করোনাভাইরাসের মহামারিতে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিপর্যস্ত দেশ। তবে এই পরিস্থিতির ‘সুযোগ নিয়ে’ স্বাস্থ্য খাতে লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থা ঠেকাতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেশ কিছু সুপারিশ করলেও তা আমলে নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতি করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে করোনা আতঙ্ককে। করোনায় ‘অগ্রধিকার খাত’ বা ফ্রন্টলাইন হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য খাতে চলছে সীমাহীন অনিয়ম। কেবল সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়েও চলছে নিয়ম লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন অজুহাতে বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার নামে রোগী ও স্বজনের পকেট কাটা হচ্ছে।
এসব নিয়ে অভিযোগের পাহাড় জমেছে দুদকে। অনলাইন ও হটলাইনেও প্রতিনিয়ত আসছে অভিযোগ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কেনাকাটায় দুর্নীতিতে জড়িত ১৫০ জনের তালিকা ধরে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি কেনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এসব সিন্ডিকেট সরকারের দেয়া বাজেটের ৭০-৮০ ভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে।
গত বছরের শেষ প্রান্তিকে দুদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৫৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের স্ত্রীসহ মোট ১১৮ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নামে। তাদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
করোনার মধ্যে দুদকে জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে একটি হলো গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর মায়ের নামে নির্মিত শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের বাতি কেনায় দুর্নীতি।
এই অভিযোগ এসেছে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাগনে রায়হান হামিদের প্রতিষ্ঠান ‘বিডি থাই কসমো লিমিটেড’-এর বিরুদ্ধে। যেখানে ৫৫০ টাকার ১৫ ওয়াটের বাথরুম লাইট কেনা হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৩ টাকায়। ১৮ ওয়াটের ৮০০ টাকা দামের সারফেস ডাউন লাইট কেনা হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১ টাকায়। এলইডি ওয়াল স্পট লাইট ৪০০ টাকার পরিবর্তে কেনা হয়েছে ১ হাজার ৫৫৬ টাকায়। এ রকম ২৪টি সরঞ্জাম সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছে তারা।
অভিযোগ রয়েছে, পিডব্লিউডির তালিকাভুক্ত না হয়েও এসব সরঞ্জাম সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে রায়হান হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিয়ম মেনেই সব হয়েছে।’
সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল রক্ত পরীক্ষায় ব্যবহৃত ছোট্ট একটি টিউবের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২ হাজার টাকার জায়গায় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে ৫০টি টিউব কিনতে খরচ হয়েছে ৬৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ-সংক্রান্ত একটি অভিযোগও জমা পড়েছে দুদকে।
এই অভিযোগে দেখা গেছে, একটি ডিসেক্টিং টেবিলের দাম বাজারে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ধরনের দুটি টেবিল কিনেছে ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায়। ফলে একটি টেবিলের দাম পড়েছে ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।
এরই মধ্যে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ডা. কৃষ্ণ কুমার পালসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
করোনাকালে সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) ৯০০ কোটি টাকার কেনাকাটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবিরের নাম উঠে আসে। তদন্তে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পর ডা. ইকবালকে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে, তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়নি।
দুদক কমিশনার (তদন্ত ও অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত আগে থেকেই অস্বাস্থ্যকর ছিল। করোনায় তাদের আরও সুবিধা হয়েছে।
‘তাড়াতাড়ি কিনতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। ফ্রন্টলাইনার। এসব গল্পটল্প মেরে তারা এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, তাদের আমরা ধরতে গেলেও তারা বলছে, আমরা নাকি তাদের হতাশ করে ফেলছি। তারা কোনো কাজ করতে পারছে না।’
সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই অনিয়মের অভিযোগ আছে জানিয়ে মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘কী আর বলব! এখন অনেক জায়গায় করোনার দোকান বসাইছে। অনেক হাসপাতালে। অনেক অভিযোগ আসছে। এমনও অভিযোগ আছে যাদের অক্সিজেন লাগত না, তাদেরও অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। যাদের আইসিইউ লাগত না তাদেরও আইসিইউতে ঢোকানো হয়।
‘বড় হাসপাতালগুলো যা আছে, তারা আগে পেশেন্টের আয়-ইনকাম, আর্থিক অবস্থা দেখে। ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলটাইল দেখে, তারপর সেই রকম চিকিৎসা করে। এখন আমরা যাদের ফ্রন্টলাইনার বলি, তাদের সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ! আমরা কোথায় যাব বলেন?’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘নীরবতায়’ হতাশা জানিয়ে দুদকের এই কমিশনার বলেন, ‘আমরা সুপারিশ দিয়েছিলাম। এর কিছুও যদি মানা হতো, তাহলে দুর্নীতি কমে আসত। আমরা বলেছিলাম, নির্দিষ্ট লোকের কাছ থেকে, চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মালামাল কেনা যাবে না। সব ক্রয়-প্রক্রিয়া হতে হবে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে। এরপরেও তারা চিহ্নিত লোকের কাছ থেকেই সব কেনাকাটা করছে। তাহলে আপনি দুর্নীতিটা বন্ধ করবেন কী করে!’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগে পরিচালক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে ডা. বে-নজীর আহমেদের। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টাকা বানানোর টার্গেট করেই একটি গোষ্ঠী স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন অফার নিয়ে আসে। তারা জানে এই খাত সরকারের অন্যতম টাকা খরচের খাত। তারা খুবই স্মার্ট এবং তাদের বড় বড় কানেকশন আছে। নানা পর্যায়ে তাদের পরিচিতি আছে।
‘আমাদের স্বাস্থ্য খাতও এই র্যাকেটকে সুযোগ দিতে প্রস্তুত। কারণ আমাদের কেনাকাটার পদ্ধতি দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ। এর সঙ্গে যুক্ত হন স্বাস্থ্য বিভাগের কেউ কেউ। তারা বছরের পর বছর এই লুটপাটের অংশীদার হওয়ার সুযোগ পান এবং কাজে লাগান। এই দুই মিলেই আজ স্বাস্থ্য খাতের এই চিত্র।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কী বলব! স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা নীতিতেই সমস্যা। যে কারণে কেনাকাটা বা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, সবখানেই চলে দুর্নীতি। এ ক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারির সংখ্যা অনেক। এই খাতকে ঢেলে সাজানো ছাড়া মুক্তি নাই।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অবশ্য দাবি করছেন স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির মাত্রা অনেক কমেছে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যে দুর্নীতির অবস্থা আগের চেয়ে কমে এসেছে। দুদকের সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে করোনার কারণে সবকিছু শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।’
করোনার সময়ে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে লুটপাট বন্ধ করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সমীকরণ আছে। কারণ, লুটপাটের র্যাকেটটা বিস্তৃত। ধীরে ধীরে ডানা ছেঁটে একে কমিয়ে আনতে হবে। নিয়ন্ত্রণে এনে এরপর প্রতিরোধ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সফলতা পেতে আইনের প্রয়োগ ও নীতিমালা বাস্তবায়নে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। মূল কথা, যারা লুটপাটের গভীরে থেকে মূল ক্রীড়ানকের ভূমিকায় থাকে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনাই একমাত্র সমাধান।’
আরও পড়ুন:দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১২টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যায়নি। আজ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। এ দিন প্রতি ১০০ নমুনায় শনাক্তের হার ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ‘২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু ২৯ হাজার ৫২১ জন। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। এছাড়া ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে মোট শনাক্ত হয়েছে ২০ লাখ ৫২ হাজার ১২৭ জন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৫৮২ জন।
এডিশ মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সারা দেশে মশা নিধন কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে। চলতি বছরের মে মাসের তুলনায় জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। জানুয়ারিতে ১,১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬ এবং এপ্রিলে ৭০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে মে মাস থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে এবং জুনে এসে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে, বিশেষ করে বরগুনায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি।
এদিকে চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ২৯৬ জনে পৌঁছেছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৪২৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন শনাক্ত ৪২৯ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে— বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৪৯ জন; চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৭ জন; ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬১ জন; ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৪২ জন; ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৪৫ জন; খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন ও রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৪ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৫৮ জন রোগী। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।
চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং নারী ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪২ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে একজন রাজশাহী বিভাগের বাসিন্দা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এডিস মশার বিস্তার এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, 'মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ে এ সংখ্যা চার থেকে পাঁচগুণ এবং আগস্টে দশগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।'
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৯৬ জনে। এর আগে ২০২৩ সালের পুরো বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালের পুরো বছরের (১ জানুয়ারি–৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) সর্বমোট হিসাব অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৭৫ জন।
করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের মধ্যে দেশে আরও ২১ জনের শরীরে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছে।
রবিবার (২৯ জুন) সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় এসব শনাক্ত হয়েছে। তবে, নতুন করে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এই সময়ের মধ্যে।
সোমবার (৩০ জুন) স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২০ লাখ ৫২ হাজার ১১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২২ জন। আর দেশে ভাইরাসটিতে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫২১ জনের।
গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৩৮৩ জন রোগী। এসব রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৬ জন আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৩৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৫ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৮, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৮, খুলনা বিভাগে ৪১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৩৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে গত এক দিনে সারাদেশে ৩৪৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮ হাজার ৭২৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৮৬৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের।
সারাদেশে করোনা ভাইরাসের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পর সিলেট এ ভাইরাসে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার দুপরে এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছে সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন করে করোনার আক্রমন শুরুর পর সিলেটে প্রথম এই কোন রোগী মারা গেলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, করোনায় আক্রান্ত ৬৯ বছর বয়েসি পুরুষ ১৯ জুন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান তিনি। এছাড়া সিলেটে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ জন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মো. মিজানুর রহমান জানান, নিহত ব্যক্তির বাড়ি সিলেট সদর উপজেলায়। তিনি করোনা ছাড়াও আরও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে; গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন আরও ছয়জন। এ নিয়ে চলতি জুন মাসেই জেলায় করোনায় মৃতের সংখ্যা সাতজনে দাঁড়াল।
২৮ জুন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাঠানো সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলার মিরসরাই উপজেলার বাসিন্দা সালেহা বেগম (৪০) নামে এক নারী শুক্রবার নগরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই তিনি হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
এদিকে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৯১টি নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন নগরের এবং দুজন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে নগরের শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চারজন এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে দুজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে চলতি জুন মাসে মোট ১৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৬ জন পুরুষ, ৬৩ জন নারী ও একজন শিশু রয়েছে।
মশাবাহীত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালের দুই জেলায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় গোটা বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন আরও ১০৫ জন আক্রান্ত রোগী। এ নিয়ে বর্তমানে বিভাগের ছয় জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন। মৃত্যুবরণ করা দুজন হলেন- বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আ. করিম (৫০) ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের রাজপাড়া এলাকার মো. ইউসুফ খন্দকার (৭২)। এর মধ্যে আ. করিম বরিশাল শেরইবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে ও বৃদ্ধ মো. ইউসুফ খন্দকার কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক। এ পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হবে। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি। তাই মশার বিস্তার রোধ করতে বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৩০৫ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন।
বরগুনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মৃত ১১ জনের মধ্যে ছয়জনেরই বরগুনার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। শুধু মৃত্যুই নয় এ জেলায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি, বরগুনা জেলায় এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬৩২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মন্তব্য