‘হ্যালো, ব্র্যাক ব্যাংক বিটিআরসির বিকাশ অফিস থেকে তরিকুল বলছিলাম। আপনি অ্যাকাউন্ট হোল্ডার গ্রাহক সেলিম হায়দার (ছদ্মনাম) বলছেন? আপনি বর্তমান যে বিকাশ অ্যাকাউন্টটা ব্যবহার করছেন তার লেনদেন অপশনটা আমাদের অফিস থেকে সাময়িক সময়ের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ মুর্হূতে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো ধরনের লেনদেন করতে পারবেন না। আপনার অ্যাকাউন্টে যে জমানো টাকা আছে তা উত্তোলন বা বের করতে পারবেন না।’
এভাবে বিকাশ অ্যাকাউন্ট ‘সাসপেন্ড’ হওয়ার এবং জমানো টাকা আর তুলতে না পারার ভয় দেখিয়ে এক গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল ০১৮৪২-৬৪১২৮৮ থেকে ফোন করে। পুলিশ বলছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা থেকে এই ফোনটি করা হয়েছিল। এই প্রতারক চক্রের অনেকেই রয়েছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলায়।
তরিকুল হিসেবে পরিচয় দেয়া এই ব্যক্তি প্রতারণা করার জন্য ওই গ্রাহককে ‘সন্দেহমুক্ত রাখতে’ আরও নানা ধরনের কথা বলেন। যেমন, ‘বিকাশ কোম্পানি কখনও গ্রাহকের কাছ থেকে গোপন পিন জানতে চাইবে না, বিকাশের নামে নানা ধরনের প্রতারণা হচ্ছে, তাতে তিনি যেন পা না দেন।
এ ধরনের কথা বলার কারণ যাতে ওই গ্রাহক মনে করেন, বিকাশ থেকেই তাকে ফোন দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে আরও যেসব কথোপকথন হয় সেগুলো হুবহু তুলে ধরা হলো-
গ্রাহক: কেন হলো এমন?
তরিকুল: বাংলাদেশে যে ব্যক্তিগত সাড়ে তিন কোটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট রয়েছে তাদের মালিকানাধীন তথ্য জাস্টিফাই করে ২০৩০ সাল অব্দি পুনরায় চালু করা হচ্ছে। যারা সঠিক মালিক, সঠিক হোল্ডার, সঠিক তথ্য দিচ্ছে তাদের অ্যাকাউন্ট কোম্পানি চালু করে দিচ্ছে। আর যারা তথ্য দিচ্ছে না তাদের অ্যাকাউন্টটা ডুপ্লিকেট মালিক হিসেবে কোম্পানি বন্ধ রাখছে। এসব অ্যাকাউন্টে যে টাকা থাকছে সেগুলো সরকারি ফান্ডে জমা রাখা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনার মূল্যবান মতামত উইদাউট স্টেটমেন্টে জানার জন্য কল করা হয়েছে। আপনার যে অ্যাকাউন্টটা বন্ধ রাখা হয়েছে সেটা বন্ধ থাকবে, নাকি সঠিক তথ্য সরবরাহ করে অ্যাকাউন্টটা একটিভ রাখতে চাচ্ছেন?
গ্রাহক: কী ধরনের তথ্য সেটার ওপর নির্ভর করছে...
তরিকুল: আচ্ছা, তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে আমি আপনাকে বলি। বিকাশ কোম্পানি কখনও গ্রাহকের কাছ থেকে গোপন পিন জানতে চাইবে না, অর্থাৎ যে পিন দিয়ে টাকা লেনদেন বা উত্তোলন হয় সেটা বিকাশ জানতে চায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত বিকাশ শিওর না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো তথ্য দেয়া যাবে না কাউকে। কারণ বিকাশের নামে নানা ধরনের প্রতারণা হয়ে আসছে।
এই অ্যাকাউন্ট খুলতে যে আইডি কার্ড ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ব্যক্তি কি আপনি?
গ্রাহক: জ্বী, হ্যাঁ।
তরিকুল: আচ্ছা, আপনার অ্যাকাউন্টটা কি আপনার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হচ্ছে, নাকি কোনো ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার হচ্ছে?
গ্রাহক: ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হচ্ছে।
তরিকুল: স্যার ধন্যবাদ, আপনার তথ্যটা সঠিক হয়েছে। যেহেতু পারসনাল কাজে অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করছেন, সেহেতু আপনার এই অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন বা ট্রান্সজেকশন কি আপনি নিজে করছেন?
গ্রাহক: জ্বী হ্যাঁ। আমি নিজে করছি।
তরিকুল: যেহেতু লেনদেন আপনি নিজে করছেন, সেক্ষেত্রে আপনার অ্যাকাউন্টের লেনদেন ভিত্তিক মালিকানাধীন তথ্যটা জাস্টিফাই করার ক্ষেত্রে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে সবশেষ যেসব ম্যাসেজ আছে সেখান থেকে একটা তথ্য বলবেন আমাকে। সর্বশেষ কী লেনদেন করা হয়েছে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে। সেটা হলো আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে সবশেষ টাকা জমা করা হয়েছে, নাকি বের করা হয়েছে?
গ্রাহক: এটা আমার খেয়াল আসছে না...কারণ আমি বিকাশ নিয়মিত ব্যবহার করি না।
তরিকুল: তাহলে কি আপনার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে না?
গ্রাহক: না না, করতাম আগে। সবশেষ রোজার ঈদের আগে লেনদেন হয়।
তরিকুল: আচ্ছা। সেবার কি টাকা বের করেছিলেন, না জমা করেছিলেন?
গ্রাহক: সম্ভবত বের করা হইছিল।
তরিকুল: কত টাকার মতো বের করেছিলেন?
গ্রাহক: দেড় হাজারের মতো।
তরিকুল: আপনার অ্যাকাউন্টটা এখন বন্ধ আছে। আপনার কত টাকা জমা রেখে কোম্পানি অ্যাকাউন্টটা বন্ধ রেখেছে, এটা জানা আছে? এই যে তথ্যটা দেবেন, সেটা জাস্টিফাই করে আপনার টাকাটাসহ অ্যাকাউন্টটা চালু রাখার চেষ্টা করব। আর যদি টাকার অ্যামাউন্ট না বলতে পাবেন, তাহলে জিরো ব্যালান্সে চালু হবে। আপনি কি অ্যামাউন্টটা বলতে পারবেন?
গ্রাহক: সম্ভবত এক হাজার টাকা থাকতে পারে ব্যালেন্স।
তরিকুল: এই মুর্হূতে বিকাশ থেকে আপনার সিরিয়াল নম্বরটা পাঠিয়ে দেয়া হলে, আপনি যে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন, কথা বলা অবস্থায় কি আপনি এসএমএসটা দেখতে পারবেন, নাকি লাইন কেটে দিয়ে দেখে জানাতে পারবেন?
গ্রাহক: না না। আমি দেখতে পারব।
তরিকুল: আপনি যে ফোন দিয়ে কথা বলছেন, সেটা কি নরমাল ফোন নাকি স্মার্ট ফোন?
গ্রাহক: স্মার্ট ফোন থেকে কথা বলছি।
তরিকুল: তাহলে তো কথা বলা অবস্থায় মেসেজ দেখতে পাবেন। আমি লাইনে আছি। আপনি আপনার মেসেজ ইনবক্সে ঢুকে দেখেন, বিকাশ থেকে একটা মেসেজ গিয়েছে। মেসেজটির ভেতরে দুই থেকে তিন লাইন নিচে ৬ সংখ্যার একটা সিরিয়াল নম্বর আছে, এই সিরিয়াল নম্বরটি হলো বাংলাদেশ থেকে কত তম সিরিয়ালে আপনি অ্যাকাউন্টটি চালু করছেন সেটা। নম্বরটি আমাদের বলে সিরিয়ালটি চালু করে নেন স্যার। একটু কষ্ট করে ইনবক্সে যান, দেখেন বিকাশ থেকে কোনো মেসেজ পাইছেন?
গ্রাহক: না। বিকাশ থেকে কোনো মেসেজ আসেনি।
তরিকুল: আপনি ইনবক্সে গিয়েছেন?
গ্রাহক: হ্যাঁ, আমি ইনবক্সেই আছি।
তরিকুল: আচ্ছা আপনি ইনবক্সেই থাকেন। আমি চেক করে মেসেজটা এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছে। পেয়েছেন?
গ্রাহক: হ্যাঁ পেয়েছি।
তরিকুল: দেখেন মেসেজটির দুই থেকে তিন লাইন নিচে একটা ৬ সংখ্যার ওটিপি নম্বর আছে, সেটা বলেন। এটা বললে বাংলাদেশ থেকে এই সিরিয়ালে আপনার অ্যাকাউন্টটি চালু হয়ে যাবে। আচ্ছা, এটা কিন্তু ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে দিতে হবে, তা না হলে সিরিয়াল আবার পরিবর্তন হয়ে যাবে।
গ্রাহক: ওটিপি নম্বর দেয়াটা আমি সেইফ মনে করছি না।’
তরিকুল: এটা কিন্তু বিকাশ অফিস থেকে মেসেজ দিয়েছে, আপনি মনে রাখবেন। বিকাশ কোম্পানি কিন্তু আপনাক সিক্রেট নিরাপত্তা দিচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বিকাশে প্রতিনিয়ত প্রতারণা হচ্ছে। আর এসব প্রতারণা এড়াতে কোম্পানিটি পদক্ষেপ নিচ্ছে।
গ্রাহক: সে যাই হোক, আপনি বললেন যে বিকাশ থেকে এসএমএস আসবে। কিন্তু আমার বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে ওটিপি আসল কেন? আমি তো টাকা পেমেন্টের জন্য কোনো কিছু করি নাই। তাহলে ওটিপি কেন আসল? ওটিপি তো কোনো সিরিয়াল নম্বর না। আপনি ভুল বোঝাচ্ছেন। ওটিপি হলো ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড। এটা তো আমি কাউকে দিব না। বিকাশ অ্যাপেই কিন্তু বড় করে লেখা আছে যে ওটিপি আপনি কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না। এমনকি বিকাশের সঙ্গেও না।
তরিকুল: আচ্ছা আমরা যদি বিকাশ না হবো, তাহলে আপনাকে মেসেজ দিলাম কীভাবে? আপনি কি কাউকে এমন মেসেজ দিতে পারবেন?
গ্রাহক: না না। এটা পারব না। আমি এটাই চিন্তা করছি যে, আপনি এই মেসেজ পাঠালেন কীভাবে?
তরিকুল: আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে? আপনি কি বিকাশ কোম্পানিকে ডাউট করছেন?
গ্রাহক: হ্যাঁ, হচ্ছে। আমার যদি কনফিউশন লাগে তাহলে আপনি কেন, বিকাশের যে কান্ট্রি ডিরেক্টর আছেন তাকেও আমি সন্দেহ করব। আপনি আপনার আইডেনটিটি দেন।
তরিকুল: আচ্ছা ঠিকাছে স্যার আপনি যেহেতু ডাউট ফিল করছেন সেহেতু আপনি যখন মনে করেন তখন আপনার অ্যাকাউন্টটি চালু কইরেন। আপনার আমাকে কিছুই দিতে হবে না।
গ্রাহক: আপনি ভুয়াবাজি করতেছেন। আপনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কানেক্ট করে দেই আপনার নম্বরটা।
এ কথা শোনার পররপরই সংযোগ কেটে দেন তরিকুল হিসেবে পরিচয় দেয়া প্রতারক।
বিকাশের এই গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতারকের ফোন নম্বর পেয়ে পুলিশের সাহায্য নেয় নিউজবাংলা। এরপর জানা যায়, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়ন থেকে ফোনটি করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলা থেকেই এ প্রতারণামূলক ফোন বেশি করা হয়। এর বাইরে যেসব প্রতারণার ঘটনা ঘটে সেগুলোর সঙ্গেও এদের যোগসূত্র পাওয়া যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের তথ্য বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণা শিকার হওয়ার অভিযোগে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ১২০টি মামলা হয়েছে।
এই মামলাগুলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৩০ ধারায় হয়েছে। এই ধারায় অনুমতি ছাড়া ই-ট্রানজেকশনের ঘটনার প্রতিকারের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এ ধরনের অপরাধের অধিকাংশই মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা সংশ্লিষ্ট। ২০২০ সালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার অভিযোগে সারাদেশে মামলা হয় ৪১২টি।
ডিএমপির সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া ই-ট্রানজেকশনের যত ঘটনা ঘটে তার মধ্যে অল্প সংখ্যক ভুক্তভোগীই মামলা করেন। অনেকে ঝামেলা এড়াতে সাধারণ ডায়েরিও করেন না। সম্ভবত কম টাকা খোয়া যাওয়ার কারণে কিংবা অজ্ঞতার কারণে অথবা আইনি জটিলতা এড়াতে অনেকে মামলা বা অভিযোগের দিকে যান না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিকাশের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা শামসুল হায়দার ডালিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা বিকাশ প্রতারণার মূল ধরন। কথার প্যাঁচে মূলত এরা গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে। আমরা সারা বছর সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছি যে, এ ধরনের কোনো প্রতারণামূলক কথা বা গোপন পিন বা অন্য তথ্য চাইলে শুনবেনই না। ফোন কেটে দেবেন।
‘তারপরও অনেক গ্রাহক প্রতারকদের ফাঁদে পা দিচ্ছে। বিকাশ বিভিন্ন প্রচারে কিন্তু বলছে, বিকাশ কারও কাছে ফোন দিয়ে কোনো তথ্য চায় না। তারপরও অনেকে প্রতারকের কথার প্যাঁচে পড়ে তথ্য দিয়ে দেয়। অনেকে প্রতারণার বিষয়টি ধরে ফেলেন, আবার অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এক্ষেত্রে আমরা বলব, কেউ ফোন দিলে কোনো গ্রাহক যেন তথ্য না দেয়।’
প্রতারক চক্র গ্রাহকের কাছে বিকাশের মতোই হুবহু এসএমএস কী করে পাঠায়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে যে কেউ মেসেজ পাঠাতে পারে। কেননা একটা ভিন্ন ডিভাইসে বিকাশ অ্যাপ ডাউনলোড করে সেখানে কোনো গ্রাহকের নম্বর দিয়ে ঢুকতে গেলে ওই নম্বরেই একটা এসএমএস আসে। সেখানে ওটিপি নম্বর থাকে। ওই ওটিপি নম্বর দেয়ার কারণ হলো, গ্রাহক নিজেই অন্য ডিভাইসে তার অ্যাকাউন্টে ঢুকতে চাইলে সে কিনা তা অ্যাশিউর হওয়া। ওটিপি নম্বর কনফার্ম করার পর ওই অ্যাকাউন্ট নম্বরেই গোপন পিনের মেসেজ আসে।’
শামসুল হায়দার ডালিম বলেন, ‘এক্ষেত্রে প্রতারকরা গ্রাহকের নম্বর জোগাড় করে প্রথমে গ্রাহক থেকে কৌশলে ওটিপি নম্বর নেয়ার চেষ্টা করে। তারপর গোপন পিন নিতে পারলেই গ্রাহক প্রতারণার শিকার হয়। কিন্তু বিকাশ কর্তৃপক্ষ বারবার বলে যে বিকাশ থেকে ফোন দিয়ে কখনও কোনো গ্রাহকের তথ্য চাওয়া হয় না।’
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারকরা বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে। বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্পুফ কল করে। যেমন বিকাশের ২৪৭ নম্বর দিয়ে গ্রাহকদের ফোন কল করে কখনও বিকাশ অ্যাকাউন্ট আপডেট করার কথা বলে ওটিপি ও পিন নম্বর নিয়ে নেয়।
আবার কখনও বিকাশ এজেন্টের দোকান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যে নম্বরে টাকা পাঠানো হয় তাকে কল করে বলা হয় ভুলে টাকা চলে গেছে।
পুলিশ বলছে, সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের টার্গেট করেছে প্রতারকরা। তারা বিভিন্ন শিক্ষকদের মোবাইল ফোনে শিক্ষার্থী বেশে কল করে বলছে, স্যার বা ম্যাডাম অনলাইনে ভর্তি ফরম পূরণ করতে গিয়ে ভুলে আপনার নম্বরে টাকা কিংবা গোপন নম্বর চলে গেছে। শিক্ষকরা সেসব কথা বিশ্বাস করে তাদের বিকাশ বা নগদের টাকা খুইয়েছেন।
সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি প্রকল্পে কর্মরত প্রান্তিক পর্যায়ের ১৮ নারীর বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।
এ প্রসঙ্গে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের উপকমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণায় যুক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে থাকে। একটি কৌশলের কথা ফাঁস হয়ে গেলে আরেক কৌশল ব্যবহার করে।
‘তাদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারকারীদের সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, যাতে কোনোভাবেই কেউ তার ওটিপি কিংবা গোপন পিন নম্বর অন্য কাউকে সরকরাহ না করেন।’
তিনি জানান, এসব বিষয় নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিকাশ কর্তৃপক্ষের একাধিক বৈঠক হয়েছে। প্রতারণার ঘটনা প্রতিরোধে তাদেরকে ‘আপডেট’ ও ‘প্রটেক্টেড’ প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে এধরনের প্রতারণা ব্যাপক হারে বেড়েছে। সারা দেশেই প্রতারক চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
আরও পড়ুন:ব্যাংকিং নিয়মে নয়, নিজের বানানো নিয়মে ব্যাংকের কার্যক্রম চালাতেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচির জনতা ব্যাংকের তামাই শাখার ব্যবস্থাপক আল আমিন। নিজের ইচ্ছেমতো গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন ও জমা দিতেন।
এদিকে ব্যাংকের ক্যাশ ভল্টের ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার হদিস এখনও মেলিনি।
বুধবার সকালে জনতা ব্যাংকের তামাই শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকদের হিসাবে থাকা টাকা তাদের অজান্তে তুলে নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ক্যাশ ভল্টের ওই পরিমাণ টাকাই শেষ কথা নয়? গ্রাহকদের অজান্তে তাদের হিসাবে জমা বিপুল পরিমাণ টাকাও হাতিয়ে নেয়া হয়েছে?
শাখাটিতে অবস্থানকালে সাংবাদিকদের কথা হয় তামাই বাজারের মেসার্স মুসলিম উইভিং ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী আব্দুল মোতালেব জোয়ারদারের সঙ্গে।
তিনি জানান, তার একটি ৪৮ লাখ টাকার সিসি লোন করা ছিল। তবে তিনি এখনও লোনটি উত্তোলন করেননি। অথচ তার ব্যাংক হিসাব ঘেটে দেখা যায় যে তিনি পুরো টাকাই উত্তোলন করেছেন। তার এই টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে তার সিরিয়ালের চেক ব্যবহার করা হয়নি। অন্য একটি চেকে ওই পরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এমন ঘটনায় মোতালেব জোয়ারদার হতবাক! এ অবস্থায় তার করণীয় কী হতে পারে বুঝতে পারছেন না।
শুধু আব্দুল মোতালেব নন, আরও অনেক গ্রাহকের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটেছে। একই এলাকার ব্যবসায়ী চান টেক্সটাইলের আকন্দের হিসাব থেকে তার অজান্তেই ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। আল ফারুক স্টোরের শহিদুল ইসলামের ২৪ লাখ টাকার সিসি লোনের মধ্যে তার অজান্তেই চেক জালিয়াতে করে ৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাবেও এমন জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসছে। ঝিন্না মোল্লার ব্যক্তিগত হিসাবে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯১০ টাকা থাকার কথা। কিন্তু ওই হিসাবে আছে মাত্র এক লাখ ৫ হাজার ১১২ টাকা।
তাৎপর্যের বিষয় হল, এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকরা তাদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাওয়ার কথা থাকলেও কোন এসএমএস আসেনি। গ্রাহকরা এ বিষয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললে তিনি তাদেরকে জানান- সার্ভারে ত্রুটি থাকার কারণে গ্রাহক এসএমএস পাচ্ছেন না।
বুধবার সকালে দেখা যায়, তামাই শাখার নতুন ব্যবস্থাপক কামরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পাঁচজন সদস্য বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন।
জনতা ব্যাংক হেড অফিসের এজিএম সাদিকুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে আরও রয়েছেন- ব্যাংকের এসপিও মোস্তফা কামাল, সিনিয়র অফিসার মাসুদুর রহমান, প্রিন্সিপাল অফিসার শরীফ মোহাম্মদ ইশতিয়াক ও এরিয়া ম্যানেজার সঞ্জিত কুমার।
এর আগে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের বগুড়া অফিসের যুগ্ম পরিচালক এস এম সাজ্জাদ হোসেনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তামাই শাখার ক্যাজুয়াল পিয়ন শহিদুল ইসলাম জানান, গত ৭ /৮ মাস ধরে শাখা ব্যবস্থাপক আল আমিনের কথা অনুসারে তিনি বিভিন্ন গ্রাহকের চেকে নিজে স্বাক্ষর দিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন। ব্যবস্থাপকের কথায় অনেক জমা ভাউচারেও তিনি স্বাক্ষর করেছেন।
কেন স্বাক্ষর করেছেন- এমন প্রশ্নে শহিদুল বলেন, ‘আমরা তাদের চাকরি করি। তিনি যা অর্ডার করতেন আমাদের তাই করতে হতো। আমি তো শুধু স্বাক্ষর দিয়েছি, ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তার আইডির মাধ্যমে টাকাগুলো দেয়া হতো। অনেক সময় গ্রাহকের হিসাবে টাকা না থাকলেও ম্যানেজার নিজে এসে তাদের টাকা দিতেন।’
এসব বিষয়ে নতুন ব্যবস্থাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তদন্ত শেষে স্যাররাই ব্যবস্থা নেবেন।’
তদন্ত কমিটির প্রধান এজিএম সাদিকুর রহমান বলেন, ‘ঠিক কত টাকা গরমিল হয়েছে তার তদন্ত চলছে। গ্রাহকদের টাকার বিষয়ে হেড অফিস সিদ্ধান্ত নেবে। যেসব গ্রাহকের হিসাবে ঝামেলা হয়েছে তাদেরকে দরখাস্ত দিতে বলা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এর বাইরে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
ব্যাংকের বিপুল টাকার হদিস না পাওয়ার এই ঘটনায় রোববার রাতে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। তারা হলেন- সিরাজগঞ্জের বেলকুচি জনতা ব্যাংক তামাই শাখার ব্যবস্থাপক আল আমিন, সহকারী ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম ও ব্যাংক অফিসার রাশেদুল ইসলাম।
আল আমিন সিরাজগঞ্জের ধানবান্দি পৌর এলাকার মো. হারান শেখের ছেলে, রেজাউল করিম বগুড়ার ধুনট থানার বেলকুচি গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে এবং রাশেদুল ইসলাম সিরাজগঞ্জের বনবাড়িয়া কাদাই গ্রামের জিয়াউল হকের ছেলে। তারা বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
প্রসঙ্গত, ২৪ মার্চ রোববার জনতা ব্যাংক পিএলসি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই শাখার ক্যাশ ভল্টে ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার গরমিল ধরা পড়ে।
পরে এ বিষয়ে জনতা ব্যাংক পিএলসি সিরাজগঞ্জের এরিয়া অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম তামাই শাখার ম্যানেজারসহ চারজনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।
এ ঘটনায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ তিন জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। হিসাব অনুসারে ভল্টে মোট ৭ কোটি ১১ লাখ ২৪০ টাকা থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে এক কোটি ৭৭ লাখ ৬১ হাজার ২৪০ টাকা। বাকি ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার কোনো খোঁজ মেলেনি।
নওগাঁর রাণীনগরে কোনোভাবেই থামছে না কৃষি জমির মাটি লোপাট। দিনের আলোতে প্রশাসনের হানা দেয়ার ভয় থাকার কারণে কৌশল পাল্টেছে মাটিখেকোরা। দিনের আলো ফুরাতেই শুরু হচ্ছে মাটি কাটার মহোৎসব।
একটি মেশিনের জায়গায় বর্তমানে একই স্থানে একাধিক মেশিন দিয়ে কাটা হচ্ছে সরকারি খাস জমির মাটি। এতে কৃষিজমি হারানোর পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে পাকা সড়ক।
পরিবেশ ও মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে দ্রুত প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সরেজমিনে দিন ও রাতের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে গিয়ে দেখা যায়, মিরাট ইউনিয়নের ২ নম্বর স্লুইস গেট সংলগ্ন স্থানে আতাইকুলা মৌজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ সংলগ্ন স্থানে সরকারি খাস জমির সঙ্গে কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি বছরে ১৬ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে বন্ধক নিয়ে সেখানে পুকুর খনন করা হচ্ছে।
মাসখানেক আগে ‘অবৈধ ট্রাক্টর দিয়ে মাটি বহনে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ রাস্তা’- এমন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাতে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দুই ট্রাক্টরচালককে কারাদণ্ড দেন। পরে সেখানে গিয়ে সরকারি খাস জমির একটি সাইনবোর্ড এবং সরকারি জমি পরিমাপ করে লাল ফিতা দিয়ে চিহ্নিত করে আসেন উপজেলা ভূমি অফিসের লোকজন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই ঘটনার কয়েকদিন পর উপজেলার কুজাইল এলাকার সর্বরামপুর গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম জনৈক রাজনৈতিক নেতাকে ‘ম্যানেজ করে’, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে কৌশল পাল্টে রাতে মাটি কাটা শুরু করেছে। তার পর থেকে বিষয়টি প্রশাসনকে একাধিকবার জানালেও তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ফলে রাতের আঁধারে দেদারছে সরকারি খাস জমিসহ কৃষি জমি গর্ত করে মাটি কেটে বিভিন্ন ইট ভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে।
বড় বড় ড্রাম ট্রাকের চাকায় নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক ও প্রধান পাকা সড়কগুলো। শুধু তা-ই নয়, ট্রাক থেকে সড়কে মাটি পড়ার কারণে তা যানবাহন ও পথচারী চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। তাছাড়া গাড়ির নিয়ন্ত্রণে বেগ পাওয়ায় প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন জানান, রাতে মাটি কাটার জন্য উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের লাখ টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করা হয়। তা না হলে রাতে খবর পেয়ে পুলিশের লোকেরা দফায় দফায় ভেকু মেশিনের চাবি কেড়ে নিয়ে যায়। পরে সন্ধির মাধ্যমে চাবি ফিরিয়ে দেয়।
তাদের দাবি, এতো ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতেই স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মাধ্যমে উপজেলা ভূমি অফিস ও উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নির্বিঘ্নে এ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে মাটি ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘ওই স্থানে কিছু খাস জমি হয়ত আছে। তবে জমির মালিকরা আমার সঙ্গে চুক্তি করে মাটি কেটে নিচ্ছে। আমি মাটির বিনিময়ে তাদের জমি খনন করে দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মাটি খনন করা হচ্ছে কি না, এই বিষয়ে জমির মালিকরা জানেন। অনুমতি নেয়া হয়েছে কি না, তা তারা বলতে পারবেন।’
তবে রাতে মাটি কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দিনের বেলায় প্রশাসন হানা দেয়, তাই রাতে মাটি কাটা হচ্ছে।’
মিরাট ইউপি চেয়ারম্যান হাফেজ মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘ওই জমি থেকে মাটি কাটা নিয়ে একটি মামলা চলছিল। পরে কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’
তবে মাটিখেকোরা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেই হয়ত রাতে মাটি কাটছে বলে ধারণা তার।
রানীনগর থানার ওসি আবু ওবায়েদ বলেন, ‘পুলিশ শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কাজ করে। কে কোথায় মাটি কাটছে, সেই বিষয়টি দেখবে উপজেলা প্রশাসন কিংবা ভূমি অফিস।
‘পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমি এমন অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
ইউএনও উম্মে তাবাসসুম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মাধ্যমে মাটি কাটার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে মাটিকাটা বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছি। এরপরও যদি তিনি মাটি কাটা বন্ধ না করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায় চলছে খাল দখলের মহোৎসব। খাল দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে মার্কেট ও বসতবাড়ি। এছাড়া সোনাইমুড়ী-ছাতারপাইয়া খালের ১ কিলোমিটারের মধ্যেই অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে ৪৪টি সেতু। বর্তমানে খালে বাঁধ দিয়ে নতুন করে কংক্রিটের পিলার নির্মাণ করে আরও ২টি সেতু বাড়ানোর তৎপরতা চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, সোনাইমুড়ী জোড় পোল থেকে ছাতার পাইয়া সড়কের পাশে ঘেঁষে বয়ে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন সোনাইমুড়ী-ছাতারপাইয়া খাল। খালটির দৈর্ঘ্য ৪.৩৫০ কিলোমিটার।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গত শীত মৌসুমে প্রথমবারের মতো খালটি খননের কথা থাকলেও অজানা কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এ খাল।
একইসঙ্গে খালের মুখে ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন সেতু তৈরি করে কার্যত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পানির প্রবাহ। ফলে বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি হলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, এ অঞ্চলে ৪৩ হাজার ৯০০টি কৃষক পরিবার রয়েছে। সেচ-নির্ভর বোরো ধান চাষের আবাদি জমি রয়েছে ১০ হাজার ১০ হেক্টর। কিন্তু চলতি বছরে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমিতে। সেগুলোতে পানি দেয়ার জন্য শক্তিশালী সেচ যন্ত্র রয়েছে ২ হাজার ২৬২টি।
দীর্ঘ সময় ধরে এ খালটি খনন না করায় শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যায় খালটি। ফলে পানির অভাবে খালের দুপাশের কৃষিজমিতে বোরো ধানচাষ ব্যাহত হচ্ছে। যেটুকু পানি প্রবাহিত হতো সেটাও দখলের কারণে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি সেচ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরা।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সোনাইমুড়ী জোড়া পোল থেকে শুরু হওয়া খালের ওপরে প্রায় ১০০টি দোকান তুলে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। মার্কেটের পর থেকে বাকি ১ কিলোমিটার খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ৪৪টি সেতু। এর মধ্যে ইট-পাথর দিয়ে নির্মিত হয়েছে ২৫টি সেতু, যেগুলোর কারণে খালের পানি চলাচল স্থবির হয়ে গেছে। অথচ এই ২৫ সেতুর মধ্যে জনসাধারণের চলাচলে ব্যবহার হয় মাত্র ৫টি, বাকি ২০টি সেতু ব্যবহার হয় ব্যক্তিগত প্রয়োজনে।
এগুলো ছাড়াও খালটির ওপর কাঠ, বাঁশ ও পিলার দিয়ে ১৮টি এবং ইস্পাত দিয়ে নির্মিত হয়েছে ৩টি সেতু।
স্থানীয়দের অভিযোগ, খালের ওপর সেতু নির্মাণ করছেন পেয়ারা বেগম নামের এক নারী। তিনি নিজেকে সোনাইমুড়ী পৌর সভার ওয়ার্ড কাউন্সিল হাফেজ দুলালের বোন হিসেবে পরিচয় দেন। খালের ওপর পাকা সেতু নির্মাণের প্রতিবাদ করলে তিনি ‘মেয়রের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন’ বলে থাকেন।
এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন কর্মকর্তারা হাফেজ দুলালের সঙ্গে এসে নাকি এ জায়গাটিও পরিদর্শন করে অনুমতি দিয়ে গেছেন। এমনকি ওইসব কর্মকর্তাকে চা-পানের খরচও দিয়েছেন ওই নারী।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়রের অনুমোদনের লিখিত কোনো কাগজ দেখাতে ব্যর্থ হন পেয়ারা বেগম।
পেয়ারা বেগমের নির্মাণাধীন সেতুর অদূরেই একই এলাকার ওমর ফারুক তার বাড়ির সামনের খালের ওপরে সেতু ঢালাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সরকারি অনুমোদন রয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পৌর মেয়রের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি। মেয়রের নাতি শামীম সেতু নির্মাণের কাজ তত্ত্বাবধায়ন করছেন।
তিনিও অনুমোদনের লিখিত কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি।
এছাড়া ওই এলাকার বাসিন্দা তারেক, তোফাজ্জল মিয়া, জাহাঙ্গীর হোসেন, আব্দুর রহমানসহ ২৫ জন ব্যক্তি খালের ওপর ব্যক্তি উদ্যোগে সেতু নির্মাণ করেছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই খাল স্বাধীনতার পরে কখনও খনন হয়নি। আর দখলের কারণে দিনে-দিনে সেটি আরও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এতে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে কৃষি জমিতে সেচ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। খালটির পানি প্রবাহের পথরোধ হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে কৃষি জমিতে পানি জমে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সে সময় আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে।
সোনাইমুড়ী পৌর তহসিলদার আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, খালের ওপর অনুমতি না নিয়েই সেতু নির্মাণের বিষয়টি তিনি জানতেন না। পরে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নির্দেশে ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।
নোয়াখালী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল জানান, সোনাইমুড়ী বাজার হয়ে ৫০০ মিটার খাল খননের আওতায় আসেনি। অবৈধ স্থাপনার কারণে সেখানে খননকাজ চালানো সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
সোনাইমুড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন মিয়া বলেন, ‘মৌখিক অভিযোগ পেয়ে খালের ওপর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। তবে বর্তমানে দুটি সেতুর কাজ নির্মাণাধীন আর বাকিগুলো আগেই নির্মিত হয়েছিল।’
সোনাইমুড়ি পৌরসভা মেয়র নুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এলাকার জনগণ খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণ করছে এটা সত্য। তবে এতে আমার কিছুই করার নেই।’
আরও পড়ুন:ভারতে লোকসভা নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে বৃহস্পতিবার পেট্রল ও ডিজেলের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ভারতের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী হারদিপ সিং জানান, কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রল ও ডিজেলের দাম দুই রুপি করে কমিয়েছে।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে জানানো হয়, জ্বালানি তেলের সমন্বয়কৃত এ মূল্য কার্যকর হয় শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে।
জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে মন্ত্রী হারদিপ সিং বলেন, ‘পেট্রল ও ডিজেলের দাম দুই রুপি কমিয়ে দেশের শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী মোদি আবার প্রমাণ করলেন, কোটি কোটি ভারতীয়র পরিবারের কল্যাণ ও সুবিধা দেখাই সবসময় তার লক্ষ্য।’
মন্ত্রী বলেন, ১৪ মার্চ ভারতে পেট্রলের লিটারপ্রতি গড় দাম ছিল ৯৪ রুপি, যেখানে ইতালিতে ১৬৮ দশমিক ০১ রুপি, ফ্রান্সে ১৬৬ দশমিক ৮৭ রুপি এবং জার্মানিতে ছিল ১৬৬ দশমিক ৮৭ রুপি।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হারদিপ সিং বলেছিলেন, অশোধিত তেলের বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা থাকায় জ্বালানির দাম কমছে না নিকট ভবিষ্যতে।
ভারতে জ্বালানি তেলের হ্রাসকৃত মূল্যে নগরভেদে তারতম্য থাকবে। দেশটির পেট্রলিয়াম মন্ত্রণালয় জানায়, সমন্বয়কৃত মূল্য অনুযায়ী, দিল্লিতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পড়বে ৮৭ দশমিক ৬২ রুপি, যা আগে ছিল ৮৯ দশমিক ৬২ রুপি।
অন্যদিকে ভারতের রাজধানী শহরে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম পড়বে ৯৪ দশমিক ৭২ রুপি, যা আগে ছিল ৯৬ দশমিক ৭২ রুপি।
আরও পড়ুন:ফিটনেসবিহীন গাড়িতে চড়ে হাইওয়ে পুলিশ চেক করছে গাড়ির ফিটনেস। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধে নিয়মিত টহলে যাচ্ছে ভৈরব হাইওয়ে থানা পুলিশ ফিটনেসবিহীন গাড়িতে চড়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভৈরবের শেষ প্রান্তে নরসিংদী জেলার মাহমুদাবাদ এলাকায় একটি লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িতে টহল দিচ্ছেন ভৈরব হাইওয়ে থানার চার-পাঁচজন পুলিশ সদস্য।
গাড়িটির রং নষ্ট হয়ে গেছে। সামনের দুটি হেডলাইট থাকলেও ডান-বাঁমে মোড় নির্দেশক বাতি নেই। ইঞ্জিনের সামনের অংশ ভাঙা। কয়েক জায়গায় তার দিয়ে বাঁধা। কিছু অংশে ঝালাই দেয়া। সামনের দুই দরজা নড়বড়ে, লক ভাঙা। চলছেও খুব ধীরগতিতে।
পুলিশের ওই গাড়ির চালক তাজুল ইসলাম জানান, গাড়িটি অনেক পুরনো। মাঝেমধ্যেই পথে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। তখন সবাই মিলে ধাক্কা দিয়ে চালু করতে হয়। এভাবেই প্রতিদিন মহাসড়কে টহল দিতে ঝুঁকি নিয়েই গাড়ি নিয়ে বের হতে হয় তাদের।
টহলে থাকা ভৈরব হাইওয়ে থানার এসআই আবু জাফর শামসুদ্দিন বলেন, ‘ঝুঁকি নিয়েই ফিটনেসবিহীন গাড়িতে চড়ে প্রতিদিন ডিউটিতে যেতে হয়। থানায় আরও দুটি গাড়ি আছে। তবে সে দুটিরও একই অবস্থা।’
ভৈরব হাইওয়ে থানার ওসি মো. সাজু মিঞা বলেন, ‘শুধু আমাদের থানার গাড়ির অবস্থা খারাপ তা নয়। দেশের অধিকাংশ হাইওয়ে থানার গাড়িরই বেহাল অবস্থা। ফিটনেসবিহীন গাড়িতেই চলতে হচ্ছে।
‘তবে দুটি গাড়ির বিষয়ে ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আশা করছি আমাদের থানায় খুব দ্রুতই নতুন গাড়ি যুক্ত হবে।’
এ বিষয়ে গাজীপুর হাইওয়ে রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমাদের হাইওয়ে থানাগুলোতে পুরনো গাড়ি রয়েছে। তবে সেই গাড়িগুলো পরির্বতনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্য সব হাইওয়ে থানায় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নতুন গাড়ি যুক্ত হবে।’
নাটোরের বড়াইগ্রামে দশম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে ছয়জন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ ও ঘটনার ভিডিও ধারণ করার ঘটনায় মাস পেরুলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে অভিযুক্তরা। ঘটনার পর থানায় মামলা করতে গেলেও তা না নেয়ার অভিযোগ উঠেছে বড়াইগ্রাম থানার ওসি শফিউল আজম খানের বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগীর স্বজনদের অভিযোগ, মামলা না নিয়ে ওসি তাদের পাঠিয়ে দেন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে। শুধু তাই নয়, বিষয়টি মিমাংসা করে ফেলতে চেয়ারম্যানকে নির্দেশও দেন তিনি।
পরে চেয়ারম্যান মিমাংসা করতে ব্যর্থ হলে আদালতের দারস্ত হন ভুক্তভোগীর স্বজনরা। আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ঘটনায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি ও ওসি শফিউল আজম খানের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, গত ২৭ জানুয়ারি বিকেলে পূর্ব পরিচয় থাকা বাগাতিপাড়ার দশম শ্রেণীর স্কুলশিক্ষার্থীকে কৌশলে ডেকে নেয় পাশ্বকর্তী বড়াইগ্রামের আটঘরিয়া গ্রামের পারভেজ হোসেন নামের এক যুবক। পথিমধ্যে নির্জন রাস্তায় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আগে থেকেই অপেক্ষমান পারভেজ ও তার পাঁচ বন্ধু সাগর, মোহন, প্রসনজিৎ, রতন ও কৃষ্ণ মিলে ভুক্তভোগীকে মুখ চেপে ধরে পাশের পেয়ারা বাগানে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়াসহ ঘটনাটি জানাজানি হলে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে অভিযুক্তরা চলে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয়রা মেয়েটিকে উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসাও দেয়া হয়।
ভুক্তভোগীর স্বজনদের অভিযোগ, এ ঘটনায় বড়াইগ্রাম থানায় মামলা করতে গেলে ওসি শফিউল আজম খান মামলা না নিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেন জোয়ারী ইউপি চেয়ারম্যান আলী আকবরের কাছে। ওসির কথামতো সেখানে কয়েক দফায় আপস-মিমাংসার চেষ্টা করা হয়। এরমধ্যে বারবার মিমাংসার আশ্বাস, ওসি ও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে দিশেহারা হয়ে পড়ে ভুক্তভোগীর পরিবার। এভাবে কেটে যায় আরও কিছুদিন।
মামলা না নিয়ে আপস-মিমাংসায় ওসির অপতৎপরতার কথা উঠে আসে ভুক্তভোগীর স্বজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কথায়। তবে নিজের প্রতি সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওসি শফিউল।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভুক্তভোগীর বাবা বলেন, ‘থানায় গিয়ে আমার মেয়ের ওপর নির্মম নির্যাতনের কথা বলতেই ওসি বলেন- এটা কোনো বিষয়ই না। মামলা নেয়া যাবে না। আপনারা চলে যান।
‘ওসির এমন কথায় চিন্তায় পড়ে যাই। শেষে ওসির কথামতো চেয়ারম্যানের কাছে গেলাম। চেয়ারম্যানও কোনো সমাধান দিতে পারল না। শেষমেষ কোর্টে গিয়ে মামলা করি।’
ভুক্তভোগীর দুলাভাই বলেন, ‘মামলা করতে থানায় গেলে মামলা না নিয়ে বরং ধমক দিয়ে বের করে দেন ওসি।’
জোয়ারী ইউপি চেয়ারম্যান আলী আকবর বলেন, ‘ফোন করে ওসি আমাকে দুইপক্ষকে নিয়ে বসে ধর্ষণের বিষয়টি মিমাংসা করে দিতে বলেন। ওসির কথামতো বাদী-বিবাদী দুপক্ষকে নিয়ে কয়েক দফা বসেও বিষয়টি সামাধান করতে পারিনি। পরে ভুক্তভোগীর পরিবারকে আইনের আশ্রয় নিতে বলেছি।’
বড়াইগ্রাম থানার ওসি শফিউল আজম খান সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় কেউ থানায় মামলা করতে আসেনি। বারবার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও মামলা করাতে পারেনি পুলিশ।’
এ সময় চেয়ারম্যানকে দিয়ে আপস-মিমাংসার কথাও অস্বীকার করেন তিনি।
ঘটনার বিষয়ে জানতে সরেজমিনে গিয়ে অভিযুক্তদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে গা ঢাকা দেন তাদের স্বজনরাও।
নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম জানান, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় মামলা না নেয়াসহ পুলিশের কারও কোনো গাফিলতি থাকলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগীর পরিবার আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্ত করতে নির্দেশনা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন জানান, বুধবার আদালতের নির্দেশনার কপি হাতে পেয়েছেন। ইতোমধ্যে তদন্ত কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন:খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা তরুণীর কোনো খোঁজ মিলছে না। প্রভাবশালীদের চাপে ওই তরুণী আত্মগোপনে রয়েছেন নাকি তার আনা অভিযোগগুলো সাজানো ছিলো তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। দেশ জুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়া সংবেদনশীল এই অভিযোগ তদন্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নারাজ।
ঘটনার শুরু শনিবার রাত ১১টা ১৫ মিনিটে। ওই সময়ে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৮ বছর বয়সী এক তরুণীকে নিয়ে আসেন তিন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ৬৫ বছর বয়সী গোলাম রসুল দাবি করেন, ওই তরুণী তার বোন। উপজেলা চেয়্যারম্যান এজাজ আহমেদ বিয়ের প্রলোভনে কয়েক বছর ধরে তার বোনকে ধর্ষণ করে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার রাতেও তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
গোলাম রসুলের এমন বক্তব্যের বরাতে তাৎক্ষণিক এই খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তরুণীকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)। তবে পরদিন রোববার সকাল থেকে আর দেখে মেলেনি ভাই পরিচয় দেয়া গোলাম রসুলের।
এই প্রতিবেদক ওই তরুণীর বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছেন যে গোলাম রসুল নামে তাদের পরিচিত কেউ নেই। গোলাম রসুলের ছবি দেখালেও তারা কেউ চিনতে পারেননি।
মঙ্গলবার উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষে ডুমুরিয়াতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেখা মিলেছে গোলাম রসুলের। মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে ভুল বুঝিয়ে ওই তরুণীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। আমার নাম দিয়ে কৌশলে তাকে ভর্তি করানো হয়েছে। আমি এর জন্য ক্ষমা প্রার্থী। এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
ওই তরুণী যদি ধর্ষণের শিকার হন তা হলে পুলিশ বা পরিবারের সহায়তা না নিয়ে অপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে কেন হাসপাতালে এলেন- এই প্রশ্নের কোনো উত্তরও মিলছে না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মাত্র ১৪ মিনিট আগেও পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে ওই তরুণী কথা বলেন। সে সময়ও তিনি ধর্ষণের ব্যাপারে কোনো তথ্য তাদেরকে জানাননি।
তরুণীর নানীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এক প্রতিবেশী ওই তরুণীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে তরুণী রাজি না হওয়ায় ওই ব্যক্তি নানা সময়ে হয়রানি করেছেন। এক পর্যায়ে তরুণীর বিরুদ্ধে তিনটি ও তার মায়ের বিরুদ্ধে দুটি মামলাও করেছেন ওই ব্যক্তি। ওই মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে আইনজীবীর সহায়তা নেয়ার জন্য তরুণী বিভিন্ন সময়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদের কাছে যেতেন।
শনিবারের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার দিকে আমার নাতনী জানায় যে উপজেলা চেয়ারম্যানের অফিসে আইনজীবী এসেছে। মামলার বিষয়ে কথা বলতে এখনই শাহপুর বাজারে যেতে হবে। এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।’
তরুণীর নানী জানান, রাত ১১টার দিকে উপজেলা চেয়ারম্যান পরিচয়ে এক ব্যক্তি প্রতিবেশী আব্দুলাহর কাছে মোবাইলে কল দিয়ে জানান যে ওই তরুণী এত রাতে একাকী বাড়ি ফিরতে পারবে না। রাতে উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঘুমাবে।
তবে রাত ১২টার দিকে আরেক প্রতিবেশী এসে তাকে জানান, তার নাতনী খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ওই খবর পেয়ে তরুণীর মা হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন।
উপজেলা চেয়ারম্যান পরিচয়ে প্রতিবেশী আব্দুলাহর কাছে যে ফোন কলটি এসেছিল, তার রেকর্ড সংরক্ষিত আছে এই প্রতিবেদকের কাছে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠটি উপজেলা চেয়ারম্যানের নয়। আর কলটি এসেছিল রাত ১১টা ১ মিনিটে। আর তরুণী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১টা ১৫ মিনিটে।
যে স্থানে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেখান থেকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের বেশি। এই সীমিত সময়ে ধর্ষণ ও হাসপাতালে পৌঁছানোও সম্ভব নয়।
এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে- ওই তরুণী ধর্ষণের অভিযোগ তুলে বলছেন যে শাহপুর বাজারে উপজেলা চেয়ারম্যান তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে তাকে ওই রাতে ধর্ষণ করেন।
উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। শাহপুর বাজারে তিন শতাধিক দোকান রয়েছে। ওই বাজারের মাঝখানে দোতলা একটি ভবনের নিচতলায় চেয়ারম্যানের কার্যালয়। ওই কার্যালয়ের পাশে আরও প্রায় ২০টি দোকান রয়েছে। জনবহুল একটি স্থানে ধর্ষণের মতো ঘটনার পর আশপাশের দোকানদাররা জানার আগে অপরিচিত গোলাম রসুল কী করে ধর্ষণের ঘটনা জানলেন, সে প্রশ্নেরও উত্তর মিলছে না।
এছাড়া ওই তরুণীর মোবাইল কল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শনিবার তিনি তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন। দুপুর ১২টা ৩৩ মিনিটে একবার। এছাড়া রাত ৮টা ৩ মিনিট ও ৮টা ২৮ মিনিটের দিকে কথা বলেছেন।
তরুণীর বাড়ি থেকে এজাজের কার্যালয়ের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। তিনি প্রতিবেশী পীর আলির ভ্যানে করে বাড়ি থেকে শাহপুর বাজারে এসেছিলেন।
পীর আলি জানান, রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই তরুণীকে তিনি শাহপুর বাজারে পৌছে দেন। এরপর কী হয়েছে তা তিনি জানেন না।
অন্যদিকে তরুণীর শাহপুর বাজার থেকে হাসপাতালে পৌঁছাতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। অর্থ্যাৎ সাড়ে ৮টার পর থেকে ১০টার মধ্যে তিনি কোথায় ছিলেন ও কাদের সঙ্গে দেখা করেছেন তার কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
অপহরণের পর বদলে গেল বক্তব্য
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে শনিবার রাতে ভর্তি হন ওই তরুণী। রোববার তাকে ছাড়পত্র দেয়া হবে- এই খবরে সেদিন দুপুর থেকেই ওসিসির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস। উপস্থিত ছিল উপজেলা চেয়্যারম্যানপন্থী ১০ থেকে ১২ ব্যক্তি। বিকেল ৫টায় ওই তরুণীকে ওসিসি থেকে ছাড়পত্র দিয়ে মা ও মামির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ওই সময়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই রুদাঘরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তৌহিদুজ্জামানের নেতৃত্বে অন্যরা টানাহেঁচড়া করে ওই তরুণীসহ তার মা ও মামিকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। উপস্থিত ব্যক্তিরা মো. তৌহিদুজ্জামানকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করে।
এ ঘটনার পর মো. তৌহিদুজ্জামানকে নেয়া হয় খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা থানায়। রাত পৌনে ১১টার দিকে সেই একই মাইক্রোবাসে করে তরুণীসহ তিনজনকে থানায় নিয়ে আসেন তুলে নেয়া ব্যক্তিরা স্বয়ং।
ওই সময়ে তরণীর বক্তব্য পাল্টে যায়। অপহরণ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে তিনি বলেন, ‘আমাকে অপহরণ করা হয়নি। আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে গিয়েছিলাম।’
ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমেদের সঙ্গে সম্পর্ক কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এজাজ চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার ম্যালা দিনের সম্পর্ক। বিভিন্ন সময় সুবিধা-অসুবিধার জন্য তার কাছে যাই।’
ধর্ষণের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ, আমাকে সুযোগ দেন সুস্থ হওয়ার। তখন আপনারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। যদি উত্তর দিতে না পারি আমার বিরুদ্ধে লেখেন, কিছু বলব না।’
এই একই প্রশ্ন আবারও জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘কোথা থেকে কী হয়েছে না হয়েছে, আমি কিছু বলতে পারি না।’
ওই রাতে থানা থেকে আবারও ওই গাড়িতে করে অতি দ্রুতগতিতে তাদেরকে ডুমুরিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকেই নিরুদ্দেশ ওই তরুণী।
প্রভাবশালীদের চাপে ওই তরুণী আত্মগোপনে রয়েছেন নাকি ধর্ষণের অভিযোগটাই সাজানো ছিল- তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। যদিও ওই রাতে থানায় তিনি দাবি করেছেন, হাসপাতাল থেকে তারা যশোরের কেশবপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
তদন্তে নারাজ পুলিশ
ডুমুরিয়া থানার ওসি সুকান্ত সাহা জানান, ধর্ষণ কিংবা অপহরণের অভিযোগে ওই তরুণী কোনো মামলা করেননি। অন্য কেউও থানায় এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ দেননি। তাই তাদের কিছু করার নেই।
তবে ওসিসির দায়িত্বে থাকা খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. সুমন রায় বলেন, ‘রোববার ডুমুরিয়া থানার ওসি ওসিসিতে এসে ওই তরুণীর জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন।
‘গাইনি ওয়ার্ডে তরুণীর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তার যে সোয়াব (শ্লেষ্মা) সংগ্রহ করা হয়েছিল তা পরদিন ওসিসিতে মাইক্রো বায়োলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পরিহিত পায়জামাসহ কিছু জিনিস ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য সংরক্ষণ এবং বয়স নির্ধারণের জন্য এক্স-রে করা হয়। মাইক্রো বায়োলজিক্যাল রিপোর্ট পেতে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে।’
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের উচিত, বিষয়টিকে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখা।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য