দেশে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ই-কমার্স সাইট হয়েছে, যেগুলো গ্রাহকদের অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করছে। তবে টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহে বারবার সময় নেয়ার অভিযোগ আছে। তাদের ব্যবসার কৌশলও স্পষ্ট নয়। এ কারণে নানা সন্দেহ-সংশয় আছে মানুষের মধ্যে।
এর মধ্যেই ই-কমার্স সাইট ইভ্যালিকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তদন্ত চালিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি এক টাকা আয় করতে সাড়ে তিন টাকার বেশি ব্যয় করে। তাদের সম্পদের তুলনায় দেনা ছয় গুণ। ফলে তারা এই টাকা আদৌ পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
এমন পরিস্থিতিতে নিউজবাংলা কথা বলেছে আলোচিত এই ই-কমার্স সাইটের তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইভ্যালির লোক ঠকানোর গোপন কৌশল জানিয়েছেন তারা।
তারা বলছেন, ইভ্যালির নিজস্ব মূলধন ছিল খুবই কম। নেই নিজস্ব কোনো পণ্য। তারপরও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের ওপর অবিশ্বাস্য সব ছাড় দিয়ে আসছে, যে দামে মূল কোম্পানিও পণ্য বিক্রির চিন্তা করতে পারে না।
এ ছাড়া তারকাদের দিয়ে ব্র্যান্ডিং করছে; দামি দামি পণ্য উপহার দিয়ে প্রশংসাসূচক পোস্ট দেয়াচ্ছে। বিষয়টা এমন যেন তারকারা পণ্যটি ইভ্যালি থেকে কিনেছেন এবং কোনো রকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই পেয়েছেন।
মূলত এভাবে ইভ্যালিকে সাধারণ মানুষের কাছে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। ক্রেতা ধরতে নিজেদের কর্মী দিয়ে ফেইক আইডি খুলে পণ্যের রিভিউ করায়। রিভিউ দেয়ায় ‘পেইড’ লোক দিয়েও, যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে।
আবার গণমাধ্যমকর্মীরা যাতে কোনো সমালোচনা না করেন সেদিকেও আছে তাদের বিশেষ নজর। এভাবেই গত আড়াই বছর ধরে ব্যবসা করছে ইভ্যালি। কিন্তু গ্রাহক বা পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান- কোনো পক্ষের সঙ্গেই কথা রাখছে না, তাদের টাকা আটকে রাখছে মাসের পর মাস। তাদের কাছে দেনা রেখে সেই টাকা দিয়েই চালু করছে নতুন নতুন ব্যবসা। কিনছে কোম্পানিও।
পুরো বিষয়টাকে ‘কই মাছের তেল দিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন ইভ্যালির এই কর্মকর্তারা।
তাদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। সাড়া দিয়েছেন শুধু ইভ্যালির হেড অফ পিআর, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন শবনম ফারিয়া। কথা হয়েছে ইভ্যালির প্রশংসা করে পোস্ট দেয়া ইউটিউবার সালমান মুক্তাদিরের সঙ্গেও।
দুই টাকার জিনিস দেড় টাকায়: ব্যবসা কোথায়, কোম্পানি চলছে কীভাবে?
ইভ্যালির ওই তিন কর্মকর্তার কাছে নিউজবাংলার প্রশ্ন ছিল- ধরেন, আপনারা দুই টাকার জিনিস দেড় টাকায় বিক্রি করেন। এটা কীভাবে সম্ভব? ভর্তুকির টাকাটাই বা আসছে কোথা থেকে?
জবাবে তাদের একজন উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘একবার ভাবুন তো ৪০ হাজার টাকার ফ্রিজ ১৫ হাজার টাকায় কীভাবে দেয়া সম্ভব? এই অফার দেখে পাবলিকের মাথা তো পুরাই নষ্ট। অর্ডার পড়ল দুই হাজার জনের। তার মানে ইভ্যালির কাছে জমা হলো ৩ কোটি টাকা (২০০০ গুণ ১৫০০০)। কিন্তু তিন মাসেও ওই দুই হাজার লোককে পণ্য দেয়া হয় না। এই তিন মাসে ওই ৩ কোটি টাকা অন্য কোনো খাতে খাটিয়ে আয় করে ইভ্যালি।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ইভ্যালি এভাবে যে ৩ কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে তোলে, তা ব্যাংকে রেখে ৫% হারেও যদি সুদ নেয়, তাতেও মাসে আয় হয় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ৩ মাসে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা৷
‘এদিকে প্রতিষ্ঠানের ওপর যাতে চাপ না পড়ে সে জন্য ২০০০ জনের মধ্যে ১০০ জনের জন্য ফ্রিজ কেনা হয় ৩৫ হাজার টাকা দরে। তাহলে খরচ হলো ৩৫ লাখ টাকা, হাতে থাকল ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এখন যে ১০০ ফ্রিজ ডেলিভারি দেয়া হলো, যারা পেলেন তারা তো খুশিতে আত্মহারা। উৎফুল্ল হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেন, আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি। আর যারা পেলেন না তারা ভাবতে থাকলেন আরও কিছুদিন অপেক্ষা করি। যেহেতু অনেকেই পেয়েছেন, তাই আমিও পাব। কিন্তু সেই পাওয়াটা ইভ্যালির ওয়েবসাইটে ঝুলেই থাকে। এ রকম অভিযোগ বাড়তেই থাকে।’
৪৫ কার্যদিবসের নামে ‘নয়ছয়’
এই ই-কমার্স সাইট ৪৫ কর্মদিবসে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও সে প্রতিশ্রুতি রাখে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এটা কেন হচ্ছে?
এ প্রসঙ্গে ইভ্যালির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি একটা ইনভয়েস নম্বর (পণ্য কেনার আইডি নম্বর) অ্যাডমিন প্যানেল দিলে বুঝতে পারি কার প্রোডাক্টটা কোন প্রসিডিউরে আছে। কাস্টমাররা ক্লেইম করেছেন কি না, প্রোডাক্ট পাইছেন কি না, আপডেটটা কী? বা ৪৫ কার্যদিবস হয়ে গেছে, প্রোডাক্টটা কেন ডেলিভারি হয় নাই ইত্যাদি বিষয় দেখা যায়।
‘এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে দেখানো হয়, যেগুলো ৪৫ দিন পার হয়ে গেছে সে ক্ষেত্রে পিকড দেখায়। এটা হলো পিও (প্রোডাক্ট অর্ডার) সেন্ট টু সেলার। তার মানে তারা বোঝায় অর্ডারটা সেলারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে ইভ্যালি। কিন্তু আসলে দেয়নি।’
ওই তিন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ইভ্যালি বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করে ‘দালালের মতো’।
উদাহরণ দিয়ে তাদের একজন বলেন, ‘ধরেন কিয়াম নামে একটা কোম্পানি আছে। ওরা ট্রিমার, ফ্রাইপ্যান ইত্যাদি বিক্রি করে। ওদের একটা প্রোডাক্ট আপনি অর্ডার করেছেন। সে প্রোডাক্টটা ৪৫ দিন পার হওয়ার পর ইভ্যালির প্যানেলে দেখাচ্ছে পিকড। অথচ ইভ্যালি থেকে পারচেজ অর্ডার পাঠানো হয় নাই।
‘এখন কাস্টমার তো ভাবছে আমার প্রোডাক্টট তো সেলারের হাতে, সেলার আমাকে দিচ্ছে না কেন? ইভ্যালির কাজ তো ইভ্যালি করে দিছে। কাস্টমার ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তখন ইভ্যালি বলে আপনার পারচেজ অর্ডার সেলারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সেলার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রোডাক্ট দিয়ে দেবে। অথচ দুই মাস ছয় মাস পার হয়ে যায়, সেলার ওই কাস্টমারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করে না।’
তাহলে আসল ঘটনা কী জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একটা উদাহরণ দেই। আমি জেনেছি, কিয়াম ৭০ লাখ টাকা পাবে ইভ্যালির কাছে। এখন একটা কোম্পানি যখন আপনার কাছে ৭০ লাখ টাকা পায়, তখন আপনি নতুন ২০ লাখ টাকার পণ্য অর্ডার করলে তারা কি আর পণ্য দেবে?’
তিনি বলেন, ‘এদিকে কাস্টমার নানা ধরনের রিভিউ দেখে ভাবে, একই প্রক্রিয়ায় অর্ডার করে অনেকে তো প্রোডাক্ট পাইছে, আমি পাচ্ছি না কেন? আবার ইভ্যালি বলে, তারা পারচেজ অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। তাহলে দোষটা নিশ্চয়ই সেলারের। এভাবে বড় একটা শুভংকরের ফাঁকি চলে। এভাবে ডেট ওভার হয়, আবার ইভ্যালি দেখায় অনটাইমে অর্থাৎ ৪৫ দিনেই পিকড। অথচ কাস্টমার প্রোডাক্ট পায় না।’
‘পিকড’ দেখিয়ে সান্ত্বনা
ইভ্যালির প্যানেলে পিকড দেখালে তাদের দায়িত্ব বা কাজ শেষ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয় বলে জানান এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘ইভ্যালির কিছু প্রসেস আছে। যেমন প্রথমে প্রসেসিং, তারপর শিফটিং, সবশেষ পিকড। এই পিকড মানে হলো, ইভ্যালির দায়িত্ব বা কাজ শেষ। ৪৫ দিন হয়ে গেলে ইভ্যালি অর্ডারটা সেলারের কাছে পাঠিয়ে দেবে, সেলার কুরিয়ারের কাছে দিয়ে দেবে। কিন্তু ইভ্যালি এখানে টাকা পরিশোধ না করেই বেশির ভাগ সময় কাস্টমারকে বোঝায় তাদের দোষ নেই তারা পারচেজ অর্ডার দিয়ে দিছে। সেলার প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিচ্ছে না। অপেক্ষা করেন ডেলিভারি দিয়ে দেবে। এভাবে দিনের পর দিন পার করতে থাকে।’
ইভ্যালি কেন এমন করে- নিউজবাংলার এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা তারা করে কারণ ওই যে টাকা। কাস্টমার অর্ডার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পায় ইভ্যালি। ওটা নিয়ে তারা কাজে লাগায়। কাস্টমারকে যা তা বোঝানো যায়। ইভ্যালি ক্লায়েন্টকে বোঝায়, আমরা তো সবকিছু করে দিছি। সেলার কেন প্রোডাক্ট দিচ্ছে না, ওদের মনে হয় সাপ্লাই নাই। এভাবে নানান কিছু বোঝায়। কারণ কাস্টমার তো ফান্দে। অনেক সময় অপেক্ষা ছাড়া উপায় কী?
কৌশলে নগদ টাকা বের করে অন্য জায়গায় বিনিয়োগ
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়ে ইভ্যালির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্প্রতি দেখলাম সুলতান’স ডাইন ইভ্যালির কাছে কয়েক লাখ টাকা পায়। কাস্টমার যখন ইভ্যালির মাধ্যমে অর্ডার করেন তখন ইভ্যালি অর্ডারের টাকাটা পায়। সুলতান’স ডাইন কিন্তু প্রোডাক্ট দিয়ে দিচ্ছে। কারণ তারা হয়তো তাদের সুনামের কথা চিন্তা করেই খাবার দিয়ে দেয়। এভাবে ইভ্যালির কাছে দিনের পর দিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের টাকা পড়ে থাকছে। ইভ্যালি কৌশলে ঋণগ্রস্ত থেকে নগদ টাকা বের করে তা অন্য খাতে ইনভেস্ট করে।’
ইভ্যালির কাছে পাওনার বিষয়ে জানতে নিউজবাংলা কথা বলেছে সুলতান’স ডাইনের কাস্টমার সার্ভিসে কর্মরত ফাতেমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ইভ্যালির সঙ্গে সুলতান ডাইনের কোনো ব্যবসা নেই। আমাদের কর্তৃপক্ষ সেটা স্টপ করে দিয়েছে। ইভ্যালির ঋণ আছে। তবে এ বিষয়টা আমরা বলতে চাচ্ছি না।’
‘কই মাছের তেল দিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা’
অভিযোগ আছে, কোনো পণ্যের জন্য গ্রাহক ইভ্যালিকে যে টাকা দেন, সেই টাকা চাইলেও আর ফেরত পান না। বাধ্য হয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যের বদলে ‘আজেবাজে’ কোনো পণ্য কিনতে হয় টাকা উসুল করতে।
গ্রাহকদের টাকা ফেরত না পাওয়ার বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কারণ একটা অ্যাকাউন্ট হয়। সেটা হলো ইভ্যালি ব্যালান্স বা ই-ওয়ালেট। এ ব্যালান্স কাস্টমার চাইলেই তুলতে পারেন না। ধরেন, কোনো কাস্টমার ৭০ হাজার টাকার একটা ফ্রিজ অর্ডার করলেন। কাস্টমার নানা ভোগান্তির শিকার হয়ে অর্ডার ক্যানসেল করুক আর যাই করুক, রিফান্ড অন্য ইস্যু। যদি ইভ্যালির কারসাজিতে পড়ে সেলার আপনাকে বলে দেয় মাল ডেলিভারি দিতে পারবে না, তখন কাস্টমার বিরক্ত হয়ে যদি বলে দেয় অর্ডার ক্যানসেল, সে ক্ষেত্রে ব্যালেন্সটা ইভ্যালির হয়ে গেল।
‘টাকা তো ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেই সময় বাধ্য হয়ে কাস্টমাররা দুইটা মগ, জুতা-স্যান্ডেল হাবিজাবি কেনেন, যতটুকু পারে কিছু টাকা উসুল করার চেষ্টা করেন। অথচ মূল টাকাও ফেরত পাইল না, আবার প্রয়োজনীয় জিনিসটাও পাইল না। স্রেফ একটা চিটিংবাজির মধ্যে পড়ল কাস্টমার।’
তিনি বলেন, ‘বুঝলাম যে এটা ই-কমার্সের বিজনেস। কিন্তু সেলারকে টাকা না দিয়ে তাদের কাছে দেনা, আবার কাস্টমারের কাছ থেকে নগদ টাকা বুঝে নেয়া- এটা আবার কেমন ব্যবসা? লোভনীয় অফারের সুযোগ দিয়ে কাস্টমার ও কোম্পানিকে ঠকানো ছাড়া আর কিছুই না। আমার মনে হয়েছে, বিষয়টা কই মাছের তেলে কই মাছ ভাজা নয়, যেন ইলিশ মাছ ভাজা।’
‘প্রতারণা তো প্রতারণাই, আইন আগে থেকেই আছে’
এক পণ্যের বদলে অন্য পণ্য দেয়ার বিষয়টি প্রতারণার মধ্যে পড়ে এবং প্রচলিত আইনেই (দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায়) প্রতারণার জন্য শাস্তি আছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
সোমবার নিউজবাংলার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতারণার যে আইন আছে, সেখানে সংজ্ঞার মধ্যেই আছে যে, কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী একটা জিনিস দেয়ার কথা বলে সেটি না দিয়ে অন্য কোনো কিছু নিতে বাধ্য করে বা প্রতারণা করে তাহলে ফৌজদারি আইনে মামলা হবে। যেকোনো জায়গায় মামলা করতে পারবে প্রতারণার শিকার ব্যক্তি। প্রতারণা মামলায় সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছরের কারাদণ্ড। আছে জরিমানার বিধানও।’
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘তবে সম্প্রতি ই-কমার্স নিয়ে একটা আইন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক কোনো পণ্য বুঝে পাওয়ার আগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান টাকা পাবে না, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাটা পাবে। এ আইন বাস্তবায়ন হলে গ্রাহক প্রতারণার শিকার হলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান টাকা পাবে না।
‘সে ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতারণার সুযোগ কমবে। তা ছাড়া এ আইনের আগেও তো প্রতারণার মামলার সুযোগ আছে। প্রতারণা তো প্রতারণাই। প্রতারণা বা চিটিংয়ের বিষয়ে আইন আগে থেকেই আছে।’
পেইড রিভিউ
প্রতিষ্ঠানটির এই কর্মকর্তারা জানান, সবচেয়ে বড় প্রতারণার বিষয়টা হলো, ইভ্যালির পেজে যেসব রিভিউ দেয়া হয় তার সবই পেইড রিভিউ। ওদের একটা গ্রুপ আছে, সেই গ্রুপের নাম ইভ্যালি হেল্প অফার অ্যান্ড রিভিউ। সেখানে সাড়ে ৭ লাখ সদস্য। ওটার মধ্যে ইভ্যালির কর্মীরা রিপ্লাই দেন ফেইক আইডি খুলে। ওখানকার ৯৮ শতাংশ পোস্ট হলো পেইড পোস্ট।
তাদের একজন বলেন, ‘অনেক সময় আমাদেরকে অর্থাৎ ইভ্যালির কর্মীদের ব্যক্তিগত আইডি দিয়ে পোস্ট দেয়ানো হয় যে, ইভ্যালি থেকে যথাসময়ের মধ্যে আমার প্রোডাক্টটি বুঝে পেলাম। আজ আমি খুব খুশি। এমন পোস্ট দেয়া হয়। সেগুলোতে অনেক ভিউ হয়। নিজেদের বানানো পোস্ট। এসব মেইনটেইন করার জন্য ইভ্যালিতে ১২৫ কর্মী কাজ করেন। এসব ফেইক পোস্ট রিপ্লাই শুধু মানুষকে ইভ্যালির দিকে টানার জন্য। কারণ বেশির ভাগ অরিজিনাল রিভিউয়ে থাকে সমালোচনা।’
গিফটের বিনিময়ে পোস্টের ডিল
তারা জানান, ইভ্যালির সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার আরেক কৌশল তারকাদের উপহার দিয়ে পোস্ট দেয়ানো, যেগুলো আসলে পেইড পোস্ট।
উদাহরণ দিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যেমন এর আগে ইউটিউবার সালমান মুক্তাদির আর ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান যে পোস্ট দিয়েছিলেন ইভ্যালিতে, সেটা ছিল পেইড পোস্ট। তারা তাদের পেজে পোস্ট লিখেছিলেন, আমি খুব অল্প সময়ে পেয়ে গেছি, অন টাইমে পেয়ে গেছি, ধন্যবাদ ইভ্যালি। তাদের ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুকে এগুলো আছে।’
সালমান মুক্তাদির ও মুস্তাফিজুর রহমান আসলে ইভ্যালি থেকে মোটরসাইকেল ক্রয় করেননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের মোটরবাইক গিফট করে পোস্ট দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল, যাতে সবাই আকৃষ্ট হয়। এই সুযোগে বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা জড়ো করতে পারে ইভ্যালি। মানুষ তো আর এসব পেইড পোস্টের হিসাব বুঝবে না।
‘তার মানে কিন্তু ভিআইপিদের সঙ্গে সঙ্গে পণ্য দেয়া, বিষয়টা এমন না। ডিল হয় যে, আমরা তোমাকে এই গিফট দেব, পরিবর্তে আপনার ফেসবুকে ইভ্যালি থেকে প্রোডাক্টটি পেয়েছেন- এমন একটি পোস্ট দিতে হবে। এভাবে পাবলিকের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সালমান মুক্তাদির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বাইক পেয়েছি। কিন্তু ইভ্যালির সঙ্গে আমার কোনো ডিল নেই। ইভ্যালি থেকে বাইক যে প্রক্রিয়ায় কিনতে হয়, সেটা আমার মেইনটেইন করতে হয়নি। এসব ক্ষেত্রে আমরা নিজের নাম-ফোন নম্বর ব্যবহার করি না। তাই ও রকম চালান নেই।’
নিউজবাংলা কথা বলার চেষ্টা করেছে ইভ্যালির বাইক নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম বোলার মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে।
গত ২৮ জুন পাঁচবার তার নম্বরে ফোন করা হয়। এতে সাড়া না পেয়ে কয়েক ঘণ্টা পর নিউজবাংলার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এসএমএসও করা হয় তাকে। সবশেষ খুদেবার্তা পাঠানো হয় তার হোয়াটসঅ্যাপে। বলা হয়, ‘আপনার ফেসবুক পেজে ইভ্যালি বাইক সম্পর্কিত একটা পোস্ট আছে। সেটা উপহার পেয়েছেন কি না?’ এসব প্রশ্ন তিনি দেখলেও সাড়া দেননি এই তারকা ক্রিকেটার।
সাংবাদিকদের জন্য আলাদা তালিকা
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাংবাদিকদের জন্য আলাদা তালিকা রয়েছে। তালিকায় থাকা সাংবাদিকরা অফারে কোনো কিছু অর্ডার করলে ৪৫ কর্মদিবসের আগেই প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিয়ে দেয়া হয়, যাতে নেগেটিভ কোনো নিউজ না হয়।
বিষয়টি দেখভালের জন্য একটা টিম রয়েছে। টিমটি বিভিন্ন হাউসের যেসব সাংবাদিক ইভ্যালির কাস্টমার তাদের নির্ধারিত সময়ের আগেই সার্ভিস দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
এ বিষয়ে জানতে রোববার বিকেলে নিউজবাংলা কথা বলেছে ইভ্যালির হেড অফ পিআর, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন শবনম ফারিয়ার সঙ্গে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যেহেতু পিআর ডিপার্টমেন্টে আমি কাজ করি, যারা জার্নালিস্ট আছে, তারা আমার লোক। আমার সব কাজ যেহেতু সংবাদমাধ্যমে হয়, আমার কাছে এ রকম একটা লিস্ট আছে। সেখানে শুধু সাংবাদিক না, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মার্কেটিংয়ের লোকজনের নামও আছে।
‘এই লিস্টের গ্রাহকদের পণ্য আমি জরুরি ভিত্তিতে পাঠিয়ে দেই। সাইক্লোন অফারের ক্ষেত্রেও আমি এই গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ, অনেকেই ডাউট করছে, সাইক্লোন অফ হয়ে গিয়েছে, এখন আমাদের পণ্য আদৌ পাব কি না- এ রকম একটা ডাউট সাধারণ মানুষের মধ্যে হচ্ছে। এটাকে আমি স্বাভাবিক মনে করি।’
সাংবাদিকদের পণ্য সরবরাহ দ্রুত হলেও হাজার হাজার সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে কেন- জানতে চাইলে শবনম ফারিয়া বলেন, ‘এই বিষয়টা আমার ডিপার্টমেন্ট না। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
৫ লাখের মোটরসাইকেল ৩ লাখে কীভাবে
ইভ্যালির ওই তিন কর্মকর্তা জানান, মোটরবাইকের ক্ষেত্রে যেটা বলা হয়ে থাকে এত কম টাকায় বাইক দেয় কীভাবে? একটা ৫ লাখ টাকার বাইক ৩ লাখ টাকায় কীভাবে বিক্রি করে? যেখানে ওই বাইকটার দাম আসলে সাড়ে ৪ লাখ টাকা।
এ ক্ষেত্রে ইভ্যালি এভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারা একসঙ্গে অনেক বাইক আনে। তাদের ওয়্যারহাউস আছে। সুতরাং তাদের বাইকের দাম কম পড়ে, কম টাকায় দিতে পারে। কিন্তু আসল কথা হলো বাইকের যন্ত্রপাতির তো মিনিমাম একটা মূল্য আছে, ৪ লাখ ২০ হাজার। তার চেয়ে কম দামে কীভাবে ইভ্যালি বাইক বিক্রি করতে পারে?
ঘাটতির টাকা কীভাবে ম্যানেজ করে
কর্মকর্তাদের একজন বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে ইভ্যালি এই ঘাটতির টাকা কীভাবে ম্যানেজ করে? এ ক্ষেত্রে তারা চালাকি করে যে, তারা বাইকের জন্য যে টাকা কাস্টমারের কাছ থেকে অ্যাডভ্যান্স নেয়, সেই অ্যাডভান্সের টাকাটা অন্যভাবে অন্য বিজনেসে বিনিয়োগ করে। সেটা তারা কাউকে বলে না বা প্রকাশ করে নাই এখন পর্যন্ত।’
গ্রাহকের টাকায় ৬ মাসে ৬ কোম্পানি কেনার চিন্তা
কাস্টমারদের এসব টাকায় সম্প্রতি তারা ফ্লাইট এক্সপার্ট নামে একটা ট্রাভেল এজেন্সি কিনেছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি জেনেছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে তারা আরও ছয়টি কোম্পানি কিনবে। যতটুকু শুনেছি, এগুলোর মধ্যে ই-হেলথ, ই-এগ্রো, ই-ফার্মা রয়েছে।
‘আমার জানামতে, ৬০ হাজারের মতো অর্ডার ঝুলে আছে ইভ্যালিতে। এর মধ্যে তিন হাজার মানুষের অর্ডার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এক বছরের বেশি সময়, যেগুলো দেড় মাসে ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল। এদের বেশির ভাগের অর্ডার প্রথম ছয় মাস ঝুলিয়ে রাখা হয় সেলারের কাছে প্রোডাক্ট নাই বলে। বাকি ছয় মাস পার করেছে রিফান্ডের কথা বলে। কিন্তু কোনো কিছুই হয় নাই।’
‘জাস্ট আইওয়াশ’
এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই যে ইভ্যালির প্রধান মাঝে মাঝেই বলেন, আমরা একটা স্টার্টআপ কোম্পানি। কোম্পানির বয়স আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে আমাদের এমপ্লয়ি ১ হাজার ২০০ জন। এসব কথা জাস্ট আইওয়াশ।
‘যেমন ইভ্যালির একটা ডিপার্টমেন্ট আছে, সোস্যাল কমিউনিকেশনস। তাদের কাজ হলো ফেসবুকে রিপ্লাই করা, মেইলে রিপ্লাই করা এসব। এখানে এখন মোট ১৬০ জন কাজ করেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আইওয়াশটা এ রকম যে, আমি ১ হাজার ২০০ এমপ্লয়ি নিয়োগ দিছি। আমি একটা স্টার্টআপ কোম্পানি। তারা কোনো করপোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি পালন করতেছে না, ট্যাক্সের হিসাবও দেয় না। তাছাড়া তারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টরে স্পনসর করে, এটাও একটা আইওয়াশ। বড় বড় মানুষের সঙ্গে অ্যাটাচ হয়ে পাবলিককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে- এটাও প্রতারণারই কৌশল।’
‘ডু শেয়ার’
ইভ্যালির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইভ্যালিতে যেসব কর্মী কাজ করে তারা তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কীভাবে ব্যবহার করবে সে ক্ষেত্রে একটা নীতিমালা বেঁধে দিয়েছে ইভ্যালি। শুধু পজিটিভ পোস্ট করার জন্য বাধ্য করা হয়।
‘হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের গ্রুপ আছে, সেখানে তারা পোস্ট লিখে দিয়ে বলে, ডু শেয়ার। শেয়ার করার পর হোয়াটসঅ্যাপে লিখতে হয়, ডান। এটাই হলো ইভ্যালির সিস্টেম।’
এ প্রসঙ্গে আরেক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা কর্মীদের বোঝায় যে নেগেটিভ কথা হবেই। ওটা ভালো। মাঝে ইভ্যালির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছিল। অফিসের কর্মীদের তখন বোঝানো হয়, সরকারকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে ইভ্যালি নিজেই। পরে ব্যাংক হিসাব খুলে দেয়া হলে সেটা ক্যাশ করে। বলা হয়, কোনো ঘাপলা না পেয়ে সরকার ছেড়ে দিয়েছে। যেহেতু সরকার ভেরিফাই করে দিছে, সাধারণ মানুষ ভাববে ইভ্যালি ভাগবে না।’
পুরো বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কোনোভাবেই তিনি সাড়া দেননি।
গত ২৮ জুন দুটি মোবাইল নম্বরেই বারবার কল করা হলেও রিসিভ করেননি তিনি। একই দিন নিউজবাংলার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এসএমএস পাঠানো হয় তার হোয়াটসঅ্যাপে। তা দেখেও কোনো উত্তর দেননি ইভ্যালির এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
এরপর ৩০ জুন সকালে ইভ্যালির ধানমন্ডির অফিসে গিয়ে পাওয়া যায়নি রাসেলসহ কোনো কর্মকর্তাকে। চারজন নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন পুরো অফিসে। তারা জানান, গত ২৭ জুন থেকে কোনো কর্মকর্তা অফিসে আসছেন না। নিরাপত্তা প্রহরীরা জানান, প্রতিদিন বহু মানুষ অভিযোগ নিয়ে আসছিল অফিসে। এত লোকজন আসার কারণে করোনা ছড়াতে পারে, সে জন্য অফিস আগেই বন্ধ রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ ৩ জুলাই তার হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটি প্রশ্ন পাঠায় নিউজবাংলা। সেগুলো তিনি দেখলেও কোনো জবাব দেননি।
প্রশ্নগুলো হলো
১. ইভ্যালির কাছে কতগুলো প্রতিষ্ঠান টাকা পায়? আপনাদের দেনার পরিমাণ কত?
২. জানা গেছে, আগামী ৬ মাসে আপনারা নতুন ৬টি প্রতিষ্ঠান আনছেন। কতটুকু সত্য?
৩. ইভ্যালির কাছে এখন পর্যন্ত কতজন পণ্য অর্ডার করেছেন?
৪. গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ৩৫০ কোটি টাকা কীভাবে ফেরত দিবে ইভ্যালি?
৫. অনেকে আশঙ্কা করছে, ইভ্যালি গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের শত শত কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে। আসলেই কি তাই?
আরও পড়ুন:
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাতে রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের ঋণ জালিয়াতিসহ ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাংক খাত ‘ধ্বংসের’ অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন সাবেক গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক-বর্তমান ১৯ কর্মকর্তা এবং দুজন ভারতীয় কর্মকর্তার নথি তলব করে ফের চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া এসব বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত জুনে প্রথম দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদারের নথিসহ ২৩ ধরনের নথি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। তবে সে দফায় কাঙ্ক্ষিত তথ্য না মেলায় গত সেপ্টেম্বরে কমিশন তৃতীয়বারের মতো আবার নথি তলব করে।
এই তলবকৃত নথির তালিকায় রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর টেকনিক্যাল দায়িত্বে থাকা দুজন ভারতীয় কর্মকর্তার নথিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এখনও সব নথিপত্র হাতে পায়নি বলে জানিয়েছে দুদক।
জানা গেছে, সম্প্রতি গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তাদের প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট নম্বর, দায়িত্বের পরিধি এবং অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যাদের নাম তালিকায় রয়েছে তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলা, নীতি শিথিলতা এবং অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলছে। দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। রিজার্ভ চুরির সময় গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন ড. আতিউর রহমান, যিনি একই বছরের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন।
এছাড়া সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, আবু হেনা মো. রাজী হাসান, এসএম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, আহমেদ জামাল এবং বিএফআইইউয়ের সাবেক প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসের সম্পর্কেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহার নামও রয়েছে এ তালিকায়।
বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী অফিসের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক (যিনি সম্প্রতি এক মাসের নোটিশে পদত্যাগ করেছেন) এবং আইসিটি বিভাগের দেবদুলাল রায়। আরও আছেন কমন সার্ভিস বিভাগ-২-এর পরিচালক মো. তফাজ্জল হোসেন, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ এবং আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তা মসিউজ্জামান খান ও রাহাত উদ্দিন।
দুদকের চিঠিতে মসিউজ্জামানের নাম দুইবার এসেছে—একবার অতিরিক্ত পরিচালক, আবার উপপরিচালক হিসেবে—যা একই ব্যক্তিকে নির্দেশ করে বলে জানা গেছে।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় নেওয়া দুই কোটি ডলার ফেরত আসে এবং ফিলিপাইন থেকে প্রায় দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এখনো প্রায় ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধারের প্রক্রিয়া ফিলিপাইনের আদালতে চলছে।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও ছাড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকের চারটি বিভাগ—ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট, আইটি, পেমেন্ট সিস্টেম এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং—এই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দুদকের চিঠিতে আরও দুটি ভারতীয় নাগরিকের তথ্য চাওয়া হয়েছে—নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা। নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির আগে ‘সুইফট’ সংযোগ স্থাপনের কাজ করেছিলেন, আর রাকেশ আস্তানা চুরির পর নিরাপত্তা ভেদ সংক্রান্ত তদন্তে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের আমলে।
এদিকে গতকাল সোমবার আলাদা এক অনুসন্ধানে দুদক চট্টগ্রামের বন সংরক্ষক ড. মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে এক দিনেই ৭৭ জন কর্মচারীকে বদলি করার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
গেল ফেব্রুয়ারিতে অভিযান চালিয়ে দুদক রেজাউল করিমের নামে লালমাটিয়ায় ৭ কোটি টাকার দুটি ফ্ল্যাট, ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট এবং সাতক্ষীরার তালা থানায় জমি কেনার প্রাথমিক দুর্নীতির উপাদান খুঁজে পেয়েছিল।
অর্থ আত্মসাৎ, পাচার, অনৈতিক আর্থিক লেনদেন, হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন জায়গায় চারটি প্রতিষ্ঠানে পৃথক এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রোববার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের জনসংযোগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।
দুদক জানায়, মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ এবং এডিপি প্রকল্পের অর্থায়নে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কালভার্ট-সেতু নির্মাণের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বক্তব্য গ্রহণ করা হয় এবং কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডপত্রের আলোকে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়।
অপর অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের নিমিত্তে এনফোর্সমেন্ট টিম মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের ছয়না গ্রামে পাথরিয়া পাড় রাস্তা সংলগ্ন ৯ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কালভার্ট সরেজমিন পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে দেখা যায়, উক্ত কালভার্টটি কেবলমাত্র একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ির যাতায়াতের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পূর্বাঞ্চলের শতকোটি টাকার পুরাতন মালামাল ও স্ক্র্যাপ সংঘবদ্ধ অসাধু চক্রের মাধ্যমে পাচারের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে অভিযোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্রাদি সংগ্রহ করা হয়।
অপরদিকে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা প্রদানে হয়রানি ও নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযান পরিচালনাকালে দেখা যায়, হাসপাতালে রোগীদের সেবা প্রদানে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক উপস্থিত না থাকায় রোগীরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া রোগীদের খাবার সরবরাহে নানাবিধ অনিয়ম এনফোর্সমেন্ট টিমের নিকট পরিলক্ষিত হয়।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে খুলনা ও রাজশাহী নগরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নিমিত্তে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে পৃথক একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে।
সাতক্ষীরার আশাশুনিতে জমি দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজিতে অন্যতম অবস্থানে রুহুল কুদ্দুস ও মিনু বাহিনী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তেলবাজি, দালালি করত বিএনপি নেতা বনে যাওয়া রুহুল কুদ্দুস। চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস ও তার আপন সহোদর আমিনুর রহমান মিনুর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। অভিযোগ আছে, ওই চক্রটির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই বেধড়ক মারপিট, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এমনকি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে থাকে। রুহুল কুদ্দুস ও আমিনুর রহমান মিনু বাহিনীর রয়েছে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি সক্রিয় সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা দুইজন, এদের মধ্যে একজন আশাশুনি আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস এবং অপর ব্যক্তি রুহুল কুদ্দুসের আপন ভাই কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-যোগাযোগ সম্পাদক আমিনুর রহমান মিনু।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে রুহুল কুদ্দুস আমিনুর রহমান মিনু, মমিনুর রহমান মন্টু, খোরশেদ আলম, মফিজুল ইসলাম, শামীম মোস্তফা শুভসহ তাদের সঙ্গপাঙ্গদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষ সহায় সম্বল হারিয়ে এখন নিঃস্ব। আশাশুনি উপজেলার ৯ নং আনুলিয়া ইউনিয়নের মাধ্যম একসরা গ্রামের প্রয়াত আবু দাউদ সানার ছেলে সাদ্দাম সানা বলেন, ‘৫ আগস্টের পরের দিন ৬ আগস্ট রাতে আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস ও তার বাহিনী আমার মৎস্য ঘেরে সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালায়।’ ভুক্তভোগী সাদ্দাম সানা বলেন, ‘রুহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যানের ঘেরের পাশে আমার মৎস্য ঘের। রুহুল কুদ্দুস দাঁড়িয়ে থেকে তার পোষ্য বাহিনী দিয়ে আমার ঘেরের ভেড়ি কেটে দিয়ে দখলে নেয়।’
সাদ্দাম সানা বলেন, রুহুল কুদ্দুস ও তার ভাই আমিনুর রহমান মিনুকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও আমার মৎস্য ঘের ফেরত পাইনি। আমার রেকর্ডীয় ৫ বিঘা ১০ কাঠা জমি অবৈধভাবে ভোগ দখল করছে রহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যান। এ ঘটনায় প্রশাসনের সহযোগিতাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ নাংলা গ্রামের মো. আব্দুল সানার ছেলে আকবর সানা মাঝি বলেন, ৫ আগস্টের পর রুহুল কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর ইন্ধনে তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালায়। এ সময় দোকানের তালা ভেঙে আনুমানিক ৩ লাখ টাকার শ্যালো মেশিনসহ মেশিনের পার্টসের মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। একই সময় আমার ভাই আক্তার সানার দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে আড়াই লাখ টাকার মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়।
আশাশুনি, আনুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ একসরা গ্রামের রোকনুজ্জামান মোল্যা বলেন, ‘আনুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে মান্নান মোল্যা, সুমন মোল্যা, খোরশেদ শিকারীসহ সন্ত্রাসী বাহিনী জোর করে মৎস্য ঘেরে লুটপাট চালিয়ে ৩ লাখ টাকার মাছ ধরে নেয়। ভুক্তভোগী রোকনুজ্জামান মোল্যা জানান, আশাশুনি থানাধীন একসরা মৌজায় জেএল নং-১৪১, সাবেক ৫১ নং, হাল ৬৩, এসএ দাগ ১৫৫৩/১৫৯৫ নং ও আমার ডিসিআর ২২/৮৫, আরএস ২৮৪১, ২৮৪২, ২৮৪৩, ২৮৪৪ ও ২৮৪৫ দাগে আমার ডিসিআরকৃত ০.৮৮ একর এবং রেকর্ডীয় ১.৪২ একর সর্বমোট ২.৩০ একর জমির একটি মৎস্য ঘের ছিল। যা আমি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা করার একপর্যায়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখ সকাল ৯টায় রুহুল কুদ্দুস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমার মৎস্য ঘেরে প্রবেশ করে জোর করে মাছ লুটপাট করে এবং আমার জমি দখলে নেয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী রোকনুজ্জামান মোল্যা গত ২০ এপ্রিল ২৫ তারিখ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার, খুলনা বিভাগের ডিআইজি, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পসহ সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এদিকে ৫ জানুয়ারি ২০২২ সালে আশাশুনি ৯ নং আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন রুহুল কুদ্দুস। তৎকালীন সময় রুহুল কুদ্দুস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে জনসম্মুখে একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণের একটি ভিডিওতে রুহুল কুদ্দুসকে বলতে শোনা যায়, এই নৌকা বঙ্গবন্ধুর নৌকা, এই নৌকা শেখ হাসিনার নৌকা, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতীক নৌকা। এর আগে রুহুল কুদ্দুস ও আমিনুর রহমান মিনু বাহিনীর ভয়াবহ সন্ত্রাসী তাণ্ডবের শিকার হন ভুক্তভোগী আনুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রফি মেম্বারসহ একাধিক ব্যক্তি। ৫ আগস্টের পর রফি মেম্বারের দুটি মৎস্য ঘের লুটপাট ও দখল করার ঘটনায় বিভিন্ন মিডিয়ায় কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উন্মোচন করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কুদ্দুস ও মিনু বাহিনীর সন্ত্রাসীরা রফি মেম্বারকে বেধড়ক মারপিট করে। আশাশুনি উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান, রহুল কুদ্দুস একজন সুবিধাবাদী ব্যক্তি। নিজ স্বার্থ ও চরিতার্থ হাসিলের জন্য সে যা খুশি তাই করে থাকে।
ফোনে আলাপকালে রুহুল কুদ্দুস তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-যোগাযোগ সম্পাদক আমিনুর রহমান মিনু বলেন, এসব ঘটনার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ছবি: বাসস
একজন মানুষকে পৈশাচিকভাবে কতটা নির্মম নির্যাতন করা যায়, তা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন না করলে বিশ্বাস করাটা কঠিন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত পাওয়া গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল (বুধবার) তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। গুম কমিশন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কসহ আমি (চিফ প্রসিকিউটর) বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করেছি এবং বীভৎসতার চিত্র আমরা দেখেছি।
‘সেখানে ইলেক্ট্রনিক শক দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বন্দিদের চোখ বেঁধে রাখা হতো। তিন ফিট বাই তিন ফিট এবং দুই ফিট বাই দুই ফিট অমানবিক সব সেল। একটা মানুষকে পৈশাচিকভাবে কতটা নির্মম নির্যাতন করা যায়, তা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন না করলে মানুষের পক্ষে এগুলো বিশ্বাস করাটাই কঠিন ছিল।’
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্ধতিগতভাবে ভিন্নমত দমন করার জন্য নির্যাতন ও গোপন হত্যাকে যে সংস্কৃতিতে পরিণত করেছিল, সেটি উন্মোচিত হয়েছে উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন,‘যারা এই নির্যাতন বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর সাথে সম্পৃক্ত, আমরা তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে চাই।’
মায়ের সঙ্গে এক মেয়ের বন্দিদশার কথা তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘একটা ১১ বছরের মেয়েকে তার মাসহ তুলে নেওয়া হয়েছিল। মেয়েটির সামনে মাকে হাতকড়া দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। মেয়েটির মা মোটা ছিল বলে হাতকড়া কেটে তার শরীরের মধ্যে বসে গিয়েছিল। ১১ বছরের মেয়েটাকে পাশেই চোখ বেঁধে রাখা হতো। বাথরুম করার সময়ও মেয়েটির মায়ের হাতকড়া খুলে দেওয়া হতো না।
‘১১ বছরের মেয়েসহ একজন নারী রেহাই পায়নি। পুরুষ সদস্যরা নির্যাতন করেছে। এমনকি মেয়েটির মা আজও ফিরে আসেনি। আমরা ধারণা করছি, হয়তো তাকে হত্যা করে তার লাশ কোথাও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ১১ বছরের মেয়েটি কিন্তু চিহ্নিত করতে পেরেছে কোথায় তাদের রাখা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল।’
গোপন বন্দিশালার আলামত নষ্টের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘অনেক আলামত আমরা জব্দ করেছি। তবে আমরা দেখেছি গোপন বন্দিশালা বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর ব্যাপক আলামত নষ্ট করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন:
নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে নির্মাণ করা হয় সিলেট জেলা হাসপাতাল। ছবি: নিউজবাংলা
নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে নির্মাণ করা হয় সিলেট জেলা হাসপাতাল। নাগরিক সমাজের আপত্তি উপেক্ষা করে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ দায়িত্বশীলরা অনেকটা জোর করে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন এই হাসপাতাল।
২৫০ শয্যার এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ ২০২৩ সালে শেষ হলেও এখন এটির দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ।
স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টদের মতামত না নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করায় এই হাসপাতাল ভবনের দায়িত্ব নিতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। ফলে হাসপাতাল কমপ্লেক্স বুঝিয়ে দেয়ার মতো কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে না গণপূর্ত বিভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সিভিল সার্জন অফিসসহ কেউই এর দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। ফলে হাসপাতাল চালু করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। যদিও নির্মাণ কাজের শুরুতে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, এটি চালু হলে ওসমানী হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে। সিলেট অঞ্চলের রোগীরা এখান থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা নিতে পারবেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৬ দশমিক ৯৮ একর জায়গার ওপর এই জেলা হাসপাতাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণপূর্ত অধিদপ্তর হাসপাতালটির অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, ভবন নির্মাণসহ রংকরণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। তবে ভবনে হাসপাতালের কোনো যন্ত্রপাতি আনা হয়নি। এর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনীও দেয়া হয়নি।
নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মওদুদ আহমদ জানান, তাদের কাজ শেষ। তারা ভবনটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে তুলে দিতে প্রস্তুত।
জানা গেছে, হাসপাতাল ভবন নির্মাণ শেষ হলেও ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয় নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা পরিচালনা করবে, সেটি এখনও নির্ধারণ হয়নি। হাসপাতাল হস্তান্তরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ না পাওয়ায় গণপূর্ত বিভাগ এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে।
গণপূর্ত বিভাগ জানায়, ১৫ তলা হাসপাতাল ভবনে আটতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রঙের কাজ, ইলেক্ট্রিক, টাইলস, গ্লাস, দরজা, জানালা লাগানোও সম্পন্ন। হাসপাতাল ভবনের বেসমেন্টে রয়েছে কার পার্কিং; প্রথম তলায় টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুম; দ্বিতীয় তলায় আউটডোর, রিপোর্ট ডেলিভারি ও কনসালট্যান্ট চেম্বার; তৃতীয় তলায় ডায়াগনস্টিক; চতুর্থ তলায় কার্ডিয়াক ও জেনারেল ওটি, আইসিসিইউ, সিসিইউ; পঞ্চম তলায় গাইনি বিভাগ, অপথালমোলজি, অর্থোপেডিক্স ও ইএনটি বিভাগ এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় ওয়ার্ড ও কেবিন। এর মধ্যে আইসিইউ বেড ১৯টি, সিসিইউ বেড ৯টি এবং ৪০টি কেবিন রয়েছে।
জেলা গণপূর্ত অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাফর বলেন, ‘আমরা এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে দেব। বাই মিসটেক এখানে যেহেতু লোকাল অথরিটি পাওয়া যায়নি। সেহেতু আমরা অথরিটি নির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘টেন্ডার সিডিউল, নকশাসহ কাগজপত্র সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগকে দেয়া হয়েছে। প্রতি তলায় ছাদ ঢালাইয়ের সময় তারা এসেছিল। এই হাসপাতালের জমি, ভবন, টাকা- সব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; আমরা শুধু কাজ করে দিচ্ছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে হাসপাতালটি পরিচালনা বা তদারকির কথা ছিল। আমরা মন্ত্রণালয়কে সেভাবেই চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব যখন মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন গণপূর্ত বিভাগ আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। শুনেছি, হাসপাতালের কাজ শেষ। এখন তারা আমাদের গছাতে চাচ্ছে। অথচ এখানে কী আছে না আছে- সেটি আমাদের জানা নেই। তাই এ অবস্থায় আমরা হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে পারি না।
‘কারণ, আমাদের আগের পরিচালক (ডা. হিমাংশু লাল) এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে গেছেন মন্ত্রণালয়ে। তাতে তিনি লিখে যান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অগোচরেই সিলেটে অনেক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। তারা যেন না বুঝে এসব স্থাপনার দায়িত্ব কোনোভাবেই না নেন।’
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘হাসপাতালের স্থাপত্য নকশা, কর্মপরিকল্পনা, সেবা প্রদানের জন্য সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় কক্ষের সুবিন্যাসকরণ ইত্যাদির কাগজপত্র সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পরিচালক অথবা ওসমানী হাসপাতালের পরিচালকের কাছে দাখিল করা হয়নি। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এটি বাসাবাড়ি নয়; আমাকে দায়িত্ব দিয়ে দিল আর নিয়ে নিলাম। এটি একটি হাসপাতাল। এটি নির্মাণে আমাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয়নি।’
হাসপাতালটি নির্মাণের আগে কোনো মতামত নেয়া হয়নি জানিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, ‘এভাবে হুট করে আমরা কোনো হাসপাতালেল দায়িত্ব নিতে পারি না। এই ভভনের অবকাঠামো হাসপাতালের উপযোগী কী না তাও আমাদের জানা নেই।
‘তাছাড়া ওসমানী হাসপাতালের অধীনে আরও কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে। সীমিত জনবল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে এগুলো পরিচলানা করতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। নতুন করে কোনো হাসপাতালের দায়িত্ব নেয়া এখন সম্ভব নয়।’
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেট জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এমন ঠেলাঠেলি বন্ধ হোক। এখানে কারও স্বার্থ বা কোনো কুচক্রী মহল আছে কিনা, সেটি খুঁজে দেখা দরকার। এ প্রকল্প যখন পাস হয়, তখনই বলে দেয়া হয়েছে কারা পরিচালনা করবে। নির্মাণের পর কেউ দায় নিতে না চাওয়া অন্য অর্থ বহন করে।’
খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম। ছবি: সংগৃহীত
পদোন্নতি পাওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা তার ছিল না। অবৈধ উপায়ে পদ বাগিয়ে দফায় দফায় শুরু করেন নানামুখী দুর্নীতি। বিগত কয়েক বছর ধরেই খেয়াল-খুশিমতো বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন। পদে পদে তার স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছেন জেলার প্রাথমিক শিক্ষকরা।
আলোচ্য ব্যক্তিটি হলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিজ জেলাতেই ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে অবস্থান করা খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম।
১৯৯৭ সালের ২৮ এপ্রিল উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন শেখ অহিদুল আলম। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পান তিনি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদ থেকে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য ১৯৮৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক গেজেটে কিছু যোগ্যতার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ওই গেজেটের ৩২ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর বিএড ডইগ্র অথবা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রি থাকতে হবে।
খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে চলতি বছরের আগস্ট মাসে শেখ অহিদুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. মোসলেম উদ্দিন।
তদন্তকালে শেখ অহিদুল আলম চাহিদা অনুযায়ী বিএড সার্টিফিকেট দিতে পারেননি। তার বদলে ২০০২ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) থেকে পাস করা এমএড সার্টিফিকেট দাখিল করেন।
তবে বিএড ও এমএড ডিগ্রি সমমান নয় বলে জানিয়েছেন বাউবির অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. মোহসীন উদ্দিন। গত ২৮ আগস্ট তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, বিএড ডিগ্রির বিকল্প হিসেবে এমএড ডিগ্রিকে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।
বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে গত ২০ অক্টোবর বাউবির ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. হাবিবুল্যাহ মাহমুদ তদন্ত কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বিএড ডিগ্রি অর্জনের জন্য শ্রেণীকক্ষে ৯০টি অনুশীলনী পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের দক্ষতা, শিক্ষার্থী মূল্যয়নের দক্ষতা, শ্রেণী ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের ধারণা অর্জনের ব্যবস্থা নেয়া হয়।
একইসঙ্গে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের প্রাক-যোগ্যতা অর্জনের জন্য পরিসংখ্যানগত ধারণা, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা দর্শনের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের কিছু বিষয় যুক্ত থাকে। কিন্তু এমএড ডিগ্রি প্রোগ্রামে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান-সংশ্লিষ্ট দক্ষতা অর্জনের কোনো সুযোগ নেই।
তবে বিএড ডিগ্রি নেই এরূপ শিক্ষার্থীদের এক সেমিস্টার পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক চারটি কোর্স সম্পন্ন করে এমএড ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ ২০০০ সালে এমএড শিক্ষাক্রমে ছিল। এজন্য এমএড প্রোগ্রামকে বিএড-এর বিকল্প বিবেচনার সুযোগ নেই।
এছাড়া ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৫৮ জন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিএড বা ডিপ্লোপা ইন এডুকেশন ডিগ্রি না থাকায় তাদের পদোন্নতি দেয়নি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তদন্তের সত্যতা জানিয়ে মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমি গত ২৪ অক্টোবর অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) চলে এসেছি। তাই তদন্তের সব কাজ শেষ করে আসতে পারিনি। বাকি কাজটুকু বর্তমান উপ-পরিচালক সম্পন্ন করবেন।’
তবে খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো মানতে নারাজ। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এমএড ডিগ্রি থাকলে বিএড আছে কিনা এটা কোনো বিষয় না। আমাদের ব্যাচে ১৩৭ জনের একযোগে পদোন্নতি হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে দেখেন সেখানে কতজনের বিএড ছিল না। আমার বিএড-এর থেকেও উচ্চতর এমএড ডিগ্রি তো আছেই। তাই আমার পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।’
শিক্ষক বদলিতে স্বেচ্ছাচারিতা
শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল একযোগে ১৭ জন শিক্ষকে বদলি করেন। তবে পরবর্তীতে অনলাইনে শিক্ষকরা দেখতে পান যে তাদের বদলি আদেশে আন্তঃজেলা বদলির নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর আবেদন করেন। একইসঙ্গে খোদ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ওই শিক্ষকদের বদলির আদেশ বাতিলের জন্য আবেদন করেন। পরবর্তীতে তিনি নামমাত্র একটি সুপারিশ কমিটি করে তাদের বদলি বহাল রাখেন।
৩ জুন অধিদপ্তর বরাবর পাঠানো চিঠিতে অহিদুল আলম উল্লেখ করেন, যেহেতু অনলাইনে তাদের বদলির আদেশ অনুমোদন হয়ে গেছে, তাই এই আদেশ বহাল রাখা যায়।
ওইসব শিক্ষক জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ জারিকৃত পত্রে চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধান শিক্ষকদের বদলিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ১৭ জনের মধ্যে চারজন প্রধান শিক্ষককেও বদলি করা হয়েছিল। এটা তিনি করেছিলেন পছন্দের ব্যক্তিদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বানানোর জন্য।
প্রতিবাদ করলেই শাস্তি
এই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যারা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের একজন বটিয়াঘাটা উপজেলার বারোভূঁইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষক নীহার রঞ্জন রায়।
তিনি জানান, ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর পিআরএল-এ যাওয়ার দিন তাকে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে লঘুদণ্ড দিয়ে বেতনের এক ধাপ অবনমিত করা হয়। এর বিরুদ্ধে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষা কর্মকর্তা অহিদুল আলমের সঙ্গে মতের মিল না হলেই বিপদে পড়তে হয়। তিনি ২০১২ সালে এক মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়ে ২৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন।
একই জেলায় ১৪ বছর
শেখ অহিদুল আলম ইতোপূর্বে খুলনা সদর থানার শিক্ষা অফিসার পদে তিন বছর, খুলনা বিভাগীয় অফিসে ছয় বছর ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে তিন বছর কর্মরত ছিলনে।
২০২৩ সালের ২০ জুন আবারও খুলনাতে তার বদলি হয়। সে সুবাদে তিনি খুলনাতেই প্রায় ১৪ বছর কর্মরত রয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনাতেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডাটাবেইজের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, শেখ অহিদুল আলমের স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার নলডাঙ্গা গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। তবে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া গেছে খুলনা সিটি করপোরেশনের দৌলতপুরের কালিবাড়িতে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ অহিদুল আলম খুলনার বিএল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তার শ্বশুরবাড়ি দৌলতপুরের কালিবাড়িতে। দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। স্থানীয় সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে আঁতাত করেই তিনি দীর্ঘদিন খুলনায় থাকার সুযোগ পেয়েছেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে শেখ অহিদুল আলম বলেন, ‘একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা নানারকম ষড়যন্ত্র করছে।’
আরও পড়ুন:
অভিযুক্ত ফাহিমা আক্তার ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় কর্মরত। ছবি: নিউজবাংলা
কিশোরগঞ্জে বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
প্রকল্পগুলোর প্রদর্শনী নামমাত্র বাস্তবায়ন, কোথাও আবার বাস্তবায়ন না করেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, পুরো উপজেলায় বেশির ভাগ প্রদর্শনীতে মোট বরাদ্দের ৩০ শতাংশও কৃষক পাননি।
অভিযুক্ত কর্মকর্তার নাম ফাহিমা আক্তার, যিনি ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে সদর উপজেলায় কর্মরত।
এর আগে একই উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা পদে ছিলেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ছয়টি প্রকল্প থেকে (ফ্রিপ প্রকল্প, ময়মনসিংহ প্রকল্প, পার্টনার, অনাবাদি, রাজস্ব প্রকল্প ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী) কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেন ফাহিমা।
ফ্রিপ প্রকল্প
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ফ্রিপ প্রকল্পে বিভিন্ন ফসলের মোট ৫০৯টি প্রদর্শনী ও কৃষক প্রশিক্ষণ বাবদ ১ কোটি ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে।
এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা। যেগুলো করেছেন, সেগুলোও নামমাত্র বাস্তবায়ন দেখানো হলেও কৃষকরা তার সুফল পাননি।
ফ্রিপ প্রকল্পের রোপা আমন ধানের প্রদর্শনী করেন কাটাবাড়িয়া এলাকার কৃষক খোকন মিয়া। পাঁচ কেজি বীজ, ১৫ কেজি ডিএপি, ২০ কেজি ইউরিয়া সার আর কিছু কীটনাশক পেয়েছেন তিনি। তার পাওয়া উপকরণের বাজার মূল্য সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ তার অনূকূলে বরাদ্দ ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তার অনূকূলে মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ উপকরণ পেয়েছেন খোকন।
হাজিরগল গ্রামের কৃষক মুখলেছ, কাদির, হাসেম ও আতাউর মিলে ৫ একর জমিতে করেন ফ্রিপ প্রকল্পের বীজ গ্রাম প্রদর্শনী।
৪০ কেজি বীজ, পাঁচ বস্তা ইউরিয়া, চার বস্তা পটাশ, তিন বস্তা ডিএপি ও ১০ বস্তা জৈব সার পেয়েছেন এসব কৃষক, যার বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। অথচ তাদের অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয় দেড় লাখ টাকা। তারা তাদের মোট বরাদ্দের ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ উপকরণ পেয়েছেন।
খোকন, মুখলেছদের মতো এমন শত শত কৃষককে এভাবেই নামেমাত্র উপকরণ দিয়ে প্রদর্শনী বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার।
তার অভিযোগ, ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ফ্রিপ প্রকল্পে কৃষকের ৯৯টি গ্রুপ গঠনের জন্য চার লাখ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে।
প্রতিটি গ্রুপের অনূকূলে পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা দেড় হাজার করে টাকা পান বলে জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, শুধু গ্রুপ গঠন থেকেই আত্মসাৎ করা হয়েছে তিন লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
ময়মনসিংহ প্রকল্প
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পেও ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমার বিরুদ্ধে।
২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একটি মডেল গ্রামের জন্য ২ লাখ ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। এরপর ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি মডেল গ্রামের জন্য বরাদ্দ আসে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
এ দুটি প্রদর্শনীতে বরাদ্দের ৪ লাখ ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করে কৃষি কর্মকর্তা একটিও বাস্তবায়ন করেননি বলে অভিযোগ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার।
পাঁচধা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান। পার্টনার প্রকল্পের কমিউনিটি বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি প্রদর্শনী, ময়মনসিংহ প্রকল্পের ভার্মি কম্পোস্ট, অনাবাদি প্রকল্পের পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী রয়েছে তার বাড়িতে। আবার ময়মনসিংহ প্রকল্পের মডেল গ্রাম প্রদর্শনীর বরাদ্দ দেখানো হয়েছে তার নামে।
সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে মডেল গ্রামের কোনো সাইনবোর্ড বা অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। তার দাবি, মডেল গ্রামের বরাদ্দটি তিনি পেয়েছেন, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অসুস্থতার কারণে করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শুরু করবেন।
সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়িতে থাকা অন্য প্রদর্শনীর সাইনবোর্ড সরানোর চেষ্টাও করেন এ কৃষক।
ময়মনসিংহ প্রকল্পের লতিকচু প্রদর্শনী করেছিলেন বেত্রাটী গ্রামের মিলন ভূঁইয়া। তার অনূকূলে ৩৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও এই প্রদর্শনীতে ১০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি পটাশ, এক বস্তা ডিএপি সার ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। মিলন যা পেয়েছেন তার বাজারমূল্য আনুমানিক ১ হাজার ২৪০ টাকা। মিলনের নামে প্রদর্শনীর সাইনবোর্ডটি আবার পাওয়া গেছে হৃদয় নামে আরেক লতিকচু চাষির বাড়িতে।
হৃদয়ের বাবা আবদুল হেকিম জানান, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাদের এই সাইনবোর্ডটি দিয়ে ছবি তুলেছেন।
এ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা আক্তারের দাবি, মিলনকে কোনো প্রদর্শনী দেয়া হয়নি।
সদর উপজেলার বাগপাড়া এলাকায় রফিকুল ইসলাম সৈয়দও করেছিলেন লতিকচুর প্রদর্শনী। ইউরিয়া, পটাশ, ডিএপি জাতের ৪০ কেজি সার আর ২ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়া আর কিছুই পাননি তিনি। অথচ তার অনূকূলে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার টাকা। বরাদ্দের ১০ শতাংশও পাননি এ কৃষক।
ময়মনসিংহ প্রকল্পের হলুদের প্রদর্শনী করেছিলেন কাশোরারচর এলাকার বাবলু মিয়া। তার অনূকূলে ২৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও তিনি পান বীজ কেনার জন্য ৪ হাজার টাকা, এক বস্তা জৈব সার, ১০ কেজি ইউরিয়া আর ১০ কেজি পটাশ।
৫০০ বস্তায় আদা চাষ প্রদর্শনী করেন সদর উপজেলার আগপাড়া এলাকার এমদাদুল হক রুবেল। কৃষি অফিস থেকে ২০ কেজি পটাশ, ২০ কেজি ডিএপি, ১৫ কেজি আদা আর ৩৫০টি বস্তা ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। অথচ এ কৃষকের অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৪৪ হাজার টাকা।
এ কৃষক বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যেগুলো করেছেন, সেগুলোতে সুফল পেলেও বিপাকে পড়েন প্রদর্শনী করে।
ফাহিমাঘনিষ্ঠ আবুল হাসেমের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ
২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর একটি কমিউনিটি বেজড ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপনের জন্য বরাদ্দ আসে ৭০ হাজার টাকা। সেটি বরাদ্দ দেয়া হয় কৃষি কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবুল হাসেমের শ্বশুরবাড়িতে।
এ আবুল হাসেম কৃষি কর্মকর্তার সব অনিয়মের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে অভিযোগ এক কর্মকর্তার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের ওই কর্মকর্তা জানান, অফিসে উচ্চমান সহকারী থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ আর্থিক ফাইল করেন আবুল হাসেম, যেটার কোনো বিধান নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিউনিটি বেজড ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপনের বিষয়টি স্বীকার করেন আবুল হাসেম।
অনিয়ম ও আর্থিক ফাইল করার বিষয়টি অস্বীকার করে দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে মিথ্যা হিসেবে আখ্যা দেন তিনি।
অনাবাদি প্রকল্প
অনাবাদি প্রকল্পে আরও বেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমার বিরুদ্ধে।
এ প্রকল্পের পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী করেছেন কাটাবাড়িয়া এলাকার আছমা খাতুন। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন জাতের সবজির বীজ আর একটি সাধারণ নেট ছাড়া তেমন কিছুই পাননি তিনি। তার দাবি, সব মিলিয়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকার মতো উপকরণ পেয়েছেন।
এ কিষাণীর অভিযোগ, বাগানে পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে বারবার কীটনাশক চেয়েও পাননি তিনি। আছমার প্রাপ্ত উপকরণের বাজারমূল্য মোট বরাদ্দের ২৫ শতাংশ।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় অনাবাদি প্রকল্পের মোট ৯৩২টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ আসে ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে পারিবারিক পুষ্টি বাগান ৪১৯টি আর পুষ্টি বাগান পুনঃস্থাপন ৫১৩টি।
উপ-সহকারী এক কৃষি কর্মকর্তার অভিযোগ, এসব প্রদর্শনীতে আছমা খাতুনের মতো শত শত কৃষক/কিষাণীকে নামমাত্র উপকরণ দিয়ে বাস্তবায়ন করেন ফাহিমা।
পার্টনার প্রকল্প
চলতি বছরের ২৮ ফ্রেব্রুয়ারিতে আটটি এবং ৩ এপ্রিলে সাতটি (মোট ১৫) পার্টনার ফিল্ড স্কুলের জন্য ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে।
উপ-সহকারী এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, যেখানে কৃষকদের নাশতার জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ টাকা, সেখান থেকে নামেমাত্র বিস্কুট আর পানি খাইয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী
২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনীর জন্য ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। বছরের শুরুতে বরাদ্দ আসলেও কাজ শুরুই করেন অক্টোবর শেষ সাপ্তাহে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত প্রকল্পটিও আত্মসাৎ করার পাঁয়তারা করেছিলেন কৃষি কর্মকর্তা। পরে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বাস্তবায়ন শুরু করেন তিনি।
শহরের তারাপাশা এলাকার বাসিন্দা মারিয়াতুল কিপতিয়া পাপিয়া। বিগত তিন বছর ধরে নিজ উদ্যোগে মাশরুম উৎপাদন করছেন তিনি। অক্টোবরের শেষ দিকে কৃষি অফিস থেকে স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী বরাদ্দ পান তিনি। ২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি আসা প্রকল্পটির বরাদ্দ ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা হলেও এ কিষাণী পান আড়াই লাখ টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবেমাত্র ঘর নির্মাণকাজ শুরু করেছেন তিনি।
অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্য
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমা আক্তারের দাবি, দুটি মডেল গ্রাম বাস্তবায়ন করেছেন, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কৃষকের অসুস্থতার জন্য খানিকটা বিলম্ব হয়েছে।
বাস্তবায়িত মডেল গ্রামে সাইনবোর্ড আছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে।’
যদিও কৃষক জানিয়েছেন, তিনি এখনও সাইনবোর্ড পাননি।
মাশরুমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি চলমান প্রক্রিয়া। বাস্তবায়নে কোনো অনিয়ম হয়নি।’
তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও অভিযোগ পেয়েছেন। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য