× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

google_news print-icon

রাজনীতির কবি

রাজনীতির-কবি
বঙ্গবন্ধু তার মাহাত্ম্য, প্রজ্ঞা, সাহস ও সংগ্রামের পাঠ নিয়েছিলেন দুই মহান কবি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কাছ থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাই একজনের গানকে করেছেন জাতীয় সংগীত, আরেকজনকে করেছেন জাতীয় কবি। এভাবে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু অনুভবের মগ্নতায় ধারণ করেছেন সংস্কৃতির দুই কবিকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতা শহরে। ১৮৬১ সালে। কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। ১৯৯৯ সালে। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪১ সালে, নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে নির্বাক হয়ে যান ১৯৪২ সালে। তারা সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেননি। পাকিস্তান রাষ্ট্র দেখেননি। স্বাধীন বাংলাদেশও না। তারা দেখেছেন পূর্ববঙ্গ। দু’জনেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে ছুটে এসেছেন পূর্ববঙ্গে। এই ভূখণ্ডের নানা জায়গায় ঘুরেছেন। দু’চোখ ভরে দেখেছেন পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষকে। এই ভূখণ্ড ছিল দু’জন সৃজনশীল মানুষের অবলোকনের আরাধ্য ভূমি। এই ভূমি থেকে তারা দু’হাত ভরে নিয়েছেন শিল্পের উপাদান। গড়েছেন সাহিত্যের জমিন। আর এই ভূখণ্ডও তাদের দিয়েছে অমরত্বের শ্রেষ্ঠ আসন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৪ বছর বয়সে। সঙ্গী হয়েছিলেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সময়টি ছিল ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাস। ১৯ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামপুর বোয়ালিয়ার ব্রহ্মামণ্ডলী আয়োজিত প্রার্থনা সভায় যোগ দেন। প্রশান্ত কুমার পাল তত্ত্ববোধিনী মাঘ সংখ্যার সূত্র ধরে লিখেছেন ‘স্বাধ্যায়ের পর প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমধুর স্বরে একটি মনোহর ব্রহ্মসঙ্গীত করেন।’ এই সময়ে শিলাইদহে অল্প দিন অবস্থানের কারণে শিলাইদহ তার মনে তেমন দাগ কাটেনি।

তিনি দ্বিতীয় বার শিলাইদহে যান ১৮৭৬ সালে। সঙ্গী হয়েছিলেন বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সেবার তিনি শিলাইদহে একমাসের বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। এ সময় তিনি কবিতা লিখে খাতা ভরিয়েছেন। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরেছেন। ফুলের রঙিন রস কলমের নিবে লাগিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। তিনি জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন: ‘একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোট একটি কোণের ঘর, যত বড় ঢালা ছাদ তত বড় ফলাও আমার ছুটি। অজানা ভিন দেশের ছুটি, পুরোনো দিঘার কালো জলের মতো তার থই পাওয়া যায় না। বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এইসঙ্গে আমার খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করেছে পদ্যে।’

কাজী নজরুল ইসলাম ১৫ বছর বয়সে পূর্ববঙ্গে আসেন। ১৯১৪ সালে। পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর সহযোগিতায় তিনি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার কাজীরশিমলা গ্রামে আসেন। নদী-বিধৌত পূর্ববঙ্গ তার মানসপটে স্থায়ী ছাপ ফেলে। দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কাজীরশিমলা থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে তিনি স্কুলে যেতেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন গ্রন্থে লিখেছেন: ‘১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ঐ স্কুলের সহকারী শিক্ষক মহিমচন্দ্র খাসনবীশ নজরুলদের ইংরেজি পড়াতেন। তার বিবরণীতে জানা যায়, নজরুল ক্লাসে একটু অন্যমনস্ক থাকতেন এবং কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে প্রথমে একটু ঘাবড়ে যেতেন কিন্তু প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করলে নজরুল যথাযথ উত্তর দিতেন। ঐ বছর মহিমবাবুর পরিচালনায় দরিরামপুর স্কুলে একটি বিচিত্রানুষ্ঠান হয়, তাতে নজরুল রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ এবং ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতা দুটি আবৃত্তি করে সকলকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন।’ এই স্কুলে এক বছর পড়ার পরে তিনি আবার বর্ধমানে নিজ গ্রামে ফিরে যান।

এই এক বছরে কিশোর নজরুলের মনে পূর্ববঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রবলভাবে দাগ কাটে। তাকে প্রায়ই দেখা যেত ঠুনিভাঙা বিলের ধারে। দেখা যেত গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন। এভাবেই সৃজনশীল প্রতিভার মানস গঠনে পূর্ববঙ্গ এক হয়। পূর্ণ করে তার সৃজনশীলতার মাত্রা। প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র বিস্তৃত হয় সাহিত্যের ক্যানভাসে রঙে ও সৌন্দর্যে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেন পূর্ববঙ্গের যশোর জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের মেয়ে ভবতারিণীকে। ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিয়ের পরে তিনি স্ত্রীর নাম রাখেন মৃণালিনী। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন: ‘মা গায়ে হলুদের পরে রবিকাকাকে আইবুড়োভাতের নেমন্ত্রন্ন করে। মা খুব খুশি, একে যশোরের মেয়ে, তায় রথীর মা মার সম্পর্কের বোন।’ বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার কবির কথা বইয়ে লিখেছেন: ‘এই প্রস্তাব স্বীকৃত হইলে মহর্ষি দক্ষিণডিহির বাড়িতে নানাবিধ খেলনা, বসনভূষণাদি কর্মচারী সদানন্দ মজুমদারের সঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন। সদানন্দ মহর্ষির কথানুসারে গ্রামে নানা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করাইয়া কন্যার ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।’

রবীন্দ্রনাথের জীবনসঙ্গী গ্রহণের পর্বটি সম্পন্ন হয় ভালো ভাবেই। পূর্ববঙ্গের মেয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে উজ্জ্বলতম সন্তানটির জীবনে ঠাঁই নেয়। দু’জনে মিলে পাড়ি দেন অনেক পথ। জন্মগ্রহণ করে পাঁচটি সন্তান। এক সময় থেমে যান পূর্ববঙ্গের জলহাওয়ায় বড় হওয়া ভবতারিণী। এগিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উঠে যান দীর্ঘ পথ পার হয়ে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে।

স্কুল পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা ও ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে কলকাতায়। ১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম তার আমন্ত্রণে কুমিল্লা জেলার দৌলতপুর গ্রামে বেড়াতে যান। কিশোরবেলায় ময়মনসিংহ থেকে চলে যাওয়ার পরে এটি ছিল পূর্ববঙ্গে তার দ্বিতীয় বার আসা।

কুমিল্লায় পৌঁছে তারা শহরে আলী আকবর খানের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে কয়েকদিন থাকেন। বীরেন্দ্রর মা বিরাজসুন্দরী লেখালেখি করতেন। নজরুলের সঙ্গে তার হৃদ্যতা হয়। এই পরিবারের আতিথেয়তা নজরুলকে মুগ্ধ করে। এরপরে তারা দৌলতপুরে যান। গ্রামের প্রকৃতি তার কবিতায় উঠে আসে। তিনি অনেক কবিতা লেখেন। তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে সেসব কবিতা সংকলিত হয়।

দৌলতপুরে থাকার সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আকবর আলী খানের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। কবি তার নতুন নামকরণ করেন- নার্গিস আসার খানম। একই বছরের ১৮ জুন তাদের বিয়ে হয়। নার্গিস পরিবারের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে তিনি দৌলতপুর ছেড়ে চলে আসেন। কুমিল্লায় সতেরো দিন থাকেন। চারটি গান রচনা করেন। এ সময় শহরজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার বইছিল। নজরুল কুমিল্লার রাস্তায় মিছিলে যোগ দিয়েছেন। ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল’ গানটি গেয়েছেন। ড. রফিকুল ইসলাম তার জীবন ও সৃজন গ্রন্থে প্রাবন্ধিক আবদুল কুদ্দুসের লেখা উল্লেখ করেছেন: ‘একদিন কংগ্রেসের সভা বসেছিল কুমিল্লার টাউন হলে। বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, বাবু অতীন্দ্রমোহন রায় প্রমুখ বক্তারা বারবার তাগিদ দিয়ে নজরুলকে নিয়ে আসেন কান্দিরপাড়ের বাসা থেকে।’ সে সভায় তিনি গেয়েছিলেন এ গানটি- ‘এস এস এস ওগো মরণ!/ ওই মরণ-ভীতু মানুষ-মেষের ভয় কর গো হরণ।’

দেখা যাচ্ছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করে তার আন্দোলনে অংশগ্রহণের সীমানা শুধু কলকাতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা শহর পর্যন্ত ছড়িয়েছিলেন। এমনই ছিল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তার আত্মিক যোগ। ১৯২২ সালে তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তাকে গ্রেফতার করা হয় কুমিল্লা থেকে, ঐ বছরের ২২ নভেম্বরে। পরদিন তাকে কলকাতায় নেয়া হয় এবং প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয়। এইসঙ্গে তার যুগবাণী কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে সরকার।

১৯২৫ সালের ২৪ এপ্রিল নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হয় কুমিল্লার প্রমীলার। নজরুলের বয়স ছিল তেইশ আর প্রমীলার ষোল। বিয়েতে ধর্মীয় ও সামাজিক সূত্রে বিরোধ হয়েছিল। সব বিরোধিতা পাশ কাটিয়ে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করেন মিসেস এম রহমান। নজরুল তাকে বিষের বাঁশী কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন।

দেখা যাচ্ছে দু’জন বড় মানুষের ব্যাপ্ত জীবনের পূর্ণতা পূর্ববঙ্গকে বাদ দিয়ে হয়নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ সালের আষাঢ় মাসে জোড়াসাঁকোর সেরেস্তার হিসাব দেখার দায়িত্ব পান বাবার কাছ থেকে। অগ্রহায়ণ মাসে জমিদারি পরিদর্শনের অধিকার লাভ করেন। মৃণালিনী দেবী, তার বান্ধবী, বেলা ও রথীন এবং ভাইপো বলেন্দ্রনাথকে নিয়ে শিলাইদহ আসেন। শুরু হয় তার পূর্ববঙ্গ যাত্রা⎯ অবিরাম, নিরন্তর। শারীরিক এবং মানসিক ভ্রমণের সবটুকু গভীর আনন্দ দিয়েছে তার জগৎ উপুড় করে দিয়ে। পূর্ববঙ্গ যেমন দিয়েছে, তিনি তেমন দু’হাত উপচে গ্রহণ করেছেন। নিতে কুণ্ঠিত হননি। এই নেওয়াকে আপন আলোয় রাঙিয়েছেন⎯ কবিতায়, গানে, চিত্রকর্মে, নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে এবং সর্বোপরি পত্র-সাহিত্যে।

ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে শিলাইদহ উঠে এসেছে এভাবে ‘শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর⎯ ধূ ধূ করছে ⎯ কোথাও শেষ দেখা যায় না। ..... পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোট নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাতে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’

দীর্ঘ কয়েক বছর এখানে স্থায়ীভাবে বাস করে ১৯০১ সালে তিনি সংসার গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে যান। তারপর আসা-যাওয়া করেছেন। নদীতে বসবাস করেছেন বোটে- পতিসর-শাহজাদপুর ঘোরার সময় বিল-নদীর নৌপথে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিবরণ পত্র-সাহিত্যে পাওয়া যায়। কত নিবিড়ভাবে মানুষ ও প্রকৃতিকে দেখেছেন তা বর্ণনা করে শেষ করার নয়।

রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো পূর্ববঙ্গে আসেন ১৯৩৭ সালে। গ্রাম ছিল প্রতিসর। ১৮৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি লিখেছিলেন: ‘এখন বেলা একটা বেজেছে। পাড়াগাঁয়ে মধ্যাহ্নের এই হাঁসের ডাক, কাপড় কাঁচার শব্দ, নৌকা-চলা জলের ছলছল ধ্বনি, দূরে গরুর পাল পার করবার হৈ হৈ রব এবং আপনার মনের ভিতরকার একটা উদাস আলস্যপূর্ণ স্বগত সংগীতস্বর, কলকাতার চৌকি-টেবিল-সমাকীর্ণ, বর্ণ-বৈচিত্র্যবিহীন নিত্যনৈমিত্তিকতার মধ্যে কল্পনাও করতে পারিনে। কলকাতাটা বড় ভদ্র এবং বড় ভারী, গবর্মেন্টের আপিসের মতো। জীবনের প্রত্যেক দিনটাই যেন একই আকারে একই ছাপ নিয়ে টাঁকশাল থেকে তকতকে হয়ে কেটে কেটে বেরিয়ে আসছে⎯ নীরস মৃত দিন, কিন্তু খুব ভদ্র এবং সমান ওজনের। এখানে আমি দলছাড়া এবং এখানকার প্রত্যেক দিন আমার নিজের দিন⎯ নিত্যনিয়মিত দম-দেওয়া কলের সঙ্গে কোনো যোগ নেই।’

এই ছিল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কবির আত্মিক যোগ। সেবার রবীন্দ্রনাথ নাগর নদীপথে পতিসর ছাড়েন। তারপর আত্রাই স্টেশন থেকে রেলে করে কলকাতায় যান।

১৯৩৬ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে ‘Degree of Doctor of Literature’ দেয়। এছাড়া কবি পূর্ববঙ্গের সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ইত্যাদি শহরে বিভিন্ন উপলক্ষে যান। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারকে কবি যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে আছে: ‘ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ... বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনো মতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে।’ এভাবে গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে ঢাকা শহর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে তার ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম কখনো একটানা পূর্ববঙ্গে থাকেননি, কিন্তু ঘুরে ঘুরে এসেছেন অনবরত। কাটিয়েছেন মাসাধিক কাল। বিভিন্ন শহরে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ভারতবর্ষের এক ইঞ্চি জমিতে একজন ইংরেজ থাকলেও তা পূর্ণ স্বাধীনতা হবে না। এভাবে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন দেশের মানুষকে।

কিশোর বেলায় ময়মনসিংহের দরিরামপুরে স্কুলপর্বের পর নজরুল ১৯২০ সালে বরিশালে আসেন। সেটি ছিল দূর্গা পূজার সময়। কমরেড মুজফফর আহমদ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। কবি বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন। বরিশালকে ‘বাংলার ভেনিস’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচন করেছিলেন ঢাকা বিভাগ থেকে। স্বরাজ দলের প্রার্থী হয়েছিলেন। সে বছরে তিনি নির্বাচনী প্রচারের কাজে বরিশালে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তার স্মরণে আলেকান্দায় ‘নজরুল পাঠাগার ও ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯২১ সালে কুমিল্লায় এসেছিলেন। কুমিল্লা তার জীবনের এক বড় অধ্যায়। নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে কুমিল্লার মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে প্রেম হয়। এই প্রেমে হিন্দু রক্ষণশীলদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। প্রমীলার মা গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় যান। সেখানে ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল তাদের বিয়ে হয়। এরপরে নজরুল কুমিল্লায় আসেননি। তবে কুমিল্লায় অবস্থান তার সৃজনশীলতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কুমিল্লার প্রকৃতি, লালমাই পাহাড়, গোমতী নদী তার কবিতা, গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে। কুমিল্লায় নজরুল শীর্ষক গ্রন্থে আবদুল কুদ্দুস লিখেছেন: ‘কুমিল্লা নজরুলের কাব্য কাননের লালন-ক্ষেত্র, পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত পীঠস্থান, জীবননাট্যের একটা অবিস্মরণীয় অধ্যায়।’ এভাবে কালজয়ী কবির আপন আবাস পূর্ববঙ্গ হয়।

এরপর ১৯২১ সালে চাঁদপুরে আসেন, ১৯২৪ সালে কুড়িগ্রামে। ফরিদপুরে আসেন ১৯২৫ সালের ২৫ মে। উপলক্ষ ছিল বঙ্গীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন। ২ মে ফরিদপুর টাউন লাইব্রেরি মাঠে জনসভার আয়োজন হয়েছিল। সভায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সভাপতিত্ব করেন। অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধি ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। সে সময়ে কবি জসীম উদদীনের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি নৌকায় করে ঘুরেছেন, চরে নেমে বেড়িয়েছেন। পূর্ববঙ্গের মাটি মানুষ দেখেছেন। জনসভায় বক্তৃতা করেছেন, গান গেয়েছেন। ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ গান গেয়ে মাতিয়ে তুলেছেন ফরিদপুরবাসীকে।

এরপর তিনি আরও কয়েকবার ফরিদপুরে এসেছিলেন। ১৯৩৬ সালে আসেন জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনে অংশগ্রহণ করতে। তিনি সভাপতি ছিলেন। ১৯৩৮ সালে আবার ফরিদপুরে আসেন। ‘ফরিদপুর সংসদ’ তাকে সংর্ধনা জানায়। কবি শেষবার ফরিদপুরে আসেন ১৯৪১ সালে। রংপুরে আসেন দু’বার। একবার ১৯২৫ এবং আর একবার ১৯২৮ সালে। এই বছরে তাকে রংপুরে সংবর্ধনা দেয়া হয়। দিনাজপুরে আসেন ১৯২৬ সালে। এই একই বছরে দিনাজপুর থেকে মাদারীপুরে যান। এ সময়ে মাদারীপুর শহরে নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রাদেশিক মৎস্যজীবী সম্মেলনের অধিবেশন হয়। তিনি জেলেদের নিয়ে রচিত গান গেয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।

১৯২৬ সালে প্রথম ঢাকা সফর করেন নজরুল। ২৭ জুন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তিনি বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দেন। তার রচিত গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন। ১৯২৭ সালে আবার আসেন। ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আবার ঢাকায় আসেন। এ সময় ড. কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান ভবনের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) বাসায় অবস্থান করেন। ‘চল চল চল’ গানটি লেখেন। এই গান গেয়ে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এরপর ১৯৪০ সালে বেতার কেন্দ্রের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন।

পূর্ববঙ্গের আরও অনেক জায়গায় ঘুরেছেন তিনি। চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি। এবং আরও কোনো কোনো স্থান। পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা যেমন তার প্রাণের টান ছিল, তেমনি পূর্ববঙ্গবাসী তাকে সংবর্ধনা দিয়ে জানিয়েছে বুকভরা ভালবাসা।

২.

যে পূর্ববঙ্গের কথা এই লেখায় উল্লেখ করা হলো তা আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাতি অর্জন করেছে স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তার অবর্তমানে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তার নামে। এই যুদ্ধের রণধ্বনি ছিল ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই মহান কবির একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি তাদের বরণ করেছেন গভীর শ্রদ্ধায়, প্রদীপ্ত চেতনায়, জ্ঞানের মাহাত্ম্যে, সাহসের বলিষ্ঠতায়, মননের শাণিত প্রভায় এবং দিব্যলোকের অনিঃশেষ যাত্রায়।

১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে বাঙালি রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযপন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। এক পর্যায়ে পাকিস্তান বেতার থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন: ‘দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না⎯ আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এইদেশে গাওয়া হইবেই।’

এভাবে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সেতুবন্ধন সম্পন্ন করেছিলেন।

বেতার কর্মকর্তা আশরাফ-উজ-জামান তার দেশের বেতার ও শেখ মুজিব প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘প্রবল গণ আন্দোলনে আইয়ুব খান এবং মোনায়েম খানের অপসারণের পর প্রথম বেতারের অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে আলাপ হয় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। দেশের ছাত্রদল ইতোমধ্যেই তাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায় ভূষিত করেছে। দেখা হতেই তিনি প্রথম বেতার নিয়ে মন্তব্য প্রকাশ করলেন। বললেন, দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে অনুষ্ঠান প্রচার করতে না পারলে বেতার বন্ধ করে দিন। পরে কাছে এসে হেসে বলেছিলেন, একবার রবীন্দ্রনাথের ‘‘আমার সোনার বাংলা’’ গানটি বেতার থেকে প্রচার করতে পারেন না?

সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমস্ত বেতার কর্মীদের একান্ত সহায়তায় পরদিনই বেতার থেকে প্রচারিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান এবং আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করে বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়।’

স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ এই গানটিকে জাতীয় সংগীত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার সময়। ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জি একই বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি আসছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বঙ্গবন্ধু বিমানে বসে গানটি গুনগুন করে গাইছিলেন। তিনি শশাঙ্ক ব্যানার্জিকে বলেছিলেন, এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়তে ভালবাসি। আমি তাকে ভালবাসি। সাহিত্য পাঠে আমার পুঁজি ওইটুকুই। বঙ্গবন্ধুর জন্য এটি এক ধরনের সরল সত্য।

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি যখন তিনি জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করেন, তখন শুধু সাহিত্য পাঠের প্রেরণা হিসেবে নির্বাচন করেননি। কৈশোর থেকে লাভ করা অভিজ্ঞতা এবং তার ভিত্তিতে গড়ে তোলা রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিধ্বনি পেয়েছিলেন সেই গানে। যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি তার জীবন এবং রাজনীতির সূচনা করেছিলেন, এই গান ছিল তার রবীন্দ্র রচনার পাঠজনীত অভিজ্ঞতা। তিনি তাকে নন্দিত করেছেন। বরণ করেছেন। কৃষক-মজুরের ঘামে-শ্রমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেছেন।

এই গানের প্রতিটি চরণে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন একাকার হয়ে আছে। রবীন্দ্রসাহিত্য না পড়েই রাজনীতির যে দর্শন তিনি কিশোর বয়স থেকে স্থির করেছিলেন, পরিণত বয়সে তার প্রতিচিত্র দেখলেন রবীন্দ্রসাহিত্যে। যখন পড়লেন ‘তোমারি ধুলোমাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন জানি’ দেখলেন ওই একটি চরণে তার শৈশব-কৈশোর আশ্চর্যভাবে উদ্ভাসিত। যখন পড়লেন ‘তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে’⎯ দেখলেন বাবার ধানের গোলা থেকে নিরণ্ণজনের মাঝে ধান বিতরণের ছবি। যখন পড়লেন ‘ও মা, তোমার রাখাল, তোমার চাষি’⎯ দেখলেন বাংলার কৃষককুলকে, যারা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ধরে রাখে⎯ তারাই তো বাস করে পাখি-ডাকা ছায়ায় ঢাকা পল্লিবাটে। যখন পড়লেন, ‘দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মাণিক হবে’⎯ দেখলেন দেশ মায়ের পায়ের ধুলো তার সারা অঙ্গে জড়ানো। পড়লেন ‘গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে’⎯ দেখলেন গরিবের ধন ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন, সেই স্বাধীনতার ভূষণ তার গায়ে জড়ানো হয়েছে। পড়লেন, ‘আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ বলে গলার ফাঁসি’⎯ দেখলেন স্বনির্ভর অর্থনীতির যে কাঠামো তার জীবনের ধ্রুব সত্য তার জন্য মৃত্যুতে উৎসর্গিত করতে হলো জীবন।

এভাবে রাজনীতির কবি, Poet of Politics, বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতির কবিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।

১৯৪১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আজ আশা করি আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই ত্রাণকর্তা, মহানায়ক।

বঙ্গবন্ধুই সেই রাষ্ট্রনায়ক যিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশে এনে তার বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলো স্বস্তির করেছিলেন⎯ শারীরিকভাবে এবং মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই কবির গান অনুপ্রেরণার অন্তহীন উৎস ছিল।

পূর্ববঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সময় নজরুল এই ভূখণ্ডকে বারবার নমস্য মেনেছেন। ‘পূর্ববঙ্গ’ নামের কবিতায় এবং ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক গানে আবেগের মাত্রা প্রকাশ পায়। অসুস্থ হওয়ার কয়েক মাস আগে দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ‘আমার সুন্দর’ নামে সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন ⎯ ‘আট বৎসর ধরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালাম। এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালবাসলাম। মনে হলো, এই আমার মা।’

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছোটবেলা থেকে শুধু এক মন্ত্র শেখাও⎯ এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির⎯ আমাদের। ... বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’

পাকিস্তান সরকার নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য তার সাহিত্যে হাত দিতেও দ্বিধা করেনি। তার কবিতার ‘মহাশ্মশান’ শব্দটি বদলে দিয়ে ‘গোরস্থান’ শব্দ প্রতিস্থাপন করে।

স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে এম আর আখতার মুকুল তার মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বঙ্গবন্ধু স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দান করা ছাড়াও কবির রচিত ঐতিহাসিক গান ‘‘চল্ চল্ চল্, উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’’ গানটিকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ‘‘মার্চিং সংগীত’’ হিসেবে মর্যাদা দান করা হলো। এখানে শেষ নয়। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের আরো সিদ্ধান্ত হচ্ছে, অবহেলিত কবিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও শুশ্রুষার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে। এখন থেকে সমস্ত দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অনতিবিলম্বে ঢাকায় পাঠাবার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানানো হলো। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ মর্মে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে, বিদ্রোহী কবির উপস্থিতিতেই ঢাকায় আড়ম্বরের সঙ্গে কবির ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে। মাঝে মাত্র দিন দুয়েকের সময়। তখন নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. এ. আর. মল্লিক। তিনি তড়িৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাত করে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কথা অবহিত করলেন। এতেই কাজ হলো। ভারত সরকার এ ব্যাপারে সমস্ত সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান ছাড়াও রাজ্য সরকারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠিয়ে দিলো।

প্রসঙ্গত এ কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, বিদ্রোহী কবিকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ও পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের অবদান অনস্বীকার্য।

অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ বিমানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। সঙ্গে এলেন সস্ত্রীক দুই পুত্র সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ এবং কবির দুই নাতনি খিলখিল কাজী ও মিষ্টি কাজী। সেদিন তেজগাঁও বিমান বন্দরে এক বিশাল জনতা বাংলাদেশের জাতীয় কবিকে সংবর্ধনা জানালো। সেদিন ঢাকা উৎসব মুখরিত। কবিকে সোজা নিয়ে আসা হলো ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ২৮ নম্বর সড়কের (পুরাতন) ৩৩০-বি বাড়িতে।’

১৯৭৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বাংলা একাডেমি। এই সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৪ ফেব্রুয়ার থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ১৯ তারিখ ছিল কবিতা বিষয়ক আলোচনা। ঐ দিন কবি নজরুলকে মঞ্চে আনা হয়েছিল প্রধান অতিথি হিসেবে। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘Degree of Doctor of Literature’ প্রদান করে।

১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবির শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কবিকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনেই তিনি ছিলেন এক বছরেরও বেশি সময়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন আগস্ট মাসের ৬ তারিখে। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও শহীদ হন ১৫ আগস্ট। রাজনীতির কবি নিজের প্রগাঢ় অনুভবের মগ্নতায় কাছে টেনেছিলেন সংস্কৃতির দুই কবিকে। বিভিন্ন বছরের একই মাসে তাদের মৃত্যু একটি স্বাধীন দেশ ও তার মানুষের কাছে বেঁচে থাকার সত্য। জাতির মননের কাছে তিনজনই ধ্রুবতারা।

একজন রাজনীতির কবি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনিবার্য করেছিলেন। বাংলা ভাষার দুই অমর কবিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছেন।

সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন

মুজিব শতবর্ষ
Iftar of love for low income people in Naogaon at two taka

দুই টাকায় ইফতার

দুই টাকায় ইফতার
নওগাঁ শহরের কাজীর মোড় এলাকায় মঙ্গলবার বিকেলে ভ্যানে ‘ফুড প্যালেস’ নামের রেস্তোরাঁর ইফতারসামগ্রী বিতরণ করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
কম আয়ের মানুষের জন্য দুই টাকায় ইফতারসামগ্রীর একটি প্যাকেটে থাকে খিচুড়ি, একটি ডিম, বেগুনি, পিঁয়াজু, ছোলা, শসা ও খেজুর। প্যাকেটগুলো দুই টাকায় বিক্রি হলেও এগুলোতে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ টাকার ইফতারসামগ্রী দেয়া হয়।

নওগাঁ শহরে রমজানে দুই টাকার বিনিময়ে ইফতারের প্যাকেট বিক্রি করছে ‘ফুড প্যালেস’ নামের রেস্তোরাঁ।

শহরের কাজীর মোড় এলাকায় মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে রেস্তোরাঁটির পক্ষ থেকে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করতে দেখা যায়।

প্রতিদিন নওগাঁ শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা হয়। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন কম আয়ের মানুষের মধ্যে এ ইফতার বিতরণ করা হয়।

কম আয়ের মানুষের জন্য দুই টাকায় ইফতারসামগ্রীর একটি প্যাকেটে থাকে খিচুড়ি, একটি ডিম, বেগুনি, পিঁয়াজু, ছোলা, শসা ও খেজুর। প্যাকেটগুলো দুই টাকায় বিক্রি হলেও এগুলোতে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ টাকার ইফতারসামগ্রী দেয়া হয়।

রিকশাচালক আতিক বলেন, ‘নওগাঁ শহরে আমি রিকশা চালাই। হঠাৎ দেখি এখানে ইফতার দেয়া হচ্ছে মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে। তাই দুই টাকা দিয়ে ইফতারের প্যাকেটটি নিলাম। এত কম টাকায় পেয়ে খুব ভালো লাগছে।’

ভ্যানচালক জাফর বলেন, ‘আমি তো প্রথমে অবাক হয়েছি। মাত্র দুই টাকায় ইফতার এখানে বিক্রি করা হচ্ছে। তাই ভালো করে শুনে তারপর দুই টাকার বিনিময়ে ইফতার নিলাম।

‘আমাদের মতো মানুষের প্রতিদিন বেশি টাকায় ইফতার কিনে খাওয়া সম্ভব না। এ ধরনের উদ্যোগ নিলে আমরা সাধারণ মানুষরা কিনে খেতে পারব।’

৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আলম হোসেন বলেন, ‘ভ্যান গাড়ি দেখে পাশে দাঁড়িয়ে শুনি মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে ইফতার দেয়া হবে। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে আমিও নিলাম।

‘খুব ভালো লাগছে। এত অল্প টাকায় এত সুন্দর আয়োজনের জন্য।’

ফুড প্যালেস রেস্টুরেন্টের মালিক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। আমার সাধ্যের মধ্যে কম আয়ের মানুষের পাশে সবসময় থাকার চেষ্টা করি। তার ধারাবাহিকতায় নামমাত্র দুই টাকা নিয়ে ইফতার বিতরণ করছি শহরের বিভিন্ন স্থানে পুরো মাস ধরে।’

দুই টাকা কেন নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘আমি যদি এমনিতে ইফতার দিই, তাহলে অনেকে লজ্জা পেতে পারে। তাই দুই টাকা দিয়ে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই।

‘এতে করে সাধারণ মানুষরা নিজের টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে ভেবে আমাদের কার্যক্রমকে সহজে গ্রহণ করবে আর নিতে আগ্রহী হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’

মন্তব্য

মুজিব শতবর্ষ
Sanatan Dharmas Sujan Prasad is serving free Iftar

বিনামূল্যে ইফতারি খাওয়াচ্ছেন সনাতন ধর্মের সুজন প্রসাদ

বিনামূল্যে ইফতারি খাওয়াচ্ছেন সনাতন ধর্মের সুজন প্রসাদ সুজন প্রসাদ নিজ হাতেই ইফতার পরিবেশন করেন। ছবি: নিউজবাংলা
সুজন প্রসাদ বলেন, ‘আমি যে ধর্মই পালন করি না কেন, দিন শেষে আমি একজন মানুষ। তাই মানুষ হিসেবে এ দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমি রোজাদারদের জন্য এ ইফতারের আয়োজন করছি।’

গাইবান্ধার সনাতন ধর্মের একজন হোটেল ব্যবসায়ী সুজন প্রসাদ। চলমান পবিত্র রমজানে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত রোজাদারের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ইফতারের আয়োজন করে থাকেন তিনি।

যেখানে প্রতিদিন রিকশাচালক, ভ্যান চালক, ঠেলা ওয়ালা, ফুটপাতের দোকানি, পথচারী, স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় অর্ধশত মানুষ ইফতারে অংশ নেন।

রমজানে এমন মহানুভবতা দেখিয়ে যাচ্ছেন গাইবান্ধা জেলা শহরের হকার্স মার্কেটের ‘বাঙলা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের’ মালিক হিন্দু ধর্মের সুজন প্রসাদ। রোজাদার ও স্থানীয়রা বলছেন, হিন্দু ধর্মের লোক হয়েও মুসলিম রোজাদারদের জন্য সুজন প্রসাদের বিনা মূল্যের এই ইফতার আয়োজন যেন এ শহরে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে প্রথম রমজান হতে রোজাদারদের জন্য ইফতারের এমন আয়োজন করছেন বলে জানান সুজন প্রসাদ। সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ মহতী কাজটি চালিয়ে যেতে যান তিনি।

গাইবান্ধা জেলা শহরের রেলগেটের দিক থেকে হকার্স মার্কেটের প্রথম গলিতেই সুজন প্রসাদের এই হোটেল।

সরেজমিনে পড়ন্ত বিকেলে হোটেলে গেলে দেখা যায়, মাগরিবের আজানের আগেই টেবিলের ওপরে প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অন্তত ১৩ ধরনের থালা ভর্তি ইফতারি। ওইসব থালায় রয়েছে, ছোলা বুট, পেয়াজু, বেগুনের চপ, আলু মিশ্রিত ডিমের চপ, ঝুড়ি (চিনি ময়দায় তৈরি এক ধরনের খাবার) ও জিলাপি। এসবেই শেষ নয়- পুষ্টির চাহিদা জোগান দিতে ইফতারির প্লেটে যোগ করা হয়েছে, খেজুর, গাজর-শসা, কলা, তরমুজ, ও বেলের শরবত। এ ছাড়া একই প্লেটে রয়েছে বিরিয়ানিও।

বিনামূল্যে ইফতারি খাওয়াচ্ছেন সনাতন ধর্মের সুজন প্রসাদ

আজানের ঠিক আগ মুহূর্তে দেখা যায়, একে একে বাঙলা হোটেলে ইফতার করতে আসছেন রোজাদার ব্যক্তিরা। ঠিক এমন সময় কর্ম ব্যস্ততাও বাড়ে হোটেলের মালিক সুজন প্রসাদসহ হোটেলের কর্মচারীদের, তবে হোটেলের কর্মচারীরা কেবল পানি দেয়া এবং অন্য কাজ করলেও ইফতার পরিবেশন করেন সুজন প্রসাদ নিজ হাতে।

এ হোটেলে হঠাৎ এবং প্রথমদিন ইফতারে আসা তিনজন ব্যাংক কর্মকর্তার ইফতার শেষে দাম জানতে চেয়ে ইফতারির বিল দেয়ার চেষ্টা করতেও দেখা যায়। কিন্তু সুজন প্রসাদ তাদের হাসি মুখে বলেন, ‘এখানে ইফতারের কোনো টাকা নেয়া হয় না। প্রতিদিন এখানে এসে ইফতার করবেন। যদি পারেন দুই একজনকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন।’

এদিন ইফতারে অংশ নেয়া বোয়ালী ইউনিয়নের সাবুতখালীর ভ্যান চালক আব্দুস সবুর বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন থেকে দাদার হোটেলে বিনে টাকায় ইফতার করি, পেট ভরে গেছে। ইফতারে যত কিছু থাকে আমাদের মতো গরিবের এতকিছু জোগাড় করা সম্ভব নয়।’

গোবিন্দপুর এলাকার ওই বাজারের পান ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, ‘এখানে প্রতিদিন পথচারী, রিকশাচালক, অটোরিকশা চালক, ভ্যানচালক, হোটেলের কাছাকাছি ফুটপাতের দোকানদার এবং এই বাজারের কিছু ব্যবসায়ী নিয়মিত ইফতারে অংশ নেয়। আমি প্রতিদিন এখানে ইফতার করে থাকি।’

প্রেসক্লাব গাইবান্ধার সভাপতি খালেদ হোসেন বলেন, ‘সুজন প্রসাদ একজন হিন্দু ধর্মের লোক। তার এমন ইফতার আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমার মনে হয় সুজন প্রসাদ একেবারেই অন্তর থেকে মানসম্মত এবং রুচিসম্মত এসব ইফতার আয়োজন করে থাকেন।’

গাইবান্ধার সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু ফোনে বলেন, ‘হিন্দু ধর্মীয় লোক হয়েও মুসলিম রোজাদারদের জন্য সুজন প্রসাদের এ ইফতার আয়োজন সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সুজন প্রসাদের এমন আয়োজনই প্রমাণ করে বাংলাদেশ অসম্প্রদায়িক দেশ।’

কথা হয় সুজন প্রসাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি যে ধর্মই পালন করিনা কেন, দিন শেষে আমি একজন মানুষ। তাই মানুষ হিসেবে এ দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমি রোজাদারদের জন্য এ ইফতারের আয়োজন করছি।’

আরও পড়ুন:
পাঁচ বছর ধরে দুই শতাধিক মুসল্লির ইফতার আয়োজন করছে মসজিদটি
ফরিদপুরে ৫০০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস, ১০০ টাকায় তরমুজ বিক্রি  
এতিম ছাত্রদের নিয়ে জামালপুর প্রেসক্লাবের ইফতার
রমজান এলেই অন্য মানুষ হয়ে যান ব্যবসায়ী আনিসুর
‘আমরা রমজানে বিনা লাভে পণ্য বিক্রি করব’

মন্তব্য

মুজিব শতবর্ষ
10 doctor shortage in national award winning and top health complex

১০ চিকিৎসক ছাড়াই চলছে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

১০ চিকিৎসক ছাড়াই চলছে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংকট রয়েছে চিকিৎসকের। ছবি: নিউজবাংলা
গাজীপুরের সিভিল সার্জন মাহমুদা আখতার বলেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন ডাক্তার সংকট দূর করা যায়। এ বিষয়ে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই ডাক্তার সংকট দূর হবে।’

দীর্ঘদিন ধরে ১০ জন চিকিৎসক ছাড়াই চলছে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটিতে ১৭ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কাজ করছেন সাতজন।

দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর মধ্যে আলোচিত কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লক্স। এটি ২০২০ সালে জাতীয় পুরস্কার পায়।

কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালটি থেকে জেলার বিভিন্ন কারাগারে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য ডেপুটেশনে নেয়া হয় চিকিৎসকদের, যার ফলে এ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

হাসপাতালটির বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ জন রোগী আসে। সব শয্যায় সারা বছরই রোগী থাকে। এমন বাস্তবতায় মেডিক্যাল অফিসার ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট সংকটে কমে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির সেবার মান।

অনেক দিন ধরে এ স্বাস্থ্য কমেপ্লেক্সে ছয়জন চিকিৎসক গাজীপুরের বিভিন্ন কারাগারে পেষণে কর্মরত রয়েছেন। অন্যদিকে একজন মেডিসিন কনসালট্যান্ট ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হাসপাতালে পেষণে কর্মরত।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সটিতে নেই অর্থোপেডিক্স ও ইএনটি কনসালট্যান্ট।

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা

জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মামুনুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা কার্যক্রম মানসম্মত রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে শূন্য পদগুলোতে অর্থোপেডিক্স কনসালট্যান্ট ও ইএনটি কনসালট্যান্ট পদায়ন জরুরি। প্রেষণে কর্মরত ছয়জন মেডিক্যাল অফিসারের পেষণাদেশ বাতিল করা খুব প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘চলতি মাসেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আরও তিনজন ডাক্তার কোর্সের জন্য পেষণে চলে যাবেন। তখন সংকট আরও তীব্র হবে।

‘এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গুণগত মান ধরে রাখতে চিকিৎসক সংকট দূর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জেলার সিভিল সার্জন মহোদয়কে অবহিত করা হয়েছে।’

গাজীপুরের সিভিল সার্জন মাহমুদা আখতার বলেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন ডাক্তার সংকট দূর করা যায়। এ বিষয়ে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই ডাক্তার সংকট দূর হবে।’

আরও পড়ুন:
ভৈরবে গর্ভের শিশুর মৃত্যু: তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ
গাজীপুরে বিস্ফোরণে দগ্ধ অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিকিৎসকদের ওএসডি করে রাখার বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
‘দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে’
আগামী সংসদেই সুরক্ষা আইন পাস করতে চাই: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

মন্তব্য

মুজিব শতবর্ষ
Land officials do not work without money service seekers complain

টাকা ছাড়া কাজ করেন না ভূমি কর্মকর্তা, অভিযোগ সেবাপ্রার্থীদের

টাকা ছাড়া কাজ করেন না ভূমি কর্মকর্তা, অভিযোগ সেবাপ্রার্থীদের গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
ভূমি অফিসে সেবা নিতে যাওয়া এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘উপজেলা অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং ভূমি অফিসগুলো কবরের পাশে করা উচিত। যাতে করে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ নেয়া এবং সাধারণ মানুষদের হয়রানি করার আগে মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে পারে।’

জমি খারিজ করে দেয়ার কথা বলে এক সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নিচ্ছেন পাঁচ হাজার টাকা। আর যিনি টাকা নিচ্ছেন তিনি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর-পাটিচরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রসেস সার্ভার গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী। সম্প্রতি এমন লেনদেনের কিছু ছবি ধারণ করেছেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক।

শুধু এই একটি অভিযোগই নয়, এ ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে অঢেল ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ।

সেবাপ্রার্থীরা জানান, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই ভূমি অফিসে তার আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন। চাহিদামতো ঘুষ না দিলে মেলে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। আবার কেউ টাকা দিতে না চাইলে নানা শুরু করেন তালবাহনা। সেবা গ্রহীতাদের ভূমি অফিসের বারান্দায় ঘুরতে হয় দিনের পর দিন।

গোলাম কিবরিয়ার অফিশিয়াল কাজ নোটিশ জারি ও ভূমি জরিপ হলেও অনেক সেবাগ্রহীতারা বাধ্য হন তার মাধ্যমে খাজনা-খারিজসহ অন্যান্য কাজ করতে।

উপজেলার নেপালপুর গ্রামের কারিমুল ইসলাম বলেন, ‘প্রসেস সার্ভার গোলাম কিবরিয়া আমার জমি খারিজ করে দেয়ার কথা বলে আমার কাছে থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়। তারপর দিনের পর দিন আমাকে ঘুরাতে থাকে। আমার জমি খারিজ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আমাকেই গরম দেখায় ফোন বন্ধ করে রাখে। এভাবেই আমাকে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে।’

ভূমি অফিসে গিয়ে কথা হয় আব্দুল্লাহ প্রামাণিক নামের এক সেবাগ্রহীতার সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি হোল্ডিং খুলতে। তার পর কিবরিয়া বলল, এখন হবে না পরে এসো। তার পর এখানে আরেক কর্মকর্তাকে বললাম, তিনিও কোনো কাজ করে দেয়নি। এ ভূমি অফিসে প্রতিটি কাজের জন্যই অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে কোনো সেবা মেলে না। নইলে ঘুরতে হবে দিন, মাস, এমনকি বছর।’

ভূমি অফিসে সেবা নিতে যাওয়া এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘উপজেলা অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং ভূমি অফিসগুলো কবরের পাশে করা উচিত। যাতে করে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ নেয়া এবং সাধারণ মানুষদের হয়রানি করার আগে মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে পারে। যখন আমার মতো মুক্তিযোদ্ধার কাছেও ঘুষ দাবি ও হয়রানি করা হয়। তখন সাধারণ মানুষ তো আরও নিরুপায়।’

তিনি বলেন, প্রশাসনের উচিত এদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সরেজমিনে খোঁজ নিতে গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নাম প্রকাশে না শর্তে কথা হয় একাধিক প্রতিবেশীর সঙ্গে।

তারা বলেন, প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর আগে চাকরিতে যোগদান করেন গোলাম কিবরিয়া। তার পর থেকেই নিজেকে প্রভাবশালী মনে করেন নিজেকে। প্রতিবেশী হওয়ার পরও তার কাছে সেবা নিতে গেলে অতিরিক্ত টাকা ছাড়া কোনো কাজই করেন না। প্রতিটি কাজেই ঘুষ নেন তিনি।

তারা আরও জানান, নিরুপায় হয়ে চাহিদামতো টাকা দিয়েই কাজ করে নিতে হয়। প্রতিবাদ করলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের।

এ সময় স্থানীয়রা তাদের নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান।

অভিযোগের বিষয়ে গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর বক্তব্য নিতে গেলে, ভূমি অফিসে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের অতিরিক্ত টাকা নেই না। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্য নয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পপি খাতুন বলেন, ‘ভূমি অফিসের প্রসেস সার্ভার গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আরও পড়ুন:
স্বামীকে জিম্মি করে অন্তঃসত্ত্বাকে ‘ধর্ষণ’: ৫ দিনেও গ্রেপ্তার নেই
শেরপুরে হাতুড়ির আঘাতে বৃদ্ধকে হত্যার অভিযোগ, ছেলে আটক
হাতের সঙ্গে উঠে যাচ্ছে পিচ
কলা চুরির অভিযোগে কলেজছাত্রকে মারধর, দুজন আটক
কুমিল্লায় পাঁচ শতাধিক কলাগাছ কেটে জমি দখলের অভিযোগ

মন্তব্য

মুজিব শতবর্ষ
Iftar is organized for hundreds of Muslims in five years throughout Ramadan

পাঁচ বছর ধরে দুই শতাধিক মুসল্লির ইফতার আয়োজন করছে মসজিদটি

পাঁচ বছর ধরে দুই শতাধিক মুসল্লির ইফতার আয়োজন করছে মসজিদটি কুড়িগ্রামের হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর বাজার জামে মসজিদে রোজাদারদের সামনে রাখা ইফতারসামগ্রী ও পানি। কোলাজ: নিউজবাংলা
হাতিয়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এবিএম আবুল হোসেন বলেন, ‘নদীভাঙন আর চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ হাতিয়া হাটে আসেন, কিন্তু রমজান মাসে তারা রোজা রেখে হাট করে বাড়ি ফিরে যেতে রাস্তার মধ্যে ইফতারের সময় হয়ে যায়। আবার অনেকের দোকানের ইফতার কিনে খাবার সামর্থ্য থাকে না। এসব চিন্তা করে পাঁচ বছর ধরে মসজিদে বিনা মূল্যে ইফতারের আয়োজন করা হয়।’

বিগত পাঁচ বছর ধরে দুই শতাধিক মানুষের জন্য প্রতিদিন ইফতারের আয়োজন হচ্ছে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের পুরাতন অনন্তপুর জামে মসজিদে।

পুরাতন অনন্তপুর বাজার বণিক সমিতি ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির যৌথ উদ্যোগে এ আয়োজন করা হয়।

ব্যতিক্রমী এ ইফতার আয়োজনে রোজাদারদের মিলনমেলা দেখা যায়।

মসজিদটিতে রোজ ইফতারে অংশ নেন দাগারকুটি, বাবুরচর, চরগুজিমারী চর হাতিয়াসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল আর প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের ২০০ থেকে ৩০০ মানুষ।

এ আয়োজনকে দৃঢ় করতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় দাতারা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও দূরদূরান্তের রোজাদারদের জন্য এমন উদ্যোগে খুশি অনেকেই।

আছরের নামাজের পর শুরু হয় ইফতারের প্রস্তুতি। মসজিদের মুসল্লি ও পুরাতন অনন্তপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ইফতারি তৈরিতে।

ইফতার করতে আসা একজন বলেন, ‘প্লাস্টিকের বড় বড় গামলায় ইফতার সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। জায়নামাজে বসে সারিবদ্ধভাবে থাকা রোজাদারদের সামনে প্লেটে করে ইফতার,পানি পৌঁছে দিচ্ছেন সেচ্ছাসেবীরা। কলা, বুট, মুড়ি, পেঁয়াজু, শরবত, আঙুর এবং খিচুড়িসহ নানা পদের খাবার।

‘সবাই ইফতার ও পানি নিয়ে আজানের অপেক্ষায়। আজান দিলে একসঙ্গে শুরু হয় ইফতার খাওয়া। এমন সুন্দর আয়োজন রমজান মাসজুড়ে থাকে।’

ইফতারি করতে আসা অনন্তপুরের ভিক্ষুক নুর আলী বলেন, ‘আমি প্রতিদিন পুরাতন অনন্তপুর বাজার জামে মসজিদে ইফতার করি। সারা দিন ভিক্ষা করে যে আয় হয়, তা থেকে কোনো রকমে সংসার চলে।

‘ইফতার কিনে কীভাবে খাব? তাই বিনা মূল্যে এখানে ইফতার করতে ছুটে আসি।’

হাতিয়া বাজার থেকে আসা রনি বলেন, ‘আমি প্রায়ই এখানে ইফতার করতে আসি। আমি একা না; আমার মতো অনেক পথচারী, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা এবং আশপাশের ফুটপাতের দোকানদাররা এ মসজিদে ইফতার করতে আসেন। একসঙ্গে শতাধিক মুসল্লি ইফতার করার সুযোগ পাই।’

দাগারকুটি চর থেকে আসা বৃদ্ধ মোজাম্মেল বলেন, ‘হাতিয়া হাটে আসছি। শেষ বিকেলে হাট করে বাড়ি যেতে চরের মধ্যে ইফতারের সময় হয়ে যায়। তাই এখানে ইফতার খেয়ে নামাজ আদায় করে হাটে খরচ করে বাড়ি ফিরে যেতে পারি।’

মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা মসজিদে সবাই মিলে ইফতার করে যে আনন্দ পাই, সেটা বাড়িতে একা হয় না। ছোট, বড়, বৃদ্ধসহ নানা বয়সের নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করার আনন্দ অন্য রকম। আমরা চাই আমাদের পরের প্রজন্ম এ কার্যক্রম ধরে রাখুক।’

পুরাতন অনন্তপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ভুট্টো বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে এমন আয়োজন করে আসছি। বাজারে অনেক অসহায়, দুস্থ মানুষজন থাকে। সামর্থ্য না থাকায় বাইরে ইফতার করতে ইতস্তত বোধ করেন।

‘আমরা মূলত আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সবার সহযোগিতায় প্রতি বছর রমজান মাস ধরে ইফতারের আয়োজন করে থাকি। এটি দেখে পরের প্রজন্ম যেন এ ইফতার আয়োজনটি ধরে রাখে, এই প্রত্যাশা আমাদের।’

হাতিয়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এবিএম আবুল হোসেন বলেন, ‘নদীভাঙন আর চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ হাতিয়া হাটে আসেন, কিন্তু রমজান মাসে তারা রোজা রেখে হাট করে বাড়ি ফিরে যেতে রাস্তার মধ্যে ইফতারের সময় হয়ে যায়। আবার অনেকের দোকানের ইফতার কিনে খাবার সামর্থ্য থাকে না।

‘এসব চিন্তা করে পাঁচ বছর ধরে মসজিদে বিনা মূল্যে ইফতারের আয়োজন করা হয়। প্রতিদিন একসঙ্গে ২০০ থেকে ৩০০ মুসল্লি ইফতার করেন। এটি যেন আগামীতে অব্যাহত রাখা হয়, সকলের সহযোগিতা চাই।’

মন্তব্য

মুজিব শতবর্ষ
Why jelly fish wandering on the beach at this time

সৈকতে এ সময়টাতেই কেন জেলি ফিশের বিচরণ

সৈকতে এ সময়টাতেই কেন জেলি ফিশের বিচরণ কুয়াকাটা সাগর সৈকতে ভেসে আসা জেলি ফিশ। ছবি: নিউজবাংলা
সাগর-কন্যা কুয়াকাটার সৈকত জুড়ে মৃত জেলি ফিশের ছড়াছড়ি। পনের দিন ধরে চরগঙ্গামতি পয়েন্টসহ আশপাশের সৈকত এলাকা সয়লাব হয়ে গেছে মৃত জেলি ফিশে। এগুলো এভাবে পড়ে থাকলে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা করছেন অনেকে। বিপাকে পড়েছেন জেলেরাও। তারা সাগরে ঠিকমতো জাল ফেলতে পারছেন না।

সাগর-কন্যা কুয়াকাটার সৈকত জুড়ে আবারও মৃত জেলি ফিশের ছড়াছড়ি। গত পনের দিন ধরে চরগঙ্গামতি পয়েন্টসহ আশপাশের সৈকত এলাকা সয়লাব হয়ে গেছে মৃত জেলি ফিশে। গত বছরও এখানে একই চিত্র দেখা গেছে এবং তা এই সময়টাতেই।

জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা হাজার হাজার জেলি ফিশ সৈকতের বালুতে আটকে মারা যাচ্ছে। কুয়াকাটার জিরো পয়েন্টের তুলনায় চরগঙ্গামতি পয়েন্টে পর্যটক কম থাকায় এটি কারও বড় মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে না। তবে এগুলো এভাবে পড়ে থাকলে পরিবেশ দূষিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। ইতোমধ্যে জিরো পয়েন্টের আশপাশ এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সৈকত জুড়ে জেলি ফিশের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্থানীয় জেলেদেরও। কারণ তারা ঠিকভাবে সাগরে জাল ফেলতে পারছেন না। এসব পয়েন্টে জাল ফেললেই জীবিত জেলি ফিশ আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। জেলি ফিশে জাল আটকে যাচ্ছে।

সৈকতে এ সময়টাতেই কেন জেলি ফিশের বিচরণ
কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে আসা জেলি ফিশ মরে পরিবেশ দূষণের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ছবি: নিউজবাংলা

মৃত জেলি ফিশগুলোর কোনোটা দেখতে চাঁদের মতো আবার কোনোটা অক্টোপাসের মতো। সৈকত থেকে এগুলোকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন পর্যটকরা।

পটুয়াখালী জেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘জেলি ফিশ সমুদ্রের এক আজব প্রাণি। এগুলোকে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন বছর আগের ডাইনোসর যুগের প্রাণি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন বিজ্ঞানীরা।

‘জেলি ফিশের মাথা, হৃৎপিণ্ড, লেজ, মেরুদণ্ড বা হাত-পা বলে কিছু নেই। সম্পূর্ণ নরম দেহ বা জিলেটিনাস দেহ নিয়ে এটা গঠিত। বিভিন্ন প্রজাতির জেলি ফিশ পৃথিবির সব সাগর, মহাসাগর, হ্রদ বা লেগুনে বিস্তৃত রয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে এগুলো টিকে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘জেলি ফিশ প্রকৃতপক্ষে লোনা পানির প্রাণি। এরা সাধারণত সাঁতার কাটার উপযুক্ত নয়। কারণ এদের সাঁতার কাটার কোনো দৈহিক শক্তি বা অঙ্গ নেই। তবে উল্লম্বভাবে সামান্য চলাচলে ভার্টিকেল প্রোপালশন সিস্টেম রয়েছে, যার মাধ্যমে এগুলো পানির গভীর থেকে উপরে এবং উপর থেকে গভীরে গমনাগমন করতে পারে। পার্শ্বীয় চলাচল বা সামন্তরাল পথ ভ্রমণে এরা মোটেই উপযুক্ত নয়। তাই জেলি ফিশ পানির স্রোত বা বাতাসের গতির ওপর নির্ভরশীল থাকে।

সৈকতে এ সময়টাতেই কেন জেলি ফিশের বিচরণ

‘সমুদ্রের স্রোত, জোয়ার বা সামদ্রিক বাতাসের তোড়ে এগুলো সমুদ্র থেকে উপকূলে বা সমুদ্রতীরে বা বিচে এসে আটকে পড়ে। স্রোতের বিপরীতে যাওর অক্ষমতার জন্য এখানেই এদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে।

‘জেলি ফিশ সাধারণত উপযুক্ত লবণাক্ততায় প্রজনন করে থাকে এবং নির্দিষ্ট একটি বয়সে এসে মারা যায়। প্রচুর খাবার, সঠিক অক্সিজেন ও লবণাক্ততা পেলে জেলি ফিশ দ্রুত বংশ বিস্তার করে।

‘কিছু প্রজাতির জেলি ফিশের স্টিং থাকে। আর তাতে ভেনম বা বিষ থাকে; যদিও এই বিষ মৃত্যুঝুঁকির মতো নয়। তবে চুলকানি, লাল বার্ন হয়ে যাওয়া বা কিছু ক্ষেত্রে চোখে লাগলে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ‘কুয়াকাটার বিচে আটকে পড়া এসব জেলি ফিশ সাদা জেলি ফিশ নামে পরিচিত, যার বৈজ্ঞানিক নাম ফাইলোরিজা পাঙটাটা। এরা মোটেই বিষাক্ত প্রজাতির নয়। এদের স্টিং নেই যেখানে বিষ থাকতে পারে। তবে এই প্রজাতির জেলি ফিশের সংস্পর্শে কিছুটা চুলকানি হতে পারে।’

সৈকতে এ সময়টাতেই কেন জেলি ফিশের বিচরণ

প্রতি বছর মার্চ মাসের দিকে সাগর উপকূলে জেলি ফিশের বিস্তারের কারণ সম্পর্কে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মার্চ থেকে জুলাই মাসে সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেন ভালো থাকে। পাশাপাশি অনুকূল তাপমাত্রা ও ও লবণাক্ততা প্রজননের জন্য উপযুক্ত হওয়ায় সাদা জেলি ফিশ এই সময়ে ব্যাপকমাত্রায় প্রজনন করে পপুলেশন ব্লুমস তৈরি করে। পরবর্তীতে সাগরের ঢেউ, স্রোত ও বাতাসের শক্তিতে এগুলো উপকূলভাগে চলে আসতে বাধ্য হয়।

‘এ কারণেই প্রতি বছর মার্চ মাসের শুরুতে বা কিছু ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এসব জেলিফিশ উপকূলে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। তবে তাপমাত্রা কমে গেলে বা সামান্য বৃষ্টিপাত হলেই এগুলো মারা যাবে।’

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, সাগরে অধিক পরিমাণ মাছ আহরণের কারণেও জেলি ফিশের ব্যাপক বংশ বিস্তার হতে পারে। কারণ অনেক সামুদ্রিক মাছ বা প্রাণি জেলি ফিশ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তাই সাগরে কিছু প্রয়োজনীয় মাছ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই জেলি ফিশের সংখ্যা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের সাগর সীমায় সরকার যে ৬৫ দিনের জন্য মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করেছে (২০ মে থেকে ২৩ জুলাই) তা অব্যাহত থাকলে সাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে এবং মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে জেলি ফিশের সংখ্যা বা ব্লুমস প্রাকৃতিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ হবে।

মন্তব্য

মুজিব শতবর্ষ
Drug resistant tuberculosis is on the rise in Gaibandha

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বাড়ছে গাইবান্ধায়

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বাড়ছে গাইবান্ধায় যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য কফ পরীক্ষার জিন এক্সপার্ট মেশিন। ছবি: নিউজবাংলা
এনটিপি গাইবান্ধার ডেটা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত গাইবান্ধায় ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী ৩৭ জন, যা রংপুর বিভাগের আট জেলার সর্বোচ্চ। এ সময়ে জেলায় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ১৯৯৩ সালে যক্ষ্মাকে গ্লোবাল ইমার্জেন্সি ঘোষণার পর থেকেই রোগটি নির্মূলে নানা পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ সরকার। এ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও।

সারা দেশের মতো গাইবান্ধাতেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সম্ভাব্য যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত কার্যক্রম চলছে। এসবের পরও উত্তরের জেলাটিতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে যক্ষ্মা ও মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকুলোসিস (এমডিআর) তথা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা।

পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনটিপি) গাইবান্ধার ডেটা অনুযায়ী, জেলায় ২০১৯ সালে এমডিআর আক্রান্ত রোগী ছিল পাঁচজন, যেটি পরের বছর ২০২০ সালে কমে হয় চারজন, তবে পরের বছর থেকে গাইবান্ধায় বাড়তে থাকে এমডিআর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।

গাইবান্ধায় ২০২১ সালে এমডিআর আক্রান্ত রোগী ছিল ২৪ জন। জেলায় ২০২২ সালেও সমসংখ্যক মানুষ যক্ষ্মার এ ধরনের আক্রান্ত হন। এর পরের বছর ২০২৩ সালে এমডিআরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ জনে।

এনটিপি গাইবান্ধার ডেটা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত গাইবান্ধায় ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী ৩৭ জন, যা রংপুর বিভাগের আট জেলার সর্বোচ্চ। এ সময়ে জেলায় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বাড়ছে গাইবান্ধায়

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য বলছে, চলতি বছরের ২২ মার্চ পর্যন্ত গাইবান্ধায় যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগী ৬৮১ জন।

বক্ষব্যাধি নিয়ে কাজ করা রাজশাহী চেস্ট ডিজিজ হসপিটালের (সিডিএইচ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে চলতি বছরের ২০ মার্চ পর্যন্ত রংপুর বিভাগে এমডিআরে আক্রান্ত রোগী ১২৫ জন। এ সময়ে এমডিআর আক্রান্ত বিভাগের সর্বোচ্চ রোগী ছিল গাইবান্ধায়, যেখানে সর্বনিম্ন পাঁচজন রোগী পাওয়া যায় কুড়িগ্রামে।

এনটিপি গাইবান্ধার ডেটা বলছে, ২০২৩ সালে গাইবান্ধায় যক্ষ্মার সব ধরনে আক্রান্ত রোগী তিন হাজার ৬০৩ জন।

পরীক্ষায় অবহেলা

গাইবান্ধায় সম্ভাব্য যক্ষ্মা রোগী শনাক্তে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও আইসিডিডিআরবির অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

তারা জানান, যক্ষ্মার সব লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও মানুষ সহজে প্রকাশ করতে চান না, যার মূলে রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, লোকলজ্জা ও রোগের ব্যাপারে অজ্ঞতা, অবহেলা ও অসচেতনতা।

তারা বলেন, একজন সম্ভাব্য রোগীকে নানাভাবে বোঝানোর পরও কাশি পরীক্ষার জন্য কফ দিতে চান না এবং এক্সরে করতে চান না। কফ পট নিলেও অবহেলা ও নানা অজুহাতে তা ফেরত দেন।

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বাড়ছে গাইবান্ধায়

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, যক্ষ্মা পজিটিভ রোগীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যক্ষ্মার পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে টিপিটি (টিবি প্রিভেনটিভ থেরাপি) দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে তাদের আরও বেশি জটিলতায় পড়তে হয়। কেননা রোগীর স্বজনরা সুস্থতা দাবি করে কোনোভাবেই টিপিটির আওতায় আসতে চান না।

যক্ষ্মার লক্ষণ

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি তথা এনটিপির রংপুর বিভাগীয় বিশেষজ্ঞ ডা. রানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যক্ষ্মা হচ্ছে একটি বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি, যেটা মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে, যা হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে বাতাসের সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে থাকে। যক্ষ্মার প্রধান লক্ষণ এক নাগাড়ে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি। সে ক্ষেত্রে কাশির সাথে রক্ত আসতেও পারে, নাও আসতে পারে।

‘এ ছাড়া রোগীর ওজন কমে যাওয়া, আস্তে আস্তে শরীর দুর্বল হতে থাকা, ক্ষুধামান্দ্য, বিকেল-সন্ধ্যায় জ্বর হওয়া, ঘামের সঙ্গে ভোররাতে জ্বর ছেড়ে যাওয়া ও বুকে-পিঠে ব্যথা হওয়া যক্ষ্মার লক্ষণ।’

তিনি বলেন, ‘এসব লক্ষণ যদি কোনো ব্যক্তির মাঝে থাকে তাহলে সম্ভাব্য যক্ষ্মা রোগী হিসেবে তাকে পরীক্ষা করাতে হবে। শনাক্ত হলে নিয়মিত পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ খেলে যক্ষ্মা সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়।’

এ চিকিৎসক জানান, যক্ষ্মা হাত-পায়ের নখ, দাঁত ও চুলের বাইরে অনেক স্থানকে আক্রান্ত করতে পারে। এটি মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে শরীরের অস্বাভাবিক গুটি, ফোঁড়া, ত্বক, অন্ত্র, লিভার, কিডনি, হাড়, জরায়ু, অস্ত্রোপচারস্থলসহ শরীরে রক্ত সঞ্চালন হয় এমন যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শরীরের যে অংশে যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমিত হবে, সেই অংশটি ফুলে উঠবে।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘রোগটি সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এ ছাড়া যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল, এ জীবাণু থেকে তাদেরই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

‘এ ছাড়াও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী, মাদকে আসক্তি ব্যক্তি, অপুষ্টি, দারিদ্র্য, পরিবেশ দূষণ এবং সঠিক সময়ে সকল রোগী শনাক্ত না হওয়া যক্ষ্মার হার বাড়ার অন্যতম কারণ।’

একজন মানুষ এমডিআরে কীভাবে আক্রান্ত হন

এমডিআরে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে রাজশাহী চেস্ট ডিজিজ হসপিটালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শোভন পাল মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমডিআর যক্ষ্মা রোগী প্রধানত দুইভাবে হয়ে থাকে। এক. সরাসরি ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীর জীবাণু দ্বারা। দুই. যক্ষ্মা পজিটিভ রোগী যদি অনিয়মিত ওষুধ খায় কিংবা অনেকেই সেরে উঠেছেন ভেবে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন, সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে এসব রোগী এমডিআরের রোগী হিসেবে চিহ্নিত হন। এসব রোগীর যক্ষ্মার স্বাভাবিক ওষুধে আর কোনো কাজ হয় না।’

যক্ষ্মার নিরাময় নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ চিকিৎসক বলেন, ‘যক্ষ্মা দীর্ঘমেয়াদি রোগ হওয়ায় এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ খেতে হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগের ধরন, মাত্রা এবং রোগীর বয়স অনুসারে ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ করতে ছয় থেকে ৯ মাস পর্যন্ত, এমনকি রোগীর কন্ডিশন অনুযায়ী আরও দীর্ঘ সময় হতে পারে। এসবের ব্যত্যয় হলে অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও হয়।

‘এমন অবস্থায় যক্ষ্মা রোগীদের ধৈর্যের সাথে নির্দিষ্ট মাত্রা অনুযায়ী পুরো মেয়াদে ওষুধ খেতে হবে। সঠিক সময় চিকিৎসা না নিলে এই জীবাণু শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে এবং একজনের মাধ্যমে ১০ থেকে ১৫ জনের মধ্যে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

শোভন পালের মতে, যক্ষ্মা এবং এমডিআর রোগী কমাতে আক্রান্তদের প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যক্ষা রোগীর সঙ্গে থাকা লোকজনের আরও সজাগ হওয়া, অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা মানুষগুলোকে নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় নেয়ার পাশাপাশি জীবাণুবাহী রোগী হাসপাতালে আসার আগেই রোগ শনাক্ত করতে। এ ছাড়া কেউ যাতে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে না দেন, সে বিষয়ে নজরদারি করা, শনাক্ত রোগীদের চিকিৎসার দুই, তিন ও পাঁচ মাসের নিয়মিত ফলোআপ এবং যক্ষ্মায় আক্রান্ত গরিব মানুষদের চিকিৎসার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যক্ষ্মা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা জরুরি।

এনটিপি কতটা সফল

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বর্তমান সফলতা প্রসঙ্গে ডা. রানা বলেন, ‘রোগী চিহ্নিত ও চিকিৎসায় করার ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। আর ৯৬ ভাগ রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যাচ্ছে। এনটিপি এবং সহযোগী সংস্থাগুলো গত কয়েক দশকে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে যেখানে প্রতি এক লাখে প্রায় ৪৫ জন লোকের মৃত্যু হতো, বর্তমানে তা ২২ জনে নেমে এসেছে।’

যক্ষ্মা রোগীর নিবন্ধন ও পরামর্শসহ সব কার্যক্রম সরকারিভাবে করা হলেও রোগী শনাক্তের চ্যালেঞ্জিং কাজটি করে থাকে ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবির মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ বিষয়ে ব্র্যাক যক্ষ্মা কর্মসূচির (বিএইচপি টিবি) গাইবান্ধার ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার (ডিএম) নাজমুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ও ব্র্যাক যৌথভাবে ১৯৯৩ সাল থেকে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গাইবান্ধায় এই রোগ নির্মূলে শ্রেণিভেদে মাঠ পর্যায়ে ব্র্যাকের ৫৬ জন কর্মী সরাসরি কাজ করছে এবং তাদের সহযোগিতায় জেলায় ৩২০০ স্বাস্থ্য সেবিকা কাজ করছে। আমরা সরাসরি রোগীর কাছ থেকে কফ কালেকশন করে হসপিটালে পরীক্ষার জন্য জমা দিচ্ছি।

‘পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা রোগীদের ওষুধ খাওয়ানো এবং নিয়মিত ফলোআপ এবং টিপিটির ব্যবস্থা করছি। অতি দরিদ্র রোগী, পরিবহন শ্রমিক, রিকশাচালক, ইটভাটা শ্রমিকসহ এই ক্যাটাগরির পরিবারের রোগীদের পরীক্ষার জন্য যাতায়াত খরচ এবং পুষ্টিকর খাবারের জন্য অর্থ সহায়তা করা হচ্ছে। শিশুদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসায় অর্থ সহায়তা এবং ডেটা প্রোভাইডারদের ভাতা প্রদান করে রোগীদের ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে চলেছে ব্র্যাক।’

২০৩৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্ব থেকে যক্ষ্মা রোগ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এটি কতটা সহজ হবে, এমন প্রশ্নে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে যক্ষ্মা নিয়ে অনেক কাজ হলেও ২০৩৫ সালের মধ্যে এটি নির্মূল করা অত্যন্ত কঠিন। কেননা একদিকে মানুষ যেমন সচেতন নয়, অপরদিকে রোগী শনাক্তও অত্যন্ত কঠিন, তবে ওই সময়ের মধ্যে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’

রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা. মো. আবু হানিফ মোবাইল ফোনে নিউজবাংলকে বলেন, ‘যক্ষ্মা রোগ নির্মূলে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিসহ সব পরিকল্পনাই রয়েছে আমাদের। যক্ষা নির্মূলে জেলার সরকারি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, এমনকি জেলখানা ও গার্মেন্ট কর্মীদের চিকিৎসা কেন্দ্র ছাড়াও ব্র্যাকসহ বেসরকারি আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক ল্যাবরেটরিতে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় হচ্ছে। এ জন্য পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে সংযুক্ত করা হয়েছে অত্যাধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিও।

‘এর পরও যক্ষ্মা নির্মূলে যতটুকু সংকট আর চ্যালেঞ্জ রয়েছে, আমরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূল করা সম্ভব হবে।’

আরও পড়ুন:
জাল টাকায় বই-খাতা কিনতে এসে যুবক আটক
রেললাইনে মাথা রেখে ঋণগ্রস্ত যুবকের আত্মহত্যা, ধারণা পুলিশের
ট্রাকের বুবলীর বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ নৌকার রিপনের
বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে নৌকার পোস্টার, ‘ভাতা বন্ধের হুমকি’ আওয়ামী লীগ নেতার
গাইবান্ধায় যাত্রীবাহী বাসে হঠাৎ আগুন

মন্তব্য

p
উপরে