করোনাভাইরাসে নারীর চেয়ে পুরুষের মৃত্যু বেশি সারা বিশ্বেই। বাংলাদেশে এই অনুপাত আরও বেশি।
করোনাভাইরাসজনিত রোগে (কোভিড-১৯) বিশ্বে যত মানুষ মারা গেছেন তাদের ৭৩ শতাংশ পুরুষ; ২৭ শতাংশ নারী। তবে বাংলাদেশে পুরুষের মৃত্যু হার ৭৭ শতাংশেরও বেশি।
বাংলাদেশে পুরুষের মৃত্যুর হার বিশ্বের গড় তো বটেই, প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের চেয়েও বেশি।
এর কারণ কী, তা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। ফলে সুনির্দিষ্টভাবে কারণ বলার সুযোগ নেই। যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তাদের ধারণা থেকে কিছু কারণের কথা বলছেন।
শনিবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিন কোটি ৯৬ লাখ ৮৩ হাজার ২৩৮ জন। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছে ১১ লাখ ১০ হাজার ৫৩৬ জন।
দেশের স্বাস্থ্য অধিদফতের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে করোনাভাইরাসে মোট শনাক্তের সংখ্যা তিন লাখ ৮৭ হাজার ২৯৫। মারা গেছে পাঁচ হাজার ৬৪৬।
নিহতদের মধ্যে পুরুষ চার হাজার ৩৪৫ জন, আর নারী এক হাজার ৩০১ জন। শতাংশ হিসেবে পুরুষের মৃত্যুর হার ৭৬ দশমিক ৯৬। নারীর ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য বলছে, ভারতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৭৪ লাখ ৩২ হাজার ৬৮০ জন। এর মধ্যে মারা গেছে এক লাখ ১৩ হাজার ৩২ জন। এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ; ৩০ শতাংশ নারী।
পাকিস্তানে তিন লাখ ২২ হাজার ৪৫২ জন রোগীর মধ্যে মারা গেছে ছয় হাজার ৬৩৮ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ৭২ শতাংশ, নারী ২৮ শতাংশ।
সারা বিশ্বেই করোনায় মৃত্যু তাদেরই বেশি, যাদের কঠিন রোগ বা (কো মরবিডিটি) রয়েছে। ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপারটেনশন, দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগ, মেদবাহুল্য যাদের রয়েছে, তারাই মারা যাচ্ছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশে আরও বেশি হারে পুরুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে অস্বাস্থ্যকর জীবনাচরণ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসে ক্যান্সার, কিডনি রোগের আধিক্যের বিষয়ে বলেছেন একজন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এসব রোগ নারীদের তুলনায় পুরুষের বেশি। এ ছাড়া মদ ও ধূমপানের অভ্যাসও তাদের মধ্যেই বেশি।
আবার রোগে আক্রান্ত হলেও পুরুষদের চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা কম- বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম।
নিউজবাংলাকে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরুষের থেকে নারীর বেশি থাকে। তবে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পুরুষের মৃত্যুর হার কেন বেশি- এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সহজ নয়। কারণ, আমার জানা মতে এ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে আবাহাওয়াজনিত কারণে পুরুষের মৃত্যুর হার বেশি হতে পারে।’
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৬৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৪ হাজার ২৪৫ ও নারী ৪৭৬ জন।
সেই হিসাবে মারা যাওয়াদের ৭৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ পুরুষ এবং ২০ দশমিক ৯২ শতাংশ নারী।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসির অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নারী থেকে পুরুষদের মৃত্যুর কারণ পুরুষরা অসংক্রামক রোগে বেশি ভোগে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, লিভারের ক্যান্সার, স্ট্রোক পুরুষদের বেশি আক্রান্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেশাজাতীয় দ্রব্য পুরুষ বেশি গ্রহণ করে থাকে। ফলে করোনা আক্রান্ত হয়ে পুরুষদের মৃত্যু ঝুঁকিও বেশি থাকে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পুরুষরা করোনায় বেশি মারা যায় কেন, এই বিষয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব না।’
এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়কালে হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৫৩৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
চলতি বছরের শুরু থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে মোট ৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে সবশেষ ২৪ ঘণ্টায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এ তথ্য জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫৩৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে দেশের হাসপাতালগুলোতে মোট ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ২৮৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
অধিদফতর আরও জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে এক হাজার ৬৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায়, ৯৩৮ জন। বাকি ৭২৬ জন অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সারা দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে শিশুসহ তিনজন। মারা যাওয়া তিনজনই পুরুষ। তাদের বয়স ১১ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেলেন ৯৫ জন।
এছাড়া ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪০৩ রোগী। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ২০৭ জন।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৪০৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ২৫২ জন রয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ৩৬, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯২, খুলনায় ১৫ ও ময়মনসিংহে আটজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ২০৭ জন। তাদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। এ সময় মারা যাওয়া ৯৫ জনের মধ্যে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, আরএমওসহ ৪১ জন চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।
কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে মেডিক্যাল কলেজের একদল শিক্ষার্থী মঙ্গলবার বিকেলে তাদেরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। তাদের মধ্যে বহির্বিভাগের চিকিৎসক রয়েছেন ১৭ জন।
অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা চিকিৎসকরা বুধবার খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেননি। এতে সকাল থেকে চিকিৎসক সংকটে ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা। বিশেষ করে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসক না পেয়ে অনেক রোগী দূর-দূরান্ত থেকে এসে ফিরে গেছেন। অনেকে আবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন।
খুমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৪০ জনের বেশি চিকিৎসক সেবা দিয়ে থাকেন। গড়ে প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন।
ষাটোর্ধ্ব কাকলী আক্তারের বাড়ি ডুমুরিয়ায়। এক মাস আগে বহির্বিভাগের চিকিৎসক সুমন রায়ের পরামর্শ নিয়েছিলেন তিনি। বুধবার ছিল ফলোআপ। ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
কাকলী বলেন, ‘এভাবে চিকিৎসকদের ওপর নির্যাতন হলে তাদের সেবা দেয়ার মানসিকতা থাকবে কিভাবে? যদি কেউ কোনো অন্যায় করে তবে রাষ্ট্রের আইনে শাস্তি পাবে। খেয়াল-খুশিমতো কেউ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পারে না।’
সুমন রায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও)। তিনি বহির্বিভাগের মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগী দেখেন। অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় বুধবার তিনি চেম্বারে আসেননি।
মোবাইল ফোনে কথা হলে সুমন রায় বলেন, ‘গতকাল যেভাবে মারমুখী ভূমিকায় আমাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে তাতে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এ কারণে আজ হাসপাতালে যাইনি। নিজেদের সম্মান যদি না থাকে তাহলে চিকিৎসা সেবা দেব কীভাবে।’
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে উপস্থিত হন কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মোস্তফা কামাল। এক পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আক্তারুজ্জামানকে চাপ দিয়ে দুটি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। এর একটি ছিল আক্তারুজ্জামানের পদত্যাগপত্র ও অন্যটি ৪১ জন চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণার।
এই ৪১ জন চিকিৎসকের মধ্যে হাসপাতালের পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, আরএস, আরএমও, রেজিস্ট্রারসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পোস্টের চিকিৎসক রয়েছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ চিকিৎসক আবার কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িতও নন। এছাড়াও তাদের মধ্যে ১৭ জন চিকিৎসকই বহির্বিভাগে রোগী দেখেন।
উপ-পরিচালক ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘কখনও আওয়ামী লীগ বা স্বাচিপ কোনো কিছুর প্রাথমিক সদস্য হয়েছি তা দেখাতে পারলে আমি সব শাস্তি মাথা পেতে নেব। সরকারি চাকরি ছাড়া কোনোদিন কোনো আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছি এমন রেকর্ড নেই।
‘বরং আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে বার বার শাস্তিমূলক বদলি করেছে। সততার কারণে প্রমোশন দেয়নি। নিচের গ্রেডে নামিয়ে দিয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর ভাবলাম এবার হাসপাতালের জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। অথচ আমাকে তারা জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘কলেজ থেকে মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থীকে এনে আমাকে নানারকম হুমকি দিল। অন্যায়ভাবে কাগজে স্বাক্ষরও করিয়ে নিল। আর যে ৪১ জন চিকিৎসককে তিনি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলেন, তারা হাসপালতে না এলে চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়বে। সাধারণ রোগীরা চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন।’
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ ইন্টার্ন চিকিৎসক ফোরামের সদস্য সচিব ডা. তাহমিদ মাশরুর বলেন, ‘উপ-পরিচালক ডা. আক্তারুজ্জামান স্যার ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। কেন তাকে পদত্যাগ করানো হল সে বিষয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা অবগত নন।’
অভিযোগ রয়েছে, ‘ডা. মোস্তফা কামাল বরাবরই কিছুটা উগ্র স্বভাবের। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ডা. মোস্তফা কামাল নিউরো মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক তড়িৎ কান্তি ঘোষকে রড দিয়ে আঘাত করেন। এ ঘটনার পর তার বিষয়ে সাধারণ চিকিৎসদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। তিনি সেই সুযোগ নিয়ে কিছু শিক্ষার্থীকে সঙ্গে রেখে মঙ্গলবারের ঘটনা ঘটান তিনি।
কেন চাপ দিয়ে পদত্যাগ ও চিকিৎসকদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করানো হল- এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডা. মোস্তফা কামালকে বার বার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া দেননি তিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে কর্মবিরতিসহ আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন চিকিৎসকরা। সে সুবাদে বুধবার থেকে রুটিন অনুযায়ী পুরোদমে চিকিৎসা কার্যক্রম চলবে। একইসঙ্গে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়।
চিকিৎসকদের পক্ষে ঢাকা মেডিক্যালের নিউরোসার্জারি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মো. আবদুল আহাদ বলেন, ‘এখন থেকে সারা দেশের সব হাসপাতালে আগের মতো পূর্ণ সেবা চালু থাকবে। আজ বিকেলে সর্বস্তরের চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকে তাদের (চিকিৎসক ও শিক্ষার্থী) পক্ষ থেকে উত্থাপিত চারটি দাবির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।’
তিনি বলেন, ‘এসব দাবির বিষয়ে সচিব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সারা দেশে হাসপাতালগুলোতে সব ধরনের সেবা চালুর ঘোষণা দিচ্ছি।’
প্রসঙ্গত, গত শনিবার (৩১ আগস্ট) রাত ১১টার দিকে মোটর বাইক দুর্ঘটনায় আহত অবস্থায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস টেকনোলজির (বিইইউবিটি) শিক্ষার্থী আহসানুল হক দীপ্তর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
চিকিৎসার অবহেলায় তার মৃত্যু হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে দীপ্তর ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা ঢামেক অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে চিকিৎসকদের মারধর করে। এ সময় নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ইমরান, মাশরাফি ও জুবায়ের আহত হন।
একই রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একে অপরকে কুপিয়ে আহত করে। এ হামলায় একজন মারা যান। এ ঘটনার পরপরই নিরাপত্তার দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা চাপাতিসহ চারজনকে আটক করে নিয়ে যান।
ওই রাতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের লাঞ্ছিত করে।
এসব ঘটনায় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেন। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত হামলাকারীদের গ্রেপ্তার এবং নিরাপত্তার দাবিতে কর্মবিরতিতে যান মেডিক্যালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। একই দাবিতে সারা দেশে চিকিৎসা না দিতে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে শত শত রোগী দুর্ভোগে পড়েন। পরদিন রোববার আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
আরও পড়ুন:ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় তাদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে বন্ধ ছিল হাসপাতালের সেবাদান কার্যক্রম। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর রোববার রাতে জরুরি বিভাগে সেবাদান কার্যক্রম চালু হলেও বন্ধ রয়েছে বহির্বিভাগ। এবার বহির্বিভাগেও সীমিত পরিসরে সেবাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগ চালু থাকবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মুখপাত্র নিউরোসার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. আব্দুল আহাদ।
সোমবার বিকেলে ঢাকা মেডিক্যালের প্রশাসনিক ব্লকে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন যে, চিকিৎসকদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।
‘ইতোমধ্যে আমরা দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি। ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাসপাতালে হামলার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি হামলাকারীদেরও দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।
‘বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় চিকিৎসকদের ওপর হামলার আশঙ্কা রয়েছে। তাদেরও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।’
ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঢামেক হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল কলেজে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এর আগে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে রোববার সন্ধ্যা থেকে সব হাসপাতালে জরুরি বিভাগ চালু হয়েছে। সেগুলো চালুই থাকবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দুই দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং হাসপাতালে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগে আইন প্রণয়ন করতে হবে।’
ডা. আহাদ জানান, আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে সীমিত পরিসরে অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে সেবাদান চালু থাকবে। সকাল ৮টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে। জরুরি বিভাগ চালুর পর সীমিত পরিসরে ইনডোরে সেবাদান চলছে। এছাড়াও বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রয়েছে। সেগুলো চালু থাকবে।
আরও পড়ুন:ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে ভোগান্তি বেড়েছে রোগী ও স্বজনদের। বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় জরুরি বিভাগে রোগীর চাপ বেড়েছে। তাদের মধ্যে দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক রোগী নিয়ে জরুরি বিভাগে ভিড় করছেন স্বজনরা।
সোমবার ঢামেক হাসাপাতালের বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা যায় রোগীর উপচেপড়া ভিড়। ব্রেইন স্ট্রোক, হৃদরোগ, মূত্র সমস্যা, পেটব্যথা, ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত, এজমাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের ভিড় জরুরি বিভাগের সামনে।
দেশের সবচেয়ে বড় এই চিকিৎসা কেন্দ্রে এসে বহির্বিভাগ বন্ধ দেখে রোগীদের স্বজনরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনা, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হচ্ছেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ কেন জানতে চাচ্ছেন তারা।
জবাবে আইন-শৃঙ্খলা দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের অপারগতা জানিয়ে বলছেন- আপনারা এই সমস্যা নিয়ে হাসপাতাল পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।
মুন্নি হাসান নামে এক নারী রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকা থেকে ইউরোলজি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আসেন ঢামেকে। পরে তাকে চিকিৎসা না পেয়েই ফিরে যেতে।
পিত্তে পাথর সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালের ১০৯ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন বংশালের শারমিন আক্তার। সোমবার তার অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এনেসথেশিয়া চিকিৎসক না আসায় তার অপারেশন হয়নি। এমন প্রায় ১০ জন অপারেশনের রোগীকে সোমবার হাসপাতাল থেকে চলে যেতে হয়েছে।
কামরাঙ্গীরচর থেকে অন্তরা আক্তার এসেছেন তার তিন বছর বয়সী সন্তান ইয়ামিনকে নিয়ে। শিশুটি শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছে। তিনি জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য বহির্বিভাগ গিয়ে দেখেন সেখানে সেবা বন্ধ। সেখান থেকে শিশুটিকে জরুরি বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
ঢামেক বহির্বিভাগের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত সহকারী প্লাটুন কমান্ডার (এপিসি) ফজলুর রহমান বলেন, আজ সোমবার সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কমপক্ষে সাড়ে পাঁচশ’ রোগীকে বহির্বিভাগ থেকে ফেরত দেয়া হয়েছে।
যেসব রোগী জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেয়ার মতো শুধু তাদেরকে সেখানে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে রোগী ও সঙ্গে আসা স্বজনদের বহু বকাঝকা ও গালমন্দ খেতে হয়েছে আমাদেরকে।’
জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টার থেকে আজ সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৯০০ টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন টিকিট কাউন্টার ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম।
ঢামেক হাসপাতালে সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা বহির্বিবিভাগসহ বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নিয়ে তদারকি করছেন।
হাসপাতালের গার্ড ও বিভিন্ন দায়িত্বরত কর্মচারীরা জরুরি বিভাগের প্রবেশপথে অবস্থান নিয়ে প্রবেশকারীদের চেক করে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন। জরুরি বিভাগের ভেতরে বিভিন্ন ওয়ার্ডের সামনেও সেনা সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। সেখানে বরাবরের মতোই লাইন দিয়ে টিকিট কেটে চিকিৎসক দেখাতে পারছেন রোগীরা।
কর্মবিরতি নিয়ে যা বললেন চিকিৎসক
এদিকে আজ বিকেল ৫টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকে ইন্টার্ন চিকিৎসক মো. আব্দুল আহাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় দোষীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আয়তায় আনা হোক। এই সন্ত্রাসীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মবিরতি চলবে।
‘আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আমরা ঢাকা মেডিক্যালে অবস্থান কর্মসূচি। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সমপরিসরে বহির্বিভাগে রোগীদের সেবা দেয়া হবে। তবে রুটিন সেবা বন্ধ থাকবে। ইমার্জেন্সি ইনডোর খোলা থাকবে।’
আরও পড়ুন:ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) দুই প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
রোববার বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভুল চিকিৎসার অভিযোগে চিকিৎসকদের ওপর এক রোগীর স্বজনদের হামলার পরদিনই বিজিবির দুই প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
হামলার প্রতিবাদে চিকিৎসকরা ধর্মঘটের ডাক দেয়ায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ (ঢামেক) সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়।
শনিবার ঢামেক হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের তিন চিকিৎসক লাঞ্ছিত হন। হামলার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আল্টিমেটাম দেন চিকিৎসকরা। তবে চিকিৎসকরা তাদের হতাশা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ধর্মঘটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘হামলায় জড়িত চারজনকে আটক করে সেনা সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিষপান করা এক রোগীকে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এরপরই রোগীর স্বজনরা জরুরি বিভাগে ভাঙচুর চালায় এবং চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য