× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

google_news print-icon

আইনি জটিলতায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থবির

আইনি-জটিলতায়-যুদ্ধাপরাধ-ট্রাইব্যুনাল-স্থবির
১১ মাসে আসেনি কোনো মামলার রায়। বন্ধ যুক্তিতর্ক, মামলা গ্রহণ। আইন অনুযায়ী তিন বিচারকের একজনও অনুপস্থিত থাকলে রায় বা শুনানি সম্ভব নয়। বিচারপতি আমীর হোসেন গত ২২ মার্চ থেকে বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধে ময়মনসিংহের খলিলুর রহমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শেষ প্রায় ৯ মাস আগে। কিন্তু রায় কবে, জানা নেই।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর কোনো মামলা শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকেনি এত দিন।

২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম রায় আসতে সময় লাগে প্রায় তিন বছর। সাবেক জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির আদেশ আসে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি। আর ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর আসে শেষ রায়।

প্রথম রায়ের পর প্রায় সাত বছরে মোট ৪১টি মামলার রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। তবে গত ১১ মাসে আসেনি একটিও। অথচ অন্তত দুটি মামলার রায় আসতে পারত বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।

এখনও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬টি। এই মামলাগুলোর একটিতেও গত ১১ মাসে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন হয়নি। দুই একটি মামলায় কেবল সাক্ষ্যগ্রহণ ও জামিন শুনানি হয়েছে।

এই সময়ে তদন্ত সংস্থার জমা দেয়া চারটি প্রতিবেদন প্রসিকিউশন টিম ট্রাইব্যুনালকে দিতেও পারছে না। ফলে সেগুলোতেও অভিযোগ গঠনের শুনানি আটকে গেছে।

ট্রাইব্যুনাল থমকে যাওয়ার কারণ আইনি জটিলতা। ট্রাইব্যুনাল বিধিমালা ২০১০ এর ২৬ (১) ধারা অনুযায়ী অপরাধ আমলে গ্রহণ ও রায় প্রদানের সময় ট্রাইব্যুনালের সব সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।

তবে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য গত ২২ মার্চ আমীর হোসেন ভারতে যান। এখনও সেখানেই আছেন। ফলে চেয়ারম্যান শাহিনুর ইসলাম ও সদস্য আবু আহমেদ জমাদার শুনানি নিতে পারছেন না বা রায় দিতে পারছেন না।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন বিচারকের ফুল বেঞ্চ না থাকলে কোন মামলা আমলে নেয়া, অভিযোগ গঠন, যুক্তিতর্ক গ্রহণ ও রায় দেয়ায় বাধা আছে।’

এই অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে জটিলতার আশঙ্কা করছেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ দ্রুত শেষ হওয়ার দরকার। কেননা আমাদের সাক্ষীদের মধ্যে অধিকাংশের বয়স ৭০ এর ঊর্ধ্বে। এ অবস্থায় বয়স্ক এসব সাক্ষীদের ধরে রাখাও মুশকিল।’

এই অবস্থায় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালটি আবার চালুর পরামর্শ দিয়েছেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক।

২০১২ সালের ২২ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তবে শীর্ষ সন্দেহভাজনদের মামলায় রায়ের পর পর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এটি নিষ্ক্রিয় করা হয়।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাপারটা আমি দেখব।’

তবে যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারলেও এক বিচারকের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণের সুযোগ আছে। আর এ বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।

‘সাক্ষী হাজির, জামিন সংক্রান্ত আবেদনের বিষয়টি ভার্চুয়ালি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। … নিরাপত্তা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বিচারক প্যানেলের সুরক্ষিত স্বচ্ছ গ্লাস দিয়ে দেয়াল দেয়া হয়েছে। সাক্ষী ও আসামিদের জন্য নির্ধারিত জায়গাগুলো স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে।’

করোনার শুরুতেই ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকায় ২৯ জন পুলিশ সদস্য, তিন জন প্রসিকিউটর করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা সবাই অবশ্য সুস্থ হয়েছেন। যদিও স্ত্রী হারিয়েছেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন।

ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার পর ২০১৩ সালে আটটি মামলার রায় এসেছে।

২০১৪ সালে ছয়টি, ২০১৫ সালে সাতটি, ২০১৬ সালে ছয়টি, ২০১৭ সালে দুইটি এবং ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ছয়টি করে মামলার রায় হয়েছে।

যে ৪১টি মামলার রায় হয়েছে তাতে আসামি ছিলেন ৯৫ জন। যার মধ্যে ৭০ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা এসেছে ট্রাইব্যুনাল থেকে।

এর মধ্যে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সাজা বাড়ে আপিল বিভাগে। আর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর আপিল বিভাগ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে।

আরেক জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায় আপিল বিভাগ বহাল রেখেছে। এখন রিভিউ ও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা বাকি।

তদন্ত সংস্থা এখনো ২৮টি মামলার তদন্ত চালাচ্ছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৪০ জন।

আরও পড়ুন

জাতীয়
Waterlogging in Sylhet City is a major challenge

সিলেট সিটিতে জলাবদ্ধতা নিরসনই বড় চ্যালেঞ্জ

সিলেট সিটিতে জলাবদ্ধতা নিরসনই বড় চ্যালেঞ্জ সিলেট নগরীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেয়র প্রার্থীরা। ছবি: নিউজবাংলা
সুশাসনের জন্য নাগরিক সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নিয়েছে নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এখানে বিপুল ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু নগরবাসী তেমন সুফল পায়নি। তাই আগামী দিনে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাদের জন্য জলাবদ্ধতা নিরসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।’

সিলেট নগরবাসীর দুর্ভোগের অপর নাম জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি হলেই পানিতে তলিয়ে যায় নগরের রাস্তাঘাট। বাসাবাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ে পানি। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এরপরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাননি নগরবাসী।

এবার সিটি নির্বাচনের আগেও আলোচনায় নগরের জলবদ্ধতার বিষয়টি। এ সমস্যাটি সমাধানই নির্বাচিত মেয়র কাউন্সিলরদের বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন বাসিন্দারা।

নির্বাচিত হলে জলাবদ্ধতামুক্ত নগর গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রার্থীরা। এ ছাড়া নগরকে বন্যামুক্ত রাখতে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং সুরমা নদী খননেরও আশ্বাস দিয়েছেন তারা।

সিলেট নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা দীর্ঘদিনের, তবে একাধিক বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলাবদ্ধতা অনেকটাই কমে আসে, কিন্তু গত বছরের জুনে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকেই বৃষ্টি হলেই জলবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে নগরে। সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে নগরের বেশির ভাগ এলাকা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নিয়েছে নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এখানে বিপুল ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু নগরবাসী তেমন সুফল পায়নি। তাই আগামী দিনে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাদের জন্য জলাবদ্ধতা নিরসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।’

ফারুক মাহমুদ বলেন, ‘নগরের ছড়া, খালগুলো অনেক দিন ধরেই বেদখল হয়ে আছে। প্রভাবশালীরা এগুলো দখল করে রেখেছেন। বেদখল হওয়া ছড়া-খালের পুরোটা উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া যেগুলো এখনও দখল হয়নি, সেগুলোও ময়লা- আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে।’

জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নগরবাসীকে সচেতন করার পাশাপাশি প্রকল্প গ্রহণের আগে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন ফারুক মাহমুদের।

সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা যায়, নগরে ছোট বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। এতে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে। ছড়া ও ড্রেন দখল এবং ভরাটের কারণেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয় নগরে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০০৯ সালে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

২০১৩ সালে আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ওই বছরই জলাবদ্ধতা নিরসনে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এরপর ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ২০১৫ সালে আরও ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। সব মিলিয়ে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, ২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে বরাদ্দ আসে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ২৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৯৮ কোটি ৪৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। প্রকল্পটির আওতায় অন্যান্য কাজের সঙ্গে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন ও ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়।

অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণের কারণেই বিপুল অর্থ ব্যয় সত্ত্বেও নগরের জলাবদ্ধতা দূর সম্ভব সহয়নি দাবি করে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান মেয়রকে সরকার প্রচুর বরাদ্দ দিয়েছে, কিন্তু তিনি তা কাজে লাগাতে পারেননি। অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ করে কসমেটিকস উন্নয়ন করেছেন। প্রচুর লুটপাট হয়েছে। সে কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগ কমেনি।’

আনোয়ারুজ্জামান বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে শুরুতেই জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করব। এ ছাড়া বন্যায় নগর যাতে বড় ক্ষতির শিকার না হয়, এ জন্য সুরমা নদী খনন ও শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে উদ্যোগ নেব।’

জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘গত চার মেয়াদে সিলেট সিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়রকে জনগণ দেখেছে। তারা কেউই জলাবদ্ধতামুক্ত নগর ওপর দিতে পারেননি। ফলে জনগণ মনে করে এই দলের পক্ষে নগরের জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব না। তাই জনগণ এবার পরিবর্তন চায়। আমি নির্বাচিত হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবাতা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’

দলীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে এবারের সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হননি বিএনপি নেতা ও বর্তমান সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘আমি গত ১৩ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করি। তার সুফল নগরবাসী পাচ্ছেন। এখন আর আগের মতো জলবদ্ধতা হয় না, তবে গত বন্যার পর ছড়া, খাল ও ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় কয়েক দিন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল।’

আরিফ বলেন, ‘এ ছাড়া অতিবৃষ্টিতে নগরের আশপাশের টিলা ধসেও খালগুলো ভরাট হয়ে যায় এবং সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষায় নগরের পানি নদীতে নামতে পারে না। এ জন্য জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এসব সমস্যার সমাধান কেবল সিটি করপোরেশনের দ্বারা সম্ভব নয়। সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।’

মেয়র বলেন, ‘গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকা দেখতে এসেছিলেন। তখন বন্যা মোকাবিলায় তার কাছে সুরমা নদী খনন এবং শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি উত্থাপন করেছি। তিনি বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় দেখবেন বলে কথাও দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, এর কার্যকর উদ্যোগ নিশ্চয়ই নগরবাসী দেখতে পাবেন।’

এ প্রসঙ্গে লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান স্থপতি রাজন দাশ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে নগরের ড্রেনগুলোর ব্যাপক সংস্কার হয়েছে, কিন্তু অনেক স্থানে দেখা যায় সড়ক থেকে ড্রেন উঁচু। ফলে সড়কের পানি ড্রেনে নামতে পারে না। তা ছাড়া সড়ক থেকে পানি ড্রেনে নামার পর্যাপ্ত ছিদ্রও নেই। আবার ড্রেন-ছড়াগুলোর মুখ আবর্জনায় বন্ধ হয়ে আছে। ফলে পানি নদীতে নামতে পারছে না।

‘বড় অঙ্কের প্রকল্প বাস্তায়নের পাশপাশি সেসব দিকও খেয়াল রাখতে হবে। নতুবা কোন সুফল মিলবে না।’

আরও পড়ুন:
স্মার্ট খুলনা গড়তে খালেকের ৪০ দফা ইশতেহার
সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় সিলেটে বিএনপির ৪৩ নেতা বহিষ্কার
লোডশেডিংয়ে খুলনায় ভোট কমার ভয় আ.লীগের
ভোটে ইসলামকে ব্যবহার করা উচিৎ নয়: ইসি হাবিব
নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বহিষ্কৃত জাপার ভাইস চেয়ারম্যান

মন্তব্য

জাতীয়
Barisal on the way to Gazipur

গাজীপুরের পথেই বরিশাল?

গাজীপুরের পথেই বরিশাল? বরিশাল নগর ভবন। ফাইল ছবি
দলের হয়ে বরিশাল সিটি নির্বাচনের প্রচার কমিটিতে থাকা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খোকন আবদুল্লাহ ও সাদিক আব্দুল্লাহ চাচা-ভাতিজা, একই পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তবে এখন সবাই একযোগে কাজ করছেন।’

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দৃশ্যমান সর্বশক্তি নিয়োগের পরও আওয়ামী লীগের সৎ, সজ্জন হিসেবে পরিচিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান হেরে গেছেন। সরকার তথা আওয়ামী লীগের অর্জন সুষ্ঠু নির্বাচন। দলটির নেতারা বলছেন, গাজীপুরের মতো বাকি চার সিটিতেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।

সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে রাজশাহী ও খুলনায় ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান ভালো হলেও বরিশালে ততটা সুবিধাজনক নয়।

গাজীপুরের মতো বরিশালে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী না থাকলেও দলে আছে বিভেদ। পাশপাশি ইসলামী আন্দোলনের মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম শক্তিশালী প্রার্থী। এমন বাস্তবতায় ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে গাজীপুরের মতো বরিশালেও পরাজয় ঘটতে পারে আওয়ামী লীগের।

এ নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বরিশালের সন্তান জাহাঙ্গীর কবির নানক। দলের পক্ষে বরিশালে কেন্দ্রীয় প্রচার কমিটিতেও রয়েছেন তিনি।

নিউজবাংলাকে নানক বলেন, ‘মান-অভিমান মিটে গেছে। সবাই একযোগে কাজ করছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।’

আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটিতে নির্বাচন হবে। সে হিসাবে ভোটের আর বাকি তিন দিন। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল, সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কাজ করছে নগরে।

বরিশাল সিটিতে এবার বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। এ নিয়ে চাচা, ভাতিজার মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পেয়েছে।

সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিপুলসংখ্যক অনুসারী রয়েছে তার। তার বাবা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। তাকেই কেন্দ্রীয় প্রচার প্রতিনিধি দলের প্রধান করা হয়েছে। তিনি ভাইকে নিয়ে একাধিক দলীয় কর্মসূচিও পালন করছেন; করেছেন কোলাকুলিও, তবে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলেছে, এ বিভেদ মেটার নয়।

সূত্রগুলো বলেছে, বাবা-ছেলে তাদের জায়গায় অন্য কাউকে দেখতে চান না। দলের বৃহৎ অংশ দুজনের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই তারা কেউ প্রার্থীর পক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করবেন না।

বরিশালের প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী নেতা-কর্মী এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থক নেতা-কর্মীরা খোকন সেরনিয়াবাতকে সমর্থন দিচ্ছেন, কিন্তু বরিশালের প্রার্থীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কম। একসময় তিনি যুবলীগের সদস্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে যান।

এদিকে চাচা-ভাতিজার মন কষাকষির পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার বিরোধিতাও এখন বরিশালের মানুষের মুখে মুখে। সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা প্রথম দিকে নির্বাচনী মাঠে না থাকলেও এখন দৃশ্যমান। তবুও সংশয় রয়েই যায় যে, তারা আদৌ আন্তরিকভাবে কাজ করবেন কি না। কেননা সাদিক চাচার পক্ষে ঢাকা থেকে বৈঠকে যোগ দিলেও শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে দুই পক্ষ আলাদা কর্মসূচি পালন করে। এতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে; মামলা হয়।

এর আগে খোকনের মনোনয়ন ঘোষণার পরও এক দফা সংঘর্ষ হয়। তখন থেকে কিছু নেতা-কর্মী এখনও জেলে রয়েছেন।

বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মীর আমিন উদ্দীন বলেন, ‘এখন দৃশ্যমান বিরোধ নেই। আমরা চেষ্টা করব নৌকার সব ভোট যেন খোকন সেরনিয়াবাত পান। তাহলে কেউ বিজয় ঠেকাতে পারবে না।’

এদিকে ইসলামী আন্দোলনের মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম শক্তিশালী প্রার্থী। গত দুই বছরের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামী আন্দোলন শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪০ হাজারেরও বেশি ভোট পায় ডানপন্থি রাজনৈতিক দলটি। এ ছাড়া বরিশাল সিটি নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার দিন বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়।

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘টেবিলঘড়ি’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কামরুল আহসান বিএনপি ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থী। তিনি বরিশালের বিএনপি দলীয় প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে।

কামাল বরিশাল নগর বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।২০১৩ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেনকে ১৭ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন তিনি। বাবার এই প্রভাব কামরুলের ক্ষেত্রেও কাজ দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া অধিকাংশ ওয়ার্ডে বিএনপি-জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বিএনপির সমর্থকদের ভোট পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

দলের হয়ে বরিশাল সিটি নির্বাচনের প্রচার কমিটিতে থাকা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খোকন আবদুল্লাহ ও সাদিক আব্দুল্লাহ চাচা-ভাতিজা, একই পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তবে এখন সবাই একযোগে কাজ করছেন।

‘তাদের দুজনেরই অভিভাবক দলের সিনিয়র নেতা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। নৌকার জয় হবেই ইনশাআল্লাহ।’

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে কথা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে। তিনি আওয়ামী লীগের বিভেদকে দেখছেন স্বার্থের দ্বন্দ্ব হিসেবে।

রাজনৈতিক এ পর্যবেক্ষক বলেন, ‘রাজত্ব হারানোর ভয়ে একটি অংশ মেয়র প্রার্থীকে সহায়তা করবে না, এটা স্বাভাবিক। দল ঐক্যের চেষ্টা করছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দূরত্ব রয়েই যাবে; বরং তারা বিরোধী পক্ষকে নির্বাচিত দেখতে চাইবে যাতে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি নষ্ট না হয়।’

আরও পড়ুন:
রুপনসহ বরিশাল বিএনপির ১৯ নেতাকে স্থায়ী ব‌হিষ্কার
বরিশালে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হলে কড়া আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
সিটিসহ আগামী ভোটও সুষ্ঠু হওয়ার সকল আলামত দৃশ্যমান: পরশ
আপিলে প্রার্থীতা ফিরল বরিশালের আরও ৩ প্রার্থীর
বহিষ্কারের খড়্‌গ মাথায় নিয়ে নির্বাচনে বিএনপির ১৬ প্রার্থী

মন্তব্য

জাতীয়
The name is fun to eat strangely

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা জিভে জল আনা পুরান ঢাকার খেতাপুরি। ছবি: নিউজবাংলা
খেতাপুরির নাম নিয়ে কারিগর আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার বাবায় বলছে, আগে যারা বিক্রি করত তখন ছিল সাদা; চাইলের আটা দিয়া বানানো। ওইটা খোলায় সেঁক দিয়া ভাজত, ত্যাল ছাড়া। ওইডা একটু মোটা থাকত। দ্যাখতে খেতার (কাঁথা) মতো বইল্যা মুরব্বিরা নাম রাখছেন খেতাপুরি। ওই ঐতিহ্যই চলতাছে এখন।’

নাম তার অদ্ভুত। খেতে ভারি মজা। দেখতে ডালপুরি, আলুপুরির মতো হলেও মুখরোচক খাবারটির নাম খেতাপুরি।

পুরান ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় খাবার এই পুরি। এর স্বাদ নিতে যেতে হবে লালবাগ, নাজিরাবাজার, শাঁখারীবাজার, বংশালসহ বেশ কিছু এলাকায়।

প্রস্তুত প্রণালির ভিন্নতার কারণেই খেতাপুরি নামকরণ করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী খাবারটির।

অন্য পুরিতে আটা ব্যবহার করা হলেও ময়দা দিয়ে বানানো হয় খেতাপুরি। ময়দার খামিরে পুরো করে ডাল ভরে পুরি বানানো হয়। সাধারণ ডালপুরির চেয়ে খেতাপুরিতে ডালের পুর অনেক মোটা হয়।

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

খেতাপুরির খামির। ছবি: নিউজবাংলা

বুট, খেসারি বা মসুর ডালের সঙ্গে পুদিনা পাতা, ধনে পাতা, কাঁচামরিচ কুচি, আদা, পেঁয়াজ, রসুনবাটা ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে মিশ্রণ বানানো হয়, যা মূলত খেতাপুরির পুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পুর যত ভালো হবে, খেতাপুরি তত মজা হবে। এরপর হালকা তেলে তাওয়ায় ভেজে তৈরি করা হয় খেতাপুরি।

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা
অল্প আঁচে ধীরে ধীরে ভাজা হয় খেতাপুরি। ছবি: নিউজবাংলা

খেতাপুরি নামকরণ যেভাবে

লালবাগ কেল্লার ২ নম্বর গেটের পাশে ১৫ বছর ধরে খেতাপুরির দোকান চালাচ্ছেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পুরি বিক্রি করেন তিনি।

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

লালবাগ কেল্লার দেয়ালঘেঁষা মোহাম্মদ ইব্রাহীমের খেতাপুরির দোকান। ছবি: নিউজবাংলা

ইব্রাহিম জানান, প্রথমে ময়দার সঙ্গে তেল ও পানি মিলিয়ে খামির প্রস্তুত করা হয়। এরপর রুটির সঙ্গে বাসা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানিয়ে আনা ডাল ব্যবহার করা হয়।

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা
খেতাপুরির অনন্য উপকরণ ডাল। ছবি: নিউজবাংলা

তিনি বলেন, ‘ডাইলে মসলা আছে, লেবু আছে। কাঁচামরিচ, পুদিনা, ধৈন্যা (ধনে পাতা), দারচিনি, এলাচের গুঁড়া আছে; জয়ফল আছে, তারপর হলুদ আছে। এগলা মিলায় ডাইল বানায়া খামিরের মধ্যে ভরি আরকি। তারপর ত্যালে ছাড়ি।’

পুরির নাম খেতাপুরি কেন, এমন প্রশ্ন করলে ইব্রাহিম বলেন, ‘খেতাপুরি বানায় রাখলে নরম হইয়া যায়। ভাইজা রাখলে একটু পর পোতায় যাইবগা। পোতায় যায় দেইখেই এইডার নাম দিসে খেতাপুরি। আগের মুরব্বিরা এই নাম রাইখা গেছে। আমরাও তাই এইডারে খেতাপুরি কই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডাইলপুরি ভাজলে শক্ত হইয়া যায়। আর এইডা (খেতাপুরি) থাহে নরম। ওইডার (ডালপুরি) মদ্যে ডাইল কম দেয়, এইডার মদ্যে ডাইল বেশি। এইডাই পার্থক্য। আর কিছু নাই।’

অভিজ্ঞ এ কারিগর জানান, খেতাপুরি নরম রাখতে অল্প তাপে, কম তেলে ধীরে ধীরে ভাজতে হয়। এ জন্য কেরোসিনের চুলা ব্যবহার করা হয়। গ্যাসের চুলায় এভাবে পুরি ভাজা যায় না।

মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ছোট ভাই কারিগর আবদুল জব্বার বলেন, ‘দাদারা-চাচারা যে করত, হেরা কইত্তে এই নাম পাইল, এইডা আর আমরা জানি না। এই পুরি আমরার চাচারা বানাইত; চাচাগোর থেইকা আমরা শিখছি। আসল হইল খামির। খামিরে ৫-৬ কেজি ময়দার ভিতরে ৩ পোয়া ত্যাল দিবেন আর লবণ দিবেন। বাস্।’

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

বংশপরম্পরায় খেতাপুরির দোকান চালাচ্ছেন দুই ভাই ইব্রাহিম ও জব্বার। ছবি: নিউজবাংলা

তিনি আরও বলেন, ‘হোটলের ভিতরে যেইডা ভাজে (ডালপুরি), সেইডায় এইরাম খাস্তা (পুর) দিব না। এর (খেতাপুরি) খামিরডা নরম, খাস্তা বেশি। সুন্দর কইরা ভাজুম, ডাইল বেশি। এইডার খায়ই ডাইল। ডাইলডা বেশির কারণেই এইডা নরম হইয়া যায়। এইডায় মজা বেশি। খাইলে বুজতে পারবেন, ট্যাশ আছে।’

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খেতাপুরি। ছবি: নিউজবাংলা

‘এটার টেস্ট অন্যরকম’

গাজীপুরের টঙ্গী থেকে খেতাপুরির স্বাদ নিতে এসেছেন সজল ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকে খাইতাছি আমি। এইদিকে আসলেই আসা পরে (পুরির দোকানে)। এমনকি যখন মনে চায়, তখনই চলে আসি এই পুরির টানে।’

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে খেতাপুরির স্বাদ নিতে এসেছেন সজল ভূঁইয়া। ছবি: নিউজবাংলা

পুরি খেতে খেতে তিনি বলেন, ‘অতুলনীয় স্বাদ ভাই! এত অন্তরঙ্গ মনে হয় যে, মানে আত্মা থেকে টানে এইডা আমার খাইতে। দুই-চারটা খাই, আট-দশটা নিয়া যাই পার্সেল।’

খেতাপুরি কিনতে আসা লালবাগের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অন্য পুরির চাইতে এইডা ভালা। খাইতে স্বাদ লাগে। এমনে খাইতেই মজা। টক দইয়ের আচার দিয়া খাইলে আরও মজা লাগে।’

ঢাকার জুরাইন-পোস্তগোলা থেকে বাবার সঙ্গে পুরি খেতে এসেছে আট বছরের শুভ। সে বলে, ‘এটার টেস্ট অন্যরকম। অন্য পুরিতে এতকিছু (পুর) দেয়া থাকে না।’

কাজের ফাঁকে দোকানের পাশে রিকশা থামিয়ে খেতাপুরি খাচ্ছিলেন চালক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২০-২৫ বছর ধইরা এই পুরি খাই। রিকশার খ্যাপ লইয়া আইলেই এহোনও ভালো লাগে; আয়া খাই। আগে আরও উন্নত (ভালো স্বাদ) ছিল, অহন কেমন জানি। আগে আরও ছুডুবেলায় যহন খাইতাম, তহন আরও ভালো লাগত।’

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

২০ বছর ধরে খেতাপুরি খেতে আসেন রিকশাচালক শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: নিউজবাংলা

মিরপুর ১২ নম্বর থেকে আসা ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমি প্রায়ই এদিকে আসলে এটা (খেতাপুরি) খাই। আর, এটা প্রায় বেশ অনেক দিন ধরেই খাচ্ছি এখানে। ভেতরে একটু পুদিনা পাতা, ধনিয়া পাতার ফ্লেভার থাকে।’

‘আর হচ্ছে ডাল-টাল বেশি থাকে, আলু থাকে। এইটার ফ্লেভারটা টোটালি আলাদা। ফার্স্ট যখন খাইছি, তখন ২ টাকা করে খাইছি। ১ টাকাও খাইছি। এইটা এখন হইছে ১০ টাকারও বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাসার সবাই খেতাপুরি পছন্দ করে। আমি প্রায়ই নিয়ে যাই। এখন নিজে খেলাম আর দুইটা বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্যও কিছু নিয়ে যাচ্ছি।’

লালবাগ কেল্লার পাশে চা-সিগারেটের দোকান চালান স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী আদিল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা ছোটোত থেকেই দেইখে আসতেছি এইখানে দোকানদারি (খেতাপুরির) চলে। উনারা (ইব্রাহিম ও জব্বার) যে বেচাকেনা করে, অনেক ভিড়ভাট্টা হয়। ভালো লোকসমাগম হয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসে এখানে।’

আদিল আরও বলেন, ‘নরমাল পুরি বেশি ত্যালে ভাজা, এইডায় হালকা ত্যাল, যে কারণে সবাই খাইতে পারে। আমরা পরিবারসহ এই দোকানে খাই, বাসায় নিয়া যাই। এইটার যে আলাদা স্বাদ, না খাওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারবেন না।’

‘সাগরিদের সাগরিদরা এখন ব্যবসা করে’

লালবাগ কেল্লার দেয়ালঘেঁষা মোহাম্মদ ইব্রাহীমের অস্থায়ী দোকানটিতে সন্ধ্যার পর ভিড় জমে রসনাবিলাসীদের। বসার জায়গা না থাকলেও ভোক্তার অভাব নেই। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পুরি খেতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য।

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

লালবাগ কেল্লার দেয়ালঘেঁষা দোকানে রসনাবিলাসীদের ভিড়। ছবি: নিউজবাংলা

ওই দোকানটি ছাড়াও লালবাগ এলাকায় বেশ কয়েকটি খেতাপুরির দোকান রয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগ বেশ পুরোনো।

ঠিক কবে থেকে খেতাপুরির প্রচলন, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি কেউ। লালবাগের স্থানীয় বাসিন্দা জাকির আহমেদ বলেন, ‘ছোটকালেত থেইকে শুনে আসছি, স্বাধীন পিরোডের আগে (স্বাধীনতার পূর্বে) লালবাগ এলাকার কেল্লার গেটের অপজিটে একটি দোকান ছিল। সেই দোকানে এই খেতাপুরিটা বানাত। উনিই (নাম জানা নেই) সর্বপ্রথম এই লালবাগে এবং এই পুরানো ঢাকায়, উনিই ইতিহাস করছে এই খেতাপুরির।’

‘খেতাপুরির যে স্বাদ, এইডা উনিই একমাত্র এই পুরান ঢাকায় দেখাইছে। উনার আগে কেউ তৈরি করেনি। সেই দোকান এখন আর নেই। যে এটা বানিয়েছেন প্রথম, উনি এখন বেঁচে নেই। উনার ছেলেরাও কেউ ব্যবসার হাল ধরে নাই। কেল্লার ২ নম্বর গেটের সামনের দোকানে উনার সাগরিদের সাগরিদরা (শিষ্য) এখন ব্যবসা করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই পুরান ঢাকার খেতাপুরির স্বাদ কেউ নিতে পারে নাই। অন্যান্য এলাকায় খেতাপুরির নাম শুনে খেতাপুরি বানাইছে, কিন্তু নামে বানাইছে, কাজে কখনও কেউ বানাইতে পারে নাই। খেতাপুরি বানাইতে ব্যতিক্রম মসল্লা (পুর) লাগে, যে মসল্লাডা অনেকে জানেও না। এই মসল্লাডা কীভাবে মিক্স করতে হয়, যারা জানে, একমাত্র তারাই করতে পারবে। এ ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবে না।’

হাতেগোনা কারিগর

লালবাগের গোরে শহীদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দোকান বসিয়েছেন খেতাপুরির কারিগর পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. আবুল কাশেম। বাবার কাছ থেকে খেতাপুরি বানানো শিখেছেন।

কাশেম বলেন, ‘আট আনা থেইকে আমার বাবা এই পুরি বেচা শুরু করছে। এখন বেচি ৫ টাকা। আল্লায় (বাবাকে) এহনও জীবিত রাখছে, সে এহনও বিক্রি করে। তার কাছ থেইকেই আমার শিখা।’

কাশেমের দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০টি খেতাপুরি বিক্রি হয়। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।

তিনি বলেন, ‘মসল্লা মজার কারণে দূরদূরান্ত থেইকে লোকজন আহে, নিয়া যায়। অনেক গরব (গর্ব) লাগে। এতদূর থিইক্যা পুরি নিতে আমার কাছে আসে, আনন্দ লাগে।’

আবুল কাশেমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরান ঢাকায় হাতেগোনা কয়েকজন খেতাপুরি বানান। এর মধ্যে লালবাগ চৌরাস্তার আশপাশে বসেন তিন থেকে চারজন। এ ছাড়া নাজিরাবাজার, বংশাল এবং নবাবগঞ্জেও এই পুরি পাওয়া যায়।

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা
পুরান ঢাকায় খেতাপুরির দোকান। ছবি: নিউজবাংলা

খেতাপুরির নাম নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবায় বলছে, আগে যারা বিক্রি করত, তখন ছিল সাদা; চাইলের আটা দিয়া বানানো। ওইটা খোলায় সেঁক দিয়া ভাজত, ত্যাল ছাড়া। ওইডা একটু মোটা থাকত। দ্যাখতে খেতার (কাঁথা) মতো বইল্লা মুরব্বিরা নাম রাখছেন খেতাপুরি। ওই ঐতিহ্যই চলতাছে এখন।’

প্রস্তুত প্রণালি একই, নাম ডালরুটি

কাশেমের কথার সূত্র ধরে খেতাপুরির আদি সংস্করণের সন্ধান করেছে নিউজবাংলা। পুরান ঢাকার বংশালের এক পিঠার দোকানে দেখা মেলে তার, তবে নাম আলাদা। খেতাপুরি নয়, এটি এখন ডালরুটি নামে পরিচিত। পুর প্রস্তুত প্রণালি একই; পার্থক্য খামির আর রন্ধন কৌশলে। চালের আটায় বানানো ডালরুটি তাওয়ায় স্যাঁকা হয়। অল্প আঁচে, ধীরে ধীরে কাঁচা পুরির সাদা রং বাদামি হয়ে গেলে ভাজার প্রক্রিয়া শেষ হয়।

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

তেল ছাড়াই তাওয়ায় সেঁকে তৈরি হয় ডালরুটি। ছবি: নিউজবাংলা

একই এলাকার পাশের এক গলিতে দেখা মেলে আরেকটি দোকানের। ফুটপাতে বসা দোকানটির কারিগর মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘খেতাপুরি ত্যালে ভাজে। এইডা (ডালরুটি) ত্যাল ছাড়া ভাজা হয়। শুধু তাওয়ায় ছ্যাঁক দিয়াই ভাজি।’

এই দোকানে ডালরুটি কিনতে আসা রুবেল হোসেন বলেন, ‘একই জিনিস, তেলে ভাজলে খেতাপুরি, তাওয়ায় সেঁকলে ডালরুটি। দুইটাই খেতে মজা। তয় খেতাপুরির চল একটু বেশি।’

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

তেল ছাড়া ভাজা হয় ডালরুটি। ছবি: নিউজবাংলা

বাড্ডা থেকে পুরান ঢাকায় ঘুরতে এসেছেন সাইক্লিস্ট মশিউর রহমান। শখের বসে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে মুখরোচক খাবার খাওয়াই তার উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ‘খেতাপুরি আর ডালরুটি দুটোই আমি খেয়েছি, তবে কেল্লার গেটের খেতাপুরির স্বাদ অনন্য। ডালরুটিতে তাওয়ার ছেঁক দেয় বলে আমার কাছে একটু কাঁচা কাঁচা লেগেছে। এ ছাড়া সবই ভালো।’

অদ্ভুত তার নাম, খেতে ভারি মজা

খেতাপুরির আদি সংস্করণ ডালরুটি। ছবি: নিউজবাংলা

খেতাপুরি, ডালরুটির মতো এমন অনেক মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে। বাহারি এসব খাবারের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী খেতাপুরির স্বাদ আস্বাদনে যেতে পারেন যেকোনো দিন। দোকানগুলোতে সন্ধ্যার পর বেশ ভিড় থাকে। তাই অপেক্ষাকৃত আরামে খেতে যেতে পারেন বিকেলে।

মন্তব্য

জাতীয়
Sylhet City Election Courts ban is not obeyed by the candidates

সিলেটে পোস্টার নিয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা মানছেন না প্রার্থীরা

সিলেটে পোস্টার নিয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা মানছেন না প্রার্থীরা সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এক প্রার্থীর লেমিনেটেড পোস্টার। ছবি: নিউজবাংলা
সিলেট সিটি করপোরেশনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা তারেক আহমেদ বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পেলে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার অপসারণে অভিযান চালানো হবে।’

সিলেট নগরের জিন্দাবাজার মোড়। সড়কের ওপর বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ঝুলে আছে সিটি নির্বাচনের বিভিন্ন প্রার্থীদের পোস্টার। প্রায় সবগুলো পোস্টারই পলিথিনে মোড়ানো, লেমিনেটিং করা। অথচ লেমিনেটেড পোস্টার ছাপানো ও প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে উচ্চ আদালতের। সেই নিষেধাজ্ঞা মানছেন না সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনের প্রার্থীরা।

আগামী ২১ জুন সিসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে মেয়র পদে ৭, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৭৩ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৮৭ জন প্রার্থী হয়েছেন। ২ জুন থেকে এই সিটিতে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রচার। ওই দিন থেকেই ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরো নগর।

বৃষ্টিতে পোস্টার নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় বেশির ভাগ প্রার্থীই পোস্টার লেমিনেটিং করে টানিয়েছেন। ফলে কেবল জিন্দাবাজার মোড় নয়, নগরের প্রতিটি সড়ক এমনকি, পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোও ছেয়ে গেছে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টারে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন পরিবেশকর্মীরা। এ ছাড়া নগরজুড়ে ঝুলে আছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পিভিসি ব্যানার।

২০২০ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে এক আইনজীবীর উচ্চ আদালতে রিট করেন। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদেশে যেকোনো নির্বাচনী প্রচারে লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সারা দেশে লেমিনেটেড পোস্টার তৈরি ও প্রদর্শন বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়।

এই নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ‘এসব পোস্টারের বেশির ভাগই ছিঁড়ে আশপাশের খাল বা ড্রেনে জমা হবে। আর পলিথিন পচনশীল না হওয়ায় এগুলো পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি নগরে জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি করবে। তাই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার প্রদর্শন বন্ধে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে কঠোর হওয়া প্রয়োজন।’

নগরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে লেমিনেটিং করা পোস্টার টানিয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থী ও বর্তমান কাউন্সিলর তৌফিকুল হাদী।

তিনি বলেন, ‘এখন বৃষ্টির মৌসুম। ঝড়-বৃষ্টিতে কাগজের পোস্টার ছিঁড়ে যায়। তাই লেমিনেটিং করা পোস্টার টানিয়েছি, তবে এ ব্যাপারে আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আমার জানা নেই। নির্বাচন কমিশন থেকেও লেমিনেটেড পোস্টার টানানোর ব্যাপারে কোনো আপত্তি জানানো হয়নি।’

নগরজুড়েই লেমিনেটিং করা পোস্টার টানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মাহমুদল হাসান। লেমিনেটেড পোস্টারের বিষয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানা নেই দাবি করে মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব প্রার্থীকে বলে দেয়া উচিত ছিল।’

মাহমুদুল হাসান আরও বলেন, ‘নির্বাচন শেষে আমার পোস্টারগুলো আমি নিজেই অপসারণ করে নেব যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়।’

প্রায় সবাই পোস্টার পলিথিনে মুড়িয়ে টানালেও ব্যতিক্রমও কয়েকজন। তেমনই একজন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল করিম চৌধুরী কিম। তিনি নিজেও পরিবেশকর্মী। বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে পোস্টার পলিথিনে মোড়াননি তিনি।

কিম বলেন, ‘পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর পলিথিন। বর্ষার সময় এসব পরিত্যক্ত পলিথিন জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই একজন পরিবেশকর্মী হিসেবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার আর্থিক ক্ষতি ও কষ্ট হলেও নির্বাচনী পোস্টার পলিথিনে মোড়াব না।’

এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা তারেক আহমেদ বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পেলে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার অপসারণে অভিযান চালানো হবে।’

এখনও পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার নজরে পড়েনি বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন।

আরও পড়ুন:
নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বহিষ্কৃত জাপার ভাইস চেয়ারম্যান
ঢাকা-১৭ আসন: আওয়ামী লীগের মনোনয়নের দৌড়ে রাজনীতিক ব্যবসায়ী তারকা
রুপনসহ বরিশাল বিএনপির ১৯ নেতাকে স্থায়ী ব‌হিষ্কার
দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন রুপন
বরিশালে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হলে কড়া আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

মন্তব্য

জাতীয়
Dialogue in discussion

আলোচনায় সংলাপ

আলোচনায় সংলাপ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ চার রাজনীতিক আমির হোসেন আমু, আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের ও হাছান মাহমুদ সংলাপ নিয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন। কোলাজ: নিউজবাংলা
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি বন্ধুরা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। অনেক ইস্যুতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়, তবে সম্প্রতি আমাদের দলের প্রতিনিধিরা সৌজন্য সাক্ষাতেই গেছেন।’

এক দিন আগেই জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে বক্তব্য দিয়ে বুধবার বিপরীত কথা বলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, ‘কাউকে সংলাপে আহ্বান করার সুযোগ নেই। এটা আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত না যে, দাওয়াত করে এনে খাওয়াব। আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয়নি, কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়নি।’

আমুর মঙ্গলবারের বক্তব্যের পর দেশের রাজনীতিতে সংলাপ নিয়ে আলোচনা ডালপালা মেলতে থাকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলসহ রাজনীতি সচেতনরা ধরে নিয়েছিলেন ‘পারদ গলতে শুরু করেছে’। পরের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, সবকিছুই সংলাপের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে শেষ করতে হবে।’

একই দিনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের বক্তব্য ছিল ভিন্ন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এ দুই নেতা বলেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দেশে এমন কোনো সংকটও নেই যে, জাতিসংঘের মধ্যস্থতা লাগবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি কিছু না বললেও কোনো চাপে নতি স্বীকার করবেন না বলে জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের এমন অবস্থানের পরও পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে হয়তো তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সাম্প্রতিক বৈঠকের বিষয়টিকে সামনে এনেছে।

সংলাপের বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিস্থিতি জটিল। বিদেশি বন্ধুরা জড়িয়ে পড়েছে। উল্লেখযোগ্য দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বসছেন। আলোচনাও নিশ্চয়ই কিছু হচ্ছে। এখন দেখা যাক পরিণতি কী হয়।

‘খুব আশাব্যঞ্জক মনে হয় না, তবে আশা করছি আলাপ-আলোচনায় একটি সমাঝোতা হবে। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হয়, আমরা জটিলতায় পড়ব।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যা সমাধান আমাদেরকেই করতে হবে। কারও মধ্যস্থতার দরকার নেই। কেননা সরকার এবং বিরোধী দল উভয়ই বলছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তাহলে আলাপ-আলোচনায় একটা সমাধান আসতেই পারে।’

আমির হোসেন আমুর মঙ্গলবারের বক্তব্যের পর বুধবার ওবায়দুল কাদের জানান, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি তারা। হাছান মাহমুদ বলেন, আমুর বক্তব্য ব্যক্তিগত, দল ও সরকারের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি ১৪ দলের মধ্যেও নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের ব্যস্ততা

নির্বাচনের সাত মাসেরও কম সময় আগে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত সময় পার করছেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত পিটার হাস। তিনি গত ৬ জুন দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। একই দিন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন হাস। এর আগে ৪ জুন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।

বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। একই দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূত চার্লস হোয়াইটলির সঙ্গে তার কার্যালয়ে বৈঠক করে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল।

সাম্প্রতিক অতীতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ইইউর দূতের বৈঠক হয়। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেন হাস।

বৈঠকগুলোকে শুরুর দিকে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হলেও বর্তমানে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র শন ম্যাকিনটোশ মঙ্গলবার ইমেইলে একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচার, প্রক্রিয়াসহ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন তারা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনীতিবিষয়ক লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা মুখে অনেক কিছুই বলে, কিন্তু গত কয়েক দিন বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে তাদের বৈঠক বলে দেয়, তলে তলে অনেক কিছুই হচ্ছে। সেটা হতে পারে আলোচনা, দেন-দরবার, তবে সেটা বাইরে থেকে বোঝার সুযোগ নেই।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি বন্ধুরা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। অনেক ইস্যুতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়, তবে সম্প্রতি আমাদের দলের প্রতিনিধিরা সৌজন্য সাক্ষাতেই গেছেন।’

বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দল ও সরকারের স্পষ্ট অবস্থান, সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন হতে হবে। এতে নতুন করে আর আলোচনার কিছু নেই।’

আরও পড়ুন:
মেরুদণ্ড সোজা রাখার চেষ্টা করব: সিইসি
ইসির সংলাপে যাচ্ছে না বিজেপি
সংলাপে যাবে না ইসলামী আন্দোলন
সংলাপে ওয়ার্কার্স পার্টির ১১ দফা প্রস্তাব
কেন্দ্রে ভোটার না এলে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু: সিইসি

মন্তব্য

জাতীয়
Sweet mango cultivation is increasing in Lalmai hills

লালমাই পাহাড়ে বাড়ছে মিষ্টি আমের চাষ

লালমাই পাহাড়ে বাড়ছে মিষ্টি আমের চাষ লালমাই পাহাড়ের বারপাড়া এলাকায় আমের পরিচর্যায় ব্যস্ত এক বাগানমালিক। ছবি: নিউজবাংলা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাগানটি পরিদর্শন করেছি। এই আম সবার শেষে বাজারে আসে। স্বাদ অসাধারণ। রসালো। বাজারে এই আমের চাহিদা ভালো। তাই বারি-৪ চাষ করে কৃষক লাভবান হতে পারবেন।’

আমের ভারে ডালগুলো নুইয়ে পড়ছে। রং, আকার, আকৃতি প্রায় এক। কোনো কোনো গাছ থেকে ভেসে আসছে পাকা আমের সুমিষ্ট ঘ্রাণ। এমন দৃশ্য এখন কুমিল্লা লালমাই পাহাড়ের চূড়ায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে বাড়ছে মিষ্টি আমের চাষ।

পাহাড়ের বড় ধর্মপুর, বারপাড়া, রতনপুরসহ বিভিন্ন এলাকার বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলছে নানা জাতের আম। শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে আমের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিকরা।

পাহাড়ের বারপাড়া এলাকার একটি বাগানে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড় ও ঢালুতে এই বাগানের অবস্থান। বাগানের পরিমাণ দুই একর। চার থেকে পাঁচ হাত উঁচু আম গাছ। প্রতি গাছে কয়েকশো আম ঝুলছে। গাছে গাছে আম দেখে মনে হবে আমের মেলা বসেছে কিংবা কোনো শিল্পী তার পটে ছবি এঁকে রেখেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা আসছেন বাগানের আম দেখতে। এই বাগানে হালকা বাতাসে দুলছে বারি-৪ আম।

বাগানের মালিক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা এআরএম হারিছুর রহমান ও তার স্ত্রী জোহরা নাছরিন বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত। তারা গাছের মরা ডাল ভেঙ্গে দিচ্ছেন। গাছে পানি দিচ্ছেন। আগাছা পরিষ্কার করছেন।

এআরএম হারিছুর রহমান বলেন, ‘এটা আমার গ্রামের বাড়ি। জায়গাটি খালি পড়ে ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের লোকজনের পরামর্শে বাগানটি করেছি। এই শুকনো মাটিতে এই আম হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। তাদের পরামর্শে পরিচর্যা করেছি। এই বাগান থেকে সাত বছর ফল সংগ্রহ করছি। আমার বাগান দেখে আরও কয়েকজন উদ্বুদ্ধ হয়েছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আশাবাদ আগামী কয়েক বছরে পাহাড়ে আমের চাষ আরও বাড়বে।

স্থানীয় উপসহকারী কৃষি অফিসার এম এম শাহারিয়ার ভূঁইয়া বলেন, ‘বারি-৪ ওজনে ৫০০ থেকে ৯০০ গ্রাম হয়ে থাকে। স্বাদ ভালো। কাঁচা পাকা উভয় অবস্থায় এটি মিষ্টি। আমাদের পরামর্শ মোতাবেক পরিচর্যা করায় তার বাগানের ফলন ভালো হয়েছে। তার দেখাদেখি অন্যরাও আগ্রহী হচ্ছেন।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাগানটি পরিদর্শন করেছি। এই আম সবার শেষে বাজারে আসে। স্বাদ অসাধারণ। রসালো। বাজারে এই আমের চাহিদা ভালো। তাই বারি-৪ চাষ করে কৃষক লাভবান হতে পারবেন।’

আরও পড়ুন:
আমিরাতে আগুনে তিন বাংলাদেশির মৃত্যু
আম গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে সফেদা!
গুটি দিয়ে নওগাঁয় আম পাড়া শুরু
৯২৬ বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে মোংলায় বিদেশি জাহাজ
নাটোরে আম পাড়া শুরু

মন্তব্য

জাতীয়
Bangabandhus narrative of post six point events

বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় ৬ দফা-পরবর্তী ঘটনাবলী

বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় ৬ দফা-পরবর্তী ঘটনাবলী
৬ দফার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন এবং বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। সেখানে বসেই তিনি পরবর্তী ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন, যা তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’ তে ছাপানো হয়। বইটির বিভিন্ন স্থানে ৬ দফা সম্পর্কিত লেখাগুলো সংকলন করেছে আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিচার্স অ্যান্ড ইনফরমেশন। তা থেকে চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরা হলো হয়েছে এই লেখনীতে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফাকে বলেছিলেন- ‘আমাদের বাঁচার দাবি’। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের জাতীয় সম্মেলনে তিনি ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ৬ দফার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়। ৬ দফা হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সনদ।

৬ দফার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন এবং বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। সেখানে বসেই তিনি পরবর্তী ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন, যা তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’ তে ছাপানো হয়। বইটির বিভিন্ন স্থানে ৬ দফা সম্পর্কিত লেখাগুলো সংকলন করেছে আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিচার্স অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। তা থেকে চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরা হলো-

২রা জুন ১৯৬৬

সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তর হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহিরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য।

অসীম ক্ষমতার মালিক সরকার সবই পারেন। এত জনপ্রিয় সরকার তাহলে গ্রেপ্তার শুরু করেছেন কেন। পোস্টার লাগালে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে। জেলের এক কোণে একাকী থাকি, কিভাবে খবর জানব?

শুনলাম ১২/১৩ জন রাতে এসেছে। আবদুল মোমিন এডভোকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ, ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, হাফেজ মুছা, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মোস্তফা সরোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ-সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, রাশেদ মোশাররফ, সহ সম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেন।

এই নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য আন্দোলন যে পিছাইয়া যাবে না, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নাই। বুঝলাম সকলকেই আনবে জেলে। ধরতে পারলে কাউকে ছাড়বে না । মীজান ফিরে এসেছে এই একটা ভরসা। অনেকে আবার ভয়েতে ঘরে বসে যাবে, সে আমার জানা আছে। হাফেজ মুছা সাহেব বুড়া মানুষ, কষ্ট পাবেন হয়তো, পূর্বে কোনোদিন জেলে আসেন নাই। তবে শক্ত মানুষ। চৌধুরী সাহেব বেচারা খুবই নরম। আর সকলেই শক্ত আছে। আন্দোলনের ক্ষতি হবে এই ভাবনা আমার মনটাকে একটু চঞ্চল করেছে।

কোনোমতে খেয়ে বসে রইলাম, খবরের কাগজ কখন আসবে? কাগজ এল, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে খবর এসেছে পুলিশ বাহিনী নিজেরাই দিনের বেলায় ৭ই জুনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় তো করছেই। এই তো স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি।

এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজে ন্যাপ নেতা মি. মশিউর রহমান ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছেন। ইত্তেফাক ও অন্যান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয় দফার দাবি সম্বন্ধে তার মতামত দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমনকি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না।’

এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছুসংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজেদেরকে চীনপন্থী বলে থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে।

ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এরা পিন্ডি করাচী যাওয়া-আসা করে, আর পারমিটের ব্যবসা বেনামীভাবে করে থাকে। এদের জাতই হলো সুবিধাবাদী। এর পূর্বে মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।

মওলানা সাহেবকে আমি জানি। কারণ তিনিই আমার কাছে অনেকবার অনেক প্রস্তাব করেছেন। এমনকি ন্যাপ দলে যোগদান করেও। সেসব আমি বলতে চাই না। তবে ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব জানেন। এসব কথা বলতে জহুর ভাই তাকে নিষেধও করেছিলেন।

মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেইভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।

৪ঠা জুন ১৯৬৬

ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ই জুনের হরতল সম্বন্ধে কোন সংবাদ ছাপতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। কিছুদিন পূর্বে আরও হকুম দিয়েছে- এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করছে এটা লিখতে পারবা না। ছাত্রদের কোন নিউজ ছাপতে পারবা না। আবার এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারব না।’ ইত্তেফাকের উপর এই হুকুম দিয়েছিল। এটাই হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।

আওয়ামী লীগ কর্মীরা আর ছাত্র-তরুণ কর্মীরা কাজ করে যেতেছে। বেপরোয়া গ্রেপ্তারের পরও ভেঙে পড়ে নাই দেখে ভালই লাগছে। রাজনৈতিক কর্মীদের জেল খাটতে কষ্ট হয় না, যদি বাইরে আন্দোলন থাকে।

৫ই জুন ১৯৬৬

আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে চলেছে। আরও আটজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন জায়গার। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবি দাবাইয়া দেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত।

যে পথ অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবি যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে যে তাদের দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হবে।

এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলা হতেছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে।

এখন একমাত্র চিন্তা কর্মীরা নেতা ছাড়া আন্দোলন চালাইয়া যেতে সক্ষম হবে কিনা! আমার বিশ্বাস আছে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ কর্মীরা তাদের সাথে আছে। কিছুসংখ্যক শ্রমিক নেতা-যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে— তারাও নিশ্চয়ই সক্রিয় সমর্থন দেবে। এত গ্রেপ্তার করেও এদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। ৭ই জুন হরতালের জন্য এরা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে। পোস্টার ছিঁড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে, প্যামফ্লেট বাহির করছে। সত্যই এতটা আশা আমি করতে পারি নাই।

মাথার ভিতর শুধু ৭ই জুনের চিন্তা। কী হবে। তবে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনমত আমার জানা আছে।

৬ই জুন ১৯৬৬

আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ৬ দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব যেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাধার চেষ্টা যে তিনি করছেন এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও বোঝেন না।

ঘরে এসে বই পড়তে শুরু করে আবার মনটা চঞ্চল হয়ে যায়। আবার বাইরে যাই- কেবল একই চিন্তা! দুপুর বেলা খাওয়ার পূর্বেই কাগজগুলি এল।

ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। যশোরে আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করেছে। ভূতপূর্ব মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মশিয়ুর রহমান প্রতিবাদ করেছেন। নূরুল আমীন সাহেব আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মুক্তি দাবি করেছেন। ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকেসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করেছেন। তারা ৬ দফা দাবিকে সমর্থন করেছেন এবং জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ৯ জন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ও ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ এবং তাদের মুক্তি দাবি করেছেন।

আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মীরা হরতালকে সমর্থন করে পথসভা করে চলেছেন। মশাল শোভাযাত্রাও একটি বের করেছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও কর্মীরা ভেঙে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে। নিশ্চয়ই আদায় হবে জনগণের দাবি।

আজাদ যেটুকু সংবাদ পরিবেশন করিতেছে তাহাতে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেওয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্টকর তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন।

ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা। এক একজনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনদিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদী ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।

৭ই জুন ১৯৬৬

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কী হয় আজ? আবদুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীয় ভেদ করে খবর আসলো- দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে।

আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বে-আইনী কিছুই করবে না। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দিবে না।

আবার খবর এল টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠিচার্জ হতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। কয়েদিরা কয়েদিদের বলে। সিপাইরা সিপাইদের বলে। ১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ৬ দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়- এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।

এ খবর শুনলেও আমার মনকে বুঝাতে পারছি না। একবার বাইরে একবার ভিতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। বন্দি আমি, জনগণের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কী করতে পারি। বিকালে আবার গুজব শুনলাম- গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে। মেডিকেল হাসপাতালে একজন মারা গেছে। একবার আমার মন বলে, হতেও পারে, আবার ভাবি সরকার কি এতো বোকামি করে? ১৪৪ ধারা দেওয়া হয় নাই। গুলি চলবে কেন?

একটু পরেই খবর এল ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না। কিছু জায়গায় টিয়ার গ্যাস মারছে সে খবর পাওয়া গেল।

বিকালে আরও বহু লোক গ্রেপ্তার হয়ে এল। প্রত্যেককে সামারী কোর্ট করে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকেও এক মাস, কাহাকে দুই মাস। বেশির ভাগ লোকই রাস্তা থেকে ধরে এনেছে শুনলাম। অনেকে নাকি বলে রাস্তা দিয়া যাইতেছিলাম ধরে নিয়ে এল। আবার জেলও দিয়ে দিল। সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার। তালা বন্ধ হওয়ার পূর্বে খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ, কার্জন হল ও পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে। বুঝতে পারি না সত্য কি মিথ্যা। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না। সেপাইরা আলোচনা করে, তার থেকে কয়েদিরা শুনে আমাকে কিছু কিছু বলে।

তবে হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনোদিন হয় নাই, এমনকি ২৯ শে সেপ্টেম্বরও। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতোই হয়েছে হরতাল।

গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি। যে এক টিন তামাক বাইরে আমি ছয়দিনে খাইতাম, সেই টিন এখন চারদিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে? নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি । তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই।

দৈনিক আজাদ পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, ‘আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল’। প্রোগ্রামটাও দিয়েছে ভাল করে।

পাকিস্তান অবজারভার হেডলাইন করেছে ‘হরতাল’ বলে। খবর মন্দ দেয় নাই। মিজানের বিবৃতিটি চমৎকার হয়েছে। হলে কি হবে, ‘চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।’

৮ই জুন ১৯৬৬

ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেপ্তার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারে না নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই।

অনেক যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে জখম, কারও কপাল কেটে গিয়াছে, কারও হাত ভাঙ্গা। এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোনো দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল অন্য জায়গায়, সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে। দিনভরই লোক আনছিল অনেক। কিছুসংখ্যক স্কুলের ছাত্র আছে।

জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেহ কেহ খুবই ভাল ব্যবহার করেছে। আবার কেহ কেহ খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে। মোবাইল কোর্ট করে সরকার গ্রেফতারের পরে এদের সাজা দিয়ে দিয়েছে। কাহাকেও তিন মাস, আর কাহাকেও দুই মাস, এক মাস ও কিছু সংখ্যার ছেলেদের দিয়েছে। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ভাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে! এরা রাতভর কেঁদেছে। ভাল করে খেতে পারে নাই। এই সরকারের কাছ থেকে মানুষ কেমন করে বিচার আশা করে?

জেল কর্তৃপক্ষ কোথায় এত লোকের জায়গা দিবে বুঝে পাই না। ছোট ছোট ছেলেদের আলাদা করে রাখতে হয়। এর জেলে আসার পরে খবর এল ভীষণ গুলিগোলা হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ায় গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। চুপ করে বসে নীরবে সমবেদনা জানান ছাড়া আমার কি করার আছে। আমার চরিত্রের মধ্যে ভাবাবেগ একটু বেশি। যদিও নিজকে সামলানোর মতো ক্ষমতাও আমার আছে। বন্দি অবস্থায় এই সমস্ত খবর পাওয়ার পরে মনের অবস্থা কি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না।

২টার সময় কাগজ এল। আমি পূর্বে যা অনুমান করেছি তাই হলো । কোনো খবরই সরকার সংবাদপত্রে ছাপতে দেয় নাই। ধর্মঘটের কোনো সংবাদই নাই। শুধু সরকারি প্রেস নোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলেরই একই অবস্থা। একেই বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! ইত্তেফাক মাত্র চার পৃষ্ঠা । কোন জেলার কোন সংবাদ নাই । প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরাপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ রইল না।

খবরের কাগজগুলো দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম। পত্রিকার নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই। তবে সরকারি প্রেসনোটেই স্বীকার করেছে পুলিশের গুলিতে দশজন মারা গিয়াছে। এটা তো ভয়াবহ খবর। সরকার যখন স্বীকার করেছে দশজন মারা গেছে, তখন কতগুণ বেশি হতে পারে ভাবতে আমার ভয় হলো!

কতজন যখম হয়েছে সরকারি প্রেসনোটে তাহা নাই। সমস্ত দোষই যেন জনগণের । যেখানে উসকানি দিতেছে সরকারের প্রতিনিধিরা, আওয়ামী লীগ সেখানে পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে চাই। এবং সে অনুযায়ী তারা কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছে । এখন জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নাই । যেখানে পুলিশ ছিল না সেখানে কোনো গন্ডগোল হয় নাই। চকবাজার ও অন্যান্য জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট হয়েছে। সে খবর পেয়েছি।

বেলা ১১টার সময় ১৪৪ ধারা জামি করে আর সাথে সাথে গুলি শুরু হয়। পূর্বে জারি করলেই তো কর্মী আর জনসাধারণ জানতে পারে। যখন আওয়ামী লীগ তার প্রোগ্রাম খবরের কাগজে বের করে দিল যাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ১টায় শোভাযাত্রা, বিকালে সভা শেষে আবার শোভাযাত্রা। তখন তো ১৪৪ ধারা জারি করে নাই। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সরকারের দালালেরা ও কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী কর্মচারী কোনো এক উপর তলার নেতার কাছ থেকে পরামর্শ করে এই সর্বনাশ করেছে।

তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকান পাট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি পাকিস্তানে হয়েছে?

ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবেনা, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।

যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কাল রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশে ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সম্পদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি দিতে পারি। আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।

সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে বাইরে করতে লাগলাম। রাত কেটে গেল। একটু ঘুম আসে, আবার ঘুম ভেঙে যায়।

৯ জুন ১৯৬৬

অনেক রিকশাওয়ালাকে এনেছে, বোধ হয় বাড়িতে তাদের ছেলে মেয়ে না খেয়েই আছে। দুই মাসের সাজা দিয়েছে অনেকে। খবরের কাগজে দেখলাম সরকার স্বীকার করেছে আরও একজন হাসপাতালে মারা গিয়াছে। এই নিয়ে ১১ জনের মৃত্যু হলো। যারা আহত হয়েছে তাদের কোনো সংবাদ নাই আজ পর্যন্ত। প্রশ্ন জাগে, ১১ জন মারা গেছে না অনেক বেশি মারা গেছে?

১২ই জুন ১৯৬৬

দেখেই খুশি হলাম যে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনেকেই জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সঙ্কল্প করিয়াছে। রক্ত এরা বৃথা যেতে দিবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক্টিং সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের। তার সভাপতিত্বে ১১ ঘন্টা ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদে যোগদান করতে পিন্ডি চলে গেছে। ১৭, ১৮, ১৯ জুন জুলুম প্রতিরোধ দিবস উদযাপন করার আহ্বান জানাইয়াছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৬ আগস্ট এর পূর্বে সমস্ত গণবিরোধী ব্যবস্থার অবসান দাবি করিয়াছে। তা না করিলে ১৬ই আগস্ট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গণআন্দোলন শুরু করা হবে। মনে মনে ভাবলাম আর কেউ আন্দোলন নষ্ট করতে পারবে না। দাবি আদায় হবেই।

৬ দফার বাস্তবায়ন সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘোষণা করেছে। এখন আর আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে। ভাবতে লাগলাম কর্মীদের টাকার অভাব হবে। পার্টি ফান্ডে টাকা নাই। আমিও বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসতে পারি নাই। মাসে যে টাকা আদায় হয় তাতে অফিসের খরচ চলে যেতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস আছে, অর্থের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে থাকে না। জনসমর্থন যখন আওয়ামী লীগের আছে, জনগণের প্রাণও আছে। আমি দেখেছি এক টাকা থেকে হাজার টাকা অফিসে এসে দিয়ে গিয়াছে, যাদের কোনোদিন আমি দেখি নাই। বোধ হয় অনেককে দেখবোও না। ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য । তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।

১৪ই জুন ১৯৬৬

পূর্ব পাকিস্তানের উপর জুলুমের খবর আজ আর গোপন নাই। ৬ দফা দাবি পেশ করার সাথে সাথে দুনিয়া জানতে পেরেছে বাঙালিদের আঘাত কোথায়? পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিত- শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাঙালির একটি গোঁ আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে। পূর্ব বাংলার বাঙালি এটা বুঝতে পেরেছে যে এদের শোষণ করা হতেছে চারদিক দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে।

আমি বিকালে সেলের বাইরে বসে আছি। কয়েকজন ছোট ছোট বালক জামিন পেয়ে বাইরে যেতেছে। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে, মনে হয় যেতে পারলেই বাঁচে; থাকতে আর চায় না, এই পাষাণ-কারার ভিতরে। আমার কাছে এসে থেমে গেল। বলল, ‘আমরা চললাম স্যার, আপনাকে বাইরে নেওয়ার জন্য আবার আন্দোলন করব।’

আমি বললাম, ‘যাও, সকলকে আমার সালাম দিও। আমার জন্য চিন্তা করিও না।’

ওদের দিকে আমি চেয়ে রইলাম। ওদের কথা শুনে আনন্দে আমার বুকটি ভরে পেল। মনে হলো এটা তো আমার কারাগার নয়, শান্তির নীড়। এই দুধের বাচ্চাদের কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য আমার দুঃখ ভুলে গেলাম। শক্তি পেলাম মনে। মনে হলো পারব। বহুদিন জেল খাটতে পারব। এরাও যখন এগিয়ে এসেছে দেশের মুক্তির আন্দোলনে তখন কে আর রুখতে পারে?

১৮ই জুন ১৯৬৬

আওয়ামী লীগের ডাকে জনগণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করছে খবর পেলাম, আর সরকার অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাইয়া যেতেছে। দেখা যাক কি হয়।

বিকালটা ভালই ছিল। বৃষ্টি হয় নাই। হাসপাতালে আহত কর্মীরা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিন ও অন্যান্য কর্মীরা এবং সাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেবও হাসপাতালে আছেন। তিনি নেমে এসেছেন দরজার কাছে। আমি একটু এগিয়ে যেয়ে ওদের বললাম, চিন্তা করিও না। কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না। দেখ না আমাকে একলা রেখেছে। সিপাই সাহেবের মুখ শুকাইয়া গেছে। কারণ কথা বলা নিষেধ, চাকরি যাবে। আমি এদের ক্ষতি করতে চাই না। তাই চলে এলাম আমার জায়গায়। শুধু ওদের দূর থেকে আমার অন্তরের স্নেহ ও ভালবাসা জানালাম। জানি না আমার কথা ওরা শুনেছিল কিনা, কারণ দূর তো আর কম না!

২৮শে জুন ১৯৬৬

খবরের কাগজ এসেছে। ভাসানী সাহেবের রাজনৈতিক অসুখ ভাল হয়ে গেছে। যখন গুলি চলছিল, আন্দোলন চলছিল, গ্রেপ্তার সমানে সমানে চলেছে তখন দেখলাম শুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আবার দেখলাম দুই তিন দিন পরে কোথায় যেতে ছিলেন পড়ে যেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। হঠাৎ অসুস্থ মানুষ আবার বাড়ির বাহির হলেন কি করে? যখন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য কর্মীরা কারাগারে-এক নারায়ণগঞ্জে সাড়ে তিনশত লোকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে, তখনও কথা বলেন না। আওয়ামী লীগ যখন জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করল তখন একদল ভাসানীপন্থী প্রগতিবাদী (!) এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে সরকারের সাথে হাত ও গলা মিলিয়েছে। এখন তিনি হঠাৎ আবার সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং নিজে ময়দানে নামবেন।

মওলানা সাহেব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষতাবে আইযুৰ খানকে সমর্থন করে চলেছেন। মাওলানা সাহেবের সাথে যদি যুক্তফ্রন্ট করতে হয় তবে আইয়ুব সাহেবই বা কি অন্যায় করেছেন? মওলানা সাহেব তো দেশের সমস্যার চিন্তা করেন না। বৈদেশিক নীতি নিয়ে ব্যস্ত। দেশে গণআন্দোলন বা দেশের জনগণের দাবি পূরণ ছাড়া বৈদেশিক নীতিরও কোনো পরিবর্তন হতে পারে। জনগণের সরকার কায়েম হলেই, জনগণ যে বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করতে বলবে, নির্বাচিত নেতারা তাহাই করতে বাধ্য।

ডিক্টেটর যখন দেশের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেছে এবং একটা গোষ্ঠীর স্বার্থেই বৈদেশিক নীতি ও দেশের নীতি পরিচালনা করছে তার কাছ থেকে কি করে এই দাবি আদায় করবেন আমি বুঝতে পারছি না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, খাদ্য, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে তখন পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করে এখন এসেছেন যুক্তফ্রন্ট করতে।

আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতা ও কর্মী কারাগারে বন্দি কেহ কেহ আত্মগোপন করে কাজ করছে, এখন যে কয়েকজন বাইরে আছে তারা কিছুতেই এদের সাথে যোগদান করতে পারে না। আর ছয় দফা দাবি ছেড়ে দিয়ে কোনো নিম্নতম কর্মসূচি মেনে নিতে পারে না। ছয় দফাই নিম্নতম কর্মসূচি।

কোনো আপোষ নাই। জনগণ যখন এগিয়ে এসেছে, দাবি আদায় হবেই। আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে যাবে। জনগণকে আর ধোঁকা দেওয়া চলবে না। অনেক জগাখিচুড়ি পাকানো হয়ে গেছে। আর না।

ভাসানী সাহেব এগিয়ে যান আইয়ুব সাহেবের দল নিয়ে। এখন তো তিনি সুখেই আছেন, আর কেন মানুষকে ধোঁকা দেওয়া? আওয়ামী লীগ বা তার নেতারা যদি ছয় দফা দাবি ত্যাগ করে আপোষ করতে চান তারা ভুল করবেন। কারণ তাহলে জনগণ তাদেরও ত্যাগ করবে।

চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মানিক বাবু ও আবদুল মান্নানের জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়েছে। বিচারে কি হয় দেখা যাক।

২রা জুলাই ১৯৬৬

আজ যারা ৬ দফার দাবি যথা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার দাবি বলে উড়াইয়া দিতে চায় বা অত্যাচার করে বন্ধ করতে চায় এই আন্দোলনকে, তারা খুবই ভুল পথে চলছে। ছয় দফা। জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাচা মরার দাবি। এটাকে জোর করে পাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল করা হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে। কংগ্রেস যে ভুল করেছিল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ফেডারেল না মেনে আমাদের শাসকগোষ্ঠীও সেই ভুল করতে চলেছেন। যখন ভুল বুঝবে তখন আর সময় থাকবে না। আমরা পাকিস্তানের আওতায় বিশ্বাস করি, তবে আমাদের নয়া দাবি চাই, অন্যকে দিতে চাই। কলোনি বা বাজার হিসেবে বাস করতে চাই না। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার চাই।

১৮ই জুলাই ১৯৬৬

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই কারাগারে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হতেছে। কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। তবুও দেখে আনন্দই হলো যে, ২৩ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করেছে। কাজ করে যেতে হবে। ৬ দফা দাবির সাথে কোনো আপোষ হবে না। আমাদেরও রাজনীতির এই শেষ।

ন্যাপের সভাপতি নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সব দলকে এক করতে চান, আজ তাদের সভায় বলেছেন। নিম্নতম কর্মসূচি দিয়ে চুপচাপ তাঁহার নতুন বাড়ি বিন্নাচর গ্রামে যেয়ে বসে থাকলেই দেশ উদ্ধার হয়ে যাবে।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন আওয়ামী লীগ শুরু করেন সেই সময় হতে এই ভদ্রলোক বহু খেল দেখাইছেন। মিস জিন্নাহর ইলেকশন ও অন্যান্য আন্দোলনকে তিনি আইয়ুব সরকারকে সমর্থন করার জন্য বানচাল করতে চেষ্টা করছেন পিছন থেকে। তাকে বিশ্বাস করা পূর্ব বাংলার জনগণের আর উচিত হবে না। এখন আর তিনি দেশের কথা ভাবেন না। আন্তর্জাতিক হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে আইযুব-ইয়াহিয়ার কাছে টেলিগ্রাম পাঠান আর কাগজে বিবৃতি দেন। বিরাট নেতা কিনা? আফ্রো-এশীয় ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের মজলুম জননেতা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঁচুক আর মরুক তাতে তার কি আসে যায়। আইয়ুব সাহেব আর একটা ডেলিগেশনের নেতা করে পাঠালে খুশি হবেন। বোধহয় সেই চেষ্টায় আছেন।

নুরুল আমীন সাহেব সকল দলকে ডাকবেন একটা যুক্তফ্রন্ট করার জন্য। ৬ দফা মেনে নিলে কারও সাথে মিলতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নাই। মানুষকে আমি ধোঁকা দিতে চাই না। আদর্শে মিল না থাকলে ভবিষ্যতে আবার নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিতে বাধ্য। সেদিকটা গভীরভাবে ভাবতে হবে।

আইয়ুব সরকারের হাত থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনতে হলে আদর্শের সাথে যাদের মিল নাই তাদের সাথে এক হয়ে গোঁজামিল দিয়ে থাকা সম্ভবপর হতে পারে না। এতে আইয়ুব সাহেবের ক্ষতি কিছু করা গেলেও জনগণের দাবি আদায় হবে না।

এত অত্যাচারের মধ্যেও ৬ দফার দাবি এগিয়ে চলেছে। শত অত্যাচার করেও আন্দোলন দমাতে পারে নাই এবং পারবেও না। এখন যারা আবারও যুক্তফ্রন্ট করতে এগিয়ে আসছেন তারা জনগণকে ভাঁওতা দিতে চান। যারা আন্দোলনের সময় এগিয়ে আসে নাই তাদের সাথে আওয়ামী লীগ এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ এতে উপকার থেকে অপকার হবে বেশি। কোনো নিম্নতম কর্মসূচির কথা উঠতেই পারে না। নিম্নতম কর্মসূচি হলো ৬ দফা। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ঠিক না হলে কোনো দাবি আদায় হতে পারে না। পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পূর্বে ঠিক হওয়া দরকার।

১৯ জুলাই ১৯৬৬

মওলানা ভাসানী সাহেব হঠাৎ সুস্থ হয়ে ঢাকায় এসেছেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ৬ দফা সমর্থন করেন না। তবে স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করেন। কারণ, তার পার্টির জন্ম হয় স্বায়ত্তশাসনের দাবির মাধ্যমে। কাগমারি সম্মেলনের কথাও তিনি তুলেছেন। তিনি নাকি দেখে সুখী হয়েছেন যে, একসময়ে যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করবার জন্য তার বিরোধিতা করেছেন তারাই আজকাল স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছেন।

মওলানা সাহেব বোধহয় ভুলে গিয়াছেন, ভুলবার যদিও কোনো কারণ নাই, সামান্য কিছুদিন হলো ঘটনাটা ঘটেছে। খবরের কাগজগুলি আজও আছে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কর্মীরা আজও বেঁচে আছে। তারা জানে, বিরোধ ও গোলমাল হয় বৈদেশিক নীতি নিয়ে। সে গোলমালও মিটমাট হয়ে গিয়েছিল সম্মেলনের পূর্বের রাতে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ। মওলানা সাহেব ৬ দফা সমর্থন না করলেও আন্দোলন চলছে, চলবে এবং আদায়ও হবে। জনগণ ৬ দফাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে।

২০শে জুলাই ১৯৬৬

নুরুল আমিন সাহেব ঐক্যবদ্ধ হতে অনুরোধ করেছেন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকলেই দাবি আদায় হয় না। নূরুল আমীন সাহেব যাদের নিয়ে দল করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আব্দোলনের ও জেলে যাবার কথা শুনলে প্রথমে ঘরের কোণেই আশ্রয় নিয়ে থাকেন। আর পিছন থেকে আন্দোলনকে আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। বেশি গোলমাল দেখলে পাসপোর্ট নিয়ে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিদেশে রওয়ানা হয়ে যান।

৬ দফার দাবিতে যে গণঐক্য দেশে গড়ে উঠেছিল, যার জন্য হাসিমুখে কত লোক জীবন দিল, কত লোক কারাবরণ করছে, তখন এই ঐক্যবদ্ধ করার আগ্রহশীল নেতারা কেউ ঘর থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নাই। আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরা সংগ্রাম করবে! অন্য কেহ বিশ্বাস করলে করতে পারে, কিন্তু আমি করি না। কারণ এদের আমি জানি ও চিনি।

আওয়ামী লীগ সংগ্রামী দল, সংগ্রাম করে যাবে। আদর্শের মিল নাই, সামান্য সুবিধার জন্য আর জনগণকে ধোঁকা দেওয়া উচিত হবে না। নিম্নতম কর্মসূচিই ৬ দফা। সেই সঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্তি, কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, গরিব কর্মচারীদের সুবিধা ও খাদ্য সমস্যা সম্বন্ধে কর্মসূচি নেওয়া চলে। তবে ৬ দফা বাদ দিয়া কোনো দলের সাথে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। আর করবে না।

২৫শে জুলাই ১৯৬৬

আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাতে জনগণকে অনুরোধ করেছে, যে পর্যন্ত ৬ দফা দাবি আদায় না হয়। যদিও শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে চলেছে আওয়ামী লীগ, তথাপি সরকার অত্যাচার করে চলেছে। গুলি হলো, গ্যাস মারল, শত শত কর্মীকে জেলে দিল, বিচারের নামে প্রহসন করল, কত লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে কে তা বলতে পারে? সরকার নিজেই স্বীকার করেছে ১১ জন মারা গেছে ৭ই জুনের গুলিতে।

আমরা পাকিস্তানকে দুই ভাগ করতে চাই বলে যারা চিৎকার করেছে তারাই পাকিস্তানের ক্ষতি করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া উচিত। তারা আলাদা হতে চায় না। পাকিস্তান একই থাকবে, যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া হয়।

২৩ শে মার্চ ১৯৬৭

লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র তৈয়ার না করার জন্য দুই পাকিস্তানে আজও ভুল বুঝাবুঝি চলছে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনিতে পরিণত করা হয়েছে। আমি যে ৬ দফা প্রস্তাব করেছি, ১৩ই জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তি করে, সে প্রস্তাব করার জন্য আমি ও আমার সহকর্মীর কারাগারে বন্দি। ইত্তেফাক কাগজ ও প্রেস বাজেয়াপ্ত এবং মালিক ও সম্পাদক মানিক ভাই কারাগারে বন্দি। এই দাবির জন্যই ৭ই জুন ৭ শত লোক গ্রেপ্তার হয় এবং ১১ জন জীবন দেয় পুলিশের গুলিতে।

আমি দিব্যচোখে দেখতে পারছি দাবি আদায় হবে, তবে কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হবে। আজকাল আবার রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন লাহোর প্রস্তাবের দাম নাই, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দিলে পাকিস্তান দুর্বল হবে। এর অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কোটি লোককে বাজার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, যদি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। চিরদিন কাহাকেও শাসন করা যায় না, যতই দিন যাবে তিক্ততা আরও বাড়বে এবং তিক্ততার ভিতর দিয়ে দাবি আদায় হলে পরিণতি ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা আছে।

৮–১০ই এপ্রিল ১৯৬৭

আজ ৮ই এপ্রিল জেল গেটে ১৯৬৫ সালের ২০শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় যে বক্তৃতা করেছিলাম সেই বক্তৃতার মামলার সাওয়াল জবাব শেষ হয়। জনাব আবদুস সালাম খান সাহেব ও জিয়াউদ্দিন সাহেব আমার পক্ষে সওয়াল জবাব করেন। সরকারি উকিল জনাব মেজবাহউদ্দিন সরকারের পক্ষে করে । প্রায় চার ঘণ্টা চলে।

৬ দফা দাবি কেন সরকারের মেনে নেওয়া উচিত তার উপরই বক্তৃতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দরকার। দেশ রক্ষা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। আরও অনেক কিছু। আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।

আমার বুকে ব্যথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবে না। আমার সম্পদ ছলেবলে-কৌশলে নিয়ে যাবে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা-বলা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিন্ডি এখন ইসলামাবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।

২২ এপ্রিল ১৯৬৭

আজ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁ, মালিক গোলাম জিলানী, গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর, মালিক সরফরাজ ও জনাব আকতার আহম্মদ খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এবং আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, নজরুল ইসলাম, এম এ আজিজ, আবুল হোসেন এবং আরো অনেকে জেল গেটে কোর্টে আমার সাথে দেখা করতে আসে। যশোর থেকে আব্দুর রশিদ, খুলনা থেকে আবদুল মোমেন এসেছিল। অনেক আলাপ হলো। যুক্তফ্রন্ট করা যায় কিনা?

নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট করায় আপত্তি অনেকেরই নাই। তবে ৬ দফা দাবি ছাড়তে কেহই রাজি নয়। এটা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হলেও জনগণ সমর্থন দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, জেল খাটছে। এই দাবি পূরণ না হলে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচবার কোনো পথ নাই। আমি আমার মতামত দেই নাই। কারণ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা নিজেরাই আলোচনা করে তাদের পথ ঠিক করুক। আমি আমার মত চাপিয়ে দিতে যাব কেন? আমি বন্দি। বাইরের অবস্থা তারাই ভাল জানে। তবে ৬ দফা দাবি দরকার হলে একলাই করে যাবো।

২৩ এপ্রিল- ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭

আমি জানি ৬ দফা দাবি পূরণ হওয়া ছাড়া এদের বাঁচানোর উপায় নাই। আজ আমি এক বৎসর দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারে জেলে আছি। আমার সহকর্মীরাও আছে। আমি দেখলাম আমার অবর্তমানে দুই গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। এক দল ৬ দফা ছাড়া আপোষ করবে না আর একদল নিম্নতম কর্মসূচিতেই রাজি।

৩-২৩ শে মে ১৯৬৭

শুনলাম বাইরে খুব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে। একদল পিডিএম-এ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। জেলা ও মহকুমার সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে। সভা আমার বাড়িতেই করতে হবে বলে অ্যাকটিং সভাপতি ও অ্যাক্টিং সম্পাদক রেনুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকলে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও। আমার আপত্তি নাই।

আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। তাজউদ্দীন, মোমিন সাহেব, ওবায়দুল, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএম-এ যোগদান করতে রাজি নয়।

খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সে পিডিএম-এর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে।

তাজউদ্দীন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নুরে আলম, নূরুল ইসলাম- আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিত নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএম-এর পক্ষে। কর্মীরা কেউই রাজি না। মানিক ভাইও পিডিএম-এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএম দিয়েছে।

আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নুরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের মানসপুত্র বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভাল। আমি এটা স্বীকার করতে পারি নাই। তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে। পূর্ব বাংলার লোকেদের ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মহম্মদ আলী।

৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমিও চাই। তবে এই সকল বড় বড় নেতা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না আমার জানা আছে। মওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণও করেছে।

১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি, পিডিএম-এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দস্তখত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া কোনো আপোষ হবে না। এজন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন।

আমার ব্যক্তিগত মত- ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি। বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে; তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। পরে জানাইয়া দেই।

এও বলেছি- এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দস্তখত করেছে তারা সসম্মানে ফিরে আসতে পারে। তবে যদি পিডিএম কোন আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছি-সহযোগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবেই করা হয়েছে।

ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আব্দুর রশিদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম-এ যোগদান করার জন্য লাহোর রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। তারা সভায় যোগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায়; ৬ দফার আর প্রয়োজন নেই তাদের কাছে।

২৭-২৮মে ১৯৬৭

জহিরুদ্দিনের ইচ্ছা আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে- ৮ দফার বিপরীত কোনো দাবি করা যাবে না। অর্থ হলো, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। ৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএফ কমিটিতে যোগদান করতে পারবে না। কাউন্সিল সভা হউক দেখা যাবে। যদি পার্টি যেতে চায় আমার আপত্তি কি? কতদিন থাকব ঠিক তো নাই।

এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শোষক ও শাসকগোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের নেতারা বুঝেও বুঝতে চায় না। আমেনাকে বললাম, ‘৭ই জুন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করিও। হরতাল করার দরকার নাই। সভা শোভাযাত্রা পথসভা করবা।’

২৮ তারিখের কাগজে দেখলাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর ও ফতুল্লা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, যাতে ৭ই জুন ‘৬ দফা দাবি দিবস’ পালন করতে না পারে। বুঝতে আর কষ্ট হলো না।

সংবাদ ও ইত্তেফাক বন্ধ করার ব্যাপার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমাকে দমাতে হবে- এটাই হলো সরকারের উদ্দেশ্য।

১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮

রাত ১২টার দিকে আমাকে জেলার সাহেব ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বললো, আপনার মুক্তির আদেশ দিয়েছে সরকার। এখনই আপনাকে মুক্ত করে দিতে হবে।

দেশরক্ষা আইনে জেলে রেখেছে, ১১টা মামলা দায়ের করেছে আমার বিরুদ্ধে। কয়েকটাতে জেলও হয়েছে। এরপরও এদের ঝাল পড়ল না, ৬ দফার ঝাল এতো বেশি জানতাম না। ডেপুটি জেলার হুকুমনামা নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন। আমি পড়ে দেখলাম, দেশরক্ষা আইন থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

জেলগেটে এসেই দেখি এলাহি কাণ্ড। সামরিক বাহিনীর লোকজন যথারীতি সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে ‘অভ্যর্থনা’ করার জন্য। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের রুমে এসে বসতেই একজন সামরিক বাহিনীর বড় কর্মকর্তা আমার কাছে এসে বললেন, ‘শেখ সাহেব, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’ আমি তাকে বললাম, ‘নিশ্চয় আপনার কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। আমাকে দেখালে বাধিত হব।‘ তিনি একজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারীকে বললেন পড়ে শোনাতে। তিনি পড়লেন, ‘আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।‘ আমি বললাম- ‘ঠিক আছে, চলুন কোথায় যেতে হবে।’

সামরিক জিপে চড়ে এসে পৌঁছলাম একটা ঘরের সামনে। এখানেও সামরিক বাহিনী পাহারা দিচ্ছে। আমাকে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। এক কামরাবিশিষ্ট। একটা দালান। সাথে গোসলখানা, ড্রেসিং রুম, স্টোর রুম আছে। দু’খানা খাট পাশাপাশি। একটা খাটে একটা বিছানা আছে। আর একটা খাট খালি পড়ে আছে। একজন কর্মচারী- যার নাম লেফটেন্যান্ট জাফর ইকবাল সাহেব। তিনি আমার পাশের খাটেই ঘুমাবেন সামরিক পোশাক পরে, সাথে রিভলবার আছে। লেফটেন্যান্ট সাহেব একাকী প্যাসেন্স খেলতে লাগলেন। আমি বিছানায় বসে পাইপ টানতে লাগলাম, কোনো কথা নাই। কুর্মিটোলার কোন জায়গায় আমি আছি নিজেই জানি না।

সূত্র: কারাগারের রোজনামচা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মন্তব্য

p
উপরে