হোটেলে ঢুকতেই চোখে পড়ে ইংরেজিতে বড় করে ‘রিসিপশন’ লেখাটি। তার নিচে বিদেশি ভাষায় কিছু লেখা। যারা এই অঞ্চল সম্পর্কে জানেন না বা ইংরেজি পড়তে পারেন না, তারা সহজে বুঝতে পারবেন না বিষয়টা।
বলছি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরের কথা। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদের সুবাদে এ অঞ্চল যেন এক টুকরা রাশিয়া।
পুরো এলাকাটি রুশ সংস্কৃতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দোকানের সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে মূল্য তালিকায় বাংলাকে হটিয়ে ইংরেজির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে রাশিয়ান ভাষা।
২০১৬ সালের জুলাই থেকে রূপপুরে রাশিয়ার অর্থায়নে চলছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। গত ছয় বছরে এলাকাটির পরিবর্তন হয়েছে অনেকভাবে, তবে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে ভাষাগত।
বিকেলের পর রূপপুর অঞ্চলের দোকানপাট, শপিংমলে চলে রুশদের রাজত্ব। দোকানে দোকানে বিক্রি বাড়ে। চলে রুশ ভাষায় কথা আদান-প্রদান।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর কয়েক মাস পর থেকেই শুরু হয় রূপপুরের পরিবর্তন। অবকাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে কয়েক হাজার রুশ ভাষাভাষীর বসবাসের জন্য সেখানকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রায় পড়ে ব্যাপক প্রভাব।
রূপপুরে রুশ নাগরিকদের থাকার জন্য রয়েছে গ্রিন সিটি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১০ মিনিট দূরে এ সিটির অবস্থান। আর গ্রিন সিটির সামনেই গড়ে উঠেছে রুশদের জন্য আধুনিক মার্কেট ও দোকান।
রূপপুরের রিসোর্ট ও হোটেলগুলোতে প্রতিটি নির্দেশক বোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি রয়েছে রাশিয়ান ভাষা।
‘স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্ট’ নামের রেস্তোরাঁর বয় মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে খাবারের মেন্যু থেকে শুরু করে সবকিছুতেই রাশিয়ানদের জন্য আলাদা গুরুত্ব দেয়া আছে। মেন্যুতে রাশিয়ান খাবারের আলাদা তালিকা আছে।’
মামুন বলেন, ‘রিসোর্টের ৭০ ভাগ কাস্টমার রাশিয়ার নাগরিক। আমাদের খাবারের মেন্যু উনারা মোবাইলের অ্যাপের মাধ্যমে রাশিয়ান ভাষায় বুঝে নেন।’
রুশদের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে রূপপুরের দোকানপাটেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল রিচার্জ থেকে শুরু করে সেলুন, কাঁচাবাজার, ফলের দোকান, চায়ের দোকান—কিছুই বাদ যায়নি ভাষাগত বদল থেকে। অনেক খাবারের দোকান শুধু রুশদের জন্যই চালু হয়েছে। বাইরে আলাদা করে লেখাও আছে রাশিয়ান ভাষায়।
রাস্তায় টি-শার্ট বা প্যান্ট বিক্রি করেন মোখলেস। এর আগে তিনি প্রকল্পে চাকরি করেছেন। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করা মোখলেসের দোকানে ভিড় করেন রাশিয়ার নাগরিকরা। তারা কথা বলেন ইংরেজিতে।
মোখলেস বলেন, ‘প্রতিদিন ভালো বিক্রি হয়। উনারা যখন (রাশিয়ার নাগরিক) দেশে ফিরে যান, তখন যাওয়ার আগে প্রচুর জামাকাপড় কিনে নেন। এখন শীতের সময়। অনেকেই ফিরে যাবেন।’
বিক্রির নিয়ম জানিয়ে মোখলেস বলেন, ‘রাশিয়ানদের জন্য ফাইভ জিরো জিরো আর আমাদের জন্য থ্রি জিরো জিরো। এখানে দাম ৫০০ আর ৩০০ টাকা।’
পাশেই জুতার দোকানে দেশীয় কোনো সাইজের জুতা পাওয়া গেল না। বাংলাদেশিদের যেখানে স্বাভাবিক পায়ের মাপ ১০ ধরা হয়, সেখানে রূপপুরে জুতার দোকানগুলোতে মাপ দশের বেশি থেকে শুরু হয়।
দোকানে ঢুকতেই এক রাশিয়ানকে জুতা খুঁজতে দেখা যায়। পছন্দমতো সাইজ মিলে গেলে খুব অল্প ভাষায় দাম নির্ধারণ করা হয়।
দোকানি বলেন, ‘এখানে আমাদের সঙ্গে উনাদের বেশি দামাদামি হয় না। আমরা ইংরেজি বলি, উনারা হয়তো একটু কম বলেন। ব্যবসা ভালো। আর বাইরের দেশের মানুষ বলে আমরাও বেশি দামাদামি করতে চাই না।’
বাংলাদেশ নিয়ে রাশিয়ান নাগরিকদের অভিজ্ঞতা ভালো বলে জানান দোকানে আসা রুশ নাগরিকরা। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক রাশিয়ান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখানে ভালো আছি। এখানের মানুষ আমাদের প্রতি আন্তরিক।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বিতীয় চুল্লির উদ্বোধন করবেন। এ উপলক্ষে নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। রূপপুরের লোকজনের বিশ্বাস, প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও রাশিয়ার নাগরিকরা থেকে যাবেন এখানেই।
আরও পড়ুন:‘পোড়াদহ মেলাত মানুষ আসেই বাগাড় মাছের জন্য। গত বছর থেকে সে মাছ বিক্রি হচ্ছে না। তাই অন্য মাছের ওপর চাপ পড়ছে। বিগহেড, সিলভারের দাম এবার বেশি। বাগাড় থাকলে এগলা মাছের দাম পেতাম না আমরা।’
কথাগুলো বলছিলেন বগুড়ার গাবতলীর রানীরপাড়া এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মো. মুছা। উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নে বুধবার সকালে পোড়াদহ মেলায় গিয়ে এই তরুণ মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়।
চারশ’ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলা এই মেলা প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার ইছামতীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা জামাই মেলা হিসেবেও পরিচিত। এলাকার মেয়ে জামাইরা এই মেলা উপলক্ষে শ্বশুরালয়ে আসেন। তারাই এ মেলার মূল ক্রেতা।
পোড়াদহ মেলার মূল আকর্ষণ মাছ। মেলাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা প্রজাতির মাছ আমদানি হয়। তবে মাছ ছাড়াও মেলায় মিষ্টি, খেলনা থেকে শুরু করে সাংসারিক প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি হয়ে থাকে।
মুছা জানালেন, এবার মেলায় মাছের দাম বেশি। এ জন্য বড় মাছের ক্রেতা কম। তবে বাগাড় মাছ থাকলে কার্প জাতীয় মাছের দাম কম পেতো ক্রেতারা। বড় আকারের বিগহেড, কাতল, রুই- এগুলো এক হাজার টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে।
মেলা ঘুরে এবার ৪০ কেজি ওজনের গ্রাসকার্প মাছ পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীদের দাবি, এটিই এবারের মেলার সবচেয়ে বড় মাছ।
মাছটি মেলায় এনেছেন বজলুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘নাটোরের বিল থেকে আনা হয়েছে গ্রাসকার্প মাছটি। এর ওজন ৪০ কেজি। দাম চেয়েছি প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা।
অন্য মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, মেলায় আইড় মাছ দুই হাজার টাকা, চিতল ও বোয়াল ১৫শ’ টাকা করে দাম চাওয়া হচ্ছে। ছোট সাইজের সিলভার কার্প ৪০০, গ্রাসকার্প ২৫০, বিগহেড ৮৫০ দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা।
২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের এক বিজ্ঞপ্তিতে বাগাড় মাছকে মহাবিপন্ন ঘোষণা করা হয়। ক্রয়-বিক্রয়ে বিধিনিষেধের কারণে এরপর থেকে পোড়াদহ মেলায় ব্যবসায়ীরা বাগাড় মাছ আনছেন না।
তবে এর মধ্যে এক ব্যবসায়ী কয়েকটি বাগাড় মাছ মেলায় নিয়ে আসেন। পরে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের অভিযানে মাছগুলো জব্দ করা হয়। অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আফতাবুজ্জামান আল ইমরান।
গাবতলী থানার ওসি সনাতন দাস বলেন, ‘আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ৬০ হাজার টাকা মূল্যের চারটি বাগাড় মাছ জব্দ করেন। এই মাছ বিক্রির চেষ্টার জন্য শুক্রা সাকিদার নামে এক ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। মাছগুলো মহিষাবান ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের হেফাজতে রয়েছে।’
পোড়াদহ এলাকায় সূর্য ওঠার পর থেকেই মানুষের ভিড় জমে ওঠে। বেলা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিড় বাড়তে থাকে। পোড়াদহ মেলার আরেক নাম জামাই মেলা। সঙ্গত কারণে মেলার প্রধান ক্রেতা হলেন এলাকার জামাই।
স্থানীয়রা জানান, মেলা উপলক্ষে পোড়াদহের আশপাশের সব গ্রামে উৎসবের ধুম লেগে যায়। প্রত্যেক বাড়ির জামাইদের দাওয়াত করা হয়। এছাড়াও অন্য আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে আপ্যায়ন করেন স্থানীয়রা।
মেলায় ঘুরতে আসা এমন এক ব্যক্তি রেজাউল ইসলাম। তিনি বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। পোড়াদহের পাশে মহিষাবান গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি।
রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘দশ বছর হয়েছে বিয়ে করেছি। প্রতি বছরই মেলায় দাওয়াত পাই। যত কাজ থাকুক, আমাদের আসতে হয় মেলায়। মেলা উপলক্ষে আমরা মাছ-মাংস ও মিষ্টি কিনি। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াই।’
এ দাওয়াত ধনী-গরিব সব বাড়ির লোকজনেরাই করে থাকেন বলে জানান রেজাউল।
গাজীপুর থেকে মেলায় বেড়াতে এসেছেন মাসুদ রানা। এর আগে কখনও এত বড় মেলা দেখেননি তিনি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই চাকুরে বলেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়ি পাশের সারিয়াকান্দি উপজেলায়। এই মেলার কথা অনেক শুনেছি। এবারই প্রথম এলাম। এখনও কিছু কিনিনি। ঘুরে দেখছি।’
পোড়াদহ মেলার মিষ্টিরও সুনাম আছে। এ মেলায় হরেক রকমের মিষ্টি নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। এসব মিষ্টির নামও থাকে বাহারি।
মিষ্টির দোকানি আব্দুল হাকিম বলেন, ‘পোড়াদহের মেলায় মাছ মিষ্টির চাহিদা বেশি। একেকটি ১০ কেজি ওজনের এই মিষ্টির দাম ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা। এ ছাড়া বালিশ মিষ্টি, চমচম, রসগোল্লাও আছে। এগুলো ১৮০ থেকে ৪০০ টাকা দরের।’
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে মেলার স্থানটিতে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। একপর্যায়ে স্থানটি পুণ্যস্থানে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে।
প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়। ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। দিন যত যায়, স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এভাবেই গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার।
মেলাটি এক দিনের জন্য হলেও পরদিনই একই স্থানে বউ মেলা বসে। এ সময় সাধারণত নারীরা তাদের নানারকম পণ্য কিনে থাকেন।
পোড়াদহ মেলার সভাপতি ও মহিষাবান ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, ‘চার শ বছর ধরে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় অন্তত ২ হাজার দোকান বসছে, যার মধ্যে অন্তত ৪০০টি মাছের দোকান। মেলায় আলাদা করে কোনো ডাক হয় না।
‘মেলার স্থানের অন্তত ৫০ জন জমির মালিক বা জোতদার আছেন। তারাই মেলার দোকানগুলো বসাতে দেন ব্যবসায়ীদের। মেলাটি মূলত মাছের জন্য এবং প্রচুর মাছও বিক্রি হয় এখানে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারও কোটি টাকার মাছ বিক্রি হবে।’
দর্শনার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত হচ্ছে বঙ্গভবন। এ লক্ষ্যে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মঙ্গলবার বিকেলে বঙ্গভবনে সংস্কারকৃত এয়ার রেইড শেল্টার ও তোষাখানা জাদুঘরের উদ্বোধনকালে এ কথা জানান।
এ সময় তিনি বলেন, ‘বঙ্গভবনের ভেতরে সাধারণ মানুষ আসতে পারে না। এটার ভেতরে কী আছে না আছে তারা জানতে পারে না।
‘বঙ্গভবনের তোশাখানা জাদুঘর শতাব্দীকালের বর্ণাঢ্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন। বঙ্গভবনের সমৃদ্ধ ইতিহাস সংরক্ষণ এবং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বঙ্গভবন তোশাখানা জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
আবদুল হামিদ বলেন, ‘বিদেশি রাষ্ট্রদূতসহ আগন্তুকরা পরিদর্শনকালে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে সক্ষম হবেন। বঙ্গভবনের অনেক স্থাপনা দেখে মোটামুটিভাবে তারাও আকৃষ্ট হবেন এবং আমাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মনোভাব অনেক উঁচু হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
বিকেলে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নবনির্মিত তোশাখানা জাদুঘরের উদ্বোধন শেষে বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখেন।
বঙ্গভবনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা এ তোশাখানাকে একটি আধুনিক মানসম্পন্ন জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে।
তোশাখানায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছ থেকে পাওয়া উপহার সামগ্রী এবং ঐতিহাসিক ছবি সংরক্ষিত রয়েছে।
দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য এটি সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত থাকবে। আবার বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে অনলাইনেও যে কেউ তোশাখানাটি যাতে পরিদর্শন করতে পারেন এবং বঙ্গভবন সম্পর্কে জানতে পারেন সে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এর আগে রাষ্ট্রপ্রধান সংস্কারকৃত এয়ার রেইড শেল্টার হাউজের উদ্বোধন করেন এবং বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করেন।
রাষ্ট্রপতির স্ত্রী রাশিদা খানম, সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মাদ তৌফিকসহ সংশ্লিষ্ট সচিবরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
যেভাবে বঙ্গভবন
মুক্ত আকাশ, জলাধার আর অবারিত সবুজের সমাহারে গড়ে ওঠা এই স্থাপত্যের গোড়াপত্তন ঘটে ১৯০৫ সালে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্ট পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন ঢাকার নবাব পরিবারের দিলকুশা বাগানবাড়ির দক্ষিণাংশে লেফটেন্যান্ট-গভর্নরের বাসস্থান হিসেবে অস্থায়ী লাটভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
গভর্নরের অফিস ও বসবাসের জন্য নির্মিত হয় একটি কাঠের প্রাসাদ। স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের প্রধান শাসনকর্তা হিসেবে ১৯০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত অস্থায়ী গভর্নমেন্ট হাউজে প্রবেশ করেন। মূলত এ দিন থেকেই বঙ্গভবনের যাত্রা শুরু। অচিরেই ভবনটি ‘দিলকুশা গভর্নমেন্ট হাউজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এটি পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রথম গভর্নর ছিলেন স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন। এ সময় ‘গভর্নমেন্ট হাউজ’-এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় ‘গভর্নর হাউজ’।
১৯৬১ সালের ৯ মে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ভবনটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ছাদের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে। ফলে তৎকালীন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আযম খান ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সংস্কারের পরিবর্তে একটি নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ওই বছরের জুন মাসে তৎকালীন গণপূর্ত বিভাগ (সিএন্ডবি) ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত কাজ শুরু করে এবং গভর্নর আযম খান ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে এটি উদ্বোধন করেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর দেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্য ২৩ ডিসেম্বর গভর্নর হাউজে মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভা করেন। সেই সভায় গভর্নর হাউজকে নতুনভাবে ‘বঙ্গভবন’ নামে নামকরণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তিত হলে তিনি ১২ জানুয়ারি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৮৫ সালে বেশ বড় পরিসরে বঙ্গভবন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও অলংকরণের কাজে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়। অভ্যন্তরীণ নান্দনিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে সংযোজন করা হয় দুর্লভ চিত্রকর্ম।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সময়ে ২০১৬ সালে নির্মাণ করা হয় অত্যাধুনিক সুইমিংপুল কমপ্লেক্স। আবদুল হামিদের অভিপ্রায় অনুযায়ী ২০২১-২২ সালে বঙ্গভবনে ব্যাপক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষ, হরিণ পুকুর, গ্যালারি হল, দরবার হল, ভিআইপি অপেক্ষাগার-১, এয়ার রেইড শেল্টার, কেবিনেট হল, বঙ্গভবন তোষাখানা যাদুঘর।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় গভর্নরের নিরাপত্তার জন্য একটি এয়ার রেইড শেল্টার নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর এয়ার রেইড শেল্টারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ায় এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে ২০২২ সালে এটি সংস্কার করে পুনরায় ১৯৬৫ সালের আদলে নিয়ে যাওয়া হয়।
বঙ্গভবনের প্রাচীন মানুক হাউসকে সংস্কারের মাধ্যমে ‘বঙ্গভবন তোশাখানা জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে বঙ্গভবনের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো প্রদর্শন করা হচ্ছে। ১৫০ বছরেরও অধিক পুরনো মানুক হাউস এর আগে রাষ্ট্রীয় তোশাখানা হিসেবে ব্যবহৃত হত। উনিশ শতকে মানুক নামের এক আর্মেনিয় ব্যবসায়ী এখানে বসবাস করতেন।
বর্তমানে তোশাখানার বেশ কিছু উপহার সামগ্রী সংরক্ষণ ও সর্বসাধারণের দেখার জন্যবঙ্গবন্ধু সামরিক যাদুঘরের পাশে রাষ্ট্রীয় তোশাখানা জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়েছে। মানুক হাউসকে তোশাখানা জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময় এর দেয়ালে ছোটো ছোটো ইট অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় পাওয়া যায়, যার কিছু অংশ কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সংরক্ষণ করা হয়েছে।
তোশাখানার পাশেই প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেট কার। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিরা গাড়িটি ব্যবহার করতেন। জার্মানির ট্রাস্কো ব্রেমেন কোম্পানি নির্মিত প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেট কারটি একটি অভিজাত এবং অতি-বিরল প্রসারিত লিমুজিন যা মূলত ডব্লিউ ১২৬ মার্সিডিজ-বেঞ্জ ৫০০ এসইএল মডেলের উপর ভিত্তি করে নির্মিত।
বঙ্গভবনের অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় সাধকের মাজার, দানা দীঘি, মাজার পুকুর, সিংহ পুকুর উল্লেখযোগ্য। সুদীর্ঘ ইতিহাস আর ইসলামি, ব্রিটিশ ও মোঘল স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠা এই ভবন তার স্থাপত্যশৈলীকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশের এক অনন্য প্রতীক। দেশের সর্বোচ্চ সুরক্ষিত এই ভবন সম্পর্কে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই।
বঙ্গভবনকে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত করার লক্ষ্যেই তোশাখানা ও এয়ার রেইড শেল্টার হাউজের আধুনিকায়ন এবং ওয়াকওয়ে নির্মানসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সিলেটের গোলাপগঞ্জে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন ‘দেওয়ানের পুল’ ভেঙে ফেলার কাজ বন্ধ হয়েছে। সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য সেতুটি ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করেছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
বুধবার পরিবেশকর্মীরা সরেজমিনে এলাকা পরিদর্শন করে সেতুটি রক্ষার দাবি জানান। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাঙার কাজ আপাতত বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে এলজিইডি।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে সিলেটের তৎকালীন দেওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা) গোলাম রায়ের নির্দেশে গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ এলাকার শ্রীচৈতন্য দেবের বাড়ির পথে একটি সড়ক নির্মাণ করা হয়।
ওই সময় বাউশা এলাকার দেওরভাগা খালে এই সেতু নির্মাণ করা হয়। যা ‘দেওয়ানের পুল’ নামে পরিচিতি পায়।
উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি পুরোনো এই সেতুটির দৈর্ঘ্য ২০ ফুট এবং প্রস্থ ১৬ ফুট। সম্প্রতি সড়ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ কারণে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে একই জায়গায় এখন ৯৯ ফুট দীর্ঘ ও ৩২ ফুট প্রস্থ সেতু নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়।
এ কারণে পুরোনো সেতুটি ভাঙার কাজ শুরু করে এলজিইডি। তিন দিন ধরে বুলডোজার দিয়ে সেতুটি ভাঙার কাজ চলে।
সেতু ভাঙার খবর পেয়ে বুধবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের নেতারা। এ সময় তারা স্থাপনাটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে ভেঙে ফেলা অংশ দ্রুত সংস্কারের দাবি জানান।
এ বিষয়ে বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম বলেন, ‘উন্নয়নের নামে সবখানে ঐতিহ্য ধ্বংসের কার্যক্রম চলছে। সরকারি উদ্যোগে এমন কাজ করা হচ্ছে। যা খুবই দুঃখজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত সেতুর ভেঙে ফেলা অংশ সংস্কার করে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আমরা সেতুটি রক্ষার দাবি জানিয়েছি।’
এদিকে বাপা নেতাদের আহ্বান বুধবার দুপুর থেকে সেতু ভাঙার কাজ আপাতত স্থগিত রেখেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
এমন তথ্য জানিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘ইতোমধ্যে সেতুর বেশ খানিকটা অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে যেহেতু সবাই সেতু রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন, তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আপাতত ভাঙার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’ পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
সেতুটি চুন-সুরকি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য উপযোগী না। তাই নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
এই প্রকৌশলী আরও জানান, সেতুর অবস্থান শতভাগ সোজা রাস্তায়। তাই বাঁকা করে বিকল্প সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই। এমনকি সেতুর তিনটি স্প্যান (পিলার) এমনভাবে আছে, যা দিয়ে সহজে বড় নৌকাও চলাচল করতে পারে না।
আরও পড়ুন:মাঝখানে দোহারি, বাদক দল, তারপর গোলাকার ফাঁকা জায়গা। এর চারপাশে দাঁড়িয়ে ও বসা হাজারও দর্শক। ফাঁকা জায়গায় নেচে নেচে গান বয়াতি। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে অভিনয়ও।
আমন ধান ঘরে তোলার পর একসময় সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলার পাড়া-মহল্লায় প্রতিনিয়তই বসতো জারি গানের আসর। যেখানে কখনও ঐতিহাসিক কল্পকাহিনি আবার কখনও সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হতো। খোলামঞ্চে সেই সঙ্গে চলত নাটক ও গান। এসব গান-বাজনা শুনে আনন্দ পেত গ্রাম বাংলার মানুষ। কিন্তু ইউটিউব ও আধুনিক যুগের বিভিন্ন মিডিয়ার কারণে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জারি গান প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
শেরপুর পৌরসভার মোবারকপুর মহল্লায় শুক্রবার রাতে বসে এমনই এক জারি গানের আসর। উপস্থিত দর্শকরা জানান, তাদের ভালো লাগার কথা। আর এই আসরকে কেন্দ্র করে উপস্থিত হয় হাজারও নারী-পুরুষ ও শিশু।
শেরপুর পৌর শহরের আখের বাজার মহল্লার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগে রাত জেগে জারি গান আমরা খুব দেখতাম। এখন এইগুলা খুব একটা দেখা যায় না। শীত এলে বিভিন্ন জায়গায় জারি গানের আসর হইত। এইগুলা দিন দিন হারাই যাইতাছে। আমাদের উচিত জারি গানকে বাঁচায় রাখা। ইউটিউব ও ফেসবুকের কারণে গ্রাম বাংলার এই গান হারাই যাচ্ছে।’
মোবারকপুরের যুবক রাসেল মিয়া বলেন, ‘মনের খোরাক প্রাচীন এই জারির আসর। এখন জারির আসর হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা বাপ-দাদাদের কাছে শুধু শুনি। কিন্তু এখন দেখতে পাই না।’
এই সংস্কৃতি চালু রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি।
চরশেরপুর ইউনিয়নের মো. মালেক মিয়া বলেন, ‘আমরা আগে বাপ-পোলা মিইল্লা মেলা দূরে যাইয়া জারি দেখতাম। এহন আর হয় না সবখানো। অনেক মজা কইরা দেখতাম। মোবাইল আইয়া সব ওইঠা পড়তাছে।’
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার পশ্চিম টাঙ্গারপাড়া এলাকার বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে ‘দুই বিয়ে করার কুফল’ সম্পর্কে শেরপুরের পৌর এলাকায় এই জারির আসর বসে। শ্রীবরদীর ভেলুয়ার জিরাতন সুন্দরী নামক জারি গানের দলের অভিনেতা ও কর্মকর্তারা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জারি গান ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে জারি গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। দর্শকরাও সাড়া দিচ্ছে বেশ ভালো। জারি গানের শিল্পীরা চান তাদের দল ধরে রাখতে সরকারি সহায়তা।
শিল্পীদের অভিযোগ, আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় শীতের সময়েও আগের মতো হচ্ছে না জারির আসর। জারি গানের মাধ্যমে সামাজিক নানা বিষয়ে তারা জনগণকে সচেতন করেন। এখন জারি গানের আসর কমে যাওয়ায় সমাজে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা।
ভেলুয়া থেকে আসা জারি শিল্পী শামীম মিয়া বলেন, ‘আমরা আগে শীতের সময় সিরিয়াল দিবার পাইতাম না। প্রতিদিন কাজ থাকত। কিন্তু এখন আর আগের মতো কাজ নাই। আমরা এখন অবসর সময় কাটাই। আমাদের একটা জারি গানের আসরে অনেক খরচ হয়। সরকার একটু সাহায্য করলে আমরা এই জারিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম।’
৩০ বছর থেকে ভেলুয়ার ইয়াদ আলী জারি গান করেন। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্ন জায়গায় ৩০ বছরে অনেক জারির আসর করেছি। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে আসর কমে গেছে। মানুষ এখন ফেসবুক ও ইউটিউবের ফলে এইগুলার আয়োজন কম করে। এখনকার ছেলেপেলেরা জারি গানের আসর সম্পর্কে জানেই না। আমরা সরকারিভাবেও কোনো সহযোগিতা পাই না। সরকারিভাবে যদি এই জারির আসর করা হতো, তাহলে আমাদের কদর থাকত।’
শেরপুর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জারি গানের আসরের আয়োজক মো. বাবুল মিয়া বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই জারির আসর নতুন প্রজন্মের কাছে এখন দুর্লভ। আগে আয়োজন হতো বেশি, এখন কম হয়। তাই এলাকার সচেতন যুবসমাজ ও স্থানীয়দের নিয়ে হারিয়ে যাওয়া জারির আসর পুনরায় ফিরিয়ে আনতে প্রতি বছর এ আয়োজন করা হবে।
উঠানে দাগ দেয়া বৃত্তের মাঝে মুখোমুখি দুটি বিশাল আকৃতির মোরগ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের ইশারা পেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু করে লড়াই। একটি অন্যটিকে পরাস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। বিরতির পর একটি মোরগের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত দেখা গেছে। এটির মালিক পানি ছিটিয়ে বিশ্রাম দিয়ে আবার এটিকে লড়াইয়ের ময়দানে পাঠায়।
কিছুক্ষণ যুদ্ধ শেষে ক্লান্ত হয়ে একটি বসে পড়ে। অন্যটি হয়ে যায় চ্যাম্পিয়ন; নাম বাদশা।
মোরগের এই লড়াই দেখা গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মুহাম্মদ স্টেডিয়ামে। সেখানে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের পর অনুষ্ঠিত হয় গ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই খেলা।
জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলমে এই মোরগ লড়াইয়ের আয়োজক।
লড়াইয়ে আরও ৩টি দল অংশ নেয়। প্রতিটি থেকেই একটি করে মোরগ জয় পায়।
লড়াইয়ে নিজের মোরগ নিয়ে অংশগ্রহণকারী আলমগীর মিয়া জানান, ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্টের মতো মোরগ লড়াইয়ের জন্য একটি কোর্ট বানানো হয় মাটিতে দাগ টেনে। এর দুপাশে নিজ নিজ মোরগ নিয়ে অবস্থান নেয় দুজন।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৭টি লড়াই অনুষ্ঠিত হয়। উভয় দল কমপক্ষে ৯টি যোদ্ধা মোরগকে প্রস্তুত রাখে। ৭টি ম্যাচের জন্য ৭টি এবং আহত মোরগের বদলী যোদ্ধা হিসাবে আরও দুটি মোরগ রাখা হয়।
বিজয় দিবসের এই লড়াইয়ে ভাদুঘর গ্রামের আব্দুল লতিফের মোরগ ‘যুবরাজের’ সঙ্গে ফাইনালে লড়ে জয়ী হয় আলমগীরের মোরগ ‘বাদশা’।
ভাদুঘরের আব্দুল লতিফ বলেন, ‘আমার মোরগটি যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছে। তবে শেষ দিকে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবে খেলাটা শখের হওয়াতে আমরাও বেশ উপভোগ করি।’
মোড়গ লড়াই দেখতে আসা মুসলিমা বেগম বলেন, ‘গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা এই মোরগ লড়াই। দীর্ঘদিন পর মোরগ লড়াই উপভোগ করতে পেরে খুবই ভালো লেগেছে। আমার ছোট্ট মেয়ে নাভাও লড়াই দেখে খুব খুশি হয়েছে।’
মোরগ লড়াইয়ের আয়োজক জেলা প্রশাসক শাহগীর বলেন, ‘ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ও দর্শনার্থীদের আনন্দ দিতে আমাদের এই প্রচেষ্টা। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীদের ক্রেস্ট ও ১ হাজার টাকা করে সম্মানী দেয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন:দেশের ৪০ জেলায় গণহত্যা জাদুঘর স্থাপনের জন্য জরিপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।
খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটরিয়ামে শনিবার দুপুরে ‘বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ গণহত্যা: পরিণাম, প্রতিরোধ ও ন্যায়বিচার’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনীতে সচিব এ কথা বলেন।
সংস্কৃতিসচিব বলেন, ‘অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতা আমাদের অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪০ জেলায় গণহত্যা জাদুঘর স্থাপনের জন্য জরিপ করা হয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোরসহ আরও কয়েকটি জেলায় গণহত্যা স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণহত্যা, বধ্যভূমি ও নির্যাতনের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং এ-সংক্রান্ত সংগ্রহশালা তৈরি আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবাই জানতে পারবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন নারকীয় গণহত্যার স্মৃতি যেন মুছে না যায়, সে জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্বাধীনতার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অধ্যাপক কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. স্মৃতি এস পাটনায়েক, ড. শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, ড. চৌধুরী শহীদ কাদের।
গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র এবং ইতিহাস সম্মিলনী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে।
আরও পড়ুন:শব্দের কী শক্তি! একটা মাত্র শব্দ মানুষকে সুখী করে দিতে পারে। পারে দুঃখ দিতেও। প্রেমিকা যখন ‘উম্মম’ বলে সাড়া দেয়, প্রেমিকের আকাশে জ্বলে ওঠে আলো, পুবে-পশ্চিমে। আবার যখন নৈঃশব্দের আড়ালে সে নিজেকে লুকায়, প্রেমিকের গগন থেকে মধ্যাহ্নেই ডুবে যায় সূর্য।
শব্দের কত জাদু! এই যেমন ‘দ্রাক্ষা’র সঙ্গে বাগান মেলে না। দ্রাক্ষার সঙ্গে কুঞ্জ মিলে হয়ে ওঠে ‘দ্রাক্ষাকুঞ্জ’। আবার দ্রাক্ষা না হয়ে যদি কেবল আঙুর হয়, তাহলে হতে হয় ‘আঙুরবাগান’। ‘গলিত’ শুনলেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে, কিন্তু কেউ ‘বিগলিত’ হলে মন খুশি হয়।
এই যে ব্রহ্মাণ্ড, যাকে নিখিল ভুবন বা প্লানেট আর্থ যা-ই বলি, এখানে প্রথম এসেছিল শব্দ, তারপর আলো। ‘কুন’ শব্দ দিয়ে জন্ম হলো দুনিয়া। কুন মানে ‘হও’, ফা ইয়াকুন মানে ‘হলো’ …be and it is.
পদার্থবিদ্যার আদিতেও সেই শব্দ, the big bang, অতঃপর বিপুল নিনাদে বহুধা বিভাজিত হলো জগতের তাবৎ উপকরণ। উপনিষদ বলছে শব্দই ব্রহ্ম, ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ ‘আমিই ব্রহ্ম’ … I am the supreme being.
উপনিষদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যেন মিলে যায় মনসুর হাল্লাজের ‘আইন্যাল হক’! ওদিকে ‘ওঁ’ ধ্বনিতে হলো পরম শিবের প্রথম প্রকাশ; আদি ধ্বনি ‘ওঙ্কার’ সব ধ্বনির মূল, আদি মন্ত্রবীজ- সেও এক মানসিক তরঙ্গ।
আমরা কিন্তু সব শব্দ শুনি না। যেসব শব্দ আমাদের কানে আসে অর্থাৎ যা আমরা শুনতে পাই, তা নিশ্চয় কোথাও ধ্বনিত হয়। নিশ্চয় কোনো একটা আঘাত বা স্পন্দন থেকে তার উদ্ভব হয়। আঘাত থেকে উদ্ভব বলে এদের নাম ‘আহত শব্দ’।
অন্যদিকে যে শব্দ আমরা শুনি না, কোনো দৃশ্যমান আঘাত থেকে যার উদ্ভব হয়নি, হয়েছে অন্তরস্থ প্রজ্ঞা থেকে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব’এর মতো, যা সাধনা করে শুনতে হয়, সেই সব শব্দের নাম ‘অনাহত শব্দ’। কোনো এক বায়ুহীন অন্তরীক্ষে পৌঁছাতে পারলেই কেবল তা শুনতে পাওয়া যায়।
কেবল তান্ত্রিক সাধনা নয়; সত্যিকার প্রেমে পড়লেও অনাহত শব্দ শোনা যায়। যে প্রেমে কোনো আবরণ নেই, যে মগ্ন মুহূর্তে জীব বা জগতের আর কিছু টের পাওয়া যায় না, তখন অনাহত শব্দেরা অন্তরে রসক্রীড়া করে। যেমন প্রেমিকার অন্তর যখন বলে ‘কই তুমি?’ প্রেমিক তা স্পষ্ট শুনতে পায়।
আবার সে যখন ডাকে না মোটেই, সেই সাউন্ড অব সাইলেন্সও প্রেমিকের কানে বিষাদ বেদনা বাজায় (কৌশিক গাঙ্গুলির ‘শব্দ’ সিনেমায় এর সামান্য ইঙ্গিত আছে)।
কোনো বিশেষ সাংস্কৃতিক বা সামাজিক কারণে কিছু কিছু শব্দের প্রতি কারও অহেতুক অনুরাগ বা বিরাগ থাকতে পারে। ব্যক্তি ও সমাজ ভেদে একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে। শব্দটা শোনা, দেখা, পড়া বা ভাবামাত্রই মনে একটা নিজস্ব অর্থ বা দৃশ্য ভেসে ওঠে। আমরা সহ্য করতে পারি না। ওই নিরীহ শব্দটাই তখন যেন প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এমন প্রথাবদ্ধ শব্দপ্রেম বা শব্দঘৃণা অহরহ দেখা যায়।
আমাদের মনে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘটনাটি। একজন ভর্তিচ্ছু ছাত্রের টি-শার্টে ‘Fuck the System’ লেখা দেখে একজন শিক্ষক কেমন রেগে গিয়ে ছাত্রটিকে শার্ট খুলে উল্টো করে পরতে বাধ্য করেছিলেন এবং নিজের ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এই নির্মল ক্যাম্পাসে এই ধরনের অসভ্যতা কখনও মেনে নেয়া যায় না।’
‘ফাক’ শব্দটা দেখার পর এখানে শিক্ষকটির মনে যা ভেসে উঠেছে তা তার বিবেচনায় নিশ্চয় অশ্লীল, তিনি মনে করেছেন সামান্য এই শব্দটি হয়তো তার বা তার প্রতিষ্ঠানের কৌলিন্য হরণে সক্ষম, তিনি শব্দটি ঢেকে দিয়েছেন।
অথচ ‘ফাক’ শব্দের এমন অর্থও হতে পারে যা কেবল দুটি প্রত্যঙ্গ সংশ্লিষ্ট নয়, যা ‘মানি না’, বা ‘বদলাতে চাই’ বা ‘বস্তাপচা’ ইত্যাদি নানা অর্থ বহন করতে পারে। যেমন কবি এলেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন, ‘America when will we end the human war? Go fuck yourself with your atom bomb’. তিনি নিশ্চয় এটম বম্ব কোথাও ‘ঢোকানো’ বোঝাননি।
‘সতী’ শব্দটি বাঙালির নিজস্ব। এটা নারীর একটা বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারণাকে ইঙ্গিত করে। মজার ব্যাপার, বাংলা ভাষায় এই শব্দের বিপরীতার্থক পুরুষলিঙ্গবাচক কোনো শব্দ নেই।
কেউ হয়তো বলবেন ‘সৎ’, কিন্তু তখন প্রশ্ন করাই চলে, নারী কি সৎ হতে পারেন না? যে অর্থে নারী ‘সতী’ সেই অর্থে পুরুষের জন্যে কোনো শব্দ নেই। যে অর্থে নারী ‘অসতী’ সে অর্থে একজন পুরুষ কী?
‘বেশ্যা’ বলতে আমরা শাব্দিকভাবে ‘অর্থের বা অন্যবিধ প্রাপ্তির বিনিময়ে যৌনসংগমে সম্মত’ নারী বুঝলেও সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিকভাবে যা বুঝি তার সঙ্গে অপমান, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য জড়িয়ে আছে।
তাই শব্দ ব্যবহারে বিদ্বজ্জনেরা সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কারণ শব্দ কেবল বাক্যস্থ পদ নয়, একটি বার্তা, একটি শক্তি এবং কখনও শব্দ একটি অটোসাজেশনও।
শব্দের একাধিক অর্থ, ব্যাপ্তি ও ব্যঞ্জনা থাকে। শাব্দিক অর্থের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অর্থ বা প্রেক্ষাপটও শব্দের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতির দুজন মানুষ একই শব্দের দুই রকম অর্থ বুঝতে পারেন। আবার কোনো কোনো শব্দ একেবারেই একটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীর নিজস্ব ধারণা ছাড়া আর কিছু বহন করে না- যেমন অভিমান, যেমন ভাত, যেমন নদী।
ভাতের সঙ্গে বাঙালির আত্মার সম্পর্ক। যে ‘স্বামী’কে দেবতা বলা হতো, সেই স্বামীকে ‘ভাতার’ও বলা হতো। ভাত দিত, তাই সে ভাতার। ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’ বলে মুখ ঝামটা দিয়েছেন নারীরা। অভিমান করে কেউ কেউ এখনও স্বামীদের বলেন, ‘তোমার ভাত আর খাবো না।’ মানে তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।
এক ফসলি জমি ছিল। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ছিল প্রচণ্ড অভাব। দিনের পর দিন ভাত থাকত না। ভাতের হাঁড়িতে কেবল কাঁঠাল সেদ্ধ খেতে দেখেছি। ভিখারিদের ভাত চাওয়ার সাহস ছিল না। ক্ষীণ কণ্ঠে ‘একটু ফ্যান দ্যাও গো’ বলে দুয়ারে দাঁড়াত। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ বা হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’তে এই ভাত-ফ্যান-দুঃখ-বেদনার গল্প আছে। সত্যি গল্প।
সেই দেশে কৃষিতে অনেক উন্নতি হয়েছে। কৃষিবিদরা ইরি, বিরি ধান আবিষ্কার করেছেন আর কৃষক মাটির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সেই ধান চাষ করেছেন। এবং সেই ভরসায় এ দেশের রাজনৈতিক নেতারা কম দামে ভাত খাওয়াবেন বলে ভোট নিয়েছেন।
তাই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে, আমাদের কাছে বলগ ওঠা ভাতের হাঁড়ির গুড়গুড় শব্দ মালহারের চেয়েও মধুর, ভাপ ওঠা গরম ভাতের গন্ধ শ্যানেল পারফিউমের চেয়েও সুগন্ধি।
থালাভরা শিউলিফুল ভাতের সঙ্গে সামান্য তরকারি আর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাবার ব্যবস্থা করে দিলেই যে বাঙালিকে অনায়াসে শাসন করা যায়। তাই বাঙালির কাছে ‘ভাত’ একটা মাটিগন্ধি হৃদয়ঘটিত ব্যাপার, ‘রাইস’ এর সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র মিল নেই। অভিমান, নদী ইত্যাদি আমাদের এমন অনেক নিজস্ব শব্দেরও নিজস্ব অর্থ আছে যা অন্য কারও সঙ্গে মিলবে না।
ভাষাকে উন্নত করা যায়। ভাষায় প্রতিদিন যোগ-বিয়োগ ঘটে। নতুন শব্দ যুক্ত হয়, পুরোনো শব্দ হারিয়ে যায়। যেমন ‘মহকুমা’ হারিয়ে গেছে।
এই নিরন্তর পরিবর্তনের যাত্রাপথে আমাদের দায়িত্ব হলো, কারও জন্য অবমাননাকর ও বৈষম্যসৃষ্টিকারী শব্দ (যেমন বেশ্যা, মহিলা, মুচি, মেথর ইত্যাদি) পরিহার করা। আর যে শব্দের সঙ্গে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস আর মায়ার বাঁধন আছে, তা বেশি ব্যবহার করা। তবে এ-ও সত্যি সময়ের পরিবর্তনে প্রয়োগের স্থান সংকুচিত হয়ে এলে আমাদের ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের অনেক শব্দ হারিয়ে যাবে।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী
আরও পড়ুন:
মন্তব্য