখে না। আর এটা যেন একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। অথচ তার বন্ধুরাই পুরস্কার দেন। অনুষ্ঠান করেন। আলোচনা তোলেন। কিন্তু অনেক কিছু হয় সুব্রতকে বাদ দিয়ে। কেননা, সুব্রতর অতো টাকা নাই। সুব্রতর প্রতিপত্তি নাই। এখন যার টাকা আছে তাকে আপনি যখন পুরস্কার দিতে থাকবেন, তাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে থাকবেন, তার কবিতা গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে ছাপতে থাকবেন, খোলে আম তার নানা প্রশংসা করতে থাকবেন তখন আসলে আপনি সাহিত্যের না টাকার কদর করছেন। সুব্রত আপনার বন্ধু। তার জন্য আপনি কিছুই করছেন না। কেন করছেন না? একবার ভাবেন। তাহলে বুঝতে পারবেন মাসরুরের জন্য কেন এত করছেন। মিনিটে মিনিটে স্টেটাস দিচ্ছেন। দলবল নামিয়ে দিয়েছেন। আপত্তিকর স্টেটাস নিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন।
এ কাজ যে করছে তার জন্য অবমাননার। আবার যার জন্য করা হচ্ছে তার জন্যও অবমাননার।
আগের কালে নানা কাহিনী আমরা দেখতাম। সাহিত্যিকই নন এমন ব্যক্তিরা মদ খাইয়ে, টাকা বিলিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে নাম কামাতেন। সমাজের নতুন অঙ্গনে প্রতিপত্তি তৈরি করতেন। মাসরুরকে কেন সে পথে যেতে হবে? তিনি তো ২০ বছর আগে থেকে আমাদের কাছে লেখক।
মাসরুর আরেফিন ভাল লেখেন। তিনি ভাল কবি। ঔপন্যাসিক হিসেবেও ভাল। তিনি ব্রাত্য রাইসুর সমপর্যায়ের কবি না হলেও মিউলের কারণে আলোচনায় থাকবেন। কবি হিসেবে জাফর আহমদ রাশেদ যে আলোচনায় থাকেন তেমনটা তারও প্রাপ্য। আবার ঔপন্যাসিক হিসাবেও তিনি ভাল। ঔপন্যাসিক হিসেবে তার প্রাপ্য স্বীকৃতির লেভেলটা আমার মতে সাগুফতা শারমিনের ওপরে থাকা উচিত। কিন্তু প্রথম আলো, অন্য মিডিয়া ব্রাত্য রাইসু, কামুর প্রচার দেখে মনে হয় দেশের কবিতায় রিলকে, উপন্যাসে তলস্তয়ের আবির্ভাব ঘটেছে। এটা মাসরুরের জন্য ভয়াবহ আত্মপ্রতারণা। কেননা, সাহিত্যগুনে এই হাইপ তৈরি হচ্ছে না। এটা বিজ্ঞাপনী ব্যাপার। ব্রাত্য রাইসু বলবেন, বিজ্ঞাপন তো নিষিদ্ধ নয়। বই ও লেখা তার পণ্য। তিনি বিজ্ঞাপন দিয়ে সেটাকে বড় করে তুলবেন। এতে আপত্তির কী আছে। বিজ্ঞাপন দিতে খরচা আছে। সেটাই তিনি করছেন।
তিনি করুন। এখন কেউ যদি মনে করে এটা ঠিক হচ্ছে না, জিনিশের মান অতো ওপরে নয়, সেটা বলার অধিকারও তার থাকবে। কিন্তু সেটা বলায় সুমন রহমানকে যেভাবে অপদস্ত করা হলো সেটা মাস্তানি। তারমানে অর্থ, প্রতিপত্তি ক্রমান্বয়ে পেশীশক্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির দিকে যাচ্ছে। হাসান আজিজুল হক প্রসঙ্গে এমন অভিযোগ আমরা শুনেছিলাম।
ফলে, ব্রাত্য রাইসু তত্ত্ব কপচানোর আড়ালে যা করছেন তা আসলে এক ধরনের মাস্তানির প্রতি উস্কানি। এগুলো শেষ পর্যন্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। কেউ উপকার নেয়, কেউ উপকার করে। প্রতিদান দেয়। কিন্তু বিনিময় প্রথা তো আধুনিক যুগেই কত উন্নত হয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তিগত উপকার প্রাপ্তিকে একেবারে সাহিত্যের নৈতিকতা বা অনৈতিকতা হিসেবে প্রতিপন্ন করার কোনো মানে আছে?
যেটা দেখতে পেলাম, তাতে মনে হচ্ছে, একটা ছোটখাট মাস্তান দলও গঠিত হয়েছে। আমার প্রতিবাদ আসলে এই ক্ষমতা ও পেশীশক্তির বিপক্ষে। মাসরুর আরেফিনকে ব্যবহার করে সাহিত্যে যে অনৈতিক চক্র গড়ে তোলার প্রয়াস ওনারা পাচ্ছেন তার বিপক্ষে ক্ষুদ্র প্রতিবাদ ছাড়া এ কিছু নয়।’
মাহবুব মোর্শেদের এই পোস্টে ব্রাত্য রাইসু মন্তব্য করেন:
ব্রাত্য রাইসুর মন্তব্য: ‘আমি সাহিত্যিক কৌশল, মাস্তানি, দলবাজি ও বন্ধুকৃত্য করতে খুবই রাজি আছি। এগুলি মাহবুব নিজেও করেন, তার বন্ধুরাও করেন।
এই যে Dilshana Parul বললেন, "কন্ঠ লাগলে আওয়াজ দিয়েন!" এগুলি কী? প্রচ্ছন্ন নয়, প্রত্যক্ষ মাস্তানি। প্রলেতারিয়েতের দাবি আদায়ের আওয়াজের মতোই মনে হবে, কিন্তু মাস্তানি। তবে আমি এর বিরুদ্ধে না।
আমার এই সাহিত্যিক জিনিসগুলি মাহবুবের মধ্যেও আছে। সাথে আছে না জাইনাই টপ কইরা সত্য বলার মতো আওয়াজ দেওয়া। পরে মিথ্যা হিসাবে প্রমাণ দিলে স্বীকার না কইরা চুপ মাইরা যাওয়া। এইটা অবশ্য ওনার দুর্বলতাই। মিথ্যা বলা না, চুপ মাইরা যাওয়াটা।
আমি নিজে টুল হিসাবে মিথ্যা ব্যবহারের বিপক্ষে না। যেহেতু মিথ্যাকে পাকড়াও করা যায়। মিথ্যা প্রমাণিত হইলে সত্য বাইর হইয়া আসে। কিন্তু মিথ্যা বলাকে পাপের জায়গায় দেখার যে ভঙ্গি এইটা একজন সমালোচককে যতটা মুমীন হিসাবে দেখায়, ততটা সমালোচক হিসাবে দেখায় না।
২.
মাসরুর আরেফিনের সাহিত্যিক প্রতিভা মাহবুবের চাইতে বেশি এই রকম যদি আমি প্রচার করি সেইটা যেমন আমার মাসরুরের প্রতি বন্ধুকৃত্য হবে, তেমনি আমার তা মূল্যায়নও। আমারে প্রধান বিচারপতির আসন না দিয়া একজন সমালোচকের জায়গায় রাইখা সাহিত্যগত ভাবেই তার বিচার করতে হবে। এইটাই সাহিত্যিক ভদ্রতা।
এমনকি আমি যদি নিজের সাহিত্য লইয়া বড় বড় কথা বলি তার বিচারও সাহিত্যিক তুলনা দিয়াই সারতে হবে।
অন্য যে কোনো সন্দেহ, রিপোর্ট, অভিমান, হায়হুতাশ, কান্দাকাটির কোনো জায়গা নাই সাহিত্যে। সেসবের আলাদা সাহিত্য মূল্য থাকতে পারে, কিন্তু সমালোচনা মূল্য থাকবে না।
৩.
সততা ভালো, সততার চাইতে সাহিত্যে জোর বেশি তুলনার। মূলত সাহিত্য সমাজ চলেই তুলনার রাজনীতি দিয়া। কে কার চাইতে বড় আর ছোট এই নির্ধারণই সাহিত্য।
আপনারা জানেন, মাসরুর আরেফিনকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বা কবি আমি এখনও বলি নাই, তবে রবীন্দ্রনাথ যে মাঝারি কবি আমি তা বলছি।
রবীন্দ্রনাথকে মাঝারি বলাটা মাসরুরকে বড় করার কৌশল না। রবীন্দ্রনাথরে মাঝারি দেখানোই। তেমনি মাসরুরের 'ঈশ্বরদী' কবিতাকে যখন মহাকাব্য বলতেছি তা যে মহাকাব্য না সেইটা দেখানোর দায়িত্ব যিনি আপত্তি করবেন তার।
৪.
কৌশল হিসাবে আমি কিছু করি না, এইসব কিছু রাইসু ভাইই করে--এইটাও একটা কৌশল; মাহবুবের যে সেইটা আছে তাই আমি মাহবুব মোর্শেদকে বেশি পছন্দ করি।
তিনি টাফ, তিনি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান আইটেমগুলিরেই সমস্যা আকারে দেখাইতে পারেন, তাই সবাই তা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে। এইটা একটা গুণ। উকিলদের জন্যে ভালো। মাহবুব যদি তার বোকা পাঠকদের বাদ দিয়া লেখকদেরকে তার পাঠক হিসাবে চান তবে চাইলে এই পন্থা বাদ দিয়া সাহিত্যের খোলা ময়দানে তিনি যোগ দিতে পারেন।
৫.
আমি মাহবুব মোর্শেদকে গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক মনে করি। কিন্তু তিনি বড় বেশি পরিপার্শ্ব নিয়া ভাবেন। তার উচিত শুধু নিজের উপন্যাসগুলি লেখা। এবং লিখতে গিয়া যাদের জন্যে লিখতেছেন তাদের জন্যে না লেখা। শুধু নিজের জন্যে লেখা।’
আলমগীর নিষাদ: কবি ও সাংবাদিক
রমজান উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা সিরিজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন (বিআইআরই)।
গত ১৫ মার্চ এ আলোচনা শুরু হয়, যা চলবে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এটি প্রতি শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আলোচনার প্রথম পর্বে ১৫ মার্চ বিকেল পৌনে পাঁচটায় বাংলায় সুফি দর্শন নিয়ে কথা বলেন তাহমিদাল জামি। দ্বিতীয় পর্বে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ইসলাম ও ইহজাগতিকতা নিয়ে একই দিন সন্ধ্যা ৭টায় আলাপ শুরু করেন পারভেজ আলম।
আগামী ২২ মার্চ বেলা তিনটায় আলোচনার তৃতীয় পর্বে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে কথা বলবেন মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। একই বক্তা ওই দিন সন্ধ্যা সাতটায় চতুর্থ পর্বে বাংলায় খ্রিষ্ট ধর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন।
আলোচনা সিরিজের পঞ্চম পর্বে আগামী ২৯ মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় কথা বলবেন অধ্যাপক জিনবোধি মহাথেরো।
সাত পর্বের এ সিরিজের সমাপনী দিন ষষ্ঠ ও সপ্তম পর্বের আলোচনা হবে। ওই দিন বেলা তিনটা থেকে বাংলার ফকিরি দর্শন নিয়ে আলাপ করবেন অরূপ রাহী। আর সন্ধ্যা সাতটায় বাংলাদেশ ও ইউরোপের ধর্মের পর্যালোচনা বিষয়ে কথা বলবেন গৌতম দাস।
আলাপগুলো দেখা যাবে বিআইআরইর ইউটিউব চ্যানেলের এই লিংকে।
আরও পড়ুন:শেষ হলো বাঙালির প্রাণের অমর একুশে বইমেলা। বিদায়ের সুরে পর্দা নামল এবারের অধিবর্ষের বইমেলায়। একইসঙ্গে শুরু হলো আগামী বছরের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রতীক্ষা।
চলতি বছরের আয়োজনে ৬০ কোটি টাকার বেশি বই বিক্রি হয়েছে। নতুন বই প্রকাশ হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১টি। গত বছর মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৪৭ কোটি টাকা মূল্যের বেশি। আর নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিলো ৩ হাজার ৭৩০টি৷
এবারের মেলায় শুক্রবার (১ মার্চ) পর্যন্ত দর্শনার্থীর সংখ্যা ৬০ লাখের কাছাকাছি। নতুন ৬০০ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। মেলায় ৯ শতাধিক স্টল ও ৬৭০টি প্রকাশনী ছিল।
শেষ দিন শনিবার বইমেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা মেলে ভিন্ন চিত্র। অন্তিম দিনে ছিলো না অন্যান্য দিনের মতো ভিড়। অন্য দিনের তুলনায় জমেনি মেলাও। দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। স্টলে স্টলে শুধুই ক্রেতা ও পাঠকের ভিড়। বইপ্রেমীদের ব্যাগ ভর্তি বই কিনতে দেখা যায়। অধিকাংশ পাঠককে হাতে বই নিয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। বই ছাড়া মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়ছিলেন না কেউই।
এদিন ব্যস্ত সময় পার করেন বিক্রেতা ও প্রকাশকরা। সঙ্গে ছিলেন লেখকরাও। মেলার শেষ দিন হওয়ায় বই গোছাচ্ছেন কর্মীরা। প্রদর্শনী থেকে বইগুলো প্যাকেজিং করে বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়া চলতে থাকে সন্ধ্যার পর থেকেই। তবে বাংলা একাডেমির নির্দেশনায় কোনো প্রকাশনীই এদিন অবশিষ্ট বই মেলা থেকে নিয়ে যেতে পারেনি।
বেশ কয়েকজন বিক্রয়কর্মী জানান, মেলায় শেষ দিন দর্শনার্থী কম হলেও বেচাকেনা ভালো হয়েছে। যারা স্টলে আসছেন তাদের প্রায় সবাই বই কিনেছেন। কেবল ঘুরতে আসা মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
মেলায় আসা লিমন ইসলাম লিটন বললেন, ‘শেষ দিন মেলায় এসেছি। প্রথম দিকে একবার এসেছিলাম। এখন শুধু তালিকা ধরে বই কিনেছি। এবারের মেলায় এখনও আগের ফিকশনগুলোই চলছে। তবে বইমেলা বেশ ভালো চলেছে বলে মনে হয়েছে।’
শব্দশৈলী প্রকাশনীর প্রকাশক ইফতেখার আমীন বলেন, ‘মেলার সময় বাড়ানোর কারণে বেশ ভালো বিক্রি হয়েছে। আজ (শনিবার) বই কেনেননি এমন ক্রেতা মেলায় চোখে পড়েনি। প্রবন্ধ, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাস্থ্যবিষয়ক ও বাচ্চাদের নৈতিকতার বই বেশি বেচাকেনা হয়েছে।’
অনুপম প্রকাশনীর প্রকাশক মিলন কান্তি নাথ বলেন, ‘বইমেলার সময় বৃদ্ধি করায় বড় বড় প্রকাশনীগুলো লাভবান হয়েছে। আমাদের বেচাকেনা বেশ ভালোই হয়েছে। ক্রেতারা এসেছেন, বই কিনেছেন। এবারের বইমেলা বেশ ভালোভাবেই গেল।’
এদিকে অমর একুশে বইমেলার ৩১তম দিনে শনিবার মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। শেষ দিন মেলায় নতুন বই এসেছে ১৪৯টি।
বিকেল ৫টায় মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এর সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলামের লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন একাডেমির উপ-পরিচালক ড. সাহেদ মন্তাজ।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সম্মানিত অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম নাহিদ ইজাহার খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ।
বক্তব্য দেন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেড-এর সিএমও মীর নওবত আলী।
সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘এবার ছিল অধিবর্ষের বইমেলা। নির্ধারিত ২৯ দিনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অতিরিক্ত দুদিন যুক্ত হয়ে ৩১ দিনের দীর্ঘ বইমেলা শেষ হয়েছে। ২০২৪-এর বইমেলা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিল বিস্তৃত, ব্যাপক ও বর্ণাঢ্য।
‘শীতে শুরু হয়ে বইমেলা স্পর্শ করেছে বসন্ত-বাতাস। একুশের রক্তপলাশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্চের চেতনার রং।’
সদস্য সচিব তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এবারের বইমেলায় শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। বাংলা একাডেমি বিক্রি করেছে এক কোটি ৩৬ লাখ টাকার বই।’
ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা বাঙালির ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বইমেলার মাধ্যমে প্রতিবছর আমরা আমাদের সৃজনশীলতাকে উদযাপন করি। এই মেলা আমাদের আবেগের, জাতিসত্তার, ভাষা-সাহিত্য ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসার মেলা।
বেগম নাহিদ ইজাহার খান বলেন, ‘বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। এই মেলা দেখতে দেখতে চার দশক অতিক্রম করে এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব বাঙালির কাছে যেমন ঠিক তেমনই বিশ্বের জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছেও একুশের বইমেলা এক অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।’
মীর নওবত আলী বলেন, ‘বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে সহযোগিতায় থাকতে পেরে বিকাশ লিমিটেড আনন্দিত ও গর্বিত।’
খলিল আহমদ বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা কেবল বই বিক্রির জায়গা নয়; দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রাণের মেলা। সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় এবারের মেলা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।’
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা। তথ্য-প্রযুক্তির বিপুল বিকাশের পরও মুদ্রিত বইয়ের আবেদন যে কোনোমতেই ফুরিয়ে যায়নি তার প্রমাণ একুশে বইমেলায় ক্রমবর্ধমান জনসমাগম।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ প্রদান
অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশ-কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয়।
২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে মনজুর আহমদ রচিত ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর’ গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশন, মঈন আহমেদ রচিত ‘যাত্রাতিহাস: বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত’ গ্রন্থের জন্য ঐতিহ্য এবং আলমগীর সাত্তার রচিত ‘কিলো ফ্লাইট’ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস-কে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয় ময়ূরপঙ্খি-কে।
এবারের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যপ্রকাশ (প্যাভিলিয়ন), নিমফিয়া পাবলিকেশন (২-৪ ইউনিট) ও বেঙ্গল বুকস (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. শাহাদাৎ হোসেন এবং উপ-পরিচালক সায়েরা হাবীব।
আরও পড়ুন:অমর একুশে বইমেলা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল দুদিন আগে বৃহস্পতিবারই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুমোদনক্রমে মেলার সময় বাড়ানো হয়েছে দুদিন। বর্ধিত সেই সময় শেষ হচ্ছে আজ।
তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে মেলার সময় বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছিল সে অনুযায়ী বই বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা। তাদের ভাষ্য, বেইলি রোডের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনা পাঠকদের আলোড়িত করেছে। এ অবস্থায় মেলা শেষ হওয়ার আগের দিন শুক্রবার হওয়া সত্ত্বেও ভিড় ও বিক্রি ছিল কম।
আবার অনেকে বলছেন, মেলার সময় বাড়ানোর তথ্যটা যে পরিমাণে প্রচার হওয়া দরকার ছিল সেই পরিমাণে হয়নি। তাই অনেকে জানেনই না যে মেলার সময় বেড়েছে।
সাধারণত প্রাণের অমর একুশে বইমেলা হয় ২৮ দিনে। তবে এ বছর অধিবর্ষ হওয়ায় মেলা একদিন বেশি পেয়ে দাঁড়ায় ২৯ দিনে। তার ওপর ২৯তম দিনটি বৃহস্পতিবার হওয়ায় প্রকাশকদের দাবি ছিল মেলার সময় বাড়িয়ে শনিবার পর্যন্ত নেয়ার। তাদের দাবি মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুমোদনক্রমে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিয়ে বইমেলার সময় দুদিন বাড়ানো হয়।
এবারের বইমেলা শুরু থেকেই ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। প্রথম সপ্তাহের পর থেকে মেলা পুরোদমে জমে ওঠে। এর মধ্যে আবার মেট্রো ট্রেন বইমেলায় যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। দূরত্ব ও যানজট বিবেচনায় আগে যারা বইমেলায় আসতে নিরুৎসাহ বোধ করতেন এবার মেট্রো ট্রেন তাদেরকেও নিয়ে এসেছে বইমেলায়। ফলে বিগত বছরগুলোর তুলনায় দর্শনার্থীর ভিড় এবং ভালো বেচাবিক্রি হওয়ায় প্রকাশকদের মুখেও ছিল সন্তুষ্টির ছাপ।
এ ছাড়া আবহাওয়া ভালো থাকায় প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবও পড়েনি মেলায়। ২২ ফেব্রুয়ারি অল্প সময়ের বৃষ্টি মেলার বেচা-বিক্রিতে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি করলেও তা প্রকাশক ও পাঠকদের বড় ভোগান্তির কারণ হয়নি। তবে পাঠকের অত্যধিক সমাগমের দিন মেলার ধুলোবালি কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে দর্শনার্থীদের।
এদিকে বেশি ভালো বিক্রির প্রত্যাশায় মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি তোলা হলেও বইয়ের বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। পাঠক সমাগমও ততোটা বাড়েনি। প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা এজন্য ভিন্ন ভিন্ন কারণ তুলে ধরেছেন।
শুক্রবার মেলায় কথা হয় তাম্রলিপি প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি কাউসার হোসেনের সঙ্গে। বেচাবিক্রি কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেচাবিক্রি শুক্র-শনিবারের মতো তো হচ্ছেই না, নরমাল দিনের মতোও বলা যাচ্ছে না। অনেকে হয়তো জানেনই না যে মেলা দুদিন বেড়েছে। আবার এটাও হতে পারে- যারা বই কেনার তারা ২৯ তারিখের মধ্যেই কিনে ফেলেছেন।’
মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয়কর্মী তামিম হোসেন বলেন, ‘বিক্রি বা ভিড় অনেক কম। নগণ্যই বলা যায়। হতে পারে মেলার সময় বাড়ার খবরটা মানুষের মাঝে পৌঁছাতে যত প্রচার করা দরকার ছিল ততোটা প্রচার হয়নি। ফেসবুক থেকে মানুষ আর কতটাই বা নিউজ জানতে পারে।’
ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি হাসেম আলী বলেন, ‘বেচা বিক্রি নেই বললেই চলে। মালিক পক্ষ যে প্রত্যাশা নিয়ে মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল তার ধারেকাছেও নেই বেচাবিক্রি। অর্ধেকেরও কম হবে বলে মনে হচ্ছে।’
তবে অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘শুক্রবার হিসেবে আজ পাঠক ও ক্রেতা সমাগম বেশি হওয়ার কথা ছিল। আমরাও সেরকম প্রত্যাশা করে মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলাম। আমাদের দাবি পূরণ হয়েছে। কিন্তু বেইলি রোডের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড অনেকের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে। মেলায় হয়তো তার প্রভাবটা পড়েছে। আশা করি আজ ভালো বিক্রি হবে।’
মেলা শেষের আগের দিনে ২১৯ নতুন বই
এদিকে মেলার শেষ সময়েও নতুন বই নিয়ে আসছেন প্রকাশকরা। শুক্রবার বইমেলার ৩০তম দিনেও নতুন বই এসেছে ২১৯টি।
শুক্রবার হওয়ায় এদিন মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায় আর শেষ হয় রাত ৯টায়। তবে এদিন ছিল না কোনো শিশুপ্রহর। শনিবারও থাকবে না কোনো শিশুপ্রহর।
মেলার শুরু থেকে মূল মঞ্চে প্রতিদিনই থেকেছে আলোচনা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। লেখক বলছি মঞ্চে থাকতো বই নিয়ে কথোপকথন। বর্ধিত দুই দিনে তা-ও থাকছে না। এই সময়টাতে মূলত বই বিক্রিই মুখ্য বিষয় থাকবে প্রকাশকদের।
সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান
শনিবার সমাপনী দিনে মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এর সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
অনুষ্ঠানে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার দেয়া হবে।
আরও পড়ুন:অমর একুশে বইমেলা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল দুদিন আগে বৃহস্পতিবারই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুমোদনক্রমে মেলার সময় বাড়ানো হয়েছে দুদিন। বর্ধিত সেই সময় শেষ হচ্ছে শনিবার।
তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে মেলার সময় বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছিল সে অনুযায়ী বই বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা। তাদের ভাষ্য, বেইলি রোডের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনা পাঠকদের আলোড়িত করেছে। এ অবস্থায় মেলা শেষ হওয়ার আগের দিন শুক্রবার হওয়া সত্ত্বেও ভিড় ও বিক্রি কম।
আবার অনেকে বলছেন, মেলার সময় বাড়ানোর তথ্যটা যে পরিমাণে প্রচার হওয়া দরকার ছিল সেই পরিমাণে হয়নি। তাই অনেকে জানেনই না যে মেলার সময় বেড়েছে।
সাধারণত প্রাণের অমর একুশে বইমেলা হয় ২৮ দিনে। তবে এ বছর অধিবর্ষ হওয়ায় মেলা একদিন বেশি পেয়ে দাঁড়ায় ২৯ দিনে। তার ওপর ২৯তম দিনটি বৃহস্পতিবার হওয়ায় প্রকাশকদের দাবি ছিলো মেলার সময় বাড়িয়ে শনিবার পর্যন্ত নেয়ার। তাদের দাবি মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুমোদনক্রমে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিয়ে বইমেলার সময় দুদিন বাড়ানো হয়।
এবারের বইমেলা শুরু থেকেই ছিলো জাঁকজমকপূর্ণ। প্রথম সপ্তাহের পর থেকে মেলা পুরোদমে জমে ওঠে। এর মধ্যে আবার মেট্রো ট্রেন বইমেলায় যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। দূরত্ব ও যানজট বিবেচনায় আগে যারা বইমেলায় আসতে নিরুৎসাহ বোধ করতেন এবার মেট্রো ট্রেন তাদেরকেও নিয়ে এসেছে বইমেলায়। ফলে বিগত বছরগুলোর তুলনায় দর্শনার্থীর ভিড় এবং ভালো বেচাবিক্রি হওয়ায় প্রকাশকদের মুখেও ছিলো সন্তুষ্টির ছাপ।
এছাড়া আবহাওয়া ভালো থাকায় প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবও পড়েনি মেলায়। ২২ ফেব্রুয়ারি অল্প সময়ের বৃষ্টি মেলার বেচাবিক্রিতে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি করলেও তা প্রকাশক ও পাঠকদের বড় ভোগান্তির কারণ হয়নি। তবে পাঠকের অত্যধিক সমাগমের দিন মেলার ধুলোবালি কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে দর্শনার্থীদের।
এদিকে বেশি ভালো বিক্রির প্রত্যাশায় মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি তোলা হলেও বইয়ের বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। পাঠক সমাগমও ততোটা বাড়েনি। প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা এজন্য ভিন্ন ভিন্ন কারণ তুলে ধরেছেন।
শুক্রবার মেলায় কথা হয় তাম্রলিপি প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি কাউসার হোসেনের সঙ্গে। বেচাবিক্রি কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেচাবিক্রি শুক্র-শনিবারের মতো তো হচ্ছেই না, নরমাল দিনের মতোও বলা যাচ্ছে না। অনেকে হয়তো জানেনই না যে মেলা দুদিন বেড়েছে। আবার এটাও হতে পারে- যারা বই কেনার তারা ২৯ তারিখের মধ্যেই কিনে ফেলেছেন।’
মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয়কর্মী তামিম হোসেন বলেন, ‘বিক্রি বা ভিড় অনেক কম। নগণ্যই বলা যায়। হতে পারে মেলার সময় বাড়ার খবরটা মানুষের মাঝে পৌঁছাতে যত প্রচার করা দরকার ছিল ততোটা প্রচার হয়নি। ফেসবুক থেকে মানুষ আর কতটাই বা নিউজ জানতে পারে।’
ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি হাসেম আলী বলেন, ‘বেচা বিক্রি নেই বললেই চলে। মালিক পক্ষ যে প্রত্যাশা নিয়ে মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল তার ধারেকাছেও নেই বেচাবিক্রি। অর্ধেকেরও কম হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে মেলার ১৫-১৬তম দিন থেকে যদি সময় বাড়ানোর ঘোষণা আসত তাহলে হয়তো প্রতি শুক্র-শনিবারের মতোই আজ বিক্রি হতো।’
তবে অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘শুক্রবার হিসেবে আজ পাঠক ও ক্রেতা সমাগম বেশি হওয়ার কথা ছিলো। আমরাও সেরকম প্রত্যাশা করে মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলাম। আমাদের দাবি পূরণ হয়েছে। কিন্তু বেইলি রোডের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড অনেকের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে। মেলায় হয়তো তার প্রভাবটা পড়েছে। আশা করি আগামীকাল (শনিবার ভালো বিক্রি হবে।’
মেলা শেষের আগের দিনে ২১৯ নতুন বই
এদিকে মেলার শেষ সময়েও নতুন বই নিয়ে আসছেন প্রকাশকরা। শুক্রবার বইমেলার ৩০তম দিনেও নতুন বই এসেছে ২১৯টি।
শুক্রবার হওয়ায় এদিন মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায় আর শেষ হয় রাত ৯টায়। তবে এদিন ছিলো না কোনো শিশুপ্রহর। শনিবারও থাকবে না কোনো শিশুপ্রহর।
মেলার শুরু থেকে মূল মঞ্চে প্রতিদিনই থেকেছে আলোচনা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। লেখক বলছি মঞ্চে থাকতো বই নিয়ে কথোপকথন। বর্ধিত দুই দিনে তা-ও থাকছে না। এই সময়টাতে মূলত বই বিক্রিই মুখ্য বিষয় থাকবে প্রকাশকদের।
সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান
শনিবার সমাপনী দিনে মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এর সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
অনুষ্ঠানে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার দেয়া হবে।
আরও পড়ুন:অমর একুশে বইমেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে স্পর্শ ফাউন্ডেশনের ‘স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা’। বলা যায়, প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মে আটকে পড়া দৃষ্টিবঞ্চিতদের তারা আলো বিতরণ করছে।
দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্পর্শ ব্রেইলের স্টলে এসে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বই পড়ছেন। আর দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বই পড়ার সেই দৃশ্য সবার নজর কাড়ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ বই দেখছেন, কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়া শুনছেন। আবার কেউ কৌতূহলী মন নিয়ে ব্রেইল পদ্ধতি সম্পর্ক জানতে চাইছেন। সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন স্পৰ্শ ব্রেইল প্রকাশনীর স্টলের সহযোগীরা।
স্পর্শ ব্রেইলের স্বেচ্ছাসেবক রবিউল হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বই বিক্রি নয়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যে পড়তে পারে সে তথ্য জানাতেই মেলায় স্টল নিয়েছে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। ২৪ ফেব্রুয়ারি তারা ১৯টি ব্রেইল বই প্রকাশ করেছে। আর ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা বই প্রকাশ করেছে ১৫০টি।
ব্রেইল বই লেখা আর পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে স্টলের এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘ব্রেইল বই পড়ার জন্য ছয় ডটের একটি কোড নম্বর থাকে। বাংলার প্রতিটি বর্ণ এই ছয় ডট দিয়ে লেখা। ব্রেইল বই পড়তে হলে তাদের এই ছয় ডটের কোড শিখতে হয়। এরপর তারা পৃষ্ঠায় থাকা ছাপ হাত দিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে পারে কোন বর্ণ দিয়ে কী শব্দ লেখা হয়েছে।’
ব্রেইল বই তৈরির খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবক রবিউল হাসান বলেন, ‘ব্রেইল বই করার আলাদা পদ্ধতি আছে। এগুলো একটু ব্যয়বহুল। ব্রেইল বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা কিনতে ৭ থেকে ৯ টাকা পড়ে যায়। আর আছে প্রিন্টিং-মুদ্রণ ব্যয়।’
তিনি বলেন, সাধারণ বইয়ের এক পৃষ্ঠার সমান আমাদের ব্রেইল বইয়ের ৩-৪ পৃষ্ঠা। একটি বইয়ের খরচ নির্ভর করে কত পৃষ্ঠার বই হচ্ছে তার ওপর। বইগুলো দেশেই তৈরি করা হয়। আমাদের ব্রেইল পেইজ আছে। যেকোনো বই দিলে আমরা করে দিতে পারি।’
বই তৈরির খরচ নির্বাহ কীভাবে করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আছেন। তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় আমরা এসব বই প্রকাশ করি।’
কপিরাইট পাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা তৈরি হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কপিরাইট নিয়ে আমাদের এখনও কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। যেহেতু আমরা বিনামূল্যে বই বিতরণ করি, কোন লাভজনক প্রতিষ্ঠান না, তাই কপিরাইট পেতে আমাদের সমস্যা হয় না। লেখকদের বললে তারা দিয়ে দেন।’
রবিউল বলেন, ‘এ বছর আমরা যেসব ব্রেইল বই প্রকাশ করেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এছাড়া প্রসিদ্ধ বইয়ের মধ্যে গত বছর আমরা করেছি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ বইটি। ‘চাঁদের পাহাড়’, হুমায়ূন আহমেদের কিছু প্রসিদ্ধ বইয়েরও ব্রেইল বই প্রকাশ করেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি এগিয়ে আসুক। তারা ঘোষণা দিয়ে সব প্রকাশনীর জন্য বাধ্যতামূলক করুক যে, বইমেলায় স্টল দিতে হলে প্রতিটি প্রকাশনীর একটি করে ব্রেইল বই প্রকাশ করতে হবে। তাহলেই প্রতিবছর আমরা পাঁচ থেকে ছয় হাজার বই পেয়ে যাব।
‘আমাদের লক্ষ্য আছে ব্রেইল বইয়ের লাইব্রেরি করার। করপোরেট মালিকরা এগিয়ে এলে আমাদের জন্য কাজটা সহজ হয়। আমাদের এই ব্রেইল স্টলে বেতনভুক্ত কেউ কাজ করে না। সবাই আমরা ফ্রিতে কাজ করি।’
রবিউল আরও বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা আমাদের স্টলে এসে বই পড়তে পারে। আর প্রতিবছর আমাদের প্রকাশনা উৎসব হয়। এজন্য মাস জুড়ে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চলে। যারা রেজিস্ট্রেশন করে তাদের মাঝে আমরা এদিন ফ্রিতে বই বিতরণ করি। এবার প্রায় নব্বইজন রেজিস্ট্রেশন করেছেন। প্রত্যেককে আমরা চার থেকে পাঁচটি বই ফ্রিতে দিয়ে দিয়েছি।’
কেন এই উদ্যোগ জানতে চাইলে অন্য এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘দৃষ্টিহীনদের মাঝে সাহিত্যের রস পৌঁছানোই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বইমেলায় শুধু আমাদের এই প্রকাশনীতেই দৃষ্টিহীনদের ব্রেইল বই পাওয়া যায়। আমরা চাই, যারা দৃষ্টিহীন তারাও যেন সাহিত্যের রস থেকে বঞ্চিত না হন।
‘তাদেরও তো ইচ্ছে থাকে যে তারা বিভিন্ন লেখকের গল্প-উপন্যাস পড়বেন। তারা জাফর ইকবাল স্যার, হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে পড়তে চান। কিন্তু এসব বই তো আর ব্রেইলে পাওয়া যায় না। বইমেলার প্রতিটি স্টলে যেন ব্রেইল বই থাকে সেটাই আমাদের সামাজিক আন্দোলনের লক্ষ্য।’
স্টলে এসে ব্রেইল বই পড়ছিলেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থী মহিনি আক্তার তামিম। তিনি বলেন, ‘এই ব্রেইল পদ্ধতি শিখতে আমার এক মাস সময় লেগেছে। ছয় বছর বয়সে আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হই। তখনই আমার ব্রেইল পদ্ধতি শেখা।’
তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এসে আমার পছন্দের অনেক বই পড়ে শেষ করেছি। একমাত্র স্পর্শই আমাদের জন্য ব্রেইল বই সরবরাহ করে। তাই আমরা স্পর্শের কাছে কৃতজ্ঞ।’
দৃষ্টিহীন মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মেলা ঘুরে দেখাল ছাত্রলীগ
এদিকে মদীনাতুল উলূম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাদরাসার ৫০ জন শিক্ষার্থীকে বই মেলা ঘুরে দেখিয়েছেন ছাত্রলীগের মাদরাসা বিষয়ক সম্পাদক জহিরুল ইসলাম। এদের মধ্যে ২১ জন দৃষ্টিহীন।
কেন এই উদ্যোগ জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে কয়েকবার আমি এই মাদরাসায় গিয়েছি। সেখানে দেখেছি তারা সবসময় কোরআন শরীফ পড়েন। ফ্রি সময়ে অন্য কোনো বই পড়ার সুযোগ তারা পান না। তখন আমি চিন্তা করেছি যে বই না পড়ার কারণে তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবেন না। তাই আমি ঠিক করেছি তাদের বইমেলা ঘুরে দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ওপর থাকা ব্রেইল বইগুলো উপহার হিসেবে দেবো। সেজন্য আজকে আমি তাদেরকে মেলা ঘুরিয়ে দেখিয়েছি। আর বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, একাত্তরের ডায়েরি, আমার বন্ধু রাসেদসহ অনেক গল্প ও কবিতার বই যেগুলোর ব্রেইল ভার্সন রয়েছে সেসব উপহার দিয়েছি।’
২৮তম দিনে ৮০ নতুন বই
বুধবার অমর একুশে বইমেলার ২৮তম দিনে নতুন বই এসেছে ৮০টি। এদিন মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।
অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ মুনীর চৌধুরী এবং স্মরণ হুমায়ুন আজাদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে অধ্যাপক ফিরোজা ইয়াসমীন ও অধ্যাপক হাকিম আরিফ।
আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম, অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক, ওসমান গনি ও মৌলি আজাদ। সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কাজী জাহিদুল হক সংকলিত এবং ঐতিহ্য প্রকাশিত মুনীর চৌধুরীর দুষ্প্রাপ্য রচনা বই-উন্মোচনে অংশ নেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ফেরদৌসী মজুমদার, প্রাবন্ধিকদ্বয়, আলোচকবৃন্দ, বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার এবং গ্রন্থটির সম্পাদক কাজী জাহিদুল হক।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মুনীর চৌধুরী শোষিত ও মুক্তিকামী মানুষদের জন্য সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। আমাদের সামনে তিনি বিপ্লবী জীবনের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি মুনীর চৌধুরী ও হুমায়ুন আজাদের ভালোবাসা ছিল সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাদের জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।’
‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান, কবি তারিক সুজাত, কথাসাহিত্যিক সমীর আহমেদ ও শিশুসাহিত্যিক আবেদীন জনি।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চে বিকেল ৫টায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘সংস্কৃতি ও সদাচার’ বই নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. মো. হাসান কবীর এবং সম্পাদকীয় পর্ষদের সদস্যবৃন্দ।
বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি
বৃহস্পতিবার অমর একুশে বইমেলার ২৯তম দিন। এদিন বিকেল ৩টায় মেলা শুরু হয়ে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
আরও পড়ুন:প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতিসংঘ ও জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের ওপর তার রচিত দু’টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন।
শেখ হাসিনার রচিত বই ‘সকলের তরে সকলে আমরা’-তে তার জাতিসংঘে দেয়া ১৯টি ভাষণ এবং সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ স্থান পেয়েছে। অপর গ্রন্থ ‘আবাহন’-এ স্থান পেয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে দেয়া তার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যগুলো।
প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার এম. নজরুল ইসলাম বই দুটি গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন।
বরাবরের নিয়ম মেনে ২৯ তারিখ অমর একুশে বইমেলা শেষ হলে এটা ছিল মেলার শেষ শুক্রবার। আর সাপ্তাহিক ছুটির এই দিনে এসে মেলা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। জমে উঠেছে প্রাণের বইমেলা।
মেলায় অংশ নেয়া বিভিন্ন প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, অন্য শুক্রবারের চেয়ে এদিন তুলনামূলক ভিড় একটু বেশি ছিল। বিক্রিও হয়েছে ভালো। তবে মেলা আরও দুদিন বাড়ানোর জন্য প্রকাশকদের যে দাবি সেটি বাস্তবায়িত হলে আরও একটি শুক্রবার পাবে বইমেলা। যদিও আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছু জানায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুক্রবার প্রবেশপথে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পাঠকদের ঢুকতে হচ্ছে বইমেলায়। মেলার ভেতরের প্রাঙ্গণও দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর। শুক্রবার হওয়ায় অনেকে শিশু সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মেলায় এসেছেন।
বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলের সামনে ছিলো সব বয়সী পাঠকের ভিড়। কেউ বই দেখছেন, কেউ কিনছেন। আবার কেউ তুলছেন ছবি।
প্রকাশকরা বলছেন, বই না কিনুক, ছবি তোলার জন্য হলেও সবাই যে বইমেলামুখী হচ্ছে এটাই খুশির খবর।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি সোলাইমান বলেন, ‘আজকে শিশু প্রহরের সময় সকালে একটু বিক্রি কম ছিলো। তবে দুপুরের পর থেকে ভালোই বিক্রি হচ্ছে।’
আগামী প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি রবিউল ইসলামও বললেন একই কথা।
মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয় প্রতিনিধি রমিম বলেন, ‘আজ যে মেলার শেষ শুক্রবার তা ভিড় দেখে বোঝা যাচ্ছে। অন্যান্য দিনের তুলনা ভালো বিক্রি হচ্ছে। তবে শুক্রবার হিসেবে ভিড় বেশি হলেও বইয়ের ক্রেতা ততোটা নেই।’
মিরপুর থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মেলায় এসেছেন কবির আহমেদ। বললেন, ‘বউ কয়েক দিন ধরে বলছিল মেলায় যাবে। কিন্তু অফিসের ব্যস্ততার কারণে আাসা হয়নি। আজ আবার মেলার শেষ শুক্রবার। আজ না এলে এবার আর আসাই হবে না। তাই ওদের আবদার মেটাতে চলে এসেছি। ভালোই লাগছে।’
এদিকে প্রতিটি ছুটির দিনের মতোই শুক্রবারের শিশুপ্রহর মাতিয়ে রেখেছে সিসিমপুরের হালুম ইকু আর টুকটুকিরা। তাদের সরাসরি দেখে আনন্দের সীমা ছিলো না ছোট্ট সোনামনিদের। তাদের আনন্দ হাসি ফুটিয়েছে সঙ্গে মা-বাবার মুখেও।
উদয়ন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাহমিদকে নিয়ে মেলায় সিসিমপুর দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাসা একটু দূরে হওয়ায় আর বাইরে খেলার পরিবেশ না থাকায় ছেলেরা তেমন খেলতে পারে না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই তাদের থাকতে হয়। শিশুদের মোবাইলের আসক্তি কাটাতে বইয়ের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো জরুরি। তাই বাচ্চাকে এখানে নিয়ে এসেছি।’
মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি
এদিকে মেলার শেষ দিন ২৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার হওয়ায় দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রকাশনীর প্রকাশকেরা। তাদের বক্তব্য, তাহলে মেলা সাপ্তাহিক ছুটির দিন দুটি পাবে।
অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘পাঠকরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত থাকায় সরকারি ছুটির দিনগুলোতে মেলায় ওনারা আসার একটু বেশি সুযোগ পান। এবার যেহেতু বৃহস্পতিবারই মেলা শেষ হচ্ছে, তাই দুদিন বাড়িয়ে শুক্রবার আর শনিবারও যদি মেলা থাকে তাহলে পাঠকরা আসার সুযোগ পেতেন। আমাদেরও একটু বেশি ভালো বিক্রি হতো। তাই আমরা চাই মেলার সময় দুটি দিন বাড়ানো হোক।’
তবে ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টল ম্যানাজার আমজাদ হোসেন খান বলেন, ‘মনে হচ্ছে না মেলা দুদিন বাড়ানো হবে। এটি করলে মেলার ঐতিহ্য নষ্ট হবে।’
২৩তম দিনে মেলায় বই এসেছে ১৯৭টি
শুক্রবার মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ১৯৭টি।
সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মো. হাসান কবীর।
প্রধান অতিথি ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
ক-শাখায় প্রথম হয়েছে ওয়াফিয়া নূর, দ্বিতীয় আর্লিন আহমেদ সানভী ও তৃতীয় হয়েছে তাইফা জান্নাত; খ-শাখায় প্রথম হয়েছে সৌভিক সাহা, দ্বিতীয় প্রত্যুষা রায় ও তৃতীয় শাফিন উদ্দিন আহাম্মেদ এবং গ-শাখায় প্রথম স্বস্তি চৌধুরী, দ্বিতীয় সপ্তনীল হাওলাদার ঐশী ও তৃতীয় হয়েছে সুয়েত আহমেদ নিহাল।
শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা
ক-শাখায় প্রথম হয়েছে ফারহিনা মোস্তাক আযওয়া, দ্বিতীয় অংকিতা সাহা রুদ্র এবং তৃতীয় ফাবলিহা মোস্তাক আরওয়া। খ-শাখায় প্রথম সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্গ, দ্বিতীয় সুবহা আলম ও তৃতীয় অন্বেষা পণ্ডিত এবং গ-শাখায় প্রথম সিমরিন শাহীন রূপকথা, দ্বিতীয় আবদুল্লাহ আল হাসান মাহি ও তৃতীয় হয়েছে তাজকিয়া তাহরীম শাশা।
শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা
ক-শাখায় প্রথম নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির, দ্বিতীয় রোদসী আদৃতা এবং তৃতীয় নৈঋতা ভৌমিক। খ-শাখায় প্রথম তানজিম বিন তাজ প্রত্যয়, দ্বিতীয় সুরাইয়া আক্তার ও তৃতীয় রোদসী নূর সিদ্দিকী। গ-শাখায় প্রথম কে. এম. মুনিফ ফারহান দীপ্ত, দ্বিতীয় নবজিৎ সাহা ও তৃতীয় হয়েছে সরকার একান্ত ঐতিহ্য।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মামুন হুসাইন। আলোচনায় অংশ নেন ওয়াসি আহমেদ এবং জাফর আহমদ রাশেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
প্রাবন্ধিক বলেন, ‘আমাদের কালের এক আশ্চর্য-নির্লোভ মানুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চেনা বাস্তবতাকে প্রসারিত করেন প্রচলিত দৃষ্টি ও বুদ্ধিগ্রাহ্যতার ওপারে। আমাদের আদিকল্প, ইন্দ্রজাল, উপকথা তিনি চিনেছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে।’
আলোচকবৃন্দ বলেন, বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিমান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যদর্শন, সংশীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানতে হলে তার সাহিত্য পাঠ একান্ত জরুরি। তিনি ছিলেন সংবেদনশীল ও অনুসন্ধিৎসু একজন লেখক। সমাজের নানা দিকে তার সাহিত্যিক দৃষ্টি ছিল প্রসারিত। তিনি তার চিন্তাশীলতার মধ্য দিয়েই একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বোধ ছিল শাণিত, ভাষা ঝরঝরে এবং চিন্তা ছিল স্বচ্ছ। নিরন্তর নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই তার সাহিত্য অনন্য উচ্চতা লাভ করেছে। নবীন পাঠকদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যপাঠে উৎসাহিত করতে হবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন লেখক, পর্যটক ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক, কথাসাহিত্যিক নভেরা হোসেন, কবি কুশল ভৌমিক ও শিশুসাহিত্যিক আহমেদ জসিম।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চের আয়োজন
এই মঞ্চে বিকেলে পারস্য সাহিত্যের অনুবাদক ও লেখক অধ্যাপক শাকির সবুর রচিত সমকালীন ইরানের কবি ও কবিতা এবং ফারসি থেকে অনূদিত বুজুর্গে আলাভির তার চোখগুলো বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
শনিবারের সময়সূচি
অমর একুশে বইমেলার ২৪তম দিন শনিবার মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টায় থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলবে শিশুপ্রহর।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: মোহাম্মদ রফিক এবং খালেক বিন জয়েনউদদীন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য